হঠাৎ বাধা পড়ল। যে লোকটি প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে আটশো ডলারের বিনিময়ে বাককে কিনে নিতে চেয়েছিল, সে এগিয়ে এসে থর্নটনকে বলল, আমি বারোশো ডলার দিতে প্রস্তুত, কুকুরটা আমাকে দাও।
মাথা নেড়ে থর্নটন বলল, আমি বরং দাসব্যবসায়ীর কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেব। কিন্তু এই কুকুরটা আমি বিক্রি করব না। দয়া করে আমাকের বারবার বিরক্ত করো না।
পূর্বোক্ত ঘটনার পরেই সমগ্র উত্তরাঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে গেল থর্নটনের কুকুর- বাক!
.
২২. বনবাসী বন্ধু
আশেপাশে দাঁড়ানো আরও অনেক দর্শক বাক-এর বিরুদ্ধে বাজি ফেলেছিল– প্রথমেই হাজার ডলার বাজি ফেলেছিল ম্যাথসন পরে তার পক্ষে ও থর্নটনের বিপক্ষে বাজি পড়েছিল আরও ছয়শো ডলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওই ষোলোশো ডলার জিতে নিল বাক! নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে হঠাৎ ধনী হয়ে গেল জন থর্নটন!
থর্নটন, পিট ও হানস স্থির করল আর মালবহন নয়। এবার সোনার সন্ধানে যাত্রা করবে তারা। টাকার অভাব ছিল না, চটপট কিনে ফেলা হল ছয়টি নতুন কুকুর আর প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম– তারপর মহা-উৎসাহে তারা স্লেজ চার্লিয়ে যাত্রা করল সোনার সন্ধানে।
তাড়াহুড়ো করে নয়। খুব ধীরে ধীরে তারা অগ্রসর হল। তারা স্লেজটাকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করেনি, স্লেজে ছিল সোনা খোঁজার জন্য নিতান্ত দরকারি কিছু যন্ত্র ও অস্ত্রশস্ত্র। খাদ্যের জন্য তারা শিকার করত অথবা নদীর জল থেকে মাছ ধরতে সচেষ্ট হত। সবসময় যে তাদের চেষ্টা সফল হত তা নয়; বনের পশু বা নদীর মাছ যখন বন্দুক অথবা ছিপের মুখে আত্মসমর্পণ করত না, তখন কুকুরের দল ও তাদের প্রভুদের উপবাসী থাকতে হত- ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে প্রচুর মৎস্য ও মাংসে ক্ষুধা নিবারণ করত তারা। এই জীবন ছিল বাক-এর কাছে দারুণ আনন্দের মাঝে মাঝে উপবাসী থাকলেও একঘেয়ে স্লেজবাহকের জীবনযাত্রার চাইতে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ছিল তার কাছে অনেক বেশি আকর্ষক, অনেক বেশি আনন্দদায়ক।
অবশেষে একসময়ে একটি পার্বত্য নদীর জলধারার মধ্যে তারা সোনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করল। ছোটো ছেটো পাত্র নিয়ে নদী থেকে প্রতিদিন তারা সে জল তুলে আনত, সেই জল থেকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিদিনই তারা সংগ্রহ করত হাজার হাজার ডলারের সোনা। চামড়ার থলেগুলো সোনা-ভর্তি করে জ্বালানি কাঠের মতোই একজায়গায় ফেলে রাখা হত। ক্রমে ক্রমে ওই সোনা-ভরতি থলের স্তূপ একদিন উচ্চতায় বাক-কে ছাড়িয়ে গেল।
দু-এক সময়ে খাদ্যসংগ্রহের তাগিদে থর্নটন যখন শিকারে যেত, তখন বাক হত তার সঙ্গী। কিন্তু শিকার অভিযানের ওই সময়টুকু ছাড়া বাক-এর কিছু করার ছিল না। অধিকাংশ সময়েই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে সুদূর অতীতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত বাক– একটি রোমশ মানুষ গাছের উপর বিশ্রামরত, আর সেই গাছের তলায় অতন্দ্র প্রহরায় জাগছে একটি জন্তু ওই জন্তুটি কি বাক? বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে-আসা পূর্বজন্মের স্মৃতি কি তাকে চঞ্চল করে তোলে মাঝে মাঝে?… হঠাৎ ভেসে আসত দূর-দূরান্ত থেকে জান্তব কণ্ঠের বিষণ্ণ সংগীত– নেকড়ের চিৎকার! সেই বিষঃ জান্তব কণ্ঠস্বর যেন তাকেই আহ্বান করছে! শব্দ লক্ষ্য করে বাক ছুটত, কিন্তু কোনোদিনই শব্দের উৎস যার কণ্ঠে, তাকে খুঁজে পেত না…।
এক রাতে গভীর নিদ্রার মধ্যেই সেই তীব্র করুণ শব্দ শুনতে পেল বাক, সঙ্গেসঙ্গে ঘুম ভেঙে উঠে বসল সে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে অরণ্যের বুকে, তারই ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাক- ঝোপের আড়াল থেকে সে দেখতে পেল একটি কৃশকায় নেকড়ে, পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে, তার মুখ উঁচু হয়ে আছে আকাশের দিকে!
ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল বাক। তাকে দেখেই ছুটে পালাল নেকড়ে। পিছনে ছুটল বাক। একসময়ে নেকড়ে ঘুরে দাঁড়াল, হিংস্র দন্ত বিকাশ করে জানিয়ে দিল যুদ্ধের জন্য সে প্রস্তুত। বাক আক্রমণ করল না। সে নেকড়ের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বন্ধুত্ব জানানোর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করল। নেকড়ে কিন্তু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বাককে লক্ষ করছিল, সহজে সে বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি। অবশেষে বাক-এর ভাবভঙ্গিতে আশ্বস্ত হল নেকড়ে, সে বাককে কাছে এগিয়ে আসতে দিল– গৃহপালিত কুকুর ও বনবাসী নেকড়ে পরস্পরের নাকে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ গ্রহণ করল অর্থাৎ পশুজগতের নিয়ম অনুসারে তারা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল।
নেকড়ে আর বাক কিছুক্ষণ খেলা করার পর হঠাৎ খেলা ফেলে নেকড়ে ছুটতে শুরু করল। তার আচরণে সে বুঝিয়ে দিল বাক তার সঙ্গী হলে সে খুশি হবে। নেকড়ের সঙ্গ নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাক-এর মনে হল এইভাবে সে আগেও ছুটেছে। নেকড়ের ছোটার ভঙ্গিতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে সে যাচ্ছে। বাক ভাবল ওই নির্দিষ্ট স্থান থেকেই বোধহয় দূরাগত আহ্বান তার কানে এসেছে বারংবার ওই আহ্বান বন্য প্রকৃতির আহ্বান, অরণ্যের আহ্বান!
একটি ছোটো জলাধারের পাশে এসে থামল তারা, সেইখানে তৃষ্ণা নিবারণ করল আর হঠাৎ তখনই বাক-এর মনে পড়ল তার প্রভু থর্নটনের কথা সে বসে পড়ল। নেকড়ে আবার ছুটতে শুরু করল, কিন্তু এইবার বাক তাকে অনুসরণ করতে রাজি হল না। নতুন বন্ধুর এই হঠাৎ পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে গেল নেকড়ে, সে বারবার বাক-এর কাছে এসে মৃদু শব্দে তার সঙ্গ নিতে অনুরোধ জানাল– তবু বাক ফিরল না। অবশেষে পিছনের দুই পায়ের উপর বসে পড়ল নেকড়ে, আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে উঠল তীব্র তীক্ষ্ণ করুণ স্বরে। বাক তার আস্তানার দিকে ছুটতে ছুটতে শুনতে পেল সেই বিষঃ শব্দের ঝংকার ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে এবং একসময়ে সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে গেল সম্পূর্ণভাবে…