তৎক্ষণাৎ শুরু হল বিচার জনতার আদালতে। কুকুরের পক্ষে মানুষকে আক্রমণ করা গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হয়। আদালতের বিচারে বাক নিরপরাধ সাব্যস্ত হল- সে যা করেছে, ঠিক করেছে! এক মুহূর্তের মধ্যে নগণ্য অবস্থা থেকে বাক হয়ে গেল হিরো!
উত্তরাঞ্চলের মানুষ কুকুর ভালোবাসে। কুকুর তাদের প্রিয় আলোচ্য বিষয়। প্রভুর পক্ষ নিয়ে বার্টনের উপর বাক-এর আক্রমণজনিত ঘটনা তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিয়েছিল। অনেক সময় জন থর্নটন বাককে সমর্থন করতে বাধ্য হত তার নিজস্ব সম্মানরক্ষার তাগিদে।
একদিন কুকুর নিয়ে আলোচনা করতে করতে এক ব্যক্তি জানাল তার কুকুর পাঁচশো পাউন্ড ওজনের জিনিসপত্র-বোঝাই স্লেজ টানতে পারে। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানাল তার কুকুর টানতে পারে ছয়-শো পাউন্ড। তৃতীয় ব্যক্তি সগর্বে ঘোষণা করল তার কুকুরটি অনায়াসে সাত-শো পাউন্ড টানতে সমর্থ। তারপর তিনজনই ফিরে তাকাল থর্নটনের দিকে, অর্থাৎ তারা জানতে চায় থর্নটনের কুকুরের ক্ষমতার বহর কতটা।
লোক তিনটির কথা আর তাকানোর ভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জ ছিল স্পষ্ট। দারুণ উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত করে থর্নটন বলে উঠল, ওইসব ওজন ধার্তব্যই নয়। আমার বাক হাজার পাউন্ড নিয়ে চলতে পারে।
শ্রোতাদের দৃষ্টিতে ফুটল অবিশ্বাস, একজন বলল, কী বলছ তুমি? বরফে জমে থাকা স্লেজের রানার টেনে হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে চলতে পারবে তোমার কুকুর?
থর্নটন দৃঢ়ভাবে জানাল তার কুকুর ওই কাজ করতে সমর্থ।
ঠিক আছে, ম্যাথসন নামে যে লোকটি জানিয়েছিল তার কুকুর সাতশো পাউন্ড টানতে পারে, সে বলল, আমার কাছে হাজার ডলার আছে। এই হাজার ডলার বাজি রেখে আমি বলছি তোমার কুকুর হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে চলতে পারবে না।
সোনার গুঁড়োতে ভর্তি একটা চামড়ার থলি সশব্দে টেবিলের উপর রাখল ম্যাথসন।
বিপদে পড়ল থর্নটন। মাল বহন করতে সে বাককে দেখেনি কখনো, তাই বাক-এর বহন ক্ষমতা সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। থর্নটন আর তার দুই অংশীদারের সম্বল মাত্র দু-শো ডলার। হাজার ডলারের বাজিতে টক্কর দিতে হলে তাদের কাছেও হাজার ডলার থাকা দরকার এখন উপায়? একেবারে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হওয়ার উপক্রম হল যে!
উপায় হয়ে গেল। কাছেই দাঁড়িয়েছিল থর্নটনের বন্ধু জিম ওব্রায়েন। সে অতিশয় সদাশয় ধনী ব্যক্তি, থর্নটনকে হাজার ডলার ঋণ দিতে সে রাজি হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।
মৃদু হেসে ম্যাথসন বলল, বাইরে আমার কিছু ময়দা আছে। বিশ থলে ভরতি ময়দা। প্রতি থলের ওজন পঞ্চাশ পাউন্ড। এবার বাইরে গিয়ে দেখব তোমার আশ্চর্য কুকুর হাজার পাউন্ডের থলেগুলো কেমন টানতে পারে।
সমবেত জনতার কৌতূহল এখন তুঙ্গে। একটা কুকুর হাজার পাউন্ড টেনে ছুটতে পারে এমন কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
বহু মানুষের চোখের সামনে এবার বাককে নিয়ে আসা হল। ময়দা-ভরতি থলেগুলো টানার জন্য যে দশটি কুকুরকে স্লেজের সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়েছিল, তাদের বাঁধন খুলে দিয়ে সেখানে দশের পরিবর্তে একটিমাত্র কুকুরকে যুক্ত করা হল– বাক!
তার উজ্জ্বল রোমশ দেহের পেশীপুষ্ট সৌষ্ঠব দর্শকদের বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটি লোক জানাল এখনই আটশো ডলার দিয়ে সে বাককে কিনে নিতে ইচ্ছুক প্রতিযোগিতায় বাক হারল কি জিতল তা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না।
থর্নটন লোকটির কথার জবাব দিল না। হাত নেড়ে তাকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে সে হাঁটু পেতে বসল বাক-এর পাশে, দুই হাতে তার মাথাটা ধরে মুখের উপর নিজের গাল চেপে ধরে থটন বলল, টানো বাক। যদি আমায় ভালোবাসো, তাহলে সমস্ত শক্তি দিয়ে টানো।
উত্তরে থর্নটনের হাত কামড়ে ধরল বাক। তার ভীষণ ধারাল দাঁতগুলো রেশমের মতো হালকাভাবে স্পর্শ করল রক্ত বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা, হাতের উপর একটা আঁচড় পর্যন্ত পড়ল না। নিজস্ব ভাষায় নীরব থেকেই বাক জানিয়ে দিল সে প্রভুকে ভালোবাসে, তার আদেশ পালন করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পিছিয়ে এসে এবার থর্নটন আদেশ দিল, চালাও!
বাক সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ডানদিকে ফিরল, স্লেজের উপর ময়দা থলেগুলো কেঁপে উঠল ঝাঁকুনির বেগে এবং স্লেজের তলেদেশে অবস্থিত রানারের তলা থেকে বরফ ভেঙে পড়ার শব্দ ভেসে এল।
হা! আবার হুকুম দিল থর্নটন। আগের মতোই শরীরটাকে চালনা করল বাক- এইবার বাঁদিকে। বরফ ভাঙার মৃদু শব্দ এবার আরও জোরে বেজে উঠল। রানার দুটিও হড়কে সরে এল বাক-এর প্রবল আকর্ষণে স্লেজের রানার এখন বরফের কঠিন আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়েছে!
এইবার এল শেষ নির্দেশ মাশ!
সামনে ঝুঁকে পড়ল বাক লাগামে টান পড়ে সেটা শক্ত হয়ে এঁটে বসল বাক-এর শরীরে। তার প্রকাণ্ড বুক নেমে এল মাটির দিকে, মাথা উঠল উর্ধ্বে এবং নখের আঁচড়ে জমাট তুষার উড়তে লাগল চারদিকে।
অচল স্লেজ সচল হল! হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে সেটা খুব ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আধা ইঞ্চি… এক ইঞ্চি… দুই ইঞ্চি… প্রতি ঝাঁকুনির সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে চলল স্লেজ… গতি আরও বাড়ল… এখন আর ঝাঁকুনি দিচ্ছে না বাক, স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলেছে সে, তার পিছনে লাগামে বদ্ধ স্লেজও এগিয়ে চলেছে সহজভাবে স্বচ্ছন্দ গতিতে।
অনেকগুলো কাটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে একশো গজ দুরের সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছিল, অনায়াসে সেই সীমা পার হয়ে গেল বাক! দণ্ডায়মান জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে বাককে অভিনন্দন জানাল, শুন্যে উড়তে লাগল টুপি আর দস্তানা! থর্নটন নিচু হয়ে বাক-এর গলা জড়িয়ে আদর জানাতে লাগল, আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর, ওরে বাক, ওরে হতভাগা, ওরে শয়তান জানোয়ার!