ধীরে ধীরে আবার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পেল বাক। ফ্যাকাশে চামড়া আবার উজ্জ্বল হল, যেখানে হাড় দেখা যাচ্ছিল সেখানে দেখা দিল সাবলীল পেশীর তরঙ্গ।
জন থর্নটনের তাঁবুতে এসে আরও দুটি কুকুরের সঙ্গে পরিচিত হল বাক স্কীট ও নিগ। নিগ হচ্ছে ছোটোখাটো চেহারার আইরিশ সেটার, আর নিগ নামক কুকুরটি ব্লাড হাউন্ড ও ডিয়ার হাউন্ড নামক দুই বিভিন্ন জাতীয় কুকুরের সংমিশ্রণে তৈরি এক অতিকায় জীব। বিপুল দেহ এবং প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হলেও নিগ ছিল খুব শান্তশিষ্ট, বাককে সে সহজেই বন্ধু হিসাবে মেনে নিল। স্কীট ছিল মেয়ে কুকুর, জননীর স্নেহে সে গ্রহণ করল বাককে, তার আহত ক্ষতস্থানগুলিকে সে চেটে চেটে পরিচর্যা করতে লাগল। কয়েকদিনের মধ্যে স্কীট-এর জান্তব চিকিৎসার ফল পাওয়া গেল, সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করল বাক।
বাক অবাক হয়ে দেখল থর্নটন তার কুকুরদের সঙ্গে ছেলেমানুষের মতো ছুটোছুটি করে এবং নিত্য-নতুন খেলা আবিষ্কার করে চমকে দেয় সবাইকে। বিচারক মিলারকেও বাক পছন্দ করত বটে, কিন্তু থর্নটনের স্নেহ-ভালোবাসা তাকে অভিভূত করে ফেলল, এমন তীব্র আবেগ ও আকর্ষণ ইতিপূর্বে কারও জন্যেই অনুভব করেনি বাক, বোধহয় এমন একজন প্রভুর জন্যই এতদিন অপেক্ষা করছিল সে।
অবশেষে থর্নটন যাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তারা এসে উপস্থিত হল- হানস ও পিট, জন থর্নটনের দুই অংশীদার। স্কীট আর নিগ যেভাবে থর্নটনের হাতের তলায় মাথা গলিয়ে আদর পেতে চাইত, ঠিক সেইভাবেইনবাগতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল তারা। তাদের আশা অবশ্য অপূর্ণ থাকেনি। থর্নটনের মতোই কুকুর দুটিকে আদর করত হানস আর পিট। কিন্তু বাক নতুন মানুষদের কাছে ভিড়ল না। সে বুঝেছিল এই মানুষ দুটি তার মনিবের বন্ধু, তাই তাদের সান্নিধ্য সে সহ্য করত– কিন্তু তার সমস্ত অনুরাগ ও ভালোবাসা ছিল থর্নটনের জন্য। সে প্রভর কাছে আদর পেতে চাইত না, থর্নটনের পাশে চুপচাপ বসে তার মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রভুর মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করত। সেই নিমেষহীন দৃষ্টি আকর্ষণে থর্নটন মুখ ফিরিয়ে চাইত, কয়েক মুহূর্তের জন্য তাদের দৃষ্টি বিনিময় ঘটত এবং চোখে চোখে ফুটত পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা…
হ্যাঁ, সুখী হয়েছিল, খুব সুখী হয়েছিল বাক থর্নটনের কাছে এসে, তবু রক্ত-জমানো ঠান্ডায় অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে অগ্নিশিখার চঞ্চল নৃত্যের মধ্যে বাক যেন প্রত্যক্ষ করত তার পূর্বপুরুষদের তাকে যেন আহ্বান করে আদিম অরণ্য। যেখানে ঘুরে বেড়ায় নেকড়ের মতো হিংস্র বুনো কুকুরের দল… বহু যুগের ওপার হতে সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের আদিম অরণ্য যেন তাকে টানতে থাকে অমোঘ আকর্ষণে…
.
২১. বিখ্যাত হল বাক
যে-সময়ের কথা বলছি, সেইসময় উত্তর আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসছিল সোনার সন্ধানে। পার্বত্য নদীর তীরভূমিতে বালির উপর প্রবাহিত জলস্রোত ছড়িয়ে দেয় স্বর্ণরেণু, বালুকামিশ্রিত ওই স্বর্ণরেণু পাত্র বোঝাই করে পরীক্ষার পর খাঁটি নির্ভেজাল সোনার গুঁড়ো অন্বেষণকারীর হস্তগত হয়। যথেষ্ট অর্থ ছিল না বলে তারা ডসন শহরে ফিরে গেল– যদি কোনোরকমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা যায়, তাহলে আবার সোনার সন্ধানে তারা অভিযান শুরু করতে পারে, না হলে অর্থাভাবে সমস্ত পরিকল্পনা হবে নষ্ট…
ডসন শহরে পৌঁছে একটি পানাগারে ঢুকল থর্নটন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে উদ্দেশ্য, তৃষ্ণা নিবারণ। বাক সর্বদাই থর্নটনকে অনুসরণ করত, পানাগারের মধ্যেই এক জায়গায় শুয়ে সে প্রভুর উপর নজর রাখছিল।
ব্ল্যাক বার্টন নামে একটা লোক ওই সময় পানাগারের ভিতর মদ্যপান করছিল। বার্টনের দেহে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। স্বভাবেও সে ছিল অত্যন্ত কলহপ্রিয় সর্বদাই সে মারামারির সুযোগ খুঁজত। পানাগারের মধ্যে সে একটি নিরীহ ছোকরার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিল। ছোকরা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল, কোনো অপরাধ না করেও সে ক্ষমা চাইতে লাগল কাচুমাচু হয়ে। বার্টন ছাড়ার পাত্র নয়, সে ছেলেটিকে রূঢ়ভাবে এক ধাক্কা মারল।
ঠিক সেইসময়ে অকুস্থলে প্রবেশ করেছিল জন থর্নটন। সে অন্যায় সহ্য করতে পারত না, বিনাদোষে ছেলেটিকে নিগৃহীত হতে দেখে দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে বার্টনকে নিবৃত্ত করতে চাইল। খুব শান্তভাবে কয়েকটা কথা বলেছিল থর্নটন, তাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল বার্টন, বিনা বাক্যব্যয়ে সে ঘুসি বসিয়ে দিল থর্নটনের মুখে। ঘুসিটা এমন জোরে পড়েছিল যে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে পড়তে কোনোরকমে একটা টেবিল আঁকড়ে ধরে পতন থেকে আত্মরক্ষা করল থটন।
বার্টন আর থর্নটনের কাছাকাছি যে মানুষগুলো ছিল তাদের কানে এল একটা ভয়ংকর জান্তব শব্দ- আওয়াজটা কুকুরের গলার আওয়াজের মতো হলেও উপস্থিত জনমণ্ডলী কোনো কুকুরের গলা থেকে অমন ভয়ংকর শব্দ বেরিয়ে আসতে শোনেনি। পরবর্তীকালে দর্শকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ওই চিৎকারের শব্দকে গর্জনধ্বনি বলেই বর্ণনা দিয়েছিল।
লোকগুলো দেখল একটা প্রকাণ্ড কুকুর মাটি থেকে সগর্জনে লাফিয়ে উঠে যেন শূন্যপথে উড়ে এল বার্টনের গলা লক্ষ্য করে। হাত দিয়ে গলা আড়াল করে কোনোমতে প্রাণ বাঁচাল বার্টন, কিন্তু বাক-এর গুরুভার দেহের আঘাতে সে ছিটকে ধরাশায়ী হল। শত্রুর হাতটাকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে তার গলায় কামড় বসাতে উদ্যত হল বাক। সেদিন বার্টনের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত কেবল আশেপাশে অবস্থিত লোকজনের হস্তক্ষেপে বার্টন প্রাণে বেঁচে গেল। প্রথমে সকলেই হকচকিয়ে গিয়েছিল, তারপরেই তাদের সংবিৎ ফিরে এল। সবাই মিলে বাককে বার্টনের দেহের উপর থাকে তাড়িয়ে দিল নিরাপদ দূরত্বে। একজন চিকিৎসককে ডেকে আনা হল। চিকিৎসক যখন বার্টনের ক্ষতগুলো পরীক্ষা করছিলেন, সেইসময় দণ্ডায়মান জনতার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আবার বার্টনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছিল বাক।