আমাদের নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না, হাল-এর কণ্ঠে বিদ্রুপের আভাস, কিছু কিছু লোকের সাহস একটু বেশি বিপদের মুখে এগিয়ে যেতে তারা ভয় পায় না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো আমরা নির্ঘাত ডসনে পৌঁছে যাব নিরাপদে।
এবার চাবুক উঁচিয়ে সে স্লেজবাহক কুকুরদের ছুটতে আদেশ করল। ধরাশয্যা ত্যাগ করে কেউ উঠে দাঁড়াতে রাজি হল না। হাল সজোরে চাবুক হাঁকাতে লাগল কুকুরদের উপর। প্রথমে উঠে দাঁড়াল সোল-লেকস– অতিকষ্টে। জো দুবার উঠতে চেষ্টা করেও সফল হল না, তৃতীয় বারের চেষ্টায় সে উঠে দাঁড়াল। বাক ওঠার চেষ্টা করল না, পড়ে পড়ে মার খেতে লাগল। একটি অপরিচিত মানুষের সামনে বাক-এর অবাধ্য আচরণ হালকে ক্ষিপ্ত করে তুলল, চাবুক ছেড়ে সে ধরল মুগুর! কিন্তু মুগুরের প্রচণ্ড আঘাতকেও অগ্রাহ্য করে বাক শুয়ে রইল, উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল না একবারও। খুব দুর্বল হয়ে পড়লেও বাক অন্য কুকুরদের মতো স্লেজ টানতে পারত। তবু সে উঠে দাঁড়ায়নি, তার কারণ, তীব্র অনুভূতি দিয়ে বুঝেছিল তুষারে ঢাকা ওই পথ মৃত্যুর পথ, ওই পথে পা দিলে মৃত্যু নিশ্চিত তাই মুগুরের প্রচণ্ড আঘাত উপেক্ষা করেও সে শুয়ে রইল, উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল না।
হাল-এর মুগুর পড়তে লাগল সর্বাঙ্গে, ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল বাক-এর দৃষ্টি, শরীর এমন অবশ ও অসাড় হয়ে গেল যে, আঘাতের যন্ত্রণাও সে আর বোধ করতে পারছিল না— বাক বুঝতে পাল তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে…
আচম্বিতে এক তীব্র জান্তব ধ্বনি সকলকে চমকে দিল- ওই ভীষণ অমানুষিক চিৎকার বেরিয়ে এসেছে থর্নটনের গলা থেকে এক লাফে এগিয়ে এসে এক প্রচণ্ড ঘুসি বসাল সে হাল-এর মুখের উপর ছিটকে ধরাপৃষ্ঠে লম্ববান হল হাল।
বাককে আড়াল করে দাঁড়াল থর্নটন, ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আর-একবার যদি কুকুরটাকে তুমি আঘাত করো, তাহলে আমি তোমাকে খুন করব।
এটা আমার কুকুর, নাক থেকে রক্ত মুছে ফেলে উঠে দাঁড়াল হাল, সরে যাও আমার সামনে থেকে। আমি এখনই ডসনের পথে রওনা দেব।
তবুও বাককে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল থর্নটন। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হাল এইবার খাপ থেকে টেনে নিল ছুরি। যে-গাছের ডাল থেকে কুঠারের হাতল তৈরি করছিল থর্নটন, সেটা তার হাতেই ছিল- কবজির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে সেই হাতলটা দিয়ে হাল-এর মুঠিতে আঘাত করে সে ছুরিটা মাটিতে ফেলে দিল। তৎক্ষণাৎ ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার হাল আঘাত হানতে চেষ্টা করল। কুঠারের হাতল এবার মুঠির উপর এত জোরে পড়ল যে, যন্ত্রণায় হাল-এর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল এবং অবশ হাতের মুঠি থেকে আবার ছিটকে পড়ল ছুরি। এবার ছুরিটাকে হস্তগত করল থর্নটন, তারপর বাক-এর শরীর থেকে সাজ-সরঞ্জাম কেটে ফেলে আবার ছুরিটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে।
হাল-এর আর লড়াই করার মতো উৎসাহ বা ক্ষমতা ছিল না। নিঃশব্দে ছুরি, চাবুক আর মুগুর কুড়িয়ে নিয়ে সে স্লেজটাকে চার্লিয়ে দিল। কুকুরগুলো স্লেজ টানতে ইচ্ছুক ছিল না; বাধ্য হয়েই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুর্বল শরীরে অতিকষ্টে স্লেজ টানতে লাগল নদীর বুকে জমাট বরফের উপর দিয়ে।
স্লেজ চলার শব্দে মুখ তুলে তাকাল বাক– দলটাকে নেতৃত্ব দিয়ে সকলের আগে এগিয়ে চলেছে পাইক, সকলের পিছনে রয়েছে সোল-লেকস এবং ওই দুজনের মাঝখানে অবস্থান করছে জোর আর টিক– সব কয়টা কুকুরই টলছে আর খোঁড়াচ্ছে। তাদের দুরবস্থা দেখেও হাঁটতে সম্মত হয়নি মাসের্ডিস। চেপে বসেছে স্লেজের উপর। স্লেজের পিছনে গী-পোল নামে যে বক্রাকার বস্তুটি অবস্থান করে, সেই বস্তুটির সাহায্যে স্লেজগাড়িটিকে চালনা করছে হাল সকলের পিছনে স্খলিতচরণে এগিয়ে চলেছে চার্লস।
আচম্বিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল জমাট বরফ, মার্সেডিসের আর্তস্বর শোনা গেল একবার পরক্ষণেই স্লেজসমেত দুটি নরনারী ও চারটি কুকুরকে নিঃশেষে গ্রাস করে আত্মপ্রকাশ করল এক সুগভীর গহ্বর!
নদীবক্ষ থেকে পিছন ফিরে নদীতীরে ফিরে আসতে সচেষ্ট হল চার্লস- তার চেষ্টা সফল হল না, অনেকটা জায়গা নিয়ে ভেঙে পড়ল জমাট বরফ- সেই ভেঙে পড়া জমাট বরফের ফাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল চার্লস! যেখানে এক মুহূর্ত আগেও ছিল জমাট বরফের নিরেট পথ, এখন সেখানে অবস্থান করছে তরল জলধার!
জন থর্নটন আর বাক পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। থর্নটন বলল, আহা বেচারা! খুব বেঁচে গেছ তুমি!
বাক তার নতুন বন্ধুর হাত চেটে দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাল।
২০. বাক ও জন থর্নটন
জন থর্নটন ছিল স্লেজচালক। স্লেজ চালনাই ছিল তার পেশা। সাধারণত পেশাদার স্লেজচালকদের তাঁবুতে থাকে অনেক কুকুর এবং তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চালনা করার জন্য দুই কি তিনজন অভিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু থর্নটনের তাঁবুতে সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। নিদারুণ শীত তার পা দুটিকে সাময়িকভাবে অসাড় করে দিয়েছিল বলেই কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে ওই অঙ্গ দুটিকে আবার সচল করে নিতে মনস্থ করেছিল সে। তার দুই অংশীদার ডসন থেকে খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে, তাদের জন্যই পূর্বে উল্লিখিত হোয়াইট রিভার নামক নদীর ধারে সে অপেক্ষা করছিল ইতিমধ্যে অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল আমাদের কাহিনির নায়ক বাক!
বাক যখন থর্নটনের জীবনে এল, তখনও একটু খুঁড়িয়ে চলে থর্নটন। তার পায়ের মাংসপেশিতে সাড় এসেছে বটে, কিন্তু এখনও সে আগের শক্তি ফিরে পায়নি। বাক এতদিন যথেষ্ট অনাচার অত্যাচার সহ্য করেছে, তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে থর্নটনের সান্নিধ্যে এসে সর্বপ্রথম বিশ্রামলাভের সুযোগ পেল সে। নদীর ধারে চুপচাপ বসে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল চতুষ্পদ বাক ও দ্বিপদ থর্নটন।