কতদিন ধরে পথ চলতে হবে সে বিষয়ে হাল একটা ধারণা করে নিয়েছিল এবং সেই ধারণা অনুসারে স্লেজে বোঝাই করেছিল কুকুরদের প্রয়োজনীয় খাদ্য। একসময়ে প্রমাণ হল হাল-এর ধারণা ভুল যে সময়ের মধ্যে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে বলে ভেবেছিল, বাস্তবে সেই সময়ের ভিতর গন্তব্যস্থলের অর্ধেক পথও অতিক্রম করতে পারল না। অথচ কুকুরদের খাদ্য তখন ফুরিয়ে এসেছে। এবার কুকুরদের খাদ্য কমিয়ে দেওযা হল, প্রত্যেক কুকুরকে নির্ধারিত খাদ্যের অর্ধ অংশ দেওয়া হত। অনাহারে অর্ধাহারে কুকুরদের কাহিল অবস্থা হল আরও কাহিল। স্ক্যাগওয়েতে যে ছয়টি কুকুরকে ক্রয় করা হয়েছিল, দুরন্ত পথশ্রম আর উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে তারা পথেই মারা পড়তে লাগল। সঙ্গীদের মৃত্যুদৃশ্য দেখেও বাক তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়নি–প্রভুদের নির্দেশ অনুসারে সে স্লেজ টানছিল যথাসাধ্য।
কুকুরদের চাইতেও খারাপ অবস্থা হল প্রভুদের প্রথম প্রথম অনাহারক্লিষ্ট কুকুরদের দুরবস্থা দেখে কেঁদে ফেলত মার্সেডিস, গোপনে তাদের খাবারও দিয়েছিল কয়েকদিন কিন্তু পরবর্তীকালে তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে সে এমন বিব্রত হয়ে পড়ল যে, কুকুদের দুরবস্থার দিকে তার নজর রইল না।
মার্সেডিসের আদুরে খুকির মতো চালচলন তার স্বামী আর ভাই-এর পক্ষে বেশিদিন সহ্য করা সম্ভব হল না। এতদিন মার্সেডিস তার পুরুষ সঙ্গীদের উপর সব কাজকর্মের দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত ছিল নিতান্ত স্বার্থপরের মতো। সে তাদের সাহায্য তো করতই না, উপরন্তু সামান্য ত্রুটি হলেই ক্রুদ্ধ অভিযোগে মুখর হয়ে উঠত। প্রথম প্রথম চার্লস ও হাল মার্সেডিসের অন্যায় আচরণ সহ্য করলেও পরে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল, তারাও প্রতিবাদ করতে শুরু করল। পুরুষ সঙ্গীদের রূঢ় ব্যবহার মার্সেডিসকে আরও অবুঝ, আরও স্বার্থপর করে তুলল। সে এবার স্লেজের সঙ্গে না হেঁটে স্লেজের উপর চড়ে বসল। তার স্বামী আর ভাই প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, অনাহারে দুর্বল কুকুরদের পক্ষে এখন মার্সেডিসের একশো কুড়ি পাউন্ডের বাড়তি ওজন সমেত স্লেজ টানা সম্ভব নয়। কথাটা যুক্তিসঙ্গত হলেও মার্সেডিস স্লেজের উপর থেকে নেমে মাটিতে পদার্পণ করতে রাজি হল না।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। বহু চেষ্টাতেও কয়েকদিন পর কুকুরের দল অচল স্লেজটাকে সচল করতে পারল না। তখন হাল আর চার্লস দুজনে মিলে স্লেজের উপর থেকে তুলে এনে মাটির উপর দাঁড় করিয়ে দিল মাসের্ভিসকে। মেয়েটি এবার বসে পড়ল বরফের উপর, সে হাঁটতে রাজি নয়। চালর্স আর হাল তাকে ফেলে রেখেই অগ্রসর হল। প্রায় তিন মাইল পথ পেরিয়ে আসার পরেও তারা যখন পিছন ফিরে মার্সেডিসকে দেখতে পেল না, তখন বাধ্য হয়েই ফিরে এসে মেয়েটিকে তারা আবার স্লেজের উপর তুলে নিল।
অবশেষে ফুরিয়ে গেল খাদ্য। সেই অবস্থাতেও বাক স্লেজ টানতে চেষ্টা করছিল প্রাণপণে। তার শরীরের চামড়া ঝুলে পড়ল, পাঁজরের হাড়গুলো ঠেলে বেরিয়ে এল, লোমগুলো ঝুলে পড়ল অথবা হাল-এর মগুরের আঘাতে রক্তাক্ত স্থানগুলিতে শুষ্ক রক্তের সঙ্গে জট বেঁধে ঝুলতে লাগল। দলের অন্য কুকুরগুলোর অবস্থাও ভালো নয়, তাদের দিকে এক নজর তাকালেই মনে হত অনেকগুলো কঙ্কাল হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে। একজনের পর একজন তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল। যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি দিতে ধরাশায়ী কুকুরগুলোকে গুলি করতে বাধ্য হল হাল।
হতাবশিষ্ট দলটার মধ্যে ছিল বাক আর চারটি কুকুর। হোয়াইট রিভার নামে একটা নদীর ধারে এসে দলটা থামল। সেটা বসন্তকাল, গাছগুলো বরফের চাপে নুয়ে পড়ছিল, ফাঁক হয়ে যাচ্ছিল মাটির উপর বরফের চাঙড়, কখনো বা মাটিতে পড়ে থাকা বরফের আবরণ সশব্দে ফেটে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করছিল মারাত্মক মৃত্যুফঁদের মতো সুগভীর গহ্বর।
যে তাঁবুটার পাশে কুকুরের দল নিয়ে স্লেজ থামাল হাল ও চার্লস, সেই তাবুর অধিকারী ছিল একটি মাত্র মানুষ। ওই মানুষটি একটি গাছের গুঁড়ির উপর বসে কুঠারের হাতল তৈরি করছিল নিবিষ্টচিত্তে। কুকুররা শুয়ে পড়ল মড়ার মতো। মার্সেডিস যা করতে অভ্যস্ত তাই করছিল অর্থাৎ কাঁদছিল। তার দুই পুরুষ সঙ্গী পথশ্রমের ক্লান্তিতে টলছিল। বাক তার ক্লান্ত মাথাটা তুলে কুঠার তৈরিতে নিবিষ্টচিত্তে মানুষটির দিকে তাকাল এবং জীবনে সর্বপ্রথম জন থনৰ্টন নামে মানুষটিকে দেখতে পেল।
.
১৯. উদ্ধার পেল বাক
ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে তিনটি নরনারীকে জরিপ করে নিল থর্নটন। একনজর তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল নবাগতরা নিতান্তই আনাড়ি ও অনভিজ্ঞ, কিন্তু অতিশয় উদ্ধতা হাল যখন বরফের অবস্থা কেমন জানতে চাইল, থর্নটন সংক্ষেপে জবাব দিল, খুব খারাপ।
হাল-এর ওষ্ঠাধারে ফুটল তাচ্ছিল্যের হাসি, দুদিন আগেও লোকের মুখে ওই কথা শুনেছি। পথের উপর বরফ নাকি ধসে যাচ্ছে বসে যাচ্ছে। কয়েকটা লোক বলেছিল আমরা এই রাস্তা ধরে এগোলে হোয়াইট রিভার পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না। যত বাজে কথা- এই তো আমরা জমাট বরফের উপর দিয়ে এখানে পৌঁছে গেছি।
লোকগুলো ঠিকই বলেছিল, থর্নটন গম্ভীরভাবে বলল, যে-কোনো সময়ে বরফ ভেঙে পড়তে পারত। মুখ ও নির্বোধকে মাঝে মাঝে ভাগ্য কৃপা করে সেই ভাগ্যের কৃপাতেই মত্যকে ফাঁকি দিয়ে তোমরা এখানে উপস্থিত হতে পেরেছ। কিন্তু এই ধরনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত। নয়। তোমরা আর এগিও না, বিপদ ঘটতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। আলাস্কার সমস্ত সোনা আমাকে ঢেলে দিলেও আমি ওই পথে পা বাড়াব না।