লোকটির দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মার্সেডিস বলল, তাবুটা আমার দরকার। অতএব, ওটা সঙ্গে যাবে।
এটা বসন্তকাল, লোকটি জবাব দিল, এখন ঠান্ডা নেই। কাজেই তাবুর দরকার হবে না।
মার্সেডিস লোকটির কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে সঙ্গীদের মালপত্র বাঁধাবাঁধির কার্য পর্যবেক্ষণ করতে লাগল নিবিষ্টচিত্তে।
আর-একজন মন্তব্য করল, স্লেজটা বড়ো বেশি ভারি হয়ে পড়েছে।
লোকটির দিকে একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল চার্লস। তারপর চাবুক তুলে হাঁক দিল, চলো সামনে এগিয়ে যাও।
বাক এবং তার সঙ্গীরা একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে টান দিল; স্লেজ একটুও নড়ল না! ক্ষণেক বিরতি দিয়ে আবার সবাই মিলে টান মারল; স্লেজ অনড়! আবার টানল সবাই বৃথা চেষ্টা অচল স্লেজ সমবেত চেষ্টাতেও সচল হল না!
হাল চাবুক তুলল, হতচ্ছাড়া অলস জানোয়ারের দল, দাঁড়া তোদের মজা দেখাচ্ছি।
মার্সেডিস চিৎকার করে ভাইকে থামাল, তারপর তার হাত থেকে চাবুক ছিনিয়ে নিল, না, ওদের মারতে পারবে না তুমি। কথা দাও আমাকে ওদের মারবে না।
হাল দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কুকুরদের হালচাল তুমি কিছুই জানে না। চাবুক না মারলে ওদের কাছ থেকে কাজ পাওয়া যায় না। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে এখানে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের জিজ্ঞাসা করো।
প্রতিবেশী তিনজনের দিকে তাকাল মার্সেডিস, ওদের কি সত্যিই চাবুক মারা দরকার? আমি আবার এইসব নিষ্ঠুর কাজ দেখতে পারি না।
প্রথম যে লোকটি নীরবতা ভঙ্গ করেছিল সে, বলে উঠল, কুকুরগুলো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। বেশ কিছুদিন বিশ্রাম না নিলে ওদের চলার ক্ষমতা হবে না। এই দলটাকে কত টাকা দিয়ে তোমরা কিনেছ জানি না। তবে টাকাটা জলে পড়েছে, তোমরা ঠকে গেছ।
তার স্বামী আর ভাই-এর যে ব্যবসাবুদ্ধি নেই, একথা মানতে পারল না মার্সেডিস, সে চটপট মত বদলে ফেলল, চাবুকটা ভাই-এর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সে বলল, তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে। এই জায়গাটা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই ভালো।
কথাটা বলেই সে দণ্ডায়মান তিনটি দর্শকের দিকে ঘৃণামিশ্রিত তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
হালের হাতে চাবুক উঠল আর পড়ল, কুকুরগুলো তাদের বক্ষবন্ধনীর উপর ঝুঁকে পড়ে সজোরে টান মারল– তবু স্লেজ নড়তে চাইল না, সে যেন বরফের তলায় নোঙর গেঁথে মাটি কামড়ে ধরেছে! চাবুক পড়তে লাগল শপাশপ, কুকুরদের টানার বিরাম নেই- স্লেজ অচল, অনড়।
তিন দর্শকের মধ্যে যার বয়স বেশি, সে এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তোমাদের উপর আমার একটুও সহানুভূতি নেই। তোমরা যদি কোনোদিনই গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে না পারো, তাহলেও আমি দুঃখিত হব না। কিন্তু বেচারা কুকুরদের বাঁচাতে চাই বলেই বলছি– স্লেজের পিছনে দাঁড়িয়ে চাপ দাও, তাহলেই স্লেজ চলবে। স্লেজের তলায় বরফ জমে গেছে, চাপ দিলেই ওই বরফ ভেঙে স্লেজ চালু হবে।
লোকটির কথামতো কাজ করল চার্লস ও হাল কিন্তু একবারও তাকে ধন্যবাদ জানাল না। স্লেজ চালু হল। ঘন ঘন চাবুকের মার খেয়ে কুকুরগুলো প্রাণপণে গাড়ি টানতে লাগল। রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে স্ক্যাগওয়ে শহরের প্রধান রাজপথে মিশেছে ওইখান দিয়ে যাওয়ার সময়েই স্লেজ উলটে পড়ল, জিনিসপত্র গড়াগড়ি খেতে লাগল বরফ-ঢাকা মাটির উপর।
কুকুরের দল থামল না। অন্যায়ভাবে মার খেয়ে ভীষণ রেগে গিয়েছিল বাক, তার উপর এতক্ষণ বিষম ভারি বোঝা নিয়ে তাকে ছুটতে হয়েছে- এখন বোঝা হালকা হতেই সে স্লেজ তিরবেগে ছুটল। দলের অন্য কুকুরগুলো তাকে অনুসরণ করে ছুটতে লাগল সবেগে। রাজপথের উপর গড়াগড়ি খেতে লাগল মার্সেডিসের সাধের কাপড়-চোপড়ের পুঁটলি আর উচ্ছিষ্ট-মাখা নোংরা বাসনপত্র।
শহরের লোকগুলো ভালো– রাজপথ থেকে কাপড় আর তার বাসন তারা উদ্ধার করল। জিনিসগুলো গাড়িতে ভোলার সময়ে তারা জানাল এত ভারি ওজন কুকুররা টানতে পারবে না। তখন চার্লস এবং হাল আরও ছয়টা কুকুর কিনে আনল। কিন্তু ওই কুকুরগুলো কঠিন পথশ্রম সহ্য করার মতো বলিষ্ঠ ছিল না।
তবে বিপুলসংখ্যক ওই সারমেয় বাহিনীর মালিক হয়ে চার্লস আর হাল খুবই গর্ববোধ করতে লাগল– কারণ, সেখানে কোমো স্লেজেরই বাহক কুকুরের সংখ্যা চোদ্দো ছিল না। কিন্তু ভার্জিনিয়ার তিন আনাড়ি একবারও ভাবল না কেন অন্যান্য স্লেজের বাহকসংখ্যা কম চোদ্দোটা কুকুরের উপযুক্ত যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রী একটি স্লেজের পক্ষে যে বহন করা সম্ভব নয়, একথা তাদের মাথায় ঢুকল না।
তিনি আনাড়ি চোদ্দোটা কুকুরবাহিত স্লেজ ছুটিয়ে দিল গন্তব্য অভিমুখে। সেই সারমেয় বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বাক।
.
১৮. পথের দুর্ভোগ
চার্লস, হাল ও মার্সেডিস উৎসাহে টগবগ করছিল, কিন্তু স্লেজবাহী কুকুরদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত- চলমান ডাকঘরের মতো বিপুল চিঠিপত্রের বোঝা সমেত স্লেজ টেনেছে তারা বেশ কিছুদিন, উপযুক্ত বিশ্রামের অভাবে তাদের শরীর এখনও দুর্বল– সুতরাং ক্লান্ত দেহ আর মন নিয়ে তারা নতুন করে যাত্রা করতে আদৌ উৎসাহিত ছিল না।
স্লেজবাহক কুকুরদের প্রভুরা অর্থাৎ চার্লস, হাল ও মার্সেডিস কিন্তু কুকুরদের দৈহিক বা মানসিক অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায়নি একেবারেই। তুষারাচ্ছন্ন পথে স্লেজ-চালনা বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ছিল না কিছুমাত্র। কোনো অবস্থা থেকেই তারা শিক্ষালাভ করতে চাইত না– সবসময় তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতেই ব্যস্ত থাকত। রাত্রে স্লেজ থামিয়ে তাবু ফেলতে এবং সকালে তবু গুটিয়ে যাত্রা শুরু করতে তারা অনর্থক সময় নষ্ট করত, তার উপর পথের মাঝে স্লেজ থামিয়ে অধিকাংশ সময়েই তারা জিনিসপত্র নতুন করে সাজাতে বাধ্য হত। যাত্রা শুরু করার সময়ে প্রথমেই জিনিসপত্র ঠিকমতো না সাজানোর ফলে মাঝপথেই স্লেজের গতিরোধ হওয়ার উপক্রম হত। যে দলটা ইতিপূর্বে দিনে চল্লিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে, সেই দলটাই এখন সারা দিনে দশ মাইল বা তার চেয়েও কম দূরত্ব অতিক্রম করে।