নৃত্যচঞ্চল অগ্নিশিখার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার মন চলে যেত আরও দূরে, সুদূর অতীতে যেখানে তার সঙ্গে গুহার আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে একটি মানুষ এখন যেসব লোক তার আশেপাশে চলাফেরা করে তাদের সঙ্গে গুহায় উপবিষ্ট ওই মানুষটির সাদৃশ্য নেই কিছুমাত্র মনশ্চক্ষে বাক দেখতে পায় ওই বিচিত্র মানুষের পা দুটি ছোটো, তুলনায় হাত দুটি অস্বাভাবিক লম্বা এবং তার মাথার উপর লটপট করছে লম্বা চুলের জটা। ওই আদিম মানুষ গুহার বাইরে জমাট অন্ধকারের দিকে বার বার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে, তার আচরণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অন্ধকারকে সে ভয় করে। জ্বলন্তু আগুনের উপর দিয়ে দৃষ্টিকে চালনা করে বাক দেখতে পায় আঁধার সমুদ্র ভেদ করে জ্বলে জ্বলে উঠছে জোড়ায় জোড়ায় প্রদীপ্ত চক্ষু। বাক বুঝতে পারে হিংস্র শ্বাপদের দল অন্ধকারে ওত পেতে বসে আছে। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের বাধা এড়িয়ে সামনে আসতে তারা সাহস পাচ্ছে না। এইভাবে মনের চোখে বাক দেখতে পেত সুদুর অতীতের দৃশ্য যে দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিল বাক-এর পূর্বপুরুষ, সেই অতীতের দৃশ্য বাস্তবে আর কোনোদিনই চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবে না বাক। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের নৃত্যপরায়ণ চঞ্চল শিখাগুলোর ভিতর দিয়ে সুদূর অতীত ভেসে আসত বর্তমানে পৌঁছে দিত বাক-এর কাছে আদিম গুহার বার্তা বর্তমানের তুষার ঢাকা তাবুর মধ্যে…।
.
১৬. পালা বদলের পালা
বাক আর তার দল যখন ডসন ছেড়ে স্ক্যাগওয়ের পথে রওনা হল, তখনই প্রবলবেগে তুষার পড়তে শুরু করল। ফলে, নরম তুষারের উপর স্লেজের রানার ঘষা খেতে লাগল ভীষণ জোরে, কুকুরদের পরিশ্রমও তাই বেড়ে গেল দারুণভাবে। শীতের প্রারম্ভেই তারা আঠারো শো মাইল পার হয়ে এসেছে, এখন নতুন যাত্রাপথে স্লেজ টেনে ছুটতে তাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। বিলি নামে শান্ত কুকুরটা প্রতি রাত্রেই অস্ফুট আর্তস্বরে ক্রন্দন করতে লাগল।
ত্রিশ দিন পরে বাক ও তার দলভুক্ত পঞ্চাশটি কুকুর অর্ধমৃত অবস্থায় স্ক্যাগওয়ে নামক স্থানে পৌঁছল। তাদের অবস্থা তখন শোচনীয়, দলপতি বাক-এর শরীরের ওজন একশো ছত্রিশ থেকে নেমে হয়েছে একশো পনেরো! অধিকাংশ কুকুর খোঁড়াচ্ছে, কেউ কেউ আবার টানধরা পেশীর যন্ত্রণায় ভুগছে। প্রত্যেকটি কুকুর এখন ক্লান্তির শেষ সীমায় উপস্থিত, তাদের শরীর আর বইছে না। স্লেজ যখন ঢালু জমি বেয়ে নেমে আসে, তখন কোনোরকমে ধাবমান স্লেজের ধাক্কা থেকে তারা আত্মরক্ষা করে।
স্লেজের চালকরা দীর্ঘ বিশ্রাম পাবে বলে আশা করেছিল কিন্তু চিঠি বিলি করতে হবে যথাসম্ভব শীঘ্র, বিলম্বের অবকাশ নেই অথচ এই শ্রান্ত ক্লান্ত কুকুরদের নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা চালকরা স্থির করল এই কুকুরের দলটাকে বিক্রি করে নতুন কুকুরদের নিয়ে স্লেজবাহক নতুন দল গঠন করতে হবে। পর পর তিন দিন কাটল, কোন ক্রেতাই কুকুরগুলোকে কিনে নিতে এগিয়ে এল না। অভিজ্ঞ চালকরা এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারছিল কিছুদিন বিশ্রাম না নিলে এই কুকুরগুলো তাদের হৃতশক্তি ফিরে পাবে না– এখন তাদের কিনলে টাকাটা জলে পড়বে।
চতুর্থ দিন সকালে ভার্জিনিয়া থেকে উপস্থিত হল দুটি মানুষ, তারা খুব কম দামে বাক ও তার সঙ্গীদের কিনে নিল সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম সমেত। ক্রেতা দুজনের একজন মধ্যবয়স্ক, তার সঙ্গীর বয়স কুড়ির বেশি নয়। মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির নাম চার্লস, তার সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত সঙ্গীর নাম হাল। হালের চওড়া কোমরবন্ধনীতে ঝুলছিল একটা মস্ত ছোরা ও একটা কোল্ট রিভলভার। হাল মনে করছিল অস্ত্র দুটি তার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আসলে ওই অপরূপ সজ্জা তাকে পোড়-খাওয়া মানুষের কাছে হাসির খোরাক করে তুলেছিল। অভিজ্ঞ ব্লেজচালকরা হালকে দেখে অতিকষ্টে হাসি চেপে রাখছিল।
পূর্বোক্ত চার্লস এবং হাল হল বাক-এর নতুন মনিব।
.
১৭. আনাড়ির পাল্লায় বাক
নতুন-কেনা কুকুরদের সাহায্যে স্লেজ চার্লিয়ে চার্লস ও হাল তাদের তাঁবুতে ফিরে এল। তাবুর অগোছালো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র দেখে দস্তুরমতো চমকে গেল বাক। ওই তাবুর ভিতরেই মার্সেডিস নামে মেয়েটিকে সে দেখতে পেল। মার্সেডিস হল চার্লসের স্ত্রী আর হালের ভগ্নী। স্লেজ চালনা সম্পর্কে কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল না মার্সেডিসের, তবু কেমন করে কীভাবে স্লেজে মালপত্র বোঝাই করতে হবে সে বিষয়ে তার সঙ্গীদের সে বিস্তর উপদেশ দিচ্ছিল, কিন্তু হাতে-নাতে কাজ করে সে তাদের একটুও সাহায্য করছিল না। তার পুরুষ সঙ্গীরা তাবুটাকে তালগোল পাকিয়ে একটা মস্ত পুঁটলি বানাল, টিনের থালাগুলো পরিষ্কার না করেই একসঙ্গে জড়ো করল এবং মার্সেডিসের নির্দেশ অনুসারে তার পোশাক-পরিচ্ছদগুলো বার বার উঠিয়ে নামিয়ে শেষ পর্যন্ত স্লেজ বোঝাই করল।
পাশের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে তিনটি লোক সকৌতুকে দুটি আনাড়ি পুরুষ ও একটি মেয়ের কাণ্ড দেখছিল আর নিজেদের মধ্যে হাসাহসি করছিল। অবশেষে আর থাকতে না পেরে তাদের মধ্যে একজন নীরবতা ভঙ্গ করল
দেখ বাপু, তোমাদের ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাই না, লোকটি বলে উঠল, তবে আমি হলে ওই তাবুটাকে নিয়ে স্লেজের ভারবৃদ্ধি করতাম না।