বাক ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। সোল-লেকসকে দলের পুরোভাগে দিয়ে সমস্ত কুকুরের দলটাকে স্লেজগাড়ির সঙ্গে জুতে দেওয়া হল। বাক তখনও সামনে আসেনি। ফ্রাঁসোয়া তাকে গাড়িতে জোতার জন্য ডাকল। বাক অনড়। সে মারধরের ভয় করে না, কিন্তু দলনায়কের স্থানে তাকে স্বীকৃতি না দিলে সে স্লেজ টানতে রাজি নয়! এবার পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, তারা মুগুর ছুঁড়ে মারল। চটপট সরে গিয়ে বাক আত্মরক্ষা করল। তাকে পাকড়াও করার জন্য তাড়া করতেই সে মনিবদের নাগাল থেকে দ্রুত সরে গেল। মনিবরা তাকে গালি দিল, সেও দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিতে লাগল– অবশ্য নিরাপদ দূরত্ব থেকে।
পেরল্ট তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে তাদের রওনা হওয়া উচিত ছিল। বোকার মতো ফ্রাঁসোয়ার দিকে তাকিয়ে কাঁধে ঝাঁকুনি দিল পেরল্ট। বন্ধুর ইঙ্গিত বুঝে সোল-লেকসকে দলের পুরোভাগ থেকে সরিয়ে এনে আগের জায়গায় তাকে জুতে দিল ফ্লাগোয়া।
এবার ডাকতেই ছুটে এল বাক, স্থানগ্রহণ করল দলের প্রথমে। জোর করেই দলের নেতা হয়ে গেল সে!
সমস্ত দলটা এতদিন যা-খুশি তাই করে এসেছে। অবশ্য বাক-ই তাদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। তার নেতৃত্বেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল কুকুরদের মধ্যে। কুকুরগুলো হয়ে উঠেছিল অবাধ্য, অলস, বিশৃঙ্খল। এখন চট করে বাক-এর কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে নিয়ম শৃঙ্খলার বাঁধনে আবদ্ধ হতে তারা রাজি হল না। কিন্তু দলপতি বাক-এর প্রচণ্ড শাসন কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বঝিয়ে দিল, যা হয়েছে তা হয়েছে- এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে বর্তমান অবস্থায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাজি না হলে দলপতির দাঁত তাদের শরীরকে করে দেবে রক্তাক্ত! অতএব কিছুদিনের মধ্যেই বিশৃঙ্খল দলটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে স্লেজ টানতে শুরু করল।
পথের মধ্যে রিংক র্যাপিডস নামক জায়গায় দুটি নতুন হাস্কি কুকুরকে দলভুক্ত করা হল। তাদের নাম চিক ও কুনা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বুনো স্বভাবকে বদলে দিল বার্ক। তারা হয়ে উঠল কর্তব্যপরায়ণ স্লেজবাহক। ফ্রাঁসোয়া অভিজ্ঞ স্লেজচালক, ইতিপূর্বে ক্ষমতাশালী বহু দলনায়কের সাক্ষাৎ পেয়েছে সে কিন্তু দলের নেতা হিসাবে বাক-এর দক্ষতা তাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিল।
স্ক্যাগওয়ে নামক স্থানে পৌঁছে তারা হিসাব করে দেখল চোদ্দো দিনের মধ্যে প্রতিদিন তারা প্রায় চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। স্লেজবাহক দলপতির মধ্যে এমন গতিবেগের চাঞ্চল্যকর উদাহরণ ইতিপূর্বে কেউ স্থাপন করতে পারেনি– বাক প্রমাণ করে দিয়েছে দলপতি হিসাবে সে অনন্য।
১৫. আদিম স্মৃতি
একদিন সকালে ফ্রাঁসোয়া ও পেরল্টের কাছে কানাডা সরকারের চিঠি এল- ডাকবাহকদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছে সরকার, সেইখানে নতুন ডাকবাহকদের তুষার-আচ্ছন্ন দুর্গম পথে কুকুর বাহিত স্লেজ চালানোর শিক্ষা দেওয়ার জন্য ফ্রাঁসোয়া আর পেরকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে।
বাককে ডেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ফ্রাঁসোয়া। তারপর সে আর পেরল্ট অন্য কুকুরদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল। পরবর্তীকালে কোনোদিন ওই লোকদুটির দেখা পায়নি বাক, তার জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া।
সমস্ত দলটা এবার আর একটি ডাকবহনকারী দলের সঙ্গে যুক্ত হল। বারোটা নতুন কুকুরের সঙ্গে বাক ও তার সঙ্গীদের নিয়ে নবগঠিত দলটার নাম হল সল্ট ওয়াটার মেইল। সোনার সন্ধানে যে-সব অভিযাত্রী উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছিল, তাদের কাছ থেকে এবং তাদের উদ্দেশে প্রেরিত চিঠিপত্র নিয়ে পূর্বোক্ত স্লেজবাহী কুকুরের দল যাতায়াত করছিল। কাজটা খুব কষ্টসাধ্য, কুকুরদের পরিশ্রম করতে হত ভীষণভাবে। বাক যদিও ওই কাজ পছন্দ করছিল না, তবু নিপুণভাবে দলটাকে পরিচালনা করে যথাসাধ্য কর্তব্যপালন করছিল সে। কিন্তু একঘেয়ে জীবন তার ভালো লাগছিল না। প্রত্যেকটা দিন ছিল বৈচিত্র্যহীন প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ে রাঁধুনিরা আসত, আগুন জ্বালিয়ে খাদ্য তৈরি করা হত, তারপর প্রাতরাশ শেষ করে স্লেজ টেনে ছুটত কুকুরের দল– অন্ধকার ঘনিয়ে এলে তাবু ফেলে নিদ্রার আরাধনা এবং পরের দিন ভোরের আলো ফুটতেই আবার বিরামহীন পথ চলার পালা।
রাত্রে কুকুরদের খাওয়ার জন্য মাছ দেওয়া হত। সেই খাদ্য উদরসাৎ করার পর প্রায় ঘণ্টাখানেক কুকুররা এদিক-ওদিক চলাফেরা করত। ওই দলটায় কুকুরের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল মারামারি আর কামড়াকামড়ি করতে ওস্তাদ। দলের ভিতর সবচেয়ে ভীষণ তিনটি কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল বাক এবং সব কয়টি লড়াইতেই শত্রুদের পরাজিত করেছিল সে। ফলে, বাক যখন গায়ের নোম ফুলিয়ে সগর্জনে দন্তবিস্তার করত, তখনই অন্য কুকুরগুলো তার সামনে থেকে সরে পড়ত চটপট।
রাতের ভোজনপর্ব ছিল বাক-এর কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। আগুনের সামনে বসে স্বপ্নাতুর দুই চোখের দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে থাকত চঞ্চল অগ্নিশিখার দিকে, কিন্তু তার মন ভ্রমণ করত বিস্মৃত অতীতের পটভূমিতে। কখনো কখনো বিচারক মিলারের মস্ত বড় বাড়ি, সাঁতারের জন্য নির্দিষ্ট পুকুর এবং ঘোড়ার আস্তাবল ভেসে উঠত তার স্মৃতির পটে কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তার মানসপটে ভেসে উঠত মর্গ্যান, তার প্রথম লড়াই- যখন তাকে মুগুরের আঘাত করা হয়েছিল, কার্লির মৃত্যু এবং স্পিটজের সঙ্গে তার ভয়ংকর মৃত্যুপণ দ্বৈরথ…