এই ধরনের শিকারে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ছিল স্পিটজের যেখানে খাড়ির মুখটা বেঁকে গেছে, দলের সঙ্গ ত্যাগ করে সেই বাঁকের মুখে উঁচু জমির উপর ওত পেতে পলাতকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই কুকুরদের তাড়া থেকে বাঁচতে বাঁকের মুখে উপস্থিত হল ধাবমান শশক সঙ্গেসঙ্গে এক লাফে শিকারের উপর পড়ে কামড় বসাল স্পিটজ। দুই দাঁতাল চোয়ালের কঠিন পেষণে তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারাল নিরীহ খরগোশ।
কুকুরের দলটার নেতৃত্ব দিয়ে সকলের আগে-আগে ছুটে আসছিল বাক। সে যখন দেখল স্পিটজ তার শিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, সে বুঝল এইবার চরম নিষ্পত্তির সময় হয়েছে- খরগোশের মৃত্যু দেখেও সে গতিবেগ একটুও সংযত করল না, ঝড়ের মতো এসে পড়ল স্পিটজের উপর, শুরু হল মৃতুপণ দ্বৈরথ। পরস্পরের দেহের সংঘাতে দুটি কুকুরই গড়িয়ে পড়ল তুষারের উপর। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল স্পিটজ এবং বাক-এর কাঁধে কামড় বসিয়েই এক লাফে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে সুযোগের অন্বেষণে ঘুরতে লাগল বাক আর স্পিটজ…
মরা খরগোশটাকে উদরসাৎ করে কুকুরের দল প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা দুটিকে ঘিরে বসে পড়ল, তাদের চোখগুলো জ্বলতে লাগল হিংস্র আগ্রহে।
দ্বৈরথ রণে অভিজ্ঞ যোদ্ধা স্পিটজ। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ধরেনর কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছে সে। বারংবার দংশনে বাক-এর স্কন্ধদেশ রক্তাক্ত করে দিল স্পিটজ, কিন্তু বাক একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না- আঘাত করা তো দূরের কথা। কুকুরের দল তাদের ঘিরে অপেক্ষা করছিল দুই যোদ্ধার মধ্যে যে ধরাশায়ী হবে, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করবে তারা। বাক-এর দম ফুরিয়ে এসেছিল, একবার স্পিটজের ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর অপেক্ষমাণ সারমেয়-বাহিনী হিংস্র আগ্রহে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তারা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল বাক; কুকুরের দলও আবার বসে পড়ল যোদ্ধাদের ঘিরে এক সুবিশাল জীবন্ত বৃত্তের আকারে।
বাক এতক্ষণ তার সংস্কার আর দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করছিল, এইবার সে তার মস্তিষ্ককে ব্যবহার করল– দ্রুতবেগে প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা লক্ষ্য করে কঁপ দিল বাক, পরক্ষণেই নিশানা পরিবর্তন করে প্রায় শায়িত অবস্থায় ছুটে এসে কামড় বসাল স্পিটজের বাঁ পায়ের উপর। সেই প্রচণ্ড দংশনে ভেঙে গেল স্পিটজের বাঁ পা, তিন পায়ে ভর দিয়ে শত্রুর সম্মুখীন হল স্পিটজ। আবার একই কৌশল অবলম্বন করল বাক, ভেঙে গেল স্পিটজের পিছনের ডান পা। আবার আক্রমণ করল বাক, পিছনের দুই পা ভেঙে স্পিটজ এখন অসহায় শত্রুর আক্রমণের বেগ সামলাতে না পেরে সে আবার ধরাশায়ী হল। শত্রুর গলায় কামড় বসিয়ে এক লাফে সরে এল বাক, সঙ্গেসঙ্গে অপেক্ষমাণ কুকুরের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণাহত স্পিটজের উপর….
একটু দূর থেকে বাক তার শত্রুর মৃত্যুদৃশ্য উপভোগ করতে লাগল পরমানন্দে- তুষারাবৃত উত্তরাঞ্চলে এই নিয়মই প্রচলিত– হয় মারো, নয় মরো।
.
১৪. দলের নায়ক বাক
পরের দিন সকালে ফ্রাঁসোয়া যখন স্পিটজকে দেখতে পেল না এবং বাক-এর সর্বাঙ্গে রক্তাক্ত ক্ষতগুলো যখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তখনই সে বুঝল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মৃত্যুপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হয়েছে বাক।
একটা কুকুরের মতো কুকুর ছিল বটে স্পিটজ, বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলল ফ্রাঁসোয়া, যেসব কুকুর দলের নেতা হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাদের মধ্যে সেরা ছিল স্পিটজ। লড়াইতেও সে ছিল ওস্তাদ। পেরল্ট, বাক-এর ক্ষতচিহ্নগুলো একবার তাকিয়ে দেখ।
দেখেছি, পেরল্ট বলল, স্পিটজ ওস্তাদ লড়য়ে বটে, কিন্তু বাক তার চেয়েও বড়ো ওস্তাদ। তা না হলে বাক-এর বদলে স্পিটজকেই আমরা দেখতে পেতাম। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে- স্পিটজের মৃত্যুর পর দলের মধ্যে এখন আর গোলমাল হবে না। আমরা সময়মতো। কাজকর্ম করতে পারব।
সোল-লেকস নামে কুকুরটাকেই দলের অধিনায়ক স্থির করা হল। স্লেজবাহকদের মধ্যে যে স্থানটি সোল-লেকস নামক কুকুরটার জন্য নির্দিষ্ট ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে দলের সর্বাগ্রে তাকে জুতে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসে ফ্রাঁসোয়া দেখল দলের পুরোভাগে অধিনায়কের স্থান অধিকার করে দাঁড়িয়ে আছে বাক! সে এখন দলের নেতা হতে চায়।
ফ্রাঁসোয়া হেসে উঠল, কী ভেবেছ তুমি? স্পিটজকে হত্যা করেছ বলে তোমাকেই দলনেতা করা হবে? যাও, যাও, পিছনে যাও- নিজের জায়গায় দাঁড়াও।
বাক মনিবের আদেশ পালন করল না। সোল-লেকসকে তাড়া করে তার আগেকার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে আবার এসে দাঁড়াল দলের পুরোভাগে। সে তার পছন্দমতো জায়গা থেকে এক পা-ও নড়তে রাজি হল না। অবশেষে তার ঘাড়ের চামড়া টেনে ধরে জোর করে তাকে সরিয়ে দিল ফ্রাঁসোয়া।
সরালে কি হবে? বাক দলের নেতৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। সোল-লেকসকে দলের অধিনায়ক করে স্লেজের সামনে জুতে দেওয়ার উপক্রম করতেই দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এল বাক আর সভয়ে পিছিয়ে এসে তাকে দলনায়কের জায়গা ছেড়ে দিল সোল-লেকস।
ফ্রাঁসোয়ার মুখে কৌতুকজড়িত হাসির রেখা মুছে গেল বাক ভেবেছে কী? গায়ের জোরে দলের নেতা হবে?- একটা মুগুর নিয়ে তেড়ে এল ফ্রাঁসোয়া।