একদিন সকালে প্রচণ্ড তুষারপাতের পর পাইক নামে অলস কুকুরটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কুকুরদের তখন স্লেজগাড়িতে জুতে দেওয়া হচ্ছে, একটু পরেই স্লেজ ছোটানো হবে, চিৎকার করে পাইকের নাম ধরে ডাকছে ফ্রাঁসোয়া- কিন্তু কোথায় পাইক? সে যেন হঠাৎ হাওয়ায় মিশে গেছে, তার সাড়াশব্দ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকের এই অবাধ্য আচরণে ক্রুদ্ধ স্পিটজ হানা দিয়ে ফিরতে লাগল সব জায়গায়, তবু তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পাবে কি করে? এক ফুট গভীর তুষারের তলায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়েছিল পাইক।
অবশেষে পলাতককে খুঁজে পেল স্পিটজ এবং হিংস্ৰদন্ত বিস্তার করে পলাতককে শাস্তি দিতে উদ্যত হল। কিন্তু স্পিটজের উদ্যম ব্যর্থ করে দিয়ে দুই কুকুরের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাক, তার প্রকাণ্ড দেহের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল স্পিটজ। এতক্ষণ ভয়ে কাঁপছিল পাইক, এইবার বাককে তার হয়ে রুখে দাঁড়াতে দেখে সে সাহস পেল- সগর্জনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পিটজের উপর। দুই শত্রুর মিলিত আক্রমণের মহড়া নেওয়ার ক্ষমতা স্পিটজের ছিল না, সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। ব্যাপারটা দেখে ফ্রাঁসোয়ার মুখে ফুটল চাপা হাসি, কিন্তু শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে সে চাবুকপেটা করল বাককে আর সেই সুযোগে স্পিটজ ভালোভাবেই দাঁতের ধার পরখ করল পাইকের দেহে।
এই ঘটনার পর দেখা গেল দলের অধিকাংশ কুকুরের মধ্যে বিদ্রোহের সঞ্চার হয়েছে। দলের কোনো কুকুরকে যখনই শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্যে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছে স্পিটজ, তখনই মুর্তিমান বিঘ্নের মতো সেখানে হাজির হয়েছে বাক এবং অন্যায়কারীর সমর্থনে রুখে দাঁড়িয়েছে স্পিটজের বিরুদ্ধে। অবশ্য ফ্রাঁসোয়ার চোখের আড়ালেই ওইসব কাণ্ড ঘটত, দ্বিতীয়বার চাবুকের মার খেতে রাজি ছিল না বাক।
ক্রমশ এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল সব কুকুরের মধ্যে। কেউ আর স্পিটজের সারি সহ্য করতে ইচ্ছুক নয়। দলের মধ্যে আলস্য, বিশৃঙ্খলা আর লড়াই-এর ঘটনা ঘটতে লাগল বারবার। দুটি কুকুর অবশ্য বিদ্রোহীদের দলভুক্ত হতে সম্মত হয়নি- ডেভ আর সোল-লেকস।
বিদ্রোহীদের সাহস এমন বেড়ে গেল যে ভীতু পাইক পর্যন্ত একদিন স্পিটজের বরাদ্দ মাছ ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলল। কাছেই পাহারা দিচ্ছিল বাক, স্পিটজ কিছু করলেই সে তাকে বাধা দিতে প্রস্তুত- অতএব মনের রাগ মনেই চেপে স্পিটজ পাইকের দস্যুবৃত্তি হজম করে নিল। আর একদিন স্পিটজের বিরুদ্ধে মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াল ডাব আর ডো। একসঙ্গে দু-দুটো কুকুরের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না স্পিটজের, সুতরাং অপরাধীদের শাস্তি না দিয়েই পিছু হটে এল স্পিটজ। দলের কুকুরগুলো ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠল, তারা আর স্পিটজকে দেখে ভয় পায় না। স্পিটজু তাদের ধমক দিলেই তারাও দাঁত খিঁচিয়ে তাকে পাল্টা ধমক দেয়। স্পিটজের সামনে এলেই বাক-এর সর্বাঙ্গে লোম খাড়া হয়ে উঠত এবং গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসত রুদ্ধ রোষের চাপা গর্জনধ্বনি।
বিদ্রোহ যদি তাঁবুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে বিশেষ ক্ষতি ছিল না। কিন্তু স্লেজ টেনে ছোটার সময়েও ককরদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠত। ঝগড়া, কামড়াকামড়ি, লাগাম জড়িয়ে স্লেজের গতিরোধ প্রভৃতি অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটতে লাগল অনবরত, প্রাণপণে চাবুক চার্লিয়েও যঁফ্রাঁসোয়া দলটার মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারল না। চাবুকের শাসন অগ্রাহ্য করে স্পিটজের বিরুদ্ধে হিংস্র বিদ্রোহ ঘোষণা করতে লাগল স্লেজবাহক সারমেয়-বাহিনী। ফ্রাঁসোয়া বুঝতে পারছিল বাক হচ্ছে এইসব অঘটনের নায়ক, সব নষ্টের গোড়া। কিন্তু তাকে হাতে-নাতে ধরার উপায় ছিল না– প্রথম দিন চাবুক খেয়েই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল বাক, সব কিছুই করত সে ফ্রাঁসোয়ার অগোচরে।
সমগ্র দলটা যখন ডসন নামক গন্তব্যস্থলে পৌঁছল তখন কুকুরদের মধ্যে শৃঙ্খলার বালাই ছিল না, যে-যার ইচ্ছেমতো চলছে। স্পিটজের পক্ষে উক্ত বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করাও ছিল অসম্ভব। যে-সব সংবাদ পরিবেশনের ভার ছিল পেরন্টের উপর, সেগুলো বিলি করতে তার দেরি হল। কুকুরদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে না পারার জন্য পেরল্ট দায়ী করল বন্ধুকে, আর বন্ধুর
ফ্রাঁসোয়াও তার জবাব দিল কুদ্ধকণ্ঠে। কুকুরদের কলহ এবার ছড়িয়ে পড়ল তাদের মনিবদের মধ্যে। স্পিটজের সর্দারি যে ফুরিয়ে গেছে তা বুঝতে পেরে ভারি খুশি হয়ে উঠল বাক।
.
১৩. মৃত্যুপণ দ্বৈরথ
এক রাতে নৈশভোজের পর ডাব নামে কুকুরটি বরফ-ঢাকা প্রান্তরের উপর একটি খরগোশ দেখতে পেল। সঙ্গেসঙ্গে সে খরগোশটাকে তাড়া করল। তার পিছনে ছুটল সমগ্ৰ কুকুরবাহিনী। কাছেই ছিল উত্তর-পশ্চিম পুলিশ বাহিনীর তাবু- সেই তাবু থেকে পঞ্চাশটা হাস্কি কুকুর বেরিয়ে এসে ডাব এবং তার সঙ্গীদের দলে যোগ দিল। তুষারাবৃত প্রান্তরের উপর খরগোশের পিছনে তাড়া করে ছুটতে লাগল কুকুরদের এক বিশাল বাহিনী।
দারুণ ঠান্ডায় জমে-যাওয়া নদীর নিরেট বরফের উপর দিয়ে ছুটল ভয়ার্ত খরগোশ, তারপর হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে নদীর ছোটো খাড়ির ভিতর ঢুকল সে। তার হালকা শরীর যেন উড়ে চলল বরফের উপর দিয়ে, কিন্তু অনুসরণকারী কুকুরদের পাগুলো জমাট তুষারের মধ্যে ঢুকে তাদের গতিবেগ কমিয়ে দিচ্ছিল। তবু পলাতক শিকারের পিছনে লেগে রইল নাছোড়বান্দা কুকুরের দল। দলটাকে পরিচালনা করে সর্বাগ্রে ছুটছিল বাক…।