মুশকিল তো বটেই, দলের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, তবে খেলা বন্ধ রাখা যাবে না। মুকুন্দ না এলে তাকে বাদ দিয়েই আমাদের খেলতে হবে। কিন্তু ও আসছে না কেন? আমাদের ক্লাবকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, ওকে বাদ দিয়ে খেললে আমরা যে হারব, একথাও সে জানে– তবে? তবে কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল?
হতে পারে, বলাই নামে আর একটি খেলোয়াড় মন্তব্য করল, মুকুন্দ যা কাঠ-গোঁয়াড়, কোথায় হয়তো মারামারি বাধিয়ে বসেছে। রাগলে তো হতভাগার জ্ঞান থাকে না।
সেটাই সম্ভব, উদ্বিগ্নকণ্ঠে শশাঙ্ক বলল, নিশ্চয় কারও সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে। নইলে আজকের ম্যাচে সে নিশ্চয়ই হাজির থাকত।
অত ভাবছ কেন ক্যাপ্টেন? একটি বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারার খেলোয়াড় এগিয়ে এল, মুকুন্দের উপর আমরা বড়ো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা ঠিক নয়। আমরা কি খেলতে জানি না? মুকুন্দ না খেললে হেরে যাব এটা কেমন কথা?
তোর দম আছে, জোর আছে, খেলিসও ভালো স্বীকার করছি, আর একজন খেলোয়াড় বলে উঠল, কিন্তু মদন, গদাইকে তুই সামলাতে পারবি?
তা-তা-হ্যাঁ, এটাই তো সমস্যা, শুকনো মুখে মদন বলল, গদাইকে নিয়েই তো ভয়। মুকুন্দ ছাড়া আর কেউ গদাইকে সামলাতে পারে না।
বাগনান ক্লাবের তরফ থেকে একজন হেঁকে বলল, ওহে শশাঙ্ক, চারটে তো বাজল– এইবার মাঠে নেমে পড়া যাক, কি বলো?
যে খেলোয়াড়টি হাঁক দিল তার চেহারাটা সত্যি দেখার মতো। তার লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড দেহের সর্বত্র খেলা করছে মাংসপেশীর তরঙ্গ, আর সেই অতিশয় দর্শনীয় দেহের ভারসাম্য রেখে দুই গালের শোভা বর্ধন করছে বিশাল চাপদাড়ি এবং ঠোঁটের উপর একজোড়া ঘন কালো গোঁফ! মাথার চুল ঢেকে বাঁধা রয়েছে একটা রঙিন বুটিদার রুমাল খেলার সময়ে চুলগুলো যাতে মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দৃষ্টিকে না ব্যাহত করে, সম্ভবত সেইজন্যেই রুমালের শাসন। দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে তার চোহরাই সর্বপ্রথম দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম গদাই, যাকে নিয়ে গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের এত দুশ্চিন্তা।
গদাই-এর হাঁক শুনে গোলাপ কলোনির ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, মুকুন্দ এখনো আসেনি। গদাই, আমরা তার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
হ্যাঁ, মুকুন্দ না থাকলে খেলাটা তেমন জমবে না, গদাই তার অভিমত জানাল, আমরা ওর জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
আমিই রাজি নই, মধ্যস্থ অনিলবাবু তার কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, চারটে বেজে পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। এবার ম্যাচ শুরু করতেই হবে।
মধ্যস্থের কথার উপর কথা চলে না। উভয়পক্ষের সমর্থক ও দর্শকদের প্রবল উত্তেজনার মধ্যে খেলা শুরু হল…
কিছুক্ষণ খেলা চলার পর দেখা গেল গোলাপ কলোনির অবস্থা কাহিল। দৈত্যাকৃতি গদাই যেন একাই একশো! সে দান দিতে এলে তিন-চারজন মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারে না অপরপক্ষের কোনো খেলোয়াড় বাগনান ক্লাবের সীমানার মধ্যে হানা দিতে এসে দৈবাৎ যদি গদাই এর কবলে ধরা পড়ে, তাহলে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার ক্ষমতা তার হয় না, সেইখানেই তার খেল খতম!
মধ্যবর্তী বিরতির সময়ে দেখা গেল গোলাপ কলোনির সাতজন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচজনরেই মোড় হয়েছে, অর্থাৎ বসে পড়েছে। মুকুন্দকে বাদ দিলে ওই দুজনই গোলাপ কলোনির সেরা খেলোয়াড়, কিন্তু উভয়পক্ষই বুঝে গেছে আবার খেলা আরম্ভ হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পূর্বোক্ত দুই খেলোয়াড় বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
গোলাপ কলোনির পক্ষে দুজন খেলোয়াড় এখনও কোনোরকমে পরাজয় ঠেকিয়ে রেখেছে, কিন্তু বিরোধীপক্ষ বাগনান ক্লাবে এখনও সক্রিয় হয়ে অবস্থান করছে পাঁচজন খেলোয়াড়–মোড় হয়েছে মাত্র দুজন।
..খেলার মধ্যবর্তী বিরতির নিদিষ্ট পনের মিনিট পেরিয়ে গেল, মধ্যস্থ আবার খেলা শুরু করার নির্দেশ দিতে যাবেন- এমন সময়ে হঠাৎ শোনা গেল বহুকণ্ঠের উল্লসিত কোলাহল, মুকুল এসেছে! মুকুন্দ এসেছে!
সচমকে কোলাহল লক্ষ্য করে চোখ ফেরাতেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক আর মদন দেখতে পেল খেলার মাঠে উপস্থিত হয়েছে মুকুন্দ। কিন্তু এ কী দৃশ্য!–সাইকেলে সামনের রডে বসে আছে মুকুন্দ এবং যথাস্থানে আসন গ্রহণ করে তিরবেগে সাইকেল চুটিয়ে আসছেন অত্যন্ত রোগা ও দুর্বল চেহারার চশমাধারী এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
ভদ্রলোকের চেহারা যেমনই হোক, লোকটা খুব দুর্বল নয়। শশাঙ্ক নিজের মনেই বলল, মুকুন্দর মতো যা চেহারার জোয়ানকে নিয়ে যে-লোক এত জোরে সাইকেল চালাতে পারে, তাকে দেখতে যত রোগাই লাগুক, আসলে মানুষটা খুব দুর্বল নয়।
ততক্ষণে একেবারে সামনে এসে পড়েছে মুকুন্দ। সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক, এগিয়ে এল মুকুন্দ ক্যাপ্টেনের সামনে। খুব গম্ভীর হয়ে মুকুন্দের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, তোমার আর একটু দায়িত্বজ্ঞান থাকা উচিত ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যে এসে পড়েছ এটাই আশার কথা। আমাদের দলে এখন রয়েছি আমি আর মদন, সুতরাং আমাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। বাগনান ক্লাবের গদাইকে নিয়ে পাঁচজন খেলুড়ে মজুত। এখন মদনকে বসিয়ে ওর বদলে তুমি মাঠে নামবে। একবার চেষ্টা করে দেখি– তুমিই আমাদের শেষ ভরসা, মুকুন্দ।