নইলে কী করবেন? হেসে উঠল মুকুন্দ, মারবেন নাকি? আচ্ছা, আমার এই আঙুলটা বাঁকাতে পারবেন?
ত্রিবেদীর নাকের সামনে বুড়ো আঙুল তুলে ধরল মুকুন্দ।
ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী মেধাবী ছাত্র হিসাবে খুব ছোটোবেলা থেকেই গুরুজনদের এবং শিক্ষকমণ্ডলীর প্রশংসা পেয়েছেন। পরবর্তীকালে উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছেন। কিন্তু কোনোদিনই– এমন কি কিশোর বয়সেও কখনো তিনি হাতহাতি মারামারি করেননি। কখনো কখনো অবশ্য দুর্বিনীত ব্যক্তির সম্মুখীন হয়ে তিনি অনুভব করেছেন সময় বিশেষে মারামারি করার প্রয়োজন আছে। তবে দুর্বল ক্ষীণদেহ নিয়ে তার পূর্বোক্ত অনুভূতিকে বাস্তবে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হলে যে বিপদ ঘটতে পারে, সেটা বুঝেই দুর্জনের সঙ্গ পরিত্যাগ করে তিনি মাঝে-মাঝে সরে এসেছেন। ঐ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে তার অল্পবয়সে– বিজ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর প্রবীণ বয়সে কোনোদিনই তাকে অপ্রীতিকর অপমানজনক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। এখন হঠাৎ এই উদ্ধত যুবকের ব্যবহারে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, মকলের দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বদ্ধাঙ্গলি-প্রসারিত হস্তের কবজি চেপে ধরলেন তিনি, আঙুল বাঁকা করব না বৎস, গোটা শরীরটাকেই বাঁকিয়ে দিচ্ছি।
মুকুন্দের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে যে-ছেলেটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, ত্রিবেদী স্যারের বরাতে আজ দুর্গতি আছে- সে অবাক হয়ে দেখল মর্তিমান বিভীষিকা বিখ্যাত বাঘা মুকুন্দের মুখে ফুটে উঠেছে নিদারুণ যন্ত্রণার চিহ্ন! একবার ঝটকা মেরে সে হাতটাকে ত্রিবেদীর কবল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না… অবশেষে তার গলা থেকে বেরিয়ে এল কাতর আর্তনাদ, ছাড়ুন, ছাড়ুন, লাগছে!
ছেড়ে দেব? ত্রিবেদী খুব নিরীহভাবে জানতে চাইলেন, খুব লাগছে বুঝি? আচ্ছা, তবে ছেড়ে দিলাম।
পরক্ষণেই মুকুন্দর বিশাল দেহ সবেগে শূন্যে উঠে সশব্দে ছিটকে পড়ল মাটির উপর!
ত্রিবেদী বললেন, আচ্ছা, এইবার তুমি উঠে এসে আমার আঙুলটা বাঁকাও তো দেখি।
অতিকষ্টে উঠে বসে যাতনাবিকৃতস্বরে মুকুন্দ বলল, রক্ষে করুন মশাই। আমার নাম মুকুন্দ, লোকে বলে বাঘা মুকুন্দ– সেই বাঘকে আপনি এক আছাড়ে ছাগল বানিয়ে দিয়েছেন!
সে একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেই আবার আর্তনাদ করে বসে পড়ল। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল বটে, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না– দুই হাতে কোমর চেপে ধরে সে নিজেকে খাড়া রাখতে চেষ্টা করছিল এবং তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল অস্পষ্ট আর্তস্বর!
ত্রিবেদী নিজেও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, মুকুন্দের দুরবস্থা দেখে তার মায়া হল, এগিয়ে এসে তিনি বললেন, খুব লেগেছে?
লেগেছে মানে? বিকৃতস্বরে মুকুন্দ বলল, মনে হচ্ছে আমার কোমরের উপর এক ডজন হাতি ডন-বৈঠক দিচ্ছে! আপনি স্যার, আমার আর আমাদের পাড়ার সর্বনাশ করলেন- উঁহু!
তার মানে? ত্রিবেদী হতভম্ব, তোমার মতো জোয়ান ছেলে এই আঘাতের ফলে আর কতক্ষশ কাবু হয়ে থাকবে? আর পাড়ার কথা উঠছে কিসে? আমি তোমাদের পাড়ার কী সর্বনাশ করলাম?
–আজ আমাদের পাড়া অর্থাৎ গোলাপ কলোনির সঙ্গে বাগনান ক্লাবের কপাটি প্রতিযোগিতা আছে। আমি না খেললে আমাদের পাড়া নির্ঘাত হেরে যাবে। কিন্তু আপনি আছাড় মেরে আমার কোমর এমন মচকে দিয়েছেন যে, খেলা তো দূরের কথা, উঠে দাঁড়াতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
হ্যাঁ, স্যার সত্যি কথা, মুকুন্দের কবলমুক্ত হয়ে যে বালকটি এতক্ষণ বাঘা মুকুন্দ আর অধ্যাপক ত্রিবেদীর দ্বৈরথ উপভোগ করেছিল, সে এইবার বলে উঠল, মুকুন্দদা না খেললে আমরা নির্ঘাত কপাটি-ম্যাচে হেরে যাব। বাগনান ক্লাবের গদাই-এর গালে যেমন চাপদাড়ি, গায়েও তেমনি ভীষণ জোর। মুকুন্দদা ছাড়া কেউ তাকে এঁটে উঠতে পারে না।
তাই নাকি? ত্রিবেদী হাসলেন, কপাটি খেলা আমাদের জাতীয় খেলা। এইসব ব্যাপারে আমার ভারি উৎসাহ। মুকুন্দ, তুমি চিন্তা কোরো না, তোমার বদলে আজ আমিই খেলব। চলো, কোনদিকে তোমাদের কপাটি-খেলার মাঠ– আমি সাইকেল চালাচ্ছি, তুমি সামনের রডে বসে আমায় রাস্তা দেখাও।
৩. অধ্যাপক ত্রিবেদী ও খেলোয়াড় গদাই
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও খেলোয়াড় গদাই
কলকাতার কাছে গোলাপ কলোনি নামে এক শহরতলিতে এসে অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী এক আশ্চর্য-গাছ আবিষ্কার করেছেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে শরীরে অসাধারণ শক্তির সঞ্চার হয় বটে, কিন্তু পূর্বোক্ত আশ্চর্য-পাতার ভেষজ গুণ চিরস্থায়ী কিনা, অথবা সাময়িকভাবে স্থায়ী হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ, এবিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি অধ্যাপক ত্রিবেদী।
তিনি যেখানে থাকেন, সেই গোলাপ কলোনির সঙ্গে বাগনান ক্লাবের কপাটি-প্রতিযোগিতা শুরু হতে আর বিশেষ দেরি নেই, কিন্তু প্রধান খেলোয়াড় মুকন্দ ওরফে বাঘা মকলের অনুপস্থিতি গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিতে বোঝা যায় বাঘা মুকুন্দের ব্যাঘ্রবৎ বিক্রমের সহায়তা না পেলে গোলাপ কলোনিকে যে পরাজয়ের কলঙ্ক বহন করতে হবে এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
পল্টু নামে গোলাপ কলোনির এক খেলোয়াড় বলল, চারটে বাজতে আর দেরি নেই। চারটে থেকে খেলা শুরু। মুকুন্দ না এলে তো মহা মুশকিল।