খেলতে! আপনাকে। আমাদের সঙ্গে! একাধিক কণ্ঠে জাগল বিস্মিত কলরব, না স্যার। আপনি যে-দলে খেলবেন সেই দলই জিতবে। আপনার লাফের যা বহর দেখছি, তাতে অনুমান করছি আপনার শটু-এর ক্ষমতাও দারুণ–আমাদের সঙ্গে খেলে আপনি মজা পাবেন না। আপনি স্যার দয়া করে বলটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিন।
ত্রিবেদী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বেশ বলটা ধরো। তিনি ফুটবলটা ছুঁড়ে দিলেন এবং সবিস্ময়ে দেখলেন বলটা ক্রমশ ছোটো হয়ে শুন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ত্রিবেদী নিজের মনেই বলে উঠলেন, এ কী কাণ্ড! আমি তো খুব জোরে বলটা ছুড়িনি, তবু ওটা অত উপরে উঠে গেল! আশ্চর্য-পাতা আমার শরীরে এমন অসম্ভব শক্তি এনে দিয়েছে যে, আমি নিজেই চমকে যাচ্ছি!
ছেলের দলও বিলক্ষণ চমকে গিয়েছিল, তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে সাগ্রহে লক্ষ করছিল, ফুটবলের অবতরণ-পর্ব- বল মাটিতে পড়ার আগেই তাকে ধরে ফেলার জন্য প্রস্তুত হল কয়েকজন খেলোয়াড়।
কিন্তু সকলের প্রস্তুতি ব্যর্থ করে ফুটবলটা মাঠ ডিঙিয়ে এত দুরে চলে গেল যে, প্রাণপণে ছুটেও খেলোয়াড়রা তার নাগাল পেল না। খেলার মাঠের পেছন দিক দিয়ে যে পথটা চলে গেছে, সেই পথের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে সাইকেল চার্লিয়ে ছুটে আসছিল এক যুবক–বলটা এসে পড়ল তার ঘাড়ে এবং অতর্কিত আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে সাইকেল সমেত আরোহী হল ধরাপৃষ্ঠে লম্বমান!
সশব্দে শ্বাস টেনে একটি ছেলে বলে উঠল, সর্বনাশ! এ যে বাঘা মুকুন্দ! শিগগির পালা, ধরতে পারলে পিটিয়ে ছাতু করে ফেলবে।
পরামর্শ গৃহীত হল তৎক্ষণাৎ। মুহূর্তের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছেলের দল যে-যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করল তিরবেগে!
ধরাশায়ী যুবক সাইকেল ফেলে এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর তাড়া করে ধরে ফেলল একটি ছেলেকে। ভয়ে বেচারার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি তোমার গায়ে বল ফেলিনি মুকুন্দদা। আমার দোষ নেই, আমাকে ছেড়ে দাও।
জ্বলন্ত চক্ষে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মুকুন্দ বলল, হতে পারে তুই বল ফেলিসনি, কিন্তু যে ফেলেছে তার নামটা বলে ফ্যা। আজ না-হোক কাল তাকে নির্ঘাত ধরতে পারব। হতভাগার দল, রাস্তা দিয়ে তোক চলাচল করে, খেয়াল নেই?
ছেলেটিকে সজোরে এক ঝাঁকুনি দিয়ে মুকুন্দ বলল, বোবা থেকে নিস্তার পাবি না। শিগগির বল কে ফেলেছে ফুটবল আমার ঘাড়ে, নইলে—
বাক্য অসমাপ্ত রেখে হাতের ভঙ্গিতে মুকুন্দ বুঝিয়ে দিল অপরাধীর নাম না বললে ধৃত বালকের ভাগ্যে জুটবে অশেষ লাঞ্ছনা।
কাঁদো কাঁদো হয়ে ছেলেটি বলল, ওই যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ওইখানে, উনিই বলটা ফেলেছেন তোমার ঘাড়ে!
ছেলেটির নির্দেশ অনুসারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে মুকুন্দ দেখল নিতান্ত নিরীহ গোছের একটি রোগা চেহারার ভদ্রলোক তাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। এমন একটি বয়স্ক মানুষ ফুটবলের আঘাতে তাকে কাবু করেছেন বলে ভাবতে পারল না মুকুন্দ, ছেলেটিকে আর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে বলল, ফের মিছে কথা? চড়-চাপড় না পড়লে সত্যি কথাটা বেরুবে না দেখছি। বাঁচতে চাস তো বল সত্যি কথা।
আহা! ছোটো ছেলেকে মারধর করছ কেন? ও সত্যি কথাই বলেছে, ত্রিবেদী ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছেন, বলটা আমিই ছুঁড়েছিলাম বটে। তবে তুমি যে ওই সময়ে ওইখান দিয়েই সাইকেল চার্লিয়ে আসবে সেকথাটা জানা ছিল না তত তাই অঘটন ঘটে গেছে। ইচ্ছে করে কেউ কারও ঘাড়ে বল ফেলে না এটা তোমার বোঝা উচিত।
অ! ছেলেটিকে ছেড়ে দুই হাত কোমরে রেখে মুকুন্দ এবার ত্রিবেদীর দিকে ভালোভাবে চেয়ে দেখল, আপনার নাম তো ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী? পাড়ায় নতুন এসেছেন? কী সব বিজ্ঞান-টিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন শুনেছিলাম। তা ওইসব নিয়ে তো বেশ ছিলেন, এখন হঠাৎ শিং ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়েছেন? তো ভিড়েছেন, ভিড়েছেন, ভালোই করেছেন কিন্তু চোখেও কি দেখতে পান না? নাকি চারটে চোখেও চলছে না, অ্যাঁ?
মুকুন্দের দিকে তাকালেন ত্রিবেদী- চাপা গোল গলার গেঞ্জির ভিতর দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছে চ্যাটালো বুক, দুই হাতের স্ফীত পেশিগুলোর দিকে একনজর তাকালেই বোঝা যায় নিয়মিত ব্যায়াম না করলে এমন চেহারা হয় না– অধমাঙ্গে শর্টস বা হাফ-প্যান্টের তলা থেকে উরু এবং পায়ের দৃঢ়বদ্ধ মাংসপেশি জানিয়ে দিচ্ছে যুবকটি উর্ধ্বাঙ্গের ন্যায় নিম্নাঙ্গের পেশীগুলির উন্নতি সাধনেও অতিশয় তৎপর! ত্রিবেদী বুঝলেন তার সামনে দণ্ডায়মান যুবকটি একজন ব্যায়ামবীর; তার পেশিপুষ্ট বিশাল দেহের দিকে তাকিয়ে তিনি দস্তুরমতো দমে গেলেন। পরক্ষণেই তার মনে হল আশ্চর্য-পাতার আশ্চর্য ক্ষমতা বোধ হয় তার মধ্যে এখনো জাগ্রত, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ত্রিবেদী অনুভব করলেন তার দেহের শিরায় শিরায় ছুটছে অসীম শক্তির তরঙ্গ; কিন্তু এই প্রকাণ্ড দৈত্যের সঙ্গে তিনি কি লড়তে পারবেন?… হঠাই তার মনে পড়ে গেল দুদিন আগের ঘটনা এক পদাঘাতে একটা কুকুরের মৃতদেহকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সামনে দাঁড়ানো দৈত্যটার পক্ষেও ওই কাজ করা কি সম্ভব? মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললেন ত্রিবেদী, যা হয় হবে- আশ্চর্য পাতার ক্ষমতা পরখ করার উপযুক্ত পরিস্থিতি এবং সুযোগ তাঁর সামনে উপস্থিত, এই সুযোগ অবহেলা করা উচিত নয়। সুতরাং মুকুন্দের চোখের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর যথাসম্ভব গুরুগম্ভীর করতে সচেষ্ট হলেন ত্রিবেদী, ভদ্রভাবে কথা বলো, নইলে–