জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনা আমাজন নদীর ধার থেকে সংগৃহীত যে গাছের পাতা আমাকে দেখিয়েছিলেন, এখানে বাগচী মশাই-এর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে হানাবাড়ির মধ্যে ঠিক সেইরকম পাতার গাছ আমি দেখতে পেয়েছিলাম। ওই পাতা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার জন্যই এই পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিলাম। কিন্তু লোকের সামনে ওই গাছের পাতা সংগ্রহ করতে গেলে লোকে হয়তো আমাকে পাগল ভাবত তার চেয়েও বিপদের কথা, কোনো চেনা লোক আমাকে পাতা ছিঁড়তে দেখলে ওই পাতা সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়ত, আর তার ফলে নানাধরনের অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি নাজেহাল হয়ে পড়তাম। তারপর ভেবে দেখলাম বেশি রাত্রে অথবা খুব ভোরে ওই পথে যখন লোক চলাচল বিশেষ থাকে না, সেই সময়ই কাজ হাসিল করতে হবে। আজ খুব সকালে গোবিন্দকে বাড়ির পথে রওনা করে দিয়ে আবার হানাবাড়িতে হানা দিয়ে আমি ওই পাতা অনেকগুলো জোগাড় করে এনেছি। পরে বুঝলাম বুবুসোনা যে-পাতা আমাকে দেখিয়েছিলেন, এগুলোর সঙ্গে বুবুসোনার নমুনার সাদৃশ্য থাকলেও হানাবাড়ির গাছের পাতা বুবুলোনার সংগৃহীত নমুনার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। বুবুলোনা তাঁর গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখেছেন কয়েকটা বিশেষ ধরনের বস্তু ওই পাতার সঙ্গে মিশিয়ে যে-নির্যাস তরি হয়, সেই মিশ্রিত তরল পদার্থ পান করলে কিছুক্ষণের জন্য অসীম শক্তির অধিকারী হওয়া যায়। হানাবাড়ি থেকে যে-পাতা আমি এনেছি, সেগুলো পিষে রস করে তার সঙ্গে বুবুলোনার ফরমুলার জিনিস মিশিয়ে পান করলে কোনো ফল পাওয়া যায় না কিন্তু ওই পাতা কাঁচা অবস্থায় খেলে শরীরে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার আসে। বেড়ালটা দুধের সঙ্গে নিশ্চয়ই কয়েকটা দুধমাখা পাতা খেয়ে ফেলেছিল, তাই তার থাবার আঘাতে কুকুরটার অমন দুর্দশা। আমিও খাওয়ার সময়ে অন্যমনস্ক হয়ে কয়েকটা পাতা চিবিয়ে ফেলেছিলাম– তাতেই আমার দেহে এমন অমানুষিক শক্তির সঞ্চার হল যে, অতবড় কুকুরটা আমার লাথিতে প্রায় বিশ-পঁচিশ হাত দুরে ছিটকে পড়ল!… প্রথমে আমিও হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি। সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছি। এখনও আমার সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার অনুভব করছি। কিন্তু কতক্ষণ? আর কতক্ষণ স্থায়ী হবে আশ্চর্য-পাতার এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা?
আমাদরও প্রশ্ন আশ্চর্য-পাতার ক্ষমতা কতক্ষণ স্থায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে পরবর্তী কাহিনি– অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ!
২. অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ
তোমরা যারা আগের কাহিনি অধ্যাপক ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল পাঠ করেছ, সেই পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই জানো উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী কলকাতার নিকটবর্তী একটি শরতলিতে এক আশ্চর্য গাছ আবিষ্কার করেছেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে শরীরে অসাধারণ শক্তির উদ্ভব হয়। কিন্তু সেই আশ্চর্য পাতার ভেষজ গুণে সঞ্চারিত আশ্চর্য শক্তি কতক্ষণ স্থায়ী, সেকথা এখনও জানতে পারেননি অধ্যাপক ত্রিবেদী। সেদিন সকালবেলা ওই আশ্চর্য পাতা কয়েকটি ভক্ষণ করে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন অধ্যাপক মহাশয় এবং সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার অনুভব করতে করতে পরমানন্দে পদচালনা করছিলেন। ত্রিবেদীর পা দুটির সঙ্গে সমতা রেখে তার মস্তিষ্ক ছিল সমান সক্রিয় অর্থাৎ পদচালনা করতে করতেই ত্রিবেদী মনে মনে চিন্তা করছিলেন- একঘণ্টা হল কয়েকটি আশ্চর্য-পাতা খেয়েছি; এখনও শরীরে প্রচণ্ড শক্তি অনুভব করছি। কিন্তু কতক্ষণ পর্যন্ত এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা বজায় থাকবে সেইটা জানা দরকার। ওই যে ওখানে কয়েকটা ছোটো ছেলে ফুটবল খেলছে, ওদের সঙ্গে খেললে আশ্চর্য-পাতার শক্তি কিছুটা পরখ করা যায়… আরে! আরে! বলটা যে এইদিকেই আসছে!
হ্যাঁ, সামনের মাঠে কয়েকটা ছেলে ফুটবল খেলছে বটে, তাদের দিকেই অগ্রসর হলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। হঠাৎ একজন খেলোয়াড়ের প্রবল পদাঘাতে বলটা খুব উঁচুতে উঠে শূন্য-পথে পাশের পুকুরের দিকে রওনা হল। যে ছেলেটি বলে লাথি মেরেছিল, সে সক্ষোভে বলে উঠল, ঈস! বড় জোরে হয়ে গেল!
আর একজন খেলোয়াড় বলল, আবার তুই বলটা পুকুরে ফেললি। কিন্তু না, বলটা পুকুরের দিকে রওনা দিলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারল না– এক লাফ মেরে শূন্যপথেই পলাতক ফুটবলকে গ্রেপ্তার করে ফেললেন ত্রিবেদী!
বালক খেলোয়াড়ের দল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ– কোনো মানুষ যে মাটি থেকে হঠাৎ লাফিয়ে আট-দশ ফুট উঁচুতে উঠে শূন্যপথে ধাবমান একটি ফুটবলকে ধরে ফেলতে পারে, এমন অবিশ্বাস্য আশ্চর্য ব্যাপার তারা চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিশেষত আগন্তুক ভদ্রলোক বয়স্ক মানুষ তার চেয়ে অনেক কমবয়সী কোনো যুবকের পক্ষেও এমন হনুমান-সদৃশ লম্ফপ্রদান অসম্ভব সুতরাং ছেলের দল চমকে গিয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথাই কইতে পারল না।
অবশেষে একজন খেলোয়াড়ের গলায় স্বর ফুটল, ইয়ে আপনি স্যার দারুণ লাফাতে পারেন তো!
আর একজন বলল, হাই জাম্প কমপিটিশনে নামলে আপনি সারা দুনিয়াকে চমকে দিতে পারেন।
হয়তো পারি, ত্রিবেদী হাসলেন, তবে আপাতত সেরকম কোনো ইচ্ছা আমার নেই। বরং তোমরা যদি আমাকে খেলতে নাও, তাহলে আমি খুশি হব।