বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই, গজগজ করতে করতে দ্রুত পদক্ষেপে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে একতলার বৈঠকখানায় উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অভাবিত দৃশ্য–
খোলা দরজার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ভৃত্য সনাতন এবং ঘরের মধ্যে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে একটা মস্ত বড়ো কুকুর!
পায়ে পায়ে এগিয়ে কুকুরটার শায়িত দেহের সামনে এসে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন কুকুরটা জীবিত নেই তার বাঁ চোখের তলা থেকে গলা পর্যন্ত হাঁ করে আছে একটা গভীর ও সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন এবং সেই ক্ষত থেকে রক্তধারা ঝরে ঘরের মেঝেটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
ত্রিবেদী কিছুক্ষণ কথা কইতে পারলেন না, তারপর যখন কণ্ঠস্বর কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে এল, তখন ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, কী সাংঘাতিক কাণ্ড! কুকুরটাকে এমনভাবে খুন করে ঘরের মধ্যে ফেলে গেল কে?
সনাতনের মানসিক অবস্থাও তার প্রভুর চাইতে ভালো নয়, তবু সে অধ্যাপকের প্রশ্নের উত্তর দিতে সচেষ্ট হল, কুকুরটাকে কেউ ঘরের মধ্যে ফেলে যায়নি, বাবু। আমি ঘরে ঢুকে একটা কালো বেড়ালকে বসে থাকতে দেখনু। আমি জানতাম ওটা কুকুরের তাড়া খেয়ে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে; তাই ওটাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দরজা খুলে যেই না চিঠির বাসকো দেখতে গিছি, অমনি এই হতভাগা কুকুর ঘরে ঢুকে বেড়ালটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেড়ালটা প্রথমে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু বন্ধ ঘরে পালাবে কোথায়? দরজাটা আমি খুলে দিয়েছিলাম বটে, কিন্ত সেই রাস্তা আগলে রেখেছিল কুকুরটা- ওদিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করলেই ঘ্যাক করে বেড়ালের ঘাড় কামড়ে কুকুরটা তাকে মেরে ফেলত। বেড়াল যখন দেখল পালিয়ে জান বাঁচানো যাবে না, তখন রুখে দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে মারল এক থাপ্পড়। উরি বাস সে কী থাপ্পড়! কুকুরটা একবার কাতরে উঠেই এলিয়ে পড়ল আর বেড়ালটাও দরজা খোলা পেয়ে এক দৌড়ে হাওয়া!
বলিস কী সনাতন, ত্রিবেদী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, বেড়ালের থাবায় কুকুরের এমন অবস্থা হতে পারে? বেড়াল বাঘের মাসি বটে, কিন্তু তার থাবা তত বাঘের মতো ভয়ংকর নয়। চোয়াল থেকে গলা অবধি ছিঁড়ে রক্তের বান ডেকেছে, বেড়ালের থাবায় এমন রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটতে পারে না। তুই নিশ্চয় কুকুরটাকে মেরে বেড়ালের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস।
কী যে বলেন বাবু, সনাতন রেগে গেল, এমন রক্তারক্তি করতে গেলে তোয়াল কিংবা ভোজালির কোপ বসাতে হয় এ বাড়িতে তো সেসব কিছু নেই, থাকার মধ্যে আছে দুগাছা লাঠি। তাই দিয়ে কি এমনভাবে ঘাড়-গলা-চোয়াল পেঁচিয়ে কাটা যায়?
তাহলে কি বলছিস বেড়ালের থাবার নখ লেগে কুকুরটার এমন দুরবস্থা হয়েছে? ত্রিবেদীর কণ্ঠে অবিশ্বাস, এটা কি বিশ্বাস করার মতো কথা?
হঃ আমি যা দেখনু, তাই বলনু। বেড়ালটা কুচকুচে কালো। কালো বেড়ালের উপর ভূতের ভর হয়, জানেন? ওটাতেও নিচ্চয় ভূতে ভর করেছিল! নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না যে, বেড়ালে এমনভাবে কুকুর মারতে পারে। ওঃ বাবু, আপনি তো দেখেননি– সে কী বিষম থাপ্পড়! কুকুরটা একবার ডেকে উঠেই চোখ উলটে শুয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে মিত্যু! একে দুপুরবেলা, সামনে রয়েছে হানাবাড়ি, তার উপর বেড়ালের রং কুচকুচে কালো- একেবারে তেরোস্পর্শ যোগ। কথায় বলে ঠিক দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা! নিয্যস ওই কালো বেড়ালটার উপর ভূতের ভর হয়েছিল। ভাগ্যি ভালো, কুকুরের উপর দিয়েই চোটচ গেছে- আমি যদি বেড়ালটাকে তাড়া দিতাম, তাহলে আমারও দশা হতো কুকুরটার মতো।
ওঃ! আবার হানাবাড়ি আর ভূত! ক্রোধে ফেটে পড়লেন ত্রিবেদী, আজকের দিনটাই খারাপ। কুকুর, বেড়াল আর তোর মতো ভূত নিয়ে সকালটা পণ্ড সরিয়ে নে এই কুকুরটাকে।
সজোরে কুকুরটাকে এক লাথি মারলেন ত্রিবেদী। পরক্ষণেই যা ঘটল তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি তার লাথি খেয়ে কুকুরের মৃতদেহটা খোলা দরজা দিয়ে তিরবেগে বেরিয়ে গেল এবং শুন্যপথে অনেকগুলো ডিগবাজি খেয়ে প্রায় তিরিশ হাত দূরে ছিটকে পড়ল! ভাগ্যিস পথে লোকজন ছিল না- নইলে, মৃত কুকুরের এমন বিদ্যুৎগতিতে শূন্য পথ ভ্রমণের কোনো বিশ্বাসযোণ্য কারণ দেখাতে পারতেন না অধ্যাপক মহাশয়!
এই কল্পনাতীত কাণ্ড দেখে সনাতনের চোখ কপালে উঠে গেল, সশব্দে শ্বাসগ্রহণ করে সে বলে উঠল, আরে ব্বাস! আপনার দেহে যে এমন ভীমের শক্তি তা তো জানতাম নি! এক লাথিতে অতবড়ো কুকুরটাকে আপনি বিশ হাত দূরে ছিটকে ফেইলে দিলেন।
য্যাঁ, তাড়াতাড়ি বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করলেন ত্রিবেদী, হ্যাঁ, বুঝেছি… ইয়ে হয়েছে সনাতন.. আমার গায়ের জোর একটু বেশি… তা ইয়ে হয়েছে, মানে শোন… তুই এবার একটু বিশ্রাম কর, দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নেওয়া ভালো… আবার দাঁড়িয়ে রইলি কেন?… যা, যা, শুয়ে পড়।
সনাতন অবাক হয়ে বাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল তার নিতান্ত রোগা ও নিরীহ প্রকৃতির মনিবটি যে এমন প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী, তা সে চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। ত্রিবেদী আর একবার তাড়া দিতেই সে নিজের ঘরে বিছানাটির উদ্দেশ্যে প্রস্থান করল…
সনাতন চলে যেতেই অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী সমস্ত ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন– এতক্ষণে তিনি বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে প্রকৃতিস্থ হয়েছেন এবং তাঁর মস্তিষ্ক দস্তুরমতে সক্রিয় হয়ে চিন্তার জাল বুনতে শুরু করেছে–