ত্রিবেদী হাঁক ছাড়লেন, সনাতন! অ্যাই সনাতন!
উত্তর এল, যাই বাবু।
–এখানে আসতে হবে না। বাড়ির সামনে একটা কুকুর, ভীষণ চ্যাচাচ্ছে। ওটাকে তাড়িয়ে দে। যদি সহজে যেতে না চায়, তাহলে লাঠিপেটা করে বিদায় কর। যত সব আপদ- স্থির হয়ে যে একটু কাজ করব, তার উপায় নেই।
নেপথ্য থেকে উত্তর এল, কুকুরের তাড়া খেয়ে নিচের জানালা দিয়ে একটা বেড়াল ঘরে ঢুকেছে। ওটাকে ধরতে না পেরে কুকুরটা চাঁচাচ্ছে। এখন আর আপনাকে কাজ করতে হবেকনি। বেলা হইছে, খাতি আসেন।
-আচ্ছা, আচ্ছা, এখনই যাচ্ছি।
-হ, তাড়াতাড়ি আসেন।
ত্রিবেদী হাতের টিউবটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলেন, একটু ইতস্তত করে টিউবের তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিলেন। হাতঘড়িটা চোখের উপর তুলে ভাবতে লাগলেন- জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনা আমাকে যে ফরমুলা দিয়েছিলেন, সেই ফরমুলা অনুসারেই তো এই মিকশ্চার তৈরি করেছি। যে-নমুনা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, হানাবাড়িতে তো ঠিক সেই বস্তুটি পেয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। তাগাসাকি বলেছেন পনেরো মিনিট পরেই ফল পাওয়া যায়, আমি না-হয় আধঘণ্টা অপেক্ষা করব।
একতলা থেকে সনাতনের উচ্চকণ্ঠ ভেসে এল, আপনাকে নিয়ে আর পারি না বাবু। কাজ থাকলে তো ফল-মিষ্টি আর দুধ ছাড়া কিছু খান না। তা-ও যদি সময়মতো না খান, তাহলে শরীর থাকবে কি করে?… আবার দেখছি খাবার টেবিলে কতগুলো গাছের পাতা রেখে গেছেন এগুলো কি হবে?
ওগুলো নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না, ত্রিবেদী চেঁচিয়ে উঠলেন, এইবার খেয়ে নেব। পরে হয়তো খাওয়ার সময় পাব না। তুই তাড়াতাড়ি খেতে দে।
তিক্তস্বরে উত্তর এল, অনেকক্ষণ দিয়েছি।
খাবার টেবিলের সামনে চেয়ারের উপর আসন গ্রহণ করতে করতে ত্রিবেদী বললেন, অনেক বেলা হয়েছে, তুই এইবার খেতে যা, সনাতন। আমি তো শুধু ফল-মিষ্টি আর দুধ খাব, পরিবেশনের ঝামেলা নেই। তোর খাওয়া হলে চিঠির বাক্সটা দেখবি, চিঠি আসতে পারে।
সনাতনের গমনপথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ত্রিবেদী এবার কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন, আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে। সনাতনটাও খেতে গেছে, এই সুযোগে পরখ করে দেখি।
ডাইনিং টেবিল অর্থাৎ খাবার টেবিলটা দুহাতে ধরে সেটাকে ভোলার চেষ্টা করলেন ত্রিবেদী; টেবিল নড়ল না। আবার চেষ্টা করলেন তিনি, এবারও তার চেষ্টা সফল হল না– টেবিল তখনও স্থাণু, নট নড়নচড়ন ন কিছু!
ত্রিবেদীর ভ্রূ কুঁচকে গেল, এ কী হল! টেবিল একটুও নড়ল না! কিন্তু প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনার নমুনা তো এইরকমই ছিল মনে হচ্ছে। তার দেওয়া ফরমুলা মিলিয়েই তো সব করেছি– তবে?… আচ্ছা, নোটবইটা প্যান্টের পকেটেই রয়েছে, খেতে খেতে বরং আর একবার ফরমুলাটা দেখি… নাঃ, সব তো ঠিকই আছে দেখছি, কোথাও তো ভুল হয়নি… তাহলে.. তাহলে কি এটা আসল জিনিস নয়? তাগাসাকি বলেছিলেন আমাজন নদীর অববাহিকায় এই জিনিস তিনি পেয়েছিলেন। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বিচরণ করেছেন তিনি, কিন্তু ওই বস্তুটি তিনি কোথাও দেখতে পাননি, এমনকি আফ্রিকার গভীর অরণ্যেও নয়- আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটা জায়গায় ওই ধরনের গাছ তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু সেগুলো পরীক্ষার সুযোগ–ঈঃ! থু! থু!
অন্যমনস্ক হয়ে ফল খেতে খেতে টেবিলের উপর পড়ে-থাকা গাছের পাতাগুলোর উপর ত্রিবেদীর হাত পড়ে যায়, নোটবুকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ত্রিবেদী কয়েকটা পাতা তুলে মুখে ফেলে দেন, পরক্ষণেই অতিশয় কটু তিক্তরসে পরিপূর্ণ হয়ে যায় তার মুখগহ্বর- ঈস! কী তেতো রে বাবা! অন্যমনস্ক হয়ে কয়েকটা পাতা মুখে দিয়ে ফেলেছি… ওই যাঃ!
আবার এক অভাবিত দুর্ঘটনা! হঠাৎ তাঁর হাতের ধাক্কা লেগে উলটে গেল দুধের গেলাস! টেবিলের উপর পাতার রাশি ভিজিয়ে ছুটল দুগ্ধস্রোত! সেই অমল ধবল তরল স্রোতের দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে ত্রিবেদী যখন তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করছেন, সেই সময় হঠাৎ জানালার ফাঁক গলে অকুস্থলে উপস্থিত হল একটি কালো বিড়াল। ত্রিবেদীর দিকে এক নজর তাকিয়ে বিড়াল বুঝে নিল এই লোকটি তেমন বিপজ্জনক হবে না। অতএব একলাফে জানলা থেকে টেবিলে উঠে সে বহমান দুগ্ধস্রোতের স্বাদগ্রহণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল…
ত্রিবেদী সম্পর্কে বিড়ালের চরিত্র-বিশ্লেষণ ছিল নির্ভুল, ত্রিবেদী তাকে একবারও তাড়া দিলেন না, দুগ্ধপানে নিবিষ্টচিত্ত মার্জারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, কোথা থেকে একটা কালো বেড়াল এসে জুটেছে!… ওহো, একটু আগে সনাতন বলছিল বটে কুকুরের তাড়া খেয়ে একটা বেড়াল একতলার জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। নিচের তলায় অন্যান্য ঘরে ঘোরাঘুরি করতে করতে বেড়ালটা বোধহয় দুধের গন্ধ পেয়ে এই ঘরে হানা দিয়েছে… তা খাক, দুধটা তো আর আমি খেতে পারলাম না, ও-ই খা… আমি বরং একটু বিশ্রাম করি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল, সব পরিশ্রম ব্যর্থ।
খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে অন্য ঘরে একটা সোফার উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী…
ভোক! ভৌউ-উ! ভোঃ- কাঁঈঈঈ!
আচম্বিতে একটা কুকুরের তীব্র ক্রুদ্ধ চিৎকার তন্দ্রাচ্ছন্ন ত্রিবেদীকে জাগিয়ে দিল- পরমুহূর্তেই ক্রুদ্ধ গর্জন পরিণত হল সুদীর্ঘ আর্তনাদে!
একলাফে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। কুকুরের আর্তনাদ তখন থেমে গেছে। বিস্মিত ও বিমূঢ় ত্রিবেদীর মনে হল আওয়াজটা যেন এই বাড়ির একতলা থেকেই এসেছে!