বরেনবাবু এগিয়ে গিয়ে গজুর শরীর থেকে দুটো শুঁড় টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করলেন। হলুদ রাক্ষস তার বন্ধন শিথিল করল না। বরেনবাবুর ভ্রূ কুঁচকে গেল, পিচকারিটা মেঝের উপর রেখে হলুদ রাক্ষসের বাহু ধরে সজোরে এক টান মারলেন। হলুদ রাক্ষসের যে শুড় বা বাহুটা গজুর গলা জড়িয়ে ধরেছিল, প্রবল আকর্ষণে সেটা খুলে গেল গলা থেকে সঙ্গে সঙ্গে গজুর ঘাড় ও গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ল তপ্ত রক্তের ধারা! ত্রিবেদী বুঝলেন শোষক যন্ত্রগুলি গজুর ঘাড় ও গলা ছেদা করে রক্তপান করছিল, বরেনবাবুর প্রচণ্ড আকর্ষণে বাহুর সঙ্গে সংলগ্ন শোষকযন্ত্রগুলিও সরে এসেছে তাই হঠাৎ ক্ষতস্থানগুলোর মুখ খুলে গিয়ে ছিদ্রপথে রক্তধারা ছিটকে পড়ছে বাইরে।
দুইহাতে বাহুটাকে চেপে রেখেই বরেনবাবু তীব্রকণ্ঠে বললেন, ছেড়ে দে রাক্ষস ছেড়ে দে! বলার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বাহুকে সবলে পা দিয়ে চেপে ধরলেন তিনি। ফল হল তৎক্ষণাৎ গজুকে ছেড়ে ওই দুটি বাহু সাপের মতো কিলবিল করে জড়িয়ে ধরল বরেনবাবুকে!
কী! এত বড়ো স্পর্ধা! ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে পিচকারিটা মেঝে থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন বরেনবাবু।
তার চেষ্টা ব্যর্থ হল– আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে ত্রিবেদী দেখলেন বরেনবাবুকে জড়িয়ে ধরেছে হলুদ রাক্ষসের আরও কয়েকটি বাহু! ছেড়ে দে! ছেড়ে দে আমাকে!বরেনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন।
হলুদ রাক্ষস তার আদেশ পালন করল না। বরেনবাবুর দেহের উপর গুঁড়ে বন্ধনগুলো যে আরও কঠিন হয়ে চেপে বসছে, তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল। ত্রিবেদীর মনে হল সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় তিনি একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছেন– দারুণ আতঙ্কে তার সর্বাঙ্গ হয়ে গেল অসাড়, নড়াচড়া করার ক্ষমতাও তার রইল না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ তিলু? চিৎকার করে উঠলেন বরেনবাবু, পিচকারিটা তুলে নাও। রাক্ষসটা খেপে গেছে, ও এখন আমায় হত্যা করে রক্তপান করতে চায়। তাড়াতাড়ি করো; আমাকে বাঁচাতে চাও তো পিচকারি ছুঁড়ে ওর মর্মস্থানে আঘাত হানো। শুঁড়গুলো ছেড়ে ওর–
পরক্ষণেই একটা শুঁড় বরেনবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে তাঁর কণ্ঠরোধ করে দিল।
বন্ধুর বিপন্ন কণ্ঠস্বর মুহূর্তের মধ্যে ত্রিবেদীর সম্বিৎ ফিরিয়ে দিল, তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল তার বিকল স্নায়ু, নিচু হয়ে মেঝে থেকে পিচকারিটা তুলে নিলেন তিনি বন্ধুর অসমাপ্ত বাক্য থেকেই তাঁর বক্তব্য বুঝতে পেরেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী- পিচকারি তুলে তিনি নিশানা স্থির করতে লাগলেন…
সপাৎ করে একটা সর্পিল বাহু তাঁর একটা পা জড়িয়ে ধরল, আর একটা বাহু বেষ্টন করল তার কোমর- ত্রিবেদী বিচলিত হলেন না, হলুদ রাক্ষসের বাহুবন্ধন তার শরীরে চেপে বসার আগেই তিনি গাছের মূল কাণ্ড বা গুঁড়ি লক্ষ্য করে পিচকারি ছুড়লেন। একটি তরল পদার্থ পিচকারির মুখ থেকে ছুটে গেল নির্ভুল নিশানায়। গাছের যে-জায়গাটা তরল পদার্থটি ভিজিয়ে দিয়েছিল, সেই জায়গা থেকে উঠে এল খানিকটা নীলাভ ধোঁয়া!
পিচকারির হাতলটা এবার সম্পূর্ণ টেনে নিয়ে সজোরে চাপ দিলেন ত্রিবেদী- তরল নির্যাসের ধারা গাছের গুঁড়িটাকে ভিজিয়ে দিয়ে আবার ছড়িয়ে দিল নীলাভ ধোঁয়ার কুণ্ডলী! ত্রিবেদী আবার হাতল টেনে সজোরে চাপ দিলেন, কিন্তু পিচকারির মুখ থেকে আর তরল মৃত্যুবাণ শত্রুর দিকে ছুটে গেল না- পিচকারির গর্ভ এখন শূন্য, তরল বস্তুটি নিঃশেষে ফুরিয়ে গেছে।
আর দরকার নেই তিলু বরেনবাবুর শরীর থেকে তখন খুলে গেছে শুড়ের বাঁধন, মেঝের উপর বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, সমস্ত নির্যাসটাই তুমি ঢেলে দিয়েছ। আর ঢেলেছ একবারে মর্মস্থানে। হলুদ রাক্ষসের মৃত্যু হয়েছে। সে আর কখনো কোনো প্রাণীর রক্তপান করতে চাইবে না।
মৃত্যু হয়েছে?
হ্যাঁ, প্রচুর পরিমাণে তীব্র বিষ মর্মস্থল ভেদ করেছে। ওই নিদারুণ আঘাত সামলে উঠতে পারেনি হলুদ রাক্ষস। আমার হাতে পিচকারি থাকলে গাছের গোড়ায় একটুখানি ছিটিয়ে দিতাম। তাতেই কাজ হত, গাছটা ওর শুড় বা বাহুগুলো গুটিয়ে নিত। ওকে হত্যা করার প্রয়োজন হত না।
অত পরিমাণ মেপে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তুমি বলেছিলে হলুদ রাক্ষস তোমায় ভালোবাসে। সে নাকি পিচাকরির বিষাক্ত নির্যাসে আহত হয়েও তোমাকে কখনো আক্রমণ করেনি; কিন্তু আজ যদি আমি পিচকারি ছুঁড়ে ওকে বধ না করতাম তাহলে হলুদ রাক্ষসের কবলে তোমার মৃত্যু ছিল অবধারিত। এই গাছটাকে হলুদ রাক্ষস নামটা তুমি ভালোই দিয়েছিলে। এমন সার্থকনামা জীব খুব কমই দেখা যায়। ওটা রাক্ষসের মতোই হিংস্র। রক্তলোলুপ। যে-কোনো কারণেই হোক, গাছটা আগে তোমায় আক্রমণ করেনি, আজ সুযোগ বুঝে শোণিত তৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে ও তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তুমি মনে করেছ ও তোমায় ভালোবাসত? ফুঃ! রাক্ষসের আবার ভালোবাসা!
না, তিলু,বরেনবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন, গাছটা সত্যিই আমায় ভালোবাসত। কিন্তু গুলি আর ছুরিতে আহত হয়ে ওর হিংস্র স্বভাব আরও হিংস্র হয়ে উঠেছিল, তার উপর রক্তের নেশায় ও উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল, আপন-পর জ্ঞান আর ওর ছিল না। তুমি কি জানো না, সার্কাসের পোষা বাঘও অনেক সময় রিং মাস্টারকে হত্যা করে? হিংস্র শাপদের বন্য সংস্কার কিছুক্ষণের জন্য তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। তাই বলে তার ভালোবাসা কি মিথ্যে? না, তিলু, না।