চোখ খুলে কাঁপা কাঁপা গলায় সাড়া দিল গোবিন্দ, হ্যাঁ, স্যার। আমি জুজ-জেগে আছি স্যার।
কী কাণ্ড! ত্রিবেদীর গলা খুবই স্বাভাবিক, তাহলে এতক্ষণ আর যন্ত্রণা ভোগ করলাম কেন? আমি ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ, তাই আর তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি। যাক, তুমি যখন জেগেই আছ তখন একটা কাজ করো আমার পিঠের এই জায়গাটা একটু চুলকে দাও–
ত্রিবেদী পিছন ফিরে পিঠের একটা জায়গায় হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন, ওই জায়গাটায় কিছুতেই আমার হাত যাচ্ছে না।
বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে গোবিন্দ বলল, আ-আ-আপনি পি-পি-পিঠ চুলকাতে চেষ্টা করছিলেন?
-হ্যাঁ, গোবিন্দ। কখন থেকে চেষ্টা করছি, ঠিক জায়গায় কিছুতেই হাত যাচ্ছে না… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক জায়গায় তুমি হাত দিয়েছ গোবিন্দ… বাঃ, ভালো করে চুলকে দাও, ভালো করে…হ্যাঁ, জোরে আরও জোরে আঃ! কি আরাম! কি আরাম।…
ভোরবেলা হানাবাড়ির দরজা খুলে বাইরে এসে ত্রিবেদী বললেন, দেখলে তো গোবিন্দ, সারা রাত আমরা অপেক্ষা করলাম, ভূত কি এল? আসলে ভূত-টুত কিছু নেই। ওই সব অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারে কখনো বিশ্বাস করবে না, বুঝেছ?
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গোবিন্দ বলল, হা স্যার, বুঝেছি।
-আচ্ছা, তুমি তাহলে বাড়ি যাও। আমিও আমার বাড়ির দিকেই রওনা হই। পরে আবার দেখা হবে।
অধ্যাপক ত্রিবেদী খুব তাড়াতাড়ি পা চার্লিয়ে গোবিন্দের চোখের আড়ালে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল গোবিন্দ। পথের বাঁকে অধ্যাপকের চলমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল এবং অন্য একটা রাস্তা ধরে বাড়ির উদ্দেশে পদচালনা করতে করতে গোবিন্দ ভাবতে লাগল- ত্রিবেদী স্যার যে বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়িটা তো আমি চিনি। কিন্তু উনি তো নিজের বাড়ির দিকে গেলেন না, আবার ঘুরে হানাবাড়ির দিকেই হাঁটা দিলেন যে ত্রিবেদী স্যার কি ওখানে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন? শুনেছি, পোড়োবাড়িতে অনেক সময় গুপ্তধন থাকে… নাঃ, ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে
কিন্তু হানাবাড়ি আর ত্রিবেদীকে নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তার সুযোগ পেল না গোবিন্দ, আচম্বিতে তার কর্ণকুহরে সবেগে ধাক্কা মারল কুকুর ও বিড়ালের মিলিত কণ্ঠের ক্রুদ্ধ আস্ফালন-ভোক! ভোক!-ফ্যাঁসস!
শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে গোবিন্দ দেখল একটা ইটের পাঁজার উপর আশ্রয় নিয়ে সর্বাঙ্গের লোম ফুলিয়ে গজরাচ্ছে একটা কুচকুচে কালো বিড়াল আর সেই ইটের পাঁজার নিচে দাঁড়িয়ে বিড়ালটাকে ক্রমাগত ধমক দিচ্ছে একটা প্রকাণ্ড কুকুর!
ঈসস! গোবিন্দ বলে উঠল। বগলুর হতভাগা কুকুরটা একটা কালো বিড়ালকে কোণঠাসা করেছে। বেড়ালটা ইটের পাঁজার উপর উঠেছে বলে কুকুরটা ওর নাগাল পাচ্ছে না, উঠতে গেলেই বেড়ালের থাবা পড়ছে নাকে কিন্তু একবার যদি খুনে কুকুরটা বেড়ালটাকে ধরতে পারে তাহলেই বেড়ালের দফারফা। নাঃ, বেড়ালটাকে বাঁচাতে হবে।
গোবিন্দ এগিয়ে গিয়ে কুকুরটাকে তাড়া দিল, হেট! হেট! যাঃ! বেড়ালকে ছেড়ে কুকুরটা এবার গোবিন্দের দিকে ফিরে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জে উঠল, গরর! গরর! ভো! ভোঃ!
আরে গেল যা! আমাকেই কামড়াবে নাকি? গোবিন্দ নিচু হয়ে দুটো ইট কুড়িয়ে নিল, আমি বেড়াল নই, বুঝেছিস? আমাকে কামড়াতে এলে নাক মুখ আস্ত রাখব না।
কুকুরটা বোকা নয়- গোবিন্দ ইট তুলতেই সে বুঝে গিয়েছিল এই মনুষ্যশাবক দস্তুর মতো বিপজ্জনক, এর শরীরে দন্তস্ফুট করতে গেলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে– অতএব দূরে দাঁড়িয়ে সে সারমেয় ভাষায় গালাগালি করতে লাগল, ভোক! ভোক! ভৌ-উ-উ-উ-ভোঃ!
দ্বিপদ ও চতুস্পদ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্ভাব্য দ্বৈরথ-যুদ্ধে বাধা দিয়ে হঠাৎ অকুস্থলে দেখা দিল গোবিন্দেরই সমবয়সী একটি ছেলে, এই গোবিন্দ! আমার কুকুরের পিছনে লাগছিস কেন রে?
আরে বগলু যে! গোবিন্দ হাতের উদ্যত ইট নামিয়ে নিল, তোর কুকুর ওই বেড়ালটাকে কামড়াতে যাচ্ছিল, তাই আমি কুকুরটাকে তাড়া দিচ্ছিলাম।
বেড়াল? বগলু জানতে চাইল, কোথায়?
গোবিন্দ কিছু বলার আগেই বেড়ালটা ইটের পাঁজার উপর থেকে একলাফে নেমে ছুটে পালাতে লাগল এবং তৎক্ষণাৎ তাকে তাড়া করে ছুটল বগলুর কুকুর। বগলু এবার দেখতে পেল বেড়ালটাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, আরে! আরে! কুচকুচে কালো একটা বেড়াল! জিম- ধর ওটাকে, যা, যা, ধর!
জিম আগেই তাড়া করেছিল, প্রভুর উৎসাহ পেয়ে সে আরও জোরে ছুটল বিড়ালের পিছনে।
গোবিন্দ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, বগলু, তুই কুকুরটাকে লেলিয়ে দিলি? ধরতে পারলে বেড়ালটাকে মেরে ফেলবে। তোর কুকুর এই এলাকাতে তিন-চারটে বেড়াল মেরেছে।
বগলু হাসল, এটাকেও মারবে। ওই দ্যাখ।
বাস্তবিকই বেড়ালটাকে তখন প্রায় ধরে ফেলেছে বগলুর কুকুর। হঠাৎ বেড়াল দিক-পরিবর্তন করল একপাক ঘুরেই সোজা রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা গলিতে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিয়ে অদৃশ্য হল বগলুর কুকুর।
.
০৩.
নতুন জায়গায় এসে অধ্যাপক ত্রিবেদী সদ্য ভাড়া-নেওয়া বাড়িটির একটি ঘরে প্রয়োজনীয় বস্তু দিয়ে ছোটোখাটো একটি ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার সাজিয়ে নিয়েছিলেন। বর্তমানে ওই গবেষণাগারের ভিতর একটি কাঁচের টিউবে কিছু তরল পদার্থ নিয়ে তিনি পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ সারমেয় কণ্ঠের তীব্র চিৎকার তাকে চমকে দিল, আর একটু হলেই কাঁচের টিউবটা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ত। কুকুরটা তখনও থামেনি, মহাআক্রোশে চিৎকার করে কোন অদৃশ্য শত্রুকে ধমকের পর ধমক দিচ্ছে!