পাঁচিলের পরে কিছুটা জমির উপর বাগান। এখন অবশ্য বাগান বলা চলে না, দীর্ঘকাল, অযত্নের ফলে জায়গাটা আগাছার জঙ্গলে পরিণত। সেই একদা-নির্মিত উদ্যান এবং বর্তমানে আগাছার জঙ্গল ভেদ করে একটা সরু পথ এগিয়ে গেছে বাড়ির দরজার দিকে। ওই দরজাই হল বাড়ির প্রবেশ পথ। গোবিন্দের সঙ্গে ওই পথেই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন ত্রিবেদী। একটা ঘরের সামনে এসে গোবিন্দ বলল, একটু দাঁড়ান স্যার, আলো জ্বালি।
পকেট থেকে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে আলো জ্বালিয়ে দিল গোবিন্দ। ত্রিবেদী। দেখলেন ঘরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ধুলো বালি নেই এবং মেঝের উপর মাদুর ও চাদর বিছিয়ে যে শয্যাটি প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে দুটি মানুষের স্থান হয়ে যাবে। উপরন্তু শয্যার উপর রয়েছে দুটি বালিশ– অর্থাৎ রাত্রিযাপনের জন্য আয়োজনের কোনো ত্রুটি নেই।
ত্রিবেদী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, এমন পোড়ো বাড়ি, কিন্তু মেঝেটা দেখছি বেশ পরিষ্কার। এই সব মাদর, চাদর, বালিশ প্রভৃতি সব কিছুই তুমি জোগাড় করেছ নিশ্চয়? আমি তো ওগুলোর কথা একেবারেই ভাবিনি। তুমি বেশ করিকর্মা ছেলে গোবিন্দ।
গোবিন্দ গর্বিতস্বরে বলল, আমি বিকেলবেলা এসে এই ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছিলাম। মাদুর, চাদর আর বালিশ একটু আগে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি।..
ত্রিবেদী বললেন, বেশ, বেশ। এখন কিছুক্ষণ পর্যন্ত জেগে থেকে তুমি ভুতের জন্য অপেক্ষা। করতে পার। অবশ্য কোনো ভূতই যে তোমাকে দেখা দিতে আসবে না এবিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। ভূতের দেখা না পেয়ে তুমি যখন হতাশ হয়ে পড়বে, তখন তুমিও শুয়ে পড়ে নিদ্রার আয়োজন করবে– কী বলো?
গোবিন্দ বলল, আমি ভূতের জন্যে অপেক্ষা করব না স্যার। আমার দারুণ ঘুম পেয়েছে। ভূত যদি এসে গোলমাল বাধায়, তাহলে তো উঠে পড়তেই হবে।
কিন্তু এই বাড়ির আনাচকানাচ হয়ত অনেক ভূত ওত পেতে আছে। সেকথা ভেবেও কি তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে?
আপনি ঠাট্টা করছেন স্যার? আমি একা থাকলে নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারতাম না। কিন্তু আপনি তো আছেন, তাই নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ছি।
-আচ্ছা, তাহলে গুডনাইট গোবিন্দ।
–গুডনাইট, স্যার।
… গভীর রাত্রে হঠাৎ গোবিন্দের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে সে ঘুম ভাঙার কারণটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু একটা ধুপ-ধাপ শব্দ তার কানে আসতেই সে বুঝল ওই শব্দটাই তার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। দুই হাতে চোখ দুটো ভালো করে ঘষে নিয়ে সে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল তার চোখের সামনে!- নানারকম অঙ্গ-ভঙ্গি করে নাচছেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। ধুপধাপ শব্দের উৎস হচ্ছে তার নৃত্যচপল দুই পা! শুধু যে অশান্ত পদক্ষেপেই নৃত্য অভ্যাস করছেন ত্রিবেদী তা নয়, তার দুটি হাতও এঁকেবেঁকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুরছে! দারুণ আতঙ্কে গোবিন্দের চুল খাড়া হয়ে উঠল, সে বুঝল ত্রিবেদীর উপর ভূতের ভর হয়েছে– নাহলে রাত দুপুরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হঠাৎ নৃত্যকলার চর্চা করতে যাবেন কেন? তাঁর যে হাত দুটি এখন নাচের মুদ্রায় ঘুরছে, সেই হাত যদি হঠাৎ গোবিন্দের গলা টিপতে চায়, তাহলে কি হবে?
কে বাঁচাবে তাকে?… গোবিন্দ ভেবেছিল অশরীরী হঠাৎ শরীর ধারণ করে তাকে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু ভূতেরা যে কখনো কখনো মানুষের উপর ভর করে এবং সেই ভূতে-পাওয়া মানুষ যে নানারকম ভয়াবহ কাণ্ড করে থাকে, একথা অনেকবার শুনলেও গোবিন্দ ভাবতে পারেনি যে, অধ্যাপক ত্রিবেদীর উপরেই হঠাৎ ভর করবে হানাবাড়ির ভূত!
ভীষণ ভয় পেলেও গোবিন্দের মস্তিষ্ক আতঙ্কে অসাড় হয়ে যায়নি। সে চটপট ভেবে নিল এখন অধ্যাপক ত্রিবেদীর থেকে যথাসম্ভব দুরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। গোবিন্দ শুনেছিল ভুতে-পাওয়া মানুষ নাকি অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী হয়। কিন্তু বরাবর স্কুলের স্পোর্টসে দৌড়-প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে, আজ যদি সে একবার টেনে দৌড় মারতে পারে, তাহলে ত্রিবেদী অথবা ভূত কিংবা ত্রিবেদী ও ভূতের সম্মিলিত শক্তি অর্থাৎ ভূতে-পাওয়া অধ্যাপক ত্রিবেদী যে তার ভৌতিক শক্তি দিয়েও তাকে ধরতে পারবেন না, এবিষয়ে গোবিন্দের সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। কিন্তু দৌড় দেওয়ার আগেই ত্রিবেদী যদি তাকে ধরে ফেলেন, তাহলে তাঁর হাত ছাড়িয়ে পালানো যে সম্ভব হবে না একথাও বুঝতে পারছিল গোবিন্দ। নাঃ, সেই সুযোগ গোবিন্দ তাকে দিতে রাজি নয়, ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে শরীরটাকে সে গুটিয়ে আনল, এইবার দৌড় দিলেই হয়—
আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী, তার হাত পায়ের আন্দোলনও বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!
গোবিন্দ সভয়ে দেখল দরজা এবং তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন ত্রিবেদী! পলায়নের পথ একেবারেই বন্ধ!
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গোবিন্দের মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন ত্রিবেদী। গোবিন্দের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল দারুণ আতঙ্কে- এইবার বোধহয় ভূতগ্রস্ত ত্রিবেদী ঝাঁপিয়ে পড়বেন তার উপর…
প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থায় গোবিন্দের কানে এল ত্রিবেদীর কণ্ঠস্বর, আরে গোবিন্দ, তুমি জেগে বসে আছ? তাহলে সাড়া দিচ্ছ না কেন? ওহে গোবিন্দ, গো-বি-ল-অ-অ-অ!