ত্রিবেদীর কীর্তি বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। একজন খেলোয়াড় গদাইকে উদ্দেশ করে বলল, ওরে গদাই, এ তো সাংঘাতিক খেলুড়ে– বর্ণচোরা আম! চোখে কানে দেখতে দিল না, ঝড়ের মতো উড়ে এসে কাঁচি মারল ঝংকার কোমরে! আরে ব্বাস রে বাস!
গদাই বলল, লোকটা চটপটে আছে। তবে আমার কাছে চালাকি চলবে না। আসুক একবার এইদিকে।
–ওরে গদাই, ওই লোকটাই যে দান দিতে আসছে রে!
আসুক। ঝট করে চেপে ধরলে আর নড়তে পারবে না। যতই চটপটে হোক, অত রোগা লোকের গায়ে জোর থাকে না। চেপে ধরলেই ফিনিশ… সাবধান ঝন্টু, ও আসছে।
ত্রিবেদী এলেন। এ আগমন নয়, আবির্ভাব!
বিদ্যুতের শিখা যেন সহসা প্রকাশ!চুকিৎ-কিৎ শব্দে দম নিতে নিতে ত্রিবেদী যখন নিজের সীমানায় ফিরে গেলেন, তখন দেখা গেল বাগনান ক্লাবের আরও দুই খেলোয়াড় অধ্যাপক মশাই-এর স্পর্শসখ অনুভব করতে করতে মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে।
যে-ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে গদাই বলেছিল রোগা লোকের গায়ে জোর হয় না, চেপে ধরলেই ফিনিশ, সে এইবার গদাই-এর দিকে তাকিয়ে তিক্তস্বরে বলে উঠল, কী রে গদাই, কী হল? তুই না বলেছিলি চেপে ধরলেই ফিনিশ! এখন দেখছিস তো ফিনিশ হওয়ার জিনিস এ নয়। আরে ব্বাস- যেন একটা ঝড় ছুটে গেল।
অপর দিকের সীমানায় দণ্ডায়মান ত্রিবেদীর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে গদাই বলল, যদি একবার ধরতে পারতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম ফিনিশ করা যায় কিনা. আচ্ছা, এবার আমি যাচ্ছি।
চুকিৎ-কি-কিৎ দম নিতে নিতে অগ্রসর হল গদাই, মনে মনে বলল, তালপাতার সেপাইটাকে একবার নাগালে পেলে হয়, এমন একখানা ঝাড়ব যে বাছাধনকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
তালপাতার সেপাই অর্থাৎ অধ্যাপক ত্রিবেদীর উপর এখন গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের অগাধ বিশ্বাস ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ফিস্ ফিস্ করে ত্রিবেদীকে বলল, গদাই আসছে। ত্রিবেদী স্যার, ওকে ধরে ফেলুন। গদাই বসে গেলে নির্ঘাত জিতব। আপনি যদি গদাইকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড রুখে দিতে পারেন, তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে কাবু করতে পারব।
দরকার হবে না, ত্রিবেদী হাসলেন, গদাইকে ধরতে পারলে কারও সাহায্য ছাড়া আমি একাই ওকে কাবু করতে পারব।
গদাই এসে ঢুকল প্রতিপক্ষের সীমানার মধ্যে। মুখে তার দম নেওয়ার কিৎ-কিৎ ধ্বনি, তার শালের গুঁড়ির মতো দুই পেশিপুষ্ট বাহু ছোবল মারার জন্য প্রসারিত- গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়রাও তাকে ঘিরে ফেলতে সচেষ্ট… দর্শকদের মধ্যেও তখন প্রবল উত্তেজনা– দারুণ খেলছে গদাই… দুজন ওকে জড়িয়ে ধরতে এসে ছিটকে পড়ল… আরও একজন…শাবাশ গদাই, শাবাশ! তিনজনকে মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে গদাই!
-উঃ! আমার চোয়ালটাও যে মেরে উড়িয়ে দিলে মশাই!
-স্যরি! খেলার ঝোঁকে হাত ছুঁড়েছি, কনুইটা আপনার চোয়ালে লেগে গেছে। কিছু মনে করবেন না।
–না, না, মনে করব কেন? খেলার ঝেকে আমার হাতের মুঠো যদি হঠাৎ মশাই-এর নাকে লেগে যায়, আশা করি আপনিও কিছু মনে করবেন না।
তার মানে? আমার কনুইটা হঠাৎ আপনার চোয়ালে লেগে গেছে। আমি কি ইচ্ছে করে আপনাকে মেরেছি? আর আপনি এখন আমার নাকে ঘুসি মারতে চাইছেন? একবার মেরে দেখুন
–তাই নাকি? দেখবেন তবে?
অনেকগুলো ক্রুদ্ধকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, দুটোকেই ঘাড় ধরে বার করে দেব। ঝগড়া করার বাসনা থাকলে এখান থেকে সরে গিয়ে যত খুশি গুঁতোগুতি করুন। এখানে ঝামেলা করলে দুজনকেই আগাপাশতলা ভালো মতো পালিশ করা হবে।
এমন ভয়ংকর নিরপেক্ষ বিচারের সম্ভাবনা কনুই এবং ঘুসি উভয় পক্ষকেই নিরস্ত ও নীরব করে দিল। জনতা আবার খেলার মাঠের দিকে মনোনিবেশ করল…
গদাই তখন প্রায় নিজের ঘরে ফিরে গেছে, হঠাৎ পিছন থেকে একলাফে এসে তার একটা পা চেপে ধরলেন ত্রিবেদী। পরক্ষণেই তিনি অনুভব করলেন তার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি অন্তর্ধান করছে, অস্ফুটস্বরে তিনি বলে উঠলেন, সর্বনাশ! আশ্চর্য-পাতার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে!
নিজেকে মুক্ত করার জন্য গদাই পা ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ত্রিবেদীর দেহ শূন্যপথে উড়ে গিয়ে মাঠের পাশে একটা ঝোপের মধ্যে ছিটকে পড়ল!
দর্শকদের ভিতর থেকে ভেসে এল বিরূপ মন্তব্য। ওই চেহারা নিয়ে কপাটি খেলা যায় না।
–হুঁ, হুঁ, বাবা; ওর নাম গদাই। এতক্ষণ বাবাজি খুব খেল দেখাচ্ছিলেন, এখন শক্ত পাল্লায় পড়ে হিম্মৎ ছটকে গেছে।
-হা! হা! হা!
ভিড়ের ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল মুকুন্দ! কী হল স্যার? লাগল নাকি?
না, লাগেনি, ত্রিবেদী বললেন, ভাগ্যিস এই গাছটা ছিল, এটার ডালপালার উপর পড়েছিলাম বলেই বেঁচে গেছি, নয়তো হাড়গোড়–আরে! আরে! এ কী!
-কী হল স্যার? হঠাৎ অমন চেঁচিয়ে উঠলেন কেন?
–না, না, ও কিছু নয়। একটা লতা দেখে সাপ ভেবে ভুল করেছিলাম।
ঝোপের মধ্যে সাপখোপ থাকতে পারে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার কোথাও চোট লাগেনি তাহলে?
-না, না।
–ওখানে আর দাঁড়াবেন না। দলের সবাই যেখানে মোড় হয়ে বসে পড়েছে, সেইখানে গিয়ে বসুন। যদি বরাত ভালো থাকে, আপনি আবার একটা সুযোগ পেতে পারেন।
কিন্তু ত্রিবেদী তখন মুকুন্দের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না– দুই চোখ পাকিয়ে তিনি সেই গাছটার দিকেই তাকিয়েছিলেন, যেটা তার শূন্যপথে ধাবমান দেহকে কঠিন ধরণীর সাংঘাতিক সংঘাত থেকে রক্ষা করেছে। ত্রিবেদীর অভিজ্ঞ চক্ষু একনজরেই গাছটার স্বরূপ নির্ণয় করতে পেরেছে, মাঠের একপাশে ঝোপের মধ্যে অভাবনীয় ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে আশ্চর্য-পাতার একটি গাছ!