না হে ক্যাপ্টেন, আমি খেলতে পারব না, মুকুন্দ বলল, আমার কোমরে সাংঘাতিক মচকে গেছে। আমার বদলে এই ভদ্রলোক ওহো, তোমার সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি এ হচ্ছে আমাদের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক দত্ত, আর ইনি আমাদের পাড়ায় নবাগত অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী। হ্যাঁ, যা বলছিলাম আমার বদলে ত্রিবেদী স্যারই খেলবেন।
আমরা ভীষণভাবে হেরে যাচ্ছি, ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল শশাঙ্ক, এই সময় রসিকতা ভালো লাগে না, মুকুন্দ।
–আরে না, রসিকতা নয়। শোনো এই দিকে, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি..
গোলাপ কলোনির সমর্থকদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, আমাদের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ককে ডেকে নিয়ে মুকুন্দ কী এমন প্রাইভেট টক করছে রে! সঙ্গে আবার একটা রোগা-পটকা লোক।
-ওই তো সাইকেলে চাপিয়ে মুকুন্দকে নিয়ে এল। লোকটা পাড়ায় নতুন এসেছে। কোনো একটা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যেও উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে, ওরে গদাই, বাঘা মুকুন্দ এসে গেছে। এইবার সাবধানে খেলতে হবে।
গদাই-এর কপালে ভাঁজ পড়ল, কুঁচকে গেল ভুরু। মুকুন্দকে আমি ভয় পাই না। আমরা পাঁচজন আর ওরা মাত্র দুজন… আরে! ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে মনে হচ্ছে।
গদাই, দ্যাখ, বাগনান ক্লাবের এক খেলোয়াড় উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, মুকুন্দ খেলছে না। মুকুন্দের বদলে একটা রোগা-পটকা লোককে ওরা মাঠে নামাচ্ছে!… কী আশ্চর্য! উনি তো অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী, কলোনিতে নতুন এসেছেন।
গদাই অট্টহাস্য করে বলল, মুকুন্দই তো জোর করে লোকটাকে মাঠে নামাল মনে হচ্ছে। মুকুন্দটার মাথা খারাপ হল নাকি? ওই তালপাতার সেপাইকে তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে।
গোলাপ কলোনির পাঁচজন খেলোয়াড়ই মোড় হয়ে বসে পড়েছে। নিয়ম-অনুসারে বিরোধী দলের কোনো খেলোয়াড়কে ঘায়েল করতে পারলে নিজের দল থেকে দলপতির নির্বাচন অনুযায়ী একজন মোড় বা বসে-যাওয়া খেলোয়াড় আবার উঠে খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বিরোধী দলের পাঁচজন খেলোয়াড় যেখানে সক্রিয় আবার তাদের মধ্যে গদাই-এর মতো বিভীষিকাও যেখানে উপস্থিত সেইখানে মাত্র দুজনের পক্ষে গদাই সমেত আর চার-চারটি খেলোয়াড়কে বিধ্বস্ত করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। তা-ও যদি মুকুন্দ খেলত, তাহলে যৎপরোনাস্তি ক্ষীণ হলেও একটু আশা ছিল কিন্তু মুকুন্দের পরিবর্তে অধ্যাপক মশাইকে মাঠে নামতে দেখে গোলাপ কলোনির সমর্থকরা একেবারেই হতাশ হয়ে পড়ল।
অন্যান্য খেলোয়াড়দের সমবেত আপত্তি তুচ্ছ করেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ত্রিবেদীকে মাঠে নামাল। তার আগে অবশ্য শশাঙ্ককে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা চুপি চুপি জানিয়েছিল মুকুন্দ। অন্য খেলোয়াড়দের কাছে অবশ্য ব্যাপারটা সে চেপে গিয়েছিল। বাঘা মুকুন্দকে একটা লোক সজোরে আছাড় মেরেছে এটা তো গর্ব করে বলার বিষয় নয়– শশাঙ্ককে সব কথা খুলে না বললে সে ত্রিবেদীকে মাঠে নামাতে রাজি হত না বলেই তাকে আদ্যন্ত নিগ্রহের ইতিহাস খুলে বলতে বাধ্য হয়েছিল মুকুন্দ। ওই সঙ্গে অবশ্য অনুরোধ করেছিল আছাড় মারার লজ্জাকর ঘটনা যেন শশাঙ্ক গোপন রাখে।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্ষীণকায় অধ্যাপক মশাইকে নিরীক্ষণ করতে করতে শশাঙ্ক বলেছিল, ভদ্রলোককে দেখলে তোমার কথা বিশ্বাস করা শক্ত, মুকুন্দ। তবে অধ্যাপক মশাই যে তোমার মতো গায়ে-গতরে ভারি মানুষকে নিয়ে বন্ বন্ করে সাইকেল চালাচ্ছিলেন, সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছি। যাক তোমার কথামতো ভদ্রলোককে নামাচ্ছি। একটা এক্সট্রা জার্সি ছিল, কাজে লেগে গেল। এখন দেখা যাক কি হয়।
…চুউউ-ইই-কি-কিৎ-কিৎ, দম নিয়ে একজন বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড় দান দিতে ঢুকল গোলাপ কলোনির ঘরে। হঠাৎ নিচু হয়ে প্রায় ড্রাইভ দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিয়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়টিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল শশাঙ্ক। তার চেষ্টা সফল হল না- বিপক্ষের খেলোয়াড় সজোরে ধাক্কা মেরে আলিঙ্গনে উদ্যত দুই হাতের বন্ধন এড়িয়ে গেল এবং তিরবেগে ছুটে নিরাপদ সীমানার খুব কাছে পৌঁছে গেল কয়েকমুহূর্ত পরেই খেলোয়াড়টি নিজের ঘরে পৌঁছে যাবে আর মোড় হয়ে বসে যাবে ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক! বাগনান ক্লাবের সমর্থকদের ভিতর থেকে একটা তীব্র উল্লাসধ্বনি উঠেই থেমে গেল তৎক্ষণাৎ, কারণ—
আচম্বিতে একটা গতির ঝড় যেন উড়ে এসেছে পলাতক খেলোয়াড়ের দিকে এবং মুহূর্তের মধ্যে একজোড়া পা সাঁড়াশির মতো তার কোমর পেঁচিয়ে তাকে ধরাশায়ী করে দিয়েছে!
ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ধাক্কার চোটে ছিটকে পড়েছিল, এখন ভূমিশয্যা ত্যাগ করে সে ছুটে এল ত্রিবেদীকে সাহায্য করতে। কিন্তু শশাঙ্কর উদ্যম তখন বাহুল্য মাত্র, ত্রিবেদীর দুই সরু ঠ্যাং-এর যাঁতাকলে পড়ে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে গেছে নিজের সীমানায় ছুটে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না…
এতক্ষণ পরে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটল। নিয়ম-অনুযায়ী বাগনান ক্লাবের ধরা-পড়া খেলোয়াড় মোড় হয়ে বসে পড়ল এবং মোড় হয়ে বসে পড়া গোলাপ কলোনির দল থেকে একজন খেলোয়াড় খেলাতে অংশগ্রহণ করতে মাঠে নামল। গোলাপ কলোনির অবস্থা এখন আর অতটা শোচনীয় নয়– পাঁচ আর দুই-এর পরিবর্তে চার-এর বিরুদ্ধে তিন-এর লড়াই গোলাপ কলোনির খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার করল।