- বইয়ের নামঃ অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ নিউ বেঙ্গল প্রেস (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী
১. ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল
অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি (উপন্যাস)
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল
০১.
কলকাতার কাছে এক অখ্যাত শহরতলিতে একদিন বিকালে যে-ভদ্রলোকটিকে দেখা গেল, তিনি এই এলাকায় নবাগত- মাঝারি আকারের অত্যন্ত রোগা চেহারার মানুষটি তার চশমার ভিতর দিয়ে একটি বৃহৎ অট্টালিকার দিকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে কী-যেন ভাবছিলেন।
বাড়িটি মস্ত বড়ো, কিন্তু একনজর তাকালেই বোঝা যায় সেখানে জনপ্রাণী বাস করে না;— তার দেয়ালে দেয়ালে ফাটল ধরেছে এবং পাঁচিলের গা ঘেঁষে বাগানের সীমানার মধ্যে বেড়ে-ওঠা আগাছার ঝোঁপ ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে একটা ছোটোখাটো গাছ আপাতত সেই গাছটার দিকেই তাকিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন উক্ত ভদ্রলোক।
অকস্মাৎ তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিল একটি বালকের কণ্ঠস্বর, এই যে স্যার, আপনিই তো বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী? আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন, তাই না?
চমকে উঠে ভদ্রলোক দেখলেন তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে। প্রশ্নটা যে সে-ই করেছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। এতক্ষণ যেন অন্য জগতে বিচরণ করছিলেন ভদ্রলোক, ছেলেটির কণ্ঠস্বর আবার তাকে বাস্তব পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে দিল, তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে থাকি। কিন্তু তুমি আমাকে চিনলে কি করে?
ছেলেটি হাসল, খবরের কাগজে মাঝে-মধ্যেই আপনার ছবি দেখতে পাই। কয়েকদিন আগে এই পাড়ারই একটি বাড়ির দরজায় আপনার নাম দেখতে পেলাম। বুঝলাম, আপনি হঠাৎ আমাদের পাড়ায় এসে উঠেছেন। কিন্তু কেন? আপনি তো দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। হঠাৎ এই জায়গায় আপনার মতো বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের উঠে আসার দরকার হল কেন? এখানকার গাছপালা নিয়ে কিছু গবেষণা করছেন নাকি?
অধ্যাপক ত্রিবেদী ভীষণ চমকে গেলেন, কিন্তু মনের ভাব গোপন করে বললেন, না, না, ওসব কিছু নয়। এই অঞ্চলে এখনও তেমন গাড়ি-টাড়ির চলাচল শুরু হয়নি, এখানকার বাতাস কলকাতার মতো দুষিত নয়, তাই এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাব ভাবছিলাম।
–খুব ভালো কথা। কিন্তু হানাবাড়ির দিকে তাকিয়ে আপনি অত মন দিয়ে কী দেখছিলেন?
ত্রিবেদীর ভ্রু কুঞ্চিত হল, হানাবাড়ি? তার মানে?
–লোকে তো তাই বলে। আমার সঙ্গে কেউ থাকলে একটা রাত ওই বাড়িতে থেকে ভূত দেখার চেষ্টা করতাম। আমার বন্ধুরা ভীতু, কেউ ওখানে রাত কাটাতে রাজি নয়। আর আমি আমি ঠিক ভীতু নই, তবে একা-একা ওই হানাবাড়িতে রাত কাটাতে আমারও সাহস হয় না।
-কেন? ভূতে ঘাড় মটকে দেবে?
–না, না, তা নয়। তবে ইয়ে মানে, বলা তো যায় না, যদি
বুঝেছি, অধ্যাপক ত্রিবেদী হাসলেন, অর্থাৎ ভূতের ভয় তোমার আছে। কিন্তু ভূত বলে কিছু নেই। এই সব কুসংস্কার তোমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। তুমি যদি আজ এই হানাবাড়িতে রাত কাটাতে রাজি থাকো, তবে আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
সত্যি বলছেন স্যার? ছেলেটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাহলে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঠিক রাত দশটার সময়ে আপনি এখানে আসুন। আমিও আসব।
ছেলেটি পিছন ফিরে চলতে শুরু করেছিল, অধ্যাপক তাকে ডাকলেন, শোনো। তোমার নামটি তো আমার জানা হল না।?
আমার নাম গোবিন্দ ঘোষ। এখন আমি চললাম। মনে রাখবেন, ঠিক দশটায় আমি আসব।
-আরে, শোনো, শোনো। তোমার বাবা-মা তোমার মতো ছোটো ছেলেকে সারা রাত এই বাড়িতে থাকার অনুমতি দেবেন বলে আমার মনে হয় না। বরং চলো, আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে তাদের অনুমতি নিয়ে আসি।
-দরকার নেই স্যার। মার আবার ভীষণ ভূতের ভয়। তিনি কিছুতেই আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দেবেন না।
তাহলে? তাহলে তুমি আসবে কি করে? রাত্রে তোমাকে দেখতে না পেলে বাড়ির সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করবে, হয়তো থানাতে খবর যাবে। নাঃ, তোমার আসার দরকার নেই।
-না, স্যার; আমি বাড়িতে বলেই আসব। তবে হানাবাড়িতে থাকার কথা বলব না। আমাদের ক্লাসের রথীন অঙ্কে খুব ভালো, আমি মাঝে মাঝে তার বাড়িতে অঙ্ক করতে যাই। অনেক সময় রাতেও থাকি। আমি অঙ্কে খুব কঁচা কিনা, তাই রথীনের বাড়িতে অঙ্ক করতে গেলে বাড়ির কেউ কখনো বাধা দেয় না। আজ রাতে আমি রথীনের বাড়ি যাচ্ছি বলেই বেরিয়ে আসব বুঝেছেন?
ত্রিবেদী গম্ভীর হলেন, গোবিন্দ, মিছে কথা বলে বাবা-মাকে ফাঁকি দেওয়া কখনো উচিত নয়। তবে একটা কুসংস্কার পুষে রাখবে, সারা জীবন অলীক ভয়ের দাপটে মনের স্বাস্থ্য নষ্ট করবে, এটাও ঠিক নয়। বিজ্ঞানী হিসাবে তোমার মন থেকে এই অলীক ভুতুড়ে ব্যাপারটা মুছে ফেলা আমার কর্তব্য। শুধু সেইজন্যই তোমার মিথ্যাভাষণ এবারের মতো আমি ক্ষমা করতে রাজি আছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো বাবা-মার কাছে মিছে কথা বলবে না। আমার কথাটা মনে থাকবে?
থাকবে স্যার। তাহলে ওই কথাই রইল। আপনি রাত দশটায় আসছেন তো?
–আসছি। এখন বাড়ি যাও।
.
০২.
কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটার সময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। বাড়ির চারদিক ঘিরে যে পাঁচিলটা রয়েছে, তার গায়ে লাগানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল গোবিন্দ।