তা বাপু এই বংশের মানুষ তো এক কালে চাষবাসের কাজই করতো। বাঘাড় মাঝির বাপ বুধা মাঝির দাদা না পরদাদা না-কি তারও দাদা সোভান ধুমা। বিলের এপারে গিরিরডাঙার অর্ধেক, অর্ধেক না হলেও সিকি জমির জঙ্গল কেটে বসত করলো কে?–সোভান ধুমা ছাড়া আবার কে? করতোয়ার পশ্চিমে কোথায় খুব গোলমাল করে কাদের তাড়া খেয়ে সোভানের বাপ এখানে যখন আসে এই তল্লাট জুড়ে তখন খালি জঙ্গল আর জঙ্গল। সোভানের মা ছিলো চার জন, ভাইবোন পঁচিশ তিরিশ জনের কম নয়। এর মধ্যে প্রায় সবই বেটাছেলে। মাঝি হওয়ার আগে তাদের বংশে বেটি পয়দা হয়েছে কম। আরে, বিলের পশ্চিমে এতো বড়ো জঙ্গল কেটে চাষের জমি বার করা কি মেয়েছেলের কাম নাকি? জঙ্গলও জঙ্গল! জঙ্গল জুড়ে তখন বাঘ, ভালুক বুনো শুওর আর সাপ। প্রথম দিকে গাঁইগুঁই করলেও জানোয়ারগুলো তটস্থ থাকতো সোভান আর তার ভাইদের ভয়ে। শেষে এমন হলো যে, সোভানের গায়ের গন্ধ পেলে বাঘ পর্যন্ত আর পালাবার দিশা পায় না। ধরতে পারলে সোভান ধুমা বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চড়িয়ে। তাকে দিয়ে লাঙল টানায়।
তারপর কবে, সোভান ধুমার নাতি না তার নাতির বেটার আমলে একবার আসামে না রংপুরে না-কি দিল্লিতেই হবে, না বার্মায় কোথায় ভূমিকম্প হলে কোথাকার বড়ো এ গাঙের পানি সব এসে পড়লো পুবের যমুনায়। যমুনা তখন কী?-মানুষ শুনে হাসে, যমুনা তখন একটা রোগা খাল। তার ওই ছিপছিপে গতরে যমুনা কুলাতে পারে না, অতো পানি সে রাখে কোথায়? ক্রোশকে ক্রোশ-জমি আর বাঘ ভালুক শুওর আর সাপ আর মানুষ আর ঘরবাড়ি আর হাঁসমুরগি আর গোরুবাছুর সাবাড় করে সে কেবলি হাঁসফাঁস করে। যমুনার বদহজম হলে পানির ঘোলা স্রোতের অনেকটাই সে উগরে দিলো বাঙালি নদীতে। প্রবল স্রোতের দলছুট একটা ধারা বাঙালি থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লো এই কাৎলাহার বিলে। কাৎলাহার বিল তো তখন একটু জলা মাত্র, তার উত্তর সিথানে পাকুড়গাছে মুনসি আরস পেতে বসেছে সোভান ধুমার আমলেই, কিংবা তার বেটার সময়েও হতে পারে। মুনসি না থাকলে কাহারকে তখন আর পুছতো কে? মুনসি থাকায় পানি খুব টলটলে, গিরিরডাঙার জঙ্গল-কেটে বসত-করা মানুষ ঐ পানি খায়। কিন্তু ওই জলা কি আর বাঙালির দলছুট স্রোতের মতো পানি ওইটুকু গতরে রাখতে পারে? গিরিরডাঙা ড়ুবলো, কামারপাড়া বাদে নিজগিরিরডাঙা তখনো জঙ্গল, সেটাও ড়ুবলো। গিরিরডাঙার চাষের জমি আর গোরুবাছুর আর হাঁসমুরগি আর বৌবেটাবেটি নিয়ে মানুষকে ভেসে যেতে দেখে মুনসির আর সহ্য হলো না, পাকুড়গাছ থেকে সে তার জোড়া পা পঁচিশ তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ গজ বাড়িয়ে বিলের দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ে মারলো এক লাথি। সেখানে কতোদিন আগে জঙ্গল কেটে তৈরি চাষের জমি আর বাড়িঘর সব ভেঙে পড়লো, বানের পানি গলগল করে ঢুকে পড়লো পাড়-ভাঙা বিলের ভেতর। বাঙালি নদীর স্রোত দুটো ধারায় এসে পাকুড়গাছে কদমবুসি করে গাছের দুই ধার দিয়ে এসে মিশলো বিলের পানিতে। একটি ধারা মুছে গেছে অনেক দিন আগেই। পাকুড়গাছের পেছনে অনেকটা জায়গা সেই স্রোতের স্মৃতিতে এখনো নাকি ভিজে ভিজেই থাকে। মায়ের কাছে তমিজ গল্প শুনেছে, টাউনের রমেশ উকিল এখানে চাষবাসের জন্যে কাশবন ইজারা নিয়েছিলো। তমিজের বাপকে নাকি সে ওখানে লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলো তার ভাগ্নে টুনুবাবুর সঙ্গে। তখন রমেশ উকিলের কথায় তার বাপ কান দেয় তো পাকুড়তলার উত্তরে না হলেও তিন বিঘা জমির মালিক হয়। তাদের জায়গাজমি খেয়েই তো বিলের গতর এতো মোটা। ঐ বান না হলে আর মুনসি তাদের বাঁচাতে বিলের গায়ে লাথি না মারলে এইসব জমি তো তাদেরই থাকে। যাদের জমি খেয়ে মুনসির বিলের গতর বাড়ে, তাদের রেজেকের ব্যবস্থাও করে দেয় মুনসি নিজেই। তার লাথিতে মাটি ভেঙে পানিতে ড়ুবে গেলে লাঙল হারিয়ে যায় বিলের ভেতরে। মুনসির হুকুমে সেখান থেকে ভেসে ওঠে তৌড়া জাল, প্যালা জাল, এমন কি মস্ত বড়ো বেড় জাল পর্যন্ত।
মুনসির ইশারায় সোভান ধুমার বংশ হয়ে গেলো মাঝি। তা এখন বিল তো আবার খুঁজতে শুরু করেছে। আট বছর আগে বড়ো বানের পর পলি পড়ে বিল ছোটো হয়ে এসেছে। কতো কতো মাঝি কাঁধে জাল আর বৌদের কোলে-কাখে ছেলেমেয়েদের তুলে দিয়ে চলে গেলো পুবে যমুনার দিকে। আবার কেউ কেউ বিলে পানির ওপর পুরু সর-পড়া মাটিতে লাঙল ঢোকাবার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু নতুন জমি যা উঠবে সবই নাকি শরাফত মণ্ডলের, জমিদারকে টাকা দিয়ে গোটা বিল সে পত্তন নিয়েছে। কিন্তু তমিজের কেমন খটকা লাগে, বিলের নতুন জমিতে চাষবাস করার হক এখন কার?—বোবঝা, ভালো করে বুঝে দেখো। কিন্তু সে নিজেও হিসাবটা ভালো করে বুঝতে পারে না। জমির মালিক না হোক, জমিতে বর্গা তো করতে পারবে, না কী কও?-কিন্তু তার উত্তেজনা ও উদ্বেগ ও খানিকটা হাহাকারও বটে, সবটাই মিনতি হয়ে প্রকাশের জন্যে ছটফট করে, কিন্তু তাও.আর হয়ে ওঠে না। তবে তার হয়ে কথা বলে কাদের, ভাইজান, এই চ্যাংড়াক জমি দিলে ফসল মার যাবি না। চ্যাংড়াটা খাটতে পারে খুব। গরিব মাঝির বেটা, বেয়াদবি করার সাহস পাবি না।
সেটা আবদুল আজিজও আঁচ করতে পারে। মাঝিদের বেটা, তার ওপর গরিবের মধ্যেও গরিব। চাষ করতে শুরু করলেও ভালোভাবে চাষা হতে আরো দুই পুরুষ লাগবে। লাঙল হাতে নিতে না নিতে আরো কয়েকটা চাষার সঙ্গে জোট বাঁধার সময় কোথায় তার?—ঠিক আছে। কিন্তু আবদুল আজিজ একজন সরকারি কর্মচারী, তার বেতন আসে ডিস্ট্রিক্ট ট্রেজারি থেকে। তাকে চলতে হয় বৃটিশ রাজের তৈরী রুলস অনুসারে। বৃটিশ রাজ আর যাই করুক, তোমরা এটা বলো সেটা বলল, কিন্তু আইনের ফাকি তারা সহ্য করে না। বৃটিশ খেদাতে তোমরা উঠে পড়ে লেগেছো, দেশটা তোমাদের হাতে পড়লে এর হালটা কী হয় তখন দেখে নিও। তা এখনো আইনকানুন বলে কিছু আছে, চাষেরও নিয়ম আছে। এখন পর্যন্ত ফসল ভাগ হয় আধাআধি। পুঁজিও খাটাও তবে আধাআধি, এতোকাল তাই তো চলে আসছে। লাঙল গোরু নাই, ঠিক আছে ভাড়া বাবদ আধাআধি পয়সা দিয়ে বর্গা নাও।