০১. পায়ের তলা কাদা

পায়ের পাতা কাদায় একটুখানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতোটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাঢ় ছাই রঙের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাত দুটো নাড়ছিলো, ঐ জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার। অনেকদিন আগে, তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার বাপেরও জন্ম হয় নি, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরই তখনো দুনিয়ায় আসতে ঢের দেরি, বাঘাড় মাঝির দাদার বাপ না-কি দাদারই জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন-কেটে বসত-করা বাড়ির নতুন মাটি ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, ঐসব দিনের এক বিকালবেলা মজনু শাহের বেশুমার ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান কেল্লায় যাবার জন্যে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় মুনসি বয়তুল্লা শাহ গোরা সেপাইদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিলো ঘোড়া থেকে। বন্দুকের গুলিতে ফুটো গলা তার আর পুরট হলো না। মরার পর সেই গলায় জড়ানো শেকল আর ছাইভস্মমাখা গতর নিয়ে মাছের নকশা আঁকা লোহার পান্টি হাতে সে উঠে বসলো কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মাথায়। সেই তখন থেকে দিনের বেলা রোদের মধ্যে রোদ হয়ে সে ছড়িয়ে থাকে সারাটা বিল জুড়ে। আর রাতভর বিল শাসন করে ওই পাকুড়গাছের ওপর থেকেই। তাকে যদি এক নজর দেখা যায়–এই আশায় তমিজের বাপ হাত নাড়াতে নাড়াতে আসমানের মেঘ খেদায়।

তা না হয় হলো, কিন্তু এখন থেকে দুই বছর সোয়া দুই বছর পর, না-কি আড়াই তিন বচ্ছরই হবে, বিলের পানি মুছতে মুছতে জেগে-ওঠা ডাঙার এক কোণে চোরাবালিতে ড়ুবে মরলে তমিজের বাপটা উঠবে কোথায়? তাকে ঠাঁই দেবে কে? বড়ো বানের ছোবলে বড়ো বড়ো কঁঠালগাছ তো সব সাফ হয়ে গেছে মেলা আগে, শরাফত মণ্ডলের বেটা ইটখোলা করলে বাকি গাছগুলোও সব যাবে ভাটার পেটে। তখন? তখন তমিজের বাপ উঠবে। কোথায়? দিনে দিনে বিল শুকায়, শুকনা জমিতে চাষবাস হয়, জমির ধার ঘেঁষে মানুষ ঘর তোলে। বড়ো বিরিক্ষিকে জায়গা দেওয়ার মতো জায়গা তখন কি আর পাওয়া যাবে?

দিনের বেলা হলে ভালো করে দেখা যায়,-বিলের পশ্চিমে বিলের তীর থেকে। এদিকে খালপাড় পর্যন্ত জায়গাটা এখন পর্যন্ত খালিই পড়ে রয়েছে। তারপরই মাঝিপাড়া। মাঝিপাড়ার মানুষ অবশ্য নিজেদের গ্রামকে ওভাবে ডাকে না, গোটা গ্রাম জুড়ে তো আগে তাদেরই বসবাস ছলো। এখন পাঁচ আনা ছয় আনা বাসিন্দাই চাষা। আগে কয়েক ঘর কলু ছিলো, আট মাইল পশ্চিমে টাউনে তবিবর মুক্তারের রহমান অয়েল মিল হওয়ার তিন বছরের মধ্যে কলুদের অর্ধেকের বেশি চলে গেলো পুবে যমুনার ধারে। যে কয় ঘর আছে তাদের কারো কারো ঝোঁক জমিতে আবাদ করার দিকেই বেশি।

বিলের ওপারে অনেকটা জমি জুড়ে চাষবাস, তারপর ছোটো খালটা পার হলে চাষাদের গ্রাম। সেখানে একেকটা ঘরের পাশে বাঁধা গোরু, বৃষ্টির পানিতে ভিজে কালচে হয়ে-যাওয়া হলদে খড়ের ভাঙাচোরা গাদা, ভেরেণ্ডা ঝোপের পাশে গোবরের সার, কলাগাছের ঝাড়, বৌঝিদের আব্রু করতে শুকনা কলাপাতার পর্দা, ঘরের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা লাঙল, মই ও জোয়াল। সকাল থেকে দুপুর, এমন কি আষাঢ়ের বিকালে বৃষ্টি না হলে সন্ধ্যাবেলাতেও এপারে দাঁড়িয়ে ওপারটা স্পষ্ট দেখা যায়। শরাফত মণ্ডলের হাতে খাজনা দিয়ে দূৰদূরান্তের জেলেরা এসে মাছ ধরে। ওপারের চাষারা, চাষাদের বৌঝিরা পর্যন্ত সার করে দাঁড়িয়ে তাই দেখে। সেসব দিনে বিলে হুলুস্থুল কাণ্ড। জেলে আর কয়জন? সংখ্যায় তাদের তিন গুণ চার গুণ বেশি চ্যাংড়াপ্যাংড়া বিলের তীরে লাফাতে লাফাতে হৈ চৈ করে। তখন কি বিল কি জমি, কি পানি কি ডাঙা কারো কোনো আব্রু নাই। তখন মানুষ বলো, গোরুবাছুর বলো, মেয়েমানুষ বলো আর ছোলপোল বলো, মাছবলো শামুক বলো, সব, সব শালা উলঙ্গবাহার হয়ে বেহায়ার। মতো খ্যামটা নাচন নাচে।

এখন রাত। এখন কিন্তু অমন নয়। সন্ধ্যা থেকে আবছা কালো পাতলা একটা জাল পড়ে বিলের ওপর, সন্ধ্যা গড়ায় রাত্রিতে আর ঐ অদৃশ্য জালের বিস্তার বাড়ে ঐ সঙ্গে। অন্ধকার গাঢ় হতে হতে সেই বেড় জালের নিচে ধরা পড়ে সমস্ত এলাকা। রাত বাড়ে, রাত আরো বাড়ে, কেউ টের পাবার আগেই শুরু হয় জাল গোটানো। পাকুড়গাছ থেকে টান পড়ে জালের দড়িতে, আস্তে আস্তে দুই পাড়ের গ্রাম নিয়ে গোটা বিল তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে এসে থিতু হয় বিলের মাঝখানে। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী-কী শুক্লপক্ষ কী কৃষ্ণপক্ষ-গিরিরডাঙা-নিজগিরিরডাঙা-কাৎলাহার বিলের দুই পাড়ের দুই গ্রাম এই বিলের মধ্যে একাকার হয়ে যায়। তখন যাই দেখো, একটার থেকে আরেকটার ফারাক ধরতে পারবে না। তখন বিলের সিথান থেকে সেই পাকুড়পাছ মস্ত ছায়া ফেলে বিলের ওপর। রাত বাড়ে, বিলু জুড়ে তার ছায়া খালি ছড়াতে থাকে, ছড়াতেই থাকে। অমাবস্যার ঘনঘোট অন্ধকার কি পূর্ণিমার হলদে জ্যোৎস্না কিংবা কৃষ্ণপক্ষের ঘোলা লাল আলোয় সেই মস্ত ছায়া গতরে মুড়ে কাৎলাহার বিল, বিলের দুই পাশে গ্রাম, বিলের কাছে খাল, বিলের সিথানে পাকুড়তলা, ওদিকে দক্ষিণে শরাফত মণ্ডলের টিনের বাড়ি এবং বাড়ির পুবে সাদা বকে-ছাওয়া শিমুল গাছ-সব, সবই মায়ের কাছে ভাতের জন্যে কাঁদতে কাঁদতে গায়ে মাথায় জাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে-পড়া মাঝিপাড়ার বালকের মতো একটানা নিশ্বাস নেয়। সেই নিশ্বাসের টানে ফেঁপানির রেশ। সব একসঙ্গে দেখার তখন ভারী জুত। এই সময় বেড়জালের দড়ি টানতে টানতে বিলের মাঝখানের আসমানে এসে দাঁড়ায় মুনসি বয়তুল্লা শাহ। তার আগে সাঁতার কেটে কেটে চলে যায় ভেড়ার পাল। মুনসিকে এক নজর দেখার সুযোগটা নিতেই তমিজের বাপের এখানে আসা। মুনসি কখনোই বেশিক্ষণ থাকে না। ওপরে আসমান আর নিচে পানি ও জমিন একেবারে একাকার। সবখানে মুনসির ইচ্ছামতোন বিচরণ। সবাইকে একটি লহমার জন্যে এক জায়গায় ঠাঁই করে দিয়ে জাল নিয়ে সে উড়াল দেবে উত্তরের দিকে। বাঙালি নদীর পথভোলা রোগা একটি স্রোত এসে মিশেছে। সেখানে কাৎলাহার বিলে। বিলের শিওরে পাকুড়গাছে বসে সকাল থেকে শকুনের চোখে মণি হয়ে ঢুকে মুনসি সূর্যের আকাশ পাড়ি দেওয়া দেখবে, দেখতে দেখতে হঠাৎ রোদে মিশে গিয়ে রোদের সঙ্গে রোদ হয়ে ওম দেবে বিলের গজার আর শোল আর রুই আর কাৎলা আর পাবদা আর ট্যাংরা খলসে আর পুঁটির হিম শরীরে। আর হয়রান হয়ে পড়লে পাকুড়গাছের ঘন পাতার আড়ালে কোনো হরিয়াল পাখির ডানার নিচে ছোটো একটি লোম হয়ে নরম মাংসের ওমে টানা ঘুম দেবে সারাটা বিকাল ধরে।

বিলের শিওরের আরো উত্তরেও কিন্তু সবই মুনসির কবজায়, সেখানেও তারই। রাজত্ব। তা তমিজের বাপ সেখানে গিয়েছে বৈ কি! সেখানে অনেক দিনের ঘন কাশবন সাফ করে পাটের জমি তৈরির আয়োজন করেছিলো শরাফত মণ্ডল। তখন পৌষ মাস। খুব ভোরবেলা কুয়াশার নিচে দুটো নৌকা করে নিজগিরিরডাঙার চাষাদের সঙ্গে এপারের মাঝিপাড়ার কয়েকজন গেলো, তমিজের বাপও চললো কামলা খাটতে। কাশবনে ওই সময়ে পানি থাকে না বলে তখনি এই উদ্যোগটা নেয়। কিন্তু না, কাশবনে খটখটে শুকনা জায়গা কোথাও নাই। তখনো পায়ের নিচে প্রতিটি কদমে পানি ছপছপ করছিলো। পৌষ মাসের হিম কাটাতে হাজার হাজার জোঁক গা শুকাচ্ছিলো কাশগাছের রোগা কাণ্ডে, তদের ভারে গাছগুলো একটু একটু নুয়ে পড়েছিলো। এতোগুলো মানুষ কাস্তেকোদাল নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লে দারুণ বুভুক্ষু জোঁকগুলো নিজেদের পছন্দমতো দলে দলে একেকজন কামলার হাতে পায়ে পেটে তলপেটে উরুতে নুনুতে পাছায় হাঁটুতে, এমন কি গোয়ায়-যে যেখানে সুবিধা করতে পারে—খামচে ধরে ঝুলে পড়লো। তাদের বহুকালের খিদে মেটাতে গিয়ে গিরিরডাঙার মাঝি ও নিজগিরিরডাঙার চাষারা ঠিক ভয় না পেলেও যন্ত্রণায় সেগুলো ছাড়াতে তৎপর হয়ে ওঠে এবং শরীরের কোনো না কোনো জায়গায় আস্ত জোঁক বা জোঁকের কামড়ের দাগ নিয়ে ঘরে ফেরে সন্ধ্যার পর। তা ওই জমি ব্যবহারের জন্যে শরাফত মণ্ডলকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো আরো কয়েকটা বছর। তাও সে নিজে নয়, তার বড়োবেটা। ওটার পত্তনি নেবে তখন ওখানে কাশগাছ একটাও নাই। চাষা ও মাঝিদের গতরে জোঁকের গাঢ় চুম্বনের রেশ মুছে যাবার আগেই কাশবনের বন্দোবস্ত নিয়েছিলো টাউনের উকিল রমেশ বাগচি। টাউনের বাবু,-জোতজমি করা কি এদের কাজ? তার বেকার ভাগ্নে টুনুবাবুকে জমির তদারকির ভার দিয়ে রমেশবাবু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। টুনুবাবুকে সাহায্য করার জন্যে এবং তার ওপর একটু নজর রাখার জন্যেও বটে, রমেশবাবু এদিককার একজন বেশ কর্মঠ, বিশ্বাসী ও বোকাসোকা মানুষ খুঁজছিলো। তমিজের বাপ ইচ্ছা করলেই সুযোগটা নিতে পারতো। খবরটা যখন পায় তার তখন একরকম উপাস চলছে, তমিজের মায়েরও আটমাস, কাজকাম করতে পারে না।

কিন্তু শরাফত মণ্ডল বললো, বিলের উত্তর সিথান জায়গা ভালো লয়। হুঁশিয়ার হয়া কাম করা লাগবি। তা মণ্ডল তো মিছা কয় নি, মুনসির রাগ একটু বেশিই বটে। কারো ওপর মুনসির আসর একবার হয় তো সারা জীবনের মতো তার সব কাজ কাম বন্ধ। তখন তার কিসের বৌ আর কিসের বেটাবেটি! তমিজের বাপ জাহেল মাঝির বেটা, পাক নাপাকের সে জানে কী? সেখানে গিয়ে কখন কী করে বসে সেই ভয়ে সে একেবারে গুটিয়ে পড়লো। তারপর আট মাস শেষ না করেই একটি মরা মেয়ে বিয়ে তমিজের মা মণ্ডলবাড়ির বৌঝিদের মতো বিছানায় শুয়ে পড়লে মণ্ডলের দুই নম্বর বিবি গলা নিচু করে সাবধান করে দেয়, তমিজের বাপ, বিলের সিথানে যাওয়া আসা করার চিন্তা করিস না। আবার কী মুসিবত হয় কে জানে?

এসব সেই কোন কালের কথা, কত বছর আগে, সে হিসাব করা তমিজের বাপের সাধ্যের বাইরে। আর দেখো, আজকাল মুনসিকে একটু দেখার লালচে সেই তমিজের বাপ রাতবিরেতে ঘুমের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিলের ধারে এসে হাজির হয় একই রাস্তা ধরে। তা মুনসির কোনো আলামত দেখতে হলে রাত্রিবেলাই হলো ঠিক সময়। তমিজের বাপের হাতের ঢেউয়ে ঢেউয়ে মেঘের গাঢ় ছাই রঙ হালকা ছাই হয়ে আসছে। এইবার বিলের পানিতে ভেড়ার পাল হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটবে। ছাইরঙ ঝেড়ে ফেলে মেঘ সম্পূর্ণ হাওয়া হয়ে যাবে। তখন ভেড়াগুলোর ময়লা সাদা পশমে ঢাকা শরীর দেখে ভেড়া বলে সনাক্ত করা সোজা। তা শালার মেঘ আর কাটে কৈ? মেঘ কাটলেই না ভেড়াগুলোর পিছে পিছে এসে হাজির হবে মুনসি। তার হাতে মাছের নকশা কাটা লোহার পান্টি। এই পান্টি তার হাতের সঙ্গে জোড়া লাগানো, বড়ো একটা আঙুলের মতো বেরিয়ে এসেছে তার হাতের তালু থেকে। মুনসির গলার ফাঁক দিয়ে তার হাঁকডাক দিনদিন একটু একটু করে কমলেও তার দাপটে শরীর এখনো কাঁপে। ওই ফাঁকের জন্যে সে কথা বলতে পারে না, তবে ওখান থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাসের যে ধমক বেরিয়ে আসে ভেড়ার পালের কাছে তার হুকুম বোঝার জন্যে তাই মেলা। চার পা ছুড়ে তারা সাতার কাটে, হাবুড়ুবু খায়। উত্তরে পাকুড়গাছ থেকে দক্ষিণে শিমুলগাছ, এমন কি উত্তর পূর্বে পোড়াদহ মাঠ ছুঁয়ে পানিতে সারারাত তাদের ডোবা ও ভাস, যাওয়া ও আসা সব চলে এই বাতাসের গর্জন মোতাবেক। তাদের তোলপাড়-করা চলাচলে বিলের সব মাছ সরে সরে যায়। প্রবীণ বোয়াল কি বুড়ো বাঘাড় তার পরিবার। পরিজন নিয়ে অনেক নিচে ড়ুব দিয়ে বিলের তলায় শ্যাওলায় কিংবা সোয়াশো বছর আগে ভূমিকম্পে তৈরি বন্যার তোড়ে মাঝির হাত থেকে খসে-পড়া বৈঠায় বুক পেতে অপেক্ষা করে, কখন ভেড়ার পাল গুটিয়ে নিয়ে ভেড়াগুলোকে গজার মাছের চেহারা ফিরিয়ে দিয়ে মুনসি এদের পাঠিয়ে দেবে বিলের নির্ধারিত জায়গায়। আর নিজে উঠে পড়বে পাকুড়গাছের মগডালে। তারপর? পরদিন সারাটা দিন ধরে শকুনের চোখের ধারালো মণি হয়ে আকাশ ফালা ফালা করে ফৈলবে। আর যদি ফুর্তি ওঠে তো রোদের মধ্যে রোদ হয়ে মিশে বিলের পানিতে তাপ দেবে। আর হাপসে গেলে পাকুড়গাছের ঘন পাতার আড়ালে হরিয়াল পাখির ডানার তলে লোমের মধ্যে লোমশিশু হয়ে হরিয়ালের নরম মাংসের ওমে টানা ঘুম দেবে একেবারে সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত।

তা না হয় হলো, কিন্তু এখন?—ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এতোদূর এসে তমিজের বাপ এখন মুনসিকে কৈ কোথাও দেখতে পায় না। জাগরণে তাকে দেখতে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার, স্বপ্নের আড়ালেই কি সে রয়ে যাবে চিরটা কাল? মুনসি মানুষ ভালো লয় গো। মানুষটা মুনসি ভালো লয়! ব্যামাক মানুষের আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে থাকতে সে বড়ই ওস্তাদ।হায়! হায়! মুনসি কি মানুষ নাকি? তওবা! তওবা! মুনসিকে মানুষের সারিতে নিয়ে এলে তোরকম বালামুসিবতই না সে দিয়েই চলবে! মরার আগে পর্যন্ত মুনসি হয়তো মানুষই ছিলো। তা সে কি আজকের কথা? সেই কোন আমলে এক বিকালবেলা বেলা ডোবার আগে আগে মজনু শাহের হাজার হাজার বেশুমার ফকিরদের সঙ্গে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় গোরাদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে সে পড়ে গিয়েছিলো সাদা ঘোড়া থেকে। সব্ব অঙ্গে তীর-বেঁধা সেই ঘোড়া উড়ে গেলো কোথায় কে জানে, আর এখানে এই কাদায় পড়ে থাকতে থাকতে মুনসির লাশ জ্বলে উঠলো লাল আগুন, নীল আগুন, কালো আগুনের শিখায়। তিন দিন তার জ্বলন্ত শরীর ছোঁয়ার সাহস কারো হলো না, কাফন দাফন সবই বাকি রইলো দেখে মুনসি কী আর করে, গুলিতে ফাঁক-করা গলা নিয়ে সোজা চড়ে বসলো পাকুড়গাছের মাথায়। মুনুসি সেই থেকে আগুনের জীব। তার গোটা শরীর, তার ল দাড়ি, তার কালো পাগড়ি, তার বুকের শেকল, তার হাতের পান্টি সবই এখন আগুনে জ্বলে। এরকম একটা মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে ফেলার ভয় ও আফসোসে তমিজের বাপ চমকে চমকে ওঠে। হয়তো এই চমকেই ধাক্কা খায় তার ঘুমের ঘনঘোর আন্ধার। হঠাৎ ঘুম-ভাঙা মানুষের মতো চোখ মেলে সে পা ফেলে সামনে। পায়ের গিরে-সমান পানিতে নিজের পায়ের ছপছপ আওয়াজে সে শোনে মুনসির গলা থেকে বেরুনো চাপা গর্জনের বন্ধু কাত্রানি। আশায় আশায় তার বুক ছটফট করে : এই বুঝি মুনসির দেখা পাওয়া গেলো! ভয়ে ভয়ে তার বুক ছমছম করে : এই বুঝি রে মুনসি এসে পড়লো! বিলের শাপলার মূল তার পায়ে ঠেকলে একটু উপুড় হয়ে সে আঁকড়ে ধরে শাপলার ডাঁটা। কিন্তু শাপলার লতা কি তার শরীরের ভার বইতে পারে? বিলের তলার কাদাই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট। তার হাতের মুঠোয় ছিড়ে চলে আসে শাপলার পাপড়ির দোমড়ানো টুকরা। হেঁড়া পাপড়ির নরম ছোঁয়ায় তার ঘুমের পাতলা কয়েকটা খোসা উঠে গেলেও ঘুম কিন্তু সবটা কাটে না। তার মধ্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সে চলতে থাকে বাড়ির দিকে। তার হাতে শাপলার হেঁড়াখোঁড়া পাপড়ি। কাধে জাল। তন্দ্রা কেটে যাবার আগেই পথ চলার একেকটি কদমে তন্দ্রা ফের ঘন হতে থাকে ঘুমে।

কিন্তু সবসময় কি এমনি হয়?-না কোনো কোনো দিন টানা কোনো আওয়াজে তমিজের বাপের ঘুম একদম ভেঙে গিয়েছে। অনেক দূর থেকে, পাকুড়গাছ ছাড়া আর কোখেকে হবে?-ভাঙা ভাঙা গলায় টেনে টেনে কে যেন কয়,

সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি।
তলায় গজার মাছ অতি হিংস্ৰমতি।।
গভীর নিশিতকালে মুনসির আদেশে।
বিলের গজার মাছ রূপ লয় মেষে।।

এর পরেও অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু তমিজের বাপ দারুণভাবে চমকে ওঠায় সেগুলো চলে যায় তার কানের এখতিয়ারের বাইরে, ফলে মাথায় চুলকানি তুলেই সেসব হারিয়ে যায়। এমন হতে পারে যে, কথাগুলো তার শরীর জুড়ে শিরশির করছিলো। সেগুলো শব্দের আকার পেতে না পেতে তমিজের বাপের ঘুম ভাঙে এবং ততক্ষণে আওয়াজটি ফিরে গেছে পাকুড়গাছে। যে বাতাসে ভর করে আওয়াজ আসে তারই প্রবল। ঝাপটায় এর পরের কথাগুলো উড়ে যায় দক্ষিণে মণ্ডলবাড়ির খুলি পর্যন্ত, তাইতে জেগে ওঠে শরাফত মণ্ডলের শিমুলগাছের সাদা বকের ঝক। এইসব বক হলো শরফতের পেয়ারের জীব, মণ্ডলের প্রতাপেই এরা বাঁচে এদের সবটা হায়াৎ নিয়ে। তার কড়া নিষেধ আছে বলেই গ্রামের মানুষ দূরের কথা, মাঘ মাসের শেষ বুধবারে দুর-দুরান্ত থেকে পোড়াদহের মেলায় আসা হাজার হাজার মানুষের কারো সাধ্যি নাই যে ঐ গাছের দিকে একটা ঢিল ছোঁড়ে। শরাফত মণ্ডলের মতো এই বকেদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিলো নিজগিরিরডাঙা গ্রামে। সেখানে চাষাপাড়ার খালের পর কামারপাড়া, কামারপাড়ার সীমানা শুরু হয় দশরথ কর্মকারের অর্জুনগাছ দিয়ে। দশরথের পূর্বপুরুষের নাম যদি মান্ধাতা না-ও হয়ে থাকে, তবু মান্ধাতার আমলেই যখন দশরথ তো দশরথ, তার ঠাকুরদারও জন্ম হয় নি, এমন কি ঠাকুরদার বাপেরও জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন কেটে নতুন বসতকরা নতুন ভিটায় সদ্য-বসানো হাঁপরের আঁচে হামাগুড়ি দিচ্ছে, অর্জুনগাছে বকেদের ঘর সংসারের শুরু সেই তখন থেকেই। বক ও কামারের বংশ বেড়েছে পাশাপাশি। গত আকালের সময় কামাররা পটাপট মরতে আরম্ভ করলে বেশ কয়েকটা বকও মরে পড়ে রইলো অর্জুনগাছের নিচে। আকালের সময় কামারদের জমিজমার অর্ধেক চলে যাচ্ছিলো জগদীশ সাহার দখলে, কামারদের ডেকে শরাফত টাকা দিলে সেই টাকা তারা জগদীশকে দিয়ে জমিগুলোকে ক্রোক হওয়া থেকে বাঁচায়। তবে সেগুলোর মালিক হয় শরাফত নিজেই। ওইসব কামার টাউনের দিকে চলে গেলে তাদের ভিটায় হাল দিতে যায় মণ্ডলের কামলারা এবং তখন অর্জুনগাছের বকের ঝাক বিল পাড়ি দিয়ে উড়ে এসে বসলো শরাফত মণ্ডলের শিমুলগাছের ডালে ডালে। এই অবলা পক্ষীর জাতকে শরাফত মণ্ডল ঠাঁই দিয়েছে পরম যত্নে। আল্লা মেহেরবান, তার নজরে এড়ায় না কিছুই, এই কাজে শরাফতের সওয়াব মিলেছে মেলা। তার পয়মন্ত সংসারে ছেলেমেয়ে, বৌঝি, গোরুবাছুর, হাঁস-মুরগি, জমিজমা, কামলাপাট দিনদিন বেড়েই চলেছে। তবে একটা কথা—হিন্দু গাঁয়ের পাখি কি কারো কপাল এতো ফেরাতে পারে? আসলে কথাটা মুখে বলতে একটু বাধো বাধো ঠেকলেও গ্রামের মানুষ জানে এই গাছভরা বক হলো মুনসির হুকুমের গোলাম। বকের মন্থর উড়ালে তমিজের বাপ তাই থরথর করে কাপে। এই কাঁপুনি আবার ঘুমের মধ্যে শোনা কিংবা ঘুম ভাঙানিয়া শোলোকেরও রেশ হতে পারে। এই শোলোক কি বের হয় মুনসির ফুটো গলার ভেতর দিয়ে বাতাসের ওপর ভর করে? নাকি তমিজের বাপের পরিচিত কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর তার লোমভরা কানে আটকে গিয়ে ভোঁ ভোঁ করে? ভোঁ ভোঁ আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত বিলের ওপর উড়াল দিয়ে দিয়ে তাই জরিপ করার দায়িত্ব পালন করতে করতে ৭/৮টা বক আবার তমিজের বাপের মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে সে পাক কি নাপাক তাই হিসাব করে চলেছে। গজার মাছের চেহারা নেওয়ার জন্যে মুনসি ভেড়ার পালকে হুকুম করে কীভাবে তাই দেখতে তমিজের বাপের ঘুমে-নেতানো দুটো হাত একটু আগে নড়ছিলো আকাশের মেঘ তাড়াতে, তাই এখন চট করে চেপে বসে তার নিজেরই মাথার ওপর। পাটের আঁশের মতো চুলে ঢাকা এই মাথায় বকের নজর পড়লেই মুনসির হাত থেকে তার আর রেহাই নাই গো, রেহাই নাই! মুখ ঘুরিয়ে তমিজের বাপ কাদা ঠেলে উঠে পড়ে ডাঙার ওপর। এবং সোজা পথ ধরে বাড়ির দিকে। এবার তার কদম পড়ে এদিক ওদিক। কয়েকবার গাইখুরা গাছের কাঁটা লাগে পায়ের নিচে, হাজা-পড়া পায়ের অজস্র ফুটোর কয়েকটিতে কাটা বিধেও যায়। হাঁটতে হাঁটতে কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে আরো কাঁটা বেঁধার ঝুঁকি নিয়ে আরো জোর কদম ফেলে সে ছোটে বাড়ির দিকে। এরকম কতোবার আকাশের মেঘ তাড়িয়ে মুনসিকে দেখতে গিয়ে পাতলা ছাই রঙের উড়ন্ত মেঘ চোখে পড়লে তারই ভয়ে পিছু হটতে গিয়ে তমিজের বাপ তার ঘাড়ের তৌড় জাল ফেলে গেছে বিলের ধারে, কখনো কাদার ওপর, কখনো বৃষ্টিভেজা ডাঙায়।

 ০২. পেটে খিদের খোঁচা

পেটে খিদের খোঁচায় চোখজোড়া ফাঁক হয়ে পড়লে কুলসুমের নজরে পড়ে দরজার কপাট একটা হাট করে খোলা। তমিজের বাপের বাঁ পায়ের কাদামাখা পাতা চৌকাঠের ওপর। দরজা কি খুলে পড়েছে এই পায়ের ধাক্কাতেই? কী করে হয়? ঐ পায়ে কি সেই জোর আছে? মাটিতে শুয়ে রয়েছে; এর মানে মানুষটা রাত্রে উঠে বাইরে গিয়েছিলো; তার মানে কালাহারের কাদাপানি তার পায়ের না হলেও দুই আনা রক্ত টেনে নিয়েছে। আজ দুপুরবেলা পর্যন্ত হাঁটার ক্ষমতা তার হবে কি-না সন্দেহ। তার ডান পা অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে দরজার ভেজানো কপাটের শেষ প্রান্তে। তার রঙ-জ্বলা ভবনের অনেকটাই ওপরে ওঠানো, কাপড় তার জায়গামতো নাই। অনেকদিন আগে, এই ঘরে তখন তমিজের মায়ের সংসার, একদিন অমাবস্যার রাতে তমিজের বাপ কালাহার বিলে নামলে মুনসির পোষা গজারের একটি এক কামড়ে তার উরু থেকে খুবলে নিয়েছিলো এক ছটাক মাংস। তমিজের বাপের বন ওপরে ওঠায় সেই কামড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। তার নিচে হাঁটুতে দগদগ করে বছরখানেকের একটি ঘা। এই ঘা শুরু হলো বড়শির খোঁচা খেয়ে। বড়শি পেতে তমিজের বাপ বসেছিলো ফকিরের ঘাটের শ্যাওড়াগাছের নিচে। মস্ত একটা মাগুর বড়শিতে গেঁথে গেলে তমিজের বাপ হঠাৎ করে টান দেয়। মাগুরশুদ্ধ বড়শি এসে লাগলো তার হাঁটুর ওপর, বড়শি থেকে মাছ ছিটকে পড়ে শ্যাওড়াগাছের নিচু একটা ডালে আর বড়শি গেঁথে যায় তার হাঁটুর ভেতর। মাছটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি, পানিতে যে ওটা ফিরে গেছে তারও কোনো আলামত তমিজের বাপ দেখে নি। মাছটা তবে ডাঙায় এসেছিলো কার ইশারায় যে তার কারসাজিতে বড়শির ঘা তার আজো সারলো না? তমিজের মায়ের আমলের গজার মাছের কামড়ের দাগ আর হাল আমলের বড়শিবেঁধার ঘা কিন্তু কাছাকাছিই থাকে। ঘা তার দিনে দিনে বাড়ে, ভাব দেখে মনে হয়, গজারের কামড়ের দাগকে বুঝি এই ছুঁয়ে ফেললো। কিন্তু ঐ দাগের সীমায় পৌঁছে শালা আর এগোয় না, আর ওপরে ওঠার লক্ষণ তার নাই। তবে ঘা তার শুকায়ও না, যেটুকুই আছে পুঁজে রসে তাই আরো পুরুষ্ট হয়ে ওঠে।

কাদা লেগে রয়েছে হাঁটুর নিচেই। আর একটুখানি ওপরে লাগলে ঘায়ের আঁশটে গন্ধে কালাহার বিলের সোঁদা গন্ধ মিশে অন্য একটি গন্ধ পাওয়া যেতো। ঐ গন্ধটাও কুলসুমের খুব চেনা। এখন পর্যন্ত আগলে-রাখা নাকছাবিপরা নাকটিকে কুঁচকে নিশ্বাস নিলে বিলের পানির একটু সোঁদা, একটু পানসে ও একটু আঁশটে গন্ধের সঙ্গে তার নাকে ঝাপটা মারে অন্য আরেকটি হালকা বাস্না। কিসের বাস্না গো? মাচার ওপর উঠে কুলসুম এদিক দেখে, ওদিক দেখে। গন্ধে গন্ধে দিশা পেলে জিনিসটা তার চোখে পড়ে। কী গো?–না, তমিজের বাপের রোগপটকা কালোকিষ্টি গতরের পিঠের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে শাপলা ফুলের হেঁড়াখোড়া পাপড়ি। এবার কুলসুমের নাকের সঙ্গে সারা পেট ও বুক নিয়োজিত হয় গন্ধ শোকার কাজে। সারাটা শরীর দিয়ে বাতাস টেনে টেনে ছোটো ও মাঝারি নিশ্বাসগুলিকেও সে প্রসারিত করে লম্বা একটি নিশ্বাসে। তা সেটাকে দীর্ঘশ্বাসই বলা যায়। এই দীর্ঘশ্বাসটিকে শব্দে হেঁকে নিলে তার কথাগুলি হবে এরকম : বুড়া যদি শাপলার উঁটা কয়টা তুলে আনতো! তাহলে কী হতো? তাহলে বেশি করে মরিচ দিয়ে, রসুনের কয়টা কোয়া কুচিয়ে ফেলে কুলসুম কী সুন্দর চচ্চড়ি বেঁধে ফেলে। একটু চচ্চড়ি হলে পোড়া মরিচ কয়টা ডলে নিয়ে তমিজের বাপ তিন সানকি ভাত সেঁটে ফেলতে পারে একাই। রাতভর হাঁটাহাঁটি করে আর কাদাপানি ঘেঁটে ঘরে ফিরলে পরদিন অনেক বেলা করে উঠে তমিজের বাপ কী ভাতটাই না গেলে! এই হাড়গিলা গতরটার ভেতর বুড়া এতো এতো ভাত রাখে কোথায়?

বুড়ার জন্যেও বটে, তার নিজেরও বেশ খিদে পেয়েছে, আজ সকাল সকাল ভাত চড়ানো দরকার। কাল দুপুর থেকে ঝমঝম বৃষ্টি, উঠানের চুলা পানিতে টইটম্বুর। পরশুদিনের ভাতে পানি দেওয়া ছিলো, কাল বিকালে তমিজের বাপ একলাই তার সবটা গিললো। পান্তা খেয়ে হুকায় কয়েকটা টান দিয়ে মাচায় উঠে বুড়া সেই যে নিন্দ পাড়তে শুরু করলো, আল্লা রে আল্লা, সন্ধ্যাবেলার ঝড়, ঝড়ের পর বৃষ্টি, তারপর আসমানের একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর ফের টিপটিপ বৃষ্টি, মানুষটা এসবের কোনো খবরই যদি রাখে! পেট ঠাণ্ডা থাকলে বুড়া কী ঘুমটাই যে পাড়ে!

কাল সকালে কয়েকটা শাক আলু পেটে জামিন দিয়েছিলো কুলসুম। ব্যস ওই পর্যন্ত। এ ছাড়া এ পর্যন্ত তার মুখে একটা দানা পড়ে নি। তার আর ঘুম হয় কোখেকে? ঘরে ভোলা-উনান একটা আছে, কিন্তু পরের দিন বাদলা হলে চাল জুটবে কী করে—এই বিবেচনায় হাঁড়ির চালটুকুতে গন্ধ নিয়ে কুলসুম গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছিলো স্বামীর পাশে। ঘরে এবার নতুন চাল ছাওয়া হয়েছে, কোনোখান দিয়ে পানি পড়ছে না—এই সুখে বিভোর কুলসুমের চোখেও যে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিলো সে কিছুই টের পায় নি। তারপর তমিজের বাপ কখন উঠলো, বাইরে গেলো কখন, আবার ফিরে এসে শুয়ে পড়লো মেঝেতে,-কুলসুম এসব কিছুই টের পায় নি। তমিজের বাপ এখন যতোই ঘুমাক, বেলা করে ঘুম থেকে উঠে পিঁচুটি-জড়ানো চোখে ঘরের কোণে হাঁড়িবাসনের দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকবে, তারপর ভাত না পেলে তার সারা শরীরে সাড়া পড়ে যাবে, তখন গলা থেকে কাশি জড়ানা যে স্বর বেরোবে তাতে আর কারো ঘরে টেকা দায়।

তবে সেই স্বর বেরুতে এখনো দেরি আছে, বুড়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে ঘরের দুটো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার মাটির সরা তুলে কুলসুম প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়। এই কম্ম করতে তাকে মেঝেতে নামতে হয় নি, মাচায় বসেই মাচার শেষ প্রান্তের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা যায়। তো তার তিনটে কি চারটে নিশ্বাসে হাঁড়ির সের দেড়েক চালে বলকানো ভাতের সুবাস পাওয়া যায়। এতে তার পেট, তারপর তলপেট এবং তলপেট থেকে ফের পেট হয়ে ওপরদিকে বুক ও একেবারে জিভ পর্যন্ত চনচন করে ওঠে। চালের ভাতের গন্ধ পেয়ে পেটের এই তোলপাড়ে কুলসুমের গতর কিন্তু এলিয়ে পড়ে না, বরং আরো চাঙা হয়ে ওঠে। গতরের সাড়ায় সে তখন এটা করে, ওটা করে। যেমন, কয়েক মাস আগে টাউন থেকে তমিজের নিয়ে-আসা বড়ো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার মাটির সরা সরিয়ে তমিজের মায়ের আমলের একটা ওষুধের শিশি আলগোছে তুলে তার খরখরে আঙুলে কাচের মসৃণ ছোঁয়া নেয়। ছোটো গোল আয়নাটা ডান হাতে নিয়ে একবার নিজের মুখের ডানদিকে, একবার বাঁদিকে এবং একবার চিবুক দেখে। দুই গাল ও চিবুক দেখার পুনরাবৃত্তি চলে বেশ কয়েকবার। দুই গালের মধ্যে তার তেমন ফারাক নাই, শরীরের শ্যামলা রঙ গালে ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে বলে নিজের মুখটাকে তার প্রায় ফর্সাই ঠেকে। টিকলো না হলেও নাকটা তার উঁচুই, সামনের দিকটা একটু বড়ো। ঠোঁটজোড়া তার দাদার মতো অতোটা পাতলা নয়, কিন্তু পান খেলে দাদার মতোই দুটো ঠোটই টুকটুকে লাল দেখায়। দাদার মুখে পানশুপারি থাকতে দিনরাত, কুলসুম পান পায় কোথায়? আয়না ভালো করে দেখে সেটা পাশে রেখে হাঁড়ির ভেতর থেকে একটা একটা করে তমিজের পুরনো পিরান, লুঙি ও তিলে-ধরা কিস্তি টুপি হাতে নিয়ে নাকের সঙ্গে ঠেকিয়ে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে গন্ধ নেয়। তমিজের পিরানের পিঠটা হেঁড়া, তমিজ ফেলে যাবার পর আর ধোয়া হয় নি। জামার বুকে ঘামের গন্ধ দিনদিন ফিকে হয়ে আসছে, কুলসুমের নিশ্বাসের তোড়ে শিগগরিই মুছে না যায়! না-কি নিশ্বাসে নিশ্বাসেই এর গন্ধ এখন পর্যন্ত টিকে আছে কি-না তাই বা কে জানে?

রোজ সকালবেলার এইসব কাজকাম সেরে কুলসুম মেঝের দিকে আড়চোখে তাকায়। না, তমিজের বাপ আঘোরে ঘুমায়। কুলসুম এবার মাচার সব হাঁড়িপাতিল বস্তার আড়ালে লুকিয়ে-রাখা ঘরের সবচেয়ে পুরোনো জিনিস তার দাদার জরাজীর্ণ বইটা বার করে জান ভরে গন্ধ নেয়। বইটা তার দাদার, দাদা হলো তার বাপের বাপ, অথচ তমিজের বাপ এটাকে আগলে রাখে যক্ষের ধনের মতো। জাহেল মানুষ, মাঝির বেটা, বইয়ের সে বোঝেটা কী? অথচ কুলসুম এটায় হাত দিয়েছে টের পেলেই কটমট করে তাকায়। পাতায় পাতায় চৌকো চৌকো দাগ দেওয়া আর হাবিজাবি কী লেখায় ভরা এই বই তার দাদা যে কী বুঝতো আল্লাই জানে, এ নিয়ে কুলসুমের মাথাব্যথা নাই। তবে হাজার হলেও দাদার জিনিস, অনেকক্ষণ ধরে গুঁকলে দরজায় দাদার চেহারাটা ভেসে ওঠে। কিন্তু তারিয়ে তারিয়ে দাদাকে দেখার সময় কোথায় তার? মাটিতে কুলসুমের ভারি পায়ের চাপে তমিজের বাপের রোগা কালো গতরে অল্প একটু হলেও সাড়া পড়ে, কীসব বিড়বিড় করতে করতে লুঙিটা সে তোলে আরেকটু ওপরে। এতোক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো তার হাঁটুর ঘা, এবার তমিজের মায়ের আমলের কাটা দাগটাও বেরিয়ে পড়লো। লুঙি আরেকটু ওপরে উঠলেই বুড়ার কালো কালো কুচকুচে বিচি দুটোর ওপর ন্যাতানো নুনুখানও বেরিয়ে পড়বে। ওটা দেখে লাভ কী কুলসুমের? কিন্তু স্বামীর লুঙি ঠিক করার চেষ্টা না করে কুলসুম চুপচাপ দাড়িয়েই থাকে। কান দুটো তার খাড়া করে রাখা, সমস্ত মনোযোগ দিয়ে সে তমিজের বাপের বিড়বিড় ধ্বনির আস্ত আস্ত শব্দগুলো শুনতে চায়। তমিজের বাপের থুথুতে জড়ানো তলাত তাজল তাছ ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ছপছপ করে গড়িয়ে পড়লে কুলসুম আরো ভালো করে কান পাতে। তমিজের বাপ এখন কী স্বপ্ন দেখছে? কাজল বলতে গিয়েই কি তার মুখ দিয়ে তাজল বেরুলো? দাদা বলতো, কাজলের স্বপ্ন দেখলে ছেলেমেয়ে বাপমায়ের কলজে ঠাণ্ডা করে দেয়। এর মানে হলো, ছেলেমেয়ের হাতে বাপমায়ের জান জুড়ায়। তা তমিজের বাপের ফরজন্দ বেটা আছে, এরকম খোয়াব তো সে দেখতেই পারে। নিজের খালি কোলে হাত রেখে স্বামীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত কুলসুম চোখ বুলায় এই আবোর মানুষটা কি তার বিয়ে-করা বিবির শূন্য কোলের কথা কখনো ভাবে? তার কি হুঁশজ্ঞান কিছু আছে?–বেহুঁশ হয়ে ঘুম পাড়তে পাড়তে তমিজের বাপ নতুন করে বিড়বিড় করে উঠলে কুলসুম ফের সেদিকে কান পাতে। কিন্তু অন্য সময়ের মতো এখনো তার কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে গলার ভেতর ভাত খাবার সুড়ঙ্গ দিয়ে সেঁধিয়ে পড়ে তমিজের বাপের পেটের ভেতর। কুলসুম কখনো তার নাগাল পায় না। দিনের বেলা কিংবা রাতেও জাগনা থাকলে শোলোক বলার ক্ষমতা তমিজের বাপের লোপ পায়। তখন যতোই পুস করো, ক্যা গো, নিন্দের মদ্যে কার সাথে কি শোলেক কচ্ছিলা, কও তো? শুনে তমিজের বাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, তার ঘুমের ভেতরকার কথা জানবার জন্যে কুলসুম বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে ভুরু কোঁচকায়, মেজাজ ভালো থাকলে হয়তো স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নে বলা শোলোক মনে করার চেষ্টা করে, চেষ্টা করতে করতে ঝিমায়, চেষ্টা করার ক্লান্তিতে তার স্বর নিচু হয়ে আসে এবং ঘুমের ভেতরে যেভাবে বলে প্রায় সেভাবেই বিড়বিড় করে, নিন্দের মদ্যে মানুষ কী কয় না কয়, কিছু মনে থাকে? কী জানি বাপু, কী যে কলাম। কী বা দেখলাম। তার স্বপ্ন মনে করার জন্যে কুলসুম আরো মিনতি করলে তার দাম বাড়ে, ধমক দিয়ে ওঠে তখন, অঙের কথা এখন থো। ভাত দে। ভাদ্দে। কামোত যাই। কুলসুমের গো তবু যায় না, স্বামীর ধমক খেয়েও তার হুশ হয় না, এমন কি তমিজের বাপের হাতের মারও সে থোরাই পরোয়া ক্লরে। ঘুমন্ত মানুষ কথা বলে মুনসির সাথে, না হলে জিন পরির সাথে, মাসুম বাচ্চাদের আলাপ হয় ফেরেশতাদের সাথে। আগুনের জীবদের সাথে তমিজের বাপের কি যোগাযোগ হয় না? দাদা বলতো, মানুষটাক আবোর ঠেকলে কী হয়, জাহেল মাঝির বেটা হলে কী হয়, অর মদ্যে বাতেনি এলেম থাকবার পারে রে! মানুষটার মদ্যে আগুন জ্বলে!

এমন কালোকিষ্টি ছাইয়ের গাদার ভেতর আগুন উস্কে তোলার জন্যেই কি দাদা তাকে এর হাতে সোপর্দ করে কেটে পড়লো? তা সেই দাদার তত্ত্বতালাশ কি তমিজের বাপ কিছুই করতে পারে না? দাদার সঙ্গে কতো বছর ধরে এতো মেলামেশা করলো, এতো গুজুরগাজুর এতো ফুসুরাসুর করেও তমিজের বাপ কি দাদার কি কিছুই রপ্ত করতে পারলো না? দাদার যে হেঁড়াখোড়া পুরোনো বই, বইয়ের ভেতরে নানা কিসিমের চিহ্ন, চৌকো রেখা, হাবিজাবি কীসব লেখা,-এইসব দেখে দেখে, মাটিতে ওইসব রেখা এঁকে এঁকে দাদা কতো মানুষের খোয়াবের মানে বলে দিয়েছে, হারানো জিনিসের হদিস করে দিয়েছে; কত মানুষের হাউসের মেয়েমানুষের সঙ্গে আশেকের পথ বাতলে দিয়েছে; বলতে নাই, কুলসুম শুনেছে জোয়ান বয়সে এই বই দেখে দেখেই মানুষের কাছে পয়সা নিয়ে দাদা অনেকের সংসার ভেঙেও নাকি দিয়েছে।তো সেই বইটাই রয়ে গেলো তমিজের বাপের কাছে। বইয়ের মালিক হয়েও মানুষটা কুলসুমের দাদার কোনো খবরই বার করতে পারে না। ঘুমের মধ্যে এই যে উঠে কোন মুলুক ঘুরে আসে, ঘরে যতোক্ষণ ঘুমায় ঘুমের মধ্যে কী কী বলে, দাদার শোলোকগুলোই তোতলায়, তা সে কি কোনো ইশারাই পায় না? নাঃ! তার কথা বোঝবার কোনো উপায়ই কুলসুমের নাই। এইযে কথা কয়টা মুখ থেকে ছাড়তে ছাড়তেই তমিজের বাপ ফের মিহি সুরে নাক ডাকতে শুরু করলো, কখন খান্ত দেয় কে জানে? মেঝে জুড়ে বুড়া যেভাবে শুয়ে থাকে তাতে মাচা থেকে কুলসুমের নামাটাও মুশকিল। ওই হাড়গিলা শরীরে তিল পরিমাণ জায়গাতেও তার পা ঠেকে তো সর্বনাশ, বুড়া একটা হুলুস্থুল কাণ্ড করে বসবে। এই পা লাগানো নিয়ে একদিন তার কম ভোগান্তি হয় নি।

সেও তো অনেকদিন হয়ে গেলো। তার বিয়ের তখন বোধহয় বছর দুয়েক কেটেছে, তমিজের বাপ সন্ধ্যারাতে বসে ভাত খাচ্ছে, ল্যাম্ফোর কালচে আলোয় ঘর একটু থমকে ছিলো, বাইরে চাঁদের আলোয় উঠানে বসে হুঁকা টানছিলো তমিজ। তামাকের ধোঁয়ার নেশায়-মাতাল জ্যোৎস্নার অনেকটাই খোলা দরজা পেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে কালচে লাল আলোতে হলুদ রঙ মিশিয়ে দেওয়ায় কুলসুমের মাথাটা হয়তো এতটু ঘুরেই গিয়েছিলো। এমন সময় ট্যাংরা মাছ দিয়ে গোগ্রাসে ভাত খেতে খেতে তমিজের বাপ একটা পেঁয়াজ চাইলো। কুলসুম উঠে দাঁড়িয়ে মাচার ওপর মাটির হাঁড়ি থেকে পেঁয়াজ পেড়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে স্বামীর পাতে দেবে বলে উপুড় হয়েছে, কিংবা উপুড় হয়ে বসতে গেছে স্বামীর সামনে, এমন সময় তার বাম পা লেগে গেলো তমিজের বাপের ডান হাতের কনুইতে। ফলে ভাতের সানকিখান একটু কাৎ হয়ে পড়লো। ঘরের মেঝে লেপামোছায় কুলসুম একটু অকর্মা, সারা মেঝে জুড়ে সম্পূর্ণ সমান জায়গা, একটাও যদি পাওয়া যায়! তা তমিজের বাপের সানকির ডালের একটুখানি ছলকে পড়লো মেঝেতে। না, আর কিছু পড়ে নি। ছলকে-পড়া ডালের সঙ্গে ভাতের কয়েকটা দানা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ির মাছের কণা কি বেগুনের কুচি কি পোড়া মরিচের কামড়ানো টুকরা সব যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গিয়েছিলো সানকির ভেতরেই। তাতেও মানুষটার রাগ কী! তড়াং করে লাফিয়ে উঠলো ভাত ছেড়ে, তারপর শুরু হলো তার সাটাসাটি, তুই আমার ভাতেত পাও দিস? এই নাপাক ভাত হামি এখন মুখোত তুলি ক্যাংকা করা? সঙ্গে সঙ্গে ওই এঁটো হাতের কিল পড়তে লাগলো কুলসুমের পিঠে। বাপরে, ভাতের সঙ্গে বহুদিন পর মুখে দুটো মাছ পড়তে না পড়তে বুড়ার তেজ কী! হাতের কিল আর তার থামে না। ওদিকে চাঁদের আলোয় হুকা টানা খান্ত দিয়ে দরজায় এসে দাড়ালো তমিজ। বাপের রাগে জোগান দেয়। সেও, বাজানের ভাতের থালিত তুমি পাও দেও? ইটা কেমন কথা গো? মুখের রন্ন তুমি পাও দিয়া ঠেললা? নক্ষ্মীর কপালেত তুমি নাথি মারো? কেমন মেয়ামানুষ গো তুমি?

ছেলের সমর্থনে শক্তি পেয়ে বাপ বৌয়ের চুল ধরে টেনে আনে উঠানে, বলে, অতো খলবল খলবল কিসক রে? হুঁশিয়ার হয়া কাম করা যায় না? বেহায়া মাগী, মনে হয় চুলকানি উঠিছে, খালি নাফ পাড়ে, খালি নাফ পাড়ে। আর এই তমিজ জোয়ান মরদটা, কিছুই জানলো না, বুঝলো না, শুরু করলো প্যাচাল পাড়তে, ওজগার তো করো না, ফকিরের ঘরের বেটি, ওজগারের কষ্ট তো বোঝো না! মানুষের ভাতের থালিত তুমি নাথি মারবা না তো মারবি কেটা? তমিজের আক্ষেপে তার বাপের তেজ কিন্তু বাড়ে না। সানকি থেকে ভাতের কয়েকটা দানা গড়িয়ে পড়ার বেদনায় ক্লিষ্ট মুখে সে আরো কয়েক গ্রাস ভাত তোলে এবং তবুও অর্ধভুক্ত থাকার কষ্ট বুকে নিয়ে উঠানের দিকে মুখ করে বসে পড়ে চৌকাঠের ওপর। উঠানের ছোটো ফাঁকা জায়গাটা হালকা ফ্যাকাশে জোৎস্নায় একটুখানি ওপরে উঠেছিলো, ঊর্ধ্বগামী সেই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে সে হুঙ্কার ছাড়ে, তামুক দে! বৌকে বকার হঠাৎ উত্তেজনায় সে হাঁপায়, ফলে তার হুঙ্কারে রুগ্ন ঘর্ঘরতা, সেই শব্দে জোৎস্নায় এতোটুকু চিড় ধরে না এবং কুলসুম পর্যন্ত ওই হুকুম কিংবা তমিজের হালকা ক্ষোভ এবং জ্যোৎস্নাপীড়িত ছটফটে শূন্যতাকে কিছুমাত্র পরোয়া না করে পায়ের দুমদাম আওয়াজে ঘরে ঢোকে। ঐ যে ঘরে ঢুকে মাচার ওপর শুয়ে পড়লো, সারারাত সে আর উঠবে না। মেঝেতে তার ভাতের খোলা হাঁড়ি যেমন ছিলো তেমনি খোলাই পড়ে থাকবে, এলোমেলোভাবে ছিটানো থাকবে এটা ভাতের সানকি, পানি খাবার খোরা, পানির বদনা। এসব এমনি পড়েই থাকবে। এই যে না খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো, এখন মারো আর বকো, কারো সাধ্যি নাই তাকে মাচা থেকে ওঠায়। ওদিকে মণ্ডলবাড়িতে রাতভর সের দুয়েক চাল নিয়ে ঘরে ফেরা, তাই বা কম কী? এখন এই মাগীকে মাচা থেকে ওঠায় কে? বৌকে মাচা থেকে ওঠাবার ক্ষমতা হয় না বলে এবং গলার জোরও মিইয়ে আসায় তমিজের বাপকে অব্যাহত রাখতে হয় আগের প্যাচাল। তবে প্যাচালে এখন আফসোসই বেশি, মেয়ামানুষ, তার এতো কোদ্দ ভালো লয়, ভালো লয়। আজ পাছাবেলা থ্যাকা খলবল, খালি খলবল। নাফপাড়া মেয়ামানুষের কপলেতে দুষ্ক থাকে, সংসার ছারেখারে যায়।

মাচায় শুয়ে এসব শুনতে শুনতে কুলসুমের সত্যি সত্যি লাফ পাড়তে ইচ্ছা করে। বুড়া তার লাফ পাড়ার দেখলোটা কী? খিয়ার এলাকায় ধান কাটা সেরে আগের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলো তমিজ। গাঁয়ের বাইরে রোজগার করতে যাওয়া জীবনে তার সেই প্রথম। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো কম করে হলেও তিন আনা কম দুইটা টাকা। আকালের দুই বছর আগে সেটা কি কম টাকা গো? খিয়ারের ধান নিয়ে এসেছিলো তাও সের আষ্টেক তো হবেই। কাল সন্ধ্যায় তমিজ যখন বাড়ি পৌঁছয় কুলসুম তখন মণ্ডলবাড়িতে। পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে সে দেখে, তমিজ গিয়েছে নিজগিরিরডাঙায়, মণ্ডলের জমির ফলন আর ধান কাটা দেখতে। তারপর কাৎলাহার বিল ঘুরে এসেছে তৌড়া জালটা নিয়ে, কয়েকটা ট্যাংরা নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর পেরিয়ে বিকাল। মাঝির ঘরের ছেলে হলে কী হয়, মাছ ধরায় তার হাউস কম, কেরামতিও একটু কমই। তবে মাছ ছাড়া খিয়ারের চিকন চালের ভাত খেতে মন চায় না। সেই জন্যেই তার জাল নিয়ে বিলে যাওয়া। খিয়ারের চিকন চালের ভাত, চিরল চিরল করে কাটা এলোকেশী বেগুনের সঙ্গে খুব ঝাল দিয়ে বাঁধা মাছ। চচ্চড়ি, মাসকলায়ের ডাল আর নতুন আলুর ভর্তা,এতোসব রান্নাবান্নার উত্তেজনায় কুলসুম সেদিন তমিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলো একটু বেশি। হাসাহাসিটাও বোধহয় বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। তা কুলসুমের দোষ কী? বুড়া খালি তার পেছনে লেগে থাকে, নিজের বেটার ইয়ার্কি মারা তার চোখেই পড়ে না। রঙ করে তো তার বেটা, আজ দেখা হওয়ার পর থেকে তো সে কেবল মজা করে খিয়ারের গল্পই করলো সেখানে একোজন জোতদারের দেড়শো দুইশো পাঁচশ্যে হাজার বিঘা জমি। তাদের জমিতে দাঁড়ালে যতোদূর চোখ যায় খালি ধানের ভিউ। মাঠের পর মাঠ সেখানে ধানের জমি। কোন কোন মুলুক থেকে সেখানে ধান কিনতে যায় পাইকাররা। মণকে মণ ধান কিনে ধানের বস্তা নিয়ে রেলগাড়ি করে তারা চলে যায় কোথায় কোথায়! তালোড়া না কাহালু-কীসব জায়গায় রেলের স্টেশন আছে, স্টেশনের পাকা বারান্দায় ধানের বস্তার পাহাড় জমে ওঠে! এতো ধান হলে কী হবে, খিয়ারের মানুষ নাকি কিপটের একশেষ, ফকির মিসকিনকে তারা খয়রাত দেয় না, রাত্রে মুসাফির এলে তারা ঘরের দরজা আটকে রাখে। দেশে পানি না থাকলে মানুষের জানে দয়ামায়া একটু কমই হয়। সেখানে নদী নাই, খাল নাই, খালি বড়ো বড়ো পুকুর। সেগুলো তো আর আল্লার দান নয়, মানুষের কাটা। নদীই নাই, সেখানে বান হবে কোত্থেকে? বানের পানির কামড়ে পায়ে ঘা হয় শুনে কোন বর্গাদারের বেটার বৌ ও মা! কী কচ্ছে? পানি বলে কামড়ায়? পানির দাঁত জালায় নাকি? বলে কীরকম আঁতকে উঠেছিলো তমিজ অদ্ভুত ভঙ্গি করে তার নকল করলে কুলসুম হেসে বাঁচে না। তবে খিয়ারের মানুষের সুখ বুঝি আর টেকে না।–উত্তর থেকে পশ্চিম থেকে নতুন নতুন ঢেউ আসছে, বর্গাদাররা সব ধান নিজেদের ঘরে তোলার জন্যে একজোট হচ্ছে। ইগলান কী কথা?-কুলসুমের বিস্ময়ে উৎসাহিত হয়ে তমিজ গম্ভীর হয়ে যায়। তবে কুলসুমকে আবার আশ্বাসও দেয়, কোথায় এখন যুদ্ধ চলছে, সবাই সেই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, বর্গাদারদের নেতারা কী করবে বুঝে উঠতে পাচ্ছে না। তা যুদ্ধের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী?—কুলসুমের এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া তমিজের পক্ষে একটু মুশকিল। তবে সে জানায়, যুদ্ধের জন্যে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। টাউনে তমিজ নিজে নিজে দেখে এসেছে গোরুর গোশতের সের উঠেছে। চার আনায়। দর না উঠলে সেরখানেক গোশত সে নিয়ে আসতো। এই যে বাজারে সাদা কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না, মণ্ডলরা হ্যারিকেন জ্বালাতে টাউন থেকে চড়া দামে সাদা কেরোসিন আনে,—এসবই যুদ্ধের জন্যে। যুদ্ধের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম চড়বে কেন?—কুলসুমের কৌতূহলে সাড়া না দিয়ে তমিজ তখন টাউনের গপ্পো ধরে। তাকে খিয়ারে যাওয়া আসা করতে হয়েছে তো টাউন হয়ে। টাউনের মানুষ সব দোকানে বসে চা খায়, গরম চা দেয় ছোটো একটা খোরার মধ্যে করে। যুদ্ধের জন্যে নাকি সাদা। চিনিও পাওয়া যায় না, তারা লাল চিনির চা খায়, একেক খোরা দুই পয়সা। একবার খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে তমিজের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে বাবা, আর নয়! টাউনের মানুষ সব মানুষ সুবিধার লয় গো, কথার প্যাচে তারা মানুষকে ঠকায়, চার আনার জিনিস তারা দর হাঁকে আট আনা দশ আনা। সেখানকার হোটেলে কতো কিসিমের খাবারই যে পাওয়া যায়, কুত্তা জবাই করে তারা খাসি বলে চালায়। তমিজ তাই টাউনে আর যাই করুক, গোশত কখনোই খায় না। তাকে ঠকাবার জো নাই, পুবের পাড়াগাঁর মানুষ হলে কী হয়, টাউনের ফন্দি ফিকির ধরতে আর দেরি হয় নি। তারপর ধরো টাউনের মেয়েমানুষেরা! তারা কীভাবে কথা বলে, মাজা দুলিয়ে তাদের হাঁটা, বিয়ের বয়েসি ল মেয়েরা, বিয়ে দিলে দুই তিন ছেলের মা হতো, বুকের সঙ্গে বই জড়িয়ে ধরে ইস্কুলে যায়, রিকশায় শাড়ি জড়িয়ে পর্দা করে বসেও শাড়ির ওপর দিয়ে মুখ তুলে তারা টাউন দেখতে দেখতে, কথা বলতে বলতে চলে,-শরীর দুলিয়ে তমিজ এসব বিত্তান্ত এমনভাবে বলে যে হেসে কুটিকুটি না হয়ে কুলসুমের আর জো থাকে না। তা এসব কথাবার্তা আর হাসাহাসিতে তমিজের বাপের মন থাকবে কোত্থেকে? ঘরে থাকলে বেশিরভাগ সময়ই তো সে ঘুমায়, না হয় হুঁকাটা হাতে গুড়ক গুড়ুক টানে, না হলে চৌকাঠে বসে ঝিমায়। তা এতোদিন পরে তমিজ সেদিন ঘরে ফিরেছিলো, সেবার সেই তো তার প্রথম গাঁয়ের বাইরে যাওয়া। ছেলে রোজগার করে ঘরে এলো তো কুলসুম। একটু খুশি হবে না? হোক না তার সৎ বেটা, হোক না সতীনের বেটা, পেটে নাই বা ধরলো তাকে, তবু বেটা তো!

সেই কতোদিন আগের কথা, কতো দিন আগের উচ্ছ্বাস, আকালের আগের খুশি, আকালের কাঁটাবেঁধা বছর উজিয়ে এসে কুলসুমের বুকে ছলছল করে ওঠে। গর্ভে তো সে কাউকে ধরলো না, ছেলে বলো আর মেয়ে বলো তমিজই তার সব। এই আবেগ বুকে উপচে পড়লে সারাটা শরীর তার শিরশির করে এবং শরীরের এই উৎপাত থেকে রেহাই পাবার তাগিদে তমিজের দোষ ধরার জন্যে সে হঠাৎ করে হন্যে হয়ে ওঠে। কিন্তু সে হলো মুখ মেয়েমানুষ, ফকিরের ঘরের বেটি, অতো বড়ো জোয়ান মরদ তমিজের আয়াব তার চোখে পড়ে কী করে? বরং তমিজের বাপের অঘোরে ঘুমের সুযোগে ছেলের ওপর বাপটার এই রাগের খানিকটা চুরি করে সে চাখে : ক্যা বাপু, কামের খোজে খিয়ার এলাকাত না গেলে হয় না?-কিন্তু আবার কাজের সুযোগ এদিকে দিনে দিনে কমে আসছে। এ কথাও তো ঠিক। বেশি দিন নয়, ময়মুরুব্বির কাছে শোনা গেছে, ১০/১২ বছর আগে এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙায়, বিলের এপার ওপার জুড়ে ধান রোপা, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা—সব কামই পাওয়া গেছে। এখানেই। তখন নাকি কামলা দেওয়ার মানুষই ছিলো কম। আর যখন তখন কোনো কাজ বাধলে যেতে হতো বিলের ওপারের পচার বেটা কসিমুদ্দির কাছে। লোকটা বাপের মতোই বোকা ছিলো। জমি ছিলো না তার এক ফোঁটা। থাকতো চাষাদের খুলিতে, এর বারান্দায়, ওর গোয়ালে। গাছ কাটা কি ঘর মেরামতের দরকার হলে মানুষ তার হাতে পায়ে ধরতো। আর দেখো, এই কয় বছরে যেদিকে তাকাও হাজার কসিমুদ্দি। সব শালা খালি কাম খুঁজে বেড়ায়। আকালের বছর এতো মানুষ মরলো, এতো মানুষ ভিটাজমি বেচে দেশান্তরি হলো, তবু শালার মানুষ তো কমে না। জমি-বেচা মানুষ যারা গাও ছাড়ে নি, সব কামলা খাটার জন্যে পাগল। কামের জুত কৈ? আগে বর্গাদাররা জমিতে মানুষ খাটাতো, এখন বর্গাদার তার কোলের ছেলেকে পর্যন্ত জমিতে লাগায়।-ঠিক আছে, সবই ঠিক? এরকম হলে তমিজ খিয়ারে না গিয়ে। করবে কী?—কিন্তু তার বাপের কথাটাও বোঝো, ভালো করে বুঝে দেখো। খিয়ারে কাম করতে গিয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গে তোমার অতো ঢলাঢলি কিসের গো? তমিজের বাপ তো সবই জানে, কুলসুমও অনুমান করতে পারে, খিয়ারের মানুষ মানুষ ভালো লয়। জোয়ান মরদ, কামের মরদ দেখলে তারা নিজেদের মেয়েদের লেলিয়ে দেয় তার পেছনে। মেয়ের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে ঐ ছেলেকে তারা ধরে রাখে নিজেদের ঘরে। ওদের দিয়ে নিজেদের বর্গা-নেওয়া জমিতে কাম করায়, গোরুবাছুরের দেখাশোনা করায়, ঘর। তোলে; মাটি ছেনে দেওয়াল গেঁথে তার ঘর তোলে, মেহনত কম নয়। ছেলে। চিরকালের জন্যে তাদেরই হয়ে যায়। ঐসব ডাইনি মেয়েরা ধুলা ঝাড়ে আর পুরুষগুলি তাদের গোলাম হয়ে জীবন কাটায়। নিজেদের বাপমায়ের কথা তাদের আর মনেও পড়ে না। বিয়ে করে পুরুষমানুষ শ্বশুরবাড়িতে কায়েম হবে, ব্যাপারটা কুলসুমের কাছে হঠাৎ করেই অসহ্য ঠেকে। তমিজের বাপ কি ব্যাজার হয় এমনি? তমিজের বাপ। তো যি সি মানুষ লয় বাপু!—ঘুমের মধ্যে সে কার ডাকে বাইরে চলে যায়, কতোদূর যায়, কোথায় যায়, কেউ জানে না। তমিজের বাপকে নিয়ে মানুষ কতো কথাই না বলে! এমনিতে টোপ পাড়লে কী হবে, কামে গেলে তার জুড়ি নাই। শরাফত মণ্ডলের দখলে যাবার আগে কাৎলাহার বিলের মাছ তো ভোগ করেছে মাঝিপাড়ার মানুষই। তখন তমিজের বাপের তৌড়া জালেও পাঁচ সের সাত সের রুই কাৎলা উঠেছে কয়েকটা করে। মাছের ভারে এইসব ছোটো জাল বিলের তলায় এমনি করে আটকে গেছে যে তমিজের বাপকে গলা পানিতে নেমে জালের দড়ি গোটাতে হয়েছে। মুরুব্বি মাঝিরা বলেছে, তুমি বাপু বিলে নামার সময় হুঁশিয়ার হয়া নামো। তুমি জাল ফালালেই ব্যামাক মাছ মনে হয় দৌড়াদৌড়ি করা খালি তোমার জালতই আসে। কথা ভালো লয় বাপু। কেউ কেউ আরো ভয় দেখিয়েছে, একটা গজার যদি একদিন জালেত পড়ে তো বড়ো মুসবিত হবি। কেউ কেউ তার রক্তে তার দাদা বাঘাড় মাঝির অসাধারণ কেরামতি প্রবাহিত হয় বলে মন্তব্য করেছে। এসব অনেক আগের কথা। এখানে। তখন তমিজের মায়ের সংসার, কিংবা আরো আগে তমিজের বাপ তখনো বিয়েই করে। নি। তবে কুলসুমের দাদা চেরাগ আলি জানতো আসল খবর।ওসব দাদা পরদাদা কোনো ব্যাপার নয়। তমিজের বাপের শক্তি আসে পাকুড়গাছ থেকে। কালাহার বিল এখন মণ্ডলের দখল, মাঝির বেটা তমিজের বাপ এখন আর মাছ ধরার কেরামতি দেখায় কোত্থেকে?-দাদার কথা কুলসুম বিশ্বাস করে কীভাবে? এখানে আসার পর থেকে, তার বিয়ের অনেক আগে থেকেই তমিজের বাপকে সে তো এরকম ঝিমাতে আর ঘুমাতেই দেখে আসছে। কাৎলাহার বিল তো মণ্ডল ইজারা নিয়ে দখল করলো সেদিন, আকালের পরের বছর। তার আগে থেকেই তমিজের বাপ একইরকম মানুষ। তবে হ্যাঁ, কামে কোনোমতে একবার লাগলে সে নাকি অন্য মানুষ। জমিতে কাম। করতে গেলেও এখনো সে নাকি তিন কামলার খাটনি খাটে একলাই। আবার ঐ মানুষই ঘরে এলে শুরু হলো তার ঘুম আর টোপ-পাড়া। তবে একটা কথা আছে।-তমিজের বাপের ঘুম মানে তো খালি চোখ বন্ধ করে নাক ডাকা নয়; ঘুমের মধ্যেই তার নড়াচড়া, তার হাটা, ঘুমের মধ্যেই তার সব চলাচল। কতো মানুষ তাকে নিয়ে কতো কথা কয়। এতে মানুষের ভয় আর ভক্তি দেখেও বেটা তার কথা শোনে না কেন? বাপ যখন পছন্দ করে না তো তমিজ বছর বছর খিয়ারের দিকে না দৌড়ালেই পারে। এই যে আজ ২০/২১ দিন তমিজ বাড়ি নাই, এই বাদলায় খিয়ারে সে কী করছে কে জানে? এখন এখানে বিলের ওপারে মণ্ডলের জমিতে আউশ কাটা চলছে, হুরমতুল্লা একলাই তার জমি বর্গা করছে। আউশ কাটার পর বীজতলা থেকে চারা নিয়ে আমন। রোপা হচ্ছে। কাজের অভাব আছে? তমিজের ফুটানিটাও একটু বেশি। এখানে শরাফত মণ্ডলের জমি বর্গা করতে চাইলো, মণ্ডল রাজি হলো না দেখে সোজা হাঁটা দিলো খিয়ারের দিকে। তা বাপু ওখানেও তো কামলাই খাটবি, ওখানে তোকে জমি বর্গা দেওয়ার জন্যে মানুষ কি বসে আছে নাকি? এই বাদলায় সারা দিন পানিতে ভিজতে ভিজতে ধান কাটতে হবে তো ওখানেও। সন্ধ্যাবেলা কোনো বর্গাদারের ঘরের বারান্দায় সে হয়তো বর্গাদারের গোলগাল বৌ কি ছিনাল মেয়ের হাত থেকে চালভাজা কি কঁঠালের বিচি ভাজা খাচ্ছে। তা মাগীরা কি তাকে এমনি এমনি খেতে দেয়? বাঁশের খুঁটির সঙ্গে সুতা বেঁধে জাল বুনে নিচ্ছে না? তাদের আরো কতো ফন্দি আছে তাও কুলসুম ঠিক বোঝে!

এই সময়ে একটি টিকটিকির ঠিকঠিক আওয়াজ কুলসুমের অনুমানের যাথার্থ নিশ্চিন্ত করে। আসলে টিকটিকি নয়, মেঝেতে পাশ ফিরতে ফিরতে তমিজের বাপই বোধহয় তার সন্দেহে সায় দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো। মানুষটা কী কয়? কাল রাতে বেরিয়ে কার সাথে কী নিয়ে কথাবার্তা বলে এসেছে? কুলসুমের দাদাই কি তমিজের বাপের স্বপ্নে এসে কিছু ইশারা দিয়ে যাচ্ছে?—ইশ! কথাগুলো যদি একটু বোঝা যায়! তমিজের বাপের ঘুমের ভেতর বলা কথা শুনতে কুলসুম মাটিতে উপুড় হয়ে কান পাতলো তমিজের বাপের মুখের কাছে। ঘুমের মধ্যেই তমিজের বাপ লুঙি আরেকটু ওপরে ওঠায়, তার হাত দুটো রাখে নিজের উরুসন্ধিতে এবং কথা বলার বদলে সে জোরে নাক ডাকতে থাকে। কুলসুম তার। লুঙিটা একটু নামাতে গেলে তমিজের বাপের নাক ডাকা থামে এবং সুস্বাদু কিছু খাবার ভঙ্গিতে জিভে ও টাকরায় চপচপ আওয়াজ করে?—তা হলে চেরাগ আলি কি তার স্বপ্ন থেকে সরে পড়লো নাকি? না-কি তমিজের বাপ নিজেই তার সব কথা গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের গলার ভেতরে? চপচপ করে কথাগুলো গিলে ফেললে সেগুলো ঝাপসা হতে হতে ঠাঁই নেয় তমিজের বাপের কোন খোয়াবের শাঁসের মাঝখানে কুলসুম তার নাগাল পায় না।

কানে কথা ঢোকার বদলে তার নাকে ঢোকে তমিজের বাপের মুখের পচা আঁশটে গন্ধ। কুলসুমের টিকালো-না-হলেও উচু নাক বেয়ে তমিজের বাপের মুখের এই পরিচিত গন্ধ ঢুকে পড়ে তার পেটে। গলায় তো লাগেই, এমন কি একটুখানি ধাক্কা দেয় তার মগজেও। কুলসুমের জিভ জুড়ে এখন পচা মাছের বাস্না। মাচার নিচে বারবার থুথু ফেলে গন্ধটা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতেই কুলসুম স্বামীর নাকের কাছে নিজের নাক এগিয়ে দেয়। এতে তো পেটটা তার ভরে যাবার কথা, কিন্তু ফল হয় উল্টো। নিস্তেজ খিদেটা তার পেট থেকে তলপেটে এবং ফের পেট হয়ে বুক, এমন কি গলা পর্যন্ত হাঁচড়েপাঁচড়ে ঘোরে। শরীরের এইসব অঙ্গে তোলপাড় ওঠে যে একই সঙ্গে তা নয়। তার চোখের একেকটি পলকে একেকটি অঙ্গে খিদে খুব জোরেসোরে জানান দিয়ে যায়। তবে বারোভাতারি খানকি খিদেকে কাবু করার কায়দাও কুলসুমের জানা। আছে। জানে তো জন্ম থেকেই, তবে নতুন ফন্দিটা শিখেছে বছর দুই আগে আকালের সময়। সেটা কী রকম?—জোরালো কোনো গন্ধ পেট ভরে নিতে পারলেই পেটটা তার বেশ ফুলে ওঠে। তবে থুথু ফেললে চলবে না। থুথু যতোবার আসে একটু জমতে দিয়ে গিলে ফেলতে হবে, তাতে পাতলা ডাল খাওয়ার কাজ হয়। বমি বমি লাগবে; কিন্তু বমি করা চলবে না, বমি হলেই পেট খালি।

গন্ধের ভাবনাই কুলসুমের নাকে খেলিয়ে দেয় পানজৰ্দার হালকা সুবাস। গোলাবাড়ি হাটের বৈকুণ্ঠের মুখের এই গন্ধ বৈকুণ্ঠকে ছাড়াই এসে হাজির হলো,এরকম মাঝে মাঝে তো হয়ই, তবে এতে পেট ভরে না। গন্ধটা নাক দিয়ে ঢুকে গলা পর্যন্ত নেমে ফের উঠে যায় মাথায় এবং মগজে অনেকক্ষণ ধরে ম ম করে কখন মিলিয়ে যায় সে ঠিক ধরতে পারে না।

উঠানে ভাঙা মাটির মালসা চাপা-দেওয়া চুলার ভেতর ছাই গত রাতের বৃষ্টিতে ভিজে কাদা। এর ভেতর থেকে কয়লার দুটো টুকরা নিয়ে ফের ঘরের ভেতর দিয়ে বাইরের উঠান পেরিয়ে ডোবায় পৌঁছে খিদে মেটাবার তাড়া কিন্তু তার আর রইলো না। ডোবার ওপারে একটু উঁচু সরু পথ, খানিকটা গিয়ে গাঁয়ের শেষে এই পথ মিশেছে। গোলাবাড়ি যাবার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড়ো রাস্তার সঙ্গে। বর্ষার ভিজে হাওয়ায় গোলাবাড়ি থেকে পানজর্দার সুবাস কি একেবারেই আসে না? পুবদুয়ারি ঘর তাদের, দাদা বলতো, দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের রাজা, পুবদুয়ারি তাহার প্রজা। যমুনার তীরে তাদের মাদারিপাড়া, দরগাতলার মতো এদিককার সব বাড়িও পুবদুয়ারি। এখানে এসে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে পুবদুয়ারি ছাপরা ঘর পেয়ে চেরাগ আলি মহা খুশি, দেখ, একইরকম ঠেকিচ্ছে না রে? আবার বিয়ের পর ডোবার এদিকে তমিজের বাপের ঘরে ঢুকলো কুলসুম, এটাও পুবদুয়ারি। একটু বাতাস বইলেই তাদের ঘরে হাওয়া ঢোকে। ডোবার ঘাসপাতাশ্যাওলা, অল্প পানির খলসে পুঁটি কি ডোবার ধার ঘেঁষে কাদার ঘরসংসার-করা শোল বেলের তাজা আঁশটে গন্ধ, মানুষের গুয়ের গন্ধ, গোরুবাছুরের গোবরের গন্ধ-সব মিলেমিশে ঝাঁ ঝাঁ রোদে শুকিয়ে কিংবা বৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ে ঘরে ঢুকে মাচার ওপরটা, মাটির মেঝেটা বা ঘরের ছোটো শূন্যতাটিকে কখনো ভারি করে তোলে, কখনো হালকা করে ফেলে।

এসব গন্ধ কি কুলসুমের আজকের চেনা? তমিজের বাপের সঙ্গে বিয়ের কতো আগে থেকে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ের ভেতর ছাপরা ঘরে থাকতেই তো তার থাল-বাসন ধোয়াপাকলা, কাপড় কাচা, মুখ ধোয়া, হেগে ছোচা, গোসল করা সবই তো হয়েছে এই ভোবাতেই। কালাম মাঝির বাড়িতে পাতকুয়া কাটার আগে খাবার পানিও নেওয়া হতো এখান থেকেই। তখন এটা অবশ্য পুকুরই ছিলো। বড়ো বানের পলি জমে উত্তর দিকটা ভরে গেলে ওখানে আরো মাটি ভরে মরিচবেগুনের খেত করে কালাম মাঝি জায়গাটা নিজের দখলে নিয়ে আসে। এসব তো কুলসুমের চোখের সামনের ঘটনা। আল্লারে আল্লা, বিয়ের পরও কুলসুমের সেই আগের নিয়মের কোনো বদল হলো না।

ডোবার ধারে বসে চোখ বন্ধ করেও সে ঠাহর করতে পারে ডোবার ওপারে সরু রাস্তায় সাইকেল চেপে চলেছে সাকিদারদের ইস্কুলে-পড়া ছেলে। ধানের ভার নিয়ে মণ্ডলবাড়িতে যাচ্ছে অহিদ পরামাণিক।

খেজুরগাছের পিড়িতে বসে ডোবার পানিতে ঝুঁকে কুলকুচো করছে কুলসুম, তার মুখের ছাইকয়লামাখা পানিতে ডোবার ঘোলা পানির রঙ পাল্টায় না। সেই অপরিবর্তনীয় পানির দিকে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনীর সাদা দাঁতগুলি চকচক শব্দ করে মাজতে মাজতে এবং বারবার কুলকুচো করতে করতে কুলসুম ঠিক বোঝে, দক্ষিণের কলুপাড়ার গফুর কলু গোলাবাড়ি যাচ্ছে দলবল নিয়ে। লোকটা গফুর কলু না। হলে তার কিছুই এসে যায় না, শ্যামলা মুখটা যতোটা পারে ফর্সা করে তুলতে অবিরাম পানির ঝাপটা মারতো। কিন্তু গফুর কলু মানুষটা বেহায়া ধরনের আলাপি মানুষ, আবার তার মুখে কথা শুনতেও কুলসুমের কান দুটো উসখুস করে। তা কথা বেশি বললে কী হয়, গফুর ভাইটা কামের মানুষ। অসুখে পড়ে বাপটা তার তেলের ঘানি ঘোরাতে পারে না, তার একরকম ভিক্ষা করে খওয়ার দশা হয়েছিলো। গফুর কিন্তু তেলের ঘানি টানি বাদ দিয়ে ঘুরতে লাগলো মণ্ডলের ছোটোবেটা কাদেরের পিছে পিছে। বছরখানেক তার লীগের পাট্টির হুজুগে মেতে থাকায় তার মেলা ফায়দা হয়েছে। সে এখন কাজ পেয়েছে কাদেরের তেলের দোকানে। এই এলাকায় শুধু কোরোসিন তেল বেচার দোকান প্রথম করলো শরাফত মণ্ডল, সেই দোকান চালায় কাদের। এক বছরেই দোকানের সাইজ বড়ো করে ফেলেছে, আগে টাউন থেকে সপ্তাহে দুইবার ৬/৭টা করে তেলের টিন আসত টমটমে করে, এখন জোড়া জোড়া গোরুর গাড়ি ভর্তি টিন এনেও আশেপাশের চাহিদা মেটাতে পারে না। এর সব দেখাশোনার ভার গফুরের ওপর। কিন্তু এ নিয়ে গফুরের দেমাক নাই, মাঝিপাড়ার আর আর মানুষের সঙ্গে তমিজের বাপও যে তাকে কলুর বেটা কলুর বেটা বলে হেলা করেছে এসব কথা সে মনেও রাখে না। কুলসুমের সঙ্গে দেখা হলেই সে একটু দাঁড়াবে, গোলাবাড়ি হাটের খবর দেবে, তমিজের বাপের কথা জানতে চাইবে, তমিজ কবে ফিরবে জিগ্যেস করবে এবং কুলসুমের দাদার খোয়বের মানে বলার একটা দুটো নজির দেবে। আজকাল কলুপাড়ার কয়েকটা চ্যাংড়াপ্যাংড়া তার সঙ্গে থাকবেই। লীগের পাট্টির হুজুগ বেশ ভালোই শুরু হয়েছে, হুজুগে সে এদের শরিক করায়, দোকানের কাম কম থাকলে সে নিজেও কাদেরের পিছে পিছে ঘোরে। তা করো, মনিবের মর্জি মতো তোমাকে তো চলতেই হবে। কিন্তু আজ আবার ওই ছিনাল মাগীটাকে নিয়েছো কেন? বুলু মাঝির ভাতারের ভাত-না-খাওয়া বৌ আবিতন এই সাত সকালে কলুর বেটার পাছার সঙ্গে সেঁটে যায় কোথায়? বেশরম বেলহাজ মাগী, দুদিন পর ভাতার তালাক দেবে, আজ তুই রাস্তা দিয়ে হাঁটিস অন্য জায় তর মানুষের বগল ধরে। শরম করে না?

ক্যারে কুলসুম, আত্রে ঘরের দুয়ার দিস নাই? রাত্রে কুলসুমের দরজা খুলে রাখার কারণ জানার আগেই গফুর কলু বলে, কাল তালতলাত হাঁটু পানি জমিছিলো রে, তাই। ঘুরা তোর ঘরের খুলির উপর দিয়া গেনু। তোর দুয়ার দেখি খোলা। ভুলকি দিয়া দেখি তুই নিন্দ পাড়িচ্ছ। তমিজের বাবোক ক্যামা দেখনু না।

বলতে বলতে তার ডান হাতের পুঁটলিটা পাচার হয়ে যায় বা হাতে। বলে, মনে হলো বাঁশের আড়াত গেছে। আড়ার ধার দিয়াই তো হ্যাটা গেনু, দেখনু না তো। একলা একলা তোক ঘরত থুয়া তাই কোটে গেছিলো রে?

তমিজের বাপের অনুপস্থিতিতে গভীর রাত্রে তার ঘরে উঁকি দিয়ে লোকটা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে গেছে—এই খবরে কুলসুমের অস্বস্তি হতে না হতে ভাতারের ভাত-না-খাওয়া আবিতন মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, ঘর দুয়ার খুল্যা নিন্দ পাড়িস কিসক? তোর বাপের বাড়ির কথা ভিন্ন। ওটি আছিলো কী, আর চোরে লিবিই বা কী? এটি না। হলেও বাসনকোসনগুলা তো আছে। মামুর জাল যে কয়খান আছে তাই চুরি হলে তোক বেচলেও দাম উঠবি না, বুঝলু?

আবিতন মাঝিদের মেয়ে। তমিজের বাপ কোনো না কোনোভাবে এর চাচা মামু দাদা খালু নানা ভাই ভাতার লাঙ একটা কিছু হয়ই। সেই সুবাদে কুলসুমের বাপের বাড়ি নিয়ে খোটা মেরে গেলো।-মাঝির ঘরের বেটি, তুই দুই দিন বাদে লিকা বসবু কলুর বেটার সাথে। তমিজের বাপের সাথে তোর আত্মীয়তা কুটুম্বিতা তখন কোটে যায় দেখা যাবি।তা দেখে নেওয়ার কাজটা কুলসুম এখনি করতে পারে। কিন্তু গফুর কলু তাগাদা দেয়, চলো চলো। কাদের ভাই কছে লওটার মদ্যে গোলাবাড়ি পৌঁছা লাগবি। জোড়াগাছত সভা দশটার সময়। গোলাবাড়িত থ্যাকা মেলা করলে এক ঘন্টার কম। লাগবি? চলো বাপু, এ্যানা পাও চালাও।

আরে বাপ! কুলসুম আর কতো দেখবে? মণ্ডলের দোকানে কাম নিয়ে গফুর কলু আজকাল সময় ঠিক করে ঘড়ির সময় দিয়ে। আবার সভা করে বেড়ায়। কলুর বেটা কলু, তার আবার ফুটানি কতো দেখবো? আবিতনের কথার ঝাঁঝে কুলসুমের রাগ হয় গফুর কলুর ওপর। দাদা এই কলুটাকে বেশি খাতির করতে, এক আধ পোয়া সর্ষের তেলের  লোভে কী মনোযোগ দিয়েই না তার খোয়াবের বিত্তান্ত শুনতো। সেই কলুর বেটা এখন। ঘোরে মাঝির ঘরের বৌয়ের সাথে। মরার গাঁয়ে এদের গাঁয়ে আঁটার বাড়িও কেউ মারে না।

০৩. গফুর কলুর ওপর রাগ

কিন্তু গফুর কলুর ওপর রাগ করে কি আবিতনের কথার ঝাঁঝ মোছা যায়? ডোবার ধার থেকে উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে মাটিতে কুলসুমের পা পড়ে দরকারের তুলনায় অনেক বেশি জোরে। এতোগুলো ভারি কদমে আবিতনের পাছায় লাথি ছুঁড়ে মারা হয়। না। বরং পায়ের ভেতর দিয়ে মাগীর চোপা কুলসুমের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢুকে তার সারা শরীরে কোলাহল তুলতে থাকে। ভাতারের ভাত-না-খাওয়া মাগীর ওপর যতোই রাগ হোক, গ্রামের আর দশটা বৌঝিদের মতো সেই রাগ ঝাড়ার ক্ষমতা কুলসুমের নাই। তার বাপ নাই এবং কোনোদিনই ছিলো না বলে বাপের বাড়ির অভাব অনটনের খোটা। দিলে সে মুখ ঝামটা দিয়ে জবাব দেয় কোন মুখে? সে যখন এতোটুকু, হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে কি করে নি, তখনি এক চৈত্র কি বৈশাখের পূর্ণিমা রাতে ভেদবমি করতে করতে মারা যায় ওই অপরিচিত বাপটা। তারপর, কততদিন পর মনে নাই, যমুনার পুবপাড়ের এক চাষার হাত ধরে ও তাকে কোলে করে মা তার চলে যায় যমুনার পুবেরই কোনো চরে, সেই চরের নাম কুলসুম এখন পর্যন্ত জানে না। তারপর মায়ের। কোল থেকে নামবার অল্প দিনের মধ্যেই কুলসুম ঘুরতে থাকে দাদার আঙুল ধরে ধরে। চেরাগ আলি ফকির তো গান করতে করতে নানান দেশে ঘোরে, হয়তো যমুনার ওই চরে মরা ছেলের বৌয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গিয়েছিলো, কুলসুমের মা-ই হয়তো সবুজ শাড়ির ময়লা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কুলসুমকে তুলে দিয়েছিলো তার প্রথম পক্ষের শ্বশুরের হাতে। দাদার সঙ্গে এ-গাঁও ও-গাঁও নিয়ে কিন্তু মানুষ এভাবে কথা বলে নি। কয়েকটা ঘরে তো খয়রাত তার একরকম বাধাই ছিলো, শুক্রবার জুম্মার আগে। যে-কোনো সময় একবার গেলেই বেতের ছোটো টালার আধখানা ভরে চাল ঢেলে দিতো তার ঝোলায়। ঈদে বকরিলে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে নতুন হোক পুরনো হোক লুঙি একটা ঠিকই পাওয়া গেছে। মিলাদে ফকিরকে যেতে হতো একলাই, কিন্তু কারো জেয়াফতে নাতনিকে সঙ্গে নেওয়ার এজিন না পেলে চেরাগ আলি দাওয়াত কবুলই করতো না। একবার মনে আছে, মাদারিপাড়ার পশ্চিমে খাল পেরিয়ে চন্দনদহের আকন্দবাড়ির হাফিজ দারোগার মা মহরমের চাঁদের এক ভোররাতে স্বপ্নে হাফিজের বাপকে গোরুর গোশত দিয়ে ভাত খেতে দেখে তিনজন ফকিরকে গোরুর। গোশত দিয়ে ভাত খাওয়াবার নিয়ত করে। তিন ফকিরের এক ফকির চেরাগ আলি। চেরাগের সাথে কুলসুমকে দেখে আকন্দের পুরনো বাদি হোচ্চার মা গজরগজর করে, দেখো, সাথ সাথ লাতনিক লিয়া আসিছে। ও ফকিরের বেটা, তোমার লাতনিক জেয়াফত দেওয়া হছে? চাকরানি মাগীর ভাঙা মোেটা গলার আওয়াজে উঠানের পাশে মস্ত রান্নাঘর থেকে ছোলার ডাল দিয়ে গোরুর গোশত রান্নার গন্ধ শুকনা কাটা হয়ে কুলসুমের পেটে গলায় বুকে চিরে চিরে যায় : না খেয়েই যদি ফিরে যেতে হয়! তা। হলে? কিন্তু তার দাদা চেরাগ আলি ফকির কি কাউকে পরোয়া করার মানুষ? তাঁর কথা সরাসরি বাড়ির গিন্নির সাথে, হাফিজ দারোগার মাকে লক্ষ করে সে বলে, মা, হামার। সাথে হামার লাতনি আছে গো। হামরা মাদারি ফকির, মানষের বাড়িত একলা। জেয়াফত কবুল করা হামাগোরে মানা আছে মা। একলা খাই তো হামাগোরে দোয়া। কবুল হয় না। আর একটা কথা কি, মাদারিপাড়ায় যতোদিন ছিলো, শুকুরবার দিন দুপুরবেলা খেতে বসে কথা বলা ছিলো ফকিরের জন্যে মকর, তাকে থাকতে হতো চুপচাপ। পাতে তার কখন ভাত লাগবে, গোশতের টুকরা চেয়ে নেওয়া কি এক হাতা ডাল ঢেলে দিতে বলা, দৈ দিলে আরেকটু গুড় চেয়ে নেওয়া,দাদার হয়ে এসব দায়িত্ব পালন করেছে কুলসুম। মানুষের নিয়ত বলো, মানত বলল, ফকির খাওয়ানো বলল, এমন কি খতনা, কুলখানি, জেয়াফত সাধারণত জুম্মার দিনেই আসে বেশি। নাতনিকে সঙ্গে না রাখলে চেরাগ আলির খাওয়া ভালো হবে কী করে? মাদারিপাড়ার খালটা পেরিয়ে চন্দনদহ, শিমুলতলা, শাকদা, গোসাইবাড়ি, ভবানীহাট, দরগতিলা-এসব গ্রামে বড়ো বড়ো গেরস্থের বাস। এক চন্দনদহেই তো খালি টিনের ঘর আর টিনের ঘর। শিমুলতলায় তালুকদারদের মস্ত দরদালান, ভবানীহাটে সরকারবাড়িও পাকা দালান। এসব জায়গায় আকিকা, খতনা, কুলখানি, চেহলাম, বিয়েশাদি, মানত একটা না একটা লেগেই থাকতো। দরগাতলায় শাহসাহেবের দরগাশরিফ, সেটা তো চেরাগ। আলির একরকম বাড়িঘরই বলা চলে। সেখানে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পা দিলে আর কিছু হোক, আটার খোরমা কিংবা চালগুড়ের পাতলা শিরনি জুটতোই।

আগরবাতির ধোঁয়ার সঙ্গে গুড়ের গন্ধে দরগাশরিফ সবসময় ম ম করে। ফকিরের বেটি বলে ওখানে কেউ তাকে কখনো হেলা করে নি।–না-কি করেছে? কী জানি?–হেলা যদিও করে থাকে তবু শিরনি পেতে তো অসুবিধা হয় নি।

কষ্টে কাটতো বর্ষাকালটা। বাইরে যাওয়া মুশকিল, আবার ভাদ্র মাসে আউশ কাটার আগে পর্যন্ত মানুষ সহজে ভিক্ষা দিতে চায় না। ঐ সময়টা মানুষ খোয়াবও দেখে না। ধান উঠলে ঐ এলাকার মানুষের খোয়াব দেখার ধুম পড়ে গেছে। খোয়াবে খারাপ কিছু দেখলেই চেরাগ আলির কাছে ছুটে এসেছে মানুষ, ও ফকির, কও তো, পাছারাতে দেখলাম, আমাগোরে কুয়ার পানি ক্যামা গরম ঠেকিছে। বালটি দিয়া তুল্যা গাও থোমা, পিঠোত পানি ঢালিচ্ছি, তামান পিঠ বলে পুড়্যা গেলো গো। এই খাবের মাজেজা কী, কও তো বাপু। ঝোলা থেকে একমাত্র বইটা বার করে চেরাগ আলি আস্তে আস্তে পাতা ওলটাতো। প্রতিটি পৃষ্ঠা ওলটাবার সঙ্গে জিভে আঙুল ছুঁয়ে বলতো, স্বপন তুমি কখন দেখিছো কও তো। ঠিক লগ্নটি বলতে স্বপন-দেখা মানুষটা আমতা আমতা করলে তাকে করা হতো পরবর্তী প্রশ্ন, পাছারাতোত তুমি শুছিলা কোন কাত হয়? পাশে বই রেখে বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই ঘরের সাসনে ছোটো উঠানে কাঠি দিয়ে চৌকো চৌকো দাগ দিতে দিতে সে এরকম প্রশ্ন করেই যেত এবং অন্তত পঁচিশটা প্রশ্ন করে তার অর্ধেকেরও জবাব না পেয়েও স্বপ্নের মাজেজা বলে দিতো। কুয়ার পানি স্বপ্নে গরম হলে তার ভাগ্যে অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত,-এই খবর দিয়ে না হলেও দুটো পয়সা সে কামাতোই। কিন্তু বর্ষা আর কার্তিক অগ্রহায়ণে মানুষের স্বপ্ন দেখা বন্ধ। কার্তিকের। অভাব আর কাটে না। কিন্তু অভাবের সাধ্য কি যে চেরাগ আলিকে কাবু করে? পেটে কিছু পড়ুক আর নাই পড়ুক, তার কথার তেজ যদি এতোটুকু কমে। কার্তিক হয়ে যায় তার কাছে পোয়াতি মাস। কেমন?–

ছাওয়া লে গর্ভেতে ধরি শুকায় পোয়াতি।
মাতার লোহুতে পুত্র বাড়ে দিবারাতি।।

খালি পেটে এসব শুনতে কুলসুমের ভালো লাগতো না, খালি হাবিজাবি কথা কও!

হাবিজাবি লয় রে ছুঁড়ি, বুঝ্যা দ্যাখ। চেরাগ আলি তার শোলোক ব্যাখ্যা করে, মাটি এখন গভভো ধারণ করিছে। তার গভভে দুটা মাস, এক কাত্তিক আর এক। আঘুন। পোয়াতি হলে মেয়ামানুষের শরীল শুকায়, এক প্যাট ছাড়া পোয়াতির ব্যামাক অক্ত তার খায়া ফালায় প্যাটের ছাওয়াল। পৌষ মাসে পোয়াতি বিয়ালে তার কোনো দুষ্ণু থাকে না। বলতে বলতে দাদার মুখ থেকে ব্যাজার ভাব কেটে যায়, কার্তিক মাসের অভাব যে সচ্ছলতার প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই নয় এই আশ্বাসে সে মহা খুশি। কিন্তু ঘরে বসে আনন্দ অপচয় করার বান্দা চেরাগ আলি নয়, হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে ঝোলাটা টেনে নিয়ে বলে, চল বুবু, বেড়াকুড়া আসি। একটা বেলার খোরাক তো পামু। বেড়াকুড়া আসা মানে ভিক্ষা করা, মাদারিপাড়ার লোকজন এভাবেই বলতো। ওখানকার কেউ তার এই পেশায় দোষের কিছু দেখেনি। ছোট খাটো বিপদ আপদ, বালা মুসিবত হলে পরামর্শ নিতে কি স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখলে তার তাবির জানতে তারা বরং ফকিরের কাছেই আসতো। কলিকাল,আখেরাতের আর বাকি নাই, পরামর্শ শুনে বেশি পয়সা দেওয়ার মানুষ কমে গেছে, ফকির তাই বেড়াকুড়া খায়। এতে হেলা করার কী আছে?–না-কি ভেতরে ভেতরে সবাই তাদের একটু ছোটো নজরেই দেখেছে? কী জানি?–চেরাগ আলি ওদিকে সবার কাছে ফকিরের বেটা। ফকিরের বেটা চলেছে। আগে আগে, তার মাথায় কালো রঙের কাপড়ের টুপি, আলখেল্লাটির রঙ এককালে হয়তো কালোই ছিলো, পরে নানা রঙের কাপড়ের তালি লাগার ফলে আসল রঙ খুঁজে পাওয়া দায়। কাঁধে রঙ-জ্বলা চটের ঝোলা, এর ভেতরে তার বই। আবার গেরস্তের ঘরের চাল, বাজারে হাটে দোকানদাররা আলু পেঁয়াজ, পটল, বেগুন, মরিচ, সময়ের আমটা কলাটা যে যা দেয় নেওয়ার জন্যে সে এটা সামনে এগিয়ে দেয়। পয়সা নেওয়ার জন্যে কুলসুমের হাতে একটা টিনের থালা। ফকির হাটে তড়বড় করে। সরু দুটো পা যেন দুটো রণপা। হাতের ছড়িটাকে কখনো কখনো ভুল হতো চেরাগ আলির আরেকটি পা বলে। দাদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কুলসুমের জোরে হাঁটার অভ্যাস হয়েছে, এখন চেষ্টা করেও পায়ের গতি সামলাতে পারে না। তা মাদারিপাড়ায় থাকতে কুলসুমের হাঁটার দোষ কেউ ধরে নি।—ধরতো কি? কী জানি?—এখানে আসার পর, বিশেষ করে তমিজের বাপের সংসার করতে শুরু করার পর থেকে মাঝিপাড়ার বৌঝিরা তার যেসব। খুঁত ধরে বেড়ায় তারই কোনো কোনোটি সে গুলিয়ে ফেলে মাদারিপাড়ার মানুষের কথাবার্তার সঙ্গে। আবার এমনও হতে পারে, মাদারিপাড়ায় থাকতে দাদার বেড়াকুড়ার সাথী হয়ে এ-গাঁও ও-গাঁও ঘুরতে ঘুরতে মানুষের যেসব খোটা শুনেছে তাই সে আরোপ করে বসে গিরিরডাঙা আর নিজিগিরিরডাঙার বৌঝিদের মুখে। মাদারিপাড়ার কি আর সব ভালো? ওই গায়ে কারো অবস্থাই ভালো লয় গো! ওখানে বারো মাসই আকাল, বারো মাস টানাটানি। একটা দিন খাল পেরিয়ে না ঘুরলে ওখানে ভাত জোটে নি। ছোটো গাম, ঘর মোটে কয়েকটা, সবাই ফকিরের জ্ঞাতিগুষ্টি। পুবদিকে এক ক্রোশ চাষের জমির পর যমুনা, এর মধ্যে কয়েক বিঘা বাদ দিলে সবটাই চন্দনদহের আকন্দদের, শিমুলতলার তালুকদারদের, রৌহাদহের খাদের আর গোঁসাইবাড়ির মণ্ডলদের জমি। মাদারিপাড়ার ফকিরদের বেশিরভাগ মানুষ ওখানে বর্গা করে নয়তো কামলা খাটে। কয়েক বিঘা পতিত জমির মালিক ছিলো ফকিররা, তাই নিয়ে তাদের দেমাক কতো! অতো দেমাকের কী আছে? যেখানে পুরনো আমলের গোরস্থান। একটা মস্ত শিরীষ গাছ, কয়েকটা পিতরাজের গাছ আর দুটো শ্যাওড়া গাছ। জিন আর ভূতের আস্তানা। ফকিরগুষ্টির কেউ মরলে গোর দেওয়া হতো ওখানেই; কিন্তু দাফন সেরেই জ্যান্ত মানুষগুলো তড়িঘড়ি করে ঘরে ফিরতো। পরে গোর জিয়ারত করতে যাবার সাহসও কারো হয় নি। এখন তো ওসবের চিহ্নমাত্র নাই।

নদীর ভাঙন শুরু হওয়ার আগে মাদারিপাড়া থেকে যমুনার মূলবাড়ি ঘাটে যেতে হাঁটতে হয়েছে এক ক্রোশের ওপর। চেরাগ আলি বলতো তার পরদাদার পরদাদার আমল ওখানে নাকি নদীই ছিলো না, যমুনা ছিলো ছিপছিপে লাজুক একটি খাল মাত্র। গোরা নাসারাদের সঙ্গে লড়াই করার সময় মাদারিরা নাকি যখন তখন ঘোড়ায় চড়েই। এপার ওপার করেছে। শেষকালে গোরারা জিতে গেলে প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর পর এই। গোরস্থান থেকেই মাদারিদের কোন সর্দার ফকির না-কি পীর না পয়গম্বর অভিশাপ দিলে ভূমিকম্প হয়, সাংঘাতিক ভূমিকম্প, তাইতে খালটা পায় নদীর সুরত। কে অভিশাপ দিলো, কী দোষে এই অভিশাপ কিংবা কাকে অভিশাপ দেওয়া হলো-এসব নিয়ে পরিষ্কার করে চেরাগ আলি কখনো বলে নি। কুলসুম জানতে চাইলে গুনগুন করে শোলোক ধরতো,

তানার লানতে মাটি ফাটিয়া চৌচির।
নবস্রোত তালাশিয়া দরিয়া অস্থির।।
সেইমতো ব্রহ্মপুত্র বহে যমুনায়।
করতোয়া হইল ক্ষীণতোয়া শীর্ণকায়।।
আহা রে কুলীন নদী আবিল পঙ্কিলে।
ফকিরে ঠিকানা পায় মহামীন বিলে।।

তা ওই নদীতে-পরিণত খাল পশ্চিম তীর ভাঙতে শুরু করলে চেরাগ আলি হুঙ্কার ছাড়লো, শালী নদী আসুক, মাদারিপাড়ার দিকে আসুক। তখন শালীক দেখা যাবি। নদীর গতি তবু স্তিমিত না হলে সে হুঁশিয়ার করে দেয়, যার অভিশাপে খাল পরিণত হয়েছে নদীতে, তার মুরিদ সাগরেদ, আত্মীয় স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টির কবর আছে না তাদের গোরস্থানে? এই গোরস্থান ডিঙিয়ে নদী এক পা এগোয় তো চেরাগ আলি নিজের নাম পাল্টে এই নাম দেবে কোনো নেড়ি কুত্তাকে। কিন্তু শিরীষ আর পিতরাজ আর শ্যাওড়া গাছের জিন আর ভূত আর কবরে কবরে চেরাগ আলির সব পূর্বপুরুষ আর চেনাজানা আত্মীয়স্বজনের হাড়গোড়শুদ্ধ গোরস্থান গিলে ফেলার পরও যমুনার আয়তন কমে না। চেরাগ আলির নামের মহিমা বরণ করার নেড়িকুত্তাও সব সাফ হলো। তবে হ্যাঁ, নদী এসে থমকে দাঁড়ালো মাদারিপাড়ার ঠিক ধারে এসে। সবাই বোঝে, এতো খাবার পর যমুনা একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, গতরটা একটু ঝরঝরে হলেই শালী ফের গিলতে শুরু করবে। তাই মাদারিপাড়ার লোকজন আগেভাগে এদিক-ওদিক সরে পড়তে লাগলো। কিন্তু চেরাগ আলিকে নড়াবে কে? তার ওপর যেন ওহি নাজেল হয়েছে, যমুনার খিদে সম্পূর্ণ মিটে গেছে, আর এক ছটাক মাটি গিললে যমুনা পেটের অসুখেই মারা পড়বে। মাদারিপাড়া হজম করার সাধ্যি শালীর কোনোদিন হবে না। কিন্তু চেরাগ আলির এই জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বেটা সামাদ ফকির ভোররাতের স্বপ্নে যমুনার ঘোলা পানিতে নিজের ড়ুবে যাবার স্বপ্ন দেখে তার মাজেজা জানতে এলে চেরাগ আলি ধন্দে পড়ে। ঘোলা পানি দেখা তো ভালো কথা নয়। এ তো রোগের ইশারা বাবা। রোগ বিমারি, বালামুসিবত, এমনকি কারাবাস পর্যন্ত হতে পারে। তবে সামাদ তো ভালো সাঁতার জানে, স্বপ্নেই বা পানিতে কেন ড়ুববে সে? পানিতে ডোবার স্বপ্নের তাবির খুব খারাপ। সামাদের স্বপ্নের তাবির ঠেকাতে চেরাগ আলি যাকে পায় তাকেই ধরে ধরে শোনায়, মাদারিপাড়া গাঁও ছোটো হলে কী হয়, এই গাঁয়ের মাটি বহুত পুরানা। হামাগোরে পরদাদার পরদাদারা দরগাশরিফের ইজ্জত রাখার জন্যে গোরা নাসারা কোম্পানির সাথে নড়াই করিছে। ওই ময়মুরুব্বির দোয়া কায়েম হয়া আছে এই গাঁওত। দোয়ার রকত আছে না? নদী আর সাহস পাবি না, দেখো! পূর্বপুরুষের দোয়া, ভোররাতে ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে তার নিজের দেখা শুভ স্বপ্ন এবং তার সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী নস্যাৎ করে দিয়ে এক বছরেরও কম জিরিয়ে নিয়ে নদী এক বর্ষার মাঝামাঝি ছোবল দিলো মাদারিপাড়ার পুবপাড়া। কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তরের মাটি হজম করে পশ্চিম দিক গিলে যমুনা এসে ঠেকলো খালপাড় পর্যন্ত। চেরাগ আলির চাচাতো ভাইয়ের তিন মাসের একটি ছেলে, সামাদ ফকিরের বকনা বাছুরটা, ভুলু ফকিরের সদ্য-ফোঁটা এক পাল হাঁসের বাচ্চা এবং ল্যাংড়া লইমুদ্দির এক ধামা ধান শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো গেলো না। এ ছাড়া আর সবাই থালাবাসন, ঘরের বাঁশের খুঁটি ও বেড়া, বালিশ ও কাঁথা, বদনা প্রভৃতি সম্পত্তি নিয়ে খাল পেরিয়ে খালের পশ্চিম তীরে আকন্দদের জমিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে যমুনার ভোজনের বহরটা দেখলো। একটু দেরিতে তৎপর হওয়ায় বাঁশের ঘরটা চেরাগ আলি রক্ষা করতে পারে নি। কিন্তু তার মাথার কালো টুপি, রঙবেরঙের ছোপলাগা আলখাল্লা, ছড়ি, গলা থেকে বুক পর্যন্ত ঝোলানো লোহার শেকল, দোতারা, কেতাবশুদ্ধ ঝোলা এবং ঝোলার বাইরে কুলসুম-এগুলোর কিছুই। খোয়া যায় নি। এসব নিয়ে কয়েকটা দিন তার কাটলো আকন্দদের জমিতে, হাফেজ দারোগার মায়ের তুলে দেওয়া চালের নিচে। এরপর এক নাগাড়ে মেলা দিন তার কাটে দরগাতলায় দরগা শরিফে। সেখানে নতুন খাদেম জুটেছিলো তখন কয়েকজন, তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এবং দরগাকে পরিণত করেছে মসজিদে। তারা মিলাদ পর্যন্ত করতে দেবে না। মাদারি তরিকার ফকির চেরাগ আলি, এসব শরিয়তি বিধিনিষেধের মধ্যে গেলে তার আর থাকে কী? কুলসুম অবশ্য বোঝে, দাদার ওসব তরিকার জেদ  টেদ কিছু নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা করা, মওলানাদের ওয়াজ শোনা-এসব করতে গেলে দাদাজানের টোঁ টোঁ ঘোরাটা বন্ধ হয়, তার রোজগারই বা হয় কোত্থেকে? নইলে বর্ষার দিনে ঐ দরগাশরিফের টিনের ছাদের নিচে পাকা বারান্দায় শোবার সুযোগ ছেড়ে দাদা মরতে আসে এই গিরিরডাঙা গ্রামের কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে পাটখড়িঘেরা ছনের ছাপরায়?

বুড়া এখানে কী মধু যে পেলো তা বুড়াই জানে। এটা কি একটা গ্রাম হলো? প্রথম দিকে দাদার সঙ্গে কোথাও খেতে বসে একটু বেশি ভাত চাইলেই এতোকোনো ছুঁড়ির প্যাটখান কতো বড় গো! কিংবা অদ্যাখলা হুঁড়ি! এবং কারো সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হলেই ফকিরের বেটি, ফকিরের লাতনি,-এইসব কথা শুনতে হয়েছে। ঠিক আছে, দরগায় সুবিধা হলো না, মাদারিপাড়ার সবাই তো চন্দনদহে আকন্দদের জমিতেই মুখ গুঁজে রইলো কয়েকটা মাস, চেরাগ আলি কি সেখানে থাকতে পারতো না? কয়েক মাসের মধ্যে তার জ্ঞাতিগুষ্টি চলে গেলো যমুনার অনেক ভেতরে গোবিন্দপুর চরে, কেউ কেউ ধারাবর্ষায়, কেউ যমুনার পুবপাড়ে মাদারগঞ্জে, সরিষাবাড়িতে। তাদের সাথে সাথে থাকতে পারলেও চাষ করার জমি তো অন্তত কয়েক বছরের জন্যে পাওয়া যায়। যমুনাতীরের মানুষ, যমুনার কোলেকঁখে থাকাই ভালো। কে শোনে কার কথা? চরে যাবার কথা তুললেই চেরাগ আলির ফুটানির কথা, হামরা কি চরুয়া আছিলাম কোনোদিন? বির এলাকার মানুষ চরে যামু কোন দুষ্কে? এসব ছিলো বুড়ার ছলের কথা। আলসের হাড়ি, চাষের কামে কোনোদিন হাত লাগালো না, খালি শোলোক গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করার অছিলা! কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে ঠাঁই পেয়ে খুশিতে দাদা কয়েকটা দিন বুঁদ হয়ে রইলো। বর্ষাকাল, বৃষ্টি লেগেই থাকে, এরই মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে কয়েকদিন বুড়া খালি পুরোনো শোলোকগুলি ঝালাই করে নিলো। এখানকার কাৎলাহার বিল, তার সিথানে কোন জিন না দেও থাকে, সে কি তার বাপ না সম্বুন্দি কী হয়, চেরাগ আলি তার সারা জীবনের শোলোক মনে হয় বকশা করে দিলো তাকেই।।

কুলসুমের তখন কিছুই ভালো ঠেকে না। এখানে মাঝিপাড়ার মানুষ তেমন খয়রাত দিতে চায় না, মিলাদ পড়ায় কম, ছেলেদের খতনা করে কি-না কে জানে। আর এদের মরা ময়মুরুব্বির পাষাণ হিয়া, ছেলেমেয়েদের খোয়বে এসে দেখাও দেয় না। গোলাবাড়ির হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন, জোড়গাছায় এক দিন। এই তিন দিনে ঐসব হাটে গিয়ে দাদায় নাতনিতে প্রাণপণে চাঁচালেও পয়সা যা মেলে তাতে রেজেক হয় কয় দিনের? পেট প্রায় খালিই থাকে। এর ওপর রাতে বাতাস উঠলেই মাথার ওপর বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকি। মাদারিপাড়ায় যখন ছিলো, রাত্রিবেলা দাদা বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটে নি পর্যন্ত। রাত হলেই প্রত্যেকটা বাঁশ হলো তেনাদের একেকজনের আসন। আর এখানে বাঁশঝাড় হলো তেনাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু বললেই শুরু হতো ফকিরের ভাষণ, এই জায়গার বরকত দেখিছিস? হামাগোরে পরদাদারা এটি অ্যাসা আস্তানা লিছিলো। জ্ঞাতিগুষ্টির কতোজন এটি চোখ মুঞ্জিছে, তানাগোরে রুহ এখনো এটিই ঘোরাঘুরি করে রে বুবু, এই জায়গা যি সি জায়গা লয়।

মাদারিপাড়াত না তোমার দাদা পরদাদা ব্যামাক মানুষের গোর আছে। একোজন মানুষের কব্বর হয় কয় জায়গাত?

হয় না? তাও হয়। চেরাগ আলি নজির দেয়, সেরপুরে এক পীরের দুই মোকাম, দুই মাজার। একটা শিরমোকাম, সেটি গোর দিছে পীর সাহেবের কাল্লাখানা। আরেকটা ধড়মোকাম, সেটি আছে তেনার শরীলটা। দুষমনে পীর সাহেবকে কাটিছে দুই ছাও করা। গোরও হচ্ছে দুই জায়গাত। এক কোশ তফাত।

তোমার পরদাদারা কি সোগলি মরার পর দুই তিনখানা করা ভাগ হছে?

এ রকম নিষ্ঠুর উক্তিতে চেরাগ আলির মন খারাপ করতো, গলা নিচু করে বলতো, আস্তে বুবু, আস্তে। ময়মুরুব্বি সবই শুনিচ্ছে। তবে মন ভালো করার কায়দাও চেরাগ আলির ভালো করেই জানা, সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রয়োগ করে,

সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি।
তলায় গজার মাছ অতি হিংস্রমতি।

এটিকার বিল দেখ্যা, তুমি এই শোলোক নতুন বান্দিছো।

অবোধ বালিকার সন্দেহে চেরাগ আলি হাসে, কোনো শোলোক বাঁধবার ক্ষমতা কি তার আছে? কতো কিসিমের আওয়াজ মানুষের বুকে থাকে। কোনোটা বেরিয়ে আসে কষ্ট পেলে, কোনোটা বেরোয় মানুষ হঠাৎ ভয় পেলে। শোক হলে মানুষের আওয়াজ একরকম, আবার খুশির আওয়াজ আলাদা। এইভাবে কতো শোলোক যে জন্ম থেকে তার বুকে থরে থরে জমা হয়ে আছে, তার দাদা পরদাদার রক্তের সঙ্গে এইসব গান তার শরীরে ভাটি বয়ে এসেছে, কখন সে কোনটা গাইবে তা কি তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে? কুলসুম বোঝে, দাদার কথাই ঠিক, এতো এতো শোলোক দাদা বাঁধবে কী করে? এসব হলো তার পাওনা-শোলোক। শুনতে শুনতে কুলসুমের অনেকগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। রাস্তার মোড়ে, হাটে, বাজারে, মেলায় দোতারা বাজাতে বাজাতে চেরাগ আলি এইগুলো গায়, গাইতে গাইতে চরণের মাঝখানে হঠাৎ তার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বাকি কথাগুলো সুর করে গাইতে হয় কুলসুমকে। দাদার শোলোক থেকে মাঝে মাঝে পুরনো কথা ঝরে পড়ে, অন্য কোনো শোলোকের চরণ এসে ঢুকে পড়ে সুড়ুত করে, কুলসুম ঠিক ধরে ফেলে। ওদের মাদারিপাড়া দরগাতলায় এসব গান জানে। মেলা মানুষ। এদিকে কখনো কখনো কাউকে কাউকে পাওয়া যায় যারা শোলোকের শুরুতে কয়েকটা চরণ গুণগুণ করে গলা মেলাতে পারে। গোলাবাড়ি হাটের বৈকুণ্ঠ, সেই কেবল কয়েকটা গানের পুরোটাই জানে, আর আর শোলোকের কোনোটা আদ্দেক, কোনোটা সিকিভাগ। গোলাবাড়ি হাটে কালাম মাঝির দোকানে এদের নিয়ে তুললো তো সে-ই। তারই উস্কানিতে কালাম মাঝি তাদের দাদা নাতনিকে নিজের বাঁশঝাড়ে ছাপরা করে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তখন ছোটো থাকলে কী হবে, কুলসুমের সব স্পষ্ট মনে আছে। এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে হিন্দুটা তার কী সর্বনাশই না করে দিয়েছে। শরাফত মণ্ডলের বেটার সঙ্গে সভা করে করে গফুর কলু যে আজকাল বলে, হিন্দুরা এক জাত, মোসলমান আরেক জাত-কথাটা ঠিকই। না হলে চেরাগ আলি ফকিরের গান শোনার মতলবে বৈকুণ্ঠ কি চিরটা কাল তাদের এখানে রাখার ব্যবস্থা করে কুলসুমের এতো বড়ো সর্বনাশ করতে পারে?

বুলু মাঝির ভাতারের ভাত-না-খাওয়া বৌ আবিতন এতোক্ষণে চলে গিয়েছে। কতো দূর, কিন্তু গিরিরডাঙার মানুষের ওপর, জলবায়ুর ওপর কুলসুমের রাগ আর যায় না। শাড়ির ময়লা আঁচলে সে মুখটা মুছছে তো মুছছেই। এই মোছামুছিতে নাকের ডগা তার একটু একটু ব্যথা করে এবং ঘষায় ঘষায় ডোবার ঘাসপাতাশ্যাওলা ও গুগোবরমাটির গন্ধ এবং বেলে পুঁটি খলসে শোলের আঁশটে গন্ধ ফিকে হয়ে আসে, ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যায়। এই সুযোগে বৈকুণ্ঠের মুখের পানজার সুবাস তার মাথায় ঢুকলে মাথা ঝিমঝিম করে। নেশা-ধরা ঐ গন্ধের সঙ্গতে চেরাগ আলি ফকিরের দোতারার টুংটাং বোল কুলসুমের ডানদিকে বাঁদিকে এবং সামনে ও পেছনে, এমন কি মাথার ওপরেও টক টক মেঘ জমিয়ে তোলে। ওই বাসি গন্ধ ও বাসি আওয়াজেই বৃষ্টি নামে তার গোটা মাথা জুড়ে। বহুদিন আগে এই বৃষ্টির মধ্যেই ছুটতে ছুটতে তারা উঠেছিলো কালাম মাঝির দোকানে। গোলাবাড়ির হাটে সেদিন হাটবার, এর মধ্যে সন্ধেবেলা কী ঝমঝম বৃষ্টি! বৈকুণ্ঠের ডাকে তার দাদা আর দাদার হাত ধরে সে একবার মুকুন্দ সাহার দোকানে, একবার কালাম মাঝির দোকানে ছোটাছুটি করলো। মাথার ওপরে ঝমঝম বৃষ্টি। লক্ষণ তো কোনো দিক থেকেই ভালো ছিলো না। দাদা তার এতো জানে, আর এটুকু কি বুঝতে পারলো না যে, ঐ ঝড় বাদলে আর ঐ অন্ধকার রাতে ঘরের বাইরে থাকার কিংবা নতুন ঘরে ওঠার কোনো ইশারাই নাই? কেন, মাদারিপাড়া থাকতে কোনো কোনো মেঘলা সকালে এমন হয়েছে, ঘরে চাল নাই, মাটিতে উপুড় হয়ে বসে দোতারায় টুংটাং করতে করতে চেরাগ আলি কুলসুমকে পাঠাতে চেয়েছে পড়শির ঘরে, যা তো বুবু, সামাদের মায়ের ঘরত যা, এক টালা চাল চায়া আন। আজ আর বারালাম না। মানুষের মুখঝামটা আর কতো খাওয়া যায়? বৃষ্টির মধ্যেই সে বরং খালের ওপারে চন্দনদহে আকন্দবাড়ির যাবার আবদার ধরলে চেরাগ আলি বলেছে, পানি হলে ঘরত থাকা লাগে রে। পানসে বৃষ্টি তার গলা থেকে ঝরাতো আঠালো গাঢ় স্বর,

আসমানে সাজিল মেঘ হাতির হাওদা।
ঘরেতে বসিল মজনু জপে আল্লা খোদা।
সাগরেদ না বাহিরিও মাস দুই কাল।
পানির বেগানা পথে নসিব কাঙাল।।

তা বাপু আল্লাখোদাই যদি করতো তো চেরাগ আলিকে কি আর দরগার পাকা বারান্দা থেকে ওভাবে উৎখাত হতে হয়? নতুন খাদেম প্রথম থেকেই তার বেদাত কামকাজে অসন্তুষ্ট। এর ওপর সঙ্গে মসজিদ হলো। ওখানে কোনোরকম বেদাত কাম। সহ্য করা হবে না। তা নামাজ বন্দেগি করে পাকা বারান্দায় ঠাঁই পাওয়া গেলে চেরাগ আলি কি তাই করলে ভালো করতো না? কিন্তু মসজিদের ইমাম মেয়েছেলেকে দরগায় থাকতে দেবে না। তবে চেরাগ আলি কি তার নাতনিকে ভাসিয়ে দেবে? চেরাগ আলি অবশ্য বড়ো গলা করে বলতো, শালা ভিন্ন তরিকার মানুষ রে, শালারা হামাগোরে দরগা দখল করিছে। হামার পাও ধরলেও হামি এটি থাকিচ্ছি না। আমরা আজকার ফকির লয়, মাদারি ফকির হামরা, বেড়াকুড়া না খালে দাদা পরদাদারা শাপমন্যি দিবি। এসব গলাবাজি তার ছিলো নতুন খাদেম কিংবা ইমামের আড়ালে, এমন কি দরগার চৌহদ্দির বাইরে, রাস্তায়, যখন কুলসুম ছাড়া তার পাশে আর কেউ নাই। তা খাদেমকে বুড়া যতোই ভয় করুক, ইমামের ভয়ে সে যতোই দরগা ছাড়ুক, এই কথাগুলো বলতে বলতেই তার গলায় গান ফুটতো। তার দোতারার টুংটাং রোল এতোকাল পরেও কুলসুমের মাথায় এতোটাই জোরে বাজে যে মগজের জর্দার নেশা এবং চোখের সামনে তমিজের বাপের চিৎপটাং গতর কোথায় হারিয়ে যায়। মাচা থেকে রান্নার চাল নিতে নিতে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসে শোলোক, বেরিয়ে আসে দাদার দোতারার বোলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে।

০৪. ক্যা গো, নিন্দা পাড়ো

ক্যা গো, নিন্দা পাড়ো? ওঠো, ওঠো।

গতকাল শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো, মরার ঘুম আর চোখ ছাড়ে না। বুলু মাঝির ধাক্কায় কুলসুম গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে; এতেই মনে পড়ে, বুলু মাঝি মারা গেছে কাল দুপুরবেলা, তাকে দাফন করে তমিজের বাপ ঘরে ফিরেছে অনেক রাতে। তমিজের বাপ শুয়ে পড়েছে না খেয়েই, মণ্ডলদের বাড়ি থেকে সে খেয়ে এসেছিলো পেট ভরে। শরাফত মণ্ডল বুলুকে মরণোত্তর পুরস্কার দিয়েছে ৮/১০ জন গোরযাত্রীকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে। বুলুর নিজের হাতে চাষ করা জমির ধানের ভাত, ভাত কী মিষ্টি! মণ্ডলের চার বিঘা জমি বুলু এবারেই প্রথম বর্গা নিয়েছিলো, জমিতে আউশের ফলন দেখে মণ্ডল খুব খুশি। অথচ প্রথমে এই জমিটা তাকে দিতে মণ্ডল দোনোমনো করছিলো। হাজার হলেও জমির মালিক ছিলো বুলু নিজেই, আড়াই বছর আগে আকালের সময় মণ্ডলকে বেচে দেয়। তা এবার বুলু খুব কারুবারু করলো এবং বিশেষ করে মণ্ডলের ছোটোবেটা তার পক্ষে সুপারিশ করলে মণ্ডল নরম হয়। তা বুলুর হাতে ধান হলোও বটে! হাজার হলেও নিজের জমিই তো ছিলো, ভিটার সাথে লাগোয়া বাপদাদার আমলের জমি তো, বুলুর রোগা শরীরের অমানুষ খাটনিতে জমি কি সাড়া না দিয়ে পারে? হয়তো ঐ জমিতে আউশ ফলাবার জন্যেই আল্লা এই বছরটা হায়াৎ। দিয়েছিলো তাকে, নইলে পেটের ওই ব্যারাম নিয়ে তার চলে যাবার কথা অনেক আগেই। বৌ তো ভেগেছে আরো আগে। শরাফত মণ্ডল গোরযাত্রীদের খাবার সময় কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়েছিলো নিজেই। তার ইশারায় বুলুর বেটা আফাজের পাতে ভাত তুলে দেওয়া হলো কয়েকবার। মাছ সবার জন্যে জুটলো এক টুকরা করে, আফাজের পাতে পড়লো দুটো পেটি। তার লাশ দাফন করে একেকজনের খিদেও পেয়েছিলো খুব, খেয়েও নিয়েছে ঠেসে। বোয়াল মাছের সালুন দিয়ে পেট ভরে খাবার তৃপ্তিতে তমিজেরক্ষ্মাপ কুলসুমের কাছে বুলুর জন্যে শোক ও আফসোসের কথা বয়ান। করে তারিয়ে তারিয়ে। তার বিলাপ ঝাপসা হতে হতে নাক ডাকার একটানা ধ্বনিতে ড়ুব দিলে কুলসুম কী আর করে, মেঝেতে বসে হাঁড়ির ভাত সব খেয়ে নিলো একাই। মাচায় তমিজের বাপের পাশে শুয়ে তার ঘুম আর আসে না। বাইরে বৃষ্টি-বোয়া জ্যো ত্যা, চাঁদের আলো চাল চুয়ে ঢুকে ঘরের অন্ধকারকে অনেকটা পাতলা করে তোলে। এবার বর্ষায় বৃষ্টিতে চালের ছন অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। চাল ফুটো হলে বর্ষার পানি তবু হড়িকুড়ি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু শীত ঠেকাবে কী দিয়ে? তমিজ যদি নতুন শাড়ি আনে তার জন্যে তো তার ভেঁড়া শাড়িটা আর তমিজের পুরনো বন আর ন্যাকড়া-ট্যাকড়া জোগাড় করে কুলসুম একটা কথা সেলাই করতে পারে। কাঁথার লাল নীল সবুজ সুতা পাতলা অন্ধকারে তার চোখে শিরশির শিরশির করে। সামনের শীতে নতুন কাথার ওমে ঘুমাবার সুখে তখন কুলসুমের চোখ ভরে ঘুম নামে।

তমিজের হাঁকে সেই ঘুম ভাঙলে কুলসুমের বুক কাঁপে : ছোঁড়া এতোদিন বাদে বাড়ি এসেই বাপটাকে বকাঝকা শুরু না করে। দুয়ার ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে তমিজের বাপ সারাটা রাত ঘুম পাড়লো এই মাচার ওপরেই, ঘুমের মধ্যে উঠে সে একবারও বাইরে যায় নি। সারাটা রাত এরকম বেঘোরে ঘুমালো কি বুলুর শোকের তাপে? তা যতোই ঘুমাক, রাতভর বাইরে বাইরে হাঁটার মেহনত যখন হয় নি, তখন কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘুম ভাঙবে। বাপ উঠলেই বেটা তাকে বকবে। বাপকে বকায় ব্যস্ত থাকলে তমিজ তাকে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাবার ফুরসৎ পাবে না বলে কুলসুম একটু স্বস্তি পায়। আবার বেটার বকাঝকায় তমিজের বাপের কাচুমাচু মুখ ঐ স্বস্তিতে চিড় ধরায়।

এদিকে বাইরে তমিজের গলা শোনা যাচ্ছে ফের, আফাজের বাপের দাফন হলো কোটে? তমিজ নিশ্চয়ই বাইরে কারো সঙ্গে কথা বলছে। এই সুযোগে কুলসুম এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার সরা তুলে ফেলে, হাঁড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো উঠে আসে তমিজের পুরনো পিরানের গন্ধ। বাইরে মেয়েলি গলায় তমিজের কথার জবাব দিচ্ছে কেউ। হাঁড়ি সরাচপা দিয়ে মুখ তুলে কান খাড়া করলে কুলসুম বোঝে তমিজের সঙ্গে কথা বলছে আবিতন। ছি! মাগীর লজ্জাশরম কিছু নাই। মাস ছয়েক আগে গফুর কলুর সঙ্গে নিকা বসলো, তারপর থেকে মাঝিপাড়ায় তার পা দেওয়াই নিষেধ। আজ এতো সাহস সে পায় কোত্থেকে? নিজের বাপের বাড়ি কি মাঝিপাড়া দূরে, থাক, গিরিরডাঙা গ্রাম থেকেই তাকে খারিজ করা হয়েছে চিরকালের জন্যে। গফুর কলুর সঙ্গে মাঝিদের ওঠা-বসা তো দূরের কথা, তার কাছে কেউ কিছু বেচেও না। এমন কি কাদেরের দোকানে কাজ নেওয়ার পর সে অবস্থা অনেকটা ভালো করেছে, কিন্তু মাঝিদের কেউ তার কাছে টাকা হাওলাত নিতেও যায় না। এই অবস্থায় কাদের তাকে দিয়ে লীগের কাজ করায় কী করে? মাঝিপাড়ার মাথাগুলোকে নিয়ে সে কয়েকবার বৈঠক করলো। সে বোঝায়, কলু হোক তেলি হোক, গফুর তো মুসলমান। কী? আবদুল গফুরের ধর্ম কী?-ইসলাম। ইসলামে এসব ভেদাভেদ নাই। মুসলমানের এখন একজোট হওয়া দরকার, একজোট না হলে হিন্দুদের সঙ্গে আর কি। পেরে উঠবো?—তা মাঝিরা আরো বেশি একজোট। গফুর মানুষ হিসাবে যাই হোক, মাঝির বেটিকে বিয়ে করে মাঝিদের সে যেভাবে বেইজ্জত করেছে, তার ও তার বৌয়ের কোনো মাফ নাই। মাঝিদের সিদ্ধান্তে বিরক্ত হয় কাদের, হিন্দুদের মতো জাতপাত মানলে মুসলমান কওম থেকে তোমরা খারিজ হয়া যাও, সেটা বোঝো? ওইসব বৈঠকের একটিতে বুলু নিজেও হাজির ছিলো, এর তিন চার মাস আগে সে বৌকে তালাকও দিয়েছে। আবার কাদেরের সুপারিশেই শরাফতের জমিতে বর্গা করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু সেও মহা গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে জ্ঞাতিগুষ্টির ক্রোধে ইন্ধন জোগায়। শেষ বৈঠকে শেষ মুহূর্তে কালাম মাঝি এসে একটি কথা বলেই কাদেরকে চুপসে দেয়, আপনার বাপজানের সঙ্গে কথাবার্তা কয়েন। আপনে কি কোনো মাঝির বেটিক বিয়া করবেন? মাঝিগোরে আপনেরা কী চোখে দ্যাখেন, কন তো?

বাড়িতে শরাফত মণ্ডলও ছেলেকে প্রায় একই যুক্তি দেয়, আজ তুমি কলুর সাথে মাঝির বেটির নিকা সাপোর্ট করো, ভালো কথা, কিন্তু কোনো মাঝি তোমার বোনের সাথে সম্বন্ধ করবার আসে তো তুমি রাজি হবা? কাদের জবাব দিয়েছিলো, ছেলে যদি লেখাপড়া জানে তো আপত্তি করবো কেন? সে বলে, লেখাপড়া শিখে চাকরিতে ঢুকেছে বলেই না তার বড়োভাইয়ের এতো খাতির, টমটমে করে গ্রামে ঢোকার সাথে সাথে তাকে দেখতে ভিড় জমে যায় রাস্তার দুই পাশে। আবার মানুষ তাকে হিংসাও করে। এসব তো তার চাকরির জন্যেই। এসব অকাট্য যুক্তি। কিন্তু শরাফত মণ্ডল আবদুল কাদের মিয়া, শোনো, বললে কাদের তার পুরো নাম এবং নামের পর ইজ্জত-বাড়ানো শব্দটি শুনে চোখ নিচে নামিয়ে লতিশুদ্ধ দুই কান পেতে দেয় বাপের। কথা শুনতে, লীগের কামে নামিহো। সামনে ভোট। ভোট চাও তো সমাজ তোমার মানাই লাগবি। মানুষের মন বুঝা কাম করো। বইপুস্তকের কথা থোও। ইগলান কথা কলে ভোট পাওয়া যাবি না। ভোটের কথায় কাজ হয়। গিরিরডাঙা গ্রামে লীগের কাজ থেকে গফুরকে বিরত রাখতেও সে বাধ্য হয়েছে।

যে মাগীকে নিকা করে গফুরের মতো মানুষের হেনস্থার শেষ নাই, সেই আবার তার আগের ভাতার মরতে না মরতে মাঝিপাড়ায় আসার সাহস পায়? ছি! ছি! আবিতনের গলা শুনেই কুলসুম লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে আসে। তাকে দেখেও তমিজ আবিতনকে জিগ্যেস করে, আফাজের বাপের প্যাটের বিষ তো অনেক দিনের, না? জবাব না দিয়েই আবিতন দ্রুত পায়ে চলে যায় গোলাবাড়ির দিকে। কড়া চোখে তার যাওয়া দেখে কুলসুম তমিজকে ঘরত যাও বলতে বলতে ডোবার দিকে রওয়ানা হয়। ঘরে ঢুকে তমিজ বলে, বাজান নিন্দা পাড়ো?

প্রশ্নটি তমিজের বাপের কানে ঢোকে শাসনের মতো এবং সে উঠে বসে ধরফর করে। এ তার চিরকালের ব্যারাম। ঘুম থেকে জাগার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মাঝখানে ধক করে আওয়াজ হয় : হায়রে, বেলা বুঝি মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের বকদের সাদা শরীর বেয়ে নেমে এসেছে গাছের হাঁটু অব্দি, আর এখনো তার চেতন হলো না। এই উদ্বেগ থেকে রেহাই পেতে কিংবা উদ্বেগের ক্লান্তি মোচন করতে সে মেঝেতে থাকলে মাচায় ওঠে এবং মাচায় থাকলে মাচাতেই ফের পাশ ফিরে শোয়। ঘুম অবশ্য তার আর আসে না, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাপসে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁপায়। হাজার হলেও ঘুম হলো তমিজের বাপের এক ধরনের কাজ, তার খুব প্রিয় পেশাও বলা যায়। ঘুমালে তার মেহনত মেলা। ঘুমে ঘুমে তার চলাচল, তার খোঁজাখুঁজি, তার ভাবনাচিন্তা, তার উদ্বেগ ও উত্তেজনা এবং নানারকম বুদ্ধি করা ও ফন্দি আঁটা। সে কী খোজে, ভাবনা তার কী নিয়ে, তার উদ্বেগের কারণ কী, কেনই বা তার এতো উত্তেজনা এসব ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় তার মুশকিল আরো বেশি। তাই ঘুম তার যখনি ভাঙুক অন্তত খানিকটা জিরিয়ে না নিলে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানোটাই কঠিন। কিন্তু এখন সে জিরাবে কি? ঘরের মধ্যে তমিজ। তবে পিঠের নিচে সাপ না বিছার অবিরাম খোঁচায় তমিজের শাসন চাপা পড়ে, ওই শাসন থেকে অব্যাহতির সময়টা আরেকটু বাড়াতেই অদৃশ্য সরীসৃপের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিড়বিড় করে শালার বেটা শালা বলতে বলতে পিঠের দুর্গম জায়গায় হাত দিয়ে সে বার করে আনে অপরিচিত একটি জীবকে। জীবের দুই পাশে চোখা আগাওয়ালা কয়েকটা ডানা। ডান হাতে চোখের সামনে ধরলে জিনিসটা স্পষ্ট হয় এবং ঝাপসা হয়ে ফুটে ওঠে গত সন্ধ্যার দাফনের ছবি। কাল গোরস্তানের একটি দুই দিনের বাসি কবর থেকে সে এটি তুলে এনেছে। গোরস্তানের খেজুর ডালের গুণ অনেক, এটা সঙ্গে থাকলে রাত্রে কেউ ঘাটাতে সাহস পায় না, এর শক্তি আগুন ও লোহার পরেই। রাতে কাৎলাহার বিলের সিথানে পাকুড়তলায় যাবার সময় এটা সঙ্গে রাখা ভালো। কিন্তু গত রাতটা তার কাটলো শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। অপচয়! অপচয়!-একটি দীর্ঘ রাত্রি বৃথা কাটাবার বেদনায় দমে গিয়েও ঐ রাতটির নষ্ট তেজ ফিরে পাবার লোভে তমিজের বাপ চোখজোড়া বন্ধ করে। এতে কাজও হয় বৈ কি! কালাহার বিলে হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটে ভেড়ার পাল, নিজেদের গজার মাছের সুরত ফিরে পাবার আশায় তারা সাঁতার কাটে খুব মন দিয়ে। এইসব দেখতে দেখতে চোখ মেলে তমিজের বাপ তাকায় ছেলের দিকে। জীবিত একমাত্র সন্তানের কড়া চোখ তার নজরে পড়ে না, ছেলের ঝাঁকড়া চুলে সে দেখে কালো পাগড়ি, তার হাতে লোহার পান্টি, গলায় শেকল।

টাসকা মারা গেলা ক্যা গো ওঠো না কিসক? তমিজের এই ধমকে ১৪ অক্ষরের পয়ারের আভাস থাকলেও তমিজের বাপের কানে তা এমনি কষে ধাক্কা দেয় যে চোখের পলকে তার চোখের সমুখের পান্টি মিশে যায় তমিজের হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত, গলার শেকল ঢুকে পড়ে তমিজের কণ্ঠার হাড়ে এবং মাথার কালো পাগড়ি লুকায় তার ঝাঁকড়া চুলের ভেতর। তমিজের বাপ মাচায় উঠে বসে বলে, ক্যা বাবা, সোমাচার ভালো? ছেলের ধমক খাবার ঝুঁকি এড়াতে ছেলের কুশল না জেনেই নিজের চোখমুখদাড়ি দুই হাতে ঘষতে ঘষতে তমিজের বাপ জরুরি তথ্য দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, বুলুর খবর শুনিছিস? কও তো বাপু, তাজা মানুষটা, বেনবেলা প্যাট ভরা পান্তা খায়া বার হছে, পান্তা খাছে, পান্তার সাথে।

শুনিছি। এক কথায় তমিজ তাকে থামিয়ে দিলে আরো কথা বলার খাটনি থেকে রেহাই পেয়ে এবং বুলুর শেষ খোরাক গেলার মুখরোচক বর্ণনা বয়ান করা থেকে বঞ্চিত। হয়ে এখন কী করবে ঠিক বুঝতে না পেরে তমিজের বাপ হঠাৎ করেই মেঝেতে নামে এবং বেলা কুটি গেছে গো বলে ডোবার দিকে যেতে যেতে আপন মনে বলে, আজ শমশেরের জমিত মাঙুন কামলা দেওয়ার কথা। আজ বুধবার লয়?

লিজেগোরে নাই এক চিমটি জমি, হামাগোরে আবার মান কামলা খাটা কিসক গো? তমিজের এই কথার জবাব না দিয়ে তার বাপ বাইরে গেলে তমিজ জোরে জোরে বলে, যার জমিত মাঙুন খাটবা, তাই তোমার খ্যাটা দিবার পারবি? তোমার জমি কোটে? তমিজের এই খেদোক্তির প্রতিবাদ করা মুশকিল। জমিতে মাঙুন খাটা মানে পরস্পরকে মাগনা সাহায্য করা, তমিজের বাপ জমির কাজে সাহায্য করার সুযোগ কোথায়?

তমিজের বাপ বাইরে মুখ ধুতে গেলে তমিজ যায় ভেতরের দিকের নতুন ঘরটিতে। ফাল্গুনে খিয়ার থেকে টাকা এনে এই ঘরটা সে তুলেছিলো নিজের থাকার জন্যে। সে বাইরে গেলে বৃষ্টি বাদলায় কুলসুম এখানে রাঁধে, ধানের বস্তা রাখে। মুরগিটাকে ওমে বসিয়েছিলো এখানেই, বাচ্চাগুলো মরতে মরতে এখন দুটিতে এসে ঠেকেছে, রাতে মুরগিটা দুটি সন্তানকে নিয়ে এখানেই থাকে। আজ মেঘ নাই, তার। ওপর তমিজও বাড়ি এসেছে। কুলসুম তাই উঠানের চুলায় ভাত চড়াবার জন্যে চাল ধুচ্ছিলো। একটা চটের ঝোলা তার হাতে এগিয়ে দেয় তমিজ, গোলাবাড়ি থাকা কয়টা মাছ লিয়া আসিছি। কুলসুম তার দিকে না তাকিয়ে ঝোলাটা নিয়ে চাল ধোয়া অব্যাহত রাখলে তমিজ হঠাৎ নতুন করে গলা চড়ায়, কালাম ভায়েক কয়া গেলাম, তাই বাঁশ দিবি, খ্যাড় দিবি, চুলার উপরে চালা তুল্যা লিবার কলাম। কিছুই তো করো নাই দেখিচ্ছি।

গতবার তমিজ এসে কালাম মাঝির পাতকুয়ার পাট বদলে দেওয়ার কাম করলো, মজুরি নেয় নি। কথা হয়েছিলো ধান দেবে আধ মণ। তমিজের ঘরেই তখন মেলা ধান, কালামের কাছ থেকে ধান এনে দেওয়া মানে আরো কয়েক দিন বাপটাকে বসে খাওয়ার সুযোগ দেওয়া। তমিজ তাই কালামকে দুটা বাঁশ আর কিছু খড় দিতে বলে যায়, ওই দিয়ে তমিজের বাপ উঠানে একটা চালা করে দিলে কুলসুমেরই সুবিধা হয়। চড়া রোদে কুলসুম ভাত রাঁধে, বৃষ্টি নামলে ছোটাছুটি করে ঘরে উঠে তোলা-উনান ধরায়। এসব কষ্ট থেকে তাকে রেহাই দিতেই চালাটা তোলার কথা। তা তাড়াতাড়ি করে তাকে খিয়ারের দিকে যেতে হলো। বাপকে কতোবার বলে গেলো। কোথায় চালা, কোথায় কী? বাঁশের একটা খুঁটি পর্যন্ত নাই। তমিজের মেজাজটা খিচড়ে যায়, ক্যা গো ফকিরের বেটি, হামি না থাকলে একটা কামও কি হবি না গো?

ভোরবেলা বাড়ি এসেই তমিজ গফুর কলুর নিকা-করা বৌয়ের সাথে কথা বলে কুলসুমের দিনটা তো মাটি করে দিয়েছে। সতীনের বেটার এখন শুরু হলো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা। কুলসুম কয়েকবার গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিলে চুলায় আগুন জ্বলে দপ করে, তার আঁচে মুখটা তার হয়ে ওঠে বেগুনি রঙের। আগুনের তাপে তার গলা বাজে গনগন। করে, হামাক তো তোমরা রাখিছো চাকরানি কর‍্যা, আবার হামাক দিয়া কামলাও খাটাবার চাও? একবার কথা শুরু করলে কুলসুমের পক্ষে থামাটা কঠিন। তাই তাকে অবিরাম বকে যেতেই হয়, কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ের বাঁশ কি ক্যাটা আনা লাগবি হামাকই? খুঁটি কি হামিই পুঁতমু? রাগে ও চুলার আঁচে তপ্ত বেগুনি মুখটা তমিজের দিকে পলকের জন্যে একবার ঘুরিয়ে ফের চুলায় মনোযোগী হয়ে কুলসুম বলে, হামরা ফকিরের ঘরের বেটি, হামরা কি জেবনে পাকঘর দেখিছি; না-কি পাকঘরত পাকশাক। করিছি? হামাক ওদেত পোড়া লাগবি, বিষ্টিত ভিজা লাগবি। এখন থেকে অন্তত বিকালবেলা পর্যন্ত এই কথাই, একই বাক্য নানা বিন্যাসে সে পুনরাবৃত্তি করে চলবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কথা যোগ হবে।-কী? হামার কপালের দোষ। কেন?আগুন ও লোহার পরেই-না, সে ফকিরের বেটি, সে পড়েছে খানদানি মাঝিদের ঘরে। মাঝিদের নিজেদের পাছায় ত্যানা নাই, নিজগিরিরডাঙার হাভাতে চাষারাও এদের সঙ্গে এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা দূরের কথা, ওঠা বসা পর্যন্ত করে না।—সেই গুষ্টির মানুষ। হয়ে তমিজ কথায় কথায় তাকে খোটা দেয় ফকিরের বেটি বলে। কৈ, তমিজের বাপ তো কুলসুমকে অন্তত বংশ তুলে কখনো কথা শোনায় না। মানুষটা বোকাসোকা আবোর হোক আর পাইঙ্গা হোক, হাজার হলেও কয়েকটা বছর তো চেরাগ আলির পিছে পিছে ঘুরলো। দাদা কি তাকে কিছুই দিয়ে যায় নি। এই যে ঘুমের মধ্যে উঠে সে বাইরে যায়, আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ঠিকঠাক ঘরে ফেরে, এইসব সম্ভব হয় কী করে? তেনাদের কেউ তার ওপর ছাতা ধরে আছে বলেই তো! চেরাগ আলি থাকলে তাকে। সতীনের বেটার এতোই খোটা সহ্য করতে হয়? কুলসুমের দুই চোখের পাতাই ভারি। হয়ে আসে। তবে সাতসকালে ছিনাল মাগী আবিতনের সঙ্গে তমিজের কথাবার্তার। অস্পষ্ট ধ্বনি চুলার আগুনকে উসকে দিলে তার আঁচে চোখ খরখর খরখর করে এবং তার ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে থাকে প্রবল তোড়ে। কিন্তু কুলসুমের কথার কি চুলার আগুনের ঝাঁঝ তমিজকে ছুঁতে পারে না, সে কথা বলে চলে তার বাপকে লক্ষ করে। কী,-না, আকালের বছর তার সবেধন নীলমণি তিন বিঘা জমি শরাফত মণ্ডলকে বেচে সে শোধ করলো জগদীশ সাহার দেনা, তার গোরুটা পর্যন্ত নিয়ে গেল জগদীশের মানুষ এসে। তাতেও নাকি সাহার সুদের টাকা সব শোধ হয় নি। সেই মানুষ আবার যায় মান কামলা খাটতে! এরকম হাউস সে করে কোন আক্কেলে? তমিজের বাপ জবাব দেয় না। জবাবের জন্যে পরোয়া না করে তমিজ হাঁটা দিলো রাস্তার দিকে।

কুলসুম দেখে হাঁড়ির ভেতরটা, ভাত হতে আর কতক্ষণ? তমিজ ততোক্ষণে চলে গেছে নজরের বাইরে। এ কী রকম জোয়ান মানুষ গো? সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় খালি পেটে? হাঁটা দিলো বুঝি শরাফত মণ্ডলের বাড়ির দিকে। বুলুর বর্গা-করা জমিটা এবার নিজেই বর্গা নিতে পারে তো আমনের খন্দটা ধরতে পারে। আমন রোপার সময় এখনো যায় নি। কড়া কড়া কথা বলতে বলতেই সে বাপকে এই পরিকল্পনার কথা একবার বলেছে। বাপের সাড়া না পেয়ে হনহন করে ছুটলো।

না খেয়ে তমিজ ঝাল ঝেড়ে গেলো কুলসুমের ওপর। ওদের বাপবেটার ঝগড়া হলে দুজনেই কথা শোনায় কুলসুমকেই। এই ঘরে বিয়ে দিয়ে গিয়ে দাদাটা তার কী সর্বনাশটাই যে করে গেছে! বুড়া নিজে তো দিব্যি কেটে পড়েছে, এতিম নাতনিটার কথা কি তার একবার মনেও পড়ে না? তমিজের বাপের খোয়াবে তো সে নিত্যি আসা-যাওয়া করে, কুলসুমের চোখের ভেতর কি একবার উঁকিটাও দিতে পারে না? কী। জানি, বিটকেলে বুড়া মরেই গেলো কিনা কে জানে? মরে গিয়েছে?-মরলে কিন্তু একদিক থেকে ভালোই। যদি বেঁচে থেকে থাকে তো চোখের আলো তো তার এ্যাদ্দিনে একেবারে নিভু নিভু; একা একা ক্রোশের পর ক্রোশ সে পাড়ি দেয় কী করে? জেয়াফতের বাড়িতে খেতে বসলে তার পাতে এক টুকরা গোশত কি এক হাতা ডাল তুলে দিতে বলবে কে? কুলসুমের সামনে হাঁড়ির ওপর ধোঁয়ায় কাঁপে কালো টুপিপরা চেরাগ আলির মাথা। হাতের ছড়ি ঠুকে ঠুকে বুড়া কোন মেলায়, কোন হাটে, কোন নদীর ঘাটে বটতলায় ঘোরে আর দোতারা বাজিয়ে গান করে। চুলায় ভাত ফোটে টগবগ করে, সেই আওয়াজে তৈরি হয় চেরাগ আলির শোলোক। কিন্তু গানের কথা কুলসুম কিছু বুঝতে পারে না। গান করতে করতে বুড়া মানুষটা হাপসে যাচ্ছে, শুধু দোতারাই বাজিয়ে চলেছে, মুখে তার কথা ফোটে না। তাকে একটু আরাম দিতে কুলসুম বাকি কথাগুলো গুনগুন করবে তার জো নাই। চেরাগ আলির গানের কথা তো। কিছুই ধরা যাচ্ছে না।

অনেক দূরের অচেনা জায়গায় চেরাগ আলির অস্পষ্ট কথার ধ্বনি ছাপিয়ে ওঠে। তমিজের বাপের হুঁশিয়ারি, ক্যা রে ভাত উথলায়, দেখিস না? চুলার আঁচ কমিয়ে মাড় বসিয়ে হাঁড়ি নামাতে নামাতে কুলসুমের সমস্ত শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ে, হায়রে, গান করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ হলেও দাদার কাছে কেউ নাই যে তাকে একটু জিরাতে দিয়ে পরের কথাগুলো গায়।

 ০৫. আউশের নতুন চালের ভাত

অনেকদিন পর রাত্রে গলা পর্যন্ত আউশের নতুন চালের ভাত, গোরুর গোশত ও হাতিবান্দার দৈ এবং এর আগে দুপুরবেলা ভাত ও আলু দিয়ে পাক-করা বোয়াল মাছের ঘাঁটি সালুন এবং সকাল থেকে দুপুর ও দুপুরে ভাত খাবার পর থেকে রাতে খাবার আগে পর্যন্ত দুই দফায় মুড়ি, বাতাসা ও খাগড়াই খেয়ে বাড়ি ফিরে তমিজের বাপ টইটম্বুর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাঝরাতে তলপেটের ব্যথায় সে জেগে ওঠে এবং দরজা খুলে বাইরের উঠান পেরিয়ে বাঁশঝাড়ে পৌঁছুবার আগেই তাকে বসে পড়তে হয় ডোবার অনেকটা এদিকেই। কোনোমতে-ধোয়া নষ্ট লুঙি এবং নিজের পাছা উরু ও পা ধুয়ে শরীর টেনে ঘরে ঢোকার আগেই তাকে ফের বসে পড়তে হয় দরজার বাইরে এবং সেখানে বসেই বিপুল আওয়াজে শুরু করে বমি করতে। পায়খানা করার সময় শরীরের বেআক্কেলে নিয়মে মলদ্বারে খাদ্যবস্তুর স্বাদ একটুও পায় নি, এখন বমি করতে গিয়ে গলা দিয়ে ওগরানো ভালো ভালো জিনিসের স্বাদ পেয়ে সে একটু চাঙা হয়ে ওঠে। বমি করার সময় গলার মাত্রাছাড়া আওয়াজে ব্যামাক খাবারের পেট খালি করে বেরিয়ে যাবার জন্যে হাহাকারটিও ছিলো। এই আওয়াজে শমশের পরামাণিকের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ থাকাটাও অসম্ভব নয়। শমশের হলো আদি চাষাঘরের মানুষ, পাছায় ত্যানা না জুটলেও কথাবার্তায় এরা সব লবারের বেটা। কথা সবটা সে রাখে নি। পরশু গোলাবাড়ি হাটে দেখা হলে বললো, নরেশের দোকানের। রসগোল্লা দুটো করে হলেও দেবে। না, পাকা মিষ্টি শালা দিলো না। তাতে তমিজের বাপের ততো দুঃখ নাই। হাতিবান্ধার গোপাল ঘোষের দৈ আর দৈয়ের সঙ্গে আখের গুড় যে পরিমাণ দিয়েছে তাতে পাকা মিষ্টি না দিলেও চলে। কিন্তু কপাল মন্দ, এতোগুলো ভালো ভালো জিনিস, পেটে বুঝি কিছুই রইলো না।

তা পেটের কী দোষ? রাত্রে তার খাওয়া নিয়ে নিজের বেটা যেমন চটাং চটাং কথা বললো তাতে গোরুর গোশত আর বোয়াল মাছ কি পেটের মধ্যে জুত করে দুই দণ্ড বসতে পারে? এসব খানদানি খানার ইজ্জত নাই? তমিজের খালি এক কথা, যে মানুষ। এক ছটাক জমি রাখতে পারে নি, সে মাঙন কামলা খাটতে যায় কোন আক্কেলে? ওই শমশেরই তো ওই একই আকালের সময় জগদীশ সাহার দেনা শোধ করতে মণ্ডলের কাছে সব বেচে দিয়েও বিঘা দুয়েক জমি কিছুতেই হাতছাড়া করলো না। হোক না তার দোপা জমি, আউশ ছাড়া আর কিছুই হয় না, কিন্তু এ জমি নিতে মণ্ডল তো কম চেষ্টা করে নি। তবু শমসের জমিটা ছাড়লো না। এর রহস্য কী? –ভরপেটে তমিজের বাপ এই রহস্যের কোনো কিনারা করতে না পারলে দায়িত্বটি পালন করতে হয় তমিজকেই।-আরে, শমশের পরামাণিক হলো খাটি চাষার বংশ, এক ছটাক হলেও চাষের জমি তার রাখা চাই। আর তমিজের বাপ হলো মাঝি, মাছ মেরে খাওয়া তার বংশের পেশা। মুসলমান মাঝি আর হিন্দু চাড়ালে ফারাক কী? জমির ইজ্জত এই মাঝির জাত বুঝবে কী?—নিজের বংশ নিয়ে বেটার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলা কথা শুনতে শুনতেই তমিজের বাপের পেটে অস্বস্তি শুরু হয় এবং তখন থেকেই পেট গুড়গুড় করতে থাকে।

বাপের এইসব মন-খারাপ কি পেট-চিনচিনকে পরোয়া না করে তমিজ বলেই চলে মানুষের বাড়ি বাড়ি এরকম খাবার ললিচ বাদ দিয়ে বাপ বরং মণ্ডলের হাতে পায়ে ধরে বুলুর চাষ-করা জমিটা বর্গা নেওয়ার ব্যবস্থা করুক। মণ্ডল রাজি হচ্ছে না। তমিজকে আজ ফিরিয়ে দিয়েছে, তবে কাল ফের যেতে বললো। তমিজের বাপ একটু চেষ্টা করুক না! সে গিয়ে কারুরু করলেই মণ্ডল তাকে মাফ করে দেবে।

তমিজের বাপের দোষটা কী যে তাকে মাফ চাইতে হবে? পেটের সঙ্গে তার গোটা শরীর এবার গরগর করে রাগে : সে কী অপরাধ করলো?

নিন্দের মদ্যে হলেও তুমি কালাহার বিলে যাও না? তমিজের প্রশ্ন শুনে বুড়া ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, গেলোই বা, তাতে দোষের কী?

আত্রে ঘাড়ত জাল লিয়া তুমি বিলত যাও কিসক? জানো না, লায়েববাবুর সাথে ন্যাকাপড়া করা মণ্ডলে ওই বিল জমা লিছে। তাক খাজনা না দিয়া বিলেত কেউ কিছু। করবার পারবি না। আর তুমি লিত্যি ওটি যাও মাছ ধরবার, মণ্ডল যদি চৌকিদার দিয়া তোমাক ধরায়, তুমি কিছু কবার পারবা?

তমিজের মুখে মণ্ডলের অভিযোগ শুনে তমিজের বাপের চোখ জুড়ে মেঘ নামে। বাপদাদাপরদাদা সোগলি ওই বিলের মাছ ম্যারা সংসার চালায়া গেছে, এখন আবার– তার এই অসম্পূর্ণ বাক্য মুখ দিয়ে বেরুতে না বেরুতে সমস্ত মুখ-ঢেকে-ফেলা অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে ঢুকে পড়ে মুখের ভেতর এবং নালী অনুনালী হয়ে পেটে ঢুকে যায় হজম বা বদহজম-হতে-থাকা ভাত, গোরুর গোশত, বোয়াল মাছ ও গুড়-দিয়া-মাখা হাতিবান্ধার দৈয়ের কোমল আশ্রয়ে। তার ঘরের ওপরে মণ্ডলবাড়ির কয়েকটা সাদা বকের সুনসান উড়ালে তার কালোকিষ্টি রোগাপটকা শরীর শিরশির করে উঠলে সে তার ঘরের চালের দিকে তাকায় না। ঐসব বকের ছাইরঙের ছায়া থেকে নিজের মাথা বাঁচানোর চেয়েও পেটের খাদ্যিখাওয়াগুলোর হেফাজত করা বেশি জরুরি। বকের নজর থেকে পেটের খাবার বাঁচাতে দুই হাতে সে তার পেট চেপে ধরে এবং তমিজের কথা শুনতে শুনতেই তাড়াতাড়ি করে লুকিয়ে পড়ে ঘুমের আড়ালে। কিন্তু ঘুম কি ছাই ওইসব ছাইরঙের ছায়া-ফেলা বকদের ক্রমপ্রসারমাণ অন্ধকারকে মুছে ফেলতে পারে? তাদের নিনজরে পেটের খাবার তার পেটে থাকতে পারে না। দরজায় বসে বমি করার বিকট আওয়াজে তার পেট থেকে গোরুর গোশত, বোয়াল মাছ, বাতাসা, খাগড়াই ও দৈ বেরিয়ে যাবার জন্যে হাহাকার তো ছিলোই, ওই আওয়াজ ব্যবচ্ছেদ করলে বৈকুণ্ঠের গলায়-গাওয়া চেরাগ আলি ফকিরের গানের টুকরাটাকরাও পাওয়া যেতে পারে,

মজনু হুঙ্কারে যতো মাদারি ফকির।
আন্ধার পাগড়িত বান্ধো নিজ নিজ শির।
সিনাতে জিঞ্জির পরো আঁখির ভিতর।
সুরমা করিয়া মাখো সুরুজের কর।।

তুমি ফকিরের সব গানই জানো, না? ইগলান মারফতি গান তুমি বোঝো?-শমশের পরামাণিকের এই সংশয়ে বৈকুণ্ঠের কিছুমাত্র বিকার নাই। পাঁচটা গান না গেয়ে সে এখান থেকে উঠবে না। ফর্সা গেঞ্জি ও ময়লা ধুতি পরে মুখভরা পান নিয়ে সে যাচ্ছিলো সাবগ্রাম হাটের দিকে; বাবুর আড়তের জন্যে জিরা কিনবে আর জিরার ভেজাল দিতে শটিবীজের বায়না দিয়ে আসবে ছাইহাটার ভক্তদাস কুণ্ডুর গদিতে। একেবারে সন্ধ্যা পার করে দিয়ে জিরা আর জিরার ভেজাল নিয়ে গোরুর গাড়িতে ফিরবে গোলাবাড়ি।

তা সাবগ্রামের পথে এখানে পড়ে গেলো শমশেরের দোপাজমি, জমিতে মাঙুন খাটা মা হচ্ছে শুনেই বৈকুণ্ঠ বসে পড়লো জমির আলে আমগাছের তলে।

ক্যা গো, মাঙুন কামলা খাটো, তা মুখখাতু গান নাই? বলে বৈকুণ্ঠ নিজেই গাইতে শুরু করলে শমশের ভয় পায়, এই মানুষটার বোধশোধ কম,এই যে গান শুরু করলো এর আর থামাথামি নাই। কামলাদের কাজে ঢিল না পড়ে। সে তাই তাকে তাগাদা দেয়, সাবগ্রাম যাবা বলে? হাট তো বস্যা গেছে বেনবেলা।

আরে জিরা তো পাওয়াই যাবি। শটির বিচি পাওয়ার জন্যে ঐ শালা কুণ্ডুর পাও ধরা লাগবি। শালা ভ্যাজাল বেচে, তারও দাপট কতো। কয় বছর হলো ভ্যাজাল না দিলে জিরা বেচ্যা বাবুর নাকি লোকসান।

হাটে যাওয়া তার মাথায় ওঠে। গান শুনতে কামলাদের উৎসাহও কম নয়, বাপু, হাট তো পাছাবেলা পর্যন্ত চলবিই। আরো কয়টা গান করো। আর একজন বলে, গান না হলে কামের জুত হয়? চেরাগ আলি ফকির থাকতে মাঙুন খাটার সুখ আছিলো গো। মাঙুন খাটার খবর পালেই ফকির লিজে অ্যাসা গান ধরিচ্ছিলো, কাম খুব আগাছে। তা চেরাগ আলির কথাই আলাদা। কোথাও মাঙুন কামলা খাটা হবে শুনলেই সে ঠিক। হাজির হতো তার নাতনিকে নিয়ে। দোতারা বাজিয়ে একটার পর একটা গান করে অন্তত এক বেলা নাতনিকে নিয়ে পেট ভরে খেয়ে তারপর উঠেছে জমি থেকে। বৈকুণ্ঠের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজরটা কম, পান ছাড়া তার মুখে খুব একটা কিছু দেখা যায় না। এমন কি আমগাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা হুঁকা হাতে নিয়ে মুখে লাগাতে গিয়েও সে রেখে দেয়, না বাপু থাক।

তামুক খালেও জাত যাবি? মোসলমান ফকিরের গান ধরিছো, তাত তোমার জাত যায় না? শমশেরের এই মিষ্টি ধিক্কারে কান না দিয়ে বৈকুণ্ঠ তার ময়লা ধুতির কোঁচা থেকে পেতলের কৌটা বার করে সাজা পান মুখে দেয়। কৌটার ভেতরেই আরেকটি ছোটো কৌটা, সেটা হাতের তালুতে উপুড় করে জর্দা নিয়ে মুখে ফেললে মিষ্টি তামাকের গন্ধে আমতলা ম ম করে। কিছুক্ষণ আয়েশ করে পান চিবিয়ে কৃপণের মতো অল্প একটু পিক ফেলে সে বলে, কাম করো গো কাম করো। গান শুনলে কামের জোর বাড়ে। সাধুজনের বাক্য আছে, সংগীতে লজ্জিবি গিরি, পঙ্গুরে কহিল গিরি। গিরি কয়, ওরে পঙ্গু, সংগীত দিয়া পাহাড় ডিঙাবার পারবু। এই গিরি কেটা?—শোনো সেই গিরির গান ধরি। আগেও শুনিছো, এখন আবার শোনো। প্রস্তাবনা সেরে গুনগুন করে গানের সুর ভেজে নিয়ে অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করে। তারপর গায়,

দশনামী প্রভুগণে বন্দিয়া পবিত্র মনে
গিরিসেনা দাড়ায় কাতারে।
ভবানী নামিল রণে পাঠান সেনাপতি সনে
গোরা কাটো আদেশে হুঙ্কারে।
ভবানীর কণ্ঠধ্বনি মৃগরাজধ্বনি জিনি
গর্জনে শার্দুলে লজ্জিত।
সেই ডাকে চঞ্চল মানাস নদীর জল
হইল গোরা শোণিতে রঞ্জিত।
কোম্পানির গোরাসবে পাঠাঁইয়া যমভবে
জলে প্রভু করে আচমন।
বন হইতে সঙ্গোপনে গোরাগণ আক্রমণে
প্রভু সেথা ত্যাজিল জীবন।
গিরিগণে নামে জলে যতনে লইল কোলে
কৃষ্ণ কোলে যেন শত রাই।
পাষাণে হৃদয় বান্ধো কান্দো গিরিগণে কান্দো
ভবানী পাঠক ভবে নাই।

কীর্তনের সুরে হাওয়ার ভ্যাপসা ভাব কাটে, এতে কামলাদের কাস্তের ধার বাড়ে এবং বৈকুণ্ঠের শেষ কথা না-আ-আ-ই-এর লম্বা টানে তমিজের বাপ কেটে ফেলে ধানের মোটা মোেটা আঁটি। এমন কি ভবানী পাঠকের মৃত্যুর শোকে বৈকুণ্ঠের পানের পিক-গেলা গলা চিরে গেলেও তাতে ঘাতকের বিরুদ্ধে ক্রোধ মেশানো থাকায় তার ঝঝে প্রত্যেকের কাস্তের গতি বাড়ে। গান থামার পর গোটা মাঠের হাওয়া এসে ঝাপটা মারে আমগাছের পাতায় পাতায় ও ধানের শীষে শীষে। কেঁচড় ভরা মুড়ি আর বাতাসা আর খাগড়াই নিয়ে বৈকুণ্ঠ সাবগ্রামের দিকে রওয়ানা হলো তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে।

এখন এই এতোক্ষণ পর, এই মধ্যরাতে তুমুল আওয়াজে বমি করতে করতে তমিজের বাপের সামনে বৈকুণ্ঠ গিরির লেশমাত্র ছায়া নাই। গানের কথাগুলি সে বার করে নেয় তার বমির আওয়াজ থেকে। এই গানে তমিজের বাপের রোগাপটকা শরীরে এমনি কাঁপুনি ওঠে যে উঠে দাঁড়াবার বলটুকু তার থাকে না, উঠতে গেলে সে পড়ে যায় চৌকাঠেই। তার মাথা পড়ে থাকে মাচার অন্য প্রান্তের খুঁটির সঙ্গে ঠেকানো এবং পা ঠেকে চৌকাঠে। ঘুম থেকে উঠে আসা তমিজ তন্দ্রা জড়ানো গলায় অক্ষেপ করে, বুড়া হয়া মরবার ধরিছে, জিভার লালচ এখনো গেলো না। এখন আত হচ্ছে কতো, আরো কতবার যে ওঠা লাগবি আল্লাই মালুম। তার উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ কথা তমিজের বাপের কানে নিশ্চয়ই ঢোকে; কিন্তু মশার ভনভনানি, ঝিঝির ডাক, বাঁশঝাড়ের অবিরাম শনশন আওয়াজ, ডোবার পানিতে ঘুমিয়ে-থাকা খলসে পুটি বেলে মাছের চমকে ওঠায় পানির উত্তেজনা এবং তমিজের ঘুমে-জড়ানো জিভের কথার সঙ্গতে তার কানে বাজতে থাকে এলোমেলো ছন্দের একটানা সুর,

পাষাণে হৃদয় বান্ধো কান্দো গিরিগণে কান্দো
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইল সকল ঠাঁই।
বিবিবেটা নিন্দে মগন ফকির ঘরত নাই।
হায়রে ভবানী পাঠক ভবে নাই।।

 ০৬. নিজের গ্রামে বর্গাচাষী

খিয়ারের খেতমজুর থেকে নিজের গ্রামে বর্গাচাষী হওয়ার হাউস মেটাতে তমিজকে শুনতে হয় মেলা কথা। তার নাই গোরু, নাই লাঙল জোয়াল মই; বীজচারা কেনার পয়সাও নাই, লোকে তাকে জমি দেয় কোন ভরসায়? তমিজ জোড়হাতে কারুবারু করে, এখন মণ্ডল তাকে এসব দিক, ধান উঠলে ফসলের ভাগাভাগি করে সব কিছুর দাম ধরে না হয় কেটে নেবে।

তা নেওয়া চলে, এতোকাল যে একেবারে চলে নি তাও নয়। কিন্তু শরাফত মণ্ডলের বড়ো বেটা আবদুল আজিজ বড়ো হুঁশিয়ার মানুষ। সে থাকে জয়পুরে, জয়পুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি, জমিজমার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, জমির মাপজোঁক থেকে শুরু করে খাজনা ট্যাকসের আঁটঘাট আর ফাঁকফোকর তার মতো জানে এমন মানুষ লাঠিডাঙার কাছারিতেও কেউ আছে কি-না সন্দেহ। গোরু, লাঙল, জোয়াল, মই, বীজ ধানের দামের আধাআধি সে আগাম দাবি করে। গোরু নাই, লাঙল নাই, তবু বর্গা করার সখ? ঠিক আছে, করো। কিন্তু শর্ত মেনে জমিতে নামো।

আবদুল কাদের বলে, এরা তো অনেক দিনের মানুষ। এর বাপও আমাদের বাড়িতে এক সময়–।

কিন্তু চাষাদের বাড়াবাড়ি সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে, টাউন হয়ে করতোয়া পেরিয়ে ঐ দাপাদাপি এই পুব এলাকায় আসতে আর কততক্ষণ? খিয়ার এলাকায় চাষারা ফসলের ভাগ চায় দুইভাগ, নিজেরা দুইভাগ নিয়ে জমির মালিকের গোলায় তুলে দিয়ে আসবে এক ভাগ। তা চাও; চাইতে তো আর ট্যাকসো লাগে না। কিন্তু একটা কথা,-জমি তো আর হেঁটে হেঁটে জোতদারের বাড়িতে এসে হাজির হয় না। একি কামারপাড়ার অর্জুনগাছের বক যে উড়াল দিয়ে বিল পেরিয়ে এসে বসলো মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছে? এক এক ছটাক জমি করতে মানুষের শরীরের এক এক পোয়া রক্ত নুন হয়ে বেরিয়ে যায়, সে খবর রাখো? জাহেল চাষার গো আবদুল আজিজ দেখে খিয়ার এলাকায়। সেই গোঁ এখানকার চাষার শরীরে চাগিয়ে উঠতে কতোক্ষণ? কাউকে খাতির। করার দরকার নাই, নিয়ম অনুসারে জমি বর্গা নাও। না পোষালে কেটে পড়ো।

আবদুল আজিজের এসব উদ্বেগ আর ভবিষ্যদ্বাণীর জবাব তমিজ দেবে কী করে? আবদুল কাদের যে আবদুল কাদের, যে কি-না ইংরেজিতে নিজের নাম এক টানে লেখে এম. এ. কাদের, সভাসমিতি করা মানুষ, সুযোগ পেলেই মানুষকে ধরে ধরে হিন্দুর জুলুমের কথা ফাঁস করে দেয়, সেই জুলুম থেকে বাঁচতে মুসলিম লীগের নিশানের নিচে সবাইকে জড়ো হতে বলে, সে পর্যন্ত খালি নাক খেটে আর মাথা চুলকায়। হাজার হলেও ভাইজান তার চাকরি করে জয়পুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে, ডান হাত বাম হাত দুটোই তার ভারী সচল। কয়েক দিনের জন্যে বাড়ি আসায় সকালে হাগার পর ছোচা ছাড়া বাম হাতের কাজকাম বন্ধ, সেই নিস্ক্রিয়তার শোধ সে তোলে জিভ আর টাকরার অবিরাম ব্যবহার করে।

পশ্চিমে ধান কাটতে গিয়ে আধিয়ারদের কাণ্ডকারখানা তো তমিজ দেখে এসেছে। নিজের চোখেই, এসব দাপাদাপি সে নিজেই কি আর পছন্দ করে? জমি হলো জোতদারের, ফসল কে কী পাবে সেটা তো থাকবে মালিকের এখতিয়ারে। অথচ ফসলের বেশিরভাগ দখল করতে আধিয়াররা নেমে পড়ে হাতিয়ার হাতে। তাদের ফন্দি ঠেকাতে এবার পাঁচবিবিতে কয়েকজন জোতদার ধান কাটতে জমিতে কামলা লাগিয়েছিলো নিজেরাই। পুব থেকে গিয়ে তমিজও এক জমিতে কাজ পেয়ে গেলো। জোতদার নাকি পুলিসের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছিলো। তা পুলিস যাবে আর কতত জায়গায়?-সেদিন ভালো মজুরির চুক্তিতে আপখোরাকি কাজে নেমেছিলো তমিজ। ধুমসে কাজ করছে, যত তাড়াতাড়ি পারে ধান কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু দুপুর হতে না হতে এতোগুলো মানুষের হৈ হৈ শুনে ভাগ্যিস সময়মতো দৌড় দিয়েছিলো। চাষাদের বৌঝিরা পর্যন্ত ঝাটা খুন্তি বঁটি নাকড়ি নিয়ে তাড়া করে। ধানখেতের ভেতর দিয়ে, কাটা ধানের আঁটি ডিঙিয়ে এবং কখনো সেগুলোর ওপর পা রেখে ছুটতে না পারলে ঝটা কি খুন্তির দুই একটা ঘা কি তমিজের গায়ে পড়তো না? কয়েকটা বাড়ি যে পড়ে নি তাই বা কে জানে বাপু? মেয়েমানুষের হাতে মার খেয়ে কেউ কি তা চাউর করে বেড়ায়? ওদের ঝাঁটার ঘা খেয়ে কিংবা কোনোভাবে এড়িয়ে জোতদারের উঠানে ওঠার আগে থেকেই আধিয়ারদের এরকম বাড়াবাড়ি তমিজের একেবারেই ভালো লাগে নি। জমি হলো লক্ষ্মী, লক্ষ্মীর বেটাবেটি হলো তার ফসল। সেই ফসল নিয়ে টানাটানি করলে জমির গায়ে লাগে না? ফসল হলো জমির মালিকের জানের জান। তাই নিয়ে টানাহ্যাচড়া করলে বেচারা বাচে কী করে? মাঝির বেটা বলে জমির বেদনা বুঝবে না বললে তমিজ খুব কষ্ট পায়। তার বাপ দাদা পরদাদা সব মাছ ধরে খেয়ে এসেছে, এটা ঠিক। তার জন্মের অনেক আগে নাকি পোড়াদহ মেলার সবচেয়ে বড়ো বাঘাড় মাছটা আসতো তার বাপের দাদা বাঘাড় মাঝির হাত দিয়ে। এই কারণে সম্মানসূচক মানুষটার নামটি তমিজের বাপ, অর্জন করে এবং এমন কি আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও তার আসল নামটি চাপা পড়ে যায়। পূর্বপুরুষের এই খ্যাতি ভোগ করেছে তমিজের বাপ অব্দি। তমিজের। জন্মের আগে পর্যন্ত তমিজের বাপকে সবাই চিনতো বাঘাড় মাঝির লাতি বলে, তার পরিচয় পাল্টে যায় তমিজের জন্মের পর। তবে তমিজকে সবাই চেনে তমিজ বলেই।

তা বাপু এই বংশের মানুষ তো এক কালে চাষবাসের কাজই করতো। বাঘাড় মাঝির বাপ বুধা মাঝির দাদা না পরদাদা না-কি তারও দাদা সোভান ধুমা। বিলের এপারে গিরিরডাঙার অর্ধেক, অর্ধেক না হলেও সিকি জমির জঙ্গল কেটে বসত করলো কে?–সোভান ধুমা ছাড়া আবার কে? করতোয়ার পশ্চিমে কোথায় খুব গোলমাল করে কাদের তাড়া খেয়ে সোভানের বাপ এখানে যখন আসে এই তল্লাট জুড়ে তখন খালি জঙ্গল আর জঙ্গল। সোভানের মা ছিলো চার জন, ভাইবোন পঁচিশ তিরিশ জনের কম নয়। এর মধ্যে প্রায় সবই বেটাছেলে। মাঝি হওয়ার আগে তাদের বংশে বেটি পয়দা হয়েছে কম। আরে, বিলের পশ্চিমে এতো বড়ো জঙ্গল কেটে চাষের জমি বার করা কি মেয়েছেলের কাম নাকি? জঙ্গলও জঙ্গল! জঙ্গল জুড়ে তখন বাঘ, ভালুক বুনো শুওর আর সাপ। প্রথম দিকে গাঁইগুঁই করলেও জানোয়ারগুলো তটস্থ থাকতো সোভান আর তার ভাইদের ভয়ে। শেষে এমন হলো যে, সোভানের গায়ের গন্ধ পেলে বাঘ পর্যন্ত আর পালাবার দিশা পায় না। ধরতে পারলে সোভান ধুমা বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চড়িয়ে। তাকে দিয়ে লাঙল টানায়।

তারপর কবে, সোভান ধুমার নাতি না তার নাতির বেটার আমলে একবার আসামে না রংপুরে না-কি দিল্লিতেই হবে, না বার্মায় কোথায় ভূমিকম্প হলে কোথাকার বড়ো এ গাঙের পানি সব এসে পড়লো পুবের যমুনায়। যমুনা তখন কী?-মানুষ শুনে হাসে, যমুনা তখন একটা রোগা খাল। তার ওই ছিপছিপে গতরে যমুনা কুলাতে পারে না, অতো পানি সে রাখে কোথায়? ক্রোশকে ক্রোশ-জমি আর বাঘ ভালুক শুওর আর সাপ আর মানুষ আর ঘরবাড়ি আর হাঁসমুরগি আর গোরুবাছুর সাবাড় করে সে কেবলি হাঁসফাঁস করে। যমুনার বদহজম হলে পানির ঘোলা স্রোতের অনেকটাই সে উগরে দিলো বাঙালি নদীতে। প্রবল স্রোতের দলছুট একটা ধারা বাঙালি থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লো এই কাৎলাহার বিলে। কাৎলাহার বিল তো তখন একটু জলা মাত্র, তার উত্তর সিথানে পাকুড়গাছে মুনসি আরস পেতে বসেছে সোভান ধুমার আমলেই, কিংবা তার বেটার সময়েও হতে পারে। মুনসি না থাকলে কাহারকে তখন আর পুছতো কে? মুনসি থাকায় পানি খুব টলটলে, গিরিরডাঙার জঙ্গল-কেটে বসত-করা মানুষ ঐ পানি খায়। কিন্তু ওই জলা কি আর বাঙালির দলছুট স্রোতের মতো পানি ওইটুকু গতরে রাখতে পারে? গিরিরডাঙা ড়ুবলো, কামারপাড়া বাদে নিজগিরিরডাঙা তখনো জঙ্গল, সেটাও ড়ুবলো। গিরিরডাঙার চাষের জমি আর গোরুবাছুর আর হাঁসমুরগি আর বৌবেটাবেটি নিয়ে মানুষকে ভেসে যেতে দেখে মুনসির আর সহ্য হলো না, পাকুড়গাছ থেকে সে তার জোড়া পা পঁচিশ তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ গজ বাড়িয়ে বিলের দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ে মারলো এক লাথি। সেখানে কতোদিন আগে জঙ্গল কেটে তৈরি চাষের জমি আর বাড়িঘর সব ভেঙে পড়লো, বানের পানি গলগল করে ঢুকে পড়লো পাড়-ভাঙা বিলের ভেতর। বাঙালি নদীর স্রোত দুটো ধারায় এসে পাকুড়গাছে কদমবুসি করে গাছের দুই ধার দিয়ে এসে মিশলো বিলের পানিতে। একটি ধারা মুছে গেছে অনেক দিন আগেই। পাকুড়গাছের পেছনে অনেকটা জায়গা সেই স্রোতের স্মৃতিতে এখনো নাকি ভিজে ভিজেই থাকে। মায়ের কাছে তমিজ গল্প শুনেছে, টাউনের রমেশ উকিল এখানে চাষবাসের জন্যে কাশবন ইজারা নিয়েছিলো। তমিজের বাপকে নাকি সে ওখানে লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলো তার ভাগ্নে টুনুবাবুর সঙ্গে। তখন রমেশ উকিলের কথায় তার বাপ কান দেয় তো পাকুড়তলার উত্তরে না হলেও তিন বিঘা জমির মালিক হয়। তাদের জায়গাজমি খেয়েই তো বিলের গতর এতো মোটা। ঐ বান না হলে আর মুনসি তাদের বাঁচাতে বিলের গায়ে লাথি না মারলে এইসব জমি তো তাদেরই থাকে। যাদের জমি খেয়ে মুনসির বিলের গতর বাড়ে, তাদের রেজেকের ব্যবস্থাও করে দেয় মুনসি নিজেই। তার লাথিতে মাটি ভেঙে পানিতে ড়ুবে গেলে লাঙল হারিয়ে যায় বিলের ভেতরে। মুনসির হুকুমে সেখান থেকে ভেসে ওঠে তৌড়া জাল, প্যালা জাল, এমন কি মস্ত বড়ো বেড় জাল পর্যন্ত।

মুনসির ইশারায় সোভান ধুমার বংশ হয়ে গেলো মাঝি। তা এখন বিল তো আবার খুঁজতে শুরু করেছে। আট বছর আগে বড়ো বানের পর পলি পড়ে বিল ছোটো হয়ে এসেছে। কতো কতো মাঝি কাঁধে জাল আর বৌদের কোলে-কাখে ছেলেমেয়েদের তুলে দিয়ে চলে গেলো পুবে যমুনার দিকে। আবার কেউ কেউ বিলে পানির ওপর পুরু সর-পড়া মাটিতে লাঙল ঢোকাবার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু নতুন জমি যা উঠবে সবই নাকি শরাফত মণ্ডলের, জমিদারকে টাকা দিয়ে গোটা বিল সে পত্তন নিয়েছে। কিন্তু তমিজের কেমন খটকা লাগে, বিলের নতুন জমিতে চাষবাস করার হক এখন কার?—বোবঝা, ভালো করে বুঝে দেখো। কিন্তু সে নিজেও হিসাবটা ভালো করে বুঝতে পারে না। জমির মালিক না হোক, জমিতে বর্গা তো করতে পারবে, না কী কও?-কিন্তু তার উত্তেজনা ও উদ্বেগ ও খানিকটা হাহাকারও বটে, সবটাই মিনতি হয়ে প্রকাশের জন্যে ছটফট করে, কিন্তু তাও.আর হয়ে ওঠে না। তবে তার হয়ে কথা বলে কাদের, ভাইজান, এই চ্যাংড়াক জমি দিলে ফসল মার যাবি না। চ্যাংড়াটা খাটতে পারে খুব। গরিব মাঝির বেটা, বেয়াদবি করার সাহস পাবি না।

সেটা আবদুল আজিজও আঁচ করতে পারে। মাঝিদের বেটা, তার ওপর গরিবের মধ্যেও গরিব। চাষ করতে শুরু করলেও ভালোভাবে চাষা হতে আরো দুই পুরুষ লাগবে। লাঙল হাতে নিতে না নিতে আরো কয়েকটা চাষার সঙ্গে জোট বাঁধার সময় কোথায় তার?—ঠিক আছে। কিন্তু আবদুল আজিজ একজন সরকারি কর্মচারী, তার বেতন আসে ডিস্ট্রিক্ট ট্রেজারি থেকে। তাকে চলতে হয় বৃটিশ রাজের তৈরী রুলস অনুসারে। বৃটিশ রাজ আর যাই করুক, তোমরা এটা বলো সেটা বলল, কিন্তু আইনের ফাকি তারা সহ্য করে না। বৃটিশ খেদাতে তোমরা উঠে পড়ে লেগেছো, দেশটা তোমাদের হাতে পড়লে এর হালটা কী হয় তখন দেখে নিও। তা এখনো আইনকানুন বলে কিছু আছে, চাষেরও নিয়ম আছে। এখন পর্যন্ত ফসল ভাগ হয় আধাআধি। পুঁজিও খাটাও তবে আধাআধি, এতোকাল তাই তো চলে আসছে। লাঙল গোরু নাই, ঠিক আছে ভাড়া বাবদ আধাআধি পয়সা দিয়ে বর্গা নাও।

আবদুল আজিজের কথা শেষ হলে আবদুল কাদের মুখ খোলে, ভাইজান, আধিয়ারের সাথে নগদ পয়সার কারবার কী চলে নাকি? ফসল উঠলে ওর ভাগ থেকে ক্যাটা নিলেই হবি। তমিজ পয়সা পায় কোথায়?

জগদীশ সাহার মোকাম এখান থেকে কয় দিনের রাস্তা? আজিজ পরামর্শ দেয়, হাঁটার কষ্ট হলে না হয় সাইকেলটা দে।

জগদীশ সাহার নাম মুনসির ইশারায় কি মাথার ওপর আমগাছের ডালপাতার আলোছায়ার কারসাজিতে তমিজের সামনে একটা ভাঙাচোরা গোরুর আদল পায়, গলায় বাঁধা দড়ির টানে সেটা কেবলি সামনের দিকে চলে। দড়ি-ধরা হাতের মালিককে দেখা যায় না, কিংবা দেখার সাহস তমিজের হয় না বলে ওটা রয়ে যায় তার চোখের আড়ালেই। তমিজের বাপের আসল গোরু তবু সেদিন বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলো, এখন এ বেটা ভূতুড়ে গোরুর সেই টানটাও নাই। এর খুরের লাথিতে নিজের টলোমলো করা পা সামলাতে তমিজের প্রাণপণ জোর খাটাতে হয়। তমিজের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি খানিকটা এসে বর্তায় কাদেরের ঠোঁটে, সেই তেজে তার জিভ বলকায়, হিন্দু জমিদার আর হিন্দু মহাজনের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই তো লীগের পাকিস্তানের লড়াই। হিন্দু মহাজন মুসলমান চাষার রক্ত চুষে শেষ করে ফেললো। আর আপনি এখন এই ছোঁড়াটাকে পাঠাবেন সেই মহাজনের বাড়ি? নাঃ। ওকে জমি বর্গা দিয়ে কাজ নাই। গলার ঝাঝ দ্বিগুণ করে তমিজকে সে নির্দেশ দেয়, তমিজ, তুই যা। জমি তোক দেওয়া যাবি না। মাঝির বেটা, যা, খালে বিলে মাছ ধরা খা। যা ভাগ।

আঃ। তোমরা কী শুরু করলা? বিলের প্রসঙ্গ ওঠায় শরাফত তাড়াতাড়ি করে কথা বলে। বিল থেকে সরিয়ে রাখার জন্যেই মাঝিদের সে জমি বর্গা দেওয়ায় আগ্রহী। ছেলেটা আবার সেই বিলের কথাই তুললো। ছেলেদের কথা কাটাকাটিতে লোকটা মাথা গলায় না। খানকা ঘরের একটু উঁচু বারান্দায় আধশোয়া হয়ে সে বসেছিলো ইজি চেয়ারের খয়েরি ও সবুজ ভোরা-কাটা ক্যানভাসে। কয়েক গজের মধ্যে আমগাছের নিচে হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আজিজ এবং বেঞ্চে বসে কথা বলে কাদের। শরাফত তাদের কথা ঠিকই শুনছিলো, তবে তার চোখ ছিলো বাড়ির সীমানা পেরিয়ে কাৎলাহার বিলের ওপারে নিজগিরিরডাঙার চাষাদের গ্রামের পেছনে বৃষ্টির পানিতে ছপছপ-করা জমির দিকে। বকের ঝাঁকের ফেলে-আসা অর্জুনগাছের কয়েক গজ পরেই কামারদের ছেড়ে-যাওয়া ভিটা চাষ করে দেড় বিঘা জমিতে এবার কলা লাগানো হয়েছে। এই গোটা এলাকার এতো জায়গা নিয়ে কলার আবাদ এই প্রথম করলো শরাফত মণ্ডলই। সারি সারি শবরি কলার গাছে কলাপাতা রঙ ভাদ্রের ঘোলা রোদে একটু ময়লা দেখালেও শরাফত একটুও দমে না। কারণ চশমা ছাড়াই কলাপাতার আসল রঙ সে দিব্যি দেখতে পায়। ওপারের রোদবৃষ্টি, গাছপালা, আলোছায়া, জমিজমা, মানুষজন, গোরুবাছুর সবই তার খুব চেনা। আজ এপারের বাসেন্দা হলে কী হয়, জন্ম তো তার ওপারেই, দলিল দস্তাবেজে তার সাকিন লেখা থাকে : গ্রাম—নিজগিরিরডাঙা। আবদুল আজিজ আজকাল সব দলিলে লিখতে শুরু করেছে : হাল সাকিন–গিরিরডাঙা। কালাহার বিল পুরষ্ট হতে শুরু হওয়ার অনেক আগেই শরিকদের সঙ্গে গোলমাল করে এপারে এসে ঘর তোলে শরাফতের বাপ। শরাফত তখন একেবারেই শিশু। সেবার কী যেন হলো, আল্লার ইচ্ছা বুঝতে পারে কে?-কালাহারে মাছ মরলো একেবারে ঝাঁক বেঁধে। গিরিরডাঙার মাঝিদের জালে কেবল মরা মাছই ওঠে, বিলের পচা মাছ খেয়ে মাঝিপাড়ায় কলেরা লাগলো। অভাবে পড়ে কয়েকজন মাঝি নিজেদের বাড়িঘর জমিজমা বেচে দিলে শরাফতের বাপ কিছু জমি কিনে এপারে চলে আসে। বাপের কি পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে কিংবা জমি বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে শরাফত যে এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলো তা কিন্তু নয়। বিলের ওপারে জমি তার কম নাই। খোদার রহমতে পূর্বপুরুষের গ্রামে সে কম জমি করে নি। মোষের দিঘির দক্ষিণে জমিটা তার বাপের আমলের, বাপের আমল থেকে জমিটা নিজেরাই চাষ। করেছে, বছর পাঁচেক হলো অর্ধেক দিয়েছে হুরমতুল্লাকে বর্গা করতে। মোষের দিঘির ধার ঘেঁষে সবটাই জমিদারের খাস জমি, পতিত হয়েই রয়েছে। উত্তরে হুরমতুল্লার ভিটা, ভিটার সঙ্গে লাগোয়া বিঘা তিনেক জমি হুরমতুল্লা এখনো হাতছাড়া করে নি। তার ভিটার দক্ষিণে ভবানীর মাঠ, প্রায় আধ ক্রোশ জায়গা খা খা পড়ে থাকে। ওপারের গাঁয়ের গোরু চরাবার জায়গা ওটা, জমিদার কাউকে পত্তন দেয় না। এর পরই মণ্ডলের এক দাগে ১২ বিঘা জমি, একটা জলা, তারপর ফের কামারপাড়ায় কেনা তার চার বিঘা জমি। বিলের দক্ষিণে সাত দাগে তার আটচল্লিশ বিঘা জমি, এর বেশিরভাগ বর্গা করে হামিদ সাকিদার। গিরিরডাঙায় তার জমি একেবারে কম নয়, কিন্তু সেগুলো বড়ো এলোমেলো। মাঝির জাত জমি আর গুছিয়ে করবে কী করে? এদিকে সস্তায় পেলে মণ্ডল জমি ছাড়ে না, তবে তার মনোযোগটা নিজগিরিরডাঙার জমির দিকেই বেশি। হামিদ সাকিদারের ওপর বেশ ভরসা করা যায়। ওপারের উত্তরের জমিও অর্ধেকটা নিজে লোক দিয়ে চাষ করার ব্যবস্থা আগের মতোই রেখে বাকিটা হুরমতুল্লাকে বর্গা দিলে ছেলেরা মোটেই সায় দেয় নি। তাদের কথা, হামিদ সাকিদারই করুক। কিন্তু শরাফতের হিসাব অন্যরকম, নিজের পূর্বপুরুষের গ্রামে প্রজা একটা বাড়লো। তা ছাড়া ভিটার কাছাকাছি বলে নিজের অল্প জমির সঙ্গে এই জমিটার যত্ন হুরমতুল্লা একটু বেশিই নেবে। আবার নিজের দূর সম্পর্কের আত্মীয় এই মানুষটাকে বশে রাখা যাবে। কিন্তু জমির বাকিটা হুরমতুল্লা এতো চাইলেও তাকে দিলো না কেন তা শরাফতুই জানে। তবে মোষের দিঘির উত্তরের জমি, পুবের জমি ও পশ্চিমের জমি পত্তন পেলে এটা হয়তো সে হুরমতকেই দেবে। মোষের দিঘির ঘেঁষা জমিগুলো নিয়ে গতবার পোড়াদহের মেলায় নায়েববাবুর সঙ্গে শরাফতের একটু আলাপও হয়েছিলো। আশাও পাওয়া গেছে। খাস জমি রাখার ব্যাপারে জমিদারবাবুর আগ্রহ নাকি দিন দিন কমে আসছে। ছেলেরা তার কলকাতা থেকে নড়তেই চায় না। কলকাতাতেই ব্যবসা করার নাম করে জমিদারি থেকে টাকা সরানো ছাড়া জমিদারিতে তাদের কোনো আগ্রহই নাই। নায়েববাবু বলে, বিষয় সম্পত্তিতে বাবুও উদাসীন হয়ে উঠেছে, এটাকে নায়েববাবু বৈরাগ্যই বলতে চায়। শুনে উত্তেজনা ও উৎসাহে শরাফত পায়ের গতি আর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। তবে মেলার ভেতর হাঁটতে হাঁটতে পায়ের তাল সে রাখে হুঁশিয়ার হয়েই। দুদিন পর পনেরো সেরি দুটো রুই মাছ আর হাতিবান্ধার তিন হাঁড়ি দৈ নিয়ে লাঠিডাঙার কাচারিতে নায়েববাবুর সঙ্গে দেখা করে খুব হুশিয়ার হয়ে মোষের দিঘি পত্তন নেওয়ার কথা তোলে। নায়েববাবুর হাবেভাবে বোঝা যায় কিছু খরচপাতি করলে ওটা পাওয়া যেতে পারে। পেলে দিঘির চারপাশ মিলে এক দাগে বিঘা বিশেক জমি শরাফতের দখলে আসে। জোত এরকম এক দাগে হলে হিসাব রাখতে সুবিধা, জমিতে গিয়ে চোখও জুড়ায়। ওদিকে দক্ষিণে অর্জুনগাছের একটু ওপাশে কামারপাড়ার অনেকটাই শরাফত কিনে ফেলেছে। কেবল দশরথ আর নারদ আর ওদিকে গৌরাঙ্গ আট বিঘা জমি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে। ওরা উঠে গেলেই ওখানে এক দাগে সতেরো বিঘা জমি হয়। আহা! তা হলে নিজের বাপের গ্রামের অর্ধেকের বেশির মালিক হতে পারে সে।এখন তার ছেলেরা যদি সামান্য এক মাঝির বেটাকে জমি বর্গা দেওয়া নিয়ে এতো তর্ক করে তো সম্পত্তি রাখতে পারবে এরা? ভাইয়ে ভাইয়ে তর্কাতর্কি মনোমালিন্যে পৌঁছুতে কতোক্ষণ? একেক দাগে বিঘার পর বিঘা জমির সম্ভাবনা আর ছেলেদের বিবাদের আশঙ্কা তাকে বঞ্চিত করছিলো ইজি চেয়ারের নিরঙ্কুশ আরাম। থেকে এবং একই সঙ্গে তাকে বাধ্য করছিলো চুপ করে থাকতে। নইলে তার সামনেই তার নিজের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আলোচনা কি ঝগড়াঝাটি তার সহ্য করার কথা নয়। কিছু না হোক, গোরু দুটোর মুখের সামনে খড়ের কুচির পরিমাণ কমে এসেছে। এবং কাঁঠালতলায় বাঁশের বাতায় ঘেরা মাটির চারিতে মাড়নুন মেশানো পানি থেকে বকনাটা বারবার মুখ তুলে নিচ্ছে, এসব ব্যাপারে রাখাল ছোঁড়াটাকে অন্তত বার কয়েক ধমক দিতোই। ধমকের কুচি লাগতো তার ছেলেদের গায়েও। কিন্তু শরাফত হঠাৎ করে এতোটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, ইজিচেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে সে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে, জবান যখন দেওয়া হছে, জমি তমিজকেই দেওয়া লাগে।

এই সিদ্ধান্ত শরাফত নিয়েছে ছেলেদের মুখের দিকে চেয়ে নয়। বড়ো ছেলেটা সুযোগ পেলেই আইন নিয়ে তড়পায়। বর্গাচাষাদের সঙ্গে এতে আইন তড়পালে চলে না। জোতজমি ঠিক রাখতে হলে, সম্পত্তি বাড়াতে হলে কখন কী করতে হয় তা আগে থেকেই কোথাও ঠিক করা থাকে না। আবদুল আজিজ রাগ করতেপারে; কিন্তু কয়েক বছরের সরকারি চাকরি তার রাগ পোষার ক্ষমতাকে অনেকটা নিংড়ে ফেলেছে। এই ছেলেকে সামাল দেওয়া শরাফতের কাছে ডালভাত। সে বরং কাদেরের একটা ভুলকে ভেঙে দিতে বেশি মনোযোগ দেয়, কাদের, শোনো, টাকা লগ্নি করা হলো জগদীশের পেশা, এই ব্যবসায় না গেলে ওর বাপের লগ্নি করা টাকাও তো উদ্ধার করবার পারতো না। এটাই হলো ব্যবসা, ব্যবসার ভালোমন্দ দেখলে চলে? তোমরা যদি কও, হিন্দু মহাজনের টাকা নেওয়া হবি না, তা হলে মানুষ যাবি কুটি? আজই জগদীশ টাকা লগ্নি করা বন্ধ করে তো কালই মেলা মানুষ না খায়া মরবি। কার্তিক মাসে মানুষের পেট তো চালায় জগদীশই।

তার সুদটা তোলে কীভাবে তাও তো জানেন।

ওটা ওর ব্যবসা। জানা শুন্যাই মানুষ টাকা লেয়। জগদীশের ধর্মেও তো সুদ খাওয়া পাপের কাম লয়।

আবদুল কাদেরের মৌন যে সম্মতির লক্ষণ নয় এটা জেনেও শরাফত মণ্ডল বিরক্ত হয় না। ছোটো ছেলের পাগলামিগুলোকে প্রশ্রয় দিতে তার ভালোই লাগে। বংশের এই ছেলেটাই বছর তিনেক কলেজে আসা যাওয়া করেছে। দুই চান্সে আই এ পাস করে বি এ পড়ার বায়না ধরেছিলো। কিন্তু তা হলে তাকে যেতে হয় রাজশাহী। রাজশাহী যাওয়া মানে মাসে মাসে টাকা গোনা তো আছেই, তা ছাড়া ছেলেকে নাগালের বাইরে। ছেড়ে দেওয়া হয়। যেভাবে সভাসমিতি শুরু করেছে দূরে পড়তে গেলে পড়াশোনা সে ছেড়েই দিতো। তবে এখন বাড়ির ভাত খেয়ে যতো খুশি সভা করে বেড়াক শরাফতের আপত্তি নাই। জেলার নেতারা গোলাবাড়ি এলে তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে, তাদের বাড়িতেও আসে। দিনকাল যা পড়ছে এসব ছাড়া আর গতি নাই। গোলাবাড়িতে কেরোসিনের দোকানটা দেওয়ার বুদ্ধি ওর মাথায় এলো; সে তো এইসব যোগাযোগের ফলেই। আবার গ্রামের গরিব ছোটোলোকদের খাতির করতেও ছেলেটা তার বেশ পটু। এটার দরকার কম নয়। আবদুল আজিজ বলুক আর নাই বলুক, শরাফত ঠিকই জানে, অবস্থা ওদিকে সুবিধার নয়। আইনকানুনের ধার বেশি ধারলে শেষে সবই ফসকে যাবে। শরাফতকে সবই বিবেচনা করতে হয়। কাদের তমিজকে কথা দিয়েছে, তাকে এতোদিন আশায় আশায় রেখে এখন ফিরিয়ে দিলে ছোঁড়াটা হয় কাৎলাহার বিলে মাছ, চুরি শুরু করবে, চুরি করতে করতেই একদিন বিলের হক দাবি করে বসবে। নইলে সে চলে যাবে খিয়ারে। খিয়ারের চাষাদের বেয়াদবি দেখতে দেখতে তারও মাথাটা বিগড়ে যাবে না কে বলতে পারে?

শরাফত বলে, বুলুর জমি এখন দেওয়ার দরকার নাই। তমিজ বরং বিলের ওপারে মমাষের দিঘির কাছে হুরমতুল্লার পাশের জমিটা বর্গা করুক। হুরমতুল্লার বাড়িতে মণ্ডলের গোরু লাঙল মই জোয়াল সব থাকবে, তমিজ সব ব্যবহার করবে। তবে যাই নিক, সব কিছুর দাম ধরে ফসলেই সে শোধ করবে ধান কাটার পর। তবে সেখানে কয়েক মাসের হিসাবে কিছু লাভ শরাফতকে দিতে হবে। মুসলমান বলে সুদ সে নেবে না, কিন্তু মুনাফা নিলে কাদের নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না।

সুদ নিতে মুসলমানের অসুবিধা আছে কি নাই, তা নিয়ে আবদুল কাদের মাথা ঘামায় না। সে তো আর মাদ্রাসায় পড়া কাঠমোল্লা নয়, রীতিমতো কলেজে পড়ে আই এ পাস করেছে, তার মধ্যে ওসব গোঁড়ামি থাকবে কেন? টাউনে মুসলিম লীগ অফিসে কি সিরইলে ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে কি ঝাউতলায় সাদেক উকিলের বৈঠকখানায় পাকিস্তানের আলাপ একবার শুরু হলে কতো নামাজের ওয়াক্ত কোন দিক দিয়ে চলে যায় কেউ খেয়াল করে না। আবদুল কাদেরের সহ্য হয় না হিন্দুদের জুলুম। এর সঙ্গে মুসলমানদের হারাম হালালের সম্পর্ক কী? কিন্তু এসব কথা সাদেক উকিল কি ইসমাইল হোসেনের মতো গুছিয়ে বলা কাদেরের সাধ্যের বাইরে।

তার আমতা আমতা কথা এবং আজিজের উসখুস-করা নীরবতা অগ্রাহ্য করে শরাফত বলে, তমিজ, ভালো জমিখান তোক দিলাম। বাপের আমল থ্যাকা ঐ জমি নিজেরা চাষ করিছি। উঁচা ভাঙা জমি, আমনের ফসল হবি ভালো। তার বাপের আমলে গোবর ছাড়া আর কোনো সার ছিলো না, গোবর ছাড়া অন্য সার দেওয়াকে তারা গণ্য করেছে শুনা বলে। তো তার দাদার আমলে ওই জমিতে একেক বিঘা জমিতে ধান উঠেছে ছয় মণ, সাড়ে ছয় মণ। বাপজান লিজে লাঙল ধরলে সাড়ে সাত মণ ধান না তুল্যা ছাড়ে নাই।

তাদের দাদার নিজের হাত লাঙল ধরার বিবরণ আবদুল আজিজ বা আবদুল কাদের উপভোগ করে না। আজিজ ছোটোখাটো হলেও সরকারি চাকরি করে, শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, মাত্র দুই পুরুষ আগে মাঠে নিজের হাতে লাঙল ধরার কথা শুনলে তারা ওর দিকে তাকাবে। আর তাদের মধ্যে যাদের বাপেরা এখনো ভোর হতে না হতে লাঙল ঠেলতে শুরু করে তারা তো এই নিয়ে আজিজকে পাকেপ্রকারে টিটকিরিই দেবে।

তবে বিরক্ত হবার সুযোগ কাদেরের কম। তমিজকে জমি বর্গা দেওয়ায় বাপের প্রতি সে গদগদচিত্ত। তমিজটা এখন তার বশেই থাকবে। গিরিরডাঙায় মাঝিদের দাপট এখনো কম নয়। মাঝিদের মধ্যে এই তমিজটাই গোলাবাড়ি গেলে একবার না একবার তার দোকানে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে, লীগের ছেলেদের কথাবার্তা মন দিয়ে শোনে। একে দিয়েই মাঝিপাড়াটা কাদের নিজের দিকে টানতে পারবে। আবার দলের নেতাদের সামনে সে দাখেল করতে পারবে তমিজকে, এরকম কর্মী এই এলাকায় আর পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া, এসব মাঝি আর চাষা আর কলুদের মধ্যে ভেদাভেদ রাখলে পাকিস্তানের ডাকে সাড়া দেবে কে? সেখানে তার দাদা পরদাদার লাঙল ধরার কথায় সংকোচ করার কী আছে? তবু হালুয়া চাষা দাদা সম্বন্ধে বাপের স্মৃতিচারণে সেও অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করে। বাপ যে তাদের আরো কততদূর নিয়ে যায়, বংশকে নামিয়ে আনে। কোন পর্যায়ে এই নিয়ে দুই ভাইই কাতর হয়ে পড়লে বাড়ির ভেতর থেকে শরাফতের দ্বিতীয় বিবির ক্যা গো, বেলা গেলো কোটে, এখনো তোমরা ড়ুব দিলা না, ভাত খাবা কখন গো?—এই তাগাদা এসে আবদুল আজিজ ও আবদুল কাদেরকে উদ্ধার করে।

০৭. সকালের পান্তা সব ঘাম হয়ে

মণ্ডল দুই বেটাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেলো, বেলা তখন অনেক। সকালের পান্তা সব ঘাম হয়ে, হাওয়া হয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তমিজের পেটটা চুপসে গেছে। কিন্তু হলে কী হয়, নিজগিরিরডাঙায় দুই বিঘা সাত শতাংশ জমিটা এক পাক ঘুরে আসার জন্যে চোপসানো পেটশুদ্ধ সারাটা শরীর তার ছটফট ছটফট করে। বিলের ধারে বিলের পাহারায় নিয়োজিবুলুর বেটাকে বলে তমিজ চেয়ে নেয় মণ্ডলের কোষা নৌকাটা।

পানিতে টান ধরেছে, দক্ষিণে বাড়ির কাছে মাছ আটকে রাখার ব্যবস্থাও করে রেখেছে মণ্ডল। বিলে এখন মাছ ধরার জুত। বিল তো এখন ভরা পোয়াতি, গর্ভে তার রুই কালা থেকে শুরু করে পাবদা ট্যাংরা, কৈ মাগুর শিঙি আর খলসে পুঁটি। বিলের ভেতর, অনেক ভেতরে কোথায় মাছ রান্না হচ্ছে, তার ধোঁয়ায় তমিজের চোখমুখ ঝাপসা। হয়ে আসে। অবশ্য মাথার ওপর রোদের ভ্যাপসা তেজও তার চোখ ঝাপসা ঠেকার কারণ হতে পারে। আকাশে এদিক-ওদিক ছড়ানো মেঘ, সূর্যের তাপে সেগুলো এখন শুকাচ্ছে বলে পানিতে ময়লা মেঘের নিংড়ানো ধোয়া। পানি এখন তাই ঘোলা। আশ্বিনে। পানি আরো সরে গেলে বিল সাফসুতরো হবে। তা ঘোলা হোক আর সাফ হোক, বিল তো মণ্ডলের দখলে। রুই কি কালার কয়েকটা বাচ্চা বৈঠায় দুষ্টুমি করে ঠোকর দিয়ে যায় : মণ্ডলের বর্গাচাষী হওয়ায় কালাহারের মাছেরা কি তমিজকে বিদায় জানিয়ে গেলো?

কোষাটা বিলের পুব তীরে ভেড়ার আগেই দ্যাখা যায়, অল্প দূরে জমির আলে নামাজ পড়ছে হুরমতুল্লা পরামাণিক। কোষা থেকে লাফিয়ে নেমে, সেটা একটু টেনে ডাঙায় রেখে তমিজ গিয়ে দাঁড়ালো তার জমির পাশে। বিলের ঢালের একটু ওপরে এক দাগে শরাফতের সাড়ে চার বিঘা জমি। এর মাঝামাঝি আল, আলটা একটু চওড়াই। আলের পশ্চিম ভাগটা বর্গা করে হুরমতুল্লা, পুবেরটা এখন থেকে করবে তমিজ। খানিকটা তফাতে উত্তরে মোষের দিঘি, মস্ত গোল দিঘির উত্তর পূর্ব কোণে দিঘি থেকে অন্তত পাঁচ ছয় বিঘা জমি পেরিয়ে হুরমতুল্লার বাড়ি, দিঘির খুব উঁচু পাড়ের জন্যে এখান থেকে সম্পূর্ণ দ্যাখা যায় না। চার পাশটা ভালো করে দেখে বহুবার দ্যাখা জায়গাটা। তমিজ জরিপ করে। না, মণ্ডল তাকে জমি দিয়েছে চমৎকার। সমান ডাঙা জমি, একেবারে খিয়ার এলাকার মতো। মাঝখানের আলটাও সমান। কুলগাছের নিচে সবুজ জমিতে গামছার ওপর বসে নামাজের শেষে হাত দুটো জোড়া লাগিয়ে হুরমতুল্লা এখন মোনাজাত করছে। মাঝিপাড়া জুম্মঘরে নামাজের পর কুদুস মৌলবি একদিন বয়ান করেছিলো, রফাদানিদের এটাও একটা দোষ, মোনাজাতের সময় হাত এক সাথে করে। তারা শয়তানকে বসার সুযোগ করে দেয়। জোড়াহাতের পেছনে এবং এলোমেলো ছড়ানো দাড়ির ভেতরে হুরমতুল্লার কালো ঠোঁটজোড়া বিড়বিড় করে। মোনাজাত শেষ হলে হাত নামাবার পরেও দোয়া পড়া তার থামে না, তবে তার গলা চড়লে তমিজ শোনে, হুরমতুল্লার লক্ষ এখন আল্লাতালা নয়, তমিজ নিজে। কী রকম?-ক্যা রে মাঝির ব্যাটা, মণ্ডল তালে জমি তোকই দিলো? মণ্ডলেক কয়া হামাকও এটি থ্যাকা বিদায় দে। মাঝির সাথে জমিত কাম করবার পারমু না বাপু!

এরপর শুরু হয় তার একটানা আক্ষেপ, কততদিন সে গোটা সাড়ে চার বিঘা জমিতে মণ্ডলের কামলা খাটলো। তার আগে এই জমিতে কামলা খেটেছে হুরমতুল্লার। ভাই। তারপর গত বছর পাঁচেক হলো জমির আর্ধেকটা বর্গা করছে হুরমতুল্লা। পুরো। জমিটাই তো সে চেয়েছিলো, তখন মণ্ডল গলা নিচু করে বলেছিলো, বুঝিস তো, বেটারা যতোই কোক, ব্যামাক জমি বর্গা দাও; হাজার হলেও হামি চাষার বেটা। লিজের হাতোত নাঙল ধরি না, আবার কামলাকিষাণ দিয়াও যদি এক আধটা জমি আবাদ না করি তো জমি ব্যাজার হবি। এই জমিটা হামারই থাক, তুই এটি আগের লাকান কামলা খাট। তা ছেলেদের সঙ্গে যখন পারলোই না তখন এটা হুরমতুল্লাকে বর্গা দিলে মণ্ডলের লোকসানটা কী হতো? আবদুল আজিজ তো তার হয়ে বাপকে বলতেও চেয়েছিলো, বললো কি-না কে জানে? তাকে বর্গা দিলে তার আগের বর্গার জমিটার পাট না হয় সে। একটু আগেই কাটতো। পরে গোটা জমি জুড়ে আমন করে দেখিয়ে দিতো আবাদ করা কাকে বলে! তার মুশকিল হলো, সে নিজেও চাষার ঘরের ছেলে, দুই পুরুষ আগেও শরাফতের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা পর্যন্ত ছিলো। সে তো আর চামার কি কামার কি কুমার কি কলু কি মাঝির ঘরে জন্ম নেয়নি যে জমি বর্গা নেওয়ার জন্যে মণ্ডলের ছেলেদের পায়ে ধরবে। মণ্ডলেক খালি একবার কছিলাম। তার ছোটো বেটা কয়, এই জমি দেওয়া লাগবি তমিজেক। কিসক?-না, মাঝির বেটা জমিত সোনা ফলাবার পারবি। হঠাৎ কাশতে শুরু করলে হুরমতুল্লার শেষ কয়েকটি কথায় আবদুল কাদেরের মুখ ভ্যাংচাবার চেষ্টা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সফল হয়।

জবাব না দিয়ে তমিজ হাঁটু মুড়ে বসে নিজের বর্গা জমির মাটি তুলে দ্যাখে। আউশ কাটা হয়েছে জমি চেঁছে, নাড়ার গোড়া যেন কালচে হলুদ চুলের কদমছাট হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে মাঠ জুড়ে। নাড়ার গোড়ায় হাত দিয়ে একটু ডলতে তার খড়খড়ে আঙুলে নরম ছোয়া লাগে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জমিতে আস্তে আস্তে হাঁটলে পায়ের নিচে বৃষ্টির পানিতে ভেজা মাটি ও নাড়ার ছপছপ বোল ওঠে। কাল খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে হুরমতুল্লার গোয়ালে রাখা মণ্ডলের জোড়া বলদ জোয়ালে জুতে লাঙল চালিয়ে দেবে এই নরম মাটিতে। মাঝির বেটা হলে কী হবে, তমিজ ঠিক বুঝে ফেলেছে, শরীরে লাঙলের ফলা লুফে নেওয়ার জন্যে জমি অস্থির হয়ে উঠেছে। জমিতে এটা কি বৃষ্টির পানি? চুতরের সামনে পানি ভাঙছে? প্রথম দিনেই যতোটা সম্ভব জায়গা জুড়ে চাষ দিয়ে জমির আশটা মেটানো চাই। পর দিন ফের চাষ দাও, তারপর পর দিন ফের চষো। সবটা জমিতে যতোবার পারে চাষ দিয়ে ফেলবে তমিজ। নাড়ার মোতাগুলো সব মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, মিশতে মিশতে মাটির রঙ নেবে। জমি। কাদাকাদা করে তাতে রুয়ে দেবে কচি কচি ধানের চারা। মণ্ডলের বাড়ির পালানে বুলু বীজতলা করে গেছে। আজকেও দেখে এসেছে তমিজ। কী শোভা! কলাপাতা রঙের একটা নতুন কাঁথা যেন পেতে দিচ্ছে, পেতেই দিচ্ছে। কে পেতে দেয় গো? কাঁথা পাততে উপুড় হয়েছে ঐ মানুষটা কে? একটু নিচের দিকে তাকানো মুখটি কুলসুমের বলে বুঝতে পারলে তার মাথাটা ঘুরে যায় এবং এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে। তার খিদে পেটে মোচড় দিতে থাকে নতুন করে। কিন্তু এসব কেবল কয়েক পলকের জন্যে। জমিতে লাঙল দিতে হবে;—একটা হাল, দুটো হাল, তিনটে হাল। জমির মাটি তুলতুলে নরম না হলে ধানের চারা কষ্ট পাবে। চারা বুনতে হবে একটু ফাঁক করে করে। তবেই না চারা বাড়বে, কলকল করে বাড়বে। চারা বাড়তে বাড়তে বাড়তে গাছ হবে, কাদায় পানিতে আরো বাড়বে। অগ্রহায়ণে পানি শুকায়, শুকনা জমিতে রসের খোঁজ করতে গাছ শিকড় নামায়, ওপরেও বাড়ে। কার্তিকে পানি না হলে এই জমিই খটখট করবে। তখন পানি সেঁচো রে, নিড়ানি দাও রে, গাছের গোড়ালি একটু আলগা করে দাও রে—এইসব খেদমত কোনো কালানুক্রমিক বা অন্য কোনোরকম বিন্যাসে না আসায় তমিজের মাথার উত্তেজনা কেবলি বাড়তে থাকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার। শিরশির করে, আবার সেখানে ফুরফুরে হাওয়াও একটু বয় বৈ কি! শিরশির-করা ফুরফুরে উত্তেজনায় শরাফত মণ্ডলের জমিকে নিজের জমি ভাববার সুখ ছিলো, এই প্রথম সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে আবাদ করার উদ্বেগ ছিলো, আর ছিলো আবদুল কাদেরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, সেটা চড়ে গিয়েছিলো আনুগত্যে। এই অবস্থায় ছটফট করতে করতে তাকে একবার বসে পড়তে হয়েছে হুরমতুল্লার পাশে, তার হুঁকা নিয়ে লম্বা লম্বা টান দিলে খালি পেটে ধোয়া ঢোকে, খিদেটাকে বেশ ভোতা করা যায়। তার হাতে হুঁকা। রেখে হুরমতুল্লা ফের পাট কাটে। বুড়া পাট কাটে একা একা। প্রথমে আড়চোখে, পরে ভরা চোখে এবং আরো পরে শুধু তার দিকে দেখতে দেখতে তমিজ উঁকায় টান দিতে ভুলে যায়।—বুড়া হোক আর হিংসুটে হোক, মানুষটা খাটতে পারে বটে। এই চড়া। বেলায়, এইতো দিঘির ওপারে বাড়ি, তবু বাড়িতে গিয়ে কথায় পিঠটা ঠেকায়নি একবারও। একটা কামলা নেয়নি। বেশির ভাগ পাট সে একলাই কেটে ফেলেছে। বুড়া কি একাই সব করে? জিন পোষে নাকি?

জিনের কথা তার সম্বন্ধে শোনা যায় না। তবে বদনাম আছে অন্যরকম। কামলা রাখলেও মোটা কাজগুলো সারা হলেই কামলাপাট বিদায় দিয়ে জমিতে সে খাটায় তার মেয়েদের। হুরমতুল্লার মেয়ে তিন জন। বড়োটার বিয়ে হয়েছিলো, স্বামীর ভাত খায় না দুই বছরের ওপর। বাপের বাড়িতেই পড়ে আছে। তার পরেরটাও বিয়ের বয়েসি, ছোটোটা বোধহয় একেবারেই ছোটো। দুটো বিয়ে করেও হুরমতের ছেলের ভাগ্য হয়নি। আকালের সময় দুই নম্বর বৌকে সে পাঠিয়ে দিয়েছিলো বাপের বাড়ি, আকালেই সেটা মরে গেছে। তা ছেলে না হোক, লোকে বলে, মেয়েরাই তার একেকটা মদ্দা মানুষের মতো। নিজেদের ভিটার জমিতে সব কাম তো করেই, দিঘির দক্ষিণে এই বর্গা জমিতেও বাপের কামলাগিরি করে তারাই। বাপের সাথে সাথে তারা থাকে। এই যে পাট কাটছে বুড়া, কাটা পাটগাছ দাঁড় করিয়ে সাজিয়ে রাখার পটুত্ব তাদের কোনো কামলার চেয়ে কম নয়। তমিজ অনুমান করে, দুটো মেয়ে তার সঙ্গেই কাজ করছিলো, তমিজকে দেখে বাড়ির দিকে চলে গেছে। হুরমতুল্লা হঠাৎ করে ডাকে, মাঝির বেটা, একটু আসো তো। বস্যাই তো আছো, ধরো।

কাটা পাটগাছগুলো তমিজ ধরলে সদ্য-ফাঁকা-হওয়া জায়গায় সেগুলো দাঁড় করিয়ে রাখতে হুরমতুল্লার সুবিধা হয়। বুড়ার পাট হয়েছে ভারি সুন্দর। অতি চমৎকার। একটু দেরিতেই কাটলো, কিন্তু পাট নষ্ট হয়নি। গাছ একেকটা পুরুষ্টু কী! পাকা ছাল ছুঁড়ে আঁশের সোনালি আভা উঁকি দিচ্ছে এখন থেকেই। তমিজের মুগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে হুরমতুল্লা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, পাট তো আল্লা দিলে ভালোই হছে। লাভ কী? সোগলি বুঝি মণ্ডলের বাড়িতই ভোলা লাগে গো। পাঁচ বছর তার জমি বর্গা করি, খন্দ উঠলে হামার ঘরত যা তুলি কামলা দিলেও মনে হয় ততোকোনাই তুলতাম। কখন ধান করজ করি, কিবা কিবা হিসাব কয়, ফসল হামি কিছুই পাই না।

তমিজ বলে, তুমি আঁটিটা ধরো, আমি বাড়িত যাই।

আর এক ঘড়ি বাপু! এই কয়টা কোষ্টা কাটা হলেই আজ উঠমু।

না গো। যাই। হামার খিদা নাগিছে। তমিজ আল পেরিয়ে নিজের জমিতে উঠে দাঁড়ায়। এই বুড়া তো ভারি বজ্জাত। মণ্ডলের জমি বর্গা করে, ওর বাপের ভাগ্যি। কার্তিক মাসে মঙার সময় মণ্ডল ধান করজ না দিলে বুড়াকে তো যেতে হয় জগদীশ সাহার মোকামে। হিন্দু মহাজন যে ওর কী সর্বনাশ করতো সেটা সে এখনো টের পায়নি। জমির মালিককে তার ভাগের ফসল দিতে বুড়ার বুক টনটন করে। নিমকহারাম! নিমকহারাম! কথাটা কাদেরের কানে তোলা দরকার। না, কাদের মানুষটা নরম, তাকে দিয়ে কাজ হবে না। মণ্ডলকে সব খুলে বললে এখানে হুরমতুল্লাকে মণ্ডল জমিই দেবে না। হুরমতুল্লাকে উচ্ছেদ করতে হলে মণ্ডলকে চেতিয়ে দেওয়া দরকার। কাদেরকে লাগাবে এর পর। ওকে ধরে তমিজ এই জমিটা বর্গা পায় তো আল উঠিয়ে এক সঙ্গে সাড়ে চার বিঘা জমিতে সে মনের সুখে আবাদ করতে পারে। নিমকহারাম বুড়া হুরমতুল্লার বেইমানি তমিজের আর সহ্য হয় না।

কিন্তু শরাফত মণ্ডল কি তার কোনো ছেলের কানে তমিজ কথাটা আর তুলতে পারে। সময় কোথায় তার? সূর্য ওঠার অনেকটা আগে অন্ধকার থাকতেই লাঙল গোরু জোয়াল নিতে তমিজকে যেতে হয় হুরমতুল্লার বাড়ি। প্রায় রোজই ঐ সময়টাতে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ে। মাথাল মাথায় মোষের দিঘির উত্তরে যখন সে পেঁৗছয় বৃষ্টি তখনো পড়তেই থাকে। এর মধ্যে একবার ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে যায় তো ভালো, এর মানে বৃষ্টির পর বিকাল পর্যন্ত আসমান সাফ থাকবে। যতো তাড়াতাড়িই করুক, হুরমতের বাড়ি গিয়ে তমিজ তাকে একদিনও দেখতে পায় না। তমিজ পৌঁছুবার অনেক আগেই বুড়া জমিতে গিয়ে হাজির। তমিজ লাঙল গোরু নিয়ে জমিতে পৌঁছতেই বুড়ার বড়ো মেয়েটা মুখের ওপর লম্বা ঘোমটা টেনে দৌড় দেয় বাড়ির দিকে। তখন হয়তো বেলা কেবল উঠছে। বৃষ্টির মধ্যে কাশতে কাশতে পাট কাটতে দেখে তমিজের মেজাজটা খিচড়ে যায়, বাপবেটির চোখে এদের নিন্দ নাই নাকি? বুড়ার বেটির তাকে দেখে ওভাবে পালাবার দরকার কী?

পাট কাটা কি পাটের গাছ গোছাবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে হুরমতুল্লা কখনো কখনো হুঁকাটা হাতে নিয়ে চলে আসে তমিজের জমিতে। তমিজ হঠাৎ করে তার কথা শুনতে পায়, এ মাঝির বেটা, ইংকা করা নাঙল ধরলে মাটির মদ্যে ঠেলতে কষ্ট হয় গো। গোরু ক্যাংকা হাপস্যা যাচ্ছে দ্যাখো না? বলতে বলতে হুরমতুল্লা তার হাত থেকে লাঙল নিয়ে ভিজে মাটিতে লাঙল চষার যথাযথ কায়দাটি দেখিয়ে দেয়।

তা এই কয়েক দিনে তমিজ জমিটাকে একেবারে মাখনের মতো করে ফেলেছে। সকালবেলার দিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি প্রায় পড়েই না। বিকালের দিকে আলের ওপর বসে দুই হাতে কাদা ছানতে ছানতে বৃষ্টির গন্ধে, কাদার গন্ধে, একটুখানি আভাস-দিয়ে-যাওয়া রোদের গন্ধে এবং হাতের সঞ্চালনে তমিজের ঘুম ঘুম পায়, এই সময় জমিতে একেবারে উপুড় হয়ে শোবার তাগিদে তার সারা শরীর এলিয়ে এলিয়ে পড়ে। হয়তো সত্যি সত্যি সে শুয়েই পড়তো, কিন্তু বেছে বেছে ঐ মুহূর্তেই শালার বুড়ার বেটা চিৎকার করে বলে, ক্যা রে মাঝির বেটা, মাটি কি মাগীমানষের দুধ? ওংকা করা টিপিচ্ছো কিসক?—এই ধমকে তমিজের চোখের সামনে জমি যেন উদাম মেয়েমানুষ হয়ে শুয়ে থাকে। শুধু স্তন নয়, তার গোটা গতরে সাঁতার কাটার জন্যে তার নিজের শরীরেই ভয়ানক কোলাহল শুরু হয়। হুরমতুল্লার ওপর রাগ করার সুযোগও তার হয় না। আবার তার শরীরের কোলাহল চাপা পড়ে হুরমতুল্লার উপদেশে, হাত দিয়া মাটি ছানা হয় না। জমি চায় নাঙলের ফলা, বুঝলু জমি হলো শালার মাগীমানুষের অধম, শালী বড়ো লটিমাগী রে, ছিনালের একশ্যাষ। নাঙলের চোদন না খালে মাগীর সুখ হয় না। হাত দিয়া তুই উগলান কী করিস?

বলতে বলতে হুরমতুল্লা গম্ভীর হয়ে যায় এবং কাশির দমক অগ্রাহ্য করে সে জানায়, হাত দিয়ে ছানলে রোদ একটু চড়া হলেই মাটি শক্ত হয়ে যায়। ভেতরে শক্ত হলে সেই মাটিতে ধানের চারা আরাম পায় না।

জমির বুক থেকে হাত প্রত্যাহার করে নিয়ে তমিজ উঠে দাঁড়ায়। হুরমত কাশতে কাশতে দলা দলা থুথু ফেলে এবং এর ফাঁকে ফাঁকে বকেই চলে, মাঝির বেটা জমির খেদমত করবে কী করে? এ কী জাল ফেললো আর ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ উঠলো? মাছের প্রতি তারা যেমন নিষ্ঠুর, জমিও তাদের কাছে শুধু ভোগের বস্তু ছাড়া আর কী? চাষার ঘরে না জন্মালে কি আর জমির দরদ বোঝা যায়? আরে হুরমতুল্লা তো পুরুষমানুষ, তার বেটিরা পর্যন্ত জমির যে তদারকি করতে পারে, নতুন চাষা হওয়ার হাউস-করা মাঝি কি তার ধারে কাছেও যেতে পারবে?—মেয়েছেলের সাথে এরকম তুলনায় তমিজের গা জ্বলে যায়। একটু আগে তার দুই বিঘা সাত শতাংশ জমি জুড়ে উদাস হয়ে শুয়েছিলো যে লম্বা চওড়া মেয়েমানুষ সে হারিয়ে যায় জমির ভেতরে, তাকে আর দ্যাখা যায় না।

এই হুরমতুল্লাকে সহ্য করা দিনদিন তমিজের অসহ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু কিছু বলাও মুশকিল। চাষবাসের সবই সে জানে খুব ভালো। তাকে দেখে সরে-যাওয়া বুড়ার বেটির কাজের যে নমুনা সে দ্যাখে তাও একেবারে নিখুঁত। বাপবেটির কাজে মুগ্ধ চোখজোড়া তমিজ কখনোই সরাসরি ফেলতে পারে না বুড়ার চোখে। কিন্তু পাট কাটুক আর কাটা পাটের গোছা সরাতে থাকুক আর কাশতে কাশতে মাঝির গুষ্টি উদ্ধার করুক, বুড়ার ঘোলাটে চোখজোড়ার একটা সবসময় নিয়োগ করা থাকে তমিজের দিকে।

 ০৮. বাড়িতে তমিজের বাপ

বাড়িতে তমিজের বাপ বেটার দিকে মোটে তাকায় না। প্রতিদিন ঘরে ফিরে তমিজ দ্যাখে অন্ধকারে মাচার ওপর শুয়ে ভোঁসভেস করে ঘুমাচ্ছে তার বাপ। আর ঐ ঘরের ভেতরের ছোটো বারান্দায় চুলার সামনে বসে আগুনের আভায় ও ধোঁয়ায় এবং আগুন ও ধোঁয়ার ছায়ায় মুখে অন্যরকম চেহারা করে আগুনের ওপরকার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কুলসুম। খিয়ারের চাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার যখন তখন ভাত রাধার আর খান্ত হবে না। তমিজের বাপের ভাত খাবার কোনো সময় অসময় নাই। দুই বছর আগে আকালের সময় খুদও জুটতো না, না খেয়ে থাকাটা তখন বেশ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। আর এখন খিয়ার থেকে চাল নিয়ে ফিরলে লোকটার খাবার কোনো আগামাথা থাকে না। বিকলাবেলা হয়তো ঘুমিয়েছে ভর পেট খেয়ে, অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাচা থেকে নেমে হাঁড়ি হাতড়ায়। আর সেদিন পেট খারাপ হলো, সেরে ওঠার পর তার খাওয়া বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। পারিমাণে তমিজ যতোই খাক, তার খাবার একটা সিজিলমিছিল আছে। সকালে পান্তা খেয়ে মাঠে যাবার সময় ভাত বেধে নিয়ে যায়। রাতে ফিরে সে একবারই ভাত খায়। খেতে বসার আগে ডোবায় কয়েকটা ড়ুব দিয়ে এলেও হাতে হোক, পায়ে হোক, কানের লতিতে কি ঘাড়ের খাজে হোক, কোথাও না কোথাও একটুখানি কাদা তার লেগেই থাকে। কুলসুম মহা উৎসাহে সেদিকে আঙুল দিয়ে দ্যাখালে তার সমস্ত উদ্দীপনা নস্যাৎ করে দিয়ে বাপের দিকে চোখ নাচিয়ে তমিজ জিগ্যেস করে, তামান দিন ঘরের মদ্যেই আছিলো?

কুলসুম কখনোই এই প্রশ্নের জবাব দেয় না। স্বামীর সারাদিন শুয়ে-থাকা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ফের আরেক দফা তার বিবরণ দিতে গেলে তার হাই উঠতে পারে। সন্ধ্যাবেলা হাই তুলতে তার ভালো লাগে না। কিংবা একটু তফাত থেকে তমিজের কানের লতি কি ঘাড়ের খাজ কিংবা হাত কি পায়ে লেগে থাকা কাদার গন্ধ চুরি করতে নিয়োজিত থাকায় স্বামীর প্রসঙ্গটি কুলসুম এড়িয়ে যায়। সে জিগ্যেস করে, হাল দেওয়া শ্যাষ হলো? কিংবা আর কয়টা হাল দেওয়া লাগবি?

গোগ্রাসে ভাত গিলে হাত ধুয়ে নিজের ঘরের ভেতরের বারান্দায় দরজার চৌকাঠে–হুকা হাতে বসে তমিজ ধীরেসুস্থে জবাব দেয় কুলসুমের কথার, এখনি? আরে লিজে জমি বর্গা করলে মেলা খাটনি গো! ইটা তো তোমার মানষের জমিত কামলা খাটা লয় যে চুক্তিমতোন দুটা হাল দিলাম আর ধানের বিছন রুয়া দিলাম। বলে আমন ধানের খন্দ, খাটো তো ফসল উঠবি বুনা ধানের দেড়া, না খাটলে ফক্কা, হুঁকায় টান দিতে দিতে সে জানায়, জমি খেদমত চায়, খেদমত না পেলে জমি অসন্তুষ্ট হয়। জমি হলো ছিনাল মাগীমানুষের লাকান—। বলতে বলতে সে মুখ সামলায়, হুরমতুল্লার কথা সে বলতে বসেছে কোথায়?—একটু থেমে হয়তো হুরমতুল্লাকে অনুসরণ করার সাফল্যের খুশিতেই একটি উপমা বেরিয়ে আসে তার নিজের মাথা থেকেই, অসন্তুষ্ট জমি হলো কিপটার একশেষ। শালার জগদীশ সাহার চায়াও কিপটা। কৃপণতায় মানুষের সঙ্গে . জমির তুলনা শুনে কুলসুম হেসে গড়িয়ে পড়ে। তমিজের এই উপমা কি তার হাসির কারণ, না-কি তার হাসির অছিলা তা না বোঝে তমিজ, না বোঝে সে নিজে। কুলসুমের হাসিতে তমিজের উৎসাহ বাড়ে। সে ঘোষণা করে, এবার জমির যে সেবাটা সে করছে তাতে ঐ শালা হুরমতুল্লার মুখটা আন্ধার না করে ছাড়বে না। অনেক ধান পাবার সম্ভাবনায় হতে পারে, হুরমতুল্লার মন্ধকার মুখ দ্যাখার আশায় হতে পারে, আবার কুপির শিখার কালচে হলুদ আঁচেও হতে পারে, তমিজের কালো মুখে বেগুনি রঙের আভা ফুটতে দেখে কুলসুমের সারাটা শরীর শিরশির করে ওঠে। খুব ঝাপসা এই কাঁপনকে কথায় গড়িয়ে নিতে পারলে কুলসম শুনতো : তমিজের বাপের মুখেও এমনি ছায়া ছায়া, আভা কখনো কখনো ফুটে ওঠে। কখন? কখন গো?—সেই দিনক্ষণ খুঁজে বার করতে কুলসুম শো শো করে নিশ্বাস নিতে থাকে, গন্ধ শুকে এঁকে তমিজের এই চেহারায় তার বাপের ঠিক সময়ের আদলটা দেখতে পারবে। কয়েকটি বড়ো বড়ো নিশ্বাসেই পাওয়া গন্ধে কুলসুম সত্যি বুঝতে পারে, তমিজের বাপের মুখে হলুদ-বেগুনি ও কালো রঙের ঝাপটা টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার আগে আগে। না, সব দিন নয়, মাঝে মাঝে। কখন? কুলসুম আরো কয়েক বার গন্ধ নেয়। —হ্যা, মানুষটা যে রাতে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বাইরে যায়, সেই সব সন্ধ্যায় এই সব গাঢ় রঙের ঝাপটা লেগে মুখটা তার ঝাপসা হয়ে আসে।

তার বেটা তো খালি জমিতেই পড়ে থাকে, রাতেও তার ধানের ভাবনা। রাত্রির খোয়াব কি আর তাকে কখনো কবজা করতে পারে? তবু, তবু সাবধানের মার নাই। ঘুমের মধ্যে তমিজের বাইরে যাবার সম্ভাবনাটিকে বিনাশ করতে তমিজের কালো মুখের এই হলুদ-বেগুনি দাগ এক্ষুনি মুছে ফেলা চাই, হয়তো এই বিবেচনা থেকেই হুরমতের প্রসঙ্গটাই সে অব্যাহত রাখে, হুরমত তোমার কী করবি? বুড়া মানুষ, তাই তোমার কী লোকসান করবার পারে?

বুড়ার শয়তানির কথা শুনবা? শুনবা? হুরমতুল্লার আপত্তিকর স্বভাব প্রকাশের উত্তেজনায় ঠুকায় নতুন করে তামাক সাজানো স্থগিত রেখে তমিজ সোজা হয়ে বসে এবং হুরমতুল্লা চাষার রক্তের দাপটে তাকে কীভাবে হেলা করে, কাজ শেখাবার ছলে। পদে পদে তার ভুল ধরে, এইসব নালিশ করতে করতে গলা কেবলি ওপরে চড়ায়। বুড়া কয়, ও মাঝির বেটা, হামরা হলাম চাষার জাত, হামাগোরে ঘরের বিটিছোলও চাষবাসের কাম যা জানে তোরা জেবনভর নাঙল ঠেললেও তার এক কানিও শিখবার পারবু না।—এটা কি কোনো একটা কথা হলো? নিজের ঘরের বেটিদের বেআব্রু করতে তার এতোটুকু বাধে না, চাষার বংশের ফুটানি মারে সে কোন আক্কেলে? আবার এরা নাকি রফাদানি জামাতের মুসলমান? তমিজ ভোররাতে জমিতে পৌঁছলেও হুরমতের বড়ো মেয়েটাকে কাজ করতে দেখে। তাকে দেখে আস্তে করে সরে পড়ে। ঐরকম জোয়ান সোন্দরি মেয়েকে হুরমতুল্লা ঘরের বাইরে আনে, পরপুরুষরা তাদের গতর দেখে, আল্লা সহ্য করবে না এসব!

হুরমতুল্লার সুন্দরী মেয়েদের বেহায়াপনার গল্প তমিজ করে চলেছে, করেই চলেছে, কুলসুম কোনো সায়ই দেয় না। তমিজ হঠাৎ বুঝতে পারে, তার একটু কাছে ঘেঁষে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এই নিশ্বাস কথার বিকল্প হয়ে দাঁড়ালে তমিজকে চুপ করতে হয়, কল্কেতে তামাক সাজিয়ে সে হুঁকা টানতে শুরু করে। কিছু হারিয়ে গেলে কুলসুম মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গন্ধ শুকে শুকে যেমন করে খোজে,—তাই নিয়ে তমিজের বাপ তাকে কতোবার তাকে বকাবকি করে এবং তমিজ নিজেও ঠাট্টা করে আসছে কুলসুমের বিয়ের আগে থেকেই,—তেমনি করে এক হাত দূর থেকে তমিজের সর্বাঙ্গ খুঁকেতে শুকতে সে খোজেটা কী? কুলসুমের সজোর নিশ্বাসের আওয়াজে তমিজের বুক ধড়ফড় করে : কুলসুমের কী হারিয়ে গেছে? সেই জিনিস কি তার ঝাঁকড়াচুল মাথায় কি কাদা-লেগে-থাকা ঘাড়ের খাঁজে কি হাতের কনুইতে লুকানো রয়েছে যে বাপের বৌটা এমন পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করলো? সে কি কুলসুমের কিছু চুরি করেছে?—এই অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে সে কী চুরি করলো তাই ঠাহর করার উদ্বেগ মাথা চাড়া দিলে হুঁকার মালাটা সে হাত দিয়ে চেপে ধরে বেশি জোর দিয়ে এবং ঐ মালার ফুটোতে পুরু ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে এতোটাই সেঁটে চেপে ধরে যে তার চুমুর টানে ডাবার সব পানি কল্কের তামাকের আগুনের তাপে ধোয়া হয়ে তার পেট ও বুকের, এমন কি তলপেটের ফাঁকফোকর সব অন্ধকার করে ফেলে। তার প্রাণপণে হুঁকা টানার গুরগুর ধ্বনি এবং লসুমের গন্ধ শোকার জন্যে নিশ্বাসপ্রশ্বাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ চড়তে থাকে সমান মাত্রায়। এগুলোর মধ্যে সংঘাতের লক্ষণ নাই, আবার সময়ের সম্ভাবনাও নাই। তমিজ তাই কিছুক্ষণের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসেই থাকে। অকেজো হাতিয়ারের মতো কাটাকে সে রেখে দেয় দরজার পাশে বেড়ার সঙ্গে ঠেস দিয়ে। কাটা কাৎ হয়ে থাকে এবং সেটার গড়িয়ে পড়ার ভয় একটু থাকলেও তমিজ সেদিকে ফিরেও তাকায় না। সে দরজার ভেতরদিকে আরেকটু সরে বসে এবং মোটামুটি নিরাপদ দূরত্ব তৈরি হলে কয়েকবার কাশে, উঠানের দিকে থুথু ফেলে এবং একটা ঢেকুরও তোলে। ঢেকুরের সংক্ষিপ্ত ধাক্কায় জিভে তামাকের গন্ধ-মাথা একটু-আগে-গেলা ভাত, খেসারির ডাল, বেশি মরিচ দিয়ে রাধা খলসে মাছ-বেগুনের চচ্চড়ির স্বাদ একটুখানি পেয়েই তমিজের গায়ে বল আসে। নিজের ঘরে যাবার জন্যে সে উঠে দাঁড়ালে কুলসুম দুই কদম পিছে গিয়ে চড়া গলায় বলে, চাষার ঘরের বিটিছোল খন্দের তয়তদবির তোমার চায়া ভালোই করবি। হুরমতুল্লা পরামাণিক কথাটা অলেয্য কয় নাই। তোমার বাপও তো কাল ইংকা কথাই কচ্ছিলো। কয়, মাঝির বংশের বেটা জমির মদ্যে নাঙল ঢুকালে জালের সাথে নাঙলের আগামা জড়ায়া যায়। ওটি ফসল কুনোদিন ভালো হবি না। জালখানাও মাটির তলা থ্যাক্যা আর ওপরে ওঠে না। মাঝির বেটার তখন মাছ ধরারও শ্যাষ।

মা কুলসুমের প্রবল বেগে গন্ধ-শোঁকা ফেটে পড়লো এইসব কথার তোড়ে। তার সজোর নিশ্বাসপ্রশ্বাস থেকে অব্যাহতি পেয়ে তমিজ ফের চাঙা হয়ে ওঠে এবং সমান। তেজে চাঁচায়, তুমি কী বোঝো? ফকিরের ঘরের বিটি, মানষের ঘরত ঘরত ভিখ মাঙিছে, মানুষের গোয়ার পিছে ঘুরা ভাত চায়া খাছো, জমিজমার তুমি বোঝো কী? যাও যাও। তোমাক আর প্যাচাল পাড়া লাগবি না। উঠা বাজানেক ভাত দেও। বুড়া মানুষ, তার খিদা নাগে না? তোমার লজর খালি লিজের প্যাটের দিকে। ফকিরের বেটির ওংকা চোপা ভালো লয়।।

এইসব কথা যেন অন্য কোনো মানুষের হাতের চড় থাপ্পড় হয়ে তমিজকেই ঘা মারতে থাকে একটা একটা করে। যতোই ঘা খায়, তমিজের কথা ততোই বাড়ে। সেই রাত থাকতে বিল পেরিয়ে হুরমতুল্লার গোয়াল থেকে গোরু নেওয়ার সময় থেকেই তমিজের ঘোর লাগার শুরু, সারাটা দিন জমিতে লাঙল চষতে চুষতে তা আরো পুরুষ্টু হয়েছে। কুলসুমের গন্ধ শোঁকার ধাক্কায় ধাক্কায় তা চাপা পড়েছিল, এখন নিজের এই চড়া চড়া কথায় সেই ঘোর একেবারে কেটে গেলে তমিজের শরীর ভেঙে পড়ে অবসাদে। তার ঘুম পায়, খুব ঘুম পায়। ঘুমঘুম চোখে মাচার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শোনে, পাশের ঘর থেকে বাবার ঘর্ঘরে গলার ভাঙাচোরা কথা, শমশেরের ভিটার পুব ধারে ধানের বীজতলা করিছে। কাল বেনবেলা শমশেরের কাছে যাস। হামার সাথে অর কথা হছে। অর ধানের পুলের বরকত বেশি। শমসের লিজে হামাক কলো। পয়সাও কেমই লিবি না।

তমিজের বাপের ঘুম-ভাঙা গলার এইসব ছোটো ছোটো বাক্য মনোযোগ দিয়ে না শুনলে এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করা মুশকিল। তমিজের ঘুমে-ভারি মাথাতেও শমশেরের ভিটার বীজতলা কচি কলাপাতা রঙে ঢেউ খেলাতে লাগলো। এতে তার ঘুম নামে আরো কেঁপে।

কুলসুম এদিকে নিজের ঘরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত ঠেকিয়ে চিৎকার করে তমিজের কথার জবাব দেয়, হামি না হয় ফকিরের বেটি। তোমার বাপের জমিদারি আছে তো, আমি তাই জমি আর খন্দের বিত্তান্ত সবই শিখ্যা লেমো, না? তোমার মাও তো তামান দিন বলে মণ্ডলবাড়িতই পড়্যা থাকিচ্ছিলো। জোতদারের বাড়িত গতর খাটায়া তাই জমিজমার ব্যাক কথা শিখ্যা লিছিলো, না? ঐ বাড়িত কাম করা তাই খুব সুখে আছিলো, না? ওংকা সুখ আমি চাই না। ওংকা সুখের পাছাত হামি নাথি মারি।

তমিজের বাপ কিন্তু এর মধ্যেও শমশেরের বীজতলার কথা বলেই চলছিলো। ঘুমভাঙা ঘর্ঘর-করা পুরুষ কণ্ঠের সঙ্গে চড়া মাত্রার মেয়েলি গলা মিলে এমন আওয়াজ তৈরি হয় এবং কলাপাতা রঙের ঢেউতে তা এমনভাবে ঢেউ খেলায় যে তমিজের ঢুলুঢুলু চোখের ভেতরে ঢুকে পড়ে তাই তাকে গড়িয়ে দেয় আরো গভীর ঘুমের পরতে।

 ০৯. কুলসুমের গলার তেজে

কুলসুমের গলার তেজে বরং ঘুমের রেশটুকু কেটে যায় তমিজের বাপের। ঘুমিয়ে আর দিনমান শুয়ে ক্লান্ত শরীরে বৌকে ধমক দেওয়ার বলও সে পায় না। মেঝেতে বসে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালে তারার টিমটিমে আলোয় জবুথবু বাইরের উঠানটা একটু করে বাড়ে, কিন্তু তার নিজের জবুথবু ভাব আর কাটে না। সামনের ডোবাটাও মাথা গুঁজে দিয়েছে এই উঠানের ভেতর। ডডাবায় কি ডাঙা জেগে উঠলো? তমিজ কি ডোবা-ফুড়ে-ওঠা এই ডাঙাতেও একদিন লাঙল দেওয়ার নিয়ত করে নাকি? তখন তো এটা চলে যাবে মণ্ডলের দখলে। তমিজ কি তখনো মণ্ডলের বর্গাচাষী হয়েই জীবন কাটাবে? ওদিকে কালাহার বিলে এই যে রোজ রোজ জমি জেগে উঠছে, বিল হয়তো একদিন এই ডোবার মতোই আরেকটি ছোট্টো ডোবার মধ্যে গুটিসুটি হয়ে ধুকতে থাকবে।–তমিজের বাপ জানে, এসব আসলে শালা মণ্ডলের কারসাজি। মণ্ডল মনে হয় উত্তর সিথানের পাকুড়গাছ দখলের তালে আছে। তমিজের বাপের চোখ হঠাৎ করে খচখচ করে, সেখানে কি পড়লো বোঝা যায় না। খচখচ-করা চোখের বন্ধ দুই মণির। মাঝখানে ঠাঁই নেয় কালাহার বিল। ভাদ্রের ভরা বিলে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে,তাতে তার মাথার ভেতরটা চুলকায়। হতে পারে চোখ সাফ করে চোখের কাঁটা তার পৌঁছে গেছে মাথার ভেতরে। সেখানে টনটন করে : ভাদ্রের মেঘের উল্টা টানে কা ৎলাহারের সব পানি বুঝি মেঘ হয়ে হয়ে ওপরে উড়ে যাচ্ছে। উড়তে উড়তে, রাতভর উড়তে উড়তে বেলা উঠবে, সূর্যের তাপে মেঘ আগুন হয়ে জ্বলে ঝুলতে ঝুলতে শুষে নেবে বিলের শেষ জলবিন্দুটি। তারপর আসমান থেকে আগুনের গোলাগুলো দেখবে যে, পানিহারা বিলে শরাফত মণ্ডলের বর্গাচাষীরা হাল বাইছে।–মণ্ডল যদি পাকুড়গাছ পর্যন্ত লাঙল চালায় তো কী হবে? সবটাই মণ্ডলের দখলে গেলে মুনসির পোষা গজার মাছগুলো হয়তো নতুন-ওঠা মাটির তলায় কেঁচো হয়ে কিলবিল করবে। না-কি সেগুলোকে ভেড়ার আকার দিতে না পেরে মুনসি তাদের লোহার আংটা করে গড়িয়ে নিয়ে গেঁথে রাখবে। নিজের গলার শেকলে? অতো সোজা লয়!–চেরাগ আলি বলে গেছে, চেরাগ আলির রুহে ভর করে মুনসিই জানিয়ে গেছে, গজারগুলোকে কেউ উৎপাত করলে এই দুনিয়ার ভাত তার চিরকালের জন্যে উঠে যাবে। গজার মাছের ওপর জুলুম করা অতো সোজা নয়।-তমিজের বাপের সারা শরীরে রক্ত চলাচলের গতি বাড়ে, এই চলাচলের আওয়াজ সে শোনে এইভাবে:

মুনসির হুকুম দরিয়াতে গরজিলে।
কোম্পানি সিপাহি চোক্ষে দ্যাখে আজরাইলে–

কিন্তু ফকির নাই, মুনসির হুকুম আসবে কার মুখ দিয়ে? কতোদূরে কোন কোন গাঁও, কতো চর, কলোকায়েমি চর, কতো নতুন জেগে-ওঠা বিরান চর পেরিয়ে যমুনার সাত স্রোতের টানে টানে, ঊনপঞ্চাশ ঢেউয়ের তালে তালে চেরাগ আলির গান উছলে পড়ে বাঙালি নদীর পানিতে, সেখানে কয়েকটা ড়ুব দিয়ে উঠে মানুষের জোতজমি, জোতদারদের সাথে লাঠালাঠি করা বর্গাচাষাদের রক্তে পিছলা জমির আল পেরোতে পেরোতে মুনসির গান কমজোর হয়ে গড়িয়ে পড়ে কালাহার বিলে। বিলের পানিতে হাবুড়ুবু খেয়ে উঠে এই গিরিরডাঙায় আসতে আসতে গান ঝাপসা হয়ে পড়ে। বৃষ্টিভেজা তারার আলোয় তমিজের বাপের বাড়ির খুলিতে তার ছায়া পড়ে। এই ছায়া ছায়া আলোয় ঐ গান এসেছে কার গলায় সওয়ারি হয়ে ভালো করে খেয়াল করলে ছায়াটিকে পাকুড়তলার সাদা ঘোড়া বলে ঠাহর করা যায়। সারা অঙ্গে তার দুষমনের তীর বেঁধা, সওয়ারি নেওয়ার জন্যে অস্থির সাদা ঘোড়ার গায়ের তীরের ডগাগুলো তিরতির করে কাঁপে। অতো অতো তীরের মধ্যে মুনসি বসবে কোথায় তা ভালো করে বুঝতে না বুঝতে ঘোড়া ছুটতে শুরু করে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বাজিয়ে তোলে চেরাগ আলি ফকিরের গান :

চান্দ কোলে জাগে গগন পাশে বিবি নিন্দে মগন
খোয়াবে কান্দিলো বেটা না রাখে হদিস।
(ফকির) না রাখে হদিস।
(হায়রে) সিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাসের বালিস।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ঘোড়া করিলো কুর্নিশ।
(ফকির) ঘোড়ায় চড়ি বাহিরিলো নাহিকো উদ্দিশ।।

এখানে কে গান করে গো? ফকির চেরাগ আলি কি ফিরে এলো নাকি? বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলে তমিজের বাপ হয়তো বুঝতে পারতো, কিন্তু হাঁটু ভেঙে বসে দাড়িওয়ালা মুখটা হাঁটুর ওপর রেখে চোখ বন্ধ করে কান বন্ধ করে সে এক মনে গান শোনে :

চান্দ জাগে বাঁশঝাড়ে একটা একটা ডিম পাড়ে
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইলো সকল ঠাঁই।
উঁকি দিয়া চায়া দেখি ফকির ঘরত নাই।।

না গো, এ তো চেরাগ আলির গলা নয়। তার গলার স্বর তমিজের বাপের মতো এতো ভালো করে চেনে আর কে? গিরিরডাঙায় আসার পর চেরাগ আলির গান প্রায় সব সময় শুনতে সেই মানুষটা কে?-তমিজের বাপ ছাড়া আবার কে? আর থাকতো চেরাগ আলির নাতনি কুলসুম। তা কুলসুমের বয়স তখন কম। দাদার গান শুনে সে নিজেও গাইতো, কিন্তু এইসব গানের কথা বোঝার বয়স কি তখন তার হয়েছে? এখনি কি গানের ভেতরের কথা কিছু ধরতে পারে নাকি? কালাম মাঝির বাশঝাড়ের ছাপরা ঘরের ভেতর বসে গুনগুন করতে করতে মাটিতে দাগ কেটে কেটে লোকটা কতো মানুষের খোয়াবের তাবির বলতো তার আর লেখাজোকা নাই। খোয়াবের মানে খোঁজার ফাঁকে ফাকে কিংবা খোঁজার জন্যেই ফকির একটার পর একটা শোলোক গাইতো। আবার। গোলাবাড়ি হাটে দোতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে সে মানুষ জমাতো, মানুষজন জমা হলে শুরু হয়েছে তার স্বপ্নের বয়ান। তার রঙবেরঙের কাপড়ের তালি দেওয়া ঝোলা থেকে বার হতো হেঁড়াখোড় বই, সেই বইয়ের লেখা কি ফকির পড়তো, না-কি তার পাতায় পাতায় আঁকা চৌকো চৌকো সব রেখাগুলো শুনতো তা অবশ্য তমিজের বাপ জানে না। তবে ঐ দাগগুলো সে আঁকতো ঘরের জমিনে। দাগ কেটে কেটে সে মানুষের স্বপ্ন বুঝে ফেলতো। কতো মানুষের কতো কিসিমের খোয়াব!-গোয়াবে কেউ একটা গোরু দেখলো, গোরুটা মোটাতাজা হলে তার মানে এক রকম, আবার রোগা হলে মানে.. অন্য রকম। গোরু জবাই হতে দেখলে তাবির পাল্টে যাবে। স্বপ্নে কাউকে কুকুর তাড়া করেছিলো শুনে চেরাগ আলি হাসতো, লোকটার শত্রু জব্দ হবে। আবার শুধু কুকুর দেখা মানে কঠিন বিপদের আলামত। বাঙালি নদীর ওপারে কোনো এক গাঁয়ের এক জয়িফ বুড়া এক দিনের রাস্তা হেঁটে এসে উপুড় হয়ে পড়েছিলো চেরাগ আলির পায়ে। কী ব্যাপার?—না, সে নিজের বেটার বৌয়ের সঙ্গে জেনা করার স্বপ্ন দ্যাখে সপ্তাহে অন্তত একবার। হাজার তওবা করেও কুলকিনারা করতে না পেরে চেরাগ আলির কাছে ধন্না দেয়। তারপর ধরো কালাম মাঝির নামাজের জামাতে ইমামতি করার স্বপ্ন খুব জোরেসোরে রাষ্ট্র করা হয়েছিলো। কিন্তু কালামের অন্য অনেক খোয়াবের বৃত্তান্ত জানে। এক কালাম আর চেরাগ আলি। শরাফত মণ্ডলও গোলাবাড়ি হাটে একদিন চেরাগ। আলিকে আড়ালে ডেকে খুব গোপনে তার এক স্বপ্নের কথা বলেছিলো। তবে ফকির কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন কারো কাছে ফাঁস করে দেয়নি। বৈকুণ্ঠ তো প্রায় নিত্যি নতুন নতুন স্বপ্নের কথা শোনাতো। নিজের স্বপ্নের কথা শুধু বলেনি তমিজের বাপ। তবে তার আর দোষ কী?—আবোর মানুষ, রাতভর ঘুমের ভেতর যা দেখে আকাশ ফর্সা হলে তার কিছুই মনে থাকে না। গোলাবাড়ি হাটে বৈকুণ্ঠ ছোঁড়াটা প্রায়ই বলতো, তমিজের বাপ, তুমি কথা কও না কিসক? তুমি কী দেখিছো, কও তো? এমনিতে কথা বলতে গেলে তমিজের বাপের সব তালগোল পাকায়, স্বপ্নের কথা সে বলে কী করে? এই বৈকুণ্ঠই ফকিরের ঘরে একদিন চেপে ধরলো, তোমার আজ কওয়াই লাগবি তমিজের বাপ। তুমি বলে দরজার হুড়কা খুল্যা কোটে কোটে যাও? তোমাক ডাক দেয় কেটা, কও তো? কী স্বপন দেখ্যা তুমি বারাও? আজ তোমাক কওয়াই লাগবি।

তখন মাটিতে চৌকো চৌকো দাগ কেটে চেরাগ আলি খুঁজছিলো বৈকুণ্ঠের স্বপ্নের মানে, গুনগুন করে শোলোক বলা স্থগিত রেখে একেকবার বৈকুণ্ঠকে সে কী জিগ্যেস করে আর তাকে জবাব দেওয়ার ফাকে ফাকে বৈকুণ্ঠ খালি খোঁচায়, ক্যা গো, তমিজের বাপ, কল্যা না?

ভোতা চোখে তমিজের বাপ এদিক ওদিক দ্যাখে। অনেকক্ষণ স্থির তাকিয়ে থাকে ঘরের বাইরে। বাঁশঝাড়ের ওপারে বেগুনখেতের বেড়া ডিঙাবার চেষ্টা করে না পেরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাম মাঝির মাদি ছাগলটা। তমিজের বাপ ওর চোখে কী দ্যাখে? দেখতে দেখতে তার চোখ বুজে খুঁজে আসে। আগের রাতে দ্যাখা স্বপ্নটা মনে করতে সে কি কয়েক পলক ঘুমিয়ে নেবে নাকি? বৈকুণ্ঠের তাগাদায় শেষ পর্যন্ত তাকে মুখ খুলতেই হয়, কাল। বলে সে চুপ করে। কিছুক্ষণ পর স্বপ্নের ভেতর কথা বলার মতো বিড়বিড় করে, না, গো কাল লয়। ঊদিনকা! কিন্তু ঠিক কোন দিন সেটা উল্লেখ না করেই সে ফের বলে, বেনবেলা পান্তা খানু মরিচপোড়া দিয়া, না আঁইটা কলাও বুঝি আছিলো। না, কলা খাছি তার আগের দিন। কলা খাবার দিনটাও ঠিক মনে করার জন্যে সে ফের চুপ করে। কুলকিনারা না পেয়ে বৈকুণ্ঠের দিকে বোবা চোখে তাকালে বৈকুণ্ঠ হেসে ফেলে, কী হলো কও। তমিজের বাপ চমকে উঠে গড়গড় করে বলে, উদিনকা বেনবেলা খাপি জালখান লিয়া বিল গেনু। কয়টা ট্যাংরা পাওয়া গেলো, সাথে দুটা ছাতান আর একটা বেল্যা আছিলো। তমিজের বাপ থামলে তার এই সংক্ষিপ্ত স্বপ্লবয়ানে বৈকুণ্ঠ হতাশ হয়, দুর, ইটা তোমার স্বপন হবি কিসক? তুমি তো লিত্যি কালাহার বিলত যাচ্ছে। বিলত মাছ ধরো না তুমি?

শরাফত মণ্ডল তখনো বিল ইজারা নেয়নি। সুতরাং তমিজের বাপের এটা স্বপ্ন হতে যাবে কেন?

তা হলে ঐদিন রাতে সে দেখলো কী?—মাথা নিচু করে তমিজের বাপ মেঝেতে বসেই থাকে, তার তখন-পর্যন্ত-কালো দাড়ি আরো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে তার ঘুম পায়, ঘুম ঘুম চোখে তার স্বপ্নের লেশমাত্র নাই। তার কানে ঝাপসা হয়ে বাজে, চেরাগ আলির শোলোকের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে বৈকুণ্ঠ গিরি। বৈকুণ্ঠের মুখ ভরা মুড়ি, গানের তোড়ে তার সামনে মুড়ির গুড়ার কুয়াশা। চেরাগ আলির ঘরে আসার সময় কেঁচড় ভরে সে মুড়ি দিয়ে এসেছে। তার মুড়ি খাচ্ছে সবাই,—চেরাগ আলি, কুলসুম, এমন কি তমিজের বাপও। মুড়ি খেতে খেতে আর কথা বলতে বলতে গলা কাঠ হয়ে এলে বৈকুণ্ঠ কুলসুমকে ডাকে, এ কুলসুম, তোর হাতের আমটা দে।

খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে খাল পেরিয়ে গিয়ে বুলু মাঝির বাড়ির পালান থেকে আমটা কুড়িয়ে এনেছে কুলসুম। বৈকুণ্ঠের আবদেরে হুকুমে মুখটা কালো করে সে তার হাতে আম তুলে দেয়। আমের নিচের দিকটা দাঁতে কেটে বৈকুণ্ঠ চুষে চুষে খায় আর বলে, টক আম রে। টকের টক।

কুলসুম মুখ ঝামটা দেয়, হামি তোমাক সাধিছিনু? টক আম তোমাক খাবার কছে। কেটা?

তিয়াস লাগিছে রে ছুঁড়ি। এতোগুলা মুড়ি খালাম, জলতেষ্টা হবি না?

মুশকিল কি, চেরাগ আলির ঘরে বৈকুণ্ঠ জল খেতে পারে না। তার জাত তো আলাদা, পিপাসা পেলেও জাত বাঁচাতে তাকে জলতেষ্টা মেটাতে হয় আম খেয়ে।। এদের ঘরে বৈকুণ্ঠ বসতে পারে, মুড়ি খেতে পারে,-গুড় দিয়ে তো পারেই, এমন কি নুনতেল দিয়ে মাখালেও দোষ নাই। কিন্তু পারে না কেবল জল স্পর্শ করতে। জাতের দোষ হয়ে যাবে। কুলসুম আর একবার মুখ ঝামটা দিলে বৈকুণ্ঠ বলে, ভগবান জাত সিষ্টি করিছে, আমরা সিটা লষ্ট করবার পারি?

তোমার ভগবান মানষের ঘরত আম খাবার হুকুম দিছে, না? ভগবানের লালচ বেশি, পানি খাবার দিবি না, আমেত আপত্তি নাই।

উগলান কথা কওয়া হয় না, কওয়া হয় না। তোর আল্লা যা, হামার ভগবানও তাই। ফারাক খালি নামের। লয় গো ফকিরের বেটা?

আল্লা ও ভগবানের অভিন্ন সত্তা সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠের এই সিদ্ধান্তকে ঘাড় নেড়ে অনুমোদন জানাতে জানাতে চেরাগ আলি মেঝেতে আরো কয়েকটি দাগ কাটে এবং নতুন দাগের দিকে কয়েক মিনিট চুপ করে তাকিয়ে থেকে বৈকুণ্ঠকে জিগ্যেস করে, তুই খৈ খাওয়ার স্বপন দেখলু বেনবেলা বেলা ওঠার আগে?

হুঁ। তোমাক আর কী কই, বাবু বাড়ির দিকে ঘাটা ধরিছে আত তখন লওটা বাজে। না-কি দশটাই হবি? না গো, এগারোটার কম লয়। দোকান থেকে তার মনিবের বাড়ি যাবার সময় নির্ণয় করতেই সে অনেকটা সময় নেয়। তারপর তার খলসে মাছ দিয়ে এবং পরে তালের রস আর দুধ দিয়ে ভাত খাবার বিবরণ চলে অনেকক্ষণ ধরে। তারপর হরির নাম দিয়ে শোয়া এবং নিঝুম হাটে মুকুন্দ সাহার দোকানে তার দুই চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে না পারার কষ্ট সম্বন্ধে বলতেও তার উৎসাহের কোনো সীমা নাই। এসব খান্ত করে তারপর আসে তার স্বপ্নের প্রসঙ্গ। সকালে মুড়ি খেতে খেতে গত রাতে দেখা স্বপ্নের যে বিবরণ সে দিয়েছিলো এখন তার সঙ্গে যোগ করে মেলা খুচরা ঘটনা। এতে চেরাগ আলির কোনো বিকার নাই, বৈকুষ্ঠের নতুন নতুন সংযোজন শোনে আর মাটিতে তার দাগের সংখ্যা বাড়ে। এর মধ্যে বৈকুণ্ঠ জানায়, স্বপ্নে বৈকুণ্ঠ খৈ খেয়েছিলো মশারির ভেতরে বসে। চেরাগ আলি জানতে চায়, মনে করা কোস। মশারির মদ্যে খৈ খালৈ একরকম, ধারেত বস্যা খাস তো তার মাজেজা আলাদা। খোয়াব ঠিক মতো কবার না পারলে ফুল, খারাপ কলাম। যা দেখিছু ঠিক ঠিক বুঝা শুন্যা কবু।

চেরাগ আলির এরকম প্রশ্ন, মন্তব্য, হুঁশিয়ারি ও ধমকে উৎসাহিত হয়ে বৈকুণ্ঠ একটিমাত্র রাত্রের স্বপ্নের যে দীর্ঘ ও জটিল বিবরণ দেয় তাতে তমিজের বাপ একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু চোখের কোণে ও ঠোঁটের বিচিত্র বাঁকাচোরায় চেরাগ আলি ওর স্বপ্নের যে মাজেজা শোনায় তাতে সবাই বোঝে, খৈ খাবার স্বপ্নে বৈকুণ্ঠের ধনদৌলত রোজগারের যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিলো, একই স্বপ্নে মশারির ভেতর ঢুকে বৈকুণ্ঠ তার বিনাশ তো ঘটিয়েছেই, এমন কি বেশ সংকটেই পড়েছে। সর্বনাশের ইংগিত পেয়ে বৈকুণ্ঠ জোরে শব্দ করে টক আমের রস একেবারে শেষ বিন্দুটুকু চুষে খায়। তার নির্বিকার চেহারায় চেরাগ আলির লম্বা দাড়িওয়ালা মুখে মেঘ নামে। মশারির স্বপ্ন আসলে কবরের ইশারা,–কথাটা বলতে বাধোবাধে ঠেকছিলো চেরাগ আলির। এটা সে সরাসরি জানায় কেবল তমিজের বাপকে, তাও তিন দিন পর গোলাবাড়ি হাটে। ওখানেই বৈকুণ্ঠকে ডেকে ফকির শুধু বললো, বৈকুণ্ঠ তোর খোয়বের মাজেজা ভালো লয় রে! পাঁচ আনা পয়সা মুনসির নামে মানত দেওয়া লাগবি। শুনে বৈকুণ্ঠ হাসলে ফকির ধমক দেয়, হাসিস কিসক রে ছোঁড়া? পয়সা কয়টা দে। বড়ো ফাড়া আছে রে তোর!

পাঁচ আনা পয়সা কম নয়। বৈকুণ্ঠ বলে, পয়সা পাই কুটি? কলকাতাত বোমা। পড়িচ্ছে, সেই খবর রাখো? হামার বাবুর বলে ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠিচ্ছে, তার চোখোত নাই ঘুম। এখন হামাক পয়সা দিবি?

কলকাতায় বোমা পড়ার খবর এবং জাপানিদের অবধারিত বিজয়ের সম্ভাবনায় হাট জুড়ে সেদিন মহা উত্তেজনা, চেরাগ আলির রোজগারপাতি একেবারেই কম। বৈকুণ্ঠের কাছ থেকে একটা সিকি পেলেও সের খানেক চাল, বেগুন আর তেল নুন কেনা যায়। দরগায় গিয়ে মানত পরে দিলেও চলবে। চেরাগ আলি বলে, ছোঁড়া তুই হাসিস? মশারির স্বপন দেখা এখনো তুই হাসিস? দোতারায় টুংটাং তুলতে তুলতে সে খোয়াবে মশারি দেখার শোলোক গায়,

খোয়াবে দেখিল মুসা শয্যাতে মশারি।
শুনিয়া মজনু কান্দে আছাড়ি পিছাড়ি।।
হায় হায় নাহি মোর পুত্রের হায়াৎ।
কেমনে সহিব পুত্রবিয়োগ আঘাত।।
আজরাইলে তিন বোজ তিন রাত দিবে।
তওবা করা আসো বেটা দরগাশরিফে।।

এতোকাল পর ঘরের মেঝেতে বসে বাইরে তারার আলো-ফেলা আবছা আলোর দিকে দেখতে দেখতে তমিজের মাথামোটা মাথার ভেতরে একটানা ঢেউ ওঠে। ঢেউ ওঠে, ঢেউ পড়ে এবং অবিরাম এমনি হতে থাকলে তার চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে। মেঝেতে সানকিতে বেড়ে-রাখা ভাত ও খেসারির ডালের টান এড়িয়ে সে সটান শুয়ে পড়ে মাচার ওপরে, কুলসুমের গা ঘেঁষে শুতে না শুতে ঘুম নামলো তমিজের বাপের দুই চোখ ঝোঁপে।

তমিজের বাপের ঘুমের মধ্যে চেরাগ আলির গান কিছুমাত্র মিইয়ে যায় না, বরং ফুটতে থাকে আরো কলকল করে। ঐ শোলোক গাওয়া হয়েছিলো বৈকুণ্ঠকে লক্ষ করেই। দ্বিতীয়বার যখন গাওয়া হয় তখন বৈকুণ্ঠও গলা মেলালো তমিজের বাপের সঙ্গে। তার মনিবের ব্যবসার সম্ভাব্য লোকসান কিংবা জাপানিদের বোমা পড়ার ভয় ভুলে সে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলো আসন পেতে। তিন দিন আগে দেখা নিজের স্বপ্ন সে ভুলে গেছে কিংবা ঐ স্বপ্ন চলে গেছে তার নতুন কোনো স্বপ্নের আড়ালে। তমিজের বাপকে নতুন শোলোকটা বারবার গাইতে বললে তমিজের বাপ হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে যায়, বেশ জোর দিয়ে বলে, বৈকুণ্ঠ, পয়সা কয়টা দিয়া দে। স্বপন তোর ভালো লয় রে।

সে কথায় কান না দিয়ে বৈকুণ্ঠ জিগ্যেস করে ফকিরকে, গানটা লতুন শুনলাম। লতুন বান্দিছো? আগে তো শুনি নাই।

গান তো হামি বান্দি না বাবা, কতোবার না তোক কছি। ইগলান হামাগোরে মাদারির গান। ইগলান পাওনা গান। হামরা পাই নাই, হামরা কি আর পাওয়ার মানুষ ইগলান পাছে আগিলা জামানার মুরুব্বিরা। চেরাগ আলির কথার মাঝখানে বৈকুণ্ঠের দিকে তাকিয়ে প্যানপ্যান করে কুলসুম, পয়সাটা দ্যাও না? তোমার জানের মায়া নাই? চার আনাই তো পয়সা। দ্যাও না কিসক?

পয়সা দিলে তোক দিমু। উদিনকা তুই যা টক আম খিলালু, তার দাম শোধ করা লাগবি না? সুদে আসলে ধরলে তোক আধুলি একটা পুরাই দেওয়া লাগে রে।

বৈকুণ্ঠের এইসব ইয়ার্কি মারা কথায় কুলসুমের রাগ হয় না, তার ভয় করে। —মানুষটার কি জানের ভয়ডর কিছু নাই? কাছেই বসে সেদিন কুলসুমের চোখের সেই ভয় দেখছিলো তমিজের বাপ। সে কি আজকের কথা গো? অথচ দেখো, শালা গিরির বেটার জন্যে কুলসুমের সেই সেদিনকার উদ্বেগ এতোকাল পর তমিজের বাপের মাথায় কুটকুট করে কামড়ায়। এই পোকাটিকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই সে কাত হয়ে, শোয়, তার মাথা লাগে কুলসুমের বুকে। ঐ বুকে বৈকুণ্ঠের মশারির স্বপ্ন দেখায় তার জন্যে কতোকাল আগেকার উদ্বেগের ছিটেফোঁটা রেশ আছে কি-না, থাকলেও তমিজের বাপের কানে সেটা লাগে কি-না বোঝা মুশকিল। তবে তমিজের বাপের মাথায় ও ঘাড়ে, পাতলা চুলে ও ঘন দাড়িতে কাদার গন্ধে কুলসুমের স্তনজোড়া কেবলি ফুলতে থাকে। কিন্তু তমিজের বাপের মাথায় চেরাগ আলির শোলোক বাজে শিরশির করে, শোলোকের সঙ্গে বৈকুণ্ঠ গিরি গলা মেলাচ্ছে বলেই হয়তো তার মাথার ভেতরটা ভারি হয়ে গড়িয়ে পড়ে কুলসুমের বুক থেকে। সেখানে খট খট করে বাজে শরাফত মণ্ডলের কাঠের খড়মের আওয়াজ। এই আওয়াজে মুনসির মস্ত কালো জাল কি গুটিয়ে পড়ছে নাকি? মুনসি কি কিছুই খেয়াল করে না? পাকুড়গাছে বসে মুনসি এখন করেটা কী?—একবার দেখা দরকার। মুনসিকে এক নজর দেখতে বিলের দিকে যাবার জন্যে তমিজের বাপ মাচা থেকে নামে টলতে টলতে।

 ১০. ভাদ্র গেলো, আশ্বিন গেলো

ভাদ্র গেলো, আশ্বিন গেলো, কার্তিক আর যায় না। আমনের বাড় এবার ভালোই; কিন্তু মাটি একটু শুকনা, ধানের গোড়ার নিচে নিচে মাটিতে চিকন চিকন রেখা। আশ্বিনের শুরুতে এই উঁচু জমিতে একটু পানি ছিলো। পানি নেমে যাবার আগে এক রাতে হুরমতুল্লা চুরি করে তমিজের আল কেটে পানি টেনে নিয়েছে নিজের জমিতে। বুড়ার জমির মাটি এখনো কেমন কালো কুচকুচে, আলে দাঁড়ালে সোঁদা গন্ধে তমিজের বুকটা ভরেও যায়, একটু জ্বলেও ওঠে। বুড়া তার জমিতে এখন মরিচের আবাদ করে।

এদিকে তমিজের জমিতে চিড় ধরার আভাস; পানির পিপাসায় জমির ঠোট একটু একটু ফাঁক হচ্ছে, ফাঁকটুকু হাঁ হতে আর কততক্ষণ?—হাঁ হলেই ধানের চারাগুলো আস্তে আস্তে হেলে পড়বে। তখন?—তখন?—নিড়ানি দিতে গেলেই তমিজের বড়ো পিপাসা পায়। হুরমতের কাছে বদনা ভরা পানি, তার কাছে পানি চাইলেই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। তমিজ ঠিকই বোঝে, মাঝির বেটাকে নিজের বদনা থেকে পানি খেতে দিতে বুড়ার বাধো বাধো ঠেকে। পানি খেতে তমিজকে তাই যেতে হয় মোষের দিঘির ধারে। কিন্তু এখন জমির পিপাসায় তমিজের গলা কাঠকাঠ, দিঘির অতো উঁচু পাড়ে ওঠানামা করার ধৈর্য তার নাই। দিঘির পুব ধার দিয়ে হেঁটে চয়ে যায় হুরমতের ঘরের দিকে। ক্যা গো, বাড়িত কেউ আছো? পানি খিলাবার পারো? তমিজ হাঁক দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁসার বদনা হাতে এসে দাঁড়ায় হুরমতের ছোটো মেয়ে। কিন্তু তমিজ ভাবছিলো। বড়ো মেয়েটি আসবে। খুব ভোরে এসে তমিজ রোজ তাকে চুপচাপ জমি থেকে চলে যেতে দেখেছে, তার পেছনটা তমিজের একরকম চেনাই। তা মেয়েটির মুখ দেখার তাগিদ হয়তো তমিজের ছিলো। আবার আশ্বিন মাসে ওর জমি থেকে আল কেটে পানি নেওয়ার সময় বাপের পাশে দাড়িয়ে সেও কোদাল ধরেছিলো; এই সুযোগে তাকে বেশ দুটো কথা শুনিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ছোটো বোনকে দেখে তমিজের এসব আর মনে পড়ে না। তার পানির পিপাসাও তখন হঠাৎ প্রকট হয়, বদনার নল উঁচু করে ধরে সে পানি খায় ঢক ঢক করে।।

তমিজের পেছনে শুকনা কলাপাতা ঝোলানো পর্দা, পর্দার ওপার থেকে কচি কলাপাতায় এক টুকরা গুড় এগিয়ে দিলো একটা কালো হাত। কচি কলাপাতা তমিজ হাতে তুলে নিলো এবং অন্যের জমির আল কেটে পানি-চুরি-করা মন্দা কিসিমের মাগীর পর্দার বাহারকে মনে মনে গাল দিয়ে গোগ্রাসে গিলে ফেললো গুড়ের টুকরা। গুড় মুখে বদনার বাকি পানিটুকু গিলতে তার বড়ো ভালো লাগে, এবার পানির স্বাদ বেড়ে গেছে। শত গুণ। নিজের জমিতে ফিরতে ফিরতে তার ছোটো একটা ঢেকুর ওঠে, এই ঢেকুরে আখের গুড়ের গন্ধের সঙ্গে উগরে ওঠে চিনচিনে হিংসা : কার্তিক মাসে মানুষের ভাত জোটে না, আবার চাষার ঘরে দ্যাখো গুড়ের ফুটানি! বাপটা তো কিপটের একশেষ, জমির আলে কুলগাছতলায় সানকি ভরা পান্তা মরিচ দিয়ে ডলে খেতে খেতে একবার মুখের কথাটাও বলে না, ক্যা গো, খাওয়া দাওয়া হছে? আর এ কঞ্জুসের বেটি গুড়ের ফুটানি মারে। গুড় যখন দিলোই তো পর্দার বাহার দেখাবার দরকারটা কী? রাত্রিবেলা। বাপের সঙ্গে আল কেটে তমিজের জমির পানি চুরি করার সময় পর্দার বাহাদুরি ছিলো কোথায়?–তা দুই বছরের ওপর বাপের বাড়িতে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করছে, বাপের জমিতে কাম না করে তার উপায় কী? তমিজ সব খবরই রাখে আকালের বছর হুমতুল্লার জামাই নিজের বৌ, বছর দেড়েকের একটা বেটা আর ছয় মাসের একটা–বেটি শ্বশুরবাড়িতে গছিয়ে রেখে সেই যে ভাগলো,—বেটিটা মরলো বছর না পুরতে, পেটফোলা বেটাটার পেট দিনদিন আরো ফুলছে তো ফুলছেই, তার তামাটে মুখ রোজ রোজ হলদে হয়, চোখের হলুদ ছোপ গাঢ় হয়ে আসছে। আর খেতে না পেয়েও বৌটার পাছা হয়ে উঠছে ধামার সমান।—তা সেই মানুষটার কোনো পাত্তাই নাই। ওদিকে ঐ জামাই বেটার গায়ের আদ্দেকের বেশি মানুষ নাকি আকালে সাফ হয়ে গেছে, যারা ছিলো তাদের বাড়িঘর খেয়ে ফেলেছে যমুনা। কিন্তু হুরমতুল্লার জামাই নাকি বেঁচে থেকেই কোথাও উধাও হয়ে গেছে কেউ বলতে পারে না। হুরমত শুনেছে জামাই তার রংপুর না আসাম না কুচবিহার না জলপাইগুড়ি না দিনাজপুর কোথায় চলে গেছে, কাউকে ঠিকানা দিয়ে যায়নি। সে নাকি আবার গান লেখে; হুরমতুল্লা বলে, তার গানের এতোই চাহিদা যে গান লিখতে তাকে হয়তো কলকাতা না হয় ঢাকা না হয় দিল্লি চলে যেতে হয়েছে। তমিজ এসব বোঝে! ঐ লোকটা নির্ঘাৎ পাড়ি দিয়েছে খিয়ার এলাকায়। কামলার মজুরি ওদিকে বেশি, এই কার্তিক মাসেও সাড়ে পাঁচ আনা ছয় আনার কম নয়। কাজও পাওয়া যায় ওদিকে, মেলা কাম। জমির তদারকি ওদিকে বেশি, জমিতে ওরা মেহনতও করে খুব। খিয়ারে তো নদী একরকম নাই বললেই হয়, বড়ো বড়ো সব দিঘি আছে, দিঘি থেকে নালা কেটে ওরা জমিতে পানি সেঁচে দোন দিয়ে। কামলাপাটের নাকমুখ খুঁজে পান্তার শেষ আমানিটুকু চুমুক দিয়ে খাবার মতো জমি চুপচাপ শুষে নেয় দোনের পানি। এখানে নিজের জমিতে পানি সেঁচতে পারলে কাজ হতো। হুরমতুল্লাকে ভালো করে বোঝাতে পারলে সে-ই শরাফত মণ্ডলকে বলে মোষের দিঘি থেকে নালা কাটাবার ব্যবস্থা করতে পারবে।

কিন্তু বুড়ার কাছে তমিজ কথাটা পাড়ে কীভাবে?—শুরু করা যয় তার পালিয়ে-যাওয়া জামাইকে খোজ করার পরামর্শ দিয়ে।—না, ওসব কলকাতা দিল্লি কিংবা আসাম কি জলপাইগুড়ি দিনাজপুরের কথা বাদ দাও বাপু, জামাই তোমার খিয়ারের দিকেই গেছে।—আরে, হিসাব তো সোজা।–টাউনে গিয়ে ট্রেনে চাপো, তারপর যে স্টেশনেই নামো, চোখে পড়বে খালি ধানখেত আর ধানখেত। বর্গাচাষাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ কোনো জোতদার হুরমতের জামাইকে ঠিক কাজে লাগিয়ে দিয়েছে নিজের খাস জমিতে। আধিয়ারদের হাঙ্গামা বাড়ার পর কামলার মজুরি সেখানে বেড়ে গেছে।—কেন? মজুরি বাড়বে কেন?—কাজে অনেক ঝুঁকি নিতে হয় তো, তাই। বর্গাচাষারা সেখানে একজোট, জোতদারের মানুষদের তারা যে কোনো সময় হামলা করতে পারে। তমিজ তো ঐ এলাকা থেকেই ঘুরে এসেছে এই মাস তিনেক। তিন মাস, কিন্তু মনে হয় কালকের ঘটনা। আধিয়ারদের তাড়া খেয়ে কাটা ধান ফেলে সে দৌড় দিলো। দৌড়, দৌড়, দৌড়। তার গায়ে তীর বিধছিলো একটার পর একটা, তমিজ শুনেছে সাঁওতাল চাষারা নাকি জোতদারদের মারে তীর দিয়ে। তা তীরের খোঁচায় টিকতে না পেরে তমিজ একটা জমির আলে দাঁড়িয়েছিলো বাবলা গাছের নিচে। তা ঐ রোগা বাবলা গাছ তাকে আর আড়াল দেবে কোত্থেকে? উপায় না দেখে তমিজ তখন কাঁটাওয়ালা বাবলাডাল ভেঙে ভেঙে ছুঁড়ে মারতে লাগলো ঐ চাষাদের দিকে। কিন্তু কোন শালা কি মন্ত্র পড়ে দিয়েছে, বাবলাডাল একটার পর একটা গিয়ে লাগে। জোতদারের গায়ে। শরাফত মণ্ডলের গলার ঠিক নিচে বাবলাকাটা লেগে রক্ত বেরুচ্ছে। বাপের পেছনে দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ আবদুল কাদের দুই ভাই। অন্তত আবদুল আজিজের মুখ বরবার কাঁটাওয়ালা মোটা একটা বাবলাল লাগাবার জন্যে তমিজ নানাভাবে চেষ্টা করে, কিন্তু জুত করতে পারে না। তমিজ আরো ডাল ভাঙতে লাগলো। জোতদার শালা ঝাড়েবংশে হারামজাদা, শালার একোটা মাক্কুচোষা। তমিজের এতো কষ্ট, এতো মেহনত, এতো কষ্টের মেহনতের ফসল সব নিয়ে তুলতে হবে শালাদের মোটা মোটা গোলায়।-জমির আলে কুলগাছের ডাল মুঠি করে ধরায় হাতের তালুতে ও আঙুলে কাঁটা ফুটলে মাথা ঝাকিয়ে তমিজ চারদিকে তাকায়; তার পাশের জমিতে মরিচের চারা বুনে চলেছে হুরমতুল্লা। এখানে বাবলা গাছ কোথায়? খিয়ারে কাজ করতে গিয়েও তো তমিজ কখনো বাবলা গাছের ডাল ভাঙেনি। খিয়ারে চাষাদের তাড়া খেয়ে সে আবার রুখে দাঁড়ালো কবে? একদিন কেবল আধিয়ারদের হামলায় পালিয়ে এসে জোতদারের বাড়ির উঁচু ভিটা থেকে সাঁওতালদের তীর ছুঁড়তে দেখেছে। কিন্তু তাই বলে সে-ও তাদের দলে ভিড়ে যাবে কেন? তওবা, তওবা! ছি! ছি! শরাফত মণ্ডল কিংবা তার ছেলেদের গায়ে সে কি কখনো ভুলেও হাত তুলতে পারে? সে কি এতোই নেমকহারাম হয়ে গেলো যে এসব ভাবনা এসে দানা বাঁধে তার মাথায়? আবদুল কাদেরের সুপারিশে আর শরাফত মণ্ডলের মেহেরবানিতে তমিজ দিনমজুর থেকে আজ বর্গাচাষী। অথচ এই ভর দুপুরবেলা মণ্ডলেরই জমিতে দাঁড়িয়ে জেগে থেকে সে এসব কী দেখে? বাপের ব্যারাম কি তার ওপরে ভর করলো নাকি? ব্যাপারটা ভালো করে বোঝবার আগেই সে শুনতে পায় হুরমতুল্লার ডাক, ক্যা গো। ওটি খাড়া হয়া কী তামসা দ্যাখো? নিড়ানি হলো? মাটি বলে শুকনা। বানও এবার জুতের হলো না গো!

হুরমতুল্লার এই কথা ধরেই মোষের দিঘি থেকে নালা কাটার ব্যাপারটা তোলা যায়। কিন্তু একটু আগে দিব্যি জেগে জেগে দেখা বেআক্কেলে খোয়াবটা তার আসল কথাটা ভুলিয়ে দিতে না পারলেও কথার ভনিতাটা গুলিয়ে ফেলেছে। কী কথা দিয়ে যেন শুরু করার কথা ছিলো? কিছুতেই আর মনে পড়ে না। মনে পড়ে কোত্থেকে?–মাথার। ভেতরে তার কেবল দিঘি কাটা নালার পানি বইতে থাকে কুলকুল করে। পানি পেয়ে জমি তার গাঢ় সবুজ রঙের হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে আকাশ জুড়ে, তমিজের সর্বাঙ্গ কাঁপে সেই হাওয়ায়। হুরমতের বুড়া গতরে তো কাঁপন উঠবে আরো বেশি। বুড়ার মরিচ খেত প্রথমে হয়ে উঠবে ঘন সবুজ। তারপর সবুজ পাতার ভেতরে পাতার সঙ্গে সবুজ মরিচের লুকোচুরি খেলা। তারও পুর সবুজ আঁচল ফেটে বেরুবে পাকা মরিচের লাল টকটকে শিখা। আহা, পাকা মরিচের সেই আগুনে-হাসি দেখে বুড়ার সব দোষ তমিজ মাফ করে দেবে। আর তখন তমিজের আমন হবে এখানে আউশ যা হয়েছিলো তার আড়াই গুণ। এতো এতো ধান তারা খাবে কততঃ দুর! আমন ধানের চিকন চাল দাঁতের ভেতর কেমন ফস্কে ফস্কে যায়, ভাত খাবার জুত হয় না। খাবার জন্যে আউশ ধানের ভাত কতো ভালো। আর অতো খাবার লালচ কেন? আমন বেচে টাকা যা পাবে সবটা পেটের ভেতরে না সেঁধিয়ে জমিয়ে রাখবে। এক জোড়া গোরু, লাঙল, জোয়াল, মই কিনতে পারলে জমি বর্গা পেতে কষ্ট হয় না। বেশি নয়, বছর তিনেক বর্গা করতে পারলে দুটো দুটো ফসল ঘরে তুলে অন্তত ১৫ শতাংশ জমি কেনার টাকা হয়। নিজেদের ভিটার লাগোয়া জমিটা মণ্ডলের কাছ থেকে ফেরত পাওয়া যায় কি-না একবার চেষ্টা করে। দেখতে ক্ষতি কী? আবদুল কাদেরকে তমিজ একবার বলে দেখবে। মাসখানেক হলো। তো সে রোজই সন্ধ্যাবেলা গোলাবাড়িতে কাদেরের দোকানে যাচ্ছে, লীগের ছেলেদের সঙ্গে এদিকে ওদিক যায়, খুব জোর গলায় স্লোগান হকে। এসব দেখে কাদের নিশ্চয়ই খুশি। কাদের কি আর তার ভিটার জমিটার জন্যে বাপকে একটু বলবে না? মণ্ডল জমি যদি না-ও বেচে তো অন্তত খাইখালাসি দিক। বাপটাকে তমিজ তা হলে ওখানেই লাগিয়ে রাখতে পারে।

বাপ তো তার কামের মানুষ। যেখানেই লাগুক, সে একাই একশো। খালি একটা কথা,কামটা তার জুত মতো হতে হবে। বিলের মধ্যে যেসব ডাঙা ফুটে উঠছে। সেখানে বর্গা করার সুযোগ পেলে তমিজের বাপ কাম দেখাতে পারে। মণ্ডল এই বিল পত্তন নেওয়ার আগে তমিজের বাপ বিলের যেখানে জাল ফেলেছে, মাছ উঠেছে সেখানেই। মানুষটার হাতে জাল ফেললেই মাছ। বিলের স্বভাবচরিত্তির তার চেয়ে ভালো জানে কে? বিলের পানি থেকে ওঠা জমিও তার বশেই থাকবে। এই যে রাতে নিন্দের মধ্যে আন্ধারে মান্দারে মাঠেপাথারে হেঁটে হেঁটে বিলে যায়, সে কি এমনি এমনি? বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছ থেকে মুনসি তাকে যদি একটু কোল দেয় তো বিলের জমিজিরেত কি তার হাতে না এসে পারে?

কিন্তু হুরমতুল্লা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দৌড়াতে শুরু করলে তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, এই কালাহার বিল আর তার দুই পাশের গ্রামগঞ্জের সবার বাপ মুনসি পর্যন্ত রোদে মিলিয়ে যায়। বুড়ার হলোটা কী? মোষের দিঘির ওপারে নিজের বাড়ির দিকে মুখ করে বুড়া হাত দেখায় বিলের ওপারে পুবের রাস্তার দিকে আর উর্ধশ্বাসে চাঁচায়, ক্যা রে ফুলজান, ক্যা রে নবিতন, ক্যা রে ফালানি, দ্যাখ দ্যাখ কেটা আসিচ্ছে দ্যাখ।

গোলাবাড়ি থেকে দক্ষিণে নেমে কালাহার বিলের পুব দিয়ে মণ্ডলবাড়ি ছুঁয়ে কলুপাড়া পর্যন্ত চলে-যাওয়া রাস্তায় একটা টমটম ছুটছে। টমটমের পেছন পেছন ছুটছে এক দঙ্গল ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে। এদের বেশির ভাগের কোমরে তাবিজ আর কানাপয়সা ঝোলাবার তাগা ছাড়া শরীরের সবটাই খালি। ৪/৫টি মেয়ের পরনে কেবল গামছা, তাদের গলায় অবশ্য তাবিজও ঝুলছে। মাঝে মাঝে টমটমের চাকায় কাঠি ঠেকানোর ফলে টরররররর আওয়াজ উঠছে, ঘোড়ার খুরের শব্দের সঙ্গে সেই আওয়াজ শুনে একটু দূরের ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে বৌঝিরা, তাদের প্রত্যেক্যের কোলে একটা একটা ন্যাংটা শিশু।

টমটমের সওয়ারিকে চিনতে পারলে হুরমতের লাফালাফি ও উত্তেজনার কারণ বোঝা যায়। বিলের ওপারে স্পষ্ট নজর দেওয়া সোজা নয়। তবু টমটমের ওপর কাঁথা পেতে বসা আবদুল আজিজকে সনাক্ত করা গেলো। তার পাশে সবুজ এন্ডির ব্যাপারে জড়ানো বালকটি নিশ্চয়ই আজিজের ছেলে। তাদের উল্টোদিকের মেয়েটি আজিজের মেয়ে ছাড়া আর কে হবে? টমটমের নাগাল পেতে হুরমত দৌড় দিলো বিলের পাড়ে, কোষা নৌকা নিয়ে সে যদি ওপারে যায়ও তো গাড়ি ততোক্ষণে চলে যাবে মেলা দূর। ফিরে এসে হুরমত তাই মোষের দিঘির উঁচু পাড়ে উঠে যতোটা পারে টমটমটা ভালো করে দেখতে লাগলো।

ওদিকে হুরমতের মেয়েরাও এসে দাঁড়িয়েছে দিঘির পাড়ের ওপর। বড়ো মেয়ের কোলে তামাটে হলুদ ছেলেটি ঘ্যানঘ্যান করে কেঁদেই চলেছে, টমটমের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে তার মায়ের সবরকম চেষ্টাই একেবারে ব্যর্থ। হুরমতের ছোটো মেয়েটি নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে, কিন্তু তার বড় বোেন এক হাতে খামাখা তাকে আটকাতে গেলে ছেলেটি তার কোল থেকে একরকম গড়িয়ে নামে নিচে এবং ওখানেই বসে কাঁদতে থাকে চিষ্কার করে। কিন্তু গলার জোর একেবারেই কম, তার পেটের পিলে মনে হয় তার গলার ভেতরটাও কুরে কুরে খেয়ে ঢাউস হয়ে উঠেছে।

কোলের ছেলে নিচে নেমে পড়ায় হুরমতুল্লার বড়ো মেয়ের মুখ বুক এখন তমিজ স্পষ্ট দেখতে পায়। তামাটে রঙের গোলগাল মুখের নিচে ফুলজানের ঘ্যাগটা একটু বড়োই দেখায়। শরীরটা তার মোটা, তবে কোমর অতোটা মোটা না। সারা শরীরে শক্ত মাংস ঠাসা। এই শরীরের মেয়ে জমিতে কাজ করবে না তো করবে কে? আহাম্মুক স্বামীটা তার বুঝতে পারলো না! নইলে এই বৌকে নিয়ে সে তো জমি বর্গা চাষ করতে পারে কোনো কামলা ছাড়াই।

হাঁপাতে হাঁপাতে জমির আলে কুলগাছের নিচে ফিরে এসে হুরমতুল্লা হাঁপায় এবং হাতের কাছে পানি ভরা বদনা থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চাঁচায়, পানি লিয়া আয়। পরের মুহূর্তেই সে নির্দেশ পাল্টায়, ওটি খাড়া হয়া বেহায়ার লাকান কী দেখিস? যা, ঘরত যা।

তার হুকুম মেয়েরা পালন করলো কি-না না দেখেই হুরমত বলে, মণ্ডলবাড়িত একবার যাওয়া লাগে গো। কিসক আসলো, কী সমাচার শুন্যা আসি। ঘাড়ের গামছা দিয়ে পিঠ ও বুক মুছতে মুছতে সে টমটমের সওয়ারিদের মধ্যে আবদুল আজিজ ছাড়া আর কে কে থাকতে পারে তাই নিয়ে নানারকম অনুমান করে, অনুমানটি নিয়ে সংশয় হয় তার, তখন অনুমান বাতিল করে ও ফের নতুন অনুমানটি জানায়। টমটমে আবদুল আজিজকে বাড়ি আসতে দেখে হুরমতুল্লার এরকম উত্তেজনা তমিজের পছন্দ নয়। কিন্তু এই অপছন্দ জানানো দূরের কথা, এটিকে বেশিক্ষণ পুষে রাখাও তার পোষায় না। হুরর্মত হলো আজিজের পেয়ারের মানুষ। শরাফত মণ্ডলের বাপ এই গ্রাম থেকে বাস উঠিয়ে নেওয়ার আগে হুরমত তাদের পড়শি ছিলো, তাদের মধ্যে আত্মীয়তাও থাকতে পারে। তমিজের এই জমিটাও আজিজ হুরমতকেই বর্গা দিতে চেয়েছিলো। তার কথা, পুরানা আমলের মানুষ। পুরানা চাল ভাতে বাড়ে। কিন্তু শরাফত মণ্ডলের কী হয়েছে, বিল পত্তন নেওয়ার পর থেকে সে জমি বর্গা দিতে। শুরু করেছে মাঝিদের কাছে। এই নিয়ে আবদুল আজিজ বেশি কিছু বলতেও পারে না। হাজার হলেও সে থাকে বাইরে, গাঁয়ের খুঁটিনাটি ব্যাপার সে আর কতোটাই বা জানে? তবে হিসাবনিকাশের কাজে বড়ো ছেলের ওপর মণ্ডলের আস্থা বেশি। ফসল কাটার সময় তাকে তাই ছুটি নিয়ে একবার বাড়ি আসতেই হয়। আবদুল আজিজ মাথার ওপর দাড়ালে আধিয়াররা ফাঁকি দিতে পারে না, তাদের ফন্দিফিকির কিছুই খাটে না। কিন্তু এখন তো ধান কাটার সময় নয়। আবদুল আজিজ হঠাৎ করে বাড়ি এলো কেন? লোকটা কি তবে তাদের জমিতে জমিতে ফসলের সম্ভাবনা অনুমান করতে এসেছে? তমিজ। একটু ভাবনাতেই পড়ে মাঝির বেটা লাঙল ধরে কোথায় কী অকাম করলো তাই তদন্ত করতেই যদি সে গ্রামে এসে থাকে তো তমিজের কপালে দুঃখ আছে।

১১. মোষের দিঘি

ত্রিশূল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মহাদেব নিজের হাতে মোষের দিঘি খুঁড়েছেন এক রাতের মধ্যে। তাও আবার মা দুর্গার আবদারে। দেবমহিমায় নায়েববাবুর ঘন ভুরুতে গেরো পড়ে : এই দিঘিতে জাত-বেজাতের মানুষের হাত পড়লে ভোলানাথ আবার দ্বিতীয় একটা দক্ষযজ্ঞ করতে পারে, সেই ভাবনায় নায়েববাবু বড়ো কাতর। তার ভক্তিখচিত কাতরধ্বনি শুনতে শুনতে শরাফত সোজা হয়ে বসে চেয়ারের ওপর, মহাদেবের কিংবা তার ভক্তের বেসামাল রাগের ভয়ে তার শিরদাঁড়া একটু একটু কাঁপে।

দেবতা ও জমিদার দুই জনের প্রতিই নায়েববাবুর ভয় ও ভক্তি সমানভাবে বরাদ্দ, কর্তাবাবু তো তোমাদের জন্যে সর্বদাই খুব ভাবে, বুঝলে না? তাঁর প্রজাপাটের দশ আনাই মোসলমান, তোমার জাতের মানুষ। চার আনার বেশি নমশূদ্র। তার নিজের জাতের মানুষ আর কয়জন?-এই এস্টেটে বামুন কায়েত কতো তা তো জানোই। আর কর্তাবাবুর ছেলেরা তো জাত একরকম মানেই না, তাদের খাদ্যিখাওয়া ওঠাবসা সব সায়েবদের সাথে। জমিদারতনয়দের বৈপ্লবিক জীবনযাপনে নায়েববাবু যেমন গর্বিত দেবদেবীর প্রতি তার ভক্তিও তেমনি সীমাহীন। সে বলে, কিন্তু কথাটা বোঝো, ভালো করে বুঝে দেখো। কথাটা অন্যভাবে নিও না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নায়েববাবু চোখজোড়া আধবোজা করে, মহাদেবের নিজের হাতে কাটা দিঘি, তাও কাটলেন মা দুর্গার কথায়, এই দিঘিতে ব্রাহ্মণও কোদাল বসাতে সাহস পায় না। আর অন্য জাতের হাতের কোদাল পড়লে কৈলাসনাথ সহ্য করেন কীভাবে? বলো, তুমিই বলো।

কৈলাস এখান থেকে কতো দূরে সে সম্বন্ধে শরাফতের ধারণা না থাকলেও ওখানকার বাসিন্দাদের ভক্ত নায়েববাবুকে সে ভালো করেই চেনে। আহলে হাদিস জামাতের মানুষ সে, মাঝি কলু কি হানাফি জামাতের অন্যসব মানুষের মতো হিন্দু দেবদেবীর নামে সে কখনো মানত করে না। কিন্তু ভয় একটু পায়। জমিদারের কাছারিতে বসে নায়েববাবু ও অনুপস্থিত মহাদেবের সঙ্গে বেয়াদবি করার ইচ্ছা কিংবা সাহস তার একেবারেই নাই। যতোক্ষণ ওখানে ছিলো ভয় ও ভক্তিকে সে এক মুহূর্তের জন্যে কাছছাড়া করে নি। দিঘিটা যে মহাদেবের কাটা তাও সে জীবনে প্রথম শুনলো। কোম্পানির গোরা সেপাইদের কেটে ভবানী সন্ন্যাসী তার খাড়াটা ধোবার জন্যে এই পুকুর কাটে বলে ছোটোবেলা থেকে সে গল্প সে শুনে আসছে সেটা কি তবে ঠিক নয়? তবে নায়েববাবুকে চটিয়ে তার লাভ কী? কথাটা না তুলেই সে কাছারি থেকে ফেরে।

গোলাবাড়ি হাটে ভুটিয়া ঘোড়া থেকে নেমে শরাফত এদিকে ওদিক তাকাতেই গফুর কলু ছুটে আসে কাদেরের দোকান থেকে। গফুর ঘোড়া ধরলে সে বলে, দোকানের পিছনে ছায়া দেখ্যা বান্ধ্যা রাখ। বিকালবেলা কাউকে দিয়া বাড়িত পাঠায়া দিস।

গফুরকে হুকুম দিতে দিতে কাছারির ভয়টা তার তরল হয়। দোকানের ভেতরে ক্যাশবাকসের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাদের। বাপকে দেখে দাড়ালো তা কিন্তু নয়। লীগের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। তার পেছনে–টিনের দেওয়ালে সাঁটা আগামী রবিবার টাউনে মুসলিম লীগের মিটিঙের পোস্টার। পোস্টারের একেবারে ওপরে আড়াআড়িভাবে আঁকা মুসলিম লীগের নিশান, তার ওপরে লেখা, পাকিস্তান জিন্দাবাদ ও মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ। অন্য তিন দিকে টিনের বেড়ায় পুরোনো দৈনিক আজাদের ওপর গাঢ় নীল কালিতে লেখা পোস্টার। ঘরের এক দিকে টিনের বেড়া ঘেঁষে কেরোসিন তেলের টিন সাজানো, অন্য দিকে খালি টিন একটু এলোমেলোভাবে রাখা। খালি টিনগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শরাফত গত দুইদিনের বিক্রির পরিমাণটা আন্দাজ করে নিলো।।

আবদুল কাদেরের দিকে মুখ করে দুটো বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসেছিলো ১২/১৪ জন ছেলে, কাদের এদের সঙ্গেই কথা বলছিলো। শরাফত মণ্ডল আজকাল যখনি। দোকানে আসে এক দঙ্গল ছেলে দেখতে পায়। দিনরাত এরকম দরবার করলে ব্যবসা হবে? মণ্ডলের মেজাজটা খিচড়ে যায়, হিন্দুদের সঙ্গে লাগতে চাও;—দেখো হিন্দুর বাচ্চা কী করে ব্যবসা করে। এই তো কয়েজ গজ পরেই মুকুন্দ সাহার আড়ত, চার চালা টিনের ঘর, বাপের আমলে যেমন ছিলো তেমনি আছে, একটা টুলও বাড়ায় নি। অথচ ব্যবসা। চালাচ্ছে চুটিয়ে! আজ হাটের দিন নয়, তবু আড়তের সামনে বাঁধা ৪/৫টা ঘোড়া, আদা রসুন জিরা নিয়ে এসেছে পাইকাররা। দোকানে বসে সাহা কি কখনো আড্ডা মারে? আর কাদেরের ঘরে এতোগুলো ছোকরা, বিড়ির ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। মুরুব্বি গোছের খদ্দেরদের এখানে ঢুকতে কি একটু বাধো বাধো ঠেকবে না?

তবে কিছুক্ষণের মধ্যে এই ক্ষোভ ও বিরক্তি শরাফত সামলে নেয়, তাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে-পড়া ছেলেদের দেখে একটু চাঙাই হয়ে ওঠে। পিপাসা না পেলেও সে তখন এক গ্লাস পানি খেতে চায়। শুধু তার জন্যেই দোকানে রাখা বড়ো কসার গ্লাস হাতে গফুরকে বাইরে টিউবওয়েলের দিকে যেতে দেখে সে বলে, এখন থাক। কাদের তখন গফুরের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ওটা এগিয়ে দেয় গিরিরডাঙার চাষীপাড়ার একটি ছেলের দিকে। এবার পানি খাওয়া স্থগিত রাখার দরকার হয় না শরাফতের। পানি খেয়ে আরামের নিশ্বাস ছেড়ে সে বলে, মোষের দিঘিত নালা কাটা যাবি না। ওই দিঘি বলে দেও দানবে কাটিছে, লায়েববাবু কয়, মহাদেবের লিজের হাতে কাটা দিঘি, মোসলমানে কোদাল ধরলে ঠাকুর কোদ্দ হবি।

দেবতার ক্রুদ্ধ হবার কথায় জ্বলে ওঠে কাদের, মোসলমানের ভালো দেখলেই হিন্দুর গাও জুলে। এই বাক্য তার একটু আগে বলা কথার জের হিসাবে চালানো যায়, প্রসঙ্গটি অব্যাহত রাখতে তাই তার অসুবিধা হয় না, হিন্দু জমিদার ফুটানি মারে মোসলমান প্রজার রক্ত চুষে। পাকিস্তান না হলে মোসলমানের জান মাল ইজ্জত সব বিপন্ন।

এর মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে বৈকুণ্ঠ গিরি। কাদেরের কথা সে শুনছে খুব মন দিয়ে। কাদেরের কথা শেষ হলেও সে সরে না, বরং ফের পান মুখে দেওয়ায় জর্দার গন্ধে তার অবস্থান আরো শক্ত হয়। শরাফত মণ্ডল ও কাদের বাড়ি যাবার জন্যে পা বাড়ালে বৈকুণ্ঠ এগিয়ে মণ্ডলের কাছে এসে বলে, কাকা, আপনের সাথে বাবুর কী দরকার, কী নাকি কথা আছিলো।

ও হ্যাঁ, শরাফতের হঠাৎ কী মনে পড়লে কাদেরকে বলে, তুমি একটু বসো, মুকুন্দবাবুর সাথে কথাটা সারা আসি।

শরাফত মুকুন্দ সাহার আড়তের দিকে গেলেও বৈকুণ্ঠ দাঁড়িয়েই থাকে, কাদেরকে সে জিগ্যেস করে, দাদা, আপনাগোরে না সভা হবার কথা? সভাত গান হবি তো? গান না হলে সভা কিসের?

গোলাবাড়ি হাটে তখন শেষ দুপুর। বটতলায় একটি ভিখিরিনী বসে পাতা জ্বালিয়ে রান্নার আয়োজন করছে। দোকানপাট সব বন্ধ, একটি দোকানের সামনে বাঁশের মাচায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ৭/৮ বছরের একটি মেয়ে, ওই ভিখিরিনীরই মেয়ে হবে। হঠাৎ করে কার্তিক মাসের ফাজিল মেঘের ছপছপ বৃষ্টি হলেও মেয়েটির ঘুম ভাঙে না, মায়েরও রান্নার খুব একটা ব্যাঘাত হচ্ছে বলে মনে হয় না।

বৃষ্টি থামলেও শরাফতের ছাতা খোলাই থাকে, তবে রাস্তায় নেমে সে বলে, বৃষ্টি আর হবি না। বৃষ্টিরই দরকার, না হলে ফসল মার যাবি।

কিন্তু আবদুল কাদেরের মনোযোগ অন্য দিকে। সারাটা পথ ধরে সে হিন্দু জমিদারদের জুলুম নিয়ে গজগজ করে। আবার বাপের অপমানও তার গায়ে লেগেছে। জিগ্যেস করে, নায়েববাবু কি আপনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করিছে বাপজান?

আরে না, তুমি কী কও! শরাফত ছেলের ভয়কে উড়িয়ে দিতে চাইলেও বুকের ভেতরটা একটু খচ খচ করে। নায়েববাবুর তলব এসেছিলো সকালে, শরাফত তখন চিড়াদুধকলা নাশতা করে উঠে হাত ধুচ্ছে। কাদের তখনো নাশতা করে নি, সে তার ভাইপোর জ্বর দেখছিলো থার্মোমিটারে। তখন বাড়িতে এসে হাজির হলো নায়েববাবুর খাস পেয়াদা হাতকাটা অসিমুদ্দি। অসিমুদ্দি স্পষ্ট করে কিছু বলে নি, শুধু জানালো মোষের দিঘি থেকে নালা কাটা নিয়ে নায়েববাবু কার কাছে কী শুনেছে, শরাফতের সঙ্গে তাই নিয়ে আলাপ করতে চায়। নায়েববাবুর হুকুম তামিল করতে বাপকে তড়িঘড়ি করে পিরান ও টুপি পরতে দেখে কাদের আড়চোখে তাকিয়ে বলে, হুমায়ুনের জ্বর তো আজ বেশি। হুমায়ুনের মায়ের দিকে থার্মোমিটার এগিয়ে দিয়ে সে নিজের বাকস থেকে বার করে একটা জিন্না টুপি। বাপের সামনে বিছানায় টুপি রেখে কাদের বলে, বাপজান, এই টুপি মাথাত দেন।

শরাফত কিন্তু নিজের কিস্তি টুপিটাই ফুঁ দিয়ে মাথায় চড়ালো, তবে ছেলের নতুন কেনা জিন্না টুপিটা তাকে ফিরিয়ে দিলো না, আজিজের বৌয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো, বাবরের মা, রাখো, বাবরের মাথাত হবার পারে।

এখন ছেলের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শরাফত মণ্ডলের মনে হয়, জিন্না টুপিটা . মাথায় থাকলে নায়েব আরেকটু হুঁশিয়ার হয়ে কথা বলতো। তা বয়স হতে হতে নায়েব এমনিতেই অনেকটা নরম হয়ে আসছে, তার কথাবার্তা আজকাল আগের চেয়ে অনেক ভালো,। আজ এতোদিন পর হঠাৎ এরকম বেঁকে গেলো কেন? মণ্ডল বেঞ্চে বসার আগেই নায়েব বলে, কী মণ্ডল, তোমার তো দেখাই পাই না। তা তোমাদের সাথে আজকাল বড়ো বড়ো মানুষের খাতির, আমাদের তো মনে হয় পোঁছেই না। আমাদের দিন শেষ হয়ে গেলো নাকি?

শরাফত চুপ করে থাকে, নায়েববাবুর কাছে এর চেয়ে অনেক খারাপ ব্যবহার সে আগে মেলা পেয়েছে। তবে আজ মোষের দিঘির পুবের জমিটা পত্তন নেওয়ার কথাটা আর তোলা যাবে না বলে সে দমে যায়।

নায়েব বলে, তোমার বেটা তো পাকিস্তানের মিটিং করে বেড়ায়। ভালো, বাপু ভালো। আমাদের এস্টেটের একটা ছেলে উঠতে পারলে আমরা খুশি। দেখো না, কাউনসিলে যেতে পারে কি-না। আবার শুনি, জমিদারি নাকি উচ্ছেদ করবে। দেখো। বাপু, জমিদারি আর ধনসম্পদ সব দুইদিনের ভোগ। কর্তাবাবু বলেন, পূর্ণ, এসব কিছুই থাকবে না। দেশটা ছোটোলোকদের অধিকারেই যাবে। কিন্তু আমার অনুরোধ, জাতটা মেরো না। জাত গেলে মানুষের আর থাকে কী?

কী যে কন বাবু, কী যে কন। জমিদারি না জাত,-কোন প্রসঙ্গে শরাফত নায়েববাবুর খেদ ও আকুতিতে সাড়া দিচ্ছে তাও পরিষ্কার করতে পারে না সে।

তোমাদেরই তো এখন দিন! মন্ত্রী বলো, উজির নাজির সবই তো তোমাদের। চাকরি বাকরি তো ভদ্রলোকের ছেলেদের জন্যে বন্ধই করে দিয়েছে। কয়টা দিন গেলে দেশে আর চাষাবাদ করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। চাষারা হ্যাটকোট পরে অফিস কাছারি করবে। তা করুক। অন্নদাতা ভগবান, জীব যখন দিয়েছেন, অন্নও তিনি জোগাবেন। কিন্তু বাপু, জাত মারার ফন্দি করলে-

এই অসমাপ্ত ব্যাক্যের জবাব শরাফত মণ্ডল দেয় কী করে? তাকে উদ্ধার করে নায়েব নিজেই। প্রথমে জানায় যে, মোষের দিঘিতে নালা কাটা শুরু করে শরাফত বিবেচনাবোধের পরিচয় দেয় নি। তারপর নায়েব হঠাৎ করে প্রশ্ন করে, মণ্ডল, তুমি তো বুড়ো হলে। এখানকার সবই তো জানো। এই দিঘি কে কেটেছে, কাটার উদ্দেশ্য কী ছিলো জানো না?

এই এলাকায় এসব আবার জানে না কে? আষাঢ়ের অমবস্যায় রাত্রি আড়াই প্রহরে কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে, পাকুড়গাছ থেকে অল্প তফাতে পানিতে একটা কাত্রা ভেসে ওঠে। মণ্ডল এই গপ্পো বলতে শুরু করলে নায়েব ভুরু কোচকায়, কাত্রা? মণ্ডল। বুঝিয়ে বলে, কাত্রা মানে বলি দেওয়ার জন্যে জোড়া কাঠ। মানে–নায়েব হাত তুলে থামায়, যূপকাষ্ঠ? শব্দটির মানে জানে না বলে মণ্ডল চুপ করে থাকলে নায়েব বলে, আরে এসব তো বানেয়াট গল্প। তা বানোয়াট গল্পটাই তো এখানে ঘটে আসছিলো বহুকাল থেকে ওই কাত্রা ভেসে উঠলে সেখানে জোড়া পাঠা বলি দিয়ে শত্রুবিনাশ হয়, বিলের দুই ধারে রোগবালাই থাকে না। তা এখন আর কেউ বলি টলি দেয় না, তাই কাত্রাও বুঝি রাগ করে আর ভেসে ওঠে না।বলি দেবে কোথেকে?-বলির পাঁঠা তো কিনে আনলে চলবে না। সেই রাতে মুনসির পোষা গজারের সবগুলি ভেড়ার আকার পায় না, এক জোড়া গজার মাছকে মুনসি সেই রাতে ভাসিয়ে দেয় সাদা পাঁঠার শরীরে। কবে কয়শো বছর আগে কোন সন্ন্যাসী এদিকে এসেছিলো, মানাস নদীর তীরে লড়াই করতে করতে কোম্পানির গোরা সেপাইদের সে নাকি নিজের হাতে বলি দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী মারা পড়ে সেপাইদের হাতেই। তা মরে গিয়ে লোকটা বছরের একটা দিন এখানে আসে, বিল থেকে কাত্রা তুলে নিয়ে মুনসির দেওয়া পাঁঠা বলি দিয়ে সে ঠাঁই নেয় পোড়াদহ মাঠের বটতলায় সন্ন্যাসীর থানে। যাবার আগে বলি দেওয়ার খাড়াটা সে ধুয়ে নেয় মোষের দিঘিতে। ওই রাতে মানুষজন এদিকে আসে না, আসা নিষেধ। কিন্তু পরদিন মোষের দিঘির মাঝখানে গোলাপি রঙের পানি ভাসতে থাকে।

গল্প শুনে নায়েববাবু হাসে, এই গল্প শুনে লোকটা অনেকবার এমনি করে হেসেছে। তার সঙ্গে হাসে শরাফত মণ্ডল। হিন্দুদের এইসব গালগল্প সে বিশ্বাস করে না। তবে মাঝি আর কলুদের কথা আলাদা, তারা কতোটা মোসলমান তাই নিয়ে মণ্ডল প্রায়ই এটা ওটা বলে। আর তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও সব কেচ্ছা বলার লোকের অভাব নাই। তবে আজকাল কাত্রা টাতরা আর ওঠে না, উঠলেও কেউ দেখতে পায় কি-না সন্দেহ।

এ গ্রামবাসীর অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে নায়েববাবু দুঃখিত হয়। নায়েববাবু বলে, আরে, মহাদেবের দিঘিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নমশূদ্ররা চালিয়ে দেয় সন্ন্যাসীর নামে। তাঁর দুর্গার সখের দিঘিতে বেজাতের মানুষের হাত পড়া কি দেবতা সহ্য করবেন? এই পাপ কি গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙার প্রজাদের, এমন কি এদের কলকাতাবাসী জমিদারবাবুকেও স্পর্শ করবে না?

কিন্তু কাদেরকে তো শরাফত মণ্ডল সব খুলে বলতে পারে না। মাথাগরম ছেলে তার, এসব শুনে আবার কী করতে কী করে ফেলে! না বাবা, জমিদারের কোপে পড়লে কাৎলাহারের এপার-ওপার জুড়ে বিস্তীর্ণ জোত করার সাধ তার কখনো মিটবে না। নায়েববাবুকে সে চটায় কী করে? নায়েব এখন কলো নরম মানুষ হয়েছে এই মানুষের রাগ কাদের কি কিছু দেখেছে? শরাফতের বাপচাচাকে কাছারির কোনো নায়েব তুইতোকারি ছাড়া ডাকে নি। অনেক আগে শরাফতের জ্যাঠা পিয়ারুল্লা মণ্ডলকে আগের নায়েব ডাকতো শিয়ারুল্লা বলে, এই নায়েবের আমলে সে পরিচিত হলো শিয়ালু বলে এবং মরার পরও ওই নাম থেকে জ্যাঠা তার রেহাই পায় নি, তার ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি সবার বাপদাদার নাম এখনো লেখা হয় শিয়ালু মণ্ডল। সেই লোকের ভাইপো হয়েও শরাফত নায়েবাবুর কাছে আসল নামে স্বীকৃত এবং তুমি বলে সম্বোধিত হয়। হবে না কেন? আল্লায় দিলে শরাফত কিছু জোতজমি করেছে, গিরিরডাঙায় বাপের ছনের ঘর ভেঙে টিন দিয়ে সব ঘর তুলেছে বড়ো বড়ো। তার দুই ছেলের একজন ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করে, আরেকজন বছর তিনেক কলেজে পড়েছে। সব তো জমির কল্যাণেই। আর নায়েববাবুর নেক-নজরটা না থাকলে জোতজমি কি আর হেঁটে হেঁটে তার হাতে আসে?

কালাহার বিলের কাছাকাছি এসে শরাফতের হাঁটার গতি হঠাৎ করে বাড়ে এবং রাস্তা থেকে সে নেমে পড়ে ডান দিকে জমির আলে। পাকুড়তলার দিকে হাঁটা দিলে তার গতি আরো বাড়ে এবং এতে কাদেরের অস্বস্তি টের পেয়ে সে বলে, হুরমতের জমিটা দেখাই যাই। বুড়া মরিচের কী করিচ্ছে বোঝা দরকার। মুকুন্দ তোদর এবার ভালোই দিবি কলো।

বেলা হেলে পড়েছে, একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ এখন মেঘশূন্য, শেষ রোদের তেজ একটু বেশি। খিদায় কাদেরের শরীর এলিয়ে পড়েছে। তার ওপর পাকুড়তলায় বড়ো বড়ো গাছের জঙ্গল, ওদিক দিয়ে এই অবলোয় হাঁটতে একটু গা ছমছম তো করেই। কিন্তু বাপ তার সিদ্ধান্ত একটা নিয়ে ফেলেছে, তাকে নড়ানো অসম্ভব।

ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে জমির আলে আলে হেঁটে মোষের দিঘির ধারে পৌঁছে কাদের ফের চাঙা হয়ে ওঠে, বলে, এই দিঘিতে মোসলমানের কোদাল পড়লে দোষ হয়, না? নিজের কথায় তেতে উঠে সে বার করে বিকল্প উপায়, বিল কাটলেই তো হয় বাজান। বিল থেকে নালা নেওয়া যায় না? শরাফত কিছুই না বললে কাদেরের ধৈর্য থাকে না, বিল কাটলে মুনসি আবার লাফালাফি শুরু করবি না তো?

মুনসির স্বভাব নিয়ে এরকম বাঁকা কথা শরাফতের, গায়ে বেঁধে, তার একটু ভয় ভয়ও করে। তবে ছেলের প্রস্তাব সে বিবচেনা করে বৈ কি! কাৎলাহার বিল তো একরকম তার নিজের সম্পত্তিই। এই বিল ইজারা নিতে তার কম ভোগান্তি হয় নি। নায়েববাবুকে সেলামি দিতে হয়েছে দফায় দফায়, লাঠিভাঙা কাছারিতে নানা স্তরের আমলা থেকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়েছে পাইক বরকন্দাজ সবাইকে। মনে হয় কুত্তাবিলাইও একটা বাদ পড়ে নি। কালকাতায় জমিদারবাবুকে খাওয়াবার নাম করে নায়েববাবু হাতিবান্ধার দৈ নিয়েছে হাঁড়ি হাঁড়ি। তার পৌঁছানোর খরচা পর্যন্ত জোগাতে হয়েছে শরাফতকে।-এতো কষ্টের বিল তার, জমিতে পানি সেঁচতে সেখান থেকে নালা কাটতে পারবে না কেন? কাদেরের পরামর্শটা ভালো। নালা কাটার কাজে তমিজকে মাগনা খাটানো যাবে, এই ব্যাপারে প্রথম উৎসাহটা তো তারই।

কিন্তু আমনের খেতে তমিজ নাই, পাশে মরিচের জমিতে হুরমতও নাই। আলের ওপর কুলগাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা হুরমতুল্লার হুঁকা, পাশে তার বদনা ভরা পানি। আবার পাশের জমিতে মাঝে মাঝে কেটে রাখা আগাছার ছোটো ছোটো স্তুপ।-কিন্তু এরা গেলো কোথায়? শরাফত জমিতে মরিচের গাছের বাড় পরীক্ষা করে। এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো নিজের ঘর থেকে ছুটে আসছে হুরমতুল্লা। পথ সংক্ষেপ করতে সে উঠে পড়েছে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ের ওপর এবং তাতে সময় লাগছে আরো বেশি। উঁচু পাড়ে উঠে সে হাঁপায় এবং হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে, ক্যা রে নবিতন, পান লিয়া আয়, পান লিয়া আয়। মেয়ের প্রতি এই নির্দেশে বেশিরকম জোর থাকায় তার গলা চিরে চিরে যায় এবং শুরু হয় কাশি। কাশির দমকে দৌড়ুবার বল পাওয়া যায় না, আবার দৌড়ুবার ফলে কাশির স্বচ্ছন্দ প্রকাশ বিঘ্নিত হয়।

হুরমত শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় শরাফতের সামনে এবং হাঁপাতে থাকে। একই সঙ্গে অনেক কথা বলার উদ্যোগ নিয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে সে ফের চাঁচায়, ক্যা রে নবিতন, কথা কানোত যায় না?

কী গো, তোমরা সব কোটে গেছো? তমিজ কোটে? কিন্তু শরাফতের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেয়ে তাকে আপ্যায়নের গুরুত্ব হুরমতুল্লার কাছে অনেক বেশি। ফের মেয়েকে ডাকতে শুরু করলে ক্লান্তি ও উত্তেজনায় তার গলার। স্বর বেরোয় না, পিঠে কাঁটা বেঁধার ঝুঁকি নিয়েও কুলগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে সে বিড়বিড় করে, কী জ্বালা, কানোত কথা সান্দায় না। এতো ডাক পাড়িচ্ছি, কেউ আসে না।

এর মধ্যে মোষের দিঘির ওপার থেকে ফিরে আসে তমিজ, তার হাতে মাটির সানকিতে পান, শুপারি, চুন ও তামাক পাতা। শরাফত নিজেই পান সেজে মুখে দিলে তমিজ জানায়, ফুলজানের ছেলেটা খেতে বসে হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলো, তার মুখের কষে ফেনা বেরিয়ে যায়। ফুলজান, নবিতন ও ফালানির সমবেত আর্তনাদ শুনে হুরমতুল্লা ও তমিজ দৌড়ে গিয়েছিলো। তমিজের বুদ্ধিতেই চার বছরের ছেলেটির মাথায় পানি ঢালা হলো অনেকক্ষণ ধরে, এখন সে অনেকটা সুস্থ, ফুলজান এখন তাকে ভাত খাওয়াচ্ছে।

কাদের বলে, বেহুঁশ হয়া গেছিলো? ভালো কথা নয় তো। তোমার নাতির না কালাজ্বর শুনিছিলাম। চিকিৎসা করাও না?

হুরমতুল্লা প্রথমে তার নসিব ও নিরুদ্দিষ্ট দায়িত্বহীন জামাইকে গালি দেয় এবং কাদের তার প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেওয়ার জন্যে তাগাদা দিলে সে তার নাতির চিকিৎসার একটি বিবরণ ছাড়ে, আর বছর লাঠিভাঙার যতীন কোবরাজের ওটি হামি লিজে যায়া বড়ি লিয়া আসিছি, ছয় আনা খচর কর‍্যা ওষুধ লিয়া আলাম, দুটা বড়ি খায়া আর খালো না। আর বড়িগুলান ফেরত দিবার গেলাম, কোবরাজ বড়িও লেয় না, পয়সাও দেয় না। তিন মাস আগেও পীরসাহেবের, মহাস্থানের শাহসাহেবের পানিপড়া লিয়া আসিছি দুইবার, সাড়ে চার আনা দিলাম মাজারত, আসা যাওয়ার খরচ-তাও তিন আনা চোদ্দ পয়সা,কতো হলো?

আরে থোও তোমার পানি পড়া! ওষুধ না দিলে ব্যারাম সারে? ছাইহাটার সাকিদারবাড়ির ইমান আলি সাকিদারের বেটা করিমকে দেখাও। এল এম এফ ডাক্তার, নতুন পাস করা আসিছে। নাতিক নিয়া একদিন যাও। দেরি করো না।

বাড়ির কাছে হরেন ডাক্তার থাকতে ছাইহাটা যাওয়ার দরকার কী? ডাক্তার নির্বাচনে শরাফত ছেলের পরামর্শ অনুমোদন করে না, হরেন কি আজকের মানুষ? এদিককার রোগীপত্তর তো সবই তার হাতে।

হরেন ডাক্তার অনেকদিনের লোক ঠিকই, কাদের জোর দিয়ে বলে, কিন্তু একটা মোসলমান ছেলে নতুন প্র্যাকটিস করতে বসিছে, কোয়ালিফায়েড় ছেলে, তাকে একটু হেলপ না করলে কি চলে?

কিন্তু হুরমতুল্লার নাতির চিকিৎসা সংক্রান্ত আলাপে সময় নষ্ট করা শরাফতের পক্ষে সম্ভব নয়। সে তাই তোলে পানি সেঁচার কথা, তমিজ তোর জমিত তো ফাটা ধরিছে। আর কয়টা দিন গেলে।।

তমিজ তো এই প্রসঙ্গটির জন্যেই ব্যর্থ হয়ে ছিলো। মোষের দিঘিতে কোদালের কোপ পড়তে না পড়তে কাজটা বন্ধ হয়ে গেলো, এর ভেতর হুরমতুল্লার কোনো ফন্দি আছে কি-না কে জানে? তবে হুরমত সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও যাতে তার মুখ দিয়ে না বেরোয় সে ব্যাপারে সে খুব হুঁশিয়ার, একটু ভেবে বলে, নালা কাটা হলে আপনার ব্যামাক জমিতই ফসল ভালো হবি। আমি তো খিয়ারেত অনেক–।

না রে, মোষের দিঘি কাটা হবি না শরাফতের এই কথায় কাদেরের উত্তেজনা বাড়ে, প্রস্তুতি নিয়ে সে আরম্ভ করে, শালা জমিদাররা প্রজার ভালো দেখলে–।

তার পাকিস্তান প্রসঙ্গ আসার আগেই শরাফত তাকে থামিয়ে দেয়, তমিজকে বোঝায়, ওই দিঘি তো হামি পত্তন নেমো, বুঝছিস? আগেই নালা ক্যাটা এমন সোন্দর দিঘিটা লষ্ট করি! নালা কাটলেই বর্ষার ঘোলা পানি সান্দাবি। নায়েববাবুক সেই কথাই কবার গেছিলাম।

আবদুল কাদির হাঁ করে বাপের কথা শোনে। এখন নায়েববাবুর শয়তানির কথা চেপে যাচ্ছে দেখে বাপকেও তার দুটো কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু রাফত এখন তার দুই বর্গাচাষার সঙ্গে কালাহার থেকে নালা কাটার আলাপে নিয়োজিত। কিছু বলতে না পারায় কাদেরের রাগ তাই বেড়েই চলে, সে কেবলি থুথু ফেলতে থাকে।

 ১২. বালিশের নিচে মানকচুপাতা

বালিশের নিচে মানকচুপাতা দিয়ে আবদুল আজিজের ছেলের মাথায় পানি ঢালছিলো শরাফত মণ্ডলের দ্বিতীয় বিবি। হুমায়ুনের ভিজে মাথায় চুলে সে বিলি কাটছে বা হাতে। ঠাণ্ডা পানির অবিরাম ধারায় ছেলেটি চোখ বন্ধ করে রয়েছে, ঘুমিয়েও পড়তে পারে। কিন্তু শরাফত ও কাদের ঘরে ঢুকতেই সে চোখ মেললো। চোখ তার টকটকে লাল, লাল রঙে যন্ত্রণার দাগ। কাদের কথা বলতে পারে না, তার খিদাও মনে হয় মরে গেছে। শরাফতের ছোটোবিবি স্বামী ও সৎ ছেলের দিকে একবার তাকিয়েই পানি ঢালা অব্যাহত রাখে। বিছানায় ছেলের শিয়রে বসেছে আজিজের বৌ হামিদা, কিছুক্ষণ পর পর আঁচলে মুখ চেপে সে কান্না সামলাচ্ছিলো। শ্বশুর ও দেওরকে দেখে ভিজে আঁচলটা মাথায় বেশি করে চাপাতে চাপাতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এবং ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলে, এই অজপাড়াগাঁয়ে ছোলেক থুয়্যা কোথায় গেলো, এখন কী করি?

অসুস্থ ছেলে এবং একমাত্র মেয়েকে বাড়িতে রেখে আবদুল আজিজ চলে গেছে কর্মস্থলে। বৌ তো তার আগে থেকেই বাড়িতে ছিলো, ভাদ্র মাসে আউশ উঠলে এসেছে, আমন ধান তোলা পর্যন্ত থাকবে। এ্যানুয়াল পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা বাড়ি আসবে, এই কয়েকটা মাস মাকে ছাড়াই তাদের থাকার কথা। এখন ছোটো ছেলের ঘুসঘুসে জ্বর চলতে থাকায় তার সেবাযত্ন করা আজিজের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব কি পুরুষমানুষের কাজ? ওদিকে জয়পুরে আবার মাছ ভালো পাওয়া যায় না। এক পটলটাই যা মেলে, আবার পটল আর আলু ছাড়া আর সব তরকারি সেখানে নিরেস। বাজারের তরকারিতে কি আর স্বাদ হয়। এখানে বাড়িতে নিজেদের বিল, উঠানে হাঁসমুরগির লেখাজোকা নাই। মায়ের কোলে বসে দিন কয়েক শিংমাগুরের ঝোল আর ঘরের মুরগি আর খেতের তরকারি খেয়ে ছেলে ঝরঝরে হয়ে উঠবে,-এই ভরসাতেই আজিজ তাকে বাড়িতে রেখে গেলো। তা এখানে এসে ভালোর দিকেই তো যাচ্ছিলো। মেয়াদের জ্বর ঘণ্টা তিনেকের বেশি থাকে না, কটা দিন তো দুপুরের জ্বর আসতে আসতে আসরের ওক্ত পেরিয়ে যাচ্ছিলো। ছেলেটা দাদীর ন্যাওটা। অনেক রাত্রে জ্বর ছেড়ে গেলে মায়ের পাশ থেকে উঠে সোজা এসে শুয়ে পড়েছে দাদীর ঘরে, তার কোল ঘেঁষে। রোগ তো তার সেরেই যাচ্ছিলো, দাদী তাকে চুপচুপ করে এক দিন ইলিশ মাছের সর্ষেবাটা দিয়ে ভাতও খাইয়ে দিয়েছে। তাতেও কিন্তু জ্বর তখন তার বাড়ে নি।

কিন্তু আজ দুপুরবেলা থেকে তার গা গরম। রান্নাঘরে খেতে বসে কাঁপতে কাঁপতে পিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছিলো, দাদী ধরে না ফেললে মাটিতে গড়িয়েই যেতো। তারপর থেকে তার প্রবল কাঁপুনি, জ্বরও বেড়ে যাচ্ছে ধা ধা করে। সকালে তাকে বারান্দার রোদে বসতে দেখে হামিদার একটু ভয় হয়, আবদুল কাদেরকে দিয়ে থার্মোমিটারে জ্বরটাও দেখিয়ে নিলো। তেমন কিছু হলে কাদের নিশ্চয়ই বলতো। এদিকে কাদের ছাড়া বাড়িতে কেউ থার্মোমিটার দেখতে জানে না। কিন্তু গায়ে হাত দিয়েই বোঝা যায় জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে।

উঠানের ওপারে পুবদুয়ারি ঘরে শুয়েছিলো শরাফত মণ্ডলের প্রথম বিবি, আবদুল আজিজ ও আবদুল কাদেরের মা। চিরকালের নিয়ম অনুসারে বাড়িতে অসুখ দেখেই সে শয্যা নিয়েছে। জ্বরতপ্ত মানুষের মতো অবিরাম কথা বলে চলেছে এবং সেগুলোকে প্রলাপ বলে বাতিল করা যায় না। তার কথার সিংহভাগ জুড়ে তার স্বামীর নামে নানারকম নালিশ। নাতির রোগের প্রকোপ বাড়তে বাড়তে তার নালিশ চড়ে যায়–সরাসরি গালাগালির পর্যায়ে। যেমন, সারাদিন খালি জোতজমি আর সম্পত্তি তার মাথাত কুটকুট করিচ্ছে। বেটা হামার ব্যারামি ছোলটাকে গুয়্যা গেলো, তার জন্যে একটা ওষধু লয়, পথ্যি লয়, পানিপড়া লয়, পীরমুনসি লয়। জ্বর কি তোমার কামলা কিষাণ না চাকরবাকর? তুমি হুকুম করলা আর জ্বর গেলো?

উঠান পেরিয়ে বড়োবিবির নালিশ এই ঘরে এসে ধাক্কা খায় হুমায়ুনের মায়ের বিলাপের সঙ্গে, বাবা আমার, আব্বা আমার। এখন কেমন ঠেকিচ্ছে বাবা?

মায়ের ব্যাকুল ডাকে চোখ মেলে হুমায়ুন জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, মা, আজ ডিমভাজা দিয়া ভাত দিবা না মা?

শূন্যের সঙ্গে ডিমের সাদৃশ্য থাকায় হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার কয়েকটা দিন ছেলেকে স্কুলে যাবার সময় ভাতের সঙ্গে ডিম দেয় নি বলে আফসোসে হামিদা হাপুস নয়নে কাঁদে এবং রোগ সেরে গেলে তাকে রোজ, এমন কি এ্যানুয়াল পরীক্ষার সময়েও দুটো করে ডিম দেওয়ার মনস্থ করে। মায়ের কান্না এবং সংকল্পকে অগ্রাহ্য করে জ্বরের ঘোরের হুমায়ুন বিড়বিড় করে, আজ খালি ডিম খায়া যাই মা। ভাত খাবো না। আজ তো হাফ ইস্কুল।

এইসব এলোমেলো কথায় সবাই ঘাবড়ে যায় এবং টিনের বেড়ায় লাগানো কাঠের তাকে থার্মোমিটার খুঁজতে গিয়ে আবদুল কাদের মেঝেতে ফেলে দেয় শরাফতের মদনমঞ্জরি বড়ি আর চ্যবনপ্রাসের দুটো কৌটা এবং ওষুধ খাবার খলনুড়ি। কিছুই ভাঙে না, এমন কি কৌটাগুলোর ঢাকনিও খুলে পড়ে না। তবে কাদেরের বুকটা কাপে। অনেকটা সময় নিয়ে ভালো করে ঝেড়ে থার্মোমিটার সে গুঁজে দেয় হুমায়ুনের বগলে। তার মাথায় পানি ঢালার বিরতি ঘটে এবং এতে এই ঘরের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা উঠান পেরিয়ে ঘা দেয় পুবদুয়ারি ঘরে। বড়োবিবি তার নালিশ ফের চড়িয়ে দেয় গালাগালিতে, এই কিপটা বুড়া কারো ব্যারাম হলে একটা পয়সাও খরচ করবি না। কঞ্জুস বুড়া পয়সা জমায় কার জন্যে? হামি কিছু বুঝি না, না? বুড়া বয়সে জোয়ান বৌ আনিছো ঘরত, তার নামে ব্যামাক সম্পত্তি লেখ্যা দেওয়ার মতলব করে। হামি বুঝি না? চান্দে চান্দে কাছারিত যায় কিসক, আমি বুঝি না? কার নামে ব্যামাক দলিল করিচ্ছে, হামি ইগলান বুঝি না? তোমার বেটাবেটি লাতিপুতি মরলে তুমি খুশি, ব্যামাক সাফ হয়া যাক, তুমি থাকো তোমার জোয়ান বৌ লিয়া!

তার অভিশাপ পৌঁছে যায় রোগীর ঘরে এবং অ বৌ, ধরো তো বলে পানির বদনা হামিদার হাতে দিয়ে ছোটোবিবি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা হয়ে উঠানে নামে এবং দুই হাত কোমরে রেখে দাঁড়ায় পুবদুয়ারি ঘরের দিকে মুখ করে। তারপর শুরু করে তার একটানা কথা, মুখ সামলায়া কথা কও আজিজের মাও। তোমার বুড়ার সম্পত্তিত হামি প্যাশাব করি, প্যাশা করি। বলতে বলতে তার কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত সে এমনভাবে দোলায় যে মনে হয়, তার সংকল্পটি এক্ষুনি কার্যকর করতে যাচ্ছে। তবে বর্ষণ না হলেও গর্জন তার চলতেই থাকে, হামার বাপের ট্যাকা লিয়া বুড়া কতো জমি কিনিচ্ছে, সেই খবর তুমি রাখো? হামার নামে জোত করার কথা কয়া বাপজানের কাছ থাকা ট্যাকা লিয়া দলিল করে লিজের নামে। আজই বুড়া চোখ মোঞ্জে তো সম্পত্তি ভোগ করবা তুমি আর তোমার বেটাবেটি।

শরীরের রাগ ভালোভাবে ঝেড়ে ফেলে ঘরে এসে রোগীর শিয়রে বসে ছোটোবিবি কাঁসার বদনাটা ফের নিজের হাতে নেয় এবং আগের মতো একই ধারায় পানি ঢালতে থাকে হুমায়ুনের মাথায়।

কিন্তু থার্মোমিটারে জ্বর দেখে মুখ অন্ধকার করে আবদুল কাদের আড়চোখে তাকায় হামিদার দিকে, এতো পানি ঢালার পরেও ছেলেটার এতো জ্বর? বিচলিত হয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে খোলা থার্মোমিটার হাতেই সে চলে যায় খানকা ঘরে। সেখানে জলচৌকিতে আসরের কাজা নামাজ পড়তে বসেছে শরাফত মণ্ডল। কাদের দাড়িয়ে ছটফট করে। টের পেলেও শরাফতের নামাজের বিরাম নাই, রাকাতের পর রাকাত নামাজ সে পড়েই চলে। অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করে উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ ভাজ করতে করতে শরাফত বলে, তুমি সাইলেকটা লিয়া যাও। হরেনেক সব বুঝায় বললে হরেনই সাব্যস্ত করবি; আর কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগে কি-না ওই কয়া দিবি। তবে ওক একবার লিয়া আসবা। বলতে বলতে শরাফত বারান্দায় যায়। বাইরে উঠানের আমতলায় বুলুর বেটাকে ডাংগুলি খেলার কাঠি চেঁছতে দেখে তাকে সে ধমক দেয়, এই ছেড়া, খালি খেল্যাই বেড়াস। গোরুর প্যাট ওঠে না কিসক রে? তখন দেখি বকনাটা চারির তলা চাটিচ্ছে, জাবনা কি তোর প্যাটত সান্দাছু? প্রায় একই স্বরে একটু নিচু গলায় ছেলেকে নির্দেশ দেয়, কামলাপাট লিয়া যাও। কাছারি থ্যাকা আসার সময় দেখলাম অজিত সাইকেল লিয়া পশ্চিমমুখে যাচ্ছে। কালুর বাপ না হয় ঘোড়াটা লিয়া তোমার সাথে যাক। হরেনের সাইকেল ঘরত না থাকলে ওই ঘোড়াত চড়া আসবি। হরেন আর বছরও ঘোড়াত করাই রোগী দেখবার গেছে, সাইকেল কিনলো তো উদিনকা।

বাড়ির সামনের পাগাড়ের ওপারে বেগুনখেতে কাজ করছিলো কালুর বাপ। বুলুর বেটা তাকে ডাকতে গেলে হঠাৎ করে হুরমতুল্লার নাতির জন্যে কাদেরের সুপারিশের কথা মনে পড়ে শরাফতের, কাদের, তখন তুমি না কার কথা কচ্ছিলা? আরে কী নাম। কল্যা? আরে মোসলমান কোন ডাক্তার, ছাইহাটার কোন ডাক্তারের কথা তখন কল্যা না?

করিমের কথা কন? আবদুল করিম? নাম ঠিকঠাক বলতে পারলেও আবদুল কাদের ওই ডাক্তারকে নাকচ করে দেয়, না না। বাজান, কী যে কন! হরেন বাবু পুরানা ডাক্তার, আগে দেখুক। খালি খালি নতুন ডাক্তারের কাছে যাওয়া–।

দরকার নাই। তুমি তখন কল্যা, তাই।

হরেন ডাক্তার পরপর দুইদিন এলো, জ্বর একটু কমে ফের দ্বিগুণ বেগে জ্বর ও কাঁপুনি হতে থাকলে টাউনের রহমত শেখের জোড়া ঘোড়ার ফিটন ভাড়া করে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো ডাক্তার শিশির সেনকে। শিশিরবাবুর সঙ্গে এসেছে প্রশান্ত কম্পাউনডার, তার হাতে ডাক্তারের ব্যাগ। গাড়ির পিছে পিছে এসেছে চাষীপাড়ার মানুষ, মাঝিপাড়ার মানুষ। কলুপাড়ার গফুর আর গোলাবাড়ির কিছু লোক তো আছেই। মেয়েমানুষও হাজির হয়েছে মেলা। কোলে কোলে ন্যাংটা শিশুরা এবং সঙ্গে বিপুলসংখ্যক বালক বালিকা। বিলের ওপারের নিজগিরিরডাঙার মানুষও ভেঙে পড়েছে মণ্ডলবাড়িতে। এমন কি মরিচের খেত থেকে নিজেকে ছিড়ে নিয়ে হাজির হয়েছে হুরমতুল্লা। হুরমতুল্লা কিছুক্ষণ পর পর আবদুল আজিজকে খুঁজে বার করছে এবং নিয়োজিত থাকছে আজিজের ছেলে সম্বন্ধে প্রশংসা করায় এবং তার রোগ নিয়ে আক্ষেপ করায় এবং প্রশংসা ও আক্ষেপকে বিলাপে রূপ দেওয়ায়। টেলিগ্রাম পেয়ে আবদুল আজিজ এসে পৌঁছেছে শিশির ডাক্তার পোঁছুবার একটু পর; সুতরাং তার টমটমের গতি উদযাপন ও চাকা অনুসরণে উৎসাহী মানুষ বেশি পাওয়া যায় নি।

হুরমতুল্লার মেয়ে এসেছে দুই জন, ফুলজান আর সবচেয়ে ছোটোটা, ফালানি। ফুলজানের কোলে তার ছেলেটি প্রায় সবসময় ঘ্যানঘ্যান করে, মাঝে মাঝে তার কমজোরি কান্না বন্ধ হয় কেবল সে মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লে। তমিজ ঘুরঘুর করছিলো প্রশান্ত কম্পাউনঙরের পিছে পিছে। কম্পাউনডার বাবুর ভার লাঘব করতে তার হাতের ব্যাগ বহন করার জন্যে সে দুটো হাতই বাড়ালো কয়েকবার। কিন্তু প্রশান্ত তার সেবা প্রত্যাখ্যান করেছে বারবার। এমনি রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় আর তমিজ একেকবার ভাবে, দূর, এর চেয়ে বরং জমিতে যাই, বিল থেকে নালা কেটে নেওয়ার কাজটা বরং এগিয়ে রাখি। কিন্তু এতো এতো মানুষ, এরকম জোড়াঘোড়ার ফিটন গাড়ি এবং ডাক্তারবাবু, কম্পাউনডার এবং সর্বোপরি তার হাতের ব্যাগের আকর্ষণ তাকে সেঁটে রাখে মণ্ডলবাড়ির সঙ্গে।

হুমায়ুনের অছিলাতেই কয়েক গ্রামের মানুষ মেয়েমানুষকে আল্লা আজ টাউনের বড়ো ডাক্তার, তার ব্রাহ্মণ কম্পাউনডার, কম্পাউনডারের হাতের ব্যাগ, জোড়া ঘোড়ার ফিটন গাড়ি প্রভৃতি এতো কাছে থেকে দেখার সুযোগ দিয়েছে। সুতরাং হুমায়ুনের প্রতি দায়িত্ব পালনে উচাটন হয়ে তারা ভিড় জমায় রোগীর ঘরের বারান্দায়, বারান্দার নিচে উঠানে, ঘরের দরজায়, এমন কি ঘরের ভেতরে পর্যন্ত। প্রশান্ত নাকে রুমাল চেপে বলে, এ কি, তামাশা নাকি? যাও, যাও। শরাফত, আবদুল কাদের ও হরেন ডাক্তারের ধাক্কাধাক্কিতে লোর্কজন উঠানে নেমে গেলে শিশির ডাক্তার স্টেথসকোপ দিয়ে হুমায়ুনকে নানাভাবে দেখে আর যতোই দেখে ততোই গম্ভীর হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা চোখে সে তাকায় হরেনের দিকে। হরেন অবশ্য কাল থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে। কাল বিকালে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলেছিলো হুমায়ুন। লুঙিতে রক্তের দাগ দেখে হামিদা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায় বিছানাতেই। তখনি শিশির ডাক্তারকে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই গ্রামে শিশির সেন আজ প্রথম এলেও শরাফত মণ্ডলের ছেলেরা চিকিৎসার জন্যে টাউনে গেলে তার চেম্বারেই ধন্না দেয়। আবদুল কাদের তার মোটামুটি ভালোভাবেই চেনা। এই দুই ভাইকে বারবার নাম ধরে ডেকে ডাক্তার আজ দূরত্বটি কমিয়ে ফেলেছে। হুমায়ুনকে বাবা, বাবু, লক্ষ্মীছেলে, এইতো আমার গুডবয় বললে বাড়ির সবাই ডাক্তারের প্রতি গদগদচিত্ত হয় এবং তার ওপর নিরঙ্কুশ আস্থা পোষণ করতে থাকে।

পুবদুয়ারি ঘরে শরাফতের বড়োবিবি ডাক্তারের মুখ দেখতে না পেলেও রোগীর ঘরের আকস্মিক নীরবতা থেকে হুমায়ুনের বিপদের মাত্রা ঠিক আঁচ করে ফেলে এবং নিয়ম অনুসারে বিলাপ করতে করতে গালি দিতে থাকে শরাফত মণ্ডলকে। এই উচ্চকণ্ঠ বিলাপে প্রথমে বিব্রত ও পরে ক্ষিপ্ত হতে থাকে আবদুল কাদের। তবে মায়ের অসৌজন্যমূলক আচরণে ডাক্তার ও কম্পাউনডারের প্রতিক্রিয়া দেখতেই সে বেশি মনোযোগী ছিলো। ডাক্তারের মুখের রেখা এতোটুকু বাঁকা হয় না, কিন্তু প্রশান্ত কম্পাউনডার তার ফর্সা মুখটাকে বাঁকাচোরা করে বারবার তাকায় উঠানের ওপারে পুরদুয়ারি ঘরের দিকে এবং ডাক্তার শুনতে না পায় এমন স্বরে বিরক্তি ঝাড়ে, এরকম চাঁচালে রোগী দেখা যায়? এগুলো সব কী?

ডাক্তারবাবুকে সন্তুষ্ট রাখতে তটস্থ ছিলো আবদুল আজিজ। রোগী দেখার পর ডাক্তারবাবুর হাত ধোবার ব্যবস্থা করতে সে নিজেই বারান্দায় পানির বালতি, বদনা ও জলচৌকি নিয়ে আসে। সাবানের জন্যে ডাক্তার প্রশান্তের দিকে হাত বাড়ালে বেচারা। ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে হয়রান হয়ে পড়ে, নাঃ ব্যাগে সাবান নাই। আজকাল তার এরকম ভুল প্রায়ই হচ্ছে, বাবু এই নিয়ে কথা তুলবে টাউনে গিয়ে। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সে আজিজকে বলে, এদিকে দোকান নাই? সাবান পাওয়া যাবে না?

সাবান? দিচ্ছি। বলে আজিজ ঘরে গেলেও প্রশান্তের সংশয় কাটে না, কাদেরকে জিজ্ঞেস করে হাটের গোলাপি সাবান? তোমাদের ব্যবহার করা না তো?

আবদুল কাদেরের ভুরুতে গেরো পড়ে, গেরো-পড়া ভুরুর নিচে চোখজোড়া কুঁচকে সে তাকায় প্রশান্তের দিকে, আবদুল আজিজ এর মধ্যে নতুন লাইফবয় সাবান এনে দিলে ডাক্তারবাবু দুই হাতে সাবান মাখে, বদনা থেকে পানি ঢালে আবদুল আজিজ। প্রশান্তের কানের কাছে মুখ এনে কাদের বলে, লাইফবয় চলে তো? নাকি লাক্স, পালমোলিভ লাগবে? কন তো তাই না হয় দেই।

প্রশান্ত এবার হাসে বাঁকা ঠোঁটে, তোমাদের তো এখন দিন! কতো কি আমদানি হচ্ছে। তোমরা শিশির ডাক্তারকে নিয়ে আসো! ওরে বাবা! বাড়িতে তো বাবু পিয়ার্স ছাড়া মাখে না। তোমাদের ঘরে বুঝি তাও মজুত রাখো, না কি?

বাইরের ঘরে বসে ডাক্তার নীচু গলায় বলে, একটু দেরি হয়ে গেছে শরাফত মিয়া। আমার সঙ্গে কাদের যাক, ওষুধপত্র নিয়ে আসুক। হরেন ইনজেকশনটা পুশ করবে। দেখা যাক।

কাঁসার মস্ত গামলা থেকে ফুলপাতা আঁকা চিনামাটির বড়ো প্লেটে চামচ দিয়ে পায়েস ঢেলে দিতে কাদেরের বাধো বাধো ঠেকছিলো। কিন্তু দুই চামচ দেওয়ার পর ডাক্তার ব্যস বললে এই খাদ্য গ্রহণে তার সম্মতি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে খুশিতে সে আরেক চামচ ঢালে। টাউন থেকে ডাক্তারকে নিয়ে আসার সময় ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট ও লিপটনের চা নিয়ে এসেছিলো। পায়েসের পর বিস্কুট কয়েকটা খেয়ে চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে ডাক্তার বলে, আঃ! ভেরি গুড!

কিন্তু ঘরের বারান্দায় বসে-থাকা প্রশান্ত কম্পাউনডারকে কিছুই খাওয়ানো গেলো। এমন কি কিসের না কিসের হাঁড়িতে জল গরম করেছে এই ভাবনায় সে চা পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখলো না। এতে শরাফত বা আজিজ মাথা ঘামায় না। কিন্তু প্রশান্তকে খাওয়াবার জন্যে কাদেরের যেন জেদ চেপে যায়, তো কলা চলবে তো? কলায় তো আর জাতের গন্ধ নেই।

কাদেরের এই উত্তেজনায় ঘরের ভেতর ডাক্তার হেসে ফেলে, কাদেরকে ডেকে বলে, কাদের, রাগ করো না। প্রশান্তের ছোঁয়াছুঁয়িটা একটু বেশি। ব্রাহ্মণ সন্তান, আমার বাড়িতেও কিছু মুখে দেয় না, বুঝলে? তুমি কিছু মনে করো না।

কাদের বাইরে এলে প্রশান্ত গলা নামিয়ে বলে, বাবু সায়েব মানুষ, তিনি সবই পারেন। আমরা গরিব বামুন, আমাদের অর্থবল নেই, প্রতিপত্তি নেই, জাতটা গেলে আমাদের আর থাকে কী?

কাদের বলে, জাতপাত নিয়েই থাকেন। আলাদা জাত বলেই তো আলাদা হতে চাই। আলাদা দেশ দিতে আপনাদের এতো গায়ে লাগে কেন?

ফর্সা ও রোগা প্রশান্ত ফের বাঁকা করে হাসে, আলাদা হয়ে থাকতে পারবে? আলাদা হলে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসা করবে কে?

আবদুল কাদেরের তখন রাগ হয় বাপের ওপর, ভাইয়ের ওপর এবং খানিকটা নিজের ওপরেও বটে। স্কুলে লেখাপড়াটা ভালো করে করলেই আই এসসি পড়তে পারতো, তাহলে সোজা মেডিক্যাল কলেজে ঢুকলে ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে আসতো কবে? ম্যাট্রিক পাস করে তো ক্যাম্বেলেও ঢুকতে পারতো। ডাক্তার হতে না পারার দুঃখে আবদুল কাদের কাতর হয়ে পড়ে। নিজেদের মধ্যে ডাক্তার থাকলে এই মালাউন কম্পাউনডারের কাছে আজ তাকে এরকম হেনস্থা হতে হয়? দুটো ভাইকেই ম্যাট্রিক যখন পাস করালোই তখন তার বাপের মাথায় এটা কি ঢুকলো না যে, ফ্যামিলিতে এখন একটা ডাক্তার অন্তত হোক। চাষের জমি বাড়াবার ফন্দি ছাড়া বুড়ার আর কোনো বুদ্ধি খোলে না।-আবদুল আজিজের বড়ো ছেলে বাবর ছাত্র তো খুব ভালো, জয়পুর হাই ইংলিশ স্কুলে হিন্দু ছেলেদের মধ্যেও তার রোল নম্বর হয় ৪/৫। হিন্দু মাস্টাররা কি তাকে ফেল করাবার জন্যে চেষ্টা করে না? তারপরেও তার এই রেজাল্ট। বাবরকে ডাক্তার করতে পারলে এই শিশির সেনেরই পসার নষ্ট হবে। এই তামাম এলাকার মোসলমান রুগীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে টাউনে বাবরের চেম্বারে। এই বেটা মালাউন কম্পাউনডার তার ফার্মেসিতে চাকরির জন্যে এই কাদেরের সুপারিশ চাইবে। চাইতে পারে?—ভাইপোকে বড়ো ডাক্তার বানিয়ে শিশির সেনের পসার মারা এবং প্রশান্তকে তার অধীনে চাকরি দেওয়ার সব পরিকল্পনা পণ্ড হয় তমিজের ডাক শুনে, ভাইজান!

চমকে উঠে বারান্দার নিচে তাকালে ভয়ে আঁতকে ওঠে কাদের : একি? তমিজের ঘাড়ের পাশে বিদুঘুটে একটা ঘ্যাগ গজালো কী করে? তারপর বোঝা যায়, ঘ্যাগ নয়, ওটা একটা মুণ্ডু। তমিজের খালি গতরের ওপর ঘাড় থেকে উঠে এসেছে দুটো মাথা। একটি তার চেনাজানা ও বর্তমানে তাদের বর্গাচাষা তমিজের; আর একটার ঘোলাটে চোখ, ফ্যাকাশে তামাটে মুখ জুড়ে কালচে হলুদ ছোপ। তমিজের ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল তার দ্বিতীয় মাথাটিতে গড়িয়ে পড়েছে ফ্যাকাশে লাল আঁশ হয়ে। ওই মাথায় ঘোলা চোখের নিভু নিভু মণিজোড়া বেঁধা রয়েছে কাদেরের দিকে। ময়লাজমা ওই দুটো চোখের টিমটিম করে জ্বলা ভেঁতা মণি দুটো সামলানো কাদেরের সাধ্যের বাইরে।

ভাইজান, ফুলজানের বেটা। হুরমতুল্লার লাতি গো। নিজের দ্বিতীয় মুণ্ডুটির পরিচয় দিলে প্রথমে মনে হয়, ওটাই আসলে কথা বলছে পরিচিত তমিজের মুখ দিয়ে। ফুলজানের বেটা আস্তে আস্তে কাঁদতে আরম্ভ করলে কাদেরের কাছে দুজনে আলাদা হয়ে যায়। তমিজ বলে, ভাইজান, ছোলটার আজ ব্যায়না থ্যাকা খুব জ্বর। উদিনকার লাকান বেহুঁশ হয় নাই, কিন্তু শরীলেত মনে হয় আগুন ধরিছে। জ্বরের মদ্যে চ্যাংড়া খালি হেল্যা হেল্যা পড়ে। ডাক্তারবাবুক একবার দেখাবার চাছিনু।

শিশুটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে কাদেরের গা শিরশির করে। অনেকদিনের কালাজ্বর ও আজকের প্রবল জ্বরে সে পেয়েছে একটা ভূতের চেহারা। কে জানে তার ওপর কারো আসর টাসর পড়লো কি-না। মোষের দিঘিতে কোদালের কোপ পড়েছে, মহাদেব কি আর কোনো দেও তার মুখে ছাই ছিটিয়ে দিলো নাকি? না-কি কাৎলাহারের খানদানি বাসিন্দা চোখ দিলো তার ওপর? এখন এই ভূতের চিকিৎসা করার অনুরোধ সে ডাক্তারবাবুকে করে কোন আক্কেলে?

এই সময় ডাঃ শিশিরকুমার সেন বারান্দা থেকে নিচে নেমে ঘোড়াগাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে একটু দাঁড়িয়ে সাদা বকে-ছাওয়া শিমুলগাছ দেখছিলো অভিভূত চোখে। পাশে তার আবদুল আজিজ। আজিজের চাপাস্বরের তীব্র ধমকে তমিজ সরে যায়, তবে কয়েক মুহূর্তেই সে দাঁড়ায় গিয়ে ফিটনের সঙ্গে জুতে-দিতে-থাকা জোড়া ঘোড়ার পাশে। ফুলজানের বেটা এখন মায়ের কোলে, মাতৃক্রোড়েও তার রূপের হেরফের হয় নি। তবে তমিজ মুক্ত হয়েছে ভৌতিক মুণ্ডু থেকে। তাই কাদের স্বস্তি পায়, স্বস্তির খুশিতে তার বর্গাচাষা ও দলের কর্মীকে কৃতজ্ঞতা পর্যন্ত জানায়, ফুলজানের বেটাক ভালো ঠেকলো না রে। করিম ডাক্তারের কাছে লিয়া যাস। তখন কলাম না? আমার কথা বললে পয়সা কম লিবি। যাস!

গাড়িতে ওঠার আগে ডাক্তারবাবু আবদুল আজিজের সঙ্গে রোগী সম্বন্ধে শেষবারের মতো কথাবার্তা বলছিলো। গাড়িতে এক কাঁদি শবরিকলা তুলে দেওয়ার তদারকি করছিলো শরাফত মণ্ডল নিজে। ফুলজান ডাক্তারের দিকে এগোবার চেষ্টা করলে শরাফত চাপা গলায় বকে, এই বেহায়া মাগী, তফাৎ যা, তফাৎ যা! একটু তফাৎ যেতেই . ফুলজান পড়ে প্রশান্তের সামনে। প্রশান্ত হঠাৎ শিশুটির গায়ে হাত দিয়ে বলে, জ্বর তো অনেক রে? চোখ দেখেই আমি বুঝেছি।

এতোটা লাই পেয়ে ফুলজান গদগদ হয়ে যায়, তার বাড়ন্ত গলগণ্ড থেকে কথা। গড়িয়ে পড়ে পুঁজের মতো আঠালো হয়ে, ছোলকোনার হামার বারো মাসই ব্যারাম গো বাবা ডাক্তোরবাবু। এানা ওষুধ দিয়া যান গো বাবা। পয়সা হামি সাথথ লিয়াই আসিছি। ওষুধ দিয়া যান বাবা।

সিকি দুয়ানি একানি কানা পয়সা মিলে সে সাড়ে চোদ্দ আনা পয়সা নিয়ে এসেছিলো। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে বলে তমিজ তার কাছ থেকে নিয়েছিলো পুরো আট আনা পয়সা, পয়সা না দিলে ডাক্তার তোমার ছেলের গাওত হাত দিবি না। এখন ফুলজানের আঁচলে বাধা সাড়ে ছয় আনা। তমিজ তো কিছু করতে পারলো না। এখন নিজেই সে মরিয়া হয়ে এসেছে ডাক্তারের কাছে। ওষুধপত্র যা দেয়। এখনি সে কিনে ফেলবে নগদ নগদ, নইলে পরে মাঝির বেটার কাছ থেকে পয়সা কি আর আদায় করতে পারবে?

দিলি তো দিনটা নষ্ট করে। প্রশান্ত রাগ করে, এখন বাড়ি গিয়ে রাতবিরেতে চান করে জলটা স্পর্শ করতে পারবো? শরতের রাতে একটু একটু ঠাণ্ডায় স্নান করার ঝুঁকি নিয়েও প্রশান্ত কিন্তু শিশুটির পেট টেপে এবং এই সিদ্ধান্তে আসে, পেটের পিলেটা তো পিপে হয়ে গেছে রে। হরেন বুঝি এই হাল করে দিয়েছে। না কী?

হরেন ডাক্তারকে অবশ্য কখনো দেখানো হয় নি। ফুলজান তবু তার সন্তানের চিকিৎসা ব্যয়ের একটি হিসাব দাখিল করে, ডাক্তোর কোবরাজ কম করনু না বাবা ডাক্তারবাবু। উদিনকা কয়েস কোবরাজেক দ্যাখানু, লগদ সাড়ে সাত আনা পয়সা খরচ হলো। মহাস্থানের ফকিরের পানিপড়া লিয়া আসিছি জষ্টি মাসোত, বাজানের আসা যাওয়া আর দরগার শিরনি বাবদ গেছে এক পয়সা কম চার আনা। আবার—

এই ব্যারাম কতোদিন হলো রে? প্রশান্ত তাকে থামিয়ে জিগ্যেস করলে ফুলজান বলে, ছোল হামার বারোম্যাসা রোগী গো। ছোলকোনা হামার বাঁচবি না!

বাঁচবে না কেন? ডাক্তার সম্বোধনটির মর্যাদা রাখতে প্রশান্ত কম্পাউনডার প্রেসক্রিপশন ছাড়ে, ব্রহ্মচারীর ইনজেকশন দিতে হবে। কালাজ্বর এখন সারে, এই ইনজেকশন দিলেই সারে। টাউনে নিয়ে আয়, দিয়ে দেবো। ছেলে তোর ঠিক বেঁচে যাবে।

ছেলের আয়ুর নিশ্চয়তা পেয়ে ফুলজানের ঘ্যাগে কাপন ওঠে, তার মোটা ও তামাটে গালে লাগে রক্তের ঝাপটা। তার মুখের সঙ্গে লাগানো শিশুটির কালচে হলুদ ছোপ-লাগা মুখে ও ঘোলাটে চোখে সেই ঝাপটার ছায়া একটুখানি হলেও পড়ে বৈ কি?

 ১৩. প্রশান্ত কম্পাউনডারের ভবিষ্যদ্বাণী

প্রশান্ত কম্পাউনডারের ভবিষ্যদ্বাণী শিরোধার্য করে ফুলজানের বেটা বেঁচেই থাকে। সারা শরীরের রক্ত চুষে পিলেটা তার নাদুসনুদুস হয়, তার পেট মনে হয় রোজই একটু একটু করে ফোলে। ইনজেকশন তাকে দেওয়া হয় নি। করিম ডাক্তারের কাছেও যাওয়া হচ্ছে না। আবদুল আজিজের ছেলে হুমায়ুন মারা যাওয়ার পর কাদের কয়েকটা দিন মনমরা হয়ে পড়ে রইলো ঘরেই, সপ্তাহখানেক পর গা ঝেড়ে উঠে লীগের কাজে এতোটাই জড়িয়ে পড়েছে যে তার নিশ্বাস নেওয়ার সময়টুকু নাই। সাইকেলে করে আজকাল তাকে যেতে হয় অনেক দূরের গ্রামে গ্রামে। টাউনেই যেতে হচ্ছে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন। তার কেরোসিন তেলের বিক্রিও বেড়ে গেছে অনেক বেশি। এই ইউনিয়নে কেরোসিন আর কোথাও মেলে না, কয়েক গাঁয়ের মানুষ কেরোসিন তেল কিনতে ভিড় জমায় তার দোকানের সামনে। দোকানে গফুর কলুর দাপট, গফুর তেল বেচে আর পাকিস্তানের ভাষণ ছাড়ে। লোকের না শুনে উপায় নাই। আর মানুষ দিনরাত খালি এইসব গল্পেই মেতে থাকে। কাদেরের সঙ্গে ফুলজান ছেলেকে নিয়ে একটু দেখা করার সুযোগ পায় না।

ইনজেকশন সম্বন্ধে তমিজ একটু আধটু খবর রাখে; উঁচু একবার ঢোকালে শরীর। থেকে সেটা যে ফের বের করা যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নাই। এ ছাড়া তমিজ ব্যস্তও তো কম নয়। চারপাশে আমন কাটার ধুম পড়ে গেছে। এদিকে আমনের চাষ তো আগে ছিলোই না। বছর তিনেক হলো একটু উঁচু ডাঙা জমি কেউ আর খালি রাখে না, রোপা আমন লাগায়। শরাফত মণ্ডলের গিরিরডাঙার সব জমিতে আমনের ফলন বেশ ভালো। এখানে তার আধিয়ার হামিদ সাদিকার নিজেও মাঝারি গেরস্থ; তার নিজের জমি বেশিরভাগই দোপা বলে আমন সে তেমন সুবিধার করতে পারে নি। কিন্তু শরাফতের জমিতে ধান সে তুলেছে মেলা। নিজের বাড়ির পালান পেরিয়ে বিঘা চারেক জমি শরাফত মণ্ডল কখনো বর্গা দেয় না, চাষ করায় তার বছর কামলাদের দিয়ে। ধান রোপা থেকে শুরু করে কাটা এবং কাটার পর মাড়া এবং তারও পর গোলায় তোলা পর্যন্ত সব সে দেখে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সেখানে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটায়, তা বিঘা দেড়েক তো হবেই, শালি ধানের চাষ করেছে মণ্ডল। কালিজিরা শালি ধানের চাষ এবারেই সে প্রথম করলো। কী করবে?–বেটার বৌয়ের বাপের বাড়ি টাউনের ধারে, চাঁদে চাঁদে তারা পোলাও খায়; বলতে কি, বড়ো বেটা আর বেটার বৌয়ের হাউসেই এই ধান বোনা হলো। সারাদিন ওই ধান কেটে তমিজের নাকে মুখে সারা গায়ে পোলাওয়ের চালের সুবাস।

তমিজের জমিতেও ধান এবার ভালো। কাৎলাহার বিল থেকে নালা কেটে সেঁউতি দিয়ে পানি সেঁচে সেঁচে তমিজ তার জমির চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। কার্তিকে জমিতে যে চিড় ধরেছিলো, তা সম্পূর্ণ ঝুঁজে গিয়ে মাটি সেখানে এই পৌষেও কালো কুচকুচ করে। অথচ দেখো, পাশেই রাস্তার মাটির রঙ সেখানে হাড়ের মতো ময়লা সাদা। জমিতে ধানের গোছা তার বেশ ভারি, শীষের ভারে ধান গাছ নুয়ে পড়ে। ধানের রঙও দিন দিন হচ্ছে পাকা সোনার মতো। পাশ দিয়ে যে-ই যায়, সে বাপু যতো ঝানু চাষাই হোক, কিছুক্ষণ দাঁড়াবেই। আলের ওপর দাঁড়িয়ে শমশের পরামাণিক সেদিন আর চোখ ফেরাতে পারে না। খুশিতে সে ডগমগ, মাঝির বেটা, তুই কী করিছু রে? তোর হাতের বরকত আছে বাপু। তাও তো শীষের ছড়া ছাড়া শমশের আর কিছুই দেখে নি। পাকা শীষ মাথায় করে কালো মাটির দিকে মাজা একটু হেলে দাঁড়ানো পুরুষ্টু উঁটিগুলোকে দেখে শুধু তমিজ নিজে। ধানখেত কিন্তু নিজের রঙকে কখনোই সম্পূর্ণ করে দেখায় না; ভোরে শিশিরে এটা টলটল করে, দুপুরবেলা ধানের শীষ থেকে রঙ নিয়ে রোদের তেজ বাড়ে, রোদকে দিয়ে থুয়ে ধানের রঙ হয় একটু ফ্যাকাশে। আবার পৌষের বেলা তাড়াহুড়া করে হেলে পড়লে এই জমিতেই পড়ে হালকা ছায়া, শীষগুলো তখন তাকিয়ে থাকে নিজের ছায়ার দিকে। তারপর সন্ধ্যায় কুয়াশার ভেতর মাথা গুঁজলে ধানখেতটাকে চেনা যায় না, এটা তখন কার কবজায় বোঝা দায়!

ভোরবেলা শীত পড়ে। পিরানের ওপর একটা কথা জড়িয়েও তমিজের জাড় করে। ধানগাছও একটু একটু কাঁপে। তখন নিজের শিরশির করা আর ধানগাছের কাঁপুনির কোনটা কার তমিজ ফারাক করতে পারে না।

দিনমান শরাফতের অন্য কোনো জমিতে ধান কেটে কিংবা ধান কাটার তদারকি করে হুরমতুল্লা সন্ধ্যার আগে আগে মরিচ খেতে এসে নিড়ানি দেয়, মরিচ গাছের গায়ের ময়লা সাফ করে। বেলা ডোবার পর এদিকে মানুষজন থাকে না, মোষের দিঘির ওপারে। হুরমতের বাড়ি থেকে ধোঁয়া ওঠে। হুরমত কিন্তু জমি থেকে ওঠে না। কোনো কোনো দিন হুঁকায় কল্কে সাজিয়ে আনে ফুলজান। একেক দিন তার হাতে থাকে পোড়া মিষ্টি আলু। বাপকে আড়াল করে এক-আধ টুকরা আলু সে এগিয়ে দেয় তমিজের দিকে। কোল থেকে বেটাকে নামিয়ে কুলগাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে বসিয়ে রেখে সে জমিতে। হাত লাগায় বাপের সঙ্গে। ঠাণ্ডায় ছেলেটা তার হি হি করে কাঁপে। তমিজ তখন তাকে কোলে নিয়ে নিজের শরীরের ওম দেওয়ার চেষ্টা করে। ফুলজানের বেটা আরামে মাথা ঠেকিয়ে দেয় তমিজের বুকে। বুকটা তমিজের ভার ভার ঠেকে;—এটা কি এই পেট-ফোলা ছেলেটার শরীরের ভারে কি-না সে ঠিক ঠাহর করতে পারে না। মরিচখেতের হালকা কুয়াশার ভেতর থেকে ফুলজান তার বেটা কোলে বসে-থাকা তমিজকে দেখতে পায় কিনা সন্দেহ। দেখলে ভালোই হয়!

হুরমতুল্লার বড়ো বেটির সবই ভালো। সুযোগ পেলেই তমিজের হাতে পোড়া আলুটা, চালের আটার রুটিটা কিংবা ঠাণ্ডা একটা ভাপা পিঠা গুঁজে দেয়। আবার বাপ অন্যমনস্ক থাকলে তমিজকে জমিতে সাহায্য করতেও তার আপত্তি নাই। মেয়েমানুষের নিড়ানির হাত যে এতো ভালো না দেখলে বিশ্বাস হবে না।—সবই ভালো। দোষ তার একটাই। তমিজকে সে মাঝির বেটা বলে বড়ো হেলা করে। আর একটা দোষ।–কী?—ওই যে শিশির ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিতে তমিজকে আট আনা পয়সা দিয়েছিলো সেটা সে এক ঘড়ির জন্যেও ভুলতে পারে না। তমিজ তো সেখান থেকে কিছু খরচও করে ফেললো। না, নিজের জন্যে নয়।-বৈকুণ্ঠকে দিয়ে টাউনের কালীবাড়ি থেকে পাদোদক এনে দিয়েছে দশ পয়সা খরচ করে। দশ পয়সা আর বৈকুণ্ঠ পান খেতে নিয়েছে দুটো পয়সা। টাউনের কালীবাড়ির জবাফুল ধোয়া মায়ের পাদোদক ভক্তি করে খেতে পারলে মরা মানুষও লাফ দিয়ে ওঠে। ফুলজানের বেটার কিছু হলো না। হবে কী করে?—সব নষ্ট করলো ওই শালা কলুর বেটা গফুর। গোলাবাড়ি হাটে একদিন হুরমতুল্লাকে সে শুনিয়ে দিয়েছে, মাঝির বেটা তোমার বেটির পয়সা আর ফেরত দিছে! আবার হিন্দুর ঠাকুরের পানি লিয়া আসিছে? আরে, হিন্দুর ঠাকুর, তাই মোসলমানের বালামুসিবত আসান করবি কিসক? এটা শুনে ফুলজানের মনটা বিষিয়ে উঠেছে, পাদোদকে তার আর ভক্তি রইলো না। বেটার ব্যারাম সারে কী করে? এরপর থেকে পয়সা ফেরত পাবার জন্যে ফুলজান খালি ঘ্যানঘ্যান করে। তমিজ কতোবার বলেছে, ধান কাটলেই কড়ায় ক্রন্তিতে সব শোধ করবে। তো শোনে না।

কিছু পয়সা তমিজ এখনি যে দিতে পারে না তা নয়। মানুষের জমিতে জমিতে ধান কেটে কামাই তার মন্দ নয় এখন। বাড়িতে রাত্রিবেলা রোজ ভাত জুটছে, সকালে পান্তা কি কড়কড়া না খেয়ে বাপ বেটা ঘর থেকে বেরোয় না। এ ছাড়াও এদিক ওদিক থেকে কিছু কিছু আসছে। এই তো, আবদুল কাদের সেদিন গোলাবাড়ি হাটে লীগের ছেলেদের খাওয়াবার জন্যে জিলিপি আর পান বিড়ি কিনতে তমিজকে পুরো একটা টাকার নোটই দিলো, খরচ হলো সাড়ে বারো আনা, বাকি পয়সাটা পরদিন পর্যন্ত তমিজের কাছেই ছিলো। সে নিজে থেকে দুই আনা ফেরত না দিলে আবদুল কাদের মনেও করতে পারতো না। পুরো চোদ্দটা পয়সা রেখে দিলেই ভালো হতো। সোমবার হাটের দিন মুকুন্দ সাহার আড়তে আদার বস্তা উঠিয়ে দিতে তাকে ডেকে নিলো বৈকুণ্ঠ গোরুর গাড়ি থেকে বারোটা বস্তা নামিয়ে দোকানে উঠিয়ে দিলো সে আর বৈকুণ্ঠ। বস্তা ওঠাবার পর আড়ালে ডেকে বৈকুণ্ঠ তার হাতে তিন আনা পয়সা গুঁজে দিলো। বাবুর কাছ থেকে নিশ্চয়ই আরো বেশি নিয়েছিলো। তা নিক। তিন আনা পয়সাই বা কম কী? সেখান থেকে খামাখা দুই আনা দিয়ে ট্যাংরা মাছ না কিনে ফুলজানকে দিলেও তার ধারের পরিমাণটা একটু কমে যেতো।

আবার হাটবারের একদিন পর নিজগিরিরডাঙায় কামারপাড়ায় শরাফত মণ্ডলের জমিতে ধান কাটা হলো। আধিয়ার যুধিষ্ঠির কামার। হায়রে, কামারের বেটা নিজের জমি নিজেই বর্গা চাষ করলো। আকালের সময় যুধিষ্ঠিরের বাপ ধান নিয়েছিলো জগদীশের কাছ থেকে, সুদে আসলে যা হয়েছিলো তাই শোধ করতে জমি বেচলো সে শরাফতের কাছে। শরাফতের হাবভাব বোঝা দায়। কামারের বেটাকে তার নিজের জমি বর্গা দাও, ভালো কথা, কিন্তু তমিজের বাপের ভিটার সাথে লাগোয়া জমিটা তমিজকে দিতে দোষ কী? তমিজ কি তার বাপ কি আর গোলমাল করার লোক? যুধিষ্ঠির তো মেলা গাইগুই করলো। কী সমাচার?–না, আঁটি কোবান দিয়েই ধান সে একবার তুলতে চায় মণ্ডলের গোলায়। আঁটি খুলে গোরু দিয়ে মাড়িয়ে খড় দেবে পরে। মণ্ডল রাজি নয়। ভিজে ধান সে নেবে না। আর ধান-ছাড়ানো আঁটি কামারের বাড়ি রেখে এলেই কামারের বেটা পরে ওখান থেকে মেলা ধান বার করবে। হোক সেটা ঘোলানো ধান, তার দাম যতোই কম হোক, শরাফত নিজের ন্যায্য ভাগ ছাড়বে কেন? যুধিষ্ঠিরকে শেষপর্যন্ত জোতদারের কথাই মানতে হয়। কিন্তু এই নিয়ে মণ্ডলের সঙ্গে ছোঁড়া একটু বেয়াদবিই করে এসেছে। আবার মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের সাদা বকের কয়েকটা নাকি যুধিষ্ঠিরের ওপর উড়ে উড়ে ওদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলো। এতে মণ্ডল আরো রেগে গেছে। বকের ঝাক তো এসেছিলো কামারপাড়া থেকেই, যুধিষ্ঠির কি আবার তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে তুকতাক করছে নাকি? কিন্তু তমিজের বাপ সেদিন রাতে জড়িয়ে জড়িয়ে। তমিজকে বলছিলো, নেমকহারাম বকের ঝাক আসলে গিয়েছিলো কামারবাড়ির খুলিতে মণ্ডলের ধানের পরিমাণ দেখে আসতে।।

তা বাপু, যুধিষ্ঠির আর মণ্ডল যা ইচ্ছা করুক, তমিজের তাতে কী? যুধিষ্ঠির মানুষটা ভালো। কামলাপাটকে পয়সা যা দেওয়ার দিয়েছে, খাওয়া দিয়েছে ভালো। ওখানে ধান কেটে তমিজের পয়সা যা মিললো, তাতে ফুলজানের পয়সা মিটিয়েও মেলা থাকতো। তবে, পয়সা জমানো দরকার। পয়সা এলো, আর একে ওকে দিয়ে আর মাছ কিনে আর। বাতাসা কিনে সব উড়িয়ে দিলো, তো গোরু কিনবে কী করে? তবে ফুলজানের চটাং চটাং কথা শুনে একেকবার ভাবে, দুত্তোরি দিয়েই দিই। কিন্তু ফুলজান তখন তার কাছে আর চাইবে কী?

মাঝির বেটা তমিজের সঙ্গে বেটির এইটুকু মেলামেশায় হুরমতুল্লা তেমন গা করে। হাজার হলেও বেটির তার স্বামী আছে একটা, মানুষ কতো দূর আর বলতে পারবে? নবিতনের ব্যাপারে বুড়া কিন্তু টনটনা, ওর কাছে তমিজকে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। তবে নবিতন তো একটু ফুটানিওয়ালি, রাতদিন কাঁথা সেলাই নিয়ে থাকে, কিছুদিন বাদে বাদে কাপড় খারে দেয়, চুল আঁচড়ায় রোজ কাকই দিয়ে। এইসব মাঝি আর কলু, ঘরের পুরুষমানুষকে সে মোটে আমলই দেয় না। সেদিক থেকে হুরমতুল্লা নিশ্চিত। আর তমিজের সঙ্গে হুরমতুল্লা অতো ঠাস ঠাস করে কথাও কয় না। ছোঁড়াটাকে দিয়ে তার উপকার তো কম হলো না। বিল থেকে নালা কাটার কাজটা তমিজ করলো বলতে গেলে একলাই। হুরমতুল্লার মরিচের খেতে ফলন এবার আল্লায় দিলে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো হবে। মরিচের যেমন বাড়, তাতে ফাল্গুনেই মরিচ তোলা যাবে। মুকুন্দ সাহা মণ্ডলকে মরিচের দরও মনে হয় ভালোই দেবে।–তমিজ সব ধরতে না পারলেও কিছু কিছু তো আঁচ করতে পারেই। তমিজ দেখে মরিচের খেতে নিড়াতে নিড়াতে হুরমতের চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে। এখন সেটা মণ্ডলের মরিচের লাভের কথা ভেবে খুশির আবেশে না নিজের খাটনির ক্লান্তিতে তা সে বুঝতে পারে না।

তমিজের চোখ খামাখা ঝুঁজে আসে না, জেগে থাকলে চোখজোড়া তার খোলাই থাকে। কিন্তু আজ শমশের পরমাণিকের জমির ধান কেটে তার বাড়ির নিকানো উঠানে আঁটিগুলো ফেলতে ফেলতে তার বুকটা হঠাৎ ধক করে ওঠে। বুকে অমন ধাক্কা দিলো কে, কেন দিলো কিছু বোঝা যায় না। এরকম আলগা ব্যারাম তো তার কখনো হয় না। কারণটা সে বুঝতে পারলো বাড়ি থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা ভাত খেতে বসে।

ক্যা গো, মানষের জমির ধান কাটো, তোমার লিজের ধান তুলবা কুনদিন? কুলসুমের এই সাদামাটা প্রশ্নে তার সারাদিনের কাঁপুনির কারণ বুঝলো তমিজ। তবে ধান কাটতে তার দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? হুরমতুল্লা বলে, দেরিতে রোপা হয়েছে, আরো সপ্তাহ খানেকের আগে তার জমির ধান কেটে লাভ নাই। বুড়াকে বিশ্বাস কী? সময় চলে গেলে ধান কেটে খন্দের সর্বনাশ। তার মানে মাঝির বেটাকে বর্গা থেকে উচ্ছেদ করিয়ে ওই জমি হুরমতুল্লা নিয়ে আসবে নিজের চাষে। বুড়া কি কম শয়তান?-তমিজ সারাদিন পর হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে : জমি ভরা ধান, আর আজ একবারের জন্যেও সে জমিতে যায় নি। সেখানে কার না কার নজর লাগলো, সেখানে কী না জানি হয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে তার ঘুম আসে না। কিংবা ঘুমের পাতলা পর্দার নিচে ছটফটট করে। তার বাপ ঘুমায় পাশের ঘরে। ভেতরের উঠানের দিকের ঝাপ খুলে চৌকাঠে বসে একটানা গুনগুন করছে কুলসুম। আধধা আধো ঘুমে অথবা তন্দ্রায় অথবা জেগে থেকেও হতে পারে, তমিজ কুলসুমের একঘেয়ে সুরের গীত শোনে,

সুরুজে বিদায় মাঙে শীতেতে কাতর।
ধান কাটো ফাটে ভরা শীষের অন্তর।।

একঘেয়ে সুরেই তমিজের মাথার জট খোলে, বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে নেমে পড়ে উঠানে। কুলসুম ওখানে বসে থেকেই বলে, এই জাড়ের মধ্যে তুমি কুটি যাও? তোমার বাপের ব্যারাম ধরলো?

ইগলান ব্যারাম হামার হয় না ফকিরের বেটি। উগলান ফকিরালি ব্যারাম, তোমার দাদা দিয়া গেছে হামার বাপোক। হামার বলে ধান দেখা লাগবি না?

এই জাড়ের মধ্যে যাবা পাথারের মদ্যে? গাওত খালি একটা পিরান, জাড় করবি না?

যাওয়াই লাগবি গো। তামা ন দিন আজ যাবার পারি নাই।

সে সামনে পা বাড়াতেই তার পিঠে পড়ে কুলসুমের সুতি চাদর। কুলসুম চাদর দিয়ে বলে, গাওত দিয়া যাও।

এই চাদর এবার পাওয়া গেছে আবদুল কাদেরের দৌলতে। পাউডার দুধ, সুতির র‍্যাপার, উলের সোয়েটার, কুইনাইন ট্যাবলেট আর দেশলাই নিয়ে এসেছিলো রেড ক্রসের দল। দলের সর্দার আবার কাদেরের জানাশোনা মানুষ। মুসলিম লীগের টাউনের নেতা। কাদের বলে, শিক্ষিত মানুষ, আগে ছাত্রনেতা ছিলো। এখন টাউনে বাপের বাড়িতে আসিছে। লোকটার বয়স কম, তিরিশ বত্রিশও হবে না। কিন্তু জুলফিতে পাক ধরেছে এখনই। শ্যাম বর্ণের লম্বা মানুষটির গায়ে বোতাম লাগানো লম্বা মোটা পিরান। কাদের বলে, এর নাম আচকান। সেই কালো আচকান আর সাদা পায়জামাপরা। লোকটির মুখে প্রায় সবসময় সিগ্রেট থাকলেও তার গলার স্বর ভারী গম্ভীর ও ভিজে ভিজে বলে তার কথা শুনতে ভালো লাগে। সবার সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলতে পারে, এমন কি এই রিলিফ দেওয়ার সময়েই একদিন সে মুকুন্দ সাহাকে ডেকে বলে, এই যে সাহামশায়, কলকাতায় আমার নামে কম্পেইন করেছেন। আমাকে বললেই তো হতো! নালিশ মুকুন্দ সাহা করে নি, তার নাম দিয়ে করেছে টাউনের কংগ্রেস নেতা নলিনাক্ষবাবু। তো নালিশটা কী?গোলাবাড়িতে রেড ক্রসের রিলিফ দেওয়া হচ্ছে মুসলিম লীগ অফিস থেকে। কাদেরের দোকানে লীগের সাইনবোর্ড। রেড ক্রসের মাল, নাম হবে মুসলিম লীগের। এটা কেমন কথা? এই নালিশ সম্বন্ধে মুকুন্দ সাহা কিছু বলার আগেই রেড ক্রসের ওই লোক বলে, বেশ তো আপনার ঘরে জায়গা দিন না! আপনি কংগ্রেস, মহাসভা যার সাইনবোর্ড টাঙান আমার আপত্তি নেই। আমতলি থানার কাছে ধীরেনবাবুর ঘরটা চাইলাম, সেখানে তো কংগ্রেসের আখড়া। আমার কোনো আপত্তি নেই, লোকে রিলিফ পেলেই হলো। তো ধীরেনবাবু রাজি হলেন না। এখানে কাদেরের দোকানে জায়গা পেলাম। বাধা দেবেন, অথচ জায়গাও দেবেন না, এ কেমন কথা?

মুকুন্দ সাহা সুরসুর করে সরে গেলে কিছুক্ষণ পর আসে বৈকুণ্ঠ গিরি এবং তার জন্যে সুপারিশ করে কাদের, ইসমাইল ভাই, সাহার আড়তে কাজ করলে কী হবে, এই চ্যাংড়াটা ভালো। ইসমাইল হোসেন তাকে সুতির চাদর আর একটা উলের সোয়েটার তো দেয়ই, তার বাবুর জন্যেও পাঠিয়ে দেয় একটা ভালো সোয়েটার। পাউডার দুধ নিয়ে বৈকুণ্ঠ রেখে দিলো কাদেরের দোকানেই, বাবু আবার বিলাতি দুধ দেখ্যা কী বা কয়! সুতির চাঁদরের ওপর সোয়েটার চড়িয়ে বৈকুণ্ঠ হাটময় টহল দিয়ে বেড়াতে লাগলো। সোয়েটার কিন্তু তমিজকে দেওয়া হলো না। কাদের বলে, সোয়েটার পরলে এসব মানুষের গা কুটকুট করবে। দুধের টিনটাও রেখে দিলো কাদের, ইগলান বিলাতি দুধ, খাবার পারবি না। তুই বরং দুইটা চাদর লে। একটা তোর বাপকে দিস। বাপকে সবুজটা দিয়ে নিজের খয়েরি চাদরটা তমিজ দিয়ে দিলো কুলসুমকে। একদিন গায়ে দিয়ে কুলসুম সেটা রেখে দিয়েছিলো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ভেতর।

আজ সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে কালাহার বিলের উত্তর সিথান ঘুরে তমিজ নিজের জমিতে পৌঁছুলো, গিরিরডাঙায় তখন অনেক রাত্রি। চারদিকে ধানের জমি, বেশিরভাগ জমিতে ধান কাটা হয়ে গেছে। এর ফাঁকে ফাঁকে মরিচের খেত। চারদিকে ফসল, না হয় ফসল কাটার চিহ্ন। মোষের দিঘি থেকে পানি খেয়ে ছুটে পালিয়ে গেলো বিলের উত্তর সিথানের কয়েকটা শেয়াল। মুনসির তাপে এরা রাতে বিলের পানিতে মুখ লাগাতে পারে না। শেয়ালগুলো চলে গেলে তমিজ একেবারে একা।

দিঘি, এদিকে মাঠের পর মাঠ, ওপরে আকাশ পর্যন্ত কুয়াশা জড়ানো চাঁদের আলো। তমিজের জমিতে পাতলা কুয়াশা টাঙানো রয়েছে মশারির মতো, মশারির ভেতরে ঢুয়ে-পড়া আলোয় তার ধানগাছগুলো ঘুমিয়ে রয়েছে মাথা ঝুঁকে। চাঁদের আলো। এই ধানখেতে ঢুকে আর বেরোয় না, ধানের শীষে গাল ঘষতে ঘষতে ধানের রঙ চোষে চুকচুক করে। আবার আলো পোয়াতে পোয়াতে ঘুমায় সারি সারি ধানগাছ।

নয়ন ভরে নিজের জমি দেখতে দেখতে হঠাৎ করে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়, ধানখেতে তার নজর লাগলো না তো? কিন্তু মরিচের খেতে নজর পড়তেই তমিজের সারা শরীর থমকে গেলো, আবার শরীরটাকে স্থির রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে, বুকের ভেতর থেকে হিম বাতাস বেরোয়, ভয়ে তমিজ তার শিসটা পর্যন্ত শুনতে পায় না। এই চাঁদনি রাতে হুরমতুল্লার মরিচের খেতে হানা দিতে এসেছে সে কোন জীব?

বিলের উত্তর থানের মুনসি কি তার মাছেদের আধার জোগাড় করতে এখানে এসে হাজির হয়েছে নিজেই। তমিজ তো ওইদিক দিয়েই এখানে এলো। কৈ কিছু তো মনে হলো না। পাকুড়গাছের নিচে নিয়ে এলে হয়তো চোখে পড়তো। পাকুড়গাছের তলায় তো সে যায় নি, দেখবে কোত্থেকে? পাকুড়তলা আরো উত্তরে। গাছটা কি তমিজ কখনো দেখেছে? তার মনে পড়ে না বলে ভয় আরো বাড়ে, হুরমতুল্লার জমির ওই প্রাণী তা হলে মুনসির কেউ না-ও হতে পারে। আরো অপরিচিত, একেবারেই অচেনা কোনো কিছুর ভয়ে তমিজ যখন চোখ বন্ধ করে ফেলেছে তখন তাকে উদ্ধার করে হুরমতুল্লার কাশির আওয়াজ।

এই শীতের রাতেও বুড়ার চোখে ঘুম নাই। এখন সে এসেছে জমির তদবির করতে বুঝতে পেরেই তমিজের মনে পড়ে, কার্তিক মাসে এভাবেই সে পানি টেনে দিয়েছিলো তার জমি থেকে। তখন তো তার সঙ্গে ছিলো ফুলজান। এখন সে আসে নি? আসে নি কেন? নিজের ধানখেত ও হুরমতুল্লার মরিচখেতের মাঝখানে আলের ওপর দাঁড়িয়ে সে এদিকে ওদিক দেখে। আল্লার কী কাম, ঠিক সেই সময়েই এসে হাজির হলো ফুলজান। মোষের দিঘির ধারে এসেই সে বাপজান বলে হাঁক দেয়। তার ডাক কেঁপে কেঁপে ওঠে, তমিজকে ছায়ার মতো ঠেকছিলো বলে সে হয়তো একটু ভয়ই পেয়েছে। কুয়াশা ও চাঁদনিতে তার কালো গতরটা সাদাটে কালো দেখায়, বলতে কি তার গায়ের রঙ এখন ফর্সার ধার ঘেঁষে।।

কাছে এসে তমিজকে দেখে ফুলজান খুব অবাক, তবে তার বিস্ময়কে ছাপিয়ে ওঠে তার বদ খাসলত, ক্যা, গো, হামার পয়সাটা দিলা না? ধান কাটিচ্ছে সারা মুলুক জুড়া, পয়সা তো ভালোই কামাচ্ছো। খালি হামার হাওলাতটা শোধ করতে তোমার পাছা কামড়ায়, না?

এইসব শুনেও তমিজের পাছা কেন, কোনো অঙ্গই একটুও কামড়ায় না। বরং তাকে পুরো আট আনা, আট আনাও নয়, বারো আনা পয়সা দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। একটু তাড়াহুড়া করেই সে বলে, কাল দেমো। কালই দেমে। সুদও না হয় দেমো।

মাঝির কথার কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? বলতে বলতে ফুলজান বাপের দিকে এগুলে হুরমতুল্লা বলে, আর অল্প এ্যানা জায়গা সাফ করা উঠিচ্ছি। কততক্ষণ লাগবি? পাঁচুন দিয়ে জমির আগাছা তুলতে তুলতে সে আপনমনে বলে, চাঁদের আলো যখন আছে তখন কাজ করতে আর আপত্তি কী? আল্লা সুরুজ দিয়েছে মানুষের চাষবাসের সুবিধা হবে বলেই তো। আর যেসব রাতে আল্লা চাঁদ জ্বালিয়ে দেয় সেসব হলো কাজের রাত্রি, চাঁদনি রাতে রাতভর কাম করো।-আল্লার প্রতি শোকরানা গুজার তার চাপা পড়ে হঠাৎ কাশির দমকে।

ফুলজানও হঠাৎ বাচাল হয়ে ওঠে, গোঁ ধরার মতো করে বলে, না বাপজান, ঘরত যাও। কাল বেনবেলা বেলা ওঠার আগেই যাওয়া লাগবি গিরিরডাঙা, মণ্ডলবাড়ি থাকা মানুষ আসিছিলো।

আল্লা চাঁদটাকে নিভিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত হুরমতুল্লা উঠবে না বলে স্থির করেছিলো। কিন্তু ফুলজান তার পাশে বসে হাত থেকে পাঁচুনটা টেনে নিয়ে বলে, এখন ওঠো।। তোমার না আজ বেনবেলা জুর আসিছিলো। কাল ব্যায়না পান্তা খায়ো না। কড়কড়া আছে, ত্যাল মরিচপোড়া দিয়া নবিতন ম্যাখ্যা দিবি, তাই খায়া যায়। তুমি যাও। তোমার পাঁচুন হুঁকা আর হোঁচা হামি লিয়া আসিচ্ছি।

বড়ো মেয়ের এরকম আদুরে কিসিমের হুকুম হুরমতুল্লা জীবনে শোনে নি, বাপের ঠাণ্ডা লাগায় এমন উদ্বিগ্ন হওয়া কি আর এই মেয়ের ধাতে আছে? এ রকম সোয়াগের কথা বলে তার মেজোমেয়ে নবিতন। হুরমতের কাশি তো সবসময় লেগেই থাকে, আবার শীত বাড়ার সাথে সাথে ঘুসঘুসে জ্বরও তার নতুন কিছু নয়। ফুলজানের ঘ্যাগ। থেকে গলা হয়ে বেরুনো এরকম আদরে সোয়াগে হুরমতুল্লার কাছে তার নিজের শরীর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সত্যি সত্যি সে উঠে দাঁড়ায়। তাড়তাড়ি আয়। বলে হুরমতুল্লা রওয়ানা হলে তার টলোমলো পা দেখে বোঝা কঠিন, সে কি আসন্ন জ্বরে কাঁপছে, না-কি ফুলজানের আদরে বিচলিত হয়ে পড়েছে।

ফুলজান কিন্তু পাঁচুন হোচা গুছিয়ে নিয়েও ওঠে না। হুরমতুল্লা তার দিকে পেছন ফিরে তাকালে সে ফের ওইরকম আদুরে হুকুম ছাড়ে, তুমি যাও। হামি আসিচ্ছি। মেয়ের আদরের ঠেলায় কিংবা একবার কাজ ছেড়ে ওঠায় জ্বর তার হয়তো চেপে এসেছে বলে হুরমতুল্ল টলতে টলতে বাড়ির দিকে চলে যায়। ফুলজান আর একটু জায়গার আগাছা সাফ করতে নিড়ানি শুরু করে।

পাঁচুন দিয়ে ঘাস আগাছা কাটার কুচকুচ আওয়াজে ঘোড়ার ঘাস খাবার আভাস পেয়ে তমিজের পায়ের পাতা তিরতির করে কাঁপে এবং এই চাপা গতি দিয়ে সে যে কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না। তার এক পাশে মরিচ খেত, মরিচ খেত ঢাকা রয়েছে পাতলা কুয়াশার মশারিতে, এর ভেতরে ঢুকে পড়ে চাঁদের রঙ আটকা পড়েছে অন্যরকম রঙে। এর সঙ্গে তার ধানখেতের ফারাক অনেক। মরিচ খেতে ঢুকে জ্যোৎস্না হয়ে গেছে হলদেটে সবুজ। ছোটো ছোটো ঝোপে জবুথবু হয়ে বসে জ্যোৎস্না অতি ধীরে তার বেগ সামলায়। এই অতি অল্প বেগে সবুজ সবুজ মরিচ একটু করে বাড়ে, সেই বাড়া এতোই ধীর যে এক মরিচ ছাড়া তা দেখার সাধ্যি আর কারুর নাই। তবে হুরমতুল্লা হয়তো টের পায়। বাপের কাজ থেকে সেটা টের পেতে শিখেছে হয়তো ফুলজান। ঘাস আগাছা কাটার কুচকুচ বোলে মরিচগুলো আরাম পায়, তারা বাড়ে আরেকটু তাড়াতাড়ি। তমিজের হাউস হয়, কুয়াশার মশারির মধ্যে ঢুকে সে-ও এই নিড়ানিতে ফুলজানের শরিক হয়। মশারিটা ভালো করে গোঁজা আছে, সে ঢুকলেও চাঁদের আলো এর ভেতর থেকে সহজে বেরুতে পারবে না। তার ধানখেতের আলো যদি মিশে যায় এই মরিচের খেতের সাথে তো রাতভর দুজনে খালি জমির খেদমতই করবে। এখানে এক সাথে কাজ করলে ধান কাটার পরও ফুলজান তার পাশে পাশেই থাকতো। তমিজের জমিতে কাজের কী আর অভাব হবে? আমন উঠলে তমিজ তো আরও জমি বর্গা নিচ্ছে। তার ফসলের ফলন দেখে মণ্ডল কি তাকে জমি বর্গা না দিয়ে পারে?—তাকে জমি দিতে পারলে মানুষ বর্তে যাবে গো! দুই তিনটা খন্দ করতে পারলেই ভিটার লাগোয়া জমিটা মণ্ডলের কাছ থেকে কিনতে না পারুক, খাইখালাসি তো নিতে পারবে। ভিটার জমি, বাড়ির পেছনে বেরোলেই পা পড়ে সেই জমিতে। ফুলজান তখন আসতে পারে, পানি নিতে পারে, নিড়ানি তো দেবেই।-চাঁদ ও কুয়াশায় তার বাড়ি ও হুরমতুল্লার বাড়ি এবং কুলসুম ও ফুলজান সব মিলিমিশে যাচ্ছে। মেয়েটা তার যখন এততাই করবে। তো আর মরিচখেতে তমিজ কি একটু হাত লাগাতে পারে না?

কিন্তু আলের ওপর তমিজ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই মরিচের খেতের সব জ্যোৎস্না গলগল করে বাইরে আসার সুযোগ করে দিয়ে কুয়াশার মশারি তুলে বেরিয়ে আসে ফুলজান। তার বাঁ হাতে বাপের হুঁকা ও পাঁচুন এবং ডান হাতে ঘাস আগাছা ফেলার হোঁচা। সে তো এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি জিনিস বয়ে নিয়ে হেঁটে বাড়ি যায়। তাহলে হয়তো শীতে সে নুয়ে নুয়ে পড়ছে, এখন নুয়ে একটু কাঁপতে কাঁপতে ফুলজান আল ধরে হাঁটতে লাগলো। মরিচ খেতের এখন সবটাই আন্ধার, ফুলজান খেত থেকে বেরুতে চাঁদনির সবটাই বার করে দিয়েছে। কিন্তু এই আল, আল পেরিয়ে মোষের দিঘির উঁচু পাড় সব চাঁদের আলোয় ফকফক করে। কেউ যেন চালের আটা গুলে ঢেলে দিয়েছে তামাম পাথারে, সবই দেখা যায়, কিন্তু চোখে ক্যাটক্যাট করে লাগে না।

সবই ভালো। হুরমতুল্লার বেটিরও সব ভালো, কিন্তু তমিজের কাছে তার কয়েক আনা পয়সার দাবি তুলছে না, একেবারে চুপচাপ হাঁটছে বলে তমিজ উসখুস করে। আগামীকাল পয়সা ফেরত পাবার ওয়াদা পেয়েই কি তার উদ্বেগ শেষ হয় গেলো? তমিজ আস্তে আস্তে বলে, পয়সাটা আর কয়েদিন বাদে লেওয়া যায় না? ১ কয়টা দিন বাদে? বলে ঠোঁটে একটুখানি বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ফুলজান তমিজের দিকে কেবল একবার তাকায়। তার চোখজোড়ার চেয়ে বাঁকা ঠোটটাই তমিজের চোখে সেঁটে থাকে অনেকক্ষণ, বলতে গেলে সারা রাত জুড়ে। তমিজ বোঝে চারদিকের এই চালের আটা গোলা আলো আসলে আসে ওই ঠোট থেকে। আসমানের চাঁদের সাধ্য কি এই ফকফকা আলোয় দুনিয়া ভাসিয়ে দেয়? আকাশের দিকে তাকিয়ে তমিজ দেখে। সেখানে চাঁদের চিহ্নমাত্র নাই। তাহলে এতো আলো কি এমনি এমনি আসে? মেয়েটাকে তার একটু ভয় ভয় লাগে, আবার তার পাশ থেকে তার সরতেও ইচ্ছা করে না। তমিজ তাই আস্তে আস্তে বলে, ধানটা উঠলেই দিমু। না হয় কয়টা পয়সা বেশিই দিমু।

ঠোঁটে চাঁদ জ্বালিয়ে রেখেই ফুলজান ফের হাসে, উগলান ঢঙের কথা থোও মাঝির বেটা। পয়সা হামার দরকার, বোঝো না? ছছালেক লিয়া হামি ডাক্তোরের কাছে যামু। বলতে বলতে ফুলজান আরো কাপে, চারদিকের আলোও কেঁপে কেঁপে ওঠে।

ফুলজানের বেটার রোগের কথায়, না-কি তার কাঁপুনিতেই কে জানে, তমিজের বুকের ভেতরে তোলপাড় করে ওঠে। নিজে ঠিক ধরতে না পেরে তোমার খুব জাড় করিচ্ছে, না? বলে সে তার গায়ের সুতির ব্যাপারটা ফেলে দেয় ফুলজানের পিঠে। ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে ফুলজান চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলে, ছোল বুঝি হামার বাঁচে না গো! তার কথায় একটু ফেঁপানিও থাকে, আজ সাজবেলাত মুখোত ভাত তুললো না। একটা নওলা ভাতও যদি খাবার পারে!

শুনে ফুলজানের ছেলের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধে তমিজের মাথা ভারী হয়ে আসে। আবার ওই ভারী মাথায় তার ফুরফুরে হাওয়া খেলে যায় : আবদুল কাদেরকে তার এতো তোয়াজ করার দরকার কী? সে নিজেই না হয় ফুলজানের বেটাকে নিয়ে যাবে ছাইহাটার। করিম ডাক্তারের বাড়িতে। তার জমির ধানটা কাটা হয়ে যাক। এইতো দুই ক্রোশ আড়াই ক্রোশ রাস্তা। সোজা চলে যাবে খুতিতে পাঁচটা টাকা নিয়ে। সে হাঁটবে এক পা আগে, পিছে পিছে চলবে ফুলজান, কোলে বেটা।

এখন অবশ্য ফুলজান চলছে তার পাশ ঘেঁষে। খয়েরি রঙের চাঁদরে শরীরের সবটা জড়িয়ে নেওয়ায় তার হলুদ ঘোমটা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে। তার কপালে এসে পড়েছে তার ঠোঁটের আলো।-আহা। বিমারি একটা বেটাকে এর কোলে ফেলে পাষণ্ড স্বামীটা কোথায় উধাও হয়ে গেলো, লোকটার কি একবার এর কথা মনেও পড়ে না? বিমারি ছেলেকে নিয়ে সে এখন রাত নাই দিন নাই খেটে মরে বাপের বাড়িতে। তার ছেলের চিকিৎসা করলে সে একটু আরাম পায়। আবার ওই পাষাণহিয়া হারামজাদাটকে ভালো একটা কোবান দিতে পারলেও এর জানটা ঠাণ্ডা হয়। এই দুটো কাজ করতেই তমিজ প্রস্তুত। এই সংকল্প মনে দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে না করতেই ছয় ক্রোশ দূরের যমুনা নদীর সাত স্রোত উনপঞ্চাশ ঢেউয়ের ভেতর থেকে পাক খেয়ে বেরিয়ে বাতাসের একটা ঘূর্ণি উড়তে উড়তে বাঙালি নদীতে ভিজে একটু দুর্বল হয় এবং ভাঙায় খানিকটা আর্দ্রতা ঝেড়ে ফেলে ঝাপটা মারে নিজগিরিরডাঙার মোষের দিঘির উঁচু পাড়ে এবং সেই ঝাপটায় তমিজ তো বটেই, এমন কি রেড ক্রসের চাদর গায়ে জড়ানো ফুলজানও হিহি করে কাপে। এ ছাড়াও পেট-মোটা, সরু হাত পা এবং হলুদ চোখে নিভু নিভু মণি ছেলেটির ভাবনাতেও তারা কাঁপতে পারে। তমিজ এতোটাই কাঁপতে শুরু করে যে, তার এই শরীর আর নিজের দখলে থাকে না। তার হাত থেকে পড়ে যায় ফুলজানের বাপের হোঁচাটা এবং ওই হাতটাই হয়তো কাঁপতে কাপতেই পড়ে গিয়ে ফুলজানের পিঠে। নিজের ঢ্যাঙা কালো শরীরটার সবটা নিয়েই সে পড়ে যাচ্ছিলো। তবে তার আগেই সে জড়িয়ে ধরে ফুলজানকে। ফুলজানের ঠোট থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে জ্যোত্সা। এমন কি জ্যোৎস্নার পেছনে আগুনের শিখায় আঁচ লাগে তমিজের সারা মুখে। সাদা কেরোসিন পাওয়া যায় না, ফুলজানের ঠোঁটের আলো জ্বলে লাল কেরোসিনে, তার ঝাঁঝে তমিজের মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে ওঠে। তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফুলজানের উঁচু বুক তার বুকে ঠেকলে সে বেশ আরাম পায় এবং ফুলজানের বুকের বেদনা অথবা তার স্তনজোড়া কিংবা দুটোই তমিজের গোটা শরীর জুড়ে প্রবল কোলাহল তুলতে থাকে। ফুলজানের আলো-জ্বলা ঠোঁটে তার ঠোট লাগাবার চেষ্টা করলে ফুলজান মুখ সরিয়ে নেয়, তখন তমিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গালে লাগে ফুলজানের ঘ্যাগ। এতে তার শরীরের কোলাহল কিছুমাত্র কমে না। ঠোঁটের আলো চুমুক দিয়ে সে নিতে পারে নি বটে, তবে এর মানে বোধহয় এ নয় যে, ফুলজান তাকে ফিরিয়ে দিলো। কারণ তার ঘ্যাগে তমিজের প্রবল চাপে মুখ ও গাল ঘষায় সে কৈ, কোনো আপত্তি করলো না তো। তমিজের শরীরের উত্তাপ, উত্তেজনা ও উৎসাহ বাড়তে থাকে সমান তালে। ধানখেতের কয়েক হাত তফাতে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ের পুব দিকের ঢালে তমিজ তাকে জড়িয়ে ধরে শোবার উদ্যোগ নিলে কোনোরকম জোর না খাটিয়ে ফুলজান যে কীভাবে তার হাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেলো তমিজ কিছুই বুঝতে পারলো না। বেরিয়ে পড়েই সে যেন মিলে গেলো পাথারের ভেতর। সে কি জ্যোত্ম হয়ে মিশে গেলো জ্যোৎস্নার মধ্যে?

মাঝির বেটা, আসমানেত ছ্যাপ ফালাবার হাউস করিস কোন সাহসে? ফুলজানের গলায় এই কথা সে শুনতে পায়, তবে সেটা তমিজের হাতের ভেতর সে থাকতে থাকতে না হাত থেকে গলিয়ে যাবার পর, তার খেয়াল নাই।আরো ব্যাপার আছে।-ফুলজানের এই ছিছিক্কার মোষের দিঘির ধার থেকে তার কানে বাজে অনেকক্ষণ পরে। মোষের দিঘির পাড়ে ফুলজান হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলে হাঁপাতে হাঁপাতে টলোমলো পায়ে তমিজ ঢুকে পড়ে নিজের ধানখেতে। সারা গায়ে তখন তার অবসাদ, হাতপা সব ঝিমঝিম করছে, তার সর্বাঙ্গে তখন ঝি ঝি ধরেছে। ধানের জমিতে ধপ করে বসে পড়ারও বেশ কিছুক্ষণ পর ফুলজানের কথা মরিচখেত হয়ে কচি মরিচের ঝাল মেখে নিয়ে তার দুই কানে দুটো চড় লাগালো। এতে তমিজের অবসাদটা কাটে, হাতে পায়ে ঝি ঝি কেটে গিয়ে সারা শরীর জ্বলতে লাগলো। তার অস্থির হাতের মুঠিতে গোছা গোছা ধানের শীষ ঢুকেও পিষে যায় না। গোছা ধরে ধানের শীষ তার খেউরি-না করা গালে ঘষতে সে বেশ আরাম পায়। তবে কয়েকটা শীষের মধ্যে থেকে ধানের দানা পড়ে গেলে তার ভয় হয়, ধান কাটতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো?

বিলের উত্তর সিথান এড়াতে কিংবা নৌকায় বিল পাড়ি দিতে তমিজ রওয়ানা হয় দক্ষিণের দিকে। কিন্তু মণ্ডলের কোষা নৌকাটা বিলের ওপারে ফকিরের ঘাটে বাঁধা। তাই তাকে হাঁটতে হয় বিলের দক্ষিণ ধার ঘেঁষে। কিন্তু তার চোখ বিলের ওপারে। হাঁটতে হাঁটতে দেখে, একটি ছায়া চলেছে তার সঙ্গে সঙ্গে। গোটা বিল পার হয়ে তার ছায়া পড়বে বিলের ওপারে—এটা কি কখনো হতে পারে? না, ওই ছায়াটি তার নয়। ছায়া ছায়া মানুষটির ঘাড়ে তৌড়া জাল। ছায়া চলেছে উত্তরের দিকে। ভয়ে ও খানিকটা আশায় ভালো করে ঠাহর করলে তমিজ বোঝে, ওটা ছায়া নয়, লোকটি তমিজের বাপ। বাপ তার ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলেছে উত্তরের দিকে। বিলের ওপারে তমিজের বাপ সুরা পড়ার মতো বিড়বিড় করে কী বলে; আর বিলের রুই কালা, পাবদা ট্যাংরা, খলসে পুঁটি, কৈ মাগুরের নিশ্বাসে প্রশ্বাসের বুদবুদে টাটকা হয়ে বিলের পানিতে ড়ুবসাঁতার দিয়ে সেইসব কথা এসে ভেড়ে বিলের পূর্ব তটে। পঁড়িয়ে একটু মনোযোগ দিলেই

তমিজ তার বাপের সব কথা শুনতে পায় :

সুরুজে বিদায় মাঙে শীতেতে কাতর।
শীষের ভিতরে ধান কাঁপে থরথর।।
পশ্চিমে হইল রাঙা কালা পানি অচিন ডাঙা
ফকিরে করিবে মেলা রাত্রি দুই পহর।
ধানের আঁটি তোলো চাষা মাঝি ফেরো ঘর।

জীবনে কখনো শুনেছে কি-না মনে করতে না-পারা এই লম্বা শোলোকের প্রতিটি অক্ষরের ঠেলায় ঠেলায় তমিজ বাড়ি পৌঁছে গেলো বেশ তাড়াতাড়ি। তার বাপের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে কুলসুম একটু সরে দাঁড়িয়ে বলে, এতে আতেত তুমি কোটে গেছিলা গো? তোমার বাপের ব্যারাম তোমাক ধরিছে? দরজায় বাঁশের উঁশা লাগাতে লাগাতে সে হাসে, আজ তুমি কোটে কোটে ঘোরো আর তোমার বাপ নিন্দ পাড়ে ঘরের মদ্যে।

চোপসানো বুকে তমিজ ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ করে, তাঁই ঘরত?

তো?

ঘরের ভেতর দিয়ে ভেতরের বারান্দায় গিয়ে তমিজ তখন ঢুকছিলো নিজের ঘরে। কুলসুমের কথা শুনে বাপের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, মাচার ওপরে বাপ তার শুয়ে রয়েছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে। তাহলে? বিলের ধারে ধারে তৌড়া জাল কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে তাহলে শ্লোক বলছিলো কে? বাপকে তমিজ এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখায় এবং শোলোকের একটি কথাও মনে করতে না পারায় তার সামনে থেকে ছোট্টো উঠানের জ্যোৎস্না নিভে যায়। সে তখন ঢুকে পড়ে নিজের ঘরের ভেতর। তারপর কাঁথা গায়ের ওপর দিয়ে শুয়েছে কি শোয় নি, কুলসুম হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, হামার গিলাপ? গায়ের লয়া কাপড়খান হামার কুটি ফালায়া আসিছো?

কুলসুমের ব্যাকুল জিজ্ঞাসার জবাবে তমিজের মাথা পড়ে যায় তেলচিটটিচে বালিশের ওপর। আর নতুন সুতির র‍্যাপার নিয়ে উদ্বেগ ও আক্ষেপ জানাতে জানাতে কুলসুম করে কী, তমিজের মাথার কাছে নাক দিয়ে খুব টেনে টেনে নিশ্বাস নিতে থাকে। যতটা তীব্রভাবে পারে, নিশ্বাস নিয়ে তমিজের মাথার গন্ধে গন্ধে নতুন গিলাপের হদিস সে করে ছাড়বে। তমিজের মাথায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, এটা কী? সেই ছোঁয়ায় তার চোখ বুজে আসে। একটু-আগে-শোনা ও এখন ভুলে-যাওয়া শোলোক, সুর করে শোলোক বলতে বলতে তার বাপের উত্তরের পানে যাওয়া এবং সেই বাপেরই আবার কোথাও না গিয়ে ঘরের মাচায় ভেঁস ভোঁস করে ঘুমানো,-এতোসব এলোমেলো কাণ্ড এড়াতেই সে হয়তো চলে যাচ্ছে ঘুমের আড়ালে। কিন্তু ঘুমের একটা পরত পেরিয়ে পরের পরতটিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে মরিচখেতের মশারি খুলে গলগল করে বেরিয়ে আসে চালের আটা গোলানো চাঁদনি, সেটা আবার দপ করে জ্বলে ওঠে মোষের দিঘির পুব পাড়ে। সেখান থেকে তৌড়া জালে জড়িয়ে নিয়ে তাকে ফেলে দেওয়া হয় কালাহারের গভীর নিচে। মস্ত একটা বেড় জাল গোটা বিল সেঁচে উত্তরদিকে গোটাতে শুরু করলে তার ঘুম বারবার ছিড়ে যায়। কী জ্বালা! তমিজ তখন পাশ ফিরে শোয় একটা হাত তার গালের নিচে রেখে।

হাতের চাপে তার কয়েকদিন না-কামানো দাড়ি গালে লাগে। তার গালে ধানের শীষ তখন খোঁচা খোঁচা চুমু দেয়। তার চোখ জুড়ে নামে রাজ্যের ঘুম। নতুন র্যাপারের হদিস জানতে কুলসুম আরো অনেকক্ষণ তার মাথার গন্ধ শুকেছে কি-না সে টের পায় নি। হয়তো শুকেছে। তবু সে ঘুমায়। কিংবা হয়তো এই জন্যেই ঘুম নামে তার দুই চোখ ঝেঁপে।

 ১৪. হুমায়ুনের চল্লিশার ধুম

ধান কাটতে তমিজের আরো কয়েকটি দিন সবুর করতে হবে। এর মধ্যে লাগলো হুমায়ুনের চল্লিশার ধুম। শরাফত মণ্ডলের বর্গাদারদের সবাই কয়েকটা দিন পেটে ভাতে খেটে দিলো। আপখোরাকি মজুরি দেওয়ার ইচ্ছা আজিজ ও কাদের দুজনেরই ছিলো, বাড়ির মাসুম ছেলেটার রুহের মাগফেরাতের জন্যে খরচ করতে তাদের কোনো দ্বিধা নাই, এখানে পয়সা ঢালা মানে আখেরাতের সঞ্চয়। কিন্তু মণ্ডলের বড়ো বর্গাদার হামিদ সাকিদার অভিমান মতো করে : যার জমি চাষ করে তাদের রেজেক, তার বাড়ির শোক উদযাপনে গতর খাটিয়ে তারা পয়সা নেয় কোন আক্কেলে? তাদের আল্লারসুল নাই? তাদের আখেরাত নাই? গরিব হলেও কেয়ামতের দিন তাদের জবাবদিহি করতে হবে না? তার কাকুতি মিনতিতেই শরাফত তাদের মজুরি না দিয়ে দুই বেলা গরম ভাত খাওয়াবার ব্যবস্থা করে। আবদুল আজিজ খাওয়াবার ঝামেলার মধ্যে যেতে চায় না বলেই পয়সা দিয়ে কাজ করার পক্ষে। পয়সা নাও, কাম করো। একেকজনের হাতির খোরাক জোটাবার চেয়ে পৌষ মাসের খেতমজুরির রেটে পয়সা দিলে রবং অনেকটা সাশ্রয় হয়। কিন্তু তার বর্গাদারদের দুনিয়াদারির সঙ্গে আখেরাতের দেখভালের জিম্মাদারি শরাফতের এখতিয়ারেই পড়ে। সুতরাং নতুন ধান ভানা, বর্গাদারদের কারো কারো বাড়ির গাছ কাটা, করতোয়ার ওপারে দশটিকার হাট থেকে ৭টা বড়ো বড়ো দামড়া কিনে তাদের হটিয়ে নিয়ে আসা, কয়েক মণ আটা, আলু মশলাপাতির জোগাড়যন্তর করা, বাড়ির খুলিতে মস্ত মস্ত চুলা কাটা, কয়েক মাইল পুবে শিমুতলার মিয়াবাড়ি গিয়ে ভারে করে বড়ো বড়ো ডেকচি বয়ে আনা এবং চল্লিশার দিন রান্নাবান্না ও পরিবেশনের কাজ করার অনুমতি দিয়ে শরাফত তার আধিয়ারদের সওয়াব হাসিলের সুযোগ করে দেয়।

এতো বড় আয়োজন,-শরিক না হয়ে কি তমিজ পারে? তমিজের বাপ এই নিয়ে গাঁইগুঁই করে : কারো জমিতে মাঙুন কামলা খাটতে তমিজের এতো আপত্তি, শমশেরের। ধান কাটার সময় মাঙুন কামলা খাটলো বলে বাপটাকে তমিজ তো কম হেনস্থা করে। নি। আর মণ্ডলের বাড়িতে তুমি মাগনা খেটে মরো, তাতে তোমার খুব পোষায়? ২ বাপটাকে নিয়ে তমিজের পদে পদে বিপদ! বুড়ার বেটার গো আর কমলো না। নিজের বেটা মরার আগে আবদুল আজিজ কতোবার খবর দিলো, তমিজও কতোবার বললো, আজিজের বৌ কি স্বপ্ন দেখেছে তাই নিয়ে কী বলবে,—তা বুড়া গেলো না তো গেলোই না। শেষপর্যন্ত কুলসুম না গেলে আবদুল আজিজ যে কী কাণ্ডটা করতো ভাবতেও তমিজের গা শিউরে ওঠে। আর সে-ই কি আর কাদেরের কাছে মুখ দেখাতে পারতো?

বাপের কথা শুনলে কী আর তমিজের চলে? আবুদল কাদের তো অনেকটা ভরসা করে তার ওপরেই। তার টাউনের মেহমানদের খেদমত করতে গফুর কলু একাই যথেষ্ট, কিন্তু চল্লিশার প্রস্তুতির কাজে কয়েকটা দিন তাকে ছেড়ে দিলে কাদেরের চলবে কী করে? কাদেরের দোকানে বসে তেল বেচার কাজটা গফুর একাই করে। ঘানিতে সর্ষে। তেল বার করার চাইতে দোকানে বসে কেরোসিন তেল বেচা অনেক সোজা। এখানে ইজ্জতও আছে,-কন্ট্রোল রেটে আধ পোয়া তেল পেতে কতো মানুষ তাকে কী তোয়াজটাই না করে। আগে এইসব মানুষ কলুর বেটা বলে তাকে কতো হেলা করেছে। গফুরের কাজ আরো আছে। মুসলিম লীগের ছেলেরা দোকানে আসে দলের কাজ করতে। কাদের না থাকলে তাদের বসতে দেওয়া, তাদের কাজের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা এবং কাদের সম্বন্ধে কে কী বললো সেদিকে একটু নজর রাখাও বটে,—এসব করে কে?

ভদ্রলোক মেহমান যা অনুমান করা গিয়েছিলো তার চেয়ে কমই এসেছে। আবদুল আজিজের অফিসের লোকজন অতো দূর থেকে আসতে পারে না। টাউনের সিভিল সাপ্লাই অফিসে সে তার তিনজন বন্ধুকে দাওয়াত করেছিলো, এসেছে একজন। আবদুল কাদেরের মেহমান মেলা, তবে দাওয়াত করা হয়েছিলো আরো অনেককে। আজিজ বা কদেরের যত খুশি মেহমানকে আপ্যায়ন করতে শরাফত মণ্ডলের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু কাঁচা রাস্তায় টমটমের ঝাকুনি খেতে খেতে টাউনের বাবুরা যে এই পর্যন্ত কতো আসবে সেটা তার ভালো করেই জানা আছে!

লাঠিডাঙা কাছারির মুসলমান পাইক বরকন্দাজদের সবাইকে বলা হয়েছিলো। কাদের খামাখা তড়পালো, নায়েববাবুর ভয়ে ওরা এক সঙ্গে এতোগুলো মানুষ কাছারি ছেড়ে আসবে কি-না সন্দেহ। শরাফত অবশ্য ঠিকই জানে কয়েক বছর আগে হলেও পাইক বরকন্দাজের এক দিনের কামাই নিয়ে নায়েববাবু হাম্বিতম্বি করতো, কিন্তু বুড়ো হতে হতে লোকটা ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কারো ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার মানুষই সে নয়। নায়েববাবুর এখনকার কথাই হলো; আমার ধর্ম আমি মানি। তোমার ধর্ম ভুল হক আর যাই হোক, সেটাই ঠিকমতো পালন করো। মানুষের সবই অনিত্য, এই ভবসংসারে সবই নশ্বর, কিন্তু ধর্ম আর জাত হলো জীবনের সার; ওটা গেলে মানুষের আর রইলো কী?

কামারপাড়ায় নেমন্তন্ন করলে সেটা বরং নায়েববাবুর সইতে না। মোসলমানের মড়ার শ্রাদ্ধের ভাত গিলে জাত খোয়ানোর অধিকার ভগবান কিংবা নায়েববাবু কেউই তাদের দিতে পারে না। তবে কাদেরের বিয়ের সময় মণ্ডল তার কামারপড়ার আধিয়ারদের ঠেসে খাওয়াবে; শিমুলতলার মিয়ারা তো বাড়িতে বিয়েসাদি হলে একটা দিন খওয়ায় শুধু হিন্দুদের। মণ্ডলও তাই করবে।

তা হুমায়ুনের চল্লিশায় মানুষও হয়েছিলো বাপু! গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি, ছাইহাটা থেকে ওদিকে রানিরপাড়া পারানিরপাড়া মহিষাবান,-কোনো গ্রামের মানুষ বাদ পড়ে নি। চাষা বলো, মাঝি বললা, কলু বলো আর জোলা বলো সবাই এসেছে ঝাঁক বেঁধে, ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে–এতো এতো সব মানুষে গোটা গাও গমগম করে; কালাহার বিলের সব মাছ ভিড় করে গিরিরডাঙার তটের দিকে। ফজরের নামাজের পরপরই মসজিদে দোয়া পড়া হলো। বলতে গেলে এই উপলক্ষেই মণ্ডলবাড়ির লাগোয়া জুম্মাঘরটার বেড়া নতুন করা হলো, জুম্মাঘরকে মসজিদ বলা শুরু হয়েছে এর আগে আগে। আহলে হাদিস জামাতের মসজিদ, এখানে মিলাদ পড়ানো চলে না। কাদের টাউনের টাইটেল পাস মৌলবিকে দিয়ে দোয়া পড়াতে চাইলেও মণ্ডল রাজি হয় নি, বাপদাদার আমলের রেওয়াজ মোতাবেক গায়ের জুম্মাঘরের ইমাম সাহেব দোয়া পড়ুক। পরে নাহয় খাওয়া দাওয়া দেওয়ার পর নাজাতের দোয়া পড়বে টাউনের আলেম সাহেবরা।

খানকা ঘরের উঁচু বারান্দায় সতরঞ্চির ওপর দুই দিকে বালিশ দিয়ে সাজানো। জায়নামাজে বসে নাজাতের দোয়া পড়ে টাউনের জামে মসজিদের ইমাম আলহাজ মওলানা হাফেজ আবু নসর বরকতুল্লাহ প্রতাপপুরী সাহেব। দুই পাশে বালিশের শিওরে কাঁসার গ্লাসে চালের ভেতর গোঁজা আগরবাতির ধোঁয়ায় ভর করে মওলানা সাহেবের সুরেলা মিষ্টি গলার এহলান ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির সামনে বিশাল জমায়েতে এবং দেখতে দেখতে তা মিশে যায় বড়ো বড়ো ডেকচির গোরুর গোশতের সুরুয়ার গরম ধোঁয়ায় এবং রূপান্তরিত হয় খিদে-বাড়ানো সৌরভে।

এতো এতো লোক দেখে হামিদ সাকিদার ও গফুর কলু ঘাবড়ে যায় এবং সারিতে সারিতে ভাত দেওয়ার ব্যাপারে একটু তাড়াহুড়াই করে। দোয়া পড়ার শুরুতেই কলাপাতার ভাত ও নুন দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো, বালতিতে বালতিতে আটা দিয়ে পাক-করা গোরুর গোশত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরিবেশনের জন্যে, তখন আরম্ভ হলো মোনাজাত। সারি সারি মানুষ অপেক্ষা করছে গোশতের জন্যে। গোশতের বালতি নিয়ে ছুটছে হুরমতুল্লা, কালুর বাপ, হামিদ সাকিদার, গফুর কলু, তমিজ,-মোনাজাতের দিকে এদের খেয়াল নাই। খানকা ঘরের বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ হঠাৎ জোরে নির্দেশ দেয়, মোনোজাত হচ্ছে, মোনাজাত; সবাই হাত তোলেন। পরপরই মওলানার স্বর হঠাৎ করে চড়ে গেলো।

মওলানার মোনাজাত হচ্ছিলো উর্দুতে, উর্দুতে সমবেত জনতার অজ্ঞতা এই ভাষার প্রতি তাদের ভক্তিকে উস্কে দেয় এবং এর রহস্যময়তা আরবি আয়াতের সঙ্গে সবরকম ফারাক মোচন করে। ওদিকে পঙক্তিতে বসা লোকজনের অনেকেই অধৈর্য হয়ে নুন দিয়েই ভাত মেখে খেতে শুরু করেছে। এমন কি কারো কারো ক্যা গো তরকারি দিবা না? ভাত কি শুধাই খাওয়া লাগিব? তোমরা কিসের সাকিদারি করো? পাতেত গোশত কুটি? প্রভৃতি অভিযোগ ঠোকাঠুকি লাগে মোনাজাতের কথার সঙ্গে। এতে বিরক্ত হয়ে কাদের আজিজের পাশে দাড়িয়ে হুকুম ছাড়ে, খামোশ! এই শব্দটির অর্থ পরিবেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদেরও জানা না থাকায় ঘাবড়ে গিয়ে গোশতের বালতি মাটিতে রেখে তারা মোনাজাতের জন্যে হাত তোলে এবং তাদের দেখাদেখি হাত তোলে খেতে বসা মানুষের অনেকে। নুন দিয়ে ভাত যারা মেখে ফেলেছিলো তাদের নাকে লাগে ভাতের গন্ধ এবং ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনং-এর তৃপ্তির বদলে তাদের পেটে তারা পায় খিদের নতুন মোচড়। মোনাজাতে নিষ্ঠার সঙ্গে শরিক হয়েছিলো সতরঞ্চি পাতা খানকা ঘর ও ওই ঘরের বারান্দায় বসা মেহমানরা। মাসুম বালক মোহাম্মদ হুমায়ুনের বেহেশত * নসিবের জন্যে আল্লাপাকের দরবারে, মওলানা সাহেবের আকুল আবেদনে তাদের চোখ ভিজে যায়, আমিন আমিন বললে তাদের গলা থেকে গড়িয়ে পড়ে নোনতা আওয়াজ। এই মাসুম আওলাদের অছিলায় তার বাপমা, দাদাদাদী এবং সমস্ত পূর্বপুরুষের গোনাখাতা মাফ করার জন্য মিনতি জানানো হচ্ছিলো। আগরবাতির ধোয়া এই ঘরে ছিলো স্বচ্ছ উৎসের মতো, গোশতের গন্ধে বিলুপ্ত হবার জন্যে ছোটার আগে ওই ধোয়া এই ছছাটো মজলিশে হুমায়ুনের তো বটেই, তার বাপদাদা এমন কি অপরিচিত পূর্বপুরুষের জন্যে লোকদের সংহত করে তোলে। হুমায়ুনের বড় ভাই বাবর বসেছিলো দাদুর কোল ঘেঁষে। পড়াশোনায় ভালো বলে এই নাতিটির জন্যে শরাফত মণ্ডলের টান একটু বেশি। দোয়ার প্রথম থেকে তার চোখ দিয়ে অবিরাম পানি ঝরছিলো, মোনাজাতের সময় ভাষার দুর্বোধ্যতা ছাপিয়ে মওলানা সাহেবের আকুল মিনতি তাকে ধাক্কা দেয় বেশ জোরেসোরে এবং সে কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আর শরাফত মণ্ডলের চোখ ছলছল করে, চোখের পানি আটকে থাকে চোখের গভীর গর্তে এবং নোনা পানির পর্দা ফুড়ে সে তাকিয়ে থাকে মিয়াবাড়ির ছোটোমিয়ার সৌম্য চেহারার দিকে। ছোটোমিয়ার ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি ও পায়ের ওপর যেনতেনভাবে ছড়িয়ে রাখা একই রঙের কাশ্মীরি শাল থেকে আসা আতরের গন্ধ শরাফতের শোককে গৌরব দেয় এবং ছোটোমিয়ার প্রায়-বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে সে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুদ হয়ে যায়।

শিমুলতলার বুড়ো বুড়ো চার ভাইয়ের পানজর্দা খাওয়া ও গড়গড়া টানা চার জোড়া ঠোঁটের বাঁকা হাসির কুচিতে তার নিজের চোখজোড়া খচখচ করতে পারে-এই ঝুঁকি নিয়েও শরাফত দুইবার গিয়েছিলো তাদের দাওয়াত করতে। বড়ো বড়ো ডেকচি কাদের জোগাড় করতে পারতো তো টাউন থেকেই। কিন্তু মণ্ডল ছেলের কথায় কান না। দিয়ে ওইসব চাইতে গেলো শিমুলতলার মিয়াদের বাড়িতে। এতে বড়ো বড়ো হাঁড়িপাতিল ও দামি বাসনপত্র সংগ্রহে মিয়াদের পুরনো সমৃদ্ধির ধারণাটির নবায়ন করা হয়। তা এতে কাজ হয়েছে; ছোটোমিয়া এসেছে তার মেজোভাইয়ের এক নাতিকে নিয়ে।

আবদুল কাদেরের মেহমানরা টাউনের যতো দাপটের বান্দা হোক না কেন, শরাফত মণ্ডলকে তারা ওপরে ওঠাবে কতোটা? তারা দল বেঁধে এসেছে, জমিয়ে গপ্পোজব করছে, তারা পাকিস্তান, মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, গান্ধিজি, জিন্না সাহেব, ইলেকশন, জহরলাল, কৃষক প্রজা পার্টি, হক সাহেব, সোহরোয়ার্দি, আবুল হাশিম, নাজিমুদ্দিন, আলিগড়, ইসলামিয়া কলেজ নিয়ে মেলা বাক্য ছাড়বে। মানুষ হাঁ করে ওইসব শোনে এবং বেশিরভাগ কথা না বুঝে কিংবা বোঝে না বলেই অভিভূত হয়। তারপর স্লামালেকুম বলে টমটমে চেপে তারা টাউনের দিকে রওয়ানা হলে লোকজন অনেকক্ষণ বিলীয়মান টমটমের দিকে তাকিয়ে থাকে। টমটম চোখের আড়াল হতেই তাদের কথা লোকে ভুলে যাবে, তাদের কথাবার্তার যেটুকু বুঝেছে তাও ভুলে যাবে। কিন্তু শিমুলতলার মিয়াদের সঙ্গে এক কাতারে না হলেও একই দিনে, একই জেয়াফতে, একই বাড়িতে ভাত খাবার কথা তারা জীবনে ভুলবে না।

শিমুলতলার মিয়ারা আজকের খানদান নয়, সেই কবে থেকে দীঘাপতিয়ার রাজাদের মস্ত তরফের খাজনা আদায় করে আসছে এরা। জেলার গোটা পুর এলাকার দীঘাপতিয়ার প্রজাপাটের ওপর চোটপাট করা, তাদের মারধোর করা, তেমন সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়লে তাদের ভোগ করা,—সবই তো করে আসছে এরা। ইদানীং দুই পাতা লেখাপড়া করে ছোটো ঘরের কেউ কেউ বেয়াদব হয়ে উঠছে, এই ছোটোলোকের বাচ্চারা কাউকেই আমল দিতে চায় না। শগ্রফত তবু জানে, মরা হাতির দাম লাখ টাকা। শিমুলতলা পড়ে গেলেও এদের নাম থেকে এখনো আভা বেরোয়। এদের অবস্থা। পড়ো পড়ো হয়েছে বলেই শরাফত এদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক করার সখ করতে সাহস পায়। বড়োমিয়ার এক নাতনিকে কাদেরের বৌ করে আনার কথা সে একবার ভেবেছিলো, জগদীশ সাহাকে দিয়ে মিয়াবাড়িতে ইশারাও দিলো। জগদীশ বললো, সত্যিমিথ্যা জগদীশই জানে, প্রস্তাব শুনেই বৃড়োমিয়া জ্বলে ওঠে, চাষার, সাহস তো কম নয়, তার ঘরের মেয়ে নিতে চায় নিজের ছেলের বৌ করে!

বড়োমিয়া ওরকম রাগ না করলেও তো পারে। শরাফত নিজের হাতে লাঙল ধরে না, তার বাপই লাঙল ধরা ছেড়েছে জোয়ান বয়সেই। এ কথা ঠিক, জমিজমা কি জোতসম্পত্তির দিক থেকে মিয়াদের তুলনায় তারা কিছুই নয়। কিন্তু মণ্ডলের ধানপান, বাঁশঝাড়ের আয়, গোলাবাড়ি হাটের দোকানে কেরোসিন তেল বেচার টাকা—এসব ধরলে তার রোজগার তালুকদারদের কাছাকাছিই যাবে। জগদীশ সাহা অনেক রাত করে শিমুলতলায় তালুকদারদের বাড়ি যাওয়া আসা করে; এসবের মানে কি মণ্ডল বোঝে না? মিয়াদের নাক কারো কারো বেশ চাপাই, কিন্তু অবস্থা পড়তে শুরু করার পর থেকে তাদের নাক-উঁচু ভাবটা বাড়ছে।

এদের মধ্যে ছোটোমিয়াই বরং মানুষটা ভালো। টাউনে তার যাতায়াত বেশি। মাসে দুমাসে একবার কলকাতা যায়, দুই বছর পরপর দার্জিলিং ঘুরে আসে। আবার খদ্দরও ধরেছিলো কিছুদিন। দেশবন্ধু মারা যাবার সময় ছোটোমিয়া দার্জিলিঙে। দেশবন্ধুর শবদেহ নিয়ে কংগ্রেস ভলান্টিয়ারদের সূঙ্গে ছোটোমিয়া একই ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলো। ওই ট্রেনে মুসলমান ভলান্টিয়ার ছিলো আর কয়জন? এসব অবশ্য অনেক আগেকার কথা। রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছে তা বছর দশেক তো হবেই। এই লোকটা এখনো সবার সঙ্গে মিশতে পারে। ছোটোমিয়ার আর একটা ব্যাপার মণ্ডলের বড়ো পছন্দ, অবস্থাপন্ন ঘর হলেই তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে ছোটোমিয়ার আপত্তি নাই, অতো খানদানের ধার সে ধারে না। তবে তার ব্যারাম অন্যখানে। গ্র্যাজুয়েট না হলে তাদের বাড়ির জামাই হতে পারবে না। আরে এ কি গভর্নমেন্ট অফিসে অফিসার পোস্টে চাকরি দিচ্ছো যে বি এ পাস না হলে এ্যাপ্লাই করতে পারবে না?

গ্র্যাজুয়েট না হলেই বা আবদুল কাদের কম কিসে? ছোটোমিয়ার সঙ্গে কাদেরের আলাপ শুনতে শুনতে শরাফত মণ্ডল মুগ্ধ। বড়ো ছেলেটা তার সরকারি চাকরি করে, কিন্তু ভারিক্কি গোছের কি নামী দামি লোক দেখলে সরে সরে থাকে। গুজুরগাজুর ফুসুরাসুর সব ওই সিভিল সাপ্লাইয়ের কেরানির সঙ্গেই। অথচ আবদুল কাদের কেমন দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে।

আপনে ইসমাইল সাহেবকে বলেন, টিকেটের একটু চেষ্টা তদবির করুক। আমাদের এদিকে তার ফিল্ড খুব ভালো। আর বাঙালির পুবে যমুনার পশ্চিমে আপনাদের কথা কেউ ফেলতে পারবে না।

কাদেরের কথায় ছোটোমিয়া মোটেই ফুলে ওঠে না, এসব কথা তারা জন্ম থেকেই শুনে আসছে। তবে ইসমাইলের প্রশংসা করায় লোকটা খুশি। ইসমাইল হোসেন তার আপন ভাস্তিজামাই, বড়োমিয়ার মেজোমেয়ের স্বামী। তবে ইলেকশনে সে নমিনেশন পাবে কি না তাতে ছোটোমিয়ার একটু সন্দেহ আছে, দামাদমিয়া টিকেট পাবে কী করে? এই এলাকায় তো তোমাদের পুরনো লোক অনেক। কাদের এতে দমে না, বরং আরো উৎসাহিত হয়ে বলে, তা আছে। তারা তেমন কামের মানুষ নয়। কলকাতার নেতাদের সঙ্গে ইসমাইল ভায়ের খাতির কতো বেশি। ছাত্রনেতা ছিলেন তো। পাকিস্তান ইসু সারা বাঙলায় যারা প্রচার করে।

পাকিস্তানের ব্যাপারে ছোটোমিয়ার উত্তেজনা কম, আমাদের বাবাজি পাকিস্তান ছাড়া কিছু বোঝে না। তুমিও তাই। তোমরা ছেলেমানুষ, মাথা গরম করা তোমাদের বয়সের ধর্ম।

ছোটোমিয়া ইসমাইল হোসেন ও তাকে বয়সের ও মাথা গরম করার ব্যাপারে এক কাতারে ফেলায় কাদের এই লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, এই কৃতজ্ঞতাবোধ তাকে একটু লাই দেয়। ফলে উত্তেজিত হয়ে সে বলে, পাকিস্তান ছাড়া মোসলমানের টেকার পথ নাই। মোসলমান কী ছিলো আর আজ কোথায় নেমেছে–।

মুসলমানদের বর্তমান হাল ব্যাখ্যা করার ভার তার হাত থেকে স্বেচ্ছায় তুলে নেয় টাউনের মাঝবয়েসি নেতা ডাক্তার আমিরুদ্দিন আখন্দ। দেখেন না, শিক্ষদীক্ষা, স্কুল কলেজ, কোর্ট কাচারি, অফিস আদালত, বিজনেস সব হিন্দুদের হাতে। আর জমিদার তো নাইন্টি পার্সেন্ট হিন্দু। লোকটা মনে হয় আজ সকালেই রিহার্সেল দিয়ে এসেছে, কিংবা নিজের চেম্বারে বসে রোজ রোজ বলতে বলতে তার মুখস্থ, মোসলমান হলো হিন্দু জমিদারের প্রজা, হিন্দু উকিলের মক্কেল, হিন্দু মহাজনের খাতক, হিন্দু মাস্টারের স্টুডেন্ট, হিন্দু ডাক্তারের পেশেন্ট।

ছোটোমিয়া তার কথার স্রোত একটুখানি আটকায়, কেন আপনার কাছে মোসলমান পেশেন্ট যায় না? ডাক্তার আসিরুদ্দিন জবাব দেয়, হিন্দু পেশেন্ট তো আমার কাছে যায়ই না, আবার মোসলমান সব ভালো ভালো শিক্ষিত মানুষের ধারণা, মোসলমান কখনো ভালো ডাক্তার হতে পারে না।

তাহলে খালি হিন্দুদের দোষ দেন কেন? মোসলমান ডাক্তার যদি ভালো হয় তো হিন্দু পেশেন্ট কি তার কাছে না গিয়ে পারবে? টাউনের চোখের ডাক্তার দুজনেই তো মোসলমান, হিন্দুরা তাদের দিয়ে চোখ দেখায় না? কলকাতায় সবচেয়ে বড়ো দাঁতের ডাক্তার তো মোসলমান, তার পেশেন্টদের মধ্যে হিন্দুর হার কতো বেশি তা হিসাব করে দেখেছেন?

এসব একসেপশন। টোটাল পজিশনটা কী? প্রশ্ন করে আবার জবাব দেওয়ার কাজটিও সম্পন্ন করে ডাক্তার সাহেবই, বিজনেস ওদের হাতে, চাকরি বাকরিতে বড়ো বড়ো পোস্টও দখল করে আছে তো ওরাই। ভালো পজিশনে থাকলে জাতভাইদের টেনে তোলা যায়। আমাদের সেই অপরচুনিটি কোথায়?

গভর্নমেন্ট তো মুসলিম লীগের। লীগ তো বেঙ্গল রুল করছে অনেক দিন। এক ফেমিন ছাড়া এদের বড়ো কীর্তি আর কী বলেন তো?

এই তো ঠিক পয়েন্টে আসলেন। ছোটোমিয়াকে জুতমতো ধরা গেছে এমন ভাব . করে ডাক্তার, ফেমিনের সময় বেঙ্গল গভর্নমেন্ট চাল চাইলো বিহার গভর্নমেন্টের কাছে, হিন্দু ডমিনেটেড কংগ্রেস গভর্নমেন্ট না করে দিলো। এখানকার হিন্দু লিডাররা পুরো সায় দিলো বিহারকে। ওয়ারের নাম করে বৃটিশ চাল সব গায়েব করে দিলো। বদনাম হলো। মুসলিম লীগের। পাকিস্তান হলে হেলপ করবে গোটা ইনডিয়ার মোসলমানরা। মোসলমান বিজনেস কমিউনিটি হেলপ করার স্কোপ পাবে।

মোসলমান জমিদার যারা আছে তারা এখুন কী হেলপ করছে? হিন্দু জমিদার ছাড়া দেশে স্কুল কলেজ হতো? এই ডিস্ট্রিক্টে এক জেলা স্কুল ছাড়া আর সবই হিন্দু জমিদারদের দান। টাউনে তো বড়ো বড়ো জমিদার দুজনেই মোসলমান, কোনো স্কুল কলেজের জন্যে একটা ইট দিয়েছে কেউ? ডাক্তার সাহেব, এসব কাজ করতে আলাদা মেন্টালিটি লাগে, বুঝলেন?

মেন্টালিটি তৈরি হবে পাকিস্তান হলে। নিজের দেশে পাওয়ার থাকবে নিজেদের হাতে, মুসলমান জমিদারদের তখন সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি গ্রো করবে।

কিন্তু ডাক্তারের এই কথায় কাদেরের সায় নাই, সে বরং প্রতিবাদ করে, পাকিস্তানে জমিদারি সিস্টেম উচ্ছেদ করা হবে। বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে। পাকিস্তানে নিয়ম হবে জমি তার লাঙল যার। পাকিস্তানের আমিরে গরিবে ফারাক থাকবে না।

এই কথাগুলো অনেক গুছিয়ে বলতে পারে ইসমাইল হোসেন। কলকাতা থেকে বস্তা বস্তা কাগজ আসছে, পপাস্টারে লিফলেটে এইসব কথা লেখা থাকে। পাকিস্তান নামে বইও এসেছে। কাদের সেসব পড়ে, কিন্তু ঠিকমতো বলতে পারে না। তার অগোছালো উত্তেজনায় কেউ সায় দেয় না। আসিরুদ্দিন ডাক্তার বরং একটু বিরক্ত হয়। জমিদারি ব্যবস্থার অভাবে সম্পত্তির মালিকানায় অরাজকতা দেখা দেবে ভেবে শরাফত মণ্ডল ছেলের মন্তব্যে সায় দিতে পারে না। বরং নিশ্চিন্তে হাসে ছোটোমিয়াই, বলে, তোমরা জমিদারদের সম্পত্তি কেড়ে নেবে, বড়োলোকদের মারবে। কম্যুনিস্টদের সঙ্গে তাহলে তোমাদের ফারাক কী? এদিকে দীন ইসলামের কথা বলো, ওদিকে নাস্তিকদের কথা ধার করে বলো। আমরা এখন কোনটা ধরি, বলো?

ইসলাম তো সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। ইসলামে কোনো কাস্ট সিস্টেম নাই। আমাদের নবী এই কথা বলে গেছেন কতো আগে। কম্যুনিস্টরাই এসব ধার করেছে ইসলামের কাছ থেকে। কাদেরের গলা আত্মবিশ্বাসে ঝাঝালো হয়ে উঠেছে। এই ঝাঁঝ ইসমাইলের কাছ থেকে ধার-করা টের পেয়ে ছোটোমিয়া সন্তুষ্ট দামাদমিয়া এই এলাকায় সাগরেদ বেশ ভালো জুটিয়েছে। নমিনেশন পেলে ভোটটা ভালোভাবেই পাড়ি দেব। যাক, করতোয়ার পুব দিকটা তাহলে তাদের আত্মীয় কুটুম্বের দাপটে থাকে। ছোটোমিয়ার সন্তোষের আরেকটি কারণ হলো এই যে, ইসমাইলের সঙ্গে রাজিয়ার বিয়ের সম্পর্কটা পাকা হয় তার হাতেই। বড়ো ভাইয়ের তো ইচ্ছাই ছিলো না, মেজাভাইও তেমন গা করে নি। জমিজমা তেমন নাই; শুধু শহরের চাকুরে পরিবারের ছেলে হয়ে শিমুলতার মিয়াদের বাড়ির জামাই হওয়া অতো সোজা নয়। এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন হলো কেবল ছোটোমিয়ার গোঁ ছিলো বলেই। আজ সেই জামাইয়ের সাফল্যের আভাস পেয়ে সে তো একটু খুশি হবেই। কাদেরকে তার ওই জামাইয়ের কথাগুলোর জবাব দিতেও তার ভালো লাগে, ইসলামে কি কারো সম্পত্তি দখল করার হুকুম আছে? আমাদের হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাহিসালাম কি হজরত ওসমান রাজিআল্লাহু আনহুর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন? বরং তার সঙ্গে তিনি তার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। ধনী গরিব বড়ো কথা নয় বাবা। পরহেজগার মানুষ আমির হলেও ভালো, গরিব হলেও ভালো।

এতোসব খুঁটিনাটি ব্যাপার কাদেরের জানা নাই, জবাবই বা সে দেবে কোত্থেকে? ইসমাইল ভাই আজ খামাখা কলকাতা গেলো। কর্পোরেশনের মেয়র ইলেকশনের এখনো এক মাস, অথচ সেই অছিলা করে লোকটা ছুটলো। সুযোগ পেলেই খালি কলকাতা ছছাটে। ইসমাইল হোসেন আজ থাকলে এখানে চমৎকার মিটিং করা যেতো একটা। এক সাথে এতো মানুষ পাওয়া কি সোজা কথা?

তোমাদের লীগের বড়ো বড়ো হোমরাচোমরা তো সবই জমিদার আর বড়োলোক। তাদের উচ্ছেদ করলে তোমাদের পার্টি টিকবে কী করে? তার দীর্ঘ বক্তব্যের উপসংহার সেরে তার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে ভেবে ছোটোমিয়া তৃপ্তি পায় এবং বিজয়ীর উদারতায় আবদুল কাদেরকে রেহাই দিতে সে প্রসঙ্গ পাল্টায়। আবদুল আজিজের বড়ো ছেলে বাবরকে কোলে কাছে টেনে নিয়ে তার নাম, কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, পরীক্ষায় কেমন করে, ধান গাছে বড়ো বড়ো তক্তা হয় বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ কী প্রভৃতি জিগ্যেস করে এবং নিজের রসিকতায় হো হো করে হাসে। বাবর কিছুক্ষণ উসখুস করে ছোটোমিয়ার কৌতূহল ও আদর সহ্য করে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়। ছেলে হাতছাড়া হলে ছোটোমিয়া ধরে তার বাপকে। আবদুল আজিজের বস সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবের জীবন বৃত্তান্ত তার প্রায় সবটাই জানা। মুর্শিদাবাদের কোন এক। খান বাহাদুরের অকর্মণ্য ছেলে, আনওয়ার্দি সন অফ ওয়ার্দি ফাদার হিসাবে লোকটা চাকরি পেয়েছে কবে, সব কথা ছোটোমিয়া ফাঁস করে দেয়। আবার এটাও জানায়, সাব-রেজিস্ট্রারের সঙ্গে তাদের তিন পুরুষের আত্মীয়তা। ছোটোমিয়ার এক চাচী এসেছে ওই পরিবার থেকে এবং ওই চাচীর বাবা আবার ছোটোমিয়ার খালার দেওরের খালুশ্বশুর। তাদের এই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের কথা জেনে আজিজ বড়োই পুলকিত। জয়পুরে। অফিসে যোগ দিয়েই স্যারকে এটা জানাতে হবে। বেশ আনন্দিত চিত্তে এই খানকা। ঘরের মেহমানদের খাওয়ার বন্দোবস্ত কতোটা হলো তার খবরদারি করতে সে রওয়ানা হলো বাড়ির ভেতর। এইসব খাস মেহমানদের রান্নাবান্না হচ্ছে বাড়ির ভেতরে রান্নাঘরে, রাঁধছে তার বৌ আর শাশুড়ি। এদের জন্যে দুটো খাসি জবাই করা হয়েছে, এদের কেউ হয়তো গোরু নাও খেতে পারে। আর শুধু গোরুর গোশত দিয়ে কি সবাইকে ভাত খাওয়ানো যায়? দৈয়ের জন্যে লোক পাঠানো হয়েছিলো হাতিবান্ধায়, গোপাল ঘোষ নিজে দৈ নিয়ে আসবে। এখন পর্যন্ত তার দেখা নাই। বেলা হয়ে যাচ্ছে। তবে খানকা। ঘরের মেহমানদের আসার পরপরই ভারী নাশতা দেওয়া হয়েছে, তাদের খিদে লাগতে একটু সময় দেওয়ার দরকার।

এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই জেয়াফতের মজলিশ থেকে জোরে জোরে ধমক দেওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। কী নিয়ে কে কাকে ধমক দিচ্ছে না এই খানকাঘর থেকে বোঝা গেলেও একজনের গর্জনে আঁচ করা যায় যে, ওখানে কেউ সাংঘাতিক অপরাধ করে। ফেলেছে। মজলিশের হৈ চৈতে এখানেও অস্বস্তিকর নীরবতা নামে। মুসলিম লীগের এক উত্তেজিত কর্মী এই সুযোগ পাকিস্তানের অপরিহার্যতা নিয়ে নতুন করে কথা বলতে শুরু করে। জমিয়ে আলাপ করার প্রস্তুতি নেয় আবদুল কাদের। কিন্তু শরাফত মণ্ডলের ইশারায় তাকে উঠে যেতে হয় বাইরে যেখানে কে যেন কাকে কষে ধমকাচ্ছে।

টিনের আটচালা ও নতুন চারচালার মাঝখানে চওড়া গলির ভেতর থেকে গোরুর–গোশতের তরকারির বালতি হাতে তমিজকে ছুটে আসতে দেখে কাদের চোখে ও ভুরুতে প্রশ্ন ফুটিয়ে তুললে তমিজ বলে, হুরমত পরামাণিক ক্যাচাল করিচ্ছে।

ঝামেলা হুরমতুল্লা শুরু করলেও এতে তীব্রতা দেওয়ার কৃতিত্ব গফুর কলুর। বাইরের উঠানে কয়েকশো মানুষ বসার পর মানুষ উপচে পড়লে ওই গলিতে মুখোমুখি দুটি সারিতে পঞ্চাশ ষাটজন মানুষ বসাবার হুকুম দিয়ে গিয়েছিলো কাদের নিজেই। এখান সেখানে যারা বসেছে তাদের মধ্যে আছে হুরতমুল্লা আর তমিজের বাপ।। পরিবেশনের দায়িত্বে থাকলেও প্রথম দল বিদায় হবার পর হুরমতুল্লা খিদেয় অস্থির হয়ে আর অপেক্ষা করতে পারে না, গলির একটি সারিতে পাতা পেতে বসে পড়ে একটু চাপাচাপি করেই। কিন্তু পাশেই তমিজের বাপ। কেন বাপু, গোয়ালঘরের পেছনেই তো তোমাদের মাঝির জাতের মানুষের পাত পড়েছে, ওখানে সাকিদারি করার কাজও করছে মাঝিপাড়ার লোক। ওখানে বসলে তোমার পাতে ভাতের ভাগ কি কম পড়বে? না-কি গোশতের বালতি তোমাকে বাদ দিয়ে চলে যাবে সামনের দিকে? এক সারিতে বসলেও হয় কথা ছিলো, তা তো নয়, তমিজের বাপ বসেছে তার গা ঘেঁষে। শালা মাঝির এঁটো পাতের সুরুয়ার ছিটা কি ভাতের একটা দানা হুরমতুল্লার পাতে পড়লে সে সহ্য করে কী করে? হুরমতুল্লা তাই চাচায়, মাঝি, তোমার জাতের মানুষ তো ওটি এক ঠেনে বসিছে। তুমি এটি পাত পাতো কোন আক্কেলে গো?

তমিজের বাপ এসব কথায় কান না দিয়ে তার কলাপাতার টুকরাটা হাত দিয়ে। মোছে, কলাপাতায় ময়লা দাগ পড়ে, বারবার মুছলে সবুজ রঙ চাপা পড়লেও সেদিকে তার খেয়াল নাই, তার দুই চোখেই সে তাকিয়ে থাকে ধোয়া-ওঠা ভাতের চাঙাড়ির দিকে, ওটা এ পর্যন্ত পৌঁছুতে আর কতো দেরি?

হুরমতুল্লার সব অভিযোগ শুনে গফুর কলু এগিয়ে আসে। তার মূল দায়িত্ব ভদ্রলোক মেহমানদের খেদমত করা। তারা তো এখানে খানকাঘরে বসে গপ্পো করেছ; এই সুযোগে সে কলুদের খাওয়ার দেখাশোনা করছিলো। কলুরা বসেছে শিমুলতলার বকের ঝকের নিচে। তাদের জন্যে গোশতের বালতিতে সুরুয়ার সঙ্গে গোশতের পরিমাণ নিশ্চিত করতে সে নিজেই যাচ্ছিলো ভেতর উঠানের দিকে। এদিক দিয়ে হাঁটার সময় জাত তুলে কথা বলতে শুনে প্রথমেই সে ধমক দেয়, মোসলমানের আবার জাত কী গো? খবরদার, জাতের কথা কলে এই বাড়িত খাওয়া চলবি না।

ধমকে হুরমতুল্লা ভয় পায়। কলু জাতের মানুষ হলেও গফুরের দাপট সম্বন্ধে হুরমতুল্লা ওয়াকিবহাল, তাই সে তাড়াতাড়ি অন্য নালিশ করে, জাতের কথা লয় বাপু, খালি জাতের কথা লয়। খ্যাপশা বুড়া খাবার বস্যা খালি পাদে, গোন্দে প্যাট হামার খালি ঘাঁটিচ্ছে। বুড়াক তুমি সর্যা বসবার কও।

গোশতের খুশবুতে অন্য যে কোনো গন্ধই তো চাপা পড়বে। তবু তমিজের বাপের এই কাজটিকে গফুর কলু অনুমোদন করতে পারে না। থুথু ফেলে সে নাকে হাত দেয়। তার দেখাদেখি এবং তার সম্মানে আরো কয়েকজন নিজনিজ পাতের সামনে গোশতের সুরুয়া মেশানো আঠালো থুথু ফেলে। ততোক্ষণে হুরমতুল্লা ও তমিজের পাতে ভাত পড়েছে এবং গোশতের সুরুয়াও দেওয়া হয়েছে দুই হাতা করে। দুজনেই ভাতের গর্ত করে গোশতের টুকরাগুলি আলাদা করে একটু আড়াল করে রেখে সুরুয়ামাখা আঙুল চোষে। গোশত পাতে পড়ার আগেই অবশ্য নুনমাখা ভাতের কয়েকটি লোকমা তাদের মুখে উঠে পড়েছে।

গফুর কলু কপাল কুঁচকে তমিজের বাপের মুখে সরাসরি তাকায় এবং হঠাৎ বলে, ক্যা গো তুমি না গোয়ালঘরের পাছামুড়াত বস্যা খায়া আসলা। আবার এটি খাবার বসিছো? ওঠো, এখনি ওঠো। দুইবার কর‍্যা কাকো খাওয়া দেওয়া হবি না। একবার যতো খুশি খাও, প্যাট ড়ুমড়ুম্যা করা খায়া ওঠো। কিন্তু দুইবার দেওয়া হবি না, পোটলাও বান্দার দিমু না। এই জেয়াফতে খাওয়ার বিধিমালা জানিয়ে সে বিধি প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়, ওঠো! ল্যালপা বুড়া। ওঠো কলাম।

তখন মোটা একটা হাড় থেকে মজ্জা বের করার কাজে তমিজের বাপ খুব ব্যস্ত, গফুর কলুর নির্দেশ মানা তার পক্ষে অসম্ভব। বরং গফুরের হুমকিতে তার খিদে বাড়ে দশ গুণ এবং মজ্জা চোষা স্থগিত রেখে ভাত মুখে দিতে থাকে, তখন তার একেকটা গ্রাস তেআঁটিয়া তালের সমান। তার আশেপাশের এবং সামনের সারির কেউই তার দুইবার খাওয়া একেবারেই অনুমোদন করে না, জেয়াফতে এসে একবারের বেশি খাওয়া যে খুবই বদ খাসলতের প্রকাশ এ ব্যাপারে তারা একমত। তবে তাদের ধিক্কার জ্ঞাপনও পানসে। গফুর কলুকে খুশি করা তাদের উদ্দেশ্য, কিন্তু এই নিয়ে বেশি কথা বলা মানে এখন সময়ের অপচয় বিবেচনা করে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে একটির পর একটি লোকমা মুখে তোলে। তমিজের বাপের দৃষ্টান্ত তাদের কাউকে কাউকে দ্বিতীয়বার চুপচাপ পাত পাতার ফন্দি আঁটতে উদ্বুদ্ধ করেও থাকতে পারে।

হুরমতুল্লা ও গফুর কলু দুইজনের দুই ধরনের আপত্তি সত্ত্বেও তমিজের বাপ ফের ভাত নেওয়ার জন্যে পাত থেকে মুখ তুলে এদিকে ওদিকে তাকায়। ওই সময় তমিজ ওই গলি দিয়ে যাচ্ছিলো গোশতের বালতি হাতে। মাঝিপাড়ার মানুষদের পরিবেশন করতে করতে গফুরের মতো সেও যাচ্ছিলো ভেতরের উঠানে তার বালতিটা ভরে নিতে। রান্নাবান্না বাইরে হলেও নিরাপত্তার স্বার্থে গোশতের বড়ো বড়ো ডেকচিগুলো রাখা হয়েছিলো বাড়ির ভেতরের উঠানে একটা নতুন চালার নিচে। তা তমিজ তো কিছুক্ষণ আগে নিজেই বাপকে পাত ভরে ড়ুমা ড়ুমা গোশত ঢেলে দিয়েছে। গোয়ালঘরের পেছনে এক পেট খেয়ে বাপকে ফের এখানে এসে বসতে দেখে তমিজের হাসিই পায় : বুড়ার বেটার খাবার হাউসটা একটু বেশি। তা খাক, বুড়া মানুষ, এরকম খাবার ফের কবে জোটে আল্লাই জানে। মণ্ডল এতো এতো খাওয়াচ্ছে, দুইবার কেন, তিনবার চারবার। খেয়েও বাপের দিলটা যদি মণ্ডলের প্রতি একটু নরম হয় তো ভালো। বাপটাকে বেশি করে গোশত দেওয়া যায় কী করে এই ভাবতে ভাবতে সে শুনতে পায় গফুর কলুর কড়া নির্দেশ, ওঠো। তুমি ওঠো কলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাপের প্রতি প্রশ্রয় তার চাপা পড়ে তীব্র। ক্ষোভের তলায়।কয়টা দিন মণ্ডলবাড়ির এই জেয়াফতের জন্যে বেগার খাটলাম দেখ্যা বুড়া কী কথাটাই না হামাক শুনালো। আর তুমি এটি আসো ল্যালপা ফকিরের লাকান। তোমার দশগজি জিভখান লিয়া একবার গোলঘরের ওটি খায়া উঠা তুমি ফির আরেক জায়গাত অ্যাস্যা পাত পাতো। খাওয়ার এতো লালচ তোমার?—উচ্চারণ করে বলতে না পারলেও মনে মনে সে এই কথাগুলি ঠিক এমনি করেই আওড়ায়। গফুর কলু যেমন হারামি, মাঝির ঘরের তালাক-খাওয়া মাগীকে বিয়ে করে আর কাদেরের পাছার পেছনে। পেছনে ঘুরে ঘুরে শালা কি-না-জানি-হনু-রে ভাব নিয়ে থাকে, শালা বুড়া মানুষটাকে পাত থেকে না উঠিয়ে ছাড়বে না।-এতোগুলো মানুষের সামনে বাপের ভোগান্তি দেখা এড়াতে তমিজ হনহন করে হাঁটে গোয়ালঘরের দিকে, এমন কি গোশতের বালতি ভরে না নিয়েই। মাঝিদের পেট পুরে খাওয়াতে পারলে তাদের জানগুলো আরাম পায়। আবার তাদের মতো মাঝির ঘরের মানুষ হয়েও মণ্ডলবাড়িতে তমিজের দাপট দেখে ওই জানগুলোই হিংসায় চিনচিন করে। এতোগুলো জানের আরাম ও হিংসা তৈরির গৌরব ও সুখ থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে বাপের লালচের জন্যে।

চারচালা টিনের ঘরের জানলার কপাট একটু ফাঁক করে দুইজন মানুষের দুই ধরনের আপত্তি অগ্রাহ্য-করা এক বুড়োর প্রবল তেজে খাওয়া দেখছিলো আবদুল আজিজের শাশুড়ি। নাতি মরার পর দিন সে এসেছিলো টাটকা শোক নিয়ে। এবার দিন তিনেক হলো এসেছে মেয়ের শোক ও নাতির চল্লিশায় যোগ দিতে। মণ্ডলের দুই নম্বর বিবির অনুরোধে খাস মেহমানদের রান্নার দেখাশোনাও করছে সে-ই। এদের বাড়ি টাউনের সঙ্গেই। তাদের হাটবাজার, টুকটাক ব্যবসাপাতি, রোজগার কামাই সব টাউনেই। ছয় মাসে নয় মাসে ফাস্ট শো টকি দেখে তাদের বাড়িতে মেয়েরা বাড়ি ফেরে শাড়ি-জড়ানো রিকশা করে।

টাউনের প্রভাবে এবং একটু টানাটানির জন্যেও বটে, তাদের খাওয়া-পরা, ঘোরাফেরা মোটামুটি ছিমছাম। উত্তেজনা যেটুকু আছে তাও. প্রায় বাঁধা ধরা। টাউন তাদের একেবাইে ছোটো; কিন্তু চাষবাস নাই বলে রোজগার সম্বন্ধে মোটামুটি আগে থেকেই সব জানা। জীবনযাপনও তাই ধরাবাঁধাই বলা চলে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নাতির চল্লিশায় হৈ চৈ, ভিড়ভাট্টা এবং অনির্ধারিত ও অকল্পনীয় উত্তেজনা দেখে এবং খানদানি মেহমানদের রান্নার তদারকি করার সুযোগ পেয়ে হিংসায়, খুশিতে, গর্বে আজিজের শাশুড়ি ছটফট করে এবং যেদিকে চোখ যায় তাই দেখে নেয় নয়ন ভরে। রান্না সেরে মুখে একটা পান পুরতে এবং মেয়েকে কাছে পেলে ভালো রান্না সম্বন্ধে এই বাড়ির মানুষের সীমাহীন অজ্ঞতা নিয়ে তাকে যথাযথ ধারণা দিতে সে এসেছিলো মেয়ের ঘরে। জানলার ঠিক বাইরে কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা একটা বুড়াকে এরকম হেনস্থা হতে দেখে সে হেসে ফেলে। ব্যাপারটা দেখে সে বেশ তারিয়ে তারিয়ে এবং যতোই দেখে, ততোই হাসে।

ভেতর উঠানে সারি সারি কলাপাতার সামনে বসা মেয়েদের এবং তাদের কোলেপিঠেবুকে আসা রোগা, বেঢপ মোটা, পেটফোলা, মাথায় ঘা, চোখে পিঁচুটি ও নাকে-সিকনি বাচ্চাদের খাওয়ার তদারকি করতে করতে হামিদার হঠাৎ হঠাৎ করে মনে পড়ে তার ছেলের কথা। এতোগুলো মানুষ আজ মেতে উঠেছে ভাতের উৎসবে, গোশতের উৎসবে। তার সোনার টুকরা, বুকের মাণিকের অছিলাতেই এই বাড়িতে আজ এতোগুলো মানুষের মুখে ভাতের গেরাস ওঠে। অথচ, হায় রে, ছেলেটা তার কিছুই দেখতে পারলো না।-চোখের পানি মুছতে মুছতে হামিদা তার নিজের ঘরে এসে বিছানায় বসে হুহু করে কাঁদে। কিন্তু কান্নার সময় কৈ তার? তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে ফের যেতে হয় উঠানে। সে নিজের হাতে যতো মানুষকে যতো তৃপ্তি দিয়ে খাওয়াতে পারবে, মাসুম ছেলেটার রুহে ততো শান্তি, ততো তৃপ্তি। এখনি ফের উঠানে। যাবে বলে হামিদা উঠতে যাচ্ছিলো, জানলার পাশ থেকে ডাক দিলো তার মা, ও হামিদা, দেখ, মানুষটা ক্যাংকা করা ভাত খাচ্ছে, দেখ। আর একবার বলে খায়া আসিছে। দেখ, একোটা লোমা কতো বড়ো? গাঁয়ের মানুষ এতোও ভাত খাবার পারে গো!

গ্রামের মানুষের বেশি বেশি ভাত খেতে দেখার প্রবৃত্তি হামিদার একেবারেই নাই। বিয়ের পর থেকেই এটা দেখে দেখে সে একেবারে অতিষ্ঠ। নেহায়েৎ মায়ের উৎসাহে হামিদা এসে দাঁড়ালো একটু-ফাঁক-করা জানলার পাশে।

ঐ সময়টায় গফুর কলু ও হুরমতুল্লার দুইরকম অভিযোগ ও ধিক্কার শুনতে শুনতে তমিজের বাপ আরো চারটে ভাতের আশায় পাত থেকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো ওপরের দিকে। এই ঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে তার মুখটা এবার স্পষ্ট দেখা গেলো। তমিজের বাপকে দেখেই হামিদা একটা জোর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে পেছন দিকে। বিছানাটা ছিলো বলে বসে পড়লো ওটার পরেই। তা জানলা দিয়ে তমিজের বাপকে চোখে পড়ে এই বিছানা থেকেও। পাতে দ্বিতীয় দফা ভাত তখনো পায় নি বলে তমিজের বাপের মুখটা তখনো ওপরের দিকে ফিট-করা। সুতরাং হামিদা তাকে নয়ন ভরে দেখতেই থাকে। দেখতে দেখতেই সে কাঁপে এবং তার পাশে বসে মা তাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলে, কী মা? কী হলো রে মা?

ফ্যাকাশে চেহারার মুখ দিয়ে হামিদা ফিসফিস করে, এই মানুষই মা! এই মানুষটাই গো হুমায়ুন যাওয়ার আগের দিন রাতে, না-কি তার আগের রাতে, তোমাক কলাম না মা, কই নাই? এই মানুষটাই আসিছিলো গো। হামিদার মায়ের সব মনে আছে। হামিদার সেই কালরাত্রির অভিজ্ঞতার কথা হামিদার মা শুনেছে হুমায়ুনের মৃত্যুর পরদিনই এখানে এসে। এই বাড়ির সব মানুষ এই ঘটনা জানে। গ্রামের লোকও অনেকে শুনেছে আর হামিদা তার মাকে বলেছে অন্তত একশো বার।

১৫. প্রস্রাবে রক্তের ধারা

মরার দুই দিন আগে হুমায়ুন সারা দিনে প্রস্রাব করলো তিন বার, প্রস্রাবে রক্তের ধারা। তার সারা শরীর জুড়ে জ্বর মেতে ওঠে মাতালের মতো, বাড়তে বাড়তে জ্বর উঠে পড়ে ১০৬ ডিগ্রিতে। মাথায় অনেকক্ষণ পানি ঢাললে তাপ একটু কমে। জ্বর তখন আড়ি পেতে থাকে বালিশের তলায়, তোষকের নিচে। রোগীর মাথায় পানির ধারা একটু থামতে না থামতে জ্বর ফের লাফিয়ে এসে আসন পেতে বসে হুমায়ুনের কপালে। হরেন ডাক্তার বলে গেলো, এতো পানি ঢাললে নিউমোনিয়া হতে পারে, বরং কপালে জলপট্টি দিলে হয়।

অনেক রাত পর্যন্ত জলপট্টি দিলো মণ্ডলের ছোটোবিবি, পাশে পালা করে বসছিলো আজিজ ও কাদের। কিছুক্ষণ পরপর বাটির পানি পাল্টে দিচ্ছিলো হামিদা। নিজের ঘরে। জলচৌকিতে রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে চললেও নাতির প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখছিলো শরাফত মণ্ডল। পুবদুয়ারি ঘরে বড়োবিবি হুমায়ুনের জ্বরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়মমাফিক গালাগালি করছিলো স্বামীকে, রাত বাড়তে বাড়তে ক্লান্ত হয়ে না খেয়ে ও এশার নামাজ না পড়েই সে ঘুমিয়ে পড়ে। রোগীর ঘরে এশার নামাজ পড়ার পর ছোটোবিবির হাত আর চলে না, চোখ খুলে রাখাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাদের চলে গিয়েছিলো আগেই। আজিজ আর হামিদা ছোটোবিবিকে একরকম জোর করেই পাঠিয়ে দিলো, অন্তত ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে আসুক। ছোটোবিবি চলে যাবার পরপরই আবদুল আজিজ ঝিমুতে শুরু করে, কখন গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছে ছেলের পায়ের কাছে সে বুঝতেই পারে নি। মিহি স্বরে তার নাক ডাকার আওয়াজ পেয়ে হামিদা আস্তে করে ডাকে, বাবরের বাপ। ও বাবরের বাপ। এতে তার নাক ডাকা থামে, কিন্তু ঘুম ভাঙে না। ঘরটা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। টিনের চালে শুকনা পেয়ারা পাতা পড়ে তিন ফোঁটা শিশিরের ভারে, হালকা ভিজে শব্দে ঘরের নীরবতায় এক ফোঁটা ফাঁক থাকে না।

ঘরে একা জাগে হামিদা। জলপট্টির ভিজে ন্যাকড়া হুমায়ুনের শিওরের বালিশের পাশে রাখা কাঁসার জামবাটির পানিতে ভিজিয়ে হামিদা ওর কপালে রাখতে না রাখতে শুকিয়ে যায়, শুকিয়ে গরম হয়ে যায়। মানুষের শরীরে এতো তাপ? হুমায়ুনের শরীর থেকে ভাপ বেরোয়, এই ভাপে হামিদার চোখ জ্বলে। চোখ বুজলে একটু আরাম পাওয়া যায়। বেশ আরাম!-বাবা আম, সোনা আমার, আমার আব্বা, আমার ময়না।হামিদা তার ঠোট রাখে ছেলের কপালে, ঠোট রাখে ছেলের গালে। ঠোট রেখে সে ছেলেকে চুমু খেতে থাকে। চুমুর চুমুকে সে শুষে নেবে ছেলের সব তাপ, সব জ্বালা।আল্লা, আল্লা গো, আমার ছেলেকে তুমি ভালো করে দাও। আমার ছেলের সব রোগ, সব তাপ তুমি আমাকে দাও আল্লা। আমার হুমায়ুনকে তুমি ভালো করে দাও।আল্লাকে সে এইসব কথা বলছে, এমন সময় হামিদার পিঠে লাগে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক। তাহলে আল্লা তার মিনতিতে সাড়া দিয়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা পাঠিয়ে দিলো, এই শীতল বাতাসে। ছেলের গা জুড়াবে। এরপর হামিদার গায়ে লাগে আরেক ঝাপটা ঠাণ্ডা হাওয়া, তার মাথাটা আরো ঝরঝরে হয়। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নাকে লাগে লোবানের গন্ধ। লেবানের গন্ধে তার বুকে ধক করে আওয়াজ হয়, সে চট করে মাথা তোলে। তার সামনে সাদা ধবধবে কাপড়পরা কাচাপাকা দাড়িওয়ালা একটা মানুষ। লোকটার গলায় ঝোলানো লম্বা লোহার শেকল। হামিদার ডান হাতটি তখন ছেলের বুকের ওপর, সেই হাতটিতে তার ধরা রয়েছে জলপট্টির শুকনা ন্যাকড়া। তার হাতের ভারে ছেলেটা বুঝি হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু হামিদা না পারে তার হাতটা তুলতে, না পারে সাদা কাপড় জড়ানো লোকটির চেহারা থেকে চোখ সরাতে। ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ; হুমায়ুন অসুখে পড়ার পর থেকে জানলাগুলো সব সময়েই বন্ধ থাকে, আর বিকাল হতে না হতে দরজা আটকে দেয় বড়োবিবি। তাহলে এই লোকটি ঘরে ঢুকলো কী করে, এই প্রশ্নটি কিন্তু তখন হামিদার মাথায় ওঠে নি। বরং সুবেহ সাদেকের হালকা আলোর মতো একটি জিজ্ঞাসার আঁচ লাগে তার শরীর জুড়ে : এই মানুষটিকে সে কোথায় দেখেছে? কবে দেখেছে? ঘোলাটে লাল চোখে লোকটি হুমায়ুনকে দেখে। তার চোখের ঘোলাটে সাদা জমি জুড়ে ঘোলা আলো। মণিহীন চোখ সে ফেরায় হামিদার দিকে। তার ঠোট নড়ে না, কিন্তু বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ফ্যাসফেসে কথা, আর কদ্দিন? বেটাকে এখন আরাম দে, আরাম দে! লোবানের গন্ধ আরো তীব্র হয়।

এই খসখসে স্বর হামিদা আগেও শুনেছে। কোথায় শুনলো? কবে শুনলো? কোনোদিন কি শুনেছে?–এসব মনে করার চেষ্টা বাদ দিয়ে সে বলে ফেলে, যাও।। যাও। কিন্তু বোৰা-ধরা মানুষের মতো তার গলা থেকে আওয়াজ বেরোয় না। দুই কামরার মাঝখানে খোলা দরজায় পেরেক ঝোলানা হ্যারিকেনে সলতে জ্বলছিলো কালচে লাল আলোয়। সেই আলোয় মানুষটির পরনের সাদা কাপড়টিকে হামিদা কাফনের কাপড় বলে ঠাহর করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হ্যারিকেন দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেলো। বাতি নেভার আগে দুপ-করে জ্বলে-ওঠা আলোয় কাফনের ওপর কয়েক জায়গায় ছোপ ছোপ মাটির দাগও হামিদার চোখে পড়ে। আলো যাওয়ার পর মানুষটিকে আর দেখা গেলো না। তবে এর পর উঠানে গুনগুন শোলোক শোনা যায়। গানের কথাগুলো হামিদা শুনতে পায় সবই, কিন্তু ঘর্ঘর গলার স্বর মিশে যেতে না যেতে হামিদা চিৎকার করে পড়ে যায় ছেলের বুক ঘেঁষে।।

কিছুক্ষণের মধ্যে পানির ঝাপটায় তার জ্ঞান ফেরে, ঘরে তখন ঘরভরা মানুষ। বাকি রাতটায় হুমায়ুন ছাড়া আর কারো ঘুম হয় না। হঠাৎ করে তার জ্বর নেমে আসে ১০০ ডিগ্রিতে। হামিদা রাতভর তার দেখা দৃশ্য শব্দ ও গন্ধের বিবরণ দেয়, ভয়ে কাঁপা গলায় তার বর্ণনা ক্রমেই অস্পস্ট ও এলোমেলো হতে থাকে।

শরাফতের ছোটোবিবি টের পায়, এসব চেরাগ আলি ফকিরের কেরামতি। কাউকে বলে সে কোথায় না কোথায় চলে গিয়েছে, কোথায় তার মরণ হয়েছে কে জানে? সে-ই কোনো ভেক ধরে এসে এই গাঁয়ের ছেলেদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। হামিদার এই খোয়বের মাজেজা যদি কেউ বার করতে পারে তো এক তমিজের বাপ ছাড়া আর কেউ নয়। চেরাগ আলির সঙ্গে সঙ্গে থাকতে তো কেবল সেই। ফকিরের নাতনিকে বিয়ে করার পর তার যাবতীয় বিদ্যা, যাবতীয় বুদ্ধি, যাবতীয় ফন্দিফিকির এখন চলে এসেছে তার কবজায়। হামিদা বারবার জানায়, সে তো স্বপ্ন দেখে নি। স্বপ্নই যদি দেখবে তো হ্যারিকেন সত্যি সত্যি নিভে যায় কী করে? সে বেহুঁশ হয়ে পড়লে আবদুল আজিজ জেগে উঠে ঘর কি অন্ধকার পায় নি। তারপর, স্বপ্নে মানুষ কি আর লোবানের গন্ধ পায়? এই গন্ধটি কিন্তু ছোটোবিবির নাকেও ঢুকেছিলো।

পরদিন সকাল থেকে বাড়ির সবার মেজাজ ফুরফুরে। হুমায়ুনের জ্বর ৯৯.৫ ডিগ্রি, নেবুর রস দিয়ে সে বার্লিও খেয়েছে আধ বাটি। হামিদা কিন্তু ছেলের রোগশষ্যা থেকে এক পা নড়ে না। কিছুক্ষণ পরপর সে কেবল শিউরে শিউরে ওঠে।

তমিজের বাপেক ডাকো। বাবরের মায়ের খোয়বের তাবির না শুনলে হুমায়ুনের কী হবি কেউ করার পরবি না। মণ্ডলের ছোটোবিবি বারবার করে বললে আজিজেরও ভয় লাগে। ছেলের সঙ্গে বৌও পড়ে গেলে আবদুল আজিজের হালটা হবে কী? সুতরাং

তমিজকে দিয়ে খবর পাঠানো হলো তার বাপকে। ঘরের ব্যাপারে চারবাকর কি আধিয়ারদের জড়ানো শরাফত মণ্ডল কিংবা আজিজ একেবারেই পছন্দ করে না। কিন্তু হামিদার জোর হলো তার সৎশাশুড়ি, ছোটোবিবির সঙ্গে লাগতে যাওয়া শরাফতের। পক্ষে কঠিন। আর আজিজ কি আর নিজের বৌকে ভয় পেয়ে মরতে দেখবে?

তমিজের বাপ কিন্তু আসে নি। বেটার কাছে টুকরা টুকরা করে হামিদার স্বপ্ন বা জাগরণে দেখা ঘটনার সবটাই সে শোনে। প্রায় ঝিমাতে ঝিমাতে শোনে এবং শুনে ঝিম ধরে বসে থাকে। সন্ধ্যা হতে না হতে সানকিভরা ভাত খেয়ে মাচার ওপর চিৎপটাং হয়ে সে ঘুমায়। ঘুমের ভেতর তার যাবতীয় বিড়বিড় করা শুনতে সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে ছিলো কুলসুম। তমিজের বাপের মুখ থেকে মেলা আওয়াজই তো বেরোয়, কিন্তু এর কোনোটাই কুলসুমের কানে শব্দের গড়ন পায় না। তবে দাদার কোনো কোনো শোলোকের রেশ আঁচ করা যায়। এতে কুলসুমের মাথাটা শুধু কামড়ায়।

সেই রাতে নাকে লোবানের গন্ধ পেয়ে ও কানে গুনগুন শোলোক শুনে হামিদা নতুন করে ভয় পায়। ঘরভরা মানুষ সেদিন তার সঙ্গে জেগে ছিলো। হামিদার বড়ো বড়ো চোখে অপরিচিত ছায়া দেখে তাদের গা ছমছম করে। সকালবেলা কাদের তাড়া দেয় তমিজকে, তার বাপ এসে হামিদাকে অন্তত বানিয়ে বানিয়েও দুটো কথা বলুক। বাড়িতে তমিজ বাপকে রীতিমতো শাসায়, সে যদি মণ্ডলবাড়ি না যায় তো শরাফত তাদের জমি বর্গা করতে দেবে আর? বাপ এরকম করলে তমিজ কিন্তু এসপার ওসপার একটা কিছু করে ফেলবে। ছেলের হুমকিতে বাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, . তাকিয়েই থাকে। এ ছাড়া তার আর কোনো প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না।

কুলসুম তখন নিজে মণ্ডলবাড়ি যাবার প্রস্তাব করে। তা কুলসুম গেলেও হয়। হাজার হলেও সে হলো চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি। তমিজ জানে তার এই সত্যটি কম মানুষ নয়। তার বাপটাকে এখনো ফকিরের কবজার মধ্যে ধরে রেখেছে এই কুলসুমই।

তমিজ ও কুলসুম পাশাপাশি হাঁটে এবং তমিজ মহা উৎসাহে হামিদার ভয় পাওয়ার গল্প বলে। অনেকটা এসে, বুলু মাঝির পালান পেরিয়ে তমিজ পেছনে তাকিয়ে দেখে, একটু দূরে ফকিরের ঘাটে দাঁড়িয়ে বাপ তাদের একসঙ্গে হাঁটা আর কথা বলা দেখছে। তমিজের বাপ দাঁড়িয়েই থাকে, তারা চলে মণ্ডলবাড়ির দিকে।

কুলসুমের কাছে হামিদা সেই রাতের বিস্তারিত বয়ান পেশ করে। সে শুরু করেছিলো ওইদিন সন্ধ্যা থেকে হুমায়ুনের কপালে জলপট্টি দেওয়া, এশার নামাজের পর তার ক্লান্ত সৎশাশুড়ির পাশের ঘরে জিরোতে যাওয়া এবং ছেলের পায়ের কাছে। আজিজের ঘুমিয়ে পড়ার বর্ণনা দিয়ে। যতোটা সময় জুড়ে এইসব কাণ্ড ঘটে, বর্ণনাতে সে বরাদ্দ নেয় প্রায় ততোটা সময়। এর ফাঁকে ফাঁকে তার ছেলের বিদ্যাবুদ্ধি, } খেলাধুলায় তার পারঙ্গমতা, ছেলের ওপর তার টাউনবাসী মামুদের প্রভাব এবং বড়ো ছেলে বাবর ও ছোটো ছেলে হুমায়ুনের স্বভাবের মিল ও পার্থক্য সম্বন্ধে অনেক তথ্য সে পরিবেশন করে যায়। অনেকগুলিই কুলসুম কিছু না বুঝলেও তার কাছে সেসব বিরক্তিকর কিংবা অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে নি। হামিদার প্রত্যেকটি কথাই সে শুনছিলো নিবিষ্টচিত্তে, তার মুখ ছিলো সম্পূর্ণ বন্ধ। মাঝে মাঝে ঠায় বসে থেকে একটুও না ঝুঁকে সে নাক টেনে গন্ধ নিচ্ছিলো, গন্ধে গন্ধে হামিদার স্বপ্নের ভুলে-যাওয়া টুকরাগুলো হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে। তবে সেই রাতে ছেলের জ্বরতপ্ত কপালে হামিদার চুমু খাওয়ার কথায় কুলসুম কেঁপে ওঠে। কাঁপুনি চেপে রাখতে চেষ্টা করলে তোলপাড় ওঠে তার বুকে, খানিকটা পাঁজরার হাড়ে এবং এতেই সেখানে বেড়ে ওঠে চেরাগ আলির গলা। কুলসুম স্পষ্ট শোনে,

খোয়বে জননী চুধে পুত্রের ললাটে।
ঝাঁপ দিয়া পড়ে বাছা মণ্ডতের ঘাটে।।
চুম্বিলে পুত্রেরে মা গো কী কহিব আর।
আজরাইল লুকায়া ছিলো ওষ্ঠেতে তোমার।।

তারপর হামিদার স্বপ্নে, হামিদা অবশ্য স্বপ্ন বলে মানতে চায় না, স্বপ্ন হলে হ্যারিকেন সত্যি সত্যি নিভে যায় কী করে?-কাফনপরা মানুষটি গায়েব হয়ে গেলে বাইরে যে শোলোক শোনা গিয়েছিলো কুলসুম সেটা শুনতে চায়। হামিদা তার একটি অক্ষরও মনে করতে পারে না, কুলসুমের বারবার তাগাদায় সে চোখ বন্ধ করে ভাবে, কিন্তু লাভ হয় না। ততোক্ষণে কুলসুম মাথার ভেতরে শোনে চেরাগ আলির দোতারার টুংটাং বাজনা। কুলসুম আস্তে করে বলে, আমি কই? মনে করা দেখেন, এই শোলোক লয়? এরপর কুলসুমের গলা একটু মোটা হয়, বোধহয় তার গলায় গাইতে শুরু করে চেরাগ আলি,

তপ্ত দেহে পোড়ে পাখি, জননীর না পড়ে আঁখি
আঁখিটি মুঞ্জিলে পরে ঘরত পাখি নাই।
ওগো ওগো মা জননী ঢাকো তোমার চোক্ষের মণি
ডিমের ভেতরে ডানা কেমনে ঝাপটাই।
জননী মুঞ্জিলে চক্ষু উড়াল দিয়া যাই।
মা জননী ঘুমাও গো এবার বিদায় চাই।।

শুনতে শুনতে হামিদার চোখে নামে ভয় আর উত্তেজনা। এই ভরদুপুরে নামে হ্যারিকেন নিভে-যাওয়া ঘনঘোট আন্ধার রাত, এর মধ্যে কুলসুমের গলায় সে শোনে সেই রাত্রির শোলোক। ব্যাকুল হাতে সে জড়িয়ে ধরে কুলসুমের হাত এবং জড়ানো গলায় বলে, ওই শোলাকই তো। একটা কথার ফারাক নাই। আরেকবার ক বুবু, আরেকুবার ক।

বুবু সম্বোধনে কুলসুম বিগলিত হয়, এক্ষুনি গুনগুন করা শোলোক তার গুলিয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে পুরো শোলোক ফের মনে করার চেষ্টা করে, হামিদা মিনতি করে, বুবু, তুই আমার মায়ের পেটের বোন। আরেকবার ক বুবু। কিন্তু হামিদার চোখ তন্দ্রায় জড়িয়ে আসছে। কুলসুম ফের বলে,

চান্দ জাগে বাঁশ ঝাড়ে কতো কতো ডিম পাড়ে।
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইল সকল ঠাঁই।
উঁকি দিয়া দেখি হামার ফকির ঘরত নাই।।
ময়না পাখি উড়াল দিছে কোনঠে তারে পাই।।

হুঁ, এই গানই করিছিলো গো, মানুষটা এই গানই করিছিলো গো, মানুষটা এই গানই করিছিলো। জড়ানো জিভ থেকে তার কথা পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে, চোখজোড়া তার খুঁজে খুঁজে আসে। পিড়ি থেকে সে পড়েই যেতো, মণ্ডলের ছোটোবিবি পেছন থেকে তাকে ধরে ওঠায় এবং নিয়ে যায় হামিদার শোবার ঘরে। হুমায়ুনের পাশে তাকে শোয়াতে না শোয়াতে হামিদা ঘুমিয়ে পড়ে।

হুমায়ুনের দাফনের সময় হামিদার ভাই টাউনের এক জবরদস্ত মৌলবিকে নিয়ে এসে বাড়িটাকে দোয়াদরুদ পড়িয়ে ভালো করে বাঁধিয়ে দেয়। চল্লিশ দিন ধরে হামিদার ঘরে কোরান শরিফ পড়া হচ্ছে। তবে হামিদার দেখা কাফনপরা মানুষটার ব্যাপারে কারো কোনো গা নাই। সেই একটি রাতের পর হামিদাকে সেও তো একবার চোখের দেখাটাও দেখতে এলো না।

 ১৬. মরার কথা ইশারায় জানিয়ে দিয়ে

বেটার মরার কথা ইশারায় জানিয়ে দিয়ে পাকা দেড়টি মাস পর কাফনের কাপড় পাল্টে খয়েরি-নীল চেক-কাটা লুঙ্গি পরে এই ভর দুপুরবেলা ওই মানুষটা এসেছে ওই ছেলেরই চল্লিশার ভাত খেতে। তাও একবার খেয়ে তার আশ মেটে নি, বেহায়ার মতো ফের বসেছে কলাপাতা পেতে। হামিদা মানুষটাকে দেখে, ভালো করে দেখে; তার নজর লেগেই কি-না কে জানে, লোকটার কাঁচাপাকা দাড়িগুলো দেখতে দেখতে পেকে ওঠে। এবং তার গলায় গজিয়ে ওঠে শেকলের মালা। এইসব কাণ্ডে হামিদার নজর দেওয়ার শক্তি লোপ পায় এবং তার চোখজোড়াও বুজে আসে। তবে তার শরীরের কাঁপুনি কমে।, ওই কাঁপুনির ধাক্কায় তার মায়ের শরীর কাঁপে দ্বিগুণ বেগে। তবে মেয়ের মতো তার জবান বন্ধ হয় নি। হামিদার মায়ের বিলাপে ভেতর-উঠান থেকে অনেকেই এই ঘরে আসে এবং তাদের অনেকেই হামিদার বিচলিত হওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে তার ওপর বিরক্ত হয়। তবে সহানুভূতিও কারো কারো ছিলো বৈ কি? তারা জিভ দিয়ে চ চ। এবং গলায় নানারকম ভিজে আওয়াজ করে। তবে তাদের কিছুই করবার নাই এবং বৌয়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের অধিকার তাদের এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাদের। সমবেদনা প্রকাশ অন্যদের বিরক্তিকে আরো বাড়ায়। রীতিমতো রাগ করে হামিদার শাশুড়ি, শরাফতের বড়োবিবি। বৌয়ের ওপর রাগের চোটে নাতির শোক তার স্থগিত থাকে এবং অনেকদিন পর হুমায়ুনের জন্যে উদ্বেগ ও কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ক্রোধের হাওয়ায় তার নিজের রেওয়াজ বাতিল হয়ে যায়। পুবদুয়ারি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে।

বারবার ডাক পেয়ে আবদুল আজিজ একবার আসে। হামিদার এইসব ব্যাপারে সে বেশ ব্ৰিত, বিচলিতও বটে। শাশুড়ির সামনে বৌয়ের সঙ্গে রাগারাগি করার ঝুঁকিও নিতে। পারে না, তাই হামিদাকে সে ধমকায় একটু আদুরে গলায়, বাবরের মা, তুমি একটু শক্ত না হলে চলে? মনটা শক্ত কর। আল্লার মাল আল্লার পছন্দ হছে, নিয়া গেছে।

আজিজ ঘরে ঢুকতে তার শাশুড়ি সরে গিয়েছিলো দরজার আড়ালে। টাউনের শাশুড়ি, লজ্জাশরম কম, তাই ওখান থেকেই জামাইকে সরাসরি বলতে পারলো, হামিদা টাসকা ল্যাগ্যা গেছে বাবা, একটা বড়ো ব্যারাম হতে কততক্ষণ? কাল না হয় হামি অক সাথে করা লিয়া যাই।

শুনে সবাই ঠোট বাঁকায়, বেটা যেন কারো আর মরে না! বেটার শোকে মায়ের কঠিন ব্যারাম হবে কেন? এটা আবার কোন দেশী কথা গো? টাউনের বুড়িগুলোর আক্কেল জ্ঞান কম।

এদিকে বৌয়ের রোগশোক নিয়ে পড়ে থাকলে আবদুল আজিজের চলে না। উঠানে সারি সারি বসা মেয়েদের পেছন দিয়ে সে চলে যায় বাইরে মজলিশের মাঝখানে। বৌ-সোহাগের সময় কোথায় তার? মানুষ এতো এসেছে, এরকম জেয়াফত তাদের বাড়িতে এই প্রথম। বংশে মানুষ কি আর মরে নি? তার দাদার চল্লিশায় ফকির খাওয়ানো হয়েছিলো, জনা পঁচিশেক মানুষ ছিলো কিনা সন্দেহ। আর আজ তার নিজের ছেলের মৃত্যুতে এতো বড়ো আয়োজন। আজিজের চোখ ছলছল করে, হুমায়ুন মরে গিয়ে বাড়িতে এতো মানুষের জমায়েতের পথ করে দিয়ে গেলো। অথচ আজিজের নিজের অফিসের একটি মানুষও এলো না। কেরানির চাকরি করে, তাকে পোছে কে? কিন্তু চাকরি সে যতো ছোটোই করুক, তার বাড়িতে কত মানুষের উৎসব হতে পারে সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবকে একবার দেখাতে পারলে লোকটা কথায় কথায় তার ইংরেজি ভুল ধরার বাতিকটা কাটিয়ে উঠতো। লোকটা নিজে না আসুক, অফিসের একটা চাপরাশি এসেও যদি এই বাড়ির আজকের হালটা দেখে যেতো তো জয়পুর ফিরে গিয়ে অফিসের আর সবাইকে অন্তত ওয়াকিবহাল তো করতে পারতো!

বয়স কম হলে কী হয়, কাদেরটা এদিক থেকে অনেক চালাক। টাউনে সব ব্যবস্থা করে এসেছিলো, সবাই একসঙ্গে হয়ে ১৫/২০ জন মানুষ টমটমে করে এসেছে হৈ চৈ করতে করতে। গাড়ি থেকে নেমেই তারা মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, লড়কে লেঙে, পাকিস্তান, নাড়া দিয়ে গ্রাম কাঁপিয়ে তুললো। জেলার নেতাগোছের মানুষও এসেছিলো তিন জন। কাদেরের এই মেহমানদের যেভাবে আজ খাওয়ানো হলো তাতে টাউনে কাদেরের পজিশন কতো বাড়বে!

সেখানে আবদুল আজিজের হালটা কী?-শোক, আক্ষেপ ও চিনচিনে হিংসা থেকে আজিজকে উদ্ধার করে গোলাবাড়ি প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার আলিমুদ্দিন। লোকটা হাজির হলো একেবারে বিকালবেলা। এক স্কুল ছাড়া মানুষটা সব জায়গাতেই লেট। মানুষ পেলেই দাঁড়ায়, আর চাষাভুষাদের সাথে তার জমে বেশি। বাড়ি অনেক দূরে, পশ্চিমে শান্তাহার কি আদমদিঘির ওদিকে, এখানে থাকে গোলাবাড়ির উত্তরে এক চাষার বাড়িতে। তার চাষবাসের কাজেও হাত লাগায়, নইলে চাষা তাকে থাকতে দেবে কেন? চাষাদের সঙ্গে তার মেলামেশা দেখে কাদের তার সঙ্গে লীগের ব্যাপার আলাপও করেছে, তেমন আমল বোধহয় পায় নি। আজ তাকে দেখে আবদুল আজিজ তার স্বভাবের অতিরিক্ত তৎপরতা দেখিয়ে আলাপ করে এবং খানকাঘরে নিয়ে তাকে বসায় মেহমানদের সঙ্গে। খাওয়া দাওয়া তখন তাদের শেষ। তবে কাদেরের লীগের কর্মীদের কেউ কেউ তখনো খায় নি। আলিম মাস্টারকে আজিজ তাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলো।

নামীদামি মেহমানরা কাঁচা রাস্তায় টমটমে ফিরে যাবে, তারা একটু তাড়াহুড়া করে গাড়িতে ওঠে। শিমুলতলার ছোটোমিয়ার ফিটনগাড়িতে জোড়া ঘোড়া জুতে সহিস অপেক্ষা করছে। ছোটোমিয়া হাতের ছড়ি একটু একটু নাড়াচ্ছে আর মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলছে। আবদুল আজিজ হোটোমিয়ার কাছছাড়া হয় না, শেষ সময়ের কথাটাই মানুষের মনে থাকে।–সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবের সঙ্গে দেখা হলেই ছোটোমিয়া যেন আজিজের প্রসঙ্গ তোলে।

আবদুল কাদেরের মেহমানদের মধ্যে কমী গোছের রয়ে গেলো পাঁচজন। আজ রাতে তারা মানুষের ঘরে ঘরে যাবে। দলের পোস্টার আর হ্যান্ডবিল আনতে কাদের গোলাবাড়ি লোক পাঠিয়েছে।

বিকাল শেষ হতে না হতে বেশ ঠাণ্ডা পড়লো। খানকাঘরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শরাফত মণ্ডল দেখে শুকনা খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোয়াচ্ছে তার বাড়ির কামলাপাট, সঙ্গে আরো কিছু মানুষ জুটেছে। লোকগুলো জেয়াফত খেয়ে এখনো বাড়ি ফিরে যায় নি। এরা এতোক্ষণ করে কী? আহা থাক, শীতে কষ্ট পাচ্ছে, এখানে একটু গা গরম করে যাক! শরাফত ছলছল চোখে তাদের দেখে। তার ছোট্টো দাদাভাইকে আল্লা বেহেশত নসিব করবে, মাসুম বাচ্চাটার জন্যে এই লোকগুলোর দোয়া আল্লার আরসে পৌঁছুবে সবার আগে। গরিব মানুষকে আলাদা করে দোয়া পড়তে হয় না, ভুখা মানুষের তৃপ্তিই আল্লাকে সন্তুষ্ট করে, গরিব বান্দার ভরা পেটের চেয়ে সুখ আল্লার কাছে আর কী আছে? এই এলাকায় এতগুলো গরিব মানুষ ভুখা নাঙা মানুষ আছে বলেই তো তাদের খাইয়ে তৃপ্তি দেওয়ার সুযোগ আজ শরাফত মণ্ডলের হলো। আহা এরা থাক। নাঙা মানুষের গায়ে আগুনের ওম লাগলে সেই আরামে তার নাতির রুহের মাগফেরাত হবে।

শিমুলগাছের সাদা বকের ঝক নিচের আগুনের তাপে ওম নিতে নিতে তাদের পাখাগুলো আস্তে আস্তে মেলে, কিন্তু গুটিয়ে নেয় ঝপ করে। কয়েকটা বক শান্ত ও অলস উড়ালে চলে যায় বিলের ওপরকার পাতলা কুয়াশার ভেতর, তারপর ছোটো ছোটো ঝকে ভাগ হয়ে ডানায় কুয়াশার হিম মাখতে মাখতে বিলের ওপর ঘিরে ঘিরে ওড়ে।

গোলাবাড়ির রাস্তায় এখনো যারা হাঁটছে তারা সবাই ফিরে যাচ্ছে এই বাড়ি থেকেই। পাতলা কুয়াশায় তাদের গতি বোঝা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। বিলের ওপারে শরাফত মণ্ডলের নিজের জমি এবং তার আকাঙ্ক্ষিত জমির ওপর কুয়াশা একটু ঘন। ধান কাটা হয়ে-যাওয়া জমির উদাম বুক ধানগাছের স্মৃতিতে কুয়াশার ভেতরে একটু কঁপে কাৎলাহার বিলের ওপরকার কুয়াশা আঁশটে পানির গন্ধে পুরুষ্ট হচ্ছে। ওদিকে তাকিয়ে শরাফতের বুক পেট মাথা ভরে যায় কানায় কানায়।

শীতের সন্ধ্যা নামে ঝপ করে, কুয়াশার কোলে-পিঠে অন্ধকার ক্রমে ঘন হয়। বিলের হাওয়া এসে লাগে শরাফতের কিস্তি টুপি-পরা মাথায়। ঘরের ভেতরে গিয়ে পশমি-টুপি মাথায় দিয়ে, গলায় মাফলার ও গায়ে খয়েরি শাল জড়িয়ে সে নামে বারান্দার নিচে। নিচে নামলে বিল চলে যায় চোখের আড়ালে। তখন আবছা আবছা শোনা যায় নামীদামি মানুষের কথাবার্তা। চোখের সামনে দোলে ছোটোমিয়ার হাতের ছড়ি। এই ছোট্টো দাদাভাইটা মরে গিয়ে শরাফতকে আজ কী ইজ্জতটাই না দিয়ে গেলো! আর সেই মাসুম বাচ্চাটাই পড়ে থাকে মাটির নিচে একা একা। সবই আল্লার ইচ্ছা!—শরাফতের দুই চোখ বেয়ে নামে পানির ধারা। সে তখন আস্তে আস্তে হাঁটে পশ্চিমের দিকে, বাড়ির পেছনে পালানে জোড়াপুকুরের ওপারে বেগুনখেত পেরিয়ে মস্ত বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের গা ঘেঁষে হুমায়ুনের কবর।

চল্লিশ দিনে হুমায়ুনের কবরে ঘাস গজিয়েছে, চারপাশে শীতের দাপটে ঘাসগুলো একটু রক্তশূন্য। এর ওপর টাঙানো কুয়াশার মশারি, সামনে গেলে মশারি পাতলা হয়ে আসে। শরাফতের বাবা, মা, সৎ, বড়োভাই, ভাবী ও ছোটেভাইয়ের কবর। সবই এলোমেলো। এই কবরগুলো এখানে তবু চেনা যায়। এছাড়া এই বড়ো জমিটা জুড়ে শুধু কবর আর কবর। সে গুলোকে আলাদা করে চেনা কঠিন। বড়ো বড়ো ঘাস আর গাছড়ার নিচে কোনোমতে মুখ গুঁজে থাকে। শুধু এই জমির শেষ মাথায়, একেবারে উত্তর পশ্চিম কোণে কালাম মাঝি মাঝে মাঝে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে যায়, সেটা নাকি ওর বাপের কবর। কবরে মোমবাতি দেওয়া বেদাত কাম, মোহাম্মদি জামাতের মানুষ হয়ে শরাফত এটা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কালাম মাঝি বড়ো ঘাড়ত্যাড়া মানুষ, তাকে দুই একবার বলে লাভ হয় নি, সে জবাব দেয়, হামাগোরে আলাদা জামাত, হানাফির গোরস্থান, হামার দাদা পরদাদা তার পরদাদা সোগলি এটি আছে। মোমবাতি হামার দেওয়াই লাগবি। জায়গাটা অবশ্য আগে থেকেই গোরস্থান ছিলো, এখানে মাঝিদের কাছ থেকে জমি কেনার সময় শরাফতের বাপ দলিলে পুরো জমিটাই নিজের নামে লিখে নেয়। তবে শরাফতের বাপের আমলেও মাঝিদের লাশ কিন্তু দাফন হতো এখানেই। শরাফতের জমি বাড়তে লাগলো পশ্চিমে ও উত্তরে, এমন কি কালাম মাঝির এক ভাগীদারের কাছ থেকে গোরস্তানের দক্ষিণের মজা ডোবাটাও মণ্ডল কিনে নিয়েছে আকালের বছর। গোরস্তানের চারো দিকের জমি শরাফতের দখলে আসার পর সে এমন চাষবাস শুরু করে দিলো যে, মাঝিপাড়ার মানুষ এখানে গোর দেওয়ার রেওয়াজ চালু রাখতে আর সাহস পায় না। কাৎলাহার বিলের উত্তর পুবের একটা পতিত জমি শরাফত তাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বেটারা সেখানেই মড়া পেতে আজকাল। এই কালাম মাঝির মতো রগত্যাড়া মানুষ মাঝে মাঝে এটা সেটা কয়। বাপের কবরে মোমবাতি দেওয়ার নাম করে মরা মাঝিদের অছিলায় এখানে জ্যান্ত মাঝিদের দখল কায়েম করার ফন্দি করে। বুলু মাঝি মরলে তাকে এখানে গোর দেওয়ার কথা উঠিয়েছিলো এই কালাম মাঝিই। তা কী করতে পারলো? বুলুর দাফনে শরাফত খরচা করলো কতো। কালাম মাঝির এতো বড়ো দোকান থেকে একটা পয়সা তো বেরুলো না। এরপর বুলু মাঝির দাফন কোথায় হবে সে নিয়ে মাঝির বেটারা আর কথা বলতে পারে? শরাফত মণ্ডল বিল। ইজারা নেওয়ার পর থেকেই কালাম হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। আরে বাবা, জমিদার তার এলাকার ভেতর কাকে কী দেবে সে জানে কেবল জমিদারই। হিংসা করে কালাম মাঝি কী করতে পারে? মাঝিপাড়ার সবাইকে জমি বর্গা দিয়ে শরাফত তাদের বিলের কথা ভুলিয়ে ছাড়বে। আজ জেয়াফতে মাঝিপাড়ার একটি প্রাণী বাদ পড়ে নি। কালাম মাঝি প্রথমদিকে এলো না দেখে কাদের তমিজকে পাঠাতে চেয়েছিলো। মণ্ডল বললো, আসবি বাবা। দোকানপাট করে, কতো কাম তার। দেরি হবার পারে। তা সে ঠিকই এসেছিলো। কালাম মাঝির ছেলে তহসেন বর্ধমান জেলায় কোথায় পুলিসের চাকরি পেয়েছে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। শরাফত সেদিন নিজে তাকে বলে এসেছিলো। সে তো এসে খানকাঘরে ভদ্রলোকদের মধ্যে দিব্যি খেয়ে গেলো। বিকালের দিকে কালাম কখন এসে গোয়ালঘরের পেছনে আর দশজন মাঝির কাতারে বসেছিলো, শরাফত সব খবরই রাখে। কালাম মাঝির জারি-জুরি আর কতোদিন? গোরস্থান দখল করার ফন্দি ওর আজই মিটে যাবে।

হুমায়ুনকে কবর দেওয়ার পর জায়গাটিকে মণ্ডলদের পারিবারিক গোরস্তানে পরিণত করার ব্যবস্থা এখন পোক্ত করা যায়। ছেলের কবরটা বাধাবার জন্যে আবদুল আজিজ কয়েক দিন ঘ্যানঘ্যান করলো। বড়োবেটাটা তার বড়ো বৌচাটা, বৌ ফোৎ ফোৎ করলেই তার মাথা খারাপ, বৌ যা বলে তাই করার জন্যে হন্যে হয়ে ওঠে। শরাফত বলেই দিয়েছে তাদের আহলে হাদিস জামাতে কবর সাজানো শেরেকি কাজ।

তবে এখন হুমায়ুনের কবরের পাশে দাড়িয়ে তার চোখ জুড়ে শুয়ে থাকে। শিমুলতলার মিয়াদের বাড়ির গোরস্তানের সার সার কবর। মিয়াদের কোনো কোনো কবর কী সুন্দর করে বাঁধানো। কোনো কবরের শিওরে সিমেন্টের ওপর চাঁদ তারা, কোনো কবরে পাথরে খোদাই-করা আল্লার কালামের নিচে মরহুমের নাম, বাপের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ। সেখানে গেলে সেই সব মরহুমের অছিলায় তাদের ছেলেমেয়ে নাতি পুতিদের জন্যেও ভক্তিতে বুকটা ভরে ওঠে। শিমুলতলার মিয়াদের খানদানি বোঝার জন্যে জ্যান্ত মানুষকে না দেখলেও চলে, ওইসব বাঁধানো কবরই হলো খানদানের নীরব নকিব।

তা হুমায়ুনের কবর বাধালে ক্ষতি কী? ছেলেটা তাদের কতো ইজ্জত এনে দিলো, মরার পর তার কি এটুকুও প্রাপ্য নয়?

ইট সিমেন্ট কবর বাঁধালে নায়েববাবু কি আপত্তি করতে পারে? কয়েক বছর আগে বিলের উত্তরে কাশবন কেটে চাষবাস করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হলে টাউনের উকিল রমেশ বাগচি ওখানে ইটের ভাটা করার কথা ভাবছিলো। উকিলবাবুর ভাগ্নে টুনুবাবু পয়সাকড়ি নিয়ে বোম্বাই না মাদ্রাজ ভাগলে এসব ভাবনা তারা ঝেড়ে ফেললো। তারপর কাদের একবার বাই তুললো ইটের ভাটা করবে। ওদিকে তো জঙ্গুলে জায়গা, কাঠের খরচ নাই। সস্তায় হঁট করে প্রথমে না হয় নিজেদের বাড়িটাই পাকা করে ফেলবে। তা। কাদেরের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা কী করে লাঠিডাঙা কাচারিতে পৌঁছুলে নায়েববাবুই

একদিন মণ্ডলকে ডেকে পাঠিয়ে বলে, মণ্ডল, কর্তা আমাদের মাটির মানুষ। তার সহ্যশক্তিও অনেক। ভগবান একেকজন মানুষকে সৃষ্টিই করেন ওইভাবে। কিন্তু চাষাভুষা প্রজাপিট সবাই যদি দরদালানে থাকতে শুরু করে তখন তার সম্মানটা থাকে কোথায় বলো তো? ইঙ্গিত ধরতে পেরে শরাফত বলে, সোগলি দালানেত থাকলে দালানের ইজ্জত থাকে ক্যাংকা করা? কথা ঠিকই কছেন বাবু। ধরেন, হামার কথাই ধরেন। বাপের ছনের ঘর আছিলো, হামি করলাম টিনের ঘর। আশীর্বাদ করেন বাবু, নায়েবের আশীর্বাদ নিতে শরাফত অন্তত পাঁচ হাত দূরে মাটি ছুঁয়ে ফের উঠে দাঁড়ায়, আশীর্বাদ করেন, ওই টিনের ঘরত যেন মরবার পারি। ওই ঘরত যানি হামার মরণ হয়। তখন কাচারিতে সে নিয়মিত ভেট দিয়ে যাচ্ছিলো, শরাফতের এক কথাতেই নায়েব গুজবটা বাতিল করে দেয়।

তবে কবর বাঁধালে নায়েববাবু আপত্তি করবে কেন? বাড়ি আর কবর কি আর এক হলো?

কিন্তু অসুবিধা আর একটা আছে। সেটা অন্যরকম। কী—এখানে তো শরাফতের মুরুব্বিরাও আছে। বাপজান আছে, মা আছে, মিয়াভাই আছে, এদের কবর পাকা না করে হুমায়ুনের কবরে সে ইঁট বসায় কী করে?

তাহলে হুমায়ুনের জন্যে, তার লাশ হেফাজতের জন্যে শরাফত কি কিছুই করতে পারে না? এটা কি তার সঙ্গে নিমকহারামি করা হচ্ছে না? এই ভাবনা ও উদ্বেগে তার জিয়ারতের দোয়া বারবার এলোমেলো হয়ে যায়। নতুন করে সমস্ত মনোযোগ সে নিয়োগ করে দোয়ার দিকে। আসসালামু আলাকুম ইয়া আহলাল কুবরে, মিনাল মুসলিমিনা, ওয়াল মুমিনিনা, আন্তম লানা পর্যন্ত বলেছে, তখন তার পাশে এসে দাঁড়ালো আবদুল আজিজ। জিয়ারতে সে শরিক হয়, কিন্তু মোমবাতি ও আগরবাতি জড়ানো কাগজের মোড়কে তার একটা হাত বন্ধ, মোনাজাতের জন্যে হাত ভোলা তার পক্ষে বেশ মুশকিল। দোয়া শেষ হলে হাতের প্যাকেটার জন্যে আবদুল আজিজ বাপের দিকে তাকায় অপরাধী চোখে। তাদের জামাতে গোরে বাতি দেওয়া একেবারেই নিষেধ। মিনমিন করে সে কৈফিয়ৎ দেয়, বাবরের মাও খালি কান্দিচ্ছে, বাপের সঙ্গে দূরত্ব না রাখার জন্যে কিংবা শোকেও হতে পারে, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ছোটোবেলার বুলি, খালি কান্দে আর কয়, বেটাটা হামার ঘুটঘুটা আন্ধারের মধ্যে একলা পড়া থাকে। তাই হামি–

 শরাফত চুপচাপ ছেলের হাত থেকে মোমবাতি নিয়ে হুমায়ুনের শিওরে সাজায়, তারপর আজিজের কাছ থেকে দেশলাই নিয়ে মোমবাতি ও আগরবাতি সব এক এক করে ধরিয়ে কবরের চারদিকে মাটিতে পুঁজে খুঁজে দেয়। এই করতে করতে, হয়তো মোমবাতির আলো ও আগরবাতির সুবাসেই হবে, শরাফতের মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে, তার বাপ-মা কি মিয়াভাই তো নিজেদের কবর বাঁধাবার জন্য কোনো অসিয়ত করে যায় নি। তারা পাকা আহলে হাদিস। মিয়াভায়ের নাম শেতল মণ্ডল পাল্টে শমশের আলি মণ্ডল হলো তো মওলানা আবদুল্লাহেল বাকির কথায়। না, তাদের কবর পাকা করলে তাদের রুহ কষ্ট পাবে। কিন্তু হুমায়ুন এক মাসুম বাচ্চা, নাবালক। তার কবর কী হবে না। হবে সেটা ঠিক করবে তার মুরুব্বিরা। তার কবরে কোনো শেরেকি কাজ তারা করবে না, শুধু পাকা দেওয়ালে ঘিরে দেবে যাতে ভবিষ্যৎ বংশধররা শিশুটিকে চিনতে পারে, শিশুটি তাদের পরিবারে অনেক মর্যাদা দিয়েছে।

সিদ্ধান্তটি শরাফত ঠিক তক্ষুনি আজিজের কাছে প্রকাশ করে না। কিন্তু হুমায়ুনের। প্রতি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে ভেবে তার মাথার জট খুলে যায় বলে হুমায়ুনের জন্যে শোকের প্রতি মনপ্রাণ নিবেদন করতে পারে। এর মধ্যে আবদুল আজিজ কবরের ওপর গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়েছে এবং আগরবাতি ও গোলাপজলের খুসবু মোমবাতির কচি আলোর আভায় ছড়িয়ে পড়ে তামাম গোরস্তান জুড়ে। এইভাবে অনেক অনেক আগে দাফন-হওয়া মাঝিদের কবরগুলোও চলে আসে হুমায়ুনের কবরের আওতার ভেতরে। চল্লিশার অনুষ্ঠানের এমন নিটোল উপসংহারে শরীফত মণ্ডলের মাথা খুব হালকা হয়ে যায়, তার চোখ থেকে প্রবাহিত নোনা পানি আগরবাতির মিষ্টি গন্ধ ও মোমবাতির কচি আলো কবুল করে নিয়ে হয়ে ওঠে মিষ্টি ও স্বচ্ছ।

অন্ধকার গাঢ় হয়। বাপেবেটায় এবার বাড়ি ফেরার জন্যে পা ফেলে পুব দিকে। কিন্তু পাশের বাঁশঝাড়ে কিসের শব্দ পেয়ে দুজনেই থমকে দাড়ায়। শরাফত মণ্ডল কপাল কোঁচকায় : মাঝিদের পুরনো কোনো লাশ কি মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসছে গোরস্তানে টহল দেওয়ার জন্যে? আর আবদুল আজিজের ভাবনা কি ভয় পাবার শক্তির সবটাই ঢুকে পড়েছে সেই টহল-দেওয়া লাশের শূন্য কবরের ভেতর, সে কেবল প্রাণপণে চেষ্টা করছে কোনোমতে নিজের পা দুটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে। এতো বড়ো বাঁশঝাড়টা এখন এরা পেরোবে কী করে? দুই জনের একটি পা-ও এক পা নড়তে পারে না।

কিন্তু কয়েক মুহর্তেই শরাফত স্বস্তি ও ক্রোধের নিশ্বাস ফেলে। আলহামদুলিল্লাহ! সেরকম কিছু নয়। বাঁশঝাড়ে বসে পায়খানা করছে কোনো শালা ছোটোলোকের বাচ্চা। আজ জেয়াফতে গোগ্রাসে গেলা এবং হজম-বদহজম-হওয়া খানা সে খালাস করছে মিহি ও মোটা নানারকম ধ্বনি তুলতে তুলতে। ভূতপেত্নী আর যাই হোক হাগামাতা করে না, এই ভরসায় শরাফত তেজি গলায় হাঁক ছাড়ে, কেটা রে? কেটা হাগে? এটি হাগে কোন হারামজাদা?

বাঁশঝাড় থেকে মলত্যাগকারীর গলার আওয়াজও পাওয়া যায় এখন। কোৎ দেওয়ার ও পায়খানা করার আওয়াজ বাজে যুগলবন্দি হয়ে, লোকটা তাড়াতাড়ি কাজ সম্পন্ন করার জন্যে মরিয়া হয়ে লেগেছে। শরাফত মণ্ডল দ্বিতীয়বার হুংকার ছাড়ার পরেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় দুজনকে। তারপর বাঁশঝাড় থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে তমিজের বাপ। তার শরীরে উল্কট দুর্গন্ধ। গন্ধ ধাঁ করে ঢুকে পড়ে আজিজের গলায়, সেখান থেকে পেটেও চলে যেতে পারে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বমি করে ফেলে। তার বমির তরল ছিটায় হুমায়ুনের কবরের শিওরে একটি মোমবাতির শিখা একটু কেঁপে দপ করে নিভে যায়।

শরাফত মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তমিজের বাপ অপরাধী গলায় বলে, বাড়িত যাচ্ছিলাম। ঘাটাত বাহ্যি চাপলো, আর পারলাম না। হামাগোরে গোরস্তানের এটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে

তমিজের বাপের গুয়ের গন্ধ এখন দখল করে নিয়েছে গোটা গোরস্তান। এখানে ফেরেশতা আসবে কীভাবে? শরাফত ও আজিজের পক্ষেই তো টেকা দায় হয়ে পড়েছে।

ঘরে যেতে যেতে শরাফতের ভুরু কুঁচকে আসে, তমিজের বাপ এই পথে বাড়ি ফেরে কেন? মাঝিপাড়ার মানুষের জন্যে এই পথে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। এই গোরস্তান কি এখনো শালাদের হামাগোরে গোরস্তান? এতো সাহস ও পায় কোত্থেকে? কালাম মাঝি আবার লেলিয়ে দেয় নি তো? আর আবদুল আজিজের করোটিতে বেঁধে একটির পর একটি কাঁটা, কিংবা একটি কাটারই শাখাকাটা উপকাটা : এই লোকটাই না? দুপুরবেলা এই লোকটাকে দেখেই তো হামিদা অমন ভয় পেয়ে গেলো? আজিজ এখন বোঝে, এই তমিজের বাপই সেই রাত্রে কাফনের কাপড় পরে ওই রাতে এসেছিলো হুমায়ুনকে নিয়ে যেতে। ছেলেটা মরার পরেও সে তার পিছু ছাড়ছে না। সন্ধ্যার পর পায়খানা করার জন্যে সে কি হুমায়ুনের কবরের পাশে ছাড়া আর জায়গা পেলো না? লোকটা আসলে কী? তমিজের বাপ কি আসলেই তমিজের বাপ? লোকটা কে?-ভয়ে আবদুল আজিজ থরথর করে কাঁপে। কাঁপুনির বেগে সে ঘরে পৌঁছে যায় শরাফতের অনেক আগে। তমিজের বাপের আচরণ শরাফতকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, ভাবনায় তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেশ ভারী। তার গতি একটু মন্থর।

১৭. ধান কাটার দিন

ধান কাটার দিন ভোর হওয়ার বেশ আগেই, আন্ধার থাকতে থাকতে আলের উপর কুলগাছতলায় দাঁড়িয়ে তার দুই বিঘা সাত শতাংশ জমি তমিজ দেখে নিচ্ছিলো দুই চোখ ভরে। এ বছর জমির এমন ভরা বুক তো সে আর দেখতে পারবে না। পাকা ধান মাথায় নিয়ে ধানগাছগুলো খানিকটা হেলে পড়েছে, আবার জায়গায় জায়গায় তমিজ ধানগাছ এলিয়ে দিয়েছে নিজেই, ধান যাতে সমানভাবে পাকে। কোলে ধান কাঁখে ধান নিয়ে একেকটি গাছ নিঃসাড়ে ঘুমায়। কুয়াশা ছুঁয়ে শিশিরের এক-একটি বিন্দু শীষের ওপর স্বপ্নের তরল ফোঁটার মতো পড়লে ধানগাছের ঘুম আরো গাঢ় হয়। ধানখেতের স্বপ্নের ঝাপটায় তমিজের গা কাঁপে, দেখতে দেখতে সে বসে পড়ে আলের ওপর।

ধানগাছের স্বপ্নের ধাক্কায় দুলতে দুলতে তমিজ হাতের কাস্তের ধার দেখে আলগোছে, কাস্তের কচি কচি দাঁতে তার হাতে সুড়সুড়ি লাগে, ভোতা আঙুলের মাথা বেয়ে তাই ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীরে। দশরথ কর্মকারের পাশে বসে সে কাস্তে ধার করে নিয়ে এলো পরশুদিন। কাস্তে কোদালে ধার দশরথের মতো দিতে পারে-এ তল্লাটে তেমন আর কেউ নাই। মানুষটা কথা কয় কম, দিনরাত হাঁপর টানে, হাঁপর টানে আর ফাঁকে ফাঁকে এটা ওটা ধার দিয়ে দেয়। তবে প্যাচাল পাড়ে তার বেটাটা। বাপ কেমন চুপচাপ হপর চালাচ্ছে। আর দেখো এক নাগাড়ে কথা বলে চলে যুধিষ্ঠির।কী?-না, গোলায় ধান তোলার সময় মণ্ডল নাকি তার সঙ্গে খুব প্যাগনা করেছে। মণ্ডল খালি এটা চায়, ওটা চায়। এই খরচ দাও, ওই খরচ দাও। খরচ দিতে না পারো তো তোমার ভাগের ধান থেকে এ বাবদ এতো ধান দাও, ওই বাবদ অতো ধান দাও। যুধিষ্ঠির তমিজকে ভয় দেখায়, তোমার তো মেলা ধান হছে। হামি লিজেই দেখ্যা আসিছি। কতো ধান ঘরত তুলবার পারো দেখো!

আগেভাগে এসব অলক্ষুণে কথা বলার দরকারটা কী বাপু? তমিজের রাগই হচ্ছিলো। যুধিষ্ঠিরের ওপর, যার জমি তুমি বর্গা করো, যার জমিতে তোমার লক্ষ্মী তার নামে এমন গিবত করলে তোমার ধর্মে সইবে?-ধান মাপা আরম্ভ হলে মণ্ডল খালি প্যাগনা করবি।-এই দেখো, শীতের অন্ধকার ভোরে যুধিষ্ঠিরের বাড়ির হাঁপরের আঁচ লাগে, এই আঁচে ধানখেতের ওপরকার কুয়াশা উড়ে যাচ্ছে ধোয়া হয়ে, শিশিরবিন্দু শুকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জমির ভেতরে। আসমান সাফ হয়ে আসছে।

এই সময় বাপকে কাস্তে হাতে আসতে দেখে তমিজ উঠে দাড়ালো। না গো, বুড়া দেরি করে নি। বাপ বেটায় এখনি জমিতে নামা যায়।

কিন্তু দুজনে জমিতে নামার আগেই এসে হাজির হলো হুরমতুল্লা ও তার পেছনে আরো তিন জন কামলা। এরা সূব নিজগিরিরডাঙার পুবপাড়ার মানুষ।

নামো, নামো। হুরমতুল্লা এসেই তাগাদা দেয়, কামেত নামো গো। বেলা ডোবার আগেই ব্যামাক আঁটি হামার বাড়িত তোলা লাগবি।

কিন্তু কামলা নেওয়ার কথা তো তমিজের ছিলো না। মণ্ডলের সঙ্গে এমন কথা তো হয় নি। তবে এগুলো কী?–না,কামলা নিতে হবে। শরাফত মণ্ডলের হুকুম। এই জমির ধান কাটতে হবে এক দিনে। তমিজ একলা কাটলে এক সপ্তাহেও কুলাতে পারবে না।

হামার বাপ তো হামার সাথে আছে। তাই হাত লাগালে তোমার দুই কামলার কাম সারবার পারে, সেই খবর রাখো?

তমিজের কথায় হুরমতুল্লা আমল দেয় না। ধান বেশি পেকে গেছে। কয়েক দিন ধরে কাটলে এর মধ্যে অর্ধেক ধান ঝরে পড়বে মাটিতে, ঝরা ধানে বরকত নাই। শরাফত তাই কাল রাত্রে হুরমতুল্লাকে ডেকে কামলা জোগাড়ের ভার দিয়েছে।

সবাই মাঠে নেমে পড়লে তিন মুঠা কাটা হলে আঁটি বান্দো, হুশিয়ার হুয়া কাম। করো, কাচি ধরার কায়দা আছে বাপু, ইটা তোমার জাল মারা লয়। ধান যানি ঝর্যা না পড়ে, হুরমতুল্লার প্রভৃতি উপদেশে শরাফতের হুকুমই গমগম করে ওঠে। তবে বাপের কাস্তের অতি দ্রুতগতিতে তমিজ তার ভোরবেলার, এমন কি, আরো আগেকার তেজ ফিরে পায় এবং হাম্বিতম্বি শুরু করে নিজেই, দেখো! চোখ দিয়া চায়া দেখো। বুড়া। মানুষটার ছ্যাও দেখ্যা তোমরা শিখ্যা লেও।

বাপের কাজে অসাধারণ ক্ষিপ্রতা ও পটুত্বের কল্যাণে দুপুরবেলার মধ্যেই জমি জুড়ে তমিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে ধানের পরিমাণে, আকারে, পুষ্টিতে ও সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার সুযোগ সে পায় এবং এই জমিতে নিজের মেহনত ও কৌশল নিয়ে নানা কিসিমের বাকি ছাড়ে। তমিজের বাপ কথা কয় না। ধানের ফলনে বেটার কৃতিত্বে সে খুশি কি-না তার কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু তার কাস্তের গতি ও তমিজের চোপার নিচে চাপা পড়ে হুরমতুল্লার দাপট।।

বাপের চুপ মেরে যাওয়া সুদে-আসলে তোলে হুরতুল্লার বেটি ফুলজান। বাঁকের দুই দিকে ভারে ভারে ধানের আঁটি এনে হুরতুল্লার উঠানে কামলারা সাজিয়ে রাখছিলো থাক থাক করে, ফুলজান তখন চলে আসে সামনে। কামলাগুলো না থাকলে সে হয়তো মাঠেই চলে যেতো।

দুই দিন ধরে সব ধান কাটা শেষ হলে কামলারা চলে যায়, এখন থেকে ধানের সমস্ত তদবির করতে হবে তমিজকে একা। বাপটা ঘরেই পড়ে থাকে, জমি থেকে ধান। কেটে দেওয়ার পর তার আর কোনো উৎসাহ নাই। তমিজ বললে হয়তো আসতো। তা তমিজ কিন্তু বাপকে কিছু বলে নি। ফুলজানের চোপার কিছু ঠিক নাই, কার সামনে কী বলে বসে কে জানে? তমিজ অবশ্য রোজ ভোরবেলা এই বাড়িতে ঢোকার সময় বুকে। বল জুগিয়ে নেয়, সে কি ফুলজানের খায় না পরে, না-কি তার বাপের জমিতে বর্গা চাষ করে যে তাকে ভয় করতে হবে? আবার তার বিমারি বেটাকে দেখে তমিজের মায়াও লাগে, আহা ছেলের জন্যে মায়ের কষ্টের আর শেষ নাই। তা বেটাকে নিয়ে টাউনে যাবার কথা সে তুলবে, আগে ধানটা মণ্ডলের গোলায় তোলা হোক। ফুলজানের বেটা নবিতনের কোলে বসে ঘোলাটে চোখে জ্বলজ্বল নজরে তমিজের ধান পেটানো দেখে। ফ্যাকাশে মুখে তার চোখজোড়া চকচক করে দেখে তমিজের ধান পেটানো হাত শিথিল হয়ে আসে : দুত্তোরি! ছোঁড়াটা মনে হয় ভালোই হয়ে গেলো! ওকে নিয়ে প্রশান্ত কম্পাউনডারের কাছে যাবার কথা ছিলো, তা বুঝি আর হলো না!

ধানের কোবান দেওয়ার কায়দা আছে, বুঝিছো? কিন্তু কাঠের তক্তায় ধানের আঁটি বাড়ি মারার কৌশলটি দেখিয়ে না দিয়েই ফুলজান বলে, খালি গায়ের জোর খাটালেই ব্যামাক কাম হয় না গো মাঝির বেটা। বুদ্ধি খাটান লাগে।।

তার কাজের খুঁত ধরতে ফুলজান সবসময় কাছে থাকে। তমিজের একেক দিন রাগ হয়, ইচ্ছা করে, মাগীর পাওনা পয়সা কয়টা ঝনাৎ করে ফেলে দেবে সামনে। বলবে, ভালো করা গুন্যা লেও। কিন্তু ফুলজান তো পয়সা চায় না। তমিজও ভাবে, ধান ঘরে ওঠার আগে এতো খরচ করা ভালো নয়। তবে নিজেকে ফুলজান যে এতো কামলি মেয়েমানুষ বলে মনে করে, এই দেখে দেখে তমিজ ভাবে, এখানে কুলসুমকে একবার এনে ফেললে হয়। কাম তো আর ফুলজান একলা জানে না। কয়টা বছর আগেও কুলসুম মণ্ডলবাড়িতে ধান ভানার কাজ কম করে নি। আর বিয়ের আগে কালাম মাঝির। বাড়িতে কতো হাঁড়ি ধান যে সেদ্ধ করতে তার কোনো হিসাব আছে? আর এমনিতে কুলসুমের পাশে এই মাগী কি আর দাঁড়াতে পারে নাকি? ফুলজানের যে জায়গাটায় মস্ত ঘ্যাগ ঝোলে একটা, কুলসুমের ওইখানটা দেখতে কী মসৃণ। কুলসুমের রঙ কালো হলে কী হয়, তার মুখের দিকে তাকালে তাকে বড়োলোকের বাড়ির মেয়েদের মতো দেখায়। তমিজের সত্য হলেও কুলসুম তাকে কখনো হিংসা করে নি। মাঝির বংশ নিয়ে তাকে খোটা দেয় বটে, কিন্তু সেটা কেবল তার বাপদাদা নিয়ে তুমি কথা শোনালেই। কুলসুম এখানে থাকলে ফুলজানের নাহক খোটা মারা, তাকে হেয় করাটা বন্ধ হবে। তার নিজের বর্গা করা জমির প্রথম ধান উঠছে। মণ্ডল বাগড়া না দিলে তো জমি থেকে ধান সে তুলতো সোজা বাড়িতেই। কুলসুম বাড়ির বাইরের উঠানটা নিকাবার আয়োজনও করেই রেখেছিলো। নিজের বাড়িতে না হোক, নিজের জমির ধান ঝাড়ার সময় তমিজ কুলসুমকে পাশে পাবে না, তা কী করে হয়?

ভোরবেলা কাৎলাহার পেরিয়ে নিজগিরিরডাঙার হুরমতুল্লার বাড়িতে গিয়ে দিনভর কাজ করবে কুলসুম,—এতে তমিজের বাপের তেমন সায় ছিলো না। কুলসুম বলেই ফেললো, ইগলা আলগা ফুটানিই তোমার সব্বোনাশ করলো! তবে ধান ঝাড়ার চেয়ে কুলসুম মরিয়া হয়ে উঠেছে ফুলজানের নামে এটা ওটা শুনতে শুনতে। কুলসুম রাগে জ্বলে! মা গো মা, মাগীমানুষ বলে এতো দজ্জাল হয়? এমন না হলে স্বামীটা কি তার এমনি এমনি ভাগে? এখন আবার লেগেছে পরের ছেলে তমিজের পেছনে। স্বামীকে বেশি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কুলসুম ভোররাতে বেরিয়ে যায় তমিজের সঙ্গে।

তমিজের বাপ তখন মাচায় শুয়ে চোখ মেলে তাকিয়েছিলো বাইরের দিকে। তার বেটা আগে এবং পিছে বৌ চলতে চলতে ডোবার ওপারে গিয়ে হাঁটতে লাগলো পাশাপাশি। তমিজের বাপ পাশ ফিরে শুয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়ে।

কিন্তু কুলসুমের রাগারাগি বলো, ঝগড়াঝাটি আর মুখ ঝামটা দেওয়া বলো, সবই তার বাড়ির ভেতর। হুরমতুল্লার ভিটায় পা দিয়েই সে একরকম চুপ হয়ে যায়। ফুলজানের দিকে আড়চোখে তাকায়, যেন জীবনে এই পয়লা দেখছে তাকে।

সেদিন তমিজ আর কুলসুমের পৌঁছুবার পরপরই শুরু হলো গোরু দিয়ে ধানের আঁটি মাড়াই। কাঠের তক্তায় পিটিয়ে ধান ঝরানো আঁটিগুলো উঠানের পাশে গাদা করে রাখা ছিলো। ফুলজান আর হুরমতুল্লা আগেই কয়েকটা আঁটি খুলে বিছিয়ে রেখেছিলো উঠানে। গলায় গলায় বাঁধা ও মুখে ঠুলি পরানো জোড়া গোরুর পেছনে পান্টি হাতে ঘুরতে লাগলো তমিজ। উঠানের অন্যদিকে ধানের স্থূপ থেকে কুলায় ধান নিতে নিতে। ফুলজান চাঁচায়, ও নবিতন, কাঁড়ালটা লিয়া মাঝির বেটার পিছে না! নবিতন বারান্দায় বসেছিলো কাঁথা সেলাই করতে। বেশ মন দিয়ে নকশা তুলছিলো, বোনের ডাকে সাড়া না দিয়ে নকশাই তুলে চললো। এই মেয়েটিকে তমিজ প্রায় সবসময়ই কথা সেলাই করতে দেখে, ধানের কাজে তার উৎসাহ নাই। ফুলজান আরেকবার চিৎকার করলে জোড়া গোরু ও তমিজের পিছে পিছে কড়াল হতে নামলো সে। কাঁড়ালের আঁকশি দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলো ভাঙা আঁটিগুলো। পেটাবার পর এই কয়েকদিনে। আঁটির ধানগুলো লাল হয়ে এসেছে, এই ধানের চালও লাল হবে, ভাতে স্বাদ নাই। তমিজ বেশ বুক চিতিয়ে এগোয়, তার কোবানো আঁটিতে ঘুলানা ধান থাকে না, তার কয়েকটা বাড়িতেই আঁটির ধান সব ঝরে পড়ে।

ঘুলানা ধান তো তোমার হলোই না গো। ব্যামাক ধানই বার কর‍্যা লিছো? নবিতন তাকে সাবাশি দিতে এই কথা বলতে না বলতে ফুলজান বলে ওঠে, হাভাতা মাঝির বেটা, ধান কি আঁটিত কিছুই থোয়া লাগে না?

আঁটি পেটানোর পটুত্বও তার ফুলজান স্বীকার করে না, এটাকে সে বিবেচনা করে হাভাতেপনা বলে। তমিজকে এভাবে হেয় করাটা কুলসুমের গায়ে একটু লাগে, একটু নিচু গলাতেই সে বলে, ঘুলানা ধানের চাউল হামরা খাই না বাপু!

কিসক? ভিক্ষা করা বেড়াছো, তখন মানষে ঘুলানা চাউল দিলে ফিক্যা মারিছো? ফুলজান কথাটা বলে কুলসুমকে, কিন্তু তাকে এই কথা বলার সুযোগ দেওয়ায় তমিজের রাগ হয় কুলসুমের ওপর। গোরুর পিঠে আলগোছে পান্টির বাড়ি মেরে সে বলে, ভিক্ষা হামরা করি নাই। ফকিরের বেটিক লিকা করা হামার বাপ ঘরজামাই হয়া যায় নাই। ঘুলানা চাউল হামাগোরে খাওয়া লাগে না।

তমিজের কথায় ফুলজান বোধহয় আরাম পেয়েছে, নইলে এর পিঠে তার কিছু না কিছু বলার কথা। কুলসুম তো এখন অনেক কথাই বলতে পারতো।-তমিজের বাপের সংসারে ঘুলানা চালের ভাত তাকে কম খেতে হয় নি। তমিজের কথায় দুঃখ পাওয়ার চেয়ে সে অসহায় বোধ করে বেশি। বিচলিত হয়ে ফুলজানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ধান ঝাড়ার কুলাটা সে ধরে দক্ষিণ দিকে। তাই দেখে ফুলজান হাসে খিলখিল করে, তার ঘ্যাগের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে খিলখিল স্বরটি লুপ্ত হয় এবং শোনা যায় ঘর্ঘর শব্দ। শীতের বাতাস তো বইছে সবই উত্তর থেকে, সেই বাতাসে কুলার চিটাধান কি খড়কুটো উড়ে পড়ে নিচে, কুলায় রয়ে যায় ভালো ধানগুলো। ফুলজানের মুখোমুখি দাঁড়াবার ফলেই কুলসুম কুলা ধরে উল্টোদিকে। তা এতে ফুলজানের এত হাসির কী হলো? ফুলজানের এই তুচ্ছ-করা হাসির প্রতিবাদে, না কুলসুমের অযোগ্যতায় বিরক্ত হয়ে, ঠিক বোঝা মুশকিল তমিজ দুটো গোরুর পিঠেই পান্টির বাড়ি লাগায় কষে। এই বাড়ির জন্যে একেবারেই অপ্রস্তুত গোরু দুটো হঠাৎ একটু দৌড় দিলে তমিজ হুমড়ি খেতে খেতে সামলে নেয়। তার এই দশায় হেসে ফেলে নবিতন, তার হাসিতে নির্ভেজাল খিলখিল বোল। ফুলজান কিন্তু এবার হাসে না, জিভ দিয়ে চ চ্চ আওয়াজ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হায়রে, চাষা হাওয়ার হাউস! মাঝি বলে হাউস করিছে চাষা হবি!

একটু আগে ফুলজানের ঘর্ঘরে হাসিতৈ কিন্তু কুলসুমের আনাড়িপনার জন্যে একটু প্রশ্রয়ও ছিলো। বিদ্রুপ কিংবা প্রশ্রয় কোনোটাতেই কুলসুম স্বস্তি পায় না। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই সে কুলা ধরেছিলো উত্তরদিকে, উত্তরের হাওয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেও তার অস্বস্তি কাটে না।।

জোড়া গোরুর পিছে পিছে মলন দিতে দিতে তমিজ কিন্তু সবই দেখে। কুলসুমের কালো ও লম্বা আঙুলওয়ালা হাতের হালকা নাচন ধানের ওপরকার চিটাধান ও খড়কুটো উড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে, সেখানে হলুদ ও হালকা কালচে হলুদ ছোটো স্থূপ তৈরী হচ্ছে তার স্তনের মতো। ফুলজানের কুলায় মোটা মোটা গাবদা গোবদা হাতের হালকা পিটুনিতে কিন্তু কাজ এগোয় অনেক তাড়াতাড়ি। কিন্তু ঘেগি মাগী আজ এমন ছটফট করে কেন? কিছুক্ষণ পরেই সে ছোটোবোনকে বলে, ধর তো নবিতন। কুলাটা তার হাতে তুলে দিয়ে সে হাতিয়ে নেয় তার কাঁড়াল এবং একটু জোর কদমে অনুসরণ করতে থাকে তমিজকে। ফলে তমিজকেও কদম বাড়াতে হয় এবং তার প্রভাব পড়ে গোরুজোড়ার ওপর। গোরুর টানে ও ফুলজানের ঠেলায় তমিজের বুক ও পিঠ শিরশির করে। গোরু সে ঠিকই সামলে নেয়, কিন্তু বুকটা টিপটিপ ও পিঠটা শিরশির করতেই থাকে।-বাঁশের কড়াল দিয়ে ফুলজান তার পিঠে একটা খোঁচা না মারে! কাঁড়ালের আঁকশিতে সে আবার তমিজের গলায় আটকে একটা হ্যাচকা টান না দেয়! আহা, ফুলজান একটা হালকা খোঁচা যদি দেয়! তমিজের পিঠের কি আর সেই কপাল হবে?

কিন্তু ফুলজান নিয়োজিত কেবল খড়ের আঁটিগুলো আলগা করে দেওয়ার কাজে। এখানেও সে কতো তাড়াতাড়ি কাম করে। কঁড়ালের আঁকশি বিঁধে দেয় আঁটির একেবারে নিচে, তারপর কড়ালের পেছনটায় এমন জোরে মোচড় দেয় যে আঁটি একেবারে আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর ওপর দিয়ে গোরু হেঁটে আরাম পায়, খড়ও মোলায়েম হয়। ওদিকে কুলা ঝেড়েই চলেছে কুলসুম; তার আঙুল নড়ে খুঁড়িয়ে, এতেক্ষণ ধরে ঝেড়েও তার চিটাধান ও খড়কুটোর পরিমাণ ফুলজানের স্তুপের চেয়ে কতো ছোটো।

ফুলজানের হাতের কাম কত পাকা! তার বাপের বৌটা যদি ওরকম হতো! এরকম একজন কেউ পাশে থাকলে তমিজ বিঘার পর বিঘা জমি চাষ করতে পারে একা। ধান ঝাড়ার এরকম কেউ থাকে তো তমিজের লাঙলের ফলা ঢুকে যাবে মাটির অনেকটা নিচে, সেখান থেকে এমনকি পানিও তুলে আনতে পারে সে। তখন জমিতে পানি সেচার জন্যে আর মণ্ডলের হাতে পায়ে ধরতে হয় না।

সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আগে তমিজ আবছা আন্ধারে দেখে তার ধানের স্তুপ। আল্লায় দিলে কতো ধান তার হয়েছে। এই ধান কাল যাবে মণ্ডলবাড়ি। ভাগাভাগির পর তার নিজের ভাগ নিয়ে তমিজ কালই ওঠাবে তার উঠানে। এতো ধান কি কুলসুম সেদ্ধ করতে পারবে? কালাম মাঝির বাড়িতে সে ধান সেদ্ধ করেছে তখন তো তার বিয়েই হয়। নি, ছোটো ছিলো। কালাম মাঝি বৌঝিদের সাথে সাথে থাকতো, কুলসুম হাত লাগিয়েছে মাত্র। এখন এতো ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে ঘরে তোলা কি আর সাধ্যে কুলাবে? এখন কী আর করা যায়? ফুলজান কি তার বাড়ি উজিয়ে গিয়ে তার ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে দিয়ে আসবে নাকি?

কুলসুমের সামনে ফুলজানের কথা এভাবে ভাবতেও তমিজের এমন বাধো বাধো ঠেকে কেন? কুলসুমকে তার এতো পরোয়া করার দরকারটা কী? এর ভয়ে কি ফুলজানের বেটার ব্যারামের খবরটাও নিতে পারবে না? মরিয়া হয়ে একটু উঁচু গলাতেই ফুলজানকে জিগ্যেস করে, বেটা তোমার ক্যাংকা আছে গো? এই কয়টা দিন যাক, চলো একদিন টাউনেত যাই। দেরি করা ভালো লয়।

টাউনেত গেলে তোমার পাছ ধরা লাগবি কিসক? বেটাক লিয়া হামি হামার বাপের সাথে যাবার পারি না? ফুলজানের জবাবে তমিজ কষ্ট করে হাসতে চেষ্টা করে, লাভ হয় না। মাঝখান থেকে তার চোয়াল ও ঠোট ব্যথা করে।

তখন সন্ধ্যা, সন্ধ্যার কুয়াশা কালচে লাল হয় বারান্দায় রাখা কুপির আলোয়। তমিজের সঙ্গে কথা বলেতে বলতেই ফুলজানের ঘরের ভেতরে গিয়ে তার ছেলেকে নিয়ে আসে, কোলের ওপর রুগ্ন ছেলেটিকে সে নিয়ে এসেছে একটি নতুন র্যাপারে জড়িয়ে। কুপির আলো পড়েছে ফুলজানের বেটার গায়ের কাপড়টিতে। এই কালচে লাল আলোতেও কাপড়টা চিনতে তমিজের একটুও দেরি হয় না। সঙ্গে সঙ্গে সে তাকায় কুলসমের দিকে, কুলসুমও ওই কাপড়টাই দেখছে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে। তমিজের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।

সারাটা রাস্তা কুলসুম রেডক্রসের সেই ব্যাপারের কথা তুললো না। সেই চাঁদনি রাতে তমিজ ওই যে ফুলজানের গায়ে র‍্যাপার চড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো, এরপর কুলসুম না হোক একশোবার ওটার কথা বলেছে। তমিজ একেকবার একেক জবাব দিয়েছে। আচ্ছা, সত্যি কথাটা বলতে তার অসুবিধাটা কী ছিলো? তমিজের গা চড়চড় করে : সে কি তার বাপের বৌয়ের খায় না পরে? তাকে তার এতো ভয় করার কী হলো? ফুলজানকে রাপার দিয়েছে, ঠিক করেছে। তাকে কি কুলসুমের মুখ চেয়ে চলতে হবে? তাকে সংসার করতে হবে না? দুই চার বিঘা জমি করতে হবে না? তার দিকে দেখে কে? বাপ তো তার হিসাবের বাইরে। রাত নাই, দিন নাই আবোরের লাকান খালি টোপ পাড়ে আর নিন্দ পাড়ে। নিন্দের মধ্যে কীসব খোয়াব দেখে আর এদিক ওদিক হাঁটে।-কুলসুম কি স্বামীকে কখনো এভাবে ঝিমাতে আর ঘুমাতে আর হাঁটতে না করেছে কখনো?

ঘুমের পাঁকের মধ্যে পড়েই তো বাপ তার খোয়াব দেখে আর কামকাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। স্বামীর এই খাসলত তো কুলসুমই বরং উস্কে উস্কে দেয়। আর কোনো মেয়েমানুষ কি স্বামী ঘুমের ভেতর কী বিড়বিড় করে তাই শুনতে তার মুখের কাছে কান পেতে থাকে? বাপের এই খাসলতেই সংসারটা তাদের ছারেখারে গেলো। এখন হিসাব করো তো, এই খাসলত সে পেলো কোথায়? চেরাগ আলি ফকিরের পোঁদে পোঁদে ঘুরেই তো তার এই দশা। খোয়াব দেখার কী ভয়ানক নেশা ফকির তার মধ্যে সেঁধিয়ে দিলো যে ঘর সংসার ভুলে মানুষটা তাতেই বুদ হয়ে থাকে এই বুড়া বয়সেও! যে মানুষ বড়ো হওয়া পর্যন্ত ঘুরঘুর করলো মণ্ডলদের বাড়িতে, যাদের এঁটোকাটা খেয়ে যার শরীর পুরুষ্টু হলো, সে-ই কিনা ওই বাড়ির নাম পর্যন্ত শুনতে পারে না। ফকির তাকে কী এলেম যে দিয়ে গেলো। শরাফত মণ্ডলের এতো কষ্ট করে, এতো তদবির করে, নায়েববাবুর পেছনে এতো খরচা করে ইজারা নেওয়া বিল, সেই বিলের ধারে ধারে আন্ধারে মান্দারে তমিজের বাপ যদি ঘুরে বেড়ায় তো মণ্ডল তাকে সন্দেহ করবে না কেন? চেরাগ আলি তার নাতনিটাকে গছিয়ে দিয়ে গেলো বাপের ঘাড়ে, কী মন্তর পড়ে দিয়ে গেছে কে জানে? না-কি ফকিরের মন্ত্রে কুলসুমই তাকে এমন করে রেখেছে? তা ছাড়া আবার কী? ঘরের দুষমন এই মেয়েমানুষটাকে তোয়াক্কা করলে কি তমিজের চলে?

 ১৮. ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে

ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে সেদিন মেলা মানুষ। দুই দিকে পাথরের ওপর গথিক অক্ষরে যথাক্রমে হোসেন মঞ্জিল ও এম. টি হোসেন খোদাই-করা দুই পিলারের মাঝখানে কাঠের ফ্রেমে বাঁধা টিনের গেট হাট করে খোলা। দুই পাশের কামিনী গাছ দুটো পড়ে গেছে গেটের দুই পাল্লার আড়ালে।

ভেতরে পাঁচিল ঘেঁষে দুটো গোলঞ্চ, একটা বকুল ও একটা কণকচাঁপা গাছ। প্রতিটি গাছের নিচে দুই থেকে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছে। তাদের কেউ কেউ কাদেরের মুখ-চেনা, কিন্তু তারা তাকে আমল না দিয়ে নিজেদের মধ্যে গুজুরগাজুর চালিয়ে যায়। লন পেরিয়ে জোড়া ঝাউগাছের মাঝখানে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠেও কাদেরের সুবিধা হয় না, সেখানে পেতে রাখা চেয়ার ও বেঞ্চের একটিও খালি নাই। হলঘরের কপাট একটা ভেজানো, আরেকটা প্রায়-খোলা। খোলা কপাটের সামনে দাড়িয়েই কাদের ইসমাইলের হাতের ইশারা টের পায়। ঘরের ভেতরেও বসবার আসন সব ভর্তি। কর্মী গোছের কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাদেরকেও দাঁড়িয়েই থাকতে হয়।

সোফায় বসে অবিরাম কথা বলে চলেছে ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার। জেলা মুসলিম লীগের প্রবীণ নেতা, থার্টি সেভেনে প্রজা পার্টির টিকেটে এম এল এ হয়ে বছর তিনেক পর মুসলিম লীগে জয়েন করে। মানুষটা রাশভারী না হলেও স্বল্পবাক, এ্যাসেম্বলি কিংবা বাইরে কখনো মুখ খোলে না। রোগীদের সঙ্গে প্যাচাল পাড়তে হয় বলে ডাক্তারি ছেড়েছে এম বি পাস করার দুই বছরের মাথায়। এখন রাইস মিল, বাংলা সাবানের কারখানা ও কেরোসিনের ডিলারশিপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। লীগ অফিসেও তার যোগাযোগ নাই বললেই চলে। রাজনীতি সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনা বা প্রতিক্রিয়া যা প্রকাশ করার সব পেশ করে আসে জেলা মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট খান বাহাদুর সৈয়দ আলি আহমদের দরবারে।

তা সেই মানুষ আজ এসেছে ইসমাইলের বাড়িতে এবং এতোটাই সবাক হয়ে উঠেছে যে, সবাই চুপচাপ তার কথা শোনে। শ্রোতাদের নিরঙ্কুশ মনোযোগে তার বাক্য পায় বাণীর মর্যাদা, সূর্যের চড়া তাপ সহ্য করা যায়। না কী বলেন? কিন্তু তপ্ত বালুতে হাঁটতে গেলে পায়ে ফোস্কা পড়ে। না কী?

শ্রোতাদের মৌনকে সম্মতির লক্ষণ বিবেচনা করে খন্দকার তার বাণীর ব্যাখ্যা শোনায়, বুঝলেন না? সবার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে শ্রোতাদের বোঝার ক্ষমতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে সে বোঝায়, জমিদারের অত্যাচার সহ্য করা যায়। কেন? না, তার আগামাথা আছে, নিয়মকানুন আছে। কিন্তু ছোটলোকরা তো নিয়ম জানে না, আইন মানে না। না কী? এইগুলো হলো বেয়াদব, বেয়াদবের জুলুম গায়ে জ্বলে। জ্বলে না? এখন মুসলিম লীগের ওয়ার্কাররা যদি এদের সঙ্গে থাকে তো পার্টি করতে পারবেন? বলেন, পারবেন? * ইসমাইল তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, আরে ডাক্তার সাহেব, ওসব হলো তেভাগার এরিয়া। আমাদের ওয়ার্কারদের মধ্যে বর্গা খেটে খায় প্রায় সবাই। এখন অন্য বর্গা চাষীদের তারা অপোজ করে কীভাবে?

এবার ইসমাইলকে উপদেশ দেওয়ার সুযোগ নেয় সাদেক উকিল, ছোঁড়াদের। ডেকে বলে দাও, তোমরা ইসলামের কথা বলো। মাথা গরম না করে পাকিস্তান হাঁসেলের কথা বলো। ইসলাম গরিবদের হক আদায় করে। ইন পাকিস্তান উই উইল ইনট্রোডিউস জাকাত। আল্লা যাকে দৌলত দিয়েছেন সে তার প্রপার্টির টু এ্যান্ড হাফ পার্সেন্ট কন্ট্রিবিউট করবে জাকাত ফান্ডে। ইসলাম ইজ এ ফুল কোড অফ লাইফ। আর কোনো রিলিজিওনে গরিবকে এতো রাইট দেওয়া হয়েছে? আবার কারো প্রপার্টি লুটপাট করাও ইসলাম এ্যাপ্রুভ করে না। কায়েদে আজমের মটোই হলো, লিভ এ্যান্ড লেট লিভ। অর্থাৎ নিজে।

সাদেক উকিলের কথা বলা মানেই বক্তৃতা দেওয়া, তার ইংরেজি বাক্যের বাঙলা অনুবাদ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই শামসুদ্দিন ডাক্তার তার ও কায়েদে আজমের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করে, আমি তো তাই বলি। ওইসব ছোঁড়ারা যা করছে তাতে এলাকার ভদ্রলোকদের পক্ষে আমাদের পার্টিতে থাকা অসম্ভব।

আদমদিঘির মজিদ সরকার বসেছিলো শামসুদ্দিন ডাক্তারের পাশে এবং অনেকটা তার আশ্রয়েও বটে। ইসমাইল তার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসে, দলের ওয়ার্কারদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি এতোই খারাপ? ওদের ওপর আপনার হোল্ড নেই? অন্তত আপনাকে তো মানবে!

ইসমাইলকে এবার বেশ জুত করে ধরা যাচ্ছে দেখে ডাক্তার পুলকিত হয়, আরে এরা তো সব আপনার রিকুট। বলে পুরো অবস্থাটার বিবরণ দেয় দ্বিতীয়বার। আবদুল কাদের প্রথমবার মিস করেছিলো, কিন্তু অন্যান্য শ্রোতার মনোযোগও তার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়।-জেলার পশ্চিমে অনেকটা এলাকা জুড়ে আধিয়াররা ধান কেটে তুলছে নিজেদের ঘরে। তুলুক। কিন্তু নিজেরাই ধান মেপে এক ভাগ দিতে চায় জোতদারকে আর দুই ভাগ নেবে নিজে। তা এ উৎপাত তো অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। টাউনের মানুষ ইসমাইলের তাতে কী? কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো এই যে, ওইসব বর্গাচাষীদের অনেকেই মুসলিম লীগের ওয়ার্কার, লীগের লোক বলে তাদের সবাই চেনে। এমন কি আদমদিঘির দুই মাইল পুবে শান্তিগড় বাজারে মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড টাঙানো ঘরটিও ওদেরই দখলে।—এরা নিজেরা জোতদারদের পাওনা তো দিচ্ছেই না, এমন কি কম্যুনিস্টদের সঙ্গে ভিড়ে ধান সব নিজ নিজ ঘরে তোলার জন্যে নিরীহ গ্রামবাসীদের উস্কানি দিচ্ছে; ফলে পাকিস্তান ইস্যু মার খাচ্ছে। এলাকার ভদ্রলোকদের সাপোর্ট ছাড়া দল টেকে কী করে?

সাদেক উকিল তার বক্তৃতা সম্পূর্ণ করার আশা ছেড়ে দিয়ে একটু রাগ করেই পড়তে শুরু করে দিয়েছিলো আগের দিনের দৈনিক আজাদ। দার্জিলিং মেলে কাগজটা টাউনে পৌঁছুবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নিশ্চয়ই এটা তন্ন তন্ন করে পড়ে ফেলেছে। এই দৈনিকের চিঠিপত্র কলামে স্থানীয় সমস্যা, স্কুল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা, ইসলামের আলোকে নানা সমস্যার সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে তার লেখা ছাপা হয় তিন মাসে অন্তত একবার। সাদেক এখন কাগজের কোন পৃষ্ঠা পড়ছে আড়চোখে তাই দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে কথা বলছিলো শামসুদ্দিন ডাক্তার। কিন্তু এবার বাধা আসে অন্যদিক থেকে। মজিদ সরকার কথা বলতে চেষ্টা করছিলো অনেকক্ষণ ধরে, এবার সে ডাক্তারের দীর্ঘ কাশিজনিত বিরতির সুযোগ নেয়, হামাগোরে সর্বস্বান্ত করা দিলো। আরে হামার বর্গাচাষা হামার জমির ধান লিয়া গেলো লিজের ঘরত, আবার শুনি ওই চাষা বলে হামারই পার্টির মানুষ। মানষে হাস্যে, ইগলান কী পার্টি করো গো?–আক্কেলপুর ইস্টিশনত ট্রেন লেট করায়া তমিজুদ্দিন খান সাহেবকে দিয়া লেকচার দেওয়ালাম। গাঁয়ের মধ্যে থাকা মানুষ লিয়া আসিছি। কতো ওয়ার্কারেক চিড়াগুড় খিলালাম। এখন ওই নেমকহারামরাই হামার বর্গাদারেক উস্কানি দেয়। হামাক সর্বস্বান্ত কর‍্যা ফালালো।

তিন হাজার বিঘা জমির মালিকের সর্বস্বান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় সবাই খুব চিন্তিত। তাদের সমবেত দীর্ঘশ্বাস পড়ে, এই দীর্ঘশ্বাস ইসমাইলের প্রতি প্রতিবাদ প্রকাশও বটে। কারণ ওই এলাকায় ওইসব ছোটলোকদের লীগে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছে ইসমাইল। ইসমাইল হোসেন আসলে পুব এলাকার মানুষ। তাও আবার দুই তিন পুরুষ টাউনের বাসিন্দা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে ছিলো কলকাতায়। জেলার কোথায় কী হাল সে তার জানেটা কী? তখনি তাকে ইশারা দেওয়া হয়েছিলো, দল করতে গিয়ে যে সে মানুষের কাছে যাওয়াটা পরে দলের জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। ইচ্ছেও তো তাই।

ইসমাইল কোণঠাসা হয়েছে বুঝতে পেরে ডাক্তারের উত্তেজনায় মেশে উল্লাস, কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে সে ছোটো ছেলেকে বোঝাবার ভঙ্গিতে ইসমাইলকে বলে, মজিদ সরকার, আলি মামুদ খাঁ, আলতাফ মণ্ডল, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন পাইকার এরা আজকের বড়োলোক নয়, একেকটা থানা জুড়ে এদের প্রতিপত্তি। এদের মতামত নিয়ে ওইসব এলাকার পুলিস যায় চোর ডাকাত ধরতে। এদের সম্পত্তিতে গতর খাটিয়ে সমস্ত এলাকার মানুষের রেজে আসে। এমন কি পুব এলাকার চাষারা ধান কাটার সময় রোজগার করতে যায় এদের জমিতেই। এখন এইসব মাথা মাথা মানুষের মাজা ভেঙে দিলে ওখানে মুসলিম লীগ করবে কে? ওইসব বেয়াদব ছোটোলোকদের কাছে লীগকে বন্ধক দিলে পাকিস্তান টাকিস্তান সব ফাঁকি।

ইসমাইল এর মধ্যে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে, আরে রাখেন। জয়পুর, আদমদিঘি, পাঁচবিবি, আক্কেলপুরে ফর্টি ওয়ানে আমরা গিয়েছি না? আবুল হাশেম সাহেব এসেছিলেন, মনে আছে ডাক্তার সাহেব?

কিন্তু ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকারের স্মরণশক্তির পরীক্ষা না নিয়েই সে বলে চলে, ওদিকে কোনো জোতদারের কোঅপারেশন পাওয়া গেলো না। শ্যামা-হক ক্যাবিনেট, বড়োলোকরা অন্যদিকে ঝুঁকতে ভয় পায়। আরে ভাই, কোথাও মিটিং করা যায় না। পাঁচবিবিতে নাসের মণ্ডল খুব পাওয়ারফুল লোক, তিনি আছেন কম্যুনিস্টদের সঙ্গে। তিন বছর আগের কথা বলতে বলতে ইসমাইল চাঙা হয়ে ওঠে, শেষকালে নাটোরের উকিল কিরণ বাবুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, কিরণ মৈত্র, পুরনো কংগ্রেসি, বললেন, নাসির মণ্ডলকে ভালো করে ধরো, তাঁকে হাত করতে পারলে তোমাদের মিটিং হবে। তো গেলাম। বুড়ো কি রাজি হয়?

এই গল্প ডাক্তার ও সাদেক উকিলের জন্যে অস্বস্তিকর, নাসির মণ্ডল এদের কাউকেই এ পর্যন্ত তার এলাকায় ঢুকতে দেয় নি। সাদেক উকিল অস্বস্তি কাটাতে বলে, আরে আপনার নাসির মণ্ডলকে তো আমি এক হাত নিলাম একবার শান্তহারে। বললাম, আপনারা লড়াই করেন আল্লার বিরুদ্ধে, আমরা জেহাদ করি আল্লার হুকুমত কায়েম করতে। ইসলাম ইজ এ ফুল কোড–। এবারেও তার ভাষণ অসমাপ্ত থাকে ইসমাইলের কথার তোড়ে, আঃ! শোনেন না। আমি গিয়ে বুড়োকে বললাম, মণ্ডল সাহেব, আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও যদি কম্যুনিস্টদের শেলটার দিতে পারেন তো আমরা কী দোষ করলাম? আমাদের মিটিং প্রিজাইড করবেন আপনি। আমাদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই বলবেন। কিন্তু আমাদের নেতাকেও বলতে দিতে হবে। বুড়ো তখন রাজি। নিজের লোকজন নিয়ে মিটিং অর্গানাইজ করালেন। হাশেম সাহেব পাক্কা দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। দারুণ রেসপন্স পাওয়া গেলো। আমরা তো চাষীদের কথাই বললাম। কয়েকটা ইয়াং ছেলে, চাষী ঘরের ছেলে, আমাদের সঙ্গে জয়েন করলো। ওদের দিয়ে লোকাল কমিটি ফর্ম করে রাত্রে নাসির মণ্ডলের বাড়িতে ভুরিভোজন সেরে দার্জিলিং মেলে নামলাম শান্তাহার।

বুঝলাম। কিন্তু ছেলেগুলো কি আসলে আমাদের ইডিওলজিতে সাদেকের কথায় ফের বাধা দেয় ইসমাইল, তার গল্প এখনো শেষ হয় নি, শোনেন না! শান্তাহারে নেমে দেখি কিরণবাবু। আমাদের মিটিঙের খবর শুনে মহা খুশি। শান্তাহার রেলওয়ে এন্টারটেনমেন্ট রুমে আমাদের লাঞ্চ করালেন। এতে খুশি কেন? তাহলে এবার তারা কংগ্রেসের মিটিং করতে পারবেন। করুন। আমাদের কী? হিন্দুরা যতো খুশি কংগ্রেস করুক। মুসলমান ছেলেরা তো আমাদের সঙ্গেই চলে এলো। ওই মিটিংটা না হলে ঘোড়াগুলোকে কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সরানো যেতো?

সরিয়ে লাভ কী হলো? ইসমাইল হোসেনের কৃতিত্বকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেয় সাদেক উকিল, ওদের মাইন্ড তো চেঞ্জ করতে পারলেন না। পাকিস্তানের ইডিওলজি কি ওরা মেনে নিয়েছে?

মাঝখান থেকে মুসলমান ভদ্রলোকেদের বিপদে ফেললেন। মুসলিম লীগের মেম্বার হয়ে মুসলমানদের মধ্যে ডিভিশন তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ডাক্তারের অভিযাগের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করে চণ্ডিহারের আলতাফ মণ্ডল, কিসের মোসলমান? ওঠাবসা সব সাঁওতালগোরে সাথে। সাঁওতালরা আগে কী সুন্দর বর্গা করিচ্ছিলো, ওরা জমিত হাত দিলেই ফসল, ভাগাভাগির সময় কোনো ক্যাচাল নাই। আপনের এই ছেড়াগুলার পাল্লাত পড়া ওরাও এখন ধান তোলে নিজের ঘরত। সাঁওতাল মোসলমান আধিয়াররা একজোট, আপনের কিসের পাকিস্তান? উপায়ন্তর না দেখ্যা হামরা ডাক্তার সায়েব আর উকিল সায়েবেক ধরা আজ গেলাম খান বাহাদুর সাহেবের দরবারে। তা সাহেব কলেন,।

প্রসঙ্গটি তোলা ডাক্তারের পছন্দ হয় নি। আলতাফ মণ্ডলকে সে থামিয়ে দেয়, আরে তিনি হলেন শরিফ মানুষ। বেন্নার ঘরের বেতমিজ ছোকরাদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন নাকি?

কিন্তু ছোটোঘরের বেতমিজ ছোরাদের ঠেকাতে না পারলে আলতাফ মণ্ডলের ধানপান, জোতজমি; মানইজ্জত সব রসাতলে যায়। বাঁচার জন্যে খড়কুটো ধরতেও সে ব্যগ্র, তা খান বাহাদুর সাহেব মনে হলো খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। কলেন, ওরা সব ইসমাইলের লোক। ইসমাইলকে বলেন, ওদের ঠাণ্ডা করুক।

খান বাহাদুরের দুর্বলতার কোনোরকম প্রকাশ ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকারের। নিজের অপদস্থ হওয়ার সামিল। সে তাই বিরক্ত হয়ে বলে, আরে আলতাফ মিয়া, অতো ভয় পান কেন? দুশ্চিন্তা তো খান বাহাদুর করেন না, দুশ্চিন্তায় মরেন আপনারা। অতো ঘাবড়ান কেন? দেখেন না, সপ্তাহখানেকের মধ্যে নাজিমুদ্দিন সাহেব আসবেন বালুরঘাট। আমাদের খান বাহাদুর সাহেবও যাবেন। ঢাকা ফেরার পথে খান বাহাদুর যদি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে এদিকে এনে জয়পুর কি শান্তাহারে একটা মিটিং করাতে পারেন তো তাতেই কাজ হবে। ভালো একটা মিটিং হলে এইসব ছোঁড়াদের পিটিয়ে গ্রামছাড়া করা যাবে।

আরে রাখেন! ইসমাইল তাকে কিংবা নাজিমুদ্দিন কিংবা দুজনকেই উড়িয়ে দিতে পাশের টেবিলে জোরে চাপড় মারে। টেবিলের ওপর কাপ পিরিচ ঝনঝন করে বাজলে তার প্রভাব পড়ে ইসমাইলের গলায়, ওইসব ছেলেদের হোস্টাইল করে রেখে নাজিমুদ্দিন শান্তাহারে নামতে পারবে? জয়পুর দিয়ে পাস করতে পারে কি-না দেখেন। ইন ফ্যাক্ট, দে আর আওয়ার বেস্ট ওয়ার্কার্স ইন দি হোল ডিস্ট্রিক্ট।

আলতাফ মণ্ডল উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গি করে, তাহলে আর কী? আপনারা ওই চ্যাংড়াপ্যাংড়াক লিয়াই থাকেন। হামরা আর থাকি ক্যাংকা করা?

ডাক্তার তার হাত ধরে বসিয়ে দেয়, আরে, পলিটিক্স করেন, এতো রাগ করলে চলে? বসেন।

ভালো করে বসেও আলতাফ মণ্ডলের রাগ আর পড়ে না, হামরা কি আর পলিটিক্স করি? পাড়াগাঁয়ের মানুষ, পলিটিক্সের হামরা বুঝি কী? আপনারা পাকিস্তানের কথা কন, পাকিস্তান হলে এসলামের ইজ্জত হয়, মোসলমানের মাথাটা উঁচা হয়। এসলামের খেদমত করলে আল্লা খুশি হয়, লিজের জানটাও শান্তি পায়। তাই কৃষক প্রজা বাদ দিয়া নাম লেখালাম মুসলিম লীগের খাতৃত। হায় আল্লা, এখন দেখি, আল্লারসুল মানে না, নামাজরোজার তো ধারই ধারে না, এইসব মানুষের পিছে ছোটে যিগলান চ্যাংড়া আপনারা লীগের চাবি দিয়া থুছেন সেইগুলার হাতে। ঠিক আছে, লীগ পাট্টি তারাই করুক।

আলতাফ মণ্ডলের কথার ঝঝে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলে আলি মামুদ খা খুব খুশি হয়, আবার মণ্ডলের এক নাগাড়ে এতো কথা বলার শক্তিতে তার হিংসাও একটু হয়। সে বলে, লাল লিশানের পাট্টির চ্যাংড়াপ্যাংড়া লিয়া আপনার লীগের ফায়দা হবি না। গণেশতলাভহামার মামুগোরে জমি বর্গা করে এক চাষা, তার বেটা, বুধা করা কয়, এক্কেরে হালুয়া চাষা, উঁই একজোট হছে ওই তেভাগার হুজুগেত। শালা হালুয়া চাষার বেটা, আল্লারসুল তো মানেই না। সেটা আল্লাই বিচার করবি, ছোঁড়া লিজের আখেরাত লিজেই খোয়ায়, হামার কী?—কথা সেটা লয়। কথাটা কী তাই বলতে গলার স্বর একটু নামায় সে, আপনারা বিশ্বাস করবেন না। হামার মামু লিজে কছে। মামু হামার হাজি মানুষ, নামাজ কাজা করে না। মিছা কথার মানুষ লয়। সত্যবাদী মামার সরবরাহকৃত তথ্যটি জানাতে তার গলা নামে আরো নিচে, ফিসফিস করে বলে, বুধা শালা কাছিমের মাংসও খায়! হারামখোর শালা! তারপর তার গলায় ফের জোর আসে, ইগলান মানষেক ইমাম মানিচ্ছে আপনার মুসলিম লীগের চ্যাংড়াপ্যাংড়া।

এদের সোজা এক্সপেল করে দেওয়া হবে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার, এসব তো আর ছেলেখেলা নয়। সামনে ইলেকশন, আধিয়ার চাষার হাতে ভোট কটা আছে? ছয় আনা ট্যাক্স দেয় কয়জন?

ইসমাইল বলে, কিন্তু মুসলিম লীগের প্রোগ্রামে তো চাষীদের দাবিই বেশি। বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ—

কিন্তু আমাদের মজিদ সরকার, আলফাত মণ্ডল, আলি মামুদ খা এঁরা কি কেউ জমিদার? না মহাজন? জমিদারদের খাজনা দিতে এদের জান বেরিয়ে যাচ্ছে। এড়ুকেশন সেস ধরেছে জমিদারের ওপর, জমিদার এই টাকা জোগাড় করবে কোত্থেকে?

প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্যে ধার্য এড়ুকেশন সেসের চাপে জমিদাররা একেবারে হেলে পড়েছে, সেই হাহাকার এরা একটু আগে শুনে এসেছে খান বাহাদুর সৈয়দ আলি আহমদের অসহায় কঠে। খান বাহাদুরের এমন সংকটে এরাও খুব দুঃখিত। তবে দুঃখের আর একটি কারণ হলো এই যে, ওই খাজনা তো জমিদার আদায় করবে প্রজাদের ঘাড় ভেঙে। চাষারাই কী কেবল প্রজা? বড়ো প্রজা তো জোতদার। ইসমাইল কি ওই বেয়াদব ছোঁড়াদের বোঝাতে পারে না যে, জোতদাররাও কেমন জুলুমের শিকার?

খান বাহাদুরের ওখানে নিজের বেদনার জন্যে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটি মজিদ সরকার ছাড়ে এখানে, আমাদের উপরে জুলুম দুই দিক দিয়া। জমিদার লিত্যি খাজনা ধরে। ফ্লাউট কমিশন রেপোট দিলো, কই কিছু তো হয় না। জমিদারি উচ্ছেদ তো হামরাও চাই। আবার দেখেন লিচের দিকের বিপদ, জমির ফসল লিয়া যাচ্ছে আধিয়াররা। হামরা এখন করি কী? উদিন কবির তরফদার সাহেব কলেন, কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকের দিকে দেখে, প্রজার দিকেও দেখে। বড়ো প্রজা কারা?-আপনারাই কন।

সাদেক উকিল ভয় পায়, এরা আবার নতুন করে কৃষক প্রজার সঙ্গে না ভেড়ে, আরে ওটা একটা পার্টি হলো? হক সাহেব আউট, পার্টিও শেষ। ইনডিয়ান মুসলমানের পার্টি একটাই। অল ইনডিয়া মুসলিম লীগ।

তা তো বটেই। ইসমাইল সুযোগ নেয়, মুসলমানদের মধ্যে মেজরিটি তো চাষাই। লীগের দাবির বেশিরভাগই তো চাষাদের জন্যে।–কম্পালসারি ফ্রি প্রাইমারি এড়ুকেশন হলে স্কুলে যেতে পারবে তো তাদের ছেলেমেয়েরাই। হাটে এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টস বিক্রির সময় টোল বন্ধ করার দাবি। সবই তো তাদের জন্যেই। তাদের ছেলেরা পার্টির ওয়ার্কার তো হবেই।

কিন্তু ইসমাইল সাহেব, আপনার পার্টির প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্ট করতে হলে ইলেকশনে আসতে হবে না? শামসুদ্দিন ডাক্তারের আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে, গ্রামের মুরুব্বিদের সর্বনাশ করে আপনি ভোট পাবেন না। হিন্দু ক্যানডিডেট সব আসবে কংগ্রেস থেকে, ওদের ইউনিটি আছে। মুসলিম কনষ্টিটিউয়েনসিতে জোতদাররা আমাদের সাপোর্ট নাও দিতে পারে, আমাদের ওয়ার্কাররা ওদের জমি লুট করবে আর ওরা আমাদের পক্ষে থাকবে, এটা আশা করেন কীভাবে? কংগ্রেস, কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম ক্যানডিডেট দেবে। দেবে না? মুসলমান ভোট ভাগ হয়ে গেলে কে আসবে। শিওর করে বলতে পারেন? গ্রামে ভোট অর্গানাইজ করবে কারা? কারা করবে?—গ্রামের মুরুব্বিরাই তো, না কী?

ইসমাইল একটু গম্ভীর হয়ে পড়লে সাদেক উকিল বলে, জোতদারদের ধান লুট করা কি মুসলিম লীগের প্রোগ্রামের মধ্যে আছে নাকি? ইসলামে কি এসব লুটপাট জায়েজ করা হয়েছে?

ইসমাইল চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তাদের দলের ভালো ভালো কর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টি,এটা তো ঠিক হচ্ছে না। আর ইলেকশনে গ্রামের মাতব্বররা বড়ো ফ্যাক্টর। ছাত্রজীবনে মেয়র ইলেকশনে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, কলকাতার শিক্ষিত মানুষও ভোট দেয় দল বেঁধে। তাদের মুরুব্বি আছে, সমাজ আছে, সমাজের ভেতর উপ-সমাজ আছে। ইলেকশন করতে গেলে এসব খেয়াল করতে হয়। এখানে ভোটার হলো পাড়াগাঁয়ের মানুষ। তাদের মধ্যে আবার ছয় আনা ট্যাকস দেয় যারা ভোট দেবে কেবল তারাই। বিয়েশাদি, আকিকা, মুর্দার দাফন, চেহলাম, ভোট এসব তারা করে সমাজ মেনে।

কম্যুনিস্টদের সঙ্গে কাজ করছিলো এরকম কিছু ছেলে লীগে আসায় তার খুব ভালো লাগছিলো। জেলার পশ্চিমে কয়েকটা জায়গায় তেভাগার বেশ জোর, এই ছেলেগুলোকে ধরে রাখতে না পারলে এরা সবাই তো কম্যুনিস্ট হয়ে যাবে। এই বুড়োগুলো এটা বোঝে না কেন? আবার সে নিজে কম্যুনিস্ট না হয়েও যদি গরিব মুসলমানদের কিছু হেলপ করতে পারে কম্যুনিস্টদের সাহায্যে, তাতে তো বরং তার দলেরই লাভ। ওর ছেলেবেলার বন্ধু অজয় আর ওর বোন প্রতিমা তো তার রেডক্রসের দুধ বিলি করতে। মেলা সাহায্য করলো। ফেমিনের সময় ইসমাইল কতো লোককে দাফন করেছে, তখন এইসব বুড়ো ছিলো কোথায়? বীরেন, সমীর, সুকুমার এরাই তো সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। গোলাবাড়িতে মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড লটকানো কাদেরের দোকান থেকে রেডক্রসের রিলিফের মাল দিলো, এই নিয়ে কংগ্রেসের লোকজন তো ওপরে নালিশও করেছিলো। রেডক্রসের বৃটিশ সাহেব এই ব্যাপারে ইনকুয়ারি করতে এলে অজয়ই তো ইসমাইলের পক্ষে মেলা যুক্তি খাড়া করিয়ে সাহেবকে বুঝিয়ে দিলো। সবই ভালো—কিন্তু তার দলের ছেলেদের দিয়ে ওরা যদি মুসলমানদের মধ্যে ডিভিশন তৈরী করে তো পাকিস্তান দূরের কথা, মুসলিম লীগ টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে।

ইসমাইলের এই নীরব অস্বস্তিকর ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে চলে সাদেক উকিলের সরব সিদ্ধান্ত, আপনারা ভাববেন না। আপনাদের ওদিকে মিটিং অর্গানাইজ করেন। ইসলামিক ইডিওলজি ভালো করে বোঝাতে হবে। তাহলেই ওসব লুটপাতের ভুত ঝাড়ানো যাবে। তার ছাড়া ছাড়া কথাগুলোই ইসমাইলকে বেশ ভাবনায় ফেলেছে দেখে নিজের সাফল্যে তৃপ্ত হয়ে সে বেশ লম্বা ডায়ালগ ছাড়ে, লেট আস আর্নেস্টলি হোপ এ্যান্ড ট্রাস্ট দ্যাট দি মোস্ট নোবল টিচিং এ্যানড একজাম্পলস অফ আওয়ার হোলি প্রফেট উইল বি ফলোড বাই অল দি মুসলমানস, দ্যাট ইজ ল্যান্ড টিলার্স এ্যান্ড শেয়ারক্রপার্স, জোতদারস এ্যান্ড লাভলর্ডস, পুওর এ্যান্ড রিচ, এড়ুকেটেড এ্যান্ড ইললিটারেট নট ওনলি অফ দি এরিয়া উই আর টকিং এ্যাবাউট বাট গ্রুআউট দি লেংথ এ্যান্ড ব্রেডথ অফ ইনডিয়া। ব্রাদার্স, নেভার ফরগেট দ্যাট ইসলাম ইজ এ ফুল কোড অফ লাইফ। ইট গিভস আস এভরিথিং উই নিড। ইট অফারস আস দি উইপন টু ফাইট ফর পাকিস্তান হুইচ রিমেইনস আওয়ার গোল টিল উই এ্যাচিভ ইট।

ইসমাইল হোসেন যথেষ্ট কোণঠাসা হয়েছে বিবেচনা করে শামসুদ্দিন ডাক্তার ব্যাপারটা এখানেই খান্ত করতে চায়। ইসমাইলটা চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে বেশি। খান বাহাদুরের সামনে প্রায়ই বেয়াদব হয়ে পড়ে, মুসলিম লীগকে নবাব নাইটদের পকেট থেকে বের করে আনতে হবে বলে তড়পায়। খান বাহাদুরের সামনে তাকে এমনি ঘায়েল করতে পারলে কাজের মতো কাজ হতো একটা! এতো খানদানি লোকটাকে ইসমাইল কম বেইজ্জত করে না। আগে মুসলিম লীগের অফিস ছিলো খান বাহাদুরের বাড়িতে, এই ইসমাইল এখানে এসে জোর করেই ঝাউতলায় অফিস ভাড়া করলো, লোহার প্যাচানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলার সেই খুপরি ঘরে উঠতে খান বাহাদুর হাঁপিয়ে যায়। ফর্সা টকটকে মানুষ, লাল হয়ে যায়। একদিন তার সামনে একে একটু শিক্ষা দিতে হবে। আজ এই পর্যন্তই থাক। একে ঘায়েল অবস্থায় দেখে যাওয়াই ভালো। সাদেক উকিলের লম্বা ইংরেজি ডায়ালগে গেঁয়ো জোতদারগুলো আর ওয়ার্কাররা একেবারে মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। ইসমাইলকে ইংরেজি বলার সুযোগ দিলে এই মুগ্ধতা স্থানান্তরিত হতে পারে। ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?

সবাই উঠে দাঁড়ালে শামসুদ্দিন ডাক্তার ইসমাইলকে একটু তফাতে ডেকে নিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কী যেন বলে।

১৯. ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার

ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকারের ওই গোপন কথাটি ইসমাইল আবদুল কাদেরকে জানায় সপ্তাহখানেক পর। উত্তরবঙ্গের প্রজাসাধারণের একমাত্র মুখপত্র সাপ্তাহিক প্রজাবাহিনীতে দি কুবের ব্যাংক লিঃ-এর একটি নিলামের বিজ্ঞাপন দেখে সেদিন টাউনে যাচ্ছিলো আবদুল কাদের, হোসেন মঞ্জিলে ঢুকলো ইসমাইলের সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে। খাকি প্যান্ট, ছাই রঙের কোট পরে ও সোলার হ্যাট হাতে ইসমাইল বেরুচ্ছিলো, কাদেরকে দেখে বাড়ির ভেতরের দিকে মুখ করে দুই কাপ চায়ের জন্যে হাঁক দিয়ে বারান্দায় বসলো চেয়ার টেনে।

নিলাম? মানে? কিসের নিলাম?

টাউনের থানা রোডে অবস্থিত দি নিউ স্বদেশী ভাণ্ডার নামীয় দোকানের কতগুলি প্যাকিং বাকস মধ্যস্থিত দ্রব্যাদি (সাধারণতঃ তৈল, সাবান, চা, কালী, পাউডার, সিন্দুর, সেন্ট প্রভৃতি) এবং উত্তম বিলাতি ল্যাম্প দি কুবের ব্যাংক লিঃ-এর প্রাপ্য অর্থ আদায় করার নিমিত্ত ব্যাংকের বড়গোলাস্থ মোকামে নিম্নবর্ণিত তারিখ ও সময়ে প্রকাশ্য নিলামে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয় হইবে। ক্রয়করনেচ্ছুক সৰ্ব্বসাধারণের উপস্থিতি প্রার্থনীয়।

সাপ্তাহিক প্রজাবাহিনী ইসমাইলের পছন্দ নয়, ভাঙাচোরা কৃষক প্রজা পার্টির পয়সাওয়ালা কিছু লোক এখনো ছেপে চলেছে, এদের টার্গেট মুসলিম লীগ। বুড়োগুলোর ওপর হক সাহেবের ছায়া লেপ্টেই থাকে। কাদেরের বাপ নিশ্চয়ই এটার গ্রাহক। ইসমাইল নিজে এটা নিয়মিতই পড়ে, কিন্তু দলের কর্মীদের হাতে দেখলে ভুরু কেঁচকায়। কাগজটা টেবিলে একটু ঠেলে রেখে ইসমাইল বলে, স্বদেশী ভাণ্ডার মানে অখিলবাবুর দোকান, অখিল কুণ্ডু। বাপ মারা গেলে ছেলেরা ভাগাভাগি করে ফেললো, এটা মনে হয় ছোটো ছেলে প্রতাপের। লক্ষ্মীছাড়াটা দোকান রাখতে পারলো না।

দোকানটা সম্বন্ধে ইসমাইল যথেষ্ট ওয়াকিবহাল দেখে কাদেরের আশা হয়, নিলাম সে-ই ডাকতে পারবে কিন্তু ইসমাইল বলে, তা তুমি এসব জিনিস দিয়ে করবে কী? তুমি কি সেন্ট মাখো নাকি আজকাল? প্যাকেট প্যাকেট তেল সাবান মাখবে কী করে?

কাদের কাচুমাচু হয়ে বলে, তা নয়। ধরেন গোলাবাড়ি হাটে আমার দোকানঘরেই একটা সাইডে এই মালগুলি বিক্রির ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?

গ্রামে স্টেশনারি দোকান? কিনবে কে? ইংলিশ ল্যাম্প কেনার মানুষ তোমাদের গ্রামে কোথায়? এর চিমনি খুলতে গেলে ভেঙে ফেলবে, হাতও কেটে ফেলবে।

ল্যাম্প আবদুল কাদের কিনতে চায় নিজের বাড়ির জন্যেই। ইসমাইলের বাড়িতে ঘরে ঘরে এই বাতি জ্বলে। কাচের ডোমের ভেতর আলো হয় কেমন নরম সাদা, একটা জুললে ঘরের চেহারা পাল্টে যায়। টাউনের লোকজন যে জিনভূতকে তেমন আমল দেয় না সে তো এই আলোর জন্যেই। টাইনে সন্ধ্যা লাগতে না লাগতে মিউনিসিপ্যালিটির লোক মই নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাতি জ্বালিয়ে যায়। সিনেমা হলের সামনে জ্বলে ডায়নামোর বিদ্যুৎ, দোকানে দোকানে ঝোলে হ্যাজাক বাতি। এই আলো থাকলে জিন-পরি আসে কী করে? সেদিন হুমায়ুনের ঘরে একটা হ্যাজাক জ্বললে ভাবির চোখের সামনে কাফনের কাপড় জড়ানো ওই মানুষটা কি ঢোকার সাহস পায়?

আলতা দিয়ে কী করবে? বিয়ে টিয়ে করার মতলব নাকি?

আবদুল কাদের মেঝের দিকে চোখ রেখে লাজুক হাসি ছাড়লে ইসমাইল তার বিয়ের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে ফের বলে, আর সিঁদুর? তোমাদের বাড়ির মেয়েরা সিদুর পরে নাকি?

কী যে বলেন। আমরা মোহাম্মদি জামাতের মানুষ, বেদাত শেরেকি কাম কি আমরা করবার পারি?

ইসমাইল হো হো করে হাসে। এই অট্টহাসি আবদুল কাদের বাড়িতে চেষ্টা করেও রপ্ত করতে পারে নি। এসব বোধহয় ওয়ারিশসূত্রে পাওয়া। হাসি থিতিয়ে এলে ইসমাইল বলে, ওইসব মোহাম্মদি আর হানাফির বাহাস তোমাদের আজও গেলো না? মুসলমানদের মধ্যে তোমরা কি কাস্ট সিস্টেম চালু করতে চাও নাকি? এই নিয়ে এখন তার অনেক ঠাট্টা করার কথা, কিন্তু নিলামে আবদুল কাদেরের শৌখিন জিনিসপত্র কেনার হাউসের কথা সে ভোলে না, তা হলে সিঁদুর দিয়ে করবেটা কী? তোমাদের ওই বিলে জিন ভূত একটা কী আছে, তারই পূজা করবে নাকি? ওটা শেরেকি কাজ হলো না? . কালাহার বিল নিয়ে কাদেরই অনেক গল্প করেছে। তার বাপ এটা পত্তন নিয়েছে, এটা তাদের পারিবারিক সম্পত্তি। বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছে বসে মুনসি তাদের বিলের ওপর, বিলের দুই ধারের গিরিরডাঙা-নিজগিরিরডাঙার ওপর নজর রাখছে। মুনসির নেকনজরে আছে বলেই তাদের আয় উন্নতি। বালা মুসিবত থেকে বেঁচেও থাকে। তারা মুনসির হুঁশিয়ার চোখের জন্যে। তাদের বাড়ির শিমুলগাছের সাদা বকের ঝকও তো মুনসির পোষা, তারা তার হুকুমে আকাশে ওড়ে, আবার বিল তদন্ত করে ফিরে আসে তারই ইশারায়। মুনসিকে নিয়ে ইসমাইলের এ রকম ঠাট্টামজাক শুনে কাদের প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতো। আজকাল অস্বস্তি লাগে। আবার কেমন ভয় ভয় করে, ইসমাইলের ওপর মুনসির নিনজর পড়বে না তো?

এই ঠাট্টা করার স্বভাবের জন্যে মুরুব্বি মানুষেরা ইসমাইলের সামনে উসখুস করে, অনেকেই তাকে পছন্দ করে না। আবার গ্রামে গেলে গরিব মানুষের সঙ্গে কি লীগের ওয়ার্কারদের সঙ্গে তার গল্পগুজব অন্যরকম, সেখানে তাকে নিয়ে ঠাট্টাইয়ার্কি করলেও সে মহা খুশি। লোকটার বাকাচোরা কথাবার্তা সহ্য করতে পারলে তার কাছে সাহায্য পাওয়া যায়। পারুক চাই না পারুক, মানুষের জন্যে তদবির করতে ইসমাইল মহা পটু। এই যে মুনসিকে নিয়ে এতো সব খারাপ খারাপ কথা বললো, আবার টিন থেকে সিগ্রেট নিয়ে ধরাতে ধরাতে বলে, কুবের ব্যাংকের ম্যানেজার তো গোপেনবাবু। বাবার বন্ধুর ছেলে। বীরভূমের লোক, আমরা সিউড়িতে থাকতে বাবার সঙ্গে গোপেনদার বাবা নলীনাক্ষ কাকার খুব মেলামেশা ছিলো। চলো তো, গোপেনদাকে বলে দেখি। নিলামের বিট আবার কী? ম্যানেজার যাকে চাইবে তাকেই দিতে পারে।

কিন্তু আবদুল কাদেরকে ইসমাইল সেদিন শামসুদ্দিন ডাক্তারের কাছে শোনা গোপন কথাটি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে। ব্যাপারটা কী?–একটা লোক সম্বন্ধে কাদেরকে একটু খোজখবর নিতে হবে।

জয়পুরের কাছে দিন পনেরো আগে যে দাঙাহাঙামা হলো, তার পরপরই লোকটা পালিয়ে এসেছে। আলি মামুদ খার জমির ধান ভাগাভাগি নিয়ে আধিয়ারদের সঙ্গে জোতদারের লোকদের খুব একচোট হয়ে গেছে। আলি মামুদের ভাগ্নে না ভাস্তে, না-কি ভাগ্নীজামাই না ভাস্তিজামাই, অথবা ভাগ্নে-কাম-জামাই কিংবা ভাস্তে-কাম-জামাই—তার মাথা আধিয়াররা এমন করে ফাটিয়ে দিয়েছে যে লোকটা মরে কি বাঁচে তার ঠিক নাই। আহত লোকটির সঙ্গে আলি মামুদের সম্পর্ক নিয়ে ইসমাইল অনেকক্ষণ ধরে মজা করে। তার ধারণা, জোতদার আর তালুকদার আর জমিদারদের সম্পত্তির ওপর লোভের কোনো সীমা পরিসীমা নাই, সম্পত্তি নিজেদের দখলে রাখার জন্যে এরা বিয়েশাদি দেয় সব নিজেদের মধ্যে। সুতরাং আহত লোকটি যখন আলি মামুদ খার ভাস্তে কিংবা ভাগ্নে, তখন বিয়েও দিয়েছে নিশ্চয়ই নিজের অন্য কোনো ভাস্তি বা ভাগ্নীর সঙ্গেই। এখন চাষাদের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে লোকটা যদি মরে তো আলি মামুদের ভাস্তে কিংবা ভাগ্নেও যায়, আবার জামাইও যায়। একসঙ্গে দুই দুইজন আত্মীয়ের মৃত্যুশোক বেচারা সামলাবে কী করে? শামসুদ্দিন ডাক্তার কি সাদেক উকিল হাজার ক্লিক করেও তখন তাকে উদ্ধার করতে পারবে? না-কি খান বাহাদুরের কাছে এর প্রতিকার তৈরি হয়েই রয়েছে? তবে, ইসমাইল আবার এটাও বলে যে, সম্পত্তি ঠিক থাকলে কোনো সুখ-দুঃখই এদের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না।

তেভাগা যদি একবার হয়েই যায় তো সেই দুঃখে এইসব লোক পটাপট হার্টফেল করবে। এখনি তো টাউনে এলে আর বাড়ি ফিরতে চায় না, আলি আহমদ সাহেবের বাড়িতে ধন্না দিয়ে পড়ে থাকে। এই সাহস নিয়ে এরা করে পলিটিকস?

তেভাগা হলে কাদেরের বাপই কি আর খুশি হবে? আলি মামুদের সুখ-দুঃখ ও বিপদ নিয়ে ইসমাইলের এরকম ঠাট্টায় কাদের সায় দিতে পারে না। আলি মামুদ মানুষটা সুবিধার নয়, সে তো বোঝাই যায়। সেদিন ইসমাইলের বাড়িতে বসে কতো হায় হায় করলো, এদিকে তার ভাড়াটে লোকজন যে আধিয়ারদের সঙ্গে লাগতে গিয়ে বেদম মার খেয়ে ভেগেছে, এটা কিন্তু একবারও বললো না।

তার এলাকার ভালো ভালো ওয়ার্কারদের যে মুসলিম লীগ থেকে বের না করে সে ছাড়বে না। কিন্তু যতোই হোক, মানুষটার এতো বড়ো বিপদ নিয়ে এভাবে কথা ইসমাইল না বললেই পারে।

ইসমাইলকে ঘাটানোও তো কাদেরের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আলি মামুদের লোভ আর ভয় নিয়ে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়। কথার রঙ চড়াতে চড়াতে ইসমাইল তাকে একই সঙ্গে একটি পাকা শয়তান ও আস্ত ভাড় বানিয়ে ছাড়ে। তারপর বাজারের কাছে এসে রিকশায় উঠে তোলে ওই ফেরারি লোকটির কথা।

ঠিক ফেরারি নয়। তবে হাঙামার সময় তাকে দেখা গেছে আধিয়ারদের সঙ্গে। আলি মামুদ খা থানায় ওর নামও দিয়েছে। শামসুদ্দিন ডাক্তার অবশ্য সবই জানে। সেই লোকের বাড়ি পুবের দিকে বাঙালি নদীরও পুবে, যমুনার ধারে কিংবা যমুনার ভেতরের কোনো চরেও হতে পারে। পশ্চিমে খিয়ার এলাকায় সে ধান কাটতে যায় আকালের সময়। ভবঘুরে বাউণ্ডেলে লোকটা নাকি জয়পুর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুরের দিকে তেভাগার নেতাদের পিছে পিছে ঘুরতো আর চাষাদের উস্কানি দিতো। এদিককার থানার পুলিস তাকে ধরার ব্যাপারে তেমন গা করছে না, তবে কেউ যদি ঠিকঠাক খবর পৌঁছে দেয় থানায়, তো তাকে ঠিকই ধরা হবে। শামসুদ্দিন ডাক্তার বললো, বাঙালি নদীর পশ্চিমেই নাকি তাকে কোথায় দেখা গেছে।

আবদুল কাদের অনেক ভেবেও এরকম কোনো লোককে মনে করতে পারে না।

ইসমাইল আরেকটু হদিস দেয়, লোকটা নাকি গান করে। চাষাদের মধ্যে গান। করতো। আলি মামুদ নিজে তাকে গান করতে দেখেছে।

বুড়া মানুষ? এক ফকির ছিলো, চেরাগ আলি। তার বাড়িও পুবের দিকে। যমুনায় তার বাড়িঘর ভেঙে ফেললে আমাদের ওখানে এসে উঠেছিলো। তার নাতনিকে বিয়ে দিয়েছে গিরিরডাঙারই এক মাঝির সঙ্গে। ওই মাঝির ছেলেকে আপনি দেখেছেন। তমিজ, মাঝির আগের পক্ষের ছেলে। তা এ বুড়া ফকির বহুদিন থেকে নিরুদ্দেশ।

আরে না, অল্প বয়েস। আলি মামুদ আমাকে পরশুদিন বললো, একটু খেয়াল রেখো।

খবর পেলে কি পুলিসে ইনফর্ম করবো?

পুলিসে জানাবে? পলাতক চাষা-কাম-গায়ককে নিয়ে ইসমাইল ভবনায় পড়ে। শ্যাওড়াপাড়া সাবগ্রাম থেকে শুরু করে বাঙালি নদী পার হয়ে যমুনার পশ্চিম তীর পর্যন্ত চমৎকার অর্গানাইজ করা গেছে। এদিককার রিপোর্ট পড়ে হাশিম সাহেব সোহরোওয়ার্দি সাহেব খুব খুশি। পুব এলাকায় তেভাগার গোলমাল নাই। এদিকে বড়ো জোতদার কম, প্রচুর জমির মালিক শিমুলতলার তালুকদাররা, তা ওটা হলো ইসমাইলের শ্বশুরবাড়ি। ওদের বিরুদ্ধে যাদের ক্ষোভ আছে তারা সব ইসমাইলের খাস লোক। এদিকে স্কুল অনেক, ছাত্রদের প্রায় সবাই মুসলিম লীগের কাজ করে। যারা রাজশাহী কি কলকাতা কি এই টাউনেই কলেজে পড়াশোনা করে, বাড়ি গিয়ে তারাও পাকিস্তান জিন্দাবাদ করে বেড়ায়। কিন্তু ফেরারি আসামি যদি গ্রামে গ্রামে উস্কানি দিয়ে বেড়ায় তো গোলমাল দানা বাঁধতে কতোক্ষণ? চাষার গো বড়ো ভয়ানক জিনিস। জয়পুর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুরের কর্মীদের কতো বলেছে ইসমাইল, একটু সবুর করা, পাকিস্তান হলেই জোতদারদের আঁটো করা হবে। এ্যাসেমব্লিতে জমিদারি উচ্ছেদের বিলের সঙ্গে তেভাগার বিলও তোলা হবে। মিল্লাত পত্রিকায় এরকম কথা লেখাও হয়েছে। বিল একবার এ্যাক্টে পরিণত হলে জোতদাররা বাপ বাপ করে দুই ভাগ ধান তুলে দেবে আধিয়াদের গোলায়। কোনো আধিয়ারকে উচ্ছেদ করা যাবে না।-নাঃ! কে শোনে কার কথা? আরে এসব কথা তো আর পাবলিক মিটিঙে ঘোষণা করা যায় না। জোতদারদের তো হাতে রাখতে হবে অন্তত ইলেকশন পর্যন্ত তো বটেই। তারপর আইনের মধ্যে দিয়ে তেভাগা প্রতিষ্ঠিত হলে চাষীর অধিকার নষ্ট করে কে?-নাঃ! কে শোনে কার কথা? স্কুল কলেজের ছেলেদের দলে টানা গেছে, কিন্তু চাষারা গোলমাল করতেই লাগলো। কথা শুনতে হয় ইসমাইলকে। নেতারা বোঝে না, এইসব ছোঁড়াদের বাবা বাছা বলে ধরে রাখতে না পারলে এরা সব লাল ঝাণ্ডার দিকে চলে যাবে। তবে একটা কথা।—ইসমাইল ওই ফেরারি লোকটি সম্বন্ধে নতুন করে ভাবে। ওকে হাত করে নিতে পারলে কাজ হয়। এরকম একটা মানুষ থাকলে আধিয়ারদের সবসময় সঙ্গে পাওয়া যায়।

কাদের ফের জিগ্যেস করে, পলাতক মানুষের সন্ধান পেলে সে কী করবে?

আমাকে বলে যেও। চুপ করে বলে যেও। চট করে পুলিসের কাছে না যাওয়াই ভালো।

 ২০. একে এক দুয়ে দুই

একে এক। দুয়ে দুই, দুই দুই। তিনে তিন, তিন তিন। চারে চার, চার চার।

মণ্ডলবাড়ির বাইরের উঠানে বসে ধান মাপে হামিদ সাকিদার। কয়েক হাত তফাতে। শরাফত মণ্ডল বসে রয়েছে ইজি চেয়ারে। আবদুল আজিজ ঘুমে-কাতর চোখজোড়া জোর করে খুলে রেখে নজর রাখছিলো দাঁড়িপাল্লার কাঁটার দিকে, ঘুম তাড়াতে তাকে মাঝে মাঝে উঠে দাড়াতে হচ্ছিলো কাঠের চেয়ার ছেড়ে। এই ধান তোলার সময়টা তাকে ঘন ঘন বাড়ি আসতেই হয়। কিন্তু এতো ছুটি তাকে দেবে কে? শনিবার বিকালে জয়পুরে ট্রেনে চেপে টাউনে নেমে টমটমে বাড়ি আসে রাত সাড়ে নটা দশটার দিকে। কাল মিনিট তিনেকের জন্যে শান্তহারে কানেকটিং ট্রেন মিস করায় বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোররাত হয়ে গিয়েছিলো, ঘণ্টাখানেকের বেশি ঘুমাতে পারে নি। যাক, এইতো কটা দিন। বর্গাদারদের ওপর সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায় না। বাপজান বুড়া মানুষ, তার ওপর আর কতো চাপ দেবে?

দাঁড়িপাল্লার দিকে শরাফতের অতো নজর নাই, হামিদ সাকিদারের ওপর ভরসা করা যায়। শরাফত বেশিরভাগ সময়েই দেখছিলো শিমুলগাছের মাথার দিকে। বকগুলো ভোরবেলায় চলে গিয়েছিলো বিলের ওপর। ছোটো ছোটো আঁকে তাদের অনেকেই ফিরে এসে বসছে নিজেদের পছন্দসই ডালে। তাদের নজর উঠানের ধানের ওপর।

হাতের ভাপা পিঠায় আনমনে কামড় দিতে দিতে বারবার বিলের দিকে চলে যাচ্ছিলো আজিজের বড়ো ছেলে বাবর। শরাফত তাকে কয়েকবার কাছে ডেকে তার হাত ধরে বসিয়েছিলো ইজি চেয়ারের হাতলে। ছেলেটা বসে না, পিছলে পিছলে সরে পড়ে। এমনিতে শান্ত ছেলে, পড়ুয়া ছেলে, একমাত্র ভাইটা মরে যাবার পর কথাবার্তা তার যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ধান মাপার দিকে শরাফত মন দিতে পারে না। চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে আসে। বকের ঝাঁক পালা করে করে ধানের ক্রুপের ওপর দিয়ে ছোট্টো উড়াল দেয়। নিশ্চিন্ত শরাফতের চোখে মৃত নাতির শোকে ও জ্যান্ত নাতির বিষণ্ণতায় বাষ্প জমে ঘন হয়ে।

শিমুলগাছের নিচে বসেছিলো হুরমতুল্লা, আর ছিলো শমশের পরামাণিক, যুধিষ্ঠির কর্মকার। তাদের সবার সামনে মাটির খোরা ভরা দুধপিঠা, তাদের কোঁচড়ে কোঁচড়ে মুড়ি। তমিজ ছিলো হামিদ সাকিদারের গা ঘেঁষে। পিঠা কি মুড়িতে তার মনোযোগ নাই, শরীরের সমস্ত শক্তি দুই চোখে নিযুক্ত করে সে দেখে দাঁড়িপাল্লার ওঠানামা। দেখতে দেখতে ধানের স্থূপ উঁচু হয়ে ওঠে। ২ বিঘা ৭ শতাংশ জমির পাকির ১৮ মণ ১২ সের ধানের দিকে শমশের ও যুধিষ্ঠির তো বটেই, হুরমুতুল্লা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ চোখে। দাঁড়িপাল্লায় তমিজের নজর সেঁটে গেছে জিগার আঠার মতো, সেই নজর ছিড়তে গেলে চোখ দিয়ে তার রক্ত বেরুতে পারে। ফুলজানকে এই সাজানো ধান একবার দেখাতে পারলে হতো।–মাঝির বেটা, মাঝির বেটা বলে রাতদিন খোঁটা দিস, কোনো শালা চাষার বেটা এই পরিমাণ জমিতে এতো ধান ফলাতে পারবে? একবার দেখে যা মাগী, চোখ দুইটা দিয়্যা লয়ন ভরা দেখ।

পিঠা কয়টা খায়া সুস্থির মতো ভাগ করো। হামিদ সাকিদারের প্রতি শরাফতের এই নির্দেশ ছিনিয়ে নেয় তমিজের চোখের অর্ধেক জোর। ধানের এমন সোন্দর পালাটা মনে হচ্ছে কুড়াল দিয়ে টুকরা করে ফেলবে। বেশি লয়, আর একটা দিন কি এই ধানের পালাটা আমান রাখা যায় না? ফুলজানটাকে একবার দেখানো যায়। মণ্ডলের নোকসানটা কী? কাল আবদুল কাদেরের সামনে ভাগাভাগিটা করলে তমিজ একটু বল পায়।কিন্তু এতোগুলো মানুষের সামনে তমিজ কথাগুলো বলে কী করে?

হামিদ সাকিদারের পিঠা খাওয়া শেষ হলে শরাফত জারি করে পরবর্তী আদেশ, ভাগ করার আগে হাল, গোরু, লাঙল, মই আর কামলাপাট,জমির কামলা, হুরমতুল্লার বাড়িত কামকাজের মজুরি—ব্যামাক হিসাব করা লাগে।

হিসাব তো শরাফতের সবই মুখস্থ। তবু হাল, গোরু, লাঙল, মই আর কামলাপাটের কোনটা কতো দিন এবং কীভাবে খাটানো হয়েছে মুখে মুখে সে গুনতে থাকে। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করে এবং হিসাব মোতাবেক কয়েক মণ প্রথমেই আলাদা করে তার নিজের ভাগে রাখতে বলে। হামিদ সাকিদার ফের পাল্লা ধরলে নিংড়ানো বুকে ও চোপসানো মুখে তমিজ মিনমিন করে, হাল, গোরু ইগলানের হিসাব আর এ্যানা কম কর‍্যা ধরলে হয়। আর—

শরাফত সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেয়, তাই সই। তুই আমার লয়া আধিয়ার, খন্দ করলু ভালো। হামিদ, এটি থাকা পাঁচ সের ধান অর ভাগোত দাও। দাও না বাপু, হামি কচ্ছি, দাও।

তমিজ তবু উসখুস করে। তার কালো মুখ লাল হতে হতে বেগুনির ওদিকে আর যেতে পারে না, এই কয়টা ধান দিলে হামাক আর কি দেওয়া হলো কন? আর। কামলাপাটের হিসাব ধরেনঃ কামলা তো আপনে লিজেই নিলেন। না হলে হামরা বাপবেটায় কয় দিনে ব্যামাক ধানই তুল্যা ফেলবার পারি না?

একটা খড় ধরে টানতে টানতে তমিজ আড়চোখে যুধিষ্ঠিরকে দেখে। তার চোখে কোনো ইশারা ছিলো কি-না বোঝা যায় না, থাকলেও কামারের বেটা তাকিয়ে ছিলো অন্যদিকে। তমিজের দিকে এখন শরাফতের চোখ, সেই চোখে খানিক আগের বাষ্পের লেশমাত্র নাই। চোখের তুলনায় গলা অনেক নরম করে সে বলে, লেয্য যা পাস তার চায়া তো অনেক বেশি দিলাম। হিসাব করা দেখিস?

আবদুল আজিজের চোখ থেকে ঘুম তখন একেবারে কেটে গিয়েছে, বাবাকে সে মনে করিয়ে দেয়, বাপজান, পানির বাবদ তো কিছু ধরা লাগে। ওইটা কিছু কলেন না।।

পানির জন্যে ফের কিছু ধান ধার্য করার কথায় তমিজের গলায় কারবালা ঢুকতে শুরু করে, এক গলা কারবালা নিয়ে সে হাঁসফাস করে। আবদুল আজিজ ব্যাপারটা। ব্যাখ্যা করে এইভাবে।কাল্লাহার বিল থেকে নালা কেটে জমিতে পানি দেওয়া হয়েছিলো, নইলে ওই জমিতে এতো ধান হয় কী করে? তো পানির খরচ ধরতে হবে। বিলের মালিককে দাম ধরে দিলে তার অর্ধেক দেবে জোতদার আর অর্ধেক বর্গাচাষী। বিলের মালিক হিসাবে পানির দাম পাবে শরাফত মণ্ডল, আবার জোতদার হিসাবে সে দেবে এর অর্ধেক, বাকি অর্ধেক দেবে তমিজ।

সবাই অবাক হয়ে আজিজের ব্যাখ্যা শোনে। তাদের বিস্ময় মোচনের দায়িত্বও আজিজের।-মোষের দিঘি থেকে নালা কাটার অনুমতি পেলে নায়েববাবুকে তো কিছু ধরে দিতেই হতো। তোমরা নায়েববাবুকে পয়সা দিতে পারো, আর মুসলমান জোতদারকে ন্যায্য পাওনা দিতে তোমাদের বুক টাটায়। এটা কী?

কিন্তু যুধিষ্ঠির বলে ওঠে, বাবু, জলের দামই যদি ধরেন তো হামার কথাটা বিবেচনা করা লাগে। কেন, তার কথা আসে কেন? – আপনের জমিত হামি লিজে জল দিছি কামারপাড়ার খাল থ্যাকা। খাটনি ষোলো আনা হামার, জলও হামাগোরে কামারপাড়ার খালের। সেটার খরচ ধরলে হামার কিছু পাওনা হয় না বাবু?

আবদুল আজিজের এই পানির ব্যাপারটা ভোলা শরাফত অনুমোদন করতে পারে।। মাঝিদের সামনে কাৎলাহার বিল নিয়ে এতো কথা ওঠাবার দরকার কী? তা এখন তো আর কিছু হটার জো নাই। হালটা ধরতে হয় শরাফতকেই। প্রথমে সামলাতে হবে যুধিষ্ঠিরকে, কামারপাড়ার খাল গেছে ওই জমির পাঁজরা দিয়া। খালের মধ্যে সেঁউতি ড়ুবালু আর জমিত পানি সেঁচলু, লয়? এর মধ্যে খাটনি কিসের? খাল কি তোর একলার? খালের দুই পাশের ছয় আনি সাড়ে ছয় আনি জমি তো হামার। পয়সা ধরার কথা আর কস না, ধরলে তোরই নোকসান।

আজিজ কিন্তু ওই খালের পানি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের আর্জি বিবেচনা করার পক্ষে। সরকারি কর্মচারীদের কাছে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। বৃটিশ রাজত্বে সূর্য যেমন অস্ত যায় না, তেমনি সেই সূর্যের কিরণ যাতে সব জায়গায় সমানভাবে পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখাও বৃটিশ সরক র বাহাদুরের পবিত্র দায়িত্ব। এরকম একটি জুতের উপমা প্রয়োগ করে তৃপ্তি পেয়ে আজিজ যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস দেয়, হিসাবনিকাশ করে। তার যদি প্রাপ্য বেয়োয় তো তাকে কড়ায়গায় বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু আবদুল আজিজের এসব হাকিম কিসিমের কথাবার্তা তমিজের কানে ঢোকে কি-না সন্দেহ। সে বলে, নালা কাটনু তো হামি একলা। একদিন খালি কোদাল ধরিছিলো বুলুর বেটা। হামি কনু, তুই চ্যাংড়া মানুষ, পারবু না। হামি একলাই তো কাটনু। পানির দাম কী কচ্ছেন হামি বুঝিচ্ছি না।

বুলুক তো হামি নিয়োগ করনু। বুলু ওই কয়টা দিন হামার গোরুবাছুর দেখলো না। এখন তুই তাক দিয়া কি করিছু তুই জানিস। বলে আর শরাফত তার বাম্প-শুকিয়ে যাওয়া চোখ মোছে। করকর-করা চোখ নিয়েই সে বলে, তমিজ, তুই বেশি কথা কস। তখন হাতেপায়ে ধরলু, তোক জমি দিলাম। বর্গা করা তোর আরম্ভ হলো। লে, আরো কর। হাল কর, গোরু কর, লিজের হালগোরু লিয়া জমিত নাম। তোেক মানা করিছে কেটা? এংকা ক্যাচাল করিস না বাপু।

হালগোরুর কথায় তমিজ চুপসে যায়, শরাফত হুমকি দিচ্ছে। ওই জমিতে পেঁয়াজ রসুনের আবাদ করার সুযোগ হারাবার ভয়ে সে চুপ করে থাকে।

অর উকিল আজ গরহাজির, কথা না কয়া আসামির আর উপায় আছে? আবদুল আজিজ তমিজের দিকে কাদেরের পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত করলে তমিজের রাগ হয় কাদেরের ওপর। কাদের আজ বেরিয়ে গেছে খুব ভোরে, সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। আজ কি তার টাউনে না গেলেই হতো না।

পানি বাবদ আরো কিছু ধান মণ্ডলের ভাগে সরে গেলে নিজের ধান বস্তায় ভরতে তমিজের হাত আর সরে না। আজিজ এবার মনোযোগ দেবে অন্য বর্গাদারের ধান নিয়ে কেবল এসেছে যে গোরুর গাড়িটি সেই দিকে। আফজাল গাড়িয়াল বস্তা নামাচ্ছে তার গাড়ি থেকে। তমিজের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চায়, গাড়ি লাগবি? চলো দিয়া। আসি। তমিজ বলে, এইকোনা ধান। তার আবার গাড়ি লাগবি? তমিজ ভারের ওপর তার ধানের বস্তা সাজায়।

আফজাল গাড়ি থেকে ধান নামানো শেষ করে শিমুলগাছের তলায় বসলে আবদুল ক আজিজ যুধিষ্ঠিরকে বলে, পৌষ মাস গেলো না, তুই আসিছিস ধান কর্জ লিবার। সোমাচারটা কী বাপু?

আপনাগোরে জমি বর্গা করা ধান যা পানু তাত তো দুই মাসের খোরাক হবি না। বাবা কচ্ছে, কয় মণ ধান কর্জ লিয়া আয়, জষ্টি মাসত পদুমশহরে লিশানের মেলার পরে।

হয় লগদ টাকা দিয়া শোধ করমু।

বুঝিছি। আবদুল আজিজের সঙ্গে আর সবাই বোঝে। নিশানের মেলায় লাঙলের ফলা, কোদাল, কুড়াল, কাস্তে, বঁটি এসব খুব ওঠে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে চাষীরা আসে। করতোয়ার পুব থেকে যমুনার পশ্চিম পর্যন্ত কর্মকারদের থোক রোজগার হয় ওই মেলাতেই। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের কথায় শরাফত আমল দেয় না, যে ধান পাছু তাই আগে খায়া শ্যাষ কর। পরে আসিস।

না বাবু। ধান হামার এখনি দরকার। ধান নেওয়ার কারণ গোপন করতে যুধিষ্ঠির হিমসিম খায়, বাবার হাঁপরের মাল কেনা লাগবি।

খোয়াবনামা মিছা কথা কস কিসক? গণেশ কর্মকারের জমির বায়না দিবু, তোর তো মেলা পয়সার দরকার। ধরা পড়ে গিয়ে যুধিষ্ঠির চুপ করে থাকে। আবদুল আজিজ তাকে পরামর্শ দেয়, জগদীশের কাছে যাস না কিসক? তোর জাতের মানুষ, যায়াই দেখ।

যুধিষ্ঠির জিভ কাটে, কি যে কন বাবু, উনিরা কতো বড়ো জাত। হামরা এক জাতের মানুষ হই ক্যাংকা করা?

শাল সাহা হলো বড়ো জাতের মানুষ? আর আমরা আর তোরা একই জাতের পয়দা? কী কস? শুনে যুধিষ্ঠির দ্বিতীয়বার জিভ কাটে, কী যে কন? কী যে কন? কিন্তু তার মুখে আর কিছু আসে না। তাকে আর জেরার মধ্যে না ফেলে শরাফত বলে, কয়দিন বাদে আয় বাবা। হামার ধান সব আসুক। যুধিষ্ঠির তমিজের পিছে পিছে চলে গেলে শরাফত আজিজকে আস্তে করে ধমকায়, অতো জগদীশ জগদীশ করো কিসক? ট্যাকাটা হাতোত পালেই যুধিষ্ঠির গণেশ কর্মকারের জমি বায়না দিবি, বোঝো না? কয়টা দিন এটি ঘুরুক, গণেশ লিজেই হামার কাছে হাজির হবি।

ওদিকে বাড়ির খুলিতে ভার নামিয়ে তমিজ কাঁধের বাকটা বেড়ার সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখতে না রাখতে ছুটে আসে কুলসুম। নিজেদের ধান ঘরে এলে কী করতে হয় বুঝতে পেরে সে দুই হাতই ঢুকিয়ে দেয় ধানের বস্তার ভেতরে, ধান তোমার কি সোন্দর হছে গো। এই ধানেত বছরের খোরাক হয়াও আরো থাকবি। এই ধানের বরকত আছে। গো।—কুলসুম প্রলাপ বকার মতো অবিরাম বলেই চলে। তমিজ তখন মাটিতে বসে পড়েছে হাঁটু ভেঙে, ডোবার ওপারে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে যুধিষ্ঠির। কিছুক্ষণ কুলসুমের প্রলাপ শুনে তমিজ বলে, লাও, হছে। ভার আর ছালা আজাড় করা দাও। ধান লিয়া আসি।

বস্তা খালি করে ভারে রেখে কুলসুম এসে দাঁড়ায় তমিজের পাশে। শীতের দুপুরে তার ঘাড় ঘামে ভিজে গেছে। বাক বয়ে বয়ে তার ঘাড়ের ওপরে খানিকটা জায়গা একটু শক্ত, সেখানেও ঘামের বুদবুদ। কুলসুম তার শাড়ির আঁচলে তমিজের ঘাড় মুছতে মুছতে বলে, খুব ঘামিছো গো। খানিকক্ষণ জিরাও।

তমিজের বাপ ঘর থেকে বেরিয়েই বেড়া থেকে বাঁক ও মাটি থেকে ভার তুলে নিয়ে রওয়ানা হয় মণ্ডলবাড়ির দিকে, বলে, তুই জিরায়া লে। হামি না হয় কয় ভার লিয়া আসি।

কুলসুমের শাড়ির আঁচল ফিরে আসে তার নিজের হাতে, তমিজ সটান উঠে দাঁড়ায়। মণ্ডলবাড়িতে তমিজের ধানের পরিমাণ দেখে তার বাপের মেজাজটা আবার বিগড়ে যাবে, মণ্ডলকে কী বলতে ফের কী বলে ফেলবে, তার ঠিক নাই। শরাফত কি আজিজ যদি রেগে যায় তো জমিটা এবার তমিজ পাবে না। না, বাপকে যেতে না দেওয়াই ভালো। পা চালিয়ে ডোবার ওপারে গিয়ে তমিজ বাপকে ধরে ফেলে। বুড়া এতো জোরে জোরে পা ফেলছিলো কি ধানের খুশিতে? না-কি কারো ওপর জেদ করে? তমিজ আরো বেশি জেদ করে, তুমি ইগলান ধান ব্যামাক খুলির মধ্যে মেল্যা দাও। আর একটা গুদ দেওয়া লাগবি। বাকি ধান হামি লিয়া আসিচ্ছি। যুধিষ্ঠির আছে হামার সাথে।

শেষ কয়েক ভারে আসে খড়। যুধিষ্ঠির আর শমশেরও কয়েকবার বাঁক কাঁধে নিয়েছিলো। এই করতে করতে শীতের দুপুর একেবারে শেষ হয়ে আসে। তিন জনে ডোবায় নেমে গোসল করে হি হি করে কাঁপে। অল্প পানিতে ভালো করে গোসল হলো, মাঝখান থেকে হাত পা সব জমে যায় ঠাণ্ডায়। গতরে হিমের কামড়ে কাঁপতেও ওদের মহা আমোদ, ওরা চলে গেলেও আমোদর রেশ থেকেই যায়। এই ছোটো অনিয়মটাকেই ধান তোলার উৎসব গণ্য করে তমিজের বাপ কিছুক্ষণ গুড়ুর গুড়ুর করে হুঁকা টেনে ওটা রেখে দেয় ছেলের পেছনে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ধান তো কিছুই দেয় নাই মণ্ডল। ধান কাটনু, তখন মনে হলো—

গোরু বেচ্যা দিছো, নাঙল হাল কিছুই তো ঘরত থোও নাই। ধান আর পাবা কতো? তমিজ রাগ করে প্রথমে বাপের ওপর, পরে কুলসুমকেও শাসায়, ও ফকিরের বেটি, আগে গোরু কেনা লাগবি, হাল নাঙল ইগলান করার পরে খাওয়া দাওয়া, বুঝিছো?

কী সোন্দর বাসনা গো তোমার ধানের। বুক ভরে ধানের গন্ধ নেয় কুলসুম, তামান ঘর, খুলি, আইঙনা ধানের বাসনাত ভুরভুর করিচ্ছে গো। পাগারের গোন্দ কুটি পলাছে দিশা পায় নাই।

ধানের সৌরভে ডোবার দুর্গন্ধ পালিয়ে গেছে এই তথ্যে কিছুমাত্র বিহ্বল না হয়ে তমিজের বাপ খেকিয়ে ওঠে, খালি বাসনা শুকলেই হবি? এই চাউলের ভাত লিত্যি খাওয়া যায়? এই ধান বেচা আউশ কেনা লাগবি।

এদের কারো কথাই গ্রাহ্য করে না তমিজ, ধান লয়, ধান লয়। ধান কেনা হবি। এই ধান সেদ্ধ করা চাউল বেচ্যা দিয়া আসমু গোকুলের হাটত, বুঝিছো? কিন্তু বাপ কি সত্য কারো গায়েই তার কথাগুলো লাগলো না দেখে তমিজ ফের বলে, খালি খাওয়ার চিন্তা! ফকিরের বেটি, জিভখানা এ্যানা খাটো করো গো, খাটো করো! চাউল হামি এক হাটোত বেচমু, আবার ওই দিনই পাঁচ কোশ উত্তরে দশটিকার গোরুর হাটত যায়া গোরু লিয়া আসমু।

ধানের খুশিতে কুলসুম খিলখিল করে হাসে, তোমার জিভখান এখন থামাও তো বাপু।

তার বাক্য মেনে তমিজ চুপ করে। ওখানে বসেই গোয়ালঘর করার একটা জায়গা খোজে। আকালের আগে যেখানে গোরু থাকতো সেখানে এখন তমিজের ঘর। ওই ঘরের উত্তর পশ্চিমে একটুখানি জায়গায় ছোটো একটা একচালা করে দিলেই দুটো গোরু থাকতে পারে। দুটো গোরু, হাল, লাঙল, জোয়াল, মই,—সবই সে করে ফেলবে সামনের খন্দ তোলার পরেই। তার বাপের খোরাকটা বড়ো বেশি। কুলসুমটাও বেশি। খলবল করে—এই যে পঁচসেরি ধামায় ধান নিয়ে কালাম চাচার টেকিত যাই। আজই তোমাগোরে পিঠা খাওয়ামু। ধান ঘরত তুল্যাই পিঠা খির না হলে ওই ধান বরকত দিবি

গো। বলতে বলতে সে চলে যায় চেঁকির আওয়াজ মুখরিত কালাম মাঝির বাড়ির দিকে। তার খিলখিল হাসির কুচি পড়ে থাকে সারা বাড়ি জুড়ে, সেই আওয়াজে মিশেল ছিলো জোড়া গোরুর মিষ্টি নিশ্বাস। আর ছিলো ধানের পালার চূড়ায় আরো ধান রাখার ঝরঝর ঝরঝর আওয়াজ।-আবদুল কাদেরকে বলে মণ্ডলের কাছ থেকে আরো কিছু ধান নেওয়া যায় না? বিলের পানি বাবদ ধান কেটে নেওয়ার ইচ্ছা শরাফতের তো ছিলোই না। বড়ো বেটার কথায় মেনে নিয়েছে। এখন কাদের যদি বাপকে ভালো করে বোঝায় তো মণ্ডল কি তার কথা শুনবে না? সন্ধ্যা তো হয়েই এসেছে, গোলাবাড়ি গেলে।

এখন কাদেরকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

ক্যা গো, আজ না হাটবার। যাই দেখি, মাছ টাছ কিছু পাই যদি। তমিজের হাঁকে সাড়া দেবে কে? কুলসুম তো এখন কালাম মাঝির বাড়িতে। তমিজ নিজেই ঘরে ঢুকে মাছের খলুই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফের ঘরে ঢুকে সর্ষের তেলের শিশিটা ঝুলিয়ে নিলো আঙুলের মাথায়।

গোলাবাড়ি হাটের কাছাকাছি পৌঁছুলে বোঝা যায, হাট এখন ভাঙার পথে। সন্ধ্যা নামছে গাঢ় হয়ে। হাটুরেরা সব বাড়ি ফিরে যাচ্ছে; তাদের বেশিরভাগের হাতে একটা ঝোলা কি মাছের খলুই। আরেক হাতে ঝোলানো তেলের শিশি। কারো শিশি দুটো, একটায় সর্ষের তেল, আরেকটায় কেরোসিন। তারা সব মাছের দাম নিয়ে চালের দর। নিয়ে আলাপ করে। সামনে যে হাটুরেকেই পায় তমিজ তাকেই চালের দর জিগ্যেস করে, শুনে বলে, চালের দর মনে হয় এবার আর উঠবি না। নোকসান হবি। গলায় সে। জোতদারদের মতো এক ধরনের হতাশা তৈরির চেষ্টা করে।

কাদেরের দোকানে হ্যাজাক জ্বলছে, তার মানে এখনো মেলা মানুষ আছে। ভেতরটা লোকে ভর্তি। ক্যাশবাকসের পাশে নতুন একটা বড়ো জলচৌকি, একটু উঁচু এই জলচৌকিতে সাজানো আয়না, চিরুনি, কাঁকই, আলতা, সিঁদুর কৌটা, পাউডার। আরো অনেক কিছু আছে, তমিজ ওগুলো চেনে না। জলচৌকির পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে গফুর কলু। এখন বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেছে। তা হলে ওই শালা কলুর বেটা ওখানে। করে কী? সে বোধহয় জিনিসপত্র পাহারা দিচ্ছে। কর শালা চৌকিদারের কামই কর। টাউনে এইসবের দোকান তমিজ কয়েকটা দেখেছে, তবে ওখানে যারা বিক্রিবাটার কাজ করে তারা কি আর কলুর বেটার মতো লুঙি পরে নাকি? ধুতিপরা সেসব মানুষের চেহারা আলাদা। তবে কেরোসিনের সঙ্গে এখানে হালকা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, এই গন্ধ টাউনের ওই দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় সে পেয়েছে।

ঘরের মানুষগুলির মধ্যে খদ্দের কেউ নাই, এরা সব কাদেরের পাট্টির মানুষ। কয়েকটা ছেলেকে কাদের বোঝাচ্ছে, তোমরা সবাইকে বলবো, মোসলমানের মধ্যে তো চাষাই বেশি। অবস্থা ভালো আর কয় জনের? মোসলমানের দল চাষার স্বার্থ না দেখলে আর কে দেখবে? বুঝিছো? এটা তো ঠিক কথাই যে, হক সাহেব খুব বড়ো নেতা। মোসলমান একদিন একবাক্যে তাকে ইমাম মানিছে, তার কথায় ওঠাবসা করিছে। কিন্তু তিনি তো গেলেন হিন্দু মহাসভার সাথে। যে হিন্দু মোসলমানের হাতে পানি খায় না, মোসলমান দেখলে ঘিননা করে, দেখো না নায়েববাবু বুড়া বুড়া মুরুব্বি মানুষের সাথে। তুই তোকারি করে কথা কয়, সেই হিন্দু জাতের সাথে হাত মেলালে হক সাহেবকে নেতা মানি কীভাবে? ভালো করা বুঝায়া কবা, বুঝিছো?

রানীরপাড়া স্কুলের একটি ছেলে কী জিগ্যেস করলে কাদের কয়েক পলকের জন্যে চুপ করে কী একটা ভেবে নেয়। তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করে, আরে গরিবের জন্যেই তো পাকিস্তান দাবি করা হচ্ছে, এটা বোঝাবার পারো না? পাকিস্তানে ধনীরা জাকাত ফান্ডে টাকা না দিলে পুলিস ওই ধনী লোককে এ্যারেস্ট করবে। আইন পাস হবে। গরিব না খেয়ে থাকবে না, জাকাতের টাকায় হক থাকবে গরিবের।

জাকাতের কথা ওঠে কেন বাপু? চাষাক ভিক্ষা দেওয়ার কথা ওঠে কেন? চাষার পাওনাটা দিয়া দিলেই তো মিট্যা যায়। চাষার যা খাটনি, আদ্দেক ফসলে তার পোষায়, তুমিই কও তো বাপু?

পেছনের বেঞ্চ থেকে আলিম মাস্টারকে হঠাৎ কথা বলতে দেখে কাদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়, আরে মাস্টার সাহেব, আসেন, এখানে আসেন। আপনে চ্যাংড়াপ্যাংড়ার সাথে পেছনে বসিছেন কেন? আলিম মাস্টার সামনে গিয়ে আরেকটি বেঞ্চে বসে বলে, বাবাজি, আমার কথাটার জবাব দিলা না? গরিবের দেশ হলে জাকাতের দরকার কী?

না। মানে, দুই চারটা বড়োলোক যারা আছে তাদের টাকা আদায় করা গরিব মানুষের মধ্যে দেওয়া হবে। পাকিস্তান হলে চাষার হক আদায় করার আইন পাস হবে। জমিদারি প্রথা উঠায়া দেওয়া হবে। তাহলে জমির মালিক হবে কে? আপনি বলেন।

মোসলমান জোতদাররাই তখন জমিদারের কামগুলান করবি। চাষার লাভ কী?

কী যে কন? তেভাগা পাস হলেই চাষার হক কায়েম হয়। কিন্তু মাস্টারের জবাব এখনো দেওয়া হয় নি বুঝতে পেরে কাদের নতুন প্রসঙ্গ তোলে, দাঁড়ান, একটা বই দেই। আপনাকে। দেখেন, প্রাইমারি শিক্ষা ফ্রি করা হবে, কম্পালসারি ফ্রি এড়ুকেশন। তাতে তো লাভ চাষীদের, না কী?

বুঝলাম। কম্পালসারি করো, আর ফ্রি করো, আধিয়ার চাষা কোনোদিন বেটাক ইস্কুলে দিবার পারবি না। চাষার উপযুক্ত হিস্যা দাও, তার অবস্থা ভালো হলে পয়সা খরচ করা ইস্কুলে ভর্তি করা দিবি। এই ন্যায্য হিস্যার কথা তুললে জোতদাররা পুলিস ডাকে, এটা কেমন কথা বাপু?

কাদেরের সন্দেহ হয়, এই আলিম মাস্টার লোকটা কোন পক্ষের মানুষ একটু গম্ভীর হয়ে সে বলে, মাস্টার সাহেব, খিয়ার এলাকায় আধিয়াররা যা করতিছে, তাতে মোসলমানের একতা নষ্ট হচ্ছে না?

কিন্তু জোতদার তো মোসলমান কম নাই। মোসলমান চাষা হিস্যা চাইলে তারা পুলিস ডাকে কিসক?।

এবার কাদের চূড়ান্ত সমাধানের কথার পুনরাবৃত্তি করে, পাকিস্তান হোক, চাষার হিস্যা খোললা আনাই পাওয়া যাবি। এখন গোলমাল করলে সবারই লোকসান।

এই তর্কের যেটুকু তমিজ বুঝেছে তাতেই সে বেশ উত্তেজিত। এইবার কাদেরকে বলে তার বাপের কাছ থেকে মণখানেক ধানও যদি নেওয়া যায়। উত্তেজনায় ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল। এদিকে কাদেরের দোকান থেকে ছেলেপিলে কখন যে চলে যাবে তারও ঠিক নাই। বাইরে বেরিয়ে দেখে, কালাম মাঝির দোকানে কুপি জ্বলছে। কালাম কয়েকদিন বাড়িতেই ধান তোলা নিয়ে ব্যস্ত, দোকানে বসেছে লালু, কালাম মাঝির সম্পর্কে ভাস্তে। মাছ তো আজ কেনাই হলো না। লালুর কাছ থেকে সর্ষের তেল আর বুটের ডাল নেওয়া যায়। বুটের ডাল অনেক দিন খাওয়া হয় না। কুলসুম চিতই পিঠা করলে বুটের ডাল দিয়ে খাওয়া যাবে। কিন্তু কালাম মাঝির দোকানে পৌঁছুবার আগেই ডাক দেয় বৈকুণ্ঠ।

বটতলায় বাঁধানো চাতালে একটা কুপি জ্বলছে, পাশে একটা নকুলদানার ডালা। নকুলদানাওয়ালা বোধহয় ডালাটা বৈকুণ্ঠের হেফাজতে রেখে কোথায় গিয়েছে; কিন্তু এ যেভাবে একটু একটু করে মুখে তুলছে তাতে লোকটা ফিরে এসে শুধু ডালাটাই পাবে।। আর খায়ো না বলে ডালার দিকে একটু এগোতে তমিজের মাথা টলে যায় : এ কী? চেরাগ আলি? কুয়াশা ও অন্ধকারে লোকটার কালো মুখ লম্বাটে হয়ে মিশে গেছে আরো ঘন অন্ধকারে, তার বাবরি চুলও হাটের অন্ধকার এই জায়গাটির অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তমিজের সামনে অন্ধকার দোলে, কয়েকটা দোকান পরে মুকুন্দ সাহার আড়ত, আড়তের মশলার গন্ধ বটতলার কুপির আলো উস্কে দেয়, সেই কালো আলোতে ভর করে বটতলা সরে যায় অনেক দিন আগে এবং এই অন্ধকার লোকটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গলা মেলায় কালো ছিপছিপে একটি বালিকা। কালো আলোয় এর হাতের দোতারা দেখা যাচ্ছে না, সেটা কি সে লুকিয়ে রেখেছে তার মস্ত লালকালো তালি দেওয়া আলখাল্লার ভেতরে? তার হাতের সেই লোহার লাঠিটা তবে কোথায়? গান করার ফাঁকে ফাঁকে চেরাগ আলি ফকির হঠাৎ হঠাৎ করে থেমে দম নিচ্ছিলো আর তখন ওই কথাগুলো গাইছিলো ওই কালো মেয়েটি, খোয়াবে কান্দিল বেটা না থাকে উদ্দিশ। গাইতে দিয়ে চেরাগ আলির মুখের হাঁ খুব বড়ো হয়ে গেলে তমিজ হেসে কুটি কুটি হচ্ছিলো, কে যেন তাকে ধমকে দেয়। কে সে? তবে রাগে ও কষ্টে ছলছল চোখ করে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েছিলো, সেটা কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। অনেক বছর উজিয়ে সেই মেয়েটিকে নিয়ে চেরাগ আলি কি ফের প্রথম থেকে হাজির হলো এখানে?

তোর বাপ কুটি রে? বৈকুণ্ঠ গিরি জিগ্যেস করলেও আন্ধারে ওই ছবি চট করে। নিভে যায় না। তবে তার রঙ ফিকে হয়ে আসে। হামি কনু, তমিজের বাপ হাটোত আসেই না আজকাল। তাইও একরকমের ফকিরই হয়া গেছে এখন। মানষে কয়, তমিজের বাপে ঘরত বস্যা খালি টোপ পাড়ে আর রাত হলে নিন্দের মধ্যে পাকুড়তলা যায়া ঘোরে। মানষে তো আসল কথা জানে না। বৈকুণ্ঠ অবিরাম কথা বলে, ক্যারে তমিজ, চিনিস? চেরাগ আলির পরিচয় দেয়, চিনিস না, না? চেরাগ আলি ফকিরের শিষ্য আছিলো, সাগরেদ, সাগরেদ। এটিকার মানুষ লয়। ফকিরের সাথে চেনা আছিলো অনেক আগে, কিন্তু মেলামেশা হছে খিয়ারেত গেলে। লয় ফকির?

লোকটা যে চেরাগ আলি ফকির নয় বোঝার সঙ্গে সঙ্গে চেরাগ আলি এবং ছিপছিপে বালিকা তমিজের সামনে থেকে মুছে যায় এবং ওই সাথে উড়াল দেয় সেই অনেক আগেকার মেঘলা বিকালবেলাটিও। বৈকুণ্ঠ এলোমেলোভাবে তার সম্বন্ধে অনেক কথা বলে। চেরাগ আলি নাকি লোকটিকে বলে দিয়েছে, সে যেন গিরিরডাঙা গ্রামে গিয়ে তার নাতনি আর নাতজামাইয়ের সঙ্গে দেখা করে। তমিজের বাপকে সে অনেক গোপন কথা বলবে, সেসব তত্ত্বকথা, এখানে কি সেই কথা বলা যায়?

তমিজ জিগ্যেস করে, আপনের বাড়ি?

বাড়ি আমার পুবে। তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বৈকুণ্ঠই তার পরিচয় দেয়। আকালের সময় এই কাছেই, নিজগিরিরডাঙা গ্রামে তার বৌবাচ্চা রেখে সে চলে যায় খিয়ারে। তার হলো গান গাওয়ার নেশা। খিয়ারের মানুষের মধ্যে তার গান খুব চলে, টাউনেও তার গানের চাহিদা খুব। এখন শুধু গানই করে বেড়ায়।

তমিজের সন্দেহ হয়, এই হলো ফুলজানের হারিয়ে-যাওয়া স্বামী। এখন তমিজের সামনে এই অন্ধকারে কুপির আলো থেকে হলদে জ্যোৎস্না ঝরতে শুরু করে। সেই জ্যোৎস্নায় ড়ুবুড়ুবু ধানখেতের পাশে সরু আল, সরু আলের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা জমাট-বাঁধা জ্যোৎস্নাকে ছুঁতে গেলে সে সরে যায় মোষের দিঘির ওদিকে, তমিজ তাকে ধরতে সেদিকে যেতেই সেই জুমাননা জ্যোৎস্না উড়াল দেয় মোষের দিঘির ওপর, দিঘির গোলাপি পানির আভায় তার কালো মুখের ছায়া। কালো ছায়ায় চিবুকের নিচে ঘ্যাগের আবছা আকার নিয়ে ছোট্টো একটি বিন্দুতে ঢুকে পড়ে সে মিশে যায় কুয়াশার খাপের ভেতর। আর আকাশ জুড়ে ওড়ে তমিজেরই দেওয়া রেড ক্রসের র‍্যাপার। কেরামত আলির গায়ের চাদর কি ওটাই নাকি? তমিজ বারবার তাকে দেখে। এতে লোকটা একটু উসখুস করে। হয়তো অস্বস্তি কাটাতেই সে বলে, তোমার নাম তমিজ? তোমার বাপের সাথে মেলা কথা ছিলো গো। ফকিরের বেটিকও অনেক কথা কওয়ার আছে। কাল পরশু তোমাদের বাড়ি যাবো।

লিচ্চয়। হামার সাথে যাবা। ঘাটা চিনায় লিয়া যামু। বৈকুণ্ঠ তার সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব করেই অনুরোধ করে, ওই গানটা আর একবার গাও তো। তোমার গলাখান বড়ো মিঠা।

এর মধ্যে ১৫/১৬ বছরের একটি ছেলে এসে তার নকুলদানার ডালা তুলে নেয়, বলে, ও বৈকুণ্ঠদা, তুমি ব্যামাক খায়া ফালাছো গো। পয়সা দিবা না?

বৈকুণ্ঠের হাতে তখনো কয়েকটা নকুলদানা। ছেলেটিকে সে ধমক দেয়, আরে ফকির মানুষ তোর নকুলদানা খাছে, তোর ভাগ্য। দে তো তমিজ, চারটা পয়সা দে তো এই ছোঁড়াক।

কেরামত একটা দুয়ানি ছেলেটির হাতে দিলে বৈকুণ্ঠ একটুখানি ক্ষোভ জানায়, আরে, জগদ্বন্ধুর বেটা, তোর বাপ কতো মানষেক বাদাম খিলাছে মাগনে, আর তুই আজ পয়সা লিলু ফকির মানষের কাছ থ্যাকা?

আমরা ফকির নই। কেরামত আলি প্রতিবাদ করে, ফকির হওয়া কি মুখের কথা? আমরা গান বান্দি, শায়েরি করি। গান লিখি, গান ছাপায়া বেচি। আমরা ফকির নই। এই কথা থেকে তার বিনয় বা অহংকার বোঝা কঠিন।

ওই তো হলো। বলে বৈকুণ্ঠ কেরামত আলির হাত ধরে টানে, চলো, ওই ঘরত চলো। ওটি লিত্যি সভা হয়। মেলা মানুষ পাবা। একটা গান করা যাও।

কাদেরের ঘরের আলোচনাকে অগ্রাহ্য করে দরজায় দাঁড়িয়ে বৈকুণ্ঠ হাঁক দেয়, ও দাদা, দেখো। কোন মানষেক ধরা লিয়া আসিছি, দেখো। গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তার মাঝখানে এরকম উটকো কথায় কাদের বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকালে সে ফের প্রায় চেঁচিয়েই বলে, দাদা, হামাগারে লিজগিরিরডাঙার জামাই গো। তারপর কেরামতের। দিকে মুখ ফিরিয়ে সে একই স্বরে জানতে চায়, ও, সেই বৌয়ের সাথে তোমার তালাক হয়া গেছে না? তোমাগোরে জাতেত তো আবার মুখের কথাতই তালাক, মুখের কথাই লিকা।

জাত তোলায় লীগের কর্মীদের রাগ করার কথা। কিন্তু কাদের ভায়ের কাছে এই লোকটার সাত খুন মাফ। তবে বিরক্ত হয়েছে সবাই। বৈকুণ্ঠ তার শ্বশুরবাড়ির কথা বলায় কেরামত আলিও ভুরু কোঁচকায়। সে নিজেই এবার সবার কাছে নিজের পরিচয় নিবেদন করে, জে, আমার নাম কেরামত আলি, নিবাস পুবে, যমুনার পশ্চিমে, গায়ের নাম আতামারি!

কে যেন বলে, আতামারি? চরের মানুষ?

জে না। আমরা কায়েমি জায়গার মানুষ ছিলাম। আকালের সময় আমাদের এলাকার মানুষ সব মরলো, দশ আনা মানুষই শ্যাষ হলো। আকালে মানুষ খালো তো। ফাঁকা গাঁওখান গিললো যমুনা। আমাকে চরুয়া বলে হেলা করবেন না। মান্যজনের নিকট এই আমার নিবেদন।

তার হাত জোড় করে কথা বলা দেখে সবাই হাসে। সবচেয়ে বেশি হাসে বৈকুণ্ঠ, কেরামত আলির যাবতীয় কৃতিত্বে সে গর্বিত। বলে, যি সি মানুষ লয়, ফকির চেরাগ আলির সাগরেদ। নামেই চেনা যায়, গুরুর নাম চেরাগ আলি, শিষ্য হলো কেরামত আলি। শিষ্য এখন লিজেই ফকির হয়া দ্যাশ জুড়া গান কর‍্যা বেড়ায়।

জে না। আমরা ফকির নই। ফকিরি গান করি না। আমরা গান বান্দি, নিজে গান বান্দি, নিজে গান লেখি, হাটে হাটে গান করি, গানের বই বেচি।

কাদের বলে, গান লেখো? বাঃ গানের বই আছে তোমার?

জে। চারখান বই আমার বাজারে চালু। তবে উপস্থিত নাই, বই তো মজুত রাখবার পারি না। পাইকাররা একেক হাটে পঞ্চাশ ষাটখান বই লিয়া যায়। আপনাদের বাপমায়ের দোয়ায় আর তেনার রহমতে বই আমার পড়ে থাকে না।

ভালো ভালো। কাদের এই কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চায়, ভালো। কাল বিকালে আসো তোমার গান শোনা হবে। ভালো হলে পাকিস্তানের দাবি লিয়া একটা গান লেখায়া নেবো। দেখি ইসমাইল সাহেবকে দিয়ে তোমার গান তেমন হলে নাহয় ছাপাবার বন্দোবস্ত করা যাবে।

আলিমুদ্দিন মাস্টার অনুরোধ করে, এখন একটা গান শোনাও তো দেখি।

আলিম মাস্টারের এই নির্দেশ কাদেরের কাছে অনধিকারচর্চা মনে হলেও তার পক্ষে প্রতিবাদ করাও মুশকিল। লোকটিকে তার পছন্দ হলেও নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে তাকে জোরে হুকুম দিতে হয়, কও। দুই লাইন শুনি।

বৈকুণ্ঠ উৎসাহ দেয়, গাও, ওইটা গাও। হামাক শোনালা না? ওইটা গাও।

কেরামত আলি চাঁদরের নিচে একটা ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে পৃষ্ঠা চারেকের রোগা একটা ছাপানো বই বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে বাবরি চুল পেছনে ঠেলে দেয়। তারপর গুণগুণ করে,

বিসমিল্লা বলিয়া শুরু করে কেরামত।
ভারতবাসীর উপরে আল্লা কর রহমত–শুন সব্রজনে।
শুন ব্ৰজনে শুধু মনে হিন্দু মোসলমান।
সোনার বাঙলার চাষীর দুস্কে ফাড়িবে পরাণ রক্ত করি জল
রক্ত করি জল সোনার ফসল চাষা ফলায় মাঠে।
অনাহারে উপর্বাসে জেবন তাহার কাটে।।

চাষার গান? গান থামিয়ে কাদের বলে, বাঃ বাঃ। কাল তুমি একবার আসো। দেখি তোমাক দিয়া ভালো একটা গান লেখানো যায় কি-না। হাই তুলতে তুলতে বলে, রাত হলো। কামের কাম কিছুই হলো না। কর্মীদের বলে, তোমরা কাল সকাল সকাল আসো, সন্ধার আগেই আসো। রাত হলে এর গানও শোনা যাবে। না কি কও হে কবিঃ এসব কথায় কেরামতের গানের প্রতি তার অনুরাগ বা উদাসীনতা কিছুই বোঝা যায় না। কেরামত আলি গাইতে শুরু করতে না করতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আলিম মাস্টারের নির্দেশটি অকার্যকর করার তৃপ্তিতে খালি পেটের দরুন ঢেকুর তুলতে না পেরে সে আরেকবার সশব্দ ও লম্বা হাই তোলে।

গানটি ভালোভাবে গাইতে না পারলেও এরই মধ্যে কেরামতের বাবরি চুলের ওঠানামা সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছে তমিজের। এক লাইনে কেরামত তার বাবরি চুল মাথার এক ঝাকুনিতে নিয়ে আসে সামনে, চোখমুখ ঢেকে তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায় এবং পরের লাইনে এসে আরেকটি ঝাকিতে মেঘ কাটালে হ্যাজাকের আলোয় জ্বলজ্বল করে তার চোখ দুটি। বাবরিতে কী যে আছে যে একেকটা ঝাকির সঙ্গে চুলগুলো একেবারে কুঁসে ফুঁসে ওঠে। মাত্র কয়েকটা কথাই সে গাইলো, তার গান শোনার পিপাসায় তমিজের বুকটা খা খা করতে থাকে। গানের সব কথা সে ধরতে পারে নি। গায়কের চুলের ঢেউ খেলানোর দিকে বেশি মন দেওয়ায় গানের কথার অনেকটাই তার কান পিছলে গেছে। কিন্তু এর মধ্যেই কানের ভেতরে ঢোকা, কথাগুলো তার মাথায় কুটকুট করে কামড়ায়। আরো শুনতে পারলে কামড়ানিটা হয়তো সারতো।

 ২১. ধান যে তমিজের আরেকটু প্রাপ্য

ধান যে তমিজের আরেকটু প্রাপ্য, অন্তত বিলের পানি ও কামলা বাবদ তার কাছ থেকে বেশিই নেওয়া হয়েছে, আবদুল কাদের এটা মানে।–তোর কথা ন্যায্য। কিন্তু ভাইজান বাগড়া দিবি।

সপ্তাহের ছয়টা দিনই তো ভাইজান বাড়ি থাকে না, কিন্তু কাদের কিছু করতে পারলো না। ভাইজান নাই, আছে ভাবি। আবদুল কাদেরের সমস্যাটা তমিজ বোঝে। আবদুল আজিজের শ্বশুরবাড়ি তো টাউনের কাছে, টাউনবন্দরের মানুষকে তমিজের। চেনা আছে। ভাবিজানের হাতটা একটু খাটো। আবার বড়ো বেটা না থাকলে বর্গাদার কি কামলাপাটকে দেওয়া থোওয়ার ব্যাপারে বেটার বৌয়ের কথা মণ্ডল খুব শোনে। বড়োবিবি তার হাজারটা ব্যাপার নিয়ে রাতদিন যতোই ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করুক, শরাফত শেষপর্যন্ত সায় দেয় বেটার বৌয়ের কথায়। এমন কি ছোটোবিবির মিহি গলার তেরছা কথায় মণ্ডল দিনমান যতোই ভিজুক আর নিজে রাত্রিবেলা তকে যতোই ভিজিয়ে দিক, ধানের হিসাবে নিকাশে তার কথার দাম নাই। ছোটোবিবিকে বলেও তমিজের তাই সুবিধা হলো না।

তো কী আর করে, তমিজ নিজেই একদিন আল্লা ভরসা করে মণ্ডলবাড়ি গিয়ে কাদেরের সামনে শরাফতের কাছে কারুবারু শুরু করে। শরাফত সরাসরি না করে দেয়, কাদের তো লিত্যি তোর কথা কচ্ছে। জাহেল মাঝি, হিসাব বুঝিস না। হিসাব করা দেখলে ধান তোক বেশি দেওয়া হছে। আর কাদের, তুমি একজন শিক্ষিত ছেলে হয়া এই সোজা হিসাবটা বোবঝা না?

তমিজের হয়ে কাদের বাপের সঙ্গে কথা বলেছে মোটে একবার। শরাফত বাড়িয়ে বললো, কাদেরের সম্মানটা এতে বাড়লো তমিজের কাছে, এই অতিরিক্ত সম্মানপ্রাপ্তির জোরে বুক ফুলিয়ে সে বাপকে বলে, বাপজান, পানি বাবদ খরচটা ধরেন কীভাবে? আর কামলার খরচ যা ধরিছেন।

মাগনা কোনো কিছু পাওয়া ভালো লয় বাপু। তুমি পানি সেচবা, পানিটা কার সেটা হিসাব করবা না? বিল কি আমি পয়সা দিয়া ইজারা লেই নাই?

কাদের জবাব না দিলে পানির ব্যাপারটা ফয়সালা হয়ে গেছে ধরে নিয়ে মণ্ডল আসে কামলার প্রসঙ্গে, তোমরাই না মিটিং করা কামলা কিষাণের কথা কও? কোরান হাদিসের কথা, মজুরের গায়ের ঘাম শুকাবার আগে তার পাওনা মিটায়া দাও। এখন। তুমি কামলাক পয়সা দিবার মানা করো কোন বুদ্ধিতে?

না না, বাপজান, কথা তো সেটা নয়। কিন্তু কথাটা যে কী তা বলতেও তার একটু দেরিই হয়। শেষপর্যন্ত অবশ্য বলতে পারে, ধান কাটার সময় তমিজের বাপ যখন আছিলো তখন আর কামলা নেওয়ার দরকার কী? তারপর ধরেন তমিজের বাড়িত যদি ধান ক্যাটা লিয়া আসা যায় তো ওর বাপ আছে, ওর সত্য আছে।

ওই জমির ধান ওরা বাপবেটা কাটলে এক সপ্তাহের কমে পারে না। ধান যেমন পাকিছিলো, অতোদিনে মেলা ধান নষ্ট হতো। বেশি কামলা দেওয়া লাগলো তাই। এ ব্যাপারটিরও ফয়সালা হলো, সুতরাং শরাফত তোলে পরের প্রশ্নটি, আর তমিজের বাড়িত ধান লিয়া গেলে সব ধানই নষ্ট হয়। তমিজের বাপ তো একটা আবোর মানুষ, আবার শয়তানের একশেষ, আর বৌটা ফকিরের বেটি; ধানের অরা বোঝে কী? হুরমতুল্লার বেটি কও, বৌ কও, হুরমতুল্লার লিজের কথাও কওয়া লাগে, সোগলি ফসলের কামই করে। ওই বাড়িত না লিলে এতো ধান বার হয়? কাদেরকে কিছুক্ষণ। কথা বলার সুযোগ দিতে শরাফত চুপ করে, তা সুযোগের সদ্ব্যবহার সে না করলে শরাফত ধীরেসুস্থে জানায়, হাজার হলেও তমিজ হলো মাঝির বেটা। আর কয়েকটা বছর চাষবাসের কাম করুক, তখন লিজেই সব বুঝবি। তা তুমি এই চ্যাংড়াটাক বুঝবার দাও, অর সাথে তোমার লাফ পাড়লে চলে?

লাফ পাড়ার সময়ও কাদেরের নাই। পোড়াদহ মাঠে সন্ন্যাসী মেলার আয়োজন শুরু হয়েছে, সেখানে মানুষ আসছে নানা জায়গা থেকে। ইসমাইল সাহেব আজ টমটমে। শিমুলতলা যাবে, যাবার পথে পোড়দহ মাঠে ঘণ্টাখানেক বসে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে। গোলাবাড়ি থেকে তার সঙ্গে আসবে কাদের। ইসমাইল যাবে শ্বশুরবাড়ি, কিন্তু তার আসল কাজ হলো ওই বাড়ির প্রজা পার্টির সাপোর্টারদের লীগে ভেড়াবার চেষ্টা করা। শিমুলতলার মিয়াবাড়ি হাত করতে না পারলে ওদিকে ছোটোবড়ো কোন ঘর থেকে একটা ভোটও পাওয়া যাবে না।।

আবদুল কাদের চলে গেলে তমিজ একেবারে চুপ মেরে গেলো। শরাফত চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে দেখে তমিজের হঠাৎ ভয় হয়, মণ্ডলের সঙ্গে তার জীবনে আর কথা। বলার সুযোগ হবে না। মণ্ডলের পায়ের কাছে বসে সে হঠাৎ বলে, ওই জমিত হামি পিয়াজ করবার হাউস করছিলাম।

এই খন্দটা হুরমতুল্লা করুক। শরাফত সোজাসুজি বলে, তুই বাপু আগে হালগোরু কর। তার কাজের প্রশংসাও করে শরাফত, সে মেহনত করতে জানে, আল্লা তার পুরস্কারও দেয়। কিন্তু নিজের হালগোরু ছাড়া জমি বর্গা নিলে নানারকম ক্যাচাল হয়, দুই পক্ষেই সন্দেহ করে, তার প্রাপ্য ঠিক পাওয়া গেলো না।–মণ্ডল রাগ করে না, ধমক দেয় না, গালাগালি করে না, মুখও খারাপ করে না। নাতির মৃত্যুর পর সে বরং আরো নরম হয়েছে, নাতির চেহলামের পর কথাবার্তায় সবার সঙ্গে সে খুব বিনীত। কিন্তু তার স্বভাব ও ব্যবহারের বদল হয় আর তমিজের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে, তমিজ–এখন তার দিকে ভালো করে তাকাতেও পারে না।

তবে তমিজের একটা ব্যবস্থা সে করে দেয়, তুই না হয় ওই জমিত বছরকামলা খাট। বিলের ওইপারে তো হুরমতুল্লা হামার মেলা জমি করিচ্ছে, কাম তোর একটা না। একটা হবিই। পিয়াজ রসুনের আবাদ করবার চাস, তো কর। মানা করিচ্ছে কেটা? হুরমতুল্লার সাথে থাকলে কামও শিখবার পারবু।

শরাফত মণ্ডলের এই নতুন বন্দোবস্তের কথা শুনে তমিজ একেবারে বসেই পড়ে, ধ্বসেও পড়ে বলা যায়। শরাফত সেটা আঁচ করে গলার আওয়াজ কমিয়ে গোপন কথা বলার ভঙ্গি করে, তুই থাকিস তো খন্দ উঠলে হুরমতুল্লা টাল্টিবাল্টি করবার পারবি না। আর বেটিটা তো শুনি জমিতই পড়া থাকে, ধামা ধামা পিয়াজ রসুন সরালে ধরবি কেটা?

প্রায় টলতে টলতে বাড়ি ফিরলো তমিজ। বাপের ওপর, কুলসুমের ওপর ঝাল ঝাড়তে পারলে তার টলোমলোটা কমে। কিন্তু কুলসুম তখন ধানভরা মাটির হাঁড়ি তুলে দিয়েছে উনানের ওপর, ধোঁয়ার আড়ালে দেখা যায়, তার চোখমুখে গালে চিবুকে ধানের সুখ সাঁটা রয়েছে মেচেতার দাগের মতো। এক পলক সেই দাগ দেখে নিয়ে তমিজ ঢুকলো বাপের ঘরে। বাপটা তখন বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলো একটা বেড় জাল হাতে। তার চোখে ও দাড়িতে খুশির ছটা, উঠানে যেতে যেতে বলে, কালাম দিলো। অর বাপের আমলের জাল। কয়েক জায়গাত সুতা নাই, জোড়া দিলেই এই জালে আরেক জেবন চলবি।।

তমিজের সব ক্ষোভ আর কষ্ট চাপা পড়ে তীব্র উৎকণ্ঠায়, তুমি কি আবার কাৎলাহার বিলত যাচ্ছো মাছ ধরবার? মণ্ডল তোমার ঠ্যাং দুইটাই ভ্যাঙা দিবি না?

বাপের জোড়া ঠ্যাং ভাঙার সম্ভাবনাতেই তমিজের অবসাদ কাটে, মণ্ডলের লাঠিতে বাপটা তার যদি সত্যি সত্যি পড়ে যায় তো সেই এক বাড়িতেই সে নিজেও ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে শরাফতের কবজা থেকে। আবার ওদিকে বেড় জালের ভেতর দিয়ে বাঘাড় মাছের তেজ যেন ঢুকে পড়েছে তমিজের বাপের গতরে, সেই তেজে ছোটে তার মুখ, কাৎলাহার বিল ছাড়া দুনিয়াত আর পানি নাই? দুনিয়ার ব্যামাক পানি কি মণ্ডলের বেটা একলাই দখল করিছে? বাঙালি নাই? যমুনা নাই? পশ্চিমমুখে করতোয়া নাই?

একনাগাড়ে এতো কথা বলে তমিজের বাপের চোখে ঢুলুনি নামে, সেই দুলুনিতেও তেজ তার কমে না, ধান যা লিয়া আসিছু, বেচলে কয়টা মাসের খোরাক হয় রে? তার গর্জন ক্রমে ক্রমে নেমে আসে বিড়বিড় ধ্বনিতে, পোড়াদহ মেলাত যদি একটা বাঘাড় তুলবার পারি তো। বাক্য অসমাপ্ত রেখেই একটু উঁচু গলায় জিগ্যেস করে, মণ্ডল তোক এবার বর্গা তো দিচ্ছে না। কামলাই খাটবু?

মণ্ডলের পেটের খবর বাপ পায় কী করে? বুড়া গত রাত্রে কি বিলের সিথানে গিয়েছিলো? পাকুড়তলা থেকেই কি সে এতো তেজ নিয়ে এসেছে গতর ভরে? তা বুড়ার সাথে মুনসির এতো খায়খাতির তো মুনসিকে দিয়ে সে মণ্ডলের মনটা একটু ফেরাতে পারে না? রাতভর বিলের ধারে ধারে এতো হাঁটাহাঁটি করে তমিজের বাপের ফায়দাটা। হলো কী? বর্গা জমিটা তার বেহাত হয়ে গেলো, বুড়া কি মুনসিকে খবরটা জানাতে পারে না?-শূন্য জমি যে দিনরাত তমিজের জন্যে আহাজারি করছে, মুনসি কি তার কিছুই শুনতে পারে না? জমির নিশ্বাসে কি মুনসি এতোটুকু সাড়া দিতে পারে না? তো সে কিসের মুনসি?

দুপুরবেলা নিজগিরিরডাঙায় মোষের দিঘির পাশের সেই ধান-কাটা জমি গা এলিয়ে দিব্যি উদাম গা পোহায়। পাশে হুরমতুল্লার মরিচখেতের সবুজ ও লাল আভায় এই জমির গা কি একটুও কঁপে? ছটফট করে বরং তমিজ। হুরমতুল্লাকে হাতে পায়ে ধরে মণ্ডলকে বলিয়ে তমিজ কি এবারের মতো, শুধু এবারের মতো হালগোরু ছাড়া জমিটা বর্গা পেতে পারে না?

কিন্তু হুরমতুল্লার বাড়িতে লোকজন কোথায়? শুকনা কলাপাতার পর্দার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তমিজ অনেকক্ষণ পর শুনতে পায় শিশুকণ্ঠের কোঁকানি। গলা খাঁকারি দিয়ে সে ভেতরে ঢুকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ফুলজান। ছেলেটির গলা থেকে ক্ষীণ কোঁকানি বেরিয়ে বাড়িটিতে আরোপ করেছে ধূ ধূ করা মাঠের ছন্দ। হুরমতুল্লাকে তমিজের খুব দরকার,-এই ব্যাপারটি আড়ালে পড়ে যায়। তমিজের বুক ধুক ধুক করে, বাড়িতে আর কেউ নাই?

মাঝির বেটা, ছোল হামার বুঝি আর বাঁচে না গো?

তার এই উৎকণ্ঠায় সাড়া না দিয়ে কিংবা ভালো করে সাড়া দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে তমিজ জিগ্যেস করে, তোমার বাপ কোটে? নবিতন কোটে? মাও?

বাজান গেলো মণ্ডলবাড়িত। বাজান মনে হয় বিল পার হয়ই নাই, ছেলের হামার বমি আরম্ভ হলো। বমি এখন থামিছে, সখন থ্যাকা খালি ক্যামা কোকাচ্ছে। লাকোত বিশ্বাস মনে হয় নাই।

নিশ্বাসবিহীন প্রাণীর পক্ষে কোনো সম্ভব নয়, শিশুটির জীবন সম্বন্ধে তমিজ নিশ্চিন্ত। শূন্য রান্নাঘর ও শূন্য উঠানের দিকে দেখে তমিজ শিশুটিকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে দেখে, কপালে হাত দেয়, গালে হাত বুলায় এবং প্রায় ডাক্তারেদের মতো করে বলে, না। ভালো হয়া যাবি। চ্যাংড়াপ্যাংড়ার বমি ওংকা হয়ই। তোমার মাও কোটে? নবিতন বাড়িত নাই?

হামার বড়োমামু আসিছিলো, মায়েক লিয়া গেলো, সাথে গেলো নবিতন আর ফালানি। তার ছেলে সম্বন্ধে তমিজের বিজ্ঞ বিজ্ঞ কথায় ফুলজান হয়তো আশ্বস্ত হয়েছে, নাইওর লিয়া গেলো। দুইদিন বাদে পোড়াদহের মেলা লয়? মামু কয়, তোমার জামাই তো আর আসবি না। ফুলজানের বাপ হামাগোরে বুড়া জামাই, তাই লিবার আসিছি।

পোড়াদহের মেলা উপলক্ষে একজন প্রবীণ জামাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে আমন্ত্রিত হবার খবরে তমিজ কিন্তু হাসে না। কিন্তু অস্পষ্ট খুশির ঝিলিক ওঠে ফুলজানের ঠোঁটে, এই আবছা হাসির হালকা টোকায় বিমারি বেটার জন্যে জমে-ওঠা অশ্রু ফুটে ওঠে। গোল বিন্দুতে এবং তমিজ একটু লাই পায়, পোড়াদহের মেলা পাড়ি দিয়া আসবি? তুমি যাও নাই যে?

এই রুগ্ন ছেলেকে নিয়ে ফুলজান যেতে পারে নি, তাকে একা রেখে বাপজানই বা যায় কী করে? এইসব জানাতে জানাতে ফুলজানের অশ্রু বিন্দুটি গড়িয়ে পড়ে গালে, কিন্তু শুকিয়ে যায় না। বাড়িতে ফুলজান আর তার ছেলে ছাড়া আর কেউ নাই, এটা। জানার পর বাড়ির নির্জনতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হলে শুরু হয় তমিজের নতুন উদ্বেগ : এই . নির্জনতা কি তাকে কোনো সুযোগ নেওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলো?-এই বাড়িতে তার আবার দায়িত্ব কী? এখন কী করবে তমিজ? হুরমতুল্লা তার জমি হাতিয়ে নিচ্ছে, ফুলজানকে বলে লাভ কী? তা হলে? ফুলজানকে কিছু একটা বলতে তো হবে। কী বলবে?—এই দমবন্ধ দশা থেকে তাকে বাঁচায় ফুলজানের বেটা, হঠাৎ সে বমি করে ফেলে মায়ের কোলেই। তার বমি নিঃশব্দ, যেন তরল কিছু জিনিস মুখ থেকে ফেলে দিলো আলগোছে। তারপর মাথাটা এলিয়ে দিলো মায়ের কোলে, যেন বাঁচার জন্যে। চেষ্টা করার শক্তিই তার নাই।

বেহুঁশ হয়া গেলো? দেখি দেখি! বলতে বলতে ছেলেটিকে নিজের কোলে তুলে .. নেয় তমিজ। ফুলজানের বেটার বেঢপ পেট আরো ফুলে উঠেছে, চোখজোড়া খুঁজে গেলেও দুই চোখের পাতায় একটু ফাঁক রয়েই গেছে, চোখ বন্ধ করার ক্ষমতাও তার লোপ পেয়েছে। তার গালের কালচে হলুদ রঙ আরো গাঢ় হয়েছে, পাটের আঁশের মতো। চুল সব মাথার খুলির সঙ্গে লেপটানো। তমিজ ওই বমির লালা লাগা গালে গাঢ় একটি চুমু খায়। গাল বেশ গরম, তমিজের ঠোঁটে যেন ছ্যাকা লাগে। তার গরম নিশ্বাসে তমিজের মাথার জট কাটে, ফুলজানের বিলাপের জবাবে সে ধকম দিয়ে বলে, ছোলের জ্বর উঠিচ্ছে, মাথাত পানি ঢালা লাগবি, ভাণ্ড দে। বদনা লিয়া আয়।

ফুলজান বড়ো মালসা আর কলসিভরা পানি আর বদনা নিয়ে এলে ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তমিজ বসে মাটিতে। ফুলজান কিছুক্ষণ তার মাথায় পানির ধারা দেওয়ার। পর ছেলেটি চোখ মেলে কাঁদতে শুরু করলে তমিজের ইশারায় ফুলজান তার মাথায় পানি ঢালতেই থাকে। কলসির পানি শেষ হলে তমিজের ইশারাতেই পানি ঢালা সে বন্ধ করে এবং তার মাথা মুছে দেয় আঁচল দিয়ে। তমিজ নিজেই তাকে মাচার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেশ ভারী গলায় বলে, জ্বর কমিছে। কালই ডাক্তারের কাছ লিয়া যামু। ব্যায়না মেলা করা লাগবি।

ফুলজানের বেটা বোধহয় এখন একটু আরাম পাচ্ছে, কিংবা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। বলেও হতে পারে, কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে ঘুমিয়ে পড়ে। তমিজ হুকুম ছড়ে, ছেলের জাড় করিচ্ছে, বুঝিস না? তোক একখান এ্যাপার দিছিনু, সেটা কোটে? র‍্যাপার কথাটির শুদ্ধ বা অশুদ্ধ কোনো রূপের সঙ্গেই পরিচিত না থাকায় কিংবা সেটা হয়তো নবিতন নিয়ে গেছে মামাবাড়িতে সে জন্যেও হতে পারে, বেটার গায়ে সে বিছিয়ে দেয় নবিতনের ফুল-তোলা একটা কাঁথা। কথা জুড়ে ছড়ানো ছোটো ছোটো ফুল তমিজ দেখছে, এমন সময় ড়ুকরে কেঁদে ওঠে ফুলজান, একটা ওষুদ লয়, পানি-পড়া লয়, ছোল হামার এমনি এমনি মরে? কেউ দেখলো না!

কান্দিস কিসক? তমিজ হঠাৎ তাকে ধমক দিয়ে ওঠে, কান্দনের কী হলো? বাপের বাড়িত বান্দি হয়া আছু, বেটার চিকিচ্ছা করবু ক্যাংকা কর‍্যা? তমিজের এই। সান্ত্বনা-কাম-ধমকে ফুলজান ফোঁপানো ছেড়ে ড়ুকরে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, হামার কপাল মন্দ। হামার নসিব মন্দ। ছেলের বাপ থ্যাকাও নাই। একটা দিন খবর লেয় না মরলো কি বাচলো!

তোর সোয়ামির কথা কোস? সোয়ামি তোর আছেই? আরে তাই তো গান করা বেড়ায়, তুই খপর আখিস না? আজ এই হাট কাল ওই হাট করিচ্চে, এটি আসে নাই?

ফের ফোঁপানিতে ফিরে এসে ফুলজান এবার কান্না থামায়। কেটা কলো? মিছা কথা কও কিসক? ফুলজান কেরামতের খবর জানে এটা অনুমান করতে তমিজের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে ফুলজানের এই ছোট্টো ভাণটুকু ভারী মিষ্টি। বেশ আত্মবিশ্বাসী কিসিমের একটা খুচরা হাসি ছেড়ে তমিজ বলে, মিছা কথা কয়া হামার লাভ? আরে কালই তো গোলাবাড়ি হাটোত দেখা, তোমার কথা কয়, ওই বিয়া তো হামার তালাক হয়া গেছে। হামি কনু, বেটাক তো আর তালাক দিবার পারো না। বেটার তোমার কঠিন ব্যারাম, দেখবার যাবা না? তো চুপ করা থাকে। হাটের মধ্যে সোগলির সামানেই কথা হলো!

তমিজের দিকে চোখ বড়ো করে তাকিয়েফুলজান মাথা নিচু করলে ওই চোখ দিয়ে তার পানি পড়ে টপটপ করে। তমিজ তৎপর হয়ে দুই হাতে ফুলজানের চোখের পানি মোছে, মুছেই চলে। চোখের পানি এরকম পড়তেই থাকলে সে আর হাত সরায়। কী করে? হাত ওভাবে রেখেই বলে, সারাটা জেবন তুই বান্দিগিরিই করবু? তোের বিয়া বসা লাগবি না? ফুলজান দ্বিগুণ বেগে কাঁদতে শুরু করলে তমিজ তার গোটা। মাথাটাকেই চেপে ধরে নিজের বুকে, তারপর চুমু খেতে থাকে তার মোনতা গালে ও নোনতা চোখে, এমন কি তার ঘ্যাগ হয়ে বুক পর্যন্ত। চুমুর এমন প্রবল বর্ষণে ফুলজানের শরীর এলিয়ে পড়ে মাচার ওপর তার ছেলের গা ঘেঁষে। তোর বেটা তো হামারও বেটাই হবি, তখন তার দ্যাখশোন হামিই করমু। কাঁপতে কাঁপতে তমিজ বলে এবং নিজের কথায় তার নিজের শরীরের কাঁপুনি আরো বাড়ে। কাঁপুনি ঠেকাতেই তাকে শুয়ে পড়তে হয় ফুলজানকে জড়িয়ে ধরে।

ফুলজান তাকে ঠেকাতে একটু চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পারে না, সে নিজেও খুব কাঁপছিলো। তার বেটার ঘুম ভেঙে যায়, সে কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদে। ফুলজানের সারা শরীর জুড়ে তখন মাঝির বেটার গতরের দাপাদাপি; তার নাক তো বটেই, তার চোখ, কান, মুখ, গলা, ঘ্যাগ, বুক, পেট, উরু, পা ও পায়ের পাতা, পিঠ, পাছা প্রভৃতি অঙ্গে মাঝির বেটার গতরের আঁশটে গন্ধ।

তমিজ উঠে দাঁড়ালেও ফুলজান শুয়ে শুয়েই ছেলেকে টেনে নেয় বুকের ভেতর। তমিজ বলে, তোর বাপোক কই? আজই কই? তমিজ জানে কাজটা একটু কঠিন। অথচ বুড়া পরামাণিক বোঝে না, তাকে জামাই করলে হুরমতুল্লার সব জমিতে সে যে খন্দটা তুলবে বুড়া জীবনে তা স্বপ্নেও দেখে নি।

বাইরে শোনা যায় হুরমতুল্লার কাশির আওয়াজ। কাশতে কাশতেই সে গোরুর পেট এতো বেলা পর্যন্ত খালি কেন তার কৈফিয়ৎ তলব করছিলো মেয়ের কাছে। তমিজ তাড়াতাড়ি উঠানে নামে এবং হুরমতুল্লাকে প্রায় অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে যায় শুকনা কলাপাতার পর্দা পর্যন্ত।

ক্যা গো, তুমি আসিছো? হামি বলে কতোক্ষণ ধরা তোমার জন্যে দেরি করিচ্ছি। তমিজের গলা শুকনা, কিন্তু খামাখা উঁচু গলায় কথা বলায় সেখানে খরার দুপুরবেলার গরম হাওয়া বয়।

মণ্ডল ছাড়বার চায় না, দেরি হয়া গেলো। হুরমতুল্লা বলতেই তমিজ জিগ্যেস করে, জমির বন্দোবস্ত লিবার জন্যে মণ্ডলের পাও ধরবার গেছিলা, না?

হামি যামু কিসক? মণ্ডলই হামাক ডাকিছে। মণ্ডল ধরিছে, ওই জমি এবার বর্গা করাই লাগবি। এখন জোতদারে একটা কথা কলে তো আর ফালাবার পারি না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে ভেতরের দিকে তাকিয়ে অতিরি