- বইয়ের নামঃ অসীমানন্দ মহারাজের গল্প
- লেখকের নামঃ অসীমানন্দ মহারাজ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আলট্রা মডার্ণ – অসীমানন্দ মহারাজ
হর্ষ চিন্তা করছিল, কী সে পেল আর কী সে হারাল। যা হারাল, তার চেয়ে যা পেল, তা-ই কি জীবনের পরম পাওয়া? হর্ষ কিন্তু তা মেনে নিতে পারছিল না। তাই তার মধ্যে প্রফুল্লতার অভাব ছিল।
হর্ষের স্ত্রী বীথি যে তা টের পেত না, এমন নয়। তাদের পাঁচ বছর বয়সের মেয়ে মৌলির আলাদা ঘরে শোয়ার বন্দোবস্ত করেও হর্ষের আদরের মাত্রা বাড়াতে সে অপারগ হল।
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধঘরে শোভন শয্যায় দেহবাস আরও শিথিল করে স্বামীর দিকে আরও এগিয়ে এসে বীথি বলল, তুমি তো সজাগই আছ, দেখছি। তোমার ভেতরের পশুটা কি এখনও ঘুমাচ্ছে?
তাই হবে হয়তো। হর্ষের কণ্ঠস্বর বড়ই উদাস।
বীথি বলে উঠল, তাকে জাগাও। পশুটা বুঝুক, তাকে সে অনেক সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, যা সে আগে কখনও পায়নি।
বীথির সে কথা মিথ্যে নয়। হর্ষ ইচ্ছে করলে তার ভেতরের পশুকে আজকাল অনেক বেশি পরিতৃপ্ত করতে পারে।
কয়েকদিন আগেও তা পারত না, যখন সে স্ত্রী কন্যা সহ বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত নিজেদের বাড়িতে।
মৌলির বয়স তখন সাড়ে চার। শিশু হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী সে। মুখখানা যেন কথার ফোয়ারা। তাকে একই ঘরে রেখে স্বামী স্ত্রী নিশ্চিন্তে খেলা করে কি করে? তবু তাকে আলাদা ঘরে শোয়াবার বন্দোবস্ত করার কথাটা গুরুজনদের কাছে তুলতে পারেনি কেউ।
তার ওপর ছিল ভোর হতে না হতে বদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বুড়ো বাপের বিরক্তিকর কাশির আওয়াজ, যার একটা অর্থও বুঝি ছিল, ওঠ, ওঠ, এত ঘুম ভাল নয়। সূর্য ওঠার আগে উঠতে হয়। Early to bed and Early to rise makes a man healthy, wealthy and fine. কথাটা কি ভুলে গেলে?
না, ভুলে যায় নি কেউ। সু সুখের শয্যা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করত না কারও। ঘুমাতও অবশ্য অনেক দেরিতে। গভীর রাতে আওয়াজ বন্ধ করে উত্তেজক ছবি দেখতে দেখতে নিজেরাও উন্মত্তের মত আচরণ করত। শরীরের ক্লান্তি তাই সহজে কাটতে চাইত না। সে কথা বলাও যেত না গুরুজনদের কাছে। অথচ বদ্ধ দরজার ওপারে গুরুজনের সশব্দ উপস্থিতি এপারে কামচরিতার্থতায় বাধা সৃষ্টি করত।
কিছুক্ষণ বাদে হর্ষের মা এসে দরজার কড়া নাড়াতেন, যার অর্থ, মৌলিকে তুলে দিতে হবে। সে স্কুলে যাবে। সাড়ে ছটার মধ্যে তার বেরিয়ে পড়া চাই।
মৌলিকে যথাসময়ে স্কুলে পাঠাবার দায়িত্বভার যদিও নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন ঠাকুর মা, তু মেয়েকে ঘরের বার করে দিয়েই আবার দরজা বন্ধ করে দিতে উভয়েই সংকোচ বোধ করত।
সেসব অসুবিধে আজ আর নেই। যতক্ষণই তারা ঘুমিয়ে থাক বা সম্ভোগে লিপ্ত থাক না কেন, কেউ এসে বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। হর্ষকে বলে বলে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কোম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটেতে উঠে আসা হয়েছে, অন্তত বীথি তা ভালই মনে করে।
সে এখন অনেক স্বাধীন। শ্বশুর শাশুড়ির উপদেশ মেনে চলার প্রয়োজন নেই। স্বামীকে তুষ্ট রাখতে পারলে কোনও সমস্যাই তার থাকে না। শ্বশুর বাড়ি থাকতে যাদের সে কখনও ফোন করতেই সাহস পেত না, স্বামীর ফ্ল্যাটে আজ সে তাদের যখন খুশি চলে আসারও আমন্ত্রণ জানায়। দু চারজন মদ্যপ বন্ধুর কথা ভেবে ফ্রিজে সে মদের বোতল পর্যন্ত এনে রাখে।
ফ্রিজে মদের বোতল দেখে হর্ষ অবশ্য বলেছে, এ কাজটা তুমি ঠিক কর নি, বীথি। মৌলি না বুঝলেও আমার বাবা মার চোখে যদি পড়ে যায় কখনও, তাদের কি ধারণা হবে, ভাবতে পার?
বীথি হেসে উত্তর দিয়েছে, গোপন জায়গা যা সংরক্ষিত থাকে, অতিথিদের তা চোখে পড়ার কথা নয়। তারা বড় জোর ডাইনিংরুমে বসে, কিচেনে ঘোরাফেরা করে না।
হর্ষ বলে উঠেছে, আমার বাবা মাও কি—
বীথি বলেছে, আমার সংসারে অতিথি বই কী। সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার অধিকার তাদের আমি দেব না। এতকাল মুক্তির স্বাদ পেতে যারা দেয় নি, তাদের এবার শাস্তি তো পেতেই হবে।
হর্ষ জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে, আমার বাবা মা কিন্তু শাস্তিযোগ্য অন্যায় কখনও করে নি। তারা আমাদের যত ভালবাসে, নিজেদেরও তত ভালবাসে না।
বীথি বলে উঠেছে, তুমি তা টের পাও কি করে? তোমার রক্তপ্রবাহের মধ্যে নাকি? তা-ই যদি হয়, আমাকে তুমি দোষ দিতে পার না। তাদের রক্ত তো আর আমার ধমনীতে বইছে না। সে কারণে তাদের দোষও আমি দেখতে পাই, তুমি যা। দেখতে পাও না। পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতামাতার মত তুমিও তোমার পিতামাতার প্রতি ভক্তিতে অন্ধ।
বীথির কথাগুলির খুব একটা প্রবািদ করতে না পারলেও হর্ষের শুনতে মোটই ভাল লাগেনি। বুঝতে তার ভু হয়নি, বীথি নিজের খুশিমত জীবন যাপন করতে চায় বলেই গুরুজনেরা তার কাছে অসহ্য।
পতিও তো পরম গুরু। কিন্তু হর্ষকে গুরু বলে কখনও কি মনে করে বীথি? একেবারেই না। নাম ধরে তো ডাকেই, তাছাড়া তাচ্ছিল্যও কম করে না। পাঁঠা ও কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে কথাও শোনায় কখনও কখনও। হর্ষ ভাবে, হায়, দিন কালের এ কী পরিবর্তন!
.
২.
শীতের সকাল। ঘুম ভেঙে গেলেও ওঠার ইচ্ছে হয় না সহজে। তবু হর্ষ উঠেই পড়ল। মেয়ে মৌলিকে তৈরি করে কাজের বৌটি যখন তাকে স্কুলে নিয়ে যায়, সে সময়টার মৌলির মনের অবস্থা কেমন থাকে, অনেকদিন তা লক্ষই করা হয় নি যে।