চিলেকোঠার সেপাই – ০১

‘তোমার রঞ্জু পড়ি রইলো কোন বিদেশ বিভূঁয়ে, একবার চোখের দ্যাখাটাও দেখতি পাল্লে না গো!’
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ওসমান একটার পর একটা লেবুপাতা ছেঁড়ে আর মায়ের বিলাম শোনে। ৩টে আঙুলে লেবুপাতা চটকাটে চটকাতে উঠানের দিকে এগিয়ে গেলে কে যেন তাকে দেখে ফেলে, ‘ওরে! রঞ্জুকে এট্টু কাঁধ দিতি দে!’ লোকটা কে? সেই লোকটাই ফের আফসোস করে, ‘আহা হাজার হলেও বড়ো ছেলে, জ্যেষ্ঠ সন্তান! কুথায় পড়ি রইলো সে, বাপের মুখে এক ফোঁটা পানি দিতি পাল্লো না। আহারে, বাপ হয়ে ছেলের হাতের এক মুঠি মাটি পেলো না গো!’
ওসমানের সামনেই কথাবার্তা চলে। ভুলটা কারো চোখে পড়ে না। বাপের লাশ-বিছানো খাটিয়ার একদিকে কাঁধ দিয়ে সে-ও পশ্চিমপাড়ার দিকে চলে। পশ্চিমপাড়ায় জুমার ঘর, জুমার ঘরের পেছনে কাজীদের জোড়শিমুলতলা, তারপর ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় ও খেজুর কাঁটায় ভর উঁচুনিচু গোরস্থান। গোলাপপাশ থেকে শবযাত্রীদের ওপর গোলাপজন ছিটিয়ে দিলে মনে হয় শিমুলগাছ থেকে টুপটাপ শিশির ঝড়ে পড়ছে। ওসমানের পায়ের কয়েক ফোঁটা পড়লে তার ঘুম ভেঙে যায়। পায়ের ওপর চাদর অনেকটা ভিজে গেছে, ওদিকের জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে।
ওসমানের উঠে বসতে হলো। শিকের ফাঁকে থুথু ফেলে জানলাটা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়লো। কিন্তু পাশের জানলা খোলাই রইলো। ঐ জানলা দিয়ে পানির ছাঁট এসে পড়ছে চেয়ারে। চেয়ারে কিংস্টর্কের প্যাকেট, দেশলাই, চাবি ও কয়েকদিন আগেকার ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’। প্রথম পৃষ্ঠায় ৪ কলাম জুড়ে এই বছরের বিশ্বসুন্দরীদের ছবি। রাতে ব্যবহার করবে বলে আনোয়ারের বাড়ি থেকে কাল দুপুরবেলা নিয়ে এসেছে। শালার শওকত ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে রাতে বাঙলার মাত্রাটা বেশি হয়ে গিয়েছিলো, এসে কখন যে প্যান্টট্যান্টসুদ্ধ শুয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। সিসিলিরূপসীদের পুরুষ্টু উরুতে শীতল বৃষ্টিপাত ঘটছে। ঐটা সামনে রেখে কম্বলের নিচে নিজের উরুসন্ধি থেকে দিব্যি ঘন প্রস্রবণ বইয়ে দেওয়া চলে। কিন্তু হয় না। প্যান্টের বোতাম খুলতে খুলতে বোঝা যায় যে, বাপের লাশের স্পর্শে তার সারা শরীর একদম ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি ঠিক ঠিক ফলে, বাপ তার সত্যি সত্যি মরে গেলো কিনা কে জান? একটু আগে দ্যাখা স্বপ্ন, সহজে কি ছাড়তে চায়? শীতের দিনেও ঘামের মত সেঁটে থাকে। তবে স্বপ্নে নিজের কাউকে মরতে দেখলে অন্য লোক মরে। নাঃ! আব্বা নিশ্চয়ই ভালো আছে। বাপের বেঁচে থাকা সম্বন্ধে একটু নিশ্চিন্ত হলে বাপের ওপর ওসমানের রাগ হয়। একবার বাস করবে বলে পাকিস্তানে এলো তো আবার ফিরে গেলো কেন? এখানে বাড়িঘর কিছুই করলো না। বছর ছয়েক চাকরি করে একবার ছুটি নিয়ে সেই যে দেশে গেলো, ফেরার নামও করলো না আর। গ্রামে না থাকলে মোড়লগিরিটা ফলাবে কোথায়!
বাপের ওপর রাগ ভালো করে জমে ওঠবার আগে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ওসমান দারুণ উৎকণ্ঠিত হয়ে এক লাফে মেঝেতে নামলো, আব্বা কি এসেই পড়লো নাকি? প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হাতের এক ধাক্কায় মিস ইউনিভার্সের ছবি মেঝেতে ফেলে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ‘কে’ বলে দরজার ছিটকিনি খুললো। দূর! আব্বা আসবে কোত্থেকে? ইন্ডিয়া থেকে আসা কি চাট্টিখানি কথা?
দরজা খুললেই নিচে নামবার খাড়া ঝাপসা সিঁড়ি। সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৪/১৫ বছরের একটি ছেলে। ওসমানের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে লাও এসে পড়েছে ছেলেটির শরীরের ওপরের ভাগে। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট, ফ্ল্যাপের নিচে দুটো বুকপকেট, ডান পকেটের ওপর ঘন খয়েরি সুতার এমব্রয়ডারি করা প্যাগোডার মাথা।
দরজার চৌকাঠে চোখ রেখে ছেলেটি বলে, ‘আপনি একটু নিচে আসেন।’
ওসমান ছেলেটির মুখের দিকে সোজাসুজি তাকায়, ‘কি ব্যাপার?’
নিচু গলায় ছেলেটি জবাব দেয়, ‘আমরা দোতলায় থাকি।’
‘আমি কি করবো?’ ওসমান একটু হাসে।
ছেলেটি হাসে না, বিরক্ত হয় না। পাশে সিঁড়ির রেলিঙে হাত রেখে বিড়বিড় করে, ‘আপনে একটু আসেন। আমার ভাই মারা গেছে।’ একটু থেমে সে হঠাৎ জোরে বলে ওঠে, ‘কাল পুলিসের গুলি খাইয়া মারা গেছে।’
গুলি কোথায় লেগেছিলো? এই প্রশ্ন না করলেও ওসমান চট করে মাথাটা নিচু করে সঙ্গে সঙ্গে ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায়?’
‘আমাদের বাসায় আসেন। বাড়িআলা সবাইরে ডাকতে বললো।’
‘চলো।’
ছেলেটির পেছন পেছন কয়েকটা ধাপ নেমে ওসমান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘরের জানলা-দিয়ে-আসা আলো এখন ছেলেটির এলোমেলো চুলে বিলি কেটে গড়িয়ে পড়েছে তার ঘাড় পর্যন্ত। ওসমানের পায়ের আওয়াজ থেমে যাওয়ায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকালো। এখন তার চিবুক পর্যন্ত আলো। তার চোখের লাল চিকন রেখাগুলো ছটফট করছে। প্রায় ৭/৮ ধাপ ওপর থেকে ওসমানের দিকে তাকালে আলো-পড়া লাল চোখ জোড়া অনেক বড়ো মনে হয়।
ওসমান বলে, ‘তুমি যাও। আমি একটু পরে আসছি।’
ছেলেটি একটু দাঁড়ায়, জানলার আলো এখন তার ঘাড়ের ওপর, শার্টের কলারে। এবার পেছনে না তাকিয়ে সে নিচে নেমে গেলো। ওসমান ভেবেছিলো যে, ছেলেটির দুঃখী চোখজোড়া আরেকবার দ্যাখা যাবে।
টুথব্রাশে অনেকখানি পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ছাদের এক কোণে গিয়ে ওসমান পেচ্ছাব করে। ঘরে এসে কলসি থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ছাদের আরেক দিকে বসে সে মুখ ধোয়। মুখ ধোয়ার কাজটা তাকে একটু ধীরে সুস্থে করতে হয়, তাড়াতাড়ি কুলকুচো করতে গেলে বমি হওয়ার চান্স থাকে। পেচ্ছাব করা ও মুখ ধোয়াটা ওসমান ছাদের সেরে নেয়। কোনোটাতেই বাড়িওয়ার সম্মতি নেই। গোসল করতে হলে অবশ্য নিচে নামতেই হয়। নিচতলায় বাড়িওয়ালার ‘গওসল আজম সু ফ্যাক্টরি’। কারখানার প্রায় ৮/১০ জন লোক। সারি বাঁধা খাটা পায়খানার ৩টে প্রায় তাদের দখলেই থাকে। ওসমান তাই অফিসে কি সিনেমা হলে কি মসজিদে পায়খানা করে। গোসলের জন্য পাকা স্যাঁতসেঁতে উঠানের একদিক জুড়ে মস্ত বড়ো চৌবাচ্চা, এটাকে বলা হয় হাউস। কিন্তু ওটার দিকে চোখ পড়লেই তার শীতশীত করে, গোসল করাটা প্রায় হয়েই ওঠে না।
এই ঘরের গণির বসবাস প্রায় আড়াই বছর। বাড়িটা হোপলেস। সামনে খোলা জায়গা নাই, ড্রেনের পরেই বাড়ি শুরু হয়ে গেলো। রাস্তার ওপরে চাওড়া দরজা, দরজাটা একটু নিচু। বাড়ির বাসিন্দারা, এমনকি বেঁটে লোকজনও মাথা একটু নিচু করে ঐ দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকে। যারা ওপরে যাবার তারা বাঁদিকে এক পা গিয়ে সিঁড়িতে ওঠে, আর একতলার গওসল আজম স্যু ফ্যাক্টরির কর্মচারী বা কর্মিগণ সরু প্যাসেজ পার হয়ে স্যাঁতসেঁতে উঠান অতিক্রম করে। রাস্তার ওপরে এই একটিমাত্র দরজা বন্ধ করে দিলে এই বিশাল ও বেঢপ দালালে ঢোকা অসম্ভব। দোতলা ও তিনতলার সামনে বারান্দায় বাঙালিদের পেট সমান উঁচু লোহার রেলিঙ। ঘরগুলো ছোটো, এর মধ্যে হার্ডবোর্ড, কাঠের পার্টিশন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘরের সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে। ঘরের মূল দেওয়াল খুব পুরু, থামগুলো মোটা। বাড়ি তৈরীর সময় মনে হয় শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটি প্রবলরকম ইচ্ছা খুব তৎপর ছিলো। সেই শত্রু কে? কোনো শত্রু না থাকলে বাড়িটাকে এরকম না-দুর্গ না-বাড়ি বানাবার মানে কি? মানে যারা জানতো সেই সাহা কি বসাক কি পোদ্দার মশাইরা ১৯৫০ সালে রহমতউল্লার কাছে বাড়ি বেচে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইপিআইডিসিতে কাজ পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর আগের অফিসের এক সহকর্মীর কল্যাণে ওসমান এই ঘরের খোঁজ পায়।
ঘর মানে বাড়ির চিলেকোঠা। ছাদের ওপর একটিমাত্র ঘর, রান্নাঘর নাই, বাথরুম নাই, পায়খানা কি গোসল করতে হলে দাঁড়াতে হয় একতলার কিউতে। তবে ওসমানের ঘরে আলো বাতাস খুব। দরজা ২টো, সিঁড়ির মুখে ১টা, আরেকটা ছাদের দিকে। ছাদটা বেশ বড়ো, চারদিকে রেলিঙ, সামনের রেলিঙ একটু উঁচু। একদিকে এসে দাঁড়ালে সামনের রাস্তা চমৎকার দ্যাখা যায়। রাস্তার ঠিক ওপারে ১টা দোতলা বাড়ি, বেশ বড়ো এবং একই রকম বেঢপ। ঐ বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া মসজিদ, মসজিদের বারান্দায় একটি সাইনবোর্ডে বাঙলা ও আরবি হরফে হক্কেনূর মক্তবের নাম লেখা। মাঝে মাঝে ওসমান ছাদে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই চারদিকের ঘিঞ্জি সব বাড়িঘরের মাঝখানে পায়ের নিচের ছাদটাকে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে, সুড়ুৎ করে তখন ঢুকে পড়ে নিজের ঘরে। আজ অবশ্য ফাঁকা ফাঁকা ভাবতার জন্যে অপেক্ষা করতে হলো না। নিচে রাস্তার ওপর পুলিসের জিপ।
নিচে নামবা সময় দোতলার ডানদিকে মহিলা কণ্ঠের ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজে বোঝা যায় যে, এই ঘরেরই কেউ নিহত হয়েছে। মৃত মানুষের বাড়িতে যেমন হাউমাউ কান্নাকাটি থাকে, এখানে কিন্তু তেমন কিছু নাই। কান্নার ধ্বনি ঘরের চাপা কোলাহল থেকে বাইরে আসছে, ধ্বনির সঙ্গে সংগে ওসমান নিচে নামে।
জিপের পেছনে আরেকটি গাড়ি—পিক-আপ, এটাও পুলিশের গাড়ি। রাস্তার ওপর থেকে রহমতউল্লার সঙ্গে ৭/৮ জন লোক রাস্তা ক্রস করছে। তাদের ৪ জনই পুলিস। বাড়িওয়ালার মাথায় কালো জিন্না টুপি। গভর্ণর গতবার এখানকার কম্যুনিটি সেন্টার উদ্বোধন করতে এলে মহল্লার একজন শ্রেষ্ঠ মৌলিক গণতন্ত্রী হিসাবে রহমতউল্লা টুপিটি উপহার পায়। তবে সবসময় সে সাদা কিস্তি টুপিই পরে। কেবল নিজের দাপট দ্যাখাবার দরকার হলে জিন্না টুপিটাকে সে ব্যবহার করে মুকুটের মতো।
না, টুপির জন্য নয়, বাড়িওয়ালাকে সেখে ওসমান গনির ঠোঁটে আপনি-আপনি একটি হাসিহাসি ভঙ্গি ফোটে। জবাবে গম্ভীর ও কোঁচকানো চোখমুখ করে বাড়িওয়ালা বলে, ‘আমার বাসায় যাইতেছিলেন? লন, উপরে যাই।’
রহমতউল্লার অনুমান ঠিক নয়। ওসমান যাচ্ছিলো ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের দিকে। ভোরবেলা হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে গেলো, ঠাণ্ডাটা বেশ জমেছে, নানরুটি পায়াতে রবিবারের সকালবেলাটা চমৎকার জমতো। এ্যাবাউট টার্ণ করে বাড়িওয়ালার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যাপার কি? কিভাবে হলো?’
‘আপনে আছিলেন কৈ? নিচের তলার পড়শি মরে গুলি খাইয়া, আপনে জানেন না?’
ওসমান চুপচাপ তার সঙ্গে হাঁটে। জবাব দেওয়াটা রিস্কি, কিন্তু জিগ্যেস করলেই তো তার অজ্ঞতা আরো স্পষ্ট হবে। রহমতউল্লা কথা বলে একাই, ‘রাইত ভইরা থানা-হাসপাতাল, হাসপাতাল-থানা না করলে লাশ পাইতাম?’ সিঁড়ির গোড়ায় এসে দারোগাকে দেখিয়ে বলে, ‘সামাদ সাহেব না থাকলের লাশ অহন কৈ পইড়া থাকতো!’
দোতলায় ও তিনতলার সরু বারান্দায় রেকিঙ ধরে দাঁড়িয়ে লোকজন ওদের দেখছে। দোতলায় উঠে ডানদিকে বারান্দার পাশে দরজার সামনে এসে সবাই দাঁড়ালো। ২টো ঘরের জন্যে পাশাপাশি দুটো দরজা। ১টি পরিবার এই ঘর ২টো ও সামনের বারান্দা ব্যবহারের অধিকারী। বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলে হার্ডবোর্ডের পার্টিশন। এখান থেকে অন্য ১টি পরিবারের সীমানা শুরু হলো। ফের পাশাপাশি ২টো দরজা, শেষ দরজার পর একই রকম পার্টিশন, তবে ক্যানভাসের। ক্যানভাসের সঙ্গে লাগানো দরজা বন্ধ। খাকি ক্যানভাসে সাদা চকখড়িতে আঁকা ১টি ল্যান্ডস্কেপ। রোগা ১টি নদীর তীরে লম্বা তালগাছের মাথায় সূর্য। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত যে কোনো দৃশ্য হতে পারে। সূর্যের অনেকটা ওপর দিয়ে ৫/৬টা সাহসী পাখির ঝাঁক। দুঃসাহসী পাখিদের ওপর এবং নদীর নিচে চুন ও কানির দাগ এবং কয়েকটা বাঙলা ও ইংরেজি অক্ষর। স্পষ্ট ও গোটাগোটা ইংরেজি হরফে লেখা একটি নাম ওসমানের মাথায় খচখচ করে বেঁধে, নামটি এবং খচখচ ভাবটি তার মাথায়া দানা বাঁধে, তার চুল একটু খাড়া হয় এবং সে পড়ে, ‘রঞ্জু’। ওটা ওসমানের নিজেরই ডাকনাম। অস্পষ্ট একটি উদ্বেগ তার গলায় আটকে থাকে। তবে বেশিক্ষণ নয়। কারণ নতুন ঝামেলা মাথায় খামচাতে শুরু করে; যে লোক বাড়ির সামনে এতো বড়ো করে নিজের নাম লিখে রাখে সেই কিনা নিহত হয় পুলিসের হাতে!
বাড়িওয়ালা ডাকে, ‘রঞ্জু।’ ওসমানের বুকে এই ডাক ভুতুড়ে প্রতিধ্বনি তোলে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে সকালবেলার সেই ছেলেটি। ওর চোখের লাল চিকন রেখাগুলো সব একাকার হয়ে গেছে। নাকের ডগা তার ভিজে ভিজে এবং ঠোঁটজোড়া শুকনা ও বেগুনী। তাহলে রঞ্জু ও নিহত ব্যক্তি এক নয়, নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই হলো রঞ্জু এবং রঞ্জু এখনো জীবিত—এই বুঝতে পেরে ওসমান আরাম পায়। এখন রঞ্জুর ভালো নাম জানতে ইচ্ছা করে। ও কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, কি খেলতে ভালোবাসে? কিন্তু এখন এসব জানবার উপায় নাই। তাই সে সোজা ঘরের ভেতর দেখতে শুরু করলো।
ঘরে কি?—দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ২জন পুলিস। দারোগাকে দেখে তারা হাত তুলে স্যালুট করে। বড্ডো আঁটোসাঁটো ঘর, স্যালুট করতে গিয়ে ১জনের হাতের কনুই দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খায়, বেচারার স্যালুটরত হাতের পাতা একটু একটু কাঁপে। ঘরে আর কি?—তক্তপোষ এলোমেলো বিছানা। ২জন লোক সেখানে বসে ছিলো। এবার উঠে দাঁড়ালো। এদের ১জন, বয়স ৫০ এর ওপর, ৫৫ বোধ হয় হয়নি, তার পরনে সবুজ চেক লুঙ্গি, তার খয়েরি এণ্ডির চাদরের নিচে কোথাও কোথাও সাদা পাঞ্জাবির আভাস। এক পা তুলে ফের মেঝেতে রেখে সে বলে, ‘স্লামালেকুম। ওসি সায়েব ভালো আছেন?’
দারোগার মুখে থেকে বিড়বিড় ধ্বনি যা বেরোয় তা থেকে নানা ধরনের বাক্য গঠিত হতে পারে, যেমন, ‘আর ভাই থাকা!’ অথবা ‘আমাদের আবার ভালো!’ অথবা ‘আল্লা রেখেছে ভাই!’
রহমতউল্লা লোকটিকে জিগ্যেস করে, ‘রিয়াজউদ্দিন সায়েব, সব হইছে?’
রিয়াজউদ্দিনের জবাবের জন্যে কিছুমাত্র অপেক্ষা না করে রঞ্জুর ডান হাত ধরে রহমতউল্লা ভেতরের ঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এই ঘরে ফিরে এসে বলে, ‘দারোগা সায়েব, আসতে পারেন। আসেন।’
‘কমপ্লিট? মুর্দাকে গোসল করানো হয়েছে?’ দারোগার প্রশ্নের জবাব দিয়ে রিয়াজউদ্দিন ফিসফিস করে মাত্র কয়েকটি শব্দ বলে। তারপর কন্যাকর্তার বিনয় ও আতিথ্য গলায় তুলে নিয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করে, ‘আসেন, আপনেরা আসেন!’
এই ঘরটি আবার বাঁশের বেড়া দিয়ে বিভক্ত। ঘরের এপারে মেঝেতে একটি মাদুরে কয়েকজন মেয়েমানুষ। নেকাব পর্যন্ত ঝোলানো বোরখাপরা ১ মহিলা কাঁদো কাঁদো গলায় কোরান শরীফ পড়ছে। জড়সড় হয়ে শুয়ে রয়েছে ১ মহিলা; ১ তরুণী তালপাতার পাখা এবং ১ প্রৌঢ়া গামছ দিয়ে তার মাথায় হাওয়া করছে। শুয়ে থাকা মহিলার গলা থেকে একটানা আওয়াজ বেরোয়। কখনো কখনো তার স্বর অস্পষ্ট হয়ে গেলে অনেক দূরে এবড়োথেবড়ো মাঠে গরুর গাড়ি চলার রেশ আসে। আরেকজন কিশোরীকে জড়িয়ে ধরে ১৬/১৭ বছরের ১টি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লোকজন ঢুকলে তার ফোঁপানি মৃদু হয়ে আসে। মাদুরের প্রান্তে ১ বছরের ১শিশু অঘোরে ঘুমায়। তার পরনের জাঙ্গিয়া পেচ্ছাবে ভিজে গেছে। শিশুর হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ১টি চাবি। তার মুখের কাছে দুটো মাছি ওড়ে। শিশুটির পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে হলুদ, সাদা ও খয়েরি ছোপ-লাগা বিবর্ণ সবুজ পর্দা।
দারোগার নেতৃত্বে সমবেত জনতা পর্দা অতিক্রম করে। এটাই ফাইনাল জায়গা, এরপর নিরেট দেওয়াল। গুলিবিদ্ধ নিহত যুবক ঠিক এখানেই অবস্থান করে। ওসমানের শরীরের রক্তপ্রবাহ তার করোটির ছাদে উদ্বন্ধন তোলে, তার চোখের ঘন খয়েরি রঙের মণি ও ভেতরকার রেটিনাসমূহ এখন খুব তৎপর। এমনি জিনিসপত্র দ্যাখার জন্যে চোখের এই বাড়াবাড়ি রকম তৎপরতার দরকার হয় না। একনিষ্ঠ মনোযোগী হলে ওসমান দ্যাখে যে, ছাদের ঠিক নিচেই গুলিবিদ্ধ ১টি যুবক দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা। যুবক অল্পবয়েসী, শরীরের চামড়া কাঁচা ও টাটকা। .৩০৩ রাইফেলের একটি গুলি তার বুককে গেঁথে রেখেছে দেওয়ালের সঙ্গে। মাথাটা বাঁ দিকে ঝুলছে। বুকের নিচে তার দীর্ঘ শরীর রেলিঙে মেলে দেওয়া শাড়ির মতো আস্তে আস্তে কাঁপে। শীতেও কাঁপতে পারে, বাতাসেও কাঁপতে পারে। যুবকের মুখ হাঁ করা, মনে হয় প্রচণ্ড ১টি চিৎকার সেখানে জমে রয়েছে; বলা যায় না, যে কোনো-সময় এই পুরনো দালান ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কোটর থেকে ছিটকে-পড়া কালো মণিজোড়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রয়েছে, তারা যেন গোগ্রাসে সব দেখছে! তার কালো ২টো হাত ডানদিকে ও বামদিকে শক্ত ১ জোড়া রডের মতো ঝোলানো। সেই ২ হাতের প্রতিটির সঙ্গে গুলি দিয়ে গাঁথা আরো ২জন যুবক। যুবক ২জন যমজ, ২জনেই অল্পবয়সী, ২জনেরই চামড়া কাঁচা ও টাটকা। এদেরও একেক জোড়া চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটরের ভেতর থেকে, বেরিয়ে-আসা মণিগুলো যেন পরিচিত ও অপরিচিত যাবতীয় দৃশ্য দ্যাখার জন্য অস্থির। ২জনেরই হাঁ করা মুখে সুপ্ত চিৎকার যে কোনো সময় বেরিয়ে ছাদ ফাটিয়ে ফেলতে পারে। তাদের ২জনের লোহার রডের মতো ২ জোড়া হাতে নিচের দিকে বাড়ানো। আবার দ্যাখো, রডের মতো সেই ২জোড়া হাতের সঙ্গে .৩০৩ রাইফেলের গুলি গাঁথা আরো ৪ জন যুবকের লাশ। কে বলবে এরা আলাদা লোক? অবিকল একরকম দেখতে ৪ জন যুবকের কোমরে থেকে নিচের দিক শীতে কি বাতাসে একটু একটু কাঁপে। গ্রোগ্রাসে সব কিছু দেখে নেওয়ার জন্য কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে ৪ জনের ৪জোড়া চোখের ৮টা মণি। একই রকম দেখতে ৪টে মুখে স্থগিত রয়েছে ৪টে দারুণ চিৎকার। এই ৪ জন আর আগের ৩ জন—মোট ৭ জনের চিৎকারে ঘরবাড়ি দালানকোঠা রাস্তাঘাট ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে না? এখানেই শেষ নয়। এই শেষ ৪ জনের লোহার রডের মতো হাতে গাঁথা রয়েছে গুলিবিদ্ধ আরো ৮ জনের মৃতদেহ। ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এরা মেঝে ফুঁড়ে নিচে নেমেছে। নিচে-নেমে-যাওয়া গুলিবিদ্ধ মানুষের দীর্ঘ সিঁড়ির শেষ দেখবে বলে নিচের দিকে তাকালে ওসমানের চোখে পড়ে সাদা ও খয়েরি চুন-সুরকির মেঝেতে কালচে-নীল কালিতে ছড়ানো মানচিত্র, ছোপ ছোপ কালো দাগ, দেশলাইয়ের পোড়াকাঠি, দাঁত দিয়ে কামড়ানো পেন্সিলের টুকরা এবং ১ পাটি স্যাণ্ডেল ও ১ পাটি জুতো। বুলেট-সাঁটা মৃতদেহের সিঁড়ি দ্যাখার ভয় ও উদ্বেগ এক মুহূর্তে উবে যাওয়ায় ওসমানের শরীর একেবারে তলিয়ে পড়তে চায়। তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। ভাবে, যাই নিজের ঘরে গিয়ে আধ ঘণ্টা একটু শুয়ে থাকি। কিন্তু ঘর ভরা মানুষ। এদের এড়িয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার জো নাই; না, ফিরে কাজ নাই। সকাল বেলার দৈনন্দিন এ্যাসিডিটি বা বুলেট-বেঁধা মানুষ দ্যাখার জন্যে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া যে-কোনো কারণে তার পেটের বাদিকটা ব্যাথায় চিনচিন করে ওঠে। ব্যথায় একটুখানি নুয়ে পড়লে চোখে পড়ে সামনের তক্তোপোষে ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু চাদর। তক্তপোষের চারদিকে সবাই দাঁড়াচ্ছে। একটু নেতৃস্থানীয়েরা দাঁড়ায় শিয়রের দিকে। এই রকম নিজ নিজ পজিশন ঠিক করছে, এমন সময় ঘরে ঢোকে আলাউদ্দিন। ৩০-এর ওপর বয়স, লোকটাকে ওসমান ভালো করে চেনে, বাড়িওয়ালা রহমতউল্লাহর ভাগ্নে সে, একবার ওসমানের কাছে এসেছিলো মামার হয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে। এরপর এসেছে ‘মিথ্যা আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের সহায়তাকারী নাগরিক কমিটি’র চাঁদা নিতে। আলাউদ্দিনের পেছনে ঢুকলো হাড্‌ডি খিজির। আলাউদ্দিনের কয়েকটি রিকশা ও ২টি স্কুটারের দ্যাখাশোনা করার ভাগ খিরিজের ওপরে। এই লোকটি খুব লম্বা, তবে তার নামের আগে উপাধিটি অর্জন করেছে তার অস্থিসর্বস্ব দেহের জন্য। তার হাতে সবসময় স্ক্রু ড্রাইভার ও প্লায়ার থাকে। কিন্তু এখন ১ হাতে আগরবাতি ও অন্য হাতে ১টি ঠোঙা। সবাইকে ওভারটেক করে খিজির সামনে আসে এবং তক্তপোষের ৪দিকে এ-ফাঁকে ও-ফোকরে কয়েকটি করে আগরবাতির কাঠি গুঁজে দেয়। ‘বেটা আগে জ্বালাইয়া লইবি তো!’ বলে আলাউদ্দিন দেশলাই ঠুকে আগরবারিগুলো ধরিয়ে দিয়ে হাল্কা ছাই রঙের ধোঁয়া ও গন্ধে ঘরের শূন্যতা এবং প্রাণী ও অপ্রাণিবাচক সমস্ত বস্তু মৃতের প্রতি নিবেদিতচিত্ত হয়। দারোগার ইঙ্গিতে রহমতউল্লা ঢেউ খেলানো চাদর তুলে ধরলো। চাদরের নিচে সাদা কাফনে জড়ানো মৃতদেহের মুখের কাপড়টিও আস্তে করে ওঠানো হয়।

চিলেকোঠার সেপাই – ০২

শ্যামবর্ণের রোগা ভাঙা গালওয়ালা এই লোকটিকে ওসমান অনেকবার দেখেছে। কোথায়? এই বাড়ির সিঁড়িতে? তাই হবে। আরো অনেক জায়গায় এর সঙ্গে দ্যাখা হয়েছে। কোথায়? স্টেডিয়ামে? হতে পারে। গুলিস্তানের সামনে সিনেমার পোস্টার দেখতে দেখতে হতে পারে। পল্টন ময়দানের মিটিঙের হতে পারে। ভিক্টেরিয়া পার্কে? আর্মানিটোলা মাঠের ধারে? ঠাঁটারি বাজারের রাস্তার ধারে বসে শিককাবাব খেতে খেতে? হতে পারে। বলাক সিনেমায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে? হতে পারে। নবাবপুরে অনেক রাতে ঠেলাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হালিম খেতে খেতে? আমজাদিয়ায় পাশের টেবিলে তর্ক করতে করতে? হতে পারে। মুখটা তার অনেকদিনের চেনা। নাকের ২পাশে ব্রণের দাগ, ২টো দাগ বেশ গভীর, এগুলো কি বসন্তের বন্ধ-করা চোখের পাতার প্রান্তে বড়ো ঘন কালো পল্লব। নাকের ডগায় ও পাতলা ঠোঁটে কালচে ছাপ। এলোমেলো চুলের এদিকে ছোটো কপালে ১টি ভাঁজও নাই। খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখলে বোঝা যায় এগুলো বেশ নরম। বয়স বোধ হয় ২০/২১-এর বেশি নয়, লোকটার পূর্ণ যৌবনকাল চলছিলো। তার চেয়ে ৫/৬ বছর ছোটো, একেবারে গড়পরতা চেহারা বলেই হয়তো এতো চেনা চেনা ঠেকে,-আর সে কিনা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরার মর্যাদা পায়। ওসমান একটু কুঁকড়ে বাইরে তাকায়। বাইরে বৃষ্টি নাই, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রোদ ঝকঝক করে। অথচ তার বাইরে যাবার উপায় নাই। দারোগা বলে, ‘আপনেরা ঐ ঘরে একটু বসেন। আধঘণ্টার ভেতর আপনাদের ছেড়ে দেবো।
ছেড়ে দেবে মানে? তারা কি তবে বন্দি পাশের ঘরে এসে রিয়াজউদ্দিন হাতলভাঙা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকায়। অন্য চেয়ারটিতে চশমা পরা একজন বেটে লোক । তক্তপোষে ওসমান এবং আরেকজন। লাল স্ট্রাইপের হাঙ্কা গোলাপি শার্ট ও পাজামা পরা এই যুবক হলো পারভেজ, তিনতলার ডানদিকে থাকে, মুখের গঠন ও বাঙলা বলার সময় যত্ন থেকে বোঝা যায় যে, তার মাতৃভাষা বাঙলা নয়। রিয়াজউদ্দিন সাহাব, এইতো পর্যু দুপুরবেলা আমি দেখলাম কে জুম্মার পর ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ঘোড়ার গাড়িতেই স্ট্রাইকের এ্যানাউন্সমেন্ট চলছে আর তালেব বহুত গওর করে শুনছে। আমাকে দেখে বললে৷ কে, পারভেজ ভাই, মওলানা ভাসানী স্ট্রাইক কল করেছে, কাল কি আর অফিস উফিস চলবে?”
কি যে শুরু হইলো, ডেলি ডেলি হরতাল, ডেলি ডেলি ইস্ট্রাইকা’ রিয়াজউদিনের এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য শেষ না হতেই পারভেজ বলে, কালকেই তো, আমি দোকানে যাচ্ছি, দেখি আলি নেওয়াজের সেলুনে বসে তালেব ফিলিম ফেয়ার পড়ছে। তো বললো কি, আজ কৈ যান? আজ না স্ট্রাইক!’
“স্ট্রাইক তো সাকসেসফুল! কিছু দালাল বাদ দিলে কাল অফিস ব্যাকটি বন্ধই আছিলো।’ আলাউদ্দিন এবার এঘরে এসে তক্তপোষে বসে রিয়াজউদ্দিনকে লক্ষ করে একটু খোটা দেয়, ‘পাবলিকরে এইবার ঠেকা দেওয়া কাউরো কাম না।”
পারভেজ বলে, ‘জী। রাত্রে আমার ভাই বললো কে নীলখেতে গুলি হয়েছে, আমার সিস্টারের হাজব্যান্ড এসে বললো, হাতিরপুলের পাওয়ার স্টেশনের এক এমপ্লয়ি তো ডেথ হয়ে গেল। আমি ইম্যাজিন করতে পারলাম না কে আমাদের তালেব-‘ বাক্যের শেষদিকে তার গলা নোনা পানিতে ছলছল করে। তারপর প্রায় মিনিটখানেকের নীরবতা, পাশের কামরার দারোগা ও রহমতউল্লার নিচু স্বরের সংলাপে কিংবা মেয়েদের বিলাপে সেই নীরবতায় একটি টিলও পড়ে না। রিয়াজউদ্দিন হঠাৎ খসখসে গলায় ডাকে, আল্লা, আল্লাহু গনি। তার ডাকার ভঙ্গি দেখে মনে হয় যে, সম্বোধিত আল্লা বোধ হয় বারান্দায় কি পাশের কামরায় তার হুকুমের জন্যে প্রতীক্ষা করছে, আরেকবার হাক দিলেই মুখের বিড়িটা কানে ওঁজে এই ঘরে ছুটে আসবে। কিন্তু এবার ঘরে ঢোকে হাড়ডি খিজির, লোকটা আস্তে কথা বলতে পারে না, কাল গুলিতে মনে লয় সাত আষ্টজনের কম মরে নাই। তার এই কথায় সারা ঘর গমগম করে ওঠে। চশমাওয়ালা বেঁটে লোকটি বলে, ‘মরে কারা? এই মিছিল কন, মিটিং কন, ব্রিটিশ আমল থেকেই তো দেখছি। মরে কারা? সকলের দিকে সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়, কিন্তু জবাবও দেয় সে নিজেই, “ভালো নিরীহ মানুষগুলো মরে। কৈ কোনো লিডার তো কখনো গুলিতে মরে না! মরতে হয়—।”
তালেৰ বেচারা খুব সিম্পল টাইপের ছিলো। আমি তো চার বছর থেকে দেখছি।” ‘আরে আমি চিনি ঐ পোলায় তখন ন্যাংটা থাকে। রিয়াজউদ্দিনের খসখসে গলা এবার আত্মবিশ্বাসে বেশ মসৃণ হয়েছে, ইসলামপুরে আমার কাটা কাপড়ের দোকান। আমার দোকানের লগেই গল্লি, লেন, ঐ গল্লির চাইরটা, না একটা দুইটা তিনটা বাড়ি পার হইলেই মতিহাজীর বাড়ি, ঐ বাড়ির দোতলায় অরা ভাড়া থাকতো! তালেবের বাপে আমার দোকানে কতো আইছে!” তালেব, এমন কি তার বাবাকেও চেনবার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা পারভেজের চেয়ে পুরনো—এই তথ্যটি ঘোষণা করে রিয়াজউদ্দিন নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়। চশমাওয়ালা বেঁটে নতুন ভাড়াটে, এখন পর্যন্ত কারো সঙ্গে তার তেমন আলাপও হয়নি। সুতরাং তালেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রচারের প্রতিযোগিতায় নামা তার পক্ষে অসম্ভব। লোকটি হরতাল ও মিছিল সম্বন্ধে তার মতামত নতুন করে ব্যাখ্যা করে, খালি হরতাল, খালি মিছিল। দোকানপাট বন্ধ, অফিস বন্ধ, দেশের ডেভেলপমেন্ট হবে কি করে?
বুঝলাম তো আলাউদ্দিন তক্তপোষে ভালো করে বসতে বসতে উত্তেজিত গলায় জবাব দেয়, স্ট্রাইক করা মানুষের সিভিল রাইট। কিন্তু স্ট্রাইক করলে গুলি কইরা মানুষ মারতে হইৰো-এই জংলি এ্যাকশন কোন দ্যাশে দেখছেন? গলা একটু নিচু করে বলে, এদের এ্যাকটিভিটি হইল একটাই, মানুষরে যেমনে পারো জুলুম করো’
কি পাবলিক রাউডি হয়ে উঠলে—। চশমাওয়ালাকে প্রায় ধমক দিয়ে আলাউদ্দিন ৰঙ্গে ওঠে, কি বাজে কথা কন দেখতাছেন না, আমাগো ব্যাকটিরে কেমুন কায়দা কইরা আটকাইয়া রাখলো। কতোক্ষণ? ইসটুডেনরা ছাড়বো? গুলি কইরা মানুষ মারে, ইসটুডেনরা আইয়া পড়বো না?
ক্যামনে আহে? খিজিরের চড়া গলায় সবাই উসখুস করে, কিন্তু তার বাক্য অব্যাহত থাকে, ক্যামনে আইবো? ঘরের মইদ্যে পুলিস, রাস্তার উপরে পুলিস বিচরাইয়া দ্যাহেন, ছাদের উপরে ভি হালার পুলিস? ইসটুডেনে আইলে এই হালাগো ইষ্ণু টাইট করতে পারতো!”
পারভেজ বলে, “পুলিস যেখানে সেখানেই বহুত হুজ্জত।’ “আপনার আবার ভর কিয়ের? হালারা সইজ্য করবার পারে না খালি বাঙালিগো।” আলাউদিনের এই অভিযোগে পারভেজ একটু জড়সড় হয়। ওসমানের রাগ হয় পুলিসের ওপর। তার ইচ্ছা করে, বারান্দা থেকে রাস্তার মানুষকে ডাক দেয়, গতকাল হরতালের দিন পুলিসের গুলিবর্ষণে নিহত তালেবের লাশ এখানে। সবাই আসুক। স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে নিহত শহীদ তালেবের—। বাসনাটি তার মনেই থেকে যায়। রহমতউল্লা এই ঘরে এসে খিজিরের ওপর চড় মারার ভঙ্গিতে হাত তোলে, ‘খামোশ মাইরা থাক। তুই বেটা কি বোঝস? হাড়ডি খিজির চুপ করে থাকে। সে অবশ্য বেশ লম্বা, একটি টুলে না দাড়ালে তার গালে চড় মারা বাড়িওয়ালার পক্ষে অসম্ভব। বাড়িওয়ালার চাচামেচিতে ওসমানের অস্বস্তি ঠেকে। ইসলামিয়ায় এখন পায়া বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে, ওদিকে সেন্ট্রাল হোটেলের পায়াটা ভালো, এখন রওয়ানা হলে অবশ্য ওখানে পৌছতে পৌছতে পায়া আর না-ও থাকতে পারে। তা হোক, নিগারে পরোটা-কলেজি মেরে আমজাদিয়ায় গিয়ে চমৎকার আড্ডা জমাতে পারতো। গতকাল গুলি চলেছে; নবাবপুর, গুলিস্তান, স্টেডিয়াম আজ নিশ্চয়ই খুব সরগরম। রবিবারের সকালটা পুলিসের হাতে মাঠে মারা গেলো।
হঠাৎ করে ১৮/১৯ বছরের ২ জন যুবক এই ঘরে ঢোকে। এদের ১ জনের সঙ্গে ওসমানের আলাপ আছে। এর নাম শাহাদত হোসেন ঝন্টু। ইউনিভারসিটিতে ইকনমিক্স পড়ে। শাহাদত হোসেন ঝন্টু ও তার সঙ্গীর উত্তেজিত ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যে, ব্যাপারটাকে এরা সহজে ছাড়বে না। পুলিসকে এড়িয়ে কিংবা পুলিসকে রাজি করিয়ে এরা এখানে যখন এসে পড়েছে তখন শালার হেস্তনেস্ত একটা না করে আর যাচ্ছে না। ওসমান ৰেশ চাঙা বোধ করে, কিন্তু ঝামেলা একটা হলে তাকেও ফের জড়িয়ে পড়তে না হয়।
“তোমাগো আওনের টাইম হইলো অহন।’ বলতে বলতে আলাউদ্দিন পাশের ঘরের দিকে আঙুল দ্যাখায়।
বটতলায় মিটিও। মিটিও এখানে চলছে।” বলে শাহাদত হোসেন ঝন্টু ও তার সঙ্গী পর্দা তুলে ভেতরে চলে যায়। ওসমান তাদের কারো নজরে পড়ে না। তাদের জন্য তৈরি মুখের বিশেষ ভঙ্গি শিথিল করে ওসমান পরবর্তী ঘটনার প্রতীক্ষা করে। ভয়ে বা ভক্তিতে বা এমনি নিয়ম পালনের খাতিরে রিয়াজউদ্দিন জোরে জোরে বলে, “আল্লা আল্লাহু গনি। এই ধ্বনিসমষ্টি দরজা দিয়ে বাইরে উধাও হয়। ঘরের সবাই এখন তাকিয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। রিয়াজউদিনের ভাঙা ভাঙা মোটা গলার আওয়াজ বারান্দায় দাঁড়ানো লোকজন, পুলিস ও পার্টিশনের ক্যানভাসে আঁকা নদী, তালগাছ, সূর্য ও সাহসী পাখিদের কাপিয়ে ধাবিত হয় শূন্যতার দিকে। সেখানে রোদ ঝকঝক করে। পাশের ঘরে ছাত্র-নেতাদের একজন বলছে, বায়তুল মোকাররমে জানাজার পর দাফন হবে।’
জবাবে রহমতউল্লার স্বর ঠাণ্ডা ও শান্ত, “আরে বাবারা, চ্যাতেন ক্যান? গোসল টোসল কমপিলিট। গোরস্থানে খবর গেছে, কবর খোড়ার কাম চলতাছে। জানাজা হইবো ওহানেই। এর মইদ্যে পলিটিক্স ঢোকাইতে চান ক্যান?
‘পলিটিক্সের কি দেখলেন? আমরা অলরেডি এ্যানাউন্স করে দিয়েছি, জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে জানাজা, জানাজার পর আজিমপুর গোরস্থানে দাফন হবে। শাহাদতের এসব কথা বেশ গুছিয়ে-বলা। দারোগার স্বরও বেশ শান্ত, ছেলেমানুষি করছেন কেন? আপনারা এডুকেটেড লোক, হাইয়েস্ট এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র। জানেন না মুর্দাকে ইজ্জত করতে হয়? মুর্দার সামনে হৈচৈ করলে গোর আজাবের চেয়েও মুর্দা বেশি তকলিফ পায়।’
এ ঘরে আলাউদ্দিন উত্তেজনায় কাপে, ‘দারোগা সায়েব অহন দেহি মৌলবি ভি হইবার চায়! কেমুন ফতোয়া দিতাছে দ্যাহেন।
ও ঘরে বাড়িওয়ালা হঠাৎ বলে, চলেন, এই ঘর ছাইড়া যাই। বেচারা পোলটারে এটু আরামে থাকতে দেন। মৃত তালেবের স্বস্তির জন্য সবাইকে নিয়ে সে ঐ ঘর ছেড়ে চলে আসে। শাহাদত হোসেন ঝন্টু এবার ওসমানকে দেখেছে। কিন্তু দারোগার সঙ্গে কথা বলতেই সে ব্যস্ত। দারোগা কিছুতেই ওদের হাতে লাশ দেবে না, ‘ডেডবডি দিতে পারবো না ভাই। অর্ডার না থাকলে আমরা কি করবো? এদিক ওদিক তাকিয়ে সে বাড়িওয়ালার দিকে তাকায়, মুর্দার গার্জেনের রিকোয়েস্টে আমরা হেল্প করতে এসেছি।
এবার বাড়িওয়ালার গলা হঠাৎ একটু নিচে নামে, আমার ভাইস্তার লাশ আমরা জোহরের আগেই দাফন করতে চাই ।
আপনি কি ওর চাচা? শাহাদত এবার রহমতউল্লাকে বোঝাবার উদ্যোগ নেয়, তাহলে আপনি বুঝবেন। বায়তুল মোকাররম নামাজের পর কতো লোকে তার জানাজা পড়বে। শহীদের লাশ দাফন হবে কাউকে না জানিয়ে এটা কি ঠিক হবে?
“আমাগো উপরে আর জুলুম কইরেন না। রহমতউল্লার চোখজোড়া ছল ছল করে, বহুত গজব পড়তাছে, দ্যাখেন না কই আছে পোলার বাপ, আর পোলায় মরে গুলি খাইয়া।’ নোনাপানিতে তার গলা ভেজে, অর বাপের বয়স হইতাছে। তামামটা জিন্দেগি কাটলো পরের দোকানে গোলামি কইরা, টাঙাইল থাইকা আইয়া দেখবো- এবার সে একেবারে কেদেই ফেললো। রহমতউল্লার কান্না ভেতর-ঘরের মেয়েদের চাপাকান্নায় ইন্ধন জোগায়, তারা জোরে জোরে কাদার সাহস পায়। তালেবের বাবা এসে কি দৃশ্য দেখবে ভেবে ওসমানের কান্না পাওয়ার দশা ঘটে। তবে তার চোখে নোনা ভাপ ওঠার আগেই আলাউদ্দিন ঠাণ্ডা ও নোনামুক্ত স্বরে বলে, এর বাপে তো আউজকাই আইয়া পড়বো। বাপেরে একবার দ্যাখাইবেন না?
কি একটা কথা যে কইলা? রহমতউল্লা ভাগ্নের ওপর বিরক্ত হয়েছে, এর মধ্যেই তার গলা থেকে বিলাপ লুপ্ত হয়ে গেছে, তার বাপে গেছে টাঙাইল। মাহাজনের লাইগা কাপড় কিনবো-বাজিতপুর, বল্লা, কালিহাতি, পোড়াবাড়ি,-চাইরটা পাঁচটা হাট সারবো, কাপড় লইবো, কাপড়ের গাইট করবো, গাইট আবার তুলবো টেরাকের উপর। আরো দুই চাইর দিনের কম না। লাশ পইড়া থাকবো?
শাহাদতের সঙ্গী ছেলেটি প্রায় মিনতি করে, আমরা দুদিন তিনদিন চাই না। এই ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যে জোহারের নামাজ, নামাজের পর জানাজা। কতোক্ষণ লাগবে? এতোগুলো লোক অপেক্ষা করবে।’
বাড়িওয়ালার গলা ফের চড়ে যায়, তার হাত এখন বেশ শক্ত, তার বাপে থাকলে আপনেরা কইয়া দেখতে পারতেন। আর মায়ে কি কইবো, কন? আমি কি আর লাশ লইয়া মিছিল করবার দিবার পারি?
ওসমান গনি তখন ভেতরে তাকাবার চেষ্টা করে। রঞ্জকে ডেকে একবার বললে হতে না? তার ভাইকে যারা হত্যা করে তাকে দাফন করার ভারও তাদেরই হাতে থাকবে? কিন্তু রঞ্জু কোথায়? ভেতরকার কান্নাকাটিতে রঞ্জুর গলা আলাদা করে ঠাহর করা মুশকিল। আহা, ভাইয়ের জন্য কেঁদে কেঁদে বেচারার চোখজোড়া একেবারে লাল হয়ে গেছে! ওর লাল চোখ এবং নীলচে ঠোট নিয়ে রঞ্জু কি একবার আসতে পারে না? এলিফ্যান্ট রোড তো এখান থেকে মেলা দূরে! সেই রাস্তা ধরে গেলে হাতিরপুল পাওয়ার স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাইয়ের কথা ভেবে রঞ্জুর মনটা খারাপ হয়ে যাবে। ১০/১১ বছর আগে ওসমান কিছুদিন সেন্ট্রাল রোডে ছিলো। পুরনো এলিফ্যান্ট রোড তখন ফাঁকা ফাঁকা, দুইদিকে কোথাও কোথাও বাড়িঘর তৈরি সবেমাত্র শুরু হয়েছে। রাস্তার ২দিকে বেশির ভাগই নিচু জায়গা, ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে পানিতে মুখ পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে থাকতো কালো কালো মোষ । সন্ধ্যাবেলা নিউমার্কেট থেকে একা একা ঘরে ফেরার সময় ওসমান দেখতে পাওয়ার স্টেশনের চিমনির মাথায় ১টি লাল আলো কোনো গ্রহের মতো স্থির হয়ে জুলছে। ঐ আলোর দিকে তাকিয়ে নির্জন রাস্তায় হাটতে হাটতে রঞ্জুর খুব মন খারাপ করতো। ওখানে চাকরি করতো ওর ভাই তালেব, কথা নাই বার্তা নাই ওখান থেকে বেরিয়ে মিছিলে ঢোকার অপরাধে নীলক্ষেতে তাকে গুলি করা হয়েছে। রঞ্জুর এই মন-খারাপে ওসমানের সারা শরীর ও মাথা শিরশির করে ওঠে। নিহত যুবকের লাশ নিয়ে ২ পক্ষের তর্ক তার কানের পাশ দিয়ে আলোর মতো গড়িয়ে যায়, সে কিছুই শুনতে পারে না।
শাহাদত হোসেন ঝন্টু তাকে জিগ্যেস করে, আপনি এখানে থাকেন? ওসমান তখন ১০/১১ বছর আগে এলিফ্যান্ট রোড ধরে ভ্রাতৃশোকগ্রস্ত রঞ্জুর চলাচল দ্যাখ্যা থেকে ফিরে আসে, বলে, ‘জি। শাহাদত ফের বলে, তিনটায় বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সভা, আসবেন। এখন যাই। দেখি।’ গোরস্থানে আসছি। একটু পরে আসবো।”
তোমরা যাও, জুরাইনে আমি খবর পাঠাইতাছি, গোরস্থানেই জানাজা হইবো, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, মিলব্যারাক থাইকা মানুষ যাইবো। আলাউদ্দিনের এই সব কথা দারোগা বা রহমতউল্লার কানে যায় না, সে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছে। কিন্তু শাহাদতও ভালো করে বুঝলো বলে মনে হয় না। সঙ্গীকে নিয়ে শাহাদত বেরিয়ে গেলে দারোগ বলে, এবার লাশ বের করার ব্যবস্থা করতে হয়। রহমতউল্লার পেছনে পেছনে আলাউদ্দিন ও হাড্‌ডি খিজির ভেতরে চলে যায়। দারোগা এবার সিগ্রেট ধরিয়ে বারান্দা ও ঘরের মাঝখানের চৌকাঠে ১টা পা রেখে বলে, মুর্দার সঙ্গে আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা অনেক কষ্ট করলেন, এবার বাড়ি গিয়ে আরাম করেন। ছাত্র ২টােকে সামলাতে পারার সাফল্যে দারোগা সিগ্রেটে কষে টান দেয়, ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসপাতালে এই লাশ গেছে আসরের নামাজের আগে। রাত যখন বারোটা তখনও পোস্ট মর্টেম কমপ্লিট হয়নি। কেন? ডাক্তার নেই। ডোমও পেলেন ডাক্তারও পেলেন তো কারেন্ট নেই। এদিকে ডিআইজি সাহেব বারবার বলে পাঠাচ্ছেন ভোর হবার আগে হাসপাতাল থেকে ডেডবডি বের করতে না পারলে ছাত্ররা একটা চান্স পেয়ে যাবে। রিয়াজউদ্দিন তার কিস্তিটুপিওয়ালা মাথা নাড়িয়ে দারোগাকে সমর্থন করে। দারোগার কথা শেষ হলেও তার মাথা নাড়ানো আর থামে না। তারপর সে শুরু করে জিভ নাড়াতে, ‘কাম পাইবেন কৈ? কৈ পাইবেন? ডাক্তারগুলির কথা কি কই? কয়দিন আগে ডাক্তাররা ইস্ট্রাইক করলো না? শুনছেন? —কুনো দাশের ডাক্তারে ইস্ট্রাইক করছে শুনছেন?
এদের কথা আর বলবেন না। দারোগা তার অসমাপ্ত বক্তৃতা সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়, আমার এসপি সাহেব বলে, হাসপাতাল থেকে লাশ সরান ! লাশ সরান। সকাল হলে এই ডাক্তাররাই ছাত্রদের ইনফর্ম করবে। চশমাওয়ালা বেঁটেও তার সায় জানায়, এরা লাশ নিয়ে পলিটিক্স করে, মুর্দার ইজ্জত করতে জানে না, এদের দিয়ে কি হবে, বলেন।’
দারোগা হয়তো আরো কথা বলতো, কিন্তু ভেতর থেকে কান্নার প্রবল রকম একটি দমক ওঠায় সবইকে চুপ করতে হয়।
লাশের খাটিয়া কাধে তুলে নেয় রহমতউল্লা, রিয়াজউদ্দিন, আলাউদ্দিন ও ওসমান।
সইরা দাঁড়ান, সইরা দাড়ান’ বাড়িওয়ালার এই নির্দেশে সমবেত কান্নার ধ্বনি সমগ্র বাড়ি উপচে বাইরে গড়ায়।
কৈ যাও? ও আব্বাজান, বাবা আমার বাবারে লইয়া আপনেরা কৈ মেলা করলেন? নিহত যুবকের মায়ের বিলাপে খাটিয়া ভারি হয়ে উঠেছে। হাড়ডি খিজির সামনে যেতে যেতে আস্তে’, ‘ডাইনে’, এটু বামে যান প্রভৃতি নির্দেশ দিচ্ছে। ওসমানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে পারভেজ। ওর খুব ইচ্ছা তালেবের শরীরটা একবার একটু বহন করে। আলাউদিনের দিকে সে আড়চোখে দেখছে। আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু বলতে বলতে রহমতউল্লা খিজিরের কাধে খাটিয়ার ১টি অংশ চড়িয়ে দেয়। খাটিয়ার পেছনে ২জন পুলিস। ১জন পুলিস ওসমানের কাছ থেকে খাটিয়ার ১টি অংশ নিজের ঘাড়ে নেয়, আর ১জন পুলিস নেয় আলাউদিনের ঘাড় থেকে। ওসমান এবার সবচেয়ে পেছনে। না, তারও পেছনে আসছে রঞ্জ, রঞ্জুর ঘাড়ে হাত দিয়ে রেখেছে পারভেজ। সিঁড়ির অন্ধকার মোড়ে এলে পারভেজকে নজরে পড়ে না। রঙ্গুনিজের দুই হাত কচলাচ্ছে। কেন? ছাইগাদায় লেবুগাছের সামনে রগুকি লেবু পাতা চটকাচ্ছে? খাটিয়া নিচে নামে। ওসমান ভয়ানক রকম বিচলিত হয়ে ভোররাতের স্বপ্ন ও সকালবেলার দৃশ্যের অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। বলা যায় না, সে হয়তো এই অবস্থায় নিচেও পড়ে যেতে পারতো কিন্তু তার আগেই শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না। —এই সমবেত ধ্বনি তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়।
১৭/১৮ জন যুবক ও প্রায় ২৫/৩০ জন পিচ্চি দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। সামনে শাহাদাত হোসেন ঝন্টুর সেই সঙ্গী। দারোগার চোখে কি চালাকি খেলে, খাটিয়া চটপট উঠে পড়ে রাস্তায় দাড়ানো পুলিসের ভ্যানে। ভ্যানে এক এক করে ওঠে রহমতউল্লা, রিয়াজউদ্দিন ও রঞ্জ। আলাউদ্দিন যুবকদের সঙ্গে কি বলছিলো, দারোগা তার পিঠে বেশ সম্ভমের ভঙ্গিতে হাত রেখে বলে, ‘আপনে আমার সঙ্গে আসেন, ওখানে চাপাচাপি হবে।’ তাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে জিপে ওঠানো হলো। পারভেজ নাক ঝাড়ার জন্য উবু হয়েছিলো। ওসমান ভাবছিলো উঠবো কি উঠবো না, উঠলে কোন গাড়িতে এবং কোন দিক দিয়ে উঠবো। —এরই মধ্যে শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবে না’, ‘আইয়ুব শাহী জুলুম শাহী-ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’-এইসব শ্লোগানের ধাক্কায় পুলিসের ভ্যান ও পুলিসের জিপ বাদিকে মোড় নিয়ে হেমেন্দ্র দাস রোড ধরে দ্রুতবেগে চলে যায় লোহার পুলের দিকে। চলন্ত ভ্যানে টাল সামলাতে সামলাতে উঠে পড়েছে হাড্‌ডি খিজির।

চিলেকোঠার সেপাই – ০৩

সুভাষ বোস এ্যাঁভেনু ও হেমেন্দ্র দাস রোডে দোকানপাট সব বন্ধ। উল্টোদিকের মসজিদের বারান্দায় মক্তবে ছেলেমেয়ে নাই। একজন বুড়োমানুষ বারান্দায় একা এক রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে চলেছে। রাস্তা যানবাহনহীন, লোক চলাচল কিন্তু কম নয়। ছাদের সামনের দিককার উঁচু দেওয়ালের ওপার এইসব দেখতে দেখতে ওসমানের একটু উঁচুকরে-রাখা পায়ের পাতা ধরে আসে। ঠাকুর দাস লেনের মাথায় তোতামিয়া ডেকোরেটার্সের গা ঘেঁষে লোহার পোস্টে অজস্র ইলেকট্রিক তারের এলোমেলো ও জটিল সমাহার। ঐখানে একবার পড়ে গেলে তারগুলো সব জ্যান্ত হয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরবে যে, জীবনে আর বেরিয়ে আসা যাবে না। ওসমানের সারা শরীর শিরশির করে। নাঃ! তাড়াতাড়ি অফিস রওয়ানা হওয়া দরকার।
সিঁড়িতে রঞ্জুর সঙ্গে দ্যাখা। সঙ্গে ওর বোন, রঞ্জুর চেহারার সঙ্গে খুব মিল। তবে মেয়েটার গায়ের রং আরেকটু চাপা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের হলে ভালো হতো। সপ্তাহ দেড়েক আগে একদিন সন্ধ্যায় ওদের ঘরে মেয়েটিকে ওসমান ভালো করে দেখেছে। তখন কিন্তু রঙটঙ নিয়ে এসব কথা মনে হয়নি। সেদিন তালেবের কুলখানি হবে শুনে ওসমান আগেভাগেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তালেবের বাবা ওপরের বারান্দা থেকে ডাকতে ডাকতে একেবারে রাস্তায় এসে ধরলো। আমার একটু দরকার ছিলো –ওসমানের মুখ থেকে এই কথা বেরোতে না বেরোতে মকবুল হোসেন তার হাত ধরে ফেলে, আমার এ্যাঁবসেন্সে আপনারা এত করলেন, আজ একটু কষ্ট করেন। বাদ আসর মিলাদ, মিলাদের পরে এফতার দিয়া বিদায়। কোরান খতম করাইতেছি, মৌলবিগো লগে আপনেরা কয়জন থাকবেন। সামান্য আয়োজন করছি।
এফতারের পর বেশির ভাগ লোক চলে গেলে মৌলবিদের সঙ্গে কয়েকজনের জন্য খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ওসমানও চান্স পায়। এদিন রঙ্গুর মা ছাড়া ওদের আর সবাইকে তার দাখার সুযোগ ঘটে।
রঞ্জুর সবচেয়ে বড়ো বোনটি বেশ ফর্স এবং বোবা। তার বাচাল স্বামীর সঙ্গে আগের দিন সে নরসিংদি থেকে এসেছে। তবে তার স্বামীটা সেদিন সবাইকে কম সার্ভিস দেয়নি। তার অবিরাম কথাবার্তার জন্যেই নিহত তালেবের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে আয়োজিত মিলাদ সেদিন ভার হয়ে কারো বুকে চেপে বসেনি। মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর সবুজ চাদর পেতে খাওয়ার সময় ওরা ২ বোনই ভেতর থেকে ভাতের গামলা, গোশতের বাটি, বেগুন ভাজার হাফ-প্লেট, গ্লাস, মগ-এগিয়ে দিচ্ছিল ঘরের দরজা পর্যন্ত। বোবা মেয়েটি কিন্তু কাদছিলো না, বড়ো বড়ো একটু কটা চোখ কুঁচকে একেকজনের দিকে সে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যে, দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ ফেরানো খুব কঠিন। তার স্বামী নরসিংদি ইপিআরটিসি বাস টার্মিনালের ফোরম্যান। তালেব যেদিন মারা যায় সেদিনই, বলতে গেলে প্রায় একই সময় বেতকার কাছে গ্রামের লোকজন ১টি স্টেটবাস আটকায়। হরতালের দিন, স্টেটবাস চলতে দেওয়ার কোনো কারণও ছিলো না। লোকজন বাসের কাঁচ ভেঙে ফেলে, যন্ত্রপাতিও জখম করে। নরসিংদি ডিপো থেকে পরদিন এই ফোরম্যানকে পাঠানো হয়। যন্ত্রপাতি ঠিক করে বাস পাঠিয়ে ফোরম্যান বসে গেলো তাড়ি টানতে। খবর পেতে পেতে ২দিন কেটে যায়। ফোরম্যানের নাড়ি নক্ষত্রের খবর রাখে কে?-আলাউদ্দিন। নরসিংদির বাস ডিপোতে কি সব গোলমাল চলছে, আলাউদ্ধিনের দলের কর্মীরা এই নিয়ে কালকেও ঢাকায় এসেছিলো। কাল বিকালবেলা ওসমান নিজেই ফোরম্যানকে সন্ত্রীক আসতে দেখেছে। মেয়েটা ওপরে উঠেই বারান্দায় বাড়িওয়ালাকে দেখতে পায় এবং তার চোখ তাক করে ছুড়ে মারে নিজের হাতের চুড়ি। মেয়েটার হাতের সই ততো সুবিধার নয়। সোনার চুড়ি রেলিঙে লেগে পড়ে গেলো রাস্তায়, নালার ধার ঘেঁষে। শ্যালক-শোকে মুহ্যমান ফোরম্যান কান্নাকাটিতে বিরতি দিয়ে চুড়ি কুড়াতে নিচে দৌড়ে গেলে বোবা মেয়ে হাউমাউ করে কাদতে-থাকা মায়ের বুকে নিজের ফর্স ও গোলগাল মুখ ঠেসে চেপে ধরে। তার পর ওসমান তাকে দ্যাখে রাত্রে ওদের ঘরে খেতে বসে। তখনও তার রাগ পড়েনি, সকলের ওপর সমানে চক্ষুবর্ষণ করে চলেছে।
রঞ্জুর এই কালো বোনটি বরং নিরাপদ। কুলখানির সন্ধ্যায় এর চাপা ঠোঁটে বেগুনি রঙই ছিলো প্রধান। রঞ্জুর সঙ্গে সেদিন ওর ঠোঁটের পার্থক্য বোঝাই যায়নি। মিলাদ ও কোরান খতমের পর আলাউদ্দিন পুলিসের গুলিবর্ষণের উত্তেজিত বর্ণনা দিচ্ছিলো, কয়েকটা প্লেট হাতে এই মেয়েটি তখন ঠিক দরজায় এসে পড়েছে, আলাউদিনের কথা শোনার জন্যে থমকে দাঁড়ায়। ওসমান আড়চোখে তাকে দেখছিলো, ঘরের ঝুলন্ত ডিসি লাইনের ৪০ পাওয়ার বাম্বের ঘোলাটে আলোতে মেয়েটির ঠোঁটে বেগুনি রঙ গাঢ় হয়, আলাউদিনের খসখসে গলায় হড়হড় করে কথা বলার তোড়ে মেয়েটির শ্যামবর্ণের গাল তিরতির করে কপিছিলো। এমন হতে পারে যে, তার মুখের ভেতর কোনো বাক্য তৈরি হচ্ছিলো। কিন্তু সেই বাক্য প্রকাশের আগেই মকবুল হোসেন ডাকে, রানু প্লেট দে।
আজকে রানুর মুখ কিন্তু মোটেই থমথমে নয়। রঞ্জুজিগ্যেস করে, স্ট্রাইকের দিন অফিস যান? ওসমান জবাব দেয়, দেখি, বাইরের অবস্থাটা দেখি। তোমরা কোথায় যাচ্ছে?
‘এইতো বানিয়ানগর। এর বন্ধুর বিয়া।’
বিয়া না। রানু সংশোধন করে, গায়ে হলুদ। খালি দ্যাখা কইরা চইলা আসবো।
রাস্তায় একটা সাইকেল পর্যন্ত নাই। ২দিকের ভাঙাচোরা ও অনিয়মিত ফুটপাথে লক্ষ্মীবাজারের নিয়মিত জনপ্রবাহটি বন্ধ, পথচারীরা হাঁটছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। কায়েদে আজম কলেজের প্রবেশপথের গলির মুখে চওড়া জায়গায় ইট দিয়ে উইকেট সাজিয়ে পাড়ার ছোটো ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছে। খেলায় সবারই বেশ মনোযোগ, কিন্তু এদিক ওদিক কোনো রিকশা কি সাইকেলের খবর পেলেই হলো,-সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত বলের সামনে থেকে ব্যাট সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে চাকার হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। এদের খবর দেওয়ার দায়িত্ব রাস্তার বেওয়ারিশ পিচ্চিদের। পিচ্চির এমনি ঘুরে বেড়ায়, কোথাও ৭/৮ জনের এক একটি গ্রুপ, কোথাও ৫/৬ জন ছাত্রের নেতৃত্বে ২০/২৫ জনের মিছিল। মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছে, আইয়ুবশাহী, মোনেম শাহী’-‘ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’, ‘আইয়ুব মোনেম ভাই ভাই-এক দড়িতে ফাসি চাই’, ‘জুলো জ্বলো’-‘আগুন জ্বলো’। আবার মাঝে মাঝে শ্লোগান ভুলভাল হয়ে যায়। যেমন, আইয়ুবশাহী, জালেমশাহী’-এর জবাবে বলছে, বৃথা যেতে দেবো না। কিংবা ‘শহীদের রক্ত’-এর জবাবে বলছে, আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো।’
আশেপাশে কেউ দোকান খুললে এদের একেকটি ছোটো ছোটো দল দৌড়ে এসে খবর দিচ্ছে, লম্বু সালামের জিলাপির দুকান আছে না, অর বগলে সাইকেলের পাটসের দুকান আছে না, আছে না, ঐ বন্টু হালায় দুকান খুলছে।
আরেকজন বলে দুকান খুলছে।’
আমরা দুকান বন্ধ করবার কইছি তো, বন্ধ করবার কইছি তো, বন্ধ করবার-। উত্তেজনায় বাড়ি-বাড়ি-কাজ-করা মাতারির পোলা বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারে না। আরেক পিচ্চি তাকে উদ্ধার করে, ঐ বন্টু হালায় কয়, কিয়ের ইস্টাইক? ইস্টাইকের মায়েরে চুদি’ শুনে বয়সে ও বাপেদের-পরিচয়ে-বড়ো ছেলেরা ব্যাট হাতে ছুটে যাচ্ছে দোকান বন্ধ করতে। এর মধ্যে গোবিন্দ দত্ত লেনের ভেতর থেকে ১টি খোলা জিপ এসে পড়ে। ঘন ঘাস রঙের হেলমেটের সঙ্গে ফিট-করা পাঞ্জাবি, বালুচ ও বাঙালি সৈন্যদের কয়েকজন জিপের রেলিঙে মেশিনগান রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ট্রিগারে আঙুল বসানো, টিপলে এক মুহুর্তে কালো নোঙরা এই পিচ্চিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। তবে পিচ্চিরা ও ক্রিকেট খেলোয়াড়রা নিমেষে হাওয়া হয়ে যায় নন্দলাল দত্ত লেনের ভেতর। আরো ভেতরে পাঁচভাইঘাট লেন। এই ২ গলির মোহনায় খেলার জন্য চওড়া জায়গা, আবার সেখান থেকে নারিন্দার পুল পর্যন্ত খানিকটা জায়গার ওপর নজর রাখাও চলবে।
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে পৌঁছে ওসমান দ্যাখে পার্কের রেলিঙের বাইরে ফুটপাথে ও ভেতরে ইপিআরের জওয়ানেরা। পার্কের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো লরি থেকে লাফিয়ে নামছে হেলমেটসাটা লোকজন। নামতে নামতেই পজিশন ঠিক করে নিচ্ছে। কী হেভি প্রিপারেশন! শালদের প্রত্যেকটার মুখে ১টা লাথি মারার জন্য ওসমানের পাজোড়া নিসপিস করে। তার পায়ের কদম সোজা হয় না। টলমল করে। কিন্তু ১০০ বছরেরও আগে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাসি দেওয়ার জন্যে নবাব আবদুল গনিকে দিয়ে পোতানো পামগাছ বা সেইসব পামগাছের বাচ্চারা মানুষের শ্লোগানে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি বলে আস্তে আস্তে হাই তোলে। ওসমানের রাগ বা ইচ্ছা তাদের ধুলোপড়া পাতায় এতোটুকু চিড় ধরাতে পারে না। ডানদিকে মোড় নিয়ে একটু এগিয়ে আজাদ সিনেমার সামনে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা ইপিআরের কয়েকটি হেলমেটধারীর ধাতব ও শীতল মুখের সঙ্গে ওসমানের চোখাচোখ হয়। তাড়াতাড়ি করে সে চোখ নামিয়ে নিল। কী ভয়ানক ঠাণ্ড সব মুখ। এরা কী না করতে পারে। নিজের চোখ মুখ গাল ঠোঁট, এমন কি কান থেকেও রাগ ও ক্ষোভের সব চিহ্ন মুছে ফেলে নিবিষ্টচিত্তে সে হাটতে থাকে। তাড়াতাড়ি অফিস যাওয়া দরকার। স্ট্রাইক ছিলো বলে কালকেও যাওয়া হয়নি। এভাবে এক নাগাড়ে কতদিন চলবে? বসের সঙ্গে ওসমানের সম্পর্ক ভালোই। কিন্তু বসের বস লোকটি ল, অর্ডার ও ডিসিপ্লিনের ১জন নিষ্ঠাবান উপাসক। ওদিকে কারো সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হলেই ফিসফিস করে, পাঞ্জাবিরা একেবারে শেষ করে ফেললো। বাসটার্ড রেস, কারো জন্যে মিনিমাম কনসিডারেশন নেই। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সহ্য করার লোক তিনি নন, পলিটিশিয়ানদের কথায় নেচে লাভ কি? এরা পাওয়ারে ছিলো না? বাঙালি মিনিস্টারের কোটা কোনদিন খালি ছিলো? নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, সোহরাওয়াদি-এর প্রাইম মিনিস্টার হয়নি?–রেজাল্ট?এভরিবডি নোজ। এরপর সিগ্রেটে গোটা দুয়েক টান দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে গভীর দীর্ঘশ্বাস এবং সমস্যার সমাধান ছাড়ে, উই নীড় প্রপার প্লেস ইন দ্য পলিসি মেকিং। অফিসাররা ছাড়া এসব করবে কে? ঐসব ডেমাগগ পলিটিসিয়ান্স? ওসমানের বস এইসব শুনে আসে তার বসের কাছে এবং নিজের কামরায় এসে ঝাড়ে ওসমানের কানে। ওসমানের বসটি এমনিতে খুব বাঙালিঅও প্রাণ। মেয়েকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ালেও ছায়ানটে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখায়। আবার বাঙালি পলিটিশিয়ানদের ওপর লোকটি অতোটা চটা নয়, বরং তাদের সঙ্গে তার অনেক আগেকার পরিচয়ের প্রসঙ্গ সুযোগ পেলেই জানায়। তবে ল’ এ্যাঁন্ড অর্ডারভক্ত বসের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্যে অনুপস্থিত কর্মচারীদের নামে শো-কজ পাঠাতে পারে। যানবাহনশূন্য নবাবপুরের পথচারীদের অনেকেই অফিসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ একেকটি গাড়ি ‘রেডক্রস বা ‘প্রেস’এর জোরে এদিক ওদিক করছে। বাঁদিকে বংশালের রাস্তায় ছোটোখাটো ভিড়, মানসী সিনেমার সামনে ছাত্রদের কেউ বস্তৃতা করছে। রোজার মাস, লোকজন বড়ডো থুতু ফেলে। যানবাহন নাই বলে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটার মতো থুতু ছড়ানো। আলু বাজারের মাথায় সিগ্রেটের ছেঁড়া প্যাকেট দিয়ে তৈরি তাস বাজি রেখে পিচ্চিরা ডাংগুলি খেলছে, ছোটে ছোটো মিছিল দেখলেই স্লোগান দিতে দিতে মিছিলে ভিড়ে যাচ্ছে। ডানদিকে বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের মাথায় পানের দোকানটা একটু খোলা। বুড়ো পানওয়ালা পাতলা ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে পানে চুন লাগায়, খয়ের লাগায়, একটু জরদা ঝাড়ে। রোজার মাস বলে সামনে ১টা চট ঝোলানো। রাস্তা জুড়ে থুতু দেখে ওসমানের একটু গা ঘিনঘিন করছিলো, ভাবলো, ঠাঠারি বাজারের পর্দা ঝোলানো কোনো রেস্টুরেন্টে এক কাপ চামেরে বুড়োর হাতে মশলা-দেওয়া পান মুখে দিলে ভালো লাগবে। কিন্তু ডানদিকে পা দিতে না দিতে হড়হড় আওয়াজ করে বুড়ো দোকানের শাটার টেনে দিলো। কি হলো?—বনগ্রামের দিক থেকে মিছিল আসছে। একটু দাঁড়ালে মিছিলটা ধরা যায়, কিন্তু অফিসে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
নবাবপুর শেষ হলে রাস্তার ছবি পাল্টায়। রাস্তা হঠাৎ নদীর মোহনার মতো অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক চেহারায় প্রসারিত হয়। ইপিআরটিসি বাস টার্মিনালের সামনে ট্রাফিক আইল্যান্ড ঘেঁষে ধিকিধিক জুলছে ১টি সরকারী বাস। এখানে বেশ ভিড়, আবার এখানে অনেকে তাড়াতাড়ি হাঁটে, যে কোনো সময় ইপিআর এসে গুলিবর্ষণ শুরু করতে পারে।
অফিসে কিন্তু অনেক লোক। গতকালও কি সবাই এসেছিলো? লিফট বন্ধ। সিঁড়ি ঠেঙিয়ে পাঁচতলায় উঠে ডানদিকে বড়ো ঘরে একেকটি নীরব টাইপরাইটারের সামনে নিজনিজ চেয়ারে বসে সবাই গল্প করছে। কেউ কেউ হেঁটে এসেছে অনেক দূর থেকে, কিন্তু যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে রাস্তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে তাতে মনে হয় না যে, কারো কোনো কষ্ট হয়েছে। এই বড়ো ঘরের ভেতর দিয়ে মাঝারি ও ছোটো ধরনের সায়েবরা চলে যাচ্ছে নিজেদের কামরায়। এদের পা টেনে টেনে হাটা দেখে বা কল্পনা করে কেরানীকুল কখনো পুলক, কখনো মায়া অনুভব করে। তবে বড়ো সায়েবের জন্য সকলের প্রাণে আজ বড়ো হাহাকার: বড়ো সায়েব আজ সুট পর্যন্ত পরেনি। তার ফুল হাতা সাদা শার্ট এই শীতেও ঘামে না হলেও ভাপে ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে। তার কপাল ও গাল তেলতেলে। মুখের সেই মহানিলিপ্ত ডাটখানিতে চিড় ধরেছে। বড়ো সাহেব থাকে ধানমণ্ডির একেবারে ভেতর দিকে, এতোটা রাস্তা হেঁটে এলো, আহা! একটা কঠিন অসুখে না পড়ে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে যেতে বড়ো সায়েবকে ১০/১১ পা হাটতে হলো। এতোটা সময় জুড়ে তাকে দ্যাখার সুযোগ মেজো ও ছোট সায়েবরা ছাড়তে চায় না। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সবাই প্রায় কোরাসে স্লামালেকুম স্যর বলে।
মাঝারি গোছের এক সায়েব বড়ো ঘরে এসে বলে, ‘ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়ি কেউ আসেনি? একটু চাটা খাওয়া যাবে না?
‘কেউ আসেনি স্যর। এই সেকশনে কেউ আসেনি। মাঝারি গোছের সায়েব নিজের কামরায় চলে গেলে ছোকরা এক কেরানি বলে, পায়জামা ঢিলা শুনে সবাই অনেকক্ষণ ধরে হাসে। একজন কেবল বিরক্ত হয়েছে, এই শালারা বেশি বাইড়া গেছে!
কারা? ‘আবার কারা? লিফট বন্ধ, আবার চাবি লইয়া ভাগছে! পিওন চাপরাশিগো এতোটা বাড়াবাড়ি ভালো না!
এই ১টি মন্তব্যই তাদের গল্পের বিষয়বস্তু বদলাবার জন্যে যথেষ্ট। একজন বলে, ‘খালি পিওনদের বলছেন কেন? রিকশাওয়ালা, বাস কন্ডাক্টর, ড্রাইভার, কুলি—এদের তেজটা দেখছেন? আরে আইয়ুব খান গেলে তোদের লাভটা কি? তোরা মিনিস্টার হবি? নাকি অফিসে এসে চেয়ার টেবিলে বসবি?’
‘আরে শোনেন। ৪/৫ দিন আগে এক শালা রিকশাওয়ালা, নবাবপুর রেলগেট থেকে সদর-ঘাট যাবো, তো কতো হাকালো জানেন? —এক টাকার কম যাবে না। ভাড়া তো আট আনাও হয় না, না হয় দশ আনা নে, বারো আনাই চা; না, পুরো টাকাটা দিতে হবে।’
রেলগেট থেকে সদরঘাটের ভাড়া ছয় আনার বেশি হইতে পারে না। সহকর্মীর সমর্থন পেয়ে রিকশাওয়ালার ব্যবহারে ক্ষুব্ধ লোকটির উৎসাহ বাড়ে, ‘সীটে বসে, হ্যাঁন্ডেলে পা রেখে নবাবের বাচ্চা বলে, এক টাকার কমে হবে না। দিনকাল খারাপ, নইলে শালার পাছায় কষে একটা লাথি বসিয়ে দিতাম!’
বসের কামরায় টেবিলের এক পাশে বসে হার্ডবোর্ড ও কাচের পার্টিশনের ওপর থেকে কেরানীদের রিকশাওয়ালা পেটাবার সখের কথা শোনা যাচ্ছে।
ওসমানের বসের পাতলা গোঁফে অল্প অল্প ঘাম লনে-ছাট ঘাসের শিশিরবিন্দুর মতো চকচক করে। বস বলে, এদের ফল ইনএভিটেবল! কেরানিকুল না রিকশাওয়ালা-কাঁদের পতন অনিবার্য ওসমান এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার আগেই বস বলে, ‘পাবলিক কি রকম স্পনটেনিয়াসলি রি-এ্যাঁক্ট করছে, দেখছেন?
বসের মস্তব্যে ওসমান খুশি হয়। বসের কথাকে আরো জোরদার করার জন্যে সে বলে, একজ্যাক্টলি স্যর! তবে মানুষ ঠিক রি-এ্যাঁক্ট করছে না। মানুষ এবার এ্যাঁকশনে নেমেছে, রি-এ্যাঁক্ট করছে বরং গভমেন্ট, রাদার কাওয়ার্ডলি!’ এই বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ছাড়তে পারায় ওসমানের ভাল লাগে। কথাটা অবশ্য আনোয়ারের। আনোয়ারের পলিটিকাল এ্যাঁনালিসিস খুব ভাল। বস কিন্তু নিজের কথার সূত্র ধরেই এগোয়, আইয়ুব খানকে এবার ঈল্ড করতেই হবে। থিংস আর আউট অফ দেয়ার গ্রিপ। এখন আমার ভয় একটাই। আর্মি নামিয়ে ব্যাটারা একটা ম্যাসাকার না করে! ক্যাবিনেটে কয়েকটা হক্স আছে এ্যাঁন্ড দেয়ার ইজ এ ট্রিগার-হ্যাঁপি আর্মি।
সেনাবাহিনী নামিয়ে নির্যাতন করার আশংকার কথায় ওসমানের গা শিরশির করে। আনোয়ারের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েও ছেলেটা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলতে পারে। এ্যাঁনালিসিস এতো কনভিন্সিং। তবে একটা ব্যাপার কি, এবার ওয়েস্ট পাকিস্তানও ইনভলভড। কিছু করলে ওখানেও করতে হবে! নিজেদের ভাইবোনের ওপর কি রিপ্রেশন চালাতে পারবে? বলতে বলতে বসের স্বর নিচু হচ্ছিলো, বোধ হয় রাষ্ট্ৰীয় কোনো গোপন খবর জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।
রিসিভার তুলে বস বলে, ‘জী স্যর। প্লামালেকুম স্যর। অপারেটররা তাহলে স্যর এসেছে? গুড়। আসছি স্যর, জাস্ট এ মিনিট সার!
বসের ঘরের পাশেই ওসমানদের ঘর। ৪জন ছোটখাটো অফিসার এখানে বসে। এদের মধ্যে খলিলুর রহমান সিনিয়র। কেরানি থেকে এই পর্যন্ত আসতে আসতে বেচারার পেনশনের সময় হয়ে এলো। ঘরের টেলিফোন সেটটা তার টেবিলেই থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওসমান রিসিভার তুলে নেয়। নাঃ, কোনো সাড়া নাই, অপারেটররা এসেই বোধ হয় গুলতানি শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে ওসমান প্রায় ছেড়ে দেবে এমন সময় মহিলা কণ্ঠে শোনা যায়, নাম্বার প্লজ! কিন্তু আনোয়ারের নম্বর আর মনে পড়ে না। খলিলুর রহমানের টেবিলে কাচের নিচে মেলা ভিজিটিং কার্ড, পূর্ব পাকিস্তানের ১টা ম্যাপ, ম্যাপে ওদের ইপিআইডিসির বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা রয়েছে, অফিসের পিবিএক্স টেলিফোনের এক্সটেনশন নম্বর। এখানে আনোয়ারের টেলিফোন নম্বর খুঁজে লাভ কি? কী আশ্চর্য! আনোয়ারকে প্রায় প্রত্যেক দিনই একবার ফোন করা হয়, আর দ্যাখো আজ একি ঝামেলা হলো? ওদিকে সরু গলার তাগাদা আসে, হ্যাঁলো! কিন্তু কিছু মনে পড়ে না। কয়েকদিন আগে অফিসের কাজে সেক্রেটারিয়েটে কথা বলতে হবে, নম্বর ওর সামনেই লেখা ছিলো, অথচ ওসমান কিনা বলে বসলো ওদের বাড়ির নম্বর, তেইস বাই দুই। অপারেটর মেয়েটি হেসে ফেললে ওর চৈতন্য হয় এবং তখন টেলিফোন নম্বরটি বলে উদ্ধার পায়। কিন্তু আজ সংখ্যাবাচক কিছুই তার মনের ত্রিসীমানায় আসে না। অপারেটরকে আর প্রতীক্ষায় না রেখে ওসমান রিসিভার রেখে দিলো। টেলিফোনে টং করে একটি আওয়াজ হয় এবং ওসমান হঠাৎ খুব ভয় পায় আইয়ুব খান একটা ক্র্যাক-ডাউন না করে। আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরি। কি যে হবে! খলিলুর রহমান থাকলে তাদের গ্রামের খবর শোনা যেতো। তো গ্রামের কিসব খবর পেয়েই নাকি খলিলুর রহমান বাড়ি গেছে। হ্যাঁ, জামালপুরের ১টা বড়ো এলাকা জুড়ে দারুণ গোলমাল চলছে। খলিলুর রহমানের বাড়ির অবস্থা ভালো, জমিজমা, গোরুবাছুর, জনকিষাণ নিয়ে সচ্ছল গেরস্থ পরিবারের লোক। যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয় ওরাও ঝামেলায় পড়তে পারে। আবার পাশের টেবিলের মমতাজউদিনের সঙ্গে কথা বললেও কাজ হতো, সে ব্যাটা আজ অফিসে আসেনি। বাকি রইলো কামাল। তা কামাল তো মহাব্যস্ত; খুব ঝুঁকে বসে চিঠি লিখছে। ওসমান তবু তাকে বলে, কি কামাল সায়েব, আজ চিঠি লেখার দরকার কি? নিজেই চলে যান না! অফিস কি আর হবে?
১টি বাক্য সম্পূর্ণ লিখে কামাল তার সোনালি রঙের কলম চমৎকারভাবে কামানো নীলচে গালে ঠেকিয়ে বলে, আমারো ঐ রকম প্ল্যান ছিলো। কিন্তু ওদের এরিয়াটা ইজনো গুড়। এইসব ট্রাবল্ড স্পট এ্যাঁভয়েড করাই ভালো।
ধানমণ্ডিতে আবার ট্রাবল কি?’ কামাল ততোক্ষণে ওর চিঠি ফের পড়তে শুরু করেছে। ১টি জায়গায় ১টি শব্দ কেটে ফেললো, তীরচিহ্ন দিয়ে ওপরে কি লিখলো, তারপর মুখ না তুলেই বললো, মালীবাগে।
ওসমান অবাক হয়, আপনার ইয়ে ধানমণ্ডি থাকে না? * না ওটা কোল্যাপস করেছে। ‘মানে? ওটা আর কন্টিনিউ করছে না। এটা অন্য। এদের বাসা মালীবাগ। মালীবাগ মোড় পার হয়ে এগুলে একটি চওড়া রাস্তা গেছে খিলগায়ের দিকে, ঐ রাস্তার ওপরে। নিজেদের বাড়ি, অল মোজায়েক। ওখানে একটা কলেজ আছে, কলেজের ছেলেরা প্রতিদিন একটা না একটা ট্রাবল ক্রিয়েট করে। জায়গাটা রিস্কি।
কামালের তা হলে এটা নতুন পিক-আপ। প্রেম ছাড়া ছোকরা থাকতে পারে না। প্রথমদিকের প্রেম এমনি এমনি ঝরে পড়েছে। ভালো প্রস্পেষ্ট্রের ছেলে পেয়ে কোনো মেয়ে কেটে পড়েছে, কারো বিয়ে হয়ে গেছে। আবার কামালও আরো পছন্দসই মেয়ে পেয়ে ১টাকে ঝেড়ে ফেলেছে। তবে এখন সমস্যাটা ঠিক হৃদয়ের নয়, ফুসফুসের। কামালের একটু হাপানি আছে, শীতকালটায় ফুসফুস মন্থর হয়ে পড়লে হাওয়া চলাচল স্বচ্ছন্দ হয় না বলে বেচারা বেশ কষ্ট পায়। সাম্প্রতিক প্রেমিকারা তাই শীতকাল এলে সুড়সুড় করে সরে পড়ে। তবে কামাল বেশ খ্যানঘ্যান করে চিঠি লিখতে পারে, হাতের লেখা ভালো। ঠেসে চাইনিজ খাওয়ায়। তাই তার গ্যাপ বেশিদিন থাকে না। তবে এবার মালীবাগের মেয়ে বাছাই করার আগে তার চিন্তা করা উচিত ছিলো।
জায়গাটা রিস্কি। ওসমান কামালের ভয়কে অনুমোদন করে, খিলগাও মালীবাগ, শান্তিনগর-এই বেল্টটাই খুব সেন্সিটিভ। প্রায় প্রতিদিন গুলি চলেছে।’
স্পেশালি প্লাম এরিয়া। ব্যাটাদের কাজকাম নেই তো. রোজ প্রসেশন বার করে। পুলিসের গাড়ি দেখলেই চিল ছোড়ে। চিল দিয়ে অটোমেটিক উইপনস ঠেকাবে? স্টুপিড।’
পার্টিশনের ওপার থেকে ওসমান গনির বস ডাকে, ওসমান গনি সায়েব!’ বোঝা যায় যে, বস তার সায়েবের ঘর থেকে চার্জড হয়ে এসেছে।
‘আরে বসেন। আজ আবার কাজ কি? বসেন। বসের বস নিশ্চয়ই এভাবেই তাকে অভ্যর্থনা করেছে।
‘একটা খবর জানেন? কি? উৎসাহ বোধ করার জন্যে ওসমান যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর আক্রমণের ভয়টা হঠাৎ মাথাচাড়া দেয়, আর্মি কি ক্র্যাক ডাউন করবে স্যর?
আরে না! কি পাগলের মতো কথা বলেন বস এবার সুস্থ লোকের মতো নড়েচড়ে বসে, আইয়ুব খান ন্যাশনাল গভমেন্ট ফর্ম করতে চায় আফটার অল ট্যালেন্টেড লোক। সিচুয়েশন এ্যাঁপ্রিশিয়েট করতে পারে।’
‘ন্যাশনাল গভমেন্ট? কে বললো? জিনিসটা কি তাও ওসমানের ধারণার বাইরে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা কি বিজাতীয়? না মালটি-ন্যাশনাল?
শুনলাম। এই মহাগোপন খবরের উৎস বস ফাস করবে না, ন্যাশনাল গভমেন্ট ইজ এ মাস্ট। ইভন’-বস এদিক ওদিক তাকায়, তারপর ফিস ফিস করে বলে, ইভন শেখ মুজিব ইজ লাইকলি টু বি ইনকুডেড। শেখ না হলে এই সব এ্যাঁনার্কি স্টপ করবে কে? মওলানা ভাসানীর প্রভোকেশনে পিপল কি রকম রাউডি হয়ে উঠছে, দেখছেন না? টেলিফোনের সংক্ষিপ্ত বাজনায় তাকে থামতে হয়। বস তার বৌয়ের সঙ্গে কথা শুরু করলে ওসমান নিজের ঘরে ঢোকে।
কেরানীরা নিজেদের সুপারিনটেন্ডেন্টদের টেবিলে ভিড় জমায়। একটু ভীতু টাইপের গুলো প্যানপ্যান করে, যাই স্যর, আবার কখন কি হয়! সবারই সমস্যার অন্ত নাই। ‘আমার বাসা স্যর পুরা হাসপাতাল। ওয়াইফের গলা ফুলছে, মেয়েটার ব্লাড ডিসেন্ট্রি। যাই সার। বায়তুল মোকাররমে আজ বড়ো গ্যাদারিং, স্টুডেন্ট লিডাররা বলবে। মিটিং না শুনলে প্যাটের ভাত হজম হয় না স্যর। সুপারিনটেন্ডেন্টরা যায় যার যার অফিসারের কামরায়।
‘কেউ অফিস করতে চায় না স্যর। কি করি? ‘অফিস করি কি করে স্যর? পিওনরা প্র্যাকটিক্যালি সবাই এ্যাঁবসেন্ট।
এইগুলিরে লইয়া স্যর বহুত বিপদ! আরে তগো চিন্তা কি? গুলি খাইয়া মরলে আইজ বাদে কাইল তগো বৌপোলাপানে দ্যাশে যাইবো, ধান বানবো, খ্যাতে কামলা খাটবো। তগো চিন্তা কি?’
প্রব্লেম স্যর আমাদের। মিডল ক্লাসের আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। যাই স্যর। আমাদের এরিয়ায় কতগুলি খচ্চইরা পোলাপান আছে। পুলিস দেখলেই চাক্কা মারবো। ইপিআর পুলিস টুইকা পড়লে মহল্লায় ঢোকাই মুশকিল হইবো। যাই স্যর। অফিসারদের সমস্যাও বড়ো জটিল। তাদের বসদের ঘরে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে বলতে একেকজন নুয়ে নুয়ে পড়ে।
আমার সিস্টার-ইন-ল লন্ডন যাচ্ছে, টুয়েন্টি থার্ডে ফ্লাইট। এখনো ফর্মালিটিজ ইনকমপ্লিট। টেলিফোনে কাউকে পাওয়া যায়!
আমার থার্ড ছেলেটা, হি হ্যাঁজ বিকাম এ প্রব্লেম চাইল্ড। আমি ঘরে না থাকলেই বেরিয়ে পড়বে। এইচ এস সি-তে স্টার মার্কস পেয়েছে, ফিজিক্সে এ্যাডমিশন নিলো, ইউনিভার্সিটি তো—
আরেকজনের সমস্যা তার স্ত্রীর সঙ্গীত-প্রতিভা, ‘গায়িকাকে বিয়ে করে আমার হয়েছে প্রব্লেম। এতো সেন্সেটিভ, নয়েজ হলেই রি-এ্যাঁক্ট করে, নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হয়।‘
বসেরা তাদের ওপরওয়ালাদের সঙ্গে এবং ওপরওয়ালারা অফিসের এক নম্বরের কামরায় বিশাল টেবিলের চারদিক আলো করে বসে দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
ক্যাওস কনফিউশন কন্টিনিউ করলে ফিউচার ইজ ভেরি ক্লিক। পলিটিক্স যাই থাক, নাথিং সাকসিডস উইদাউট ডিসিপ্লিন।’
রিমোট কর্নারে ক্যাওস আরো বেশি। এভরিবডি মাস্ট বি রিজনেবল। এ্যাঁনার্কি শুড নেভার বি এ্যাঁলাউড টু কন্টিনিউ ফর ইনডেফিনিট পিরিওড।
এখন গভমেন্টের দ্যাখা দরকার এই আনরিজনেবল পিপলকে কষ্ট্রোল করতে পারে কে? হি এ্যাঁন্ড হি শুড বি টেকন ইনটু কনফিডেন্স।
সায়েবরা নিজেদের কামরায় ফিরে গিয়ে টেবিলের নিচে পা নাচায়। ছোটো অফিসারদের ডেকে নিচের দিকে খবর পাঠায়, কাউকে চাপ দেওয়ার দরকার নাই। তবে সবাই যেন হাজিরা খাতায় সই করে যায়। এই অলিখিত নির্দেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছবার আগেই অফিস প্রায় খালি হয়ে গেছে। তবে বেরিয়ে যাবার আগে অফিসের হাজিরা খাতায় নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গেছে সবাই।

চিলেকোঠার সেপাই – ০৪

আনোয়ার সেদিন বাড়ি ছিলো না। ওর ভাইয়া মহাবিরক্ত, ‘পাবনা না নোয়াখালি কোথায় গেছে ভালো করে বলেও যায় নি। বিপ্লবের অবজেকটিভ কন্ডিশনস নাকি কোথায় কোথায় তৈরি হয়ে আছে, ঐ সব এক্সপ্লোর করতে গেছে। ভাইয়া নিজেও এককালে পলিটিক্স করতো, ভাষা আন্দোলনে জেল-খাটা মানুষ। ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে আজকাল বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় বলে ওদিকে সময় দিতে পারে না। তবে পুরনো রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগটা মোটামুটি আছে। গান বাজনার দিকে খুব ঝোঁক, পার্টির সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে এখনো জড়িত। ওসমানকে বসিয়ে চা খাওয়ালো, চা খেতে খেতে বলে, ’ওদের পার্টি তো প্রায়ই ভাঙছে। এখন ও যে কোন গ্রুপে বিলঙ করে, সেই গ্রুপের বেস কোথায়,নোয়াখালি না পাবনা না যশোর না চিটাগাং—এসব অঙ্ক মেলাতে পারলে ওর হোয়্যার এ্যাঁবাউটস জানতে পারবে। ওসমানকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বলে, খোজ পেলে একটু জানাবে তো টাকা পয়সাও নিয়ে যায়নি, কোথায় কিভাবে আছে, কে জানে? আনোয়ারের সঙ্গে ওসমানের দ্যাখা হলো আরো কয়েকদিন পর। আমজাদিয়ায় সেদিন জমজমাট। ঢুকতে না ঢুকতে ভিড়ের মধ্যে শোনা যায়, ওসমান।’
বাইরে থেকে ঢুকেছে, ওসমানের চোখে সব ঝাপসা ঠেকে। কে ডাকলো? কোণের দিকে ওদের টেবিলে যেতে যেতে ওসমান ফের শুনলো, ওসমান। আস্তে আস্তে সব স্পষ্ট হচ্ছে। মোটা চুরুটের ধোঁয়ায় আঁকাবাঁকা পর্দার পেছনে শওকতের ব্রণের দাগখচিত লম্বা ও রোগ মুখ। শওকতের পাশের চেয়ারে চিত্ত আর ফরিদ বসেছে ভাগাভাগি করে। এদের পাশের চেয়ারে আলতাফ। আলতাফের মুখোমুখি ইফতিখার। পাশের টেবিলে বসলেও প্রায় আড়াইট টেবিল জুড়ে রাজত্ব করে আনোয়ার। ওসমানের দিকে একবার খুশি খুশি চোখ করে তাকিয়ে নিয়ে আনোয়ার তার কথা অব্যাহত রাখে, এর আগে পিপল যেসব মুভমেন্টে এ্যাঁকটিভলি পার্টিসিপেট করেছে সেগুলো হয়েছে এক একটি এলাকা জুড়ে। ধরে তেভাগা, ধরে হাজং কিংবা সাওতালদের বিদ্রোহ-এগুলো বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিলো, তাই না? কিন্তু এরকম সমস্ত প্ৰভিন্স জুড়ে—।’
প্রভিন্স কেন? এবার কান্ট্রিওয়াইড মুভমেন্ট চলছে, ওয়েস্ট পাকিস্তানী পিপল আর অলসো পার্টিসিপেটিং ভেরি স্পনটেনিয়াসলি!’ ইফতিখারের এই মন্তব্য আনোয়ার ঘাড় নেড়ে অনুমোদন করতে করতে বলে, এই ব্যাপক আন্দোলন কি কেবল এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ আর পার্লামেন্টারি ফর্ম আর অটোনমির জন্যে? আর কিছু না?
আলতাফের পাশে সিকানদারের চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসতে বসতে ওসমান বলে, বায়তুল মোকাররমে পুলিস সাংঘাতিক লাঠিচার্জ করেছে।
কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে আলতাফ জবাব দেয় আনোয়ারকে, ভোটের রাইট চাই আগে। ক্ষমতায় আসতে না পারলে বাঙালি কিছু করতে পারবে না। আলতাফ অবিরাম কথা বলেই চলে। কিন্তু ওসমান কারো কথাই ভালোভাবে শুনতে পারে না। সে তখনো একটু একটু হাঁপাচ্ছে। পুলিসের লাঠির বাড়ি থেকে একটুখানির জন্যে বেঁচে গেছে।
শুক্রবারের অফিস বেলা ১২টায় ছুটি হয়ে গেলে কিছু খাবে বলে সে স্টেডিয়ামের বারান্দায় ধীরে সুস্থে হাটছিলো। একবার ভাবছিলো প্রভিন্সিয়ালে ভাত খেয়ে নেবে। কিন্তু সাড়ে বারোটায় ভাত খেলে বিকালবেলা শুধু চায়ে কুলায় না। এদিকে রোজার জন্যে রাস্তাঘাটে খোলাখুলি খাওয়া বন্ধ। আড়ালে আবডালে সবাই ঠিকই খাচ্ছে, শুধু মানুষের ঝামেলা বাড়ানো ঘুঘনি কি পেপেকটা কি সেদ্ধডিমের আশায় সে এদিক ওদিক দেখছে, এমন সময় চোখে পড়ে স্টেডিয়ামের মেইন গেট ২টোতে উঁচু উঁচু ঘোড়ার ওপর বসে রয়েছে তাগড়া সব পুলিস, পাশে রাইফেল হাতে দাঁড়ানো পুলিসবাহিনী। ১টি ঘটনার প্রত্যাশায় ওসমান খাবার কথা ভুলে তাড়াতাড়ি হাঁটে। কিন্তু ঠিক জায়গায় পৌঁছতে না পৌঁছতে জানাজা শেষ হলো। গত কয়েকদিনে সারা পাকিস্তান জুড়ে পুলিস ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদদের জানাজা। লম্বা কাতারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, এদিক ওদিক লোকজনের ছোটো ছোটো জটলা। ছাত্রদের পরবর্তী কর্মসূচী জানবার জন্য ওসমান একবার এ-জটলা একবার ও-জটলার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু মাইকের পে পো ধ্বনি ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। মাইকের এই ভেঁাতা সঙ্গীত ছাপিয়ে ওঠে শ্লোগান, শহীদের রক্ত – বৃথা যেতে দেবে না’, পুলিসী জুলুম পুলিসী জুলুম-বন্ধ করো বন্ধ করো। গেটে দাঁড়ানো উচালম্বা সাদা ও ধূসর ঘোড়াদের পা কাপে। দিকে দিকে আগুন জ্বলো,-আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো। ওসমানের বুক দারুণভাবে ওঠানামা করে। স্লোগানগুলো একটি একটানা আওয়াজে মিলিত হয়ে তার করোটির দেওয়াল তপ্ত করে তোলে শুওরের বাচ্চ আইয়ুব খান মোনেম খানের চাকরবাকরের দল, দ্যাখ! ভালো করে দেখে নে। তোদের সামনে খালি হাতে কেবল বুকসর্বস্ব করে তোদের বাপ আইয়ুব খানকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছে এরা ভরা গলায় ওসমান শ্লোগানের জবাব দেয়, মুক্তি চাই, মুক্তি চাই। খুচরা জটলাগুলো শ্লোগানে শ্লোগানে গাথা হয়, প্রসারিত হতে থাকে একটি অখণ্ড সমাবেশে। স্টেডিয়ামের গেট থেকে পুলিসবাহিনী এপাশ ওপাশ জুড়ে ছড়িয়ে ১পা ১পা করে পেছনে যায়। কয়েক পা এমনি করে হটে গিয়ে হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে পড়লো। জিপিও-র সামনে লরি থেকে লাফিয়ে নামলো বেতের ঢাল ও লাঠিধারী ১পাল পুলিস। তারপর সব এলোমেলো। প্রথম কয়েক মিনিট কেবল লাঠির সপাসপ আওয়াজ এবং পুলিসের নাক ও মুখ থেকে বেরোনো সশব্দ নিশ্বাস ছাড়া কিছুই নাই। মানুষ এখন যায় কোন দিকে? স্টেডিয়ামের জোড়াগেট জুড়ে উচালম্বা ঘোড়া, দক্ষিণে এ-ফুটপাথ থেকে ও-ফুটপাথ জুড়ে পুলিসের দেওয়াল, জিপিও-র সামনে পুলিসের ট্রাক। সবচেয়ে মুশকিল হয় শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকদের। দিনমান সিয়াম অন্তে এফতারে বিসমিল্লা বলে ভালোমন্দ কিছু মুখে দেবে বলে তারা আপেল কি আঙুর কি খেজুর কি কলা কিংবা ক্যাপিটাল বা লাইটের কেক-প্যাস্ট্রি কিনতে এসেছিলো। এই ফ্যাসাদে পড়ে কেউ কেউ মসজিদে ঢুকে নফল নামাজ পড়তে শুরু করলো, বেশ কয়েকজন বায়তুল মোকাররমের এ-প্যাসেজ ও-প্যাসেজ দিয়ে চলে গেলো পুরানা পল্টনের দিকে। ভদ্রলোক ও ছাত্রদের বেশির ভাগই, বলতে গেলে প্রায় সবাই একটা আধটা লাঠির বাড়ি খেয়ে কিংবা মার এড়িয়ে কেটে পড়েছে। এখন রইলো বাকি ২। —১. নোঙরা কাপড় পরা লোকজন এবং ২. অগুনতি পিচ্চি। পুলিসের মার এখন চমৎকার জমে উঠেছে।
পল্টনের দিকে পুলিস নাই। সেদিক দিয়ে চলে গেলেই হতো। কিন্তু পুলিসবিহীন রাস্তা দেখে একটু দিশাহারা মতো হয়ে ওসমান আবার এসে পড়ে জিপিও-র সামনেই। এখানে রোডের সামনে পুলিসের গাড়ি। বুদ্ধি করে ওসমান পায়ের গতি নিয়ন্ত্ৰণ করে। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে সে এমনভাবে হাঁটে যে, মনে হয় এই সব গোলমালের কিছুই তার জানা নাই। ততোক্ষণে গুলিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে পুলিস। মানুষের ছোটাছুটি চলছে ইপিআরটিসি টার্মিনাল পর্যন্ত। পশ্চিম দিকের বড়ো বড়ো দালানের ছাদ থেকে পিচ্চিরা ঢ়িল ছুড়ছে পুলিসের ওপর। স্টেডিয়ামের পাশে ১টা ক্লাবের এলাকা থেকে কয়েকটা খালি বোতল এসে পড়ে। রাস্তার মাঝখানে লম্বা আইল্যান্ড। না। আর কতোক্ষণ? পুলিস শালারা এবার এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি ইটাটা বড়ো ৱিস্কি। এদিককার ফুটপাথ তখন সম্পূর্ণ পুলিসের দখলে। একটু জোরে পা চালালেই ব্যাটার বুঝে ফেলবে যে, সে জানাজা থেকেই আসছে। চোখে মুখে ওসমান একটা বিরক্তি ফোটাবার জন্য একগ্নেচিত্ত হয়; শহরে ১৪৪ ধারা, সমাবেশ কি মিছিল পুলিস সহ্য করবে কেন? —এই ভাবটা তার মুখের আদলে এঁকে ফেলা দরকার। বেশিক্ষণ অবশ্য কষ্ট করতে হয় না, রেলগেটের ওপারে পুলিসের চিহ্নমাত্র নেই, এমনকি স্টেশন রোডের শুরুতে ট্রাফিক আইল্যাণ্ডেও পুলিস নাই। পুলিসের ভয় কেটে গেলে ওসমানের পেটের দিকটা চিন চিন করে। কিন্তু আমজাদিয়ায় ঢোকার পর আড্ডায় জমে থাকায় কথাটা একেবারে ভুলে যায়।
টেবিল এখন আলতাফের দখলে, সবার নীরব অনুমোদন পেয়ে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে, ১৯৫৮-৫৯ সালের পর পাকিস্তানে পার ক্যাপিটা ইনকাম বেড়েছে ১৮০ টাকা। সেখানে ইস্ট পাকিস্তানের ইনক্রিজ কতো জানো? সকলের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে সে জানায়, ২২ টাকা। টুয়েন্টি টু। এই শোষণ চললে আমাদের পরিণতি কি?
এরপর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যের ওপর সে ১টার পর ১টা তথ্য দিয়ে চলে। শুনতে শুনতে ওসমানের জিভ নিসপিস করে, আলতাফের পক্ষে কথা বলার জন্যে সে অস্থির। প্রতিটি জায়গায় শালার ডিসপ্যারিটি। সোনার দাম এখানে এক রকম, ওখানে আরেক রকম। কাগজ তৈরি হয় আমাদের এখানে, ওদের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে সেই কাগজ কিনি আমরাই। আমরা গায়ের রক্ত পানি করে পাট ফলাই, সেই পাট বেচে ফেপে ওঠে লাহোর করাচি ইসলামাবাদ। ওপরের দিকে একটা বাঙালি অফিসার নাই। আর্মিতে বাঙালি নাই। সত্যি সত্যি এক দেশ হলে এরকম হতো না। —কিন্তু কথাটা কিভাবে বলবে ওসমান তাই ভাবতে ভাবতে সিকানদারের কনুইয়ের ধাক্কা খায়। সিকানদার আস্তে করে বলে, আজকাল ইউনিভারসিটির মেয়েরা কি রকম ফ্রি হইছে দেখছো? ছেলেদের সাথে কেমন ঘুরতাছে, দ্যাখো!
কয়েকটা টেবিল পর ৪/৫ জন ছেলের সঙ্গে ২জন মেয়ে। ওসমান এতোক্ষণে খেয়ালই করেনি। এইসব রেস্টুরেন্টে মেয়েরা সাধারণত আসেই না, এলেও হার্ডবোর্ড ও পর্দায় ঘেরা কেবিনে বসে। এরকম খোলাখুলি বসেছে, একটু ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। ১ জনের প্রোফাইল দ্যাখা যায়, ফর্সা নাকের মাথায় ঘামের বিন্দু। আরেকজনের পেছনটা চোখে পড়ছে একটু, ঘামে-ভেজা জলপাই রঙ ব্লাউজের ওপর মোটা বেণী। এরাও নিশ্চয়ই বায়তুল মোকাররম গিয়েছিলো, লাঠিচার্জের আগেই চলে এসেছে।
সিকানদার ফের বলে, আমাদের সময়ে ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা কইলেই ফাইন হইতো, প্রক্টর দেখতে পারলে হয়!—সোজা রিপোর্ট পাঠাইয়া দিতো। আহা, যদি কয়ট বছর পরে জন্ম নিতাম!’
সিকানদার ওদের কয়েক বছরের সিনিয়র, তাছাড়া ওসমান ইউনিভারসিটিতে পড়েওনি, ওর এই আক্ষেপে সাড়া দেওয়া ওসমানের পক্ষে মুশকিল। সিকানদারের চাপাস্বরের আফসোসের অনেক ওপরে চলছে আলতাফের চড়া গলা, আমাদের একমাত্র প্ররেম, অন্তত এখন প্রথম ও প্রধান সমস্যা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ।’
চুরুটের ধোঁয়ার পেছন থেকে সিকানদারের কথার জবাব দেয় শওকত, আরে আপনার তো সেদিনকার ছেলে। আমাদের সময় ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে তার রেপড হওয়ার ফিলিং হতো। সবাই জোরে হেসে ফেলে। আলতাফের বিক্ষোভের মাঝখানে এই হাসি তাকে বিব্রত করে। দাঁতে চুরুট চেপে শওকত তার সহপাঠিনীদের নরভীতির বর্ণনা সম্পূর্ণ করে, ছেলেদের কথা শুনে আবার কনসিভ না করে—এই ভয়ে মেয়েরা তখন কনট্রাসেপটিভ ইউজ করতো। এবার সবাই এতো জোরে হাসে যে, অন্য কয়েকটা টেবিল থেকেও লোকজন তাদের দিকে ফিরে তাকায়। হাসি হাসি মুখ করলেও আলতাফ একটু দমে যায়। আনোয়ার এই সুযোগটা নেয়, তোমার এইসব কথা চ্যালেঞ্জ করছে কে? ন্যাশনাল এ্যাঁসেম্বলিতে মিনিস্টাররা পর্যন্ত ডিসপ্যারিটির ডাটা সাপ্লাই করে। কনস্টিটিউশনে ডিসপ্যারিটির কথা আছে। কিম্ভ-‘
তাহলে দ্যাখো, আলতাফের বিব্রত ভাব কেটে গেছে, বেশ জোর দিয়ে বলে, কোন পর্যায়ে গেলে ডিসপ্যারিটির কথা কনস্টিটিউশনেও বলা হয়? আমাদের ভাষা, কালচার থেকে শুরু করে অর্থনীতি সব জা পাঞ্জাবিদের এক্সপ্লয়টেশনের শিকার। এসব বাদ দিয়ে তোমরা জোতদার মারো আর ঘরবাড়ি জ্বালাও?
কোণঠাসা হয়ে আনোয়ার ফের শুরু করার উদ্যোগ নেয়, তুমি ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছো আলতাফ। ওয়েস্ট পাকিস্তানের একটা সেকশনের এক্সপ্লয়টেশনের কথা অস্বীকার করে কে? এসব কথা আমরা যখন প্রথম বলি তোমাদের নেতারা তখন আমাদের গালাগালি করতো।
এর মানে এর নয় যে, আমরা বললে তোমরা আবার আমাদের গালাগালি করবে!
তা নয়। আমার কথা হলো এই যে, মানুষের এই আপসার্জ কি খালি বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটাবার জন্য? বাঙালি ভদ্রলোকের চাকরির ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে?
ইফতিখার মিনমিন করে বলে, কিন্তু ওয়েস্ট পাকিস্তানের কমন পিপল কি হ্যাঁপি?
না। আলতাফ ফের জোর দিয়ে বলে, কিন্তু সেটা আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়। পৃথিবীর যেখানে যতো দুঃখী ও শোষিত,নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ আছে সবাইকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আমাদের কে দিলো? পশ্চিম পাকিস্তানের যেটুকু আমরা জানি তা হলো আমাদের শোষণ করার জন্যে অদম্য স্পৃহা। উর্দুভাষী ইফতেখারের যে কোনো কথার জবাব দেওয়ার সময় আলতাফ একটু কঠিন বাঙলা ব্যবহার করে। গত কয়েক মাস থেকে এই প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে। সিকানদার উত্তেজিত হয়ে বলে, ঐগুলি ছাড়েন। বাখোয়াজি বহুত শুনছি। স্বাধীনতার কথা বলেন। স্বাধীনতা! মাউরাগো হাত থাইকা বাঁচার উপায় ঐ একটাই।’
স্বাধীনতা! স্বাধীনতার কথায় ওসমানের তপ্ত করোটিতে শীতল হওয়া খেলে। সাড়ে ১০টার দিকে অফিসে নোভাজিল খেয়েছিলো, তার এফেক্ট পাওয়া যায়। মেয়ে ২টোকে ভালো করে দ্যাখার জন্য ঘুরে তাকালো, ঐ টেবিলে এখন অন্য সব লোক। বাইরে থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে। জিন্না এ্যাঁভেন্যুতে গোলমাল কি নতুন করে শুরু হলো?
সিকানদার অনুপ্রাণিত উক্তিকে আমন না দিয়ে আনোয়ার আলতাফের দিকেই তাকায়, বলে, ভাষা, কালচার, চাকরি-বাকরিতে সমান অধিকার, আর্মিতে মেজর জেনারেলের পদ পাওয়া—এসব ভদ্রলোকের প্রব্লেম। এই ইস্যুতে ভোটের রাইট পাওয়ার জন্যে মানুষের এতো বড়ো আপসার্জ হতে পারে?
পারে। মানুষ গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে পারে।’
‘ভোটের রাইট পাবার জন্য মানুষ প্রাণ দেবে?
‘দেৰে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য মানুষ যুগে যুগে প্রাণ দিয়ে এসেছে।’
‘ভোট দিলেই কি সব মানুষের জন্য গণতন্ত্র আসে?
আসে। ভোট দেওয়ার অধিকার গনতন্ত্রের একটা বড়ো শর্ত। তোমরা ভোট দিয়ে তোমাদের প্রোগ্রাম অনুসারে কাজ করতে পারবে।
ফরিদ খুব চুপচাপ সিগ্রেট টানছিলো। আলতাফের সমর্থনে সিগ্রেট টানায় সে একটু বিরতি দেয়, ইলেক্টেড হতে না পারলে আপনি বুঝবেন কি করে যে, আপনার পক্ষে মানুষ আছে? আপনি কার হয়ে কথা বলবেন?
বাইরের গুঞ্জন ক্রমে পরিণত হচ্ছে গর্জনে। রাস্তার মিছিল কাছাকাছি চলে এসেছে। সিকানদার উঠে দরজার দিকে চলে যায়। টেবিলে টেবিলে এখন ভাত, চাপাতি, নানরুটি, তরকারি, সালাদ, ডাল ও ফিরনি। তর্ক জমে উঠেছে, বাইরে থেকে আসছে মিছিলের গর্জন, তাই এতো খাবার ও খাবারের গন্ধেও ওসমানের পেটের ব্যথা পাত্তা পায় না।
আনোয়ার বলে, ভোটে মিড়ল ক্লাসের লোক আসবে। দেশের অধিকাংশ মানুষের প্ৰব্লেম তারা বুঝবে কি করে?
বেশ তো, আমরা না হয় মিড়ল ক্লাসের সমস্যাই সমাধান করার চেষ্টা করলাম। ফরিদ এই কথা বললে আলতাফ তাড়াতাড়ি যোগ করে, সব দেশে মধ্যবিত্তই তো নেতৃত্ব দেয়। রেভুলিউশনের লিডারশিপ মধ্যবিত্তের হাতে থাকে না? লেনিন কি প্রলেতারিয়েত? তোমাদের চৌ-এন-লাই?
কিন্তু আমাদের এখানে সাধারণ মানুষের সমস্যা তো তোমাদের লিডারশিপের কনসার্ন নয়। তোমাদের প্রোগামে তার কোনো রিফ্লেকশন নেই।’ আনোয়ারের কথা শেষ করতে না দিয়ে ফরিদ বলে, বেশ তো, মিড়ল ক্লাস যে পর্যন্ত পারে করুক।
তারা তর্ক করে। বাইরের স্লোগানের ধ্বনি ক্রমে শব্দ এবং অর্থপূর্ণ শব্দ হয়ে তাদের কানে আসে। আনোয়ার একটু জোরে বলে, কিন্তু পিপলের স্পনটেনিয়াস আপসার্জকে ভদ্রলোকের সখ মেটাবার জন্যে ইউজ করার রাইট তোমাদের কে দিলো?
আপসার্জ তো আকাশ থেকে পড়েনি। এর জন্যে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এই প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ করেছে কোন অর্গানিজেশন, বলো? দিনের পর দিন মিটিং করে, জেল খেটে—।
জ্বলো জ্বলো, আগুন জ্বলো। মিছিল এবার আমজাদিয়ার সামনে এগিয়ে আসছে। মিছিলের কয়েকজন ছেলেকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখে প্রায় সবাই উঠে দাঁড়ায়, কেউ বসে থাকলেও খাবার সামনে রেখে ওদের দ্যাখে। পাঞ্জাবি-প্যান্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি, চাপা প্যান্টসোয়েটার, চাপা প্যান্ট-পুলওভার নানা পোশাকের কয়েকটা ছাত্র ঢুকেই বলে, পানি খাবো।
কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার বিকট জোরে চাচায়, ‘পানি দে। কাধে পুলওভার ঝোলানো ১টি ছেলে বলে, চা খেয়ে নিই, এ্যাঁ? ম্যানেজার অনাবশ্যক জোরে হাক ছাড়ে, চা দে!
এর মধ্যে আরো লোকজন ঢুকে পড়েছে। এখন লুঙি-পরা লোক ও রাস্তার পিচ্চিই বেশি। পিচ্চিদের ১জন বলে ওঠে, হালায় আইয়ুব খান! দরজার বেশ খানিকটা ওপরে বড়ো ফ্রেমে কাচে বাধানো ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান, হেলালে জুরত, হেলালে পাকিস্তানের আবক্ষ প্রতিকৃতি। প্রেসিডেন্টের ভরাট গোলাপি মুখ জুড়ে ছড়ানো তার লাল ঠোঁটের চাপা হাসি। সামনের উত্তেজিত লোকদের প্রতি কৌতুক ও তুচ্ছতায় তার ছোটো চোখজোড়া একটু কোচকানো। একটি ছাত্র বলে, শালা দালালের দোকান।
‘দালালের দোকান!
সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান ওঠে, আইয়ুবের দালালি, আইয়ুবের দালালি-চলবে না, চলবে না।’ ভাঙো হালা চুতমারানির ছবি ভাইঙা ফালাও। কুত্তার বাচ্চারে লাথি মাইরা ভাঙা’ বলতে বলতে ১০/১১ বছরের ১টি পিচ্চি তার রঙজ্বলা সবুজ লুঙ্গির কোচড় থেকে ১টি ইটের টুকরা ছুড়ে দেয় ছবির দিকে। ইটের টুকরা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে ১টি টেবিলে রাখা মাটন রেজালার বাটিতে। কাচের বাসন ভাঙার শব্দে ম্যানেজার লাফিয়ে এসে পিচ্চির হাত ধরে ফেলে। ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার মিনতি করে, আপনারা থামেন। আমি নামাইয়া দেই! এর মধ্যে ১টি টেবিল চলে এসেছে দরজার কাছে। ঘন নীল রঙের প্যান্ট ও খয়েরি সোয়েটার পরা এলোমেলো চুলের রোগা ১টি ছেলে উঠে পড়ে সেই টেবিলের উপর। ছবি তার নাগালের বাইরে। ১টি চেয়ার উঠিয়ে দেওয়া হয় টেবিলের ওপর, চেয়ারে দাঁড়াতে ছেলেটা ইতস্তত করলে কয়েকজন ছেলে চেয়ারের পায়াগুলো শক্ত করে ধরে। ফ্রেমের ভেতর থেকে প্রেসিডেন্ট অপরিবর্তিত চেহারায় কৌতুক ও তাচ্ছিল্যের হাসি ছাড়ে। লোকজন প্রেসিডেন্টের পতন দ্যাখার জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছে, টেবিলের ওপরকার চেয়ারে দাঁড়ানো তরুণটি ছবির পেছনে পেরেক-বাধা দড়ি হাতড়াচ্ছে, দড়ির গেরো বোধ হয় সে খুঁজে পাচ্ছে না, হাতড়িয়েই চলে। এমন সময় ঠিক নিচে থেকে পিতলের ১টি এ্যাঁশট্রে এসে পড়ে ছবির ফ্রেমের ওপরকার কাঠে। এরপর আরেকটি এ্যাঁশট্রে। এবার ছবির মাঝামাঝি এ্যাঁশট্রে লেগে কাচ ভেঙে যায়। ফের ১টি ছোটো ইটের টুকরা লাগার সঙ্গে বিশাল ফ্রেম তার একমাত্র অধিবাসীকে নিয়ে প্রথমে হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেয়ারে, সেখান থেকে টেবিলের ১টা ধার একটুখানি ছুয়ে ছিটকে পড়ে মোজাইক করা তেল চিটচিটে ময়লা মেঝের ওপর। প্রথম এ্যাঁশট্রেটা গিয়েছিলো নীল প্যান্ট পরা তরুণের কান ঘেষে, চেয়ারে উঠবার সময় তার পা যে রকম কাপছিলো সেই দ্বিধা ভাগ্যিস ভুলে গিয়ে ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে কায়দা করে চমৎকার লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। তবে এ্যাঁশট্রের ছাই চোখে লাগায় চেয়ারের পায়া ধরে-রাখা ছেলেদের ২জনকে বেসিনে চোখ ধুতে হয়।
দুটো এ্যাঁশট্রে এবং ইটের টুকরা ছুড়ে-মারা ১০/১১ বছরের পিচ্চির লুঙির কোচড়ে এখনো কয়েকটা পাথর ও ইটের টুকরা। কনুই দিয়ে তার নাকের গোড়া থেকে ঝুলন্ত সিকনি মুছতে মুছতে সে এগিয়ে আসে। আইয়ুব খানকে প্রথমবার ইট লাগাতে পারেনি বলে তার যে গ্রানি হয়েছিলো পরবর্তী সাফল্যে তা একেবারে মুছে গেছে। এই সাফল্যে তার চেহারা ও গলায় পরিণত ও অভিজ্ঞ মানুষের ভার অর্পণ করে, দিছি। খানকির বাচ্চারে এক্কেরে নামাইয়া দিছি!’ রাস্তার ধুলামাটি ও কফথুতু মাখা পায়ে চিৎপটাং রাষ্ট্রপতির কপালে ও মাথায় সে কয়েকটা লাথি মারে। ভাঙা কাচে তার পা কেটে যায়, ভাঙা কাচের নিচে ধুলাবালিরক্তকফথুতু লেগে রাষ্ট্রপতির চেহারা ঘোলাটে হয়; ফলে ছোটো চোখ জোড়ায় কোচকানো অভিব্যক্তি মুছে যায়।
মিছিলের অনেকে রাস্তা থেকেই চিৎকার করে, ‘দালালের দোকান জ্বালাইয়া দাও! ছাত্রদের সবাই ক্লান্ত। এই উত্তেজনায় সাড়া না দিয়ে তাদের কেউ কেউ চেয়ারে বসে পড়েছে। সকাল থেকে মিটিং করে, জানাজা করে, মিছিলে হেঁটে ও স্লোগান দিয়ে ক্লান্ত ছেলেদের কেউ বসে বা কেউ দাঁড়িয়ে টেবিলের রেজালা বা ডাল-গোশত বা স্টু বা চাপ অথবা ফিরনি গিলতে থাকে। ম্যানেজারের ইঙ্গিত ছিলো কি-না কে জানে, বেয়ারাদের প্রায় সবাই এই সব টেবিলে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখে। ১টি রোজদার ছেলেও ফিরনি খেয়ে ফেলেছিলো, হঠাৎ মনে পড়ায় সে লাফিয়ে ওঠে, দূর রোজাটা নষ্ট হলো কিছুক্ষণ পরে ছেলেরা সব বেরিয়ে যায়। পিচ্চির দল জুলজুল করে এদিক ওদিক দ্যাখে। ১টা পিচ্চি এগিয়ে এসে টেবিলে রাখা গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকচক করে পানি খায়। ম্যানেজারের মুখ ঘামে স্যাঁতসেতে। খসখসে গলায় সে হঠাৎ খেকিয়ে ওঠে, এই শালা ফকুরনির পুত, গ্লাস ধরছস কারে কইয়া? অন্য কোনো পিচ্চি এরপর আর কোনো গ্লাস স্পর্শ করে না বটে, তবে এদের ১জন বলে, ‘এতো গরম দ্যাহান ক্যান? পানিই তো খাইছে, আর কি? দরজার দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার কিছুই বলে না। মিছিলের শ্লোগানে সাড়া দিয়ে পিচ্চির দল বাইরে চলে যায়।
রাস্তায় নামবার পরও ওসমানের উত্তেজনা কমে না, এই শালা দালালের রেস্টুরেন্ট জ্বালিয়ে দিলে ভালো হতো।
সিকানদার বিরক্ত হয়, আপনারা বাড়াবাড়ি করেন। ম্যানেজার আইবি-র লোক হইতে পারে।’
মিছিলে লোক তেমন নাই। মনে হতে পারে শো ভাঙার পরে সিনেমা হল থেকে লোক ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ফরিদ বলে, সামনে চলো। সামনে মালঝাল। আর ন্নাহ শওকত হতাশ হতাশ ভঙিতে বলে, ‘মেয়ে পাবেন কোথায়? ছাত্রই তো কম। সব লেবার আর স্ট্রিট আর্চিনস! আলতাফ সায় দেয়, হ্যাঁ। আন-অর্গানাইজড প্রসেশন। মিছিলের প্রোগ্রাম ছিলো না।’ ‘তোমাদের কোন কাজটা প্রোগ্রাম অনুসারে হচ্ছে? আনোয়ার ঠাট্টা করে, একেকটা ঘটনা ঘটে যায় আর লিডাররা সবই তাদের প্রোগ্রামে ইনকুড করে। আলতাফ জবাব না দিলে শওকত হেসে ফেলে, লিডারদের কাজ হলো এডিটিং। কোন কাজটা তারা করেনি আর কোন কাজটা তাদের নেতৃত্বে হলো তাই ডিসাইড করা। এ্যাঁকশন উইথ রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট। এবার সবাই, এমনকি আলতাফও খুব হাসে। অবশ্য ওসমান গনি বাদে। কারণ সে চলে গেছে একটু সামনে। এদের মধ্যে স্লোগানের জবাব দিচ্ছে সে একাই। কিছুক্ষণ যাবার পর দ্যাখে ডানদিকে বংশাল থেকে বেরিয়ে লাল রঙের বন্ধ ১টি গাড়ি নবাবপুর দিয়ে রায়সাহেবের বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা দেখতে অনেকটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির মতো, আবার অনেকটা এ্যাঁম্বুলেন্সের মতো। বেশ বড়ো গাড়ি, তাড়াতাড়ি যাচ্ছে, কিন্তু হর্ন টর্ন দেওয়ার বালাই নাই। বুলেট প্রফ নীলচে কালো কাচের আড়ালে কাউকে দ্যাখা যায় না। হঠাৎ মনে হয় গাড়িটার ভেতরে বোধ হয় কোনো মানুষ নাই। —ওসমানের বুকের ভেতর ছমছম করে, সে আরো তাড়াতাড়ি হাঁটে। এমনিতেও তাড়াতাড়ি না হেঁটে উপায় নাই, এই লেবার ধরনের লোকদের ধ্যাবড়া পায়ের সঙ্গে তাল মেলানো বড়ো শক্ত।
এই ওসমান ওসমান’ আনোয়ার ডাকলে সে পেছনে ফিরে তাকায়। আনোয়ার বলে, দাঁড়াও! ওদিকে ফায়ারিং হচ্ছে।’
‘কোনদিকে? ওসমান জিগ্যেস করতে না করতে রায়সায়েবের বাজারের দিক থেকে বহু লোককে দৌড়ে এদিকে আসতে দ্যাখা যায়। পুরুষ্ট হয়ে মিছিল এবার বইছে উল্টোদিকে। ফের একটা গুলির আওয়াজ হলো। ওসমানের হাত ধরে আনোয়ার রাস্তা ক্রস করতে করতে বলে, ‘এবার টিয়ার গ্যাস ছুড়লো। ঐ শালা রায়ট কার দেখেই আমি ভয় পাচ্ছিলাম শালারা একটা কিছু করবে। দৌড়ে পালাচ্ছে মানুষ, তাদের ভেতর দিয়ে রাস্তা ক্রস করা মুশকিল। তাজ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো চিনাবাদাম, চালভাজা ও ছোলাভাজার ঠেলাগাড়ি, হুট করে গোলক পাল লেনের ভেতর ঢুকে পড়ে। ওসমানের ইচ্ছা করছিলো পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মাখানো চালভাজা ছোলাভাজা খাবে। হলো না। আনোয়ার তার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, তাড়াতাড়ি এসো না!

চিলেকোঠার সেপাই – ০৫

যেখানে জোড়পুল লেনের শুরু তার উল্টোদিকে শাহীন রেস্টুরেন্ট এ্যাঁন্ড সুইটমিটের দরজার টুটাফাটা নোঙরা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নওশাদের সুরে আশা ভোঁসলে শোনা গেলো। শোনবার লোক কম, খাবার লোক আরো কম। খয়েরি সর-পড়া চায়ে চুমুক দিয়ে আনোয়ার একটা কিংস্টর্ক ধরায়, ধোঁয়া সম্পূর্ণবের করে দিয়ে জিগ্যেস করে, অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে?
অবস্থা জানাবার জন্য ওসমানই তোওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এখন ওসমানের খুব বমি বমি লাগছে, পেটে সলিড কিছু পড়া দরকার। এখানে এখন গাজরের হালুয়া আর বোদে আর লাড়ডু ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। মুখে মিষ্টি দেওয়া এখন অসম্ভব। আনোয়ার নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়, এদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, পাগলা কুকুরের মতো দশা!
আনোয়ারের কথায় ওসমান একটু আরাম পায়, আরো আরাম পাবার আশায় জিগোস করে, তুমি তো ঘুরে টুরে এলে। বাইরে অবস্থা কি?
বললাম তো দেয়ার ডেজ আর নাম্বারড। এখন ভয় অপোজিশনের রুই-কাতলাদের নিয়ে।’ কেন? দাখো না মানুষ কতো এগিয়ে গেছে। গ্রামে গভমেন্ট ফেল করছে, লোকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করবে। যেসব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকদের ওপর ভরসা করে গভমেন্ট চলে পিপল তাদের পাত্তা দিচ্ছে না। সেখানে লিডাররা কি চায় বলো? শেখ সাহেব বেরিয়ে এলে এক এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ ছাড়া আওয়ামী লীগের চাইবার কি থাকবে?
শেখ সাহেবকে ছাড়বে? ওসমান একেবারে সোজা হয়ে বসে এবং সাঙ্ঘাতিক এ্যাঁসিডিটি বোধ করা সত্ত্বেও একটা সিগ্রেট ধরায়। পেটের বা দিকটা চিনচিন করছে। গলার কাছে দলাপাকানো বমি। পেট খালি বলে বমিট ওখানে আটকে রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির সম্ভাবনা শুনে যেটুকু চাঙা হয়ে উঠেছিলো তা মিইয়ে যায়, বলে, কিন্তু আগরতলা কি উইথড্র করতে পারবে? শওকতের ব্যাখ্যা মনে পড়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা আইয়ুব খানের পক্ষে অসম্ভব। সত্যি হোক মিথ্যা হোক, একবার মামলা যখন শুরু করেছে, আর্মির সম্মান, এমনকি অস্তিত্ব নির্ভর করে এর উপর। শাসকদল বলো আর বিরোধীদল বলো,-আর্মি ছাড়া গোটা পাকিস্তানে এরকম সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন আর কি আছে? আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করলে কি সেনাবাহিনী হাস্যকররকম তুচ্ছ বলে প্রমাণিত হয় না? –আনোয়ারের সঙ্গে এসব কথা বলে তর্ক করা যায়, কিন্তু ওসমানের কথা বলতে ভালো লাগছে না। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলে সে খুব খুশি হয়, আনোয়ার তার মুক্তির সম্ভাবনাই ব্যাখ্যা করছে, ওসমান তাই চুপ করে থাকে। এবার যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে আমাদের বেস বেশ ভালো। মানুষ কি রকম কনশাস আর মিলিট্যান্ট হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামের যারা মাথা, কয়েক জেনারেশন ধরে যারা ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে আসছে, কর্নার্ড হতে হতে তাদের অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যে, ঘোরতর মুসলিম লীগাররা পর্যন্ত শেখ মুজিবের রিলিজ চায়। না হলে ওদের সেভ করবে কে?
নিজের মতবাদ সম্বন্ধে যতোই কথা বলুক, তার রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে আনোয়ার একেবারে চুপচাপ থাকে। এই নিয়ে ওসমানের একটু অভিমান মতোও আছে? এবার এটুকু যখন বললো তখন আনোয়ার আরো বলবে ভেবে ওসমান উদগ্রীব হয়ে থাকে। কিন্তু আনোয়ার প্রসঙ্গ একটু পাল্টায়, এবার আমাকে যেতে বলছে আমাদের গ্রামে। আমাদের ওদিকটায় আমাদের লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, ‘খানিকটা দূরে চর এলাকায় যা-ও আছে তারাও অন্য গ্রুপের। একটু থেমে আনোয়ার বলে, ‘তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
ওসমান প্রথমে একটু ভয় পায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেতেও খুব ইচ্ছা করে। আনোয়ার ফের বলে, চলো না দোস্ত! আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক চাচা থাকেন, আমাদের থাকার জায়গা মেলা। যাবে? তুমি তো গ্রাম দ্যাখেইনি চলো। ওসমান একটু একটু হাসে, তুমি গ্রামে কোনোদিন বাস করেনি, আর পাকিস্তানে চলে আসার আগে পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। ‘আরে রাখো’ আনোয়ার থামিয়ে দেয়, কতো ছোটবেলায় চলে এসেছে, গ্রামের কথা তোমার মনে আছে?
ওসমানের বেশ হাল্কা হাল্কা ঠেকে। চায়ের পেয়ালায় অনেকক্ষণ চুমুক দেওয়া হয়নি। খয়েরি রঙের চায়ের ওপর শীতকালের পশ্চিমপাড়ার পুকুরের ওপরকার পরতের মতো গাঢ় খয়েরি সর ভাঙা ভাঙা ছড়ানো রয়েছে। সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমপাড়ার বাঁকাসিধা তালগাছগুলো পুকুরের সর-পড়া পানিতে কায়ায় ছায়ায় তিরতির করে কাপে। —ওসমান নয়ন ভরে চায়ের পেয়ালা দ্যাখে।
যাবে? আনোয়ার প্রায় তাড়া দেয়, কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে না!’ ওসমান কাঙালের মতো বলে, যাবো! কবে যাবে? আনোয়ার জবাব দেওয়ার আগেই শোনা যায়, প্লামালেকুম! পাশের টেবিলের সামনে উপুড় হয়ে লুঙির পানি-ভেজানো প্রান্ত দিয়ে চোখ মোছে খিজির, চেয়ারে বসার পরও তার চোখ মোছা ও কথা বলা অব্যাহত থাকে, ত্যাজ কি! মনে লয় পাইপ দিয়া পিয়াজের রস ঢাইলা দিছে!’ এরপর কথা বলে তার সঙ্গী, ভিজে রুমালে চোখ মুছতে মুছতে লোকটি ওসমানের দিকে তাকায়, হেভি টিয়ার গ্যাস মেরেছে। এতো পানি দিলাম, এখনো জ্বলছে! চোখ থেকে রুমাল তুললে তাকে চেনা যায়। ওসমান জিগ্যেস করে, আপনারা কোথায় ছিলেন পারভেজ? প্রসেশন দেখে আমি ভিড়ে গেলাম। কোর্টের ওখানে দেখলাম কি খিজির বহুত চার্জর্ড হয়ে ইটা মারছে! এদিকে গোলি চলে আর ও ইটা মারে!’
‘কেউ মারা গেছে? ‘ডেফিনিটলি!’ পারভেজ জোর গলায় হাকে, ‘চায়ে দো! ফের গলা নামায়, এ্যাঁট লিস্ট থ্রি, হা তিনজন তো হবেই।’
কয়জন কইলেন? হাড্‌ডি খিজির জোরে প্রতিবাদ জানায়, তিনজন? আরে দশজন এগারোজনের কম হইবে না। কয়টা লাশ তো আমরাই টেরাকে উঠাইতে দেখলাম।
ওদের বেশির ভাগই জখম, ইনজুরিডা পারভেজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আরে ভাই, এরা হয়ওয়ানসে ভি বেরহম! পহলে টিয়ার গ্যাস মারলে পাবলিক ডিসপার্স হয়ে যেতো। না, এই জানোয়ারগুলি পরথমেই গুলি করলো! গুলি করলি আগে আর টিয়ার গ্যাস মারলি পরে! এটা কি হলো?
আনোয়ার শান্তভাবে মন্তব্য করে, ডেডবডি সরাবার জন্য টিয়ার গ্যাস মারলো।’
পরিণতির কথা ভেবে ওসমান ভয় পায়, লাশগুলো কি করলো? আমি নিজের চোখে দেখছি কয়টারে টাইনা তুলতাছে, উত্তেজনা ও রাগে খিজিরের কালো মুখ আরো কালো দ্যাখায়। হাতের প্লায়ার একবার তার ডান হাতে, একবার বাম হাতে, কখনো টেবিলে রাখে, কখনো তার ময়লা শাদা লুঙির কোচড়ে রেখে তার ওপর কালো কালো শক্ত রঙের মতো আঙুল বুলায়, পরথমটা তো এক গুলিতেই খতম। ব্যাটারে টাইন তুললো, দেহি হাত দুইখান ল্যাতপাত ল্যাতপাত করে। আরেকটার জান কবচ হইছে টেরাকে উঠানের বাদে। এবার আনোয়ার তাকে কি জিগ্যেস করে এবং সে-ও লাশ গায়েব করার ব্যাপারে পুলিসের তৎপরতার একটি বিস্তারিত বিবরণ ছাড়ে। কিন্তু ওসমান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। পেটের চিনচিন ব্যথা তার মাথায় উঠেছে। চোখের সামনে তার গোল গোল হলদে রঙের আলোর বিন্দু। আলোর বিন্দুর বিন্যাস এরকম দাঁড়ায় যে, মনে হয় রক্তাক্ত ১টি মৃতদেহ টেনে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। মৃতদেহ ট্রাকের বাইরে রেলিঙে ঠেকে ঝুলছে। ৪/৫ জন প্রমাণ সাইজের পুলিস ১সঙ্গে টেনেও তাকে রেলিঙের ভেতর নিতে পাচ্ছে না। মৃতদেহের চোখ বেরিয়ে এসেছে কেটির থেকে। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল অফিসের ছাদ থেকে, আজাদ সিনেমার ওপর থেকে, ওদিকে রায়সায়েবের বাজারের উঁচুনিচু টিনের ছাদ থেকে পাবলিক ইটপাটকেল ছুড়ছে। ৩০৩ রাইফেলের বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ছুটে আসছে ভাঙাচোরা বোতল। —এইসব গোগ্রাসে দেখছে মৃতদেহের কোটরছেটা চোখজোড়া। তার ২ হাত নেমে গেছে নিচের দিকে, লোহারপাতের মতো একেকটি হাতে ঝোলে একেকজন গুলিবিদ্ধ মানুষ। তাদের জোড়া জোড়া ৪টে চোখ পেটুকের মতো দেখে নিতে চায় ইট-পাটকেল-বোতল-ছোড়া পাবলিককে। ওসমান নিজের চোখে হাত রেখে দৃশ্যটি নিভিয়ে দিতে চাইলে তা ঠাই নেয় তার নয়নের মাঝখানে। তখন কপালে হাত রেখে সে এদিক ওদিকে দ্যাখে।
কি হলো ওসমান? শরীর খারাপ? আনইজি ফিল করছো? আনোয়ারের ডাকে ওসমান ফের ঠিকঠাক হয়ে বসে। নাঃ! আমজাদিয়ায় দুটো এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট খেয়ে বেরোনো উচিত ছিলো। মনে হয় রোদে পিঠ দিয়ে বসে উঠানে ছড়ানো ধান খুঁটে-খাওয়া শালিক পাখি দেখতে দেখতে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে দুটো গরম ভাত খেতে পারলে সব ঠিক হয়। মাগুর মাছের ঝোলে মাখা ভাতের অনুপস্থিত স্বাদে মুখ লালায় ভরে ওঠে। কিন্তু এ শালা টকতেতো লালা। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দরজার নোঙরা পর্দা তুলে সে থুতু ফেলে। গলা হঠাৎ শুকনা ঠেকে এবং বিশ্রীরকম কাশি শুরু হয়। কাশির সঙ্গে গমক দিয়ে বমি আসে। গলা দিয়ে মুখ দিয়ে বেদম আওয়াজ বেরোয়, কিন্তু যতো গর্জায় ততো বর্ষে না। সিগ্রেটের স্বাদে মাখামাখি হয়ে টক তেতো লালাই গড়িয়ে পড়ে ঠোঁট থেকে। ততোক্ষণে পারভেজ পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাতের নরম চাপড় দিচ্ছে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিচ্ছে খিজির।
রাস্তায় খিজির তার গা ঘেঁষে চলে, গলা নামিয়ে বলে, আমাগো আলাউদ্দিন সাব আপনার লগে কি কথাবার্তা কইতে চায়। চান্দার টিকেটের দুইটা বই দিবো আপনারে, কইলো নিজে গিয়া দিবো। ওসমান এখন সম্পূর্ণ সামলে উঠেছে, এখন তার চিন্তা হয়, ‘আগরতলা মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তদের সহায়ক কমিটি’র চাঁদার রিসিট বই নিয়ে সে করবেটা কি? কার কাছে সে চাঁদা চাইবে?
আনোয়ার ডাকে, ওসমান আমার সঙ্গে চলো। খেয়ে রেস্ট নিয়ে বাসায় যেও।’ ওসমান কিন্তু এখন যেতে চায় তার নিজের ঘরে। মাগুর মাছের ঝোল এখন তার না হলেও চলে। সবচেয়ে দরকার দুটো এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট। তারপর কানা আবুলের হোটেল থেকে ভাত রুটি যা হয় খেয়ে ঘরে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা শুয়ে থাকবে। সন্ধ্যার দিকে রঞ্জ যদি খাতা নিয়ে এসে বলে, ‘অঙ্কটা একটু দ্যাখেন তো! তো ফ্রেশ শরীরে রঞ্জুর মাথার কাছে মাথা নিয়ে রাত পর্যন্ত অঙ্ক করানো যায়। কিন্তু আনোয়ার নাছোড়বান্দা, চলো। এখন রিকশা পাবে না, লক্ষ্মীবাজার পর্যন্ত হেঁটে যেতে কষ্ট হবে। চলো।’
আনোয়ারের ঘরে এখন রোদ নাই, কিন্তু সকালবেলার রোদের তাপ একেবারে মুছে যায়নি। আনোয়ারের টেবিল বড়ো এলোমেলো, একদিকে গাদা করে রাখা লিফলেটের তাড়া, পাশে বই, পত্রিকা, কাগজপত্র, এ্যাঁশট্রে এবং এ্যাঁশট্রে হিসাবে ব্যবহৃত সিগ্রেটের খালি প্যাকেট। এমনকি ১টা নোঙর গেঞ্জি ও আধ খাওয়া ১টি কমলালেবু। আনোয়ারের বিছানা কিন্তু পরিপাটি, –পুরু গদির ওপর তোষক, তার ওপর চাদর ও বালিশ; গুলটেক্সের পুরু বেড-কভার দিয়ে গোটা বিছানা আবৃত। ঘরের মেঝেও পরিষ্কার। মনে হয় টেবিলে আনোয়ার কাউকে হাত দিতে দেয় না।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, গোসল করবে?
না। তুমি করে এসো। তুমি তাহলে বরং একটু শুয়ে থাকো। আমার পাঁচ মিনিট লাগবে। কি ভেবে আনোয়ার টেবিলে কাগজপত্র ঘাটতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে একটা চিঠি দাখাবো। আমার এক আত্মীয়’, বইপত্র ওলট-পালট করা অব্যাহত রেখে আনোয়ার বলে, ‘গতবছর বাড়ি গেলে উনার সঙ্গে খুব জমেছিলো, আব্বার কি রকম কাজিনের হাজব্যান্ড, আমাদের গ্রামেই বাড়ি, তার একটা চিঠি পেয়েছি, খুব ইন্টারেস্টিং।’ মানে তোমার ফুপা? কি লিখেছেন? কৌতুহল দ্যাখানো খুব দরকার। কিন্তু ওসমান এখন শুতে পারলে বাচে। চিঠি খুঁজতে খুঁজতে আনোয়ারের হঠাৎ মনে পড়ে, ওহো চিঠিটা ভাইয়াকে পড়তে দিয়েছিলাম। ভাইয়ারা তো হারমোনিয়াম পার্টি করে সমাজতন্ত্র করতে চায়, তাই বললাম, দ্যাখো, গ্রামে মানুষ কি রকম মিলিট্যান্ট হয়ে উঠছে, পড়লেই বুঝবে। আনোয়ার বোধ হয় ভাইয়ার ঘরের দিকে চলে গেলো।
এদিকে পায়ে পায়ে ঘষে স্যান্ডেল সু্য খুলে ওসমান যে কখন শুয়ে পড়েছে নিজেও সে ভালো করে খেয়াল করেনি। শোবার পর একটু শীতশীত করে। এতো সাজানো গোছানো বিছানা, বেণ্ড-কভার তুলে গায়ে দিতে তার বাধো বাধো ঠেকে। তার চিলেকোঠার ঘরে শেষ বিকালে শুয়ে থাকলে কখনো কখনো চারদিকের পুরু দেওয়ালের অনেক ভেতরকার ঠাণ্ডা শাঁস থেকে বাতাস বেরিয়ে এসে চোখে, কপালে ও কানের গোড়ায় আস্তে আস্তে ফুঁ দেয়। তখন উঠে বরং বাইরে দাঁড়ালে ভালো হয়। বাইরে দ্যাখা যায় যে, বাড়ির উল্টোদিকে মসজিদের সামনে পুলিসের গাড়িতে ১টি গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ তোলা হচ্ছে। কোনোরকম নড়াচড়া ছাড়া ট্রাক চলে যায় জনসন রোডে। তার নিজের দাঁড়াবার জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যায় না। নিচে সাপের খোলস ছাড়াবার মতো করে পুলিসের লরি তার বডি পাল্টায়। লরির জায়গায় এখন বিরাট বাক্সের মতো দেখতে লাল রঙের ১টা গাড়ি। তার গাঢ় কালচে নীল কাচে ১টার পরে ১টা বুলেট লেগে ফিরে যাচ্ছে। ১টি বুলেটও কি কাচ ভেদ করতে পারে না? আরো চেষ্টা করা চাই। তো রাইফেল ছেড়ে কে। আজাদ সিনেমার ছাদে রেলিঙে রাইফেলের নল রেখে এক নাগাড়ে গুলি ছুড়ে চলেছে রঞ্জু রঞ্জু রঞ্জু কি পাগলামি করছে। নিচে থেকে পুলিসের ১টি মাত্র গুলি এসে ওর মাথাটিকে একেবারে চুরমার করে দেবে। রঞ্জুর মাথায় গুলি ঠেকাবার জন্য ওসমান দুই হাত দিয়ে তার কপাল ও মুখ জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায়, ঘুমিয়ে পড়লে?
নিজের কপাল ও মুখ থেকে দুই হাত সরিয়ে ওসমান আনোয়ারের দিকে তাকায়। এই যে, এই চিঠিটা ভাবী খুঁজতে খুঁজতে দেরি করে ফেললো। পড়ো, এ্যাঁ? আমার গোসল করতে পাঁচ মিনিট।
ঘুমঘুম চোখে পিঁপড়ের সারির মতো ছোটো ছোটো বাঙলা অক্ষর প্রথম প্রথম ঝাপশা হয়ে আসে। তবে দেখতে দেখতে সেগুলো স্পষ্ট হয়, তখন অনায়াসে পড়া চলে।
এতদঞ্চলে গরু চোরের উপদ্ৰব ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহার কোন প্রতিকার হইতেছে না। পক্ষকাল পূর্বে হাওড়াখালির নাদু পরামাণিক গরু অপহরণের অভিযোগ লইয়া থানায় যায়, কিন্তু দারোগা এজাহার লয় নাই। উপরন্তু পরদিন বুধবার দিবাগত রাত্রে নাদু পদুমশহর হাট হইতে প্রত্যাবর্তনকালে কে বা কাহারা পান্টি (গবাদি পশু শাসন করিবার যষ্টিবিশেষ) দ্বারা উহাকে প্রহার করে। তিনদিন পর অর্থাৎ শনিবার দিন দ্বিপ্রহরে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে ২নং ওয়ার্ডের মেম্বর খয়বার গাজীর ভ্রাতুষ্পপুত্র আফসার গাজী একটি কিষানের মাথায় আধ মণ মরিচের বস্তা লইয়া মূলবাড়ি ঘাটে যাইবার কালে ভুলু খন্দকারের খানকার নিকট পহুছিলে নাদুর পুত্র চেংটু তাহাকে কুকুর ধরাইয়া দিতে উদ্যত হয়। আফসার গাজী দৌড়াইয়া ভুলু খন্দকারের গোয়াল-ঘরে আশ্রয় লয়। চেংটু বলিয়া বেড়াইতেছে যে, খয়বার গাজীর ইশারায় দারোগা উহাদের গরু অপহরণের এজাহার লয় নাই। ক্রুদ্ধস্বভাব খয়বার গাজী ইহার প্রতিশোধ না লইয়া ছাড়িবে না। নাদু পরামাণিক বংশপরম্পরায় তোমাদের বাড়িতে বছর-কামলা হিসাবে কাজ করিতেছে। দরিদ্র ও নীচু বংশীয় হইলেও লোকটি অত্যন্ত অনুগত ও সৎ। কিন্তু উহার পুত্রটি বড় বেয়াদব, উহার উদ্ধত স্বভাব উহার পরিবারটির জন্য সর্বনাশ ডাকিয়া আনিবে। চিঠি পড়তে পড়তে ওসমানের ঘুম সম্পূর্ণ কাটে। আমাদের এলাকার মানুষের ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হইয়াছে, সম্ৰমবোধ একরূপ নাই বলিলেই চলে। ভদ্রলোকের পক্ষে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করা ক্রমেই দুরূহ হইয়া উঠিতেছে। তুমি দীর্ঘকাল বাড়ী আস নাই। সময় করিয়া একবার আসিলে নিজেই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিতে পারিবা। এখানে খোদা চাহে সকলের কুশল। তোমার ফুফুর অবস্থা পূর্ববৎ। বাম চক্ষুর ছানি কাটিবার উপযুক্ত হইয়াছে, ঐ চোক্ষে প্রায় কিছুই দেখিতে পারে না। একবার ঢাকায় লওয়া দরকার।’
শেষ বাক্যটি পড়তে পড়তে ওসমানের ঠোঁটজোড়া একটু বাঁকা হয়, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে লোকটা আনোয়ারের কিছু পয়সা হাতাবে। তবে কোনো মহিলার ছানি-পড়া চোখের সামনে উপচে পড়ে দুপুর বেলার রোদ। কালো ও ঢাঙা ১টি তরুণ চাষী পাটকিলে রঙের একটি কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। —এই দৃশ্যটি অস্বস্তিকর। আনোয়ারের সঙ্গে ওসমানও তো ঐ গ্রামে যাচ্ছে, এরকম চলতে থাকলে তাকে আবার কেউ কুকুর লেলিয়ে না দেয়।

চিলেকোঠার সেপাই – ০৬

রঞ্জুদের ঘর থেকে ওসমান বেশি হশিখুশি হয়ে বেরোচ্ছে, সিঁড়িতে হাড্‌ডি খিজিরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। এই শীতের সকালে নিচতলায় শ্যাওলাপড়া চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে তার ওপর পরশু দুপুরে আলতাফের ফেলে-যাওয়া শাল চড়িয়ে ওসমান চুল আঁচড়াচ্ছিলো, রঞ্জ এসে একরকম জোর করে ওদের ঘরে নিয়ে গেলো। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সেখানে চললো সেমাই খাওয়া। জর্দা-সেমাইটা জড়িয়ে দলা দলা হয়ে গিয়েছিলো, দুধ-সেমাইতে মিষ্টি কম। পর্দার ওপারে নিচু ও মিহি সুরে রঞ্জুর মায়ের বিরতিহীন বিলাপ। তালেব হত্যার পর এই প্রথম ঈদ, ওর মায়ের বিলাপে তালেবের ঈদ উদযাপনের নানারকম স্মৃতিচারণ। এতে ঘরদের একটু ভারি ভরি ঠেকলেও রানু ও রঞ্জুর ক্রমাগত পীড়াপীড়িতে সেমাই খেতে খেতে ২৫/৩০ মিনিট বেশ মিষ্টি রোদের মতো পিঠের ওপর পড়ে রইলো। এখন একটু আনোয়ারদের ওখানে যাবে, খিজির ঘরে ঢুকলে কি সহজে বেরোবে?
খিজিরের হাতে ট্রে। সবুজ ও লাল সুতায় নিষ্কণ্টক ডাল পাতা ও গোলাপ ফুল সেলাই করা হলুদ রুমালে ঢাকা। খিজির একটু দাঁড়ায়, কৈ যান? মাহাজনে নাশতা পাঠাইয়া দিছে, খাইয়া একেবারে বারানা’ বায়ে ঘুরে রঞ্জুদের ঘরে যেতে যেতে বলে, ‘আপনে উপরে গিয়া কামরায় বহেন। ব্যাকটি ভাড়াইটারে দিয়া আমি আইতাছি।
ওসমানের ঘরের দরজার চাবি রঞ্জুদের ঘরে। রানুর নতুন বিবাহিতা বন্ধু তার স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে এলে ওরা সবাই মিলে ছাদে উঠে ছবি তুলবে। ওসমান রঞ্জুদের দরজায় টোকা দিয়ে চাবি নিলো।
ট্রে থেকে সেমাই ও মোরগ পোলাওয়ের ডিশ তুলে নিতে নিতে ওসমান বলে, আমার তো প্লেট মোটে একটা। এতোসব রাখি কোথায়?’
রাখেন প্যাটের মইদ্যে। আমি এটু বহি, আপনে খান! এদিক ওদিক তাকিয়ে খিজির ছাদের দিকের দরজায় চৌকাঠে বসে পড়ে।
আরে আরে ওখানে বসছো কেন? বিছানায় বসো, বিছানায় বসে। ওসমানের ব্যস্ততাকে আমল না দিয়ে খিজির হাঁটু ভেঙে গুছিয়ে বসে।
মোরগ পোলাওয়ের স্বচ্ছ ও পাতলা ধোঁয়ার সুবাসে আত্মসমর্পণ করতে করতে ওসমান বলে, এতো রঞ্জুদের ওখানে হেভি হয়ে গেছে।’
‘আরে ঈদের দিন ভি মাইপা খাইবেন? ঈদ উদ মনে লয় মানেন না, না? নমাজ ভি পড়েন নাই?
‘ভোরবেলা ঠিকমতো ঘুম ভাঙলো না, ওসমান আমতা আমতা করে।
নাহাইছেন মালুম হয়।
হ্যাঁ। চৌবাচ্চার পানি যা ঠাণ্ডা!
ভালো করছেন। ঈদের দিন উইঠা নাহাইয়া উহাইয়া সাফসুতরা হইয়া নমাজ পড়তে যাইবেন। রিশতাগো লগে মিলবেন, পড়শিগো লগে মিলবেন! তয় না মোসলমানের পোলা!
ঈদের দিন খিজির আলি মুসলমানের সন্তান হওয়ার জন্যে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালায়। আজ খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে রাস্তার কলে ৫৭০ সাবান দিয়ে গা কচলে গোসল করেছে। গায়ে চড়িয়েছে আলাউদ্দিন মিয়ার দেওয়া বুকে সাদা সুতার মিহি কাজ করা আদির কল্লিদার পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতে কজির কাছে একটু ছেঁড়া। তা হোক। হাতটা গুটিয়ে নিলেই হলো।
খিজিরের গেঞ্জিটা বড়ো ময়লা, ধোঁয়া হয়নি বলে ওটা পরেনি, পরলে পাঞ্জাবিও ময়লা দ্যাখায়। গেঞ্জির অভাবে তার অস্থিসর্বস্ব বুক প্রতিটি নিশ্বাসে প্রশ্বাসে তার নামকরণের সার্থকতা ঘোষণা করছে। সাদা লুঙিটা রাত্রিবেলা সে নিজেই ধুয়ে দিয়েছিলো, এখনো স্যাঁতসেঁতে রয়েছে। তাই কিছুক্ষণ পর পর তাকে খসখস করে উরু চুলকাতে হচ্ছে। সেই অতো ভোরবেলা মোড়ের পানির কল থেকে ঘরে ফিরে দ্যাখে জুম্মনের মা চলে গেছে মহাজনের বাড়ি, ঈদের দিন সকাল হবার আগেই না গেলে কাজ সামলানো যাবে না। বৌয়ের নারকেল তেল খুঁজে নিয়ে খিজির মাথায় মেখেছে, তা ছটাকখানেকের কম নয়, তার কপালে ও জুলফিতে তেল গড়িয়ে পড়ছে। গায়ে তার আতরের গন্ধ ভুরভুর করছে, কানে গোজা আতর মাখা তুলার টুকরা। আতরটাও আলাউদ্দিন মিয়ার কল্যাণে। তবে চোখে সুর্মা মাখার জন্যে তাকে একটু ছ্যাচরামো করতে হয়েছে। মামার সঙ্গে নামাজ পড়তে যাবে বলে মহাজনের বাড়িতে আলাউদ্দিন মিয়া সতরঞ্চি, জায়নামাজ, চাদর এসব খোঁজাখুঁজি করছে, সেই ফাঁকে বাইরের ঘরে টেবিলে রাখা সুর্মাদান থেকে সরু সুৰ্মা কাঠি দিয়ে খিজির দুই চোখে ইচ্ছামতো সুৰ্মা মেখে নিয়েছে। আলাউদ্দিন মিয়া নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। তা টের পেলেই বা কি? কাজের লোকের এই সব হাতটান দেখে চোখ ময়লা করার বান্দা তার
চাকরবাকরদের সে বরং একটু সুযোগ দেয়। আজ সকালবেলা মামাকে গ্যারেজে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করে রিকশাওয়ালদের রিকশা ভাড়া দেওয়ার দায়িত্বটা খিজিরকে জুটিয়ে দিলো, তাই বা কম কি?
বাড়ির চেয়ে রিকশার সংখ্যা বাড়িওয়ালার বেশি। রিকশার জন্যে রহমতউল্লার মায়ামোহাব্বতও বাড়ির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ফজরের নামাজ পড়ে প্রত্যেকদিন তসবি হাতে সে সরাসরি চলে আসে বাড়ির পেছনে রিকশার গ্যারেজে। অনেকের গ্যারেজ অবশ্য এর আগেই খোলা হয়, কিন্তু নামাজের আগে দিন শুরু করা তার ধাতে সয় না। তার গ্যারেজে পৌঁছবার আগেই রিকশাওয়ালাদের ভিড় জমে যায়। গম্ভীর মুখে কারো দিকে না তাকিয়ে রহমতউল্লা গ্যারেজে ঢোকে, ঢোকার পরপরই নরম গলায় প্রথম বাক্যটা ছাড়ে, ‘নবাবসাবরা তশরিফ লইছেন? তারপর মিনিটখানেক পরে শুরু হয় একটানা বিলাপ, ‘হায়রে, তিনটা গাড়ি এক্কেরে জখম কইরা ছাড়ছে, এ্যাঁ? প্রত্যেকটি রিকশার নম্বর তার মুখস্থ, আহারে, এই চাইরশ পাঁচচল্লিশটার হ্যাঁন্ডেলখান ছেইচা ভাতের চামিচ বানাইয়া দিছে। খানকির বাচ্চা ইসা দুইশ আটপঞ্চাশের মাড়গাড় আমান রাখে নাই। খানকির পুতে মাডগাডের উপরে খাড়াইয়া হোগা মারা দিছিলি তর কোন বাপেরে? কইলি না?
সারি সারি সাজানো ১৮টা রিকশার প্রত্যেকের হুডে, মাডগাড়ে, সিটে, সামনের সাইকেলে, রডে, এমনকি স্পোক বা চেসিসে হাত বুলাতে বুলাতে তার বাক্যবর্ষণে এক মুহুর্তের জন্য বিরতি দেয় না। এরই ফাঁকে ফাঁকে একেকজন ড্রাইভারকে রিকশা দেওয়া হয়। ১টি ও ২টি, ১টি ও ২টি-৩টে করে চাকা রাস্তায় গড়ায়। শেষ রিকশাটির প্যাডেল ঘুরতে শুরু করলে তসবিতে আল্লাকে গুণতে গুণতে রহমতউল্লা নাশতা করতে যায় ডানদিকের তেহারির দোকানে।
ঈদের দিন রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার নিয়ম নাই। তবে কোনো ঈদেই সবগুলো রিকশা সে ছাড়ে না। রিকশাওয়ালা যারা আসে সবাইকে ঠেসে খাওয়ায়, কিন্তু রিকশা দেয় মাত্র কয়েকজনকে। এমনিতে যাবতীয় রিকশাওয়ালার ওপর রহমতউল্লা খুব চটা, খানকির বাচ্চা না হইলে রিকশাচালাইবার কাম কেউ লয় না। মাহাজনরে ক্যামনে ঠকাইবো হালারা থাকে খালি হেই তালে। এদের মধ্যে একটু কম খানকির বাচ্চা কে, কে একটু কম ঠকায়,—এসব যাচাই করে নিতে খানিকটা সময় নেয়। আবার কারো কারো কাছে অনেকদিনের পাওনা টাকা-পয়সা আদায় করা যায় এই দিনেই, আব্বে জব্বইরা, মালীবাগের মোচড়ের মইদ্যে টেরাকের লগে রঙবাজি করবার গিয়া দুইশ বারোটারে উল্টাইয়া দিছিলি না? আমারে কতোটি পয়সা জরিমানা করাইলি খবর রাখস? জব্বারকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মেজাজ চড়ে যায়, একটা পয়সা দিছিলি?
টায়ার টিউব জখম হইছিলো মাহাজন। জব্বারের এ কৈফিয়তে রহমতউল্লাহুঙ্কার ছাড়ে, টায়ারের মায়েরে বাপ ইস্পোকগুলার দাম দিবো তর কুন বাপে? নিয়ম অনুসারে স্পোক ছাড়া অন্য কিছু নষ্ট হলে মেরামতের দায়িত্ব মহাজনের। মালীবাগের মোড়ে জব্বার একটা রিকশা ওভারটেক করতে গিয়েছিলো, পেছনের ট্রাকের ধাক্কায় ২১২ নম্বর রিকশা একেবারে উল্টে যায়। চাকা ও মাডগার্ড সব পাল্টাতে হয়েছিলো মহাজনের সেই রাগ এখন পর্যন্ত যায়নি। কিন্তু নষ্ট ও বাতিল চাকার সবগুলো স্পোকের দাম দিতে হবে শুনে জব্বার একেবারে মিইয়ে যায়। লোকটা একবার শেষ চেষ্টা করে, মাহাজন, তহন তো কিছু কইলেন না!
তহন কইলে এতোগুলি পয়সা দিবার পারতি? তহন তরে ম্যাহেরবানি করছি। যা, তর পসা লইয়া আমার কাম নাই, ফকুরনির বাচ্চা, চোপা মারস, না? তর চোপার মায়েরে বাপ! এদিকে ঈদের জামাতের সময় হয়ে এসেছে, মহাজনের হাতে পায়ে ধরে সবগুলো স্পোকের দাম যা হয় তার একটা ভাগ দিয়ে জব্বার রিকশা পায়। মালপানিওয়ালা প্যাসেঞ্জার ধরে বায়তুল মোকাররমে ট্রপ দিতে পারলে এর দ্বিগুণ রোজগার। তাই রহমতউল্লাই বা ছাড়বে কেন? ঈদের দিন তার খরচ কি কম? পয়সা আসবে কোথেকে? তার এক ডিগচি সেমাই তো সাবাড় করবে এই ফকুরনির বাচ্চার দলই। ঈদের দিন সকালবেলাটা তাই রহমতউল্লাকে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকতে হয়।
কিন্তু আজ ভোর হতে না হতে সরু গলিটা পার হয়ে মহাজনের বাড়ি এসে ঘাপলা বাধালো আলাউদ্দিন মিয়া, মামু, আউজকার দিনটা গ্যারেজে না গেলেন। কেউগারে পাঠায়৷ দেন, গাড়িগুলি ডেরাইভারগো দিয়া আইবো।
রহমতউল্লা রাজি না হলেও আলাউদ্দিন ছাড়ে না, আউজকা তো ভাড়াউড়ার কারবার নাই। কেউরে পাঠাইলেই হইলো। লন, জলদি নাহাইয়া লন, বায়তুল মোকাররম যামু। বহুত বড়ো জামাত, বহুত মানুষের লগে মিলবার পারুম। এতেও রহমতউল্লার সায় নাই, না মিয়া, ঐগুলি ছাড়ো। আমাগো পুলের উপরের মসজিদ কি আইয়ুব খানের মিলিটারি কজা করছে, না চৌচল্লিশ ধারা দিয়া মুসল্লিগে আটকাইয়া রাখছে? বাপ দাদা ময় মুরুব্বি চোদ পুরুষ নামাজ পড়ছে পুলের উপরের মসজিদে, আউজকা তুমি নয়া জায়গা বিচরাও? পুরনো প্রথার প্রতি মামার আনুগত্য আলাউদ্দিন মেনে নেয়। কিন্তু মামার গ্যারেজে যাবার ব্যাপারে তার আপত্তিতে সে একেবারে অটল। সে ১টি নতুন কৌশল প্রয়োগ করে, ঠিক আছে, কেউরে পাঠাইয়া কাম নাই। আমি যাইতেছি। আমারে বিশ্বাস করেন তো? আলাউদ্দিন মিয়া প্রায় চেচিয়ে কথা বলে। মামার জন্যে তার এই মাথাব্যথা যেন সকলের কানে লাগে। অন্তত মামার বৌটার কানে কথাগুলো পৌছানো দরকার। ঈদের দিন ভোরবেলা উঠেই রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে মুখ খারাপ করাটা তার মামীর পছন্দ নয়। হাজার হলেও মামী তার বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরাত। তিন পুরুষ আগেই তাদের অবস্থা পড়ে গেলে কি হয়, -কথায় বার্তায়, চাকরবাকরদের ধরে এই মারধোর করায়, আবার এই গাদা গাদা খাবার দেওয়ায়, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে নাকউঁচু দ্যাখানোতে তার খানদানি ভাবটা সব সময় ঘ্যানঘান করে। মামীকে পটানো আলাউদ্দিন মিয়ার খুব দরকার। মামীর মেয়েটার আবার বাপের চেয়ে মায়ের দিকেই ঝোকটা বেশি। কিছুদিন থেকে মামীর ভাইয়ের আইএ ফেল ছেলেটা এই বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। নাঃ মামীকে ভজাতে না পারলে কাজ হবে না। মামার গ্যারেজে যাওয়ার বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে পরম ধৈর্য ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে সে বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির নানারকম প্রকাশ দ্যাখাতে থাকে। লেগে থাকলে কি না করা যায়? শেষ পর্যন্ত মামী ও মামীর মেয়ে আলাউদিনের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং মহাজনের রিকশার গ্যারেজে যাওয়ার দায়িত্ব পায় খিজির।
মামাভাগ্লের গ্যারেজ ২টো পাশাপাশি। ঈদের দিন আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য সবগুলো গাড়িই বের করে। বেবি ট্যাকসি আজ তার নিজেরই কাজে লাগবে, রিকশাগুলো বাইরে গড়িয়ে দিয়ে খিজির ঢোকে মহাজনের গ্যারেজে।
খিজিরকে দেখে রিকশাওয়ালার ইচ্ছামতো রিকশায় হাত দিয়েই টানাটানি শুরু করে। সুর্মমাখা চোখ কুঁচকে খিজির ওদের কাণ্ড দ্যাখে আর চাচায়, আরে এইটা কি খানকিপটি পাইলি? গলায় রহমতউল্লার ঘর্ঘর টোনটি আনার চেষ্টা করে, আরে এইটা কি তোরা কান্দুপট্টি পাইলি? মনে লয় খানকিগো মাজা ধইরা সিনা ধইরা টান মারবার লাগছস! মহাজন না আসায় রিকশাওয়ালাদের তেজ বেড়ে গেছে, রিকশাগুলো যেন শালদের বাধা খানকি! একেকজনের বুক-চিতানো কথা শোনো, ঈদের দিন আবার পসাকিয়ের বে?
বাকি পসার খবর তুই রাখবি ক্যামতে? যা যা, বাড়ি গিয়া মহাজনরে দিয়া লাখাইয়া লইয়া আয়। তাহলে মহাজনে আহুক’ খিজিরের এই প্রস্তাবে রিকশাওয়ালাদের তেজ নিভে যায়। মহাজন আসা মানে প্রথম থেকে গ্যাঞ্জাম। তার মানে নামাজের খ্যাপ ১টাও পাওয়া যাবে না। তখন প্রত্যেকের কোমর থেকে ১ টাকার নোট, আধুলি, সিকি বের হতে থাকে। কয়েকজন শেষের ২/১টা টান বাকি রেখে বিড়িটা তুলে দেয় খিজিরের হাতে এবং এই বিড়ি দেওয়ার ক্ষোভ মেটায় এই বলে, কি ৰে, হাড্‌ডির বাচ্চা, মাহাজনের গতর উত্তর অহনও বানাইয়া দেস? না, মাহাজন অহন তরে ছাড়ান দিয়া আর কেউগ্যারে ধরছে? এসব কথার জবাব দেওয়ার সময় কৈ খিজিরের ১টা ১টা করে ৩টে বাদে সবগুলো রিকশা রাস্তায় নামে। নামাজের সময় প্রায় হয়ে গেলো। রহমতউল্লা ও আলাউদিনের বাড়ির সতরঞ্চি, চাদর ও জায়নামাজ মসজিদ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব খিজিরের ওপর। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। ক্রিং কিং -রিকশার ঘন্টার আওয়াজ, গ্যারেজের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে।-কোন হালা পোংটা পোলা গ্যারেজের মইদ্যে ঢুকছে –বিরক্ত হয়ে খিজির ভেতরে ভালো করে দাখে। না, কেউ না। বোধ হয় রাস্তায় রিকশার ঘণ্টা। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে বাশের মোটা বাতায় তৈরি দরজা চেনের সঙ্গে তালা লাগিয়ে বন্ধ করছে, এমন সময় ফের শোনা যায়, ক্রিং ক্রিং ক্রিং’ খিজির দরজা খুলে আবার গ্যারেজে ঢোকে, সব চুপচাপ। তবে গ্যারেজে কেউ না কেউ আছে। খিজিরের গা ছমছম করে, এই গ্যারেজে ছেলেবেলায় বহু রাত্রি কেটেছে, মাঝে মাঝে নন্দলাল দত্ত লেনের গলা-কাটা মাহাক্কালটা এসে রিকশার বেল বাজাতো! সেই ব্যাটা কি আজ আবার এসে হাজির? গা ছমছম ভাবটা মুহুর্তে কেটে যায়, শালা বদ জিনটার সঙ্গে একটা বোঝাপড় করার জন্য সে গ্যারেজের এমাথা ও-মাথা ঘোরাঘুরি শুরু করে।
ইট সুরকির ১৫ ইঞ্চি দেওয়াল আসলে রহমতউল্লার বাড়ির সীমানা। একদিকে সেই দেওয়াল, সামনে ও ২ পাশে টিন ও বাঁশের মোটা বেড়া দিয়ে মহাজন এই গ্যারেজ শুরু করে প্রায় ১৯/২০ বছর আগে। তখন ২টো রিকশা রাখার মতো একটুখানি জায়গা ছিলো, সবটাই বেড়ায় ঘেরা। পরে এই বাড়ির মালিক হবার পর মাহাজন দেওয়াল ঘেঁষে গ্যারেজ বানায়। দিন যায়। গ্যারেজ এগিয়ে চলে সামনের দিকে। রাস্তার ড্রেন পেরিয়ে গ্যারেজ এগোয় রাস্তায়। এরপর বাড়াতে হয় পাশে। এখন ওদিককার ল্যাম্পোস্ট পার হয়ে গেছে, ফলে গ্যারেজের একটা সাইডে বা লাগাতে হয় না। পুরু দেওয়ালের ১দিকে দরজা কেটে বাড়ির ভেতরের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। কিন্তু ছোটলোকের বাচ্চাগুলো যখন তখন ভেতরে ঢুকে চুরি চামারি করবে, অন্দরে পর্দা থাকবে না-কয়েকটা ইট সরাবার পর এই নিয়ে বিৰিসায়েব হাউকাউ করায় দরজা ফোটাবার কাজ বন্ধ থাকে। আলগা ইটগুলো কোথায় ছিটকে পড়েছে, সেখানে বিরাট ১টি ফাক। এছাড়াও এখানে ওখানে ইট খসে পড়ায় কিংবা ইট খসিয়ে নিয়ে এটা ওটা রাখবার জায়গা করা হয়েছে। খিজির যখন এখানে থাকতো, এগুলো কি এভাবেই ছিলো? অনেকগুলো মার্বেলের ঠোকাঠুকির আওয়াজে সে চমকে ওঠে, তার মার্বেল লুকিয়ে রাখতো একটা খোপে, সেটা কোনটা? সেই আওয়াজ অনুসরণ করে সে এদিক ওদিক হাতড়ায়। না, কোথায় মার্বেল? ১টা খোপে সাইকেলের অচল চেন। আরেকটা খোপে তেলের ছোটো একটা টিন। আচ্ছা, সন্ধ্যার পর রায়সায়েবের বাজারের পাশে চোরাবাজারে গ্যারেজের ১টা ক্ষু ড্ৰাইভার বেচতে গিয়েছিলো, হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকারে হাতিয়ে নিয়েছিলো ১টা বল বেয়ারিং। ঘরে এসে দ্যাখে একেবারে নতুন, এতো সুন্দর চকচক করতো। এই দেওয়ালের কোন ফোকরে লুকিয়ে রেখেছিলো। বিক্রি করতে ইচ্ছা করতো না। তারপর বিক্রি করার ইচ্ছা ও সুযোগ যখন হলো তখন কিন্তু সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন ফোকরে রেখেছিলো? নাঃ! কোথাও নাই। সিলেটের প্যাকেট-ছেঁড়া তাসের তাড়া কোথায় রাখতো ১টা খোপে হাত দিলে খসখস করে, কিন্তু না, সেখানে ব্যবহৃত শিরিষ কাগজের টুকরা। আরেকটাতে ক্ষুড্রাইভার, ১টিতে সাইকেলের চেন। নাঃ! তার বল-বেয়ারিং কি মার্বেল কি তাসের তাড়া পাওয়া যায় না। ওদিকে ঘরের ভেতর কানের পাশে রিকশার ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিয়ে বেজে চলে, খিজিরের হাতের তালে তালে সেই ঘণ্টা-বাজানো নিয়মিত বাজনায় রূপ নেয়। নাঃ! তাকে কিছুঁতেই ধরা যাচ্ছে না। হতাশ হয়ে খিজির দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
গলি দিয়ে নোঙর বাঁচিয়ে চলেছে ধোঁয়া পাজামা পাঞ্জাবি লুঙি পরা লোকজন। তাদের প্রত্যেকের মাথায় টুপি, অনেকের আঙুলে শিশুর হাত। কাউকে ভালো করে দ্যাখা যায় না, আস্তে আস্তে রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে রাস্তাও চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে যায়। খিজির ওর মাথা বারবার বাঁকালেও কোনো ফল হয় না। আজ চুলে এতোটা তেল দেওয়ায় কি তার মাথার ভেতরটা জমে বরফ হয়ে গেলো? চুল বেয়ে তেল চুয়ে চুয়ে তার করোটির ভেতর গড়িয়ে মগজের এ-চাকায় ও-চাকায় জট পাকিয়ে রেখেছে। কোনো চুতমারানি ট্রাফিক পুলিসের সাধ্য কি যে সেই জট খুলে? তার মগজে কি শুরু থেকেই এরকম জাম লেগেই থাকতো? তার মায়ের অবশ্য ধারণা ছিলো যে, খিজিরের করোটি একেবারে খ খ করে, সেখানে এক কাচ্চা মগজ যুদিল থাকে। তরে লইয়া আমি কি করি? তর কপাল তুই দেখবি, আমার কি? মা একবার বকতে শুরু করলে থামতে পারতো না, তরে কতোবার কইছিমিস্ত্রীর সামনে তুই পড়বি না। তরে দেখলে মিস্ত্রী এক্কেরে খাট্টা হইয়া উঠে, আর তুই বেলাহাজ বেশরম খাট্টাশের পয়দা একখান, তামামটা দিন ঘুইরা ফিইরা খালি তার সামনেই পড়বি!’
কিন্তু খিজির কি আর ইচ্ছা করে মিস্ত্রীর সামনে পড়তো? মিস্ত্রী শালা জোয়ান একখান মরদ, সে কি-না বৌয়ের পোলার রোজগার খাবার লোভে দিনের মধ্যে ২ বার ৩ বার এসে হাজির হতো লোহার পুলের গোড়ায়। কতোই বা রোজগার ছিলো? তখন ওর কাজ রিকশা ঠেলে ঠেলে লোহার পুলে উঠিয়ে দেওয়া। একবার সূত্রাপুরের ঢাল থেকে ওপরে উঠিয়ে দাও, তারপর ফিরে এসো একা একা। তারপর আরো সব পিচ্চিদের সঙ্গে আবার রিকশার পেছনে ছোটে, ধাক্কা দেই?—দে। আবার ঠেলো, আবার নেমে এসো। ২ পয়সা করে জমতে জমতে ২ আনা ৩ আনা না হওয়া পর্যন্ত একটানা ওঠানামা। তারপর চিনাবাদাম খাও, কি সোনপাপড়ি, কি ছোলার ঘুঘনি। অথবা পুলের ওপর এক ধারে নুলো বুড়ির কাছে বসে আধ-পচা আম কি পাখি-ঠোকরানো নোনাফল কি আধখানা কাটা মিষ্টি আলু। কিন্তু কি বলবো, ৩/৪ ঘণ্টা যেতে না যেতে ফরাসগঞ্জের আটার কলের কাজে বিরতি দিয়ে ফালুমিন্ত্রী শালা ঠিক হাজির, দেহি, কতো পাইছস? পয়সার পরিমাণ তার মনমতো না হলেই ঘাড়ে পিঠে সমানে কিলচড়, হারামির বাচ্চা, প্যাটখান বানাইছস কলতাবাজারের পানির টাঙ্কি, যহনই দেহি চুতমারানির মুখ চলতাছে। মিস্ত্রীর আড়ালে থাকার জন্যে চেষ্টা তো কম করতো না। একদিন পুলের ওপর ১টা সিকি কুড়িয়ে পায়, সেটা নিয়ে মইজার মায়ের পোলা মইজার সঙ্গে তার একচোট হাতাহাতিও হয়, সিকিটা নাকি মইজা আগে দেখেছিলো। শেষ পর্যন্ত রফা হয় এই শর্তে যে, ২জনেই সূত্রাপুরের ঢালে ১টা হোটেলে গরুর গোশত খাবে। ব্যাপারটা ফালু মিস্ত্রী টের পেয়ে গিয়েছিল, মনে হয় মইজা হালায় পুরো পয়সাটা না পাওয়ার ক্ষোভে তার কানে লাগায়। পুলের ঢালে ট্র্যাফিক পুলিস বক্সের পেছনে ফালু সেদিন তার গলা ধরে এমন চাপ দিয়েছিলো যে, গোশতের টুকরাগুলোর স্বাদ সে জিভে আরেকবার অনুভব করে। এদিক দিয়ে ধরলে ফালু মিস্ত্রী বরং তার উপকারই করেছিলো, তারই বেদম মারের চোটে ২ আনার গোশতের স্বাদ ১ ঘণ্টার মধ্যে ২ বার ভোগ করলো।
ফালু মিন্ত্রী লোক কিন্তু এমনিতে খুব খারাপ ছিলো না। অন্তত খিজিরের মায়ের গায়ে সহজে হাত তুলতো না, এটা ঠিক। খিজিরের মা, এমনকি খিজির পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকার সময় সবচেয়ে বেশি আরাম ভোগ করেছে। ফালুর বসবাস ফরাসগঞ্জের একটা বড়ো বাড়ির ঘোড়ার আস্তাবলে। বাড়ির মালিক তার দুই পুরুষের মনিব, ফালুর বাপ মনিবের ঘোড়ার গাড়ি চালাতো, ঘোড়ার গাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার পর আস্তাবলটাই সাফ সুতরো করে নিয়ে ফালু সেখানে বাস করতো। মনিবের আটার কলে সে মেশিন চালায় আর তার বৌ যেই হোক না ঐ বাড়িতে কাজ করতে হতো তাকে। ফালু এমনি হাসিখুশি মানুষ, কখন যে তার মেজাজ খিচড়ে যাবে কে বুঝবে? দ্যাখো না, মায়া সিনেমায় মোলাকাত দেখে ছবির কাহিনী বলার জন্যে বৌকে নিয়ে বসেছে,—এমনকি ঘুমিয়ে-পড়া খিজিরের মাথাটা বালিশে ঠিক করে বসিয়ে দিলো-কাহিনী বর্ণনার মাঝে হঠাৎ কি হলো, ঘুমন্ত বালকের পিঠে দমাদম শুরু করলো কিল মারতে। হাতের সঙ্গে সমানে চললো তার মুখ, এই জাউরাটারে কদর দিয়া খেজুর কাটা পুঁইতা ঘরে আইলে আমার দিলটা ঠাণ্ড হয়। বুইরা হারামজাদা,তর ইসে কইটা দিমু, এক্কেরে পোতাপুতা লইয়া কাটুম, জিন্দেগির মইদ্যে বিছনার মইদো তর প্যাশাপ করা বারাইবো দেহিস।
বিছানায় পেচ্ছাব করার ব্যাপারে খিজিরের কি করার ছিলো? ২/১ রাত পরপর ঘুমের ভেতর কারো উস্কানিতে সে সোজা চলে যেতো ফরিদাবাদ পেরিয়ে মিল ব্যারাকের পর আইজি গেটে। এই জায়গাটা তার এমনিতে চেনা, ফালুর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মাঝে মাঝে এসে ডাংগুলি খেলতো। মাঠের এক কিনারে পেচ্ছাব করতে কি যে ভালো লাগতো। কিছুদিন পর রহমতউল্লার গ্যারেজে তোতামিয়া ওকে ন্যাংটা করে খুব জাপ্টাজাপ্টি করছিলো, তখন তার নুনু অনেকটা সেইভাবে শিউরে ওঠে। সে তো অনেক পরেকার কথা। বিছানায় পেচ্ছাব বন্ধ করার জন্য মা তার কম চেষ্টা করেনি। কতো তাবিজ, কতো পানি পড়া! শেষ পর্যন্ত সারলো রহমতউল্লার বাড়ির ঠিকা-ঝি মজির মায়ের জোগাড়-করা ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মৌলবি সায়েবের পানি-পড়া খেয়ে। কিন্তু এতেও ফালু মিস্ত্রীর মারধোর কমে না। খিজির অনেকদিন থেকেই ঐ বাড়ি থেকে কেটে পড়ার তালে ছিলো। কিন্তু ওর মাও যে সরে পড়বে এটা কিন্তু খিজির কখনো কল্পনা করেনি। ফালুর ঐ প্রায়-পাকা আস্তাবল ঘর, ঘরের সামনে পাকা উঠানে সারা রাত ধরে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে, সেই আলোতে রাত্রে নিশ্চিন্তে কাটা বেছে ফলি মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া চলে। একদিকে চাকরবাকরদের জন্য সারি সারি খাটা পায়খানা, পায়খানার সারির পাশে চৌবাচ্চায় দিনরাত পানি -সব ছেড়ে আহাম্মুকের মতো মা চলে এলো। তেমন কিছু আনতেও পারলো না। লুকিয়ে গোটা দুয়েক শাড়ি, সের চারেক চাল আর ১টা বিছানার চাদর পাঠিয়ে দিয়েছিলো খিজিরকে দিয়ে। কিন্তু মনিবের ভালো শাড়িটা সরাতে গিয়ে পারলো না। নতুন মাতার মাগীটা ভঙ্কে তঙ্কে ছিলো, ঠিক সময়ে ধরে ফেলে। শাড়ি লুকিয়ে নেওয়ার কথা শুনে ফালুর লাফালাফি কী ‘কাপড় দিয়া তুই করবি কি। খানকি মাগী গতরখান কাপাইলে তর ভাত কাপড়ের অভাব?
কথাটা মিস্ত্রী খুব ভুল বলেনি। কালোকিষ্টি মা মাতারির গতরখান না থাকলে মায়ে পোয়ে তারা কোথায় ভেসে যেতো!—তা সেই বারো ভাতারি মা মাগীটা কি এতোকাল পরও তাকে রেহাই দেবে না? কিসের জিন, কিসের মাহাক্কাল, খানকি মাগী মা-ই আজ এসে তার ঈদের নামাজ পড়তে দিলো না। দেওয়াল থেকে বলকানো মাথাটা তুলে খিজির দ্যাখে রাস্তায় লোকজন নাই। তার শরীর একেবারে এলিয়ে পড়ে। তবে এই সময় সুভাষ বোস এ্যাঁভেনু বা হৃষিকেশ দাস রোড কি নন্দলাল দত্ত লেনের মুখে কোনো ট্রাকের অসহিষ্ণু হর্নের আওয়াজে খিজিরের কান চোখ গাল ঠোঁট সব ছিঁড়ে খুঁড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সমস্ত গতরটা আপনা-আপনি গোছগাছ হলে খিজির সোজা উঠে দাঁড়াতে পারে।
মহাজনের বাড়ি গেলে মহাজন রহমতউল্লা বা সায়েব আলাউদ্দিন প্রায় কিছুই বকাবকি করে না। আলাউদিনের কথায় বরং একটু প্রশ্রয়, বছরকার একটা দিন, বলদটা গ্যারেজের মইদ্যে কাটাইয়া দিলি? নামাজটা ভি পড়লি না?
‘আরে রাখো’ রহমতউল্লা সোজাসুজি কাজের কথায় আসে, এ্যাঁগো আবার নামাজ কালাম!—গাড়ি দিলে কয়টা? বাকি পসা পাইছস?
রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে আদায়-করা বাকি পয়সা গুণে নিতে নিতে রহমতউল্লা তার ক্ষোভ প্রকাশ করে, এ্যাঁগো আবার নামাজ। ঈমান নাই, এ্যাঁগো আল্লা-রসুলের ডর আছে? এবার কিন্তু খিজিরের সত্যি ভয় হয়। আল্লা-রসুলকে সরাসরি ভয় করার সাধ্য তার নাই। কিন্তু তার ঈমানের অভাবের কথা বলতে বলতে মহাজন যেভাবে তার দিকে তাকাচ্ছিলো তাতে সে বড়ো বিচলিত হয়। এর ওপর মহাজন তাকে ৫টা টাকা বকশিস দিলে খিজিরের গলা শুকিয়ে আসে। আধ ঘণ্টা এদিক ওদিক ঘুরে রহমতউল্লার কাছে গিয়ে বলে, মাহাজন। এই পাঁচ সিকা পসা দিবার কথা মনে আছিলো না। দেলোয়ার ইস্পোকের দাম দিয়া গেছে!’
মহাজনের মাধ্যমে গেথে-যাওয়া ঈমানের ভয় তবু তার কাটে না। রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে আদায় করা পয়সা এখনও তার কাছে রয়ে গেছে, ১টা আস্ত টাকার নোট, ১টা আধুলি, ১টা সিকি। ভাড়াইটাদের ঘরে ঘরে বাড়িওয়ালার পাঠানো খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় দ্যাখা প্রথম ভিখারির থালায় আস্ত আধুলিটা ফেলে দিলো। সকালবেলা রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে পাওয়া পয়সা থেকে হাতানে ৩টে টাকার বেশির ভাগই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় খিজিরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

চিলেকোঠার সেপাই – ০৭

খাওয়া শেষ করতে করতে ওসমান জিগ্যেস করে, খিজির তো এখানে অনেকদিন থেকে আছো, না?
সে তো বটেই। রহমতউল্লা মহাজনের বাড়ি, রিকশার গ্যারেজ, আলাউদিনের গ্যারেজ, এই বস্তি, কিছুদিন একনাগাড়ে রিকশা চালানো, আলাউদিনের গ্যারেজে ঢোকার পর রিকশার পর স্কুটার চালানো, রিকশা ও স্কুটারের যন্ত্রপাতি ঠিক করা, এই যে স্কু আর প্রায়ার আর নাট বন্টু, এই যে চেসিস আর ব্রেক আর টায়ার, এই যে এখানে স্কু বসানো, স্কুতে স্কু-ড্রাইভার ঘোরানো—এই তো চলছে কতোদিন থেকে। কতোদিন থেকে! কতোদিন থেকে কতোদিন থেকে!—খিজিরের মুণ্ডুটা তার গতরের ওপর একটা স্কুর মতো উল্টোদিকে খুলে যেতে থাকে।
খিজির সংক্ষেপে জবাব দেয়, বহুত দিন! আউজকার কেস?—ফালু মিস্ত্রীর সঙ্গে থাকতে থাকতেই খিজিরের মা মহাজনের ওখানে ঠিকা কাজের ব্যবস্থা করে নেয়। দুপুরবেলা এসে বাসন মেজে দিয়ে যেতো, ফালুমিস্ত্রির সায় ছিলো, তার মনিবের বৌ ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারেনি। খিজিরের মায়ের এই কাজ যোগাড় করে দেয় রহমতউল্লার বাড়ির বাধা মাতারি, এই মাতারির নিয়ে-আসা মৌলবির পানিপড়াতেই খিজিরের বিছানায়-পেচ্ছাব-করা বন্ধ হয়। বলতে গেলে রহমতউল্লার ভরসা পেয়েই খিজিরের মা ফালু মিস্ত্রীকে ছেড়ে চলে আসে। ফলে ঐ মাতারির চাকরিটা খোয়া গেলো। তখন থেকে তাদের খাওয়া-পরা, হাগা-মোতা সব এখানেই। মায়ে-পোয়ে সিঁড়ির নিচে গুটিমুটি হয়ে ঘুমাতো, তা হাত পা ছড়াবার অতো দরকারই বা কি? কিন্তু কোনো কোনো রাত্রে ঐটুকু জায়গা থেকে সে গড়িয়ে চলে আসতো বারান্দার দিকে। কখনো কখনো ঘুমের ভেতর কি নিমধুমে তার পায়ে কি হাতে খিজির অন্য কোনো শরীরের ছোঁয়া বুঝতে পেরেছে। ঘুমের ঘোরে একদিন সে মায়ের পিঠ ছুঁতে গিয়েছিলো। কিন্তু তার হাত ঠেকে মোটাসোটা ১টা পিঠে। আরেকদিন তার চিবুকে লেগে গিয়েছিলো শক্ত সমর্থ সেই হাত। ভয়ে সে ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি এই ডাক ঠিক স্পষ্ট হয়নি। বারান্দার দিকে সরে পাশ ফিরে জোড়াহাঁটুর মাঝখানে হাতজোড়া রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
এর একদিন পর একবার আড়ালে ডেকে মা বলে, মাহাজনের রিকশার গ্রাজ আছে না? আছে না? আমি কতো গেছি! এই তো এই বাড়ির পাচিল পার হইলেই গ্রাজ! রহমতউল্লার রিকশার গ্যারেজের বর্ণনা দেওয়ার জন্য খিজিরের উৎসাহের আর শেষ নাই।
গ্রাজ বলে রাইতে খালি থাকে? নাঃ রাইতে তোতামিয়া থাকে। তোতায় কয় গ্রাজের মইদ্যে মাহাজনেরে কইয়া মিলাদ পড়াইতে হইবো। জিনে বহুত জ্বালায়!
ঐগুলি কোনো কথা না’, এবার খিজিরের মা আসল কথা পাড়ে, ‘তুই মাহাজনের গ্রাজের মইদ্যে থাকবি, রাইতে থাকবি। মাহাজনের অনেকগুলি গাড়ি, কেউরে বিশ্বাস করবার পারে না!’
এইবার খিজিরের একটু ভয় করে, একলা থাকুম? ‘একলা থাকবি ক্যালায়? তোতামিয়া আছে না? মায়ের এই কথাতেই খিজির চুপ করে যায়। পরপর কয়েকটা রাত্রি গ্যারেজে কাটলো, খিজির রান্নাঘরে এসে মায়ের সঙ্গে খেয়ে যায়, তেমন করে কথা বলে না। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে খিজিরের মায়ের কেমন বাধো বাধো ঠেকে। একদিন বিবিসায়েবের চোখ এড়িয়ে সরিয়ে-রাখা মুরগির একটা রান ছেলের পাতে দিয়ে জিগ্যেস করে, রাইতে ডরাস?
‘না ডর কিয়ের? মুরগির রানে খিজিরের তখন অখণ্ড মনোযোগ। পারে তো হাড়ের গুড়ো সব গিলে ফেলে।
এসব কবেকার ঘটনা, কতোদিন আগে ঘটলো? দিন তারিখ খিজিরের মনে থাকে না, কিন্তু সেইসব ঘটনা দেখতে দেখতে তার লাল রেখা-উপরেখা কবলিত চোখজোড়া খচখচ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের রক্তে-ভাসা শরীরের ছায়া পড়ায় চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে ওঠে। খিজিরের চোখেই যেন তার মায়ের সব রক্ত মোছা হয়ে যাচ্ছে।
মায়ের রক্তপাত ঘটেছিলো শেষরাত্রে। খুব ভোরবেলা, প্রায় রাত থাকতে থাকতেই বিবিসায়েবের তলব পেয়ে ঘুম-জড়ানো চোখে খিজির গ্যারেজ থেকে এসে দ্যাখে যে, তার মায়ের কাপড়চোপড় সব কালো রক্তে মাখা। সকাল ৮টার মধ্যেই মহাজন তার দাফনের সব ব্যবস্থা করে ফেলে। মহাজনের অনেক পয়সা বেরিয়ে গিয়েছিলো। মাকে ধোঁয়াবার জন্য নতুন একটা বাঙলা সাবান কেনা হয়। কতো কপূর, কতো আতর, গোলাপজল, আগরবাতি। তখন মহাজনের ঘরে বংশালের বিবি। মহাজনের প্রথম বৌ। দিনরাত নামাজ রোজা অজিফার মধ্যে থেকে বিবিসায়েবের বয়স বেড়ে গিয়েছিলো অনেক, এর ওপর ১৩/১৪ বছরের একমাত্র ছেলে আওলাদ হোসেন মারা যাওয়ার পর পরপর দুটো মরা বাচ্চা হলো, এরপর শুরু হয় তার ছোঁয়াছুয়ির বাতিক। দিনের মধ্যে ৩ বার ৪ বার গোসল করা, ২৫ বার অজু করা আর ৫০ বার হাতমুখ ধোঁয়া। ওদিকে মহাজনের দ্বিতীয় বিবি বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরত,-সেও সতীনের ঘর করবে না। রহমতউল্লা তো বড়ো বৌয়ের কথা লুকিয়ে তাকে বিয়ে করেনি। তাহলে? অবশ্য এরকম একটা আভাস দিয়েছিলো যে, বড়ো বৌকে আলাদা বাড়িতে রাখবে। কিন্তু তাই কি হয়? ছেলেপুলে না-ই বা দিতে পারলো, সে হলো তার প্রথম স্ত্রী। তার বাপের পরামর্শ ও পয়সা দিয়েই রহমতউল্লা প্রথম রিকশা কেনে। এই বিয়ের পরই তার টাকা পয়সা আসতে শুরু করে, নামডাক হয়। বড়ো পয়মন্ত বিবি। তার ছোঁয়াছুয়ির বাতিক সহ্য না করে রহমতউল্লার উপায় কি? বড়ো বৌয়ের বাঁকা বাঁকা কথাতেও মহাজন কখনো রা করতো না। খিজিরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বড়ো বিবি বলে, ‘মায়ের লগে লগে থাকবার পারস নাই? তুই লগে থাকলে তর মায়ে এমুন কইরা তরে ছাইড়া যায় গিয়া? খিজিরের কিন্তু খুব অস্বস্তি ঠেকছিলো, বিবিসাবরে আউজকা না হউক ৫০ বার নাহাইতে হইবো! –কিন্তু ৫০ বার গোসল করুক আর ১০০ বার অজু করুক, সেদিন রাত্রে বিবিসায়েব নিজের ঘরের মেঝেতে শুতে দিয়েছিলো খিজিরকে। তার সামনেই বিবিসায়েব মহাজনকে বকে, হাবিয়া দোজখের মইদ্যেও তোমার জায়গা হইবো না আওলাদের বাপ! কি খাওইয়া দিছিলা, কও তো? তোমার আখেরাত নাই? গোর-আজাবের ডর নাই? মনে হয় পরকালে স্বামীর গতি নিয়ে বিবিসায়েব বড়ো উদ্বিগ্ন। বৌকে কাঁদতে দেখে রহমতউল্লা একটু বিব্রত হয়, ‘আরে আওলাদের মাও, তুমি এইগুলি কি কও? মইরা গেছে, কইতে নাই, আবার হাছা কথা না কইয়াও থাকতে পারি না, গলা নামিয়ে বলে, খারাপ মাইয়া মানুষ, কার লগে আকাম উকাম কইরা প্যাট বাধাইয়া বসছে, অহন প্যাট খসাইবার গেছিলো, গিয়া এই মুসিবত। খাড়াও না, চাকরবাকর, রিকশার ডেরাইভার উরাইভার ব্যাকটিরে আমি ধরুম!
থাউক। বিবিসায়েব চোখ মুছে বলে, পোলারে এইগুলি হুনাইয়া ফায়দা কি?
পোলায় কি ফেরেশতা? মায়ের কারবার পোলায় জানে না, না? এ্যাঁরে জিগাও তো, বাপের নাম কইবার পারবো? জিগাও না!
বিবিসায়েব জিগ্যেস করে না। মায়ের মৃত্যুর দোষে ও মায়ের মৃত্যুর শোকে খিজির এমনি নুয়ে পড়েছিলো, এর উপর বাপের নাম না জানার অপরাধ যোগ হওয়ায় সে একেবারে নেতিয়ে পড়ে। সে কি আজকের কথা? তবু দ্যাখো, জুরাইন গোরস্তানের কবরের ভেতর মাটিতে মাখামাখি কালো রক্তে ডুবসাঁতার দিতে দিতে ভুস করে ভেসে উঠে মা তার দিকে তাকায়। বেলাহাজ বেশরম মাগীটার শরম হায়া যুদিল এটু থাকো মওতের পরেও কি মানুষের খাসলত বদলায় না? —সেই কতোকাল আগে এসব কাণ্ড ঘটেছে, এর পর মহাজনের পয়লা বিবি এক শীতের রাতে আড়াই ঘণ্টা ধরে গোসল করে নিউমোনিয়ায় ভুগে মরে গেলো। এর মাস ছয়েক আগে থেকেই অবশ্য বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরাত মেয়েকে নিয়ে মহাজনের ঘরে এসে জাকিয়ে বসেছে। তা পয়া এই বিবিরও কম নয় এর আমলে মহাজন নবদ্বীপ বসাক লেনে সরকারী পায়খানা ও পানির পাম্পের পেছনে মস্ত বড়ো বস্তির মালিক হলো। খিজিরের মা মাগী আজও সেই বস্তিতে খিজিরের ভাড়াটে ঘরে আসে ছিনালীপনা করতে। বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, এখনো মাঝে মাঝে অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে নিমখুম নিমজাগরণে খিজির বুঝতে পারে যে, মোটাসোটা একটি হাত তাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে। মা—এই সম্বোধন করার জন্যে তার শ্লেষ্মা-জমা ও সিগ্রেটের ধোঁয়ায় কালি-মাখা গলায় ঝাপশা ধ্বনিপুঞ্জ জমা হয় এবং মাথার ওপরকার কেরোসিন টিনের ছাদকে তখন সে ধরে নেয় সিঁড়ির উল্টাপিঠ বলে। তবে এই হাল বেশিক্ষণ থাকে না। জুম্মনের মায়ের সশব্দে পাশ ফেরার আওয়াজে মা এবং অন্যজন হাওয়া হয়ে যায়। বাঁশের বেড়া ও ভাঙাচোরা টিনের ফাঁক দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়ে জুম্মনের মায়ের মুখের বাদিকে। বৌয়ের গোলগাল কালো মুখে বসন্তের কয়েকটি দাগে লুকিয়ে থাকে ঘোলা আলো। খিজির তখন ঘর্ঘর-করা গলায় ‘মা’ বলে বৌকে জড়িয়ে ধরে।
আজ জুম্মনের মায়ের সঙ্গে থাকতে পারলে ছিনাল মায়ের দাপটটা সামলানো যায়। বেলা তিনটে সাড়ে তিনটের দিকে জুম্মনের মা রোজ একবার ঘরে আসে, প্রায় ঘণ্টাখানেক থাকে। আজ কি তার আসবার সময় হবে না? এখন মহাজনের বাড়ি গেলে হতো। তাহলে জুম্মনের মায়ের সঙ্গে কি একবার দ্যাখা হয়!
খিজির বোধহয় সিঁড়ির সবগুলো ধাপও নামে নি, এরই মধ্যে ওপর দিককার ধাপগুলোতে কোলাহল শোনা যায় এবং এক মিনিটের মধ্যে ওসমানের ঘরে ঢেকে রঞ্জু।
*আপনে না বাইরে গেলেন। কখন আসলেন? ‘যেতে পারলাম না। নিচে নামছি, খিজির এসে হাজির। এখন যাচ্ছি। রঞ্জুর পেছনে রানু ও ফরিদা। ওরাই কথা বলছিলো বেশি। ওসমানকে দেখে দুজনে হঠাৎ থামে। ওসমানকে একবার দেখেই রানু চোখ রাখে আরেকটা দরজা পেরিয়ে ছাদে, সেখানে ছাদভাসানো রোদ। ওসমান বলে, তোমরা ছবি তোলো। চমৎকার রোদ আছে।’
ফরিদার পেছনে কচি কচি মার্কা চেহারা লম্বা একটি তরুণ। তার খয়েরি রঙের চাপা প্যান্ট, চেন-খোলা জ্যাকেট, গলায় বেগুনী-হলুদ সিন্ধের স্পার্ক। তার ঘাড় থেকে ঝোলানো ক্যামেরা, সারা শরীর থেকে সেন্টে ঝাঁঝালো গন্ধ বেরুচ্ছে। ছোকরা ওসমানের দিকে হাত বাড়ায়, আশিকুর রহমান বাদল, পাকিস্তান টোবাকোতে সেলসে কাজ করি। করমর্দন করতে করতে ওসমান নিজের নাম বলে এবং শুধু রঞ্জুর কাছ থেকে বিদায় চায়, তাহলে চলি।
রঞ্জুর হঠাৎ কি মনে হয়, বলে, নানা যাবেন কেন। আপনেও থাকেন না! ওসমান ইতস্তত করে, সে থাকবে কেন? ইয়ং হাজব্যান্ডও আহবান জানায়, আপনি থাকেন না! মোস্ট ওয়েলকাম।
রঞ্জুর উৎসাহ এতে বাড়ে, আপনে থাকেন। দুলাভাই আমাদের ছবি তুলবে, কিন্তু দুলাভাইয়ের ছবি তুলবে কে?
কিন্তু ক্যামেরা জিনিসটা চালানো সম্বন্ধে ওসমানের কিছুমাত্র ধারণা নাই। সে তাড়াতাড়ি বলে, আমার একটু কাজ ছিলো।’
রঞ্জু বলে, ঈদের দিন আবার কাজ কিসের? ফরিদার দিকে তাকিয়ে রানু আস্তে করে বলে, তোরে দেইখা ভয় পাইছে। লালচে হয়ে যাওয়া মুখ সত্ত্বেও ফরিদা হাসে, ভয় টয় পাইলে তোরেই পাইতে পারে। আমরা উনার আর কি করতে পারি?
ফরিদার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে রানু ওসমানকে অনুরোধ করে, আপনি থাকেন। এই দুইজনে একসঙ্গে ছবি তুলবে বইলাই তো আসছে। আসল তো এই দুইজন, আমরা ফাউ। আসল ছবি তুলবে কে? বলতে বলতে রানু হেসেই অস্থির।
ওসমান এবার কথায় বেশিরকম জোর দেয়, না, না। আমার একটা কাজ আছে।’ নিচে নামতে নামতে ওসমান ফের প্ররেমে পড়ে, এবার অন্যভাবে। এভাবে হুট করে চলে আসাটা ঠিক হলো না। রানুর শ্যামবর্ণ মুখের নীলচে ঠোঁটজোড়ার সব কৌতুক এতোক্ষণে নিশ্চয়ই নিভে গেছে। রঙুটাও মন খারাপ করবে। ক্যামেরা চালাতে না পারাটা কি অপমানজনক অযোগ্যতা? এ নিয়ে এতো জড়সড় হওয়ার কি আছে? শওকত সাইকেল চালাতে পারে না, কিন্তু তাই নিয়ে শওকত নিজেই কতো মজার মজার গল্প করে। অফিসের খলিলুর রহমান বেশ তোতলা, তা নিয়ে লোকটার সঙ্কোচ তো নাইই, বরং এই নিয়ে নিজেই কতো হাসিঠাট্টা করে! তো ওসমান এরকম পারে না কেন? —দাখো তো, রানুর এতো মিনতি ঠেলে সে চলে এলো। তালেব যেদিন মারা গেলো রঞ্জর ঠোঁট কি সেদিনকার মতো বেগুনি হয়ে গেছে? —আসলে এইসব ছবি তোলা, হৈ চৈ করা-কয়েক সপ্তাহ আগে নিহত ভাইয়ের শোক ভোলার জন্যেই তো এসবের আয়োজন। ঘরে তাদের মায়ের বিরতিহীন বিলাপ। বাপটা ঈদের নামাজ পড়ে এসে সেই যে বিছানায় শুয়েছে এখন পর্যন্ত করে সঙ্গে ভালো করে দুটো কথাও বলেনি। ফরিদা আজ স্বামীকে নিয়ে এসেছে কেন? বন্ধুর শোকটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু চাপা দিয়ে রাখার জন্যেই তো, তাই না? রানু তার সঙ্গ চেয়েছিলো, এখন সঙ্গ মানে বেদনার একটু ভাগ নেওয়া। তার ছোট্ট এই আবদারে ওসমান সাড়া দিতে পারলো না, ওসমানের এই প্রত্যাখ্যানে ভাইবোনের শোক ভুলে থাকার সমস্ত আয়োজনটাই পণ্ড হয়ে গেলো।—সিঁড়ির রেলিঙ ধরে ওসমান দাঁড়িয়ে থাকে। এখন যদি ও ছাদে যায় তো ওদের ছাইচাপা উৎসব আবার জ্বলে উঠতে পারে।
ঠাণ্ডা ও অন্ধকার সিঁড়িতে ওসমান বড়োজোর মিনিট তিনেক ছিলো। তিন মিনিট পরে রোদ-ভাসানো ছাদে উঠে ওর চোখে ধাঁধা লাগে, প্রথম কয়েক সেকেন্ড ভালো করে তাকাতেই পারে না। তারপর সব স্পষ্ট হলে দেখলে যে, এই কয়েক মিনিটে ওদের ছবি তোলার আয়োজন কী বিপুল পর্যায়ে উঠেছে ফরিদার বর ঐ ছোকরা এমন কায়দা করে ক্যামেরা ধরেছে যে, মনে হয়, ব্যাটা সত্যজিৎ রায় হবার জন্য স্টেজ রিহার্সেল দিচ্ছে। সত্যজিৎ রায়ের নাম জনিস নাকি ব্যাটা? দেখিস তো ওয়াহেদ মুরাদ-জেবা আর সুচন্দারাজ্জাকের ছবি ওসমানও অবশ্য এসবই দ্যাখে। তবে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি’ দেখেছে, টিকেট পায়নি বলে মহানগরী দ্যাখা হয়নি। ঐ ক্যামেরাম্যান শালা এসব ছবির নাম জানে? ওর পোজপাজে মেয়ে দুটো একেবারে মুগ্ধ। তারা একবার রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়, একবার হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে চলে পড়ে। এতো হাসির ছটা আর থামে না! ওসমানকে ফিরে আসতে দেখেও এদের হাসির কারণ কি থাকতে পারে? ওসমান এখন কি করবে? রঞ্জু বলে ডেকে ওদের দিকে এগিয়ে চলে। তার তো বলার কিছুই নাই। চুপচাপ আরেকটু এগুতেই রঞ্জু বলে, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, ক্যামেরার সামনে আইস পড়েন ক্যান? দ্যাখেন না বাদল ভাই ছবি তুলতাছে। ওসমানকে শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, রঞ্জ, মনে করে দরজাটা বন্ধ করে দিও কিন্তু।
ক্যামেরার লেন্স বোধ হয় ফরিদা, রানু, রঞ্জ এমনকি ছাদের রেলিঙ পৰ্যন্ত শুষে নিচ্ছে। এখান থেকে রানুর প্রোফাইলটা দ্যাখা যায়। শ্যামবর্ণের গালে রোদের ঝাপটা লেগে চামড়ার ওপর পাথরের এফেক্ট দিচ্ছে। ওর ঠোঁটে রোদের চিকন একটি আভা। উত্তেজনা, লজ্জা ও খুশিতে রানুর ঠোঁটজোড়া কাপছে। কি রোদ! রোদ মনে হয় কাচের পার্টিশনের মতো ওদের সবাইকে ওসমানের স্পর্শের বাইরে রেখে দিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওসমান এবার তাড়াতাড়ি নামে। সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিকেচার এই ছোকরার ক্যামেরার কারদানিতে ওদের যে ভক্তি দ্যাখা যাচ্ছে তাতে ভয় হয় যে, যাবার সময় দরজা বন্ধ করার কথা খেয়াল থাকবে না। রঞ্জকে আরেকবার তালা লাগাবার কথা বলে গেলে ভালো হতো। এখন ওসমানের সাধ্য কি ঐ উৎসবে ঢোকে? তালা টালা না লাগিয়ে চলে গেলে ওসমানের ঘরে যদি চুরি হয় তো রঞ্জু ও রানু বেশ অপরাধী হয়ে থাকে। তখন তাদের ক্ষমা করার একটা সুযোগ হয় ওসমানের। কিন্তু ওসমানের ভাগ্যে কি সেই সুযোগ আসবে?

চিলেকোঠার সেপাই – ০৮

বস্তিতে ঢোকার মুখে একটুর জন্যে গুয়ের ওপর খিজিরের পা পড়েনি। তার রাগ হয়, ‘এইগুলি জানোয়ারের পয়দা না কিয়ের বাচ্চা বুঝি না! এতো বড়ো একখান নর্দমা পইড়া রইছে, পোলাপানের হাত ধরাইয়া বহাইয়া দিলে কি হয়?
বস্তির প্রথম ঘরের দরজায় চার বছরের ন্যাংটা ছেলের পাছা ধুয়ে দিচ্ছিলো বজলুর বৌ। সিনেমার টিকেট ব্ল্যাক করা হলো বজলুর পেশা, ঈদের দিন স্বামীর মোট রোজগারের সম্ভাবনায় বজলুর বৌয়ের আজ দাপটই আলাদা, সে সঙ্গে কিচকিচ করে ওঠে, আটকুইড়া, হিজড়া মরদ, পোলাপানের তকলিফ বুজবো ক্যামনে? নর্দমার মইদ্যে পোলায় পইড়া গেলে তুলবো ক্যাঠায়?
জবাব না দিয়ে ঘরে ঢোকার জন্যে খিজির মাথা নিচু করেছে, এমন সময় ভেতর থেকে বাইরে উকি দিলো জুম্মনের মা। এক পলকের জন্যে বৌয়ের মুখ টাটকা দাখায়, মনে হয় কষে সাবান ঘষে মুখ ধুয়ে স্নো পাউডার মেখেছে। তার ভাঙা গালের নকশাই পাল্টে গেছে, তার কালো রঙের ওপর পাতলা ছাই রঙের আভা, কিন্তু জুম্মনের মায়ের তীক্ষ ও ছুচলো কণ্ঠস্বরে এই মুগ্ধতা আড়ালে পড়ে যায়, চোট্টার খানকিটার চাপার খাউজানি মনে লয় বাড়ছে। বাড়বে না? বাড়বে না ক্যালয়? তারপর ফজলুর বৌয়ের বাকশূহ বৃদ্ধির কারণ নির্ণয় করে সে নিজেই, চোট্টাগুলির আউজকা বেলাক করনের দিন! চান্দে চান্দে পুলিসের চোদন না খাইলে চোট্টাগো গতরের মইদ্যে ফোসকা পড়বো না? হাজত না চোদাইয়া বৌ পোলাপানের ভাত দিবার পারে না,-হেই চোট্ট মরদের মুখের মইদ্যে আমি প্যাসাব করি। তার ইজ্জত রাখার জন্যেই বৌ রুখে দাঁড়িয়েছে, বৌয়ের প্রতি খিজির তাই একটু গদগদ হয়, তক্তপোষে এলোমেলো করে পাতা কাঁথার ওপর একটু একটু করে শুয়ে পড়ে। পাশে বসতে বসতে জুম্মনের মা বলে, আঃ! সইরা শোও। খিজির একটি হাত রাখে বৌয়ের কোমরে। জুম্মনের মাকে নিয়ে ম্যাটিনিতে আজ সিনেমা দেখলে কেমন হয়? খিজির এতো সিনেমা দ্যাখে, জুম্মনের মাকে কোনোদিন সঙ্গে নেয়নি। স্টারে হীরা আওর পাথর খেলে মোহাম্মদ আলী-জেবার ছবি, চাল্লি হলো নিরালা। বৌকে এখন কথাটা বলে কি করে? এতো সিনেমা দেখেও কায়দা করে কথা বলাটা খিজির এ পর্যন্ত রপ্ত করতে পারলো না। তার শক্ত ও লম্বা আঙুলগুলো আনাড়ি বাদকের মতো বৌয়ের পিঠে বারবার ওঠানামা করে, ছেমরিটাকে যদি এভাবেই বাজিয়ে তোলা যায়। কিন্তু এর আগেই ঝনঝন করে ওঠে বজলুর বৌয়ের গলা, চোটাও হইতে পারে, বেলাক ভি করবার পারে। মগর ভাতার আমাগো একটাই একখান ভাউরারে গলার মইদ্যে সাইনবোর্ড বাইন্দা আমরা দুনিয়া ভইরা মানুষরে মারা দিয়া বেড়াই না। বজলুর বৌ কাজে যাচ্ছে, বিকালবেলা ২টো বাড়িতে তাকে বাসন মাজতে হয়, একটা বাড়িতে পানি দেয়। ছেলেটা এখন তার কোলে, খিজির তাকে জানোয়ারের বাচ্চা বলায় আজ মায়ের কোলে উঠতে পারলো।
বেড়ার সঙ্গে লটকানো ছোটো আয়নার সামনে জুম্মনের মায়ের কেশবিন্যাস অব্যাহত থাকে, ঠোঁটে চেপে ধরা রঙ-জ্বলা ফিতা হাতে নিতে নিতে সে বজলুর বৌয়ের শেষ বাক্যটি শোনে, আমরা আর মাইনষের বাড়ি কাম করি না, না? কৈ আমরা ইসনে পাউডার মাইখা খানকিটা হইয়া মাহাজনের বাড়ি যাই?
খিজিরের কান কুঁকড়ে আসে আবার হালার মাহাজন রহমতউল্লা মহাজনের বাড়ির কাজ থেকে জুম্মনের মাকে ছাড়িয়ে আনাটা খুব জরুরি। বজলুর বৌয়ের এই সব কথা শুনতে শুনতে তার একেকবার ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে,–কিন্তু কি ইচ্ছা করে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু ভাবতে পারে না। শুয়ে শুয়েই শক্ত হাতে তার বাহুমূল ধরলে জুম্মনের মা বলে, ছাড়ো কিন্তু হাতটা সে ছাড়িয়ে নেয় না। শুধু বলে, জোয়ান মরদটা দুপুরবেলা ঘরের মইদ্যে হুইয়া থাকো, শরম করে না?
এবার তার কথা একটু নরম। খিজির আরেকটু কাছে ঘেঁষে, তরে হুইতে মানা করছে ক্যাঠায়?
আল্লাদ! কাম আছে না? কতোগুলি মানুষ আউজকা খাইতাছে। আল্লারে আল্লা। মাহাজনের বাড়ি কতো মেহমান আহে। মহাজনের বাড়িতে অতিথি সমাগমের একটি দীর্ঘ তালিকা দিতে দিতে জুম্মনের মা উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। বেশির ভাগই শরীফ লোক, তসতরির সেমাই ছোয় কি ছোয় না, প্লেটের পোলাও আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়াই করে, জিভ পর্যন্ত তোলে না। কিন্তু বাসন তো মাজতে হয়। ঈদের দিন দামী দামী সব বাসন বার করা হয়েছে, জুম্মনের মা ছাড়া সেসব মাজবে কে? বিবিসায়েব ভরসা করবে আর কার ওপর? কড়ি কড়ি বাসন মাজার কথা বলতে বলতে জুম্মনের মায়ের বুক ফুলে ওঠে, না যাই গিয়া।
বৌয়ের ফুলে-ওঠা সিনা দেখে খিজিরের চোখে ঘোর লাগে, একটু জড়িয়ে ধরে, ‘আউজকা সায়েবে আমারে ছুটি দিছে। সায়েবের থন বেবি ট্যাক্সি লইয়া বারামু, যাইবি? এক্কেরে নিউ মার্কেট, শাহবাগ, রমনার মাঠ ঘুরাইয়া আনুম, যাইবি? এয়ারপোর্ট ভি যাইবার পারি। ক্যামনে পেলেন উঠে দেখবি? যাইবি? আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য স্কুটার দেবে না, তবে রিকশা একটা পাওয়া যাবে। বৌকে বেবি ট্যাকসির কথাই বলা ভালো। যাইবি?
ঢাঙা রোগা স্বামীর এই আহ্লাদ বচনে জুম্মনের মায়ের শরীর একটু শিরশির করে বৈ কি! সে চুপ করে থাকে। এমনকি কাপড় জামা ভেদ করে খিজিরের একটি হাত তার স্তন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলে সে বরং একটু এলিয়েই পড়ে। কিন্তু নাঃ। মহাজনকে চটানো ঠিক হবে না। মহাজনের ভারি হাতের চাপে তার দমবন্ধ হবার জোগাড় হলে কি হয়, জুম্মনকে তো তার কাছে এনে দিতে পারে মহাজনই। ছেলে তখন তার কাছে থাকবে; মহাজনের বাড়িতে, গ্যারেজে কতো কাজ, ঢুকিয়ে দেবে কোথাও। তারপর? তারপর, বড়ো হলে মহাজন একটা রিকশা কিনে দেবে।–রিকশার ভাড়া দিতে হবে না, এমনকি লাইসেন্সের পয়সাও দেবে মহাজন।-গতকাল চাদের রাতে মহাজন নিজে তাকে কথা দিলো, হাজার হলেও নামী দামী মানী লোক, সে কি ফালতু কথা বলবে?
রাত তখন অনেক। রাত পোহলেই ঈদ। জোগাড়যন্ত্র করতে করতে জুম্মনের মায়ের বলে হাসফাস উঠে গেছে। ঠিকা ঝি আবুলের মা ছেলের এ্যাঁকসিডেন্টের খবর পেয়ে চলে গেছে রাত ১০টার আগেই। আস্ত একটা খাসির নানারকম তরকারি, দশ সের গরুর গোশতের ভুনা, কাবাবের কিমা, কয়েকটা মুরগি!-মশলা বাটা চলছে তো চলছেই। সকালবেলার জন্যে সেমাই ভাঁজছে জুম্মনের মা, নামাজে যাবার আগেই সবাই সেমাই খাবে -এটা সেটা করতে করতে রাত্রি হলো ১টা কি দেড়টা। বসার ঘরের দরজার কোণে টেলিভিশন দেখতে দেখতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আবদুল, একটু রাত হয়ে গেলে জুম্মনের মাকে এগিয়ে দিয়ে আসে সে-ই। সব গুছিয়ে আবদুলকে ডাকতে জুম্মনের মা বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ির গোড়া পার হবার সময় মহাজন ডাকলো, ‘যাস?
তার কণ্ঠ শুকনা ও কাপাকাপা। রহমতউল্লা ফের বলে, যাস গিয়া? তারপর গায়ের শালের নিচে থেকে কাগজের একটা প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে ধরে, ‘ল। মহাজন তার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে, হঠাৎ তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, বহুত মেহনত হইছে, না? তার গলা এত কাপছিলো যে, এই কথায় কোনো দরদ ফোটে না। ফের বলে, ‘ল। তরে দিলাম। সেতারার মায়ে জানলে হাউকাউ লাগাইয়া দিবো। ব্রেসিয়ারের প্যাকেট হাতে নিতে নিতেই জুম্মনের মা টের পায় জিনিসটা কি? সেতারা তাকে একবার একটা দিয়েছিলো; সেতারার ব্যবহৃত, তবে তেমন পুরনো হয়নি। কিন্তু এইসব ছেমরি রঙঢঙ যতোই করুক, এদের সিনা দেখলে মনে হয় পুরুষ মানুষের সিনাও এদের চেয়ে উঁচু। আজ মহাজন তাকে ঐ জিনিস দিলো একেবারে নতুন। লোকটা তার পিঠে হাত দিয়ে নিজের শরীর ঘেঁষে টেনে নেয়, ঘাড়ের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বলে, কাউলকাতর পোলারে একবার দেখবি না? খিজিররে কইস নিমতলা না কৈ থাকে কামরুদ্দিন, খিজিরে গিয়া আর ঘর থাইকা লইয়া আইবো’ মহাজনের ভারি হাতের তলায় তার ঘাড়ের ভেঙে পড়ার দশা ঘটে। সেই ঘাড়ে মহাজন একটা চুমু খায়, তার বুকে হাত রেখে বলে, সিনা তর ফাস্ট কেলাশ। ঐটা পিন্দলে দেখবি কেমুন লাগে। তারপর ফের জুম্মনের প্রসঙ্গ তোলে, নিচু গলায় ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে মহাজন জুম্মনকে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দেওয়ার জবান দেয়। একটু বড়ো হলে তাকে রিকশা কিনে দেবে, ঘর দেবে।—মহাজনের নিশ্বাসের ভাপ লেগে তার গাল গরম হয়ে ওঠে। সে সিটকা মেরে দাঁড়িয়ে থাকে, নিশ্বাস ছাড়তে জুম্মনের মায়ের অসুবিধা হয় না, কিন্তু নাক দিয়ে বাতাস টেনে নেওয়ার কাজটা যেন কতো কঠিন এর মধ্যে একবার ভয় হয় দোতলা থেকে বিবিসায়েব যদি হঠাৎ এসে পড়ে। এখান থেকে দ্যাখা যাচ্ছে আবদুলকে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে ব্যাটা মহাসুখে ঘুমায়, তার মুখ ফাক হয়ে রয়েছে, আবার মহাজনের কাণ্ডকারখানায় চোখজোড়া ফাক না হয়! এই সময় রান্নাঘরের ভেতর থেকে বিড়ালের আওয়াজ পাওয়া যায়, ম্যাও।’ মহাজন হঠাৎ করে তাকে ছেড়ে একটু পিছিয়ে বসে এবং বিকট হাক ছাড়ে, আবদুল আবদুল! ওঠা এ্যাঁরে ঘরে দিয়া গ্যারেজে যা গিয়া গ্যারেজ খালি পইড়া রইছে!
মহাজনের সেই হাকে জুম্মনের মা যে দারুণ রকম চমকে উঠেছিলো আজ এই এখন পর্যন্ত তার রেশ যায়নি। খিজিরের দিকে একবার তাকিয়েই সে মাথা নিচু করে বলে, ‘আউজকা তুমি জুম্মনরে একবার আনতে পারব?
জুম্মনরো জুম্মনের কথা ওঠায় বৌকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণের উৎসাহ খিজিরের প্রায় নিভে যায়। মাগীটা তার ছেলের কথা একেবারে ভুলতে পারে না। ছ্যামরা এসে তো খিজিরের ঘাড়েই পড়বে, ওটাকে সামলাবে কে? ছেলের জন্যে অতোই টান তো ঐ কামরুদিনের ঘর করলেই তো পারতো! আবার ৭/৮ বছরের এই পিচ্চির ওপর রাগ পুষে রাখতেও নিজেকে কেমন চোর চোর মনে হয়। গলায় একটু ঝাঁঝ এনে জিগ্যেস করে, জুম্মনে মালীবাগ থাকে না?
না। নিমতলীর কাছে রেল লাইনের লগে বস্তি আছে না? ঐ বস্তির মইদ্যে থাকে। ওস্তাগরে না মালীবাগে ঘর লইছিলো? ওস্তাগর বলে কামরুদিন সম্বন্ধে খিজির একটু টিটকিরি করলো। কামরুদিন আসলে জোগানদার, কিন্তু কথাবার্তা বলে শালা ওস্তাগরের স্টাইলে। দাদা পরদাদা নাকি কলতাবাজারের সেরা ওস্তাগর ছিলো, সেই দাপটে কামরুদিন যখন তখন বৌ পেটতো। মালীবাগ খিলগায়ের দিকে আজকাল খুব দালান তৈরি হচ্ছে, তার নাকি কাজের শেষ নাই, ঐদিকে ঘর ভাড়া না নিয়ে তার উপায় কি? ব্যাটা আবার নিমতলী গেলো কবে?
আগের স্বামীর প্রতি বর্তমান স্বামীর এই শ্লেষ গায়ে না মেখে জুম্মনের মা বলে, কাম করতে করতে ভারা থাইকা পইড়া গিয়া অহন জোগানদারি করবার পারে না, একখান পাও বলে ভাইঙ্গা গেছে।’
পাও ভাঙছে! কথার ভঙ্গিতে ঠাট্টা অব্যাহত রাখলেও খিজিরের খারাপ লাগে। কামরুদিন কিন্তু তার সঙ্গে কোনোদিন তেমন খারাপ ব্যবহার করেনি।
অহন কি করে?
কায়েতটুলির মইদ্যে হুনি ডাইলপুরি ভাইজা বেচে। জুম্মনের মা একটু হেসে বলে, যাইবা? জুম্মনেরে লইয়া একবার আমারে দ্যাখাইতে পারো? বছরকার একটা দিন, কি খাইবো, ক্যাঠায় দেখবো? বৌয়ের এই ভিজে ভিজে কণ্ঠস্বর খিজিরের ঠিক পরিচিত নয়, এতে সাড়া দেওয়ার নিয়মকানুনও তার অজানা। ছোটো চোখজোড়া যতোটা সম্ভব বড়ো করে জুম্মনের মা ফের বলে, পোলাটারে বাপে যা জুলুমটা করে! তুমি একবার আনব? মাহাজনে কইছে আরে কামে লাগাইয়া দিবো। গ্যারেজের মইদ্যে থাকবো, ডাঙর হইলে একখান গাড়ি কিন্যা দিবো। ভাড়া উড়া লাগবো না, যা কামাইবো অরই থাকবো।
মহাজনের কথা ওঠায় খিজির একেবারে উঠে বসলো। জুম্মনের ওপর ঠিকমতো রাগ করতে বাধো বাধো ঠেকেছিলো, মহজনের ওপর সেই রাগ দিব্যি দশ গুণ উস্কে ওঠে, আবার মাহাজনে আহে ক্যামনে? মাহাজনের কথা কইতে না পারলে খোমাখান খাউজায়, না? খিজিরের এই আক্রমণের পরও জুম্মনের মা আধ মিনিট চুপচাপ ছিলো। কিন্তু ছেলের দরদে বুদ হয়ে বসে থাকাটা তার পোষায় না, একটু সামলে নিয়ে সে ক্যাটক্যাট করে ওঠে, এইগুলি কি কও? তোমার মুরাদ হইবো? আমার পোলারে কাছে রাখবার মুরাদ হইবো তোমার? গোলামি করস মানুষের, চোপাখান বানাইছস নবাবের বাচ্চার।’
মাগী কি কইলি? আবার ক! খানকি মাগী সাইজা গুইজা মাহাজনের লগে রঙ করতে যাস, না? কিয়ের জোরে রোয়াবি মারস? কিন্তু জবাব না দিয়ে মাগী দুপদাপ করে বেরিয়ে যায়।
যতোই রাগ হোক, বৌকে খিজির মহাজনের বাড়ি থেকে ছাড়িয়ে আনে কি করে? কতোদিন আগে তার মা খিজিরকে নিয়ে এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলো। না হলে ফালু মিস্ত্রির কিল চড় খেতে খেতে এ্যাঁদিন কোথায় ভেসে যেতো কে জানে? তারপর ধরো, জুম্মনের মায়ের সঙ্গে তার বিয়েটা দিলো কে? জুম্মনের মা এ বাড়িতে আসে কাজ করতেই, তাতে কামরুদিনের সায় ছিলো ষোলো আনা। যতোই রোয়াবি করুক, রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগানদারের কাজ করে বাঙলা মদ টানা আর কান্দুপট্টি মারা, তারপর বৌপোলা সামলানো অতো সোজা নয়। তবে জুম্মনের মা প্রথম প্রথম সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরে যেতো, কামরুদিন তখন কলতাবাজারে নিজেদের পৈতৃক বাড়ির ১টা অংশেই বাস করে। বড়োলোকের বাড়ি কাজ করে মাস তিনেকের মধ্যে জুম্মনের মায়ের গায়ে গোশত লাগে, এর মধ্যে তার ২টো শাড়ি জুটেছে, সেতারার স্নো পাউডার মাখে একটু সুযোগ পেলেই। তখন রাত্রে কান্দুপটি-ফেরত কামরুদিনের হাতে মার খেতে তার আর ভালো লাগতো না। রুগ্ন বিবিসায়েবের খেদমত করার কথা বলে বিবিসায়েবের ঘরের মেঝেতে সে রাত কাটাতে শুরু করলো। একদিন সন্ধ্যার পর কামরুদিন টলোমলো পায়ে মহাজনের বাড়ি এসে রান্নাঘর থেকে বৌয়ের চুল ধরে ছ্যাচরাতে ছ্যাচরাতে রাস্তায় নামায়। জুম্মনের মায়ের চ্যাচামেচিতে রাস্তায় ভিড় জমে যায় এবং বিবিসায়েব পর্যন্ত তার হাঁপানি ভুলে ‘কেয়া হইস রে? কেয়া হইস রে? বলতে বলতে নিচে নামে এবং তার প্রেরণা ও প্ররোচনায় বজলু, খিজির, আবদুল—এরা একজোট হয়ে কামরুদ্দিনকে বেশ ভালোরকম প্যাদানি দেয়। এরপর লোকটা অনেকদিন আর এমুখো হয়নি। পৈতৃক বাড়ির ভাগ কোন চাচাতো না মামাতো ভাইয়ের কাছে বেচে দিয়ে মহাসুখে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়।
বেশ কিছুদিন পর এক বর্ষার রাতে, অনেক রাত্রি, মহাজনের গ্যারেজে এসে কামরুদ্দিন খিজিরকে ডেকে তোলে। খিজির সেদিন একা, তার একটু ভয় ভয় করছিলো, লোকটা সেদিনকার বদলা না নেয়। কিন্তু নাঃ জুম্মনের মাকে একটা খবর দেওয়ার জন্যে সে খিজিরকে নির্দেশ দেয়। কি খবর?-না, কামরুদিন গত রাতে যে মেয়েকে বিয়ে করেছে জুম্মনের মা তার বাদি হওয়ারও যোগ্য নয়। এই খবর দিয়ে সে চলেই যাচ্ছিল, ফের ঘুরে এসে বলে, তর মাহাজনেরে কইস আমি আইছিলাম। আমার নাম কামরুদিন ওস্তাগর, আমার বাপের নাম হাসমত আলি ওস্তাগর, দাদার নাম লাল মোহাম্মদ ওস্তাগর, পরদাদার নাম নায়ু ওস্তাগর। নবাব বাড়ির গম্বুজটা বানাইছিলো নায়ু ওস্তাগরে, বুঝলি?তর মহাজনে খুব বড়ো লোক হইছে, না। অর দাদার নাম জিগাইস তো, কইতে পারবো না!
জুম্মনের মাকে পাঠানো খবরটা খিজির যথারীতি পৌঁছে দেয়। কিন্তু রহমতউল্লাকে দাদার নাম আর জিগ্যেস করতে পারেনি। খিজির নিজের বাপের নাম জানে না, সে জিগ্যেস করবে মহাজনের দাদার নাম? তবে কামরুদিনের এই সব কথাবার্তা মহাজনের কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। শুনে রহমতউল্লা প্রথম প্রথম খুব হাম্বিতাম্বি করছিলো, ইচ্ছা করলেই কামরুদিনকে সে জেলের ভাত খাওয়াতে পারে। এক বৌ থাকতে জোগানদার হালা আবার সাদী করে কোন সাহসে? আইয়ুব খান নতুন নিয়ম করেছে, দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্যে প্রথম বৌয়ের অনুমতি দরকার। রহমতউল্লা হলো আইয়ুব খানের বিডি মেম্বর, সে নিজে যদি এসব বিষয়ে লক্ষ না করে তবে দেশের লোকের আইন অমান্য করার প্রবণতা তো বেড়েই যাবে। কিন্তু সমস্যা বাধায় মহাজনের বিবি জুম্মনের মাকে রাখাটা তার দরকার, খিজিরের সঙ্গে জুম্মনের মায়ের বিয়ের উদ্যোগ নেয় বিবিসায়েব।
খানদানি ঘরের মেয়ে এই বিবিসায়েব বারো মাসের রোগী। সতীনের সঙ্গে ঘর করবে না বলে বিয়ের ২বছর পর ৬ মাসের মেয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলো বাপের বাড়ি, সতীন মরার আগে আগে স্বামীর ঘরে আসে। সঙ্গে ৪০ ভরি সোনা, ১মাত্র মেয়ে এবং হাঁপানি। রোগে ও দুঃখে সে প্রায় সব সময় হাঁপায় এবং হাপানির সংক্ষিপ্ত বিরতিকালে সশব্দ নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গতে তার বেগমবাজারের খানদানি বাপের বাড়ির মোরগপোলাও এবং নবাব বাড়ির কুবলির সাদৃশ্য, তার বাপের বাড়ির খাস্তা ও লজিজ মোরগ কাবাবের সঙ্গে তার ননদের হাতের রাধা দড়ির মতো শক্ত চিকেন টিক্কার তুলনা, হঠাৎ-বড়োলোকদের জাফরানের বদল রঙ দিয়ে জরদ রান্না করার ছোটোলোকামি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজস্ব মতামতসমৃদ্ধ আলোচনা করে এবং নিজের রোগ ও ভাগ্য নিয়ে তীব্র অসন্তোষ জানায়। ক্লাস নাইনে ২বার ফেল করার পর সেতারা পড়াশোনা চালিয়ে যাবার অসারতা বেশ বুঝে ফেলেছে। সকাল বিকাল প্রসাধন এবং যখন তখন রেডিও সিলোন ও বিবিধভারতী শোনা ও উদৃত্ত সময়ে মন ভার করে থাকার পর সে কোন কাজটা করার সময় পায়? জুম্মনের মাকে ছাড়া মা-মেয়ের একদণ্ড চলে না। বুকটা একটু বেশিরকম উঁচু হলেও এবং যখন তখন তার বুকের কাপড় পড়ে গেলেও বিবিসায়েব তাই তাকে সহ্য করে। মাতারটা এমনি খুব কাজের, একটা কাজের কথা একদিন বলে দিলেই চলে। আবার এমনিতে বেশ সাফসুতরো। খিজিরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সময় বিবিসায়েব মহাজনকে দিয়ে খরচও করালো, গ্যারেজের কর্মচারী ও রিকশাওয়ালদের বাকেরখানি ও অমৃতি খাইয়ে দিলো। বিবিসায়েবের জন্যে এসব কিছু না। তাদের বেগমবাজারের বাড়িতে এককালে বিড়ালের বিয়ে দিতেও তার বাপ ৫০০০ টাকা খরচ করেছে।
এতো খরচ করে তার বিয়ে দিলো, বড়োলোকের মতি, ১০টা দিনও যায়নি, গ্যারেজে রিকশাওয়ালাদের সামনে মহাজন খিজিরকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলো। কি ব্যাপার? চুতমারানি, আমারই খাইবি আমারই পরবি, আমি ঘর না দিলে জায়গা নাই, আর আমার লগে নিমকহারামি করস?
কিভাবে? মহাজন তাকে জিগ্যেস করে, মহল্লার মইদ্যে দেওয়ালে পোস্টার লাগাইছে ক্যাঠায়? খুব বাইড়া গেছস, না?
পোস্টার লাগাতে দিয়েছিলো তাকে আলাউদ্দিন মিয়া। সঙ্গে দুজন ছাত্র ছিলো, আলাউদ্দিন খুব সাবধান করে দিয়েছিলো, পুলিস যেন না দেখে। খিজিরের ইচ্ছা ছিলো লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সবগুলো দেওয়ালে পোস্টার সেটে ভিক্টোরিয়া পার্কের নতুন শহীদ মিনারের উঁচু গম্বুজে উঠে চারদিকে বেশ সাজিয়ে বাকি পোস্টার সব লাগবে। কিন্তু ছাত্র ২জনের তাতে আপত্তি, অতো উঁচুতে তাকিয়ে পোস্টার পড়বে কে? এদিকে মোসলেম হাই স্কুলের দেওয়াল পর্যন্ত আসতেই পার্কের ওপারে কয়েকজন পুলিস দ্যাখা গেলো, ওরা সঙ্গে সঙ্গে চম্পট। বাকি পোস্টারগুলো খিজির রেখে দিয়েছে গ্যারেজের ভেতর, রিকশার বাতিল গদির নিচে, সুযোগমতো পুরনো কাগজওয়ালার কাছে বেচবে। মহাজন এতো চেতবে-এটা কিন্তু খিজির ধারণা করতে পারেনি। মহাজন বলে, তরে অক্ষণ ধরাইয়া দেই তো কয় বছরের জেল খাটতে হইবো, জনিস? পুলিসের অভাবে মহাজন নিজেই এই সব তৎপরতার বিরুদ্ধে বক্তৃতা ঝাড়ে, মানষে বোঝে না। এইগুলি ইন্ডিয়ার মতলব ওয়ারে ডিফিট খাইয়া ইন্ডিয়া অহন এই ট্যাকটিস ধরছে। ছয় দফার পোস্টার মারস, আরে ছয় দফা হইলে পাকিস্তান থাকবো? আমরা পাকিস্তানের লাইগা ফাইট করছি, পাকিস্তান হইছে, মোসলমানের ইজ্জত হইছে! আবার দ্যাহো, কতো মানুষ চাকরি পাইলো, ব্যবসা বাণিজ্য তেজরতি কইরা কতো মালপানি বানাইলো পাকিস্তান না আইলে ফকুরনির বাচ্চাগুলি হিন্দুগো গোলামী করতো। আমরা মালপানি বানাইবার পারি নাই, ক্যান? সে সমবেত রিকশাওয়ালাদের প্রশ্ন করে, পারলাম না ক্যান? উত্তরদাতাও সে নিজেই, মিয়ারা, ব্যাক দিবার পারি, মগর ঈমানটা? এবারও সে নিজেই উত্তর দেয়, না, এইটা দিবার পারুম না। এইটা আমার! ধন দৌলত বড়ো কথা না, বুঝলা? ট্যাহাপসা প্যাসাবের ফ্যানা, এই আছে এই নাই। নানারকম অপ্রাসঙ্গিক কথার পর সে নিজের বক্তব্য সংক্ষেপে জানায়, বহুত লিডার দেখছি! মালপানি কেউগায় কম কামায় নাই। আহন লাগছে পাকিস্তানটারে মিসমার করনের তালে। ইন্ডিয়ায় মাল ছাড়ে, আর এইগুলি গাদ্দারের পয়দা খালি ফাল পাড়ে।’
মহাজনের এই চাপাবাজির সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে আলাউদিনের বাড়ি সার্চ করে পুলিস তাকে ধরে নিয়ে গেলো। তখন তার গ্যারেজের দায়িত্ব নিলো রহমতউল্লা। রহমতউয়ার হুকুমে আলাউদিনের গ্যারেজ দ্যাখাশোনা করতে হলো খিজিরকেই। ৭ মাস পর ফুলের মালা গলায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে আলাউদ্দিন খিজিরকে আর ছাড়ে না, তার অনুপস্থিতিতে লোকটা চমৎকার ম্যানেজ করেছে। রহমতউল্লার অনুমতি নিয়ে খিজিরকে সে নিজের গ্যারেজে নিযুক্ত করে, মামার বস্তিতে তার জন্য একটা ঘর ভাড়ারও ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু জুম্মনের মাকে মহাজন ছাড়বে না। জুম্মনের মা না হলে তার বিবিসায়েবের ঘর সংসার চালানো কঠিন। এর মধ্যে কতো কি ঘটলো, আলাউদ্দিন মিয়া স্কুটার কিনলো, তিন মাসের মধ্যে তার দুটো স্কুটার হলো। খিজির কখনো রিকশা চালায়, কখনো স্কুটার। তা খিজিরেরও উন্নতি হয়েছে বৈকি। রিকশা বা স্কুটার চালাবার ফাঁকে ফাঁকে আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজের সামগ্রিক দ্যাখাশোনাটা তার দায়িত্বে। কিন্তু জুম্মনের মা মহাজনের বাড়ির কাজ আর ছাড়তে পারে না। খালি খালি মহাজনকে দোষ দিয়ে লাভ কি? ঘরের বৌ-সে কি-না তড়পায় খালি মহাজনের বাড়ি যাবার জন্যে। ঈদের দিন স্বামী কি খাবে না খাবে সেদিকে তার কোনো নজর আছে?–বৌয়ের ওপর রাগে খিজির বিছানায় উঠে বসে, তখন তার চোখ পড়ে ঘরের কোণে রাখা গামছায় জড়ানো গামলার দিকে। থালার নিচে গামলায় পোলাও ও মুরগির ১টা আস্ত রান। মাগী রানটা সরালো কিভাবে?-রান খেতে খেতেও বৌয়ের ওপর খিজিরের রাগ কমে না। আরে সে তো স্বামী, নিজের পেটের ছেলের দিকেও কি মাগীর কোনো খেয়াল আছে? ছেলে পড়ে আছে কোথায়, আজ তার জন্যে বার দুয়েক ফ্যাচফাচ করে কেঁদে মা তার ডিউটি শেষ করলো। জুম্মনটা থাকলেও কাজ হতো, মহাজনের কজা থেকে বৌকে বার করে আনার জন্যে ছামরাটাকে লাগিয়ে দিলে হয়।
হাপুশ ছপুশ করে খাওয়া শেষ করে খিজির গেলো আলাউদ্দিন মিয়ার বাড়ি। সায়েব তখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে একপাল ছেলে। খিজিরকে দেখে সায়েব ধমক দেয়, ‘তুই থাকস কই? ২৪ নম্বরে তাজুদিন সাবে আইছে, আমারে খবর দিছে, আমার ফিরতে দেরি হইতে পারে। বড়ো আপা পোলাপান লইয়া আইছে, মামুগো বাড়ি থাইকা অগো সাত রওজা পৌছাইয়া দিস, নয়া বেবিটা বাইর করবি!’
সায়েবের বোনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নাজিমুদিন রোডের মাথায় রেলগেটের কাছে স্কুটার রেখে খিজির জুম্মনের খোজে বস্তিতে ঢুকলো। কোথায় জুম্মন? এই বস্তিতে কামরুদ্দিনকে কেউ চেনে না।
আলিমুদ্দিন আছে একজন, আলিমুদিনের কথা কন না তো? আলিমুদিনে তো তরকারি বেচে, সিগন্যালের লগে ঘর তুলছে। এই সব কথোপকথন চলে, কিন্তু জুম্মনের খবর পাওয়া যায় না। রেললাইনের ২দিকে লম্বা বস্তি, লাইনের মাঝে মাঝে ৩/৪ জন করে লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, কোথাও কয়লা ভরা কড়াইয়ের আগুনের সামনে বসে হাত সেকে কয়েকটি মেয়ে। কোনো কোনো ঘর থেকে ধোয় ওঠে; ধোঁয়ায়, কুয়াশায় ও অন্ধকারে মোড়ানো সারিসারি বেড়ার ঘর, ঘরের ওপর ইট-চাপা ভাঙাচোরা টিনের কিংবা বাঁশের চাল। ধোঁয়ার সঙ্গে কুয়াশার সঙ্গে স্থায়ী একটি দুর্গন্ধ বস্তির সীমানা নির্দেশ করে। খিজির এর মধ্যে হাঁটে এবং প্রায় সবাইকে কামরুদিনের কথা জিগ্যেস করে। লোকজন তার সামনে আসে, এমনকি নাজিমুদ্দিন রোডের আলোকিত রাস্তা ভুলে শিশুরা রেল লাইনে দাঁড়িয়ে খিজিরকে দ্যাখে।
না, কামরুদিনরে না আইলেও চলে। অর বৌ, বাড়ি বাড়ি কাম করে।’ লোকজনের উৎসাহ থাকে না। বাড়ি বাড়ি কাজ করার মাতারির অতিথি এসেছে, তাকে অতো খাতির না দ্যাখালেও চলে। তাদের নিজেদের বৌরাই তো এই কাজ করে। ঘুরতে ঘুরতে রাত্রি বাড়ে, খিজিরের পায়ের নিচে কখনো রেলের কাঠের স্লিপার, কখনো পাথর। আকাশে চাদ নাই, রেললাইনের ধারে ল্যাম্পোস্ট নাই। বড়ো রাস্তার একদিকের ল্যাম্পোস্ট থেকে আলো আসে, আলোর তলানি, তাতে বস্তির জবুথরুঘরগুলোকে ট্রাকে ওল্টানো রিকশা বলে ভুল হতে পারে। শহরের মাঝখানে ঘোলা আলোর ভেতর, পথহীন ও যানবাহনশূন্য এরকম ১টি জায়গায় ২রেলের মাঝখানে কাঠের স্লিপার বা পাথর-মেশানো মাটিতে হাটতে হাটতে খিজির আলি প্রতিটি ঝুপড়ির দিকে তীব্র চোখে তাকায়, জুম্মনকে দেখতে পেলেই ছো মেরে তুলে নেবে। বস্তির এ-মাথা ও-মাথা করতে করতে সে ঘোরের মধ্যে পড়ে এবং এরকম কতোক্ষণ যে তাকে ঘুরতে হতো কে জানে? কিন্তু লুঙি-পরা, ঈদের দিনেও দাড়িনা-কামানো, ভাঙাগাল ১টি লোক তাকে জিগ্যেস করে, লাগবো সাব?
খিজিরের ঘোর কেটে যায়, ভয়ও কাটে। লোকটি ফের বলে, ‘খালি খালি ঘুরাঘুরি করতাছেন। আমার লগে আসেন। গেরস্থ ভালো মাল আছে!’ লোকটি তাকে ভদ্রলোকের মর্যাদা দেওয়ায় খিজির খুশি হয়, অবাকও হয়, বিচলিত হয় আরো বেশি। গৃহস্থ ঘরের এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে শোৰে কি-না খিজির এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই লোকটি ভালো করে তার চেহারা দেখে কেটে পড়ে।

চিলেকোঠার সেপাই – ০৯

নাজিমুদিন রোডের মাথায় পৌঁছে খিজির দ্যাখে তার স্কুটারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১টি তরুণ দম্পতি। মেয়েটির মুখে ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়েছে, একবার দেখেই চোখ নামিয়ে খিজির বেবি ট্যাকসির ভেতরে বসতে যাচ্ছে, পুরুষটি বললো, ইন্দিরা রোড যাবে?
‘না।‘
‘চলো’ পুরুষটি বেশ ডাঁটের। দামী পাজামা পাঞ্জাবির ওপর কারুকাজ করা ছাইরঙ শাল। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। এই চেহারার মানুষের হুকুম অমান্য করা কঠিন। মেয়েটার ধবধবে ফর্স গায়েও লাল শাল। মিহি ও আদুরে গলায় সে বলে, চলোনা ভাই।’ স্টার্ট দিতে গিয়েও খিজির থামে, একটু আগে ঐ ভাউরা শালা যে গেরস্থ ঘরের মেয়ের কথা বলছিলো সে কি দেখতে এরকম হতো? ‘চলেন।
মহিলার পর লোকটি উঠতে উঠতে বলে, মিটার ঠিক নেই?
আজকার দিনেও মিটার লাগবে? ঈদের দিন বেশি দিয়েন সাব।’
মিটার চালাও মিটারটা কি শো? লোকটির এই গম্ভীর আদেশ শুনে মহিলা মন্তব্য করে, ডেকোরেশন, অর্নামেণ্ট! এই ২টো ইংরেজি শব্দে স্বামী-স্ত্রী হেসেই গড়িয়ে পড়ে। সারা পথ জুড়ে এমনি হলো। লোকটি কি বলে আর মেয়েটি হাসতে হাসতে একেবারে কাত হয়ে পড়ে। আবার মেয়েটি কি বলে আর লোকটি হেসে লুটোপুটি খায়। ভদ্দরলোকেরা যে কতো ছুতোনাতায় হাসে। কিন্তু যতোই হাসুক আর যতোই কথা বলুক, তাদের এই হাসি ও কথা খিজিরের কানে ধ্বনির অতিরিক্ত কিছু তৈরি করতে পারে না। স্কুটারের পটপট আওয়াজ ও নরনারীর হাসিকথার মিলিত ধ্বনি ১টি অখণ্ড ধ্বনিপ্রবাহ হয়ে বেজে চলে খিজিরের একটানা ভাবনার পেছনে জুম্মনকে পাওয়া গেলে এখন গাড়িতে থাকতো সে-ই। গাড়িতে উঠিয়ে কয়েক গজ যাওয়ার পরই খিজির তাকে লজেন্স কি বিস্কিট কিনে দিতো। ভদ্রলোকদের ছেলেমেয়েরা আজকাল খুব কাঠি-লজেন্স খায়। জুম্মন একটা চুষতে চুষতেই গাড়ি ওদের বাড়ির সামনে চলে আসতো। বস্তির কাছে বেবি ট্যাকসি রেখে লাফিয়ে নামতো খিজির। কয়েক পা হেঁটে বস্তিতে ছুকেই হাঁকডাক শুরু করতো, জুম্মনের মাও, দেইখা যা, কারে ধইরা লইয়া আইছি, দ্যাখ্য’ জুম্মনের মায়ের জবাবটাও তার জানাই আছে, কোন মরারে লইয়া আইছ ককার দিবার লাইগা? এসব শুনেও খিজির একটুও রাগ করতো না। সে তো জুম্মনকে ভেতরে ঠেলে দিলেই এই কবর দেওয়ার কথা বলার জন্য জুম্মনের মায়ের খুব খারাপ লাগতো। খিজির দাঁড়িয়েই থাকতো, বৌয়ের প্রতিক্রিয়াটা সে দেখবে। জুম্মনের মায়ের চোখে পানি টলটল করে, সে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে-এরকমভাবে বৌকে সে কোনোদিন দ্যাখেনি। চোখে টলমল পানি নিয়ে ছেলেকে ধরে সে গড়িয়ে পড়তো স্বামীর বুকে, এ্যাঁরে তুমিকৈ পাইলা? ক্যামনে আনলা? খিজির চোখ ভরে সেই ছবি দেখতো। এই ছবি দেখতে দেখতে সে রাস্তা বেয়ে চলে। ইউনিভারসিটি এলাকায় লোকজন নাই। পাবলিক লাইব্রেরী পার হলো, ডানদিকে পাতলা কুয়াশা-টাঙানো রেসকোর্স। মাথায় ও চোখে অভিভূত জুম্মনের মা। —একবার আরোহী ভদ্রলোকের ধমকে সে পেছনে তাকায়, ‘সাইড দাও না কেন? হর্ন শুনতে পারো না? তারপর পাশে তরুণীকে বলে, ঈদের দিন বোতল টেনে চুর হয়ে আছে! মেয়েটি খিলখিল করে হাসে। ভদ্রলোকের বেঝিরা এতোও হাসতে পারে। পেছনের গাড়ির অসহিষ্ণু হন এবং আরোহীদের ধমক, ঠাট্টা ও হাসি, কিন্তু খিজিরের গতিশীল বেবি ট্যাকসির সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা ও কান্নায় ভেঙে-পড়া জুম্মনের মাকে একটুও টলাতে পারেনি। কিন্তু একটু সাইড পেয়ে সাদা জিপ তাদের ঠিক সামনে এসে ব্রেক কষতেই জুম্মনের মা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। হয়তো তার ছবি জিপের ওপরেও প্রতিফলিত হতো, তার আগেই শাদা জিপ থেকে লাফিয়ে নামে তিনজন যুবক। জায়গাটা ঠিক কোথায়?-আর্ট কলেজ পার হয়ে বা দিকে খালি জায়গা, এখানে বহু পুরনো একটা ঘর, ঘরের পাশে অনেকদিনের পরিচিত পচা ও মিষ্টি একটা গন্ধ, নিজের নাভিতে আঙুল ঘুরিয়ে আঙুল শুকলে খিজির এই গন্ধ পায়। সেই গন্ধ, দাঁড়িয়ে থাকা সাদা জিপ এবং নিয়নের তরল-সাদা আলোতে পাতলা কুয়াশা খিজিরকে সম্পূর্ণ চিত্রশূন্য করে ফেলে। একটি যুবকের পরনে ধূসর রঙের চাপা প্যান্ট ও কালো জ্যাকেট। হাতের রিভলভার সামনে তুলে শক্ত গলায় সে হুকুম দেয়, রাখো! ল্যাম্পোস্টের
ফাঁকে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে। সেই আলোতে রিভলভারওয়ালার মুখ বেশ স্পষ্ট তার ফর্স টিকলো নাকের নিচে এক জোড়া পাতলা মেয়েলি ঠোঁট। তার পেছনে আরো দুজন যুবক, এদের পরনে যথাক্রমে নেভি-রু প্যান্ট ও লাল পুলওভার এবং প্যান্ট ও কালো কোট। শেষ যুবকটির চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা এবং তাতে ড্যাগার। সে এসে দাঁড়ায় খিজিরের পেছনে, তরুণ আরোহীকে জিগ্যেস করে, এতো রাত্রে মেয়েছেলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
ইঞ্জিন থামা শালা শুওরের বাচ্চা কেটে পড়ার তালে আছে, না?–রিভলভারওয়ালার এই হুকুমে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ইঞ্জিনও কি তার বশ? কখন কিভাবে যে ইঞ্জিন বন্ধ হলো
সে কথায় আমল না দিয়ে আনোয়ার বলে, তাহলে ছয় দফাই তোমাদের ফাইনাল? ছয় দফা দিয়ে সাধারণ মানুষের লাভ কি হবে?
আলতাফ জবাব দেয়, আমাদের সমস্ত দুর্ভোগের কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। ছয় দফায় বাষ্ট্রীয় কাঠামো এমন করার ব্যবস্থা রয়েছে যাতে একটি অঞ্চল আরেকটি অঞ্চলকে শোষণ করতে না পারে। আমরা যা উপার্জন করবো খরচ করবো আমরাই। আমাদের টাকা পাচার হয়ে যেতে পারবে না। ট্যাক্স বসাতে পারবো আমরা। বাইরের দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবো আমরা। প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে বাঙালি ব্যবসা করেনি?’
বলতে বলতে আলতাফের গলা থেকে রাগ কিংবা বিরক্তি ঝরে পড়ে। সে খুব অভিভূত, আবেগে তার গলা জড়িয়ে আসে, বাঙালি এককালে জাভা, বালি, সুমাত্রায় যেতো মশলা কিনতে, নিজেরা কাপড় নিয়ে যেতো বিক্রি করতে। বাঙালি তাতীর তৈরি কাপড় ইউরোপে বেস্ট কোয়ালিটি কাপড় বলে দাম পেয়েছে। সেই দক্ষতা আমরা আবার দাখাবো। ওয়েস্ট পাকিস্তান আর্মির পেছনে বাঙালির রক্ত-পানি-করা টাকার অপচয় ঘটবে না। আমরা আলাদা আর্মির কথাও বলেছি।’
আনোয়ার বলে, ‘হ্যাঁ, বাঙালি আর্মির পেছনে পিপলের টাকা খরচ হবে, তাতে মানুষের লাভ কি?
সেটা নির্ভর করবে আমাদের ওপর। বাঙালি আমি আমাদের লোক, আমাদের মানুষের সেনাবাহিনী। আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের নির্যাতন করবে কেন?
শোষণ কি কেবল আঞ্চলিক? এখানে প্রধানত এবং প্রথমত তাই।
তাহলে কোটি কোটি বাঙালি যে হাজার হাজার বছর ধরে এক্সপ্লয়টেড হয়ে আসছে সে কার হাতে? দেশের ভেতরেই এক্সপ্লয়টার থাকে, বিদেশীর কোলাবোরেটার থাকে। গ্রামে গ্রামে থাকে। জমিতে থাকে, মিল ফ্যাক্টরি হলে সেখানেও থাকবে। ট্যাক্স বসাবার রাইট চাও? কে বসাবে?-কার ওপর?-এই দুই বাঙালি কি একই ধরনের? শোনো, যারা কাপড় বুনেছে, তারা বাইরে গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করেনি। তারা কাপড় পরতেও পারতো না ঠিকমতো। বাঙালি সেনাবাহিনী হলেই বাঙালির উদ্ধার হবে? বাঙালি আর্মি তখন চেপে বসবে বাঙালির ওপরেই, বাঙালি ছাড়া আর কার ওপর দাপট দ্যাখাবার ক্ষমতা হবে তার? পাঞ্জাবি সোলজারের উর্দু গালাগালি শুনতে খারাপ লাগে, বাঙালি কর্নেল সায়েব বাঙলা ভাষায় শুওরের বাচ্চা বললে কি তার পা জড়িয়ে ধরে বলবো, আ মরি বাঙলা ভাষা তোমরা ওয়েস্ট পাকিস্তানের হাত থেকে ইম্যানসিপেশনের কথা বলছো, কিন্তু কাঁদের জন্যে?
ইস্ট পাকিস্তানের পিপলের জন্য। না। ট্যাক্স বসাবার রাইট পিপল পায় না, পিপলের রাইট শুধু ট্যাক্স দেওয়ার। বাঙালির হাতে পাওয়ার চাও তো? মানে বাঙালিদের এক্সপ্লয়েট করার লাইসেন্স চাও?’
*ক্ষমতা মানেই শোষণ নয়। ক্ষমতা যদি তোমার লক্ষ্য না থাকে তবে এই সব আন্দোলন করার উদ্দেশ্য কি?
ড্যাগারধারী বলে, তাহলে তো আরো ভাল। ভাবীর সংগে একটু প্লেজার ট্রিপ মেরে আসবো। আপনি ওয়েট করেন, ম্যাটার অফ এ্যাঁন আওয়ার।’
এই শীতল বাক্য সুদর্শন আরোহীর কানে ঢুকেছে কি-না বোঝা গেলো না। নীলডাউন হওয়ার ভঙ্গিতে বসে সে হাত জোড় করে, আপনাদের পায়ে পড়ি ভাই। আমি একজন সেকশন অফিসার। বিশ্বাস করেন। ভাই শোনেন-।
আপনার ভাই আবার কে? পা ছেড়ে দিন বলছি। প্লীজ স্যর প্লীজ বি কাইন্ড এ্যাঁন্ড মার্সিফুল সার। আমি একজন সেকশন অফিসার সার, মিনিস্ট্রি অফ হোম, গভর্নমেন্ট অফ ইস্ট পাকিস্তান। আপনারা কাল সেক্রেটারিয়েটে আসেন, কালতো ছুটি, বুধবার আসেন, আমি গেটে পাস পাঠিয়ে দেবো, ডবল প্রোটেকটেড এরিয়ার গোলাপি রঙের পাস সার। আপনাদের কোনো সার্ভিসে আসতে পারলে স্যর-।
তার কথা শেষ হতে না হতে ছুরিধারী বলে, আপনি সেকশন অফিসার? আমি আপনার মিনিস্ট্রির জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর ২জনকে দেখিয়ে সে বলে, ঐ যে আপনার সেক্রেটারি, আর উনি আপনার চীফ সেক্রেটারি। নীলডাউন অবস্থাতেই সেকশন অফিসার ৩ জনের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ৩বার স্লামালেকুম স্যর’ বলে।
ড্যাগারধারী বলে, জাস্ট এ সেকশন অফিসার প্রমোশন পাওয়ার জন্যে বৌকে বসের বেডরুমে পাস করবি না? এখন থেকে প্রাকটিস কর!’ রিভলভারধারী তাদের আস্তে করে ধমক দেয়, মিসবিহেভ করো কেন? গো এ্যাঁহেড!’ তারপর সেকশন অফিসারকে আশ্বাস দেয়, নাথিং টু ওরি এ্যাঁবাউট। আমাদের ম্যাক্সিমাম এক ঘণ্টা। কুইক মেরে দেবো।
মেয়েটিকে পাজাকোলা করে তুলে ৩ জনের এই তরুণসমাজ উল্টোদিকের ফুটপাথে চলে যায়। ফুটপাথ ধরে একটু এগিয়ে রেসকোর্সের কাঠের রেলিঙ ডিঙিয়ে ফের সামনের দিকে হাটতে শুরু করে। কুয়াশায় তাদের আর দ্যাখা যায় না।
তরুণ আরোহীর সেই নীলডাউন অবস্থা তখনো কাটেনি। খিজির বলে, চলেন সার, থানায় যাই গিয়া। নীলখেত ফড়ি তো কাছেই।
লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। খিজির ফের বলে, চলেন, যাই। লোকটি তখন রাস্তায় ধপাস করে বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে কাঁদতে শুরু করলো। তার কানের কাছে মুখ রেখে যতোটা সম্ভব নরম করে খিজির বলে, চলেন যাই। অখনও টাইম আছে। থানায় চলেনা চলেন।
কান্নায় সাময়িক বিরতি দিয়ে লোকটি ফোপাতে ফোপাতে জবাব দেয়, এদের চেনো? এরা সব এনএসএফের গুণ্ডা। আইয়ুব খানের বাস্টার্ড মোনেম খান, মোনেম খানের বাস্টার্ড এরাt’
খিজির তাড়া দেয়, ‘লন যাই। ইউনিভারসিটির এতোগুলি হল এহানে পোলাপানেরে খবর দিই। চলেন সাব!’
লোকটির ফোপানে কণ্ঠস্বরফের গুমরে ওঠে, না। তা হয় না। আরো বিপদ হবে। ওরা এক ঘণ্টা ওয়েট করতে বললো না? এসে আমাকে না পেলে ফায়ার হয়ে যাবে চাকরি বাকরির কথা সব বলে ফেললাম, শুওরের বাচ্চারা আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে দেবে!’ লোকটি ফের হাতে মুখ গুঁজে ফোপায়, এরা ডেঙ্গারাস, মোস্ট পাওয়ারফুল! ফের নতুন উদ্যমে কাঁদবার প্রস্তুতি নিলে নিজের স্কুটারে ফিরে আসা ছাড়া খিজিরের কোনো কাজ থাকে না। তুমি আমাকে একা রেখে চলে যেও না ভাই! —লোকটির এই মিনতির জবাবে সে বলে, অরা আপনাগো গাড়ি কইরা পৌছাইয়া দিবো! ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে এক্সিলেটর থেকে হাত উঠিয়ে খিজির ফের রাস্তায় নামে, সায়েব, ভাড়াটা?
ভাড়া? তরুণ রাজকর্মচারী হাত থেকে মুখ তুলে অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকায়। মিটার দেইখা ভাড়াটা দিয়া ফালান? প্রচণ্ডরকম বিস্ময় ও মর্মাঘাতে লোকটির মুখের খুচরা-খাচরা পার্টস ওলট-পালট হওয়ার উপক্রম ঘটে। পকেট থেকে টাকা বের করে ভিজে গলায় সে বলে, তোমরা মানুষ না! মানুষ হলে এ সময় কেউ– ‘
স্কুটার রাস্তায় গড়িয়ে দিলে খিজির তার উক্তিকে স্বীকার করে চিৎকার করে, না। আমরা কুত্তার বাচ্চা, মানুষ হইলেন আপনেরা!

খিজিরকে দেখে আলাউদ্দিন মিয়া বলে, কৈ গেছিলি তুই? আপারে ফোন করছি নয়টার সময়। কয় ওরে তো ছাইরা দিছি বহুত আগে। পাসিঞ্জার লইয়া যাইবি তো আমারে কইলি না ক্যান? গ্যারেজ বন্ধ কইরা আমার বাসা হইয়া যাইস! কাম আছে!’ আলাউদ্দিন মিয়ার বাড়ি থেকে বেরোবার সময় পেছন থেকে ডাক শুনলো খিজির, কি মিয়া, ঈদের দিন খুব খ্যাপ মারতাছেন? বহুত কামাইলেন, না? রাস্তার ওপার থেকে ডাকছে কামরুদিন। রাস্তা ক্রস করে সামনে এসে কামরুদিন বলে, কৈ গেছিলেন? এর আগে সে খিজিরকে ‘তুমি’ এবং রেগে গেলে ‘তুই’ বলতো, ওর বৌকে বিয়ে করার পর তাকে মর্যাদা দিতে শুরু করেছে। বলে, ‘জুম্মনেরে রাইখা গেলাম। মাহাজনে একটা ছ্যামরারে পাঠাইছিলো, মাহাজনে আমারে আইতে কইছিলো।’
কৈ পাঠাইছিলো? আপনে থাকেন কৈ?
‘আমি তো মালীবাগ থাকি। জুম্মন থাকে আর ফুফুর সাথে, নিমতলীর লগে। তে মাহাজনে কয় জুম্মনের মায়ে পোলার লাইগা বলে ভাত পানি ছাড়ছে। অর মায়ে কয়দিন আরে রাখতে চায়। আমি কই থাউক। আমি হালায় কৈ যাই, কৈ থাকি! কোন জাগায় কহন কাম পড়ে, থাউক কয়টা দিন!’ বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর বিশেষ ব্যবহারে সিগ্রেটের গোড়া ছুড়ে ফেলে সে আরেকটা সিগ্রেট ধরায়, খিজিরের দিকে কিংস্টর্কের প্যাকেট এগিয়ে ধরে। সিগ্রেট কষে একটা টান দিয়ে বলে, আমার বইন তো ছাড়তে চায় না, পোলায় আবার ফুফুর কাছে থাকবার চায় না! কি মুসিবতে পড়ছি আমি!’
খিজির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জুম্মনকে তো নিয়ে আসার কথা তার। দ্যাখো, ঐ বস্তিতেই জুম্মন থাকে, অথচ সে কি-না মিছেমিছি ঘুরে মরলো। আর এই সুযোগে ছেলের জন্যে ওর বৌয়ের সত্যিকার ও বানানো কান্নাকাটি সব দখল করে নিলো শালার মহাজন।
কিন্তু এই নিয়ে দিওয়ানা হবার সময় কি আর খিজির আলির হবে? তাকে যেতে হয় আলাউদিনের ঘরে। আলাউদ্দিন মিয়া জানায় যে, ওসমানকে একটু খবর দেওয়া দরকার, কাল ভোরবেলাতেই ওসমান যেন আলাউদ্দিনের সঙ্গে দ্যাখা করে। পরশু মহল্লায় জনসভা, কয়েকজন বড়ো নেতা আসবে, সব আয়োজন করতে হবে আলাউদ্দিন মিয়াকে। তার বক্তৃতা ঠিক করার জন্য ওসমানকে চাই। খিজির ভাবে, ওসমান এসব ব্যাপারে এগিয়ে এলেই তো পারে। লোকটা মিছিলে যায়, মিটিং শোনে, শ্লোগান দেয়,—আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে কাজ করতে তার আপত্তি হবে কেন? এসব লোককে সঙ্গে পেলে আলাউদ্দিন মিয়া এই শালা রহমতউল্লাকে চিরকালের জন্য ধসিয়ে দিতে পারে।

সিঁড়ির সবচেয়ে উঁচু ধাপে একুট আগুনের বিন্দু দেখে খিজির চমকে ওঠে, কে?
কে? ভয় পেয়ে দুজনেই পরস্পরের পরিচয় জানতে চায় তারপর খিজির বলে, সিঁড়ির উপরে একলা বইয়া রইছেন?
ওসমান উঠে দাঁড়ায়, সিগ্রেটের শেষ অংশ ফেলে দিয়ে বলে, তুমি এতো রাত্রে?
‘লন, ঘরে চলেন। কথা আছে। আলাউদ্দিন মিয়া পঠাইয়া দিলো।
হঠাৎ?
‘সায়েব নিজে আপনার কাছে আইছিলো, আপনে ঘরে আছিলেন না। কাউলকা ভোরে থাইকেন, সায়েবে আইবো।’
কি ব্যাপার?
‘মহল্লার মইদ্যে জনসভা হইবো। মিটিং লইয়া আপনার সাথে বাতচিত করবো।
আচ্ছা।
‘তে আপনে ঘরে যাইবেন না? চলেন, ঘরে গিয়া বহি।
ওসমান একটা সিগ্রেট ধরায়, সিগ্রেটে টান দিয়ে বলে, একটু মুশকিল হয়েছে।
কি?
রঞ্জকে চাবি দিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা ছাদে ছবি তুলছিলো। তা এখন বোধ হয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চাবিটা না পেলে—।
‘তামামটা রাইত আপনে সিঁড়ির উপরে বইয়া থাকবেন?
না, না, ওসমান একটু হাসে, ভাবছিলাম একটু ওয়েট করে দেখি। এর মধ্যে ওরা জেগেও উঠতে পারে। নইলে ওয়ারিতে এক বন্ধুর বাড়িতে যাবো।
রাখেন। আপনে কেমুন মানুষ? ওসমানের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিয়ে খিজির বলে, নিজের ঘরের চাবি পরের কাছে রাইখা সিঁড়ির উপরে বইয়া থাকেন। লন, রঞ্জুর ডাইকা ड्रलि।’
না, না থাক!
কিন্তু খিজির দূর!’ বলে নিচে নামতে শুরু করলে তাকে অনুসরণ করতে হয়। খিজির যাতে রঞ্জুদের দরজায় জোরে কড়া নাড়তে না পারে ওসমান সেজন্য আগে ভাগে দরজায় আস্তে করে দুটো টোকা দেয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চাবি হাতে বেরিয়ে আসে রানু। ওসমান একটু নুয়ে বলে, তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
রানু বলে, না। আমি তো ঘুমাই নাই।
রঞ্জু?
রঞ্জ ঘুমাইছে কখন সাড়ে নয়টা দশটার দিকে। খিজির বলে, ‘হায় হায়! আপনে জাগনা? আর এই সাবে সিঁড়ির উপর বইয়া দুই হাতে মশা থাবড়ায়!
খিজিরের কথায় ওসমান বিব্রত হয়, তাড়াতাড়ি বলে, ‘তুমি এতো রাত্রি পর্যন্ত জেগে আছো? ক্লান্ত চোখে রানু স্নান হাসে, চাবি আমার কাছে, কখন আসেন ঠিক নাই। ঘুমাই কিভাবে?
খিজির হাসে, ওসমানের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার চাবি পাহারা দিতাছে। চাবি রাইখা যাইতেন ইনার কাছে, তা না, আপনে রাখছেন রঞ্জুর কাছে।
ঘরে ঢুকে খিজির মেঝেতে বসে পড়ে। বলে, ‘আউজকা একটা কারবার হইছে, বুঝলেন? রেসকোর্সের কাছে– ‘
ওসমান বাধা দেয়, খিজির অনেক রাত্রি হয়েছে। ঘরে যাও, তোমার বৌ চিন্তা করবে।’ নাঃ তার জন্য চিন্তা করবে কে? জুম্মনের মা আজ জুম্মনকে কাছে পেয়েছে, ঐটুকু বিছানায় মায়েপোলায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, তার জন্য জায়গা কোথায়। ঐ পোংটা পিচ্চিটা আজ খিজিরের জায়গা জুড়ে শুয়ে আছে। জুম্মনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারলে হাতটা আরাম পায়। তাই কি সে পারবে? ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে পড়তে পড়তে খিজির বলে, ‘না, একটা রাইত তো, আপনের ঘরে থাকুম’
‘বিছানা কোথায়?’ ‘লাগবো না। ওসমান তবু জোর করে একটা চাদর দেয়। রেসকোর্সের ঘটনা বলার আগেই খিজিরের নাক ডাকতে থাকে। ঘুমের মধ্যে মেঝের হিমে সে এপাশ ওপাশ করে। মনে হয় মস্ত বড়ো ঠাণ্ডা হাত দিয়ে কে যেন তাকে ঝাপশা ১টি মাঠের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

চিলেকোঠার সেপাই – ১০

রানুর অঙ্কের মাথা তেমন ভালো নয়। এসএসসি ১বার ফেল করেছে অঙ্কের জন্যে, আরেকবার অঙ্কের ভয়ে পরীক্ষা দেয়নি। অঙ্কের জন্য কোনো ক্লাসে তাকে ২বছর করে কাটাতে হয়েছে। রং কয়েকদিন ওসমানের কাছে অঙ্ক নিয়ে এসেছিলো। এরপর রানুর বাবা নিজেই এসে ওসমানকে ধরে। কয়েকদিন কলেজে যাওয়া-আসা না করলে কালো রোগা এই মেয়েটিকে পার করা কি তার মতো ছা-পোষা মানুষের পক্ষে সম্ভব? এখন বেশি টাকা দিয়ে স্কুল বা কলেজের শিওর-শট মাস্টার রাখা সাধ্যের বাইরে। বড়ো ছেলে মারা যাওয়ার উপার্জনের নিশ্চিত পথ বন্ধ। ওসমান তো মাঝে মাঝে প্রাইভেট টুইশান করতো। একটু বিবেচনা করে অল্প টাকা নিয়ে সে তার ছেলেমেয়েদের অঙ্ক শেখাবার ভার নিলে লোকটা নিশ্চিত হতে পারে। তা পয়সা দিয়ে মাস্টার রাখবে, এতে লোকটার এতোটা নুয়ে পড়ার দরকার কি? সপ্তাহ দুয়েক হলোওসমান পড়াচ্ছে, এর মধ্যে রানু এসেছে মোট ৪দিন। এর ২দিন ছিলো শুক্রবার। আজকেও শুক্রবার, রানু হয়তো পড়তে আসবে। ওসমান তাই অফিস থেকে বেরিয়ে প্রভিন্সিয়ালে খেয়ে নিয়েছে, তারপর সোজা চলে এসেছে ঘরে। রকে নিয়ে রানু এখানে আসে সাধারণত আড়াইটে তিনটের দিকে। রঙ্কুটার স্বভাব এমন যে, রানু থাকলে সে বড়ো অমনোযাগী হয়ে পড়ে। পেন্সিল দিয়ে রানুর পিঠে খোঁচা দেয়, রানু কলম নিয়ে রেখে দেয় টেস্ট পেপারের আড়ালে। রানুটা অন্যরকম। একমনে খাতার দিকে তাকিয়ে সে অঙ্ক দ্যাখে বা অঙ্ক কষে। এই শীতেও তার শ্যামবর্ণের নাকের হাঙ্কা-শ্যাম ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। এই সব বিন্দু এতো স্পষ্ট এদের সংখ্যা এতো কম যে, ইচ্ছা করলে সে সবগুলো দিব্যি গুণে ফেলতে পারে। কিন্তু ওসমান তখন অঙ্কের সংখ্যা গুণতে ব্যস্ত থাকে বলে রানুর নাকের ও নকের নিচে ঢেউ-খেলানো জায়গায় ঘামের বিন্দুগুলো অগণিত রয়ে যায়। ওসমান আজ বেশ কয়েকটা অঙ্ক গুছিয়ে রেখেছে, রানু ১টার পর ১টা অঙ্ক ভুল করবে বা ঠিক করবে এবং এই সুযোগে মাথা-নিচু করা রানুর নাকের ডগা বা তার আশেপাশের সবগুলো ঘামের বিন্দু গুণে ফেলবে। অথচ দাখো, রানুর কোনো পাত্তাই নাই। কিংস্টকের প্যাকেট আর ২টো মোটে সিগ্রেট। সিগ্রেট খেতে পারছে না, কারণ রানুকে অঙ্ক করাবার সময় ওর ধূমতেষ্টা পায় বেশি, তখন সিগ্রেট পাবে কোথায়? আবার সিলেট কেনার জন্যে নিচে যেতেও ভরসা পায় না, ঠিক ঐ সময়ে এসে রানু যদি ফিরে যায় তবে ফের কৰে আসবে তার ঠিক কি? এখনো আসছে না কেন? তাহলে নরসিংদি থেকে কোনো খারাপ খবর এলো? নরসিংদি ইপিআরটিসি সাব-ডিপোতে পুলিসের হাতে কয়েকজন কর্মচারী মার খেয়েছে। সকালে সিঁড়িতে রঞ্জুর সঙ্গে দ্যাখা হয়েছিলো, ওরা আলাউদ্দিন মিয়ার দলের ১টি ছেলের মুখে শুনেছে যে, আহত কর্মচারীদের মধ্যে ওর দুলাভাইও থাকতে পারে। রঞ্জকে হয়তো নরসিংদি যেতে হতে পারে। তারঞ্জনরসিংদি গেলেই বা কি? রানু কি একা আসতে পারে না? ওসমান বিরক্ত হয়। এই সব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কেবল আপন ভাই বাদ দিয়ে যাবতীয় তরুণের সঙ্গে একজন তরুণীর যৌন-সঙ্গম ছাড়া আর কোনো সম্পর্কের কথা চিন্তা করতে পারে না। যৌন-সঙ্গমকে নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুমোদন দেওয়ার জন্যে বিবাহ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাকবিবাহ প্রেমের মহড়া চলে। বিয়ে করলেই যেমন ছেলেমেয়ে পয়দা করাটা অপরিহার্য, তেমনি প্রেম মানেই বিবাহ।
আবার ছেলেমেয়েদের মেলামেশা মানেই প্রেম-প্রেম, বিবাহ ও যৌন-সঙ্গম ছাড়া এরা কি আর কিছুই ভাবতে পারে না? ওসমান এর মধ্যে ১টা সিগ্রেট ধরিয়েছে, তার সিগ্রেটের ধোঁয়া ঘরের শূন্যতায় ১টি ঝুলন্ত পর্দা তৈরি করে। মাঝে মাঝে হাওয়ায় নিজেদের ওজনের ভারসাম্য রাখতে না পেয়ে ধোঁয়াগুলো শাদা ও হাল্কা ছাইরঙের পর্দায় ছেঁড়া-খোড়া নানারকম ছবিতে ওঠানামা করে। এদিকে ধোঁয়ার দিকে একভাবে দেখতে দেখতে তার চোখজোড়ায় পানি জমে, তখন ১টি হাল্কা নীলচে খাকি রঙের বোর্ডের ওপর সাটা ডিম্বাকৃতি পুরু কাগজ থেকে রানু ওসমানের দিকে তাকায়। তার পাতা-কাটা-চুল নির্দিষ্ট আঁকাবঁকা পথ বেয়ে মিশে গেছে ঘন কেশরাশিতে। গোলগাল ফর্স মুখে পাতলা ঠোঁটজোড়া খুব চেপে বসানো। কালো-সাদা ছবিতে পাতালা ঠোঁটে পান খাওয়ার আভাস। কাঠের ফেম এবং ধুলো ও কুল দেখতে দেখতে ওসমানের চোখে পানি হু হু বাড়ে। বিষাদেও হতে পারে। কারণ, এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় গড়ানো এই ছবিটি তার মায়ের। হোক না ধোঁয়ায় তৈরি, ভাসুকনা শূন্যতায়, তবু তো মায়ের ছবি ফিফটি সেভেন-সিক্সটি নাইন। এগারো বৎসর। ১১ বছর হলো মা মারা গেছে। ছবিটা কি তেমনি রয়ে গেছে? এই ছবির নিচে ছিলো জানলা, জানলার বাইরে পেয়ারা গাছের পাতা। পাতাগুলো রোদে কাপতো, বৃষ্টিতেও কাপতো। এমনকি খুব জোৎস্না হলে নিজের বেঁটায় ভর করে পেয়ার পাতাগুলো একটু একটু করে নাচতো নাচন ছিলো পেয়ারা পাতায়, কিন্তু আওয়াজ শোনা যেতো বাঁশঝাড়ের। এর সঙ্গে মিশে থাকে ভাঙাচোরা ও পলেস্তারা-খসা পুরনো দালানের সোদা ও ভাপসা গন্ধ। রাষ্ট্ৰীয় ও প্রাকৃতিক সীমানা এবং এতোগুলো বছর ডিঙিয়ে-আসা যেই সব দৃশ্য, ধ্বনি ও গন্ধের ভেতর বন্দি হয়ে শুয়ে থাকে ওসমান গনি। চোখের ওপরের পানি পাতলা পর্দায় দ্যাখা যায় পাতা-কাটা চুলের ভেতর বোকা সোকা চোখ-বসানো মায়ের গোলগাল মুখ। রানু মাথা নিচু করে অঙ্ক করবে যখন, ওসমান ওর মুখটা ঠিক ভালো করে দেখে নেবে।-রানু অনেকদিন বাঁচবে, এইতো রানু এসেই পড়েছে, সিঁড়িতে তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওসমান উঠে বসলো। দরজা খুলে এসো’ বলে সিঁড়ির দিকে তাকালো।
যাক, ঘরেই আছো। কয়েকদিন তোমার পাত্তা নেই।
আনোয়ারকে দেখে ওসমানের ভয় হলো যে, ঘরে আর কাউকে দেখে রানু হয়তো ফিরে যাবে। এই ভয় অবশ্য এতো স্বল্পস্থায়ী যে, এটা ভালো করে বোঝবার আগেই রানুর জন্যে প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে না বলে ওসমান বেশ লঘুভার হয়। যেন ম্যাটিনিতে হিচককের ছবি দেখে গুলিস্তানের সামনে রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে উত্তেজনা থেকে অব্যাহতিপাওয়া-চোখে সদ্যোজাত টাটকা বিকালবেলার মানুষের স্রোত ও যানবাহনের অবিচ্ছিন্ন চলাচল দেখছে।
খবর জানো নাকি দোস্ত? খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার জন্য আনোয়ার জুতো খুলে বিছানায় উঠে বসে, খোকা ধরা পড়েছে। আই মিন পুলিস এ্যারেস্ট করেছে।
‘হ্যাঁ, কাগজে দেখলাম। এনএসএফের খোকা তো? পাক-মোটরের কাছে কোন হোটেলে কার ওয়াইফকে রেপ করেছিলো, সেই চার্জে ধরেছে।’
আরে মানুষ খুন করে সাফ করে ফেললো, এখন রেপের চার্জে ধরে আসলে ওর সেফটির জন্যে ওকে ধরেছে, টু গিভ হিম শেলটার।’
শেলটার?
শেলটার বিহাইণ্ড দ্য বার! গভমেন্ট দারুণ প্যানিকি! গবর্নর হাউসও এখন গুণ্ডাপাণ্ডাদের জন্য যথেষ্ট সেফ নয়। ছাত্রদের নতুন প্রোগ্রাম দেখেছে? টুডেন্ট ফন্টে মনে হচ্ছে একসঙ্গে কাজ করা যাবে।’
এগারো দফা? ওসমান জিগ্যেস করলে আনোয়ার বলে, হ্যাঁ, কাগজে দেখেছোঁ?
কাগজে দেখলাম। আলতাফ একটা লিফলেট দিয়ে গেলো কাল। ডিটেল আছে।
‘কাল আলতাফ এসেছিলো?
হ্যাঁ। আমার নিচে দোতলায় একটি ছেলে পুলিসের গুলিতে মারা গেছে না?
‘সে তো মাসখানেকের ওপর হবে।’
‘আজ আলতাফের পার্টির ছেলেরা ঐ ছেলেটির ভাইকে নিয়ে যাবে ওদের মিটিঙে। কাল আলতাফর ওর বাবার সঙ্গে আলাপ করতে এলো, আমিও ছিলাম।
তা ওর ছোটো ভাইকে পাবলিকলি কান্নাকাটি করার জন্যে পটাতে পারলো? কেন, ওর বাপ টপ নেই? বলতে বলতে আনোয়ার উত্তেজিত হয়, বুড়ো অথর্ব টাইপের বাপ হলে আরো জমে। কাঁপতে কাঁপতে স্টেজে দাঁড়াবে, কাঁদতে কাঁদতে পড়ে যাবে। ব্যাস সার্থক জনসভা। তারপর নাটক শেষ হলে অর্গানাইজাররা বুড়োর পাছায় লাথি মেরে বলবে, ভাগ শালা, বাড়ি গিয়ে প্যানপ্যান কর!’ আনোয়ারের এই কথায় ওসমানের এতো খারাপ লাগে যে, ব্যাপারটিকে রসিকতা হিসাবে নিয়ে হাসি-হাসি মুখ করার জন্যে ঠোঁটের প্রয়োজনীয় প্রসারণ ও সঙ্কোচন ঘটাতে ওর অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। রঞ্জুর বাবা মোটেও অথর্ব বুড়ো নয়, কিন্তু আনোয়ারের বর্ণনার ফলে ওসমানের চোখের সামনে মকবুল হোসেন সত্যি সত্যি অর্থব কুজো দাড়িওয়ালা ১ বুড়োর আকার পায় এবং নিহত পুত্রের জন্যে শোকপ্রকাশের পর পাছায় হাত দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের রেলিঙের বাইরে।
সিঁড়িতে ফের পদধ্বনি শোনা যায়। ওসমান টেবিলে হঠাৎ করে কি খুঁজতে শুরু করে। তার মনে হয়, রানু এসে পড়লো। আনোয়ারটা যদি ঘণ্টা দুয়েক পরে আসতে!
আরে এসো। আনোয়ার নবাগতকে খুব সাদরে আহবান করে, তোমাদের মিটিং কখন?’
আলতাফ একবার তার দিকে তাকায়, তুমি কখন এসেছে? তারপর ওসমানকে বলে, ওসমান, ওরা বিট্রে করলো কেন? এসবের মানে কি? আলতাফ বেশ রেগে গেছে, তোমার দোতলার ওরা এটা কি ব্যবহার করলো, এ্যাঁ? ঐ যে লোকটা পুলিসের গুলিতে মারা গেছে তার ছোটো ভাইকে আজ নরসিংদি পাঠিয়ে দিয়েছে। কেন? মিটিঙে যেতে দেবে না? কাল বললেই তো পারতো। গরজ তো খালি আমাদেরই, না?
আনোয়ার হাসে, তোমাদের মিটিং, গরজ তোমাদেরই হবে।’ আলতাফ একটু তেতো হাসি ছাড়ে, মিটিং শুধু আমাদের নয়, তোমাদেরও। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্ট্রিট কর্নার মিটিং করে বেড়াচ্ছে না? ১৪৪ ধারা আছে, ঘোষণা করে মিটিং করা যাচ্ছে না বলে এই পথ বার করা হয়েছে। তা লোকজন সহযোগিতা না করলে আমরা কি করবো? ছেলেটা ওর বড়ো ভাই সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলতো, তাতে ওদের অসুবিধাটা কি?
ওসমান আস্তে আস্তে বলে, রঞ্জুর বড়ো বোনের হাজব্যান্ড নরসিংদি ইপিআরটিসি ডিপোতে কাজ করে। ওখানে কি গোলমাল হয়েছে, রঞ্জু বোধ হয় খোঁজ নিতে গেছে।
‘আরে ভাই, আমাদের ছেলেরাই তো প্রথম খবর দিলো।’ আলতাফ অধৈর্য হয়ে উঠেছে, ‘নরসিংদির ডিপোতে ওয়ার্কাররা স্ট্রাইক করেছিলো। মুসলিম লীগের এক লোক্যাল পাণ্ডা গুণ্ডাপাণ্ডা নিয়ে স্ট্রাইক ভাঙতে আসে, পুলিসও ছিলো। অনেক আহত হয়েছে। আমাদের ছেলেরাই তো বলেছে। এখন দেখছি বলেই ভুল করেছে।’ ওসমান জিগ্যেস করে, ও, তোমরাই খবর দিয়েছো? ‘আরে হ্যাঁ!’ আলতাফ ফের বলে, আমরা বললাম, আপনার ছোটো ছেলেকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দেবো, লোকে একটু দেখবে। তখন তো দেখি ব্যাটার মহাউৎসাহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ছেলে যাবে না কেন? ওর ভাইয়ের কথা ও না বললে বলবে কে?—এই সব চাপাবাজি করে এখন দেখি সব হাওয়া! এদিকে মিটিঙের শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছে শহীদ-কি নাম যেন?—শহীদটার নাম যেন কি?’
আবু তালেব।’ ওসমান নিহত ব্যক্তির নাম মনে করিয়ে দিলে আলতাফ বলে, ‘হ্যাঁ, বলা হয়েছে যে, শহীদ আবু তালেবের ভাই আজ আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবে। লোকজন সব অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। ওর বাবা কি খুব ভয় পায় নাকি?
ভয় পাবে না কেন? আনোয়ার বলে, এমনি পুলিসের গুলিতে মারা পড়ায় পুলিস সেই লোকটার ওপর চটে আছে। মরা লোককে শাস্তি দিতে পারে না, শোধ নেবে আত্মীয়স্বজনের ওপর। আবার তারা যদি মিটিং করে বেড়ায় তো ফ্যামিলি কমপ্লিট করে ছাড়বে। ভয় পাবে না কেন?
আলতাফের রাগ আরো বাড়ে, আরে রাখো। হাজার হাজার লোক মিটিঙে যাচ্ছে, ১৪৪ ধারা আছে, তবু এ-ফাঁকে ও-ফাঁকে মিটিঙ করছে, মিছিল করছে, গুলির সামনে দাঁড়াচ্ছে। আর স্টেজে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলবে,—তাতেই বাপ মা ভয়ে অস্থির? পুলিসকে ভয় পায়, না? ভয় তো পাবলিকও দ্যাখাতে পারে!
‘পাবলিক মানে তোমাদের দলের ছেলেরা তো? আনোয়ার জিগ্যেস করে, ভয় দেখিয়ে গান-পয়েন্টে সবাইকে স্টেজে চড়াবে, তোমাদের দলের লোক বলে এ্যাঁনাউগ করবে, এটা কি ধরনের পলিটিক্স ভাই?
কোন পক্ষ নেবে ওসমান ঠিক বুঝতে পারে না। মিটিঙে পাঠাবার ভয়ে যদি রঞ্জকে নরসিংদি পাঠিয়ে থাকে তো মকবুল হোসেন খুব অন্যায় করেছে। আবার রঞ্জু বাওর বাবাকে ভয় দ্যাখাবার জন্যে পাবলিককে ব্যবহার করার ইঙ্গিত দেওয়ায় আলতাফের ওপরেও তার রাগ হয়। তাহলে এই সব গোলমালেই রানু কি ওপরে আসতে পারলো না? একবার নিচে গেলে হতো। চায়ের কেতলি হাতে নিয়ে সে বলে, তোমরা একটু বসো। আমি রাস্তার ওপার থেকে চা নিয়ে আসি।
ওসমানের দিকে কারো খেয়াল নাই। আলতাফ জবাব দেয় আনোয়ারকে, আমাদের দলে ওয়ার্কার এতো বেশি যে, যে-কেউ পুলিসের গুলিতে মরলেই তাকে দলের লোক বলে চালাবার দরকার হয় না। আমরা কথা দিয়েও ছেলেটিকে হাজির করতে পারলাম না বলে খারাপ লাগছে, কিন্তু এতে মিটিং পণ্ড হবে না, আমাদের ইমেজও নষ্ট হবে না। আমরা প্র্যাকটিক্যালি ইস্ট পাকিস্তানের ওনলি অর্গানাইজড় পাটি। এ কি দলের ফ্র্যাকশনের ফ্র্যাকশন, না চারজনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি? শেষের কথাটি আনোয়ারকে বিশেষভাবে খোঁচা দেওয়ার জন্যে বললো, আনোয়ার কিছু না বলায় তার কথার প্রবাহ দ্বিগুণ বেগ পায়, আমরা ছাত্র ফ্রন্টে ইউনিটি করেছি শুধু সকলের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তোলার জন্য। আমাদের পাটির প্রোগ্রাম অনেক স্পেসিফিক, অনেক স্পষ্ট। কেবল সকলের মধ্যে পার্টিসিপেশনের ফিলিং দেওয়ার জন্যে সকলের সঙ্গে নেমেছি। আলতাফের কথায় জনসভার বক্তৃতার আবেগ ও চাতুর্য। আনোয়ার তাকে প্রায় জোর করে থামিয়ে দিয়ে বলে, এগারো দফা মেনে নিয়ে তোমাদের স্টুডেন্ট উইং কি অন্য পার্টিগুলোকে ফেভার করেছে? আমি তা বলিনি। আমি বলছিলাম যে, আমাদের ছয় দফা নিয়েই আমরা সম্পূর্ণ এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু কাউকে বাদ দিয়ে কাজ করতে চাই না বলেই আমরা এগারো দফার প্রোগ্রামে সাপোর্ট দিয়েছি। এটুকু তুমি যদি এ্যাঁপ্রিসিয়েট করতে না পারো তো সেটা খুব দুঃখজনক। বলতে বলতে আলতাফ হঠাৎ দাঁড়ায়, আরে ওসমান কোথায়?’
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের কোনো গ্যারান্টি তো তোমরা দিচ্ছে না। অটোনমি অটোনমি করে পাকিস্তান হয়েছে। তোমাদের অটোনমিতে বাঙালি সিএসপি প্রমোশন পাবে, বাঙালি মেজর সায়েব মেজর জেনারেল হবে, বাঙালি আদমজী ইস্পাহানী হবে। তাতে বাঙালি চাষার লাভ কি? ডিপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করে মানুষের ইমানসিপেশন হয়? তাহলে ওয়াপদা, পিআইডিসি, রেলওয়েজ ভাগ করে আইয়ুব খান বাঙালির ইমানসিপেশনে হেল্প করেছে? তোমাদের– ‘
ওসমান চায়ের কেতলি নিয়ে ঘরে ঢোকে। কাপে ও গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে সে হাঁপায় এবং বলে, তাড়াতাড়ি চা খাও। নিচে একটা ঘাপলা হয়েছে।’
কি হয়েছে? কি হলো? আনোয়ারের উদ্বেগে তেমন সাড়া না দিয়ে আলতাফ বলে, ‘বাঙালি আদমজী ইস্পাহানী তৈরি করার প্রোগ্রাম নিলে মানুষ এভাবে সাড়া দেয়?
শোনো দোস্ত। পাকিস্তানের এ্যাঁবসার্ড ও উদ্ভট জিওগ্রাফির জন্যে যে কোনো নেগলেকটেড রিজিওনের লোকের ধারণা হতে পারে যে, এই ভৌগোলিক অবস্থাই তাদের সমস্ত দুঃখকষ্টের একমাত্র কারণ। এই এ্যাঁবসার্ড জিওগ্রাফি থাকবে না, ইট মাস্ট গো। কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে মুসলমানরা যখন নাচানাচি করছিলো তাদেরও আইডিয়া দেওয়া হয়েছিলো যে, হিন্দুদের তাড়াতে পারলেই তাদের ইম্যানসিপেশন হবে।’
তাদের এই তর্ক আরো চলতো। কিন্তু ওসমান বারবার তাগাদা দেয়, চলো, চলো। রঞ্জুর বাবাকে ডেকে বাড়িওয়ালা খুব ধমকাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা খবর পেয়ে উনার বাড়ি ঘেরাও করতে যাচ্ছে।

নিচে রাস্তায় বেশ বড়ো ধরনের জটলা। চট করে হাড্‌ডি খিজিরকে চোখে পড়ে। তার গলাও সবচেয়ে উঁচু, আমি নিজে দেখছি মাহাজনে উনারে ধামকি দিতাছে, মাহাজনে কয় পুলিসে এক পোলারে মারছে, বাকিটারে পুলিসের হাতে তুইলা দিমু আমি নিজে। কি চোট ছাড়তাছে। আমাগো সায়েবে না গেলে মনে লয় দুইচইরখান চটকানা ভি মাইরা দিতো।’
আঃ! তুই চিল্লাস ক্যালায়? আলাউদ্দিন মিয়া ধমক দেয়, কিন্তু তেমন জোরে নয়। আলতাফকে দেখে সে অনুযোগ করে, আপনে তো পিঠটান দিলেন, পোলাপানে আমারে কয়, মিটিং তো আর ধইরা রাখতে পারি না। পাবলিকে শহীদের ভাইয়েরে দ্যাখবার চায়।
আলতাফ বলে, আমি তো ওদের ঘরে গিয়েছিলাম। শুনি ওর ছোটো ভাই গেছে নরসিংদি আর বাপ কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে।
খাইবো ক্যালায়? খিজির আলি ফের এগিয়ে আসে, বাড়িআলা কাউলকা রাইতে একবার ধামকি দিয়া গেছে, রঞ্জুরে জানি মিটিঙেনা পাঠায়। আবার আউজকা মকবুল সাবরে ধইরা লইয়া গেছে। মহল্লার পোলাপান না গেলে তো মাইর দিতো। মিটিঙের মইদ্যে উনিরে এই কথাগুলি কইতে হইবো। ব্যাকটি কইয়া দিবো। মাহাজনে কি কইরা তারে বেইজ্জতি করছে পাবলিকরে কইয়া দিবো। উত্তেজনা ও আবেগে খিজির কাপে, মহল্লার মাইনষে আউজকা মাহাজনরে বানাইয়া ছাড়বো’
‘তুই চুপ কর না। তাকে ধমকে থামায় আলাউদ্দিন, বাঙ্গুর লাহান খালি প্যাচাল পাড়স। মিটিঙের মইদ্যে এইগুলি কইবো ক্যালায়? মিটিঙের এজেন্ডা আছে না?
এইসব হৈচৈ ও লোকজনের মাঝামাঝি হাতে-কাচা ঘি রঙের শার্ট ও সবুজ চেক চেক লুঙির ভেতর থর থর করে কাপে মকবুল হোসেন।
তার ঠোঁটের কাপন দেখেই রঞ্জু ওপরের দিকে তাকায়। ওদের বারান্দায় রেলিঙে কুকে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রানু। রানুর মুখ ভয়ানক ফ্যাকাশে। আহা! মেয়েটা নিশ্চয় খুব ভয় পেয়েছে। চারপাশের কোলাহল ওসমানের কানে বাজে আবহ-সঙ্গীতের মতো, এসব ছাপিয়ে শোনা যায় রানুর মিনতি, আপনে একটু বলেন না। আব্বারে মিটিঙে নিলে আব্বা কিছু বলতে পারবে না, আব্বা এক্কেবারে সাদাসিধা মানুষ! আব্বারে আপনে ঘরে নিয়া যান। ওসমান ফের ওপরে তাকায়,–না, কোথায় রানু? ইশারায় তাকে ডেকে রানু কি এই সব কথা তাকে বলতে পারতো না? ওসমান ভাবে, যাই, রানুকে বলে আসি, আমি তো আছি। তোমার বাবাকে আমি দেখবো। তুমি কিছু ভেবো না।-কিন্তু রানুর সঙ্গে এইসব কথাবার্তা বলার বা তার ওপর রানুর আস্থা উপভোগ করার কপাল কি ওসমানের হবে? লোকজন শালা ছুটছে।
ছুটন্ত জটলার ভেতর থেকে হঠাৎ স্লোগান ওঠে শহীদের রক্ত’-বৃথা যেতে দেবে না। এরপর ফের স্লোগান আরু তালেবের রক্ত-বৃথা যেতে দেবে না। এরকম ২/৩ বার স্লোগান দেওয়ার পর খিজিরের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়, আইয়ুবের দালাল মাহাজন।’ কিন্তু এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না। দ্বিগুণ শক্তিতে খিজির চিৎকার করে, আইয়ুবের দালাল মহাজন? এবার জবাব আসে, ‘ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক!’ তারপর ফের স্লোগান ওঠে, মাহাজনের জুলুম, মাহাজনের জুলুম’–’চলবে না, চলবে না। খিজির এবার ফের নতুন প্লোগান তোলে, মানুষরে ডাইকা বেইজ্জতি করা’-‘চলবে না চলবে না’ পাড়ার ছেলেরা মনে হয় মজা পেয়েছে, খিজিরের রাগ তারা উপভোগ করে। রঞ্জুর বাবার ঠোঁট আরো তীব্রভাবে কাপে, ওসমানের ভয় হয়, এরা কি রহমতউল্লার বাড়ি থেকে রানুদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করছে? আলাউদ্দিন মিয়া ছিলো মিছিলের পুরোভাগে, খিজিরের দিকে তাকিয়ে সে একটু থামে। মিছিল এগিয়ে চলে। ওপরের দিকে চামড়া জড়ানো হাড্‌ডিসর্বস্ব হাত ওঠানো খিজির তার সামনে এলে আলাউদ্দিন চোখ ঘুরিয়ে একটু নিচুস্বরে বলে, ‘খ্যাচরামো করনের জায়গা পাইলি না, না? এইগুলি কি কস হারামজাদা, এইগুলি কি? খামোস মাইরা থাক।
কিন্তু আনোয়ার এগিয়ে আসে, কেন? মহাজন তো খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিলে ক্ষতি কি?
খিজির আলি ভরসা পেয়ে বলে, আরে আমি তো তাই কই রঞ্জুর বাপে ইস্টেজের উপর খাড়াইয়া কউক, মাহাজন আমারে লইয়া গিয়া বেইজ্জত করছে! আপনেরা বিচার করেন।’
আনোয়ার সায় দেয়, বলুক না! আইয়ুব খানের লোক্যাল এজেন্টদের এক্সপোজ করা দরকার।
আলাউদ্দিন মিয়া কিন্তু আনোয়ারের দিকে মনোযোগ দেয় না। এমন কটমট করে খিজিরের দিকে সে তাকায় যে, মনে হয় ওকে আচ্ছা করে পেটাতে পারলে তার শীররটা জুড়ায়। কিন্তু মামার বদভ্যাসগুলো তার ওপর বর্তায়নি। চাকরের গায়ে সে কখনো হাত তোলে না, পারতপক্ষে মুখও খারাপ করে না। তাহলে কি খিজিরকে আজ বরখাস্ত করে দেবে? তবে আপাতত সেই কাজ স্থগিত রেখে আনোয়ারকে বলে, আপনেরা আমাগো মহল্লার খবর রাখেন না, তাই এইসব কথা কন রহমতউল্লা সর্দাররে ওপেনলি কনডেম করলে মহল্লায় রি-এ্যাঁকশন খারাপ হইবো, বুঝলেন না?
আলতাফ এবার এগিয়ে আসে আনোয়ারের সমর্থনে, মুসলিম লীগের এইসব পচারদি মালের বিরুদ্ধে কথা বললে কার গায়ে লাগবে?
দরকার কি? আলাউদ্দিন তর্ক করে, মকবুল সাব মঞ্চে দাঁড়াইয়া কইবো, তার পোলারে পুলিসে গুলি করছে তার পোলারে মারার ফলে তাদের ফ্যামিলিতে মুসিবত নাইম আসছে, তার পোলা ছিলো ফ্যামিলির ওনলি আর্নিং মেম্বার।-এইগুলি বলুক। আমাদের দরকার পাবলিকের সিমপ্যাথি, না কি কন?
আনোয়ার তবু গো ছাড়ে না, স্টেজে উঠে কান্নাকাটি করার দরকার কি? এতো নাটক হচ্ছে না, পাবলিক কাদানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং মহাজনের শয়তানিটা এক্সপোজ করলে কাজ হয়। তাই না আলতাফ ?
আলতাফ এবার আলাউদিনের ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে, ঐ লোকটাকে এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনাকে পুলিশ এ্যাঁরেস্ট করে যখন তখন এই লোক পুলিশকে ঠেকাতে এসেছিল? তার স্বর একটু নরম হলো, আপনি সেই কবে থেকে পলিটিক্স করছেন, এতো সাফার করলেন, তবু এদের চিনতে পারেন না?
‘ঐগুলি কথা কইয়া ফায়দা কি, কন? আলতাফকে থামিয়ে দিলেও আলাউদ্দিন নিজেই ঐসব কথা শুরু করে, মুসলিম লীগের এগেন্সটে কথা বললে যখন গুনা হইতো, বুঝলেন, গুনা হইতো, জমাতে নমাজ ভি পড়বার দিতো না, আমরা তখন ছোটো আছিলাম, তখন থাইকা জানটারে বাজি রাইখা চোঙা ফুকতাছি। ঐ যে মুজিব ভাইয়ের পিছে খাড়াইছি, আর ইমাম বদলাই নাই, তার পিছনেই রইছি! একটু থেমে সে ফের বলে, ‘মহল্লার মইদ্যে কার কি রকম ইজ্জত আমরা জানি না?

চিলেকোঠার সেপাই – ১১

কথা বলতে বলতে শ্লোগান দিতে দিতে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে, পার্কের ভেতর থেকে আসে বক্তৃতার আওয়াজ। আরো একটু এগোলে কথাগুলো স্পষ্ট হয়, ভাইসব, তেইশ বছর থেকে সোনার বাঙলার সম্পদে ফুলে ফেপে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙলাকে শোষণ করে গড়ে তোলা হয় করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ। পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিতে খাল কেটে আজ ফসল ফলানো হচ্ছে, সেসব কার টাকায়? আমাদের বন্যা সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। আমাদের কৃষক আজ পাটের দাম পায় না, বাঙলার ছাত্রসমাজ আমাদের এখানে তৈরি কাগজ কিনতে বাধ্য হয় বেশি দামে, বাঙালি বলে ভালো চাকরি থেকে আমরা বঞ্চিত। আমাদের অধিকার আদায়ের কথা বলার জন্য আমাদের নেতাকে কারাবন্দি হতে হয়, মিথ্যা ষড়যন্ত্রের মামলা চাপিয়ে তাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ফন্দি আঁটে আইয়ুব খান। ভাইসব, আমরা বাহান্ন সালে রক্ত দিয়েছে, বাষট্টিতে রক্ত দিয়েছি, উনসত্ত্বরের সূত্রপাত রক্তপাতের ভেতর। ভাইসব—।
ভিক্টোরিয়া পার্ক ভর্তি মানুষ। শহীদ মিনারের বিশাল বেদীতে অনেক লোক, এদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতা ও কর্মী। বেদীর চারদিকে সিঁড়িতেও ছেলেরা বসে রয়েছে, কারো কারো হাতে পোস্টার-সটা বাশের চাটাই। পাশের রেলিঙটপকে উপচে পড়েছে মানুষ, দেওয়াল ঘেঁষে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বা হাঁটতে হাঁটতে বক্তৃতা শুনছে। পূর্বদিকের গেট থেকে ফুচকাওয়ালা ঘুঘনিওয়ালাদের সরে যেতে হয়েছে ওপারে ইসলামিয়া কলেজের গেটে। এখান থেকে উল্টোদিকে ট্যাকসি-স্ট্যাণ্ডে ৩টে ট্রাক,ট্রাকে রাইফেল হাতে সদাপ্রস্তুত পুলিসবাহিনী। শীতের বিকালবেলাটা গড়িয়ে পড়েছে এই পার্কে, শেষ-রোদ লেগে শহীদ মিনারের গম্বুজ লালচে শাদা রঙে হাসছে। মাইকে এখন অন্য একটি কণ্ঠ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পাকিস্তানে তাদের পা-চাটা দালাল আইয়ুব খান ও তার চেলাচামুণ্ডাদের দিয়ে এদেশের মানুষকে শোষণ করে চলেছে। এদেশের সাধারণ মানুষের পেটে আজ ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই। অথচ সর্বহারা মানুষের শ্রমে উপার্জিত টাকায় কিছু মানুষ প্রতিদিন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। ঋণ ও সাহায্য নেওয়ার নাম করে সাম্রাজ্যবাদের পোষা কুকুর আইয়ুব খান দেশকে, দেশের মানুষকে বন্ধক দিয়ে রেখেছে বিদেশী প্রভুর কাছে। আজ বিশ্বের সর্বত্র, এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকায় সর্বহারা মানুষ জেগে উঠেছে, সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল মুৎসুদীদের দিন শেষ হয়ে এসেছে, কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষ আজ-।
একটু গম্ভীর ও একটু হাসিহাসি মুখ করে আলাউদ্দিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। ১টি ছেলে এসে বলে, আলাতাফ ভাই, ওপরে চলেন। আলতাফ মাথা নাড়ে, ছাত্রদের মিটিং, আমরা শুনতে এসেছি।
আলাউদ্দিন মিয়ার পেছনে খিজিরও সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। কিন্তু বেদী পর্যন্ত না উঠে বসে পড়ে সিঁড়ির ওপরের দিকে একটি ধাপে। খিজির আলির পেছনে ছিলো মকবুল হোসেন। খিজির বসার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ওর পাশে দাঁড়ায়। আলাউদ্দিন উদ্যোক্তাদের একজনকে পাশে ডেকে কানের কাছে মুখ এনেকি বলে আর সেই উদ্যোক্তা দাঁড়ায় বক্তৃতারত ছেলেটির পাশে। ছেলেটি বলে, ‘ভাইসব, আর মাত্র একটি কথা বলেই আমি বিদায় নেবো। আমি কেবল এই কথা বলতে চাই যে, শুধু সরকার বদলালেই আমাদের দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটবে না। সাম্রাজ্যবাদীরা চায় না যে আমদের ঘুণে-ধরা সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী সমাজে ব্যবস্থা থেকে আমরা মুক্ত হই। তারা তাই তাদের নানা রকম রঙ-বেরঙের দালাল দিয়ে—’ তার বক্তৃতা শোনা যায় না, বেদীর নিচেই একটি জটলা স্লোগান দিতে শুরু করে, জাগো জাগো’-‘বাঙালি জাগো। পণ্ডি, না ঢাকা?—‘ঢাকা ঢাকা। আগরতলা ষড়যন্ত্ৰ’-মানি না মানি না।
এর মধ্যে অন্য একটি তরুণ মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশে রঞ্জুর বাবার পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলাউদ্দিন মিয়া। মাইকে শোনা যায়, ভাইসব, আপনারা বসে পড়ুন, বসে পড়ুন আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের মহান শহীদ ভাইয়ের মহান পিতা। আপনারা জানেন, এখানে বক্তা বড়ো উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং বড়ডো তাড়াতাড়ি কথা বলতে থাকে; একই সঙ্গে মাইকে কোকো আওয়াজ শুরু হওয়ায় তার কথা কিছু বোঝা যায় না। একবার শোনা যায়, আমরা জানি, আমরা জানি, আমরা জানি- তার জানা জিনিসটা বলার সুযোগ পায় না, আরেকজন এসে মাইক দখল করে এবং বলে, গত ৮ই ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত ওয়াপদার তরুণ কর্মচারী শহীদ আবু তালেবের পিতা এখন আপনাদের সামনে কিছু বলবেন। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দক্ষিণ দিকের গেটের পামগাছের নিচে জটলা থেকে শ্লোগান ওঠে, সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা’-‘হুশিয়ার হুঁশিয়ার। দুনিয়ার মজদুর’—এক হও’, ‘কেউ খাবে, কেউ খাবে না’– তা হবে না, তা হবে না’, ‘জোতদারের গদিতে –‘আগুন জ্বালো এক সাথে। মিল মালিকের গদিতে—আগুন জ্বলো এক সাথে।’
এইসব শ্লোগান চলছে, তখন আবার বেদীর নিচে সেই জটলা থেকে দক্ষিণ দিকে মুখ করে কয়েকজন শ্লোগান দেয়, বাঙলার মজদুর’—এক হও, ছয় দফা ছয় দফা’-‘মানতে হবে মানতে হবে, আগরতলা ষড়যন্ত্র’—মানি না মানি না’, শেখ মুজিবের শেখ মুজিবের —মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।’
দুটো জটলা চিৎকার করার ভঙ্গি এমন যে, মনে হয় তারা যেন পরস্পরের দিকে শ্লোগান ছোড়াছুড়ি করছে। শ্রোতাদের বেশির ভাগই দুই দিকের শ্লোগানেই সাড়া দিচ্ছিলো। কিন্তু শ্লোগান আর থামে না দেখে লোকজন এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করে। কিছু কিছু লোক রেলিঙের বাইরে যাবার উদ্যোগ নেয়। খিজির দাঁড়িয়ে মঞ্চে ওঠে এবং সেখান থেকে গোটা পার্কটাকে ভালো করে দ্যাখার চেষ্টা করে। মঞ্চে সবাই শিক্ষিত লোকজন। বেশির ভাগই ইউনিভারসিটি বা কলেজের ছাত্র, অন্তত ভদ্রলোক তা বটেই। কিন্তু এদের মধ্যে দাঁড়ালেও কেউ তাকে খেয়াল করে না, যেভাবে শ্লোগান-পাল্টা শ্লোগান চলছে তাতে মিটিঙের পরিণতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। আলাউদ্দিনও ঘাবড়ে গিয়েছিলো বৈকি! তার অনেক দিনের অভিজ্ঞতা, সে জানে যেন এসব ব্যাপার কেবল শব্দবাণে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছাত্রদের মধ্যে কি ধরনের ঐক্য স্থাপিত হয়েছে কে জানে? ইউনিভারসিটিতে বছরের পর বছর ধরে ল ক্লাসে পড়ে-থাকা নেতাগুলো কি কিছুই আঁচ করতে পারে না? কৰ্মীদের অস্ত্র কখন যে মুখ থেকে হাতে সরে কোন শালা জানে?—আলাউদ্দিন তাই খিজিরকে একটু চোখ টিপে দেয়, সে যেন তার সামনেই একটু আড়াআড়িভাবে দাঁড়ায়। কিন্তু এই বাঙ্গুটার বুদ্ধি দাখো ব্যাট তার ইশারার কি বুঝলো, হাত দিয়ে মাইকের স্ট্যান্ড ধরে ফেললো। তারস্বরে খিজির চ্যাচাতে শুরু করে, ভাইসব ভাইসব, আপনেরা খালি খালি চিল্লাচিল্লি করেন ক্যালায়? খামোস মাইরা মিটিং হোনবার পারেন না? পাঁচজনে দশজনে একলগে নামছেন, খালি চিল্লাচিল্লি করবেন তো খালি হাউকাউ হইবো, কাম হইবো আপনের কেলাটা কাম করেন একলগে, হাউকাউ কইরেন না। হালার গ্যাঞ্জাম তো বহুত করছেন, অহন আল্লার ওয়াস্তে চোপাগুলিরে এটু আরাম দেন। খিজির আলির দৈর্ঘ্য ও কৃশতা, তার ভাঙাচোরা গাল, কাটখোটা মার্কা চেহারা, কালচে পুরু ঠোঁট কিংবা তার ঘোরতর স্থানীয় উচ্চারণে শ্রোতাদের মধ্যে দারুণ হাসাহসি শুরু হয়। এমনকি আলাউদ্দিনও হাসতে হাসতে তার পিঠে হাত রেখে বলে, ‘ল হইছে!’ লোকজন খুব হাসছে। যারা তাকে চেনে তারা তো হাসছেই, তারা জানে যে, কোথাও কোনো গোলমাল কি জটলা দেখলেই হাড্‌ডি খিজির সেখানে হাজির হয়ে চাপাবাজি করে। শ্রোতাদের বেশির ভাগই তাকে চেনে না, তারা আরো হাসছে। মাইকের সামনে এখন মকবুল হোসেন। কিন্তু লোকজন খিজিরের উচ্চারণ ভঙ্গি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মুখ ভাংচাচ্ছে, মকবুল হোসেনের দিকে তাদের মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়? আনোয়ার ও আলতাফ শ্লোগান ও পাল্টা শ্লোগানে আড়ষ্ট হয়ে পরস্পরের দিকে না তাকাবার চেষ্টা করছিলো। খিজিরের এই কাণ্ড দেখে তারা সহজ হলো নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহসি করে। শ্লোগান বন্ধ করে ছেলেরা নিজেদের অজান্তেই খিজিরের আহবান মেনে নিয়েছে। খিজিরের প্রতি ঠাট্টা, কৌতুক ও বিদ্রুপের অভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন জটলার ছেলেদের পরস্পরের প্রতি তেতো মনোভাব স্থগিত রইলো। আলাউদ্দিন মিয়া ঠোঁটে হাসি বিছিয়ে রেখেই ঘোষণা করে, এখন আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন শহীদ আবু তালেবের পিতা জনাব মকবুল হোসেন সাহেব।’ শ্রোতারা মোটামুটি চুপচাপ হয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু মকবুল হোসেনজিভ দিয়ে ঠোঁট মোছে, বারবার মেছে। আমি বলার পর সে টোক গেলে এবং ফের শুরু হয় তার জিভ দিয়ে ঠোঁট মোছার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার পেছন থেকে একজন তরুণ নেতা বলে, বলেন না, বলেন না। এই গলা মাইকে বড়ো স্পষ্ট, বলেন, আইয়ুব-মোনেমের লেলিয়ে-দেওয়া পুলিসবাহিনী আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে। কথাগুলো আস্তে বললেও মাইকে শোনা যায়। এবার শ্রোতাদের মধ্যে সাঙ্গাতিক নীরবতা। মকবুল হোসেনের ঠোঁট কাপে। পেছনের ছেলেটি ফের বলে, বলেন, বলেন। মকবুল হোসেন আস্তে আস্তে বলে, আমার ছেলে, আরু তালেব, আমার বড়োছেলে মোহাম্মদ আরু তালেব গত মাসের ৮ তারিখে নিউমার্কেটের সামনে নীলখেতের মোড়ে পুলিসের গুলিতে
তরুণ ছাত্রনেতা প্রম্পট করে, বলেন মিছিল থেকে—’ মকবুল হেসেন বিড়বিড় করে,মিছিল থেকে মারা গেছে।’ ছাত্রনেতা ফের প্রম্পট করে, বলেন, আমার একটি ছেলে মারা গেছে, কিন্তু আমার ছেলের মতো লক্ষ লক্ষ ছেলেকে আজ আইয়ুব শাহী উচ্ছেদ করার জনো- ৷
কিন্তু মকবুল হোসেনের ভারি গলায় বলা হয়ে যায়, আমার একটি ছেলে মারা গেছে, কিন্তু আমার আরেকটি ছেলে আছে। তাকে যদি না বাচাতে পারি? তাকে ক্যামনে বাঁচাই, ক্যামনে বাঁচাই? সে কাঁদতে শুরু করায় তার কথা একেবারে নেতিয়ে পড়ে। সে চোখে হাত দেয় না, নাক মোছে না। নাক থেকে চোখ থেকে পাতলা পানি গড়িয়ে পড়ছে। জনসভা নির্বাক হয়ে তার কান্নাজড়ানো ধ্বনি শোনে। মকবুল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়ে খিজির বলে, মাহাজনে আপনেরে বেইজ্জত করছে, কন আরে কন না, কন না। কাব্দেন ক্যালায়?
আলাউদ্দিন মকবুল হোসেনের ঘাড়ে আলগা করে হাত রাখে। লোকটি একটু ঝুঁকে পড়ে। তারপর আলাউদিনের ঘাড়ে মুখ গুঁজে সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।
খিজির বেশ উত্তেজিত। তার ঠোঁটজোড়া এমন বেসামালভাবে কাপে যে, ভয় হয় ঐ দুটো তার মুখ থেকে খসে নিচে না পড়ে। অস্থির ঠোঁটজোড়া থেকে বেরিয়ে আসে, কাব্দেন ক্যালায়? কথাটা কইবার পারলেন না? কন না। ডর কিয়ের? আমরা এ্যাঁতোটি মানুষ আছি না? কান্দনের কি হইলো? কইয়া ফালান, মাহাজনে আপনেরে ডাইকা লইয়া কেমুন বেইজ্জত করলো, কন না।’
মঞ্চের ও সিঁড়ির লোকজন সমস্ত অডিয়েন্সের সঙ্গে মাইকে মকবুল হোসেনের ফোপানি শুনতে শুনতে তার প্রতি সহানুভূতিতে ও তার পুত্ৰশোকে বেশ বুদ হয়ে বসে ছিলো। খিজিরের এই সব উত্তেজিত অনুরোধও মাইকে ধরা পড়ায় মকবুল হোসেনের ফোঁপানি বারবার বিঘ্নিত হয়। লোকজনের মেজাজ চড়ে যায়, একজন বলে,আঃ! আরেকজন বলে, আপদটা এই দ্বিতীয়জনের গলায় শিশুদের কোলাহলে কাঁচা-ঘুম-ভাঙা মানুষের বিরক্তি, কুট্টিটার কমনসেন্স নাই!’
মকবুল হোসেন তার বুকে মাথা রাখায় আলাউদ্দিন বড়ো অভিভূত। সমস্ত শ্রোতার চোখ এখন তার দিকে। তাকে দুই হাতে প্রায় আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে ধরতে কৃতজগদগদ কণ্ঠে আলাউদ্দিন ঘর্ঘর করে, ভাইসব, এটু শক্ত হইতে চেষ্টা করেন। একটু থেমে সে বলে, শক্ত হন, ডর কইরেন না, রহমতউল্লা সর্দাররে আমি সামলাইবার পারুম!’
মিটিং শেষ হলে রিকশা আর পাওয়া যায় না। ওসমান ও আনোয়ারকে হাটতে হলো একেবারে রথখোলার মোড় পর্যন্ত। রিকশায় উঠে লাভটা কি হলো? মানুষে, গাড়িতে, স্কুটারে, রিকশায়, সাইকেলে নবাবপুর একেবারে ঠাসা। ওদের রিকশা কিছুক্ষণ চলে, ফের থামে। সামনে যানবাহনের স্রোত থামে, ওদের রিকশাও থামে, রাস্তাফের চলতে শুরু করলে রিকশাও চলে।
মিটিং থেকে বেরুবার পর থেকেই আনোয়ারের মেজাজ চড়ে আছে, ব্যাটারা আছে খালি নিজেদের নিয়ে। নিজেদের লিডার, নিজেদের পার্টি ছাড়া কথা নেই। ওসমান বলে, নিজেদের কথা বলবে না কেন? পার্টিগুলো তো আর মার্জড হয়ে যায়নি।’
‘আরে ভাই, পাবলিকমিটিং তো সেমিনার নয়। সেমিনারে না হয় নিজের নিজের বক্তব্য বলতে পারে। এই পর্যন্ত বলে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা ১টি দোকানের সামনেসিমেন্ট আনলোড-করা ট্রাকের উদ্দেশে আনোয়ার গালাগালি করে, তারপর ফের বলে, শুধু নিজেদের কথাই বলবে তো ইউনিটি করার দরকার কি?
বলতে দাও না’, ওসমান এমন করে বলে যেন মিটিঙে দলের বক্তব্য প্রকাশ করতে দেওয়ার মালিক আনোয়ার, বলতে দাও। দাখো মানুষ কার প্রোগ্রাম এ্যাঁকসেপ্ট করে।’
আরে নাঃ এর মধ্যে যদি বুঝতে পারে যে, অন্য কোনো পার্টির প্রোগ্রামে মানুষ সাড়া দিচ্ছে তো ব্যাটারা নিজেরাই সেই ইসু নিজেদের নামে চালাবে।’
তাহলে তো ভালোই। ওসমান হাসে, মনে করে তোমাদের প্রোগ্রাম ওরা এ্যাঁকসেস্ট করলো, তাহলে কি তোমাদের বিজয় হলো না?
না। আমাদের প্রোগ্রাম ওরা নেবে শ্লোগান হিসাবে। কোনো প্রোগ্রামের পপুলারিটি বুঝে তাই নিয়ে শ্লোগান ঝাড়বে। এককালে অটোনমির নামে খড়গহস্ত ছিলো, পাকিস্তানের কনস্টিটিউশনে নাকি ৯৯% অটোনমি দেওয়া হয়েছে। আবার দাখো এরাই এখন আটোনমির চ্যাম্পিয়ন। এরপর দেখবে সোস্যালিজমকে নেবে শ্লোগান হিসাবে। অথচ কোনো ইসুকে এরা পিপলের কাছে নিয়ে যায়নি। যে কোনো পার্টির যে কোনো প্রোগ্রাম মানুষের মধ্যে পপুলার হলে সেটার শ্লোগানটা এরা পিক আপ করে নিয়েছে।
কিন্তু একই প্ল্যাটফর্ম থেকে সবাই বললে লোকে কিন্তু বুঝতে পারে কার কথা জেনুইন, কারটা শুধু চাল মারা। এছাড়া কাজ করতে করতে ওয়ার্কারদের মধ্যে পরস্পরের মতামত সহ্য করার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।’
এখানে কি ধৈর্য পরীক্ষা আর পরমতসহিষ্ণুতার ট্রায়াল দেওয়া চলবে? কৈ, ঐ লোকটাকে তো বলতে দেওয়া হলো না?
কোন লোক? আরে ঐ যে রিকশাওয়ালা না স্কুটার ড্রাইভার!—ঐ যে তোমাদের আলাউদ্দিন মিয়ার এমপ্লয়ি-ওকে তো বলতে দেওয়া হলো না! মতামতের আদান-প্রদান কি খালি ভদ্রলোকদের মধ্যে চালাচালি হবে?
ওসমান এবার বিরক্ত হয়, তুমি বোঝে না! খিজিরকে বলতে দিলে বাড়িওয়ালা চটে গিয়ে আরু তালেবের বাবাকেও শহীদ করে ছাড়তো, অন্তত ঐ বাড়িতে থাকতে দিতো না।’
কেন? বাড়িওয়ালা কি ফ্রি থাকতে দেয়? ফ্রি থাকবে? ওসমান ফিক করে হাসে, তিন তারিখের মধ্যে ভাড়া না দিলে দিনে দুবার, এক সপ্তাহ পার হলে দিনে চারবার তাগাদা দেয়।
তাহলে এতো ভয় পাবার কি আছে? এই বাড়ি ছাড়লে আর বাড়ি পাবে না? পাবে না কেন? তবে ভাড়া বেশি দিতে হয়। বাড়ি বদলানো মানেই বেশি ভাড়ায় যাওয়া। আবার এই বাড়িতে যারা আসবে তাদেরও বর্তমান ভাড়া বেশি দিতে হবে। প্ররেমটা তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না—। ওসমানকে কথা শেষ করতে দেয় না আনোয়ার, বুঝি। ঢাকায় বাড়িওয়ালা শালারা একেকটা থরো-ব্রেড হারামজাদা! দফায় দফায় ভাড়া বাড়াচ্ছে। এখন তো বছর বছর বাড়ে, এরপর ঈদে বাড়াবে, মহরমে বাড়াবে। শীতে বাড়াবে, গরমে বাড়াবে।’
ওসমান হো হো করে হাসে, রোদে বাড়াবে, ছায়ায় বাড়াবে।’ তারপর ধরো বাঙালি জাতীয়তাবাদের তোড় যেভাবে আসছে তাতে মনে হয় শহীদ দিবস উপলক্ষেও বাড়াবে, পয়লা বৈশাখে বাড়াবে।’ আনোয়ার হাসতে হাসতে বললে ওসমান খুশি হয়। আনোয়ারও তো বাড়িওয়ালা। যাক, ওসমানের কথায় সে রাগ করেনি। হাসি থামিয়ে আনোয়ার বলে, আমাদের বাড়িতেও তো দেখি। আম্মা আর ভাইয়া ভাড়া বাড়াবার ব্যাপারে সব সময় একমত!
ওসমান বিব্রত হয়, না সবাই তো একরকম নয়। তবে ধরে বাড়ি ভাড়া দেওয়াটা এখন একরকম ব্যবসা।’
ব্যবসা কি বলছো? জমিদারী, জমিদারী!’ আনোয়ার অতিরিক্ত উত্তেজনা প্রকাশ করে, এ শালা আরেকটা পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট। লর্ড মাউন্টব্যাটেন’স পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট নাইন্টিন ফোর্টি সেভেন। এদিক ওদিক করে একটা বাড়ি বানাও, এক বাড়ি ভাড়ার টাকায় আরেকটা বাড়ি করো। সেকেন্ড টাইমে একটু পশ এরিয়ায়, থার্ড টাইমে গুলশান। ব্যস এক জেনারেশনেই বুর্জেয়া’
বাড়িওয়ালাদের সম্বন্ধে কথা উঠলে আনোয়ার একটু বাড়াবাড়ি রকম চটে। অবশ্য ওদের বাড়ির বিশেষ ধরনের সুবিধা সে খুব একটা নেয় না! তার কলেজের চাকরির রোজগারের বড়ো ১টা অংশ তুলে দেয় মার হাতে। বাড়ির যে অংশে ভাড়াটেরা থাকে সেদিকে পারতপক্ষে পা মাড়ায় না। তাহলে এই বাড়িভাড়ার প্রসঙ্গ উঠলে সে এতো চড়া-গলা হয় কেন? ওসমান এ নিয়ে কোনোদিন ভাবেনি, এখনো ভাবলো না। তবে ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে। একজনের পরিবারের দুর্বল দিক যে কথায় এসে পড়ে তা এড়িয়ে চললে কি ভালো হয় না? ওসমান তাই আগের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চায়, খিজিরকে বলতে দিলে হতো কি, ও হয়তো রহমতউল্লা সর্দারের নামে যা তা বলতো, মিটিঙে ক্যাওস হতে পারতো!
রাখো! বাড়িওয়ালা যতো শক্তিশালী হোক না, মানুষ যেখানে টোটাল এক্সপ্লয়টেশনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সেখানে তার পজিশন আর কি এমন শক্ত?
সামনের ট্রাক সিমেন্টের বস্তা নামিয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো। কিন্তু আলুবাজারের মোড়ে ফের জাম। ওসমান সেই ট্র্যাফিক জামের কারণ খুঁজতে খুঁজতে বলে, না, আবু তালেবের বাবাকে যদি উৎখাত করে তো তার সমস্ত কষ্টটা বহন করতে হবে তাকে নিজেকে। আমাদের বাড়িওয়ালার যারা অপোজিট গ্রুপের লোক, তারাও তাকে কম ভাড়ায় বাড়ি দেবে না। টাকা পয়সার ব্যাপারে লোকটা একটু ট্রাবলে আছে, তালেব মারা যাবার পর—।’ ওসমানকে আনোয়ার মাঝখানে থামিয়ে দেয়, যার ছেলে মারা যায় পুলিসের গুলিতে তার আবার ভয় কি ? তার হারাবার আর কি আছে?
আছে। আরো একটি ছেলে। দুটো মেয়ে আছে— ‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নাকি? আনোয়ারের এই ঠাট্টায় ওসমান সাড়া দিতে পারে না। আনোয়ার বলে, ‘আর কি আছে, বললে না?
‘আর কি থাকবে, বলো? ছোটোখাটো চাকরি আছে, খেটেখুটে খায়, সাহসটা কম। ওর বলতে ইচ্ছা করছিলো যে, মবকুল হোসেন গরিব মানুষ, চট করে বিপ্লব করা তার পোষায় না। আনোয়ার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ঢাকা শহর বলে তোমাদের এইসব রহমতউল্লা এখন পর্যন্ত দাপটে আছে। গ্রামে অবস্থা অন্যরকম। তোমাকে বললাম, চলো একবার ঘুরে আসি। সামনের সপ্তাহে চলো।’
‘তোমার কলেজ? ‘আরে কলেজ তো সব সময় বন্ধ। একবার ছেলেরা স্ট্রাইক করে, একবার গভমেন্ট বন্ধ করে দেয়। বাকি সময়টা হয় রোববার, নয় ভ্যাকেশন। চলো, ঘুরে আসবে।’

আমজাদিয়ায় এক কোণে ওদের টেবিলের সামনে রয়েছে শওকত। মাথাটা সে ঠেকিয়ে রেখেছে পেছনের দেওয়ালে। সামনে এ্যাঁশট্রেতে মোটা চুরুট থেকে পাতলা ধোঁয়া জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আনোয়ার সামনে এসে বলে, একা যে?
এর জবাব আমি কি করে দেবো? যারা আসেনি তাদের জবাব দেওয়ার দায়িত্ব কি আমার? এই কথার সঙ্গে নিঃশব্দ হাসিতে তার মস্ত বড়ো মুখ ভরে যায়, চোখজোড়া ঢুলুচুলু। ওসমান জিগ্যেস করে, আপনার খবর কি?
সার্থী হ্যাঁয় খুবসুরত-মওসম কা ইয়ে খবর হ্যাঁয়। শওকত গুনগুন করে গানটার সুর ভাজে। সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আরো ছড়িয়ে বসে চোখ বন্ধ করে।
চা খেতে খেতে আনোয়ার জিগ্যেস করে, ওসমান, তোমার ছুটি নেওয়ার কি করলে? ওসমান আমতা আমতা করে, একটু মুশকিল হচ্ছে দোস্ত। আমাদের সেকশনে একজন ছুটি নিয়েছে, তার আর ফেরার নাম নেই।’
‘আরে তোমার তো মেলা ছুটি পাওনা! একবার এ্যাঁপ্লাই করেই দ্যাখো না! ওসমান আমতা করে, না আবার একটা প্রাইভেট ট্যুইশনি নিতে হলো, এবার পরীক্ষা দেবে।
‘ইন্টারমিডিয়েট? না। এসএসসি, মানে ম্যাট্রিক দেবে।’ ‘এখন পরীক্ষা কোথায়? চলো তো যাই। ঘুরে এসে তৈরি করে দিও।’ ওসমান সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে বলে, কিন্তু অঙ্কে খুব কাঁচা। তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করা যাবে না। ওসমান ভাবে, ভালো করে দেখিয়ে না দিলে রানুট এবারও ফেল করবে। দায়িত্ব নিয়ে এভাবে কেটে পড়াটা কি ঠিক?
এইসব গাধাগরুকে পড়াও কেন? তুমি না ভালো ছেলে না হলেতো পড়াও না। একটা ব্লান্ট ছাত্রকে পড়াতে বিরক্ত লাগে না?
এইবার রানুর জন্য ওসমানের খুব খারাপ লাগে। মনে হচ্ছে একই অঙ্ক বারবার ভুল করার অপরাধে বাইরের একটা লোক এসে রানুকে বিশ্রীভাবে হেনস্থা করছে। খাতা থেকে মুখ তুলে রানু ওসমানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রানুর মুখ আস্তে আস্তে ঝাপশা হয়ে আসে, তখন রানু কি রঞ্জু কার মুখ ঠিক ঠাহর করা যায় না।
ওসমান গম্ভীর হয়ে বলে, নিতে হলো। প্রিন্সিপলে অতোটা স্টিক করাটা আমাদের পোষায় না ভাই!’
এদিকে ঝিমুনি বা তন্দ্রা থেকে সোজা হয়ে বসে নিভে-যাওয়া চুরুটে আগুন ধরাতে শওকত জিগ্যেস করে, এই রান্ট স্টুডেন্টটা কোন জেনডারের? উল্টোদিকের টেবিল থেকে উঠে আসে খালেদ। ঐ টেবিলটা থাকে কবিদের দখলে, খালেদও কবিতা না গল্প কি যেন লেখে। খালেদ এসেই শওকতকে বলে, কি ওস্তাদ, আউট হয়ে গেছেন নাকি?
শওকত হাসে, এতো তাড়াতাড়ি? গুলসিতান থেকে পাঁচটা পেগ দিয়ে বউনি করে এলাম।
পাঁচ পেগ মেরে দিলেন? পাঁচ পেগের কথা তার বিশ্বাস হয়নি। বিশ্বাস করার কোনো কারণও নাই। কি খেলেন? আনোয়ার জিগ্যেস করলে শওকত ফের হাসে, এই শীতে আর কি চলবে? দিস ওয়েদার হুইসপারস, হুইস্কি! হুইস্কি!
খালেদ বলে, চলেন। এবার হাক্কায় একটু বঙ্গজননীর সেবা করা যাক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শওকত বলে,আসেন না! আনোয়ার, একটা পাইট মেরে আসি।
আনোয়ার সরাসরি না করে, না, এক জায়গায় যেতে হবে।’
খালেদ একটু ঠাট্টা করে বিপ্লব ত্বরান্বিত করার কাজে?
শওকত তখন ওসমানকে আহবান জানায়, ওসমান?
ওসমান সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আনোয়ারের দিকে না তাকিয়েই কাল দ্যাখা হবে দোস্ত’ বলে শওকত ও খালেদের সঙ্গে সে বেরিয়ে যায়।

চিলেকোঠার সেপাই – ১২

বললাম না আছে! তুমি কি আমার থাইকা বেশি জানো?
‘তুই তো সব জানিস’
ওসমানের একটু ঘুম পাচ্ছিলো, রানু ও রঞ্জকে ঘরে দেখে বিছানা থেকে উঠে বসলো। রাত্রিটা বিশ্রী কেটেছে, ঘুম হতে পারে এই আশায় অনেকক্ষণ ধরে মাস্টারবেশন করে, কিন্তু একটু তন্দ্রায় গড়াতে না গড়াতে পানিটোলার চাপা গলিতে সারি সারি খাটা পায়খানার বালতির পাশ দিয়ে কার সঙ্গে হেঁটে যাবার স্বপ্ন দ্যাখে এবং স্বপ্লের মধ্যেই গুয়ের গন্ধে জেগে উঠে ছাদে গিয়ে বমি করে ফেললো। বমির পর আর ঘুম হলো না। সকাল থেকে এ পর্যন্ত ৪টে এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট এবং অফিস থেকে ফেরার পথে আনন্দময়ী হিন্দু হোটেলে বাট মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বেশ ভালো লাগছিলো। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারলে সন্ধ্যাটা চমৎকার কাটতো।
আপনে কখন আসছেন? রানুর এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই রঞ্জু বলে, ‘নেন, আমারে কয়টা ট্রানশেন দ্যাখাইয়া দেন। ইস্কুল টিস্কুল হয় না, আব্বা অস্থির হইয়া থাকে। আপারে বললাম, চলো খাতাপত্র নিয়ে চলো। না। যদি না থাকে?—এখন যাও, খাতা বই নিয়া আবার আসো খালি আপ-ডাউন মারো৷’
রানু জিগ্যেস করে, খাওয়া দাওয়া করবেন না?
‘খেয়ে এসেছি।
‘এখন বিশ্রাম করবেন?
আরে না না! দুপুরে আমি কখনো ঘুমাই না। একেবারেই না। নেভার ওসমান এতোটা তাড়াহুড়া করে বলে যে, মনে হয় এই বিবৃতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কথার এই দ্রুত ও অস্থিরগতি নিজের কানেই মাত্রাছাড়ানো মনে হলে তাকে ফের বলতে হয়, গত বৎসর দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম মাত্র একদিন। তাও ছুটির দিন ছিলো, দুপুরবেলা ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিলো, না ঘুমিয়ে উপায় ছিলো না।
রঞ্জু হাসতে হাসতে জিগ্যেস করে, তারিখ মনে আছে?
খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে সায়েবি উচ্চারণে ওসমান বলার চেষ্টা করে, জানুয়ারি দ্য টুয়েন্টি সেকেন্ড, নাইনটিন হান্ড্রেড এ্যাঁন্ড সিক্সটি এইট এডি।
জানুয়ারি মাসে বৃষ্টি হয়? রঞ্জুর এই সংশোধনী বাক্যে হাসির হল্লা ওঠে, ওসমানের মাথার ভেতর ঘুমের যে প্রস্তুতি চলছিলো তার আর লেশমাত্র বাকি থাকে না। ভাইবোনকে বসতে বলে সে ১টা সিগ্রেট ধরায়। রন্ধুকে বলে, তোমার ট্রানশেন দেখি।’
রানুর সঙ্গে কথা বলার আগে সিগ্রেটে খুব জোরে টান দেয়, কিছুক্ষণ কাশে, তারপর টোক গেলে বার কয়েক। বলে, তোমার ঐকিক নিয়ম না আজ?
ভাইবোন। গায়ের রঙ দুজনের প্রায় একই রকমের শ্যামলা।
সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ঢেউ তোলানো ২ জোড়া নীলচে ঠোঁট। নাকের নিচে ঠোঁটের ওপর ছোটো ভাঁজও দুজনের একরকম। দুজনের নাকও বোধ হয় এক মাপের, স্কেল দিয়ে মেপে দ্যাখা যায়। তবে রানুর নাকের ডগায় ও নাকের নিচে ছোটো ভাঁজটিতে বিন্দু বিন্দু কয়েক ফোটা ঘাম। কিন্তু রঞ্জুর মুখের কোথাও ঘামের চিহ্নমাত্র নাই। ওসমান নিজের নাকের ডগা ও নাকের নিচে আঙুল বুলিয়ে নিলো, নাঃ। একবারে শুকনা খ খ করছে। রানুর ও রঞ্জুর দুজনেরই হাসি হাসি মুখ, কিন্তু রানুর নাক ও ঠোঁটের ওপরকার একক ঢেউটির নাতিশীতোষ্ণ নোনতা শিশিরবিন্দু তাকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে। সিলেটের ধোঁয়ার পাতলা পর্দা ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো রানুর ঘামের বিন্দুগুলোকে অনেক বড়ো করে দাখায়। মনে হয় তার নাকের ডগায় ও ঠোঁটের ওপরকার ঢেউয়ে শিশিরবিন্দু সব বৃষ্টির ফোটা হয়ে টলটল করছে। ওসমানের পিপাসা পায়, রানুর নাকের ডগায় ও ঠোঁটের ওপরকার ঢেউতে মুখ রেখে সমস্ত জলবিন্দু শুষে নেওয়ার জন্য সে ছটফট কর। ১টা চুমুক দিলে হয়তো সারাদিন আর পানি খেতে হবে না। সিগ্রেটে টান দিতে ভুলে গিয়ে ওসমান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। রঞ্জ বলে, ‘ছোটপা, তুমি থাকো। আমি তোমার বইখাতা নিয়া আসি।
আমার বই খুঁজতে গিয়া আমার সব বইপত্র তুই ওলটপালট কবি। আমি যাই।’ ওসমান বলে, রানু, তুমি বই খাতা আনোনি কেন? রানু, কথাটা বলতে ওসমানের জিভ শিরশির করে, এই শব্দটি বলতে তার স্বেদবিন্দু পানের পিপাসা শতগুণে বেড়ে গেলো। নামটির উচ্চারণে তার ঠোঁট ও জিভ ছাড়িয়ে সেই পিপাসা যেন দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। ওসমান তখন তক্তপোষের সামনে টেবিলে টেনে এনে টেবিলের এপারে ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে। রঞ্জ ও রানু এখন ওর মুখোমুখি। পিপাসা নিভিয়ে দেওয়ার কিছুমাত্র ইচ্ছা ওর নাই, চোখ জোড়া দিয়ে যতোটা পারা যায় রানুর ঘামের বিন্দু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পিপাসার তীব্রতা ক্রমে বাড়ে, তা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ওসমান হুকুম দেয়, রানু এখন আবার নিচে যাবে কেন? রঞ্জ যাও, ওর অঙ্ক বই খাতা নিয়ে এসো।
রানু বলে, দাখ, বইপত্র ওলটপালট করিস না। জবাব না দিয়ে লাফাতে লাফাতে রঞ্জ নিচে নামে। ওসমানের মুখোমুখি একা বসে রয়েছে রানু। ওসমান কি এখনই অঙ্কের কথা বলবে? নাকি আগে রানুর নাকের ডগা ও তার নিচেকার ঘামের ফোটা শুষে নেওয়ার পিপাসার কথা জানাবে? কথাটা শুরু করে কিভাবে? সে এই নিয়ে একটু প্রবলেমে পড়ে। রানু বলে, অনেক রাত্রে ফিরছেন, না?
হ্যাঁ, তুমি জানলে কি করে? সিঁড়ি দিয়া আপনার ওঠার আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙছে। রানুর সেকেন্ড ব্র্যাকেট মার্কা ঠোঁটজোড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে-আসা এই সব শব্দ তার নকের ডগা ও তার নিচেকার বিন্দু বিন্দুলিকার পানের জন্য ওসমানের পিপাসায় ইন্ধন জোগায়।
আপনে এতো রাত্রে আসেন, ভয় লাগে না? ভয় কিসের? ওসমান বলে বটে, কিন্তু তার তীব্র স্বেদতৃষ্ণা তার ধ্বনিপ্রবাহের স্বাচ্ছদ্য নষ্ট করে, বাক্য কাপে। রানু কিন্তু অনায়াসে বলে, রাস্তাঘাটে আজকাল কতোরকম গোলামাল। কোনদিন কি হইতে পারে আপনে জানেন?
কোনো উদ্বেগ বা ভয় বা আবেগে নয়, রানুর গলার স্বর হয়তো সর্দিতে একটু ভারি। ওসমানের সবগুলো আঙুল সেই ভারিস্বরে একটু একটু কাপে। সে নিজের হাত মুঠি করে, ফের খোলে। এতে আঙুলের ব্যায়াম হয়, কিন্তু কাপুনি থামে না। আঙুল বেয়ে এই কাপুনি শেষ পর্যন্ত শালার মাথায় চড়ে না বসে। এটার প্রতিবিধান খুব জরুরি। সে করে কি তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা এগিয়ে রানুর নাকের ডগায় ছুয়ে আস্তে আস্তে ঘামের বিন্দুগুলো মুছে ফেলে, তারপর ব্লটিং পেপার চেপে রাখার ভঙ্গিতে তর্জনীটাও আস্তে করে ঠেসে ধরে রানুর নাকের নিচেকার ছোটো ভাজের ওপর। রঞ্জুর ভাঁজটাও অবিকল এই রকম। ওসমানের নিজের নাকের নিচেও এরকম নিশ্চয়ই একটা ভাঁজ আছে। তার মতো গোঁফের আগাছা উঠে রঞ্জুর ভাঁজটাজগুলো আড়ালে পড়ে যাবে, রানুরটা এমনি স্থির ঢেউ হয়ে সারাজীবন সকালে বিকালে একটি দুটি করে ঘামের বিন্দু ফুটিয়ে তুলবে।
হাত সরিয়ে নিতে নিতে ওসমান বলে, রাত্রিবেলা ভয় পেয়ে আজ বিকালবেলা পর্যন্ত ঘামছো, না?
১টি পলকের জন্য রানু তার চোখজোড়া যতোটা পারে ফাক করে ওসমানকে দ্যাখে, তারপর মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে বসে। এভাবে বসেই তার কালো ও সরু আঙুল দিয়ে সে তার নাক ও নাকের নিচে, এমনকি ঠোঁট ও চিবুক পর্যন্ত ভালো করে মোছে। ওসমানের ছোঁয়ায় কি তার সুড়সুড়ি লাগছিলো?
ওসমান হঠাৎ কথা বলতে শুরু করে। খুব সিরিয়াস গোছের কথা। যেমন, ঐকিক নিয়মটা রানুর ভালো করে রপ্ত করা দরকার। যেমন, ঐকিক নিয়ম একবার রপ্ত করতে পারলে এই সব অঙ্ক একেবারে জলবৎ। যেমন, অঙ্কে ভালো করতে না পারলে পরীক্ষায় কেউ ভালো ফল করতে পারে না। যেমন, অঙ্কে নম্বর ওঠে সলিড এবং নম্বর মানে ভালো নম্বর। অঙ্কে বেশি না, সত্তর পচাত্তর তুলতে পারলে রানু এমন কি ফাস্ট ডিভিশনও পেতে পারে। ফাস্ট ডিভিশন পাওয়া এমন কিছু নয়।
রানুর বই খাতা নিয়ে রঞ্জু এসে পড়ে, বলে, ছোটাপা, তুমি পড়ো, আমারে বাইরে যাইতে হইবো।
‘এখন আবার বাইরে কি রে? বিকাল হইতে না হইতে খেলা? ওর ঘামের বিন্দু নিশ্চিহ্ন হবার পর এটাই রানুর প্রথম কথা। রানুর কণ্ঠ থেকে ভিজে ভিজে ধ্বনিও কি কেউ শুষে নিলো? রানু যদি এই কাঠকাঠ গলায় হঠাৎ বলে, রঙ্গু, তুই যাবি তো আমি কি এখানে একলা থাকবো? কিংবা রানু যদি তার পুত্ৰশোককাতর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আম্মা, আমারে তোমরা পড়াইতে পাঠাও কার কাছে? সে আমার শরীরে হাত দিতে চায়! কিংবা ওসমানের চোখে চোখ রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘খালি লেখাপড়াই শিখছেন, বাপমা ভদ্রতা শেখায় নাই? ভদ্রলোকের মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন না। কথাটা মনে রাখবেন!’ —তাহলে কি হবে?—এরকম কিছু হলে তার প্রতিক্রিয়া কি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে না পেরে ওসমান গনি চোখে মুখে এক ধরনের বেপরোয়া ভঙ্গি তৈরি করে এবং বুক চিতিয়ে বসে ওদের কথাবার্তা শোনে।
রঞ্জু বলে, ‘জী না! এখন আবার খেলতে যাবো নাকি? আম্মা বলছে দোকানে যাইতে আদা আর তেল আনতে বলছে।
রঙ্গু চলে যায়। রানুও চলে যাওয়ার সম্ভাবনায় ওসমান প্রস্তুত হয়ে থাকে। এই দৃশ্য দ্যাখা থেকে রেহাই পাবার জন্যে সিগ্রেট ধরালে ভালো হয়। কিন্তু কিংস্টকের প্যাকেট খুঁজে পাওয়া যায় না। লাভের মধ্যে খোঁজবার কাজটি জুটে গেলো। সিগ্রেট খুঁজতে খুঁজতে রানুর ক্রুদ্ধ অন্তর্ধান ঘটলেও বরং বাচোয়া।
শেষ পর্যন্ত সিগ্রেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে ওসমান যখন ওর দিকে তাকালে রানু তখন নিবিষ্টচিত্তে পাটিগণিতের পাতা ওল্টাচ্ছে। একটু অন্যদিকে তাকিয়ে ওসমান বলে, ’দেখি।’ কয়েক মিনিটের মধ্যে ওসমান ঐকিক নিয়মের মধ্যে দারুণভাবে ডুবে গেলো। রানুকে কতোভাবে বোঝাবার চেষ্টাই সে যে করে। নিয়ম সম্বন্ধে অনেকক্ষণ ধরে বলে ১টার পর ১টা অঙ্ক কষে দ্যাখায়। ওসমান ১টি পলকও থামে না। ১টি অঙ্কের উত্তর লিখতে না লিখতে আরেকটিতে হাত দেয় এবং রানু বুঝলো কি বুঝলো না জিগ্যেস করার অবসর পর্যন্ত তার হয় না। রানুই শেষ পর্যন্ত বলে , দ্যান। বুঝলাম তো, দ্যান’
রানুর এই অতিরিক্ত সপ্রতিভ ভঙ্গির সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণে খুব ছোট্রো ১টি হাসির বাঁকা আভাস সম্পূর্ণ খাপ খেয়ে গেছে। সেই আভাস অবিচলিত রেখে রানু বলে, আমারে অতো বুঝাইতে লাগে না। দ্যান!
হ্যাঁ হ্যাঁ। সে তো বটেই। ওসমান এমনভাবে বলে যেন এতোক্ষণ ধরে অঙ্ক বোঝানোটা তার অপরাধ হয়ে গেছে।
রানু অঙ্ক কষে আর ক্র একটুখানি তুলে ওসমানের দিকে দ্যাখে। ওসমানও আড়চোখে তাকায় বটে, তবে তার মনোযোগের ১০০ ভাগই রানুর অঙ্কের দিকে। রানু ১টার পর ১টা অঙ্ক ভুল করে যাচ্ছে। এতো ভুল দেখেও ওসমান বিরক্ত হয় না বা হতাশ হয় না। তার আফসোস এই যে, তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য আঙুল থেকে কায়দা করে ২টোকে সে আলাদা করে রেখেছিলো। কিন্তু অঙ্ক কষার জন্যে কলম ধরার ফলে ২টো আঙুল থেকে সমস্ত শিশিরবিন্দু কি একেবারে উৰে গেলো? আড়চোখে একবার দাখা গেলো যে রানুর নকের ডগায় কি তার নিচে ছোট্রো ভাজের ওপর ঘামের ফোটার আর চিহ্নমাত্র নাই। এদিকে রানুর ভুল অঙ্ক কষারও বিরাম নাই। রঙ্কুটার একটু বোকামির জন্য-কি দরকার ছিলো তার নিচে যাওয়ার-মেয়েটার নাকের ডগা খটখটে খা খা হয়ে গেলো। ঐ শ্যামবর্ণের মুখে আর রইলোটা কি? একটু আগে ওসমানের ছিলো ভয়, রানুর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার ভয়। সেটা বরং ভালো, এখন ক্লান্ত ও ভোতা ধরনের অনুভূতি সমস্ত শরীর জুড়ে দাপট মারে। কিছুক্ষণের মধ্যে এই অনুভূতির কারণ বা উৎস সে ভুলে যায়, ফলে অকারণ হতাশা চেপে বসে আরো জোরেসোরে। তার বুক থেকে ছড়াতে ছড়াতে ওপরের দিকে মাথার শীর্ষভাগ এবং নিচে পেটের ডানদিক পর্যন্ত তার ডালপালা পৌঁছে যায়। পেটের চিনচিনে ব্যথা ফের জেগে ওঠে। ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়ে এবং ১টা পর্যায়ে এসে আর বাড়ে না, সেখানেই থেকে যায়। তবে এতে লাভ হয় বৈকি! একটু আগেকার ভয় বা ভোতা অবসাদ-সবই এই ব্যথায় একদেহে হয় লীন এবং তাদের আলাদা করে টের পেতে হয় না। এই ব্যথাটা ডাক্তারদের বুঝিয়ে বলাও মুশকিল। এর নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নাই। বুকের মাঝখানটা এই ছটফট করলো, ভালো করে বোঝাবার আগেই সরে পড়লো নিচের দিকে, বুক ও পেটের মাঝখানকার কোনো ফাঁকে-ফোকরে। সেখানে ভালো করে জানান দিতে না দিতেই একটুখানি ঢেউ খেলিয়ে নেমে গেলো আরো নিচে পেটের নিভৃত কোনো কোণে। আসন পেতে বসে শালার ব্যথা সেখানে জিরিয়ে নেয়, একটু মনোযোগ দিলে ওসমান নিজের এ্যাঁবডোমেনের দেওয়ালে তার ঝিমুনি টের পায়। মাথা নিচু করে অন্ধ করতে থাকা রানুর চিবুক মাঝে মাঝে আলাদা করে দাখা যাচ্ছে। একবার মনে হলো রঙু বোধহয় একমনে ট্রানস্লেশন করে যাচ্ছে। একটু পর এই চিবুকের খানিকটা নিচে একটু বাঁদিকে দাখা যাবে তার শার্টের পকেটে আঁকা রয়েছে খয়েরি সুতার প্যাগোড়া। সঙ্গে সঙ্গে এ্যাঁবডোমেনের ব্যথা আরো নিচে নামে, শিরশির করতে করতে রক্তস্রোতকে ওভারটেক করে পৌঁছে যায় তার উরু জোড়ার মাঝখানে, রঞ্জকে ভালো করে দ্যাখার জন্য ওসমান সামনে তাকায়। কোথায় রঞ্জু? রঞ্জু তো এখন গেছে দোকানে, আদা, রওন, তেল কেনার নাম করে রাস্তায় দুটো তিনটে চক্কর না দিয়ে সে কি আর ফিরবে?
রানু মুখ তুলে বলে, দ্যাখেন, কতোগুলি করলাম। আরো করি?
করো। ওসমানের পেটের ব্যথা ফিরে আসে যথাস্থানে। অফিসে কামালের কাছ থেকে এই ব্যথাটা সম্বন্ধে জেনে নেওয়া দরকার। প্রেমের মতো রোগেও ওর খুব আগ্রহ। এর আগে ক্যান্সার ছিলো কামালের ফেভারিট। কিন্তু বছর দেড়েক আগে ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর কামাল ক্যান্সার-চর্চায় ক্ষান্ত দিয়েছে। আজকাল ওর প্রিয় প্রসঙ্গ হলো প্রেমিকা এবং ডিউওডিনাল আলসার। তার নিজের হাঁপানি, কিন্তু হাঁপানি সম্বন্ধে সে কখনো কিছু বলে না। আবার ডিউওডিনাল আলসারের ব্যাপারে এতো উৎসাহ যে, কথাটার উচ্চারণ ব্যাপারেও কামাল খুব শুচিবায়ুগ্ৰস্ত, কখনো ডিউভীনাল বা ডুইডিনাল বলবে না। ওসমানের পেটের এই অনিয়মিত ব্যাথা, তার এ্যাঁসিডিটি কি শেষ পর্যন্ত ঐ রোগ বলে সনাক্ত হবে? নামটা গালভরা, কিন্তু কামালের মুখে এই রোগের বর্ণনা শুনে শুনে এর ওপর ওসমানের অরুচি ধরে গেছে। পেটের ছোটো অন্ত্র ফুলে গিয়ে নাকি ফুটো হয়ে এমন ব্যথা শুরু হয়ে যে রোগী ব্যথা ছাড়া শরীরকে আর কোনোভাবেই অনুভব করতে পারে না। আচ্ছা, দীপচাদের কি এই রোগই হয়েছিলো? হঠাৎ করে গতরাত্রিতে দাখা স্বপ্লের মধ্যে পানিটোলার চাপা গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ওসমানের বুকে খচ করে ওঠে, স্বপ্নের ভেতর সঙ্গেকার লোকটিকে তখন চিনতে পারেনি, এক্ষুনি চিনলো, আরে সে তো দীপচাদ! মরার এতোদিন পর দীপচাদ মুচি স্বপ্লের মধ্যে এসে ওসমানকে নিয়ে কোথায় যাত্রা করেছিলো?
দীপচাদ মরেছে সে কি আজকের কথা? অন্ত্রের ব্যাথায় নিংড়ে যেতে যেতে দীপচাদ প্রথমে স্টেশনের পাশে তার বসবার জায়গাটা ছাড়লো, কাজকাম সব বন্ধ হলো, কিছুদিন পর মেল ট্রেন পাস করার সময় হলে নিজেই কষ্ট করে গিয়ে শুয়ে রইলো রেল লাইনের ওপর। বর্ধমান মেল বেগুনবাড়ি স্টেশন ক্রস করে রাত ৩টের দিকে, সকালে খবর পেয়ে ওসমানের বাবা ছেলের হাত ধরে চললো রেল লাইনের দিকে। বাপ বেটাকে একসঙ্গে যেতে দেখে পেছন থেকে ডাকে ওসমানের মা, আবার রঞ্জকে সাথে নিচ্ছে দ্যাখো।’
কেন? যাক না ‘ রাত পোয়াতি না পোয়াতি দুধের ছেলেটাকে মুচির মড়া দাখাতি নে যাচ্ছে? মুচি হয়েছে তো হলোটা কি? গোলমালের সময় লাইনের ওপারে সব শয়তানি আয়োজনের খবর দিতো কে? এই দীপচাঁদ মুচির মুখে খবর না এলে আমরা সাবধান হতি পারতাম?
আহা! সে কি না করিছি? রাতে ঘুম ভাঙলি পর যে ছেলে ভয়ে ঠকঠক করি কাপে সাত সকালে তাকে তুমি নে যাও রেলে-কাটা মড়া দাখাতি?
পুরুষ মানুষের অতো ভয় পেতি হবে না। ইব্রাহিম শেখের কাছে বেটাছেলে মাত্রেই পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষের ভয় পাওয়া, লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখা, মাথায় বড়ো চুল রাখা–এসব তার অসহ্য। তা লোকটার নামডাকও ছিলো গোয়াতুমির জন্যেই। লাইনের ওপারে বেগুনবাড়ি গ্রামের বোসদের খুব দাপট, এই বোসরা তাজহাট, রাবড়া—এই গ্রামগুলোতে কয়েকবার খোঁচা দিলেও গোয়ালঘূর্ণিতে হামলা করার সাহস পায়নি। গোয়ালঘূর্ণির কয়েক ঘর মুচি কি এর আশেপাশের জেলেদের পটাবার চেষ্টা করেও বাবুরা সুবিধা করতে পারলো না। শেখেরা কি কম দাপটে ছিলো? দেশভাগের পরেও ২ বছর ১৪ই আগস্ট এলে পাকিস্তানের নিশান ওড়াবার জন্য ইব্রাহিম শেখের হাত নিসপিস করতো। গ্রামের ছেলেছোকরাদের প্রথম প্রথম কী উৎসাহ ইব্রাহিম ভাই, ঝাণ্ডা ওড়ান দিনি, বেগুনবাড়ির মালাউনরা কিছু করতি আসে তো বাছাধনদের রেললাইন পার হয়ে আর বাড়ি ফিরি যেতি হবে না।
পরে সে উৎসাহ আর ছিলো না। গ্রামের খন্দকারদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে ইব্রাহিম শেখ সপরিবারে গেলো ঢাকায়, এসে বছর তিনেক যেতে না যেতেই পাকিস্তান বা পাকিস্তানের পতাকা কোনো ব্যাপারেই তার একটুও আগ্রহ রইলো না, ফের গ্রামেই ফিরে গেলো। শুরু হলো উঠতে বসতে নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমিনকে মোনাফেক আর বেঈমান বলে গাল দেওয়া।
তো ওসমানের হাত ধরে নিয়ে চললো ইব্রাহিম। বাইরে উঠান পেরিয়ে বড়ো তরফের বাধানো ঘটওয়ালা পুকুর। ঘাটের ইটগুলো তখন বড়োমিয়ার দাঁতের মতো খসে খসে পড়ছে। পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে ২০০/২৫০ গজ গেলে বুড়োবটতলা। এই বটতলা ছিলো ওসমানের খেলার জায়গা। এখান থেকে বাকনিলে ছিপছিপে ১টা পথ, সেই পথে খানিকটা গেলে ইটখোলা বিলের শুরু। বিলের পারে দীপচাদের মাটির ঘর। ঘরের আশেপাশে কি বিলের ধারে মুখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে চরে বেড়ায় দীপচাঁদের এক পাল শুওর। দীপচাদের বৌ মুনিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে বাঁশের ধামা বোনে আর দুর্বোধ্য ভাষায় স্বামীকে কি দেবতাদের কি নিজের অদৃষ্টকে যা তা বকাকি করে। কখনো কখনো মুনিয়া বিলের পানিতে বাসন মাজে, গা ধোয়। বর্ষাকালে পদ্মফুলে বুক উঁচু করে ইটখোলার বিল আকাশের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য অনেকটা ওপরে উঠে আসে। তখন মেজাজ ভালো থাকলে মুনিয়া পদ্মবীজ খেতে দেবে বলে ওসমানকে বটতলা থেকে ডেকে আনে। সেদিন দীপচাদের শুওরগুলো আপন মনে মাটি খুঁড়ছিলো, বাড়ির ভেতর থেকে আসছিলো মুনিয়ার একটানা কান্নার শব্দ।
ইব্রাহিমের ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে আসে সুখনলাল। এ লোকটিকেও ওসমান চেনে, স্টেশনের জায়গা থেকে দীপচাঁদ সরে আসার পর ওখানে বসে জুতো সেলাই করে। দীপচাদ অসুখে পড়বর পর থেকে সুখনলাল ও মুনিয়াকে নিয়ে নানারকম মুখরোচক কথা চলে আসছে। সুখনলালকে দেখে ওসমানের তৎকালীন কচি হাড়গুলো সিটকে এসেছিলো; দীপচাঁদের রেলেকাটা মুণ্ডু যদি তার সঙ্গে গড়িয়ে বাইরে চলে আসে!—কিন্তু না, সুখনলাল জানায় শবদেহ এখনো রেললাইনের ধারে; দারোগাবাবুর হুকুম, পুলিসের লোক না পৌছা পর্যন্ত সরানো চলবে না। আশেপাশের গ্রামে জাতভাইদের খবর দেওয়া হয়েছে, তারা এসে লাশ ঘিরে বসে রয়েছে। দীপচাদের এক ভাগ্নে বুলবুলিয়া আজ সকালে পাইটখানেক পচানি টেনে সুখনলালের গায়ে অকারণে হাত তুলেছে, আর মুখ খারাপ যা করেছে মিয়াদের সামনে উচ্চারণ করলেও সুখনলালের পাপ হবে। মিয়াদের গ্রামে, মিয়াদের জমিতেই তো বুলবুলিয়ার বাস, সুখনলালও মিয়াদের জমিতেই জীবন কাটালো, ইব্রাহিম শেখ কি এর কোনো বিহিত করবে না?
ওদিকে দীপচাদের ঘরের ভিতর কয়েক মিনিট বিরতির পর মুনিয়া ফের কাঁদেতে শুরু করে। ইব্রাহিম শেখ ওসমানকে বলে, ‘তুই বাড়ি যা রঞ্জু। ওসমান তবু তার সঙ্গে হাঁটলে ইব্রাহিম ধমক দেয়, বললাম না, বাড়ি যা!
‘না আমি যাবো তোমার সঙ্গে। ওসমান জেদ ধরে, আমাকে মরামানুষ দ্যাখাতি হবে।’ আবার কথা বলে!’ ইব্রাহিম ধমক দেওয়ার পর লোভ দ্যাখায়, যা। আমি ফেরার সময় স্টেশনের বাজার থেকে সন্দেশ আনবো’খন। যা!’
‘না আমি সন্দেশ খাবো না। রেলে-কাটা মানুষ দেখবো! আমি কোনোদিন দেখিনি, আজ দেখবো, এ্যাঁ! ইব্রাহিম শেখ কিন্তু চটে ওঠেনি, বরং আরো নরম হয়ে বলে,তুই যা বাবা! কাল তাজহাট থেকে টিয়া এনে দেবো, কেমন? এখন যা!
ট্রেনের তলায় আত্মহত্যাকারী দীপচাদকে দ্যাখানো থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহিম শেখ শেষ পর্যন্ত ওসমানের অনেক দিনের আবদার পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। জ্যান্ত পাখি পাবার আশায় ওসমানের রেলে-কাটা মড়া দ্যাখার লোভ ছাড়তে হয়। আজ দ্যাখা, এতোদিন পর দীপচাদ নিজেই তার স্বপ্লের মধ্যে এসে হাজির হলো। সেদিন তাকে কেমন দ্যাখাচ্ছিলো?-লুঙি গিরের ওপর তোলা, গায়ে টুইলের হাফহাতা শার্ট, হাতে জুলছে কাচি সিগ্রেট—ইব্রাহিম শেখ দীর্ঘ পা ফেলে চলে যায় রেললাইনের দিকে; রোগা প্যাকাটি সুখনলাল যাচ্ছে পেছন পেছন, নালিশ করে, মাঝে মাঝ থুথু ফেলে, ফের নালিশ করে। কিছু দূর যাবার পর হাবু মল্লিকের ডাঙা-জমির বাবলা ঝোপের আড়ালে চলে গেলে ওদের আর দ্যাখা যায় না। আর এদিকে বিলের তীরে দাঁড়িয়ে ওসমান তার সর্বাঙ্গে শোনে মুনিয়ার একটানা কান্নার ধ্বনি। এই জায়গাটায় মুনিয়া বাসন মাজে আর গোসল করে বলে এখানে কোনো পদ্মফুল নাই। পানিতে ওসমানের ছায়া পড়ে, পানির পাতলা ঢেউতে তার সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ঠোঁটজোড়া বারবার স্থানচু্যত হয়, শার্টের বুকপকেটে এস্ত্রয়ডারি-করা প্যাগোড়া পানির অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে। দীপচাদের বাড়ির পেছনের আউশের খেত থেকে কালচে হলুদ রঙের গন্ধ এসে দীপচাদের বৌয়ের কান্নার সঙ্গে মিশে ধ্বনি, গন্ধ ও রঙের বিন্যাস নষ্ট করে দেয়। বিলের পানিতে শ্রীমান রঞ্জু তখন ওসমানের মুখোমুখি শুয়ে একটু ভয়ে ও একটু কামনায় কাপে। ওসমান নয়ন ভরে পানির সেই রঞ্জকে দেখছে, রঞ্জু পানি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে তার সামনে, সে খেয়াল করেনি।
হঠাৎ রঞ্জুর কথা শুনে সে মাথা উঁচু করে তাকালো। আপনার ঘুম পাইতাছে। আপনি ঘুমান, আমি যাই।’ না, রঞ্জু নয়, কথা বলছে রানু ওসমান বিব্রত হয়, হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে কেন, বুঝতে পাচ্ছি না।
রাত্রে ঘুমাইবেন না কতো রাত্রে বাসায় ফেরেন, ঠিকমতো ঘুমান না কেন? এই অতি অল্প সময়ের তন্দ্রা কেটে যাওয়ায় ওসমানের চোখের ভেতরটা করকর করে, ভ্রজোড়া থেকে শুরু করে গোটা কপাল পর্যন্ত মাথার অর্ধেকটা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। তোষকের নিচে থেকে ২টো নোভালজিন ট্যাবলেট মুখে দিয়ে সে পানি খায়।
টেবিলের ওপরকার শূন্যতায় রানুর খোলা চুলের হান্ধা গন্ধ। ওসমান এখন সোজা হয়ে বসেছে, ২টো নোভালজিনে তার কাজ হচ্ছে, মাথা ব্যথা আস্তে আস্তে সেরে যাচ্ছে। ওসমান বলে, কৈ তোমার খাতাটা দেখি!
আজ থাক! আপনার শরীর বোধ হয় খারাপ। ওষুধ খাইবেন!’ না। একটু মাথা ব্যথা করছিলো, পাঁচ মিনিটে সেরে যাবে।’ নাঃ! ঐকিক নিয়ম রানুর মাথায় একেবারে ঢোকেনি। বছর ধরে পড়লেও ওর খুলি ভেদ করা অসম্ভব। আনোয়ারের সঙ্গে বরং ওদের গ্রামে গেলে হতো। গ্রামে গ্রামে মানুষ সংঘবদ্ধ হচ্ছে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রুখে দাঁড়াচ্ছে। এই সব দ্যাখা ছেড়ে সে কি-না পড়ে রইলো এই রান্ট মেয়েটাকে অঙ্ক কষাবার মতলবে? ওসমানের পেটের ব্যথাটা চিনচিন চিনচিন করে ওঠে। নাঃ খেলেই হতো এ্যাঁসিড হচ্ছে, রাত্রে ঘুম হলো না, এর ওপর এ্যাঁনালজেসিক ট্যাবলেট না খেলেই হতো। রানুর অঙ্কের ভুল শোধরাতে পেট ও বুক জুড়ে টক-তেতো স্রোতের উজান-ভাটা শুরু হলো। এখন একটু শুতে পারলে ভালো হয়। ওসমানকে বলতেই হলো, ‘আজ বরং থাক। কাল এসো, কেমন?
রানু জিগ্যেস করে, খুব খারাপ লাগতাছে, না? গলার কাছে টক-তেতো স্রোতের একটা দমক সামলাতে সামলাতে হাসে, না হঠাৎ খুব ঘুম পাচ্ছে। নাইনটিন সিক্সটি নাইনের গোড়াতেই দিবানিদ্রা, বছরটা মনে হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটবে।
রানু কিন্তু একটুও না হেসে উঠে দাঁড়ায়। ওসমান দাঁড়িয়েছে তার গা ঘেঁষে। রানুর শ্যামবর্ণ নাকের শীর্ষে ঘামের অনেকগুলো টাটকা বিন্দু জমেছে, তার নাকের নিচে ঠোঁটের ওপরকার ছোটো নিখুঁত ঢেউতে বড়ো বড়ো ঘামের ফোটা টলটল করে। ওসমান ইচ্ছা করলে একটু ঝুঁকে রানুর নাকের ডগায় এবং তার নিচে মুখ লাগিয়ে এক চুমুকে সমস্ত স্বেদবিন্দু টেনে নিতে পারে। তার বদলে সে তার নিজের হাতের তর্জনী চোষে। রানু একটু অবাক হয়ে তাকালে ওসমান পানি-ওঠা মুখে তরল স্বরে বলে, কাল এসো, কেমন? এই সময় এসো, কেমন?
বইপত্র নিয়ে রানু সিঁড়িতে নামবার সঙ্গে সঙ্গে ওসমান দরজা বন্ধ করে দেয়। ডান হাতের তর্জনী তার মুখেই রয়ে গেছে। কোনো নোনতা স্বাদ না পেয়ে সে তর্জনীটা আরো ভালো করে চোষে। টক-তেতো স্বাদের তর্জনী চুষতে চুষতে অন্য দরজা দিয়ে ওসমান বেরিয়ে যায় ছাদে। ছাদের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে ওসমান একটু উপুড় হতে না হতে তার হড়হড় করে বমি হয়ে গেলো।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৩

ইউনিভারসিটির যে ছেলেটি আজ পুলিসের গুলিতে মারা গেছে খিজির তাকে দ্যাখেনি। পুলিসের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ার তাগিদে যদি মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে না পড়ে তাহলে ঐ সময়টা সে থাকে ঢাকা হল আর পিজির মাঝামাঝি। ছেলেটা গুলিবিদ্ধ হয় ওখানেই। ধরো, খিজির আলি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে না চুকে মিছিলের সঙ্গে যদি থাকতো, তাহলে? পুলিসের লরি ছিলো পিজির পাশে রশিদ বিল্ডিঙের সামনে। গুলি করা হয়েছে ওখান থেকেই। ধরো, খিজির ওর পাশেই আছে, শ্লোগান দিতে দিতে চলেছে, এমন সময় গুলি এসে ওর হাত ঘেঁষে ঢুকলো ওর পাশের ছেলেটির বুকে। এমন তো হতে পারতো যে, গুলিবিদ্ধ ছেলেটি ওর গায়েই ঢলে পড়লো। লোকজন সবাই দৌড়াচ্ছে, সেও দৌড়াচ্ছে, গুলিবিদ্ধ তরুণের মৃতদেহ কোলো নিয়ে দৌড়াতে তার একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। –তাহলে? এই সব ভাবতে ভাবতে কাচা গুয়ের গন্ধ নাকে ঝাপ্টা মারলে বোঝা যায় যে, তাদের বস্তি এসে গেছে। —কিন্তু তার হাউস কি কেউ দমিয়ে রাখতে পারে-আচ্ছা তার গায়েও তো এই গুলি লাগতে পারতো! পুলিসের বুলেট কি শিক্ষিত অশিক্ষিতে, ধনী গরীবে, ছাত্র মজুরে ভেদ করে?–নাঃ! বুকে গুলি লাগানো ঠিক হবে না। কয়েকটাকে সাফ না করে এখন মরাটা ঠিক নয়। ঠিক আছে, ধরে বা পায়ে গুলি লাগলে এমন কিছু অসুবিধা হয় না। অনেকদিন রিকশা চালিয়ে পা ২টো তার লোহার পিলার। আবার এখন স্কুটার চালায়, রিকশা চালানো ছেড়ে দেওয়ায় পিলারজোড়ায় বাত ঢুকেছে, বৃষ্টি বাদলায় ভিজলে পা ২টো টনটন করে। ১টা গুলি লাগলে রক্ত বেরিয়ে বাতের ব্যথা চিরকালের মতো সারতো।
ঘরের বাপ তুলে ঢোকার পরও শ্লোগান, গুলিবর্ষণ ও টিয়ার গ্যাসের শব্দমুখর চান খার পুল ও নিমতলী এলাকা মাথার মধ্যে গমগম করে। মেঝেতে বসে গপ গপ করে ভাত খাওয়ার পর থালে হাত ধুচ্ছে, বিছানার ওপর থেকে জুম্মনের মা বলে, ব্যাকটি খাইলা?
‘তুই খাস নাই? জিগাইছিলা? জিন্দেগিতে জিগাইছো? আছে খালি নিজের প্যাটখান লইয়া। খালি হান্দাও আল্লা রে আল্লা, এই হাড্‌ডি কয়খানের মইদ্যে মনে লয় দুই তিনখান ঠিলা ছুপাইয়া রাখছে!’
বিছানার এদিকে বসতে বসতে খিজির বলে, তর মহাজনের প্যাটের মইদ্যে কলতাবাজারের পানির টাঙ্কি ফিট কইরা রাখছে। মাহাজনের প্যাট থাইকা দুই চার ঠিলা তুই লইয়া আইছস ?
বলতে বলতে খিজির বিছানার এক প্রান্তে শোয়, ডানদিকের বগল চুলকাতে চুলকাতে ভাবে, এই বাহু দিয়ে গুলিটা ঠেকাতে পারলে ইউনিভারসিটির ছেলেটা আজ মরে না। কিন্তু এখন ঝামেলা জুম্মনের মা, রাত্রে এর প্যাচাল পাড়া বন্ধ করে কে?
অক্কর্ম। ভ্যাদাইমা মরদ একখান! আউজকা গাড়ি লইয়া বারাইছিলা, গাড়ি চালাইছো? ঘরের খরচ চালাইবো তোমার বাপে?
এবার খিজিরের মেজাজ একেবারে খিচড়ে যায়, বলে আমার বাপে চালাবো ক্যালায়? তর মাহাজন বাপের লগে রাইত ভইরা ডাংগুলি খেলবার পারলি না? এখানে আইলি ক্যালায়? রাইত বাজে একটা আর খানকি মাগী অহন কলের গান একখান ছাড়লো।
এবার জুম্মনের মায়ের কলের গান চলে দারুণ স্পীডে, মাহাজন কার বাপ লাগে মহল্লার ব্যাকটি মানু জানে আমার মায়েরে মাহাজনে জিন্দেগিতে দেখছে? আমাগো বাপ থাকে একজন!
খিজির ভাবে মিছিলের জায়গাটা অমন করে ছেড়ে দৌড় দেওয়াটা ঠিক হয়নি। একটা চিলও তো সে পুলিসের গায়ে লাগাতে পারলো না।
গাড়ি লইয়া বারাও, রাস্তার মইদ্যে গাড়ি ছাইড়া দিয়া টাঙ্কি মারবার যাও, না? খিজির এবার অবাক হয়, এ বেটি জানলো কিভাবে? বলে, ‘তরে এইগুলি কইলো ক্যাঠায়? তর মহাজন বাপে, না? তর মহাজনের মাথার উপরে ঠাঠা পড়বো, বুজলি?
আস্তে কও, আস্তে কও। মাহাজনের ঘরে থাকো আবার তারে উল্টা-পাল্টা কথা কও, শরম করে না?
মাগনা থাকি? ভাড়া দেই না? কিন্তু জুম্মনের মা বারবার একই প্রসঙ্গে তোলে, সকালবেলা বেবি ট্যাকসি নিয়ে সে বেরুলো, আর মানুষের পাগলামি দ্যাখার জন্যে গাড়ি ছেড়ে দিলো মাঝপথে? এসবের মানে কি? মহাজন না হয় লোক খারাপ। তাই সই। কিন্তু আলাউদ্দিন মিয়া খিজিরের এই বান্দর নাচ দ্যাখার পাগলামি সহ্য করবে কদিন?
খিজির ফের জিগ্যেস করে, আমি জিগাই, তবে এই চাপাগুলি ছাড়ছে ক্যাঠায়? বলার লোকের কি অভাব? আজ বিকালবেলা আলাউদ্দিন মিয়া নিজেই গিয়েছিলো রহমতউল্লার বাড়ি। গিয়েই বলে, মামু, ইউনিভারসিটির ইস্টুডেন মরছে, পুলিসে গুলি চালাইছিলো। ইট্‌ হুঁশিয়ার হইয়া থাইকেন পাবলিকে আইয়ুব খানের উপরে যা চেতছে না! মোনেম খানের মাতম আরম্ভ হইয়া গেছে!’
তোমরা আইয়ুব খানের বালটা ছিড়বা’ রহমতউল্লা রাগ করে, আর কয়টার লাশ ফালায়া দিলেই এই হাউকাউ বন হইয়া যাইবো।
আলাউদ্দিন কিন্তু রাগ করে না, স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে, মনে হয় না। ইউনিভারসিটি ছাত্ৰ মইরা নূরুল আমিন খতম হইয়া গেছে না? আপনে এটু হুঁশিয়ার থাইকেন। আমলিগোলার মুসলিম লীগ অফিস ভাইঙ্গা দিছে।’
রহমতউল্লা মেয়েকে হাক দিয়ে চা দিতে বলে, মেয়ে গেছে পাশের বাড়িতে বেড়াতে। চা নিয়ে আসে জুম্মনের মা। টেবিলে বাকেরখানি, পনির ও চা রেখে সে চলে যাচ্ছিলো, আলাউদ্দিন বলে, খিজিরে এইগুলি কি করে? বেবি ট্যাকসি লইয়া বারাইয়া রাস্তার মইদ্যে গাড়ি দিয়া গেছে আরেকজনেরে। গাড়ি লইয়া ঐ হালায় যুদি পলাইতো!
মহাজন একটু রাগ ও একটু অভিমানে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, তোমরা তো আমার ইজ্জত রাখবা না! তুমি অরে খেদাইয়া দিলে পরের দিনই আমি খানকির বাচ্চাটারে লাথি দিয়া বাইর কইরা দেই! আমার জুম্মনের মায়েরে আবার বিয়া দিমু কামরুদিনের লগে।
‘কামরুদিন? উই বিয়া করবো? ‘পসা দিলে করবো না? দোলাই খালের রাস্তা করতাছি, মিস্ত্রী আমার কম লাগে? মহাজন খিজিরের নামে কতো অভিযোগ করে। তারই খেয়ে মানুষ হলো, আর সে কি-না ভিক্টোরিয়া পার্কে তারই গিবত করে! মিয়া, বোঝো তো, দিন খারাপ। নইলে এইগুলি কীড়া উড়ারে পায়ের একখান উঙলি দিয়া এক্কেরে মাটির মইদ্যে হান্দাইয়া দিবার পারি।
মামা ভাগ্লের কথা শুনতে শুনতে জুম্মনের মা বেশ ভয় পেয়েছে জুম্মনকে কি এজন্যেই মহাজন আজ পাঠিয়ে দিলো মালীবাগে কামরুদ্দিনকে খুঁজতে?
আজ সন্ধ্যাবেলা আলাউদ্দিন মিয়া খিজিরকে একটু বকেছে। যাকে তাকে এভাবে গাড়ি দেওয়া সে পছন্দ করে না। খিজিরের অবশ্য মনে হলো গাড়িটা সে নিজেই গ্যারেজে রেখে গেলে পারতো। দিনকাল ভালো না, গাড়ি নিয়ে কে কোথায় উধাও হয় তার ঠিক আছে? ১টি বেবি ট্যাকসি হারালে সায়েবের কতোগুলো টাকা নষ্ট নীলখেতে ইউনিভারসিটির সামনে ছেলেদের ভীড় দেখে সে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। নিউ মার্কেট থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাচ্ছিলো কমলাপুর স্টেশন, নীলখেতে ছেলেদের মিছিল দেখে তার ইচ্ছা করছিলো, এক্ষুনি এদের সঙ্গে ভীড়ে যায়। খুব শ্লোগান চলছে তখন, মিছিল যাচ্ছে ফুলার রোডের দিকে। পেছনে মেয়েদের হলের সামনে পুলিসের গাড়ি, রাস্তায় পুলিসের কাটাতারের ব্যারিকেন্ড। কমলাপুরে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলো গ্যারেজের দিক, গ্যারেজের আশেপাশে রঙ্গু, করিম, হোসেন-এরা সব ঘুরঘুর করছে, এদের কাউকে বেবি ট্যাকসি দিয়ে ৫টা টাকা নেবে, বিকালে এদের কাছ থেকে টাকা তুলে সায়েবকে দিলেই চলবে। সারাদিন গাড়ি চালালো কে আলাউদ্দিন কি আর তাই তদন্ত করতে যাবে? কিন্তু মতিঝিলে স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে দ্যাখে আদম আলি দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসের জন্যে। বেচারার গাল টাল বসে গিয়েছে, খোঁচা খোঁচা দাড়ির অর্ধেকের বেশি পাকা। বছর খানেক আগেও আলাউদিনের বেবি ট্যাকসি চালাতো, কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলো চাষ করতে করতে। মাঝখানে খিজির একদিন দ্যাখে মাথায় তরকারির ঝাকা নিয়ে আলু পটল কাচামরিচ শুটকি’ বলে চ্যাচাতে চাচাতে কে এম দাশ লেন ধরে হাঁটছে। আজ স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে আদম আলিকে ডেকে ওর পাশে বসিয়ে খিজির বলে, ‘গাড়ি চালাইবি?’ কৃতজ্ঞতায় হালার গেরাইম্যাটা কথা বলতে পারে না। গুলিস্তানের কাছে নেমে খিজির বলে, পাঁচটা টাকা দে, বাকি পসা দিবি রাইত আটটা বাজলে, গ্যারেজের সামনে থাকুম। আবার সায়েবরে কইস না!
ড্রাইভারের সিটে বসে আদম আলি লাইসেন্স চায়, পুলিস ধরলে আবার কিছু পয়সা খসবে!
পুলিসের মায়েরে বাপ! ব্যাকটি পুলিস অহন ইউনিভারসিটির মইদ্যে’
খিজির পুলিসকে গালি দেয় কিন্তু আদম আলির হাতে লাইসেন্স বা বুক দিতেও রাজি হয় না, কিয়ের লাইসেন্স, তুই যা গিয়া!
খানিকটা বাসে এবং বেশির ভাগ হেঁটে ও দৌড়ে খিজির মিছিল ধরলো শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনারে মিটিং চলছিলো বলে মিছিলটা ধরতে পারলো। মিছিলের সঙ্গে এগিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ গেটে এসেছে, দ্যাখে হাসপাতালের ভেতর থেকে ছেলেরা পুলিসের দিকে ঢ়িল ছুড়ছে। রেলিঙ টপকে খিজিরও ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। গুলি চলার সঙ্গে সঙ্গে খিজির মেডিক্যাল কলেজের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে পিজি হাসপাতালে। কিছুদিন আগেও এখানে ইউনিভারসিটি ছিলো। মহল্লার ২টো মেয়েকে রিকশায় নিয়ে খিজির এখানে নিয়মিত আসতো। লোকজন সব উল্টেদিকে দৌড়াচ্ছে, আর সে কিনা পাগলের মতো ছোটে পিজির গেটের দিকে। গেঠে পুলিসের মস্ত ৩টে লরি। ফের পেছনে গিয়ে বেলতলার ধারে পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে উঠে দাঁড়ালো রশিদ বিল্ডিঙের শেষ মাথায়। পুলিস ও ইপিআরের ট্রাক এখন চলে যাচ্ছে নাজিমুদিন রোডের দিকে। খিজিরের চারদিকে পলায়মান মানুষের প্রচণ্ড চাপ। গুলি, গুলি’, ‘মারা গেছে, না মরেনি, রিডিং হচ্ছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছে’-এই সব সংলাপের মধ্যে মানুষ এলোপাথাড়ি দৌড়ায়। টিবি ক্লিনিক থেকে এগিয়ে আসছে লাল গাড়িটা। এবার শুরু হলো কাদুনে গ্যাস ছোড়া। ঢাকা হলের ছাদ থেকে ইটপাটকেল ও বোতল এসে পড়ছে পুলিসের ওপর। পুলিস পিছে হটছে, তারা ঢুকে পড়ছে রেললাইনের ধারে বস্তিতে। মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে এসে পুলিস ও ইপিআরের লোকজন বস্তির ভেতর এলোপাথাড়ি মারধোর শুরু করলো। পুলিস ও ইপিআরের সম্মিলিত শক্তিতে বস্তি জুড়ে শুরু হলো তছনছ কাণ্ড। এই সব ইট-চাপা ও হার্ডবোর্ডের বাড়ি ভাঙার জন্য তাদের বুলডোজার ব্যবহার করতে হয় না।-রাইফেলের বঁটই যথেষ্ট। এক পাল হাতি যেন দৌড়ে চলে যাচ্ছে বস্তির ওপর দিয়ে। বাড়িঘর সব টপাটপ পড়ে যায়। এর ওপর মানুষের পিঠে, বুকে, পাছায় ও মাথায় রাইফেলের বাটের বাড়ি।
‘আল্লা গো, মা গো’, ‘বাবা আমরা গরিব মানুষ, কিছু জানি না’, ‘বাবা আপনে আমার ধর্মের বাপ!—নারী-পুরুষ-বালক-বালিকার আর্তনাদ ও কাকুতি-মিনতি, বস্তির মানুষের ছোটাছুটি, আবার ওদিক থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটার শব্দ। খিজির দৌড়াচ্ছে। তার কানে তখন শ্লোগান-পিপাসা। শ্লোগান শুনলেই বুঝবে যে, মানুষ পুলিসকে রুখে দাঁড়িয়েছে। রেল লাইনে লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়াচ্ছে, এমন সময় দ্যাখা গেলো জুম্মনকে, জুম্মন দৌড়াচ্ছিলো উল্টোদিকে। জুম্মনকে ডাকতে খিজির একটু দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘাড়ে পড়ে রাইফেলের বাটের বাড়ি। খিজিরকে ফের দৌড়াতে হয়। পুলিসের লোক ঘরে ঘরে ঢুকে ঘর ভেঙে দিচ্ছে, মাটির কলসি হাড়িকুড়ি ভাঙার আওয়াজ ক্রমে বেড়েই চলে। এরই মধ্যে সব অমূল্য রত্নসামগ্রী সরাবার জন্য কেউ কেউ ভাঙা ঘরে মাথা ঢুকিয়ে পাছায় ও পিঠে রাইফেলের বাটের গুতো খায়। জুম্মনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানে এতোক্ষণে মনে হলো, আরে জুম্মন তো বিছানায় নাই। খিজির জিগ্যেস করে, জুম্মনে কই?
আইবো না। জুম্মনের মা জবাব দেয়, অর বাপেরে মাহাজনে মানা কইরা দিছে।’ কি? মিস্ত্রীরে ডাইকা কইছে, পোলায় থাকবো বাপের কাছে। তোমারে আমি থাকবার জায়গা দিমু|
ক্যামনে? মাহাজনে তোমারে এহানে থাকবার দিবো না। কয় আমার বাড়ি থাইকা আমার লগে দুশমনি করবো! ঠিকই তো। মাহাজনে সইজ্য করবো ক্যালায়?’
সন্ধ্যাবেলা আজ জুম্মন ও জুম্মনের মায়ের সামনেই বাড়িওয়ালা কামরুদিনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, মিয়া নিজের বিবি পোলা লইয়া থাকে। ঐ নিমকহারামটারে আমি খাদাইয়া দেই! দোলাই খালের উপরে রাস্তার কাম চলে পুরাদমে, তোমার কামের অভাব হইবে না।’
কামরুদিন জবাব দেয়নি। জুম্মনের মা তখন পাকা উঠানের এক কোণে কলপাড়ে বাসন মাজছিলো আর তার দিকে বারবার দেখছিলো। –
বাড়িওয়ালার খুব রাগ, অর রোয়াবিটা দেখছোঁ? মিটিঙের মইদ্যে আমার নামে গিবত করে, বুঝলা? খানকির পয়দা-আর কি হইবো, কও? থাকতি কান্দুপটির মইদো, মায়ের ভাউরা হইয়া থাকতি বইনের ভাউরা হইয়া থাকতি মায়ের বইনের কাস্টমারের লাথি চটকানা খাইয়া দিন গুজরান করতি, ভালো হইতো না? আমি থাকবার জায়গা দিচ্ছি, খাওন দিয়া বড়ো করছি, খানকির পুতের আহন পাখনা গঙ্গাইছে! এইসব শুনতে শুনতে জুম্মনের মায়ের ছাইমাখা খড়-ধরা কালো হাত চলছিলো অতিরিক্ত দ্রুতবেগে।
তুই কি কইলি? খিজির আলি বৌকে জিগ্যেস করে, তুই কিছু কইলি না? জুম্মনের মা মাঝে মাঝে মিথ্যা কথা বলে, কিন্তু কোনো কথা বাড়িয়ে বলতে পারে না। তবে খিজির আলি সম্বন্ধে বাড়িওয়ালার গালিগুলো এতোটা হুবহু না বললেও তো পারতো। সুযোগ পেয়ে মাগী নিজেই কি তাকে গাল দিয়ে সুখ করে নিচ্ছে?
খিজির বলে, আমি মাহাজনের নামে গিবত কি করছি? মহল্লার মানু ঐদিন তারে ধইরা ছেইচা ফলাইতো না? আমি ঝুটা কথা কইছি? অর আপন ভাইগ্লাই তো আমাগো সর্দার, আমরা তো আলাউদ্দিন মিয়ার লগেই আছি। ভাইগ্রামিটিং করতাছেন? মিছিল করতাছে না? কার লগে ভূমি কার বিচার করো? কৈ তার ভাইগ্না, সায়েব মানু, দুইদিন বাদে বলে মাহাজনে নিজের মাইয়ার লগে বিয়া দিবো। গোলাম হইয়া তুমি তার সাথে এক লগে নাম ল্যাখাও? হায়রে মরদ কৈ মহারানী, কৈ চুতমারানী’
খিজিরের ইচ্ছা করে একটা ঘুষিতে মাগীর চোপাখান ফলাফালা কইরা ফালায়। কিন্তু তার সুযোগ না দিয়ে জুম্মনের মা বলে, এই মিছিল উছিলের হাউকাউ দেইখা মাহাজন খামোশমাইরা রইছে, নাইলে তোমারে উঠাইতে তার কতোক্ষণ?
উঠাইয়া দিলে যামু গিয়া। ঢাকার শহরের মইদ্যে জায়গার অভাব? আমারে কাম দিবো? তোমারে উঠাইয়া দিয়া মাহাজনে মিস্ত্রীর লগে আমারে বিয়া না দিয়া কাম দিবো?
এহানে কাম করবি না। কাম করলে কামের অভাব আছে? ‘আরে বাবা! মরদের লাহান কথা কইলা একখান মাহাজনে আমার পোলারে রিকশা কইরা দিবো, আমারে থাকতে দিবো। এইগুলি ছাইড়া তোমার সিনার মইদ্যে গিয়া ছুপাইয়া থাকুম, না? তাও তো খালি হাড্‌ডি কয়খান আছে। ঐ হাড্‌ডির খাঁচার মইদ্যে আমারে রাখতে পারবা? ভাদাইমা মরদ একখান!
এর মধ্যে গলা ভরে টালমাটাল গান নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো বজলু। ছুকেই দরজায় বসে হড়হড় করে বমি করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো বজলুর বৌয়ের চিৎকার, রাইতে গু-গবর খাইয়া বাড়ি আইছে, অহন এইগুলি সাফ করে ক্যাঠায়? এইগুলি ধোয় কাঠায়? এরপর বমি করার আওয়াজ সাঙ্গ হলে আওয়াজ ওঠে মারধোর করার। ১টা চড়ে মেয়েটা চেচিয়ে ওঠে, দ্বিতীয় চড়ে চুপ। তারপর বজলু তাকে মেঝেতে ফেলে দমাদম লাথি মারে। লাথির প্রবাহে বিরতি পড়তেই বজলুর বৌ বিড়বিড় করে, পুলিসের বাড়ি খাইয়া চোট্টাটার ত্যাজ বাড়ছে, না? জবাব বজলুফের লাথি মারতে শুরু করে। মেয়েটা ভয়ানক তাড়া, মার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য যা করে মাতালকে উস্কে দেওয়ার জন্য তাই যথেষ্ট। এদিকে জুম্মনের মা বিড়বিড় করে, হায়রে। পাঁচ মাসের পোয়াতিটা হায়রে! তারপর পুরনো প্রসঙ্গ তুলে সে প্রায় মিনতির স্বরে বলে, তুমি না, বুজলা, মাহাজনেরে কও, মাহাজনেরে ভালো কইরা কইলেই—?
কিন্তু তার কোনো কথা খিজিরের কানে যায় না। পোয়াতি বৌকে বজলু লাথি মারছে। খিজিরের চোখের ভেতর থেকে রক্তের একটানা স্রোত বেরিয়ে কোনো একটি দালানের সিঁড়ির তলা ভাসিয়ে দেয়, রক্তের মধ্যে শরীর ডুবিয়ে পড়ে থাকে বজলুর বৌ।
খিজির এক লাফে উঠে বাইরে যায়। মাতালটাকে ফেলে দেওয়ার জন্য ১টা লাথিই যথেষ্ট। মাটিতে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বজলু জড়ানো গলায় গাল দেয়, তুই কাঠা? নিজেরটারে তামাম দিন বন্ধক রাখস মাহাজনের কাছে, রাইতে আইছস আমারটারে ধরতে, না? তরে ফালাইয়া একদিন টেংরি দুইখান না ভাঙছি তো আমি হালায় বাপের পয়দা না। মাহাজনেভি হুকুম দিছে। খানকির বাচ্চাটারে একদিন এক্কেরে মাইরা বস্তার মইদ্যে বাইদা হালায় ফালাইয়া রাখুম ম্যানহোলের মইদ্যো খাড়া’ বজলুর জড়ানো কথা কিন্তু সব বোঝা যায়।
জুম্মনের মা ঘুমিয়ে পড়েছে। খিজির একটু রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ওদিকে শ্যাওলা-পড়া, খয়েরি রঙের দোতলা তিনতলা বাড়ির ফাঁক দিয়ে দ্যাখা যায় মস্ত বড়ো চাদ। ফাঁকা রাস্তা জুড়ে ময়লা আবর্জনা চাদের আলোতে জড়ানো। খিজিরের বুক ভয়ানক ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে। মহাজন কি বজলুকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে? শরীরটা শীতশীত করছে। ঘরে ঢোকা দরকার। কাল হরতাল। এখান থেকে মিছিল নিয়ে যেতে হবে ইউনিভারসিটি। আলাউদ্দিন মিয়া ঐ বেবি ট্যাকসি নিয়ে বকবিকি করার পর বারবার বলে দিয়েছে খিজির যেন রিকশাওয়ালাদের নিয়ে সকাল বেলাতেই অফিসের সামনে হাজির হয়। শ্লোগান কি হবে সায়েব তাও ঠিক করে দিয়েছে। নাঃ! এখন ঘুমানো দরকার, কাল ভোরে উঠতে হবে।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৪

‘আকবর ভায়ের ব্যাটা? দাঁড়াও, ভালো করা দেখ্যা নেই।’ আনোয়ারের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর খয়বার গাজী তাকে বসতে বলে, তার পাশে জালাল মাস্টার। তারপর ১টি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খয়বার গাজী অনুযোগ করে, তোমরা বাপু বাপদাদার ভিটাত আসবারই চাও না, একবার ফুচকিও পাড়ো না! তোমার মামু আর বছর জাতীয় পরিষদে কনটেস্ট করলো, আমার এখানে আসছিলো। আমার কুটুম্ব, ভায়ের সম্বান্ধী, আবার তোমার চাচীরও কি রকম ভাই হয়। তো কল্যাম, সিরাজ ভাই, আমার কিছু কওয়ার দরকার নাই। আমার ইউনিয়নের মেম্বর এগারোটা -একটা জোলা আর একটা কৈবর্ত-বাকি নয়টা ভোট আপনের। তা ফুল মার্কার টিকেট নিবার পারলেন না?-ওয়াদা দিলাম। কিন্তু বাবা জামানা খারাপ, মানুষ হলো মোনাফেক। মানুষের ঈমান নাই। ভোটের আগের রাতে মটোর সাইকেল নিয়া দুইজন মানুষ আসলো, ভটভটিওয়ালারা টাকার বস্তা নিয়া আসছিলো, সব ভোট পড়লো ফুল মার্কাত। আমার ভোটটা নষ্ট হলো একটি প্রসঙ্গ থেকে আরেকটি এসে পড়ে। কোনোটাই ভালোভাবে শেষ হয় না। খয়বার গাজী কথা বলে একটু ধীরে, বিলম্বিত লয়ে, কিন্তু লোকটা খুব স্টেডি, থামে না। মাঝে মাঝে বিরতি দিলেও এমন একটা ভঙ্গি করে যেন তার বাক্য অসম্পূর্ণ রয়েছে, ঠিক পরবর্তী সময়টিও তার জন্যেই নির্ধারিত, অন্য কারো তাতে ভাগ বসাবার সুযোগ থাকে না। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে সিগ্রেটে টান দেয় বা তার সামনে লাঙ্গল-কাধে মাঠের-দিকে-রওয়ানা হওয়া কিষানের উদ্দেশে নির্দেশ পাঠায় বা সশব্দে থুথু ফেলে বা উচ্চকণ্ঠে আল্লার নাম নেয়। এরকম ১টি ফাঁক পেয়ে আনোয়ার বলে ফেলে, ‘জী। বেসিক ডেমোক্র্যাটদের প্রায় সবাই টাকা নিয়ে ভোট দিয়েছে, সব জায়গাতেই তাই হয়েছে।’
মুখে একটু জর্দা পুরে ডান হাত তুলে খয়বার গাজী তাকে থামিয়ে দেয়, তারপর বলে, বাপু, বেসিক ডেমোক্র্যাসিকও আর আর এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যানচাইজ কও, আইয়ুব খান কও আর শেখ মুজিব কও, দ্যাশের মানুষের ঈমান ঠিক নাই। ঈমান না থাকলে কেডা কি করবো। না কি কও? হঠাৎ ভেতর বাড়ির দিকে মুখ করে লোকটা হুঙ্কার ছাড়ে, ক্যারে সাকাত আলি, নাশতা হলো?
আনোয়ার ক্ষীণকণ্ঠে একটু ভদ্রতা করার চেষ্টা করে, না, নাশতা থাক। বাড়িতে বলে আসিনি, নাশতা করে রাখবে, আপনি আর কষ্ট করবেন না। খয়বার গাজী হাসে। এই হাসিতে আনোয়ারের প্রতি নাশতা খাওয়ার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।
একটু অস্বস্তিকর হলেও লোকটাকে আনোয়ারের খারাপ লাগছে না। জালাল মাস্টারের অনুরোধেই আসতে হয়েছে, কাল সন্ধ্যায় জালাল ফুপা বার বার বলছিলো, দ্যাখে বাপু, চ্যাংড়া প্যাংড়ার কথাত কৰ্ণপাত করো না। খয়বার গাজীর সাথে বিবাদ করলে চেংটু কও আর অর বাপ কও, কারো পরিণতি ভালো হবার পারে না। কারণ কি? কারণটাও ব্যাখ্যা করে সে নিজেই। নাদু পরামাণিক ও তার ছেলে চেংটুর নামে খয়বার গাজী যে ফৌজদারী মামলা করেছে তাতে অপরাধ প্রমাণিত হলে বাপব্যাটার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল একেবারে অনিবার্য। নাদু কি মামলার খরচ যোগাতে পারবে? আরো, খয়বারের কি? ১৫ দিন পরপর সে টাউনে যায়, চাঁদে চাদে তার মোকদ্দমা। এর সঙ্গে নাদুর নামে ১টা মামলা জুড়ে দিলে তার কি এসে যায়? আনোয়ার গিয়ে যুদ খয়বার গাজীকে একবার বলে তো সে মামলাটা তুলে নিতে পারে। আনোয়ার তবু আসতে চায়নি। চেন্টুর কথা না হয় ছেড়েই দিলো, ছোড়াটা মনে হয় সব সময় টং হয়ে আছে, কিন্তু জালাল মাস্টার, এমন কি নাদু পরামাণিকের কথাতেও বোঝা যাচ্ছে যে, খয়বার গাজী লোকটা বিপজ্জনক। ১টা সুযোগ এসে পড়েছে, এখনি চিরকালের জন্য এদের উৎখাত করা সম্ভব। চারদিকে মানুষের ভাব যা দ্যাখ্যা যাচ্ছে তাতে মামলা যারা করে তারা তো নস্যি, মামলার রায় দেনেওয়ালারাই টেকে কি-না দ্যাখো!
কিন্তু ঝামেলা বাধায় নাদু পরামাণিক, চাচামিয়া’ দ্যাখেন, গরীব মানুষ হামরা, বেন্ন্যা মানুষ, আপনাগোরে পায়ের তলাতে পড়া আছি বাপদাদার আমল থাকা। হামার তিনকাল যায়া এখন এককালোতে ঠেকছে, হামি তো বুঝি বাপজান, হামি সোগলি বুঝি।’
বাপের বিবেচনাবোধে চেন্টুর আস্থা নাই, হু! তুমি কি বোঝো? নাদু জবাব দেয় আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে, চ্যাংড়াপ্যাংড়ার ইগল্যান, নাফপাড়া ব্যারাম কয়দিনের, কন? যিগল্যান ইশকুল কলেজোত পড়ে দুইদিন বাদে সিগল্যান ব্যামাক যাবো টাউনেত, অদেক যাবো জেলের ভাত খাবার। খয়বার গাজী তখন হামাক মাটির তলাত পুত্যা খুবো, মাটির উপরে ঘাস জালাবো, কেউ ফুচকি দিয়াও দেখবো না।
তারপর সে খয়বারের সঙ্গে আনোয়ারের বড়োচাচার আত্মীয়তার কথা বলে, বড়োচাৰ্চী ডালেপালায় খয়বারের মামাতো বোন। আনোয়ার কথাটা বললে গাজী তাকে না করতে পারবে না। হাজার হলেও ভদ্রলোক, আর যা-ই হোক খয়বার গাজীর বংশ তো ভালো। ছোটলোকের বাচ্চারা মেম্বার হয়ে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের গম মেরে বড়োলোক হয়, খয়বার তো সেরকম লোক নয়। কতো পুরানো বংশ, নইলে আনোয়ারদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা হয় কি করে?
বুঝলাম তো তা গোরু চুরির সোম্বাদ নিয়া তুমি থানাত গেলে তার গাওত লাগে কিসক?
চেংটুর এই অভিযোগ নাদু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে আনোয়ার তাকে থামিয়ে দিয়েছিলো, তারপর চেংটু যখন তার ভাইপোকে কুকুর ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন আপনিও রামদা হাতে তার সঙ্গে ছিলেন,—এই কথাটা খয়বার গাজী থানায় গিয়ে বললে৷ কি করে, বলেন?
জবাব না দিয়ে নাদু মাথা নিচু করে থাকে। সে বসেছিলো হাঁটু ভেঙ্গে,-আর দশজন চাষা যেভাবে বসে,—তার বড়ো পাকা দাড়ি এলোমেলোভাবে ছড়ানো, শীতে সেগুলো কেমন খাড়া খাড়া হয়ে গেছে, এতো ঘন দাড়িতেও তাই চেহারায় সৌম্য ভাব আসে না। তার দীর্ঘ দেহ সর্বদাই নোয়ানো, আনোয়ারের কথা শুনতে শুনতে তার ঘাড় এতোটা নুয়ে পড়ে যে, মনে হয় খয়বার গাজীর সমস্ত অপরাধের জন্যে দায়ী সে একা। আনোয়ারের দিকে সে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায়, পরশু জালাল মাস্টারের কাছে সে তার পর্যবেক্ষণ জানিয়ে দিয়েছে যে, আনোয়ারের দাদাজীর সঙ্গে আনোয়ারের চেহারার সাদৃশ্য খুব স্পষ্ট। তা তার পূর্বপুরুষের আমলের এক চাকরের প্রতি সে কি তার মরহুম দাদাজীর মতো একটু করুণাহাদয় হতে পারে না? খয়বার গাজীর কাছে একবার যেতে তার আপত্তিটা কি? আবার জালাল মাস্টারও বারবার চাপ দেয়। এ লোকটার কথা ফেলা মুশকিল। স্থানীয় হাই স্কুলে কুাস এইট পর্যন্ত ৪০ বছর ধরে বাঙলা পড়বার পর লোকটা এখন ঘরেই বসে থাকে। সংসার দ্যাখে, মানে শ্বশুরের দেওয়া কয়েক বিঘা জমির তদারকি করে। মাসে দুমাসে বিষাদ-সিন্ধু, মোস্তফা-চরিত, কাসাসুল আম্বিয়া বা তাপস-চরিতমালা ও রবি ঠাকুরের চয়নিক পড়ে বাঙলা ভাষার চর্চাটা চাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এই ভাষার ওপর দখল বোঝা যায় তার কথাবার্তায়, খয়বার গাজীর সহনশীলতার অভাব আছে, কিন্তু তার হৃদয় পরিষ্কার। আর তোমার বড়ো চাচীর তাই সাক্ষাৎ আত্মীয়, সম্পর্কে ফুফাতো ভাই। আর তোমার পিতার সাথে তার হৃদ্যতা কি এক আধ বৎসরের? চল্লিশ পঞ্চাশ বৎসরের বন্ধুত্ব, প্রায় সমবয়স্ক, ইস্কুলে সহপাঠী না হলেও খেলার সাখী। শৈশবের বন্ধুত্বের কাছে আত্মীয়তা কুটুম্বিতা কিছু নয়। তুমি একটা আবদার করলে গাজী কি হেলা করবার পারে?
কিন্তু খয়বার গাজীর বৈঠকখানার বারান্দায় বসে জালাল মাস্টারের বাকপটুতার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। বারান্দার ধার ঘেঁষে শেফালি গাছ, টুপটাপ ফুল পড়ে শিশির-ভেজা সাদাটে সবুজ ঘাসের জমিতে নক্সী কাথা বোনা হয়ে চলেছে, জালাল মাস্টার তাই দ্যাখে। সামনের এই খালি জমির পর ঘাট-বাধানো পুকুর, শীতের পুকুরে স্থির পানির ওপর আবছা ধোঁয়া, জালালউদ্দিন তাও দ্যাখে। একটু পশ্চিমে আনোয়ারদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় শিমুল গাছের মাথায় লালেচ রোদ হলদে হয়ে আসছে, লোকটা তাও দ্যাখে। তাহলে আনোয়ার কথাটা পড়ে কিভাবে?
লুঙ্গি পরা ১টি ছেলে এসে দাঁড়ালে খয়বার গাজী আনোয়ারকে বলে, চলো বাবা, ঘরে নাশতা করি। গরিবের বাড়িতে আসছে বাবা, কি দিয়া যত্ন করি? একটা খবর দিয়া আসা লাগে, গায়ের মদ্যে থাকি, বুঝলা না?—উপস্থিত কিছু পাওয়া যায় না।
না নাকি যে বলেন। নানা, তাতে কি? আনোয়ারের এসব বাকপ্রয়াস খয়বার গাজীর বিপুল বিনয়ের তোড়ে কোথায় ভেসে যায় তার আর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।
বৈঠকখানায় শতরঞ্চি পাতা তক্তপোষে দস্তরখান বিছানো। গোলাপি ও বেগুনি রঙের বড়ো বড়ো ফুলপাতা-আঁকা মোটা ও বড়ো চীনেমাটির প্লেটে প্রথমে পরোটা ও পায়রার গোশতের ভুনা খাওয়া হলো। তারপর মুড়ি দিয়ে পায়েস। পায়েস খেতে খেতে জালাল মাস্টারের বারবার ইঙ্গিত সত্ত্বেও আনোয়ার কথাটা তুলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত মাস্টার বলে, ‘ভাইজান, এই চ্যাংড়া আপনার কাছে একটা অনুরোধ, একটা আবদার নিয়া আসছে।’ খয়বার গাজী সাড়া না দিয়ে তার পায়েসমাখা আঙুল চোষে। সবগুলো আঙুল পরিষ্কার করে হঠাৎ বলে, কি বাবা? কও, কও।’
জালাল মাস্টার বলে, নাদু পরামাণিক ধরেন এদের বাড়িতে আজ সুদীর্ঘ-। চিলমচিতে হাত ধুতে ধুতে খয়বার গাজী তাকে থামিয়ে দেয়, জালাল মিয়া কন ক্যা? এই চ্যাংড়া নাকি কবো। তাকই কবার দ্যান না!
আনোয়ার অনেকক্ষণ থেকে মনে মনে রিহার্সেল দিচ্ছিলো। এবার বলেই ফেলে, নাদুর বিরুদ্ধে মামলাটা তুলে নিলে ভালো হতো। বেচারা খুব ভেঙে পড়েছে। গরিব লোক, শরীর খারাপ, সেরকম খাটতেও পারে না। লোকটা এমনিতে খুব ভালো, অনেস্ট লোক-।
‘না, নাদু তো মানুষ খারাপ না, অপরিবর্তিত গলায় খয়বার গাজী বলে, ছোটো জাতের মদ্যেও আল্লা ইশজ্ঞান দেয়, নাদুরও হুশজ্ঞান কম নাই। কিন্তু তার ব্যাটা? উই যে অকামটা করছে আর শালার কথাবার্তা যেমন শুনি, এখন তার সাথে কি করি কও তো? বিশ পঁচিশ বছর আগে হলেও বাপজানের দোনলা বন্দুকখান বার করা শালাক গাঙের কিনারে নিয়া ফালায়া দিল্যামনি তা বাপু দিনকাল এখন খারাপ। এখন সোগলি শালা বড়োলোক, -চাষাভুষা-জোলা-নাপিত কৈবর্ত-কামার-কুমার-সোগলিক তোয়াজ করা চলা নাগে। চেংটুক নিয়া এখন কি করি কও তো বাপু জালাল মিয়াই কন তো, চেংটুর লাকান একটা শয়তানের সাথে কি করি? আজ লাই দিলে কাল আপনার মাথাত লাথি মারবো। এ্যাঁক নিয়া কি করি আপনেই কন?
চেংটুর ব্যাপারে জালাল মাস্টারও খয়বার গাজীর সঙ্গে একমত। ছেলেপিলে আদব কায়দা ভুলে যাচ্ছে। যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে চায় না।
আল্লা সব মানুষকে সমান মনোযোগ দিয়ে সৃষ্টি করেছে এ কথা অবশ্য ঠিক। সব মানুষের প্রতি আল্লার প্রীতি ভালোবাসাও সমান। কিন্তু হাতে পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না, এক বাপের পাঁচটা ছেলে যেমন সমান বুদ্ধি-বিবেচনা পায় না, সমাজের সব মানুষ তেমনি একই আসন পেতে পারে না। এই যে চেংটু, একে একা দোষ দিয়ে লাভ কি? আজকাল এই বয়সের সব ছেলেই এরকম হচ্ছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবেই এর কারণ বলে জালাল মাস্টার মনে করে। উপযুক্ত জ্ঞানলাভ না হলে আদবকায়দা রপ্ত করা অসম্ভব, আদবকায়দা হলো শিক্ষার ১টি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে নাদুটা মানুষ খুব ভালো। মনিবের হিত ছাড়া তাই কোনোদিন অহিত চায় নাই, মিয়াদের ইষ্ট ছাড়া তাই কোনো দিন অনিষ্ট করে নাই।’
খয়বার গাজী একটু বিরক্ত হয়, খবর কি আমি কম রাখি? আপনি জামাই মানুষ, উদিনক্যা আসছেন, আপনে কি জানেন? এর দাদার আমল থাকা এই বাবাজীদের বাড়িতে যারা কাম করে সবাইকে আমি চিনি।
বারান্দায় বসে পান খেতে খয়বার গাজী আনোয়ারকে বলে, তুমি একটা আবদার নিয়া আসছে, আমি কি না করবার পারি? চেংটুক কয়ো একবার আমার সাথে যেন দ্যাখা করে। চেংটুর কথা শুনবো, আমার ভাইস্তা আফসারের কথাও শোনা দরকার। চেংটু বেয়াদবি করছে আফসারের সাথে, আমার সামনে আফসারের কাছে যদি মাফ চায়, আফসার যদি মাফ করে তো আমি মামলা তুল্যা নেবো। একটু থেমে সে বলে, আফসারেক আমি বুঝায়। বলবো, চ্যাংড়া প্যাংড়া একটা ভুল করা বসছে, আফসার মাফ করা দেবে।
এতো সহজে কাজ হবে আনোয়ার ধারণা করতে পারেনি। জালাল মাস্টারের অনুমান তাহলে অভ্রান্ত, সে একবার দ্যাখা করলে খয়বার গাজী অস্বীকার করতে পারবে না। হাজার হলেও আব্বার ছেলেবেলার খেলার সার্থী। কিন্তু খয়বার গাজী মামলা তুলে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তে জালাল মাস্টারকে একটুও খুশি মনে হচ্ছে না। কেন? গ্রামের লোকদের আবেগ প্রকাশের ব্যাপারটা আনোয়ারের কাছে বড়ো এলোমেলো ঠেকে।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে কোটা বার করে মুখে জর্দা ফেলে খয়বার গাজী বলে, বাবাজী, তুমি আসছো আমার এই গরিবখানায় এক সন্ধ্যা ডালভাত খাওয়া লাগবে। কিন্তু না, দুইটা ডালভাত খায়া যাবা। ওয়াদা করা যাও, ঐ্যা?
আনোয়ার কি রাজি না হয়ে পারে? সে কেবল এদিক ওদিক দ্যাখে। শেফালি গাছের নিচে ফুল এখন মাত্র কয়েকটি। ওরা খেতে বসলে কেউ এসে নিয়ে গেছে। পুকুরের বাধানো ঘাটের দুই পাশে মস্ত ২টো গাছ, ১টা তো বকুল, আরেকটা কি? কনক-চাপা হতে পারে, হাটখোলা রোডের ১টা বাড়িতে এরকম গাছ দেখিয়ে ওসমান একদিন ওটা কনক-চাপা বলে সনাক্ত করেছিলো। পুকুরের বা পাশে নতুন খড়ের টাটকা হলুদ রঙের গাদা। তার নিচে নতুন একটি সাদা বাছুর কচি মুখে খড়ের একটি গাছা নিয়ে খেলা করে। কচি নরম রোদ এসে পড়েছে বারান্দা জুড়ে।
পুকুরের ওপর পাতলা ধোঁয়া আস্তে হারিয়ে যায়, সেখানকার নতুন রোদের কাপন যেন ঢেউ তুলছে খয়বার গাজীর ভরা গলায়, এই যে পুষ্করনি, তোমার বাপের কয়ো ভাই সাতার শিখছে এটি। তোমার দাদা বড়ো শক্ত মানুষ ছিলো গো, ছেলেপেলেক ইদারার তোলা পানি ছাড়া গোসল করবার দেয় নাই। বড়োমিয়া বিছনা ছাড়ছে রাত থাকতে, বেলা ওঠার আগে বাড়ির ছেলেপেলে সব কয়টাক উঠায়া দিছে। নামাজ পড়া লাগছে বাড়ির সব মানষেক জায়গির, কিষান, চাকরপাট-সোগলি নামাজ পড়ছে তার বাড়িত। নামাজ পড়া হলে তিন ব্যাটাক পড়বার বসায়া তার অন্য কাম। তোমাদের বাড়িতে দুইজন তিনজন জায়গির থাকছে বারো মাস। সকালবেলা তোমার বাপচাচাগোরে পড়া দাখায়া দিছে তারাই। এই তো জালাল মিয়াও ছিলো। ক্যাগো, আকবর ভায়েক আপনে পড়ান নাই?
‘না, আমি যখন আসি আকবর ভাই তখন কলকাতার কলেজে পড়ে। ‘ছ। আপনে তাহলে এই চ্যাংড়ার ছোটোচাচাক পড়াচ্ছেন, না? জালাল মাস্টারের জবাবের অপেক্ষা না করে সে নিজেই মনে করতে পারে, না, আপনে পড়বেন ক্যামন করা? জাহাঙ্গীর তো তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবো।’
জালাল মাস্টারকে একটু ছোটো করার এই সংক্ষিপ্ত তৎপরতা কিন্তু খয়বার গাজীর স্মৃতি-আপ্লুত আচ্ছন্নতায় এতোটুকু চিড় ধরায় না, তার গলা নেমে আসে খাদে, সে বিড়বিড় করেই চলে, দেখতে দেখতে দিন গেলো! সময়ের দ্রুতগতির কথা ভেবে সে ১টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এই দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয় তার কথায়, দিন কি বস্যা থাকে? এই বারান্দার উপর বস্যা কতো গপ্পো, কতো খেলা, কতো গান শোনা, মনে হয় সেদিনকার কথা কলকাতা গেলো, কলেজ ছুটি হলে বাড়িতে আসছে, ছুটির মধ্যে সারাটা দিন বস্যা থাকছে এই বারান্দায়, এই বৈঠকখানায়, ঐ পুকুরের ঘাটে। ছুটির মধ্যে আসা খালি গান শুনছে। আকবর ভায়ের ছিলো গান শোনার নেশা।
লোকটা বলে কি? আনোয়ার ওর বাবাকে গান শুনতে দেখতো বটে, কিন্তু তাকে ঠিক নেশা বলা যায় না।
খয়বার আলি বলে, তোমার দাদা ছিলো কড়া মুসল্লি মানুষ, গান বাজনা আমোদ ফুর্তি ছিলো তার দুই চোক্ষের বিষ। আমার বাপজান আছিলো খুব হাউসআলা মানুষ, মাসের মধ্যে না হলেও পনেরো দিন টাউনে থাকছে। বাড়িত থাকলে একদিন দুইদিন অন্তর খাসি জৰো করো, পোলাও-কোৰ্মা খাও। এই থানার মধ্যে প্রথম কলের গান কেনে বাপজান, পদুমশহরের জগদীশ সেন কিনলো তার ছয় মাস পর। তোমার বাপ করছে কি-? বলতে বলতে খয়বার হাসে, গান-পাগলা মানুষ, করছে কি ছুটির সময় কলকাতা থাকা নতুন নতুন রেকর্ড নিয়া আসছে। সায়গল, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়ার যতো রেকর্ড আমার বাড়িতে আছে সব তোমার বাপের কেনা। আব্বাসউদিনের রেকর্ড প্রথম কিন্যা আনলো আমার বাপজান। ১টি মহাকৌতুককর বিষয় বর্ণনার ভঙিতে খয়বার হাসে, আকবর ভাই আবার ঐ রেকর্ডই নিয়া আসলো পুজার ছুটির সময়।
খয়বার গাজীর বিরামহীন সংলাপে আনোয়ারের কাছে তার বাবা ক্রমেই ঝাপশা মানুষ পরিণত হয়। আনোয়ার তো কোনোদিন আব্বাকে একটা রেকর্ডও কিনতে দ্যাখেনি। অথচ ওদের স্টোরিও রেকর্ড-প্লেয়ারের জন্য ভাইয়া-ভাবী মাসে অন্তত একটা লংপ্লে কেনে, এমন কি সিক্সটি ফাইভ পর্যন্ত কলকাতা থেকেও মাঝে মাঝে রেকর্ড আসতো। ঝাপশা বাবাকে শপষ্ট করার জন্য আনোয়ার জিগ্যোস করে, আব্বা রেকর্ড কিনতেন?
হ্যাঁ বাপু, এবার বলে জালাল মাস্টার, খয়বার ভায়ের বাবার ঢালাও আদেশ ছিলো, নতুন গান বার হলেই নিয়া আসবা, অর্থ যা লাগে চিন্তা করব না। মরহুম পিতার প্রসঙ্গ তোলায় খয়বার গাজী জালাল মাস্টারের ওপর একটু প্রসন্ন হয়, জালাল মিয়া ঠিক কথা কছেন। বাপজান হাউস করা হরমোনিয়াম কিনছে, তাই নিজে গান করছে ছয়মাসে নয়মাসে একবার। হারমোনিয়াম বাজাছে আকবর ভাই, একোটা গান একবার, বড়েজোর দুইবার শুনলে ঠিক তুল্য নিবার পারতো, তাই না জালাল মিয়া?
ঠিক কছেন। তার স্মরণ শক্তি ছিলো অসাধারণ একবার একটা পুস্তক পড়লে’আরে আপনে কি দেখছেন? খয়বার গাজী তাকে থামিয়ে দেয়, তোমার দাদার হাউস ছিলো এক ব্যাটাক উকিল বানাবো। বড়ো ব্যাটা, তোমার বড়োচাচার শরীরটা নরম, কলকাতার হোস্টেলের খাবার সহ্য হলো না, আইএ পাস করা বাড়িতে আসলো। আর গেলো না, সংসার দ্যাখা আরম্ভ করলো। মানুষের নসিব! তোমার বাপ বিএ পাস করা ল’য়েত ভর্তি হলো, পরের বছর বড়ো মিয়া মারা গেলো। তোমার বড়োচাচা পড়ার খরচ কুলাবার পারে না। ল’ পড়ার জন্যেই আকবর ভাই বিয়া করলো, কি মনে করা এক বছর বাদে পড়া বাদ দিলো, চাকরি নিলো। আকবার ভাই উকিল হলে এই তামাম ডিস্ট্রিষ্ট্রের মধ্যে তার সাথে পারে কেডা?
আনোয়ার ভাবে উকিল না হয়েও আব্বা এমন কি খারাপ করেছে? পার্টিশনের সময় পাকিস্তানে অপশন দিয়ে এসেই ওয়ারিতে বাড়ি কিনেছে, ব্যাংকে টাকা যা রেখে গেছে তাই নিয়ে ব্যবসা করে ভাইয়া দিব্যি রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘আকবর ভায়ের ছোটোভাইটা জাহাঙ্গীরও খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো। জালাল মাস্টার এই মন্তব্য করে ফের খয়বার গাজীর ধমক খায়, জাহাঙ্গীরকে আপনে আর কয়দিন দেখছেন? এই চাচাটিকে আনোয়ার অবশ্য একেবারেই দ্যাথেনি, জাহাঙ্গীর হোসেন মারা গেছে তার জনের আগে। আব্বা তার সম্মন্ধে খুব একটা কথা বলতো না, আম্মাও না। বড়োচাচার বোধ হয় বেশ দুর্বলতা আছে, ভাইয়া পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে চিঠি লিখলে বড়োচাচা জবাবে লিখতো, তোমার নিকট আমাদের প্রত্যাশা অনেক। জাহাঙ্গীর জীবিত থাকিলে আজ বড়ো আনন্দিত হইত। উহার মেধার লক্ষণ বংশে কেবল তোমার মধ্যে লক্ষ করা যায়। আজ খয়বার গাজীও তার প্রসঙ্গে উচ্ছসিত হয়ে উঠলো, হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর ছিলো স্কলার ছাত্র। একটা স্টুডেন্ট বটে। ওরকম তুখোড় ছাত্র এই গোটিয়া, পদুমশহর, দরগাতলা, চন্দনসহ, কর্ণিবাড়ি-এই অঞ্চলে জন্ম হয় নাই। এমনকি পার্টিশনের আগে, তখন মোসলমানের স্থান কোটে? সেই সময় হিন্দুগোরে মধ্যেও এরকম মেরিট এই অঞ্চলে একটাও আছিলো না গো। জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পর্কে খয়বার গাজীর দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক বিবৃতি আর শেষ হয় না। কুস সিক্সে পড়ার সময় সে ম্যাট্রিক ক্লাসের টেস্ট পেপার দেখে অঙ্ক করতো। ‘ক্সাস নাইনে যখন পড়ে, এবার জালাল মাস্টার প্রায় জোর করে স্মৃতি ঘটে, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কেশব মিত্রের ফেয়ার-অয়েল বস্তৃতা করলো ইংরাজিত, যারাই শুনছে তারাই বলছে, মনে হলে বিলাত থাকা সদ্য আগত ইংরাজ ভাষণ দিতেছে! তো সেই ছেলে, ঐ বয়সে অতো মেধা, —মুরুব্বিদের কেউ কেউ বলতো এতোটা ভালো নয়। সন্দেহ করতো, খয়বার গাজী বলে, চ্যাংড়ার সাথে তেনাদের কেউ আছেন। না হলে এই বয়সের চ্যাংড়া এতো বুদ্ধি পায় কোটে? তেনারা মানে কারা?–আনোয়ার বুঝতে পারে না।-আরে আগুনের জীব! তবুও বোঝে না! খয়বার গাজী বিরক্ত হয়, জীন জীন চেনো না?—মুরুব্বিদের অনুমান কি ভুল হতে পারে? ম্যাট্রিকে ২টো লেটার পেলো, ডিস্ট্রিক্টে ফাস্ট, তখন বাপু হিন্দুরা আছিলো, পরীক্ষা দিলাম আর পাস করলাম-অতো সোজা না! কলেজে ভর্তি হলো কলকাতায়। আকবর ভাই তখন পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকে, জাহাঙ্গীর তার বাসায় থেকে কলেজ করতে লাগলো। বছর না ঘুরতে জাহাঙ্গীরকে গ্রামে নিয়ে আসা হলো, তার হাতে পায়ে শিকল পরানো, তার মাথা কামানো। চোখজোড়া তার অষ্টপ্রহর লাল, মানুষ দেখলে চিৎকার করে, না দেখলেও আকাশের দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দে কার উদ্দেশে গালাগালি করে। কি ব্যাপার? জোনপুরের মৌলবি সাহেবের ভাগ্নে,—জবরদস্ত পীরসায়েব, নৌকা করে যমুনার শাখানদী বাঙালি দিয়ে যাচ্ছিলো মুরিদ বাড়ি, নাদু পরামাণিকের কাছে খবর পেয়ে আনোয়ারের বড়োচাচা নিজে গিয়ে নৌকা থামিয়ে পীরসায়েবের হাতে পায়ে ধরে। পীরসায়েব এসে জাহাঙ্গীরের রোগ সনাক্ত করে ফেললো। কলকাতায় কোথায় কোন অজায়গায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করছিলো, সঙ্গেকার জীন তাই খেপে গিয়ে একটা বদম্বভাব জীনকে তার ওপর আসর করিয়ে দিয়ে নিজে সরে পড়েছে। বদ জীন ঝেড়ে ফেলা পীরসায়েবের কাছে ভালভাত, জাহাঙ্গীরকে বেঁধে কয়েকটা আয়াত পড়তে পড়তে ঝাড়ুর বাড়ি মারলে শয়তানটা বাপ বাপ করে পালাবে। কিন্তু পীরসায়েব তা করতে নারাজ; কারণ তাতে ভালো জীন অসম্ভষ্ট হয়।
জীন হলো ফেরেস্তাদের মতো, তাকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি পীরসায়েব নেয় কি করে? —তা কলকাতায় গিয়ে জাহাঙ্গীরের মতিভ্রম ঘটেছিলো বৈ কি। কয়েকটা হিন্দু কমুনিস্টের সঙ্গে তার মেলামেশা শুরু হয়। এতো পরহেজগার পরিবারের ছেলে, সে নাকি নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছিলো, আল্লা রসুল নিয়ে ঠাট্টা পর্যন্ত করতো!—আহারে, হিন্দু কমু্যনিস্টদের পাল্লায় পড়ে পাগল না হলে জাহাঙ্গীর এই এলাকা কি, এই জেলার একটা মাথা হতে পারতো। এই নিয়ে খয়বার গাজী ও জালাল মাস্টারের পালা করে আক্ষেপ প্রকাশের আর শেষ হয় না। কতোক্ষণ চলতো কে জানে? ১টি মোটর সাইকেলের আওয়াজে ২জনেই থামে এবং তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। শিমুল গাছের নিচে এলে হোল্ডা আরোহীকে দু’জনেই চিনতে পারে, জালাল মাস্টার বলে, ফকিরগোরে আসমত না?
খয়বার গাজী সেদিক থেকে চোখ ফেরায় আনোয়ারের দিকে, কয়টা দিন থাকবা তো বাবা? ‘জী, কলেজ তো আজকাল প্রায় বন্ধই থাকে। কোনো অজুহাত পেলেই গভমেন্ট একেবারে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত— ?
‘শিক্ষার বিস্তার হয় কেমন করা? জালাল মাস্টার শিক্ষাবিস্তারে বাধাবিপত্তি নিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেছিলো, হোন্ডা এসে পড়ায় তাকে থামতে হয়। হোন্ডার আরোহী হোল্ডা দাঁড় করাতে করাতে বলে, মাস্টার সায়েব সকালবেলা কি দরবার নিয়া আসছেন?
কিন্তু খয়বার গাজীর সঙ্গে তার জরুরি আলাপ, তাই প্রশ্নের জবাব না শুনেই সে এগিয়ে আসে, ওদিককার খবর শুনছেন? হোসেন চাচামিয়া খবর পাঠাচ্ছে। কথা আছে।’
খয়বার তাকে বৈঠকখানায় বসতে বলে নিজে উঠে দাঁড়ায়। আনোয়ার ও জালালের সঙ্গে সে বারান্দা থেকে নিচে নামে। আনোয়ারের পিঠে হাত রেখে বলে, বাবা, কথাটা যেন মনে থাকে। একদিন অ্যাসা ভাত খায়া যাওয়া লাগবো। আকবর ভায়ের ব্যাটা, আমার নিজের ঘরের মানুষ, তোমাকে আমি মুখে না কলেও তোমার একদিন আসা লাগে। তার মুখের জর্দা ও পানের গন্ধ আনোয়ারের মাথার ভেতরে ঢুকে তাকে একটু আচ্ছন্ন করে, তার হাতের মস্ত থাবা দিয়ে আনোয়ারের পিঠ সে আলগোছে চাপ দেয়। খয়বার গাজীর হাতের মধ্যে দিয়ে বহুকাল আগেকার বাপের-ভয়ে-তটস্থ গান-পাগল ১টি তরুণ আনোয়ারের শিরদাঁড়ায় সারেগামা সাধে, আনোয়ারের পিঠ শিরশির করে।
বারান্দার নিচে শুকনো শিশিরের দাগ লাগা ঘাসের ধারালো রেড়ে গলা-বসানো শেফালি ফুল আস্তে আস্তে কুঁকড়ে যাচ্ছে।
শিমুলগাছের কাছাকাছি এসে জালাল মাস্টার পেছনে তাকায়। ঐ সঙ্গে তাকায় আনোয়ারও। হোন্ডাওয়ালা ছেলেটির সঙ্গে খরবার গাজী কথা বলছে, কথা বলতে বলতে ২জনে এগিয়ে যাচ্ছে পুকুর ঘাটের দিকে।
আরো কয়েক পা ইটার পর জালাল বলে, ‘খালি খালি কষ্ট করলা, কোনো কাম হলো না বাপু।
আনোয়ার ঠিকমতো শুনতে পায় না। তার চোখের ঠিক সামনে মস্ত শিমুলগাছ জুড়ে টকটকে লাল রঙ। এর উপর নীল আকাশ। হাঙ্কা ফেনার মতো মেঘ উড়ে বেড়ায় নির্ভার শরীরে। এই লাল, ঐ নীল ও সাদা দেখে দেখে আশ আর মেটে না। কতোকাল আগে আনোয়ারের বাপও এই রাস্তায় এই রঙবাহার দেখতো? ছোটোচাচার হাতের শিকল বড়ো হতে হতে সমস্ত দৃশ্যে কালোর দাপট বিস্তার করলে আনােয়ারের বড়ো অগস্তি লাগে। জালাল মাস্টার এই অস্বস্তি থেকে তাকে একরকম উদ্ধার করে, খালি পথশ্ৰম। খালি খালি আসা হলো।
কেন? আনোয়ার অবাক হয়, মামলা তুলে নেবে বললেন তো’। তুমি বুঝবার পারো নাই আনোয়ার, গাজীর শর্ত পালন করা দুঃসাধ্য। শর্ত? জিগ্যেস করতে করতে আনোয়ারের মনে পড়ে, চেন্টুর আসার কথা বলছেন তো? চেন্টু মাফ চাইবে না?
কথা তো তা নয় বাবা, দিনকাল ততো সুবিধার নয়, খয়বার গাজী চট করা কিছু করবার পারতিছে না। না হলে চেন্টু যা করছে কোনদিন তার লাশ পড়া থাকতো। চেংটুক বাড়ির সীমানার মধ্যে পালে পরে কি করবো তা অকল্পনীয়। নিজে কিছুই করবো না, হয়তো সামনে থাকবেই না, আফসার গাজীকে হাত তুলব্যার মান করা দিবো। দুইজনে ঘরের মধ্যে থাকা খালি ইশারা করবো, কাম সারবো বাড়ির কামলাপাট।

আনোয়ারের মাথায় ভেতরকাল বিন্যাস ফের এলোমেলো হয়ে পড়ে। খয়বার গাজীর মুখ ও একটানা সংলাপ ক্রমেই ঝাপশা হয়, প্রতি পদক্ষেপে তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। হাটতে হাটতে সে বারবার জালাল মাস্টারকে দ্যাখে। নিজেই একটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে, আচ্ছা, আমিও যদি চেন্টুর সঙ্গে থাকি?
এ্যাঁ?
ধরেন আপনি আর আমি যদি চেন্টুকে নিয়ে আসি? এতে কাজ হবে না? জালালউদ্দিন জবাব দেয় না জেলা বোর্ডের রাস্তার ২ দিকে ধান জমি। ধান কাটা হয়ে গেছে, ন্যাড়া মাঠ শরীর এলিয়ে রোদ পোহায়। একটু দূরে আলুর জমি। একনাগাড়ে কয়েক বিঘা জমিতে আলুর চাষ করা হয়েছে, ৩/৪ জন কিষান আলুর জমিতে কাজ করে, তাদের মাথার পেছনে ও পিঠে আৰ্দ্ৰতাশূন্য রোদ পিছলে পিছলে পড়ে। জালাল মাস্টার চোখের ওপর হাত রেখে রোড আড়াল করে ওদের মধ্যে কাউকে খুঁজছে। সে জোরে হাক দেয়, ক্যারে, করমালি আছে? জবাব আসে, নাই।’-আনোয়ারের দিকে মনোযোগী না হয়ে জালাল মাস্টারের তখন আর উপায় থাকে না। এসব ছেলেদের নিয়ে মুশকিল,—শহরে জন্ম, শহরে মানুষ, এখানকার সমস্যা এরা বুঝবে কোথেকে? চেংটুও থাকবে, খয়বার গাজীও থাকবে, জালাল মাস্টার সেখানে স্পষ্টভাবে চেংটুর পক্ষ নিয়ে কথা বলবে-একি হতে পারে? এতোবড়ো মানী মানুষটাকে কি ছোটো করা যায়? চেংটুকে বিশ্বাস করা মুশকিল, কি বলতে যে কি বলে ফেলবে, তখন তার ধকল সামলাবে কে? জালাল মাস্টার সংক্ষেপে বলে, চেংটু যাবো না। ছোড়া ভারি বেয়াদব!’
আমরা যদি ভালো করে বুঝিয়ে বলি?
‘দ্যাখা যাক!

চিলেকোঠার সেপাই – ১৫

আনোয়ারদের বাড়ির বাইরে কাঁঠালতলায় কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চের পাশে মাটিতে হাঁটু ভেঙ্গে বসে নাদু পরামাণিক হুকাটানছিলো। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় তার দাড়ি অরো এবড়োখেবড়ো এবং এলোমেলো হয়ে গেছে। ওদের দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে সে ফের হুকা টানে এবং বেশি ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে ওর মুখকে ক্রমে অস্পষ্ট ও নির্বিকার করে ফেলে। অথচ নাদু কিন্তু এদেরই প্রতীক্ষা করছিলো অনেকক্ষণ ধরে।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, আপনি এখনো অপেক্ষা করছেন? নাদু তার দিকে তাকায়। ধোঁয়ামুক্ত হলে নাদুর লাল ও ভোতা চোখের রঙ স্পষ্ট হয়, কিন্তু তাতেও তার ব্যাকুলতা ফোটে না।
কাঁঠালতলায় পশ্চিমে ভাঙা দালানের স্তুপের আড়ালে লুকোচুরি খেলা স্থগিত রেখে বড়োচাচার ছোটো মেয়ে রোজী এসে বলে, আনু ভাই, নাশতা খাবেন না? আম্মা ডাকে।
বেঞ্চে বসতে বসতে জালাল মাস্টার বলে, যাও তোমার চাচীর সাথে সাক্ষাৎ করা আসো। ভেতর বাড়ির দিকে যেতে যেতে আনোয়ার নাদুর মৃদুকণ্ঠ শুনতে পায়, কি কয়।

বিকালবেলা বোঝা যায় যে, নাদুর মেজো ছেলেটা একটু বেয়াদবই বটে। ছেঁড়া বাপের স্বভাব তো পায়ইনি, কিন্তু খয়বার গাজী সম্পর্কে মাঝে মাঝে মন্তব্য যা করে তাতে তার বাপ তো
বটেই, জালাল মাস্টারেরই বুক কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আনোয়ারকে দেখিয়ে জালাল মাস্টার বলে, এই চ্যাংড়ার পরামর্শে কর্ণপাত করবি তো? কথা কম কলে কি হয়, ঢাকাত যতো আন্দোলন হবা নাগছে, যতো সংগ্রাম—সব কয়টার সাথে আছে। তুই খালি পুটি মাছের লাকান লক্ষঝলপ করিস, এই চ্যাংড়াকে দাখ তো! কথাবার্তা শুন্যা বোঝা যায় যে, ঢাকা থেকে একজন নেতা মানুষের আগমন হছে?
আনোয়ার কোন আন্দোলনের নেতা নয়, কিন্তু জালাল মাস্টারের কথার প্রতিবাদ করলে বেচারা একটু বিব্রত হতে পারে। চেন্টু আনোয়ারের দিকে একবার তাকায়, চেন্টুর চোখ বেশ স্বচ্ছ, রাগ কি ঘৃণা থেকে সেগুলো মুক্ত। কিন্তু অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করামাত্র তার চোখজোড়া ছোটো হয়ে যায়, আস্তে আস্তে সে বলে, ‘খয়বার গাজী হামাক ঘরত তুলা বন্দুক বার করবো। দোনলা, একনলা, আইফেল, পিস্তল-ব্যামাক কয়টা তাই শান দিয়া খুছে, হামাগোরে উপরে একচেটি নিবো। ঐ খুনীর সর্দারের কাছ যায় কোন শালা? হামি অর ভাত খাই, নাউই হামাক জর্ম দিছে? আর কাছে হামার কিসের ঠ্যাকা?
জালাল মাস্টার রাগ করে, শালা মূৰ্খ কোথাকার! গণ্ডমূর্খ। অশিক্ষিত ভূত। কুবাক্য না কলে শালার মুখ থাকা বায়ু নির্গত হয় না!
নাদুর সেই ঔদাসীন্য কেটে গেছে, মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে ছেলের কাছে যায়, চিৎকার করে বলে, আজ তোরই একদিন, কি হামারই একদিন হামি নিজে তোক জবো করমু। মুন্সি লাগবো না, আল্লাহু আকবার কয়া তোর গলাত ছুরি দিমু! একটু হাপাবার পর ফের শক্তিসঞ্চয় করে সে চূড়ান্ত সংকল্প ঘোষণা করে, তোক জবো না করা আজ হামি মুখোত ভাত তুলমু না!
চেংটু জিগ্যেস করে, ভাত তোমার ঘরোতে উথলাচ্ছে? হামাক জবো করলে মিয়ারা তোমাক ভাগের ধান বেশি দিবো? আনোয়ারের পরিবারের প্রতি কটাক্ষ করায় নাদুর পক্ষে রাগ সামলানো আর সম্ভব হয় না। লাফিয়ে এসে ছেলের কাকড়া চুলের ঝুঁটি ধরে ধরে কাকায়। তার নিজের রুক্ষ দাড়ি, বড়ো মোটা নাক ও ভোতা লাল চোখজোড়ায় ছোটোবড়ো ঢেউ উঠতে থাকে। চেন্টু কিছুক্ষণ সহ্য করে, তারপর সামান্য একটু চেষ্টাতেই বাপের মুঠি থেকে নিজের কেশরাশি মুক্ত করে। মাথা ঝাকিয়ে চুল পেছনে ফেলে বাপকে সে ধমক দেয়, অতো নাফ পাড়ো কিসক? পিঠত বিষ সুলক্যা উঠবো না? ঘরোত তোমার মালিস করার তাল আছে এক ছটাক? অতো নাফ পাড়ো কিসক?
চেংটুর এই উক্তিতে তার বাবার পিঠের ডানদিককার ব্যাথার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকদিনের ব্যথা। বহুকাল আগে গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে গিয়ে ধোঁয়া না দিয়ে নাদু ঘুমিয়ে পড়ায় আনোয়ারের দাদাজীর খুব রাগ হয়েছিলো। সে কি আজকের কথা? নাদুর বয়স তখন ১০/১১ বছর, মিয়াদের বাড়িতে ফাই ফরমাস খাটে, কিষানদের পান্তা নিয়ে ভাত নিয়ে জমিতে যায়, সকালবেলা গোয়াল থেকে গোরু-বাছুর বার করে, সন্ধ্যাবেলা গোয়ালঘরে ধোঁয়া দেয়। তো সেদিন বড়োমিয়ার বড়ো মেয়ের বিয়ে কি পানচিনির উৎসব। সারাটা দিন সবারই খুব ছোটাছুটির মধ্যে কাটে। সন্ধ্যার পর গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে গেছে নাদু। গোয়ালঘরের পাশেই একটা পীতরাজ গাছের কাটা গুড়ি। আগুন-ধূপের মালসা পাশে রেখে ঐ কাঠের গুড়ির পাশে শুয়ে নাদু ঘুমিয়ে পড়ে। ঐ সময় ওখানে বড়োমিয়ার যাওয়ার কথা নয়। কেন গিয়েছিলো আল্লাই জানে! মনে হয় মেয়ের জন্যে আড়ালে একটু চোখের পানি ফেলার জন্যে জায়গাটা নিরাপদ ছিলো। গোয়ালঘরে মশার কামড়ে ছটফট-করা গোরুদের দেখে বড়োমিয়া আর সহ্য করতে পারেনি। তার কাঠের খড়ম-পরা পা দিয়ে নাদুর পিঠে বড়োমিয়া এ্যাঁয়সা ১লাথি দিয়েছিলো যে, মাস দুয়েক সে আর পিঠ তুলতে পারেনি। আজ বুড়ো হয়ে মরতে বসেছে নাদু, তার সেই ব্যথা আজো তাকে ছেড়ে গেলো না। একটু আঘাত পেলে, পূর্ণিমায় অমাবস্যায়, অসময়ে বৃষ্টি হলে কি শীত পড়লে ব্যথাটা উসকে ওঠে। এ ঘটনা এখানকার প্রায় সবাই জানে। বড়োমিয়া নিজেও ২/১ বার বলেছে। আর নাদুর খুব প্রিয় প্রসঙ্গের মধ্যে এটি ১টি। ঘটনাটি বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলতো, নিন্দের মধ্যে খাব দেখবা নাগছি। কি? না, পাতারের মদ্যে গোরু খুঁজা বেড়াই। ধলা বকনাখান গো, বড়োমিয়ার খুব হাউসের বকনা, সেই বকনাক আর পাই না। ঘড়ি বাদ দেখি, পাতারের উত্তরে মস্ত বড়ো পিপুল গাছটার তলাত খাড়া হয় আছি,-ঝড় নাই, পানি নাই, মোটা একখান পিপুলের ডাল ভাঙা পড়লো হামার পিঠোত। ইটা কি বাবা চ্যাতন পায়া দেখি কোটে পাতার? কোটে পিপুলের ডাল? বড়োমিয়ার বোলআলা খড়মখান পিঠের উপরে। ঘটনাটা সে এমনভাবে বলতো যেন ঘুম ভাঙার পরেও সে স্বপ্লের মধ্যেই ছিলো। এই ব্যথাটিকে নাদু কতোদিন থেকে পুষে আসছে। মিছে কথা বলে লাভ কি? ব্যথাটাকে মূলধন করে বড়োমিয়ার করুণা সে কম আদায় করেনি। এই ব্যথা সারাবার জন্যে বড়োমিয়ার খরচ হয়েছে মেলা, কিন্তু বড়ো কথা হলো এই যে, ব্যথাটা ছিলো বড়োমিয়া ও তার মধ্যেকার সম্পর্কের প্রকাশ। যখনি তার ছটাইয়ের প্রশ্ন আসতে কিংবা ভিটা থেকে উচ্ছেদের সম্ভাবনা দ্যাখ্যা দিতো কি তার কাছ থেকে বর্গাজমি ছড়িয়ে নেওয়ার কথা উঠতো নাদু তখন উসকে তুলতো এই ব্যথাটিকে। বড়োমিয়া আস্তে আস্তে বলতো, থাকা কতোদিনের চাকর অর বাপও কাম করা গেছে। থাকা আহা, নাদুর দেহে বড়োমিয়ার এই চিরস্থায়ী স্পর্শ কি যেন তেন সম্পর্ক হলো? বড়োমিয়া মারা গেলে লাশের পাশে বসে নাদু কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছিলো, তোমার নথি হামার পিঠোতেই থাকলো গো বড়োমিয়া, তুমি কেটে চলা গেলা
কিন্তু এই লাথির মর্যাদা চেন্টু বুঝবে কোথেকে? বাপের হাতের রেঞ্জের বাইরে দাঁড়িয়ে সে বলে, পিঠতো ভাঙছে একজন, এখন বাকি আছে বুকখান। তুমি গাজীগোরে ঘরত যাও, খয়বার মিয়ার পাও আছে দুইখান, বুকখানা পাতা দিও, খাম করা দিবো বলতে বলতে সে চারদিকে একবার তাকায়, তারপর অপেক্ষাকৃত নিচু গলায় বলে, নথিগুড়ি যা খাবার চাও তাড়াতাড়ি খায় আসো। কুনদিন যায়া শুনবা ব্যাটার দুটা ঠাই ভাঙা দিছে, তখন নাথি দিবো কি দিয়া?
আশেপাশের সবাই একেবারে চুপ। জালাল মাস্টার এই নীরবতা ভাঙে, চেন্টু, মুখ সামলা। বিবেচনা করা কথা কোস! তোর ভাগ্যে কি যে আছে চিন্তা করলেও ভয় লাগে।
এর মধ্যে লোকও জমে গেছে। বেশির ভাগ চাষাভূষা মানুষ, মিয়াবাড়ির আলুর জমির কাজ সেরে কিংবা ধান মাড়াইয়ের কাজ করতে এসে জমায়েত হয়েছে। মিয়াবাড়ির ছেলে আছে কয়েকজন। এদের কেউ কেউ স্কুলে পড়ে। চাষা বা ভদ্রলোক সবাই চুপ করে জালাল মাস্টারের সতর্কবাণী শোনে। কঁঠালতলার পশ্চিমে ভাঙা দালানের স্তুপে বসেছে কয়েকজন। শীতের বেলা দেখতে দেখতে গুটিয়ে যাচ্ছে। একটু দূরের শিমুলগাছের ওপর থেকে ছাইরঙের ১টি ডানা যেন গাঢ় হতে হতে এগিয়ে আসছে এদিকে। দালানের ভাঙা শ্বপ রঙ পাল্টায়।
চেন্টু জবাব দেয়, মুখ সামলাবার হুকুম দিবেন আপনে কয়জনোক? হামি একলা মুখ সামলালে কাম হবো? ডাকাত-মারাচর তাই ভরা ফালাছে গোরু দিয়্যা, এতো গোরু গাজীর ব্যাটা পালো কোটে?
ছাইরঙ আরো গাঢ় হয়। মস্ত জোড়াদিঘির ওপারে মরিচের জমি, ছাইরঙের পাতলা অন্ধকারে পাকা মরিচের টকটকে লাল রঙ, হঠাৎ করে তাকালে, ছাইয়ের ভেতরকার আগুনের মতো ঝাণ্টা মারে। এদিকে ছেলের কথাবার্তা শুনে নাদু মাথায় হাত দেয়। অনেকক্ষণ পর স্বগতোক্তি করে, উগল্যান কথা কওয়া হয় না বাপ, মুখখান তোর বড়ো দুষমন ছেলেকে বাচাবার উদ্দেশ্যে সে চেষ্টা করে গাজীদের দোষক্ষালণের, গাজীগোরে বাথান কি আজকার? কতো ছোটো থাকতে হামরাই দেখছি, যমুনার এই চর, ঐ চর ব্যামাকই গাজীগোরে দখলে। কতো বাথান, কতো গোরু, কতো মোষ দেখছি মাটির ঠিলা ভরা দুধ আসছে। হামরাই তো দেখছি।
তার সমর্থনে আরেকজন কিষান বলে, গাজীগোরে বাথান ভরা গোরু মোষ কি গুনা শ্যাষ করা গেছে?
কিন্তু চেন্টু বলে, উগল্যান কথা থোও গো! আগে কার কি আছিলো হামরা কবার পারি না। এখন ডাকাত-মারা চরত যায়া দ্যাখো, ব্যামাক এই অঞ্চলের গোরু। গেরস্থের গোরুবাছুর সব আটকা রাখছে। চালান হয় পুবে, যমুনার ঐ পার। মাদারগঞ্জের হাটোত বেচা হয়। ডাকাত-মারা চর দখল করছে কেডা, তোমরা জানো না?
কথা বলতে বলতে চেংটু কখন যেন উঠে পড়েছে দালানের ভাঙা গুপে। আনোয়ার এবার ভালো করে তার দিকে দেখলো। আনোয়ারের দাদাজী মারা যাওয়ার ৩ বছর আগে এই বৈঠকখানা দালানে চিড় ধরে, নতুন করে তৈরি করার জন্য গোটা দালান ভেঙে ফেলা হয়। সেই বছর তার মৃত্যু হলো। এরপর আর কিছু করা হয়নি। চেন্টু সেই স্তুপের উঁচু চূড়ায় দিব্যি পা ঝুলিয়ে বসেছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৬

বুড়ো হয় গেলেন, তাও আপনের ইশ হলো না জামাই মানুষ, জামায়ের লাকান থাকেন। কোটে কেটা মার খালো, কোটে কেটা কার সাথে ঝগড়া-বিবাদ করে-সোগলির প্যাগনা কি আপনার ঘাড়তই তোলা লাগবো? তোমাক কই বাপু, সারাটা জেবন মানুষটা হামাক জুল্যা পুড়া কিছু খুলো না!
হ্যারিকেনের লালচে হলদে আলোয় কৈ মাছের কাটা বাছতে বাছতে আনোয়ার জালাল মাস্টারের বৌয়ের সংলাপ শোনে। জালাল মাস্টারকেও শুনতে হয়। তার স্ত্রীর বাক্যে সম্বোধন করা হয়েছে ২জনকেই। ভাত খেতে আনোয়ারের ভালোই লাগছে। লতায় পাতায় জড়ানা দূর সম্পর্কের এই ফুফুটা তার রাধে ভালো। তার কথা শুনতে শুনতে মনে হয় অন্যের জিভে সুখ দেওয়ার ব্যবস্থা করে নিজের জিভের সুখ ফুফু উসুল করে অন্যভাবে। জিভটা তার ভয়ানক সচল, ঘণ্টা খানেক হলো ফুফু তার সামনে আসছে, যাচ্ছে,-এর মধ্যে একনাগাড়ে ৫ মিনিটও বিরতি দেয়নি। আবার জালাউদ্দিনকেও আনোয়ার কখনো এতোটা বাকবিমুখ দাখেনি। স্বামীর এই নীরবতায় জালালউদিনের স্ত্রীর উৎসাহ মাঝে মাঝে বাড়ে, তখন তার কথা বেরিয়ে আসে তীব্র বেগে। আবার স্বামীর ঔদাসীন্যে মাঝে মাঝে তার রাগ হয়, তাতেও কথার বেগ বাড়ে।
‘খয়বার গাজীর সাথে আপনে সামাল দিব্যার পারবেন? এ্যাঁ, তুমিই কও তো বাবা? তাই বলে শয়ে শয়ে বিঘা জমির মালিক, যমুনার চর যেটি যা উঠবো ব্যামাক নিবো তাই। তাক আঁটো করবার চান আপনে? কোটে বলে মহারাজ আর কোটে কলাগাছ। আপনার সাহসটা এ্যাঁনা বেশি, বুদ্ধিটা যদি তার এক আনাও থাকলোনি তো—।’
জালাল মাস্টার আস্তে করে বলে, ‘খয়বার গাজীক আঁটো করে কেটা? সকল গ্রামবাসীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন করার জন্যে তিনি অস্থির তার সাথে আমার কিসের কলহ? কিসের বিবাদ? –
বিবাদ আপনে পাকান আসমানের মধ্যে আপনে টেকির পাড় দিবার চান।-বাবা, মাছ আরেকটা দেই? আনোয়ারের পাতে আরেকটা পাবদা মাছ দিয়ে ফুফু তার অসমাপ্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়, এই চেংটু ছোড়া গোলামের পয়দা গোলাম, এটা অতো লাফ পাড়ে কিসক? খয়বার গাজী এ্যাঁর পিছে লাগছে, এটাক শ্যাম্ব না করা তাই ছাড়বো? গাজীর ব্যাটার ভয়ে তার বাপ, তার জন্মদাতা বাপ তাক জায়গা দেয় না, সেই চেংটুক আপনে ঘরত তোলেন। এই সোস্বাদ পালে খয়বার গাজী আপনার কি দশা করবো তা জানেন?
জালালউদ্দিন একটু হাসি মুখ করে, মোসাম্মৎ রহিমা খাতুন, তোমার প্রথম কর্তব্য নিজের অজ্ঞতা দূর করা। না দেখ্যা, না শুন্যা, খালি আন্দাজে কথাবার্তা কলে বিবেচনার পরিচয় দেওয়া হয় না।
নাম ধরে ডাকায় রহিমা খাতুন লজ্জামিশ্ৰিত সুখে ও রাগে স্বামীকে ধমকায়, বুড়া হলেন আপনার আক্কেল হলো না। চ্যাংড়া প্যাংড়ার সামনে কি কয় না কয়- তার কথা আর শেষ হয় না, আঠালো শব্দে এই নিঃসন্তান প্রৌঢ়ার কণ্ঠ জড়িয়ে আসে, পান-খাওয়া ঠোঁটের কালচে খয়েরি কোণ দুটো বাঁকা হয়, বাঁকা হয়েই থাকে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে জালাল মাস্টার, নাদু আমাকে খুব ধরছিলো। এবার বর্ষ খুব প্রবল হলো তো, নাদুর একটা ঘর হেল্যা গেছে। গত বছর বড়ো ব্যাটার বিবাহ দিলো, ঘরের এক কোণে কলাপাতার বেড়া তুল্যা পুত্র পুত্রবধূ থাকে, আর বাকি কয় হাত জায়গাত থাকে নাদু, নাদুর পরিবার দুটা ব্যাটা, ছোটো বেটিও থাকে। নাদু কয়, সরকার, আপনার গোয়াল তো খালি থাকে, বকনাট মরার পর আর গোরু কিনলেন না, এড়াটাও বেচলেন, গোয়াল সাফ সুতরা করা নিয়া চেংটু কয়টা দিন থাকবো। ধান মাড়াইয়ের কামটা হলেই মিয়াবড়িত থাকা খ্যাড় নিয়া নতুন ঘর তুলমু। এই কয়টা দিন চেংটুক এ্যাঁনা জায়গা দেন।—তা কি করি। কল্যাম, থাকো বাপু বিপদে আপদে আশ্রয় দান মানুষের ধর্ম। না কি কও আনোয়ার?
এই বিবৃতিতে নিরঙ্কুশ আস্থা স্থাপন করা রহিমা খাতুনের পক্ষে মুশকিল। অবিশ্বাসে তার স্বর মৃদু হয়, বর্ষ গেছে চার মাস হলো, এই কয়টা মাস তারা থাকবার পারলো নাদুর বড়োব্যাটা বিয়া করছে এক বছরের উপরে, মরা একটা বিটিও হলো তার; আর এখন জায়গা নাজাই পড়ে চেংটুর, না?
জালাল মাস্টার এখন নীরব। দুধ দিয়ে কলা দিয়ে গুড় দিয়ে ভাত মাখার কাজে সে একাগ্রচিত্ত। রহিমা খাতুনের অবিশ্বাসী কণ্ঠ ক্রমে চড়া হয়। চেংটুকে রাত্রিবেলা থাকতে দিয়েছে কেন সে কি বুঝতে পারে না? খয়বার গাজীর লোক তাকে যে কোনো সময়ে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে—এ কথাটা কে না বোঝে? নেহায়েৎ মিয়াদের জমিতে থাকে, তাই দিনে দুপুরে তাকে তুলে নেওয়াটা দেখতে খারাপ লাগে, নইলে খয়বার গাজীর কাছে এটা কি কোনো শক্ত কাজ? খয়বার গাজীকে সে তার স্বামীর চেয়ে অনেক ভালোভাবে চেনে। তার আপন খালুর চাচাতো ভগ্নীপতির মামাতো বোনের শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে খয়বার কি তার মামা হয় না? খয়বার মামুর সম্পত্তির কথা, প্রতাপের কথা তারা শুনে আসছে জন্মের পর থেকে। তার সঙ্গে লাগতে যায় কোথাকার গোলামের বাচ্চা গোলাম চেংটু পরামাণিক। আবার সেই ছোড়ার সর্দার হয়েছে জালাল মাস্টার। চেন্টুর শয়তানিটা তার চোখে পড়ে না? তার মামার ভাইপো, সেও তো তার মামাতো ভাই হলো, তাকে কুকুর লেলিয়ে দেয় যে শয়তান সে কি-না নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করতে এসেছে তারই বাড়িতে? স্বামীর জন্য পান সাজতে সাজতে রহিমা খাতুন বিড়বিড় করে, খয়বার মিয়া হাজার হলেও একজন মানী মানুষ। আপনে যে এতোদিন মাস্টারি করলেন সেই ইস্কুলের জমি দান করছিলো কেটা? খয়বার গাজীর বাপ না? খয়বার মিয়ার বাপ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলো পুরা তিরিশ বছর। তাই নিজেও চেয়ারম্যানগিরি করছে দশ বছর; চেংটু লাগে তার সাথে?
জালাল মাস্টার বলে, ‘আরে মানী মানুষ, ভালো বংশের সন্তান, ঐ কারণেই মিটমাট করা ফালান দরকার। বোঝে না, গায়ের চাষাভুষারা কেমন বেয়াদব হয় উঠতিছে। চাষার রাগ, জাহেল মানুষের রাগ হলে কি হয় কেউ কবার পারে? তখন তোমার মামুই বেইজ্জত হবো! হবো না?
হলে হোক। রহিমা খাতুন ভাত খাবার থালা বাসন তোলে, তক্তপোষে বিছানা মাদুর, দস্তরখান তুলে ঝাড়ে আর বলে, তাই মানুষ হলো একখান বদের হাড্‌ডি! খয়বার গাজীক আমি চিনি না? আত্মীয় হলে কি হয়, হক কথা কতে দোষ কি? তাই কতো মানষের সর্বনাশ করছে তার ল্যাখাজোকা নাই। কতো মানুষ তাক শাপমণি দিছে! এই অঞ্চলের গরিব মানষের গোরু তাই সব নিয়া রাখছে চরের মধ্যে। এই মানুষের কিছু হলে আপনের কি? রহিমা খাতুনের এই পক্ষ পরিবর্তনে আনোয়ার হা হয়ে যায়। জালাল মাস্টার বলে, ‘খয়বার মিয়া অন্যায় যদি করা থাকে তো তাক ভালো করা বুঝায়া কলেই তাই বুঝবো। মানী মানুষটার বেইজ্জত করা কি সৎ কাম হবো?
বেইজ্জত কনকি? রহিমা খ্যাক করে ওঠে, মানষের সাথে তাই যা ব্যবহার করতিছে, সুযোগ পালে মানষে তাক পিস্যা খাবো, ছেচা খাবো। কল্যাম, এই কথাটা কল্যাম। দ্যাখেন, ঠিক হয় নাকি দ্যাখেন।’
উত্তেজিত হও কিসক? খয়বার মিয়া জেদি মানুষ। বড়োমানষের ব্যাটা, বড়োমানষের নাতি, শৈশবকাল থাকা যা কামনা করছে তাই তার হাতোত আসছে। জেদী হবো না? তাক সৎ পরামর্শ দিবার মতো মানুষের বড়ো অভাব!’
আপনের পরামর্শ তাই নিবো? আপনাক দুইটা পয়সার দাম দেয়? তার মান-সম্মানইজ্জত নিয়া আপনের লাগে কিসক, কন?
আনোয়ার জটিলতার মধ্যে পড়ে। জালাল মাস্টার খয়বার গাজীর মান-সম্মান নিয়ে এতো মাথা ঘামায় কেন? রহিমা খাতুন হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বাবা রাত হছে, তোমায় চাচা চাচী আবার অস্থির হয় পড়বো। এই মানষের পাল্লায় পড়লে রাত ভর খালি গল্পোই করবো! আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। বারান্দা থেকে নিচে নামতেই মনে হলো যেন সর-পড়া পুকুরে লাফ দেওয়া হলো। জালাল মাস্টার বৌকে ডাকে, ক্যাগো, দুয়ার দাও। একটু আগায়া দিয়া আসি৷ না না, আপনি যান। আমি একাই যেতে পারবো। আনোয়ার ভদ্রতা করে বলে বটে কিন্তু বাইরে বেশ অন্ধকার। চাঁদ উঠেই ডুবে গেছে, তারার আলো ততো স্পষ্ট নয় বলে উঠোনের শূন্যতা তবু একটু সহনীয়। চাঁদের আলো থাকলে এই উঠান থেকে শুরু করে সামনের শূন্য ধানজমি পর্যন্ত খ খ করতো। অন্ধকারের জন্য ফাঁকা ফাকা ঠেকে না, কিন্তু আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত বিপুল জায়গা জুড়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তা।
বারান্দার ওপর থেকে রহিমা খাতুন বলে, কিষানপাট কেউ নাই? নিওড়ের মধ্যে হাঁটাহাটি করা অ্যাস আপনে দম নিবার পারবেন? তখন বুকত তাল মালিশ করবো কেটা? তামামটা দিন হামি চোকির সাথে পিঠ ঠেকাবার পারি নাই, আবার রাত ভরা আপনের খেদমত করা নাগবো? হামার নিন্দা পাড়া নাগে না?
আনোয়ার বিব্রত হয়, আপনার শরীর খারাপ, আপনি বরং শুয়ে পড়েন।’ এই সময় অন্ধকারে খড়ের গাদার আড়াল থেকে শোনা যায়, ‘আপনে ঘরত থাকেন, হামি যাই।’
‘কেটা? কথা কয় কেটা? রহিমা খাতুন চমকে ওঠে, কেটা গো? হামি চাচী। গায়ে কথা-জড়ানো চেংটু এগিয়ে আসে। ‘তুই’ ছু আনোয়ারকে দেখিয়ে চেন্টু বলে, তাই একলা যাবো, তাই উঠা আসলাম। চেংটুর কথায় জালালউদ্দিন হা হা করে ওঠে, ‘তুই যাবু? তোর প্যাট কানা করা দিবো না? তোর সাহস বেশি হছে, না?
রহিমা খাতুন শান্ত গলায় হুকুম দেয়, চেংটুই যা। চ্যাংড়াক ঘরোত দিয়া আয়। দেরি করিস না বাবা!

রাত্রি ১০টায় মনে হচ্ছে গভীর রাত্রি। জালাল মাস্টারের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি যেতে ছোটোখাটো একটা গ্রাম পেরোতে হয়। এই গোটা গ্রাম জুড়ে ওদের আত্মীয়স্বজন, ওদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি। বাড়িঘর সব হাতের ডানদিকে। বেশির ভাগই টিনের ঘর, মাঝে মাঝে একতলা দালান। কারো কারো বৈঠকখানায় খড়ের পুরু ছাউনি। তারার খুব আবছা আলোয় রাস্তা কোথাও চওড়া হয়ে যায়, কোথাও গাছপালার ছায়া পড়ায় সঙ্কীর্ণ হতে হতে পরিণত হয়েছে সরু রেখায়। মাঝে মাঝে কারো বাশঝাড়ের কয়েকটা বাঁশ নুয়ে পড়ায় একেকটা তোরণের মতো হয়েছে। বাঁদিকের জমির কোথাও কোথাও ধান কাটা হয়ে গেছে, সেখানে কেবল কুয়াশা। কোনো কোনো জমিতে মরিচ গাছ। ডানদিকের উঠানগুলোতে লাল মরিচ বিছানো, টিনের ছাদে ছাদে পাকা মরিচের লাল রঙ, লাল রঙের বিছানা। অন্ধকারেও লাল রঙ একটু আলাদা। অন্ধকারের কালো রঙ ও মরিচের লাল রঙ ছাপিয়ে ওঠে ভয়াবহ নীরবতা, এই গ্রামে কি ঝিঝি পোকাও ডাকে না? চেংটু হেঁটে যাচ্ছে সামনে, গায়ে তার টুটাফাটা কাঁথা, এই কথার নিচে একটুও না কেঁপে কি করে যে শীত ঠেকায় সে-ই জানে। এই সব কাথায় দুর্গন্ধের আর শেষ থাকে না। নিজের নাকটাকে আনোয়ার এখন পর্যন্ত ঠিক আয়ত্তে আনতে পারেনি, ইচ্ছা করেই তাই সে একটু তফাতে হাঁটে। কোনো কোনো বাড়ির উঠান থেকে নতুন সেদ্ধ-করা ধানের গন্ধ পাকা মরিচ বা অন্য কেনো কিছুর গন্ধের সঙ্গে মিশে এদিক ওদিক ভাসে। এই শীত, এই বিচিত্র গন্ধ, এই আবছা আলো—সব কিছুই নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা যেতো। কিন্তু চেংটুর সাঙ্ঘাতিক নীরবতাকে জেদ বলে মনে হওয়ায় আনোয়ারের সারা শরীরে তেতো স্বাদ। তার রাগ হয়। চেংটুক এই জেদ কি শোষিত মানুষের ডিফেন্স? আনোয়ারকে সে তার প্রতিপক্ষের লোক ভাবে নাকি? কেন? আদর্শ কিংবা রাজনীতি যদি ছেড়েও দেওয়া যায়,–সবাই শেষ পর্যন্ত এসব বহন করতে পারে না,-কিন্তু আনোয়ারের রুচির ওপর তো তার আস্থা থাকা উচিত। খয়বার গাজীর মতো আনোয়ার কি কখনো কোনো নিঃস্ব মানুষকে সর্বস্বাস্ত করার ফন্দি আঁটতে পারে? মিয়াবাড়ির ছেলে বলে সে কি চেংটুর কাছে সন্দেহজনক চরিত্র? তাহলে মাস্টার? জালাল মাস্টারের কাছে আশ্রয় চাইতে চেষ্ট্রর ভয় হয় না। জালালউদ্দিন কি খয়বার গাজীর ইজ্জতের বাহার ঠিক রাখার জন্য উদগীব নয়? চরম সঙ্কটের সময় সে কি চেন্টুর পক্ষে থাকবে? তবে? রাজনৈতিক শিক্ষা নাই বলে চাষা ও দিনমজুর মানুষ চিনতে ভুল করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আনোয়ারের ক্ষোভ দূর করতে পারে না। ক্ষুব্ধ শরীরে হাটতে হাটতে সে শোনে, কেটা যায়?
ডানদিকে জুম্মার ঘরের পাকা দালান। দালানের উঁচু বারান্দায় বসে-থাকা ১টি মানুষের অস্পষ্ট কাঠামো। কয়েক পলক পর বোঝা যায় লোকটি অজু করছে। বদন হাতে রেখে লোকটি ফের জিগ্যেস করে, কেটা যায় গো! চেংটু জবাব দেয়, হামরা হুজুর।’
হামরা কারা? লোকটির মোটা স্বর একটু সন্দেহপ্রবণও বটে, নাদুর ব্যাটা না? কোটে যাস? চেংটু থামে না, এমনকি তার পদক্ষেপও ধীরগতি হয় না।
বদনা হাতে লোকটি জানতে চায়, সাথে কেটা রে? দাঁড়িয়ে আনোয়ার জবাব দেয়, জী, আমার নাম আনোয়ার।’ চেংটু চাপা গলায় বলে, পাও চালান ভাইজান। চেচিয়ে আনোয়ারের পরিচয় দেয়, বড়োমিয়ার নাতি।’
লোকটি শব্দ করে কুলকুচো করে। এর মধ্যে ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। হাটতে হাটতে আনোয়ার বলে, কে চেংটু? ‘কারী সায়েব। ‘কে? ‘কারী সায়েব। জুম্মাঘরেত থাকে। কোরান শরীফ পড়ে। এক বছরের উপরে মোয়াজ্জিন গেছে বাড়িত, কারী সায়েব আজানও দেয়। কয়েক পা হেঁটে চেন্টু বলে, এমনি মানুষ ভালো। কিন্তু দোষের মধ্যে ঐ একটাই।’ বলতে বলতে সে হাসে, ‘খালি কথা কয়। হয় কোরান শরীফ পড়বো, না হলে কথা কবো। মুখ বন্ধ হয় না। একবার টাডনেত যাবো, কথা কতে কতে মটর চল্যা গেছে, দিশা পায় নাই। বাকসো সামান আছিলো মটরের মদ্যে, আর পায় নাই। চেংটু বেশ জোরে হাসে, আনোয়ারও হাসে। একটু বেশিই হাসে।
সেই হাসিটা ঠোঁটে সেঁটে রেখে বা দিকে তাকালে দ্যাখা যায় বেশ বড়ো একটা মজা পুকুর। পুকুরটা আনোয়ার ভালো করে চেনে, এর নাম বৈরাগীর দিঘি। বৈরাগীর দিঘির পর বিঘা তিনেক চাষের জমি, তারপর অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে এই জমি যেন হঠাৎ করে ফেঁপে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। না। ভুলটা আনোয়ারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভাঙে। অন্ধকার রাত্রে বৈরাগীর ভিটার বটগাছের অদ্ভুত জবুথবু চেহারা হয়েছে! দিনের বেলা এই গাছের কি গম্ভীর মূর্তি। চারদিকে ছড়ানো শিকড়বাকড়ের মধ্যে তার বিস্তৃত ও বর্ধমান রূপ দেখে সবাই মোহিত ও ভীত হয়ে পড়ে। পুরো সাড়ে তিন বিঘা জমি গ্রাস করার পরও তার থামবার লক্ষণ নাই, সে কেবল বেড়েই চলেছে। আরো তিন বিঘা জমি পেরিয়ে এই দিঘি পর্যন্ত পৌঁছলে হয়তো তার সম্প্রসারণের পিপাসা মিটবে। জমাট-বাধা অন্ধকার আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লে আনোয়ারের চোখে বটগাছের চেহারা নির্দিষ্ট আকার পায়। সমস্ত শরীরটাকে গুটিয়ে ফেলে বটগাছ যেন ঘুমাচ্ছে। নিশ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা তার শরীরে স্পষ্ট। প্রাচীন বটবৃক্ষের এই বিশ্রামের দৃশ্যে অভিভূত আনোয়ার একটু পিছিয়ে পড়েছিলো। চেন্টু বলে, পাও চালান। পা চালিয়ে চেন্টুর পাশে এসে পড়লে সে জিগ্যেস করে, আপনে ঢাকাত যাবেন কোন দিন?
ঠিক নাই। কয়েকদিন থাকবো, বেশ কয়েকদিন। কেন? না, এমনি!’ কিছুক্ষণ পর চেংটু ফের জানতে চায়, জালাল মিয়া কয় আপনে বলে সংগ্রামের একজন নেতা? ইস্কুল কলেজের চ্যাংড়া প্যাংড়া আপনাক খুব মানে, না? মিছিল বার করলেই তো পুলিশ গুলি করে। ছাত্রগোরে ভয়ডর নাই, না?
এই চাষা ছেলেটির কাছে তাকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে জালাল মাস্টারের ওপর তার রাগ হয়। জালাল মাস্টার হয়তো তাকে ভালোই বাসে। জালাল মাস্টার আবার খয়বার গাজীর জন্যে তাকে ব্যবহার করছে না তো? আসল কথাটা বলা দরকার। কিন্তু কি করে বলবে? সে জবাব দেয়, রাজনীতি তো করিই। কিন্তু নেতাগোছের কেউ নই। নেতা হওয়ার জন্য আমরা রাজনীতি করি না।’
তাহলে? কিসের জন্যে করেন? চেংটুর এই প্রশ্নে কোনো শ্লেষ নাই, তার কথার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় যে, নেতৃত্ব অর্জন ছাড়া রাজনীতিতে তৎপর লোকজনের আর কি লক্ষ্য থাকতে পারে সে জানে না। এই লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করার মধ্যে চেংটু দোষেরও কিছু দেখতে পায় না।
আনোয়ার বলে, রাজনীতি ছাড়া মানুষ ভালোভাবে বাচতে পারে না। রাজনীতি ছাড়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ, মানে একতাবদ্ধ, মানে একজোট হবে কি করে? কিসের জোরে? একজোট না হলে ধরে খয়বার গাজীর মতো লোকদের তোমরা ঠেকাতে পারবে?—খুব চেষ্টা করেও কথাগুলো এর চেয়ে সহজ করে বলা গেলো না। আর কিভাবে কথাটা পরিষ্কার করা যায় আনোয়ার তাই ভাবে। কিন্তু তার কথার মাঝখানে চেংটু বলে, ‘আলিবক্স ভাই কয়, আর বেশিদিন লাগবো না। হামাগোরে গাওত হামরা বিচার বসামু!
‘আলিবক্স?
‘চেনেন না, না? সিন্দুরিয়া চরের। শঙ্করপুর চেনেন তো? শঙ্করপুর ভাঙলে পরে পুবে সিন্দুরিয়া চরে উঠছে। মাদারগঞ্জ কলেজত পড়ে। সিন্দুরিয়াত আদালত বসছিলো, মেলা কিষানপাট জড়ো করা ডাকাত-মারা চরত গেছিলো। যাগোরে গোরু চুরি হছিলো, সোগলিক নিয়া গেছিলো, সোগলি ঠিক করছিলো খয়বার গাজীর বাগান থাকা গোরু নিয়া গোরুর মালিকগোরে ফেরত দিবো।’
পারেনি?’
না। খয়বার গাজীর মানুষ মেলা, হাতিয়ারও মেলা। আলিবক্স ভাই কুলাবার পারে নাই, নাও নিয়া আবার সর্যা গেছে। তবে চেংটু এতে হতাশ নয়। কয়বার ঠেকাবো কন? এই শালা খয়বার গাজী মানষের পয়দা না। কতো গরিব মানুষের উজিওজগার তাই বন্ধ করা দিছে! গোরু হারালে চাষামানুষ কাম করবার পারে? হামরা আর বিচার করমু। অর ভাইয়ের ব্যাটা আফসার গাজী, মিয়াবাড়ির অশিদুল, ফকিরবাড়ির ফরিদ,-সোগলির বিচার হবো। আফসার শালা আছে খালি মাগীমানষের পাছত, চাষাভূষার ঘরত এ্যাঁন সুন্দর মাগীমানুষ দেখলে তাই খালি ফাল পড়ে। আর শালা অশিদুল করে কি জানেন?—এক জমিত কাকো তাই দুই তিনবারের বেশি বর্গ করবার দিবো না। শালা এক জমি পাঁচজনের কাছে বর্গ দেয়, বর্গাদাররা কাইজা করে অশিদ মিয়া মজা মারে। তাই—। চেংটু হঠাৎ থেমে যায়। তার কি মনে পড়ে গেছে যে, রশিদুল হক লোকটি আনোয়ারের বাপের চাচাতো ভাইও বটে? আরে বাবা, তাতে আনোয়ারের কি? রশীদ মিয়া পুরা টাউট, ঢাকায় গিয়ে আনোয়ারের মাকে পটিয়ে ১০০টা টাকা বাগিয়ে এনেছিলো, সেই ব্যথা আম্মা এখন পর্যন্ত তুলতে পারেনি।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, কারা বিচার করবে?
হামরাই। হামি আলিবক্স ভাইয়েক কছি, বৈরাগীর ভিটার বটগাছের তলাত আদালত বসবো, বিচার হবো ওটি!
আনোয়ার উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে, সত্যি?
হামি মিছা কথা কইনা ভাইজান চেংটুর গলায় তলানি পড়ে। সে ফের চুপ করে যায়। আনোয়ারকে সে ঠিক বুঝতে পারে না কেন? নিজেকে ঠিকমতো প্রকাশ করার জন্যে আনোয়ার ছটফট করে, নানাভাবে সে শব্দ খোজে, বাক্য ঠিক করে, কিন্তু কিছুঁতেই সম্পূর্ণ তৈরী হতে পারে না। এইরকম ভাবতে ভাবতে একবার বলে, বিচার করাই দরকার। আমাদের দলের ছেলেরা, এইতো কাছেই, সিরাজগঞ্জ মহকুমা চেনো?-সিরাজগঞ্জের গ্রামে গণআদালত করেছে। কিন্তু এখানে তো আবার ভদ্রলোক, মানে জোতদার, মানে অবস্থাপন্ন লোক বেশি, এখানে গণআদালত করা কি সুবিধা হবে?
না, এটি বড়োলোক বেশি কৈ? এই কয়টা ঘরই আপনার চোখত পড়ছে? মাঠের ঐপারে তো সোগলি হামাগোরে চাষাভূষার গাও। ঐ যে বটগাছের ঐপারে জমি– ‘ বটগাছের মাথার দিকে তাকিয়ে চেংটু হঠাৎ নীরব হয় এবং থমকে দাঁড়ায়। আনোয়ার জিগ্যেস করে, কি হলো?
চুপ করেন!
চারদিকে ভয়াবহ নীরবতা। চেংটুর চোখ বটগাছের মাথার ওপর। সুতরাং সেদিকেই না তাকিয়ে আনোয়ারের উপায় নাই। সেখানে কি? কুয়াশা টাঙানো বটগাছ যেন সমস্ত প্রান্তর জুড়ে রাজত্ব করে। তার চোখের পলক পড়ে না। বটগাছের ঝাঁকড়া মাথায় চেংটু কি দেখছে? টিনের কি খড়ের চাল ও উঠান থেকে পাকা মরিচের গন্ধ আসছিলো, সুযোগ পেয়ে তাও শালা উধাও। সেদ্ধ-করা ধানের সুবাসও কি হাওয়া হয়ে গেলো? কান দুটোও মনে হয় বটগাছ দ্যাখার কজে নিয়োজিত। এখন যাবতীয় আওয়াজ লুপ্ত। গাছ থেকে শিশিরবিন্দু পড়ার মৃদু, অতিমৃদু ধ্বনিটুকুও লুফে নেয় শীতের শুকনা মাটি। আনোয়ারের বুকে টিপটপ আওয়াজ হয়, তাও তার সমস্ত বোধের বাইরেই থাকে। এইভাবে কতোক্ষণ কেটে গেছে আনোয়ার জানে না। হঠাৎ শুনলো, চলেন।
কোনো কথা না বলে দুজনে চলতে শুরু করলে চেন্টু বলে, উড়া গেলো, দেখলেন? কি?
দেখলেন না? ঐ পুবকোণের মগডাল থাকা একটা উড়াল দিলো, সোজা উত্তরের মুখে গেলো, দেখলেন না?
কি গেলো? কি?’
চেন্টু চুপ করে থাকে, আনোয়ার অস্থির হয়ে ওঠে, কি?
আত্রে নাম নেওয়া হয় না, আত্রে তেনাগোরে নাম নেওয়া মানা।
আনোয়ারের সারা গা ছমছম করে উঠলো। চেংটুর পিঠে ডান হাত রেখে তার কাঁথা খামচে ধরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, ‘জীন?
চেন্টু বলে, কল্যাম না? আতোত নাম নেওয়া হয় না। হাটতে হাঁটতে আনোয়ারের মুখের দিকে তাকায়, ভয় পালেন?
না? আনোয়ার একটু হাসার চেষ্টা করলে তার মুখের অসহায়ত্ব আরো প্রকট হয়, তবে অন্ধকারে তাও অদৃশ্যই থাকে। কিন্তু তার পিঠের ওপর আনোয়ারের হাত চেষ্ট্রকে সব বুঝিয়ে দেয়। চেংটু নরম করে বলে, ভয় করেন কিসক? কিছু কবে না। এটিকার পুরানা বাসেন্দা। কাকো কিছু কয় না।
শুকনা কাটা-কাটা টোক গিলে আনোয়ার বলে, থাকলে তো বলবো’ অশরীরী জীবের অস্তিত্বের প্রতি আনোয়ারের এই অবিশ্বাস ঘোষণা এতো ক্ষীণ যে, প্রায় শোনাই যায় না। অথবা শুনতে পারলেও চেন্টু পাত্তা দেয় না। খুব স্বাভাবিক গলায় সে বলে, অনেকদিনের বাসেন্দা। মুরুব্বিরা কয়, তার সবই ভালো, যতো কিছুই হোক এটিই থাকে। নড়ে না। খালি বিবাদ দেখলে তার গাও জ্বলে। বিবাদ তাই সহ্য করবার পারে না।
বিবাদ ?
ছু বিবাদ! গায়ের মদ্যে গোলমাল কি ঝগড়া-কাজিয়া, বিবাদ-বিসম্বাদ, লাঠালাঠি, মারামারির দিশা পালে উত্তরের মুখে তাই উড়াল দেয়!
উত্তরে?
ছু ছোটো থাকতে দাদার কাছে শুনছি চান্দের পয়লা সাত দিনের মধ্যে বৈরাগীর ভিটার বটৰিরিক্ষের এই পুরানা বাসেন্দা উত্তরের মুখে উড়াল দিলে গায়ের মানুষ ভয়ে সিটকা নাগছে, বড়োলোকরা মিলাদ দিছে, শিরনি দিছে, মানত করছে। জুম্বার ঘরত নফল নামাজ পড়ছে।
এবার হবে না?
আপনাগোরে বাড়িত একবার ডাকাত পড়ছিলো, আপনার দাদার আমলে। হুনছি তার সাতদিন আগে পুরানা বাসেন্দা এই জায়গা ছাড়া চলা গেছিলো।’
‘তো এবার মিলাদ দেবে না? নফল নামাজ পড়বে না? আনোয়ার বেশ সহজ হয়ে আসছে, তার কথায় ভয়ের জায়গায় ঠাট্টার একটুখানি ঝাপ্টা লক্ষ করা যায়, মিলাদ না দিলে আবার ঝগড়া বিবাদ লাগতে পারে না?
চেংটু বলে, কেউ দেখলে তো দেখছে কেটা? আপনেও তো দেখলেন না?
তুমি দেখেছে। তুমি বললেই সবাই জানবে। কাল তুমি সবাইকে বলবে না? চেন্টু হটতে হাটতে বলে, হামার গরজ? চেষ্ট্র ফের চুপ করে থাকে। ১টা ২টো ৩টে ৪টে ৫টা ৬টা ৭টা ৮টা কদম ফেলা হয়, ছেলেটা আর কথাই বলে না। এদিকে মানুষের কথা ছাড়া আনোয়ারের গতি নাই, ওপরে তাকাতে সে ইতস্তত করে: কি জানি মাথার ওপর বিশাল শূন্যতায় কেউ হয়তো দীর্ঘ অগ্নিময় উড়াল দিচ্ছে। সেই উড়ালের হিসহিস ধ্বনি না শোনার জন্যে কানজোড়া তার বন্ধ রাখা দরকার। চেন্টুটা দিব্যি সামনে সামনে হেঁটে চলেছে, এর পরেও তার পাটলে না। চেন্টুর কথায় যা হয়নি, ওর নীরবতায় বটগাছের অশরীর জীব প্রতি মুহুর্তে আকৃতি পাওয়ার পায়তার করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অদৃশ্য বলে সেগুলোকে হাত পা মুণ্ডু বলে সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু চেন্টুর এই নীরবতা অব্যাহত থাকলে আনোয়ারের সামনে সশরীরে আসতে জীনের আর কতোক্ষণ আনোয়ারের রাগ হয়, অশিক্ষিত মূৰ্খ ছোকরা কুসংস্কারের ডিপো। কিন্তু বিভ্রম দ্যাখার জন্যে চেংটুর ওপর এই রাগ তেমন জমে না। বরং প্রতিটি নীরব পদক্ষেপে তার নিজেরই জীন দ্যাখার সম্ভাবনা বেড়ে চলে। তখন চেংটুর দ্যাখা এই বিভ্রম থেকে রেহাই পাবার জন্য শ্লেষখচিত কণ্ঠে আনোয়ার বলে, ‘জীন উড়াল দিলো, সবাইকে খবর দিতে হবে না? ঝগড়া বিবাদ হলে সকলেরই বিপদ।
কিসক? চেংটুর কথায় পাল্টা ক্রোধ। ঠাট্টাবিদ্রুপ বোঝা এই ইডিয়টটার সাধ্যের বাইরে। ঠাট্টার জবাবে রাগ না করে করবেটা কি? সে বলে, ‘সোগলির বিপদ হবো কিসক? হামাগোরে আবার বিপদ কি? হামাগোরে জমি নাই, জিরাত নাই, ঘর নাই, ভিটা নাই, ধান নাই মরিচ নাই,-বিপদ বিসস্বাদ হলে হামাগোরে নোকসান কি?
জীনের উড়াল দেওয়ায় বিভ্রমটার ওপর কতো আস্থা থাকার ফলে ছোকরা পরম বিশ্বাসের সঙ্গে এরকম ভবিষ্যৎ বাণী ছাড়ে। আনোয়ারের পক্ষে এখন এমনকি সামনে তাকানো পর্যন্ত মুশকিল। উত্তর কোনদিকে দিক জানা থাকলে চোখে সামলানো সহজ হতো। এখন মনে হয় শালা সবদিকই উত্তর! সবদিকেই বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দার দীর্ঘ উড়াল। প্রায় জোর করে আনোয়ার বলে, দ্যাখে চেন্টু জীন টিন কোনো কথা নয়। কিছু করতে হলে নিজেদেরই করতে হয়। জীন কি সাহায্য করতে পারে? খুব জোর দিয়ে বললেও ওপরদিকে তাকাবার মতো বল আনোয়ার পায় না।
চেন্টু বলে, সাহায্য করবো কিসক? আগুনের জানতো, তাই সোম্বাদ পায় আগে। ২জনে ফের চুপচাপ হাঁটে। আপনে? হঠাৎ চেংটুর গলা শুনে চমকে উঠে আনোয়ার চোখ বন্ধ করে, এক পলকের জন্য মনে হয়, উড়াল-দেওয়া জীন কি ডাঙায় এসে নামলো? তবে মুহুর্তের মধ্যে কাঁঠালতলায় গায়ে শাল জড়ানো এবং মাথা ও কানে মাঙ্কি ক্যাপ পরা বড়োচাচাকে চিনতে পেরে আনোয়ার বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ে। এবার সে মহা ডাটে তাকায় ওপরের দিকে। ওপরে কাঁঠালগাছের ঝাঁকড়া মাথা। আর কি? কুয়াশার মসলিন মোড়ানো তারা বসানো আকাশ। শীতের রাত্রে গ্রামের আকাশ বড়ো মোলায়েম।
বড়োচাচা বলে, এতো রাত করলি?
এই শীতের রাত্রে বড়োচাচা একা দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রতীক্ষা করছে। বড়োচাচা কাউকে ডেকে বলে, তুই এখন যা। রাত হছে।’
আবার কে? ভাঙা দালানের স্তুপের আড়ালে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে? ১টা হাফ-হাতা জামার ওপর হাতজোড়া বুকে আড়াআড়িভাবে রেখে লোকটা শীত ঠেকাবার চেষ্টা করছে। বড়োচাচার লম্বা চওড়া কাঠামোটার পেছনে যেতে যেতে এবং ইচ্ছামতো উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম-আকাশের সবদিক দেখতে দেখতে আনোয়ার শোনে যে, লোকটা চেংটুকে বলছে, তুই আসছস? মাস্টারের বাড়িতে তোক রাখা হলো কিসক? তোর বুকের বল বেশি বাড়ছে, না? এই সব বাক্যের আওয়াজ চাপা, কিন্তু স্বর বেশ ভারি। এ তো নাদু পরামাণিক নাদু এতোক্ষণ ধরে পাহারা দিচ্ছিলো বড়োচাচাকে। আর তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এলো নাদুর ছেলে। চেংটুর কাছ থেকে ভালো করে বিদায় করে বিদায় নেওয়া দরকার। পেছনে তাকালে চোখে পড়ে যে, বাপ ব্যাটা ২জনে ২দিকে চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চেংটু জোড়াপুকুর পার হয়ে গেলো। আবছা আলোয় মনে হয় চেংটু যেন পায়ে পাল খাটিয়ে নিয়েছে। না, তার ছায়া পর্যন্ত এখন দ্যাখা যাচ্ছে না।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৭

দুপুরবেলা ভাত খেয়ে আনোয়ার আবিষ্কার করলে যে, সিগ্রেটের স্টক প্রায় শেষ। সিগ্রেটের কথা বলতে মন্টু প্রস্তাব করে, আজ বিকালে চন্দনদহ চলেন।
সিগ্রেট কিনতে দুমাইল যাবো? জালাল ফুপার বাড়ির সঙ্গে ছোটো দোকানটা থেকে নিয়ে আয় না!
দূর ওখানে তিন মাসের বাসি সিগারেট। চন্দনদহ বাজারে আজ যাত্রা আছে। যাত্রা দেখবেন? আব্বাকে বলেন, আপনি গেলে আমাকেও যেতে দেবে।
সিরাজগঞ্জের নামকরা অপেরা পার্টি। চন্দনদহের নতুন কলেজের ফান্ড তৈরির জন্য সিরাজদ্দৌলা পালার আয়োজন। ঐ অপেরা পার্টির আরো ভালো ভালো পালা আছে, কিন্তু কলেজের সাহায্যে টাকা তোলা হচ্ছে, যে সে বই হলে চলে না। স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল করে যাত্রা, চারদিকে বাশের বেড়া। সামিয়ানার নিচে চাটাই পেতে খড় বিছানো রয়েছে, মঞ্চের সামনে তিন সারি চেয়ার। আনোয়ারকে খাতির করে সামনে বসতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু বিনয় করে সে বসেছে দ্বিতীয় সারিতে। ওর পাশের চেয়ারে মন্টু। কয়েক মিনিট পর আফসার গাজী টুকতেই সামনের সারির অনেকেই উঠে দাঁড়ালো। আফসার ১টা চেয়ারে বসে পাশের লোকটিকে বলে, ‘প্রিন্সিপ্যাল সায়েব বসেন। তারপর কার কথা শুনে সে তাকালো পেছনে, আনোয়ারকে বলে, ‘আকবর চাচার ব্যাটা না? আরে সামনে এসো, সামনে এসো। বসে বসেই আনোয়ারের হাত ধরে তাকে সামনের সারিতে টেনে আনে, প্রিন্সিপ্যাল চালান হয়ে যায় দ্বিতীয় সারিতে আনোয়ারের চেয়ারে। আনোয়ার ভালো করে আফসারকে দ্যাখে, এই লোকটিকেই চেংটু কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলো! লোকটা খুব মিশুক, আবার এক আধ পাইট টেনেও এসেছে। মঞ্চের চেয়ে আনোয়ারের দিকেই তার মনোযোগ বেশি, তুমি আমার চেয়ে অন্তত দশ বারো বছরের জুনিয়ার তো হবেই। তোমার বড়োভাইও আমার জুনিয়ার।’ বলে সে হাসে। তারপর আনোয়ারের ডান হাতটা নিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দেয় তার কোটের পকেটে, আনোয়ারের হাত ঠেকে একটা বোতলে, পাইটের সাইজের বোতল। আফসার তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, চলবে?
তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলে, কেরুর সিংহ মার্কা এখানে?’ – আনোয়ারের অবাক-হওয়া দেখে সে হাসে, ক্ষতি কি? কে কি বলবে? এখানে না চাইলে বাইরে চলো, বাজারে আমার রাইস মিল। বাসাও আছে।’
আনোয়ার না করলে লোকটা বলে, বুঝছি! বাড়িতে তো আসো না, বাড়ি এসে ক্যারেক্টারটা দ্যাখাতে চাও একেবারে ধোপাবাড়ির ইঞ্জি-করা শার্ট ভালো! ভালো! আমরা ভাই গ্রামেই থাকি, ভালো কও, মন্দ কও, দরবেশ কও, লোফার কও-সব খোলাখুলি, ওপেন টু অল –না কি কোস রে আবুলের বাপ? কিন্তু তার পায়ের সামনে নিচে বসা লোকটি কিছু না বলায় সে ধমক দেয়, ক্যারে শ্যালা, কথা কোস না কিসক? এতেও আবুলের বাপ সাড়া না দিলে সে বলেই চলে, তোমারা আসো দেশ দেখতে, এ্যাঁ? দুদিন থাকবে, চাষা-ভূষাদের উস্কে দিয়ে ঢাকা যাবে, ঢাকায় সব বড়ো বড়ো হোটেল, বার তো আছেই, না কি বলো?
লোকটা একনাগাড়ে কথা বলেই চলে। একটু টিপসি হলেও কথাবার্তা কিন্তু বেসামাল নয়। এদিকে পালা যে কখন শুরু হবে কিছু বোঝা যায় না। স্টেজে ১টি মেয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফায়, তার লিকলিকে পা ২টো চোপ্ত পাজামায় মোড়ানো, মাংসহীন, উরু ও পাছা নিয়ে সে কতোরকম ক্যারদানি মারে, দেখে মেয়েটার জন্যে আনোয়ারের খারাপই লাগে, পায়ের ব্যথায় বেচার রাত্রে ঘুমাতে পারবে কি-না সন্দেহ। রোগ পটকা মেয়েটার বুক বেঢপ রকমের উঁচু, গ্যাটিস-মারা স্তন দুটো সে এমনভাবে এগিয়ে ধরে যে, যে কেউ হাত দিলে তার ভেতরকার কাপড় না হার্ডবোর্ড সব বেরিয়ে পড়তে পারে। স্নো পাউডার ও রুজের পলেস্তারার নিচে তার মুখের বসস্তের দাগ হাজাগের চড়া আলোয় অনেকগুলো কুতকুতে চোখের মতো পিটপিট করে। আফসার গাজীর দিকে চোখ রেখে তার শরীরের ব্যস্ত তৎপরতা পরিচালিত হয়। চোখের ইশারায় আফসার একবার দেখিয়ে দেয় আনোয়ারকে, কি গো সুন্দরী, আমার ভাইটাক চোখত পড়ে না? ভালো করা নাচ ঢাকার নেতামানুষ, একদিন মন্ত্রী হবো, দেখিসা তারপর আনোয়ারের দিকে ঝুঁকে সে বলে, তুমি তো ভাই রাজধানীর মস্তান, বলে তো ভালো মাল পাওয়া যায় কোথায়? বলে তো?-পারলে না?– বাদামতলী বলো, কান্দুপট্টি বলো, কুমারটুলী বলো, গঙ্গাজলী বলো,-নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের কাছে এসব একেবারে নস্যি। আর লাহোর যদি যাও তো এসব মনে হবে চুলার লাকড়ি। লাহোর কলকাতা কিছু বাকি রাখিনি। হীরামন্ডি কও, সোনাগাছি কও-পাকিস্তান হিন্দুস্থান সব চষ্যা বেড়ছি! কথার তোড়ে তার আঞ্চলিক বুলি বেরিয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে, একদিন শুনলাম বাদামতলী উঠে গেছে। আমি বলি, হায় হায় ঢাকা তো অন্ধকার হয়ে গেলো- কিসের কি? এখন গোটা ঢাকা শহর দেখি শালার একখান বেশ্যাপাড়া রাস্তায় মাগীরা সব কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশায় তোলো, জায়গায় নিয়ে কাজ সারো
আনোয়ার ভয় পায় যে, আফসার গাজীর বেশ্যাগমনের বর্ণনা এভাবে অব্যাহত থাকলে যাত্রা দ্যাখার বারোটা বাজবে। যে লোকটি নাম-ভূমিকায় নেমেছে, চলচ্চিত্র অভিনেতা আনোয়ার হোসেন তার আদর্শ। সিরাজদ্দৌলা’ ছবির সংলাপ সে হুবহু মুখস্থ বলে, চোখ বড়ো করে এদিক ওদিক তাকায়। আফসার গাজী কথা বলা বন্ধ করে ঢুলুঢুলু চোখ যতোটা পারে খুলে তার গতিবিধি দাখে। একেকটি দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে রিকেটগ্ৰস্ত মেয়েটি মঞ্চে নামে, লাফায় ও লাফাতে লাফাতে হাপায়। তার কৃত্রিম স্তন ও অকৃত্রিম উরু-পাছ এবং সিরাজদৌলার দেশপ্রেম আফসার গাজীকে ক্রমেই উত্তেজিত করে তোলে। মেয়েটি এলে সে একেকবার হাত পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, তবে মঞ্চ অনেক দূরে, তার ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়। আর নবাব সিরাজদ্দৌলাকে দেখলে সে বুক টান করে বসে। পরাজিত সিরাজদ্দৌলা বন্দি হবার পর তার শক্ররা যখন তাকে কাটার আসনে বসিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে, চেয়ার থেকে আফসার গাজী চিৎকার করে ওঠে, শালারা তোরা হাসিস দ্যাশের স্বাধীনতা যায়, তোরা মজা করিস। গাদারের পয়দা গাদ্দার। বাঙলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিলুপ্তিতে লোকটা ক্ষোভে ছটফট করে। এরপর শক্রদের সামনে নিজের ও দেশের দুর্ভাগ্যে সিরাজদ্দৌলা যখন খুব চটপটে গলায় বিলাপ করছে এবং দর্শকমণ্ডলী চোখের পানির ট্রান্সপারেন্ট পর্দা ভেদ করে তাই দেখছে, অফসার গাজী হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, থামো, থামো বাড়ার এ্যাঁকটো করো আনোয়ার হোসেনের লাকান হলো না। আবার করো।
এদিকে আনোয়ার ভাবে পাবলিক এই উত্তেজিত দর্শককে ধরে মার না দেয়। নবাব সিরাজদ্দৌলার আঠালো সংলাপের মাঝখানে আফসার ফের হুকুম ছাড়ে, কল্যাম না শালা রিপিট করো। কানোত কথা যায় না, না?
বিড়িটা হাত থেকে ফেলে যাত্রার অধিকারী মঞ্চে উঠে বাঙলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতিকে কি নির্দেশ দেয়, নবাব ঐ সংলাপের পুনরাবৃত্তি করে।
আনোয়ার নবাব সিরাজদ্দৌলার কথা একরকম ভুলেই যায়। তার অবিচল দৃষ্টি তার পাশে-বসা আফসার গাজীর দিকে। তার চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে আসছে, মনে হয় নেশা বোধ হয় জমছে। যাত্রার ঐ দৃশ্য শেষ হতে না হতে সে চেচিয়ে ওঠে, অনেকটা হছে। আবার করো। দোবারা এরশাদ। লোকটা বোধ হয় হীরামণ্ডি কি সোনাগাছির কোনো বাইজির আসর রিপিট করছে।
যাত্রার অধিকারী মশাই এবার মঞ্চে না উঠে জোড়হাতে এসে দাঁড়ায় আফসারের সামনে। বলে, ‘হুজুর এক সিন বারবার রিপিট করলে বোঝেন তো পাবলিকে
আফসার গাজী অধিকারীকে ঢালাও নির্দেশ দেয়, পাবলিকের গোয়া মরো এই আদেশ পালনে অধিকারী মশাই তার সম্মতি বা অপারগতা জানাবার আগেই পেছন থেকে চিৎকার শোনা যায়, হামরা পয়সা খরচ করা দেখবার আসছি। একজনের কথাত সব হবো? অডিয়েন্স পেছনে তাকায়, আনোয়ারও ঘাড় ফেরালো। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে লোকটি
তাকে সে চিনতে পারে। কাল দুপরে আনোয়ারদের কাঁঠালতলায় জালাল মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলো, এর নাম করমালি, জালাল মাস্টারের জমির বর্গাচাষী। বৈরাগীর ভিটা পার হয়ে কয়েক বিঘা জমি আছে জালাল মাস্টারের, সেই জমির ওপারে তালপোতাগ্রামে এদের বাড়ি। লোকটার দাত অস্বাভাবিক উঁচু বলে একে ১বার দেখলে ভোলা যায় না। তো তার এই চিৎকারের সঙ্গে ৩ সারি চেয়ারের দর্শকদের ভেতর থেকেও তাকে সমর্থন জানানো হয়, যাত্রার মাঝখানে আফসার ভাই কি আরম্ভ করলো? এমনকি গাজীদের কলেজে-পড়া একটি ছেলেও বলে ওঠে, মাতলামি করার আর জায়গা পায়নি, না?
এরপর পেছন থেকে একসঙ্গে এমন হৈ চৈ শুরু হয় যে, কারো কথাই স্পষ্ট বোঝা যায় না। এর মধ্যে ২/১ টি বাক্য বেশ পরিষ্কার, যেমন, মাস্টার, তুমি পয়সা নিছো সোগলির কাছ থাকা আর যাত্রা দ্যাখাবা খালি একজনেকি?
তুমি এক চোখত নুন ব্যাচো এক চোখত তাল ব্যাচো, না? ‘চিয়ারত বস্যা তাই লবাব হছে নাকি? হামরা পয়সা দিয়া ঢুকছি, চিয়ারত বস্যা মাগনা দেখি না।
লবাব সিরাজদ্দৌলার লাতি। শালাক এ্যাঁকটো করবার দিলেই হয় এইসব উক্তির ফলে চেয়ারে উপৰিষ্ট দর্শকরা উসখুস করে এবং হঠাৎ চুপ করে যায়। পেছনের কোলাহল অব্যাহত থাকে। চেয়ারে বসা ১জন দর্শক, আনোয়ারদের এক আত্মীয়, দাঁড়িয়ে ধমক দেয়, করমালি থাম! কি শুরু করলি?
‘দ্যাখেন না ভাইজান খালি ক্যাচাল করবো! ইগল্যান করলে যাত্রা হবো? করমালির অভিযোগ শেষ হতে না হতে আফসার গাজী শক্তি পুনরুদ্ধারে ব্যাপৃত হয়, শালা বেন্ন্যার বাচ্চাগুলাক ঢুকাছে সামিয়ানার তলাত। ট্যাকার গরম দ্যাখাস? এই শালার কলেজের নাম করা যাই যা খুশি করবো?
আনোয়ার মৃদু গলায় বলে, আঃ! আপনি কি শুরু করলেন? আফসার এবার দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে আনোয়ারের দিকে, আরে ভাই, দ্যাথো না। আমার দাদার দান-করা এই জায়গা-এখানে শালারা আমাকে বেইজ্জত করে। আমার দাদার জায়গা আর তোমার দাদার টাকায় এই স্কুলের দালান,—এখানে আমাদের সঙ্গে নিমকহারামি করে !
স্কুলের জায়গাটা গাজীদের দেওয়া, এটা ঠিক। কিন্তু এই স্কুল ভবন নির্মাণে তার নিজের পূর্বপুরুষদের কোনোরকম অবদানের কথা আনোয়ারের জানা নাই। ওর দাদা স্কুলের জন্য টাকা দিলে জালাল মাস্টার অন্তত একদিন না একদিন বলতো। তবে আফসারের এই তথ্য চ্যালেঞ্জ না করে সে বলে, আপনি বরং বাইরে যান। আপনার শরীর ভালো না।
বাইরে যাবো কেন হে? আমার জায়গা ছেড়ে বাইরে যাবে আমি? আফসার গাজীর বাক্যে যাত্রার প্রভাব লক্ষ করা যায়, ‘ছোটোলোকের দাপট সহ্য করবো আমি।
তাহলে চুপচাপ বসেন। এবার আনোয়ারের অসহ্য ঠেকে, দাপট তো দ্যাখ্যাচ্ছেন আপনি সবাই চুপচাপ শুনছিলো, আপনিই তো গোলমাল শুরু করলেন।
আফসার গাজীও ধৈর্য রাখতে পারে না, নেতাগিরি দ্যাখাবার আসছে, না? হৰো না! লাভ হবো না, তোমার মামু আসছিলো ভোট নিবার, ভোট পায় নাই। তোমাকও ভোট দেওয়া হবো না, বুঝল্যা?
‘ভোটের কথা কি হলো? আপনি তো ইতরামো করছেন। হয় চুপচাপ বসেন, নয় বেরিয়ে যান।’ এই সময় চেয়ারের দ্বিতীয় সারি থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানী হামিদ মণ্ডল এসে আফসারকে একরকম জোর করে বসিয়ে দেয়। লোকটি খয়বার গাজীর খাস লোক। তার অনুপস্থিতিতে তার ভাইপোর নিরাপত্তা ও কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রাখাও হামিদের কর্তব্য। আফসার গাজী এবার নেতিয়ে পড়ে। সে বেশ জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে শুরু করে। আনোয়ার বুঝতে পাচ্ছে যে, ওর নেশা কিন্তু একেবারে কেটে গেছে। কিন্তু আপাতত কিছুই করা সম্ভব নয়, তাই মাতলামোর ভাণ করে, কিছুই না বোঝার ভাব করেও খানিকটা উদ্ধার পায়।
যাত্রার প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে করমালি দাঁড়ায় আনোয়ারের পাশে। বলে, ‘চলেন। মন্টু জিগ্যেস করে, তুই বাড়ি যাবি না?
চলেন, আপনাগোরে বাড়ির উপর দিয়া যামু।
আনোয়ার একটু অবাক হয়, বেশ ঘোরা হবে না?
অল্প এ্যাঁনা !
মন্টু বলে, চল যে অকামটা করলি আজ তুই খালি লাফ পাড়িস মন্টু বেশ বিরক্ত। আফসার গাজীকে সে দুইচোক্ষে দেখতে পারে না, এতোক্ষণ ছিলো, ভালো করে কথাও বলেনি। তার অপমানে মন্টু বেশ খুশি। কিন্তু তাই বলে করমালি এভাবে কথা বলবে কেন?
একটু দূরে আবুলের বাপের পাশে দাঁড়িয়ে আফসার গাজী ডাকে, মন্টু শোনা’
এরা একটু দাঁড়ায়। মন্টু ফিরে এলে করমালি জিগ্যেস করে, কি কলো?
কিছু না!
তাই বাড়িতে যাবো না?
না! আজ বাজারে থাকবে।
আনোয়ার বলে, কেন? বাজারে থাকবে কেন?
মন্টু জবাব দেয়, কি জানি? বোধহয় নষ্টামি ফষ্টামি করবে। এইসব মানুষ শয়তানের হাড্‌ডি। এইসব মানুষের সাথে লাগা ভালো না, বুঝলেন? আমাকে বলে কি, আনোয়ার ইচ্ছা করলে আমার সাথে থাকতে পারে। আপনাকে কিসব খাওয়াতে চায়! লোকটার ছোটো বড়ো জ্ঞান নাই!’
করমালি তার বড়ো দাঁতে হাসে, বাড়িত যাবো না ভয়ে! ভয় পাছে, বুঝলেন না? ইন্দুরের জান নিয়া তাই নাফ পড়ে। রাত হছে তো, ঘাটা ধরা যাবো, ভয় করে। হামরা ইগল্যান বুঝি না? হাটতে হাটতে বলে, ’অর কল্লাখান দিয়া কেড়া কি করবো? অরটিংটিঙী কল্লাখানের কানা পয়সা দাম আছে? অর চাচা খয়বার গাজী সন্ধ্যা হতে না হতে বাড়ির মধ্যে সান্ধায়, তামাম আত বাড়িত ডাকাত পড়লেও বারাবার সাহস পায় না। আর উই তো ইন্দুরের বাচ্চাও না।
করমালি কথা বলে একটু বেশি। এটা বরং ভালো। আনোয়ারের এতে সুবিধাই হয়। চেন্টুর মতো হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে আনোয়ারের অকারণ অপরাধবোধটিকে কাটার মতো উস্কে তোলে না। চেংটু চুপ করলেই মনে হয় খুব মনোযোগ দিয়ে সে যেন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে।
সেদিন কাঁঠালতলায় করমালি এসেই আনোয়ারকে দেখিয়ে জালাল মাস্টারকে জিগ্যেস করছিলো, বড়োমিয়ার নাতি, না? চেংটুর মুখোত শুনলাম ঢাকাত থাকা আসছে? তা কতোদিন থাকার নিয়ত করা আসছেন?
জালাল মাস্টার সব প্রশ্নের জবাব বলে, করমালি, আরেকটা হাল দিয়া গম বুন্যা দে। করমালি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, গোরু পাই না সরকার। হামার গোরু তো গেছে– ‘
‘গোরু কি আর নাই? তোর গাওত গোরু কি খালি তোরই আছিলো?
না চাচামিয়া, করমালি ফের হাসে, হামাক কেউ গোরু দিবার চায় না। সোগলি ভয় করে, হামাক গোরু দিলে তার নিজের গোরুখানও চুরি হয়া যাবো।
মানে?-মানে তো করমালির কাছেও দুর্বোধ্য। তার গোরু চুরি হয়েছে, এতে অন্যদের ধারণা যে, গোরুচোরেরা তার ওপর অসন্তুষ্ট। তার প্রায় একঘরে হবার দশা, তার সঙ্গে কথা বলার সময় সবাই এদিক ওদিক দ্যাখে, তার বাপটার সঙ্গে পর্যন্ত ভালো করে কথা বলতে চায় না। এমনকি করমালির প্রতিবেশী, তার জ্যাঠা, বাপের বড়ো ভাই, সে আরো বেশি সাবধান। গোরু চাইলে নানা বাহানা দ্যাখায়। তার কথাবার্তা বড়োলোকদের মতো। কি রকম?-না, আজ গোরু দেওয়া যাবে না। কেন? গোরুকে বেশি খাটানো ঠিক নয়। ১ জোড়া গোরু, ৭/৮ দিন টানা খাটনি পড়লো, ২টো দিন আরাম করুক। আবার করমালির ফুপাতো ভাই না ভাইপো, সে আজ-দেবো কাল-দেবো করছিলো, তার গোরু শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেলো কিসমত সাকিদার।
কিসমত হলো খয়বার গাজীর পুরনো বর্গাদার, সে চাইলে তাকে গোরু না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এখন করমালি গোরু পায় কোথায়? জালাল মাস্টারও ঘাবড়ে যায়, এখন চাষ করবি কি দিয়া? আমার গোরুও তো একটা মরলো, একটা বেচা দিলাম।
করমালি ১টি সমাধান প্রস্তাব করে, এজন্যেই তার এখানে আসা। কি প্রস্তাব? জালাল মাস্টার নিজে একবার তাদের গ্রামে গিয়ে যদি গোরুওয়ালাদের কাউকে বলে তো কাজ হয়। কিন্তু জালাল মাস্টারের সময় কোথায়?—না, সময় একবার করে নিতেই হবে। গোরু নাই বলে করমালিকে বর্গাচাষ থেকে সে যদি খারিজ করে তো বেচারা একেবারে পথে বসবে।
এটা কয়েকদিন আগের কথা। এখন যাত্রা দেখে ফেরার পথে করমালি এক মুহুর্তের জন্য কথা থামায় না। প্রথমে কথা চললো সিরাজদ্দৌলা নিয়ে। পালার কাহিনী সে অর্ধেক বোঝেনি, মীরজাফর ও মোহনলালের ভূমিকা সম্বন্ধে একেক মন্তব্য করে। তবে খয়বার গাজীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চত, এবার তার মরণ ঠেকায় কোন বাপের ব্যাটা? কিভাবে?–আনোয়ারের এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সে দেখিয়ে দেয় মন্টুকে, মন্টু ভাইজানেক পুস করেন তো! তাই তো তার মামুই হয়। তাই কবো, খয়বার গাজী কতোগুলো মানুষের সব্বোনাশ করছে!’
তাতে তার অসুবিধাটা হচ্ছে কি? ‘বোঝেন না? এতোগুলা মানুষের শাপমণ্যি লাগলে তার উপরে আল্লার গজব পড়বো না? এই সব নিয়তিবাদী লোকজন কি করবে? মানুষের অভিশাপই যদি কাউকে প্রাপ্য দণ্ড দিতে পারে তো বিপ্লবের এতো প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার কি?
সাথে আপনেও তালপোতাত আসেন। সেদিন না কোল্যাম কোনো শালা গোরু দিব্যার চায় না, অ্যাসা দ্যাখেন, কি তামশা আরম্ভ হছে।’

চিলেকোঠার সেপাই – ১৮

বৈরাগীর ভিটার বটগাছের বিশাল সাম্রাজ্যে হাঁটতে হাটতে জালাল মাস্টারের অন্যমনস্কতা আনোয়ারের চোখে পড়ে, এতোটা সময় ধরে এরকম চুপচাপ থাকা জালাল মাস্টারের স্বভাবের বাইরে। এই বটগাছ নিয়ে লোকটার খুব বড়াই, এই নিয়ে কথা বলতে পারলে লোকটা বাচে।
এই গাছ অনেক দিনের, না? আনোয়ারের এই প্রশ্নে জালাল মাস্টারের নীরবতা ভাঙে, কিন্তু সে তোলে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ, এই ছোড়াটা আমাকে উভয় সঙ্কটে ফালালো। কি বিপদ হলো কও তো বাপু!
কি রকম?
‘যার গোরু নাই তাক কি বর্গ দেওয়া যায়? করমালির বাপেরও একাধিক গোরু আছিলো না। কোনো কোনো সময় একাধিক গোরু হছে তো কার্তিক মাসে নির্ঘাত একটা বেচ্যাদিছে। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর সাথে তার সদ্ভাব আছিলো, কাম ঠিকই চালায়া নিছে। ফসলও মোটামুটি ঠিকই দিছে।’
করমালি দেয় না?
বয়স কম তো! বাহানা করে বেশি। একটু খরা হলো তো কিছুমাপ করেন। অর বাপের আমলেও এরকম হছে, তা বাপটা আছিলো নরম মানুষ, কছে, আপনে কম নিলে আপনে মরবেন না, হামাগোরে কম হলে তো বেছোলবিটি নিয়া মর্যা যামু। কিন্তু এই ছোড়ার কথাবার্তা ত্যারা ত্যারা!
কি রকম?
‘ধরো, কবে, সার ভালো কিন্যা দিলেন না, ফসল কম হলো হামার কি দোষ? আপনে জমি দিয়া তো খালাস, মেনুত যা করছি এই ফসলে তার এক আনা দামও ওঠে না। এই সব কথা কয়।-আবার পরিশ্রমও যে নিষ্ঠা সহকারে করে তাও না!’-আপাতত করমালির আর তেমন কোনো দোষ খুঁজে না পেয়ে জালাল মাস্টার একটু দমে যায়। বটসম্রাজ্যের শেষের দিকে এসে সে তার দ্বিধার কথা জানায়, ‘দ্যাখো তো, করমালি গোরু জোগাড় করবার না পারে তো কি বিপদ। এখন যদি কেউ ওকে গোরু না-ই দেয় তো আমার জমি দেওয়া লাগে ওর জ্যাঠাক। দরিদ্র চাষা, ওর অন্ন বিনষ্ট করাটা মানবিক কাম হয় না। কিন্তু আমি করি কি?
‘ওকে গোরু দিতে গ্রামের লোকে এতো ভয় পায় কেন?
এসব করমালির কল্পনাপ্রসূত বাক্য হবার পারে। এখন দ্যাখো, আমি কি করি? ঐ জমির ধান কাটা হছে কোনদিন ফসলও এবার ভালো দিবার পারলো না, এদিকে এখন পর্যন্ত হালও দিবার পারলো না। গম বুনবো, তো হল দিবো কোনদিন, বীজ বুনবো কোনদিন!’
জালাল মাস্টারের সমস্যা আনোয়ার বুঝতে পারে বৈ কি! করমালির ওপর সে আর কতোদিন নির্ভর করবে? এখন গোরুওয়ালা কোনো চাষাকে বর্গ দিয়ে গম বুনতে না পারলে গম তুলবে কবে? এই জমিগুলো তার তিন ফসলী, গম তোলার পর অন্য ফসল বুনতে পারে। তবে জালাল মাস্টার বিবেচক ধরনের লোক বলে এতোদিন ধৈর্য ধরলো। জালাল মাস্টারের শ্বশুরের আমল থেকে এসব জমিতে করমালির বাপদাদারা বর্গাচাষ করে আসছে, হঠাৎ ছাটাই করতে তার বাধো বাধো ঠেকে।
কিছুদিন আগে করতো করমালির বাপ, বছর পাচেক হলো সে বাতে পঙ্গ। বয়স ৫০ হয়নি, শক্ত তামাটে পাকা দাড়ি, খরখরে শক্ত চুল, বাতে বাকচোরা হাত পা ও কোমর এবং ঘন ঘন কাশির কল্যাণে তার হাল হয়েছে ৭০/৭২ বছরের অথর্ব বুড়োর মতো। কারো কাছ থেকে চেয়ে-নেওয়া পুরানো জরাজীর্ণ কোট ও দুর্গন্ধময় ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে কুণ্ডুলি পাকিয়ে একটা বস্তার মতো সে শুয়েছিলো তার বাড়ির বাইরে, শুকনা কলাপাতার পর্দার ধার ঘেঁষে। সেখানটায় বেশ রোদ। সূর্যের দিকে মুখ রেখে পুরু ও ফাটা ঠোঁটজোড়া অনেকটা ফাক করে লোকটা রোদ খাবার চেষ্টা করছিলো। জালাল মাস্টারকে দ্যাখামাত্র কাউকে ডাকার উদ্দেশ্যে সে হাউমাউ করে চ্যাচাতে শুরু করে। তার কাশির দমক ওঠে, শ্লেষ্মার্ধ্বনিমুখর গলা তার আর থামে না, আনোয়ার ভয় পায়, কাশতে কাশতেই বুড়োর সবটা বাতাস বেরিয়ে না যায়। তার বাকপ্রয়াস ও তুমুল কাশির জবাব আসে উত্তরদিকের বাঁশঝাড়ের ওপার থেকে, ‘চাচামিয়া, ও চাচামিয়া, এক ঘড়ি খাড়ান গো, হামরা আসি! জালাল মাস্টার ও আনোয়ার সেদিকে তাকালে তার লম্বা লম্বা দাঁতে করমালি মহামধুর হাসি ছাড়ে। জোয়ালের পাতায় বুক পেতে করমালি গোরুর প্রকসি মারার চেষ্টা করছে। ঐ জোয়ালের পাতার আরেক দিকে বুক পেতে রেখেছে একটু বয়স্ক আরেকজন। লাঙল ধরে তাদের পেছনে পেছনে চলেছে ৮/১০ বছরের ১টি বালক। এই ছোকরা আবার হেট হেট শব্দ করে বাপচাচার বয়সী লোক ২জনকে গোরুর সম্পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করছে। করমালির সঙ্গী জোয়াল থেকে নিজের বুক সরিয়ে নিচ্ছিলো, কিন্তু করমালি বাধা দেয়, আরো খানিক দ্যাখো না গো গোরু পারলে হামরা পারমুনা কিসক? এখনি হ্যাঁপসা গেলা? কিন্তু জোয়ালের পাতা থেকে তার সঙ্গীর বুক প্রত্যাহার করার কারণ তার কুন্তি নয়, ২জন ভদ্রলোকের সামনে গোরুর ভূমিকার অবতীর্ণ হতে লোকটির বাধো বাধো ঠেকছে। একটু পর করমালি বালকটিকে কি নির্দেশ দিয়ে রওয়ানা হয়, তার সঙ্গীটি কিন্তু আসে না। আরেকটু দূরে একটা তালগাছের নিচে বসে ইকো-হাতে বসে-থাকা এক বুড়োর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে।
করমালি এসেই তাদের দিকে এক প্রস্থ হাসি বিতরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু খুব হাঁপাচ্ছে বলে তার হাসি ঠিক হাসির আকার পায় না। শুকনা কলাপাতার পর্দা সরিয়ে সে ভেতরে যায় এবং ফের বেরিয়ে আসে বাশের চটাই হাতে। চাটাই পাতবার মতো জায়গার বড়ো অভাব। বিঘার পর বিঘা চাষের জমির পাশে করমালিদের ১মাত্র ঘর ও বাইরের উঠান এমন জড়সড় হয়ে রয়েছে যে, হাত পা ছড়াবার জায়গা পর্যন্ত নাই। এরই ১দিকে কলাগাছের ছোটো ঝাড়ের সঙ্গে লাগোয়া গোরুর জাবনা খাবার মাটির গামলা। তবে গোরু নাই বলে জায়গাটা খালি। করমালি বাশের বাতা ঘেরা গামলার পাশে চাটাই পেতে দিলো। জালাল মাস্টার বসতে বসতে বলে, করমালি, মুখেত তালি!’ জালাল মাস্টারের এই ছন্দোবদ্ধ রসিকতায় করমালি শব্দ করে হাসে, তবে হাঁপাতে হাপাতেই সে বলে, চাচামিয়া, হাল দেওয়া শুরু করলাম। ধরেন দিনা সতেকের মদ্যে গম বোনা যাবো। বেছন তো আরো লাগবো চাচামিয়া!’
‘পাঁচ সের গম দিলাম যে খাওয়া সারা?
এক বিঘা জমিত কম করা হলেও দশ সের গম লাগে!
আর পাঁচ সের দিবা তোমরা, আদি নিছো, বিছন দিবা না?
তা দিমু| কিন্তু চাচামিয়া আপনের পাঁচ সের গমের আট আনা গেছে পোকের ভোগেতা মিছা কথা কবার জায়গা পাস না? কোনদিন আবার বলবি গমের মধ্যে হাতা লাগছে।’ গমের বীজে চালের হাতি পোকা ধরার ঠাট্টা করে করমালির পোকার পেটে গমের বীজ যাবার তথ্য একেবারে প্রত্যাখ্যান করা হলো। ৩/৪ বছর হলো এদিকে গমের চাষ হচ্ছে, জালাল মাস্টার ১ বিঘা জমিতে গম করতে চায়। সপ্তাহ দুয়েক আগে করমালিকে গমের বীজ দিয়েছে ৫ সের, বাকিটা দেবে করমালি, এর মধ্যে তার অর্ধেক গেলো পোকার ভোগে,—এ কথা বিশ্বাস করবে কে? আবার এটাও এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, গোরু জোগাড় করা করমালির সাধ্যের বাইরে। তার কাছে জমি বর্গ দিলে এবারকার ফসল আর ঘরে আসবে না। কিন্তু কথাটা জালাল মাস্টার বলে কি করে? আহা কতোকাল ধরে এরা এই জমি চাষ করে! জালাল মাস্টার মুখের হাসি বজায় রেখেই বলে, ‘মোহাম্মদ করম আলি মণ্ডল, মনুষ্য জাতি হইতে তোমাকে খারিজ করা হইল। তোমাকে দিয়া কাম হবো? গোরু হাল বয়, ইহাই গোরুর কর্ম, ইহাই গোরুর ধর্ম, কিন্তু ফসল উৎপাদনের দায়িত্ব কি গোরুর উপর অর্পণ করিতে পারো ?
এবার কথা বলে করমালির বাবা। জোয়ালের পাতায় বুক দিয়ে গোরুর ভূমিকা পালন করার ব্যাপারে সে সন্দেহ প্রকাশ করলে করমালি চড়া গলায় জবাব দেয়, ‘গোরু পারলে মানুষ পারবো না কিসক?
পারলু না তো কাল থাকা কবেজের সাথে তিন শতাংশ জমিত হাল দিবার পারলু? তা অবশ্য পারেনি, করমালিকে তাই চুপ করে থাকতে হয়। প্রবলভাবে কাশতে কাশতে করমালির বাবা যা বলে তা থেকে এই তথ্য উদ্ধার করা যায় যে, চষা জমিতে মই দেওয়ার সময় গোরুর বদল মানুষ কাজ করতে পারে, সে নিজেও দড়ি ধরে মই টেনেছে। মইয়ের ওপর থাকতো শিশু করমালি বা তার ভাই বরকতালি, সেও তখন বালক। কিন্তু শীতকালের এই শক্ত মাটিতে লাঙল টানা কি মানুষের কর্ম? আল্লা তাহলে গোরু পয়দা করেছে কেন? জালাল মাস্টার বলে, ‘তুই না আমাক আসতে বললি? তোর জ্যাঠা কৈ? তাক কয়া দেখি, এখন হাল গোরু দিবো, ফসল উঠলে তুই উপযুক্ত-।
তার গোরু কোটে? করমালির এই নির্লিপ্ত প্রশ্নে জালাল মাস্টার অবাক হয়, বিরক্তও হয়, মানে?
করমালি হাসে, গোরুর প্রকসি দেওয়াজনিত কারণে কুস্তি তার এখন কেটে গেছে। বড়ো বড়োদাঁতে সে বিরাট হাসি ছাড়ে, চাচামিয়া, গোরু এটেকার কারু নাই। তালপোতার ব্যামাক মানুষের এখন চারটা করা পাও নাগবো, পছন্দ হলে সোগলির মাথাত জোড়া জোড়া শিঙের বন্দোবস্ত করেন।
এরপর মহা উৎসাহে করমালি জানায় যে, গত কয়েক রাত্রে এই গ্রামের প্রায় সব চাষীর বাড়ি থেকে গোরু চুরি হয়েছে। প্রথম চুরি হলো তার নিজের গোরু, তাতে তার প্রায় একঘরে হবার দশা হয়েছিলো। তারপর উত্তরপাড়ার ২টো ঘর থেকে গেলো জোড়া জোড়া বলদ। করমালির জ্যাঠা আরো সাবধান হয়, সামনাসামনি হলেও করমালির দিকে এমনভাবে তাকায় যেন তার সামনে কোনো লোক নাই। পশ্চিমে শেখপাড়ায় এক রাত্রে ৩ ঘর চাষার ২টো গাই, ৩টে বলদ ও ১টা এঁড়ে চুরি হলে জ্যাঠা ধুনট গিয়ে লোহার শিকল ও তালা নিয়ে এলো। ধুনট থেকে জ্যাঠা আসছে, করমালি বসেছিলো বড়ো রাস্তার মোড়ে গাবগাছতলায়, জ্যাঠা তাকে এড়াবার জন্য জমির ভেতর নামলো, নতুন-কেনা দামী জিনিষগুলোর দামটা পর্যন্ত জিগ্যেস করার সুযোগ দিলো না। আল্লার কি কাজ, করমালি চোখজোড়া ছোটো করে হাসে, সেই রাত্রেই নতুন শেকল তালা ভেঙে চোর ঢুকলো জ্যাঠার ঘরে, গাই নিলো, বকনাটা নিলো, বলদ নিলো, যাবার সময় উপরি নিলো শেকল ও তালা। পরদিন শেখপাড়ার গোরুগুলো যাওয়ার পর করমালি এখন একঘরে হওয়া থেকে মুক্ত হয়েছে। লোকে এখন তাকে আর এড়িয়ে চলে না। আবার চাষের জন্য গোরু ভাড়া পাওয়ার সম্ভাবনাও এখন একেবারে শূন্য।
দেখতে দেখতে ৭/৮ জন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। এদের ১জন হলো করমালির ঐ সঙ্গী, ওর সঙ্গে জোয়ালে বুক দিয়ে লাঙল টানার চেষ্টা করছিলো। তার নীরব ও কখনো হাই-তোলা মুখ ও প্রায় নিশ্চল কালোকিষ্টি গতর দেখে মনে হয় না যে, করমালির উত্তেজিত কথা তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। আর সবার সঙ্গে সে কখনো তাকিয়ে থাকে করমালির দিকে, কখনো দ্যাখে আনোয়ারকে। করমালির সঙ্গী হঠাৎ তার নিজের গোরু চুরি হওয়ার বর্ণনা দিতে শুরু করে, ঐ আত্ৰে হামি নিজে শুতা থাকলাম গোলের মদ্যে, ছোটো এ্যাঁন গোল হামার, তারই মদ্যে হাতপাও মেলা দেই কোটে?–আর মশা! হায়রে মশা গো মশা! মশার কামড় খাতে খাতে তামান আত দুই চোখের পাতা এক করবার পারি নাই। তার দীর্ঘ বিবৃতির শেষ ভাগ বিশ্বাস করা একটু কঠিন। গোরুচোর গোয়ালঘরের বেড়া কেটে ঢুকে বলদের দড়ি ধরে চলে গেলো; গাইটা বাধা ছিলো একদিকে বাঁশের থামের সঙ্গে, অন্যদিকে খুঁটির সঙ্গে বাধা। দড়ি খুলেছে, খুঁটি উপড়ে ফেলেছে, বলদ গেছে, গাই গেছে,-কাবেজের বিনিদ্র নিশিযাপনের কথা বিশ্বাস করে কে? এই নিয়ে সবাই একটু হাসাহসি করলে কাবেজ বলে, না চাচামিয়া, ঘুম লয়, আরা কি যান ছিটা দেয়। মন্তর পড়া ঘরের মদ্যে বালু ছিটায়, হামি চ্যাতনই প্যালাম না দিশা পালে এক শালাক জান লিয়া যাবার দেই? শালার ব্যাটা শালারা!
করমালির নিয়ে-আসা পান খেয়ে জালাল মাস্টার ও আনোয়ার উঠছে এমন সময় একটু দূরের তালগাছতলা থেকে এসে দাঁড়ায় করমালির জ্যাঠা। লোকটার বয়স ৫৫-এর মধ্যেই, তার পাকা দাড়ি তামাটে সাদা, মাথার চুল বেশ কম। লম্বা ও রোগা লোকটির কোমর একটু বাঁকা, বাঁকা শরীরটাকে আরেকটু নুইয়ে সে দাঁড়ায় জালাল মাস্টারের মুখোমুখি।
জালাল মাস্টার তাকে জিগ্যেস করে, ক্যাগো পচার বাপ, আমেশা নিরাময় হছে? তার পুরনো রোগ সম্বন্ধে জালাল মাস্টারের উদ্বেগ দেখে পচার বাপ কৃতজ্ঞতায় আরো নুয়ে পড়ে। করমালি বলে, আর আমেশা। জ্যাঠোর গোরু তো গেলোই, তার তালাও গেছে, শেকলও গেছে। এখন তো হাগা ফির নয় করা শুরু হবো। নয়া শিকলখান গো ধুনটের হাট থাকা কিনছিলা না জ্যাঠো করমালির উঁচু দাঁতের স্পর্শে তার কথাগুলো ঝনঝন করে বাজে,কিন্তু তার কথায় পচার বাপ কান দেয় না। জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আস্তে বলে, ‘দ্যাখেন তো গো মাস্টার সায়েব, কারুবারু করা গোরুবাছুরগুলান পাওয়া যায় নাকি?
করমালি ফের এগিয়ে আসে, পাবা না কিসক? খুতির মদ্যে টাকা পঞ্চাশটা লিয়া ডাকাত-মারা চরত যাও। টাকা দিবা, তোমার হাতোত শালারা গোরুর দড়ি তুল্যা দিবো। দড়ি ধর্যা বিসমিল্লা কয়া বাড়ি বিলা ঘাটা ধরো।
‘দ্যাখ করমালি, পচার বাপ রাগ করে, আলতু ফালতু কথা কস না।
ফালতু কথা কমুকিসক? উত্তরপাড়ার ল্যাংড়া নবেজ বলা বলদখান লিয়া আসছে, তাক পুছ করা দ্যাখা!
নবেজক তুই কোটে দেখলুঃ নবেজের ভাই জানে না আর তুই জানিস, না?
নবেজের ভাই কাবেজ কোনো মন্তব্য না করে গম্ভীর হয়ে থাকে। গত বছর নবেজের সঙ্গে সে পৃথগন্ন হয়েছে, দুইভায়ের সম্পর্কে এখনও খারাপ।
করমালি বলে, ‘ভাই হলে কি হয়, কাবেজ কি জানে?
নবেজ তোক কছে না? পচার বাপ রেখে গেলে করমালিও কড়া জবাব দেয়, ই, নবেজ তো হামাক সবই কছে।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৯

নবেজ অবশ্য ব্যাপারটি গোপন রাখবার জন্যে চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু করমালিকে তার সব কথা বলতে হয়েছে। করমালি অতো সোজা মানুষ নয়।
১দিন খুব ভোরে, ফর্স হতে না হতে নবেজউদ্দিন রওয়ানা দিয়েছিলো তার সাদা বলদের খোজে। তার নিজের নৌকা নাই, নৌকা ভাড়া করতে গেলে খরচ পড়ে ১৫/২০ টাকা। বড়ো বড়ো খেয়ানৌকায় উঠে সে একেকটা চরে গেছে, চরপার হয়েছে হেঁটে, চরের আরেক মাথায় এসে ফের অপেক্ষা করেছে আর ১টি খেয়ানৌকার জন্য। যমুনার ১চর থেকে আরেক চরে খেয়ানৌকায় পার হওয়া মানে এই উঠলাম-আর-নামলাম নয়। ঘন্টার পর ঘণ্টা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়ানৌকা আসে, নৌকা একবার চলতে শুরু করলে ওপারে পৌছাতে ফের দেড় ঘণ্টা দুই ঘণ্টার ধাক্কা। এইভাবে সারাটি দিন এবং ১টি রাত্রি হেঁটে ও খেয়ানৌকায় পার হয়ে নবেজ পৌঁছেছিলো ডাকাত-মারা চরে। ফিরে এসেছে ১দিন পর। গোরুর দড়ি ধরে নবেজ যখন ফিরছে, ধারাবর্ষ চরের এদিকে খেয়ানৌকা থেকে তাকে দেখতে পায় আসমত আলি। খেয়ানৌকা দেখে নবেজ মুখ ফিরিয়েছিলো অন্যদিকে, আসমত অনেক ডাকাডাকি করলেও তার দিকে তাকায়নি। আসমত মরিচ বেচতে এসেছিলো ধুনটে, সে এই বৃত্তান্ত বলে করমালির ভাই বরকতালিকে। বরকতালির কাছে শুনে করমালি সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় উত্তরপাড়া।
বিকালবেলা নবেজউদ্দিন কাথা গায়ে শুয়ে ছিলো ঘরের ভেতর মাচার ওপর। নবেজের বৌ করমালির কিরকম ভাগ্নী হয়, গলা খাকারি দিয়ে করমালি সোজা টুকে পড়ে শুকন কলাপাতা ঘেরা উঠানে। মানুষের সাড়া পেয়ে মাচা থেকে নবেজ নিচে নামে এবং মাচার তলে বসে থাকে মাথা গুঁজে। তার বৌয়ের চোখের ইশারায় জানতে পেরে করমালি তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। নবেজ কথাই বলতে চায় না। গ্রামের মানুষের চোখ এড়াবার জন্য আজ ৩দিন থেকে সে কোথায় কোথায় ঘোরে-তার বৌ পর্যন্ত বলতে পারে না। বৌটা খুব বিরক্ত,-গোরু নিয়ে এলো, কিন্তু কিভাবে উদ্ধার হলো, কি সমাচার-সব কিছু সে চেপে রাখতে চায়। বৌ এদিক ওদিক থেকে নানারকম কথা শুনে তাকে খয়বার গাজীর কথা জিগ্যেস করে, ক্যাগো, গাজীর বেটা বলে ডাকাত-মারা চরত দুনিয়ার গোরু জড়ো করছে? নবেজ তাতে বৌয়ের চুল ধরে ঘাড়ে একটা থাপ্পড় মারে, আত নাই দিন নাই, খালি খয়বার গাজীর কথা কস ক্যা? খয়বার গাজীর সাথে তোর মায়ের নিকা দিবু? কাদো কাদো গলায় নবেজের বৌ করমালির কাছে সব বললে নবেজের হাত ধরে টানতে টানতে করমালি তাকে নিয়ে আসে নিজেদের পাড়ায়। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কুয়াশায়, অন্ধকারে, নাড়ার ধোঁয়ায় কিছুই ভালো করে দ্যাখা যায় না। পচার বাপের গোয়াল ঘরের পেছনে সারের গাদার পাশে তাকে বসিয়ে করমালি সোজাসুজি জিগ্যেস করে, কও তো দামান, গোরু ফেরত পাওয়া গেলো কেমন কর্যা?
নবেজউদ্দিন কথা বলবে কি?-তার ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলা, হাত-পা কাপা দেখে মনে হয় তাকে যেন গলা টিপে মারার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে। সে কি তবে চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছে? বেশ তো, তাতে ক্ষতি কি? করমালি তাকে অভয় দেয়, তারাও না হয় বাটপাড়ি করবে, তাতে নবেজের অপরাধ বিভক্ত হয়ে তারভার লাঘব হবে। নবেজ তবু কাপে হয়তো করমালির হাত থেকে নিজের রোগা-পটক গলা বাচাবার জন্যে সে জানায় যে, সে গিয়েছিলো ডাকাতমারা চরে। না, না, তার কোনা দোষ নাই, এটা তার নিজের সিদ্ধান্ত নয়। খয়বার গাজীর খাস বর্গাদার কিসমত সাকিদারের পরামর্শে সে ওদিকে রওয়ানা হয়। মাসে ১০ টাকা হার সুদে কিসমত তাকে ৬০ টাকা ধারও দেয়। নগদ ৫০ টাকা এবং এই ব্যাপারে পূর্ণ নীরবতা পালনের অঙ্গীকার দিয়ে সে তার গোরু ফেরত পেয়েছে। কোরান শরীফ ছুয়ে নবেজ কথা দিয়ে এসেছে যে, কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির কানে এই কথা দেবে না। এই কথা ফাঁস হয়ে গেলে নবেজউদিনের কপালে যে কি আছে তা কেবল সে-ই জানে, আর জানে খয়বার গাজী, আর জানে খয়বার গাজীর প্রধান সহকারী ও অংশীদার হোসেন আলি ফকির। এদের নাম বলতে বলতে সে কাপে এবং কিছুক্ষণ পর তার ভাগ্য সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞাতদের তালিকায় সর্বজ্ঞ আল্লাতালার নাম যোগ করে। এতো কথা বলে ফেলার পর নবেজউদ্দিন কিছুক্ষণ কাঁদে এবং নাক চোখ না মুছেই করমালির ঠোঁটের বিড়িটা চেয়ে নিয়ে কয়েকটা টান দেয়।
বিড়ি খেয়ে সে ঘ্যানঘান করতে শুরু করে নতুন উদ্যমে। এই বিশাল পৃথিবীতে করমালি ছাড়া কোনো কাকপক্ষীও এসব কথা জানে না। করমালির হাতে তার জীবনমরণ, করমালির মুখ থেকে এইসব কথাবার্তা বেরিয়ে পড়ে তো খয়বার গাজীর লোকজন নবেজউদ্দিনকে বাড়ি থেকে, গ্রাম থেকে তো বটেই, এই সাধের দুনিয়া থেকেও তাকে উৎখাত করবে। অথচ এবার বর্গাচাষ করে সে ফসল পেয়েছে ভালোই, বাড়ির পেছনে খাইখালাসি দেওয়া ১০ শতাংশ জমিটাও তার উদ্ধার হয়ে যাবে। এবার এমন কি বর্ষাতে তার বৌটাকে বাপের বাড়ি না পাঠালেও চলবে। ৫০টা টাকা গেছে, তা যাক। ওদেরও তো খরচা আছে। গোরু নিয়ে গেছে, গোরুকে জাবনা দিতে হয়েছে, গোরু দ্যাখাশোনার জন্যে কতোগুলো লোক পুষতে হয়। তারপর থানা সামলাও রে, আইয়ুব খার পাটির মেম্বারদের সামলাও রে, এমএনএ, এমপিএ, চেয়ারম্যান-কিসব হাবিজাবি, এদের কি লেখাজোকা আছে? এদের আদর্যত্ন করো, খাতিরদারি করো টাকা তো ওদেরও যায়! না, মামু খয়বার গাজী মানুষ খারাপ না। কলকাঠি নাড়ে সব হোসেন আলি ফকির!’ খয়বার গাজী চরের দিকে কোনোদিন পা-ও মাড়ায় না। আসল শয়তান হলো হোসেন ফকির। কার গোরু নিতে হবে, কার কতো জরিমানা ধার্য করা হবে, গোরু ফেরত দেওয়া যাবে না কাকে, কাকে মেরে পুঁতে ফেলতে হবে যমুনার নতুন চরে—সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক হোসেন আলি। খয়বার হাজার হলেও ভালো বংশের মানুষ, তার ছেলেপেলে সব লেখাপড়া জানা শহুরে লোক, তার এক ছেলে বিলাত থেকে ঘুরে এসেছে। না, হোসেন আলি ফকিরের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নেওয়া ছাড়া এইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খয়বার গাজীর কিছুমাত্র যোগ নাই।-নবেজউদ্দিন এক নাগাড়ে কথা বলে, কথা বলার পালা এখন তার। ৫০ টাকা জরিমানা দেওয়ার কথটা বলে এতো ভয় পেয়েছে যে, খয়বার গাজীর প্রতিশোধের কথা ভেবে সে নিজেই খয়বারের পক্ষে যুক্তি তৈরি করছে। খয়বার গাজী ভালো, সে নিষ্পাপ পুরুষ—এমনকি নিজের মধ্যেও এই বিশ্বাস খাড়া করার জন্যে নবেজ তখন অস্থির। কিন্তু এইসব বলতে বলতে তার বোধোদয় ঘটে যে, দাপট হোসেন আলিরও কম নয়। গতবার বড়ো ভোটের সময় আইয়ুব খানের ফুল মার্ক ক্যান্ডিডেটের পক্ষে এই এলাকার মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংগঠিত করেছে তো সে-ই। হারিকেন মার্কার ক্যান্ডিডেট ছিলো খয়বারের কি রকম আত্মীয়, খয়বার তাই একটু চুপচাপ ছিলো। এমএনএ হওয়ার পর ফুল মার্কা শালা এদিকে এসে খয়বার গাজীর বাড়িতে যতোই উঠুক, সে চেয়ারম্যান হোক আর মেম্বার হোক, কাজের মানুষ হলো হোসেন আলি। এই যে মেম্বারগুলো,-বেঈমানের বেঈমান, মোনাফেকের বাপ মোনাফেক-এদের সামলায় কে? হোসেন আলি ছাড়া আবার কে? সুতরাং হোসেন আলিকেও ভয় পাওয়া নবেজউদিনের কর্তব্য এবং তাই সে বলে, তারই দোষ দেই কি? চরের মদ্যে তার দাপট কি আজকালকার কথা গো? তা অবশ্য ঠিক। ২৫/২৬ বছর আগে যমুনায় ডাকাত-মারা চর যখন জেগে ওঠে তখন থেকে সেখানে তার বাথান। চরের একদিক ভাঙে, বাথানও সরে যায় অনদিকে। জামালপুর মহকুমার চর থেকে এমনকি বীর এলাকা থেকে গোরু বাছুর মোষ সব নৌকায় ভাসিয়ে সে নিয়ে আসতো এদিকের চরে। ওদিকে বালিজুড়ি, এদিকে ডাকাত-মারা চর-এই ২জায়গার নাম শুনলে গোরুওয়ালা চাষার বুক কাপে কি আজ থেকে? হোসেন আলির মস্ত বড়ো জলঙ্গি নৌকা যমুনার কোনো ঘাটে বাধা দেখলে সেই এলাকার মানুষ রাত জেগে গোয়াল পাহারা দেয়। এসব কি আজকের কথা? গোরওয়ালাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের ফন্দি কিন্তু তার মাথায় আসেনি। এই শালা খয়বারের বুদ্ধিতে তার এই ব্যবসার শুরু। খয়বার গাজীর কথা না শুনলেও আজকাল তার চলে না। ইউনিয়ন বোর্ড, আইয়ুব খানের পাটি, ভোট –এসবের মধ্যে না থাকলে এখন কোথাও সুবিধা করা মুশকিল। একবার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের গম সবটাই বেচে দেওয়ার সুযোগ করে দিলো খয়বার, তখন থেকে এসব লাইনে ঢুকলোসে। না, হোসেন আলি মানুষ ভালো, তার দেলটা পরিষ্কার।
এসব এলোমেলো কথা শোনার পর করমালিকে চুপচাপ থাকতে দেখে নবেজের ভয় ফের মাথাচাড়া দেয়। তার শ্বাসকষ্ট হবো হবো করে, হঠাৎ করে করমালির একটা হাত ধরে বলে, তোমার পাওত পড়ি মামু, ইগল্যান কতা কাকো কবা না। করমালি উঠে দাঁড়ালে নবেজ ফের তার হাত ধরে, মামু ইগল্যান কথা অস্ট্র হলে হামার বাড়িঘর ব্যমাক পুড়া দিবো গো! তুমি হামাক জবান দ্যাও, কাকো কয়া দিবা না, কও!
এদিকে পচার বাপের ছেলে পচা তখন গোয়ালঘরে ঢুকেছে। নবেজউদ্দিন করমালির প্রতিশ্রুতি না নিয়েই আড়ালে চলে যায়।
সেই রাত্রিটা করমালির খুব অস্থির কাটে। সারারাত ছটফট করে একটু ঘুমিয়েছে, ভোরবেলার দিকে স্বপ্ন দ্যাখে, চষা জমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নবেজউদ্দিন, নবেজের হাতে মাছ ধরার তরা জাল। নবেজের আগে আগে এক ভদ্রলোক। ‘কেডা গো? নবেজ জবাব দেয়, চিনলা না? হোসেন আলি ফকিরের ব্যাটা। করমালি জানতে চায়, কোটে যাও?’ নবেজ হাসতে হাসতে বলে, টাউনেত থাকে, বাড়িত আসা মাছ ধরার সখ হছে! স্বপ্লের মধ্যেই করমালির মনে হয়, হোসেন আলির ছেলে মাছ ধরা দাখার জন্য এই গ্রামে আসবে কেন? এই কথা ভাবতে ভাবতে নবেজ কোথায় উধাও হয়, পাটকিলে রঙের একটা কুকুর সেই ছিপছিপে ভদ্রলোককে তাড়া করে। করমালি বলে, ‘তু তু ধর শালাক ধরা ভদ্রলোক সামনের দিকে দৌড়ায় এবং কুকুর ঘেউঘেউ করতে করতে তার পেছনে ছোটে।
কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজে করমালির ঘুম ভাঙ্গে। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। বাইরে একটা কুকুর অবিরাম ডেকে চলেছে। করমালির তলপেটে তখন বেগ হচ্ছে, পানি ভরা মাটির বদনা হাতে সে বেরিয়ে পড়লো।
বাইরে কুয়াশা। বাড়ির সামনে কলাগাছের পেছন দিকে তাকিয়ে নেড়ি কুত্তাটা ডেকেই চলে। কলাগাছের ঝাড়ের ওদিকে জমির আলের দিকে যাচ্ছিলো করমালি, হঠাৎ চমকে উঠে দ্যাখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে নবেজ। কুকুরের ভয়ে কাঁপতে পারে, আবার শীতও পড়েছে সাঙ্ঘাতিক, তার গায়ে পোষাক বলতে কেবল ১টি জামা, নবেজ তাই শীতেও কাঁপতে পারে।
কারমালি বলে, ক্যাগো তুমি? এই জাড়ের মদ্যে খাড়া হয়া আছো? কি সমাচার?
এবার কাপে নবেজের গলা, না এমনি!’
একটু-আগে-দ্যাখা স্বপ্ন এবং একটু-আগে-বোধ-করা তলপেটের বেগ ভুলে করমালি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নবেজ হঠাৎ তার পায়ের ওপর পড়ে যায়, একটু হলেই করমালির বদনা তার মাথায় পড়তো। নবেজ কাঁদতে কাঁদতে বলে, মামু, তুমি হামাক বাঁচাও কাল তোমাক কি কছি না কছি হামি দিশা পাই নাই। অরা মানুষ খুব ভালো মামু, মানুষ খারাপ লয়। হোসেন ফকির মানুষ লয় বাপু উদিনক্য শালা হামার টাকা লিয়া আঙুলেত ছাপ দিয়া এটা এটা করা গোণে আর কয়, শালা ছোটোজাতের পয়দা, ইগল্যান কথা আষ্ট্র হলে তোর জান থাকবো না। মামু, তার কি? তার কিছু হবে না। হামাক ঝাড়ে বংশে শ্যাষ করবো! মামু, তুমি হামার ধর্মের ভাই, তোমাক কারুবারু করি, কাকো কিছু কয়ো না! তুমি হামাক জবান দ্যাও সে কিছুঁতেই করমালির পা ছাড়ে না। এদিকে করমালির পায়খানার চাপ ফের ফিরে এসেছে, সে পা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, দিলাম!’
কিন্তু কথা দিলেও নবেজউদিনের গোরু ফেরত পাওয়ার ঘটনা করমালি যাকে পায় তাকেই বলে।
খালি খালি মানুষটাক নিয়া টানাটানি করব, টাকা না দিলে গোরু অরা দিবে। না-পচার বাপ জ্যাঠাকে এই কথা বলে নবেজউদিনের কাহিনী সে বিস্তৃতভাবে বলার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু পচার বাপ তাকে আমল না দিয়ে দাঁড়ায় জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে। তার ফ্যাসফেসে গলা যতোটা পারে কোমল করে সে বলে, আপনে কলে পরে তারা শুনবো গো! হামরা চাষাভূষা মুখ্য মানুষ, হামাগোরে মূল্য কি? আপনে শিক্ষিত মানুষ, তাইও শিক্ষিত। হামরা গরিব-গরবা চাষা, হামাক বেচলেও দশ টাকা বারাবো না, ছেঁচলেও বারাবো না। আপনে এ্যাঁন কয়া দ্যাখেন, এই গায়ের সোগলি আপনেক মানে। খালি এই গেরাম কিসক, তামান ইউনিয়নের মদ্যে আপনের একটা কথা ফালাবার পারবো কেটা?
জালাল মাস্টার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বেঢপ খাচার মতো বুক থেকে তার ফসফস করে বাতাস বেরোয়, কিন্তু সেটা হাঁপানির টান নয়। তার নিজের সম্বন্ধে প্রকাশিত পচার বাপের মতামত সে সম্পূর্ণ অনুমোদন করে, তা ধরো, আমি কথা একটা কলে কেউ ফালাবার পারবো না। তার প্রভাবাধীন এলাকা সে আরো সম্প্রসারিত করতে চায়, এতদঞ্চলে, এই তামাম থানার যতো বড়ো অফিসার দেখবা, ম্যাজিস্ট্রেট কও পুলিশ কও আর জজ হাকিম ৬াক্তার ইঞ্জিনিয়ার-যার কাছে যে কামে যাই আমাক প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা কারো নাই।’ বলতে বলতে সে একটু থামে, হয়তো নিজের সম্বন্ধে এতোটা বলে ফেলে সে একটু লজ্জা পেয়েছে কিংবা আনোয়ারের সামনে একটু সঙ্কোচও হতে পারে। এবার একটু বিনীত ভঙ্গিতে বলে, তা কাকো তো কোনোদিন কোনো অনুরোধ করি নাই, তাই-।
করমালি বলে, আপনে গেলে খালি খালি বেইজ্জত হবেন। টাকা না হলে গোরুর একটা খুরও দিবো না!
জালাল মাস্টার সোজা হাটতে শুরু করে। এখনো তার নাক দিয়ে ফসফস করে বাতাস বেরিয়ে আসছে। করমালির ওপর সে বিরক্ত, তার ফুলে-ওঠা বুকটাকে ছোড়া একেবারে ফুটো করে দিয়েছে। মাঠের ভেতর আল পেরিয়ে দুজনেই এসে পড়েছে বৈরাগীর ভিটার কাছাকাছি। কয়েক পা পর বটগাছের এলাকা। পেছন থেকে ডাকে পচার বাপ, ও ভাইজান পা চালিয়ে জালালউদিনের পাশে এসে বলে, ভাইজান, কথাটা শোনেন। চ্যাংড়াপ্যাংড়ার কথা থোন! আপনে চলেন, হামরাও যামো!’
‘কোথায়?
গাজীর ব্যাটার কাছে না যান তো ডাকাত-মারা চর চলেন।’ আনোয়ারকে দেখিয়ে পচার বাপ বলে, এই চ্যাংড়ার চাচার নাও বান্দা আছে খালের ধারে, তাই তো আপনের সম্বন্ধীই হয়, আপনে কলেই নাও পাওয়া যাবো। খালেত এখন পানি নাই, তো নাও হামি কান্দোত করা নিয়া যামু মুলবাড়ির ঘাট।
নৌকা না হয় হলো, চরে অনর্থক যায়া ফল কি? বলতে বলতে জালাল মাস্টার বটগাছের দিকে হাঁটে।
আনোয়ারের চোখের সামনে এখন কেবল বটগাছ। পাশে জালাল মাস্টার, পাশে পচার বাপ, পেছনে মাঠের ওপার থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে করমালি, করমালির ছোটো বাড়ির সামনে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা চাষারা। কিন্তু বটগাছের এলাকায় পা দিয়ে সাঙ্ঘাতিক নির্জন মনে হচ্ছে। যেন জনমানবহীন বড়ো ১টি প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছে। জালাল মাস্টার বলে, বুঝল্যা আনোয়ার, এই বটগাছের বয়স কম করা হলেও আড়াইশো বছর তো হবেই ধরো—। কিন্তু পচার বাপ তাকে কথা শেষ করতে দেয় না, ‘কথাটা শোনেন ভাইজান ডাকাত-মারা চরেত হোসেন ফকিরেক কলে কাম হবো। হোসেন ফকির এখন থাকে ঐ চরেত, কিন্তু বাড়িঘর, জোতজমি, চাষবাস সব ধারাবর্ষা চরের মদ্যে। ধারাবর্ষা চরে মিয়াগোরে জমির বর্গাও তারই হাতোত আছিলো। এবার সে তাকায় আনোয়ারের দিকে, আপনের দাদার আমল থাকা হোসেন ফকিরের বাপ ঐ জমিত বাস করে। আপনের দাদা বড়োমিয়ার মেলা জমি তাই বর্গ নিছিলো, আপনের বাপচাচারা সব বেচ্যা দিছে তারই কাছে। অনেকদিনের কায়েমি চর, ধান পাট কালাই খুব ভালো হয়। আপনে গেলেও খুব কাম হলোনি গো!
কিন্তু আনোয়ার তখন দুই চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে বিশাল বটপ্রসাদ। যেদিকে চোখ পড়ে কেবল গাছের ঝুড়ি। অজস্র ঝুড়ি নেমে এসেছে ওপরের ডাল থেকে। অনেকগুলো ঝুড়ি দেখতে মোটা থামের মতো। এরকম থাম যে কতো গুণে শেষ করা যাবে না। আবার অনেকগুলো ঝোলে দড়ির মতো। মোটা থামগুলোর শরীরে শাদা কষ। স্নান ধূসর বাকলের ওপর এই কষ দেখে পুরনো বাড়ির নোনা-ধরা থামের কথা মনে পড়ে। আর ঝুলন্ত ঝুড়িগুলো একাগ্রচিত্তে মাটির দিকে নামছে, একদিন এরাও মাটি ছোবে, চুকে পড়বে মাটির ভেতর, পরিণত হবে একেকটি স্তম্ভে। কুড়ি ও থামের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেছে ১টা রাস্তা, রাস্তায় সাইকেলের চাকার দাগ। ১টা জায়গায় থাম ও ঝুলন্ত ঝুড়ি এমনভাবে সাজানো যে, একটু-ভাঙা পুরনো খিলানের মতো মনে হয়। এই সব থাম, কাণ্ড, ডালপালা, ঝুলন্ত ঝুড়ি নিয়ে বটবৃক্ষ কি কেবল বেড়েই চলবে? জালাল মাস্টার ও পচার বাপের সঙ্গে আনোয়ার বট এলাকার একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো কয়েক রকম পাখির বিচিত্র কলরব। এই কোলাহল এরকম আকস্মিক মনে হচ্ছে কেন? এটা কি এতোক্ষণ স্থগিত ছিলো? মাঠ থেকে, এমন কি বটগাছের তোরণে পা দিয়েও তো এর কিছুই বোঝা যায়নি। এর মানে কি? কিন্তু মানে বোঝার আগেই পচার বাপের প্রতি জালাল মাস্টারের কথা শোনা যায়, না, না, আনোয়ার যাবে কোথায়? ধারাবর্ষা কি এখানে?
‘না, আমার আপত্তি নেই। চলেন না। কবে যাবেন? আনোয়ার রাজি হওয়ায় পচার বাপ তার হাত জড়িয়ে ধরে, যাবেন? তুমি, আপনে, আপনে গেলে গরিবের বড়ো উপকার হয় বাবা। হোসেন আলী ফকিরকে কয়া বলা হামার গুনা গরিটা মাপ করায়া দাও বাপ। আল্লা আপনার ভালো করবো বাবা!
‘গুনাগারি? আনোয়ার দাঁড়ায়, গুনাগরি কিসের?
ঐ তো হলো বাপ। জরিমানা আর কি? পচার বাপ বোঝাতে চেষ্টা করে, জরিমানা কও দণ্ড কও, ট্যাকসো কও, খাজনা কও—ইগল্যান কি?-মানুষের পাপগুনার শাস্তি, নাকি কন, ভাইজান? মানুষের পাপের শাস্তি সম্বন্ধে তার মতামতের অনুমোদন লাভের জন্যে জালাল মাস্টারের দিকে তাকিয়ে পচার বাপ আনোয়ারকে বলে, ‘একদিক চলেন বাবা ফজরের আজানের আগেই নৌকা দিয়া মেলা করলে আগাবেলার মদ্যেই ধারাবর্ষা যায়া ওঠা যাবো। তাক বাড়িতে না পালে যামো ডাকাত-মারা চর। দুইটা চর এক্কেরে কাছাকাছি।
যাবো। কবে যাবেন?’
কিন্তু ইতস্তত করে জালাল মাস্টার, না বাপু টাউনের অধিবাসী। নদী খাল চরের মদ্যে ঘোরাঘুরি করলে একটা রোগ ধরতে কতোক্ষণ?
না আমার কোনা অসুবিধা হবে না।’ আনোয়ারের জেদ বেশ টের পাওয়া যায়। জালাল মাস্টার কিছু না বলে কেবল বটগাছের সাম্রাজ্য দ্যাখে।
আপনে বাড়িত যায়া বোঝেন আজ পাছাবেলা আপনের বাড়িত যামো, তখন না হয় তারিখ ঠিক করা যাবো। তো বাবা, গেলে দুই একের মদ্যেই যাওয়া লাগবো। নিচু ও শপষ্টভাবে কেবল আনোয়ারের উদ্দেশে বলে পচার বাপ তার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। তার চলে যাওয়াটা একটু আকস্মিক, তার অনুরোধে আনোয়ারের সায় পেয়ে সে হয়তো অভিভূত, তাই ঠিকঠাক নিয়মমতো বিদায় নিতে ভুলে যায়। আবার এও হতে পারে যে, আনোয়ারকে সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগ সে দিতে চায় না।
কিন্তু এসব নিয়ে আনোয়ার মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না। জালাল মাস্টারের মতো সেও তখন সম্পূর্ণভাবে বটগাছের কজায়।

চিলেকোঠার সেপাই – ২০

ঝুলন্ত ও মাটিতে-গাথা ঝুড়ির মাঝে মাঝে শুকনা পাতা, হলদে ঘাসে-ঢাকা জমির কোথাও কোথাও ছেটো বড়ো আকারের রোদ ও ছায়ার কারুকাজ। রোদ এখানে ঢোকার ফাক পেলো কোথায়? আনোয়ার তখন তাকায় ওপরদিকে। মাথার ওপর বটশাখার বীমের ওপর ঘন বটপাতার বিস্তৃত ছাদ। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ ও ফিকে লাল গোল ফল। গুচ্ছ গুচ্ছ ফল ঘিরে কলরব!—ডালের সঙ্গে ঝুলছে, বাদুড়, ডালপালার ফাঁকে চলন্ত পাতার মতো চরে বেড়ায় শালিক। আর খুব ছোটো ছোটো হরিয়াল দফায় দফায় উড়ে অতিক্রম করছে স্বল্পতম দূরত্ব। একটু করে ঠোকর দিচ্ছে লাল ফলের পাতলা রোয়াওয়ালা চামড়ায়। ফের উঠে যাচ্ছে আরেকটি ফলগুচ্ছের দিকে। বটপ্রাসাদের ছাদে চলমান প্রাণীদের কোলাহলের সঙ্গে ঠাসবুলুনি পাতার স্পন্দন। পাখি ও পাতার মিলিত গতিবিধি অপরিচিত কোনো ভাষার মতো আনোয়ারের কানে অভিনব ঠেকে। বটছাদ তার কাছে অনেক দূরের কিছু বলে মনে হয়, সে মাথা নামিয়ে নেয় নিচের দিকে। নিচে রোদ ও ছায়ার আলপনার তলায় ল্যাজ ও মুণ্ডুদিব্যি মাটিতে ডুবিয়ে পিঠ উঁচু করে শুয়ে রয়েছে এক মাতাল অজগর। অজগর সাপটির বোধ হয় বোধশোধ লোপ পেয়েছে, আর এদিকে আনোয়ারের সামনে অজগরটি ছাড়া সব কিছু হাওয়া হয়ে যায়। হঠাৎ করে অজগর সাপ নিশ্বাস ফেললে বটতলার শুকনা পাতা ও ধুলোবালি উড়ে গিয়ে পড়ে দূরের ধান-কটা জমিতে, বুক দিয়ে জোয়াল ঠেলার চেষ্টা খান্ত দিয়ে করমালি সেখানে কোদাল কুপিয়ে চাষ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ধুলোবালি কি শুকন পাতার সঙ্গে আনোয়ারও সেখানে ছিটকে যেতে পারলে ভালো হতো। এ ছাড়া এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কি কোনো উপায় নাই? এই অজগরের গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে কতোক্ষণ? না, উপায় পাওয়া যায়, কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে বটে, কিন্তু ‘আনোয়ার, তোমাকে আগেই বলছিলাম, মনে আছে? জালাল মাস্টারের প্রশ্নবোধক বাক্যে সে চমকে ওঠে। জালালউদ্দিন দাঁড়িয়ে রয়েছে বুক চিতিয়ে, তার ডান পায়ের নিচে অজগর সাপের ফুলে-ওঠা পিঠ। আনোয়ার নিজে নিজেই লজ্জা পায়, বটগাছের শিকড় শালা কি ভয়ানক ভয় দ্যাখাতেই পারে। গাছের শিকড় অজগরের দেহের বিভ্রম তৈরি করে কিভাবে? সে কি কেবল বয়সের জোরে? নাকি, একই বস্তু শিকড় ও অজগরের দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম? এসব কি এখানকার পুরনো বাসিন্দার কারসাজি?
আনোয়ার, জালাল মাস্টার ফের বলে, এই গাছের বয়স কম করা ধরলেও দুইশো তো হবেই। বেশিও হবার পারে!
প্রমাণ কি? জিগ্যেস করার আগেই জালাল মাস্টার বলে, দেখবা? ঝুড়ির ফাঁকে ফাঁকে তাদের হটতে হয়। সরু মোটা, কিলবিল করা ও পিঠ-উঁচু অনেক শিকড়, সেগুলো ডিঙিয়ে, নতুন পুরনো বেশ কয়েকটা কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে জালাল মাস্টার ও আনোয়ার এসে দাঁড়ায় মোটামেটা ১টা কাণ্ডের সামনে মস্ত মোটা কাণ্ড, কিন্তু সবচেয়ে মোটা নয়। তবে চেহারায় এর বয়স ধরা পড়ে প্রকটভাবে। রোগশয্যায় শুয়ে ছাদের সিলিঙের দিকে ভোতা ভোতা চোখে তাকিয়ে-থাকা বুড়ো মানুষের ভাঙা গালের মতো কাগুটির শরীর মাঝে মাঝে তোবড়ানো, তার এখানে ওখানে গর্ত। এর একদিকে উইপোকার একটা টিবি। এই ঢিবির সংযোজনে শরীরের আয়তন বাড়েনি, মনে হয় এটা দিয়ে তার পড়ে পড়ে গতরটা ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।
‘দ্যাখো। জালাল মাস্টারের তর্জনী অনুসরণ করে আনোয়ার মাটির দিকে দ্যাখে। ইঞ্চি দুয়েক উঁচু বাধানো একটি ইটের বেদি। চুনসুরকির খাবলা খাবলা প্লাস্টার এবং তার নিচে পাতলা চওড়া ইট। এটা দেখিয়ে জালাল মাস্টার বটগাছের বয়স বোঝায় কি করে?
জালাল মাস্টার গম্ভীর হয়ে বলে, বৈরাগীর ঘর। এইখানে বৈরাগী বসবাস করছে।
বৈরাগী কে? আনোয়ার জিজ্ঞেস করে, বৈরাগীর ভিটা তো সবাই বলে, কিন্তু বৈরাগীটা কে?
কে?
আনোয়ারের দিকে না তাকিয়েই জালাল মাস্টার বলে, বৈরাগীটা নয়। এককালের সম্মানিত ব্যক্তি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ!
ও, বৈরাগী তাহলে সত্যি সত্যি ছিলো? আমি ভেবেছি স্রেফ গল্প!
‘গল্প হবে কেন? ইতিহাসের কথা। ইতিহাসের কথা নিয়া মানুষ গল্প করে না? নাটক নভেল লেখে, বায়োস্কোপ করে। ইতিহাস কি তাই কেচ্ছা হয় যায়?
বৈরাগীর ব্যাপারে জালাল মাস্টারের উৎসাহের অন্ত নাই। অতিরিক্ত উৎসাহে প্রায় ১৫/২০ সেকেন্ড সে কথাই বলতে পারে না কেবল এদিক ওদিক দ্যাখে। তারপর বিড়বিড় করে, হু! দদুইশো ববছর তো হলোই।’
একটুখানি তোতলালেও কয়েকটি বাক্যের ঘষায় তার জিভ হাল্কা হয় এবং মুখ দিয়ে কথা বেরোতে শুরু করে প্রবল-তোড়ে-আসা বমির মতো। মনে হয় কিছুই সে রেখে দিতে পাচ্ছে না, ২শতাব্দী আগেকার সব ঘটনা ও দৃশ্য যেন তার নিজের চোখে দ্যাখ্যা, সেই সব উগড়ে ফেলার জন্যে একেবারে অস্থির!
দুশো বছর?
আনোয়ারের সংশয় দেখে জালাল মাস্টার চটে যায়, কেন, ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে, কোম্পানি আমলের শুরুতে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কথা কি আনোয়ার জানে না? —সে তো জানেই। মজনু ফকির, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক-এদের কথা কেন জানে? —যদি জানে তো এতো সন্দেহ করার কি আছে?
কিন্তু ঐ বিদ্রোহের সঙ্গে বটগাছের সম্পর্ক কি? এই বটতলা থেকে কি বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিলো?
আনোয়ার ঠাট্টা করলে এবার জালাল মাস্টার আর রাগ করে না, বরং এতে তার উৎসাহ বাড়ে। বটগাছের গহীন ভেতরে এই ভাঙাচোরা পাকা জায়গার সঙ্গে বিদ্রোহের একজন নেতার স্মৃতি জড়িত। ইতিহাস বইয়ের ওপর কি সব সময় সম্পূর্ণ নির্ভর করা আনোয়ারের উচিত? ইতিহাস বই যারা লেখে তাদের চেয়েও অন্তরঙ্গ মানুষের কাছে এসব কথা শোনা, তাহলে অবিশ্বাস করে কি করে?
শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা গেলো কোথায়?
জালাল মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মনে হয় পরাজিত বিদ্রোহীদের পরিণতির সঙ্গে তার নিজের ভাগ্যও জড়িত। একটু থেমে নিজের দীর্ঘশ্বাসটি সে হজম করে। তারপর জানায় যে, ইংরেজদের হাতে তখন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এদেশী বড়োলোকেরা পরিণত হলো তাদের লাঠিয়ালে। মার খেয়ে সন্ন্যাসী-ফকিরের দল ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। যমুনা তখন ছোটো নদী, খাল বললেও চলে, তার পশ্চিম তীরে নওখিলা পরগণার এক প্রান্তে বনজঙ্গল। বনেজঙ্গলে লুকিয়ে তারা আরো বড়ো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ভবানী পাঠক কিছুদিনের জন্য এদিকে আসেন। আনোয়ার বোধ হয় জানেন যে, শেষের দিকে ভবানী পাঠক ও মজনু শাহ একজোট হয়েছিলেন। তো এখানে এসে ভবানী পাঠক মিলিত হন ফকিরদের পলাতক কিছু কর্মীর সঙ্গে। বটগাছের তলায় এই বেদী ভবানী পাঠকের তৈরি। তার কি স্থায়ী ঠিকানা থাকতে পারে? ভবানী পাঠক তাই বিদ্রোহীদের সঙ্গে কখনো চলে যান মহাস্থান, বাঙালি নদী পেরিয়ে, করতোয়া পেরিয়ে মহাস্থান-ফকিরদের বড়ো ঘাটি। কখনো বা ঘোড়াঘাট। আবার গঙ্গা পার হয়ে বিহার। কিন্তু বিদ্ৰোহ আস্তে আস্তে নিভে যায়। বিদ্রোহ নির্বাপিত হওয়ার গল্প বলতে বলতে জালালউদিনের কণ্ঠও মিইয়ে আসে, খানদানীরা কেউ অগ্রসর হয়া ফকির-সন্ন্যাসীদের সহায়তা করলো না। তার সব নীরব হয়া থাকলো।
না নীরব ঠিক থাকেনি। আনোয়ার বলে, ইংরেজদের চাকর-বাকরে পরিণত হয়ে তার হামলে পড়লো দেশবাসীর ওপর।
‘দেশের মানুষ কি করে, কও? ফকির-সন্ন্যাসীরা কি করতে পারে? যতোই কও বাপু, শিক্ষিত মানুষ, বড়ো ঘরের মানুষ যদি নেতৃত্ব না দেয় তো কিছুই হয় না। জালাল মাস্টার হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, দ্যাখো, মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম, জওহরলাল নেহরু, ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়াদি—এই সব বড়ে বড়ো ঘরের উচ্চ শিক্ষিত মানুষ অগ্রসর না হলে দেশে স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয়?
উপমহাদেশের এতো সব নেতার নাম ও জালাল মাস্টারের অলঙ্কারসমৃদ্ধ বাক্য আনোয়ারকে মুগ্ধ করে না, সে বরং পাল্টা জিগ্যেস করে, কিন্তু আন্দোলন যদি ঐসব বড়ো বড়ো ঘরের বিরুদ্ধে হয়?
বিদেশীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, তার আবার বড়ো ঘর ছোটো ঘর কি? দেশের সকল অধিবাসীর সংগ্রাম।
কিন্তু বড়ো ঘরের মানুষদের যদি বিদেশী শাসকরা পোষে, তাহলে? এই দুইয়ের স্বার্থ যদি এক হয় তাহলে বড়ো ঘরের শিক্ষিত মানুষ বিদ্রোহীদের সঙ্গে আসবে কেন?
এসব কথা জালাল মাস্টারের মাথায় ঢুকতে চায় না। ঢোকাবার সখও নাই তার। সে তখন ব্যস্ত সন্ন্যাসীকে নিয়ে। বটতলার এই আস্তানা থেকে তার নিয়মিত অন্তর্ধানের কথা সে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে। কোথায় যুদ্ধে আহত হয়ে সন্ন্যাসী একবার ফিরে এসেছিলেন। একটু সুস্থ হলে মজনু শাহের কয়েকজন সাগরেদকে নিয়ে তিনি চলে যান পশ্চিমে। সেই যুবকদের কয়েকজন ফিরে আসে, কিন্তু সন্ন্যাসীকে আর দাখা যায়নি। বটগাছের নিচে মজনু শাহ কি মুসা শাহ-জালাল মাস্টার ঠিক বলতে পারে না,-এই ২জনের ১জনের প্রধান সাগরেদ সুলতান শাহ ১টি মক্তব খোলে। সুলতান শাহ চিরকুমার, তার মৃত্যুর পর তাই ভাইপোর ছেলে কুদ্দুস শাহ করলো পাঠশালা। আবদুল কুদুসের পাঠশালা, এই অঞ্চলে খুব নামকরা ইস্কুল। নদীতে গোসল করতে গিয়ে কুদ্দুস মৌলবি কুমিরের ভোগ হলো। তারপর কোথায় মক্তব? কোথায় পাঠশালা? বৈরাগীর ভিটা তখন থেকে খালি পড়ে থাকে। দুশো পৌনে দুশো বছর আগেকার কার্যকলাপ জালাল মাস্টার যেন চোখের সামনে দেখতে পায়। কুদ্দুস মৌলবির কথা আনোয়ার আগেও তার কাছে কয়েকবার শুনেছে, এই লোকটি জালাল মাস্টারের প্রপিতামহ। এখন তার সম্বন্ধে বলতে বলতে জালাল মাস্টার হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের কারণ কি? না, এতো বড়ো মানুষের ভিটা, তার সবটা আর কি-না একটা গাছের কজায় চলে যাচ্ছে। আরে বাবা, আল্লাহর জায়গা-বসত করো, আবাদ করো, লাঙল দাও, ফসল হোক, খাও, সংসার বাড়ুক। তা না করলে? না করলে কি হতে পারে তা এই বটগাছ থেকেই বুঝতে পারো। দ্যাখো না শালার বটগাছ কি রকম ছড়িয়ে পড়ছে। এখানকার এক ছটাক জমিও কি হেলাফেলার বস্তু? এই সব জায়গা হাজার বছর ধরে সুপ্ত ছিলো নদীর জলধারার নিচে, তা নদী থেকে উঠে এসেছে, সেও কয়েক শো বছর তো হবেই। ফসল ফলাবার জন্যে তার প্রচণ্ড কামনা পানির নিচে চাপা পড়েছিলো, জেগে উঠে তাই শরীর বিছিয়ে সে তৈরি হয়ে রয়েছে। লাঙল ছোঁয়ালেই এখানে ফসল জমির কামুক শরীরে মানুষের গতর খাটালেই শস্য। অথচ দাখো, বটগাছ কিনা দিনের পর দিন মাটি দখল করে চলে। বটগাছ এদিকে বাড়ে, ওদিকে বাড়ে, ৩ বিঘা সাড়ে ৩ বিঘা জমি তো খেয়েই ফেলেছে, মাঠের ওপারে তালপোতার মানুষ ভয় পায়, একটা ডাল যদি কোনোরকমে ওদিকে যায় তো সেখান থেকে ঝুড়ি ঝুলে পড়বে, শিকড় বেরুবে, তারপর গ্রাম কি আর লোকালয় থাকবে?
আনোয়ার অবাক হয়, তাই কি হয়? যেখানে মানুষ বসবাস করছে, চাষবাস হচ্ছে, সেখানে গাছ বাড়ে কি করে?
না গো, তোমরা জানো না। এই গাছের লোভ বড়ো বেশি। মনে হয় ব্যামাক জমি না খালে এর খিদা মিটবে না। জালাল মাস্টার চোখ দিয়ে বটগাছ চাটে, আস্তে আস্তে হাঁটে, বলে, তৃতীয় রিপু শালার বড়ো উগ্ন। প্রথম রিপুর কথা আল্লাই জানো শেষ বাক্যটিকে রসিকতা বলে মনে করে সে নিজেই একচেট হেসে নেয়, হাসি থামলে বলে, কখন মাথা তুল্যা শালা মানুষের ঘরবাড়ির মধ্যে থাম্বা তোলে কেউ কবার পারে?
গাছের এরকম স্বেচ্ছাচারী সম্পপ্রসারণের কথা আনোয়ার বিশ্বাস করে না। কিন্তু সেই কথা সরাসরি বলাটাও বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে, সে জিগ্যেস করে, তা লোকে গাছ কাটে না কেন? গাছ কেটে ফেললেই তো হয়!
জালাল মাস্টার হঠৎ একেবারে চুপ করে। চুপচাপ সে হাঁটে, একটু পেছনে হাঁটে আনোয়ার। মাথার ওপর বটপ্রাসাদের শেষ অংশ। এদিকটায় রোদ বেশ উজ্জ্বল। পায়ের নিচে বটপাতার ছোটো ছোটো স্তুপ ক্রমেই আরো ছোটো হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে বোটা থেকে কি পাখির ঠোঁট থেকে খসে পড়ে পাকা বটফল। এইসব পাতা ও ফল পায়ে মাড়িয়ে কি পাশ কাটিয়ে তারা হাঁটে। এই ২জন মানুষের নীরবতার সুযোগে গাছ ভর্তি শালিক ও হরিয়ালের ধ্বনি উচ্চকণ্ঠ হয়। আনোয়ার কথা বলতে শুরু করলে সেই আওয়াজ ফের পেছনে পড়ে যায়। এই যে জমির ওপর এই মোটা ডালটা এগিয়ে এসেছে, এর থেকেই তো ঝুড়ি নামবে। ঝুড়ি ঢুকে পড়বে মাটির ভেতর, এইভাবে মাটি মানুষের হাতছাড়া হচ্ছে। কালই করমালিকে বলে এই ডাল কেটে ফেলার বন্দোবস্ত করুক না জালাল মাস্টার!
বটগাছের সীমা পার হয়ে জমির আলে পা দিয়ে জালাল মাস্টার বলে, ‘পুরান গাছ প্রাচীন কালের বৃক্ষ, বহুদিনের সাক্ষী। তাজিম করা কথা কওয়া দরকার।
জি?
না, ধরে এতোদিনের সাক্ষী। এই গাছ হলো এই এলাকার মুরুব্বি। এ্যাঁর দেহে আঘাত দিলে মুরুৰ্ব্বিক অপমান করা হয় না?
আনোয়ার হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঠের ওপারে গ্রাম দেখতে দেখতে জালাল মাস্টার বলে, বুঝলা না? গাছের আত্মা থাকে না?
‘গাছের আত্মা? মানে?
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আত্মা মানো? জালাল মাস্টার বিরক্ত হয়, গাছেরও আত্মা থাকে। বিজ্ঞানেই তো বলে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কি আবিষ্কার করছে, কও তো বাবা?
‘সে তো প্রাণ। গাছের প্রাণ আছে।’
ঐ তো। জীবের বয়স হলে তারা আল্লার রহমত পায়। পুরান গাছেরও রুহু থাকে। গাছের দেহে ব্যথা দিলে আত্মা কষ্ট পায়।’
কি রকম?
এই গাছে আঘাত করলে তার ভালো হয় না। গাছ রুষ্ট হয়।
ভালো হয় না মানে?
অমঙ্গল ঘটে।
কিভাবে? কতোভাবে হবার পারে। জালালউদ্দিন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তোমার বাপু আজকালকার শিক্ষিত চ্যাংড়াপ্যাংড়া সবই ন্যাংটা করা দেখবার চাও। মুরুব্বি মানো না! কিছুক্ষণ চুপচাপ ইটার পর সে বলে, কেউ এই গাছের ডাল কাটলে কি দেহের কোনো জায়গায় কোপ দিলে সেই মানুষের অকল্যাণ ঘটে। তার ক্ষতি একটা না একটা হবেই।’
‘সত্যি?
হ্যাঁ, তোমার সাথে মিথ্যা উক্তি করলে আমার লাভ কি? আনোয়ারের বিস্ময়কে স্বতঃস্ফূর্ত সশ্রদ্ধ ভয় বলে গণ্য করে জালালউদ্দিন উৎসাহিত হয়, তো কি? কুড়ালের কোপ দিলে সেই মানুষ রক্তবমি করতে করতে মরবে। না হলে মাথাত বায়ু চড়ে, তখন নিজেই গলাত দড়ি দিয়া মরে।’
বলেন কি? আনোয়ারের মনে পড়ে জিনের কথা, চেংটু বলছিলো এখানে নাকি জীন থাকে?
আরে ঐ ব্যাটার কথা থোও। জালাল মাস্টার চেংটুর ওপর বিরক্ত হয়েছে, জীন থাকলে আছে তো ঐ চেন্টুর কথা বাদ দাও। শালা হস্তিমূখ, শিক্ষা নাই, দীক্ষা নাই, মাথা গরম, জীন-পর নিয়া কথা কোস তুই কোন আক্কেলে?
আনোয়ার জিগ্যেস করে, এখানে কেউ মারা গেছে এভাবে?
অনেক! জালাল মাস্টার পেছনদিকে মুখ করলে আনোয়ারও সেদিকে তাকায়। শীতকালের রোদ নিদ্বিধায় শুয়ে থাকে সমস্ত মাঠ জুড়ে। মাঠের পর বটগাছকে এখান থেকে সুদূর ও নির্বিকার বনের মতো মনে হচ্ছে। ঐ বটবনের ভেতরকার অধিবাসী শালিক হরিয়ালের ঐকতান এখন বনের বাইরে আসতে না আসতে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মাঠের রোদের নিচু স্বরের সঙ্গীতের বিস্তৃত ধ্বনিতে। কানে বাজছে অন্য কোনো তৃতীয় ধ্বনি। জালাল মাস্টার তার স্বর হঠাৎ খাদে নামায়, ফিসফিস করে, গোটা ইউনিয়ন যদি হিসাব করো তো গড় ৩০/৪০ বছরে কম করা হলেও জনা দশেক মানুষের অপঘাতে মৃত্যু ঘটছে। অভাবে পড়লে চাষাভূষা মানুষের দিশা থাকে না, বিবেচনা বোধ লুপ্ত হয়, বাজারে নিয়া বেচার জন্য গাছের ডাল কাটে। কেউ কেউ কোপ মারার সাথে রক্তবমি করা মৃত্যুবরণ করছে, কেউ আবার বাড়িত যায়া গাছের সাথে দড়ি ঝুলায়া মরছে।’
‘সে তো দারিদ্রের জন্যেও হতে পারে। খেতে পায় না, ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে না- প্রতিবাদ করলেও আনোয়ারের গলাও এখন নিচু।
এইসব কথা বেশি না কওয়াই ভালো! জালাল মাস্টার বিষয়টির উপসংহার টানতে চাইলেও আনোয়ারের বুক শিরশির করে। রোদ কি ঠিক কি একটু দূরের গ্রাম, এমনকি গোটা বটবৃক্ষ ছাড়িয়ে অন্য ১টি ছায়া তার চোখে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে এই অনুমানে সে ওপরের দিকে তাকায়। না, সেখানে বিশাল শূন্যতায় কাপে কেবল সাদা। তবু, বটগাছের প্রাচীনতম বাসিন্দার উড়ালের ফলে ১টি শিক্ষা হিসহিস করে ওঠে যদি আনোয়ার জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে হাঁটে।

চিলেকোঠার সেপাই – ২১

রায়সায়েবের বাজারের পুলের মুখে মসজিদের উল্টোদিকে বন্ধ হার্ডওয়্যার দোকানের রকে দাঁড়ালে মানুষের আর শেষ দ্যাখা যায় না। ওসমান প্রথমে তাকায় উত্তরে। কালো কালো হাজার হাজার মাথা এগিয়ে আসছে অখণ্ড স্রোতোধারার মতো। এই বিপুল স্রোতের মধ্যে ঘাইমারা রুইকাতলার কাক নিয়ে গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে কোটি ঢেউয়ের ঢল। দক্ষিণে তাকালেও দ্যাখা যায় এই সোতোধারা কেবল এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ক্যালেন্ডারে যা-ই থাক, ঢাকায় আজ আষাঢ় মাস। উত্তর থেকে আসে বরফ-গলা শহরের স্রোত, উপচে উঠে মানুষ গড়িয়ে পড়ছে পাশের গলিতে উপগলিতে। গলি-উপগলি ভরা কেবল মানুষ, দুই পাশের বাড়িগুলোর ছাদ পর্যন্ত মানুষ। গলি উপগলি থেকে স্রোত এসে মেশে মূলধারার সঙ্গে, মানুষ বাড়ে, নবাবপুর সামলাতে পারে না, মানুষের প্রবাহ ফের গড়িয়ে পড়ে পাশের ফাকা গলিতে। ফাকা গলি কি আর আছে? সব জায়গা কানায় কানায় ভরা। ঢাকায় কি এতো লোক বাস করে? মনে হয় ঢাকা শহর তার ৩৫০/৪০০ বছরের বুড়ো হাবড়া রোগাপটকা লোনা-ধরা গতর ঝেড়ে উঠে ছুটতে শুরু করেছে সামনের দিকে। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। ওসমানের বুক ধক করে ওঠে, এই এতোদিনকার শহর কি আজ তার সব মানুষ, সব রাস্তা গলি উপগলি, বাড়িঘর, সব অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে গড়িয়ে পড়বে বুড়িগঙ্গার অতল নিচে। না দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তার শীতের শীর্ণ তনু একেবারে নিচে ফেলে উঠে এসেছে বিপুল স্ফীত হয়ে, বুড়িগঙ্গার অজস্র তরঙ্গরাশির সক্রিয় অংশগ্রহণ না হলে কি এরকম জলদমন্দ্র ধ্বনি উঠতে পারে, আসাদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করে ওসমান, না হে, মিছিলের মাথা দ্যাখা যায় না। অনেক সামনে উঁচু ১টা বাশের মাথায় ওড়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের লাল ঝাণ্ডা। বাঁশের মাথায় এই শার্ট হলো দস্তি দারের হাতের লাললণ্ঠন। নদীর জাহাজ নয়, নদীই আজ ছুটতে শুরু করেছে দস্তিদারের লাল লষ্ঠনের পেছনে। এই পাগলপারা জলোস্রোতকে আজ সামলায় কে? ভরা বুকেও ওসমানের একটু খারাপ লাগে বৈ কি?-আনোয়ারটা এসব দেখতে পারলো না। এতো বড়ো মিছিল ঢাকায় কোনোদিন বেরিয়েছে? বেচারা কোথায় কোন গ্রামে গেলো, গ্রামে যতো আন্দোলন হোক, এতো মানুষ কি একসঙ্গে দ্যাখা যাবে? কাল ইউনিভারসিটির ছেলেকে মেরে ফেললো আইয়ুব খানের পুলিস, এতো বড়ো বিক্ষোভ ঘটে যায়, আনোয়ার কিছুই দেখতে পারলো না। আনোয়ার কি জানে যে ঢাকা এতো মানুষকে ঠাই দিতে পারে? সেই কোন ছেলেবেলায়, ৪ বছর বয়সে ওসমান ঢাকায় এসেছে। দিন যায়, লোকসংখ্যা বাড়ে, এলাকা প্রসারিত হয়। কিন্তু না, এতো মানুষ ঢাকায় সে কোনোদিন দ্যাখেনি। কোন বইতে যেন পড়েছে, শায়েস্তা খান কার আমলে ঢাকায় লোকসংখ্যা নাকি লন্ডনের চেয়ে বেশি ছিলো। সে কবে? কতোকাল আগে? ওসমানের বুক ছমছম করে: এই এতো মানুষের সবাই কি তার মতো শ্বাসপ্রশ্বাসনেওয়া মাছ-ভাত খাওয়া সাধারণ মানুষ? এই যে জনপ্রবাহ, এর অনেকের কাপড় চোপড়, চেহারা তার কাছে অপরিচিত ঠেকছে? এরা কে? তার মানে, অনেক কাল আগেকার মানুষও কি মিছিলে যোগ দিয়েছে? ঐ তো, মিছিলের মাঝখানে ইসলাম খাঁর আমলের খাটো-ধুতিপরা ঢাকাবাসী! এমনকি তারো আগে চালের বস্তা বোঝাই নৌকা বেয়ে যারা সোনারগাও যাতায়াত করতো তারাও এসেছে। বাঙলা বাজার, তাঁতীবাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তো ইব্রাহিম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি-পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খাঁর টাকায়-আট-মণ-চালের আমলে না-খেয়ে-মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই,-কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মোগলের হাতে মার-খাওয়া, মগের হাতে মারখাওয়া, কোম্পানীর বেনেদের হাতে মার-খাওয়া—সব মানুষ না এলে এই মিছিল কি এতো বড়ো হয়? রেসকোর্সের কালীবাড়ির ইটের শুকনা পরত খুলে খাড়া হাতে নেমে এসেছে মারাঠা পুরোহিত, মজনু শাহের ফকিররা এসেছে, ঐ তো বুড়ো আঙুল-কটা মুষ্ঠির ঘাই ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে মসলিন তাঁতী, তাদের কালে কালো খালি গা রোদে ঝলসায়। ৪০০০ টাকা দামের জামদানী-বানানো তাঁতীদের না-খাওয়া হাড্‌ডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলছে। সায়েবদের হাতে গুলিবিদ্ধ বাবুবাজার মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন মুসল্লিরা চলেছে, বিড়বিড় করে আয়াত পড়ার বদলে তারা আজ হুঙ্কার দিচ্ছে, বৃথা যেতে দেবো না লালমুখে৷ সাহেবদের লেলিয়ে-দেওয়া নবাব আবদুল গনি-রূপলাল মোহিনীমোহনের শ্বাদন্তের কামড়েক্ষতবিক্ষত লালবাগ কেল্লার সেপাইরা আসে, ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে গলায় দড়ি ছিঁড়ে নেমে আসে মীরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, সন্দ্বীপ-সিরাজগঞ্জ-গোয়ালদের সেপাই। না হে, তাতেও কুলায় না। যুগান্তর অনুশীলনের বেনিয়ান ও ধুতি-পরা মাতৃভক্ত যুবকেরা আসে, তাদের মাঝখানে কলতাবাজারে নিহত ছেলে ২টিকে আলাদা করে চেনা যায়। নারিন্দার পুলের তলা থেকে দোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। ঐ তো বরকত মাথার খুলি উড়ে গেছে, দেখে একটু ভয় পেলেও ওসমান সামলে ওঠে। এতো মানুষ। নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠেছে আজ, ঢাকা আজ সকাল-দুপর-বিকাল-রাত্রি বিস্মৃত, আর তার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ নাই, সপ্তদশঅষ্টাদশ-ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত। সীমাহীন কাল সীমাহীন স্থান অধিকারের জন্য ঢাকা শহর আজ একাগ্রচিত্ত। ওসমানের বুক কাপে এই বিশাল প্রবাহের সঙ্গে সে কতোদূর যেতে পারবে? কতোদূর? গোলক পাল লেনের মুখে কলের নিচে কাঁপতেথাকা কলসি যেমন পানিতে ভরে স্থির হয়, আমাদের ওসমান গনির বুকটাও দেখতে দেখতে পূর্ণ হলো, এই অবিচ্ছিন্ন স্রোতোধারার ক্ষুদ্রতম ১টি কণা হয়েও তো সে এই হৃৎপিণ্ডে তাপ বোধ করতে পারছে। তাই বা কম কি? ভরা-বুকে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে সে হুঙ্কার দেয়, বৃথা যেতে দেবো না।
ওসমান!
ওসমান প্রথমে এই ডাক শোনে নি। আরেকবার ডাকলে সে চমকে ওঠে, কে ডাকে? মজনু ফকিরের কোনো কর্মী তাকে চেনে? নাকি ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে দড়ি ছিঁড়ে-আসা-বেরিলির সেপাই? নাকি সোমেন চন্দ?-কে ডাকে? তার শরীর শিরশির করে। তাকে কে চেনে? এখানে কে চেনে?
‘ওসমান! এই যে!
কে?
আরে রকে দাঁড়িয়ে কি করছেন? আসেন। শওকতের হাতের চুরুট নিভে গেছে, ফের ধরাতে ধরাতে বলে, ‘আসেন।
শওকতের পাশে চলতে চলতে ওসমান এদিক ওদিক তাকায়। ঐ লোকগুলো গেলো কোথায়? আনোয়ার থাকলে এসব কথা বলা যেতো। শওকত বিশ্বাস করবে না।
বেলাগড়ায়। বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি ইসলামপুর ধরে আরেকটি স্রোতোধারা বইছে। চাপা রাস্তায় অকুলান হয় বলে উঁচু উঁচু বাড়ির মাথা থেকে পা পর্যন্ত থৈ থৈ করে মানুষ, কেবল মানুষের পাক, মানুষের ঢেউ।
বাবুবাজারে পৌঁছে শওকত বলে, ‘চলেন কিছু খেয়ে নিই। সোয়া তিনটে বেজে গেছে। কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছা ওসমানের একেবারেই নাই। যতোই বাজুক, হোক না শীতকাল, ঢাকায় আজ ভরা বর্ষা। বর্ষাকালের মেঘহীন আকাশে কিসের দুপুর, কিসের বিকাল? এই তো একটু গেলেই বাবুবাজারের পুল, তারপর দুদিকে কেমিক্যাল ও পারফিউমারি দোকান, সুগন্ধের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে কিছুটা পার হলেই চকবাজারের ফাঁড়ি, সেখানে একটা চক্কর দিয়ে এই সোতোধারা চলে যাবে জেলখানার দিকে, জেলখানার পাশ দিয়ে নাজিমুদিন রোড। জেলখানার দেওয়াল ঘেঁষে যাবার সময় এর ঢেউ কি আরো উত্তাল হয়ে উঠবে না? এমন তো হতে পারে জেলখানার কাছে পৌছুলে এই ঢলের মুখে ভেঙে পড়লো জেলখানার মস্ত উঁচু দেওয়াল হতে পারে না? ভেঙে পড়লো জেলখানা, জেলখানার নিচে লুকিয়ে থাকা ইব্রাহিম খাঁর দুর্গ, সাহাজাদা খুররমের দুর্গ? ওদিকে চলবে এই প্লাবনের ভাঙন, আর সে কি না বাবুবাজারের কোনো এক নিচু ছাদ-চাপা রেস্টুরেন্টে বসে রুটি-গোশত গিলবে?
না, না। চলেন। শহীদ মিনার পৌঁছে না হয় কিছু খেয়ে নেবো।
‘আরে আমরা খেতে খেতে মিছিল আর কতোদূর যাবে? এতো বড়ো মিছিল, এর শেষ মাথা আসার আগেই আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাবে।’
ওসমান কোনো খুঁকি নিতে চায় না, মিছিল যদি তাদের ছেড়ে এগিয়ে যায় বলে, দরকার কি? রেক্সে গিয়ে পরোটা-শিককাবাব খাওয়াবো। এখন চলেন।’
শওকতকে ঠেকানো অতো সোজা নয়, হু কেয়ার্স ফর পরোটা-শিককাবাব? চলেন, পালোয়ানের দোকানে মোরগ পোলাও মেরে দিই।
কিন্তু ওসমানের ভয় হয় মূল স্রোতোধারা থেকে ছিটকে পড়ে একটি নিঃসঙ্গ জলবিন্দুর মতো সে আবার হাওয়ায় শোষিত না হয়। খুব আস্তে করে বলে, আপনি খেয়ে নিন। আমি যাই। কিন্তু এই কথা এতো আস্তে বলা হয়েছে যে, শওকত তাতে কান দেয় না। কিংবা শওকতের চুরুটের গন্ধে কি তার খিদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে? চুপচাপ সে শওকতকে অনুসরণ করে। ওসমানের পাশ দিয়ে মিছিল গর্জন করতে করতে সামনের দিকে চলে।
রাস্তা থেকে খুব সরু ও ছোটো গলি, তারপর ২টো ৩টে ধাপ নিচে নামতে হয়। ঘরে ঢোকার আগেই মোরগ পোলাওয়ের গন্ধ মাথা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করে। ওরা বসার কিছুক্ষণের মধ্যে ২টো প্লেট আসে, পোলাওয়ের ওপরে ২টো মুরগির রান। পাশে এনামেলের ২টো পিরিচে কলজে ও গিলা।
খেতে খেতে মুখ তুললে দেওয়ালের আয়নায় ওসমান বাঁকা-চোরা প্রতিফলন দ্যাখে। চারিদকের দেওয়াল জুড়ে আয়না, যেদিক তাকানো যায় মোগর-পোলাওতে-মনোযোগী মানুষের মুখ। এতো মানুষের প্রতিকৃতির মধ্যে ওসমান নিজেরটা খোজে। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে না পেরে তার গলা শুকিয়ে আসে, তার মুখ কোথায়? আয়নায় সবাই আছে, তো সে নাই কেন? এতো মানুষের মধ্যে সে কি তবে হারিয়ে গেলো? তাহলে মিছিলে লক্ষ মানুষের মধ্যে তার গতি হবে কি? খাওয়া স্থগিত রেখে ওসমান আয়নায় নিজের চেহারা সনাক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শওকত জিগ্যেস করে, কি হলো? আর এক হাফ আনতে বলি? বলতে বলতে শওকত হাত তুললে আয়নায় তার প্রতিকৃতি আলাদা করে বোঝা যায়। পাশে ওসমান। স্বস্তি পেয়ে ওসমান ফের রান চিবায়। তবে আয়নায় তাকে বেশিরকম ইয়াং লাগছে, চেহারাটা একেবারে বালকোচিত হয়ে গেছে। মুরগির রানের হাড়ের ভেতরকার কচুকুচে শাস তার দাঁতে জিভে টাকরায় ও গালের ভেতরদিকের দেওয়ালে অপূর্ব স্বাদ ঘনীভূত করে তোলে। এই স্বাদ কি তার জিভের ও মুখের এতোকালের আস্তরণ ভেদ করে কতোকাল আগেকার অন্য ১টি মুরগির অন্য ১টি রানের পিষ্ট আমিষকে উথিত করে তুলছে? এইতো আয়নার দ্যাখা, দিব্যি বালক হয়ে ওসমান পোলাওয়ের এাস মুখে নিচ্ছে। তার সামনে কে? একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারে যে, সামনে ক্যান্টেন। কাপ্টেনকে মনে নাই? কুাস সিক্সে, কুসি সেভেনে ক্যাপ্টেন আর ওসমান একই বেঞ্চে বসতো, বাইরে বেড়াতো এক সঙ্গে। প্রথমদিকে কিন্তু এতো খাতির ছিলো না। স্যার কাসে ঢোকার আগে গোলমাল করার জন্যে ছেলেদের নাম লেখার দায়িত্ব ছিলো ক্যাপ্টেনের, তাকে তাই যমের মতো ভয় করতো সবাই। তাকে তোয়াজ করতে করতেই খাতির জমে গেলো। আজ এতোকাল পর ক্যাস্টেনের সঙ্গে সে এই দোকানে বসে মোরগ-পোলাও খাচ্ছে ওসমানের হাসিও পায়, এতোকাল আগেকার সব ঘটনা, ঠিক মনে থাকে। আবার দাখা পরশুদিন পড়া বই দিব্যি ভুলে যাই।-ওসমান চারদিকে তাকায়, এখানে এর আগে একবারই এসেছিলো; না, সব অমনি আছে। সামার ভ্যাকেশনের আগের দিন স্যারদের সেবার মোরগ-পোলাও খাওয়ানো হলো। ছুটির আগের দিন ওদের স্কুলে ক্লাসে ছোটো উৎসব হতো। হেড স্যারের নেতৃত্বে
পাকিস্তান জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ /পুরব বাঙালার শ্যামলিমায়/পঞ্চ নদীর তীরে অরুশিমায়/’-আর কোনো লাইন মনে নাই। গান করতে করতে কেউ হেসে ফেললেও স্যরর সেদিন কিছু বলতো না। গানের পর হেডসরের বক্তৃতা, তারপর খাওয়া দাওয়া। প্রস্তুতি চলতো কয়েকদিন আগে থেকে। সাররা ক্কাসে এসে উস্কে দিয়ে যেতো। রমিজ স্যর হয়তো বললো, কি রেকটাবানরের দল, এবারও কি কদলীভক্ষণ? গতবার এই ছেলেদের কুাসে সিঙাড়া মিষ্টি কম পড়ায় ঐ স্যরদের কেবল কলা খেয়ে বিদায় নিতে হয়েছিলো। রমিজ স্যর তাই মনে করিয়ে দিলো, ‘শোন, ‘ক্সাস ফোরের সব বাচ্চা বাচ্চা ছেলে, এবার পরোটা-কাবাব-পনিরের ব্যবস্থা করছে! তোমরা সব ধাড়িগুলো ডালে বসে কদলী সেবন করো। আবার সারদাবাবু এসে উপদেশ দেয়, এবার কালচান্দরে আগেই বইলা রাখিস। কাস সিক্স আষ্ট আনা প্লেট মিষ্টি দিবো, আগে অর্ডার না দিলে ফকির মধ্যে পড়বি কইয়া রাখলাম!’
সাইনু পালোয়ানের দোকানে আগেই বলা ছিলো, সেবার কুস সেভেন মোরগ-পোলাও দিয়ে সবাইকে থ করে দেবে! ক্যাপ্টেন খুব ভোরে জানলার কাছে এসে ডাকে, এই রঞ্জ, ওঠ। রঞ্জ তো রাত থাকতে জেগে বসে আছে, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বেরিয়ে দ্যাখে তাদের রাজার দেউড়ির ভাঙাচোরা বাড়িঘরের ছাদে, লোনা-ধরা দেওয়ালে, খোয়া ও পিচ-ওঠা গলিতে কী সুন্দর গোলাপি রঙের ভোর। কয়েক পা হেঁটে ক্যাপ্টেন বলে, ল, মালাউনটারে লগে লই। শঙ্করকে মালাউন বলে ওর প্রতি নিজের দুর্বলতাকে ক্যাপ্টেন আড়াল করতে চায়। রঞ্জ এসব তখনই বুঝতো বুঝতো না কে? কুসে স্যর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যাদের নামে শাস্তিবিধানের সুপারিশ করা হয় তাদের মধ্যে শঙ্কর কখনো থাকে না। আবার স্কুলের পায়খানার সারির পেছনে একদিন স্কুলে ছুটির পর ক্যাপ্টেন আর শঙ্করকে এক সঙ্গে প্যান্ট খোলা অবস্থায় দেখছে আমিন। ব্ল্যাকবোর্ডে কে যেন একদিন লিখেও রেখেছিলো ক্যাপ্টেন + শঙ্কর। রঙু এসব খুব বোঝে।
তাতীবাজার ঢুকে প্রসন্ন পোদ্দার লেনের উল্টোদিকে শঙ্করদের বাড়ি, বাড়ির সামনে হান্ধা নীল শাড়ি-পরা একটি মেয়ে টগর ফুল তুলছে। তার হাতে বেতের সাজিতে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা। গরমের ভোরবেলাটা কি ফর্সা, মেয়েটার গায়ের রঙ ফর্সা, ওর হাতের ফুলগুলো সাদা। ঝিররির করে হাওয়া বইলে মেয়েটার বাসি মাথায় এলোমেলা চুল একটু একটু ওড়ে। কয়েক গাছি চুলের নিচে ফর্স মুখ আরো ফর্স মনে হয়। ঠিক প্রতিমার মতো। স্কুলে সরস্বতী পূজার সময় একে বেদীতে বসিয়ে দিলে কার সাধ্য ধরে যে এ আসল দেবী নয়!
ক্যাপ্টেনকে দেখে সরস্বতী প্রতিমা বলে, কি কবীর, সব রেডি? মেয়েটির উঁচু-নিচু দাত দ্যাখা যায়, তাতে প্রতিমাত্ব অনেকটা কমে, ফলে সে আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কবীর বলে, ‘মেজদি, এতো ভোরে উঠছেন? ‘ভোর কোথায়? পোনে ছয়টা বাজে, সোয়া পাঁচটায় সূর্য ওঠে, এখন কি ভোর হলো? ফুল দিয়া পূজা করবেন মেজদি?
তোমাদের সারদের পূজা। শঙ্কর অর্ডার দিয়া রাখছে, ভোরবেলা ফুল চাই। রঞ্জর ইচ্ছা করে সে-ও একে মেজদি বলে ডাক। হিন্দুদের ডাকগুলো কি সুন্দর চেহারার সঙ্গে কি চমৎকার খাপ খায়! শরৎচন্দ্রের মেজদিদির চেহারা বোধহয় এরকম ছিলো। না, সে তো অনেক বড়ো, তার ছেলেও ছিলো ১টা। আর যে কেষ্ট না ফেষ্ট তাকে মেজদি বলে ডাকতো সেটা একটা গাধা। কয়েকদিন আগে রূপমহলে নিকৃত দেখেছে, সন্ধ্যারানীর সঙ্গে এই মেজদির মিল আছে নাকি? একদিন রাত্রে আব্বার নিয়ে-আসা কোন এক ম্যাগাজিনে সন্ধ্যারানীর ফুল-পেজ ছবিতে ওসমান চুপ চুপ করে কয়েকটা চুমুও খেয়েছে। সেই কথা মনে পড়লে রঞ্জর ঠোঁট শুকিয়ে এসেছিলো। আরে নাঃ! এই মেজদি কতো রোগা, কতো ফর্সা, কতো আবছা-আবছা।
মেজদি বলে, কবীর, যাও না। শঙ্কর তো এখনো ওঠে নাই। না ডাকলে ওর ঘুম ভাঙে? ক্যাপ্টেন গটগট করে ভেতর চলে যায়। শালার হাঁটুর নিচে এখনি লোম উঠেছে বড়ো বড়ো, ফেল করতে করতে ওঠে, নইলে এতোদিন কুসি নাইনে পড়তো! ভেতরে গেলো, রঞ্জকে একবার সঙ্গে যেতে বললো না পর্যন্ত!
তুমি ওদের সঙ্গে পড়ো, না? তার জবাব না শুনেই মেজদি ফের বলে, তোমাদের ইস্কুলই ভালো, আজ হইয়া ছুটি, না? আমাদের ছুটি হতে এখনো সাতদিন। পচা ইস্কুল। দেশে যাইতে যাইতে কাচা আম একটাও যদি পাই।’
ক্যাঠা রে আরতি? ক্যাঠা? কার লগে কথা কস, এ্যাঁ? কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসে এক প্রৌঢ়, ধুতিটা লুঙির মতো পরা, খালি গা খালি পা। বলে, কি চায়?
একটু রাগ ও একটু ভয় মেশানো গলায় আরতি বলে, ‘পটুর ক্লাসমেট বাবা’ রাত পোয়াইতে না পোয়াইতে বাবুর ইয়ারবন্ধুরা সব আইস পড়ছে? বাবাকে সামলাবার জন্য আরতি বলে, ‘মর্নিং স্কুল চলতাছে তো, তাই ডাকতে আসছে। নিশ্বাসের একই টানে রঞ্জকে জিগ্যেস করে, ও মা তোমার নামই শুনি নাই। তোমার নাম যেন কি?’
শেখ মোহাম্মদ ওসমান গণি। এবার শঙ্করের বাবা হঠাৎ বলে, ‘পল্টরে ডাইকা দে। ওসমানকে জিগ্যেস করে, পল্টর কুাসমেট?
‘জী। জবাব শুনে লোকটা চ্যাচায়, অরে ডাইকা দে না পন্টু, উঠলি না? নয়টা না বাজলে বাবুর ঘুম ভাঙবে না। মানুষ খাড়াইয়া থাকবো?
তার ব্যস্ততা বাড়াবাড়ি ঠেকে। চারদিকের কেমন ফাঁকা ফাকা। কয়েক মাস আগে রায়ট হয়ে গেছে, কোনো কোনো বাড়িতে লোকজন নাই, অনেকে হয়তো কোনোদিন ফিরবেও না। কয়েকটি বাড়িতে মেয়েরা নাই, তাদের ইন্ডিয়া পাঠিয়ে পুরুষগুলো সিচুয়েশন দেখছে। শঙ্করের বাবার উদ্বেগ ও ধমক এই বাড়িতে একটু কাপন তোলে, সেই কাপুনি বশ করার জন্যেই যেন আরতি ফের জিগ্যেস করে, কি নাম যেন বললে?
রঞ্জু!’ নাম জিগ্যেস করলে ওসমান কখনো কিন্তু ডাকনাম বলে না। কেউ জানতে চাইলে পুরো নাম না বললে আব্বা খুব রাগ করে। ইব্রাহিম শেখের কাছে নাম মানে পুরো নাম, তোমার নাম শেখ মোহাম্মদ ওসমান গনি। নাম জানতে চাইলে তো বললে, রঞ্জ কি তোমার নাম? তোমাকে যেমন বাবা বারু বলি, তেমনি রঞ্জও বলি। সবসময় আসল নাম বলবে। নইলে দুটো খাসি জবাই করে আকিকা দেওয়ার কি দরকার ছিলো?
কিন্তু মেজদির সামনে ওসমান রঞ্জুই থাকতে চায়। মেজদি কি তাকে ওসমান বলে ডাকবে? দূর! তাই কি হয়?
আরতি বলে, রঞ্জু ওসমান না কি যেন বললে? এই কথায় ওসমান লজ্জায় মরে যায়। সে যেন প্রত্যাখ্যাত হলো। কি থেকে প্রত্যাখ্যাত? সহপাঠীর বোনের কাছে তার ডাকনামটা নিবেদন করেছিলো, তাই কি নাকচ হয়ে গেলো? –রপ্পুটা বড়ডো ছেলেমানুষ ছিলো শওকতের মুখোমুখি মোরগ পোলাও খেতে খেতে ওসমান গনি আপন মনে হাসে, ছেলেবেলায় সে বড়ডো সেন্টিমেন্টাল ছিলো! কি কথায় যে রাগ হতো, কোন কথায় যে তার অপমান বোধে টং করে বাড়ি লাগতো আরতিকে মেজদি বলে ডাকার সাধটা একেবারে নিভে গিয়েছিলো।
শাখারি বাজার দিয়ে বেরিয়ে ৩জন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফুলের ডালা নিয়ে বসে ছিলো ২জন মালী। রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা চলতে শুরু করেছে। ফুলের ডালার বিপরীত দিকে মাঠা মাখন নিয়ে বসেছে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা বুড়োটা। সেখানে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন কি হিসাব করে, তারপর বলে, ‘মাঠা খাইবি?
এর মধ্যে কালাচাঁদের দোকানের ঝাড়পোঁছ শেষ হয়। হাড়িতে মিষ্টি ও ঝুড়িতে ফুল দিয়ে শঙ্কর একটা রিকশায় উঠলে ক্যাপ্টেন বলে, চল না, এক প্লেট খাইয়া এক লগে যামু! না। মোরগ পোলাও খেয়ে শঙ্কর জাত নষ্ট করবে না। ওর বাবা প্রায়ই বলে, রায়টে যখন বেঁচে গেছে তার মানে ভগবানের একটা ইঙ্গিত রয়েছে ভগবানে প্রাণটা রক্ষা করলো, জাত বাঁচাবার দায়িত্ব তার সৃষ্টির। হরেন ডাক্তারকে কে বোঝাবে যে আরতির বড়োবোন সবিতার দিকে তাহের গুণ্ডার একটা চোখ বিশেষভাবে সাটা ছিলো বলে ওরা প্রাণে বেঁচে গেছে। রায়টের পর পরই সবিতাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতায়। দূর সম্পর্কের মামার বাড়িতে রেখে তার বিয়ের চেষ্টা চলছে। এরপর রায়ট বাধলে জাত ও প্রাণ ২টোর ১টাও সামলাবার দায়িত্ব ভগবান নেবে কি-না সন্দেহ।
সাইনু পালোয়ান নিজে তদারক করে হাড়িতে ৫০ প্লেট মোরগ-পোলাও পরিপাটি করে গুছিয়ে দিলো। সঙ্গে ৫৫টা কাঁঠাল-পাতার ঠোঙা। ক্যাপ্টেন ও রন্ধু ২প্লেট খায় ফ্রি। খাওয়ার জন্যে ব্যবহৃত সেই সব দাঁতে অনেক খাবার চিবানো হয়েছে, জিভে আস্তরণ পড়েছে, অথচ দ্যাখা এখনো তারিয়ে তারিয়ে গলা পর্যন্ত সেই স্বাদ নেওয়া যাচ্ছে। ক্যাস্টেন খেতে খেতে বলছিলো, আমরা খাইছি কেউরে কইবি না, বুঝলি? জলদি খা’
জলদি করেন। চুরুট ধরাতে ধরাতে এখানে এখন তাড়া দিচ্ছে শওকত। তার মুখ দাখা যায় না, ওসমান বলে, রিকশায় যাবো, স্কুলে যেতে কতোক্ষণ লাগবে?
রিকশায় যাবেন? কোন স্কুলে? শওকতের হাসির শব্দে ও চুরুটের গন্ধে ওসমানের ঘোর কাটে।
ওসমান একটু হাপায়। কয়েকটি মিনিটের মধ্যে এতোগুলো বৎসর পারাপার করার ধকল কি কম? তার আর উঠতে ইচ্ছা করে না। ধীরেসুস্থে হাত ধুয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। শওকত তখন বিল শোধ করছে। ওসমান দেওয়ালের আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আরে একি! রঞ্জ এসে পড়লো কখন? রঞ্জুর সঙ্গে কি রানুও আছে? সামনের পারদ-ওঠা আয়নায় মঞ্জুর প্রতিকৃতি, তার হাওয়াই শার্টের পকেটে এম্বডারি করা প্যাগোড়া। রঞ্জকে দাখার জন্য সে পেছনদিকে মুখ ঘোরায়, নাঃ রঞ্ছ কোথায়। রঙ্গু এখানে আসবে কোথেকে? এইসব ৫০/৬০ বছরের আয়নায় মানুষকে যে কিরকম দ্যাখায়! ওসমান ঘুরে দাঁড়ালে আয়না থেকে রন্থ অদৃশ্য হয়।
আয়নায় রন্ধুকে দেখছে মনে করে যে চঞ্চলতা ও উত্তেজনা হয়েছিলো তা কেটে যাওয়ায় ওসমানের মাথা ও বুক খুব খালি খালি লাগে। অবসাদ আরো বাড়ে। মিছিলের ল্যাজের পাতলা অংশটি তাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দোকান থেকে সিগ্রেট কিনে ওসমান সিগেট ধরায়। মিছিলের গর্জনে তার ভয় হয়, এর ভেতর ঢুকে সে কি সমান তালে হাটতে পারবে? এমনকি শ্লোগানও দিতে পারবে কি? এতো মানুষের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে তাকে চিনবে কে? শওকতকে বলে, আপনি যান, আমি ফিরে যাবো।
মানে?
আমার শরীরটা খারাপ। খুব টায়ার্ড। আমি বরং বাসায় যাই।
বাসায় যেতে হলেও তো হেঁটেই যেতে হবে। তার চেয়ে চলেন, একটু তাড়াতড়ি হেঁটে মিছিলের মাঝামাঝি চলে গেলে দেখবেন ভালো লাগবে।
শওকতের যুক্তি ও পরামর্শে ওসমান ভূ কোচকীয়, এই লোকটা অন্যের প্রব্লেম বুঝতে পারে না। এর কথার প্রতিবাদ করাও মুশকিল। তার খুব বমি বমি লাগছে। আস্তে আস্তে বলে, ‘না, আমি চলি।
শওকত তাড়াতাড়ি মিছিলে যাবার জন্য উদগ্রীব, আপনি বোধহয় খুব সিক। একা যেতে পারবেন?
খুব!

চিলেকোঠার সেপাই – ২২

শাঁখারি পট্টিতে ঢুকে পলেস্তারা-খসা ও ইট বার-করা চুনসুরকির উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে ওসমান হাঁটছে আর সেই সব বাড়িঘরের শুকিয়ে-যাওয়া মজ্জার গভীর ভেতরকার শাস থেকে সোদা সোদা ও ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে তার শরীরে। ফলে অবসাদ একটু একটু করে কাটে, শরীর ফুরফুরে মনে হয়। সেই হাওয়ার একেকটা দমক এসে হাথায় ঝাপটা মারে: ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এই রাস্তায় হঁটিতে হাটতে এরই একটা গলি ধরে সে ঢুকে পড়েছে তাতীবাজার, কিংবা বেরিয়ে গেছে ইসলামপুরের দিকে। না, শঙ্করদের বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। ক্যাপ্টেন ঐ একদিনই ওকে নিয়ে গিয়েছিলো, তা শঙ্করের কাছে যাবার সময় ক্যাস্টের কোনোদিন কাউকে সঙ্গে নিতো না। ওসমান পরে হয়তো যেতো, কিন্তু ম্যাট্রিক পাস করে আরতি কলকাতা চলে গেলো, মাস ছয়েকের মধ্যে গেলো শঙ্করদের বাড়ির আর সবাই। হ্যাঁ, ওসমানের সব মনে আছে। যতোই ইন্ডিয়া নিয়ে যাক, ঐ খাটো-ধুতি খালি গা, খালি পা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সাধ্য কি ওদের দুই ভাইবোনকে এই পাড়া থেকে শেকড়বাকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে? ওসমান এইতো শপষ্ট দেখতে পাচ্ছে, অপরিবর্তিত শাখারি পটির কলের ধারে ধারে কলসি, বালতি ও হাড়ির সারি। পাশে পাশে দাঁড়ানো শাড়ি ও ফ্রকওয়ালা ফ্যাকাশে ফর্স মুখের মেয়েগুলো। মেয়েদের ঝগড়া চলছে, তাদের নালিশ চলছে, তাদের স্বর এই আবদেরে আবদেরে, আবার পরের মুহুর্তে ঝাঁঝালো। ওসমান একটা গা-ঝাড়া নিশ্বাস ফেলে: না, এখানে অবিকল সব একই রকম রয়ে গেছে। ফ্রকের নিচে তাদের চিকন বা শাসালো পাগুলো এবং শাড়ির তলায় তাদের নিস্তেজ বা চাঙা বুক একইভাবে পুরুষের শরীরে হাওয়া খেলায়। খোঁচা খোঁচা কালো-সাদা দাড়িওয়ালা যে প্রৌঢ় লোকটি ওসমানের, এমন কি ওসমানের বাপ-দাদার জন্মেরও আগে থেকে পূর্ব পুরুষের সঙ্কীর্ণ বারান্দায় বসে রাস্তার নোঙরা নালায় সশব্দে খুধু ফেলতে ফেলতে মস্ত ভাঙা-চাদের মতো করাতে শাখ কাটতো, তার খুধু ফেলা ও শাখ কাটা আজো অব্যাহত রয়েছে। এমন কি এই ২টো নির্ধারিত কাজের মধ্যে সময় করে নিয়ে কলের পাশে পানির প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের কলাগাছের মতো পাগুলোর দিকে তার শ্যাওলা-পড়া চোখে তাকাবার অভ্যাস থেকেও লোকটা ছাটাই হয়নি।
তাঁতীবাজারে ঢুকেও ওসমান বেশ ধীরে সুস্থে হাঁটে। কিন্তু যে জায়গায় এসে সে থামবো থামবো করে সেখানকার চেহারা একটু পাল্টে গেছে। কয়েকটা বাড়ি ভেঙেচুরে এমন আকার দেওয়া হয়েছে যে ওসমানকে বারবার ওপরে নিচে এবং ডাইনে ও বায়ে তাকাতে হয়। চেনা জায়গায় থাকার ফুরফুরে ভাবটা নষ্ট হওয়ার দশা ঘটলে ওসমান টগর বা গন্ধরাজ বা শেফালি ফুলের গাছ দ্যাখার জন্য ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকায়। ১টি পুরনো অপরিবর্তিত বাড়ি তার তীক্ষ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। না, সেই বারান্দায় ঝুলও টবে অৰ্কিড, বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরতির বয়সের একটি মেয়ে। না, এই মেয়েটির পরনে সালওয়ার-কামিজ। এ বাড়ি হতেই পারে না। এরকম পর পর কয়েকটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। না, এ বাড়ি নয়। ওসমান অস্বস্তি বোধ করে এবং তার বুকের নিচে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। অথচ এরকম হওয়ার কোনো কারণ নাই। সকালবেলা ঘর থেকে বেরুবার সময় নোভালজিন ও এ্যাঁন্টাসিড ২টো করে ট্যাবলেট খেয়েছে। আবার এখন খিদে পাওয়াও উচিত নয়, একটু আগে পেট ভরে মোরগ-পোলাও খাওয়া হলো। দুৰ্ত্তোরি। তার খুব রাগ হয়। রাগের টার্গেট না পাওয়ার উত্তেজনায় ছটফট করে এবং দ্রুত পায়ে এ-গলি সে-গলি হয়ে বেরিয়ে আসে কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। আর হরতাল বলে এই রাস্তায় লোকজন কম। ছোট্রো ১টি রেস্টুরেন্টের সামনে কয়েকজন তরুণ দাঁড়িয়ে মিছিলের গল্প করছে। কিন্তু এই রাস্তাটি তার চোখে ধাবমান ছবিই রয়ে যায়, কোনো দৃশ্যে স্থির হবার সুযোগ পায় না। ওসমান বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে, মিছিলটাও মিস করলো, এখন কোথাও পৌছুঁতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৌছুঁতে হবে কোথায়? কৈলাস ঘোষ লেনের ১টি বাড়ির সামনে এসে দুরুদুরু বুকে সে বাড়িটাকে সনাক্ত করার চেষ্টা করে। এইতো ছোটো দোতলা বাড়ি, রাস্তার ঠিক ওপরে উঁচু ইট-বের-করা খয়েরি রঙের বারান্দা। দোতলা বরাদায় শিশু বটগাছের রোগা ডালপালার ভারে ঝুলে পড়েছে কার্নিশের অংশ। না। এই বাড়ি তাকে প্রতারিত করেনি। ওসমান একটু একটু হাঁপায় এবং সক্তজ্ঞ চোখে বাড়িটার দিকে দ্যাখে। এইতো নিচে রাস্তার দিকে জানলাওয়ালা ঘরটিতে ক্যাপ্টেন থাকে। সিমেন্টের প্ল্যাপে পা রেখে বারান্দায় উঠে সে আঁশ ওঠা, বৃষ্টির ঝাপ্টায় রেখা-রেখা-দাগ-হয়ে-যাওয়া এবং রোদে এবড়োখেবড়ো কাঠের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। কিন্তু ভেতর থেকে সাড়াশব্দ নাই। একটু বিরতি দিয়ে ওসমান এদিক-ওদিক দ্যাখে। উল্টোদিকের ডাস্টবিনটাও আছে, কেবল ড্রামের জায়গায় সিমেন্টের নিচু দেওয়াল। মুখ ফিরিয়ে সে ফের কড়া নাড়ে এবং ডাকে, ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন ২বার ডাকার পরও তার খুব হাসি পায়, এতোদিন পর ক্যাপ্টেন বলে ডাকলো কি করে? একি? সে কি এখনো কুাস VIB না VIIA-তে পড়ে? তাহলে কি ঘোরের মধ্যে ফের অনেকদিন আগে চলে গিয়েছিলো? এরকম যাওয়া যায়? খুশি ও কৌতুকে তার এতো হাসি পায় যে ঠোঠে হাত দিয়ে হাসি চাপতে হয়। ক্যাপ্টেন শালা আসুক, ওসমান বলবে, কি ক্যাপ্টেন চিনতে পারো? চিনতে পারলে ওসমান বলবে, দোস্ত তোমাকে শালা এতো ভয় পেতাম যে আজও নাম ধরে ডাকতে সাহস হয় না! ক্যাপ্টেন বলবে, রংবাজি ছাড়, তুই শালা আছিলি কৈ? ইস্কুলে থাকতে চিকনা আছিলি, অহনও আমসিই রইলি!’ ওসমান বলবে, তুমি আমাদের বডি-বিল্ডার ক্যাপ্টেন, তোমার সামনে সবাই আমসি’ ক্যাপ্টেন একটু হাসবে না দোস্ত বডি আর রাখতে পারলাম কৈ?
এই কাল্পনিক কথোপকথন স্থগিত রেখে ওসমান ফের ডাকে, কবীর। কবীর। এই কবীর। এইভাবে কয়েকবার ডাকার পর ওপর থেকে জবাব আসে, কে? ওপরের বারান্দার দিকে তাকাবার জন্যে ওসমানকে রাস্তায় নামতে হয়। দোতলার বারান্দায় একজন প্রৌঢ় মহিলা, ফর্স গালের মেচেতা থেকে তাকে কবীরের মা বলে চেনা গেলো, কাঠের রেলিঙে হাত রেখে জিগ্যেস করে, ‘কাকে চান?
‘কবীর আছে? ওসমান বলে, কবীর আছে? আমাকে চিনলেন না খালাম্মা?
এর আগে কবীরের মায়ের সঙ্গে ওসমানের তেমন কথাবার্তা হয়নি। ওসমান সাধারণ রাস্তা থেকেই কবীরকে ডাকতো, কবীর থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। আবার কোনো কোনোদিন ওপর থেকে টানা গলায় জবাব এসেছে না-ই!’ কবীরের মা একদিন বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেছিলো, তোমাদের ইস্কুল খুলবে কবে? ইস্কুল কি সারা বছর বন্ধই থাকে? আজ এতোদিন পর মহিলাকে খালাম্মা বলে ডাকতে ওসমানের ভালো লাগলো। মহিলা তার পুরু লেন্সের চশমা-পরা ২চোখের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওসমানকে চেনার চেষ্টা করে। ওসমান বলে, ‘আমার নাম রঞ্জ, কবীরের সঙ্গে ইস্কুলে পড়তাম।
মহিলার পাশে কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ২২/২৩ বছরের একটি যুবকের দিকে চোখ পড়লে ওসমান হাসে, ঐ তো ক্যাপ্টেন তার দিকে চোখ রেখে কি বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু না, সঙ্গে সঙ্গে সে সামলে ওঠে, ক্যাপ্টেন আমাদের আরো কালো, তার বয়স আরো বেশি। ক্যাপ্টেনের নাকের পাশে এরকম কালো তিল নাই। একেও চিনতে পারলো, এ হলো কবীরের ভাই। সগীর কি এতো বড়ো হয়ে গেছে? মায়ের ইঙ্গিতে সগীর ওসমানকে ডাকে, ওপরে আসেন।
নিচের দরজা খুলে যায়। দরজার ডান দিকে সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে রঞ্জু ওর ক্লাসের আরো ২জন ছেলের সঙ্গে একবার ওপরে উঠেছিলো। কবীরের বাবা মা সেদিন সারাদিনের জন্য কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলো। ওপরতলার বারান্দায় বসে গরমের একটি দীর্ঘ দুপুর ওরা ক্যারাম খেলে কাটিয়ে দেয়। সেই সময় কিন্তু সিঁড়ির এই ধাপগুলোকে আরো উঁচু মনে হতো। ক্যারাম খেলতে সেদিন ভয়ও হচ্ছিলো, ঘোড়ার গাড়ি করে কবীরের মা আবার কখন
এসে পড়ে। আর সেই মহিলার আহ্বানে ওসমান লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে। মোটা ও ভাঙা গলায় ঘরের ভেতর থেকে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি শোনা যায়, কে? কেডা? অ কবীরের মা, কেড়া কথা কয়? কিন্তু ওসমান ছাড়া এই গোঙনি কারো কান স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। গোঙনি আসছে সিঁড়ির ডানদিক থেকে, কবীরের ভাইয়ের পেছনে পেছনে ওসমান ঢুকলো বা দিকের ঘরে।
ঘরে ৩ রকম ৩টে চেয়ার। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ওসমান এবং মাদুর-পাতা তক্তপোষে বসে কবীরের মা। আরো আসন শূন্য থাকা সত্ত্বেও অন্য সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। চেয়ারে বসতে বসতে ওসমান বলে, কবীর বাসায় নেই? জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করেই বলে, ক্লাস এইট পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আপনাদের এই বাড়িতে কতো এসেছি? তারপর সে তাকায় সগীরের দিকে, তোমার নাম তো সগীর, না? আমাকে তুমি চিনতে পাচ্ছো?
ভাইয়ার সব বন্ধুরেই তো চিনি। কয় বছরে আরো ভালো কইরা চিনলাম। এর পরও ওসমানের মুড অবিকৃত থাকে, খালাম্মা, এই বরাদায় আমরা একদিন সারা দুপুর ক্যারাম খেলে গিয়েছি, আপনারা কোথায় যেন গিয়েছিলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে প্রায় আপন মনে বলে, ইস! কতোদিন হয়ে গেলো!
কবীরের মা আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, আপনে ইন্ডিয়া চইলা গেছিলেন না?
‘আট দশ মাসের জন্যে। আমার বাবা-মা আর ফিরলেন না। আমি ফিরে এসে অন্য স্কুলে ভর্তি হলাম। সেই থেকে কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেলো।
আপনার বাবা মা ইন্ডিয়া থাকে?
কতোদিন হয়ে গেলো, এই মহিলার সঙ্গে ওসমানের কোনোদিন তেমন আলাপও হয়নি, অথচ দাখো, সব মনে রেখেছে। ছেলেবেলার বন্ধুর মা, নিজের মায়ের চেয়ে কম কি? কথা বলতে গেলে তার গলা থেকে আঠোলো ধ্বনি বেরোয়, আব্বা ইন্ডিয়ায় থাকে। গ্রামের বাড়িতে। আম্মা মারা গেছে এখান থেকে যাবার পর কয়েক বছরের মধ্যেই। তার বলার ইচ্ছা ছিলো, আমার মা নেই খালাম্মা! কিন্তু ২/১বার চেষ্টা করে ঐ বাক্য নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে সে বলে, আমাকে আপনি বলছেন কেন?
আপনি বোধ হয়— ‘
ওসমান তাকে জোরেসোরে বাধা দেয়, আমাকে আপনি বলবেন না খালাম্মা। আমি কবীরের খুব ছেলেবেলার বন্ধু। আমার নাম রঙ্গু, মনে পড়ে?
কবীরের মা তার অনুরোধ মেনে নেয়, তোমার নাম কি কইলা? তাইলে ওসমান কার নাম?
রঙ্গু এবার নিভু-নিভু হয়ে যায়, তবু যতোটা পারে জোর দিয়ে বলে, আমারই নাম। কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধব সব ডাক-নামেই ডাকতো।
আচ্ছা। তুমি পরে আর্মনিটোলা থাকতা না?
‘জী। সেই জন্যেই তো আর্মানিটোলা স্কুলে ভর্তি হলাম। ওসমান ফের উৎসাহিত হয়।
‘কার বাড়ি জায়গির থাকতা না?
ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে ওসমান বাস করতে শুরু করে তার এক চাচার সঙ্গে, বাপের মামাতো ভাই। চাচাতো ভাইবোন ছিলো মেলা, তাদের পড়াতে হতো, চাচার স্ত্রী ঠিক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করতো না। আজ কবীরের মায়ের গলায় জায়গির কথাটি ওর খারাপ লাগলো। আমার চাচা-চাচী যে ব্যবহার করেছে তাতে কথাটার প্রতিবাদ করাও যায় না। তবে কবীরের সঙ্গে দাখা করার প্রবল স্পৃহা এইসব ফালতু ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম। সে জিগ্যেস করে, খালাম্মা, কবীর এলে আমার কথা বলবেন। ওকে বাসায় পাওয়া যায় কখন?
কবীরের মা ওসমানের চোখে ১বার সরাসরি তাকায়, তারপর হঠাৎ বলে, কবীর মারা গেছে।
ওসমান জিগ্যেস করে, কোথায় গেছে?
কবীরের মা একই ভঙ্গিতে তার বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু দ্বিতীয়বার শোনার আগেই ওসমান তার বন্ধুর পরিণতি বুঝতে পেরেছে। ভয়ানক বিচলিত গলায় সে বলে, কি? মারা গেছে?
তুমি জানো না?
না তো। কিন্তু আর কিছু জিগ্যেস করার মতো শক্তি তার হয় না।
এইতো পাঁচ বছর হইয়া গেলো। চৌষট্টি সালে রায়ট হইছিলো মনে আছে?
‘রায়টে মারা গেছে?
‘না। রায়টের আগের দিন।’
এইবার ওসমান নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেয়, কি হয়েছিলো?
কবীরের মা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরে ভয়ানক নীরবতা, এমনকি পাশের ঘরের গোঙানিও ফিরে যাচ্ছে দরজার কপাট থেকে। কিছুক্ষণ পর সগীর তার বড়োভাইয়ের মৃত্যুর কারণ জানায়, ‘খুন হইছে। গট কিলড়’
কিভাবে? কারা মারলো? কেন? ওসমান নিস্তেজ গলায় জিগ্যেস করে। কবীরের স্থায়ী অনুপস্থিতি তাকে এতোটা বিচলিত করেছে যে তার কারণ জানবার কৌতূহল তৈরি করার শক্তিও সে খুঁজে পায় না।
আর কারা? সগীর বলে, সেই সব কথা তুইলা লাভ কি? ভাইয়ার বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কারা? কার কার সাথে বিজনেস করতে নামলো, তারাই মারছে।
তারপর সবাই ফের নীরব হলে পাশের ঘরের গোঙানির আওয়াজ ফাক বুঝে ঘরে ঢুকে পড়ে, ’অ করীরের মা, অ হাসিনা, কেডারে? কথা কয় কেডা? কবীরের মা তার কিশোরী কন্যাকে হুকুম দেয়, হাসিনা দ্যাখ তো তর বাপে কি চায়? দ্যাখ না।’
কিন্তু বাপের বক্তব্য কি জিজ্ঞাসায় হাসিনার কোনো উৎসাহ নাই। দরজার চৌকাঠ ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে!
সঙ্গীর হঠাৎ খ্যাক করে ওঠে, যা না! এখানে কি দ্যাখস? যা।’ সেই বিরক্তি অক্ষত রেখে ওসমানকে বলে, ‘আপনে কিছুই জানেন না? পাঁচ বছর বাদে আসছেন বন্ধুর খবর লইতে? এতোদিন পুলিসের ভয়ে আসেন নাই?
কবীরের মা উঠে দাঁড়ায়, যাই। অর বাপের শরীর খুব খারাপ, সাত বচ্ছর প্যারালাইসিসে পইড়া রইছে। অপরিবর্তিত স্বরে ওসমানকে বলে, আমাদের উপরে খুব জুলুম গেছে। পুলিসের লোক একটা বচ্ছর খুব জ্বালাইছে। আবার কতো মানুষ যে আসছে, কেউ কয়, কবীর আমার সাথে বিজনেস করার কথা কইয়া পাঁচ হাজার টাকা নিছিলো। কেউ কয় কবীর হাওলাত নিছে তিন হাজার টাকা। আমরা খুব ভুগছি!
বন্ধুর জন্যে শোক ওসমানের দানা বাধতে পারে না। সগীরের কিংবা তার মায়ের কথাবাতায় যে অপমান বোধ করবে মনে সেরকম বলও পায় না।
বিদায় দেওয়ার জন্যে নিচে এসে সগীর বলে, ‘আপনে আছেন কোথায়?’
আমি লক্ষ্মীবাজার থাকি।
না, আই মিন আপনি কোন প্রফেশনে আছেন? কি করেন?
ইপিআইডিসি-তে কাজ করি।
‘কোন সেকশনে। কি পোস্টে?
ওসমানের জবাবে সগীর উৎসাহিত হয়, টাকা পয়সার জায়গা। আমি ফ্লাইং বিজনেস করি, আমারে একটু হেল্প কইরেন। ভাইয়া বিজনেসে নামলো, কতোগুলি শয়তানের পাল্লায় পইড়া লস দিলো। জানটা পর্যন্ত দিতে হইলো। নিজে মরলো, ফ্যামিলিটা রুইন কইরা দিয়ে গেলো। আপনারে কই, আব্বার স্ট্রোকের কজটা কি?-ভাইয়ার ডেথ।’
ওর বাবা তো কবীর নিহত হওয়ার আগে থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিন্তু এসব প্রশ্ন করে লাভ কি?
ওসমান রাস্তায় নামলে সগীর বলে, ‘আপনের এ্যাডরেসটা দিলেন না? ওসমান তার ঠিকানা দিলে সগীরও রাস্তায় নামে, তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, আমারে একশোটা টাকা দিতে পারেন? সামনের মাসে বিল উঠাইয়া আপনার বাসায় পৌছাইয়া দিয়া আসবো।
ওসমান বিব্রত হয়, টাকা তো নেই।’ আরে দেন না। সামনের মাসে মোটা বিল পাবো, ওয়াপদায় আড়ইশো ফ্যান সাপ্লাই দিলাম। আপনার বাসার এ্যাডরেস তো রাখলাম, মাসের ফাস্ট উইকে দিয়া আসবো। ওসমানের বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে তার দয়া হয়, কতো আছে? যা পারেন দেন।
প্যান্টের পকেট থেকে ১০ টাকার ১টা নোট বের করে ওসমান বলে, আর টাকা তিনেক সঙ্গে থাকলো। এই নেন। সগীরকে সে কখন থেকে আপনি করে বলতে শুরু করেছে নিজেও খেয়াল করেনি।
নোটটা হাতে নিয়ে সগীর তেতো হাসি ছাড়ে, ওনলি এ টেনার?
ওসমান এগিয়ে যেতে যেতে সগীরের উচ্চকণ্ঠ স্বাগতোক্তি শোনে, কি সব ফ্রেন্ড। দশটা টাকা দিতে জান বারাইয়া যায়, দোস্তের খবর নিতে আসছে।’
রাস্তা চিনতে ওসমানের অসুবিধা হয়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে চাপা প্যান্ট পরা কয়েকটা ছোকরা পোজ মোর দাঁড়িয়ে আশেপাশের বাড়ির জানলা ও দোতলার বারান্দা সার্ডে করছে। ওসমান এদের কাউকে চেনে না। ১টা সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় কথা বলছে৩জন লোক। কারা? কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে? উপচে-পড়া ডাস্টবিনে সামনের ২টো পা তুলে দিয়ে ১টা নেড়ি কুত্তা খাবার খোজে, এই কুকুর জাতটাকে বিশ্বাস নাই, ওসমানের দিকে হঠাৎ তেড়ে আসতে কতোক্ষণ? শাঁখারি পট্টির এই মাথায় চায়ের দোকানটা নতুন, দোকানের মুখে তন্দুরের ভেতর থেকে লোহার আকসি দিয়ে রুটি বার করে আনছে গেঞ্জি পর ১টি বালক, ব্যাটা কাজ করতে করতে ওসমানের দিকে তাকালো কেন? দোকানের ভেতর তারস্বরে হিন্দী গান চলছে, গানের সুরটা ওসমান কোনোদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারলো না। একবার ইচ্ছা হয়, শাঁখারি পট্টি ক্রস করে ইসলামপুর হয়ে চলে যায় চকবাজার। কিন্তু শাখারি রাস্তা যদি ঠিকমতো চিনতে না পারে? তাহলে? চকবাজার গিয়ে এখন লাভ কি? এই ১ঘন্টায় মিছিল কতোদূর চলে গেছে। শহীদ মিনারে মিলিত হয়েছে বিশাল সমাবেশে। রিকশা নাই, বাস নাই, স্কুটার নাই,-ওসমান কি অতোটা হাটতে পারবে? মিছিলে থাকলে মাইলের পর মাইল হাঁটলেও গায়ে লাগে না, ক্যাপ্টেনের খোজ করতে এসে সব বরবাদ হয়ে গেলো।

চিলেকোঠার সেপাই – ২৩

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসের লোকজন বেরিয়ে আসে সকাল ১০টার আগেই। মতিঝিলে বিরাট মিছিল। মিছিল ডিআইটির সামনে পৌছুলে স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শোনা যায়, ‘আরে চেয়ারম্যান, ডিআইটির চেয়ারম্যান মিছিলে ওসমান ছিলো মিছিলের মাঝামাঝি। সেদিন সে বেশ ব্যস্ত। তাদের যাদের অফিসার বলা হয় এই মিছিলে তাদের নামবার ব্যাপারে প্রেম-পত্র-লেখা কামালের সঙ্গে সে-ও বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলো। কামালের এখন প্রচুর অবসর, মালীবাগের প্রেমিকার কাছে তার হাপানির ব্যাপার ফাঁস হয়ে গেছে, প্রেমিকা ইদানীং রোগমুক্ত ১জন ছেলের সঙ্গে প্রত্যেক দিন চাইনীজ খেয়ে বেড়াচ্ছে। মিছিলের মাঝখানে চলতে চলতে কামাল ওসমানকে একটু ধাক্কা দেয়, দ্যাখেন না, ডিআইটির চেয়ারম্যান পর্যন্ত নেমে এসেছে।’
এ্যাঁ। এরা এ্যাঁকশনে নামলে আইয়ুব খান টিকতে পারে? ওদের সেকশনের প্রধান খলিলুর রহমান অন্য সংস্থার চেয়ারম্যানকে মিছিলে দেখে গদগদ হয়ে বলে, ‘আরে, ওরা হইল সব সিএসপি। পাকিস্তানের প্রথম দিকের সিএসপি। বিলিয়ান্ট প্রোডাক্টস অব দি ইউনিভারসিটি। এরা কেউরে পরোয়া করে?
কিন্তু কামাল কথাটা অগ্রাহ্য করে, কতো সিএসপি দেখলাম! কৈ আমাদের চেয়ারম্যান নামুক তো!
খলিলুর রহমান দমে না, আস্তে করে বলে, সকলের নামার দরকার কি? সরকারের মধ্যে থাইকাও সরকারের বারোটা বাজান যায়।’
সেক্রেটারিয়েটের কাছে এলে মিছিলের মূল প্রবাহ চলে যায় প্রেস কুবের দিকে। আর ছোটো ১টি ধারা টোকে আবদুল গনি রোডে। সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটে সার করে দাঁড়ানো হেলমেট ও রাইফেলধারী পুলিস। মিছিলের লোকজন রাস্তার মোড়ে সাজানো ব্যারিকেড সরিয়ে সমবেত হয় ঐ গেটের দুইদিকে। নতুন স্লোগান শোনা যায়, সেক্রেটারিয়েটের ভাইয়েরা’-বেরিয়ে এসো বেরিয়ে এসো। আইয়ুব খানের দালালদের জ্বলিয়ে মারো, পুড়িয়ে মারো’ পুলিসের সারির পেছনে গেটের ভেতরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ১টার পর ১টা স্লোগান তাদের শরীরে ঝাপ্টা দিচ্ছে। মিছিল থেকে বেশ কিছু লোক লাফিয়ে উঠে পড়ে সেক্রেটারিয়েটের দেওয়ালে। হঠাৎ কি করে পুলিসের দুর্ভেদ্য সারি ভেঙে পড়ে, হুহু করে বেরিয়ে আসে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা। আবদুল গনি রোড উপচে পড়ে মানুষে। বিপুল সমাবেশ চলতে শুরু করে কার্জন হলের দিকে। ওসমানও ঐদিকে রওয়ানা হয়েছিলো, হঠাৎ সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনে ওসমানের সমস্ত শরীর ও মাথা কেমন ফাঁকা ফাকা মনে হয়। ও দ্যাখেনি, তবে মনে হচ্ছে গুলিটা চলে গেছে ওর মাথা কিংবা বুকের ঠিক পাশ দিয়ে। লোকজনের এলোমেলো ছোটাছুটির মধ্যে সে এসে পড়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে,জিপিও-র কাছাকাছি। ছোটাছুটি করতে করতেই লোকজন স্লোগান দিয়ে চলেছে, ‘ধ্বংস হোক, নিপাত যাকা’ ১রাউণ্ড গুলির পর আর কোনো আওয়াজ নাই। মানুষ ফের দাঁড়ায় এবং ওসমানের চোখে পড়ে লাল রঙের সেই গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে জিপিও-র সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। গাড়িটা দেখে ওসমানের গা ছমছম করে অনেকক্ষণ ধরে তো সে এখানেই রয়েছে, এই রায়টকার কখন এলো? কিভাবে এসে পৌছুলো? এতো মানুষের চলমান স্রোত উজিয়ে এলো? ওই লাল গাড়িটাকে লোকে আক্রমণ করে না কেন? ওসমান তার ছমছম-করা গা একবার ঝাকালো, এই শালদের ভয় পেলেই এদের লাই দেওয়া হয়। যা হয় হোক, এই জায়গা ছেড়ে সে নড়বে না।
ওখান থেকে সত্যি সে অনেকক্ষণ সরেনি। আর আর মানুষের সঙ্গে সে-ও এদিক ওদিক থেকে কাঠের টুকরা কাগজ, গাছের শুকনা পাতা জোগাড় করে পাক-বাগিচার উল্টোদিকের ফুটপাথে স্তুপ করে ফেললো। আইয়ুব খানের মস্ত ১টা ছবি রেখে সেই স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে ওসমান তার প্যান্টের পকেট থেকে অফিসের একটা কাগজ ও লন্ত্রির রিসিট বার করে সেই স্তুপে অগুলি দিলো। আগুনের শিখার চারপাশে স্লোগান ওঠে, দিকে দিকে আগুন জ্বলো’–’আগুন জ্বলো আগুন জ্বালো! জাগো জাগো’—‘বাঙালি জাগো!’
এর মধ্যে তোপখানা রোড ও পল্টনের মোড়ে ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সামনে লোহার রডের সঙ্গে টাইট করে লাগানো মস্ত সাইনবোর্ড নিয়ে আসা হয়েছে। এটা হলো আইয়ুব খানের শাসনের ১০ বছর পূর্তির বাহাদুরি ঘোষণার বিজ্ঞাপন। আগুনের ভেতর বোর্ডটা ফেলতেই মানুষ সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো। এতো বড়ো টিনের বোর্ড দেখতে দেখতে দুমড়ে যায়। ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের পাশে সেক্রেটারিয়েটের গেট, সেই গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছিলো দমকলের গাড়ি। লোকজন ঐ গাড়ির দিকে ছুটে যেতেই সেটা ব্যাক গিয়ারে চলে গেলো ভেতরে।
দমকলের গাড়ির পলায়ন দেখে ওসমানের হাসি পায়, মানুষের বাড়িঘর দোকানপাট পুড়ে সাফ হয়ে গেলেও এই শালাদের টিকিট দ্যাখা যায় না। আর দ্যাখে আইয়ুব খানের বাহাদুরির বিবরণ বাঁচাবার জন্য শুওরের বাচ্চারা কেমন তৎপর। এইরকম ভাবতে ভাবতে ফট করে পর পর ২বার আওয়াজ হয়, ২টো শেল ফাটে এবং বাতাস হয়ে ওঠে ঝাঝালো। লাল রায়ট-কার থেকে টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছে। ঝাঁঝালো বাতাসে ওসমানের চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে, চোখ দারুনরকম জুলছে, নিশ্বাস নেওয়াটা এখন কষ্টের কাজ।
রায়ট কার মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেলো কোথায়? মানুষ এখন ছুটে চলেছে স্টেডিয়ামের দিকে। আউটার স্টেডিয়ামে খুব ভিড়। এই ভিড়ে ওসমান স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ভিড় ঠেলে ঠেলে অকারণে সে এদিকে-ওদিক ঘোরে। এরকম ঘুরতে ঘুরতে মাইকের একটি হনের সামনে এসে শুনতে পায় যে সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটের সামনে গুলিবর্ষণে দুজন মারা গেছে। তাদের লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তরুণ কোনো নেতার কণ্ঠ শোনা যায়, ভাইসব, স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনেমের লেলিয়ে দেওয়া কুকুরের গুলিতে আজ নিহত হয়েছে আমাদের দুজন ভাই। ভাইসব, আমাদের শহীদ মকবুলার রহমান ও রুস্তম আলির লাশ এক্ষুনি এসে পড়বে। শহীদ আসাদুজ্জামানের শোক-সভা আজ জানাজার পরিণত হলো কেন? কার জন্যে? ভাইসব-।
সমবেত জনতা বারবার তাকায় স্টেডিয়ামের গেটের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে কালো কাপড়ে ঢাকা দুটো মৃতদেহ কালো কালো চুলের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ভেসে আসে। তাদের বহনকারীদের দ্যাখা যায় না, মনে হচ্ছে শহীদদের লাশ যেন শূন্যে সাতার দিয়ে এগিয়ে আসছে।
ওসমানের বুকে খচ করে একটা কাটা বেঁধে গুলির সময় সে তো ঠিক ঐ জায়গাটাতেই ছিলো। ওসমান হয়তো একটুর জন্যে বিরাট এই সমাবেশের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হতে পারলো না! আহা, মানুষের উড়ন্ত চুলের টেউয়ে সাতরাবার কি সুযোগ সে হারালো।—তবে এই ক্ষোভ তার স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ১টি মুহূর্তের জন্য। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে মাইকে হঠাৎ বিকট স্বরে টাটা আওয়াজ হয়, এই আওয়াজে তার মগ্নতা ভাঙে এবং মনে হয়, আহা! একটুর জন্য সে বেঁচে গেছে। নইলে এই সমাবেশ, শহীদদের প্রতি সম্মান দ্যাখাবার জন্য মানুষের এই আকুলতা-কিছুই দ্যাখা হতো না। সে যে বেঁচে গেছে এবং বেঁচে আছে-এই বোধ চাঙা হয়ে ওঠায় ভিড় ঠেলে ওসমান এদিক ওদিক ঘোরে। ভিড়ের মধ্যে পান বিড়ি সিগেটওয়ালারা; হাতে লোহার চুলায় কেতলি নিয়ে চা বিক্রি করে এক ছোকরা। এমনকি স্টেডিয়ামের গেটে চটপটি ফুচকার ঠেলাগাড়ি। ১প্লেট চটপটি ও ৪টে ফুচকা খেয়ে ওসমান চা খেলো। খালি পেটে তেঁতুল-গোলা পানিতে চোবানো ফুচকা খেয়েও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কালো কাপড়ে ঢাকা নিহত মকবুলার রহমান ও রুস্তম আলি যেদিক দিয়ে এসেছিলো সেই গেট দিয়েই ফের উড়ে গেলো আজিমপুরের দিকে। সেদিকে না গিয়ে ওসমান চললে বাদিকে, মতিঝিলের দিক থেকে অনেক লোক ছুটে আসে, অনেকে ঐদিকেই যেতে শুরু করে। লোকজন যারা আসছে এবং যাচ্ছে সকলেরই হস্তদন্ত ভাব। মাথার উপর হালকা কালো রঙের ধোঁয়া। সম্প্রসারণমাণ একটি ছাদের মতো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত মতিঝিলে। একটু এগিয়ে গেলে দ্যাখা যায় মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বলছে। অফিসের সামনে জ্বলন্ত ২টো গাড়ি। এর মধ্যে উত্তেজিত মানুষের স্লোগান, আইয়ুবের দালাল, আইয়ুবের দালাল’-‘হুশিয়ার ইশিয়ার’ অফিসের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় ওসমানের গায়ে আগুনের তাপ লাগে, তার শরীর নিসপিস করে, সে কি কোনোভাবেই এই কর্মযজ্ঞে একটু অংশ নিতে পারে না? এর মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারের উল্টোদিকের ১টি বাড়িতে। এখানে আগুন লাগানো হলো কেন? একটু এগিয়ে যেতে শোনা যায় যে এটা মুসলিম লীগের ১ এমএনএ-র বাড়ি। লোকজন মন্তব্য করে, চুতমারানি, চুরি চামারি কইরা কি মহল বানাইছে একখান, ল, অহন ল! বইয়া বইয়া খা।’
চারদিকের আগুনের ধোঁয়ায় শীতকালের সন্ধ্যা নামে আরো তাড়াতাড়ি। কিন্তু লোকজন কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে না, মনে হয় আরো অনেক কিছু পোড়াবার দায়িত্ব সবার ঘাড়ে, দাঁড়াবার সময় তো নাই। অজস্র মানুষের সঙ্গে ওসমান গড়িয়ে পড়ে জিন্না এ্যাঁভেনুর বড়ো প্রবাহে। দোকানপাট সব বন্ধ, কিন্তু রাস্তা তাতে স্থগিত থাকেনি। রাস্তার ২দিকে আলো জ্বলছে। রাস্তা এখানে চওড়া বলে জনস্রোত একটু পাতলা। ইপিআরটিসি টার্মিনালের সামনে জটলা, টার্মিনালের গেটের পিলার ২টোর গোল গোল সিমেন্টের মাথা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙছে ২জন শ্রমিক যুবক, লোকজন চিৎকার করে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। এই টার্মিনালের পেছনে গভর্নর হাউস এখন পর্যন্ত অক্ষত। এই বাড়িটা জালানো খুব দরকার। কিন্তু ওসমান একা একা কি করে যায়? একা তার কিছু করবারই নাই, সে হলো এই বিশাল জনস্রোতের ১টি ঢেউ, ধাক্কায় ধাক্কায় গড়িয়ে চলেছে সামনের দিকে।
জিন্না এ্যাঁভেনু্য পার হবার আগেই নবাবপুর রোডে ২ পাশে আলো নিভে গেলো। নবাবপুর ১টা ল্যাম্পোস্টের ঘিঞ্জি মাথার জটায় আগুন লেগেছে। ওসমানের পাশে কে যেন বলে, ওদিকে যাবেন না, ইলেকট্রিক তারে আগুন ধরেছে আরজু হোটেলে। নিচে রেস্টরেন্টের মস্ত দরজায় আগুন জ্বলছে, দোতলাতেও আগুন। উল্টোদিকের আমজাদিয়া হোটেল থেকে চেয়ার টেবিল এনে তাও কিছু কিছু পোড়ানো হচ্ছে। তাদের আড়ড়ার কেন্দ্রেও ক্ষত বিক্ষত দেখে ওসমানের একটু খারাপ লাগে বৈ কি! কিন্তু কারেন্ট চলে যাওয়ায় অন্ধকার নবা