- বইয়ের নামঃ চিলেকোঠার সেপাই
- লেখকের নামঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
- প্রকাশনাঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
চিলেকোঠার সেপাই – ০১
‘তোমার রঞ্জু পড়ি রইলো কোন বিদেশ বিভূঁয়ে, একবার চোখের দ্যাখাটাও দেখতি পাল্লে না গো!’
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ওসমান একটার পর একটা লেবুপাতা ছেঁড়ে আর মায়ের বিলাম শোনে। ৩টে আঙুলে লেবুপাতা চটকাটে চটকাতে উঠানের দিকে এগিয়ে গেলে কে যেন তাকে দেখে ফেলে, ‘ওরে! রঞ্জুকে এট্টু কাঁধ দিতি দে!’ লোকটা কে? সেই লোকটাই ফের আফসোস করে, ‘আহা হাজার হলেও বড়ো ছেলে, জ্যেষ্ঠ সন্তান! কুথায় পড়ি রইলো সে, বাপের মুখে এক ফোঁটা পানি দিতি পাল্লো না। আহারে, বাপ হয়ে ছেলের হাতের এক মুঠি মাটি পেলো না গো!’
ওসমানের সামনেই কথাবার্তা চলে। ভুলটা কারো চোখে পড়ে না। বাপের লাশ-বিছানো খাটিয়ার একদিকে কাঁধ দিয়ে সে-ও পশ্চিমপাড়ার দিকে চলে। পশ্চিমপাড়ায় জুমার ঘর, জুমার ঘরের পেছনে কাজীদের জোড়শিমুলতলা, তারপর ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় ও খেজুর কাঁটায় ভর উঁচুনিচু গোরস্থান। গোলাপপাশ থেকে শবযাত্রীদের ওপর গোলাপজন ছিটিয়ে দিলে মনে হয় শিমুলগাছ থেকে টুপটাপ শিশির ঝড়ে পড়ছে। ওসমানের পায়ের কয়েক ফোঁটা পড়লে তার ঘুম ভেঙে যায়। পায়ের ওপর চাদর অনেকটা ভিজে গেছে, ওদিকের জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে।
ওসমানের উঠে বসতে হলো। শিকের ফাঁকে থুথু ফেলে জানলাটা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়লো। কিন্তু পাশের জানলা খোলাই রইলো। ঐ জানলা দিয়ে পানির ছাঁট এসে পড়ছে চেয়ারে। চেয়ারে কিংস্টর্কের প্যাকেট, দেশলাই, চাবি ও কয়েকদিন আগেকার ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’। প্রথম পৃষ্ঠায় ৪ কলাম জুড়ে এই বছরের বিশ্বসুন্দরীদের ছবি। রাতে ব্যবহার করবে বলে আনোয়ারের বাড়ি থেকে কাল দুপুরবেলা নিয়ে এসেছে। শালার শওকত ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে রাতে বাঙলার মাত্রাটা বেশি হয়ে গিয়েছিলো, এসে কখন যে প্যান্টট্যান্টসুদ্ধ শুয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। সিসিলিরূপসীদের পুরুষ্টু উরুতে শীতল বৃষ্টিপাত ঘটছে। ঐটা সামনে রেখে কম্বলের নিচে নিজের উরুসন্ধি থেকে দিব্যি ঘন প্রস্রবণ বইয়ে দেওয়া চলে। কিন্তু হয় না। প্যান্টের বোতাম খুলতে খুলতে বোঝা যায় যে, বাপের লাশের স্পর্শে তার সারা শরীর একদম ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি ঠিক ঠিক ফলে, বাপ তার সত্যি সত্যি মরে গেলো কিনা কে জান? একটু আগে দ্যাখা স্বপ্ন, সহজে কি ছাড়তে চায়? শীতের দিনেও ঘামের মত সেঁটে থাকে। তবে স্বপ্নে নিজের কাউকে মরতে দেখলে অন্য লোক মরে। নাঃ! আব্বা নিশ্চয়ই ভালো আছে। বাপের বেঁচে থাকা সম্বন্ধে একটু নিশ্চিন্ত হলে বাপের ওপর ওসমানের রাগ হয়। একবার বাস করবে বলে পাকিস্তানে এলো তো আবার ফিরে গেলো কেন? এখানে বাড়িঘর কিছুই করলো না। বছর ছয়েক চাকরি করে একবার ছুটি নিয়ে সেই যে দেশে গেলো, ফেরার নামও করলো না আর। গ্রামে না থাকলে মোড়লগিরিটা ফলাবে কোথায়!
বাপের ওপর রাগ ভালো করে জমে ওঠবার আগে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ওসমান দারুণ উৎকণ্ঠিত হয়ে এক লাফে মেঝেতে নামলো, আব্বা কি এসেই পড়লো নাকি? প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হাতের এক ধাক্কায় মিস ইউনিভার্সের ছবি মেঝেতে ফেলে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ‘কে’ বলে দরজার ছিটকিনি খুললো। দূর! আব্বা আসবে কোত্থেকে? ইন্ডিয়া থেকে আসা কি চাট্টিখানি কথা?
দরজা খুললেই নিচে নামবার খাড়া ঝাপসা সিঁড়ি। সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৪/১৫ বছরের একটি ছেলে। ওসমানের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে লাও এসে পড়েছে ছেলেটির শরীরের ওপরের ভাগে। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট, ফ্ল্যাপের নিচে দুটো বুকপকেট, ডান পকেটের ওপর ঘন খয়েরি সুতার এমব্রয়ডারি করা প্যাগোডার মাথা।
দরজার চৌকাঠে চোখ রেখে ছেলেটি বলে, ‘আপনি একটু নিচে আসেন।’
ওসমান ছেলেটির মুখের দিকে সোজাসুজি তাকায়, ‘কি ব্যাপার?’
নিচু গলায় ছেলেটি জবাব দেয়, ‘আমরা দোতলায় থাকি।’
‘আমি কি করবো?’ ওসমান একটু হাসে।
ছেলেটি হাসে না, বিরক্ত হয় না। পাশে সিঁড়ির রেলিঙে হাত রেখে বিড়বিড় করে, ‘আপনে একটু আসেন। আমার ভাই মারা গেছে।’ একটু থেমে সে হঠাৎ জোরে বলে ওঠে, ‘কাল পুলিসের গুলি খাইয়া মারা গেছে।’
গুলি কোথায় লেগেছিলো? এই প্রশ্ন না করলেও ওসমান চট করে মাথাটা নিচু করে সঙ্গে সঙ্গে ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায়?’
‘আমাদের বাসায় আসেন। বাড়িআলা সবাইরে ডাকতে বললো।’
‘চলো।’
ছেলেটির পেছন পেছন কয়েকটা ধাপ নেমে ওসমান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘরের জানলা-দিয়ে-আসা আলো এখন ছেলেটির এলোমেলো চুলে বিলি কেটে গড়িয়ে পড়েছে তার ঘাড় পর্যন্ত। ওসমানের পায়ের আওয়াজ থেমে যাওয়ায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকালো। এখন তার চিবুক পর্যন্ত আলো। তার চোখের লাল চিকন রেখাগুলো ছটফট করছে। প্রায় ৭/৮ ধাপ ওপর থেকে ওসমানের দিকে তাকালে আলো-পড়া লাল চোখ জোড়া অনেক বড়ো মনে হয়।
ওসমান বলে, ‘তুমি যাও। আমি একটু পরে আসছি।’
ছেলেটি একটু দাঁড়ায়, জানলার আলো এখন তার ঘাড়ের ওপর, শার্টের কলারে। এবার পেছনে না তাকিয়ে সে নিচে নেমে গেলো। ওসমান ভেবেছিলো যে, ছেলেটির দুঃখী চোখজোড়া আরেকবার দ্যাখা যাবে।
টুথব্রাশে অনেকখানি পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ছাদের এক কোণে গিয়ে ওসমান পেচ্ছাব করে। ঘরে এসে কলসি থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ছাদের আরেক দিকে বসে সে মুখ ধোয়। মুখ ধোয়ার কাজটা তাকে একটু ধীরে সুস্থে করতে হয়, তাড়াতাড়ি কুলকুচো করতে গেলে বমি হওয়ার চান্স থাকে। পেচ্ছাব করা ও মুখ ধোয়াটা ওসমান ছাদের সেরে নেয়। কোনোটাতেই বাড়িওয়ার সম্মতি নেই। গোসল করতে হলে অবশ্য নিচে নামতেই হয়। নিচতলায় বাড়িওয়ালার ‘গওসল আজম সু ফ্যাক্টরি’। কারখানার প্রায় ৮/১০ জন লোক। সারি বাঁধা খাটা পায়খানার ৩টে প্রায় তাদের দখলেই থাকে। ওসমান তাই অফিসে কি সিনেমা হলে কি মসজিদে পায়খানা করে। গোসলের জন্য পাকা স্যাঁতসেঁতে উঠানের একদিক জুড়ে মস্ত বড়ো চৌবাচ্চা, এটাকে বলা হয় হাউস। কিন্তু ওটার দিকে চোখ পড়লেই তার শীতশীত করে, গোসল করাটা প্রায় হয়েই ওঠে না।
এই ঘরের গণির বসবাস প্রায় আড়াই বছর। বাড়িটা হোপলেস। সামনে খোলা জায়গা নাই, ড্রেনের পরেই বাড়ি শুরু হয়ে গেলো। রাস্তার ওপরে চাওড়া দরজা, দরজাটা একটু নিচু। বাড়ির বাসিন্দারা, এমনকি বেঁটে লোকজনও মাথা একটু নিচু করে ঐ দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকে। যারা ওপরে যাবার তারা বাঁদিকে এক পা গিয়ে সিঁড়িতে ওঠে, আর একতলার গওসল আজম স্যু ফ্যাক্টরির কর্মচারী বা কর্মিগণ সরু প্যাসেজ পার হয়ে স্যাঁতসেঁতে উঠান অতিক্রম করে। রাস্তার ওপরে এই একটিমাত্র দরজা বন্ধ করে দিলে এই বিশাল ও বেঢপ দালালে ঢোকা অসম্ভব। দোতলা ও তিনতলার সামনে বারান্দায় বাঙালিদের পেট সমান উঁচু লোহার রেলিঙ। ঘরগুলো ছোটো, এর মধ্যে হার্ডবোর্ড, কাঠের পার্টিশন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘরের সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে। ঘরের মূল দেওয়াল খুব পুরু, থামগুলো মোটা। বাড়ি তৈরীর সময় মনে হয় শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটি প্রবলরকম ইচ্ছা খুব তৎপর ছিলো। সেই শত্রু কে? কোনো শত্রু না থাকলে বাড়িটাকে এরকম না-দুর্গ না-বাড়ি বানাবার মানে কি? মানে যারা জানতো সেই সাহা কি বসাক কি পোদ্দার মশাইরা ১৯৫০ সালে রহমতউল্লার কাছে বাড়ি বেচে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইপিআইডিসিতে কাজ পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর আগের অফিসের এক সহকর্মীর কল্যাণে ওসমান এই ঘরের খোঁজ পায়।
ঘর মানে বাড়ির চিলেকোঠা। ছাদের ওপর একটিমাত্র ঘর, রান্নাঘর নাই, বাথরুম নাই, পায়খানা কি গোসল করতে হলে দাঁড়াতে হয় একতলার কিউতে। তবে ওসমানের ঘরে আলো বাতাস খুব। দরজা ২টো, সিঁড়ির মুখে ১টা, আরেকটা ছাদের দিকে। ছাদটা বেশ বড়ো, চারদিকে রেলিঙ, সামনের রেলিঙ একটু উঁচু। একদিকে এসে দাঁড়ালে সামনের রাস্তা চমৎকার দ্যাখা যায়। রাস্তার ঠিক ওপারে ১টা দোতলা বাড়ি, বেশ বড়ো এবং একই রকম বেঢপ। ঐ বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া মসজিদ, মসজিদের বারান্দায় একটি সাইনবোর্ডে বাঙলা ও আরবি হরফে হক্কেনূর মক্তবের নাম লেখা। মাঝে মাঝে ওসমান ছাদে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই চারদিকের ঘিঞ্জি সব বাড়িঘরের মাঝখানে পায়ের নিচের ছাদটাকে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে, সুড়ুৎ করে তখন ঢুকে পড়ে নিজের ঘরে। আজ অবশ্য ফাঁকা ফাঁকা ভাবতার জন্যে অপেক্ষা করতে হলো না। নিচে রাস্তার ওপর পুলিসের জিপ।
নিচে নামবা সময় দোতলার ডানদিকে মহিলা কণ্ঠের ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজে বোঝা যায় যে, এই ঘরেরই কেউ নিহত হয়েছে। মৃত মানুষের বাড়িতে যেমন হাউমাউ কান্নাকাটি থাকে, এখানে কিন্তু তেমন কিছু নাই। কান্নার ধ্বনি ঘরের চাপা কোলাহল থেকে বাইরে আসছে, ধ্বনির সঙ্গে সংগে ওসমান নিচে নামে।
জিপের পেছনে আরেকটি গাড়ি—পিক-আপ, এটাও পুলিশের গাড়ি। রাস্তার ওপর থেকে রহমতউল্লার সঙ্গে ৭/৮ জন লোক রাস্তা ক্রস করছে। তাদের ৪ জনই পুলিস। বাড়িওয়ালার মাথায় কালো জিন্না টুপি। গভর্ণর গতবার এখানকার কম্যুনিটি সেন্টার উদ্বোধন করতে এলে মহল্লার একজন শ্রেষ্ঠ মৌলিক গণতন্ত্রী হিসাবে রহমতউল্লা টুপিটি উপহার পায়। তবে সবসময় সে সাদা কিস্তি টুপিই পরে। কেবল নিজের দাপট দ্যাখাবার দরকার হলে জিন্না টুপিটাকে সে ব্যবহার করে মুকুটের মতো।
না, টুপির জন্য নয়, বাড়িওয়ালাকে সেখে ওসমান গনির ঠোঁটে আপনি-আপনি একটি হাসিহাসি ভঙ্গি ফোটে। জবাবে গম্ভীর ও কোঁচকানো চোখমুখ করে বাড়িওয়ালা বলে, ‘আমার বাসায় যাইতেছিলেন? লন, উপরে যাই।’
রহমতউল্লার অনুমান ঠিক নয়। ওসমান যাচ্ছিলো ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের দিকে। ভোরবেলা হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে গেলো, ঠাণ্ডাটা বেশ জমেছে, নানরুটি পায়াতে রবিবারের সকালবেলাটা চমৎকার জমতো। এ্যাবাউট টার্ণ করে বাড়িওয়ালার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যাপার কি? কিভাবে হলো?’
‘আপনে আছিলেন কৈ? নিচের তলার পড়শি মরে গুলি খাইয়া, আপনে জানেন না?’
ওসমান চুপচাপ তার সঙ্গে হাঁটে। জবাব দেওয়াটা রিস্কি, কিন্তু জিগ্যেস করলেই তো তার অজ্ঞতা আরো স্পষ্ট হবে। রহমতউল্লা কথা বলে একাই, ‘রাইত ভইরা থানা-হাসপাতাল, হাসপাতাল-থানা না করলে লাশ পাইতাম?’ সিঁড়ির গোড়ায় এসে দারোগাকে দেখিয়ে বলে, ‘সামাদ সাহেব না থাকলের লাশ অহন কৈ পইড়া থাকতো!’
দোতলায় ও তিনতলার সরু বারান্দায় রেকিঙ ধরে দাঁড়িয়ে লোকজন ওদের দেখছে। দোতলায় উঠে ডানদিকে বারান্দার পাশে দরজার সামনে এসে সবাই দাঁড়ালো। ২টো ঘরের জন্যে পাশাপাশি দুটো দরজা। ১টি পরিবার এই ঘর ২টো ও সামনের বারান্দা ব্যবহারের অধিকারী। বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলে হার্ডবোর্ডের পার্টিশন। এখান থেকে অন্য ১টি পরিবারের সীমানা শুরু হলো। ফের পাশাপাশি ২টো দরজা, শেষ দরজার পর একই রকম পার্টিশন, তবে ক্যানভাসের। ক্যানভাসের সঙ্গে লাগানো দরজা বন্ধ। খাকি ক্যানভাসে সাদা চকখড়িতে আঁকা ১টি ল্যান্ডস্কেপ। রোগা ১টি নদীর তীরে লম্বা তালগাছের মাথায় সূর্য। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত যে কোনো দৃশ্য হতে পারে। সূর্যের অনেকটা ওপর দিয়ে ৫/৬টা সাহসী পাখির ঝাঁক। দুঃসাহসী পাখিদের ওপর এবং নদীর নিচে চুন ও কানির দাগ এবং কয়েকটা বাঙলা ও ইংরেজি অক্ষর। স্পষ্ট ও গোটাগোটা ইংরেজি হরফে লেখা একটি নাম ওসমানের মাথায় খচখচ করে বেঁধে, নামটি এবং খচখচ ভাবটি তার মাথায়া দানা বাঁধে, তার চুল একটু খাড়া হয় এবং সে পড়ে, ‘রঞ্জু’। ওটা ওসমানের নিজেরই ডাকনাম। অস্পষ্ট একটি উদ্বেগ তার গলায় আটকে থাকে। তবে বেশিক্ষণ নয়। কারণ নতুন ঝামেলা মাথায় খামচাতে শুরু করে; যে লোক বাড়ির সামনে এতো বড়ো করে নিজের নাম লিখে রাখে সেই কিনা নিহত হয় পুলিসের হাতে!
বাড়িওয়ালা ডাকে, ‘রঞ্জু।’ ওসমানের বুকে এই ডাক ভুতুড়ে প্রতিধ্বনি তোলে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে সকালবেলার সেই ছেলেটি। ওর চোখের লাল চিকন রেখাগুলো সব একাকার হয়ে গেছে। নাকের ডগা তার ভিজে ভিজে এবং ঠোঁটজোড়া শুকনা ও বেগুনী। তাহলে রঞ্জু ও নিহত ব্যক্তি এক নয়, নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই হলো রঞ্জু এবং রঞ্জু এখনো জীবিত—এই বুঝতে পেরে ওসমান আরাম পায়। এখন রঞ্জুর ভালো নাম জানতে ইচ্ছা করে। ও কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, কি খেলতে ভালোবাসে? কিন্তু এখন এসব জানবার উপায় নাই। তাই সে সোজা ঘরের ভেতর দেখতে শুরু করলো।
ঘরে কি?—দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ২জন পুলিস। দারোগাকে দেখে তারা হাত তুলে স্যালুট করে। বড্ডো আঁটোসাঁটো ঘর, স্যালুট করতে গিয়ে ১জনের হাতের কনুই দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খায়, বেচারার স্যালুটরত হাতের পাতা একটু একটু কাঁপে। ঘরে আর কি?—তক্তপোষ এলোমেলো বিছানা। ২জন লোক সেখানে বসে ছিলো। এবার উঠে দাঁড়ালো। এদের ১জন, বয়স ৫০ এর ওপর, ৫৫ বোধ হয় হয়নি, তার পরনে সবুজ চেক লুঙ্গি, তার খয়েরি এণ্ডির চাদরের নিচে কোথাও কোথাও সাদা পাঞ্জাবির আভাস। এক পা তুলে ফের মেঝেতে রেখে সে বলে, ‘স্লামালেকুম। ওসি সায়েব ভালো আছেন?’
দারোগার মুখে থেকে বিড়বিড় ধ্বনি যা বেরোয় তা থেকে নানা ধরনের বাক্য গঠিত হতে পারে, যেমন, ‘আর ভাই থাকা!’ অথবা ‘আমাদের আবার ভালো!’ অথবা ‘আল্লা রেখেছে ভাই!’
রহমতউল্লা লোকটিকে জিগ্যেস করে, ‘রিয়াজউদ্দিন সায়েব, সব হইছে?’
রিয়াজউদ্দিনের জবাবের জন্যে কিছুমাত্র অপেক্ষা না করে রঞ্জুর ডান হাত ধরে রহমতউল্লা ভেতরের ঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এই ঘরে ফিরে এসে বলে, ‘দারোগা সায়েব, আসতে পারেন। আসেন।’
‘কমপ্লিট? মুর্দাকে গোসল করানো হয়েছে?’ দারোগার প্রশ্নের জবাব দিয়ে রিয়াজউদ্দিন ফিসফিস করে মাত্র কয়েকটি শব্দ বলে। তারপর কন্যাকর্তার বিনয় ও আতিথ্য গলায় তুলে নিয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করে, ‘আসেন, আপনেরা আসেন!’
এই ঘরটি আবার বাঁশের বেড়া দিয়ে বিভক্ত। ঘরের এপারে মেঝেতে একটি মাদুরে কয়েকজন মেয়েমানুষ। নেকাব পর্যন্ত ঝোলানো বোরখাপরা ১ মহিলা কাঁদো কাঁদো গলায় কোরান শরীফ পড়ছে। জড়সড় হয়ে শুয়ে রয়েছে ১ মহিলা; ১ তরুণী তালপাতার পাখা এবং ১ প্রৌঢ়া গামছ দিয়ে তার মাথায় হাওয়া করছে। শুয়ে থাকা মহিলার গলা থেকে একটানা আওয়াজ বেরোয়। কখনো কখনো তার স্বর অস্পষ্ট হয়ে গেলে অনেক দূরে এবড়োথেবড়ো মাঠে গরুর গাড়ি চলার রেশ আসে। আরেকজন কিশোরীকে জড়িয়ে ধরে ১৬/১৭ বছরের ১টি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লোকজন ঢুকলে তার ফোঁপানি মৃদু হয়ে আসে। মাদুরের প্রান্তে ১ বছরের ১শিশু অঘোরে ঘুমায়। তার পরনের জাঙ্গিয়া পেচ্ছাবে ভিজে গেছে। শিশুর হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ১টি চাবি। তার মুখের কাছে দুটো মাছি ওড়ে। শিশুটির পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে হলুদ, সাদা ও খয়েরি ছোপ-লাগা বিবর্ণ সবুজ পর্দা।
দারোগার নেতৃত্বে সমবেত জনতা পর্দা অতিক্রম করে। এটাই ফাইনাল জায়গা, এরপর নিরেট দেওয়াল। গুলিবিদ্ধ নিহত যুবক ঠিক এখানেই অবস্থান করে। ওসমানের শরীরের রক্তপ্রবাহ তার করোটির ছাদে উদ্বন্ধন তোলে, তার চোখের ঘন খয়েরি রঙের মণি ও ভেতরকার রেটিনাসমূহ এখন খুব তৎপর। এমনি জিনিসপত্র দ্যাখার জন্যে চোখের এই বাড়াবাড়ি রকম তৎপরতার দরকার হয় না। একনিষ্ঠ মনোযোগী হলে ওসমান দ্যাখে যে, ছাদের ঠিক নিচেই গুলিবিদ্ধ ১টি যুবক দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা। যুবক অল্পবয়েসী, শরীরের চামড়া কাঁচা ও টাটকা। .৩০৩ রাইফেলের একটি গুলি তার বুককে গেঁথে রেখেছে দেওয়ালের সঙ্গে। মাথাটা বাঁ দিকে ঝুলছে। বুকের নিচে তার দীর্ঘ শরীর রেলিঙে মেলে দেওয়া শাড়ির মতো আস্তে আস্তে কাঁপে। শীতেও কাঁপতে পারে, বাতাসেও কাঁপতে পারে। যুবকের মুখ হাঁ করা, মনে হয় প্রচণ্ড ১টি চিৎকার সেখানে জমে রয়েছে; বলা যায় না, যে কোনো-সময় এই পুরনো দালান ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কোটর থেকে ছিটকে-পড়া কালো মণিজোড়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রয়েছে, তারা যেন গোগ্রাসে সব দেখছে! তার কালো ২টো হাত ডানদিকে ও বামদিকে শক্ত ১ জোড়া রডের মতো ঝোলানো। সেই ২ হাতের প্রতিটির সঙ্গে গুলি দিয়ে গাঁথা আরো ২জন যুবক। যুবক ২জন যমজ, ২জনেই অল্পবয়সী, ২জনেরই চামড়া কাঁচা ও টাটকা। এদেরও একেক জোড়া চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটরের ভেতর থেকে, বেরিয়ে-আসা মণিগুলো যেন পরিচিত ও অপরিচিত যাবতীয় দৃশ্য দ্যাখার জন্য অস্থির। ২জনেরই হাঁ করা মুখে সুপ্ত চিৎকার যে কোনো সময় বেরিয়ে ছাদ ফাটিয়ে ফেলতে পারে। তাদের ২জনের লোহার রডের মতো ২ জোড়া হাতে নিচের দিকে বাড়ানো। আবার দ্যাখো, রডের মতো সেই ২জোড়া হাতের সঙ্গে .৩০৩ রাইফেলের গুলি গাঁথা আরো ৪ জন যুবকের লাশ। কে বলবে এরা আলাদা লোক? অবিকল একরকম দেখতে ৪ জন যুবকের কোমরে থেকে নিচের দিক শীতে কি বাতাসে একটু একটু কাঁপে। গ্রোগ্রাসে সব কিছু দেখে নেওয়ার জন্য কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে ৪ জনের ৪জোড়া চোখের ৮টা মণি। একই রকম দেখতে ৪টে মুখে স্থগিত রয়েছে ৪টে দারুণ চিৎকার। এই ৪ জন আর আগের ৩ জন—মোট ৭ জনের চিৎকারে ঘরবাড়ি দালানকোঠা রাস্তাঘাট ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে না? এখানেই শেষ নয়। এই শেষ ৪ জনের লোহার রডের মতো হাতে গাঁথা রয়েছে গুলিবিদ্ধ আরো ৮ জনের মৃতদেহ। ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এরা মেঝে ফুঁড়ে নিচে নেমেছে। নিচে-নেমে-যাওয়া গুলিবিদ্ধ মানুষের দীর্ঘ সিঁড়ির শেষ দেখবে বলে নিচের দিকে তাকালে ওসমানের চোখে পড়ে সাদা ও খয়েরি চুন-সুরকির মেঝেতে কালচে-নীল কালিতে ছড়ানো মানচিত্র, ছোপ ছোপ কালো দাগ, দেশলাইয়ের পোড়াকাঠি, দাঁত দিয়ে কামড়ানো পেন্সিলের টুকরা এবং ১ পাটি স্যাণ্ডেল ও ১ পাটি জুতো। বুলেট-সাঁটা মৃতদেহের সিঁড়ি দ্যাখার ভয় ও উদ্বেগ এক মুহূর্তে উবে যাওয়ায় ওসমানের শরীর একেবারে তলিয়ে পড়তে চায়। তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। ভাবে, যাই নিজের ঘরে গিয়ে আধ ঘণ্টা একটু শুয়ে থাকি। কিন্তু ঘর ভরা মানুষ। এদের এড়িয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার জো নাই; না, ফিরে কাজ নাই। সকাল বেলার দৈনন্দিন এ্যাসিডিটি বা বুলেট-বেঁধা মানুষ দ্যাখার জন্যে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া যে-কোনো কারণে তার পেটের বাদিকটা ব্যাথায় চিনচিন করে ওঠে। ব্যথায় একটুখানি নুয়ে পড়লে চোখে পড়ে সামনের তক্তোপোষে ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু চাদর। তক্তপোষের চারদিকে সবাই দাঁড়াচ্ছে। একটু নেতৃস্থানীয়েরা দাঁড়ায় শিয়রের দিকে। এই রকম নিজ নিজ পজিশন ঠিক করছে, এমন সময় ঘরে ঢোকে আলাউদ্দিন। ৩০-এর ওপর বয়স, লোকটাকে ওসমান ভালো করে চেনে, বাড়িওয়ালা রহমতউল্লাহর ভাগ্নে সে, একবার ওসমানের কাছে এসেছিলো মামার হয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে। এরপর এসেছে ‘মিথ্যা আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের সহায়তাকারী নাগরিক কমিটি’র চাঁদা নিতে। আলাউদ্দিনের পেছনে ঢুকলো হাড্ডি খিজির। আলাউদ্দিনের কয়েকটি রিকশা ও ২টি স্কুটারের দ্যাখাশোনা করার ভাগ খিরিজের ওপরে। এই লোকটি খুব লম্বা, তবে তার নামের আগে উপাধিটি অর্জন করেছে তার অস্থিসর্বস্ব দেহের জন্য। তার হাতে সবসময় স্ক্রু ড্রাইভার ও প্লায়ার থাকে। কিন্তু এখন ১ হাতে আগরবাতি ও অন্য হাতে ১টি ঠোঙা। সবাইকে ওভারটেক করে খিজির সামনে আসে এবং তক্তপোষের ৪দিকে এ-ফাঁকে ও-ফোকরে কয়েকটি করে আগরবাতির কাঠি গুঁজে দেয়। ‘বেটা আগে জ্বালাইয়া লইবি তো!’ বলে আলাউদ্দিন দেশলাই ঠুকে আগরবারিগুলো ধরিয়ে দিয়ে হাল্কা ছাই রঙের ধোঁয়া ও গন্ধে ঘরের শূন্যতা এবং প্রাণী ও অপ্রাণিবাচক সমস্ত বস্তু মৃতের প্রতি নিবেদিতচিত্ত হয়। দারোগার ইঙ্গিতে রহমতউল্লা ঢেউ খেলানো চাদর তুলে ধরলো। চাদরের নিচে সাদা কাফনে জড়ানো মৃতদেহের মুখের কাপড়টিও আস্তে করে ওঠানো হয়।
চিলেকোঠার সেপাই – ০২
শ্যামবর্ণের রোগা ভাঙা গালওয়ালা এই লোকটিকে ওসমান অনেকবার দেখেছে। কোথায়? এই বাড়ির সিঁড়িতে? তাই হবে। আরো অনেক জায়গায় এর সঙ্গে দ্যাখা হয়েছে। কোথায়? স্টেডিয়ামে? হতে পারে। গুলিস্তানের সামনে সিনেমার পোস্টার দেখতে দেখতে হতে পারে। পল্টন ময়দানের মিটিঙের হতে পারে। ভিক্টেরিয়া পার্কে? আর্মানিটোলা মাঠের ধারে? ঠাঁটারি বাজারের রাস্তার ধারে বসে শিককাবাব খেতে খেতে? হতে পারে। বলাক সিনেমায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে? হতে পারে। নবাবপুরে অনেক রাতে ঠেলাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হালিম খেতে খেতে? আমজাদিয়ায় পাশের টেবিলে তর্ক করতে করতে? হতে পারে। মুখটা তার অনেকদিনের চেনা। নাকের ২পাশে ব্রণের দাগ, ২টো দাগ বেশ গভীর, এগুলো কি বসন্তের বন্ধ-করা চোখের পাতার প্রান্তে বড়ো ঘন কালো পল্লব। নাকের ডগায় ও পাতলা ঠোঁটে কালচে ছাপ। এলোমেলো চুলের এদিকে ছোটো কপালে ১টি ভাঁজও নাই। খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখলে বোঝা যায় এগুলো বেশ নরম। বয়স বোধ হয় ২০/২১-এর বেশি নয়, লোকটার পূর্ণ যৌবনকাল চলছিলো। তার চেয়ে ৫/৬ বছর ছোটো, একেবারে গড়পরতা চেহারা বলেই হয়তো এতো চেনা চেনা ঠেকে,-আর সে কিনা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরার মর্যাদা পায়। ওসমান একটু কুঁকড়ে বাইরে তাকায়। বাইরে বৃষ্টি নাই, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রোদ ঝকঝক করে। অথচ তার বাইরে যাবার উপায় নাই। দারোগা বলে, ‘আপনেরা ঐ ঘরে একটু বসেন। আধঘণ্টার ভেতর আপনাদের ছেড়ে দেবো।
ছেড়ে দেবে মানে? তারা কি তবে বন্দি পাশের ঘরে এসে রিয়াজউদ্দিন হাতলভাঙা চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকায়। অন্য চেয়ারটিতে চশমা পরা একজন বেটে লোক । তক্তপোষে ওসমান এবং আরেকজন। লাল স্ট্রাইপের হাঙ্কা গোলাপি শার্ট ও পাজামা পরা এই যুবক হলো পারভেজ, তিনতলার ডানদিকে থাকে, মুখের গঠন ও বাঙলা বলার সময় যত্ন থেকে বোঝা যায় যে, তার মাতৃভাষা বাঙলা নয়। রিয়াজউদ্দিন সাহাব, এইতো পর্যু দুপুরবেলা আমি দেখলাম কে জুম্মার পর ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ঘোড়ার গাড়িতেই স্ট্রাইকের এ্যানাউন্সমেন্ট চলছে আর তালেব বহুত গওর করে শুনছে। আমাকে দেখে বললে৷ কে, পারভেজ ভাই, মওলানা ভাসানী স্ট্রাইক কল করেছে, কাল কি আর অফিস উফিস চলবে?”
কি যে শুরু হইলো, ডেলি ডেলি হরতাল, ডেলি ডেলি ইস্ট্রাইকা’ রিয়াজউদিনের এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য শেষ না হতেই পারভেজ বলে, কালকেই তো, আমি দোকানে যাচ্ছি, দেখি আলি নেওয়াজের সেলুনে বসে তালেব ফিলিম ফেয়ার পড়ছে। তো বললো কি, আজ কৈ যান? আজ না স্ট্রাইক!’
“স্ট্রাইক তো সাকসেসফুল! কিছু দালাল বাদ দিলে কাল অফিস ব্যাকটি বন্ধই আছিলো।’ আলাউদ্দিন এবার এঘরে এসে তক্তপোষে বসে রিয়াজউদ্দিনকে লক্ষ করে একটু খোটা দেয়, ‘পাবলিকরে এইবার ঠেকা দেওয়া কাউরো কাম না।”
পারভেজ বলে, ‘জী। রাত্রে আমার ভাই বললো কে নীলখেতে গুলি হয়েছে, আমার সিস্টারের হাজব্যান্ড এসে বললো, হাতিরপুলের পাওয়ার স্টেশনের এক এমপ্লয়ি তো ডেথ হয়ে গেল। আমি ইম্যাজিন করতে পারলাম না কে আমাদের তালেব-‘ বাক্যের শেষদিকে তার গলা নোনা পানিতে ছলছল করে। তারপর প্রায় মিনিটখানেকের নীরবতা, পাশের কামরার দারোগা ও রহমতউল্লার নিচু স্বরের সংলাপে কিংবা মেয়েদের বিলাপে সেই নীরবতায় একটি টিলও পড়ে না। রিয়াজউদ্দিন হঠাৎ খসখসে গলায় ডাকে, আল্লা, আল্লাহু গনি। তার ডাকার ভঙ্গি দেখে মনে হয় যে, সম্বোধিত আল্লা বোধ হয় বারান্দায় কি পাশের কামরায় তার হুকুমের জন্যে প্রতীক্ষা করছে, আরেকবার হাক দিলেই মুখের বিড়িটা কানে ওঁজে এই ঘরে ছুটে আসবে। কিন্তু এবার ঘরে ঢোকে হাড়ডি খিজির, লোকটা আস্তে কথা বলতে পারে না, কাল গুলিতে মনে লয় সাত আষ্টজনের কম মরে নাই। তার এই কথায় সারা ঘর গমগম করে ওঠে। চশমাওয়ালা বেঁটে লোকটি বলে, ‘মরে কারা? এই মিছিল কন, মিটিং কন, ব্রিটিশ আমল থেকেই তো দেখছি। মরে কারা? সকলের দিকে সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়, কিন্তু জবাবও দেয় সে নিজেই, “ভালো নিরীহ মানুষগুলো মরে। কৈ কোনো লিডার তো কখনো গুলিতে মরে না! মরতে হয়—।”
তালেৰ বেচারা খুব সিম্পল টাইপের ছিলো। আমি তো চার বছর থেকে দেখছি।” ‘আরে আমি চিনি ঐ পোলায় তখন ন্যাংটা থাকে। রিয়াজউদ্দিনের খসখসে গলা এবার আত্মবিশ্বাসে বেশ মসৃণ হয়েছে, ইসলামপুরে আমার কাটা কাপড়ের দোকান। আমার দোকানের লগেই গল্লি, লেন, ঐ গল্লির চাইরটা, না একটা দুইটা তিনটা বাড়ি পার হইলেই মতিহাজীর বাড়ি, ঐ বাড়ির দোতলায় অরা ভাড়া থাকতো! তালেবের বাপে আমার দোকানে কতো আইছে!” তালেব, এমন কি তার বাবাকেও চেনবার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা পারভেজের চেয়ে পুরনো—এই তথ্যটি ঘোষণা করে রিয়াজউদ্দিন নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়। চশমাওয়ালা বেঁটে নতুন ভাড়াটে, এখন পর্যন্ত কারো সঙ্গে তার তেমন আলাপও হয়নি। সুতরাং তালেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রচারের প্রতিযোগিতায় নামা তার পক্ষে অসম্ভব। লোকটি হরতাল ও মিছিল সম্বন্ধে তার মতামত নতুন করে ব্যাখ্যা করে, খালি হরতাল, খালি মিছিল। দোকানপাট বন্ধ, অফিস বন্ধ, দেশের ডেভেলপমেন্ট হবে কি করে?
বুঝলাম তো আলাউদ্দিন তক্তপোষে ভালো করে বসতে বসতে উত্তেজিত গলায় জবাব দেয়, স্ট্রাইক করা মানুষের সিভিল রাইট। কিন্তু স্ট্রাইক করলে গুলি কইরা মানুষ মারতে হইৰো-এই জংলি এ্যাকশন কোন দ্যাশে দেখছেন? গলা একটু নিচু করে বলে, এদের এ্যাকটিভিটি হইল একটাই, মানুষরে যেমনে পারো জুলুম করো’
কি পাবলিক রাউডি হয়ে উঠলে—। চশমাওয়ালাকে প্রায় ধমক দিয়ে আলাউদ্দিন ৰঙ্গে ওঠে, কি বাজে কথা কন দেখতাছেন না, আমাগো ব্যাকটিরে কেমুন কায়দা কইরা আটকাইয়া রাখলো। কতোক্ষণ? ইসটুডেনরা ছাড়বো? গুলি কইরা মানুষ মারে, ইসটুডেনরা আইয়া পড়বো না?
ক্যামনে আহে? খিজিরের চড়া গলায় সবাই উসখুস করে, কিন্তু তার বাক্য অব্যাহত থাকে, ক্যামনে আইবো? ঘরের মইদ্যে পুলিস, রাস্তার উপরে পুলিস বিচরাইয়া দ্যাহেন, ছাদের উপরে ভি হালার পুলিস? ইসটুডেনে আইলে এই হালাগো ইষ্ণু টাইট করতে পারতো!”
পারভেজ বলে, “পুলিস যেখানে সেখানেই বহুত হুজ্জত।’ “আপনার আবার ভর কিয়ের? হালারা সইজ্য করবার পারে না খালি বাঙালিগো।” আলাউদিনের এই অভিযোগে পারভেজ একটু জড়সড় হয়। ওসমানের রাগ হয় পুলিসের ওপর। তার ইচ্ছা করে, বারান্দা থেকে রাস্তার মানুষকে ডাক দেয়, গতকাল হরতালের দিন পুলিসের গুলিবর্ষণে নিহত তালেবের লাশ এখানে। সবাই আসুক। স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে নিহত শহীদ তালেবের—। বাসনাটি তার মনেই থেকে যায়। রহমতউল্লা এই ঘরে এসে খিজিরের ওপর চড় মারার ভঙ্গিতে হাত তোলে, ‘খামোশ মাইরা থাক। তুই বেটা কি বোঝস? হাড়ডি খিজির চুপ করে থাকে। সে অবশ্য বেশ লম্বা, একটি টুলে না দাড়ালে তার গালে চড় মারা বাড়িওয়ালার পক্ষে অসম্ভব। বাড়িওয়ালার চাচামেচিতে ওসমানের অস্বস্তি ঠেকে। ইসলামিয়ায় এখন পায়া বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে, ওদিকে সেন্ট্রাল হোটেলের পায়াটা ভালো, এখন রওয়ানা হলে অবশ্য ওখানে পৌছতে পৌছতে পায়া আর না-ও থাকতে পারে। তা হোক, নিগারে পরোটা-কলেজি মেরে আমজাদিয়ায় গিয়ে চমৎকার আড্ডা জমাতে পারতো। গতকাল গুলি চলেছে; নবাবপুর, গুলিস্তান, স্টেডিয়াম আজ নিশ্চয়ই খুব সরগরম। রবিবারের সকালটা পুলিসের হাতে মাঠে মারা গেলো।
হঠাৎ করে ১৮/১৯ বছরের ২ জন যুবক এই ঘরে ঢোকে। এদের ১ জনের সঙ্গে ওসমানের আলাপ আছে। এর নাম শাহাদত হোসেন ঝন্টু। ইউনিভারসিটিতে ইকনমিক্স পড়ে। শাহাদত হোসেন ঝন্টু ও তার সঙ্গীর উত্তেজিত ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যে, ব্যাপারটাকে এরা সহজে ছাড়বে না। পুলিসকে এড়িয়ে কিংবা পুলিসকে রাজি করিয়ে এরা এখানে যখন এসে পড়েছে তখন শালার হেস্তনেস্ত একটা না করে আর যাচ্ছে না। ওসমান ৰেশ চাঙা বোধ করে, কিন্তু ঝামেলা একটা হলে তাকেও ফের জড়িয়ে পড়তে না হয়।
“তোমাগো আওনের টাইম হইলো অহন।’ বলতে বলতে আলাউদ্দিন পাশের ঘরের দিকে আঙুল দ্যাখায়।
বটতলায় মিটিও। মিটিও এখানে চলছে।” বলে শাহাদত হোসেন ঝন্টু ও তার সঙ্গী পর্দা তুলে ভেতরে চলে যায়। ওসমান তাদের কারো নজরে পড়ে না। তাদের জন্য তৈরি মুখের বিশেষ ভঙ্গি শিথিল করে ওসমান পরবর্তী ঘটনার প্রতীক্ষা করে। ভয়ে বা ভক্তিতে বা এমনি নিয়ম পালনের খাতিরে রিয়াজউদ্দিন জোরে জোরে বলে, “আল্লা আল্লাহু গনি। এই ধ্বনিসমষ্টি দরজা দিয়ে বাইরে উধাও হয়। ঘরের সবাই এখন তাকিয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। রিয়াজউদিনের ভাঙা ভাঙা মোটা গলার আওয়াজ বারান্দায় দাঁড়ানো লোকজন, পুলিস ও পার্টিশনের ক্যানভাসে আঁকা নদী, তালগাছ, সূর্য ও সাহসী পাখিদের কাপিয়ে ধাবিত হয় শূন্যতার দিকে। সেখানে রোদ ঝকঝক করে। পাশের ঘরে ছাত্র-নেতাদের একজন বলছে, বায়তুল মোকাররমে জানাজার পর দাফন হবে।’
জবাবে রহমতউল্লার স্বর ঠাণ্ডা ও শান্ত, “আরে বাবারা, চ্যাতেন ক্যান? গোসল টোসল কমপিলিট। গোরস্থানে খবর গেছে, কবর খোড়ার কাম চলতাছে। জানাজা হইবো ওহানেই। এর মইদ্যে পলিটিক্স ঢোকাইতে চান ক্যান?
‘পলিটিক্সের কি দেখলেন? আমরা অলরেডি এ্যানাউন্স করে দিয়েছি, জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে জানাজা, জানাজার পর আজিমপুর গোরস্থানে দাফন হবে। শাহাদতের এসব কথা বেশ গুছিয়ে-বলা। দারোগার স্বরও বেশ শান্ত, ছেলেমানুষি করছেন কেন? আপনারা এডুকেটেড লোক, হাইয়েস্ট এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র। জানেন না মুর্দাকে ইজ্জত করতে হয়? মুর্দার সামনে হৈচৈ করলে গোর আজাবের চেয়েও মুর্দা বেশি তকলিফ পায়।’
এ ঘরে আলাউদ্দিন উত্তেজনায় কাপে, ‘দারোগা সায়েব অহন দেহি মৌলবি ভি হইবার চায়! কেমুন ফতোয়া দিতাছে দ্যাহেন।
ও ঘরে বাড়িওয়ালা হঠাৎ বলে, চলেন, এই ঘর ছাইড়া যাই। বেচারা পোলটারে এটু আরামে থাকতে দেন। মৃত তালেবের স্বস্তির জন্য সবাইকে নিয়ে সে ঐ ঘর ছেড়ে চলে আসে। শাহাদত হোসেন ঝন্টু এবার ওসমানকে দেখেছে। কিন্তু দারোগার সঙ্গে কথা বলতেই সে ব্যস্ত। দারোগা কিছুতেই ওদের হাতে লাশ দেবে না, ‘ডেডবডি দিতে পারবো না ভাই। অর্ডার না থাকলে আমরা কি করবো? এদিক ওদিক তাকিয়ে সে বাড়িওয়ালার দিকে তাকায়, মুর্দার গার্জেনের রিকোয়েস্টে আমরা হেল্প করতে এসেছি।
এবার বাড়িওয়ালার গলা হঠাৎ একটু নিচে নামে, আমার ভাইস্তার লাশ আমরা জোহরের আগেই দাফন করতে চাই ।
আপনি কি ওর চাচা? শাহাদত এবার রহমতউল্লাকে বোঝাবার উদ্যোগ নেয়, তাহলে আপনি বুঝবেন। বায়তুল মোকাররম নামাজের পর কতো লোকে তার জানাজা পড়বে। শহীদের লাশ দাফন হবে কাউকে না জানিয়ে এটা কি ঠিক হবে?
“আমাগো উপরে আর জুলুম কইরেন না। রহমতউল্লার চোখজোড়া ছল ছল করে, বহুত গজব পড়তাছে, দ্যাখেন না কই আছে পোলার বাপ, আর পোলায় মরে গুলি খাইয়া।’ নোনাপানিতে তার গলা ভেজে, অর বাপের বয়স হইতাছে। তামামটা জিন্দেগি কাটলো পরের দোকানে গোলামি কইরা, টাঙাইল থাইকা আইয়া দেখবো- এবার সে একেবারে কেদেই ফেললো। রহমতউল্লার কান্না ভেতর-ঘরের মেয়েদের চাপাকান্নায় ইন্ধন জোগায়, তারা জোরে জোরে কাদার সাহস পায়। তালেবের বাবা এসে কি দৃশ্য দেখবে ভেবে ওসমানের কান্না পাওয়ার দশা ঘটে। তবে তার চোখে নোনা ভাপ ওঠার আগেই আলাউদ্দিন ঠাণ্ডা ও নোনামুক্ত স্বরে বলে, এর বাপে তো আউজকাই আইয়া পড়বো। বাপেরে একবার দ্যাখাইবেন না?
কি একটা কথা যে কইলা? রহমতউল্লা ভাগ্নের ওপর বিরক্ত হয়েছে, এর মধ্যেই তার গলা থেকে বিলাপ লুপ্ত হয়ে গেছে, তার বাপে গেছে টাঙাইল। মাহাজনের লাইগা কাপড় কিনবো-বাজিতপুর, বল্লা, কালিহাতি, পোড়াবাড়ি,-চাইরটা পাঁচটা হাট সারবো, কাপড় লইবো, কাপড়ের গাইট করবো, গাইট আবার তুলবো টেরাকের উপর। আরো দুই চাইর দিনের কম না। লাশ পইড়া থাকবো?
শাহাদতের সঙ্গী ছেলেটি প্রায় মিনতি করে, আমরা দুদিন তিনদিন চাই না। এই ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যে জোহারের নামাজ, নামাজের পর জানাজা। কতোক্ষণ লাগবে? এতোগুলো লোক অপেক্ষা করবে।’
বাড়িওয়ালার গলা ফের চড়ে যায়, তার হাত এখন বেশ শক্ত, তার বাপে থাকলে আপনেরা কইয়া দেখতে পারতেন। আর মায়ে কি কইবো, কন? আমি কি আর লাশ লইয়া মিছিল করবার দিবার পারি?
ওসমান গনি তখন ভেতরে তাকাবার চেষ্টা করে। রঞ্জকে ডেকে একবার বললে হতে না? তার ভাইকে যারা হত্যা করে তাকে দাফন করার ভারও তাদেরই হাতে থাকবে? কিন্তু রঞ্জু কোথায়? ভেতরকার কান্নাকাটিতে রঞ্জুর গলা আলাদা করে ঠাহর করা মুশকিল। আহা, ভাইয়ের জন্য কেঁদে কেঁদে বেচারার চোখজোড়া একেবারে লাল হয়ে গেছে! ওর লাল চোখ এবং নীলচে ঠোট নিয়ে রঞ্জু কি একবার আসতে পারে না? এলিফ্যান্ট রোড তো এখান থেকে মেলা দূরে! সেই রাস্তা ধরে গেলে হাতিরপুল পাওয়ার স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাইয়ের কথা ভেবে রঞ্জুর মনটা খারাপ হয়ে যাবে। ১০/১১ বছর আগে ওসমান কিছুদিন সেন্ট্রাল রোডে ছিলো। পুরনো এলিফ্যান্ট রোড তখন ফাঁকা ফাঁকা, দুইদিকে কোথাও কোথাও বাড়িঘর তৈরি সবেমাত্র শুরু হয়েছে। রাস্তার ২দিকে বেশির ভাগই নিচু জায়গা, ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে পানিতে মুখ পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে থাকতো কালো কালো মোষ । সন্ধ্যাবেলা নিউমার্কেট থেকে একা একা ঘরে ফেরার সময় ওসমান দেখতে পাওয়ার স্টেশনের চিমনির মাথায় ১টি লাল আলো কোনো গ্রহের মতো স্থির হয়ে জুলছে। ঐ আলোর দিকে তাকিয়ে নির্জন রাস্তায় হাটতে হাটতে রঞ্জুর খুব মন খারাপ করতো। ওখানে চাকরি করতো ওর ভাই তালেব, কথা নাই বার্তা নাই ওখান থেকে বেরিয়ে মিছিলে ঢোকার অপরাধে নীলক্ষেতে তাকে গুলি করা হয়েছে। রঞ্জুর এই মন-খারাপে ওসমানের সারা শরীর ও মাথা শিরশির করে ওঠে। নিহত যুবকের লাশ নিয়ে ২ পক্ষের তর্ক তার কানের পাশ দিয়ে আলোর মতো গড়িয়ে যায়, সে কিছুই শুনতে পারে না।
শাহাদত হোসেন ঝন্টু তাকে জিগ্যেস করে, আপনি এখানে থাকেন? ওসমান তখন ১০/১১ বছর আগে এলিফ্যান্ট রোড ধরে ভ্রাতৃশোকগ্রস্ত রঞ্জুর চলাচল দ্যাখ্যা থেকে ফিরে আসে, বলে, ‘জি। শাহাদত ফের বলে, তিনটায় বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সভা, আসবেন। এখন যাই। দেখি।’ গোরস্থানে আসছি। একটু পরে আসবো।”
তোমরা যাও, জুরাইনে আমি খবর পাঠাইতাছি, গোরস্থানেই জানাজা হইবো, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, মিলব্যারাক থাইকা মানুষ যাইবো। আলাউদ্দিনের এই সব কথা দারোগা বা রহমতউল্লার কানে যায় না, সে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছে। কিন্তু শাহাদতও ভালো করে বুঝলো বলে মনে হয় না। সঙ্গীকে নিয়ে শাহাদত বেরিয়ে গেলে দারোগ বলে, এবার লাশ বের করার ব্যবস্থা করতে হয়। রহমতউল্লার পেছনে পেছনে আলাউদ্দিন ও হাড্ডি খিজির ভেতরে চলে যায়। দারোগা এবার সিগ্রেট ধরিয়ে বারান্দা ও ঘরের মাঝখানের চৌকাঠে ১টা পা রেখে বলে, মুর্দার সঙ্গে আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা অনেক কষ্ট করলেন, এবার বাড়ি গিয়ে আরাম করেন। ছাত্র ২টােকে সামলাতে পারার সাফল্যে দারোগা সিগ্রেটে কষে টান দেয়, ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসপাতালে এই লাশ গেছে আসরের নামাজের আগে। রাত যখন বারোটা তখনও পোস্ট মর্টেম কমপ্লিট হয়নি। কেন? ডাক্তার নেই। ডোমও পেলেন ডাক্তারও পেলেন তো কারেন্ট নেই। এদিকে ডিআইজি সাহেব বারবার বলে পাঠাচ্ছেন ভোর হবার আগে হাসপাতাল থেকে ডেডবডি বের করতে না পারলে ছাত্ররা একটা চান্স পেয়ে যাবে। রিয়াজউদ্দিন তার কিস্তিটুপিওয়ালা মাথা নাড়িয়ে দারোগাকে সমর্থন করে। দারোগার কথা শেষ হলেও তার মাথা নাড়ানো আর থামে না। তারপর সে শুরু করে জিভ নাড়াতে, ‘কাম পাইবেন কৈ? কৈ পাইবেন? ডাক্তারগুলির কথা কি কই? কয়দিন আগে ডাক্তাররা ইস্ট্রাইক করলো না? শুনছেন? —কুনো দাশের ডাক্তারে ইস্ট্রাইক করছে শুনছেন?
এদের কথা আর বলবেন না। দারোগা তার অসমাপ্ত বক্তৃতা সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়, আমার এসপি সাহেব বলে, হাসপাতাল থেকে লাশ সরান ! লাশ সরান। সকাল হলে এই ডাক্তাররাই ছাত্রদের ইনফর্ম করবে। চশমাওয়ালা বেঁটেও তার সায় জানায়, এরা লাশ নিয়ে পলিটিক্স করে, মুর্দার ইজ্জত করতে জানে না, এদের দিয়ে কি হবে, বলেন।’
দারোগা হয়তো আরো কথা বলতো, কিন্তু ভেতর থেকে কান্নার প্রবল রকম একটি দমক ওঠায় সবইকে চুপ করতে হয়।
লাশের খাটিয়া কাধে তুলে নেয় রহমতউল্লা, রিয়াজউদ্দিন, আলাউদ্দিন ও ওসমান।
সইরা দাঁড়ান, সইরা দাড়ান’ বাড়িওয়ালার এই নির্দেশে সমবেত কান্নার ধ্বনি সমগ্র বাড়ি উপচে বাইরে গড়ায়।
কৈ যাও? ও আব্বাজান, বাবা আমার বাবারে লইয়া আপনেরা কৈ মেলা করলেন? নিহত যুবকের মায়ের বিলাপে খাটিয়া ভারি হয়ে উঠেছে। হাড়ডি খিজির সামনে যেতে যেতে আস্তে’, ‘ডাইনে’, এটু বামে যান প্রভৃতি নির্দেশ দিচ্ছে। ওসমানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে পারভেজ। ওর খুব ইচ্ছা তালেবের শরীরটা একবার একটু বহন করে। আলাউদিনের দিকে সে আড়চোখে দেখছে। আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লালাহু বলতে বলতে রহমতউল্লা খিজিরের কাধে খাটিয়ার ১টি অংশ চড়িয়ে দেয়। খাটিয়ার পেছনে ২জন পুলিস। ১জন পুলিস ওসমানের কাছ থেকে খাটিয়ার ১টি অংশ নিজের ঘাড়ে নেয়, আর ১জন পুলিস নেয় আলাউদিনের ঘাড় থেকে। ওসমান এবার সবচেয়ে পেছনে। না, তারও পেছনে আসছে রঞ্জ, রঞ্জুর ঘাড়ে হাত দিয়ে রেখেছে পারভেজ। সিঁড়ির অন্ধকার মোড়ে এলে পারভেজকে নজরে পড়ে না। রঙ্গুনিজের দুই হাত কচলাচ্ছে। কেন? ছাইগাদায় লেবুগাছের সামনে রগুকি লেবু পাতা চটকাচ্ছে? খাটিয়া নিচে নামে। ওসমান ভয়ানক রকম বিচলিত হয়ে ভোররাতের স্বপ্ন ও সকালবেলার দৃশ্যের অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। বলা যায় না, সে হয়তো এই অবস্থায় নিচেও পড়ে যেতে পারতো কিন্তু তার আগেই শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না। —এই সমবেত ধ্বনি তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়।
১৭/১৮ জন যুবক ও প্রায় ২৫/৩০ জন পিচ্চি দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। সামনে শাহাদাত হোসেন ঝন্টুর সেই সঙ্গী। দারোগার চোখে কি চালাকি খেলে, খাটিয়া চটপট উঠে পড়ে রাস্তায় দাড়ানো পুলিসের ভ্যানে। ভ্যানে এক এক করে ওঠে রহমতউল্লা, রিয়াজউদ্দিন ও রঞ্জ। আলাউদ্দিন যুবকদের সঙ্গে কি বলছিলো, দারোগা তার পিঠে বেশ সম্ভমের ভঙ্গিতে হাত রেখে বলে, ‘আপনে আমার সঙ্গে আসেন, ওখানে চাপাচাপি হবে।’ তাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে জিপে ওঠানো হলো। পারভেজ নাক ঝাড়ার জন্য উবু হয়েছিলো। ওসমান ভাবছিলো উঠবো কি উঠবো না, উঠলে কোন গাড়িতে এবং কোন দিক দিয়ে উঠবো। —এরই মধ্যে শহীদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবে না’, ‘আইয়ুব শাহী জুলুম শাহী-ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’-এইসব শ্লোগানের ধাক্কায় পুলিসের ভ্যান ও পুলিসের জিপ বাদিকে মোড় নিয়ে হেমেন্দ্র দাস রোড ধরে দ্রুতবেগে চলে যায় লোহার পুলের দিকে। চলন্ত ভ্যানে টাল সামলাতে সামলাতে উঠে পড়েছে হাড্ডি খিজির।
চিলেকোঠার সেপাই – ০৩
সুভাষ বোস এ্যাঁভেনু ও হেমেন্দ্র দাস রোডে দোকানপাট সব বন্ধ। উল্টোদিকের মসজিদের বারান্দায় মক্তবে ছেলেমেয়ে নাই। একজন বুড়োমানুষ বারান্দায় একা এক রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে চলেছে। রাস্তা যানবাহনহীন, লোক চলাচল কিন্তু কম নয়। ছাদের সামনের দিককার উঁচু দেওয়ালের ওপার এইসব দেখতে দেখতে ওসমানের একটু উঁচুকরে-রাখা পায়ের পাতা ধরে আসে। ঠাকুর দাস লেনের মাথায় তোতামিয়া ডেকোরেটার্সের গা ঘেঁষে লোহার পোস্টে অজস্র ইলেকট্রিক তারের এলোমেলো ও জটিল সমাহার। ঐখানে একবার পড়ে গেলে তারগুলো সব জ্যান্ত হয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরবে যে, জীবনে আর বেরিয়ে আসা যাবে না। ওসমানের সারা শরীর শিরশির করে। নাঃ! তাড়াতাড়ি অফিস রওয়ানা হওয়া দরকার।
সিঁড়িতে রঞ্জুর সঙ্গে দ্যাখা। সঙ্গে ওর বোন, রঞ্জুর চেহারার সঙ্গে খুব মিল। তবে মেয়েটার গায়ের রং আরেকটু চাপা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের হলে ভালো হতো। সপ্তাহ দেড়েক আগে একদিন সন্ধ্যায় ওদের ঘরে মেয়েটিকে ওসমান ভালো করে দেখেছে। তখন কিন্তু রঙটঙ নিয়ে এসব কথা মনে হয়নি। সেদিন তালেবের কুলখানি হবে শুনে ওসমান আগেভাগেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তালেবের বাবা ওপরের বারান্দা থেকে ডাকতে ডাকতে একেবারে রাস্তায় এসে ধরলো। আমার একটু দরকার ছিলো –ওসমানের মুখ থেকে এই কথা বেরোতে না বেরোতে মকবুল হোসেন তার হাত ধরে ফেলে, আমার এ্যাঁবসেন্সে আপনারা এত করলেন, আজ একটু কষ্ট করেন। বাদ আসর মিলাদ, মিলাদের পরে এফতার দিয়া বিদায়। কোরান খতম করাইতেছি, মৌলবিগো লগে আপনেরা কয়জন থাকবেন। সামান্য আয়োজন করছি।
এফতারের পর বেশির ভাগ লোক চলে গেলে মৌলবিদের সঙ্গে কয়েকজনের জন্য খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ওসমানও চান্স পায়। এদিন রঙ্গুর মা ছাড়া ওদের আর সবাইকে তার দাখার সুযোগ ঘটে।
রঞ্জুর সবচেয়ে বড়ো বোনটি বেশ ফর্স এবং বোবা। তার বাচাল স্বামীর সঙ্গে আগের দিন সে নরসিংদি থেকে এসেছে। তবে তার স্বামীটা সেদিন সবাইকে কম সার্ভিস দেয়নি। তার অবিরাম কথাবার্তার জন্যেই নিহত তালেবের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে আয়োজিত মিলাদ সেদিন ভার হয়ে কারো বুকে চেপে বসেনি। মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর সবুজ চাদর পেতে খাওয়ার সময় ওরা ২ বোনই ভেতর থেকে ভাতের গামলা, গোশতের বাটি, বেগুন ভাজার হাফ-প্লেট, গ্লাস, মগ-এগিয়ে দিচ্ছিল ঘরের দরজা পর্যন্ত। বোবা মেয়েটি কিন্তু কাদছিলো না, বড়ো বড়ো একটু কটা চোখ কুঁচকে একেকজনের দিকে সে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যে, দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ ফেরানো খুব কঠিন। তার স্বামী নরসিংদি ইপিআরটিসি বাস টার্মিনালের ফোরম্যান। তালেব যেদিন মারা যায় সেদিনই, বলতে গেলে প্রায় একই সময় বেতকার কাছে গ্রামের লোকজন ১টি স্টেটবাস আটকায়। হরতালের দিন, স্টেটবাস চলতে দেওয়ার কোনো কারণও ছিলো না। লোকজন বাসের কাঁচ ভেঙে ফেলে, যন্ত্রপাতিও জখম করে। নরসিংদি ডিপো থেকে পরদিন এই ফোরম্যানকে পাঠানো হয়। যন্ত্রপাতি ঠিক করে বাস পাঠিয়ে ফোরম্যান বসে গেলো তাড়ি টানতে। খবর পেতে পেতে ২দিন কেটে যায়। ফোরম্যানের নাড়ি নক্ষত্রের খবর রাখে কে?-আলাউদ্দিন। নরসিংদির বাস ডিপোতে কি সব গোলমাল চলছে, আলাউদ্ধিনের দলের কর্মীরা এই নিয়ে কালকেও ঢাকায় এসেছিলো। কাল বিকালবেলা ওসমান নিজেই ফোরম্যানকে সন্ত্রীক আসতে দেখেছে। মেয়েটা ওপরে উঠেই বারান্দায় বাড়িওয়ালাকে দেখতে পায় এবং তার চোখ তাক করে ছুড়ে মারে নিজের হাতের চুড়ি। মেয়েটার হাতের সই ততো সুবিধার নয়। সোনার চুড়ি রেলিঙে লেগে পড়ে গেলো রাস্তায়, নালার ধার ঘেঁষে। শ্যালক-শোকে মুহ্যমান ফোরম্যান কান্নাকাটিতে বিরতি দিয়ে চুড়ি কুড়াতে নিচে দৌড়ে গেলে বোবা মেয়ে হাউমাউ করে কাদতে-থাকা মায়ের বুকে নিজের ফর্স ও গোলগাল মুখ ঠেসে চেপে ধরে। তার পর ওসমান তাকে দ্যাখে রাত্রে ওদের ঘরে খেতে বসে। তখনও তার রাগ পড়েনি, সকলের ওপর সমানে চক্ষুবর্ষণ করে চলেছে।
রঞ্জুর এই কালো বোনটি বরং নিরাপদ। কুলখানির সন্ধ্যায় এর চাপা ঠোঁটে বেগুনি রঙই ছিলো প্রধান। রঞ্জুর সঙ্গে সেদিন ওর ঠোঁটের পার্থক্য বোঝাই যায়নি। মিলাদ ও কোরান খতমের পর আলাউদ্দিন পুলিসের গুলিবর্ষণের উত্তেজিত বর্ণনা দিচ্ছিলো, কয়েকটা প্লেট হাতে এই মেয়েটি তখন ঠিক দরজায় এসে পড়েছে, আলাউদিনের কথা শোনার জন্যে থমকে দাঁড়ায়। ওসমান আড়চোখে তাকে দেখছিলো, ঘরের ঝুলন্ত ডিসি লাইনের ৪০ পাওয়ার বাম্বের ঘোলাটে আলোতে মেয়েটির ঠোঁটে বেগুনি রঙ গাঢ় হয়, আলাউদিনের খসখসে গলায় হড়হড় করে কথা বলার তোড়ে মেয়েটির শ্যামবর্ণের গাল তিরতির করে কপিছিলো। এমন হতে পারে যে, তার মুখের ভেতর কোনো বাক্য তৈরি হচ্ছিলো। কিন্তু সেই বাক্য প্রকাশের আগেই মকবুল হোসেন ডাকে, রানু প্লেট দে।
আজকে রানুর মুখ কিন্তু মোটেই থমথমে নয়। রঞ্জুজিগ্যেস করে, স্ট্রাইকের দিন অফিস যান? ওসমান জবাব দেয়, দেখি, বাইরের অবস্থাটা দেখি। তোমরা কোথায় যাচ্ছে?
‘এইতো বানিয়ানগর। এর বন্ধুর বিয়া।’
বিয়া না। রানু সংশোধন করে, গায়ে হলুদ। খালি দ্যাখা কইরা চইলা আসবো।
রাস্তায় একটা সাইকেল পর্যন্ত নাই। ২দিকের ভাঙাচোরা ও অনিয়মিত ফুটপাথে লক্ষ্মীবাজারের নিয়মিত জনপ্রবাহটি বন্ধ, পথচারীরা হাঁটছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। কায়েদে আজম কলেজের প্রবেশপথের গলির মুখে চওড়া জায়গায় ইট দিয়ে উইকেট সাজিয়ে পাড়ার ছোটো ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছে। খেলায় সবারই বেশ মনোযোগ, কিন্তু এদিক ওদিক কোনো রিকশা কি সাইকেলের খবর পেলেই হলো,-সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত বলের সামনে থেকে ব্যাট সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে চাকার হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। এদের খবর দেওয়ার দায়িত্ব রাস্তার বেওয়ারিশ পিচ্চিদের। পিচ্চির এমনি ঘুরে বেড়ায়, কোথাও ৭/৮ জনের এক একটি গ্রুপ, কোথাও ৫/৬ জন ছাত্রের নেতৃত্বে ২০/২৫ জনের মিছিল। মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছে, আইয়ুবশাহী, মোনেম শাহী’-‘ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’, ‘আইয়ুব মোনেম ভাই ভাই-এক দড়িতে ফাসি চাই’, ‘জুলো জ্বলো’-‘আগুন জ্বলো’। আবার মাঝে মাঝে শ্লোগান ভুলভাল হয়ে যায়। যেমন, আইয়ুবশাহী, জালেমশাহী’-এর জবাবে বলছে, বৃথা যেতে দেবো না। কিংবা ‘শহীদের রক্ত’-এর জবাবে বলছে, আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো।’
আশেপাশে কেউ দোকান খুললে এদের একেকটি ছোটো ছোটো দল দৌড়ে এসে খবর দিচ্ছে, লম্বু সালামের জিলাপির দুকান আছে না, অর বগলে সাইকেলের পাটসের দুকান আছে না, আছে না, ঐ বন্টু হালায় দুকান খুলছে।
আরেকজন বলে দুকান খুলছে।’
আমরা দুকান বন্ধ করবার কইছি তো, বন্ধ করবার কইছি তো, বন্ধ করবার-। উত্তেজনায় বাড়ি-বাড়ি-কাজ-করা মাতারির পোলা বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারে না। আরেক পিচ্চি তাকে উদ্ধার করে, ঐ বন্টু হালায় কয়, কিয়ের ইস্টাইক? ইস্টাইকের মায়েরে চুদি’ শুনে বয়সে ও বাপেদের-পরিচয়ে-বড়ো ছেলেরা ব্যাট হাতে ছুটে যাচ্ছে দোকান বন্ধ করতে। এর মধ্যে গোবিন্দ দত্ত লেনের ভেতর থেকে ১টি খোলা জিপ এসে পড়ে। ঘন ঘাস রঙের হেলমেটের সঙ্গে ফিট-করা পাঞ্জাবি, বালুচ ও বাঙালি সৈন্যদের কয়েকজন জিপের রেলিঙে মেশিনগান রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ট্রিগারে আঙুল বসানো, টিপলে এক মুহুর্তে কালো নোঙরা এই পিচ্চিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। তবে পিচ্চিরা ও ক্রিকেট খেলোয়াড়রা নিমেষে হাওয়া হয়ে যায় নন্দলাল দত্ত লেনের ভেতর। আরো ভেতরে পাঁচভাইঘাট লেন। এই ২ গলির মোহনায় খেলার জন্য চওড়া জায়গা, আবার সেখান থেকে নারিন্দার পুল পর্যন্ত খানিকটা জায়গার ওপর নজর রাখাও চলবে।
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে পৌঁছে ওসমান দ্যাখে পার্কের রেলিঙের বাইরে ফুটপাথে ও ভেতরে ইপিআরের জওয়ানেরা। পার্কের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো লরি থেকে লাফিয়ে নামছে হেলমেটসাটা লোকজন। নামতে নামতেই পজিশন ঠিক করে নিচ্ছে। কী হেভি প্রিপারেশন! শালদের প্রত্যেকটার মুখে ১টা লাথি মারার জন্য ওসমানের পাজোড়া নিসপিস করে। তার পায়ের কদম সোজা হয় না। টলমল করে। কিন্তু ১০০ বছরেরও আগে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাসি দেওয়ার জন্যে নবাব আবদুল গনিকে দিয়ে পোতানো পামগাছ বা সেইসব পামগাছের বাচ্চারা মানুষের শ্লোগানে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি বলে আস্তে আস্তে হাই তোলে। ওসমানের রাগ বা ইচ্ছা তাদের ধুলোপড়া পাতায় এতোটুকু চিড় ধরাতে পারে না। ডানদিকে মোড় নিয়ে একটু এগিয়ে আজাদ সিনেমার সামনে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা ইপিআরের কয়েকটি হেলমেটধারীর ধাতব ও শীতল মুখের সঙ্গে ওসমানের চোখাচোখ হয়। তাড়াতাড়ি করে সে চোখ নামিয়ে নিল। কী ভয়ানক ঠাণ্ড সব মুখ। এরা কী না করতে পারে। নিজের চোখ মুখ গাল ঠোঁট, এমন কি কান থেকেও রাগ ও ক্ষোভের সব চিহ্ন মুছে ফেলে নিবিষ্টচিত্তে সে হাটতে থাকে। তাড়াতাড়ি অফিস যাওয়া দরকার। স্ট্রাইক ছিলো বলে কালকেও যাওয়া হয়নি। এভাবে এক নাগাড়ে কতদিন চলবে? বসের সঙ্গে ওসমানের সম্পর্ক ভালোই। কিন্তু বসের বস লোকটি ল, অর্ডার ও ডিসিপ্লিনের ১জন নিষ্ঠাবান উপাসক। ওদিকে কারো সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হলেই ফিসফিস করে, পাঞ্জাবিরা একেবারে শেষ করে ফেললো। বাসটার্ড রেস, কারো জন্যে মিনিমাম কনসিডারেশন নেই। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সহ্য করার লোক তিনি নন, পলিটিশিয়ানদের কথায় নেচে লাভ কি? এরা পাওয়ারে ছিলো না? বাঙালি মিনিস্টারের কোটা কোনদিন খালি ছিলো? নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, সোহরাওয়াদি-এর প্রাইম মিনিস্টার হয়নি?–রেজাল্ট?এভরিবডি নোজ। এরপর সিগ্রেটে গোটা দুয়েক টান দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে গভীর দীর্ঘশ্বাস এবং সমস্যার সমাধান ছাড়ে, উই নীড় প্রপার প্লেস ইন দ্য পলিসি মেকিং। অফিসাররা ছাড়া এসব করবে কে? ঐসব ডেমাগগ পলিটিসিয়ান্স? ওসমানের বস এইসব শুনে আসে তার বসের কাছে এবং নিজের কামরায় এসে ঝাড়ে ওসমানের কানে। ওসমানের বসটি এমনিতে খুব বাঙালিঅও প্রাণ। মেয়েকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ালেও ছায়ানটে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখায়। আবার বাঙালি পলিটিশিয়ানদের ওপর লোকটি অতোটা চটা নয়, বরং তাদের সঙ্গে তার অনেক আগেকার পরিচয়ের প্রসঙ্গ সুযোগ পেলেই জানায়। তবে ল’ এ্যাঁন্ড অর্ডারভক্ত বসের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্যে অনুপস্থিত কর্মচারীদের নামে শো-কজ পাঠাতে পারে। যানবাহনশূন্য নবাবপুরের পথচারীদের অনেকেই অফিসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ একেকটি গাড়ি ‘রেডক্রস বা ‘প্রেস’এর জোরে এদিক ওদিক করছে। বাঁদিকে বংশালের রাস্তায় ছোটোখাটো ভিড়, মানসী সিনেমার সামনে ছাত্রদের কেউ বস্তৃতা করছে। রোজার মাস, লোকজন বড়ডো থুতু ফেলে। যানবাহন নাই বলে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটার মতো থুতু ছড়ানো। আলু বাজারের মাথায় সিগ্রেটের ছেঁড়া প্যাকেট দিয়ে তৈরি তাস বাজি রেখে পিচ্চিরা ডাংগুলি খেলছে, ছোটে ছোটো মিছিল দেখলেই স্লোগান দিতে দিতে মিছিলে ভিড়ে যাচ্ছে। ডানদিকে বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের মাথায় পানের দোকানটা একটু খোলা। বুড়ো পানওয়ালা পাতলা ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে পানে চুন লাগায়, খয়ের লাগায়, একটু জরদা ঝাড়ে। রোজার মাস বলে সামনে ১টা চট ঝোলানো। রাস্তা জুড়ে থুতু দেখে ওসমানের একটু গা ঘিনঘিন করছিলো, ভাবলো, ঠাঠারি বাজারের পর্দা ঝোলানো কোনো রেস্টুরেন্টে এক কাপ চামেরে বুড়োর হাতে মশলা-দেওয়া পান মুখে দিলে ভালো লাগবে। কিন্তু ডানদিকে পা দিতে না দিতে হড়হড় আওয়াজ করে বুড়ো দোকানের শাটার টেনে দিলো। কি হলো?—বনগ্রামের দিক থেকে মিছিল আসছে। একটু দাঁড়ালে মিছিলটা ধরা যায়, কিন্তু অফিসে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
নবাবপুর শেষ হলে রাস্তার ছবি পাল্টায়। রাস্তা হঠাৎ নদীর মোহনার মতো অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক চেহারায় প্রসারিত হয়। ইপিআরটিসি বাস টার্মিনালের সামনে ট্রাফিক আইল্যান্ড ঘেঁষে ধিকিধিক জুলছে ১টি সরকারী বাস। এখানে বেশ ভিড়, আবার এখানে অনেকে তাড়াতাড়ি হাঁটে, যে কোনো সময় ইপিআর এসে গুলিবর্ষণ শুরু করতে পারে।
অফিসে কিন্তু অনেক লোক। গতকালও কি সবাই এসেছিলো? লিফট বন্ধ। সিঁড়ি ঠেঙিয়ে পাঁচতলায় উঠে ডানদিকে বড়ো ঘরে একেকটি নীরব টাইপরাইটারের সামনে নিজনিজ চেয়ারে বসে সবাই গল্প করছে। কেউ কেউ হেঁটে এসেছে অনেক দূর থেকে, কিন্তু যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে রাস্তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে তাতে মনে হয় না যে, কারো কোনো কষ্ট হয়েছে। এই বড়ো ঘরের ভেতর দিয়ে মাঝারি ও ছোটো ধরনের সায়েবরা চলে যাচ্ছে নিজেদের কামরায়। এদের পা টেনে টেনে হাটা দেখে বা কল্পনা করে কেরানীকুল কখনো পুলক, কখনো মায়া অনুভব করে। তবে বড়ো সায়েবের জন্য সকলের প্রাণে আজ বড়ো হাহাকার: বড়ো সায়েব আজ সুট পর্যন্ত পরেনি। তার ফুল হাতা সাদা শার্ট এই শীতেও ঘামে না হলেও ভাপে ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে। তার কপাল ও গাল তেলতেলে। মুখের সেই মহানিলিপ্ত ডাটখানিতে চিড় ধরেছে। বড়ো সাহেব থাকে ধানমণ্ডির একেবারে ভেতর দিকে, এতোটা রাস্তা হেঁটে এলো, আহা! একটা কঠিন অসুখে না পড়ে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে যেতে বড়ো সায়েবকে ১০/১১ পা হাটতে হলো। এতোটা সময় জুড়ে তাকে দ্যাখার সুযোগ মেজো ও ছোট সায়েবরা ছাড়তে চায় না। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সবাই প্রায় কোরাসে স্লামালেকুম স্যর বলে।
মাঝারি গোছের এক সায়েব বড়ো ঘরে এসে বলে, ‘ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়ি কেউ আসেনি? একটু চাটা খাওয়া যাবে না?
‘কেউ আসেনি স্যর। এই সেকশনে কেউ আসেনি। মাঝারি গোছের সায়েব নিজের কামরায় চলে গেলে ছোকরা এক কেরানি বলে, পায়জামা ঢিলা শুনে সবাই অনেকক্ষণ ধরে হাসে। একজন কেবল বিরক্ত হয়েছে, এই শালারা বেশি বাইড়া গেছে!
কারা? ‘আবার কারা? লিফট বন্ধ, আবার চাবি লইয়া ভাগছে! পিওন চাপরাশিগো এতোটা বাড়াবাড়ি ভালো না!
এই ১টি মন্তব্যই তাদের গল্পের বিষয়বস্তু বদলাবার জন্যে যথেষ্ট। একজন বলে, ‘খালি পিওনদের বলছেন কেন? রিকশাওয়ালা, বাস কন্ডাক্টর, ড্রাইভার, কুলি—এদের তেজটা দেখছেন? আরে আইয়ুব খান গেলে তোদের লাভটা কি? তোরা মিনিস্টার হবি? নাকি অফিসে এসে চেয়ার টেবিলে বসবি?’
‘আরে শোনেন। ৪/৫ দিন আগে এক শালা রিকশাওয়ালা, নবাবপুর রেলগেট থেকে সদর-ঘাট যাবো, তো কতো হাকালো জানেন? —এক টাকার কম যাবে না। ভাড়া তো আট আনাও হয় না, না হয় দশ আনা নে, বারো আনাই চা; না, পুরো টাকাটা দিতে হবে।’
রেলগেট থেকে সদরঘাটের ভাড়া ছয় আনার বেশি হইতে পারে না। সহকর্মীর সমর্থন পেয়ে রিকশাওয়ালার ব্যবহারে ক্ষুব্ধ লোকটির উৎসাহ বাড়ে, ‘সীটে বসে, হ্যাঁন্ডেলে পা রেখে নবাবের বাচ্চা বলে, এক টাকার কমে হবে না। দিনকাল খারাপ, নইলে শালার পাছায় কষে একটা লাথি বসিয়ে দিতাম!’
বসের কামরায় টেবিলের এক পাশে বসে হার্ডবোর্ড ও কাচের পার্টিশনের ওপর থেকে কেরানীদের রিকশাওয়ালা পেটাবার সখের কথা শোনা যাচ্ছে।
ওসমানের বসের পাতলা গোঁফে অল্প অল্প ঘাম লনে-ছাট ঘাসের শিশিরবিন্দুর মতো চকচক করে। বস বলে, এদের ফল ইনএভিটেবল! কেরানিকুল না রিকশাওয়ালা-কাঁদের পতন অনিবার্য ওসমান এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার আগেই বস বলে, ‘পাবলিক কি রকম স্পনটেনিয়াসলি রি-এ্যাঁক্ট করছে, দেখছেন?
বসের মস্তব্যে ওসমান খুশি হয়। বসের কথাকে আরো জোরদার করার জন্যে সে বলে, একজ্যাক্টলি স্যর! তবে মানুষ ঠিক রি-এ্যাঁক্ট করছে না। মানুষ এবার এ্যাঁকশনে নেমেছে, রি-এ্যাঁক্ট করছে বরং গভমেন্ট, রাদার কাওয়ার্ডলি!’ এই বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ছাড়তে পারায় ওসমানের ভাল লাগে। কথাটা অবশ্য আনোয়ারের। আনোয়ারের পলিটিকাল এ্যাঁনালিসিস খুব ভাল। বস কিন্তু নিজের কথার সূত্র ধরেই এগোয়, আইয়ুব খানকে এবার ঈল্ড করতেই হবে। থিংস আর আউট অফ দেয়ার গ্রিপ। এখন আমার ভয় একটাই। আর্মি নামিয়ে ব্যাটারা একটা ম্যাসাকার না করে! ক্যাবিনেটে কয়েকটা হক্স আছে এ্যাঁন্ড দেয়ার ইজ এ ট্রিগার-হ্যাঁপি আর্মি।
সেনাবাহিনী নামিয়ে নির্যাতন করার আশংকার কথায় ওসমানের গা শিরশির করে। আনোয়ারের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েও ছেলেটা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলতে পারে। এ্যাঁনালিসিস এতো কনভিন্সিং। তবে একটা ব্যাপার কি, এবার ওয়েস্ট পাকিস্তানও ইনভলভড। কিছু করলে ওখানেও করতে হবে! নিজেদের ভাইবোনের ওপর কি রিপ্রেশন চালাতে পারবে? বলতে বলতে বসের স্বর নিচু হচ্ছিলো, বোধ হয় রাষ্ট্ৰীয় কোনো গোপন খবর জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।
রিসিভার তুলে বস বলে, ‘জী স্যর। প্লামালেকুম স্যর। অপারেটররা তাহলে স্যর এসেছে? গুড়। আসছি স্যর, জাস্ট এ মিনিট সার!
বসের ঘরের পাশেই ওসমানদের ঘর। ৪জন ছোটখাটো অফিসার এখানে বসে। এদের মধ্যে খলিলুর রহমান সিনিয়র। কেরানি থেকে এই পর্যন্ত আসতে আসতে বেচারার পেনশনের সময় হয়ে এলো। ঘরের টেলিফোন সেটটা তার টেবিলেই থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওসমান রিসিভার তুলে নেয়। নাঃ, কোনো সাড়া নাই, অপারেটররা এসেই বোধ হয় গুলতানি শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে ওসমান প্রায় ছেড়ে দেবে এমন সময় মহিলা কণ্ঠে শোনা যায়, নাম্বার প্লজ! কিন্তু আনোয়ারের নম্বর আর মনে পড়ে না। খলিলুর রহমানের টেবিলে কাচের নিচে মেলা ভিজিটিং কার্ড, পূর্ব পাকিস্তানের ১টা ম্যাপ, ম্যাপে ওদের ইপিআইডিসির বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা রয়েছে, অফিসের পিবিএক্স টেলিফোনের এক্সটেনশন নম্বর। এখানে আনোয়ারের টেলিফোন নম্বর খুঁজে লাভ কি? কী আশ্চর্য! আনোয়ারকে প্রায় প্রত্যেক দিনই একবার ফোন করা হয়, আর দ্যাখো আজ একি ঝামেলা হলো? ওদিকে সরু গলার তাগাদা আসে, হ্যাঁলো! কিন্তু কিছু মনে পড়ে না। কয়েকদিন আগে অফিসের কাজে সেক্রেটারিয়েটে কথা বলতে হবে, নম্বর ওর সামনেই লেখা ছিলো, অথচ ওসমান কিনা বলে বসলো ওদের বাড়ির নম্বর, তেইস বাই দুই। অপারেটর মেয়েটি হেসে ফেললে ওর চৈতন্য হয় এবং তখন টেলিফোন নম্বরটি বলে উদ্ধার পায়। কিন্তু আজ সংখ্যাবাচক কিছুই তার মনের ত্রিসীমানায় আসে না। অপারেটরকে আর প্রতীক্ষায় না রেখে ওসমান রিসিভার রেখে দিলো। টেলিফোনে টং করে একটি আওয়াজ হয় এবং ওসমান হঠাৎ খুব ভয় পায় আইয়ুব খান একটা ক্র্যাক-ডাউন না করে। আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরি। কি যে হবে! খলিলুর রহমান থাকলে তাদের গ্রামের খবর শোনা যেতো। তো গ্রামের কিসব খবর পেয়েই নাকি খলিলুর রহমান বাড়ি গেছে। হ্যাঁ, জামালপুরের ১টা বড়ো এলাকা জুড়ে দারুণ গোলমাল চলছে। খলিলুর রহমানের বাড়ির অবস্থা ভালো, জমিজমা, গোরুবাছুর, জনকিষাণ নিয়ে সচ্ছল গেরস্থ পরিবারের লোক। যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয় ওরাও ঝামেলায় পড়তে পারে। আবার পাশের টেবিলের মমতাজউদিনের সঙ্গে কথা বললেও কাজ হতো, সে ব্যাটা আজ অফিসে আসেনি। বাকি রইলো কামাল। তা কামাল তো মহাব্যস্ত; খুব ঝুঁকে বসে চিঠি লিখছে। ওসমান তবু তাকে বলে, কি কামাল সায়েব, আজ চিঠি লেখার দরকার কি? নিজেই চলে যান না! অফিস কি আর হবে?
১টি বাক্য সম্পূর্ণ লিখে কামাল তার সোনালি রঙের কলম চমৎকারভাবে কামানো নীলচে গালে ঠেকিয়ে বলে, আমারো ঐ রকম প্ল্যান ছিলো। কিন্তু ওদের এরিয়াটা ইজনো গুড়। এইসব ট্রাবল্ড স্পট এ্যাঁভয়েড করাই ভালো।
ধানমণ্ডিতে আবার ট্রাবল কি?’ কামাল ততোক্ষণে ওর চিঠি ফের পড়তে শুরু করেছে। ১টি জায়গায় ১টি শব্দ কেটে ফেললো, তীরচিহ্ন দিয়ে ওপরে কি লিখলো, তারপর মুখ না তুলেই বললো, মালীবাগে।
ওসমান অবাক হয়, আপনার ইয়ে ধানমণ্ডি থাকে না? * না ওটা কোল্যাপস করেছে। ‘মানে? ওটা আর কন্টিনিউ করছে না। এটা অন্য। এদের বাসা মালীবাগ। মালীবাগ মোড় পার হয়ে এগুলে একটি চওড়া রাস্তা গেছে খিলগায়ের দিকে, ঐ রাস্তার ওপরে। নিজেদের বাড়ি, অল মোজায়েক। ওখানে একটা কলেজ আছে, কলেজের ছেলেরা প্রতিদিন একটা না একটা ট্রাবল ক্রিয়েট করে। জায়গাটা রিস্কি।
কামালের তা হলে এটা নতুন পিক-আপ। প্রেম ছাড়া ছোকরা থাকতে পারে না। প্রথমদিকের প্রেম এমনি এমনি ঝরে পড়েছে। ভালো প্রস্পেষ্ট্রের ছেলে পেয়ে কোনো মেয়ে কেটে পড়েছে, কারো বিয়ে হয়ে গেছে। আবার কামালও আরো পছন্দসই মেয়ে পেয়ে ১টাকে ঝেড়ে ফেলেছে। তবে এখন সমস্যাটা ঠিক হৃদয়ের নয়, ফুসফুসের। কামালের একটু হাপানি আছে, শীতকালটায় ফুসফুস মন্থর হয়ে পড়লে হাওয়া চলাচল স্বচ্ছন্দ হয় না বলে বেচারা বেশ কষ্ট পায়। সাম্প্রতিক প্রেমিকারা তাই শীতকাল এলে সুড়সুড় করে সরে পড়ে। তবে কামাল বেশ খ্যানঘ্যান করে চিঠি লিখতে পারে, হাতের লেখা ভালো। ঠেসে চাইনিজ খাওয়ায়। তাই তার গ্যাপ বেশিদিন থাকে না। তবে এবার মালীবাগের মেয়ে বাছাই করার আগে তার চিন্তা করা উচিত ছিলো।
জায়গাটা রিস্কি। ওসমান কামালের ভয়কে অনুমোদন করে, খিলগাও মালীবাগ, শান্তিনগর-এই বেল্টটাই খুব সেন্সিটিভ। প্রায় প্রতিদিন গুলি চলেছে।’
স্পেশালি প্লাম এরিয়া। ব্যাটাদের কাজকাম নেই তো. রোজ প্রসেশন বার করে। পুলিসের গাড়ি দেখলেই চিল ছোড়ে। চিল দিয়ে অটোমেটিক উইপনস ঠেকাবে? স্টুপিড।’
পার্টিশনের ওপার থেকে ওসমান গনির বস ডাকে, ওসমান গনি সায়েব!’ বোঝা যায় যে, বস তার সায়েবের ঘর থেকে চার্জড হয়ে এসেছে।
‘আরে বসেন। আজ আবার কাজ কি? বসেন। বসের বস নিশ্চয়ই এভাবেই তাকে অভ্যর্থনা করেছে।
‘একটা খবর জানেন? কি? উৎসাহ বোধ করার জন্যে ওসমান যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর আক্রমণের ভয়টা হঠাৎ মাথাচাড়া দেয়, আর্মি কি ক্র্যাক ডাউন করবে স্যর?
আরে না! কি পাগলের মতো কথা বলেন বস এবার সুস্থ লোকের মতো নড়েচড়ে বসে, আইয়ুব খান ন্যাশনাল গভমেন্ট ফর্ম করতে চায় আফটার অল ট্যালেন্টেড লোক। সিচুয়েশন এ্যাঁপ্রিশিয়েট করতে পারে।’
‘ন্যাশনাল গভমেন্ট? কে বললো? জিনিসটা কি তাও ওসমানের ধারণার বাইরে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা কি বিজাতীয়? না মালটি-ন্যাশনাল?
শুনলাম। এই মহাগোপন খবরের উৎস বস ফাস করবে না, ন্যাশনাল গভমেন্ট ইজ এ মাস্ট। ইভন’-বস এদিক ওদিক তাকায়, তারপর ফিস ফিস করে বলে, ইভন শেখ মুজিব ইজ লাইকলি টু বি ইনকুডেড। শেখ না হলে এই সব এ্যাঁনার্কি স্টপ করবে কে? মওলানা ভাসানীর প্রভোকেশনে পিপল কি রকম রাউডি হয়ে উঠছে, দেখছেন না? টেলিফোনের সংক্ষিপ্ত বাজনায় তাকে থামতে হয়। বস তার বৌয়ের সঙ্গে কথা শুরু করলে ওসমান নিজের ঘরে ঢোকে।
কেরানীরা নিজেদের সুপারিনটেন্ডেন্টদের টেবিলে ভিড় জমায়। একটু ভীতু টাইপের গুলো প্যানপ্যান করে, যাই স্যর, আবার কখন কি হয়! সবারই সমস্যার অন্ত নাই। ‘আমার বাসা স্যর পুরা হাসপাতাল। ওয়াইফের গলা ফুলছে, মেয়েটার ব্লাড ডিসেন্ট্রি। যাই সার। বায়তুল মোকাররমে আজ বড়ো গ্যাদারিং, স্টুডেন্ট লিডাররা বলবে। মিটিং না শুনলে প্যাটের ভাত হজম হয় না স্যর। সুপারিনটেন্ডেন্টরা যায় যার যার অফিসারের কামরায়।
‘কেউ অফিস করতে চায় না স্যর। কি করি? ‘অফিস করি কি করে স্যর? পিওনরা প্র্যাকটিক্যালি সবাই এ্যাঁবসেন্ট।
এইগুলিরে লইয়া স্যর বহুত বিপদ! আরে তগো চিন্তা কি? গুলি খাইয়া মরলে আইজ বাদে কাইল তগো বৌপোলাপানে দ্যাশে যাইবো, ধান বানবো, খ্যাতে কামলা খাটবো। তগো চিন্তা কি?’
প্রব্লেম স্যর আমাদের। মিডল ক্লাসের আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। যাই স্যর। আমাদের এরিয়ায় কতগুলি খচ্চইরা পোলাপান আছে। পুলিস দেখলেই চাক্কা মারবো। ইপিআর পুলিস টুইকা পড়লে মহল্লায় ঢোকাই মুশকিল হইবো। যাই স্যর। অফিসারদের সমস্যাও বড়ো জটিল। তাদের বসদের ঘরে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে বলতে একেকজন নুয়ে নুয়ে পড়ে।
আমার সিস্টার-ইন-ল লন্ডন যাচ্ছে, টুয়েন্টি থার্ডে ফ্লাইট। এখনো ফর্মালিটিজ ইনকমপ্লিট। টেলিফোনে কাউকে পাওয়া যায়!
আমার থার্ড ছেলেটা, হি হ্যাঁজ বিকাম এ প্রব্লেম চাইল্ড। আমি ঘরে না থাকলেই বেরিয়ে পড়বে। এইচ এস সি-তে স্টার মার্কস পেয়েছে, ফিজিক্সে এ্যাডমিশন নিলো, ইউনিভার্সিটি তো—
আরেকজনের সমস্যা তার স্ত্রীর সঙ্গীত-প্রতিভা, ‘গায়িকাকে বিয়ে করে আমার হয়েছে প্রব্লেম। এতো সেন্সেটিভ, নয়েজ হলেই রি-এ্যাঁক্ট করে, নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হয়।‘
বসেরা তাদের ওপরওয়ালাদের সঙ্গে এবং ওপরওয়ালারা অফিসের এক নম্বরের কামরায় বিশাল টেবিলের চারদিক আলো করে বসে দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
ক্যাওস কনফিউশন কন্টিনিউ করলে ফিউচার ইজ ভেরি ক্লিক। পলিটিক্স যাই থাক, নাথিং সাকসিডস উইদাউট ডিসিপ্লিন।’
রিমোট কর্নারে ক্যাওস আরো বেশি। এভরিবডি মাস্ট বি রিজনেবল। এ্যাঁনার্কি শুড নেভার বি এ্যাঁলাউড টু কন্টিনিউ ফর ইনডেফিনিট পিরিওড।
এখন গভমেন্টের দ্যাখা দরকার এই আনরিজনেবল পিপলকে কষ্ট্রোল করতে পারে কে? হি এ্যাঁন্ড হি শুড বি টেকন ইনটু কনফিডেন্স।
সায়েবরা নিজেদের কামরায় ফিরে গিয়ে টেবিলের নিচে পা নাচায়। ছোটো অফিসারদের ডেকে নিচের দিকে খবর পাঠায়, কাউকে চাপ দেওয়ার দরকার নাই। তবে সবাই যেন হাজিরা খাতায় সই করে যায়। এই অলিখিত নির্দেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছবার আগেই অফিস প্রায় খালি হয়ে গেছে। তবে বেরিয়ে যাবার আগে অফিসের হাজিরা খাতায় নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গেছে সবাই।
চিলেকোঠার সেপাই – ০৪
আনোয়ার সেদিন বাড়ি ছিলো না। ওর ভাইয়া মহাবিরক্ত, ‘পাবনা না নোয়াখালি কোথায় গেছে ভালো করে বলেও যায় নি। বিপ্লবের অবজেকটিভ কন্ডিশনস নাকি কোথায় কোথায় তৈরি হয়ে আছে, ঐ সব এক্সপ্লোর করতে গেছে। ভাইয়া নিজেও এককালে পলিটিক্স করতো, ভাষা আন্দোলনে জেল-খাটা মানুষ। ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে আজকাল বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় বলে ওদিকে সময় দিতে পারে না। তবে পুরনো রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগটা মোটামুটি আছে। গান বাজনার দিকে খুব ঝোঁক, পার্টির সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে এখনো জড়িত। ওসমানকে বসিয়ে চা খাওয়ালো, চা খেতে খেতে বলে, ’ওদের পার্টি তো প্রায়ই ভাঙছে। এখন ও যে কোন গ্রুপে বিলঙ করে, সেই গ্রুপের বেস কোথায়,নোয়াখালি না পাবনা না যশোর না চিটাগাং—এসব অঙ্ক মেলাতে পারলে ওর হোয়্যার এ্যাঁবাউটস জানতে পারবে। ওসমানকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বলে, খোজ পেলে একটু জানাবে তো টাকা পয়সাও নিয়ে যায়নি, কোথায় কিভাবে আছে, কে জানে? আনোয়ারের সঙ্গে ওসমানের দ্যাখা হলো আরো কয়েকদিন পর। আমজাদিয়ায় সেদিন জমজমাট। ঢুকতে না ঢুকতে ভিড়ের মধ্যে শোনা যায়, ওসমান।’
বাইরে থেকে ঢুকেছে, ওসমানের চোখে সব ঝাপসা ঠেকে। কে ডাকলো? কোণের দিকে ওদের টেবিলে যেতে যেতে ওসমান ফের শুনলো, ওসমান। আস্তে আস্তে সব স্পষ্ট হচ্ছে। মোটা চুরুটের ধোঁয়ায় আঁকাবাঁকা পর্দার পেছনে শওকতের ব্রণের দাগখচিত লম্বা ও রোগ মুখ। শওকতের পাশের চেয়ারে চিত্ত আর ফরিদ বসেছে ভাগাভাগি করে। এদের পাশের চেয়ারে আলতাফ। আলতাফের মুখোমুখি ইফতিখার। পাশের টেবিলে বসলেও প্রায় আড়াইট টেবিল জুড়ে রাজত্ব করে আনোয়ার। ওসমানের দিকে একবার খুশি খুশি চোখ করে তাকিয়ে নিয়ে আনোয়ার তার কথা অব্যাহত রাখে, এর আগে পিপল যেসব মুভমেন্টে এ্যাঁকটিভলি পার্টিসিপেট করেছে সেগুলো হয়েছে এক একটি এলাকা জুড়ে। ধরে তেভাগা, ধরে হাজং কিংবা সাওতালদের বিদ্রোহ-এগুলো বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিলো, তাই না? কিন্তু এরকম সমস্ত প্ৰভিন্স জুড়ে—।’
প্রভিন্স কেন? এবার কান্ট্রিওয়াইড মুভমেন্ট চলছে, ওয়েস্ট পাকিস্তানী পিপল আর অলসো পার্টিসিপেটিং ভেরি স্পনটেনিয়াসলি!’ ইফতিখারের এই মন্তব্য আনোয়ার ঘাড় নেড়ে অনুমোদন করতে করতে বলে, এই ব্যাপক আন্দোলন কি কেবল এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ আর পার্লামেন্টারি ফর্ম আর অটোনমির জন্যে? আর কিছু না?
আলতাফের পাশে সিকানদারের চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসতে বসতে ওসমান বলে, বায়তুল মোকাররমে পুলিস সাংঘাতিক লাঠিচার্জ করেছে।
কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে আলতাফ জবাব দেয় আনোয়ারকে, ভোটের রাইট চাই আগে। ক্ষমতায় আসতে না পারলে বাঙালি কিছু করতে পারবে না। আলতাফ অবিরাম কথা বলেই চলে। কিন্তু ওসমান কারো কথাই ভালোভাবে শুনতে পারে না। সে তখনো একটু একটু হাঁপাচ্ছে। পুলিসের লাঠির বাড়ি থেকে একটুখানির জন্যে বেঁচে গেছে।
শুক্রবারের অফিস বেলা ১২টায় ছুটি হয়ে গেলে কিছু খাবে বলে সে স্টেডিয়ামের বারান্দায় ধীরে সুস্থে হাটছিলো। একবার ভাবছিলো প্রভিন্সিয়ালে ভাত খেয়ে নেবে। কিন্তু সাড়ে বারোটায় ভাত খেলে বিকালবেলা শুধু চায়ে কুলায় না। এদিকে রোজার জন্যে রাস্তাঘাটে খোলাখুলি খাওয়া বন্ধ। আড়ালে আবডালে সবাই ঠিকই খাচ্ছে, শুধু মানুষের ঝামেলা বাড়ানো ঘুঘনি কি পেপেকটা কি সেদ্ধডিমের আশায় সে এদিক ওদিক দেখছে, এমন সময় চোখে পড়ে স্টেডিয়ামের মেইন গেট ২টোতে উঁচু উঁচু ঘোড়ার ওপর বসে রয়েছে তাগড়া সব পুলিস, পাশে রাইফেল হাতে দাঁড়ানো পুলিসবাহিনী। ১টি ঘটনার প্রত্যাশায় ওসমান খাবার কথা ভুলে তাড়াতাড়ি হাঁটে। কিন্তু ঠিক জায়গায় পৌঁছতে না পৌঁছতে জানাজা শেষ হলো। গত কয়েকদিনে সারা পাকিস্তান জুড়ে পুলিস ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদদের জানাজা। লম্বা কাতারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, এদিক ওদিক লোকজনের ছোটো ছোটো জটলা। ছাত্রদের পরবর্তী কর্মসূচী জানবার জন্য ওসমান একবার এ-জটলা একবার ও-জটলার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু মাইকের পে পো ধ্বনি ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। মাইকের এই ভেঁাতা সঙ্গীত ছাপিয়ে ওঠে শ্লোগান, শহীদের রক্ত – বৃথা যেতে দেবে না’, পুলিসী জুলুম পুলিসী জুলুম-বন্ধ করো বন্ধ করো। গেটে দাঁড়ানো উচালম্বা সাদা ও ধূসর ঘোড়াদের পা কাপে। দিকে দিকে আগুন জ্বলো,-আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো। ওসমানের বুক দারুণভাবে ওঠানামা করে। স্লোগানগুলো একটি একটানা আওয়াজে মিলিত হয়ে তার করোটির দেওয়াল তপ্ত করে তোলে শুওরের বাচ্চ আইয়ুব খান মোনেম খানের চাকরবাকরের দল, দ্যাখ! ভালো করে দেখে নে। তোদের সামনে খালি হাতে কেবল বুকসর্বস্ব করে তোদের বাপ আইয়ুব খানকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছে এরা ভরা গলায় ওসমান শ্লোগানের জবাব দেয়, মুক্তি চাই, মুক্তি চাই। খুচরা জটলাগুলো শ্লোগানে শ্লোগানে গাথা হয়, প্রসারিত হতে থাকে একটি অখণ্ড সমাবেশে। স্টেডিয়ামের গেট থেকে পুলিসবাহিনী এপাশ ওপাশ জুড়ে ছড়িয়ে ১পা ১পা করে পেছনে যায়। কয়েক পা এমনি করে হটে গিয়ে হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে পড়লো। জিপিও-র সামনে লরি থেকে লাফিয়ে নামলো বেতের ঢাল ও লাঠিধারী ১পাল পুলিস। তারপর সব এলোমেলো। প্রথম কয়েক মিনিট কেবল লাঠির সপাসপ আওয়াজ এবং পুলিসের নাক ও মুখ থেকে বেরোনো সশব্দ নিশ্বাস ছাড়া কিছুই নাই। মানুষ এখন যায় কোন দিকে? স্টেডিয়ামের জোড়াগেট জুড়ে উচালম্বা ঘোড়া, দক্ষিণে এ-ফুটপাথ থেকে ও-ফুটপাথ জুড়ে পুলিসের দেওয়াল, জিপিও-র সামনে পুলিসের ট্রাক। সবচেয়ে মুশকিল হয় শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকদের। দিনমান সিয়াম অন্তে এফতারে বিসমিল্লা বলে ভালোমন্দ কিছু মুখে দেবে বলে তারা আপেল কি আঙুর কি খেজুর কি কলা কিংবা ক্যাপিটাল বা লাইটের কেক-প্যাস্ট্রি কিনতে এসেছিলো। এই ফ্যাসাদে পড়ে কেউ কেউ মসজিদে ঢুকে নফল নামাজ পড়তে শুরু করলো, বেশ কয়েকজন বায়তুল মোকাররমের এ-প্যাসেজ ও-প্যাসেজ দিয়ে চলে গেলো পুরানা পল্টনের দিকে। ভদ্রলোক ও ছাত্রদের বেশির ভাগই, বলতে গেলে প্রায় সবাই একটা আধটা লাঠির বাড়ি খেয়ে কিংবা মার এড়িয়ে কেটে পড়েছে। এখন রইলো বাকি ২। —১. নোঙরা কাপড় পরা লোকজন এবং ২. অগুনতি পিচ্চি। পুলিসের মার এখন চমৎকার জমে উঠেছে।
পল্টনের দিকে পুলিস নাই। সেদিক দিয়ে চলে গেলেই হতো। কিন্তু পুলিসবিহীন রাস্তা দেখে একটু দিশাহারা মতো হয়ে ওসমান আবার এসে পড়ে জিপিও-র সামনেই। এখানে রোডের সামনে পুলিসের গাড়ি। বুদ্ধি করে ওসমান পায়ের গতি নিয়ন্ত্ৰণ করে। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে সে এমনভাবে হাঁটে যে, মনে হয় এই সব গোলমালের কিছুই তার জানা নাই। ততোক্ষণে গুলিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে পুলিস। মানুষের ছোটাছুটি চলছে ইপিআরটিসি টার্মিনাল পর্যন্ত। পশ্চিম দিকের বড়ো বড়ো দালানের ছাদ থেকে পিচ্চিরা ঢ়িল ছুড়ছে পুলিসের ওপর। স্টেডিয়ামের পাশে ১টা ক্লাবের এলাকা থেকে কয়েকটা খালি বোতল এসে পড়ে। রাস্তার মাঝখানে লম্বা আইল্যান্ড। না। আর কতোক্ষণ? পুলিস শালারা এবার এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি ইটাটা বড়ো ৱিস্কি। এদিককার ফুটপাথ তখন সম্পূর্ণ পুলিসের দখলে। একটু জোরে পা চালালেই ব্যাটার বুঝে ফেলবে যে, সে জানাজা থেকেই আসছে। চোখে মুখে ওসমান একটা বিরক্তি ফোটাবার জন্য একগ্নেচিত্ত হয়; শহরে ১৪৪ ধারা, সমাবেশ কি মিছিল পুলিস সহ্য করবে কেন? —এই ভাবটা তার মুখের আদলে এঁকে ফেলা দরকার। বেশিক্ষণ অবশ্য কষ্ট করতে হয় না, রেলগেটের ওপারে পুলিসের চিহ্নমাত্র নেই, এমনকি স্টেশন রোডের শুরুতে ট্রাফিক আইল্যাণ্ডেও পুলিস নাই। পুলিসের ভয় কেটে গেলে ওসমানের পেটের দিকটা চিন চিন করে। কিন্তু আমজাদিয়ায় ঢোকার পর আড্ডায় জমে থাকায় কথাটা একেবারে ভুলে যায়।
টেবিল এখন আলতাফের দখলে, সবার নীরব অনুমোদন পেয়ে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে, ১৯৫৮-৫৯ সালের পর পাকিস্তানে পার ক্যাপিটা ইনকাম বেড়েছে ১৮০ টাকা। সেখানে ইস্ট পাকিস্তানের ইনক্রিজ কতো জানো? সকলের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে সে জানায়, ২২ টাকা। টুয়েন্টি টু। এই শোষণ চললে আমাদের পরিণতি কি?
এরপর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যের ওপর সে ১টার পর ১টা তথ্য দিয়ে চলে। শুনতে শুনতে ওসমানের জিভ নিসপিস করে, আলতাফের পক্ষে কথা বলার জন্যে সে অস্থির। প্রতিটি জায়গায় শালার ডিসপ্যারিটি। সোনার দাম এখানে এক রকম, ওখানে আরেক রকম। কাগজ তৈরি হয় আমাদের এখানে, ওদের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে সেই কাগজ কিনি আমরাই। আমরা গায়ের রক্ত পানি করে পাট ফলাই, সেই পাট বেচে ফেপে ওঠে লাহোর করাচি ইসলামাবাদ। ওপরের দিকে একটা বাঙালি অফিসার নাই। আর্মিতে বাঙালি নাই। সত্যি সত্যি এক দেশ হলে এরকম হতো না। —কিন্তু কথাটা কিভাবে বলবে ওসমান তাই ভাবতে ভাবতে সিকানদারের কনুইয়ের ধাক্কা খায়। সিকানদার আস্তে করে বলে, আজকাল ইউনিভারসিটির মেয়েরা কি রকম ফ্রি হইছে দেখছো? ছেলেদের সাথে কেমন ঘুরতাছে, দ্যাখো!
কয়েকটা টেবিল পর ৪/৫ জন ছেলের সঙ্গে ২জন মেয়ে। ওসমান এতোক্ষণে খেয়ালই করেনি। এইসব রেস্টুরেন্টে মেয়েরা সাধারণত আসেই না, এলেও হার্ডবোর্ড ও পর্দায় ঘেরা কেবিনে বসে। এরকম খোলাখুলি বসেছে, একটু ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। ১ জনের প্রোফাইল দ্যাখা যায়, ফর্সা নাকের মাথায় ঘামের বিন্দু। আরেকজনের পেছনটা চোখে পড়ছে একটু, ঘামে-ভেজা জলপাই রঙ ব্লাউজের ওপর মোটা বেণী। এরাও নিশ্চয়ই বায়তুল মোকাররম গিয়েছিলো, লাঠিচার্জের আগেই চলে এসেছে।
সিকানদার ফের বলে, আমাদের সময়ে ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা কইলেই ফাইন হইতো, প্রক্টর দেখতে পারলে হয়!—সোজা রিপোর্ট পাঠাইয়া দিতো। আহা, যদি কয়ট বছর পরে জন্ম নিতাম!’
সিকানদার ওদের কয়েক বছরের সিনিয়র, তাছাড়া ওসমান ইউনিভারসিটিতে পড়েওনি, ওর এই আক্ষেপে সাড়া দেওয়া ওসমানের পক্ষে মুশকিল। সিকানদারের চাপাস্বরের আফসোসের অনেক ওপরে চলছে আলতাফের চড়া গলা, আমাদের একমাত্র প্ররেম, অন্তত এখন প্রথম ও প্রধান সমস্যা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ।’
চুরুটের ধোঁয়ার পেছন থেকে সিকানদারের কথার জবাব দেয় শওকত, আরে আপনার তো সেদিনকার ছেলে। আমাদের সময় ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে তার রেপড হওয়ার ফিলিং হতো। সবাই জোরে হেসে ফেলে। আলতাফের বিক্ষোভের মাঝখানে এই হাসি তাকে বিব্রত করে। দাঁতে চুরুট চেপে শওকত তার সহপাঠিনীদের নরভীতির বর্ণনা সম্পূর্ণ করে, ছেলেদের কথা শুনে আবার কনসিভ না করে—এই ভয়ে মেয়েরা তখন কনট্রাসেপটিভ ইউজ করতো। এবার সবাই এতো জোরে হাসে যে, অন্য কয়েকটা টেবিল থেকেও লোকজন তাদের দিকে ফিরে তাকায়। হাসি হাসি মুখ করলেও আলতাফ একটু দমে যায়। আনোয়ার এই সুযোগটা নেয়, তোমার এইসব কথা চ্যালেঞ্জ করছে কে? ন্যাশনাল এ্যাঁসেম্বলিতে মিনিস্টাররা পর্যন্ত ডিসপ্যারিটির ডাটা সাপ্লাই করে। কনস্টিটিউশনে ডিসপ্যারিটির কথা আছে। কিম্ভ-‘
তাহলে দ্যাখো, আলতাফের বিব্রত ভাব কেটে গেছে, বেশ জোর দিয়ে বলে, কোন পর্যায়ে গেলে ডিসপ্যারিটির কথা কনস্টিটিউশনেও বলা হয়? আমাদের ভাষা, কালচার থেকে শুরু করে অর্থনীতি সব জা পাঞ্জাবিদের এক্সপ্লয়টেশনের শিকার। এসব বাদ দিয়ে তোমরা জোতদার মারো আর ঘরবাড়ি জ্বালাও?
কোণঠাসা হয়ে আনোয়ার ফের শুরু করার উদ্যোগ নেয়, তুমি ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছো আলতাফ। ওয়েস্ট পাকিস্তানের একটা সেকশনের এক্সপ্লয়টেশনের কথা অস্বীকার করে কে? এসব কথা আমরা যখন প্রথম বলি তোমাদের নেতারা তখন আমাদের গালাগালি করতো।
এর মানে এর নয় যে, আমরা বললে তোমরা আবার আমাদের গালাগালি করবে!
তা নয়। আমার কথা হলো এই যে, মানুষের এই আপসার্জ কি খালি বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটাবার জন্য? বাঙালি ভদ্রলোকের চাকরির ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে?
ইফতিখার মিনমিন করে বলে, কিন্তু ওয়েস্ট পাকিস্তানের কমন পিপল কি হ্যাঁপি?
না। আলতাফ ফের জোর দিয়ে বলে, কিন্তু সেটা আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়। পৃথিবীর যেখানে যতো দুঃখী ও শোষিত,নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ আছে সবাইকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আমাদের কে দিলো? পশ্চিম পাকিস্তানের যেটুকু আমরা জানি তা হলো আমাদের শোষণ করার জন্যে অদম্য স্পৃহা। উর্দুভাষী ইফতেখারের যে কোনো কথার জবাব দেওয়ার সময় আলতাফ একটু কঠিন বাঙলা ব্যবহার করে। গত কয়েক মাস থেকে এই প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে। সিকানদার উত্তেজিত হয়ে বলে, ঐগুলি ছাড়েন। বাখোয়াজি বহুত শুনছি। স্বাধীনতার কথা বলেন। স্বাধীনতা! মাউরাগো হাত থাইকা বাঁচার উপায় ঐ একটাই।’
স্বাধীনতা! স্বাধীনতার কথায় ওসমানের তপ্ত করোটিতে শীতল হওয়া খেলে। সাড়ে ১০টার দিকে অফিসে নোভাজিল খেয়েছিলো, তার এফেক্ট পাওয়া যায়। মেয়ে ২টোকে ভালো করে দ্যাখার জন্য ঘুরে তাকালো, ঐ টেবিলে এখন অন্য সব লোক। বাইরে থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে। জিন্না এ্যাঁভেন্যুতে গোলমাল কি নতুন করে শুরু হলো?
সিকানদার অনুপ্রাণিত উক্তিকে আমন না দিয়ে আনোয়ার আলতাফের দিকেই তাকায়, বলে, ভাষা, কালচার, চাকরি-বাকরিতে সমান অধিকার, আর্মিতে মেজর জেনারেলের পদ পাওয়া—এসব ভদ্রলোকের প্রব্লেম। এই ইস্যুতে ভোটের রাইট পাওয়ার জন্যে মানুষের এতো বড়ো আপসার্জ হতে পারে?
পারে। মানুষ গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে পারে।’
‘ভোটের রাইট পাবার জন্য মানুষ প্রাণ দেবে?
‘দেৰে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য মানুষ যুগে যুগে প্রাণ দিয়ে এসেছে।’
‘ভোট দিলেই কি সব মানুষের জন্য গণতন্ত্র আসে?
আসে। ভোট দেওয়ার অধিকার গনতন্ত্রের একটা বড়ো শর্ত। তোমরা ভোট দিয়ে তোমাদের প্রোগ্রাম অনুসারে কাজ করতে পারবে।
ফরিদ খুব চুপচাপ সিগ্রেট টানছিলো। আলতাফের সমর্থনে সিগ্রেট টানায় সে একটু বিরতি দেয়, ইলেক্টেড হতে না পারলে আপনি বুঝবেন কি করে যে, আপনার পক্ষে মানুষ আছে? আপনি কার হয়ে কথা বলবেন?
বাইরের গুঞ্জন ক্রমে পরিণত হচ্ছে গর্জনে। রাস্তার মিছিল কাছাকাছি চলে এসেছে। সিকানদার উঠে দরজার দিকে চলে যায়। টেবিলে টেবিলে এখন ভাত, চাপাতি, নানরুটি, তরকারি, সালাদ, ডাল ও ফিরনি। তর্ক জমে উঠেছে, বাইরে থেকে আসছে মিছিলের গর্জন, তাই এতো খাবার ও খাবারের গন্ধেও ওসমানের পেটের ব্যথা পাত্তা পায় না।
আনোয়ার বলে, ভোটে মিড়ল ক্লাসের লোক আসবে। দেশের অধিকাংশ মানুষের প্ৰব্লেম তারা বুঝবে কি করে?
বেশ তো, আমরা না হয় মিড়ল ক্লাসের সমস্যাই সমাধান করার চেষ্টা করলাম। ফরিদ এই কথা বললে আলতাফ তাড়াতাড়ি যোগ করে, সব দেশে মধ্যবিত্তই তো নেতৃত্ব দেয়। রেভুলিউশনের লিডারশিপ মধ্যবিত্তের হাতে থাকে না? লেনিন কি প্রলেতারিয়েত? তোমাদের চৌ-এন-লাই?
কিন্তু আমাদের এখানে সাধারণ মানুষের সমস্যা তো তোমাদের লিডারশিপের কনসার্ন নয়। তোমাদের প্রোগামে তার কোনো রিফ্লেকশন নেই।’ আনোয়ারের কথা শেষ করতে না দিয়ে ফরিদ বলে, বেশ তো, মিড়ল ক্লাস যে পর্যন্ত পারে করুক।
তারা তর্ক করে। বাইরের স্লোগানের ধ্বনি ক্রমে শব্দ এবং অর্থপূর্ণ শব্দ হয়ে তাদের কানে আসে। আনোয়ার একটু জোরে বলে, কিন্তু পিপলের স্পনটেনিয়াস আপসার্জকে ভদ্রলোকের সখ মেটাবার জন্যে ইউজ করার রাইট তোমাদের কে দিলো?
আপসার্জ তো আকাশ থেকে পড়েনি। এর জন্যে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এই প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ করেছে কোন অর্গানিজেশন, বলো? দিনের পর দিন মিটিং করে, জেল খেটে—।
জ্বলো জ্বলো, আগুন জ্বলো। মিছিল এবার আমজাদিয়ার সামনে এগিয়ে আসছে। মিছিলের কয়েকজন ছেলেকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখে প্রায় সবাই উঠে দাঁড়ায়, কেউ বসে থাকলেও খাবার সামনে রেখে ওদের দ্যাখে। পাঞ্জাবি-প্যান্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি, চাপা প্যান্টসোয়েটার, চাপা প্যান্ট-পুলওভার নানা পোশাকের কয়েকটা ছাত্র ঢুকেই বলে, পানি খাবো।
কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার বিকট জোরে চাচায়, ‘পানি দে। কাধে পুলওভার ঝোলানো ১টি ছেলে বলে, চা খেয়ে নিই, এ্যাঁ? ম্যানেজার অনাবশ্যক জোরে হাক ছাড়ে, চা দে!
এর মধ্যে আরো লোকজন ঢুকে পড়েছে। এখন লুঙি-পরা লোক ও রাস্তার পিচ্চিই বেশি। পিচ্চিদের ১জন বলে ওঠে, হালায় আইয়ুব খান! দরজার বেশ খানিকটা ওপরে বড়ো ফ্রেমে কাচে বাধানো ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান, হেলালে জুরত, হেলালে পাকিস্তানের আবক্ষ প্রতিকৃতি। প্রেসিডেন্টের ভরাট গোলাপি মুখ জুড়ে ছড়ানো তার লাল ঠোঁটের চাপা হাসি। সামনের উত্তেজিত লোকদের প্রতি কৌতুক ও তুচ্ছতায় তার ছোটো চোখজোড়া একটু কোচকানো। একটি ছাত্র বলে, শালা দালালের দোকান।
‘দালালের দোকান!
সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান ওঠে, আইয়ুবের দালালি, আইয়ুবের দালালি-চলবে না, চলবে না।’ ভাঙো হালা চুতমারানির ছবি ভাইঙা ফালাও। কুত্তার বাচ্চারে লাথি মাইরা ভাঙা’ বলতে বলতে ১০/১১ বছরের ১টি পিচ্চি তার রঙজ্বলা সবুজ লুঙ্গির কোচড় থেকে ১টি ইটের টুকরা ছুড়ে দেয় ছবির দিকে। ইটের টুকরা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে ১টি টেবিলে রাখা মাটন রেজালার বাটিতে। কাচের বাসন ভাঙার শব্দে ম্যানেজার লাফিয়ে এসে পিচ্চির হাত ধরে ফেলে। ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার মিনতি করে, আপনারা থামেন। আমি নামাইয়া দেই! এর মধ্যে ১টি টেবিল চলে এসেছে দরজার কাছে। ঘন নীল রঙের প্যান্ট ও খয়েরি সোয়েটার পরা এলোমেলো চুলের রোগা ১টি ছেলে উঠে পড়ে সেই টেবিলের উপর। ছবি তার নাগালের বাইরে। ১টি চেয়ার উঠিয়ে দেওয়া হয় টেবিলের ওপর, চেয়ারে দাঁড়াতে ছেলেটা ইতস্তত করলে কয়েকজন ছেলে চেয়ারের পায়াগুলো শক্ত করে ধরে। ফ্রেমের ভেতর থেকে প্রেসিডেন্ট অপরিবর্তিত চেহারায় কৌতুক ও তাচ্ছিল্যের হাসি ছাড়ে। লোকজন প্রেসিডেন্টের পতন দ্যাখার জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছে, টেবিলের ওপরকার চেয়ারে দাঁড়ানো তরুণটি ছবির পেছনে পেরেক-বাধা দড়ি হাতড়াচ্ছে, দড়ির গেরো বোধ হয় সে খুঁজে পাচ্ছে না, হাতড়িয়েই চলে। এমন সময় ঠিক নিচে থেকে পিতলের ১টি এ্যাঁশট্রে এসে পড়ে ছবির ফ্রেমের ওপরকার কাঠে। এরপর আরেকটি এ্যাঁশট্রে। এবার ছবির মাঝামাঝি এ্যাঁশট্রে লেগে কাচ ভেঙে যায়। ফের ১টি ছোটো ইটের টুকরা লাগার সঙ্গে বিশাল ফ্রেম তার একমাত্র অধিবাসীকে নিয়ে প্রথমে হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেয়ারে, সেখান থেকে টেবিলের ১টা ধার একটুখানি ছুয়ে ছিটকে পড়ে মোজাইক করা তেল চিটচিটে ময়লা মেঝের ওপর। প্রথম এ্যাঁশট্রেটা গিয়েছিলো নীল প্যান্ট পরা তরুণের কান ঘেষে, চেয়ারে উঠবার সময় তার পা যে রকম কাপছিলো সেই দ্বিধা ভাগ্যিস ভুলে গিয়ে ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে কায়দা করে চমৎকার লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। তবে এ্যাঁশট্রের ছাই চোখে লাগায় চেয়ারের পায়া ধরে-রাখা ছেলেদের ২জনকে বেসিনে চোখ ধুতে হয়।
দুটো এ্যাঁশট্রে এবং ইটের টুকরা ছুড়ে-মারা ১০/১১ বছরের পিচ্চির লুঙির কোচড়ে এখনো কয়েকটা পাথর ও ইটের টুকরা। কনুই দিয়ে তার নাকের গোড়া থেকে ঝুলন্ত সিকনি মুছতে মুছতে সে এগিয়ে আসে। আইয়ুব খানকে প্রথমবার ইট লাগাতে পারেনি বলে তার যে গ্রানি হয়েছিলো পরবর্তী সাফল্যে তা একেবারে মুছে গেছে। এই সাফল্যে তার চেহারা ও গলায় পরিণত ও অভিজ্ঞ মানুষের ভার অর্পণ করে, দিছি। খানকির বাচ্চারে এক্কেরে নামাইয়া দিছি!’ রাস্তার ধুলামাটি ও কফথুতু মাখা পায়ে চিৎপটাং রাষ্ট্রপতির কপালে ও মাথায় সে কয়েকটা লাথি মারে। ভাঙা কাচে তার পা কেটে যায়, ভাঙা কাচের নিচে ধুলাবালিরক্তকফথুতু লেগে রাষ্ট্রপতির চেহারা ঘোলাটে হয়; ফলে ছোটো চোখ জোড়ায় কোচকানো অভিব্যক্তি মুছে যায়।
মিছিলের অনেকে রাস্তা থেকেই চিৎকার করে, ‘দালালের দোকান জ্বালাইয়া দাও! ছাত্রদের সবাই ক্লান্ত। এই উত্তেজনায় সাড়া না দিয়ে তাদের কেউ কেউ চেয়ারে বসে পড়েছে। সকাল থেকে মিটিং করে, জানাজা করে, মিছিলে হেঁটে ও স্লোগান দিয়ে ক্লান্ত ছেলেদের কেউ বসে বা কেউ দাঁড়িয়ে টেবিলের রেজালা বা ডাল-গোশত বা স্টু বা চাপ অথবা ফিরনি গিলতে থাকে। ম্যানেজারের ইঙ্গিত ছিলো কি-না কে জানে, বেয়ারাদের প্রায় সবাই এই সব টেবিলে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখে। ১টি রোজদার ছেলেও ফিরনি খেয়ে ফেলেছিলো, হঠাৎ মনে পড়ায় সে লাফিয়ে ওঠে, দূর রোজাটা নষ্ট হলো কিছুক্ষণ পরে ছেলেরা সব বেরিয়ে যায়। পিচ্চির দল জুলজুল করে এদিক ওদিক দ্যাখে। ১টা পিচ্চি এগিয়ে এসে টেবিলে রাখা গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকচক করে পানি খায়। ম্যানেজারের মুখ ঘামে স্যাঁতসেতে। খসখসে গলায় সে হঠাৎ খেকিয়ে ওঠে, এই শালা ফকুরনির পুত, গ্লাস ধরছস কারে কইয়া? অন্য কোনো পিচ্চি এরপর আর কোনো গ্লাস স্পর্শ করে না বটে, তবে এদের ১জন বলে, ‘এতো গরম দ্যাহান ক্যান? পানিই তো খাইছে, আর কি? দরজার দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার কিছুই বলে না। মিছিলের শ্লোগানে সাড়া দিয়ে পিচ্চির দল বাইরে চলে যায়।
রাস্তায় নামবার পরও ওসমানের উত্তেজনা কমে না, এই শালা দালালের রেস্টুরেন্ট জ্বালিয়ে দিলে ভালো হতো।
সিকানদার বিরক্ত হয়, আপনারা বাড়াবাড়ি করেন। ম্যানেজার আইবি-র লোক হইতে পারে।’
মিছিলে লোক তেমন নাই। মনে হতে পারে শো ভাঙার পরে সিনেমা হল থেকে লোক ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ফরিদ বলে, সামনে চলো। সামনে মালঝাল। আর ন্নাহ শওকত হতাশ হতাশ ভঙিতে বলে, ‘মেয়ে পাবেন কোথায়? ছাত্রই তো কম। সব লেবার আর স্ট্রিট আর্চিনস! আলতাফ সায় দেয়, হ্যাঁ। আন-অর্গানাইজড প্রসেশন। মিছিলের প্রোগ্রাম ছিলো না।’ ‘তোমাদের কোন কাজটা প্রোগ্রাম অনুসারে হচ্ছে? আনোয়ার ঠাট্টা করে, একেকটা ঘটনা ঘটে যায় আর লিডাররা সবই তাদের প্রোগ্রামে ইনকুড করে। আলতাফ জবাব না দিলে শওকত হেসে ফেলে, লিডারদের কাজ হলো এডিটিং। কোন কাজটা তারা করেনি আর কোন কাজটা তাদের নেতৃত্বে হলো তাই ডিসাইড করা। এ্যাঁকশন উইথ রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট। এবার সবাই, এমনকি আলতাফও খুব হাসে। অবশ্য ওসমান গনি বাদে। কারণ সে চলে গেছে একটু সামনে। এদের মধ্যে স্লোগানের জবাব দিচ্ছে সে একাই। কিছুক্ষণ যাবার পর দ্যাখে ডানদিকে বংশাল থেকে বেরিয়ে লাল রঙের বন্ধ ১টি গাড়ি নবাবপুর দিয়ে রায়সাহেবের বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা দেখতে অনেকটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির মতো, আবার অনেকটা এ্যাঁম্বুলেন্সের মতো। বেশ বড়ো গাড়ি, তাড়াতাড়ি যাচ্ছে, কিন্তু হর্ন টর্ন দেওয়ার বালাই নাই। বুলেট প্রফ নীলচে কালো কাচের আড়ালে কাউকে দ্যাখা যায় না। হঠাৎ মনে হয় গাড়িটার ভেতরে বোধ হয় কোনো মানুষ নাই। —ওসমানের বুকের ভেতর ছমছম করে, সে আরো তাড়াতাড়ি হাঁটে। এমনিতেও তাড়াতাড়ি না হেঁটে উপায় নাই, এই লেবার ধরনের লোকদের ধ্যাবড়া পায়ের সঙ্গে তাল মেলানো বড়ো শক্ত।
এই ওসমান ওসমান’ আনোয়ার ডাকলে সে পেছনে ফিরে তাকায়। আনোয়ার বলে, দাঁড়াও! ওদিকে ফায়ারিং হচ্ছে।’
‘কোনদিকে? ওসমান জিগ্যেস করতে না করতে রায়সায়েবের বাজারের দিক থেকে বহু লোককে দৌড়ে এদিকে আসতে দ্যাখা যায়। পুরুষ্ট হয়ে মিছিল এবার বইছে উল্টোদিকে। ফের একটা গুলির আওয়াজ হলো। ওসমানের হাত ধরে আনোয়ার রাস্তা ক্রস করতে করতে বলে, ‘এবার টিয়ার গ্যাস ছুড়লো। ঐ শালা রায়ট কার দেখেই আমি ভয় পাচ্ছিলাম শালারা একটা কিছু করবে। দৌড়ে পালাচ্ছে মানুষ, তাদের ভেতর দিয়ে রাস্তা ক্রস করা মুশকিল। তাজ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো চিনাবাদাম, চালভাজা ও ছোলাভাজার ঠেলাগাড়ি, হুট করে গোলক পাল লেনের ভেতর ঢুকে পড়ে। ওসমানের ইচ্ছা করছিলো পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মাখানো চালভাজা ছোলাভাজা খাবে। হলো না। আনোয়ার তার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, তাড়াতাড়ি এসো না!
চিলেকোঠার সেপাই – ০৫
যেখানে জোড়পুল লেনের শুরু তার উল্টোদিকে শাহীন রেস্টুরেন্ট এ্যাঁন্ড সুইটমিটের দরজার টুটাফাটা নোঙরা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নওশাদের সুরে আশা ভোঁসলে শোনা গেলো। শোনবার লোক কম, খাবার লোক আরো কম। খয়েরি সর-পড়া চায়ে চুমুক দিয়ে আনোয়ার একটা কিংস্টর্ক ধরায়, ধোঁয়া সম্পূর্ণবের করে দিয়ে জিগ্যেস করে, অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে?
অবস্থা জানাবার জন্য ওসমানই তোওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এখন ওসমানের খুব বমি বমি লাগছে, পেটে সলিড কিছু পড়া দরকার। এখানে এখন গাজরের হালুয়া আর বোদে আর লাড়ডু ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। মুখে মিষ্টি দেওয়া এখন অসম্ভব। আনোয়ার নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়, এদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, পাগলা কুকুরের মতো দশা!
আনোয়ারের কথায় ওসমান একটু আরাম পায়, আরো আরাম পাবার আশায় জিগোস করে, তুমি তো ঘুরে টুরে এলে। বাইরে অবস্থা কি?
বললাম তো দেয়ার ডেজ আর নাম্বারড। এখন ভয় অপোজিশনের রুই-কাতলাদের নিয়ে।’ কেন? দাখো না মানুষ কতো এগিয়ে গেছে। গ্রামে গভমেন্ট ফেল করছে, লোকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করবে। যেসব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকদের ওপর ভরসা করে গভমেন্ট চলে পিপল তাদের পাত্তা দিচ্ছে না। সেখানে লিডাররা কি চায় বলো? শেখ সাহেব বেরিয়ে এলে এক এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ ছাড়া আওয়ামী লীগের চাইবার কি থাকবে?
শেখ সাহেবকে ছাড়বে? ওসমান একেবারে সোজা হয়ে বসে এবং সাঙ্ঘাতিক এ্যাঁসিডিটি বোধ করা সত্ত্বেও একটা সিগ্রেট ধরায়। পেটের বা দিকটা চিনচিন করছে। গলার কাছে দলাপাকানো বমি। পেট খালি বলে বমিট ওখানে আটকে রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির সম্ভাবনা শুনে যেটুকু চাঙা হয়ে উঠেছিলো তা মিইয়ে যায়, বলে, কিন্তু আগরতলা কি উইথড্র করতে পারবে? শওকতের ব্যাখ্যা মনে পড়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা আইয়ুব খানের পক্ষে অসম্ভব। সত্যি হোক মিথ্যা হোক, একবার মামলা যখন শুরু করেছে, আর্মির সম্মান, এমনকি অস্তিত্ব নির্ভর করে এর উপর। শাসকদল বলো আর বিরোধীদল বলো,-আর্মি ছাড়া গোটা পাকিস্তানে এরকম সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন আর কি আছে? আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করলে কি সেনাবাহিনী হাস্যকররকম তুচ্ছ বলে প্রমাণিত হয় না? –আনোয়ারের সঙ্গে এসব কথা বলে তর্ক করা যায়, কিন্তু ওসমানের কথা বলতে ভালো লাগছে না। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলে সে খুব খুশি হয়, আনোয়ার তার মুক্তির সম্ভাবনাই ব্যাখ্যা করছে, ওসমান তাই চুপ করে থাকে। এবার যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে আমাদের বেস বেশ ভালো। মানুষ কি রকম কনশাস আর মিলিট্যান্ট হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামের যারা মাথা, কয়েক জেনারেশন ধরে যারা ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে আসছে, কর্নার্ড হতে হতে তাদের অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যে, ঘোরতর মুসলিম লীগাররা পর্যন্ত শেখ মুজিবের রিলিজ চায়। না হলে ওদের সেভ করবে কে?
নিজের মতবাদ সম্বন্ধে যতোই কথা বলুক, তার রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে আনোয়ার একেবারে চুপচাপ থাকে। এই নিয়ে ওসমানের একটু অভিমান মতোও আছে? এবার এটুকু যখন বললো তখন আনোয়ার আরো বলবে ভেবে ওসমান উদগ্রীব হয়ে থাকে। কিন্তু আনোয়ার প্রসঙ্গ একটু পাল্টায়, এবার আমাকে যেতে বলছে আমাদের গ্রামে। আমাদের ওদিকটায় আমাদের লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, ‘খানিকটা দূরে চর এলাকায় যা-ও আছে তারাও অন্য গ্রুপের। একটু থেমে আনোয়ার বলে, ‘তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
ওসমান প্রথমে একটু ভয় পায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেতেও খুব ইচ্ছা করে। আনোয়ার ফের বলে, চলো না দোস্ত! আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক চাচা থাকেন, আমাদের থাকার জায়গা মেলা। যাবে? তুমি তো গ্রাম দ্যাখেইনি চলো। ওসমান একটু একটু হাসে, তুমি গ্রামে কোনোদিন বাস করেনি, আর পাকিস্তানে চলে আসার আগে পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। ‘আরে রাখো’ আনোয়ার থামিয়ে দেয়, কতো ছোটবেলায় চলে এসেছে, গ্রামের কথা তোমার মনে আছে?
ওসমানের বেশ হাল্কা হাল্কা ঠেকে। চায়ের পেয়ালায় অনেকক্ষণ চুমুক দেওয়া হয়নি। খয়েরি রঙের চায়ের ওপর শীতকালের পশ্চিমপাড়ার পুকুরের ওপরকার পরতের মতো গাঢ় খয়েরি সর ভাঙা ভাঙা ছড়ানো রয়েছে। সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমপাড়ার বাঁকাসিধা তালগাছগুলো পুকুরের সর-পড়া পানিতে কায়ায় ছায়ায় তিরতির করে কাপে। —ওসমান নয়ন ভরে চায়ের পেয়ালা দ্যাখে।
যাবে? আনোয়ার প্রায় তাড়া দেয়, কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে না!’ ওসমান কাঙালের মতো বলে, যাবো! কবে যাবে? আনোয়ার জবাব দেওয়ার আগেই শোনা যায়, প্লামালেকুম! পাশের টেবিলের সামনে উপুড় হয়ে লুঙির পানি-ভেজানো প্রান্ত দিয়ে চোখ মোছে খিজির, চেয়ারে বসার পরও তার চোখ মোছা ও কথা বলা অব্যাহত থাকে, ত্যাজ কি! মনে লয় পাইপ দিয়া পিয়াজের রস ঢাইলা দিছে!’ এরপর কথা বলে তার সঙ্গী, ভিজে রুমালে চোখ মুছতে মুছতে লোকটি ওসমানের দিকে তাকায়, হেভি টিয়ার গ্যাস মেরেছে। এতো পানি দিলাম, এখনো জ্বলছে! চোখ থেকে রুমাল তুললে তাকে চেনা যায়। ওসমান জিগ্যেস করে, আপনারা কোথায় ছিলেন পারভেজ? প্রসেশন দেখে আমি ভিড়ে গেলাম। কোর্টের ওখানে দেখলাম কি খিজির বহুত চার্জর্ড হয়ে ইটা মারছে! এদিকে গোলি চলে আর ও ইটা মারে!’
‘কেউ মারা গেছে? ‘ডেফিনিটলি!’ পারভেজ জোর গলায় হাকে, ‘চায়ে দো! ফের গলা নামায়, এ্যাঁট লিস্ট থ্রি, হা তিনজন তো হবেই।’
কয়জন কইলেন? হাড্ডি খিজির জোরে প্রতিবাদ জানায়, তিনজন? আরে দশজন এগারোজনের কম হইবে না। কয়টা লাশ তো আমরাই টেরাকে উঠাইতে দেখলাম।
ওদের বেশির ভাগই জখম, ইনজুরিডা পারভেজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আরে ভাই, এরা হয়ওয়ানসে ভি বেরহম! পহলে টিয়ার গ্যাস মারলে পাবলিক ডিসপার্স হয়ে যেতো। না, এই জানোয়ারগুলি পরথমেই গুলি করলো! গুলি করলি আগে আর টিয়ার গ্যাস মারলি পরে! এটা কি হলো?
আনোয়ার শান্তভাবে মন্তব্য করে, ডেডবডি সরাবার জন্য টিয়ার গ্যাস মারলো।’
পরিণতির কথা ভেবে ওসমান ভয় পায়, লাশগুলো কি করলো? আমি নিজের চোখে দেখছি কয়টারে টাইনা তুলতাছে, উত্তেজনা ও রাগে খিজিরের কালো মুখ আরো কালো দ্যাখায়। হাতের প্লায়ার একবার তার ডান হাতে, একবার বাম হাতে, কখনো টেবিলে রাখে, কখনো তার ময়লা শাদা লুঙির কোচড়ে রেখে তার ওপর কালো কালো শক্ত রঙের মতো আঙুল বুলায়, পরথমটা তো এক গুলিতেই খতম। ব্যাটারে টাইন তুললো, দেহি হাত দুইখান ল্যাতপাত ল্যাতপাত করে। আরেকটার জান কবচ হইছে টেরাকে উঠানের বাদে। এবার আনোয়ার তাকে কি জিগ্যেস করে এবং সে-ও লাশ গায়েব করার ব্যাপারে পুলিসের তৎপরতার একটি বিস্তারিত বিবরণ ছাড়ে। কিন্তু ওসমান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। পেটের চিনচিন ব্যথা তার মাথায় উঠেছে। চোখের সামনে তার গোল গোল হলদে রঙের আলোর বিন্দু। আলোর বিন্দুর বিন্যাস এরকম দাঁড়ায় যে, মনে হয় রক্তাক্ত ১টি মৃতদেহ টেনে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। মৃতদেহ ট্রাকের বাইরে রেলিঙে ঠেকে ঝুলছে। ৪/৫ জন প্রমাণ সাইজের পুলিস ১সঙ্গে টেনেও তাকে রেলিঙের ভেতর নিতে পাচ্ছে না। মৃতদেহের চোখ বেরিয়ে এসেছে কেটির থেকে। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল অফিসের ছাদ থেকে, আজাদ সিনেমার ওপর থেকে, ওদিকে রায়সায়েবের বাজারের উঁচুনিচু টিনের ছাদ থেকে পাবলিক ইটপাটকেল ছুড়ছে। ৩০৩ রাইফেলের বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ছুটে আসছে ভাঙাচোরা বোতল। —এইসব গোগ্রাসে দেখছে মৃতদেহের কোটরছেটা চোখজোড়া। তার ২ হাত নেমে গেছে নিচের দিকে, লোহারপাতের মতো একেকটি হাতে ঝোলে একেকজন গুলিবিদ্ধ মানুষ। তাদের জোড়া জোড়া ৪টে চোখ পেটুকের মতো দেখে নিতে চায় ইট-পাটকেল-বোতল-ছোড়া পাবলিককে। ওসমান নিজের চোখে হাত রেখে দৃশ্যটি নিভিয়ে দিতে চাইলে তা ঠাই নেয় তার নয়নের মাঝখানে। তখন কপালে হাত রেখে সে এদিক ওদিকে দ্যাখে।
কি হলো ওসমান? শরীর খারাপ? আনইজি ফিল করছো? আনোয়ারের ডাকে ওসমান ফের ঠিকঠাক হয়ে বসে। নাঃ! আমজাদিয়ায় দুটো এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট খেয়ে বেরোনো উচিত ছিলো। মনে হয় রোদে পিঠ দিয়ে বসে উঠানে ছড়ানো ধান খুঁটে-খাওয়া শালিক পাখি দেখতে দেখতে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে দুটো গরম ভাত খেতে পারলে সব ঠিক হয়। মাগুর মাছের ঝোলে মাখা ভাতের অনুপস্থিত স্বাদে মুখ লালায় ভরে ওঠে। কিন্তু এ শালা টকতেতো লালা। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দরজার নোঙরা পর্দা তুলে সে থুতু ফেলে। গলা হঠাৎ শুকনা ঠেকে এবং বিশ্রীরকম কাশি শুরু হয়। কাশির সঙ্গে গমক দিয়ে বমি আসে। গলা দিয়ে মুখ দিয়ে বেদম আওয়াজ বেরোয়, কিন্তু যতো গর্জায় ততো বর্ষে না। সিগ্রেটের স্বাদে মাখামাখি হয়ে টক তেতো লালাই গড়িয়ে পড়ে ঠোঁট থেকে। ততোক্ষণে পারভেজ পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাতের নরম চাপড় দিচ্ছে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিচ্ছে খিজির।
রাস্তায় খিজির তার গা ঘেঁষে চলে, গলা নামিয়ে বলে, আমাগো আলাউদ্দিন সাব আপনার লগে কি কথাবার্তা কইতে চায়। চান্দার টিকেটের দুইটা বই দিবো আপনারে, কইলো নিজে গিয়া দিবো। ওসমান এখন সম্পূর্ণ সামলে উঠেছে, এখন তার চিন্তা হয়, ‘আগরতলা মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তদের সহায়ক কমিটি’র চাঁদার রিসিট বই নিয়ে সে করবেটা কি? কার কাছে সে চাঁদা চাইবে?
আনোয়ার ডাকে, ওসমান আমার সঙ্গে চলো। খেয়ে রেস্ট নিয়ে বাসায় যেও।’ ওসমান কিন্তু এখন যেতে চায় তার নিজের ঘরে। মাগুর মাছের ঝোল এখন তার না হলেও চলে। সবচেয়ে দরকার দুটো এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট। তারপর কানা আবুলের হোটেল থেকে ভাত রুটি যা হয় খেয়ে ঘরে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা শুয়ে থাকবে। সন্ধ্যার দিকে রঞ্জ যদি খাতা নিয়ে এসে বলে, ‘অঙ্কটা একটু দ্যাখেন তো! তো ফ্রেশ শরীরে রঞ্জুর মাথার কাছে মাথা নিয়ে রাত পর্যন্ত অঙ্ক করানো যায়। কিন্তু আনোয়ার নাছোড়বান্দা, চলো। এখন রিকশা পাবে না, লক্ষ্মীবাজার পর্যন্ত হেঁটে যেতে কষ্ট হবে। চলো।’
আনোয়ারের ঘরে এখন রোদ নাই, কিন্তু সকালবেলার রোদের তাপ একেবারে মুছে যায়নি। আনোয়ারের টেবিল বড়ো এলোমেলো, একদিকে গাদা করে রাখা লিফলেটের তাড়া, পাশে বই, পত্রিকা, কাগজপত্র, এ্যাঁশট্রে এবং এ্যাঁশট্রে হিসাবে ব্যবহৃত সিগ্রেটের খালি প্যাকেট। এমনকি ১টা নোঙর গেঞ্জি ও আধ খাওয়া ১টি কমলালেবু। আনোয়ারের বিছানা কিন্তু পরিপাটি, –পুরু গদির ওপর তোষক, তার ওপর চাদর ও বালিশ; গুলটেক্সের পুরু বেড-কভার দিয়ে গোটা বিছানা আবৃত। ঘরের মেঝেও পরিষ্কার। মনে হয় টেবিলে আনোয়ার কাউকে হাত দিতে দেয় না।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, গোসল করবে?
না। তুমি করে এসো। তুমি তাহলে বরং একটু শুয়ে থাকো। আমার পাঁচ মিনিট লাগবে। কি ভেবে আনোয়ার টেবিলে কাগজপত্র ঘাটতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে একটা চিঠি দাখাবো। আমার এক আত্মীয়’, বইপত্র ওলট-পালট করা অব্যাহত রেখে আনোয়ার বলে, ‘গতবছর বাড়ি গেলে উনার সঙ্গে খুব জমেছিলো, আব্বার কি রকম কাজিনের হাজব্যান্ড, আমাদের গ্রামেই বাড়ি, তার একটা চিঠি পেয়েছি, খুব ইন্টারেস্টিং।’ মানে তোমার ফুপা? কি লিখেছেন? কৌতুহল দ্যাখানো খুব দরকার। কিন্তু ওসমান এখন শুতে পারলে বাচে। চিঠি খুঁজতে খুঁজতে আনোয়ারের হঠাৎ মনে পড়ে, ওহো চিঠিটা ভাইয়াকে পড়তে দিয়েছিলাম। ভাইয়ারা তো হারমোনিয়াম পার্টি করে সমাজতন্ত্র করতে চায়, তাই বললাম, দ্যাখো, গ্রামে মানুষ কি রকম মিলিট্যান্ট হয়ে উঠছে, পড়লেই বুঝবে। আনোয়ার বোধ হয় ভাইয়ার ঘরের দিকে চলে গেলো।
এদিকে পায়ে পায়ে ঘষে স্যান্ডেল সু্য খুলে ওসমান যে কখন শুয়ে পড়েছে নিজেও সে ভালো করে খেয়াল করেনি। শোবার পর একটু শীতশীত করে। এতো সাজানো গোছানো বিছানা, বেণ্ড-কভার তুলে গায়ে দিতে তার বাধো বাধো ঠেকে। তার চিলেকোঠার ঘরে শেষ বিকালে শুয়ে থাকলে কখনো কখনো চারদিকের পুরু দেওয়ালের অনেক ভেতরকার ঠাণ্ডা শাঁস থেকে বাতাস বেরিয়ে এসে চোখে, কপালে ও কানের গোড়ায় আস্তে আস্তে ফুঁ দেয়। তখন উঠে বরং বাইরে দাঁড়ালে ভালো হয়। বাইরে দ্যাখা যায় যে, বাড়ির উল্টোদিকে মসজিদের সামনে পুলিসের গাড়িতে ১টি গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ তোলা হচ্ছে। কোনোরকম নড়াচড়া ছাড়া ট্রাক চলে যায় জনসন রোডে। তার নিজের দাঁড়াবার জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যায় না। নিচে সাপের খোলস ছাড়াবার মতো করে পুলিসের লরি তার বডি পাল্টায়। লরির জায়গায় এখন বিরাট বাক্সের মতো দেখতে লাল রঙের ১টা গাড়ি। তার গাঢ় কালচে নীল কাচে ১টার পরে ১টা বুলেট লেগে ফিরে যাচ্ছে। ১টি বুলেটও কি কাচ ভেদ করতে পারে না? আরো চেষ্টা করা চাই। তো রাইফেল ছেড়ে কে। আজাদ সিনেমার ছাদে রেলিঙে রাইফেলের নল রেখে এক নাগাড়ে গুলি ছুড়ে চলেছে রঞ্জু রঞ্জু রঞ্জু কি পাগলামি করছে। নিচে থেকে পুলিসের ১টি মাত্র গুলি এসে ওর মাথাটিকে একেবারে চুরমার করে দেবে। রঞ্জুর মাথায় গুলি ঠেকাবার জন্য ওসমান দুই হাত দিয়ে তার কপাল ও মুখ জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায়, ঘুমিয়ে পড়লে?
নিজের কপাল ও মুখ থেকে দুই হাত সরিয়ে ওসমান আনোয়ারের দিকে তাকায়। এই যে, এই চিঠিটা ভাবী খুঁজতে খুঁজতে দেরি করে ফেললো। পড়ো, এ্যাঁ? আমার গোসল করতে পাঁচ মিনিট।
ঘুমঘুম চোখে পিঁপড়ের সারির মতো ছোটো ছোটো বাঙলা অক্ষর প্রথম প্রথম ঝাপশা হয়ে আসে। তবে দেখতে দেখতে সেগুলো স্পষ্ট হয়, তখন অনায়াসে পড়া চলে।
এতদঞ্চলে গরু চোরের উপদ্ৰব ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহার কোন প্রতিকার হইতেছে না। পক্ষকাল পূর্বে হাওড়াখালির নাদু পরামাণিক গরু অপহরণের অভিযোগ লইয়া থানায় যায়, কিন্তু দারোগা এজাহার লয় নাই। উপরন্তু পরদিন বুধবার দিবাগত রাত্রে নাদু পদুমশহর হাট হইতে প্রত্যাবর্তনকালে কে বা কাহারা পান্টি (গবাদি পশু শাসন করিবার যষ্টিবিশেষ) দ্বারা উহাকে প্রহার করে। তিনদিন পর অর্থাৎ শনিবার দিন দ্বিপ্রহরে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে ২নং ওয়ার্ডের মেম্বর খয়বার গাজীর ভ্রাতুষ্পপুত্র আফসার গাজী একটি কিষানের মাথায় আধ মণ মরিচের বস্তা লইয়া মূলবাড়ি ঘাটে যাইবার কালে ভুলু খন্দকারের খানকার নিকট পহুছিলে নাদুর পুত্র চেংটু তাহাকে কুকুর ধরাইয়া দিতে উদ্যত হয়। আফসার গাজী দৌড়াইয়া ভুলু খন্দকারের গোয়াল-ঘরে আশ্রয় লয়। চেংটু বলিয়া বেড়াইতেছে যে, খয়বার গাজীর ইশারায় দারোগা উহাদের গরু অপহরণের এজাহার লয় নাই। ক্রুদ্ধস্বভাব খয়বার গাজী ইহার প্রতিশোধ না লইয়া ছাড়িবে না। নাদু পরামাণিক বংশপরম্পরায় তোমাদের বাড়িতে বছর-কামলা হিসাবে কাজ করিতেছে। দরিদ্র ও নীচু বংশীয় হইলেও লোকটি অত্যন্ত অনুগত ও সৎ। কিন্তু উহার পুত্রটি বড় বেয়াদব, উহার উদ্ধত স্বভাব উহার পরিবারটির জন্য সর্বনাশ ডাকিয়া আনিবে। চিঠি পড়তে পড়তে ওসমানের ঘুম সম্পূর্ণ কাটে। আমাদের এলাকার মানুষের ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হইয়াছে, সম্ৰমবোধ একরূপ নাই বলিলেই চলে। ভদ্রলোকের পক্ষে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করা ক্রমেই দুরূহ হইয়া উঠিতেছে। তুমি দীর্ঘকাল বাড়ী আস নাই। সময় করিয়া একবার আসিলে নিজেই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিতে পারিবা। এখানে খোদা চাহে সকলের কুশল। তোমার ফুফুর অবস্থা পূর্ববৎ। বাম চক্ষুর ছানি কাটিবার উপযুক্ত হইয়াছে, ঐ চোক্ষে প্রায় কিছুই দেখিতে পারে না। একবার ঢাকায় লওয়া দরকার।’
শেষ বাক্যটি পড়তে পড়তে ওসমানের ঠোঁটজোড়া একটু বাঁকা হয়, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে লোকটা আনোয়ারের কিছু পয়সা হাতাবে। তবে কোনো মহিলার ছানি-পড়া চোখের সামনে উপচে পড়ে দুপুর বেলার রোদ। কালো ও ঢাঙা ১টি তরুণ চাষী পাটকিলে রঙের একটি কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। —এই দৃশ্যটি অস্বস্তিকর। আনোয়ারের সঙ্গে ওসমানও তো ঐ গ্রামে যাচ্ছে, এরকম চলতে থাকলে তাকে আবার কেউ কুকুর লেলিয়ে না দেয়।
চিলেকোঠার সেপাই – ০৬
রঞ্জুদের ঘর থেকে ওসমান বেশি হশিখুশি হয়ে বেরোচ্ছে, সিঁড়িতে হাড্ডি খিজিরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। এই শীতের সকালে নিচতলায় শ্যাওলাপড়া চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে তার ওপর পরশু দুপুরে আলতাফের ফেলে-যাওয়া শাল চড়িয়ে ওসমান চুল আঁচড়াচ্ছিলো, রঞ্জ এসে একরকম জোর করে ওদের ঘরে নিয়ে গেলো। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সেখানে চললো সেমাই খাওয়া। জর্দা-সেমাইটা জড়িয়ে দলা দলা হয়ে গিয়েছিলো, দুধ-সেমাইতে মিষ্টি কম। পর্দার ওপারে নিচু ও মিহি সুরে রঞ্জুর মায়ের বিরতিহীন বিলাপ। তালেব হত্যার পর এই প্রথম ঈদ, ওর মায়ের বিলাপে তালেবের ঈদ উদযাপনের নানারকম স্মৃতিচারণ। এতে ঘরদের একটু ভারি ভরি ঠেকলেও রানু ও রঞ্জুর ক্রমাগত পীড়াপীড়িতে সেমাই খেতে খেতে ২৫/৩০ মিনিট বেশ মিষ্টি রোদের মতো পিঠের ওপর পড়ে রইলো। এখন একটু আনোয়ারদের ওখানে যাবে, খিজির ঘরে ঢুকলে কি সহজে বেরোবে?
খিজিরের হাতে ট্রে। সবুজ ও লাল সুতায় নিষ্কণ্টক ডাল পাতা ও গোলাপ ফুল সেলাই করা হলুদ রুমালে ঢাকা। খিজির একটু দাঁড়ায়, কৈ যান? মাহাজনে নাশতা পাঠাইয়া দিছে, খাইয়া একেবারে বারানা’ বায়ে ঘুরে রঞ্জুদের ঘরে যেতে যেতে বলে, ‘আপনে উপরে গিয়া কামরায় বহেন। ব্যাকটি ভাড়াইটারে দিয়া আমি আইতাছি।
ওসমানের ঘরের দরজার চাবি রঞ্জুদের ঘরে। রানুর নতুন বিবাহিতা বন্ধু তার স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে এলে ওরা সবাই মিলে ছাদে উঠে ছবি তুলবে। ওসমান রঞ্জুদের দরজায় টোকা দিয়ে চাবি নিলো।
ট্রে থেকে সেমাই ও মোরগ পোলাওয়ের ডিশ তুলে নিতে নিতে ওসমান বলে, আমার তো প্লেট মোটে একটা। এতোসব রাখি কোথায়?’
রাখেন প্যাটের মইদ্যে। আমি এটু বহি, আপনে খান! এদিক ওদিক তাকিয়ে খিজির ছাদের দিকের দরজায় চৌকাঠে বসে পড়ে।
আরে আরে ওখানে বসছো কেন? বিছানায় বসো, বিছানায় বসে। ওসমানের ব্যস্ততাকে আমল না দিয়ে খিজির হাঁটু ভেঙে গুছিয়ে বসে।
মোরগ পোলাওয়ের স্বচ্ছ ও পাতলা ধোঁয়ার সুবাসে আত্মসমর্পণ করতে করতে ওসমান বলে, এতো রঞ্জুদের ওখানে হেভি হয়ে গেছে।’
‘আরে ঈদের দিন ভি মাইপা খাইবেন? ঈদ উদ মনে লয় মানেন না, না? নমাজ ভি পড়েন নাই?
‘ভোরবেলা ঠিকমতো ঘুম ভাঙলো না, ওসমান আমতা আমতা করে।
নাহাইছেন মালুম হয়।
হ্যাঁ। চৌবাচ্চার পানি যা ঠাণ্ডা!
ভালো করছেন। ঈদের দিন উইঠা নাহাইয়া উহাইয়া সাফসুতরা হইয়া নমাজ পড়তে যাইবেন। রিশতাগো লগে মিলবেন, পড়শিগো লগে মিলবেন! তয় না মোসলমানের পোলা!
ঈদের দিন খিজির আলি মুসলমানের সন্তান হওয়ার জন্যে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালায়। আজ খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে রাস্তার কলে ৫৭০ সাবান দিয়ে গা কচলে গোসল করেছে। গায়ে চড়িয়েছে আলাউদ্দিন মিয়ার দেওয়া বুকে সাদা সুতার মিহি কাজ করা আদির কল্লিদার পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতে কজির কাছে একটু ছেঁড়া। তা হোক। হাতটা গুটিয়ে নিলেই হলো।
খিজিরের গেঞ্জিটা বড়ো ময়লা, ধোঁয়া হয়নি বলে ওটা পরেনি, পরলে পাঞ্জাবিও ময়লা দ্যাখায়। গেঞ্জির অভাবে তার অস্থিসর্বস্ব বুক প্রতিটি নিশ্বাসে প্রশ্বাসে তার নামকরণের সার্থকতা ঘোষণা করছে। সাদা লুঙিটা রাত্রিবেলা সে নিজেই ধুয়ে দিয়েছিলো, এখনো স্যাঁতসেঁতে রয়েছে। তাই কিছুক্ষণ পর পর তাকে খসখস করে উরু চুলকাতে হচ্ছে। সেই অতো ভোরবেলা মোড়ের পানির কল থেকে ঘরে ফিরে দ্যাখে জুম্মনের মা চলে গেছে মহাজনের বাড়ি, ঈদের দিন সকাল হবার আগেই না গেলে কাজ সামলানো যাবে না। বৌয়ের নারকেল তেল খুঁজে নিয়ে খিজির মাথায় মেখেছে, তা ছটাকখানেকের কম নয়, তার কপালে ও জুলফিতে তেল গড়িয়ে পড়ছে। গায়ে তার আতরের গন্ধ ভুরভুর করছে, কানে গোজা আতর মাখা তুলার টুকরা। আতরটাও আলাউদ্দিন মিয়ার কল্যাণে। তবে চোখে সুর্মা মাখার জন্যে তাকে একটু ছ্যাচরামো করতে হয়েছে। মামার সঙ্গে নামাজ পড়তে যাবে বলে মহাজনের বাড়িতে আলাউদ্দিন মিয়া সতরঞ্চি, জায়নামাজ, চাদর এসব খোঁজাখুঁজি করছে, সেই ফাঁকে বাইরের ঘরে টেবিলে রাখা সুর্মাদান থেকে সরু সুৰ্মা কাঠি দিয়ে খিজির দুই চোখে ইচ্ছামতো সুৰ্মা মেখে নিয়েছে। আলাউদ্দিন মিয়া নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। তা টের পেলেই বা কি? কাজের লোকের এই সব হাতটান দেখে চোখ ময়লা করার বান্দা তার
চাকরবাকরদের সে বরং একটু সুযোগ দেয়। আজ সকালবেলা মামাকে গ্যারেজে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করে রিকশাওয়ালদের রিকশা ভাড়া দেওয়ার দায়িত্বটা খিজিরকে জুটিয়ে দিলো, তাই বা কম কি?
বাড়ির চেয়ে রিকশার সংখ্যা বাড়িওয়ালার বেশি। রিকশার জন্যে রহমতউল্লার মায়ামোহাব্বতও বাড়ির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ফজরের নামাজ পড়ে প্রত্যেকদিন তসবি হাতে সে সরাসরি চলে আসে বাড়ির পেছনে রিকশার গ্যারেজে। অনেকের গ্যারেজ অবশ্য এর আগেই খোলা হয়, কিন্তু নামাজের আগে দিন শুরু করা তার ধাতে সয় না। তার গ্যারেজে পৌঁছবার আগেই রিকশাওয়ালাদের ভিড় জমে যায়। গম্ভীর মুখে কারো দিকে না তাকিয়ে রহমতউল্লা গ্যারেজে ঢোকে, ঢোকার পরপরই নরম গলায় প্রথম বাক্যটা ছাড়ে, ‘নবাবসাবরা তশরিফ লইছেন? তারপর মিনিটখানেক পরে শুরু হয় একটানা বিলাপ, ‘হায়রে, তিনটা গাড়ি এক্কেরে জখম কইরা ছাড়ছে, এ্যাঁ? প্রত্যেকটি রিকশার নম্বর তার মুখস্থ, আহারে, এই চাইরশ পাঁচচল্লিশটার হ্যাঁন্ডেলখান ছেইচা ভাতের চামিচ বানাইয়া দিছে। খানকির বাচ্চা ইসা দুইশ আটপঞ্চাশের মাড়গাড় আমান রাখে নাই। খানকির পুতে মাডগাডের উপরে খাড়াইয়া হোগা মারা দিছিলি তর কোন বাপেরে? কইলি না?
সারি সারি সাজানো ১৮টা রিকশার প্রত্যেকের হুডে, মাডগাড়ে, সিটে, সামনের সাইকেলে, রডে, এমনকি স্পোক বা চেসিসে হাত বুলাতে বুলাতে তার বাক্যবর্ষণে এক মুহুর্তের জন্য বিরতি দেয় না। এরই ফাঁকে ফাঁকে একেকজন ড্রাইভারকে রিকশা দেওয়া হয়। ১টি ও ২টি, ১টি ও ২টি-৩টে করে চাকা রাস্তায় গড়ায়। শেষ রিকশাটির প্যাডেল ঘুরতে শুরু করলে তসবিতে আল্লাকে গুণতে গুণতে রহমতউল্লা নাশতা করতে যায় ডানদিকের তেহারির দোকানে।
ঈদের দিন রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার নিয়ম নাই। তবে কোনো ঈদেই সবগুলো রিকশা সে ছাড়ে না। রিকশাওয়ালা যারা আসে সবাইকে ঠেসে খাওয়ায়, কিন্তু রিকশা দেয় মাত্র কয়েকজনকে। এমনিতে যাবতীয় রিকশাওয়ালার ওপর রহমতউল্লা খুব চটা, খানকির বাচ্চা না হইলে রিকশাচালাইবার কাম কেউ লয় না। মাহাজনরে ক্যামনে ঠকাইবো হালারা থাকে খালি হেই তালে। এদের মধ্যে একটু কম খানকির বাচ্চা কে, কে একটু কম ঠকায়,—এসব যাচাই করে নিতে খানিকটা সময় নেয়। আবার কারো কারো কাছে অনেকদিনের পাওনা টাকা-পয়সা আদায় করা যায় এই দিনেই, আব্বে জব্বইরা, মালীবাগের মোচড়ের মইদ্যে টেরাকের লগে রঙবাজি করবার গিয়া দুইশ বারোটারে উল্টাইয়া দিছিলি না? আমারে কতোটি পয়সা জরিমানা করাইলি খবর রাখস? জব্বারকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মেজাজ চড়ে যায়, একটা পয়সা দিছিলি?
টায়ার টিউব জখম হইছিলো মাহাজন। জব্বারের এ কৈফিয়তে রহমতউল্লাহুঙ্কার ছাড়ে, টায়ারের মায়েরে বাপ ইস্পোকগুলার দাম দিবো তর কুন বাপে? নিয়ম অনুসারে স্পোক ছাড়া অন্য কিছু নষ্ট হলে মেরামতের দায়িত্ব মহাজনের। মালীবাগের মোড়ে জব্বার একটা রিকশা ওভারটেক করতে গিয়েছিলো, পেছনের ট্রাকের ধাক্কায় ২১২ নম্বর রিকশা একেবারে উল্টে যায়। চাকা ও মাডগার্ড সব পাল্টাতে হয়েছিলো মহাজনের সেই রাগ এখন পর্যন্ত যায়নি। কিন্তু নষ্ট ও বাতিল চাকার সবগুলো স্পোকের দাম দিতে হবে শুনে জব্বার একেবারে মিইয়ে যায়। লোকটা একবার শেষ চেষ্টা করে, মাহাজন, তহন তো কিছু কইলেন না!
তহন কইলে এতোগুলি পয়সা দিবার পারতি? তহন তরে ম্যাহেরবানি করছি। যা, তর পসা লইয়া আমার কাম নাই, ফকুরনির বাচ্চা, চোপা মারস, না? তর চোপার মায়েরে বাপ! এদিকে ঈদের জামাতের সময় হয়ে এসেছে, মহাজনের হাতে পায়ে ধরে সবগুলো স্পোকের দাম যা হয় তার একটা ভাগ দিয়ে জব্বার রিকশা পায়। মালপানিওয়ালা প্যাসেঞ্জার ধরে বায়তুল মোকাররমে ট্রপ দিতে পারলে এর দ্বিগুণ রোজগার। তাই রহমতউল্লাই বা ছাড়বে কেন? ঈদের দিন তার খরচ কি কম? পয়সা আসবে কোথেকে? তার এক ডিগচি সেমাই তো সাবাড় করবে এই ফকুরনির বাচ্চার দলই। ঈদের দিন সকালবেলাটা তাই রহমতউল্লাকে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকতে হয়।
কিন্তু আজ ভোর হতে না হতে সরু গলিটা পার হয়ে মহাজনের বাড়ি এসে ঘাপলা বাধালো আলাউদ্দিন মিয়া, মামু, আউজকার দিনটা গ্যারেজে না গেলেন। কেউগারে পাঠায়৷ দেন, গাড়িগুলি ডেরাইভারগো দিয়া আইবো।
রহমতউল্লা রাজি না হলেও আলাউদ্দিন ছাড়ে না, আউজকা তো ভাড়াউড়ার কারবার নাই। কেউরে পাঠাইলেই হইলো। লন, জলদি নাহাইয়া লন, বায়তুল মোকাররম যামু। বহুত বড়ো জামাত, বহুত মানুষের লগে মিলবার পারুম। এতেও রহমতউল্লার সায় নাই, না মিয়া, ঐগুলি ছাড়ো। আমাগো পুলের উপরের মসজিদ কি আইয়ুব খানের মিলিটারি কজা করছে, না চৌচল্লিশ ধারা দিয়া মুসল্লিগে আটকাইয়া রাখছে? বাপ দাদা ময় মুরুব্বি চোদ পুরুষ নামাজ পড়ছে পুলের উপরের মসজিদে, আউজকা তুমি নয়া জায়গা বিচরাও? পুরনো প্রথার প্রতি মামার আনুগত্য আলাউদ্দিন মেনে নেয়। কিন্তু মামার গ্যারেজে যাবার ব্যাপারে তার আপত্তিতে সে একেবারে অটল। সে ১টি নতুন কৌশল প্রয়োগ করে, ঠিক আছে, কেউরে পাঠাইয়া কাম নাই। আমি যাইতেছি। আমারে বিশ্বাস করেন তো? আলাউদ্দিন মিয়া প্রায় চেচিয়ে কথা বলে। মামার জন্যে তার এই মাথাব্যথা যেন সকলের কানে লাগে। অন্তত মামার বৌটার কানে কথাগুলো পৌছানো দরকার। ঈদের দিন ভোরবেলা উঠেই রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে মুখ খারাপ করাটা তার মামীর পছন্দ নয়। হাজার হলেও মামী তার বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরাত। তিন পুরুষ আগেই তাদের অবস্থা পড়ে গেলে কি হয়, -কথায় বার্তায়, চাকরবাকরদের ধরে এই মারধোর করায়, আবার এই গাদা গাদা খাবার দেওয়ায়, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে নাকউঁচু দ্যাখানোতে তার খানদানি ভাবটা সব সময় ঘ্যানঘান করে। মামীকে পটানো আলাউদ্দিন মিয়ার খুব দরকার। মামীর মেয়েটার আবার বাপের চেয়ে মায়ের দিকেই ঝোকটা বেশি। কিছুদিন থেকে মামীর ভাইয়ের আইএ ফেল ছেলেটা এই বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। নাঃ মামীকে ভজাতে না পারলে কাজ হবে না। মামার গ্যারেজে যাওয়ার বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে পরম ধৈর্য ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে সে বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির নানারকম প্রকাশ দ্যাখাতে থাকে। লেগে থাকলে কি না করা যায়? শেষ পর্যন্ত মামী ও মামীর মেয়ে আলাউদিনের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং মহাজনের রিকশার গ্যারেজে যাওয়ার দায়িত্ব পায় খিজির।
মামাভাগ্লের গ্যারেজ ২টো পাশাপাশি। ঈদের দিন আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য সবগুলো গাড়িই বের করে। বেবি ট্যাকসি আজ তার নিজেরই কাজে লাগবে, রিকশাগুলো বাইরে গড়িয়ে দিয়ে খিজির ঢোকে মহাজনের গ্যারেজে।
খিজিরকে দেখে রিকশাওয়ালার ইচ্ছামতো রিকশায় হাত দিয়েই টানাটানি শুরু করে। সুর্মমাখা চোখ কুঁচকে খিজির ওদের কাণ্ড দ্যাখে আর চাচায়, আরে এইটা কি খানকিপটি পাইলি? গলায় রহমতউল্লার ঘর্ঘর টোনটি আনার চেষ্টা করে, আরে এইটা কি তোরা কান্দুপট্টি পাইলি? মনে লয় খানকিগো মাজা ধইরা সিনা ধইরা টান মারবার লাগছস! মহাজন না আসায় রিকশাওয়ালাদের তেজ বেড়ে গেছে, রিকশাগুলো যেন শালদের বাধা খানকি! একেকজনের বুক-চিতানো কথা শোনো, ঈদের দিন আবার পসাকিয়ের বে?
বাকি পসার খবর তুই রাখবি ক্যামতে? যা যা, বাড়ি গিয়া মহাজনরে দিয়া লাখাইয়া লইয়া আয়। তাহলে মহাজনে আহুক’ খিজিরের এই প্রস্তাবে রিকশাওয়ালাদের তেজ নিভে যায়। মহাজন আসা মানে প্রথম থেকে গ্যাঞ্জাম। তার মানে নামাজের খ্যাপ ১টাও পাওয়া যাবে না। তখন প্রত্যেকের কোমর থেকে ১ টাকার নোট, আধুলি, সিকি বের হতে থাকে। কয়েকজন শেষের ২/১টা টান বাকি রেখে বিড়িটা তুলে দেয় খিজিরের হাতে এবং এই বিড়ি দেওয়ার ক্ষোভ মেটায় এই বলে, কি ৰে, হাড্ডির বাচ্চা, মাহাজনের গতর উত্তর অহনও বানাইয়া দেস? না, মাহাজন অহন তরে ছাড়ান দিয়া আর কেউগ্যারে ধরছে? এসব কথার জবাব দেওয়ার সময় কৈ খিজিরের ১টা ১টা করে ৩টে বাদে সবগুলো রিকশা রাস্তায় নামে। নামাজের সময় প্রায় হয়ে গেলো। রহমতউল্লা ও আলাউদিনের বাড়ির সতরঞ্চি, চাদর ও জায়নামাজ মসজিদ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব খিজিরের ওপর। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। ক্রিং কিং -রিকশার ঘন্টার আওয়াজ, গ্যারেজের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে।-কোন হালা পোংটা পোলা গ্যারেজের মইদ্যে ঢুকছে –বিরক্ত হয়ে খিজির ভেতরে ভালো করে দাখে। না, কেউ না। বোধ হয় রাস্তায় রিকশার ঘণ্টা। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে বাশের মোটা বাতায় তৈরি দরজা চেনের সঙ্গে তালা লাগিয়ে বন্ধ করছে, এমন সময় ফের শোনা যায়, ক্রিং ক্রিং ক্রিং’ খিজির দরজা খুলে আবার গ্যারেজে ঢোকে, সব চুপচাপ। তবে গ্যারেজে কেউ না কেউ আছে। খিজিরের গা ছমছম করে, এই গ্যারেজে ছেলেবেলায় বহু রাত্রি কেটেছে, মাঝে মাঝে নন্দলাল দত্ত লেনের গলা-কাটা মাহাক্কালটা এসে রিকশার বেল বাজাতো! সেই ব্যাটা কি আজ আবার এসে হাজির? গা ছমছম ভাবটা মুহুর্তে কেটে যায়, শালা বদ জিনটার সঙ্গে একটা বোঝাপড় করার জন্য সে গ্যারেজের এমাথা ও-মাথা ঘোরাঘুরি শুরু করে।
ইট সুরকির ১৫ ইঞ্চি দেওয়াল আসলে রহমতউল্লার বাড়ির সীমানা। একদিকে সেই দেওয়াল, সামনে ও ২ পাশে টিন ও বাঁশের মোটা বেড়া দিয়ে মহাজন এই গ্যারেজ শুরু করে প্রায় ১৯/২০ বছর আগে। তখন ২টো রিকশা রাখার মতো একটুখানি জায়গা ছিলো, সবটাই বেড়ায় ঘেরা। পরে এই বাড়ির মালিক হবার পর মাহাজন দেওয়াল ঘেঁষে গ্যারেজ বানায়। দিন যায়। গ্যারেজ এগিয়ে চলে সামনের দিকে। রাস্তার ড্রেন পেরিয়ে গ্যারেজ এগোয় রাস্তায়। এরপর বাড়াতে হয় পাশে। এখন ওদিককার ল্যাম্পোস্ট পার হয়ে গেছে, ফলে গ্যারেজের একটা সাইডে বা লাগাতে হয় না। পুরু দেওয়ালের ১দিকে দরজা কেটে বাড়ির ভেতরের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। কিন্তু ছোটলোকের বাচ্চাগুলো যখন তখন ভেতরে ঢুকে চুরি চামারি করবে, অন্দরে পর্দা থাকবে না-কয়েকটা ইট সরাবার পর এই নিয়ে বিৰিসায়েব হাউকাউ করায় দরজা ফোটাবার কাজ বন্ধ থাকে। আলগা ইটগুলো কোথায় ছিটকে পড়েছে, সেখানে বিরাট ১টি ফাক। এছাড়াও এখানে ওখানে ইট খসে পড়ায় কিংবা ইট খসিয়ে নিয়ে এটা ওটা রাখবার জায়গা করা হয়েছে। খিজির যখন এখানে থাকতো, এগুলো কি এভাবেই ছিলো? অনেকগুলো মার্বেলের ঠোকাঠুকির আওয়াজে সে চমকে ওঠে, তার মার্বেল লুকিয়ে রাখতো একটা খোপে, সেটা কোনটা? সেই আওয়াজ অনুসরণ করে সে এদিক ওদিক হাতড়ায়। না, কোথায় মার্বেল? ১টা খোপে সাইকেলের অচল চেন। আরেকটা খোপে তেলের ছোটো একটা টিন। আচ্ছা, সন্ধ্যার পর রায়সায়েবের বাজারের পাশে চোরাবাজারে গ্যারেজের ১টা ক্ষু ড্ৰাইভার বেচতে গিয়েছিলো, হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকারে হাতিয়ে নিয়েছিলো ১টা বল বেয়ারিং। ঘরে এসে দ্যাখে একেবারে নতুন, এতো সুন্দর চকচক করতো। এই দেওয়ালের কোন ফোকরে লুকিয়ে রেখেছিলো। বিক্রি করতে ইচ্ছা করতো না। তারপর বিক্রি করার ইচ্ছা ও সুযোগ যখন হলো তখন কিন্তু সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন ফোকরে রেখেছিলো? নাঃ! কোথাও নাই। সিলেটের প্যাকেট-ছেঁড়া তাসের তাড়া কোথায় রাখতো ১টা খোপে হাত দিলে খসখস করে, কিন্তু না, সেখানে ব্যবহৃত শিরিষ কাগজের টুকরা। আরেকটাতে ক্ষুড্রাইভার, ১টিতে সাইকেলের চেন। নাঃ! তার বল-বেয়ারিং কি মার্বেল কি তাসের তাড়া পাওয়া যায় না। ওদিকে ঘরের ভেতর কানের পাশে রিকশার ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিয়ে বেজে চলে, খিজিরের হাতের তালে তালে সেই ঘণ্টা-বাজানো নিয়মিত বাজনায় রূপ নেয়। নাঃ! তাকে কিছুঁতেই ধরা যাচ্ছে না। হতাশ হয়ে খিজির দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
গলি দিয়ে নোঙর বাঁচিয়ে চলেছে ধোঁয়া পাজামা পাঞ্জাবি লুঙি পরা লোকজন। তাদের প্রত্যেকের মাথায় টুপি, অনেকের আঙুলে শিশুর হাত। কাউকে ভালো করে দ্যাখা যায় না, আস্তে আস্তে রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে রাস্তাও চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে যায়। খিজির ওর মাথা বারবার বাঁকালেও কোনো ফল হয় না। আজ চুলে এতোটা তেল দেওয়ায় কি তার মাথার ভেতরটা জমে বরফ হয়ে গেলো? চুল বেয়ে তেল চুয়ে চুয়ে তার করোটির ভেতর গড়িয়ে মগজের এ-চাকায় ও-চাকায় জট পাকিয়ে রেখেছে। কোনো চুতমারানি ট্রাফিক পুলিসের সাধ্য কি যে সেই জট খুলে? তার মগজে কি শুরু থেকেই এরকম জাম লেগেই থাকতো? তার মায়ের অবশ্য ধারণা ছিলো যে, খিজিরের করোটি একেবারে খ খ করে, সেখানে এক কাচ্চা মগজ যুদিল থাকে। তরে লইয়া আমি কি করি? তর কপাল তুই দেখবি, আমার কি? মা একবার বকতে শুরু করলে থামতে পারতো না, তরে কতোবার কইছিমিস্ত্রীর সামনে তুই পড়বি না। তরে দেখলে মিস্ত্রী এক্কেরে খাট্টা হইয়া উঠে, আর তুই বেলাহাজ বেশরম খাট্টাশের পয়দা একখান, তামামটা দিন ঘুইরা ফিইরা খালি তার সামনেই পড়বি!’
কিন্তু খিজির কি আর ইচ্ছা করে মিস্ত্রীর সামনে পড়তো? মিস্ত্রী শালা জোয়ান একখান মরদ, সে কি-না বৌয়ের পোলার রোজগার খাবার লোভে দিনের মধ্যে ২ বার ৩ বার এসে হাজির হতো লোহার পুলের গোড়ায়। কতোই বা রোজগার ছিলো? তখন ওর কাজ রিকশা ঠেলে ঠেলে লোহার পুলে উঠিয়ে দেওয়া। একবার সূত্রাপুরের ঢাল থেকে ওপরে উঠিয়ে দাও, তারপর ফিরে এসো একা একা। তারপর আরো সব পিচ্চিদের সঙ্গে আবার রিকশার পেছনে ছোটে, ধাক্কা দেই?—দে। আবার ঠেলো, আবার নেমে এসো। ২ পয়সা করে জমতে জমতে ২ আনা ৩ আনা না হওয়া পর্যন্ত একটানা ওঠানামা। তারপর চিনাবাদাম খাও, কি সোনপাপড়ি, কি ছোলার ঘুঘনি। অথবা পুলের ওপর এক ধারে নুলো বুড়ির কাছে বসে আধ-পচা আম কি পাখি-ঠোকরানো নোনাফল কি আধখানা কাটা মিষ্টি আলু। কিন্তু কি বলবো, ৩/৪ ঘণ্টা যেতে না যেতে ফরাসগঞ্জের আটার কলের কাজে বিরতি দিয়ে ফালুমিন্ত্রী শালা ঠিক হাজির, দেহি, কতো পাইছস? পয়সার পরিমাণ তার মনমতো না হলেই ঘাড়ে পিঠে সমানে কিলচড়, হারামির বাচ্চা, প্যাটখান বানাইছস কলতাবাজারের পানির টাঙ্কি, যহনই দেহি চুতমারানির মুখ চলতাছে। মিস্ত্রীর আড়ালে থাকার জন্যে চেষ্টা তো কম করতো না। একদিন পুলের ওপর ১টা সিকি কুড়িয়ে পায়, সেটা নিয়ে মইজার মায়ের পোলা মইজার সঙ্গে তার একচোট হাতাহাতিও হয়, সিকিটা নাকি মইজা আগে দেখেছিলো। শেষ পর্যন্ত রফা হয় এই শর্তে যে, ২জনেই সূত্রাপুরের ঢালে ১টা হোটেলে গরুর গোশত খাবে। ব্যাপারটা ফালু মিস্ত্রী টের পেয়ে গিয়েছিল, মনে হয় মইজা হালায় পুরো পয়সাটা না পাওয়ার ক্ষোভে তার কানে লাগায়। পুলের ঢালে ট্র্যাফিক পুলিস বক্সের পেছনে ফালু সেদিন তার গলা ধরে এমন চাপ দিয়েছিলো যে, গোশতের টুকরাগুলোর স্বাদ সে জিভে আরেকবার অনুভব করে। এদিক দিয়ে ধরলে ফালু মিস্ত্রী বরং তার উপকারই করেছিলো, তারই বেদম মারের চোটে ২ আনার গোশতের স্বাদ ১ ঘণ্টার মধ্যে ২ বার ভোগ করলো।
ফালু মিন্ত্রী লোক কিন্তু এমনিতে খুব খারাপ ছিলো না। অন্তত খিজিরের মায়ের গায়ে সহজে হাত তুলতো না, এটা ঠিক। খিজিরের মা, এমনকি খিজির পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকার সময় সবচেয়ে বেশি আরাম ভোগ করেছে। ফালুর বসবাস ফরাসগঞ্জের একটা বড়ো বাড়ির ঘোড়ার আস্তাবলে। বাড়ির মালিক তার দুই পুরুষের মনিব, ফালুর বাপ মনিবের ঘোড়ার গাড়ি চালাতো, ঘোড়ার গাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার পর আস্তাবলটাই সাফ সুতরো করে নিয়ে ফালু সেখানে বাস করতো। মনিবের আটার কলে সে মেশিন চালায় আর তার বৌ যেই হোক না ঐ বাড়িতে কাজ করতে হতো তাকে। ফালু এমনি হাসিখুশি মানুষ, কখন যে তার মেজাজ খিচড়ে যাবে কে বুঝবে? দ্যাখো না, মায়া সিনেমায় মোলাকাত দেখে ছবির কাহিনী বলার জন্যে বৌকে নিয়ে বসেছে,—এমনকি ঘুমিয়ে-পড়া খিজিরের মাথাটা বালিশে ঠিক করে বসিয়ে দিলো-কাহিনী বর্ণনার মাঝে হঠাৎ কি হলো, ঘুমন্ত বালকের পিঠে দমাদম শুরু করলো কিল মারতে। হাতের সঙ্গে সমানে চললো তার মুখ, এই জাউরাটারে কদর দিয়া খেজুর কাটা পুঁইতা ঘরে আইলে আমার দিলটা ঠাণ্ড হয়। বুইরা হারামজাদা,তর ইসে কইটা দিমু, এক্কেরে পোতাপুতা লইয়া কাটুম, জিন্দেগির মইদ্যে বিছনার মইদো তর প্যাশাপ করা বারাইবো দেহিস।
বিছানায় পেচ্ছাব করার ব্যাপারে খিজিরের কি করার ছিলো? ২/১ রাত পরপর ঘুমের ভেতর কারো উস্কানিতে সে সোজা চলে যেতো ফরিদাবাদ পেরিয়ে মিল ব্যারাকের পর আইজি গেটে। এই জায়গাটা তার এমনিতে চেনা, ফালুর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মাঝে মাঝে এসে ডাংগুলি খেলতো। মাঠের এক কিনারে পেচ্ছাব করতে কি যে ভালো লাগতো। কিছুদিন পর রহমতউল্লার গ্যারেজে তোতামিয়া ওকে ন্যাংটা করে খুব জাপ্টাজাপ্টি করছিলো, তখন তার নুনু অনেকটা সেইভাবে শিউরে ওঠে। সে তো অনেক পরেকার কথা। বিছানায় পেচ্ছাব বন্ধ করার জন্য মা তার কম চেষ্টা করেনি। কতো তাবিজ, কতো পানি পড়া! শেষ পর্যন্ত সারলো রহমতউল্লার বাড়ির ঠিকা-ঝি মজির মায়ের জোগাড়-করা ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মৌলবি সায়েবের পানি-পড়া খেয়ে। কিন্তু এতেও ফালু মিস্ত্রীর মারধোর কমে না। খিজির অনেকদিন থেকেই ঐ বাড়ি থেকে কেটে পড়ার তালে ছিলো। কিন্তু ওর মাও যে সরে পড়বে এটা কিন্তু খিজির কখনো কল্পনা করেনি। ফালুর ঐ প্রায়-পাকা আস্তাবল ঘর, ঘরের সামনে পাকা উঠানে সারা রাত ধরে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে, সেই আলোতে রাত্রে নিশ্চিন্তে কাটা বেছে ফলি মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া চলে। একদিকে চাকরবাকরদের জন্য সারি সারি খাটা পায়খানা, পায়খানার সারির পাশে চৌবাচ্চায় দিনরাত পানি -সব ছেড়ে আহাম্মুকের মতো মা চলে এলো। তেমন কিছু আনতেও পারলো না। লুকিয়ে গোটা দুয়েক শাড়ি, সের চারেক চাল আর ১টা বিছানার চাদর পাঠিয়ে দিয়েছিলো খিজিরকে দিয়ে। কিন্তু মনিবের ভালো শাড়িটা সরাতে গিয়ে পারলো না। নতুন মাতার মাগীটা ভঙ্কে তঙ্কে ছিলো, ঠিক সময়ে ধরে ফেলে। শাড়ি লুকিয়ে নেওয়ার কথা শুনে ফালুর লাফালাফি কী ‘কাপড় দিয়া তুই করবি কি। খানকি মাগী গতরখান কাপাইলে তর ভাত কাপড়ের অভাব?
কথাটা মিস্ত্রী খুব ভুল বলেনি। কালোকিষ্টি মা মাতারির গতরখান না থাকলে মায়ে পোয়ে তারা কোথায় ভেসে যেতো!—তা সেই বারো ভাতারি মা মাগীটা কি এতোকাল পরও তাকে রেহাই দেবে না? কিসের জিন, কিসের মাহাক্কাল, খানকি মাগী মা-ই আজ এসে তার ঈদের নামাজ পড়তে দিলো না। দেওয়াল থেকে বলকানো মাথাটা তুলে খিজির দ্যাখে রাস্তায় লোকজন নাই। তার শরীর একেবারে এলিয়ে পড়ে। তবে এই সময় সুভাষ বোস এ্যাঁভেনু বা হৃষিকেশ দাস রোড কি নন্দলাল দত্ত লেনের মুখে কোনো ট্রাকের অসহিষ্ণু হর্নের আওয়াজে খিজিরের কান চোখ গাল ঠোঁট সব ছিঁড়ে খুঁড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সমস্ত গতরটা আপনা-আপনি গোছগাছ হলে খিজির সোজা উঠে দাঁড়াতে পারে।
মহাজনের বাড়ি গেলে মহাজন রহমতউল্লা বা সায়েব আলাউদ্দিন প্রায় কিছুই বকাবকি করে না। আলাউদিনের কথায় বরং একটু প্রশ্রয়, বছরকার একটা দিন, বলদটা গ্যারেজের মইদ্যে কাটাইয়া দিলি? নামাজটা ভি পড়লি না?
‘আরে রাখো’ রহমতউল্লা সোজাসুজি কাজের কথায় আসে, এ্যাঁগো আবার নামাজ কালাম!—গাড়ি দিলে কয়টা? বাকি পসা পাইছস?
রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে আদায়-করা বাকি পয়সা গুণে নিতে নিতে রহমতউল্লা তার ক্ষোভ প্রকাশ করে, এ্যাঁগো আবার নামাজ। ঈমান নাই, এ্যাঁগো আল্লা-রসুলের ডর আছে? এবার কিন্তু খিজিরের সত্যি ভয় হয়। আল্লা-রসুলকে সরাসরি ভয় করার সাধ্য তার নাই। কিন্তু তার ঈমানের অভাবের কথা বলতে বলতে মহাজন যেভাবে তার দিকে তাকাচ্ছিলো তাতে সে বড়ো বিচলিত হয়। এর ওপর মহাজন তাকে ৫টা টাকা বকশিস দিলে খিজিরের গলা শুকিয়ে আসে। আধ ঘণ্টা এদিক ওদিক ঘুরে রহমতউল্লার কাছে গিয়ে বলে, মাহাজন। এই পাঁচ সিকা পসা দিবার কথা মনে আছিলো না। দেলোয়ার ইস্পোকের দাম দিয়া গেছে!’
মহাজনের মাধ্যমে গেথে-যাওয়া ঈমানের ভয় তবু তার কাটে না। রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে আদায় করা পয়সা এখনও তার কাছে রয়ে গেছে, ১টা আস্ত টাকার নোট, ১টা আধুলি, ১টা সিকি। ভাড়াইটাদের ঘরে ঘরে বাড়িওয়ালার পাঠানো খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় দ্যাখা প্রথম ভিখারির থালায় আস্ত আধুলিটা ফেলে দিলো। সকালবেলা রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে পাওয়া পয়সা থেকে হাতানে ৩টে টাকার বেশির ভাগই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় খিজিরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
চিলেকোঠার সেপাই – ০৭
খাওয়া শেষ করতে করতে ওসমান জিগ্যেস করে, খিজির তো এখানে অনেকদিন থেকে আছো, না?
সে তো বটেই। রহমতউল্লা মহাজনের বাড়ি, রিকশার গ্যারেজ, আলাউদিনের গ্যারেজ, এই বস্তি, কিছুদিন একনাগাড়ে রিকশা চালানো, আলাউদিনের গ্যারেজে ঢোকার পর রিকশার পর স্কুটার চালানো, রিকশা ও স্কুটারের যন্ত্রপাতি ঠিক করা, এই যে স্কু আর প্রায়ার আর নাট বন্টু, এই যে চেসিস আর ব্রেক আর টায়ার, এই যে এখানে স্কু বসানো, স্কুতে স্কু-ড্রাইভার ঘোরানো—এই তো চলছে কতোদিন থেকে। কতোদিন থেকে! কতোদিন থেকে কতোদিন থেকে!—খিজিরের মুণ্ডুটা তার গতরের ওপর একটা স্কুর মতো উল্টোদিকে খুলে যেতে থাকে।
খিজির সংক্ষেপে জবাব দেয়, বহুত দিন! আউজকার কেস?—ফালু মিস্ত্রীর সঙ্গে থাকতে থাকতেই খিজিরের মা মহাজনের ওখানে ঠিকা কাজের ব্যবস্থা করে নেয়। দুপুরবেলা এসে বাসন মেজে দিয়ে যেতো, ফালুমিস্ত্রির সায় ছিলো, তার মনিবের বৌ ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারেনি। খিজিরের মায়ের এই কাজ যোগাড় করে দেয় রহমতউল্লার বাড়ির বাধা মাতারি, এই মাতারির নিয়ে-আসা মৌলবির পানিপড়াতেই খিজিরের বিছানায়-পেচ্ছাব-করা বন্ধ হয়। বলতে গেলে রহমতউল্লার ভরসা পেয়েই খিজিরের মা ফালু মিস্ত্রীকে ছেড়ে চলে আসে। ফলে ঐ মাতারির চাকরিটা খোয়া গেলো। তখন থেকে তাদের খাওয়া-পরা, হাগা-মোতা সব এখানেই। মায়ে-পোয়ে সিঁড়ির নিচে গুটিমুটি হয়ে ঘুমাতো, তা হাত পা ছড়াবার অতো দরকারই বা কি? কিন্তু কোনো কোনো রাত্রে ঐটুকু জায়গা থেকে সে গড়িয়ে চলে আসতো বারান্দার দিকে। কখনো কখনো ঘুমের ভেতর কি নিমধুমে তার পায়ে কি হাতে খিজির অন্য কোনো শরীরের ছোঁয়া বুঝতে পেরেছে। ঘুমের ঘোরে একদিন সে মায়ের পিঠ ছুঁতে গিয়েছিলো। কিন্তু তার হাত ঠেকে মোটাসোটা ১টা পিঠে। আরেকদিন তার চিবুকে লেগে গিয়েছিলো শক্ত সমর্থ সেই হাত। ভয়ে সে ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি এই ডাক ঠিক স্পষ্ট হয়নি। বারান্দার দিকে সরে পাশ ফিরে জোড়াহাঁটুর মাঝখানে হাতজোড়া রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
এর একদিন পর একবার আড়ালে ডেকে মা বলে, মাহাজনের রিকশার গ্রাজ আছে না? আছে না? আমি কতো গেছি! এই তো এই বাড়ির পাচিল পার হইলেই গ্রাজ! রহমতউল্লার রিকশার গ্যারেজের বর্ণনা দেওয়ার জন্য খিজিরের উৎসাহের আর শেষ নাই।
গ্রাজ বলে রাইতে খালি থাকে? নাঃ রাইতে তোতামিয়া থাকে। তোতায় কয় গ্রাজের মইদ্যে মাহাজনেরে কইয়া মিলাদ পড়াইতে হইবো। জিনে বহুত জ্বালায়!
ঐগুলি কোনো কথা না’, এবার খিজিরের মা আসল কথা পাড়ে, ‘তুই মাহাজনের গ্রাজের মইদ্যে থাকবি, রাইতে থাকবি। মাহাজনের অনেকগুলি গাড়ি, কেউরে বিশ্বাস করবার পারে না!’
এইবার খিজিরের একটু ভয় করে, একলা থাকুম? ‘একলা থাকবি ক্যালায়? তোতামিয়া আছে না? মায়ের এই কথাতেই খিজির চুপ করে যায়। পরপর কয়েকটা রাত্রি গ্যারেজে কাটলো, খিজির রান্নাঘরে এসে মায়ের সঙ্গে খেয়ে যায়, তেমন করে কথা বলে না। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে খিজিরের মায়ের কেমন বাধো বাধো ঠেকে। একদিন বিবিসায়েবের চোখ এড়িয়ে সরিয়ে-রাখা মুরগির একটা রান ছেলের পাতে দিয়ে জিগ্যেস করে, রাইতে ডরাস?
‘না ডর কিয়ের? মুরগির রানে খিজিরের তখন অখণ্ড মনোযোগ। পারে তো হাড়ের গুড়ো সব গিলে ফেলে।
এসব কবেকার ঘটনা, কতোদিন আগে ঘটলো? দিন তারিখ খিজিরের মনে থাকে না, কিন্তু সেইসব ঘটনা দেখতে দেখতে তার লাল রেখা-উপরেখা কবলিত চোখজোড়া খচখচ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের রক্তে-ভাসা শরীরের ছায়া পড়ায় চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে ওঠে। খিজিরের চোখেই যেন তার মায়ের সব রক্ত মোছা হয়ে যাচ্ছে।
মায়ের রক্তপাত ঘটেছিলো শেষরাত্রে। খুব ভোরবেলা, প্রায় রাত থাকতে থাকতেই বিবিসায়েবের তলব পেয়ে ঘুম-জড়ানো চোখে খিজির গ্যারেজ থেকে এসে দ্যাখে যে, তার মায়ের কাপড়চোপড় সব কালো রক্তে মাখা। সকাল ৮টার মধ্যেই মহাজন তার দাফনের সব ব্যবস্থা করে ফেলে। মহাজনের অনেক পয়সা বেরিয়ে গিয়েছিলো। মাকে ধোঁয়াবার জন্য নতুন একটা বাঙলা সাবান কেনা হয়। কতো কপূর, কতো আতর, গোলাপজল, আগরবাতি। তখন মহাজনের ঘরে বংশালের বিবি। মহাজনের প্রথম বৌ। দিনরাত নামাজ রোজা অজিফার মধ্যে থেকে বিবিসায়েবের বয়স বেড়ে গিয়েছিলো অনেক, এর ওপর ১৩/১৪ বছরের একমাত্র ছেলে আওলাদ হোসেন মারা যাওয়ার পর পরপর দুটো মরা বাচ্চা হলো, এরপর শুরু হয় তার ছোঁয়াছুয়ির বাতিক। দিনের মধ্যে ৩ বার ৪ বার গোসল করা, ২৫ বার অজু করা আর ৫০ বার হাতমুখ ধোঁয়া। ওদিকে মহাজনের দ্বিতীয় বিবি বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরত,-সেও সতীনের ঘর করবে না। রহমতউল্লা তো বড়ো বৌয়ের কথা লুকিয়ে তাকে বিয়ে করেনি। তাহলে? অবশ্য এরকম একটা আভাস দিয়েছিলো যে, বড়ো বৌকে আলাদা বাড়িতে রাখবে। কিন্তু তাই কি হয়? ছেলেপুলে না-ই বা দিতে পারলো, সে হলো তার প্রথম স্ত্রী। তার বাপের পরামর্শ ও পয়সা দিয়েই রহমতউল্লা প্রথম রিকশা কেনে। এই বিয়ের পরই তার টাকা পয়সা আসতে শুরু করে, নামডাক হয়। বড়ো পয়মন্ত বিবি। তার ছোঁয়াছুয়ির বাতিক সহ্য না করে রহমতউল্লার উপায় কি? বড়ো বৌয়ের বাঁকা বাঁকা কথাতেও মহাজন কখনো রা করতো না। খিজিরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বড়ো বিবি বলে, ‘মায়ের লগে লগে থাকবার পারস নাই? তুই লগে থাকলে তর মায়ে এমুন কইরা তরে ছাইড়া যায় গিয়া? খিজিরের কিন্তু খুব অস্বস্তি ঠেকছিলো, বিবিসাবরে আউজকা না হউক ৫০ বার নাহাইতে হইবো! –কিন্তু ৫০ বার গোসল করুক আর ১০০ বার অজু করুক, সেদিন রাত্রে বিবিসায়েব নিজের ঘরের মেঝেতে শুতে দিয়েছিলো খিজিরকে। তার সামনেই বিবিসায়েব মহাজনকে বকে, হাবিয়া দোজখের মইদ্যেও তোমার জায়গা হইবো না আওলাদের বাপ! কি খাওইয়া দিছিলা, কও তো? তোমার আখেরাত নাই? গোর-আজাবের ডর নাই? মনে হয় পরকালে স্বামীর গতি নিয়ে বিবিসায়েব বড়ো উদ্বিগ্ন। বৌকে কাঁদতে দেখে রহমতউল্লা একটু বিব্রত হয়, ‘আরে আওলাদের মাও, তুমি এইগুলি কি কও? মইরা গেছে, কইতে নাই, আবার হাছা কথা না কইয়াও থাকতে পারি না, গলা নামিয়ে বলে, খারাপ মাইয়া মানুষ, কার লগে আকাম উকাম কইরা প্যাট বাধাইয়া বসছে, অহন প্যাট খসাইবার গেছিলো, গিয়া এই মুসিবত। খাড়াও না, চাকরবাকর, রিকশার ডেরাইভার উরাইভার ব্যাকটিরে আমি ধরুম!
থাউক। বিবিসায়েব চোখ মুছে বলে, পোলারে এইগুলি হুনাইয়া ফায়দা কি?
পোলায় কি ফেরেশতা? মায়ের কারবার পোলায় জানে না, না? এ্যাঁরে জিগাও তো, বাপের নাম কইবার পারবো? জিগাও না!
বিবিসায়েব জিগ্যেস করে না। মায়ের মৃত্যুর দোষে ও মায়ের মৃত্যুর শোকে খিজির এমনি নুয়ে পড়েছিলো, এর উপর বাপের নাম না জানার অপরাধ যোগ হওয়ায় সে একেবারে নেতিয়ে পড়ে। সে কি আজকের কথা? তবু দ্যাখো, জুরাইন গোরস্তানের কবরের ভেতর মাটিতে মাখামাখি কালো রক্তে ডুবসাঁতার দিতে দিতে ভুস করে ভেসে উঠে মা তার দিকে তাকায়। বেলাহাজ বেশরম মাগীটার শরম হায়া যুদিল এটু থাকো মওতের পরেও কি মানুষের খাসলত বদলায় না? —সেই কতোকাল আগে এসব কাণ্ড ঘটেছে, এর পর মহাজনের পয়লা বিবি এক শীতের রাতে আড়াই ঘণ্টা ধরে গোসল করে নিউমোনিয়ায় ভুগে মরে গেলো। এর মাস ছয়েক আগে থেকেই অবশ্য বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরাত মেয়েকে নিয়ে মহাজনের ঘরে এসে জাকিয়ে বসেছে। তা পয়া এই বিবিরও কম নয় এর আমলে মহাজন নবদ্বীপ বসাক লেনে সরকারী পায়খানা ও পানির পাম্পের পেছনে মস্ত বড়ো বস্তির মালিক হলো। খিজিরের মা মাগী আজও সেই বস্তিতে খিজিরের ভাড়াটে ঘরে আসে ছিনালীপনা করতে। বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, এখনো মাঝে মাঝে অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে নিমখুম নিমজাগরণে খিজির বুঝতে পারে যে, মোটাসোটা একটি হাত তাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে। মা—এই সম্বোধন করার জন্যে তার শ্লেষ্মা-জমা ও সিগ্রেটের ধোঁয়ায় কালি-মাখা গলায় ঝাপশা ধ্বনিপুঞ্জ জমা হয় এবং মাথার ওপরকার কেরোসিন টিনের ছাদকে তখন সে ধরে নেয় সিঁড়ির উল্টাপিঠ বলে। তবে এই হাল বেশিক্ষণ থাকে না। জুম্মনের মায়ের সশব্দে পাশ ফেরার আওয়াজে মা এবং অন্যজন হাওয়া হয়ে যায়। বাঁশের বেড়া ও ভাঙাচোরা টিনের ফাঁক দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়ে জুম্মনের মায়ের মুখের বাদিকে। বৌয়ের গোলগাল কালো মুখে বসন্তের কয়েকটি দাগে লুকিয়ে থাকে ঘোলা আলো। খিজির তখন ঘর্ঘর-করা গলায় ‘মা’ বলে বৌকে জড়িয়ে ধরে।
আজ জুম্মনের মায়ের সঙ্গে থাকতে পারলে ছিনাল মায়ের দাপটটা সামলানো যায়। বেলা তিনটে সাড়ে তিনটের দিকে জুম্মনের মা রোজ একবার ঘরে আসে, প্রায় ঘণ্টাখানেক থাকে। আজ কি তার আসবার সময় হবে না? এখন মহাজনের বাড়ি গেলে হতো। তাহলে জুম্মনের মায়ের সঙ্গে কি একবার দ্যাখা হয়!
খিজির বোধহয় সিঁড়ির সবগুলো ধাপও নামে নি, এরই মধ্যে ওপর দিককার ধাপগুলোতে কোলাহল শোনা যায় এবং এক মিনিটের মধ্যে ওসমানের ঘরে ঢেকে রঞ্জু।
*আপনে না বাইরে গেলেন। কখন আসলেন? ‘যেতে পারলাম না। নিচে নামছি, খিজির এসে হাজির। এখন যাচ্ছি। রঞ্জুর পেছনে রানু ও ফরিদা। ওরাই কথা বলছিলো বেশি। ওসমানকে দেখে দুজনে হঠাৎ থামে। ওসমানকে একবার দেখেই রানু চোখ রাখে আরেকটা দরজা পেরিয়ে ছাদে, সেখানে ছাদভাসানো রোদ। ওসমান বলে, তোমরা ছবি তোলো। চমৎকার রোদ আছে।’
ফরিদার পেছনে কচি কচি মার্কা চেহারা লম্বা একটি তরুণ। তার খয়েরি রঙের চাপা প্যান্ট, চেন-খোলা জ্যাকেট, গলায় বেগুনী-হলুদ সিন্ধের স্পার্ক। তার ঘাড় থেকে ঝোলানো ক্যামেরা, সারা শরীর থেকে সেন্টে ঝাঁঝালো গন্ধ বেরুচ্ছে। ছোকরা ওসমানের দিকে হাত বাড়ায়, আশিকুর রহমান বাদল, পাকিস্তান টোবাকোতে সেলসে কাজ করি। করমর্দন করতে করতে ওসমান নিজের নাম বলে এবং শুধু রঞ্জুর কাছ থেকে বিদায় চায়, তাহলে চলি।
রঞ্জুর হঠাৎ কি মনে হয়, বলে, নানা যাবেন কেন। আপনেও থাকেন না! ওসমান ইতস্তত করে, সে থাকবে কেন? ইয়ং হাজব্যান্ডও আহবান জানায়, আপনি থাকেন না! মোস্ট ওয়েলকাম।
রঞ্জুর উৎসাহ এতে বাড়ে, আপনে থাকেন। দুলাভাই আমাদের ছবি তুলবে, কিন্তু দুলাভাইয়ের ছবি তুলবে কে?
কিন্তু ক্যামেরা জিনিসটা চালানো সম্বন্ধে ওসমানের কিছুমাত্র ধারণা নাই। সে তাড়াতাড়ি বলে, আমার একটু কাজ ছিলো।’
রঞ্জু বলে, ঈদের দিন আবার কাজ কিসের? ফরিদার দিকে তাকিয়ে রানু আস্তে করে বলে, তোরে দেইখা ভয় পাইছে। লালচে হয়ে যাওয়া মুখ সত্ত্বেও ফরিদা হাসে, ভয় টয় পাইলে তোরেই পাইতে পারে। আমরা উনার আর কি করতে পারি?
ফরিদার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে রানু ওসমানকে অনুরোধ করে, আপনি থাকেন। এই দুইজনে একসঙ্গে ছবি তুলবে বইলাই তো আসছে। আসল তো এই দুইজন, আমরা ফাউ। আসল ছবি তুলবে কে? বলতে বলতে রানু হেসেই অস্থির।
ওসমান এবার কথায় বেশিরকম জোর দেয়, না, না। আমার একটা কাজ আছে।’ নিচে নামতে নামতে ওসমান ফের প্ররেমে পড়ে, এবার অন্যভাবে। এভাবে হুট করে চলে আসাটা ঠিক হলো না। রানুর শ্যামবর্ণ মুখের নীলচে ঠোঁটজোড়ার সব কৌতুক এতোক্ষণে নিশ্চয়ই নিভে গেছে। রঙুটাও মন খারাপ করবে। ক্যামেরা চালাতে না পারাটা কি অপমানজনক অযোগ্যতা? এ নিয়ে এতো জড়সড় হওয়ার কি আছে? শওকত সাইকেল চালাতে পারে না, কিন্তু তাই নিয়ে শওকত নিজেই কতো মজার মজার গল্প করে। অফিসের খলিলুর রহমান বেশ তোতলা, তা নিয়ে লোকটার সঙ্কোচ তো নাইই, বরং এই নিয়ে নিজেই কতো হাসিঠাট্টা করে! তো ওসমান এরকম পারে না কেন? —দাখো তো, রানুর এতো মিনতি ঠেলে সে চলে এলো। তালেব যেদিন মারা গেলো রঞ্জর ঠোঁট কি সেদিনকার মতো বেগুনি হয়ে গেছে? —আসলে এইসব ছবি তোলা, হৈ চৈ করা-কয়েক সপ্তাহ আগে নিহত ভাইয়ের শোক ভোলার জন্যেই তো এসবের আয়োজন। ঘরে তাদের মায়ের বিরতিহীন বিলাপ। বাপটা ঈদের নামাজ পড়ে এসে সেই যে বিছানায় শুয়েছে এখন পর্যন্ত করে সঙ্গে ভালো করে দুটো কথাও বলেনি। ফরিদা আজ স্বামীকে নিয়ে এসেছে কেন? বন্ধুর শোকটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু চাপা দিয়ে রাখার জন্যেই তো, তাই না? রানু তার সঙ্গ চেয়েছিলো, এখন সঙ্গ মানে বেদনার একটু ভাগ নেওয়া। তার ছোট্ট এই আবদারে ওসমান সাড়া দিতে পারলো না, ওসমানের এই প্রত্যাখ্যানে ভাইবোনের শোক ভুলে থাকার সমস্ত আয়োজনটাই পণ্ড হয়ে গেলো।—সিঁড়ির রেলিঙ ধরে ওসমান দাঁড়িয়ে থাকে। এখন যদি ও ছাদে যায় তো ওদের ছাইচাপা উৎসব আবার জ্বলে উঠতে পারে।
ঠাণ্ডা ও অন্ধকার সিঁড়িতে ওসমান বড়োজোর মিনিট তিনেক ছিলো। তিন মিনিট পরে রোদ-ভাসানো ছাদে উঠে ওর চোখে ধাঁধা লাগে, প্রথম কয়েক সেকেন্ড ভালো করে তাকাতেই পারে না। তারপর সব স্পষ্ট হলে দেখলে যে, এই কয়েক মিনিটে ওদের ছবি তোলার আয়োজন কী বিপুল পর্যায়ে উঠেছে ফরিদার বর ঐ ছোকরা এমন কায়দা করে ক্যামেরা ধরেছে যে, মনে হয়, ব্যাটা সত্যজিৎ রায় হবার জন্য স্টেজ রিহার্সেল দিচ্ছে। সত্যজিৎ রায়ের নাম জনিস নাকি ব্যাটা? দেখিস তো ওয়াহেদ মুরাদ-জেবা আর সুচন্দারাজ্জাকের ছবি ওসমানও অবশ্য এসবই দ্যাখে। তবে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি’ দেখেছে, টিকেট পায়নি বলে মহানগরী দ্যাখা হয়নি। ঐ ক্যামেরাম্যান শালা এসব ছবির নাম জানে? ওর পোজপাজে মেয়ে দুটো একেবারে মুগ্ধ। তারা একবার রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়, একবার হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে চলে পড়ে। এতো হাসির ছটা আর থামে না! ওসমানকে ফিরে আসতে দেখেও এদের হাসির কারণ কি থাকতে পারে? ওসমান এখন কি করবে? রঞ্জু বলে ডেকে ওদের দিকে এগিয়ে চলে। তার তো বলার কিছুই নাই। চুপচাপ আরেকটু এগুতেই রঞ্জু বলে, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, ক্যামেরার সামনে আইস পড়েন ক্যান? দ্যাখেন না বাদল ভাই ছবি তুলতাছে। ওসমানকে শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, রঞ্জ, মনে করে দরজাটা বন্ধ করে দিও কিন্তু।
ক্যামেরার লেন্স বোধ হয় ফরিদা, রানু, রঞ্জ এমনকি ছাদের রেলিঙ পৰ্যন্ত শুষে নিচ্ছে। এখান থেকে রানুর প্রোফাইলটা দ্যাখা যায়। শ্যামবর্ণের গালে রোদের ঝাপটা লেগে চামড়ার ওপর পাথরের এফেক্ট দিচ্ছে। ওর ঠোঁটে রোদের চিকন একটি আভা। উত্তেজনা, লজ্জা ও খুশিতে রানুর ঠোঁটজোড়া কাপছে। কি রোদ! রোদ মনে হয় কাচের পার্টিশনের মতো ওদের সবাইকে ওসমানের স্পর্শের বাইরে রেখে দিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওসমান এবার তাড়াতাড়ি নামে। সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিকেচার এই ছোকরার ক্যামেরার কারদানিতে ওদের যে ভক্তি দ্যাখা যাচ্ছে তাতে ভয় হয় যে, যাবার সময় দরজা বন্ধ করার কথা খেয়াল থাকবে না। রঞ্জকে আরেকবার তালা লাগাবার কথা বলে গেলে ভালো হতো। এখন ওসমানের সাধ্য কি ঐ উৎসবে ঢোকে? তালা টালা না লাগিয়ে চলে গেলে ওসমানের ঘরে যদি চুরি হয় তো রঞ্জু ও রানু বেশ অপরাধী হয়ে থাকে। তখন তাদের ক্ষমা করার একটা সুযোগ হয় ওসমানের। কিন্তু ওসমানের ভাগ্যে কি সেই সুযোগ আসবে?
চিলেকোঠার সেপাই – ০৮
বস্তিতে ঢোকার মুখে একটুর জন্যে গুয়ের ওপর খিজিরের পা পড়েনি। তার রাগ হয়, ‘এইগুলি জানোয়ারের পয়দা না কিয়ের বাচ্চা বুঝি না! এতো বড়ো একখান নর্দমা পইড়া রইছে, পোলাপানের হাত ধরাইয়া বহাইয়া দিলে কি হয়?
বস্তির প্রথম ঘরের দরজায় চার বছরের ন্যাংটা ছেলের পাছা ধুয়ে দিচ্ছিলো বজলুর বৌ। সিনেমার টিকেট ব্ল্যাক করা হলো বজলুর পেশা, ঈদের দিন স্বামীর মোট রোজগারের সম্ভাবনায় বজলুর বৌয়ের আজ দাপটই আলাদা, সে সঙ্গে কিচকিচ করে ওঠে, আটকুইড়া, হিজড়া মরদ, পোলাপানের তকলিফ বুজবো ক্যামনে? নর্দমার মইদ্যে পোলায় পইড়া গেলে তুলবো ক্যাঠায়?
জবাব না দিয়ে ঘরে ঢোকার জন্যে খিজির মাথা নিচু করেছে, এমন সময় ভেতর থেকে বাইরে উকি দিলো জুম্মনের মা। এক পলকের জন্যে বৌয়ের মুখ টাটকা দাখায়, মনে হয় কষে সাবান ঘষে মুখ ধুয়ে স্নো পাউডার মেখেছে। তার ভাঙা গালের নকশাই পাল্টে গেছে, তার কালো রঙের ওপর পাতলা ছাই রঙের আভা, কিন্তু জুম্মনের মায়ের তীক্ষ ও ছুচলো কণ্ঠস্বরে এই মুগ্ধতা আড়ালে পড়ে যায়, চোট্টার খানকিটার চাপার খাউজানি মনে লয় বাড়ছে। বাড়বে না? বাড়বে না ক্যালয়? তারপর ফজলুর বৌয়ের বাকশূহ বৃদ্ধির কারণ নির্ণয় করে সে নিজেই, চোট্টাগুলির আউজকা বেলাক করনের দিন! চান্দে চান্দে পুলিসের চোদন না খাইলে চোট্টাগো গতরের মইদ্যে ফোসকা পড়বো না? হাজত না চোদাইয়া বৌ পোলাপানের ভাত দিবার পারে না,-হেই চোট্ট মরদের মুখের মইদ্যে আমি প্যাসাব করি। তার ইজ্জত রাখার জন্যেই বৌ রুখে দাঁড়িয়েছে, বৌয়ের প্রতি খিজির তাই একটু গদগদ হয়, তক্তপোষে এলোমেলো করে পাতা কাঁথার ওপর একটু একটু করে শুয়ে পড়ে। পাশে বসতে বসতে জুম্মনের মা বলে, আঃ! সইরা শোও। খিজির একটি হাত রাখে বৌয়ের কোমরে। জুম্মনের মাকে নিয়ে ম্যাটিনিতে আজ সিনেমা দেখলে কেমন হয়? খিজির এতো সিনেমা দ্যাখে, জুম্মনের মাকে কোনোদিন সঙ্গে নেয়নি। স্টারে হীরা আওর পাথর খেলে মোহাম্মদ আলী-জেবার ছবি, চাল্লি হলো নিরালা। বৌকে এখন কথাটা বলে কি করে? এতো সিনেমা দেখেও কায়দা করে কথা বলাটা খিজির এ পর্যন্ত রপ্ত করতে পারলো না। তার শক্ত ও লম্বা আঙুলগুলো আনাড়ি বাদকের মতো বৌয়ের পিঠে বারবার ওঠানামা করে, ছেমরিটাকে যদি এভাবেই বাজিয়ে তোলা যায়। কিন্তু এর আগেই ঝনঝন করে ওঠে বজলুর বৌয়ের গলা, চোটাও হইতে পারে, বেলাক ভি করবার পারে। মগর ভাতার আমাগো একটাই একখান ভাউরারে গলার মইদ্যে সাইনবোর্ড বাইন্দা আমরা দুনিয়া ভইরা মানুষরে মারা দিয়া বেড়াই না। বজলুর বৌ কাজে যাচ্ছে, বিকালবেলা ২টো বাড়িতে তাকে বাসন মাজতে হয়, একটা বাড়িতে পানি দেয়। ছেলেটা এখন তার কোলে, খিজির তাকে জানোয়ারের বাচ্চা বলায় আজ মায়ের কোলে উঠতে পারলো।
বেড়ার সঙ্গে লটকানো ছোটো আয়নার সামনে জুম্মনের মায়ের কেশবিন্যাস অব্যাহত থাকে, ঠোঁটে চেপে ধরা রঙ-জ্বলা ফিতা হাতে নিতে নিতে সে বজলুর বৌয়ের শেষ বাক্যটি শোনে, আমরা আর মাইনষের বাড়ি কাম করি না, না? কৈ আমরা ইসনে পাউডার মাইখা খানকিটা হইয়া মাহাজনের বাড়ি যাই?
খিজিরের কান কুঁকড়ে আসে আবার হালার মাহাজন রহমতউল্লা মহাজনের বাড়ির কাজ থেকে জুম্মনের মাকে ছাড়িয়ে আনাটা খুব জরুরি। বজলুর বৌয়ের এই সব কথা শুনতে শুনতে তার একেকবার ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে,–কিন্তু কি ইচ্ছা করে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু ভাবতে পারে না। শুয়ে শুয়েই শক্ত হাতে তার বাহুমূল ধরলে জুম্মনের মা বলে, ছাড়ো কিন্তু হাতটা সে ছাড়িয়ে নেয় না। শুধু বলে, জোয়ান মরদটা দুপুরবেলা ঘরের মইদ্যে হুইয়া থাকো, শরম করে না?
এবার তার কথা একটু নরম। খিজির আরেকটু কাছে ঘেঁষে, তরে হুইতে মানা করছে ক্যাঠায়?
আল্লাদ! কাম আছে না? কতোগুলি মানুষ আউজকা খাইতাছে। আল্লারে আল্লা। মাহাজনের বাড়ি কতো মেহমান আহে। মহাজনের বাড়িতে অতিথি সমাগমের একটি দীর্ঘ তালিকা দিতে দিতে জুম্মনের মা উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। বেশির ভাগই শরীফ লোক, তসতরির সেমাই ছোয় কি ছোয় না, প্লেটের পোলাও আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়াই করে, জিভ পর্যন্ত তোলে না। কিন্তু বাসন তো মাজতে হয়। ঈদের দিন দামী দামী সব বাসন বার করা হয়েছে, জুম্মনের মা ছাড়া সেসব মাজবে কে? বিবিসায়েব ভরসা করবে আর কার ওপর? কড়ি কড়ি বাসন মাজার কথা বলতে বলতে জুম্মনের মায়ের বুক ফুলে ওঠে, না যাই গিয়া।
বৌয়ের ফুলে-ওঠা সিনা দেখে খিজিরের চোখে ঘোর লাগে, একটু জড়িয়ে ধরে, ‘আউজকা সায়েবে আমারে ছুটি দিছে। সায়েবের থন বেবি ট্যাক্সি লইয়া বারামু, যাইবি? এক্কেরে নিউ মার্কেট, শাহবাগ, রমনার মাঠ ঘুরাইয়া আনুম, যাইবি? এয়ারপোর্ট ভি যাইবার পারি। ক্যামনে পেলেন উঠে দেখবি? যাইবি? আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য স্কুটার দেবে না, তবে রিকশা একটা পাওয়া যাবে। বৌকে বেবি ট্যাকসির কথাই বলা ভালো। যাইবি?
ঢাঙা রোগা স্বামীর এই আহ্লাদ বচনে জুম্মনের মায়ের শরীর একটু শিরশির করে বৈ কি! সে চুপ করে থাকে। এমনকি কাপড় জামা ভেদ করে খিজিরের একটি হাত তার স্তন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলে সে বরং একটু এলিয়েই পড়ে। কিন্তু নাঃ। মহাজনকে চটানো ঠিক হবে না। মহাজনের ভারি হাতের চাপে তার দমবন্ধ হবার জোগাড় হলে কি হয়, জুম্মনকে তো তার কাছে এনে দিতে পারে মহাজনই। ছেলে তখন তার কাছে থাকবে; মহাজনের বাড়িতে, গ্যারেজে কতো কাজ, ঢুকিয়ে দেবে কোথাও। তারপর? তারপর, বড়ো হলে মহাজন একটা রিকশা কিনে দেবে।–রিকশার ভাড়া দিতে হবে না, এমনকি লাইসেন্সের পয়সাও দেবে মহাজন।-গতকাল চাদের রাতে মহাজন নিজে তাকে কথা দিলো, হাজার হলেও নামী দামী মানী লোক, সে কি ফালতু কথা বলবে?
রাত তখন অনেক। রাত পোহলেই ঈদ। জোগাড়যন্ত্র করতে করতে জুম্মনের মায়ের বলে হাসফাস উঠে গেছে। ঠিকা ঝি আবুলের মা ছেলের এ্যাঁকসিডেন্টের খবর পেয়ে চলে গেছে রাত ১০টার আগেই। আস্ত একটা খাসির নানারকম তরকারি, দশ সের গরুর গোশতের ভুনা, কাবাবের কিমা, কয়েকটা মুরগি!-মশলা বাটা চলছে তো চলছেই। সকালবেলার জন্যে সেমাই ভাঁজছে জুম্মনের মা, নামাজে যাবার আগেই সবাই সেমাই খাবে -এটা সেটা করতে করতে রাত্রি হলো ১টা কি দেড়টা। বসার ঘরের দরজার কোণে টেলিভিশন দেখতে দেখতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আবদুল, একটু রাত হয়ে গেলে জুম্মনের মাকে এগিয়ে দিয়ে আসে সে-ই। সব গুছিয়ে আবদুলকে ডাকতে জুম্মনের মা বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ির গোড়া পার হবার সময় মহাজন ডাকলো, ‘যাস?
তার কণ্ঠ শুকনা ও কাপাকাপা। রহমতউল্লা ফের বলে, যাস গিয়া? তারপর গায়ের শালের নিচে থেকে কাগজের একটা প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে ধরে, ‘ল। মহাজন তার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে, হঠাৎ তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, বহুত মেহনত হইছে, না? তার গলা এত কাপছিলো যে, এই কথায় কোনো দরদ ফোটে না। ফের বলে, ‘ল। তরে দিলাম। সেতারার মায়ে জানলে হাউকাউ লাগাইয়া দিবো। ব্রেসিয়ারের প্যাকেট হাতে নিতে নিতেই জুম্মনের মা টের পায় জিনিসটা কি? সেতারা তাকে একবার একটা দিয়েছিলো; সেতারার ব্যবহৃত, তবে তেমন পুরনো হয়নি। কিন্তু এইসব ছেমরি রঙঢঙ যতোই করুক, এদের সিনা দেখলে মনে হয় পুরুষ মানুষের সিনাও এদের চেয়ে উঁচু। আজ মহাজন তাকে ঐ জিনিস দিলো একেবারে নতুন। লোকটা তার পিঠে হাত দিয়ে নিজের শরীর ঘেঁষে টেনে নেয়, ঘাড়ের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বলে, কাউলকাতর পোলারে একবার দেখবি না? খিজিররে কইস নিমতলা না কৈ থাকে কামরুদ্দিন, খিজিরে গিয়া আর ঘর থাইকা লইয়া আইবো’ মহাজনের ভারি হাতের তলায় তার ঘাড়ের ভেঙে পড়ার দশা ঘটে। সেই ঘাড়ে মহাজন একটা চুমু খায়, তার বুকে হাত রেখে বলে, সিনা তর ফাস্ট কেলাশ। ঐটা পিন্দলে দেখবি কেমুন লাগে। তারপর ফের জুম্মনের প্রসঙ্গ তোলে, নিচু গলায় ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে মহাজন জুম্মনকে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দেওয়ার জবান দেয়। একটু বড়ো হলে তাকে রিকশা কিনে দেবে, ঘর দেবে।—মহাজনের নিশ্বাসের ভাপ লেগে তার গাল গরম হয়ে ওঠে। সে সিটকা মেরে দাঁড়িয়ে থাকে, নিশ্বাস ছাড়তে জুম্মনের মায়ের অসুবিধা হয় না, কিন্তু নাক দিয়ে বাতাস টেনে নেওয়ার কাজটা যেন কতো কঠিন এর মধ্যে একবার ভয় হয় দোতলা থেকে বিবিসায়েব যদি হঠাৎ এসে পড়ে। এখান থেকে দ্যাখা যাচ্ছে আবদুলকে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে ব্যাটা মহাসুখে ঘুমায়, তার মুখ ফাক হয়ে রয়েছে, আবার মহাজনের কাণ্ডকারখানায় চোখজোড়া ফাক না হয়! এই সময় রান্নাঘরের ভেতর থেকে বিড়ালের আওয়াজ পাওয়া যায়, ম্যাও।’ মহাজন হঠাৎ করে তাকে ছেড়ে একটু পিছিয়ে বসে এবং বিকট হাক ছাড়ে, আবদুল আবদুল! ওঠা এ্যাঁরে ঘরে দিয়া গ্যারেজে যা গিয়া গ্যারেজ খালি পইড়া রইছে!
মহাজনের সেই হাকে জুম্মনের মা যে দারুণ রকম চমকে উঠেছিলো আজ এই এখন পর্যন্ত তার রেশ যায়নি। খিজিরের দিকে একবার তাকিয়েই সে মাথা নিচু করে বলে, ‘আউজকা তুমি জুম্মনরে একবার আনতে পারব?
জুম্মনরো জুম্মনের কথা ওঠায় বৌকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণের উৎসাহ খিজিরের প্রায় নিভে যায়। মাগীটা তার ছেলের কথা একেবারে ভুলতে পারে না। ছ্যামরা এসে তো খিজিরের ঘাড়েই পড়বে, ওটাকে সামলাবে কে? ছেলের জন্যে অতোই টান তো ঐ কামরুদিনের ঘর করলেই তো পারতো! আবার ৭/৮ বছরের এই পিচ্চির ওপর রাগ পুষে রাখতেও নিজেকে কেমন চোর চোর মনে হয়। গলায় একটু ঝাঁঝ এনে জিগ্যেস করে, জুম্মনে মালীবাগ থাকে না?
না। নিমতলীর কাছে রেল লাইনের লগে বস্তি আছে না? ঐ বস্তির মইদ্যে থাকে। ওস্তাগরে না মালীবাগে ঘর লইছিলো? ওস্তাগর বলে কামরুদিন সম্বন্ধে খিজির একটু টিটকিরি করলো। কামরুদিন আসলে জোগানদার, কিন্তু কথাবার্তা বলে শালা ওস্তাগরের স্টাইলে। দাদা পরদাদা নাকি কলতাবাজারের সেরা ওস্তাগর ছিলো, সেই দাপটে কামরুদিন যখন তখন বৌ পেটতো। মালীবাগ খিলগায়ের দিকে আজকাল খুব দালান তৈরি হচ্ছে, তার নাকি কাজের শেষ নাই, ঐদিকে ঘর ভাড়া না নিয়ে তার উপায় কি? ব্যাটা আবার নিমতলী গেলো কবে?
আগের স্বামীর প্রতি বর্তমান স্বামীর এই শ্লেষ গায়ে না মেখে জুম্মনের মা বলে, কাম করতে করতে ভারা থাইকা পইড়া গিয়া অহন জোগানদারি করবার পারে না, একখান পাও বলে ভাইঙ্গা গেছে।’
পাও ভাঙছে! কথার ভঙ্গিতে ঠাট্টা অব্যাহত রাখলেও খিজিরের খারাপ লাগে। কামরুদিন কিন্তু তার সঙ্গে কোনোদিন তেমন খারাপ ব্যবহার করেনি।
অহন কি করে?
কায়েতটুলির মইদ্যে হুনি ডাইলপুরি ভাইজা বেচে। জুম্মনের মা একটু হেসে বলে, যাইবা? জুম্মনেরে লইয়া একবার আমারে দ্যাখাইতে পারো? বছরকার একটা দিন, কি খাইবো, ক্যাঠায় দেখবো? বৌয়ের এই ভিজে ভিজে কণ্ঠস্বর খিজিরের ঠিক পরিচিত নয়, এতে সাড়া দেওয়ার নিয়মকানুনও তার অজানা। ছোটো চোখজোড়া যতোটা সম্ভব বড়ো করে জুম্মনের মা ফের বলে, পোলাটারে বাপে যা জুলুমটা করে! তুমি একবার আনব? মাহাজনে কইছে আরে কামে লাগাইয়া দিবো। গ্যারেজের মইদ্যে থাকবো, ডাঙর হইলে একখান গাড়ি কিন্যা দিবো। ভাড়া উড়া লাগবো না, যা কামাইবো অরই থাকবো।
মহাজনের কথা ওঠায় খিজির একেবারে উঠে বসলো। জুম্মনের ওপর ঠিকমতো রাগ করতে বাধো বাধো ঠেকেছিলো, মহজনের ওপর সেই রাগ দিব্যি দশ গুণ উস্কে ওঠে, আবার মাহাজনে আহে ক্যামনে? মাহাজনের কথা কইতে না পারলে খোমাখান খাউজায়, না? খিজিরের এই আক্রমণের পরও জুম্মনের মা আধ মিনিট চুপচাপ ছিলো। কিন্তু ছেলের দরদে বুদ হয়ে বসে থাকাটা তার পোষায় না, একটু সামলে নিয়ে সে ক্যাটক্যাট করে ওঠে, এইগুলি কি কও? তোমার মুরাদ হইবো? আমার পোলারে কাছে রাখবার মুরাদ হইবো তোমার? গোলামি করস মানুষের, চোপাখান বানাইছস নবাবের বাচ্চার।’
মাগী কি কইলি? আবার ক! খানকি মাগী সাইজা গুইজা মাহাজনের লগে রঙ করতে যাস, না? কিয়ের জোরে রোয়াবি মারস? কিন্তু জবাব না দিয়ে মাগী দুপদাপ করে বেরিয়ে যায়।
যতোই রাগ হোক, বৌকে খিজির মহাজনের বাড়ি থেকে ছাড়িয়ে আনে কি করে? কতোদিন আগে তার মা খিজিরকে নিয়ে এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলো। না হলে ফালু মিস্ত্রির কিল চড় খেতে খেতে এ্যাঁদিন কোথায় ভেসে যেতো কে জানে? তারপর ধরো, জুম্মনের মায়ের সঙ্গে তার বিয়েটা দিলো কে? জুম্মনের মা এ বাড়িতে আসে কাজ করতেই, তাতে কামরুদিনের সায় ছিলো ষোলো আনা। যতোই রোয়াবি করুক, রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগানদারের কাজ করে বাঙলা মদ টানা আর কান্দুপট্টি মারা, তারপর বৌপোলা সামলানো অতো সোজা নয়। তবে জুম্মনের মা প্রথম প্রথম সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরে যেতো, কামরুদিন তখন কলতাবাজারে নিজেদের পৈতৃক বাড়ির ১টা অংশেই বাস করে। বড়োলোকের বাড়ি কাজ করে মাস তিনেকের মধ্যে জুম্মনের মায়ের গায়ে গোশত লাগে, এর মধ্যে তার ২টো শাড়ি জুটেছে, সেতারার স্নো পাউডার মাখে একটু সুযোগ পেলেই। তখন রাত্রে কান্দুপটি-ফেরত কামরুদিনের হাতে মার খেতে তার আর ভালো লাগতো না। রুগ্ন বিবিসায়েবের খেদমত করার কথা বলে বিবিসায়েবের ঘরের মেঝেতে সে রাত কাটাতে শুরু করলো। একদিন সন্ধ্যার পর কামরুদিন টলোমলো পায়ে মহাজনের বাড়ি এসে রান্নাঘর থেকে বৌয়ের চুল ধরে ছ্যাচরাতে ছ্যাচরাতে রাস্তায় নামায়। জুম্মনের মায়ের চ্যাচামেচিতে রাস্তায় ভিড় জমে যায় এবং বিবিসায়েব পর্যন্ত তার হাঁপানি ভুলে ‘কেয়া হইস রে? কেয়া হইস রে? বলতে বলতে নিচে নামে এবং তার প্রেরণা ও প্ররোচনায় বজলু, খিজির, আবদুল—এরা একজোট হয়ে কামরুদ্দিনকে বেশ ভালোরকম প্যাদানি দেয়। এরপর লোকটা অনেকদিন আর এমুখো হয়নি। পৈতৃক বাড়ির ভাগ কোন চাচাতো না মামাতো ভাইয়ের কাছে বেচে দিয়ে মহাসুখে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়।
বেশ কিছুদিন পর এক বর্ষার রাতে, অনেক রাত্রি, মহাজনের গ্যারেজে এসে কামরুদ্দিন খিজিরকে ডেকে তোলে। খিজির সেদিন একা, তার একটু ভয় ভয় করছিলো, লোকটা সেদিনকার বদলা না নেয়। কিন্তু নাঃ জুম্মনের মাকে একটা খবর দেওয়ার জন্যে সে খিজিরকে নির্দেশ দেয়। কি খবর?-না, কামরুদিন গত রাতে যে মেয়েকে বিয়ে করেছে জুম্মনের মা তার বাদি হওয়ারও যোগ্য নয়। এই খবর দিয়ে সে চলেই যাচ্ছিল, ফের ঘুরে এসে বলে, তর মাহাজনেরে কইস আমি আইছিলাম। আমার নাম কামরুদিন ওস্তাগর, আমার বাপের নাম হাসমত আলি ওস্তাগর, দাদার নাম লাল মোহাম্মদ ওস্তাগর, পরদাদার নাম নায়ু ওস্তাগর। নবাব বাড়ির গম্বুজটা বানাইছিলো নায়ু ওস্তাগরে, বুঝলি?তর মহাজনে খুব বড়ো লোক হইছে, না। অর দাদার নাম জিগাইস তো, কইতে পারবো না!
জুম্মনের মাকে পাঠানো খবরটা খিজির যথারীতি পৌঁছে দেয়। কিন্তু রহমতউল্লাকে দাদার নাম আর জিগ্যেস করতে পারেনি। খিজির নিজের বাপের নাম জানে না, সে জিগ্যেস করবে মহাজনের দাদার নাম? তবে কামরুদিনের এই সব কথাবার্তা মহাজনের কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। শুনে রহমতউল্লা প্রথম প্রথম খুব হাম্বিতাম্বি করছিলো, ইচ্ছা করলেই কামরুদিনকে সে জেলের ভাত খাওয়াতে পারে। এক বৌ থাকতে জোগানদার হালা আবার সাদী করে কোন সাহসে? আইয়ুব খান নতুন নিয়ম করেছে, দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্যে প্রথম বৌয়ের অনুমতি দরকার। রহমতউল্লা হলো আইয়ুব খানের বিডি মেম্বর, সে নিজে যদি এসব বিষয়ে লক্ষ না করে তবে দেশের লোকের আইন অমান্য করার প্রবণতা তো বেড়েই যাবে। কিন্তু সমস্যা বাধায় মহাজনের বিবি জুম্মনের মাকে রাখাটা তার দরকার, খিজিরের সঙ্গে জুম্মনের মায়ের বিয়ের উদ্যোগ নেয় বিবিসায়েব।
খানদানি ঘরের মেয়ে এই বিবিসায়েব বারো মাসের রোগী। সতীনের সঙ্গে ঘর করবে না বলে বিয়ের ২বছর পর ৬ মাসের মেয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলো বাপের বাড়ি, সতীন মরার আগে আগে স্বামীর ঘরে আসে। সঙ্গে ৪০ ভরি সোনা, ১মাত্র মেয়ে এবং হাঁপানি। রোগে ও দুঃখে সে প্রায় সব সময় হাঁপায় এবং হাপানির সংক্ষিপ্ত বিরতিকালে সশব্দ নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গতে তার বেগমবাজারের খানদানি বাপের বাড়ির মোরগপোলাও এবং নবাব বাড়ির কুবলির সাদৃশ্য, তার বাপের বাড়ির খাস্তা ও লজিজ মোরগ কাবাবের সঙ্গে তার ননদের হাতের রাধা দড়ির মতো শক্ত চিকেন টিক্কার তুলনা, হঠাৎ-বড়োলোকদের জাফরানের বদল রঙ দিয়ে জরদ রান্না করার ছোটোলোকামি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজস্ব মতামতসমৃদ্ধ আলোচনা করে এবং নিজের রোগ ও ভাগ্য নিয়ে তীব্র অসন্তোষ জানায়। ক্লাস নাইনে ২বার ফেল করার পর সেতারা পড়াশোনা চালিয়ে যাবার অসারতা বেশ বুঝে ফেলেছে। সকাল বিকাল প্রসাধন এবং যখন তখন রেডিও সিলোন ও বিবিধভারতী শোনা ও উদৃত্ত সময়ে মন ভার করে থাকার পর সে কোন কাজটা করার সময় পায়? জুম্মনের মাকে ছাড়া মা-মেয়ের একদণ্ড চলে না। বুকটা একটু বেশিরকম উঁচু হলেও এবং যখন তখন তার বুকের কাপড় পড়ে গেলেও বিবিসায়েব তাই তাকে সহ্য করে। মাতারটা এমনি খুব কাজের, একটা কাজের কথা একদিন বলে দিলেই চলে। আবার এমনিতে বেশ সাফসুতরো। খিজিরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সময় বিবিসায়েব মহাজনকে দিয়ে খরচও করালো, গ্যারেজের কর্মচারী ও রিকশাওয়ালদের বাকেরখানি ও অমৃতি খাইয়ে দিলো। বিবিসায়েবের জন্যে এসব কিছু না। তাদের বেগমবাজারের বাড়িতে এককালে বিড়ালের বিয়ে দিতেও তার বাপ ৫০০০ টাকা খরচ করেছে।
এতো খরচ করে তার বিয়ে দিলো, বড়োলোকের মতি, ১০টা দিনও যায়নি, গ্যারেজে রিকশাওয়ালাদের সামনে মহাজন খিজিরকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলো। কি ব্যাপার? চুতমারানি, আমারই খাইবি আমারই পরবি, আমি ঘর না দিলে জায়গা নাই, আর আমার লগে নিমকহারামি করস?
কিভাবে? মহাজন তাকে জিগ্যেস করে, মহল্লার মইদ্যে দেওয়ালে পোস্টার লাগাইছে ক্যাঠায়? খুব বাইড়া গেছস, না?
পোস্টার লাগাতে দিয়েছিলো তাকে আলাউদ্দিন মিয়া। সঙ্গে দুজন ছাত্র ছিলো, আলাউদ্দিন খুব সাবধান করে দিয়েছিলো, পুলিস যেন না দেখে। খিজিরের ইচ্ছা ছিলো লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সবগুলো দেওয়ালে পোস্টার সেটে ভিক্টোরিয়া পার্কের নতুন শহীদ মিনারের উঁচু গম্বুজে উঠে চারদিকে বেশ সাজিয়ে বাকি পোস্টার সব লাগবে। কিন্তু ছাত্র ২জনের তাতে আপত্তি, অতো উঁচুতে তাকিয়ে পোস্টার পড়বে কে? এদিকে মোসলেম হাই স্কুলের দেওয়াল পর্যন্ত আসতেই পার্কের ওপারে কয়েকজন পুলিস দ্যাখা গেলো, ওরা সঙ্গে সঙ্গে চম্পট। বাকি পোস্টারগুলো খিজির রেখে দিয়েছে গ্যারেজের ভেতর, রিকশার বাতিল গদির নিচে, সুযোগমতো পুরনো কাগজওয়ালার কাছে বেচবে। মহাজন এতো চেতবে-এটা কিন্তু খিজির ধারণা করতে পারেনি। মহাজন বলে, তরে অক্ষণ ধরাইয়া দেই তো কয় বছরের জেল খাটতে হইবো, জনিস? পুলিসের অভাবে মহাজন নিজেই এই সব তৎপরতার বিরুদ্ধে বক্তৃতা ঝাড়ে, মানষে বোঝে না। এইগুলি ইন্ডিয়ার মতলব ওয়ারে ডিফিট খাইয়া ইন্ডিয়া অহন এই ট্যাকটিস ধরছে। ছয় দফার পোস্টার মারস, আরে ছয় দফা হইলে পাকিস্তান থাকবো? আমরা পাকিস্তানের লাইগা ফাইট করছি, পাকিস্তান হইছে, মোসলমানের ইজ্জত হইছে! আবার দ্যাহো, কতো মানুষ চাকরি পাইলো, ব্যবসা বাণিজ্য তেজরতি কইরা কতো মালপানি বানাইলো পাকিস্তান না আইলে ফকুরনির বাচ্চাগুলি হিন্দুগো গোলামী করতো। আমরা মালপানি বানাইবার পারি নাই, ক্যান? সে সমবেত রিকশাওয়ালাদের প্রশ্ন করে, পারলাম না ক্যান? উত্তরদাতাও সে নিজেই, মিয়ারা, ব্যাক দিবার পারি, মগর ঈমানটা? এবারও সে নিজেই উত্তর দেয়, না, এইটা দিবার পারুম না। এইটা আমার! ধন দৌলত বড়ো কথা না, বুঝলা? ট্যাহাপসা প্যাসাবের ফ্যানা, এই আছে এই নাই। নানারকম অপ্রাসঙ্গিক কথার পর সে নিজের বক্তব্য সংক্ষেপে জানায়, বহুত লিডার দেখছি! মালপানি কেউগায় কম কামায় নাই। আহন লাগছে পাকিস্তানটারে মিসমার করনের তালে। ইন্ডিয়ায় মাল ছাড়ে, আর এইগুলি গাদ্দারের পয়দা খালি ফাল পাড়ে।’
মহাজনের এই চাপাবাজির সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে আলাউদিনের বাড়ি সার্চ করে পুলিস তাকে ধরে নিয়ে গেলো। তখন তার গ্যারেজের দায়িত্ব নিলো রহমতউল্লা। রহমতউয়ার হুকুমে আলাউদিনের গ্যারেজ দ্যাখাশোনা করতে হলো খিজিরকেই। ৭ মাস পর ফুলের মালা গলায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে আলাউদ্দিন খিজিরকে আর ছাড়ে না, তার অনুপস্থিতিতে লোকটা চমৎকার ম্যানেজ করেছে। রহমতউল্লার অনুমতি নিয়ে খিজিরকে সে নিজের গ্যারেজে নিযুক্ত করে, মামার বস্তিতে তার জন্য একটা ঘর ভাড়ারও ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু জুম্মনের মাকে মহাজন ছাড়বে না। জুম্মনের মা না হলে তার বিবিসায়েবের ঘর সংসার চালানো কঠিন। এর মধ্যে কতো কি ঘটলো, আলাউদ্দিন মিয়া স্কুটার কিনলো, তিন মাসের মধ্যে তার দুটো স্কুটার হলো। খিজির কখনো রিকশা চালায়, কখনো স্কুটার। তা খিজিরেরও উন্নতি হয়েছে বৈকি। রিকশা বা স্কুটার চালাবার ফাঁকে ফাঁকে আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজের সামগ্রিক দ্যাখাশোনাটা তার দায়িত্বে। কিন্তু জুম্মনের মা মহাজনের বাড়ির কাজ আর ছাড়তে পারে না। খালি খালি মহাজনকে দোষ দিয়ে লাভ কি? ঘরের বৌ-সে কি-না তড়পায় খালি মহাজনের বাড়ি যাবার জন্যে। ঈদের দিন স্বামী কি খাবে না খাবে সেদিকে তার কোনো নজর আছে?–বৌয়ের ওপর রাগে খিজির বিছানায় উঠে বসে, তখন তার চোখ পড়ে ঘরের কোণে রাখা গামছায় জড়ানো গামলার দিকে। থালার নিচে গামলায় পোলাও ও মুরগির ১টা আস্ত রান। মাগী রানটা সরালো কিভাবে?-রান খেতে খেতেও বৌয়ের ওপর খিজিরের রাগ কমে না। আরে সে তো স্বামী, নিজের পেটের ছেলের দিকেও কি মাগীর কোনো খেয়াল আছে? ছেলে পড়ে আছে কোথায়, আজ তার জন্যে বার দুয়েক ফ্যাচফাচ করে কেঁদে মা তার ডিউটি শেষ করলো। জুম্মনটা থাকলেও কাজ হতো, মহাজনের কজা থেকে বৌকে বার করে আনার জন্যে ছামরাটাকে লাগিয়ে দিলে হয়।
হাপুশ ছপুশ করে খাওয়া শেষ করে খিজির গেলো আলাউদ্দিন মিয়ার বাড়ি। সায়েব তখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে একপাল ছেলে। খিজিরকে দেখে সায়েব ধমক দেয়, ‘তুই থাকস কই? ২৪ নম্বরে তাজুদিন সাবে আইছে, আমারে খবর দিছে, আমার ফিরতে দেরি হইতে পারে। বড়ো আপা পোলাপান লইয়া আইছে, মামুগো বাড়ি থাইকা অগো সাত রওজা পৌছাইয়া দিস, নয়া বেবিটা বাইর করবি!’
সায়েবের বোনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নাজিমুদিন রোডের মাথায় রেলগেটের কাছে স্কুটার রেখে খিজির জুম্মনের খোজে বস্তিতে ঢুকলো। কোথায় জুম্মন? এই বস্তিতে কামরুদ্দিনকে কেউ চেনে না।
আলিমুদ্দিন আছে একজন, আলিমুদিনের কথা কন না তো? আলিমুদিনে তো তরকারি বেচে, সিগন্যালের লগে ঘর তুলছে। এই সব কথোপকথন চলে, কিন্তু জুম্মনের খবর পাওয়া যায় না। রেললাইনের ২দিকে লম্বা বস্তি, লাইনের মাঝে মাঝে ৩/৪ জন করে লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, কোথাও কয়লা ভরা কড়াইয়ের আগুনের সামনে বসে হাত সেকে কয়েকটি মেয়ে। কোনো কোনো ঘর থেকে ধোয় ওঠে; ধোঁয়ায়, কুয়াশায় ও অন্ধকারে মোড়ানো সারিসারি বেড়ার ঘর, ঘরের ওপর ইট-চাপা ভাঙাচোরা টিনের কিংবা বাঁশের চাল। ধোঁয়ার সঙ্গে কুয়াশার সঙ্গে স্থায়ী একটি দুর্গন্ধ বস্তির সীমানা নির্দেশ করে। খিজির এর মধ্যে হাঁটে এবং প্রায় সবাইকে কামরুদিনের কথা জিগ্যেস করে। লোকজন তার সামনে আসে, এমনকি নাজিমুদ্দিন রোডের আলোকিত রাস্তা ভুলে শিশুরা রেল লাইনে দাঁড়িয়ে খিজিরকে দ্যাখে।
না, কামরুদিনরে না আইলেও চলে। অর বৌ, বাড়ি বাড়ি কাম করে।’ লোকজনের উৎসাহ থাকে না। বাড়ি বাড়ি কাজ করার মাতারির অতিথি এসেছে, তাকে অতো খাতির না দ্যাখালেও চলে। তাদের নিজেদের বৌরাই তো এই কাজ করে। ঘুরতে ঘুরতে রাত্রি বাড়ে, খিজিরের পায়ের নিচে কখনো রেলের কাঠের স্লিপার, কখনো পাথর। আকাশে চাদ নাই, রেললাইনের ধারে ল্যাম্পোস্ট নাই। বড়ো রাস্তার একদিকের ল্যাম্পোস্ট থেকে আলো আসে, আলোর তলানি, তাতে বস্তির জবুথরুঘরগুলোকে ট্রাকে ওল্টানো রিকশা বলে ভুল হতে পারে। শহরের মাঝখানে ঘোলা আলোর ভেতর, পথহীন ও যানবাহনশূন্য এরকম ১টি জায়গায় ২রেলের মাঝখানে কাঠের স্লিপার বা পাথর-মেশানো মাটিতে হাটতে হাটতে খিজির আলি প্রতিটি ঝুপড়ির দিকে তীব্র চোখে তাকায়, জুম্মনকে দেখতে পেলেই ছো মেরে তুলে নেবে। বস্তির এ-মাথা ও-মাথা করতে করতে সে ঘোরের মধ্যে পড়ে এবং এরকম কতোক্ষণ যে তাকে ঘুরতে হতো কে জানে? কিন্তু লুঙি-পরা, ঈদের দিনেও দাড়িনা-কামানো, ভাঙাগাল ১টি লোক তাকে জিগ্যেস করে, লাগবো সাব?
খিজিরের ঘোর কেটে যায়, ভয়ও কাটে। লোকটি ফের বলে, ‘খালি খালি ঘুরাঘুরি করতাছেন। আমার লগে আসেন। গেরস্থ ভালো মাল আছে!’ লোকটি তাকে ভদ্রলোকের মর্যাদা দেওয়ায় খিজির খুশি হয়, অবাকও হয়, বিচলিত হয় আরো বেশি। গৃহস্থ ঘরের এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে শোৰে কি-না খিজির এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই লোকটি ভালো করে তার চেহারা দেখে কেটে পড়ে।
চিলেকোঠার সেপাই – ০৯
নাজিমুদিন রোডের মাথায় পৌঁছে খিজির দ্যাখে তার স্কুটারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১টি তরুণ দম্পতি। মেয়েটির মুখে ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়েছে, একবার দেখেই চোখ নামিয়ে খিজির বেবি ট্যাকসির ভেতরে বসতে যাচ্ছে, পুরুষটি বললো, ইন্দিরা রোড যাবে?
‘না।‘
‘চলো’ পুরুষটি বেশ ডাঁটের। দামী পাজামা পাঞ্জাবির ওপর কারুকাজ করা ছাইরঙ শাল। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। এই চেহারার মানুষের হুকুম অমান্য করা কঠিন। মেয়েটার ধবধবে ফর্স গায়েও লাল শাল। মিহি ও আদুরে গলায় সে বলে, চলোনা ভাই।’ স্টার্ট দিতে গিয়েও খিজির থামে, একটু আগে ঐ ভাউরা শালা যে গেরস্থ ঘরের মেয়ের কথা বলছিলো সে কি দেখতে এরকম হতো? ‘চলেন।
মহিলার পর লোকটি উঠতে উঠতে বলে, মিটার ঠিক নেই?
আজকার দিনেও মিটার লাগবে? ঈদের দিন বেশি দিয়েন সাব।’
মিটার চালাও মিটারটা কি শো? লোকটির এই গম্ভীর আদেশ শুনে মহিলা মন্তব্য করে, ডেকোরেশন, অর্নামেণ্ট! এই ২টো ইংরেজি শব্দে স্বামী-স্ত্রী হেসেই গড়িয়ে পড়ে। সারা পথ জুড়ে এমনি হলো। লোকটি কি বলে আর মেয়েটি হাসতে হাসতে একেবারে কাত হয়ে পড়ে। আবার মেয়েটি কি বলে আর লোকটি হেসে লুটোপুটি খায়। ভদ্দরলোকেরা যে কতো ছুতোনাতায় হাসে। কিন্তু যতোই হাসুক আর যতোই কথা বলুক, তাদের এই হাসি ও কথা খিজিরের কানে ধ্বনির অতিরিক্ত কিছু তৈরি করতে পারে না। স্কুটারের পটপট আওয়াজ ও নরনারীর হাসিকথার মিলিত ধ্বনি ১টি অখণ্ড ধ্বনিপ্রবাহ হয়ে বেজে চলে খিজিরের একটানা ভাবনার পেছনে জুম্মনকে পাওয়া গেলে এখন গাড়িতে থাকতো সে-ই। গাড়িতে উঠিয়ে কয়েক গজ যাওয়ার পরই খিজির তাকে লজেন্স কি বিস্কিট কিনে দিতো। ভদ্রলোকদের ছেলেমেয়েরা আজকাল খুব কাঠি-লজেন্স খায়। জুম্মন একটা চুষতে চুষতেই গাড়ি ওদের বাড়ির সামনে চলে আসতো। বস্তির কাছে বেবি ট্যাকসি রেখে লাফিয়ে নামতো খিজির। কয়েক পা হেঁটে বস্তিতে ছুকেই হাঁকডাক শুরু করতো, জুম্মনের মাও, দেইখা যা, কারে ধইরা লইয়া আইছি, দ্যাখ্য’ জুম্মনের মায়ের জবাবটাও তার জানাই আছে, কোন মরারে লইয়া আইছ ককার দিবার লাইগা? এসব শুনেও খিজির একটুও রাগ করতো না। সে তো জুম্মনকে ভেতরে ঠেলে দিলেই এই কবর দেওয়ার কথা বলার জন্য জুম্মনের মায়ের খুব খারাপ লাগতো। খিজির দাঁড়িয়েই থাকতো, বৌয়ের প্রতিক্রিয়াটা সে দেখবে। জুম্মনের মায়ের চোখে পানি টলটল করে, সে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে-এরকমভাবে বৌকে সে কোনোদিন দ্যাখেনি। চোখে টলমল পানি নিয়ে ছেলেকে ধরে সে গড়িয়ে পড়তো স্বামীর বুকে, এ্যাঁরে তুমিকৈ পাইলা? ক্যামনে আনলা? খিজির চোখ ভরে সেই ছবি দেখতো। এই ছবি দেখতে দেখতে সে রাস্তা বেয়ে চলে। ইউনিভারসিটি এলাকায় লোকজন নাই। পাবলিক লাইব্রেরী পার হলো, ডানদিকে পাতলা কুয়াশা-টাঙানো রেসকোর্স। মাথায় ও চোখে অভিভূত জুম্মনের মা। —একবার আরোহী ভদ্রলোকের ধমকে সে পেছনে তাকায়, ‘সাইড দাও না কেন? হর্ন শুনতে পারো না? তারপর পাশে তরুণীকে বলে, ঈদের দিন বোতল টেনে চুর হয়ে আছে! মেয়েটি খিলখিল করে হাসে। ভদ্রলোকের বেঝিরা এতোও হাসতে পারে। পেছনের গাড়ির অসহিষ্ণু হন এবং আরোহীদের ধমক, ঠাট্টা ও হাসি, কিন্তু খিজিরের গতিশীল বেবি ট্যাকসির সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা ও কান্নায় ভেঙে-পড়া জুম্মনের মাকে একটুও টলাতে পারেনি। কিন্তু একটু সাইড পেয়ে সাদা জিপ তাদের ঠিক সামনে এসে ব্রেক কষতেই জুম্মনের মা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। হয়তো তার ছবি জিপের ওপরেও প্রতিফলিত হতো, তার আগেই শাদা জিপ থেকে লাফিয়ে নামে তিনজন যুবক। জায়গাটা ঠিক কোথায়?-আর্ট কলেজ পার হয়ে বা দিকে খালি জায়গা, এখানে বহু পুরনো একটা ঘর, ঘরের পাশে অনেকদিনের পরিচিত পচা ও মিষ্টি একটা গন্ধ, নিজের নাভিতে আঙুল ঘুরিয়ে আঙুল শুকলে খিজির এই গন্ধ পায়। সেই গন্ধ, দাঁড়িয়ে থাকা সাদা জিপ এবং নিয়নের তরল-সাদা আলোতে পাতলা কুয়াশা খিজিরকে সম্পূর্ণ চিত্রশূন্য করে ফেলে। একটি যুবকের পরনে ধূসর রঙের চাপা প্যান্ট ও কালো জ্যাকেট। হাতের রিভলভার সামনে তুলে শক্ত গলায় সে হুকুম দেয়, রাখো! ল্যাম্পোস্টের
ফাঁকে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে। সেই আলোতে রিভলভারওয়ালার মুখ বেশ স্পষ্ট তার ফর্স টিকলো নাকের নিচে এক জোড়া পাতলা মেয়েলি ঠোঁট। তার পেছনে আরো দুজন যুবক, এদের পরনে যথাক্রমে নেভি-রু প্যান্ট ও লাল পুলওভার এবং প্যান্ট ও কালো কোট। শেষ যুবকটির চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা এবং তাতে ড্যাগার। সে এসে দাঁড়ায় খিজিরের পেছনে, তরুণ আরোহীকে জিগ্যেস করে, এতো রাত্রে মেয়েছেলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
ইঞ্জিন থামা শালা শুওরের বাচ্চা কেটে পড়ার তালে আছে, না?–রিভলভারওয়ালার এই হুকুমে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ইঞ্জিনও কি তার বশ? কখন কিভাবে যে ইঞ্জিন বন্ধ হলো
সে কথায় আমল না দিয়ে আনোয়ার বলে, তাহলে ছয় দফাই তোমাদের ফাইনাল? ছয় দফা দিয়ে সাধারণ মানুষের লাভ কি হবে?
আলতাফ জবাব দেয়, আমাদের সমস্ত দুর্ভোগের কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। ছয় দফায় বাষ্ট্রীয় কাঠামো এমন করার ব্যবস্থা রয়েছে যাতে একটি অঞ্চল আরেকটি অঞ্চলকে শোষণ করতে না পারে। আমরা যা উপার্জন করবো খরচ করবো আমরাই। আমাদের টাকা পাচার হয়ে যেতে পারবে না। ট্যাক্স বসাতে পারবো আমরা। বাইরের দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবো আমরা। প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে বাঙালি ব্যবসা করেনি?’
বলতে বলতে আলতাফের গলা থেকে রাগ কিংবা বিরক্তি ঝরে পড়ে। সে খুব অভিভূত, আবেগে তার গলা জড়িয়ে আসে, বাঙালি এককালে জাভা, বালি, সুমাত্রায় যেতো মশলা কিনতে, নিজেরা কাপড় নিয়ে যেতো বিক্রি করতে। বাঙালি তাতীর তৈরি কাপড় ইউরোপে বেস্ট কোয়ালিটি কাপড় বলে দাম পেয়েছে। সেই দক্ষতা আমরা আবার দাখাবো। ওয়েস্ট পাকিস্তান আর্মির পেছনে বাঙালির রক্ত-পানি-করা টাকার অপচয় ঘটবে না। আমরা আলাদা আর্মির কথাও বলেছি।’
আনোয়ার বলে, ‘হ্যাঁ, বাঙালি আর্মির পেছনে পিপলের টাকা খরচ হবে, তাতে মানুষের লাভ কি?
সেটা নির্ভর করবে আমাদের ওপর। বাঙালি আমি আমাদের লোক, আমাদের মানুষের সেনাবাহিনী। আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের নির্যাতন করবে কেন?
শোষণ কি কেবল আঞ্চলিক? এখানে প্রধানত এবং প্রথমত তাই।
তাহলে কোটি কোটি বাঙালি যে হাজার হাজার বছর ধরে এক্সপ্লয়টেড হয়ে আসছে সে কার হাতে? দেশের ভেতরেই এক্সপ্লয়টার থাকে, বিদেশীর কোলাবোরেটার থাকে। গ্রামে গ্রামে থাকে। জমিতে থাকে, মিল ফ্যাক্টরি হলে সেখানেও থাকবে। ট্যাক্স বসাবার রাইট চাও? কে বসাবে?-কার ওপর?-এই দুই বাঙালি কি একই ধরনের? শোনো, যারা কাপড় বুনেছে, তারা বাইরে গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করেনি। তারা কাপড় পরতেও পারতো না ঠিকমতো। বাঙালি সেনাবাহিনী হলেই বাঙালির উদ্ধার হবে? বাঙালি আর্মি তখন চেপে বসবে বাঙালির ওপরেই, বাঙালি ছাড়া আর কার ওপর দাপট দ্যাখাবার ক্ষমতা হবে তার? পাঞ্জাবি সোলজারের উর্দু গালাগালি শুনতে খারাপ লাগে, বাঙালি কর্নেল সায়েব বাঙলা ভাষায় শুওরের বাচ্চা বললে কি তার পা জড়িয়ে ধরে বলবো, আ মরি বাঙলা ভাষা তোমরা ওয়েস্ট পাকিস্তানের হাত থেকে ইম্যানসিপেশনের কথা বলছো, কিন্তু কাঁদের জন্যে?
ইস্ট পাকিস্তানের পিপলের জন্য। না। ট্যাক্স বসাবার রাইট পিপল পায় না, পিপলের রাইট শুধু ট্যাক্স দেওয়ার। বাঙালির হাতে পাওয়ার চাও তো? মানে বাঙালিদের এক্সপ্লয়েট করার লাইসেন্স চাও?’
*ক্ষমতা মানেই শোষণ নয়। ক্ষমতা যদি তোমার লক্ষ্য না থাকে তবে এই সব আন্দোলন করার উদ্দেশ্য কি?
ড্যাগারধারী বলে, তাহলে তো আরো ভাল। ভাবীর সংগে একটু প্লেজার ট্রিপ মেরে আসবো। আপনি ওয়েট করেন, ম্যাটার অফ এ্যাঁন আওয়ার।’
এই শীতল বাক্য সুদর্শন আরোহীর কানে ঢুকেছে কি-না বোঝা গেলো না। নীলডাউন হওয়ার ভঙ্গিতে বসে সে হাত জোড় করে, আপনাদের পায়ে পড়ি ভাই। আমি একজন সেকশন অফিসার। বিশ্বাস করেন। ভাই শোনেন-।
আপনার ভাই আবার কে? পা ছেড়ে দিন বলছি। প্লীজ স্যর প্লীজ বি কাইন্ড এ্যাঁন্ড মার্সিফুল সার। আমি একজন সেকশন অফিসার সার, মিনিস্ট্রি অফ হোম, গভর্নমেন্ট অফ ইস্ট পাকিস্তান। আপনারা কাল সেক্রেটারিয়েটে আসেন, কালতো ছুটি, বুধবার আসেন, আমি গেটে পাস পাঠিয়ে দেবো, ডবল প্রোটেকটেড এরিয়ার গোলাপি রঙের পাস সার। আপনাদের কোনো সার্ভিসে আসতে পারলে স্যর-।
তার কথা শেষ হতে না হতে ছুরিধারী বলে, আপনি সেকশন অফিসার? আমি আপনার মিনিস্ট্রির জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর ২জনকে দেখিয়ে সে বলে, ঐ যে আপনার সেক্রেটারি, আর উনি আপনার চীফ সেক্রেটারি। নীলডাউন অবস্থাতেই সেকশন অফিসার ৩ জনের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ৩বার স্লামালেকুম স্যর’ বলে।
ড্যাগারধারী বলে, জাস্ট এ সেকশন অফিসার প্রমোশন পাওয়ার জন্যে বৌকে বসের বেডরুমে পাস করবি না? এখন থেকে প্রাকটিস কর!’ রিভলভারধারী তাদের আস্তে করে ধমক দেয়, মিসবিহেভ করো কেন? গো এ্যাঁহেড!’ তারপর সেকশন অফিসারকে আশ্বাস দেয়, নাথিং টু ওরি এ্যাঁবাউট। আমাদের ম্যাক্সিমাম এক ঘণ্টা। কুইক মেরে দেবো।
মেয়েটিকে পাজাকোলা করে তুলে ৩ জনের এই তরুণসমাজ উল্টোদিকের ফুটপাথে চলে যায়। ফুটপাথ ধরে একটু এগিয়ে রেসকোর্সের কাঠের রেলিঙ ডিঙিয়ে ফের সামনের দিকে হাটতে শুরু করে। কুয়াশায় তাদের আর দ্যাখা যায় না।
তরুণ আরোহীর সেই নীলডাউন অবস্থা তখনো কাটেনি। খিজির বলে, চলেন সার, থানায় যাই গিয়া। নীলখেত ফড়ি তো কাছেই।
লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। খিজির ফের বলে, চলেন, যাই। লোকটি তখন রাস্তায় ধপাস করে বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে কাঁদতে শুরু করলো। তার কানের কাছে মুখ রেখে যতোটা সম্ভব নরম করে খিজির বলে, চলেন যাই। অখনও টাইম আছে। থানায় চলেনা চলেন।
কান্নায় সাময়িক বিরতি দিয়ে লোকটি ফোপাতে ফোপাতে জবাব দেয়, এদের চেনো? এরা সব এনএসএফের গুণ্ডা। আইয়ুব খানের বাস্টার্ড মোনেম খান, মোনেম খানের বাস্টার্ড এরাt’
খিজির তাড়া দেয়, ‘লন যাই। ইউনিভারসিটির এতোগুলি হল এহানে পোলাপানেরে খবর দিই। চলেন সাব!’
লোকটির ফোপানে কণ্ঠস্বরফের গুমরে ওঠে, না। তা হয় না। আরো বিপদ হবে। ওরা এক ঘণ্টা ওয়েট করতে বললো না? এসে আমাকে না পেলে ফায়ার হয়ে যাবে চাকরি বাকরির কথা সব বলে ফেললাম, শুওরের বাচ্চারা আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে দেবে!’ লোকটি ফের হাতে মুখ গুঁজে ফোপায়, এরা ডেঙ্গারাস, মোস্ট পাওয়ারফুল! ফের নতুন উদ্যমে কাঁদবার প্রস্তুতি নিলে নিজের স্কুটারে ফিরে আসা ছাড়া খিজিরের কোনো কাজ থাকে না। তুমি আমাকে একা রেখে চলে যেও না ভাই! —লোকটির এই মিনতির জবাবে সে বলে, অরা আপনাগো গাড়ি কইরা পৌছাইয়া দিবো! ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে এক্সিলেটর থেকে হাত উঠিয়ে খিজির ফের রাস্তায় নামে, সায়েব, ভাড়াটা?
ভাড়া? তরুণ রাজকর্মচারী হাত থেকে মুখ তুলে অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকায়। মিটার দেইখা ভাড়াটা দিয়া ফালান? প্রচণ্ডরকম বিস্ময় ও মর্মাঘাতে লোকটির মুখের খুচরা-খাচরা পার্টস ওলট-পালট হওয়ার উপক্রম ঘটে। পকেট থেকে টাকা বের করে ভিজে গলায় সে বলে, তোমরা মানুষ না! মানুষ হলে এ সময় কেউ– ‘
স্কুটার রাস্তায় গড়িয়ে দিলে খিজির তার উক্তিকে স্বীকার করে চিৎকার করে, না। আমরা কুত্তার বাচ্চা, মানুষ হইলেন আপনেরা!