দশনামী প্রভুগণে বন্দিয়া পবিত্র মনে
গিরিসেনা দাড়ায় কাতারে।
ভবানী নামিল রণে পাঠান সেনাপতি সনে
গোরা কাটো আদেশে হুঙ্কারে।
ভবানীর কণ্ঠধ্বনি মৃগরাজধ্বনি জিনি
গর্জনে শার্দুলে লজ্জিত।
সেই ডাকে চঞ্চল মানাস নদীর জল
হইল গোরা শোণিতে রঞ্জিত।
কোম্পানির গোরাসবে পাঠাঁইয়া যমভবে
জলে প্রভু করে আচমন।
বন হইতে সঙ্গোপনে গোরাগণ আক্রমণে
প্রভু সেথা ত্যাজিল জীবন।
গিরিগণে নামে জলে যতনে লইল কোলে
কৃষ্ণ কোলে যেন শত রাই।
পাষাণে হৃদয় বান্ধো কান্দো গিরিগণে কান্দো
ভবানী পাঠক ভবে নাই।
কীর্তনের সুরে হাওয়ার ভ্যাপসা ভাব কাটে, এতে কামলাদের কাস্তের ধার বাড়ে এবং বৈকুণ্ঠের শেষ কথা না-আ-আ-ই-এর লম্বা টানে তমিজের বাপ কেটে ফেলে ধানের মোটা মোেটা আঁটি। এমন কি ভবানী পাঠকের মৃত্যুর শোকে বৈকুণ্ঠের পানের পিক-গেলা গলা চিরে গেলেও তাতে ঘাতকের বিরুদ্ধে ক্রোধ মেশানো থাকায় তার ঝঝে প্রত্যেকের কাস্তের গতি বাড়ে। গান থামার পর গোটা মাঠের হাওয়া এসে ঝাপটা মারে আমগাছের পাতায় পাতায় ও ধানের শীষে শীষে। কেঁচড় ভরা মুড়ি আর বাতাসা আর খাগড়াই নিয়ে বৈকুণ্ঠ সাবগ্রামের দিকে রওয়ানা হলো তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে।
এখন এই এতোক্ষণ পর, এই মধ্যরাতে তুমুল আওয়াজে বমি করতে করতে তমিজের বাপের সামনে বৈকুণ্ঠ গিরির লেশমাত্র ছায়া নাই। গানের কথাগুলি সে বার করে নেয় তার বমির আওয়াজ থেকে। এই গানে তমিজের বাপের রোগাপটকা শরীরে এমনি কাঁপুনি ওঠে যে উঠে দাঁড়াবার বলটুকু তার থাকে না, উঠতে গেলে সে পড়ে যায় চৌকাঠেই। তার মাথা পড়ে থাকে মাচার অন্য প্রান্তের খুঁটির সঙ্গে ঠেকানো এবং পা ঠেকে চৌকাঠে। ঘুম থেকে উঠে আসা তমিজ তন্দ্রা জড়ানো গলায় অক্ষেপ করে, বুড়া হয়া মরবার ধরিছে, জিভার লালচ এখনো গেলো না। এখন আত হচ্ছে কতো, আরো কতবার যে ওঠা লাগবি আল্লাই মালুম। তার উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ কথা তমিজের বাপের কানে নিশ্চয়ই ঢোকে; কিন্তু মশার ভনভনানি, ঝিঝির ডাক, বাঁশঝাড়ের অবিরাম শনশন আওয়াজ, ডোবার পানিতে ঘুমিয়ে-থাকা খলসে পুটি বেলে মাছের চমকে ওঠায় পানির উত্তেজনা এবং তমিজের ঘুমে-জড়ানো জিভের কথার সঙ্গতে তার কানে বাজতে থাকে এলোমেলো ছন্দের একটানা সুর,
পাষাণে হৃদয় বান্ধো কান্দো গিরিগণে কান্দো
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইল সকল ঠাঁই।
বিবিবেটা নিন্দে মগন ফকির ঘরত নাই।
হায়রে ভবানী পাঠক ভবে নাই।।
০৬. নিজের গ্রামে বর্গাচাষী
খিয়ারের খেতমজুর থেকে নিজের গ্রামে বর্গাচাষী হওয়ার হাউস মেটাতে তমিজকে শুনতে হয় মেলা কথা। তার নাই গোরু, নাই লাঙল জোয়াল মই; বীজচারা কেনার পয়সাও নাই, লোকে তাকে জমি দেয় কোন ভরসায়? তমিজ জোড়হাতে কারুবারু করে, এখন মণ্ডল তাকে এসব দিক, ধান উঠলে ফসলের ভাগাভাগি করে সব কিছুর দাম ধরে না হয় কেটে নেবে।
তা নেওয়া চলে, এতোকাল যে একেবারে চলে নি তাও নয়। কিন্তু শরাফত মণ্ডলের বড়ো বেটা আবদুল আজিজ বড়ো হুঁশিয়ার মানুষ। সে থাকে জয়পুরে, জয়পুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি, জমিজমার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, জমির মাপজোঁক থেকে শুরু করে খাজনা ট্যাকসের আঁটঘাট আর ফাঁকফোকর তার মতো জানে এমন মানুষ লাঠিডাঙার কাছারিতেও কেউ আছে কি-না সন্দেহ। গোরু, লাঙল, জোয়াল, মই, বীজ ধানের দামের আধাআধি সে আগাম দাবি করে। গোরু নাই, লাঙল নাই, তবু বর্গা করার সখ? ঠিক আছে, করো। কিন্তু শর্ত মেনে জমিতে নামো।
আবদুল কাদের বলে, এরা তো অনেক দিনের মানুষ। এর বাপও আমাদের বাড়িতে এক সময়–।
কিন্তু চাষাদের বাড়াবাড়ি সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে, টাউন হয়ে করতোয়া পেরিয়ে ঐ দাপাদাপি এই পুব এলাকায় আসতে আর কততক্ষণ? খিয়ার এলাকায় চাষারা ফসলের ভাগ চায় দুইভাগ, নিজেরা দুইভাগ নিয়ে জমির মালিকের গোলায় তুলে দিয়ে আসবে এক ভাগ। তা চাও; চাইতে তো আর ট্যাকসো লাগে না। কিন্তু একটা কথা,-জমি তো আর হেঁটে হেঁটে জোতদারের বাড়িতে এসে হাজির হয় না। একি কামারপাড়ার অর্জুনগাছের বক যে উড়াল দিয়ে বিল পেরিয়ে এসে বসলো মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছে? এক এক ছটাক জমি করতে মানুষের শরীরের এক এক পোয়া রক্ত নুন হয়ে বেরিয়ে যায়, সে খবর রাখো? জাহেল চাষার গো আবদুল আজিজ দেখে খিয়ার এলাকায়। সেই গোঁ এখানকার চাষার শরীরে চাগিয়ে উঠতে কতোক্ষণ? কাউকে খাতির। করার দরকার নাই, নিয়ম অনুসারে জমি বর্গা নাও। না পোষালে কেটে পড়ো।
আবদুল আজিজের এসব উদ্বেগ আর ভবিষ্যদ্বাণীর জবাব তমিজ দেবে কী করে? আবদুল কাদের যে আবদুল কাদের, যে কি-না ইংরেজিতে নিজের নাম এক টানে লেখে এম. এ. কাদের, সভাসমিতি করা মানুষ, সুযোগ পেলেই মানুষকে ধরে ধরে হিন্দুর জুলুমের কথা ফাঁস করে দেয়, সেই জুলুম থেকে বাঁচতে মুসলিম লীগের নিশানের নিচে সবাইকে জড়ো হতে বলে, সে পর্যন্ত খালি নাক খেটে আর মাথা চুলকায়। হাজার হলেও ভাইজান তার চাকরি করে জয়পুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে, ডান হাত বাম হাত দুটোই তার ভারী সচল। কয়েক দিনের জন্যে বাড়ি আসায় সকালে হাগার পর ছোচা ছাড়া বাম হাতের কাজকাম বন্ধ, সেই নিস্ক্রিয়তার শোধ সে তোলে জিভ আর টাকরার অবিরাম ব্যবহার করে।
পশ্চিমে ধান কাটতে গিয়ে আধিয়ারদের কাণ্ডকারখানা তো তমিজ দেখে এসেছে। নিজের চোখেই, এসব দাপাদাপি সে নিজেই কি আর পছন্দ করে? জমি হলো জোতদারের, ফসল কে কী পাবে সেটা তো থাকবে মালিকের এখতিয়ারে। অথচ ফসলের বেশিরভাগ দখল করতে আধিয়াররা নেমে পড়ে হাতিয়ার হাতে। তাদের ফন্দি ঠেকাতে এবার পাঁচবিবিতে কয়েকজন জোতদার ধান কাটতে জমিতে কামলা লাগিয়েছিলো নিজেরাই। পুব থেকে গিয়ে তমিজও এক জমিতে কাজ পেয়ে গেলো। জোতদার নাকি পুলিসের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছিলো। তা পুলিস যাবে আর কতত জায়গায়?-সেদিন ভালো মজুরির চুক্তিতে আপখোরাকি কাজে নেমেছিলো তমিজ। ধুমসে কাজ করছে, যত তাড়াতাড়ি পারে ধান কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু দুপুর হতে না হতে এতোগুলো মানুষের হৈ হৈ শুনে ভাগ্যিস সময়মতো দৌড় দিয়েছিলো। চাষাদের বৌঝিরা পর্যন্ত ঝাটা খুন্তি বঁটি নাকড়ি নিয়ে তাড়া করে। ধানখেতের ভেতর দিয়ে, কাটা ধানের আঁটি ডিঙিয়ে এবং কখনো সেগুলোর ওপর পা রেখে ছুটতে না পারলে ঝটা কি খুন্তির দুই একটা ঘা কি তমিজের গায়ে পড়তো না? কয়েকটা বাড়ি যে পড়ে নি তাই বা কে জানে বাপু? মেয়েমানুষের হাতে মার খেয়ে কেউ কি তা চাউর করে বেড়ায়? ওদের ঝাঁটার ঘা খেয়ে কিংবা কোনোভাবে এড়িয়ে জোতদারের উঠানে ওঠার আগে থেকেই আধিয়ারদের এরকম বাড়াবাড়ি তমিজের একেবারেই ভালো লাগে নি। জমি হলো লক্ষ্মী, লক্ষ্মীর বেটাবেটি হলো তার ফসল। সেই ফসল নিয়ে টানাটানি করলে জমির গায়ে লাগে না? ফসল হলো জমির মালিকের জানের জান। তাই নিয়ে টানাহ্যাচড়া করলে বেচারা বাচে কী করে? মাঝির বেটা বলে জমির বেদনা বুঝবে না বললে তমিজ খুব কষ্ট পায়। তার বাপ দাদা পরদাদা সব মাছ ধরে খেয়ে এসেছে, এটা ঠিক। তার জন্মের অনেক আগে নাকি পোড়াদহ মেলার সবচেয়ে বড়ো বাঘাড় মাছটা আসতো তার বাপের দাদা বাঘাড় মাঝির হাত দিয়ে। এই কারণে সম্মানসূচক মানুষটার নামটি তমিজের বাপ, অর্জন করে এবং এমন কি আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও তার আসল নামটি চাপা পড়ে যায়। পূর্বপুরুষের এই খ্যাতি ভোগ করেছে তমিজের বাপ অব্দি। তমিজের। জন্মের আগে পর্যন্ত তমিজের বাপকে সবাই চিনতো বাঘাড় মাঝির লাতি বলে, তার পরিচয় পাল্টে যায় তমিজের জন্মের পর। তবে তমিজকে সবাই চেনে তমিজ বলেই।