কুলসুম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, তমিজের বাপ আসে।
কালাম মাঝি কুলসুমের এরকম নির্বিকার জবাবে চমকে উঠে আশেপাশে তাকায়। সেঁক গিলে বলে, মরা মানুষ আসবার পারে? ইগলান কী কও?
আসে। রাত করা আসে।
সেদিনই কালাম মাঝি সাব্যস্ত করে রাতে এই মেয়েটিকে এই ঘরে একলা থাকতে দেওয়া যায় না। বৌকে ডেকে বলে, মরা হোক আর জেতা হোক, রাতত বেওয়া মেয়েছেলের ঘরত মানুষ আসে, এটা তো ভালো কথা লয়। তুমি ওর এটি থাকার বন্দোবস্ত করো। কুফা ঘর রাখা যাবি না।
কালাম মাঝির বৌ কুলসুমকে নিয়ে আসতে রাজি হয়, বরং একটু উৎসাহই দেখায় কিন্তু ওই ঘরের দখল নিতে তার আপত্তি আছে। এমনিতে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তারা একঘরে হয়ে পড়েছে, তমিজের বাপের ঘর কেড়ে নিলে মাঝিপাড়ার মানুষ খেপে যাবে, তমিজের বাপও চোরাবালির ভেতর থেকেই উৎপাত করতে পারে। কালাম মাঝি দেখা যাক, সেটা আমি বুঝমু। বললেও তহসেনের সৎ মা বোঝে, স্বামী তার হুঁশিয়ারিটা অন্তত আপাতত মেনে নিয়েছে।
তবে যে যাই বলুক, কেরামতের কিন্তু মনে হয়, তমিজই রাত করে কুলসুমের ঘরে আসে। যে রাতে কুলসুমের ঘরে সে কথাবার্তা শুনেছিলো তার পরদিন সকালে কুলসুমের সারা মুখে ছিলো খুশি খুশি আলো। সে হলো কবিমানুষ, যুবতীর চেহারা দেখে তার চাহিদা আর তৃপ্তি যদি বুঝতে না পারে তো এতোকাল শোলোক বাঁধলো কি বাল ছিড়তে? তমিজের বাপের কাছে কুলসুম সারাটা জীবন কী পেয়েছে। এখন সুদে আসলে তাই পুষিয়ে নিচ্ছে বুড়া হাবড়ার জোয়ান ছেলের কাছ থেকে। তারপর, তাকে দেখে। মাঝিপাড়ার ছোঁড়ারা তারই বাধা শোলোক বলে, মাঝি বিনা বিল আর জল বিনা মাছ/ নরস্পর্শ বিনা নারী পুষ্প বিনা গাছ। নিজের বাঁধা এইসব শোলোক শুনলে তার ভয় করে, শালা তমিজ ছাড়া মাঝিদের এভাবে চেতাবে আর কে? কুদুস মৌলবির মতো মানুষ পর্যন্ত কালাম মাঝির সামনেই একদিন বলে, আজ শিমুলতলার ঘাটেত মেলা কয়টা চ্যাংড়া একত্তর হছে। জাল লিয়া গেছে, সোগলি দেখি কেরামতের শোলোক কচ্ছে। শুনে কেরামতের গলা শুকিয়ে আসে। কালাম মাঝিকে চটিয়ে সে এখানে থাকতে পারবে না, মাঝি পাড়ার বাস উঠে গেলে কুলসুমকে পাবার সম্ভাবনা তার একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। কুদুস মৌলবির দিকে না তাকিয়ে সে জবাবদিহি করে কালাম মাঝির কাছে, আরে উগলান শোলোক বাদ দিছি কোনদিন।
কিন্তু মুশকিল এই কালাম মাঝিকে নিয়েই। কুলসুমের সঙ্গে তার নিকার কথা তো না আর তোলেই না, বরং কেরামত প্রসঙ্গটি তুললেই কালাম এক্কেবারে খামোশ মেরে যায়। কুলসুমকে সম্পূর্ণ নিজের কাছে না পাওয়া পর্যন্ত কেরামত না পারে নতুন শোলোক বাঁধতে, না পারে তার পুরনো শোলোকগুলো সুর করে গাইতে। সুতরাং শিঙি মাছগুলো তার হাতে তুলে দিয়ে কেরামত না হয় নিজেই সরাসরি প্রস্তাব করবে। ঘরের চৌকাঠে বসে কেরামত খালি প্যাচাল পাড়ে, কুলসুম একা থাকলে লোকে নানা কথা বলবে আর তার নামে কোনো কুকথা কেরামত সহ্যই করতে পারে না। কুলসুম যদি তার সাথে নিকা বসে তো মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়। কালাম মাঝিও তাদের এই বিয়ে সম্পূর্ণ অনুমোদন করে, এমন কি চোরাবালিতে গিয়ে কেরামত তমিজের বাপের দোয়াও নিয়ে এসেছে। কালাম মাঝি তাদের দুজনকে এই ঘরে থাকতেও দেবে, অন্তত কেরামত পরিবার নিয়ে বাস করলে কালাম এই ঘর থেকে তাদের উচ্ছেদ করবে না।
ঘর কি কালাম মাঝির বাপের? এতোক্ষণ পর মেয়েটির এই একটিমাত্র বাক্যে চমকে উঠলেও তার তেজে কেরামত মুগ্ধ হয়ে যায়। ঘর বন্দুক দিয়া তমিজের বাপ টাকা হাওলাত করিছিলো কালাম মাঝির কাছ থ্যাকা। তমিজ অ্যাসা টাকা ঘুরা দিলেই তো মিট্যা যায়। কুলসুমের জিভের ধার, ঠোঁটের জড়িয়েপড়া ও গুটিয়ে-নেওয়া এবং ভুরুর গেরো লাগানো ও গেরো ভোলা দেখতে দেখতে কেরামতের মুগ্ধতা দানা বেঁধে তাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে; এক পলকের জন্যে হলেও তার ভুললা লাগে, সে কি জেগে আছে, না। স্বপ্ন দেখছে? ঘরের চিন্তা হামি কোনোদিন করি নাই। রোজগার করবার পারলে খাওয়া পরার অভাব কী? কালাম মাঝি তো তার দোকানের খাতা লেখার কাম একটা দিয়াই রাখিছে, আবার মুকুন্দ সাহার দোকানটাও তো এখন তারই হলো, সেটার খাতা লেখার কামও হামকই করা লাগবি। রোজগার হামার কম হবি না। তা ছাড়া টাউনের মানুষের মধ্যে তার গানের জনপ্রিয়তার বিষয়টিও সে মনে করিয়ে দেয় কুলসুমকে। কুলসুমকে বিয়ে করলে তার বাউন্ডালা জেবনটা সুস্থির হয়, হামি আবার গান বান্দিবার পারি।
দোকানের খাতার মধ্যেই তো গান বান্দা যায়, না? কুলসুমের কাছে কেরামতের বাধা গান আর দোকানের খাতা লেখার মধ্যে কোনো ফারাক নাই ভেবে কেরামত একটু আহত হয়। কবির দুঃখটা একটু সামলে নিয়ে সে বলে, কালাম মাঝির এটি না পোয় তো হামি তোমাক লিয়া টাউনেত বাসা লিমু। গানের বই লিখ্যা হামার যা রোজগার হবি, টাউনেত বাসা করা থাকবার পারমু।
টাউনে যেতে কুলসুমের আপত্তি নাই। কিন্তু সেখানে নাকি রাত্রেও আলো জ্বলে, সব জায়গায় লোকজন গিজগিজ করে, বেহায়া মেয়েরা রিকশায় করে টাউন ঘোরে।
টাউনেত যাবা? * একটু ভেবে কুলসুম বলে, তমিজের বাপ তো টাউনেত যাবি না। তাই তো টাউনের ঘাটাও চেনে না।
কেরামত আলি বড়ো দমে যায়। তার সঙ্গে বিয়ের পরেও কুলসুমের এই মরা মানুষ দেখার ব্যারাম যদি না সারে?