কুলসুম দেখে হাঁড়ির ভেতরটা, ভাত হতে আর কতক্ষণ? তমিজ ততোক্ষণে চলে গেছে নজরের বাইরে। এ কী রকম জোয়ান মানুষ গো? সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় খালি পেটে? হাঁটা দিলো বুঝি শরাফত মণ্ডলের বাড়ির দিকে। বুলুর বর্গা-করা জমিটা এবার নিজেই বর্গা নিতে পারে তো আমনের খন্দটা ধরতে পারে। আমন রোপার সময় এখনো যায় নি। কড়া কড়া কথা বলতে বলতেই সে বাপকে এই পরিকল্পনার কথা একবার বলেছে। বাপের সাড়া না পেয়ে হনহন করে ছুটলো।
না খেয়ে তমিজ ঝাল ঝেড়ে গেলো কুলসুমের ওপর। ওদের বাপবেটার ঝগড়া হলে দুজনেই কথা শোনায় কুলসুমকেই। এই ঘরে বিয়ে দিয়ে গিয়ে দাদাটা তার কী সর্বনাশটাই যে করে গেছে! বুড়া নিজে তো দিব্যি কেটে পড়েছে, এতিম নাতনিটার কথা কি তার একবার মনেও পড়ে না? তমিজের বাপের খোয়াবে তো সে নিত্যি আসা-যাওয়া করে, কুলসুমের চোখের ভেতর কি একবার উঁকিটাও দিতে পারে না? কী। জানি, বিটকেলে বুড়া মরেই গেলো কিনা কে জানে? মরে গিয়েছে?-মরলে কিন্তু একদিক থেকে ভালোই। যদি বেঁচে থেকে থাকে তো চোখের আলো তো তার এ্যাদ্দিনে একেবারে নিভু নিভু; একা একা ক্রোশের পর ক্রোশ সে পাড়ি দেয় কী করে? জেয়াফতের বাড়িতে খেতে বসলে তার পাতে এক টুকরা গোশত কি এক হাতা ডাল তুলে দিতে বলবে কে? কুলসুমের সামনে হাঁড়ির ওপর ধোঁয়ায় কাঁপে কালো টুপিপরা চেরাগ আলির মাথা। হাতের ছড়ি ঠুকে ঠুকে বুড়া কোন মেলায়, কোন হাটে, কোন নদীর ঘাটে বটতলায় ঘোরে আর দোতারা বাজিয়ে গান করে। চুলায় ভাত ফোটে টগবগ করে, সেই আওয়াজে তৈরি হয় চেরাগ আলির শোলোক। কিন্তু গানের কথা কুলসুম কিছু বুঝতে পারে না। গান করতে করতে বুড়া মানুষটা হাপসে যাচ্ছে, শুধু দোতারাই বাজিয়ে চলেছে, মুখে তার কথা ফোটে না। তাকে একটু আরাম দিতে কুলসুম বাকি কথাগুলো গুনগুন করবে তার জো নাই। চেরাগ আলির গানের কথা তো। কিছুই ধরা যাচ্ছে না।
অনেক দূরের অচেনা জায়গায় চেরাগ আলির অস্পষ্ট কথার ধ্বনি ছাপিয়ে ওঠে। তমিজের বাপের হুঁশিয়ারি, ক্যা রে ভাত উথলায়, দেখিস না? চুলার আঁচ কমিয়ে মাড় বসিয়ে হাঁড়ি নামাতে নামাতে কুলসুমের সমস্ত শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ে, হায়রে, গান করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ হলেও দাদার কাছে কেউ নাই যে তাকে একটু জিরাতে দিয়ে পরের কথাগুলো গায়।
০৫. আউশের নতুন চালের ভাত
অনেকদিন পর রাত্রে গলা পর্যন্ত আউশের নতুন চালের ভাত, গোরুর গোশত ও হাতিবান্দার দৈ এবং এর আগে দুপুরবেলা ভাত ও আলু দিয়ে পাক-করা বোয়াল মাছের ঘাঁটি সালুন এবং সকাল থেকে দুপুর ও দুপুরে ভাত খাবার পর থেকে রাতে খাবার আগে পর্যন্ত দুই দফায় মুড়ি, বাতাসা ও খাগড়াই খেয়ে বাড়ি ফিরে তমিজের বাপ টইটম্বুর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাঝরাতে তলপেটের ব্যথায় সে জেগে ওঠে এবং দরজা খুলে বাইরের উঠান পেরিয়ে বাঁশঝাড়ে পৌঁছুবার আগেই তাকে বসে পড়তে হয় ডোবার অনেকটা এদিকেই। কোনোমতে-ধোয়া নষ্ট লুঙি এবং নিজের পাছা উরু ও পা ধুয়ে শরীর টেনে ঘরে ঢোকার আগেই তাকে ফের বসে পড়তে হয় দরজার বাইরে এবং সেখানে বসেই বিপুল আওয়াজে শুরু করে বমি করতে। পায়খানা করার সময় শরীরের বেআক্কেলে নিয়মে মলদ্বারে খাদ্যবস্তুর স্বাদ একটুও পায় নি, এখন বমি করতে গিয়ে গলা দিয়ে ওগরানো ভালো ভালো জিনিসের স্বাদ পেয়ে সে একটু চাঙা হয়ে ওঠে। বমি করার সময় গলার মাত্রাছাড়া আওয়াজে ব্যামাক খাবারের পেট খালি করে বেরিয়ে যাবার জন্যে হাহাকারটিও ছিলো। এই আওয়াজে শমশের পরামাণিকের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ থাকাটাও অসম্ভব নয়। শমশের হলো আদি চাষাঘরের মানুষ, পাছায় ত্যানা না জুটলেও কথাবার্তায় এরা সব লবারের বেটা। কথা সবটা সে রাখে নি। পরশু গোলাবাড়ি হাটে দেখা হলে বললো, নরেশের দোকানের। রসগোল্লা দুটো করে হলেও দেবে। না, পাকা মিষ্টি শালা দিলো না। তাতে তমিজের বাপের ততো দুঃখ নাই। হাতিবান্ধার গোপাল ঘোষের দৈ আর দৈয়ের সঙ্গে আখের গুড় যে পরিমাণ দিয়েছে তাতে পাকা মিষ্টি না দিলেও চলে। কিন্তু কপাল মন্দ, এতোগুলো ভালো ভালো জিনিস, পেটে বুঝি কিছুই রইলো না।
তা পেটের কী দোষ? রাত্রে তার খাওয়া নিয়ে নিজের বেটা যেমন চটাং চটাং কথা বললো তাতে গোরুর গোশত আর বোয়াল মাছ কি পেটের মধ্যে জুত করে দুই দণ্ড বসতে পারে? এসব খানদানি খানার ইজ্জত নাই? তমিজের খালি এক কথা, যে মানুষ। এক ছটাক জমি রাখতে পারে নি, সে মাঙন কামলা খাটতে যায় কোন আক্কেলে? ওই শমশেরই তো ওই একই আকালের সময় জগদীশ সাহার দেনা শোধ করতে মণ্ডলের কাছে সব বেচে দিয়েও বিঘা দুয়েক জমি কিছুতেই হাতছাড়া করলো না। হোক না তার দোপা জমি, আউশ ছাড়া আর কিছুই হয় না, কিন্তু এ জমি নিতে মণ্ডল তো কম চেষ্টা করে নি। তবু শমসের জমিটা ছাড়লো না। এর রহস্য কী? –ভরপেটে তমিজের বাপ এই রহস্যের কোনো কিনারা করতে না পারলে দায়িত্বটি পালন করতে হয় তমিজকেই।-আরে, শমশের পরামাণিক হলো খাটি চাষার বংশ, এক ছটাক হলেও চাষের জমি তার রাখা চাই। আর তমিজের বাপ হলো মাঝি, মাছ মেরে খাওয়া তার বংশের পেশা। মুসলমান মাঝি আর হিন্দু চাড়ালে ফারাক কী? জমির ইজ্জত এই মাঝির জাত বুঝবে কী?—নিজের বংশ নিয়ে বেটার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলা কথা শুনতে শুনতেই তমিজের বাপের পেটে অস্বস্তি শুরু হয় এবং তখন থেকেই পেট গুড়গুড় করতে থাকে।