“আমি খেয়েছি। আমি সকালে পেট ভরে নাস্তা করে এসেছি। তুমি খাও, খুবই মজা এটা, খেয়ে দেখ।”
রূপা ভদ্রতা করে বলল, “ঠিক আছে আমি একটু ভেঙে খাই।”
রাজু চকলেটের বারটা রূপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “একটু ভেঙে খেলেই তোমাকে পুরোটা খেতে হবে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একটু খেয়ে দেখ থামতে পার কি না।”
রূপা একবারও ভাবেনি যে সে লোভীর মতো পুরোটা খেয়ে ফেলবে কিন্তু সত্যি সত্যি পুরোটা খেয়ে ফেলল। রাজু তখন পানির বোতলটা এগিয়ে দিল, রূপা ঢক ঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে বলল, “থ্যাংকু।”
রাজু হাসি হাসি মুখ করে তার বইটা খুলে বলল, “তোমার মেজাজটা এখন কী একটু ভালো হয়েছে?”
“একটু না, অনেকখানি ভালো হয়েছে!”
“গুড।” রাজু বলল, “স্যারেরা ভুলভাল পড়ালে ধরার জন্যে প্রস্তুত?”
রূপা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “প্রস্তুত।”
.
০২.
আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন সোফায় বসেছে, তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের উত্তেজনা। এক্ষুনি তাদের হিন্দি সিরিয়াল শুরু হবে, দেখে মনে হচ্ছে তারা আর অপেক্ষা করতে পারছে না। এটা প্রত্যেকদিন রাতের ঘটনা–পুরো এক ঘণ্টা তারা বসে বসে এই হিন্দি সিরিয়াল দুটি দেখে। কপাল ভালো, মাত্র দুটি সিরিয়াল দেখায়, যদি আরো বেশি দেখাত তা হলে তারা আরো বেশি দেখত।
এমনিতে সবসময় আম্মুর মেজাজ খুব গরম থাকে, শুধু যখন হিন্দি সিরিয়ালগুলো শুরু হয় তখন আম্মুর মেজাজটা নরম হয়। আম্মু তখন একটু হাসাহাসি করেন। সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলেন। রূপা লক্ষ করেছে তাদের কথাগুলো শুনলে মনেই হয় না চরিত্রগুলো টেলিভিশনের চরিত্র, মনে হয় তারা সত্যি মানুষ নিয়ে কথা বলছে। একটা সিরিয়ালে রূপার বয়সী একটা মেয়ে আছে, রূপার মনে হয় আম্মু রূপাকে যতটুকু ভালোবাসেন তার থেকে একশ গুণ বেশি ভালোবাসেন ঐ মেয়েটিকে। হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে সবাই হিন্দি শিখে গেছে। আজকাল কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই তারা হিন্দিতে এক-দুইটা শব্দ কিংবা পুরো একটা বাক্য বলে ফেলেন।
পুরো ব্যাপারটাই রূপার কাছে খুবই জঘন্য একটা বিষয় মনে হয় কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সময়টাই হচ্ছে রূপার সবচেয়ে প্রিয় সময়! এই সময় রূপা আর সুলতানা ছাড়া বাসায় সবাই হিন্দি সিরিয়াল দেখে তাই তাদের কেউ বিরক্ত করে না। সুলতানার যদি রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার আর বাসন ধোয়া শেষ হয়ে যায় তা হলে সে চুপি চুপি রূপার ঘরে আসে, তার সাথে ফিসফিস করে কথা বলে!
আজকেও যখন আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন ড্রয়িং রুমে বসে বসে তাদের প্রিয় হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তখন সুলতানা চুপি চুপি রূপার ঘরে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “রূফ-রূফালী, কী কর?”
রূপা বলল, “শব্দটা মোটেও রূফ-রূফালী না। রূপ-রূপালী।”
সুলতানা বলল, “তাই তো বলছি, রূ-ফ-রূ-ফা-লী।”
রূপা বলল, “শুধু তুমি বললে তো হবে না। সেটা আমাদের শুনতেও হবে।”
সুলতানা দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমার কানে সমিস্যা আছে সেইটা আমার দোষ?”
রূপাও দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সেইটা মনে হয় ঠিকই বলেছ! সমস্যাটা মনে হয় আমার কানে।”
সুলতানা রূপার বিছানায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে একটা নিশ্বাস ফেলল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “সব কাজ শেষ?”
সুলতানা রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজ কখনো শেষ হয়? হয় না।”
কথাটা সত্যি, এই বাসায় কাজ কখনো শেষ হয় না। সেই অন্ধকার থাকতে সুলতানা ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করে, সবাই ঘুমিয়ে যাবার পরও তাকে সবকিছু গুছিয়ে ঘুমাতে হয়। তারপরেও কাজ শেষ হয় না।
সুলতানা তার ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে বলল, “যত কাজই করি খালাম্মার গালি তো শুনতেই হবে। তাই একটু বিশ্রাম নেই।”
রূপা বলল, “হ্যাঁ। বিশ্রাম নাও।”
রূপা সুলতানার দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি শ্যাম্পু দিয়ে মাথার চুলগুলো ধুয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেওয়া যায়, সুন্দর একটা থ্রী-পিস, কামিজ কিংবা একটা শাড়ি পরিয়ে, হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে কপালে একটা টিপ দিয়ে তাকে বই মেলায় নিয়ে যাওয়া হয় তা হলে কেউ বুঝতেই পারবে না সুলতানা কারো বাসায় কাজ করে। রূপা আর সুলতানা একই বয়সের, অথচ দুইজনের জীবনে কত পার্থক্য।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “সুলতানা, তুমি পড়তে পার?”
“একটু একটু।”
“স্কুলে গিয়েছিলে?”
“বাবা বেঁচে থাকতে গেছিলাম।”
“লেখাপড়া করতে মন দিয়ে?” সুলতানা দাঁত বের করে হাসল, “দুষ্টামি বেশি করছি লেখাপড়া থেকে।”
রূপা টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে সুলতানার হাতে দিয়ে বলল, “পড় দেখি এই বইটা।”
সুলতানা বইটি ওলট-পালট করে দেখল, ওপরের ছবিটি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল, তারপর বইটা খুলে পড়ার চেষ্টা করল, যুক্তাক্ষরগুলো পড়তে একটু সমস্যা হল কিন্তু সে বেশ সহজেই বেশ খানিকটা পড়ে ফেলল।
রূপা বলল, “বাহ! তুমি তো বেশ ভালোই পড়তে পার। তুমি পড় না কেন?”
সুলতানা হি হি করে হাসল, বলল, “কী পড়মু? কখন পড়মু? যখন খালাম্মা সকালবেলা বলবে এই সুলতাইন্যা, এক কাপ চা দে। তখন আমি বলমু, খাড়ান খালাম্মা। আমি এখন পত্রিকা পড়ি!” কথা শেষ করে সে আবার হাসিতে ভেঙে পড়ে।
বিষয়টা ঠিক হাসির বিষয় না কিন্তু সুলতানার কথা বলার ভঙ্গিটা দেখে রূপাও হেসে ফেলল। বলল, “তুমি কখন পড়বে সেটা অন্য ব্যাপার, কিন্তু লেখাপড়া জানাটা তো ভালো।”