- বইয়ের নামঃ রাশা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. আব্বু-আম্মু যখন অন্যরকম
রাশা – কিশোর উপন্যাস –মুহম্মদ জাফর ইকবাল
উৎসর্গ : নাইরাহ্ অনোরা সাইফ
তুমি কি জানো তুমি কত আনন্দ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ?
০১. আব্বু–আম্মু যখন অন্যরকম
রাইসার বয়স যখন দশ তখন তার ক্লাসের একটা ফাজিল ছেলে তাকে নিয়ে একটা কবিতা বানিয়েছিল। কবিতাটা শুরু হয়েছিল এভাবে :
রাইসা
মাছের কাঁটা খায় বাইছা বাইছা।
এটা মোটেও কোনো ভালো কবিতা হয়নি, ক্লাসের কোনো ছেলেমেয়ে এই ফাজিল কবি কিংবা তার কবিতাকে কোনোই পাত্তা দেয়নি। কিন্তু রাইসা কেঁদেকেটে একাকার করল। বাসায় এসে ঘোষণা করল সে তার নামটাই বদলে ফেলবে। রাইসার আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “নাম বদলে ফেলবি মানে? নাম কি টেবিল ক্লথ, নাকি বিছানার চাদর যে পছন্দ না হলেই পাল্টে ফেলবি?”
রাইসা তার আম্মুর সাথে তর্ক করল না, খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করল তার নূতন নামটি কী হতে পারে। আনুস্কা নামটা তার খুব পছন্দ কিন্তু রাইসা থেকে হঠাৎ করে এক লাফে আনুস্কা করে ফেলা যাবে না, তাই সে রাইসার কাছাকাছি একটা নাম বেছে নিল। রাইসার ই’ ফেলে দিয়ে প্রথমে সে তার নামটাকে বানাল রাসা কিন্তু উচ্চারণ করল রাশা। প্রথমে সবাই ভেবে নিল এটা একধরনের ঠাট্টা কিন্তু রাইসা হাল ছেড়ে দিল না। একদিন নয় দুইদিন নয়, তিন বছর পর তার বয়স যখন তেরো তখন সত্যি সত্যি তার নাম হয়ে গেল রাশা। একসময় যে তার নাম ছিল রাইসা সেটা সবাই প্রায় ভুলেই গেল।
দশ বছরের রাইসা যখন তেরো বছরের রাশাতে পাল্টে গেল সে তখন আবিষ্কার করেছে নামের সাথে সাথে তার চারপাশের পৃথিবীটাও কেমন যেন পাল্টে গেছে। যখন তার বয়স ছিল দশ বছর তখন তার ধারণা ছিল তার। আব্বু-আম্মুর মতো ভালো মানুষ বুঝি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। তেরো বছর বয়সে রাশা আবিষ্কার করল তার ধারণাটা পুরোপুরি ভুল-তার আব্বু আম্মু মোটেও ভালো মানুষ নন, তাদের নানা রকম সমস্যা। তার আব্বু বদমেজাজী আর স্বার্থপর ধরনের মানুষ। নিজের ভালো ছাড়া আর কিছুই। বোঝেন না। শুধু তাই না দরকার না থাকলেও অবলীলায় মিথ্যে কথা বলে ফেলেন। রাশা আস্তে আস্তে আবিষ্কার করল তার আম্মুর মনটা খুব ছোট, কেমন যেন হিংসুক ধরনের মহিলা। অল্পতেই বেশ রেগে উঠে বাসায় যে কাজের মেয়েটা আছে তাকে মারধর শুরু করেন। সেটা দেখে রাশা লজ্জায় একেবারে মাটির সাথে মিশে যেত। দেখতে দেখতে অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল, খুব ধীরে ধীরে তার আব্বু-আম্মু খুবই খারাপভাবে ঝগড়া। করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম রাশা থেকে লুকিয়ে একটু গলা নামিয়ে ঝগড়া করতেন, আস্তে আস্তে তাদের লজ্জা ভেঙে গেল, তখন গলা উঁচিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে রাশার সামনেই ঝগড়া করতে শুরু করলেন। কী খারাপ তাদের ঝগড়া কার ভঙ্গি, কী জঘন্য তাদের ভাষা, রাশার একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে করত।
তারপর একদিন তার আব্বু-আম্মুর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, রাশা আগেই টের পেয়েছিল এরকম একটা জিনিষ ঘটেবে, তাই দুঃখে তার বুকটা ভেঙে গেল সত্যি কিন্তু সে মোটেও অবাক হলো না। সে ভাবল তার আব্বু একন। অন্য জায়গায় চলে যাবেন, ঝগড়াকাটি করার জন্যে কোনো মানুষ নেই তাই বাসায় তখন একটু শান্তি ফিরে আসবে। আব্বু নুতন একটা বাসা ভাড়া করে চলে গেলেন, ঝগড়াঝাটি কমে এলো কিন্তু বাসায় মোটেও শান্তি ফিরে এলো না। আম্মু একটা ব্যাংকে চাকরি করেন, যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণ ভালো, বাসায় ফিরে এসেই আব্বুকে গালাগাল করতে শুরু করেন, যখন রাত হয়ে আসে তখন ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে থাকেন। রাশা কী করবে বুঝতে পারে না; এক-দুইবার আম্মুকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার ফল হলো একেবারে উল্টো, আম্মু রাশাকেই দোষী ধরে মুখ খারাপ করে তাকেই গালাগাল দিতে লাগলেন।
এই ভাবে এক বছর কেটে গেল, রাশার বয়স হলো চৌদ্দ। কিন্তু তার মনে হতো তার বয়স বুঝি হয়েছে চল্লিশ। এই এক বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তার আব্বু কোথা থেকে একজন মাঝবয়সী মহিলাকে খুঁজে বের করে বিয়ে করে কানাডা চলে গেলেন। রাশা ভাবল আব্বু যেহেতু দেশ ছেড়েই চলে গেছেন এখন আম্মু হয়তো একটু শান্ত হয়ে অন্য কিছুতে মন দেবেন।
কিন্তু সেটা মোটেও ঘটল না, আম্মু কেমন যেন আরো খেপে উঠলেন, তার কথাবার্তা শুনে মনে হতে লাগল পুরো দোষটাই বুঝি রাশার। একদিন রাশা স্কুল থেকে এসেছে, বাসায় এসে দেখে আম্মু বসার ঘরে গুম হয়ে বসে আছেন। রাশা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আম্মু?”
আম্মু তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, রাশা আবার জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, কী হয়েছে?”
এবারে আম্মু রাগে একেবারে ফেটে পড়লেন, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বললেন, “সব দায়-দায়িত্ব আমার? তোর বাপের কোনো দায়-দায়িত্ব নাই?”
রাশ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কিসের দায়-দায়িত্ব?”
আম্মু মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কিসের আবার? তোর দায়-দায়িত্ব।”
রাশার বুকটা কেন যেন ঘঁৎ করে উঠে, সে শুকনো মুখে বলল, “আমার দায়-দায়িত্ব?”
“হ্যাঁ। তুই কি আমার একার মেয়ে নাকি তোর বাপেরও একটু দায়িত্ব আছে? আমার ওপর তোর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সে একটা ঘাগী বুড়িকে বিয়ে করে কানাডা ভেগে গেল?”