- বইয়ের নামঃ স্কুলের নাম পথচারী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. তোমরা মনে করতে পার
তোমরা মনে করতে পার এই গল্পটা বুঝি বানানো, কিন্তু আমি আগেই বলে দিই এটা বানানো গল্প না। যে-মানুষগুলিকে নিয়ে এই গল্প তাঁরা নিজেরা আমাকে এই গল্পটা বলেছেন-তারা তো খামোখা আমার কাছে গুলপট্টি মারবেন না! আমার অবিশ্যি নিজে থেকে তোমাদের এই কথাটা বলে দেয়ার কোনো দরকার ছিল, না কারণ তোমরা একটু শুনলেই বুঝতে পারবে এর মাঝে কোনো ফাঁকিঝুঁকি নেই।
যেই মানুষগুলিকে নিয়ে এই গল্প তার প্রথমজনের নাম ফরাসত আলি। ফরাসত আলি মানুষটার মাঝে কোনো মারপ্যাঁচ নেই। তিনি বেশি মোটাও না আবার তিনি বেশি শুকনোও না। তিনি বেশি লম্বাও না আবার বেশি খাটোও না। তিনি বেশি বোকাও না আবার বেশি চালাকও না। তাকে যদি তোমরা কোনোদিন রাস্তায় দেখ হয়তো বুঝতেই পারবে না যে মানুষটা ফরাসত আলি। কিন্তু যারা তাকে চেনে তাদের বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না, তার এক নম্বর কারণ ফরাসত আলির একটা মজার অভ্যাস আছে। প্রত্যেক বছর যখন খুব গরম পড়ে ফরাসত আলি তখন চুল-দাড়ি কামিয়ে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যান, তখন তাকে দেখায় মুসোলিনির মতো। আবার যখন শীত পড়তে শুরু করে তখন তিনি দাড়িগোঁফ কামানো বন্ধ করে দেন আর তখন তাঁকে দেখায় কাল মার্ক্সের মতো।
গত বছর শীতের শেষে যখন গরম পড়তে শুরু করেছে তখন একদিন ফরাসত আলির চুল-দাড়ি কুটকুট করতে শুরু করল, তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর চুল-দাড়ি কাটার সময় হয়েছে। তখন-তখনই তিনি তার নাপিতের দোকানে রওনা দিলেন, গিয়ে দেখেন সেখানে লম্বা লাইন। কোনো কারণে সবাই সেদিন চুল কাটাতে এসেছে। কতক্ষণ আর ফরাসত আলি বসে থাকবেন তাই তিনি দোকানে গেলেন একটা রেজর কিনতে।
বড় মনোহারী দোকান, খদ্দেরের খুব বেশি ভিড় নেই। ফরাসত আলি দোকানিকে বললেন, “ভাই, ভালো দেখে একটা রেজর দেন দেখি।”
দোকানি মানুষটা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না দোকানি এত অবাক হল কেন, তবুও মাথা নেড়ে বললেন, “সত্যি।”
দোকানি তার বাক্স খুলে কী-একটা কাগজ বের করে সেখানে কীসব লেখালেখি করতে শুরু করল। ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না কী হচ্ছে, তবু তিনি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। দোকানি অনেকক্ষণ লেখালেখি করে তাঁকে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে নেন, একশোটা।”
“একশোটা কী?”
“লটারির টিকেট।” ফরাসত আলি অবাক হয়ে বললেন, লটারির টিকেট?”
“হ্যাঁ। একটা পাঁচ টাকা করে একশোটার দাম পাঁচশো টাকা।”
ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না কী হচ্ছে, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “কিন্তু লটারির টিকেট কেন?”
দোকানি অবাক হয়ে বলল, “এই যে আপনি চাইলেন!”
“আমি চাইলাম?”
“হ্যাঁ–”
”কখন?”
“এই তো এক্ষুনি। বললেন একশোটা লটারির টিকেট।”
“মোটেই না! আমি বলেছি রেজর। দাড়ি কামানোর রেজর।”
দোকানি চোখ কপালে তুলে বলল, “রেজর? আপনি মোটেও রেজর বলেননি। বলেছেন একশোটা লটারির টিকেট।”
ফরাসত আলি মুখ শক্ত করে বললেন, “আমি বলি নাই।”
“বলেছেন।” দোকানি তখন আশেপাশে দাঁড়ানো লোকজনকে সাক্ষী মানতে শুরু করল, “ইনি বলেছেন না?”
উপস্থিত লোকজন তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ বলল, বলেছেন, এক ভাগ বলল বলেন নাই, অন্য আরেক ভাগ বলল, তিনি হয়তো বলেছেন ‘রেজর’ কিন্তু তার মুখে এত দাড়ি-গোঁফ থাকায় সেটা শোনা গেছে লটারির টিকেট’। সেটা কীভাবে সম্ভব ফরাসত আলি ঠিক বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তিনি সেটা নিয়ে মাথা-ঘামালেন না। খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, আমি কী বলেছি আর আপনি কী শুনেছেন সেটা নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। আমি লটারি খেলি না, আমার লটারির টিকেটের দরকার নেই। আমাকে আমার রেজর দেন, আমি যাই।”
দোকানি মুখ কালো করে বলল, “কিন্তু লটারির টিকেট সাইন হয়ে গেলে ফেরত নেওয়ার নিয়ম নেই। এখন এইগুলি আপনাকে নিতেই হবে।”
“কিন্তু আমি লটারি খেলি না।”
“একবার খেলে দেখেন। ভাগ্যের ব্যাপার, লেগে গেলে এক ধাক্কায় তিরিশ লাখ টাকা। তা ছাড়া টিকেট সাইন হয়ে গেছে, এখন তো নিতেই হবে।”
ফরাসত আলি একবার ভাবলেন রেগে যাবেন, কিন্তু তিনি কখনোই বেশি রেগে যান না, তাই এবারেও বেশি রাগলেন না, মেঘস্বরে বললেন, “যদি না নিই?”
দোকানি তখন খুব মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তা হলে সবগুলি আমার নিজের কিনতে হবে। আমি গরিব মানুষ, খামোখা এতগুলি লটারির টিকেট কিনে
কী করব?”
ফরাসত আলি কী ভেবে লটারির টিকেটগুলি নিলেন। মানিব্যাগে সেদিন পাঁচশো টাকা ছিল, দুদিন আগেই বেতন পেয়েছেন। পাঁচশো টাকা এভাবে বের হয়ে যাবার পর তার সারা মাসে টাকার টানাটানি হয়ে যাবে, কিন্তু এখন কিছু করার নেই। টাকা গুনে ফরাসত আলি যখন বের হয়ে আসছিলেন দোকানি জিজ্ঞেস করল, “রেজর নিবেন না?”
ফরাসত আলি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়লেন, তার এখন আর রেজর কেনার ইচ্ছা নেই। তা ছাড়া তাঁর ভয় হচ্ছিল তিনি যদি মুখ ফুটে কিছু-একটা বলেন দোকানি সেটাকে অন্যকিছু একটা শুনে ফেলে আবার তাঁকে কিছু-একটা গছিয়ে দেবে। তিনি যখন বের হয়ে আসছিলেন দোকানি নরম গলায় বলল, “স্যার, রাগ হবেন না আমার উপর। এই লটারির টাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয় কেন্দ্র বানানো হবে। যদি লটারি না জেতেন মনে করবেন সকাজে দান করলেন। তা ছাড়া লটারির টিকেট সবাই কিনতে চায়-আপনি যদি নিজে একশোটা রাখতে না চান বন্ধুবান্ধবের কাছে বিক্রি করতে পারেন, দেখবেন একেবারে ইলিশ মাছের মতো বিক্রি হয়ে যাবে।”