- বইয়ের নামঃ রূপ-রূপালী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৪. রূপার ঘুম ভেঙে গেল
রূপ-রূপালী – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
হঠাৎ করে রূপার ঘুম ভেঙে গেল আর সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। সাধারণত সে নিজে থেকে ঘুম ভেঙে উঠতে পারে না, প্রতিদিনই সকালবেলা সুলতানা তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, “রূফ-রূফালী, উঠ।” সে বিড়বিড় করে বলে, “রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।” সুলতানা বলে, “তাই তো কইলাম। রূফ-রূফালী।” সে তখন বলে, “তুমি মোটেও রূপ-রূপালী বলনি। বলেছ রূফ-রূফালী।” সুলতানা তখন ফিসফিস করে বলে, “দিরং কইর না। খালাম্মা কিন্তু কাঁচা খায়া ফালাইব।” রূপা তখন বলতে চায় দিরং বলে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু সেটা আর বলে না, আম্মু তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে পারে এই কথাটা সে নিজেও বিশ্বাস করে। তার আম্মু যে কোনো মানুষকে যখন খুশি কাঁচা খেয়ে ফেলতে পারেন। তার যে এত বড় ক্ষমতাশালী আব্বু সেই মানুষটাও তার আম্মুর ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকেন। তখন রূপা আস্তে আস্তে ঘুম থেকে ওঠে। বিছানা থেকে নামে। বাথরুমে যায়।
আজ সেরকম কিছু হয়নি, কেউ তাকে ডাকেনি। সুলতানা ডাকেনি, আপু কিংবা মিঠুনও ডাকেনি। আম্মু কিংবা আব্বুও ডাকেননি। রূপা মশারি তুলে ঘড়িটার দিকে তাকাল সাথে সাথে মনে হল ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে, তাদের স্কুল শুরু হয় নয়টার সময়। প্রত্যেকদিন ঠিক সাড়ে আটটার সময় তারা স্কুলে রওনা দেয়। কিছু একটা হয়েছে, যে কারণে আজ তাকে কেউ ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি।
রূপা বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সাবধানে দরজা খুলল এবং সাথে সাথে বুঝে গেল আজ তার কপালে দুঃখ আছে। ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে নাস্তা করছে, দরজা খোলার শব্দ শুনে সবাই মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। তার আপু তিয়াশার চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন, সবসময় যেরকম থাকে। পৃথিবীর কোনো কিছুতে তিয়াশার কোনো কিছু আসে যায় না, তাকে কেউ খুন করে ফেললেও তিয়াশা এভাবে তাকাবে, সে যদি নোবেল প্রাইজ পায় তা হলেও তিয়াশা এভাবে তাকাবে। মিঠুনের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট আনন্দ, মুখে একটা ফিচলে হাসি। রূপা যখনই বিপদে পড়ে তখনই মিঠুনের মুখে এরকম আনন্দের একটা আভা ছড়িয়ে পড়ে। আব্বু রূপার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন রূপা একটা মানুষ নয়, সে যেন একটা তেলাপোকা কিংবা একটা জোক। আম্মুর চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। মনে হয় এক্ষুনি নাক দিয়ে আগুন বের হয়ে আসবে। শুধু সুলতানার চোখে তার জন্যে এক ধরনের মায়া। সুলতানা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে হাত দিয়ে গলায় পোচ দেওয়ার ভঙ্গি করে রূপাকে বুঝিয়ে দিল এখন তাকে জবাই করে ফেলা হবে। তার চোখ-মুখ দেখে রূপা এটাও বুঝতে পারল যে, বেচারি সুলতানার কিছু করার ছিল না।
আম্মু নাক দিয়ে একটা শব্দ করে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “এতক্ষণে মহারানির ঘুম ভাঙল?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোনো লাভ নেই জেনেও রূপা চেষ্টা করল, “আমাকে ডাকলেই উঠে যেতাম, কেউ ডাকল না–”
“তুমি কোথাকার কোন লাটসাহেবের বেটি যে তোমাকে প্রত্যেকদিন ডেকে তুলতে হবে? তুমি কেন নিজে থেকে উঠতে পার না? তুমি সারারাত কী কর? মানুষের বাড়ি বাড়ি চুরি করতে যাও?”
রূপা এই কথার কোনো উত্তর দিল না। সে কারো বাড়িতে চুরি করতে যায় সত্যি কিন্তু সে অপরাধ ঠিকই করে। রাত জেগে সে গল্পের বই পড়ে। এই বাসায় গল্পের বই পড়া নিষেধ তাই লুকিয়ে রাত জেগে পড়তে হয়। কাল রাতে যে বইটা পড়েছে সেটা ছিল ফাটাফাটি একটা সায়েন্স ফিকশান, শেষ না করে ঘুমাতে পারছিল না। আম্মু যদি শুধু জানতে পারেন তা হলে মনে হয় সত্যি সত্যি জবাই করে ফেলবেন।
আম্মু হুংকার দিলেন, “আজ থেকে তোমাদের কাউকে আর ডেকে তোলা হবে না। নিজেরা নিজেরা ঘুম থেকে উঠবে।”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল”ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে?” আম্মু প্রচণ্ড রেগে ডাইনিং টেবিলে একটা থাবা দিলেন আর টেবিলের সব প্লেট-কাপ-পিরিচ ঝনঝন করে উঠল।”কোন জিনিসটা ঠিক আছে? নয়টার সময় স্কুল, সাড়ে আটটার সময় উঠেছ? কেমন করে স্কুলে যাবে? কখন রেডি হবে?”
“রেডি হতে এক মিনিটও লাগবে না আম্মু।”
রূপা কোনো রকমে দাঁত ব্রাশ করে, চোখে-মুখে পানি দিয়ে স্কুলের পোশাক পরে বের হয়ে এলো। এক মিনিটে বের হতে পারল না সত্যি কিন্তু তার থেকে খুব বেশি সময় নিল না। স্কুলের ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে সে প্রায় দরজার দিকে ছুটে যায়। আম্মু আবার হুংকার দিলেন, “নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছিস?”
“করতে হবে না আম্মু। একেবারে খিদে নেই।”
“না থাকলেই ভালো। যে রকম ধুমসি মোটা হয়েছিস, একমাস না খেলেও তো তোর গায়ে-গতরের চর্বি এক সুতাও কমবে না।”
কী কুৎসিত কথা! পৃথিবীর আর কোনো মা কী তার মেয়েকে এরকম একটা কথা বলতে পারে? রূপার মনে হল তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। ভান করল আম্মুর কথাটা সে শুনতে পায়নি।
আব্বু বললেন, “তোমার এই মেয়েটা আসলেই একটা সমস্যা।” বলার সময় আলু”এই” শব্দটাতে আলাদা জোর দিলেন।
আম্মু বললেন, “আদর দিয়ে মাথা খেয়েছ, সমস্যা হবে না তো কী হবে?”