- বইয়ের নামঃ রূপ-রূপালী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৪. রূপার ঘুম ভেঙে গেল
রূপ-রূপালী – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
হঠাৎ করে রূপার ঘুম ভেঙে গেল আর সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। সাধারণত সে নিজে থেকে ঘুম ভেঙে উঠতে পারে না, প্রতিদিনই সকালবেলা সুলতানা তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, “রূফ-রূফালী, উঠ।” সে বিড়বিড় করে বলে, “রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।” সুলতানা বলে, “তাই তো কইলাম। রূফ-রূফালী।” সে তখন বলে, “তুমি মোটেও রূপ-রূপালী বলনি। বলেছ রূফ-রূফালী।” সুলতানা তখন ফিসফিস করে বলে, “দিরং কইর না। খালাম্মা কিন্তু কাঁচা খায়া ফালাইব।” রূপা তখন বলতে চায় দিরং বলে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু সেটা আর বলে না, আম্মু তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে পারে এই কথাটা সে নিজেও বিশ্বাস করে। তার আম্মু যে কোনো মানুষকে যখন খুশি কাঁচা খেয়ে ফেলতে পারেন। তার যে এত বড় ক্ষমতাশালী আব্বু সেই মানুষটাও তার আম্মুর ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকেন। তখন রূপা আস্তে আস্তে ঘুম থেকে ওঠে। বিছানা থেকে নামে। বাথরুমে যায়।
আজ সেরকম কিছু হয়নি, কেউ তাকে ডাকেনি। সুলতানা ডাকেনি, আপু কিংবা মিঠুনও ডাকেনি। আম্মু কিংবা আব্বুও ডাকেননি। রূপা মশারি তুলে ঘড়িটার দিকে তাকাল সাথে সাথে মনে হল ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে, তাদের স্কুল শুরু হয় নয়টার সময়। প্রত্যেকদিন ঠিক সাড়ে আটটার সময় তারা স্কুলে রওনা দেয়। কিছু একটা হয়েছে, যে কারণে আজ তাকে কেউ ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি।
রূপা বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সাবধানে দরজা খুলল এবং সাথে সাথে বুঝে গেল আজ তার কপালে দুঃখ আছে। ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে নাস্তা করছে, দরজা খোলার শব্দ শুনে সবাই মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। তার আপু তিয়াশার চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন, সবসময় যেরকম থাকে। পৃথিবীর কোনো কিছুতে তিয়াশার কোনো কিছু আসে যায় না, তাকে কেউ খুন করে ফেললেও তিয়াশা এভাবে তাকাবে, সে যদি নোবেল প্রাইজ পায় তা হলেও তিয়াশা এভাবে তাকাবে। মিঠুনের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট আনন্দ, মুখে একটা ফিচলে হাসি। রূপা যখনই বিপদে পড়ে তখনই মিঠুনের মুখে এরকম আনন্দের একটা আভা ছড়িয়ে পড়ে। আব্বু রূপার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন রূপা একটা মানুষ নয়, সে যেন একটা তেলাপোকা কিংবা একটা জোক। আম্মুর চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। মনে হয় এক্ষুনি নাক দিয়ে আগুন বের হয়ে আসবে। শুধু সুলতানার চোখে তার জন্যে এক ধরনের মায়া। সুলতানা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে হাত দিয়ে গলায় পোচ দেওয়ার ভঙ্গি করে রূপাকে বুঝিয়ে দিল এখন তাকে জবাই করে ফেলা হবে। তার চোখ-মুখ দেখে রূপা এটাও বুঝতে পারল যে, বেচারি সুলতানার কিছু করার ছিল না।
আম্মু নাক দিয়ে একটা শব্দ করে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “এতক্ষণে মহারানির ঘুম ভাঙল?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোনো লাভ নেই জেনেও রূপা চেষ্টা করল, “আমাকে ডাকলেই উঠে যেতাম, কেউ ডাকল না–”
“তুমি কোথাকার কোন লাটসাহেবের বেটি যে তোমাকে প্রত্যেকদিন ডেকে তুলতে হবে? তুমি কেন নিজে থেকে উঠতে পার না? তুমি সারারাত কী কর? মানুষের বাড়ি বাড়ি চুরি করতে যাও?”
রূপা এই কথার কোনো উত্তর দিল না। সে কারো বাড়িতে চুরি করতে যায় সত্যি কিন্তু সে অপরাধ ঠিকই করে। রাত জেগে সে গল্পের বই পড়ে। এই বাসায় গল্পের বই পড়া নিষেধ তাই লুকিয়ে রাত জেগে পড়তে হয়। কাল রাতে যে বইটা পড়েছে সেটা ছিল ফাটাফাটি একটা সায়েন্স ফিকশান, শেষ না করে ঘুমাতে পারছিল না। আম্মু যদি শুধু জানতে পারেন তা হলে মনে হয় সত্যি সত্যি জবাই করে ফেলবেন।
আম্মু হুংকার দিলেন, “আজ থেকে তোমাদের কাউকে আর ডেকে তোলা হবে না। নিজেরা নিজেরা ঘুম থেকে উঠবে।”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল”ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে?” আম্মু প্রচণ্ড রেগে ডাইনিং টেবিলে একটা থাবা দিলেন আর টেবিলের সব প্লেট-কাপ-পিরিচ ঝনঝন করে উঠল।”কোন জিনিসটা ঠিক আছে? নয়টার সময় স্কুল, সাড়ে আটটার সময় উঠেছ? কেমন করে স্কুলে যাবে? কখন রেডি হবে?”
“রেডি হতে এক মিনিটও লাগবে না আম্মু।”
রূপা কোনো রকমে দাঁত ব্রাশ করে, চোখে-মুখে পানি দিয়ে স্কুলের পোশাক পরে বের হয়ে এলো। এক মিনিটে বের হতে পারল না সত্যি কিন্তু তার থেকে খুব বেশি সময় নিল না। স্কুলের ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে সে প্রায় দরজার দিকে ছুটে যায়। আম্মু আবার হুংকার দিলেন, “নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছিস?”
“করতে হবে না আম্মু। একেবারে খিদে নেই।”
“না থাকলেই ভালো। যে রকম ধুমসি মোটা হয়েছিস, একমাস না খেলেও তো তোর গায়ে-গতরের চর্বি এক সুতাও কমবে না।”
কী কুৎসিত কথা! পৃথিবীর আর কোনো মা কী তার মেয়েকে এরকম একটা কথা বলতে পারে? রূপার মনে হল তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। ভান করল আম্মুর কথাটা সে শুনতে পায়নি।
আব্বু বললেন, “তোমার এই মেয়েটা আসলেই একটা সমস্যা।” বলার সময় আলু”এই” শব্দটাতে আলাদা জোর দিলেন।
আম্মু বললেন, “আদর দিয়ে মাথা খেয়েছ, সমস্যা হবে না তো কী হবে?”
আব্বু আরো একটা কিছু বললেন, রূপা সেটা শোনার জন্যে দাঁড়াল না, দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এলো। সে খুব ভালো করে জানে কেউ আদর দিয়ে তার মাথা খায়নি। তাদের তিন ভাই-বোনের মাঝে সে কালো এবং একটু মোটা। তার চেহারাটাও এমন কিছু আহামরি না, চোখে ভারী চশমা থাকার কারণে চোখগুলোকে দেখায় ছোট ছোট। আপু আর মিঠুন দুইজনকে দেখলে মনেই হয়
তারা একই মায়ের পেটের ভাই-বোন। তারা ফরসা আর ছিপছিপে, তাদের দুজনের চেহারাতেই একটা ঝকঝকে ছাপ। ছোট থাকতে রূপা অসংখ্যবার শুনেছে হাসপাতালে আম্মুর আসল বেবির সাথে বদলাবদলি হয়ে সে-অন্য কারো কালো কুৎসিত বাচ্চা, ঘরে চলে এসেছে। যখন ছোট ছিল তখন সেই কথা রূপা প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিল। সেই ছোট থেকে সে লক্ষ করেছে আন্ধু-আম্মুর আদর-সোহাগ তার বড় বোন তিয়াশা আর ছোট ভাই মিঠুনের জন্যে। তার জন্যে কখনোই কিছু ছিল না। আব্বু হয়তো ঠিকই বলেছেন সে আসলেই একটা সমস্যা কিন্তু সেই সমস্যার কারণ মোটেই আদর দিয়ে মাথা খাওয়া নয়, অন্য কিছু।
তিন ভাই-বোন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। মিঠুন বলল”ইস! তোমার কী মজা ছোট আপু। তুমি নাস্তা না খেলেও আম্মু তোমাকে কিছু বলে না!”
রূপা তার কথায় কোনো উত্তর দিল না। মিঠুন বলল”আমি নাস্তা খেতে না চাইলে আম্মু যা বকা দেয়!”
রূপা এবারেও কোনো কথা বলল না। মিঠুন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী মজা! তোমার কী মজা!”
রূপা আর সহ্য করতে পারল না, মুখ ভেংচে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “হ্যাঁ খুবই মজা সকালবেলা নাস্তা না খেয়ে বকা খেতে খুবই মজা লাগে। পেট ভরে একবার বকা খেলে সারাদিন আর কিছু খেতে হয় না। গাধা কোথাকার।”
মিঠুন একটু অবাক হয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দেখে মনে হল সে এখনো বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে রূপা কেন খেপে উঠল। তিয়াশা ভুরু কুঁচকে রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “দোষ তো তোরই! আম্মু তোর উপর এভাবে রেগেছে কেন? আম্মু রেগেছে তার কারণ, আম্মু যা চায় তার কোনোটাই তুই করিস না!”
“আমি পারি না তাই করি না। আমি তোমার মতো গান গাইতে পারি না, ছবি আঁকতে পারি না, নাচতে পারি না, আবৃত্তি করতে পারি না, পরীক্ষায় ফাস্টও হতে পারি না, আমি কী করব?”
“তুই চেষ্টাও করিস না।”
“আমি কীভাবে চেষ্টা করব? আম্মু চায় আমি এক কোচিং থেকে আরেক কোচিং, এক মাস্টার থেকে আরেক মাস্টারের কাছে দৌড়াতে থাকি! দৌড়িয়ে লাভ কী?”
তিয়াশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর তুই কী করিস? আম্মু যেটা চায় না তুই বেছে বেছে সেগুলো করিস!”
রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “সেগুলো কী করি?”
“এই মনে কর গল্পের বই পড়া। তুই দিনরাত লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়িস।”
“যদি এমনি এমনি পড়তে না দেন তা হলে কী করব?”
“তা হলে পড়বি না। না পড়লে কী হয়?”
রূপা উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। বলে কী হবে? এই বাসায় কাকে সে কী বোঝাবে? এই বাসায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য সব বইকে। বলা হয় আউট বই। বাসায় সবাই বিশ্বাস করে আউট বই পড়লে একজন নষ্ট হয়ে যায়! রূপা অবশ্য জানে না নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে কী। মানুষ তো আর দুধের প্যাকেট না যে নষ্ট হয়ে যাবে।
রূপা একটা নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে থাকে, কিছু খেয়ে আসেনি, এখনই খিদে লেগে গেছে। খিদে লাগলেই তার মেজাজটা গরম হয়ে থাকে তখন সবার সাথে শুধু ঝগড়া হতে থাকে। আজকে ক্লাশে সে নিশ্চয়ই সবার সাথে ঝগড়া করবে।
মিঠুনকে তার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে রূপা আর আপু তাদের স্কুলে এলো। স্কুলের সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি, কয়েক বছর আগেও ছেলেমেয়েরা হেঁটে স্কুলে আসত, খুব বেশি হলে রিকশায়। আজকাল অনেকেই গাড়িতে আসে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা গাড়িতে আসে তাদের চেহারার মাঝে এক ধরনের মিল আছে, মিলটা কোথায়, রূপা এখনো ঠিক ধরতে পারেনি। মনে হয় সেখানে এক ধরনের চিকচিকে ভাব আছে যেটা সাধারণ ছেলেমেয়ের মাঝে নেই।
স্কুলের গেটের কাছাকাছি আসার আগেই আপু রূপা থেকে একটু আলাদা হয়ে গেল। দুই বোন যদিও একই স্কুলে পড়ে কিন্তু স্কুলের ভেতর দুজনকে দেখলে মনে হবে একজন বুঝি আরেকজনকে চিনেই না! এর কারণটাও রূপা জানে না। সে যখন ছোট ছিল তখন স্কুলে এসে তিয়াশার পিছনে ঘুরঘুর করত–তিয়াশা খুব বিরক্ত হত। তিয়াশা দেখতে ভালো, স্কুলের সবকিছুতে থাকে, স্যার-ম্যাডামেরা তিয়াশা বলতে অজ্ঞান আর সে হচ্ছে সবদিক দিয়ে আপু থেকে উল্টো। সেই জন্যে আপু মনে হয় তাকে নিয়ে অন্যদের সামনে একটু লজ্জা পায়, তাই একটু দূরে দূরে থাকে। রূপার ধারণা তার ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে জানেই না যে রূপার একজন বড় বোন এই স্কুলেই পড়ে!
তিয়াশা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। রূপা তার ক্লাশরুমে ঢুকে। আজকে আসতে একটু দেরি হয়েছে তাই জানালার কাছে তার প্রিয় সিটটা বেদখল হয়ে গেছে। সে পিছনে এসে বসল, এই জায়গাটা তার সবচেয়ে অপছন্দের–স্যার-ম্যাডামেরা একেবারে সরাসরি দেখতে পায়, এখানে বসলেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয়। রূপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, দিনটা যখন খারাপভাবে শুরু হয়েছে সারাটা দিন নিশ্চয়ই খারাপভাবে যাবে।
রূপার সন্দেহটা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় মিম্মি ঠিক তখন তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিম্মি হচ্ছে তার ক্লাশের কুটনি বুড়ি, তার কাজই হচ্ছে একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগানো। সারাক্ষণই সে ফিসফিস করে কারো সম্পর্কে কিছু না কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলছে। কাজেই মিম্মি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে এল তখন রূপা বুঝে গেল অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা না পড়া পর্যন্ত তার এখন কুটনামি শুনতে হবে। রূপা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সেই জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল।
মিম্মি কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “জানিস কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “সোহেল।”
সোহেল তাদের ক্লাশের শান্তশিষ্ট দ্র একজন ছেলে। কারো সাতে-পাঁচে নেই, লেখাপড়াতেও ভালো সে কীভাবে মিম্মির বিষ নজরে পড়ে গেল কে জানে? রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের?”
“তুই জানিস না কিছু?”
রূপা মাথা নাড়ল, “না।”
“কী সর্বনাশ! সোহেলের বাবা-মা-” মিম্মি ইচ্ছে করে বাক্যটা শেষ না করে মাঝখানে থেমে গেল।
“কী হয়েছে সোহেলের বাবা-মায়ের?”
“হেভি ফাইটিং। এখন ডিভোর্স।”
রূপা চোখ কপালে তুলে বলল, “ডিভোর্স হয়ে গেছে?”
“না। এখনো হয়নি। কিন্তু হবে। যেরকম ডেঞ্জারাস অবস্থা ডিভোর্স যদি না হয় তা হলে মার্ডার।”
“মার্ডার?”
“হ্যাঁ। একটা না, ডাবল মার্ডার।”
ঠিক এরকম সময় সোহেলকে দেখা গেল, সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ক্লাশে ঢুকে একটা বেঞ্চে তার ব্যাগ রেখে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে ক্লাশের অন্য বন্ধুদের দিকে এগিয়ে গেল। তার চেহারা বা ভাবভঙ্গিতে কোথাও বাবা-মায়ের ডিভোর্স কিংবা ডাবল মার্ডারের চিহ্ন দেখা গেল না।
মিম্মি তাতেও খুব নিরুৎসাহিত হল বলে মনে হল না, জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল, “দেখলি? দেখলি?”
“কী দেখব?”
“এরকম একটা ব্যাপার ফ্যামিলিতে কিন্তু কাউকে একটুও বুঝতে দিচ্ছে না! কী কঠিন অভিনয়!”
“তুই কেমন করে জানিস? আসলে হয়তো ওগুলো কিছুই হয়নি—”
“হয়েছে।”
“ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করে দেখি।” রূপা গলা উঁচিয়ে সোহেলকে ডাকার চেষ্টা করল, “এই সোহেল শুন তো একটু।”
মিম্মি লাফিয়ে রূপার মুখ চেপে ধরল। তাই শব্দটা বের হতে পারল না। মিম্মি বলল, “সর্বনাশ! তুই কী করছিস? জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
“তুই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস-জানাজানির বাকি থাকল কী?”
“আমি সবাইকে মোটেও বলে বেড়াচ্ছি না।”
“এই যে আমাকে বললি।”
“তোকে বলা আর সবাইকে বলা এক কথা হল?”
“তুই আর কাউকে বলিসনি?”
“না।” মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “আর কাউকে বলিনি। শুধু তানিয়া আর টুশি আর–”
রূপা মাথা নেড়ে বলল, “আর মৌমিতা আর সাবা আর বৃষ্টি আর মিলি আর সামিয়া আর লিজা-”
“বলিনি।” মিম্মি গলা উঁচিয়ে বলল, “মোটেও আমি লিজাকে বলিনি। আমি লিজার সাথে কথা পর্যন্ত বলি না। তুই এত বড় মিথ্যুক।”
রূপা প্রায় হাল ছেড়ে দিল। দিনটা এখনো শুরু হয়নি, এখনই পেটে খিদে লেগে গেছে, সারাটা দিন কেমন করে যাবে? খিদে পেটে তার আর মিম্মির সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছা করল না। সে চুপ করে গেল। এমনিতেই চুপ করে যেত তার কারণ ঠিক তখন সঞ্জয় হেলতে-দুলতে এগিয়ে আসছিল। সঞ্জয় হচ্ছে তাদের ক্লাশ জোকার, সে সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে, সেই ঠাট্টা তামাশা নিয়ে অন্য কেউ হাসুক আর নাই হাসুক সে নিজে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
সঞ্জয় এসে ডেস্কে তার ব্যাগটা রেখে একবার রূপার দিকে তাকাল তারপর মিম্মির দিকে তাকাল, তারপর কথা নেই, বার্তা নেই, হি হি করে হাসতে শুরু করল। রূপা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই এভাবে হাসছিস কেন ছাগলের মতো?”
রূপার কথা শুনে সঞ্জয়ের হাসি মনে হয় আরো বেড়ে গেল–সে তখন একটু বাঁকা হয়ে পেটে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করে। মিম্মি এবারে একটু রেগে গেল, ধমক দিয়ে বলল, “কী হল তোর? বলবি এখানে হাসির কী আছে?”
সঞ্জয় অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “তো-তোরা দুজন–” সে কথা শেষ করতে পারল না আবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
“আমরা দুজন কী?”
“তোদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে—” আবার হাসি।
”আমরা দুজন কী?”
“মনে হচ্ছে তোদের দুজনকে কেউ আধ-চামচ করে ইয়ে খাইয়ে দিয়েছে।” বলে সঞ্জয় আবার হাসিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। মিম্মি বোকার মতো জানতে চাইল, “কীয়ে খাইয়ে দিয়েছে?”
সঞ্জয় হাসতে হাসতে লাফাতে থাকল, মিম্মির কথার উত্তর দিল না। কোনো জিনিস খাইয়ে দেওয়াটা এরকম হাসির ব্যাপার হতে পারে সেটা অনুমান করতে অবশ্যি মিম্মি বা রূপা কারোই অসুবিধে হল না। রূপা হাত পাকিয়ে ঘুষির ভঙ্গি করে বলল, “দেখ সঞ্জয় নোংরা কথা বলবি না।”
রূপার কথা শুনে সঞ্জয়ের মনে হল আরো হাসি পেয়ে গেল, এবারে হাসির দমকে তার শরীর কাঁপতে থাকে, মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হয় না। হাসি মনে হয় এক ধরনের সংক্রামক ব্যাপার, সঞ্জয়ের একেবারে পুরোপুরি অর্থহীন বোকার মতো হাসি দেখে রূপা আর মিম্মিরও হাসি পেয়ে যায়, তারাও একসময় হাসতে শুরু করে। রূপা হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক আছে সঞ্জয়, অনেক হয়েছে। এখন থাম।”
সঞ্জয় হাসতে হাসতে বলল, “থামতে পারছি না! কিছুতেই থামতে পারছি না।”
এটা সঞ্জয়ের সমস্যা-সে যখন একবার হাসতে শুরু করে তখন সে আর থামতে পারে না। একেবারে বিনা কারণে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে থাকে। রূপা বলল, “যদি থামতে না পারিস তা হলে বাইরে চলে যা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাক।”
সঞ্জয় মাথা নেড়ে একটু কাছে এসে কোনোমতে একটু হাসি থামিয়ে বলল, “আমাকে শক্ত করে একটা কিল দে দেখি।”
“কিল?”
“হ্যাঁ।” আবার হাসি।
”কেন?”
“জোরে কিল দিলে মনে হয় হাসিটা থামাতে পারব।” কথা শেষ করে আবার হাসি।
রূপা কিল নয় একটা ফুলসাইজ ঘুষি দেওয়ার জন্যেই হাত পাকিয়ে এগিয়ে গেল কিন্তু ঠিক তখন অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা পড়ে গেল। ঘণ্টার শব্দের কারণেই হোক বা অন্য কারণেই হোক সঞ্জয়ের হাসি থেমে আসে। সে তখন তার শার্টের হাতায় নিজের নাকটা মুছে নিল, হাসি তখনো দমকে দমকে আসছে। সেটা সামলে নিয়ে
সে চোখ মুছতে মুছতে অ্যাসেম্বলির জন্যে এগিয়ে যায়।
অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাশে ফিরে এসে রূপা তার জায়গায় বসল। তার বামদিকে বসেছে লিজা, ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী এবং সবচেয়ে অহংকারী মেয়ে। এই মেয়েটি একবারও ভুলতে পারে না যে তার চেহারা ভালো, সারাক্ষণই সে তার চেহারা নিয়ে কিছু না কিছু করছে। সে যখন কথা বলে বা হাসে তার মাঝেও একটা ঢং ঢং ভাব থাকে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লিজা কিছু করতেই পারে না। তার ডান পাশে বসেছে রাজু–চুপচাপ নিরীহ ধরনের ছেলে। ছোটখাট সাইজ, চোখে বড় চশমা। চেহারাটা একেবারে সাধারণ একটা ছেলের মতো, দেখলে কখনোই আলাদাভাবে চোখ পড়ে না। বেশ অনেকদিন রাজু তাদের ক্লাসে আছে রূপা এখনো ভালো করে বুঝতে পারে না ছেলেটা কী লেখাপড়ায় ভালো না খারাপ। ক্লাশে স্যার-ম্যাডামেরা যখন প্রশ্ন করেন তখন কখনো সে হাত তুলে প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে না। মনে হতে পারে সে বুঝি উত্তর জানে না–কিন্তু কখনো যদি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় সে আস্তে আস্তে ইতস্তত করে ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে দেয়! যে একটা প্রশ্নের উত্তর জানে সে কেন হাত তুলে সেটা বলার চেষ্টা করবে না রূপা এখনো বুঝতে পারে না।
প্রথম পিরিওডে জ্যামিতি ক্লাশ। জ্যামিতি পড়ান মকবুল স্যার-খুব ভালো জ্যামিতি জানেন তা নয় কিন্তু স্যারের উৎসাহ আছে, যেটা নিজে বুঝেছেন সেটা বোঝনোর জন্যে খুব চেষ্টা করেন। অন্যান্য দিন রূপা এই ক্লাশে মনোযোগ দেয়, আজ ঠিক মনোযোগ দিতে পারছিল না। সকালবেলা বাসা থেকে বের হবার সময় যে মেজাজটা খিচে গিয়েছিল সেটা আর কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছিল না।
জ্যামিতি ক্লাশের পর ইংরেজি ক্লাশ। ইংরেজি ক্লাশ নেন জিনিয়া মিস। জিনিয়া মিস স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস। সবসময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই তার ক্লাশে আসতে দেরি হয়। আজকেও দেরি হতে থাকল আর পুরো ক্লাশের ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে হইচই শুরু করে দিল। ক্লাশ ক্যাপ্টেন মাসুক ক্লাশের সামনে গিয়ে একটা খাতা খুলে চোখ পাকিয়ে বলল, “খবরদার কেউ কথা বলবি না, তা হলে কিন্তু নাম লিখে ম্যাডামকে দিয়ে দেব।”
কেউ তার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। সবাই জানে মাসুকের মনটা খুবই নরম। কোনোদিন সে কোনো ছেলে বা মেয়ের নাম লিখে স্যার কিংবা ম্যাডামকে দিতে পারবে না। মাসুককে কোনো পাত্তা না দিয়ে সবাই নিজেদের মাঝে কথা বলতে লাগল। অন্যদিন হলে রূপা নিজেও কথা বলতে শুরু করত কিন্তু আজকে তার আর ইচ্ছে করছিল না। সে ডেস্কে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে বসে ক্লাশের সবাইকে দেখতে লাগল।
“তোমার কী হয়েছে? কিছু নিয়ে মন খারাপ?” গলার স্বর শুনে রূপা ঘুরে তাকাল, রাজু একটা গল্পের বই পড়ছিল (বইয়ের নাম কবি, লেখকের নাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), পড়া বন্ধ করে চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। .
রূপা বলল, “না। মন খারাপ কেন হবে?”
রাজু বলল, “ও আচ্ছা ঠিক আছে।” তারপর সে আবার কবি বইয়ে ডুবে গেল। রূপা কিছুক্ষণ রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার কেন মনে হচ্ছে আমার মন খারাপ?”
রাজু বইটা বন্ধ করে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ক্লাশে কোনো কথা বলছ তো তাই!”
“আমি কী ক্লাশে বেশি কথা বলি?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। খুব বেশি না। কিন্তু স্যারেরা যখন ভুলভাল পড়ায় তখন তুমি সবসময় স্যারদের ধর। আজকে কিছু বলনি। কাউকে ধরনি।”
“মকবুল স্যার ভুলভাল পড়িয়েছেন?”
“হ্যাঁ। সিরিয়াস উল্টাপাল্টা জিনিস পড়িয়েছেন।” রাজু দাঁত বের করে হাসল। রূপা লক্ষ করল রাজুর দাঁতগুলো সুন্দর, টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো। একটা ছেলের মুখে এত সুন্দর দাঁত অপচয়ের মতো। মেয়েদের মুখে হলে অনেক মানাত।
রূপা জিজ্ঞেস করল, ”স্যার উল্টা-পাল্টা জিনিস পড়ালে তুমি ধরলে না কেন?”
রাজু খুক খুক করে হাসল যেন রূপা খুব মজার কথা বলেছে, “আমি কখনো কাউকে ধরি না!”
“আমি ধরি। আমি কাউকে ছাড়ি না।”
“জানি। সেই জন্যে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার মন খারাপ কি না–আজকে ছেড়ে দিলে তো।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক মন খারাপ না–একটু মেজাজ খারাপ।”
রাজু বলল, “ও আচ্ছা।”
রূপা লক্ষ করল রাজু ছেলেটা জানতে চাইল না কী নিয়ে মেজাজ খারাপ! মনে হয় কখনোই সে নিজে থেকে কিছু জানতে চায় না। রূপা হঠাৎ করে নিজেই বলে ফেলল, “আজকে আমার আম্মু আমাকে খুব বকা দিয়েছে। শুধু শুধু।”
ছেলেটা হাসি হাসি মুখে বলল, “আম্মুরা সবসময় বকাবকি করে, সেগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হয়।”
“যদি বের না হয়?”
“চেষ্টা করলে সব বের হয়ে যায়।”
রূপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আজ সকালে নাস্তা পর্যন্ত করতে পারি নাই।”
“তুমি নাস্তা করনি?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
রাজু তখন তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা বড় চকলেটের বার বের করে রূপার দিকে এগিয়ে দিল, বলল, “নাও এইটা খাও।”
“আমি খাব?”
“হ্যাঁ।”
রূপা একটু লজ্জা পেয়ে গেল, মাথা নেড়ে বলল, “না, না! আমি কেন খাব?”
“খেয়ে দেখ, খুব মজা। আমেরিকার চকলেট, মিস্টার গুডবার। এইটা খেয়ে একটু পানি খেয়ে নিলে তোমার পেট ভরে যাবে।”
এত বড় চকলেটের বার দেখে রূপার জিবে একেবারে পানি এসে যাচ্ছিল তারপরও সে বলল, “না, না তুমি খাও।”
“আমি খেয়েছি। আমি সকালে পেট ভরে নাস্তা করে এসেছি। তুমি খাও, খুবই মজা এটা, খেয়ে দেখ।”
রূপা ভদ্রতা করে বলল, “ঠিক আছে আমি একটু ভেঙে খাই।”
রাজু চকলেটের বারটা রূপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “একটু ভেঙে খেলেই তোমাকে পুরোটা খেতে হবে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একটু খেয়ে দেখ থামতে পার কি না।”
রূপা একবারও ভাবেনি যে সে লোভীর মতো পুরোটা খেয়ে ফেলবে কিন্তু সত্যি সত্যি পুরোটা খেয়ে ফেলল। রাজু তখন পানির বোতলটা এগিয়ে দিল, রূপা ঢক ঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে বলল, “থ্যাংকু।”
রাজু হাসি হাসি মুখ করে তার বইটা খুলে বলল, “তোমার মেজাজটা এখন কী একটু ভালো হয়েছে?”
“একটু না, অনেকখানি ভালো হয়েছে!”
“গুড।” রাজু বলল, “স্যারেরা ভুলভাল পড়ালে ধরার জন্যে প্রস্তুত?”
রূপা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “প্রস্তুত।”
.
০২.
আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন সোফায় বসেছে, তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের উত্তেজনা। এক্ষুনি তাদের হিন্দি সিরিয়াল শুরু হবে, দেখে মনে হচ্ছে তারা আর অপেক্ষা করতে পারছে না। এটা প্রত্যেকদিন রাতের ঘটনা–পুরো এক ঘণ্টা তারা বসে বসে এই হিন্দি সিরিয়াল দুটি দেখে। কপাল ভালো, মাত্র দুটি সিরিয়াল দেখায়, যদি আরো বেশি দেখাত তা হলে তারা আরো বেশি দেখত।
এমনিতে সবসময় আম্মুর মেজাজ খুব গরম থাকে, শুধু যখন হিন্দি সিরিয়ালগুলো শুরু হয় তখন আম্মুর মেজাজটা নরম হয়। আম্মু তখন একটু হাসাহাসি করেন। সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলেন। রূপা লক্ষ করেছে তাদের কথাগুলো শুনলে মনেই হয় না চরিত্রগুলো টেলিভিশনের চরিত্র, মনে হয় তারা সত্যি মানুষ নিয়ে কথা বলছে। একটা সিরিয়ালে রূপার বয়সী একটা মেয়ে আছে, রূপার মনে হয় আম্মু রূপাকে যতটুকু ভালোবাসেন তার থেকে একশ গুণ বেশি ভালোবাসেন ঐ মেয়েটিকে। হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে সবাই হিন্দি শিখে গেছে। আজকাল কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই তারা হিন্দিতে এক-দুইটা শব্দ কিংবা পুরো একটা বাক্য বলে ফেলেন।
পুরো ব্যাপারটাই রূপার কাছে খুবই জঘন্য একটা বিষয় মনে হয় কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সময়টাই হচ্ছে রূপার সবচেয়ে প্রিয় সময়! এই সময় রূপা আর সুলতানা ছাড়া বাসায় সবাই হিন্দি সিরিয়াল দেখে তাই তাদের কেউ বিরক্ত করে না। সুলতানার যদি রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার আর বাসন ধোয়া শেষ হয়ে যায় তা হলে সে চুপি চুপি রূপার ঘরে আসে, তার সাথে ফিসফিস করে কথা বলে!
আজকেও যখন আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন ড্রয়িং রুমে বসে বসে তাদের প্রিয় হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তখন সুলতানা চুপি চুপি রূপার ঘরে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “রূফ-রূফালী, কী কর?”
রূপা বলল, “শব্দটা মোটেও রূফ-রূফালী না। রূপ-রূপালী।”
সুলতানা বলল, “তাই তো বলছি, রূ-ফ-রূ-ফা-লী।”
রূপা বলল, “শুধু তুমি বললে তো হবে না। সেটা আমাদের শুনতেও হবে।”
সুলতানা দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমার কানে সমিস্যা আছে সেইটা আমার দোষ?”
রূপাও দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সেইটা মনে হয় ঠিকই বলেছ! সমস্যাটা মনে হয় আমার কানে।”
সুলতানা রূপার বিছানায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে একটা নিশ্বাস ফেলল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “সব কাজ শেষ?”
সুলতানা রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজ কখনো শেষ হয়? হয় না।”
কথাটা সত্যি, এই বাসায় কাজ কখনো শেষ হয় না। সেই অন্ধকার থাকতে সুলতানা ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করে, সবাই ঘুমিয়ে যাবার পরও তাকে সবকিছু গুছিয়ে ঘুমাতে হয়। তারপরেও কাজ শেষ হয় না।
সুলতানা তার ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে বলল, “যত কাজই করি খালাম্মার গালি তো শুনতেই হবে। তাই একটু বিশ্রাম নেই।”
রূপা বলল, “হ্যাঁ। বিশ্রাম নাও।”
রূপা সুলতানার দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি শ্যাম্পু দিয়ে মাথার চুলগুলো ধুয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেওয়া যায়, সুন্দর একটা থ্রী-পিস, কামিজ কিংবা একটা শাড়ি পরিয়ে, হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে কপালে একটা টিপ দিয়ে তাকে বই মেলায় নিয়ে যাওয়া হয় তা হলে কেউ বুঝতেই পারবে না সুলতানা কারো বাসায় কাজ করে। রূপা আর সুলতানা একই বয়সের, অথচ দুইজনের জীবনে কত পার্থক্য।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “সুলতানা, তুমি পড়তে পার?”
“একটু একটু।”
“স্কুলে গিয়েছিলে?”
“বাবা বেঁচে থাকতে গেছিলাম।”
“লেখাপড়া করতে মন দিয়ে?” সুলতানা দাঁত বের করে হাসল, “দুষ্টামি বেশি করছি লেখাপড়া থেকে।”
রূপা টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে সুলতানার হাতে দিয়ে বলল, “পড় দেখি এই বইটা।”
সুলতানা বইটি ওলট-পালট করে দেখল, ওপরের ছবিটি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল, তারপর বইটা খুলে পড়ার চেষ্টা করল, যুক্তাক্ষরগুলো পড়তে একটু সমস্যা হল কিন্তু সে বেশ সহজেই বেশ খানিকটা পড়ে ফেলল।
রূপা বলল, “বাহ! তুমি তো বেশ ভালোই পড়তে পার। তুমি পড় না কেন?”
সুলতানা হি হি করে হাসল, বলল, “কী পড়মু? কখন পড়মু? যখন খালাম্মা সকালবেলা বলবে এই সুলতাইন্যা, এক কাপ চা দে। তখন আমি বলমু, খাড়ান খালাম্মা। আমি এখন পত্রিকা পড়ি!” কথা শেষ করে সে আবার হাসিতে ভেঙে পড়ে।
বিষয়টা ঠিক হাসির বিষয় না কিন্তু সুলতানার কথা বলার ভঙ্গিটা দেখে রূপাও হেসে ফেলল। বলল, “তুমি কখন পড়বে সেটা অন্য ব্যাপার, কিন্তু লেখাপড়া জানাটা তো ভালো।”
সুলতানা মুখটা হঠাৎ করে গম্ভীর করে ফেলল, বলল, “কী জন্যে ভালো বল দেখি? তোমার লেখাপড়া জানা দরকার। লেখাপড়া শেষ করবার পর জজ বেরিস্টার হবা। বিয়া-শাদি করবা। আমার কী জন্যে দরকার?”
রূপা একটু বিপদে পড়ে গেল, লেখাপড়া নিয়ে সে যেসব ভালো ভালো কথা জানে, স্কুলে রচনা লেখার সময় যে কথাগুলো লিখে ভালো নম্বর পায় তার কোনোটাই সে বলতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, “কত ভালো ভালো গল্পের বই আছে, উপন্যাস-নাটক আছে সেগুলো পড়তে পারবে।”
সুলতানা হি হি করে আবার হাসতে লাগল, বলল, “খালাম্মা যখন বলবেন, এই সুলতাইন্যা, গোসলের জন্যে গরম পানি দে, তখন আমি বলমু, খাড়ান খালাম্মা, এই উপিন্যাসটা শেষ কইরা লই!”
রূপা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুলতানা তখন তাকে থামাল, বলল, “খালাম্মা তোমারেই গল্পের বই পড়তে দেন না! যদি আমারে গল্পের বই পড়তে দেখেন তাইলে এক্কেবারে হার্টফেল মারব!”
রূপা কিছু বলল না, কথাটা সত্যি। তার আম্মু যদি কখনো আবিষ্কার করেন সুলতানা বসে বসে গল্পের বই পড়ছে তা হলে সত্যি সত্যি ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। রূপা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “বুঝলে সুলতানা, বইয়ের মাঝে অনেক কিছু থাকে যেটা অন্য কোথাও থাকে না। আম্মু যখন আমাকেও বকাবকি করে তখন মনটা খুব খারাপ হয়। তারপর আমি যখন একটা ভালো বই পড়ি তখন মনটা আবার ভালো হয়।”
সুলতানা মন দিয়ে কথাটা শুনল তারপর বলল, “কী থাকে তোমার বইয়ের মাঝে?”
“কত কিছু!”
“বল দেখি একটা।”
রূপা তখন তার প্রিয় একটা বইয়ের একটা গল্প শোনাল। যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া একটা বাচ্চা মেয়ের গল্প। সুলতানা চুপ করে পুরোটি শুনল। গল্প শেষ হবার পর সে তার ওড়না দিয়ে চোখ মুছে একটা নিশ্বাস ফেলল। ঠিক তখন ড্রয়িংরুমে হিন্দি সিরিয়াল শেষ হয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যায়। সুলতানা সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে রান্নাঘরে ছুটে গেল। তাকে রূপার ঘরে দেখলে বিপদ হতে পারে।
.
খাবার টেবিলে বসেও সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। আম্মা বললেন, “দমন্তী কী নিষ্ঠুর দেখেছ? আনিলার সাথে কী খারাপ ব্যবহার করল!”
আব্বু বললেন, “হ্যাঁ। মানুষ বলেই গণ্য করে না।”
আপু বলল, “জাসিন্দর কিছু বলে না কেন?”
আম্মু বললেন, “একেবারে ভীতুর ডিম। মেরুদণ্ড বলে কিছু নাই।”
আব্বু পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন, “সামাজিক একটা স্ট্যাটাস আছে তো-সেখান থেকে বের হতে পারছে না। জাসিন্দরের মনটা কিন্তু ভালো কিন্তু নিজের ফ্যামিলিকে আপসেট করতে চায় না।”
আম্মু প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললেন, “এই সিচুয়েশানে যদি অভিক থাকত–তা হলে দেখতে কত সুন্দর করে পুরো বিষয়টা সামলে নিত–”
রূপা অবাক হয়ে একবার তার আব্বু আরেকবার তার আম্মুর মুখের দিকে তাকাতে লাগল–এরকম বড় বড় মানুষ হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিয়ে এইভাবে কথা বলতে পারে তার নিজেরও বিশ্বাস হতে চায় না।
খাবার মুখে দিয়ে হঠাৎ করে আম্মুর ভালো মেজাজ গরম হয়ে উঠল, হুংকার দিয়ে বললেন, “সুলতানা”
সুলতানা ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দাঁড়াল, “জে খালাম্মা–”
আম্মু সবজিটা দেখিয়ে বললেন, “এটা কী?”
সুলতানা ঢোক গিলে বলল, “কেন খালাম্মা? কী হইছে?”
আম্মু চিৎকার করে বললেন, “দেশে লবণ পাওয়া যায় না? তরকারিতে লবণ দিসনি কেন?”
রূপা সবজিটা মুখে দিয়ে দেখল, লবণ একটু কম হতে পারে কিন্তু লবণ দেয়নি কথাটা সত্যি না।
রূপার মনে পড়ল আম্মুর ব্লাড প্রেশার ধরা পড়েছে তাই ডাক্তার বলেছে খাবারে লবণ কম থাকতে হবে সেই জন্যে মাত্র গতকাল আম্মু সুলতানাকে সেই বিষয়ে লেকচার দিয়েছেন। মনে হয় সুলতানা সেই জন্যেই সবজিতে লবণ একটু কম দিয়েছে। আম্মু আবার চিৎকার করলেন, “কেন লবণ দিসনি?”
সুলতান বলল, “দিছি তো। একটু কম দিছি–আপনি কালকে বললেন, একটু কম দিতে–”
“আমি কম দিতে বলেছি, না দিতে তো বলিনি। বলেছি?” আম্মুর মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল, “বদমাইশ কোথাকার! কত বড় সাহস আবার আমার সাথে মুখে মুখে কথা বলিস? ছোটলোকের ঝাড়, এই বাসায় তোরে ঢুকতে দেওয়াই ভুল হয়েছে। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতি না খেয়ে না দেয়ে মা-ভাই বোন নিয়ে ঘরে ঘরে ভিক্ষা করে বেড়াতি, মানুষের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে বড় হতি তা হলে একটা উচিত শিক্ষা হত।”
সুলতানা একটা কথাও না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এতে মনে হয় আম্মুর রাগ আরো বেড়ে গেল, হাত বাড়িয়ে খপ করে সুলতানার চুল ধরে নিজের কাছে টেনে এনে একটা ঝাঁকুনি দিলেন তারপর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। সুলতানা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। ফ্যাকাসে মুখে সে সবার দিকে তাকাল, রূপা দেখল ঠোঁট কামড়ে সে অনেক কষ্টে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করছে।
আন্ধু বললেন, “হয়েছে হয়েছে, এখন ছেড়ে দাও। এমনিতেই তোমার ব্লাড প্রেশার, তোমার এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক না।”
“আমার কী এমনি এমনি ব্লাড প্রেশার হয়েছে? এই ছোটলোকের বাচ্চাদের সাথে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ক্যাট ক্যাট ক্যাট ক্যাট করতে করতে আমার ব্লাড প্রেশার হয়েছে। এরা দায়ী। এরা–”
রূপা প্লেটে তার খাবারগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, তার ইচ্ছে করছিল খাওয়া বন্ধ করে উঠে যায় কিন্তু তা হলে অবস্থা মনে হয় আরো খারাপ হয়ে যাবে। সুলতানার সাথে সাথে তাকেও মনে হয় এক হাত নিয়ে নিবে।
রাত্রিবেলা যখন সবাই শুয়ে পড়েছে তখন রূপা পায়ে পায়ে রান্নাঘরে হাজির হল। সুলতানা রান্নাঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে একটা টিনের থালায় কিছু ভাত নিয়ে খাচ্ছে। তারা যখন খেয়েছে তখন টেবিলে অনেক কিছু ছিল, সুলতানার প্লেটে সেসব কিছু নেই, একটা বড় কাঁচা মরিচ শুধু আলাদা করে চোখে পড়ে।
সুলতানা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, “কী হইছে রূফ-রূফালী!”
রূপা বলল, “রূফ-রূফালী না, রূপ-রূপালী।”
সুলতানা ফিক করে হাসল, “সেইটা বলতে আসছ?”
“না। সেইটা বলতে আসি নাই। আমি আমি–”
“তুমি কী?”
“আমি বলতে এসেছি যে আমি খুবই সরি। মানে খুবই দুঃখিত।”
সুলতানা হাসি হাসি মুখে বলল, “কেন?”
“আজকে আম্মু তোমার সাথে যেরকম ব্যবহার করেছে সেইটা দেখে।”
সুলতানা আবার খেতে শুরু করল। মুখে একটু ভাত দিয়ে বলল, “আজকে তো বেশি কিছু করে নাই। খালি চুল ধইরা একটা ধাক্কা–”
“মানে?”
সুলতানা প্লেটটা নিচে রেখে বাম হাতটা দিয়ে তার কামিজটা একটু উপরে তোলে, রূপা দেখে পিঠে লাল হয়ে খানিকটা জায়গায় দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে আছে। রূপা শিউরে উঠল, “কীভাবে হয়েছে?”
“একটা গেলাস হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছিল।”
রূপা কিছু বলতে পারে না, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সুলতানা সহজ গলায় বলল, “আসলে মারপিট আমি সহ্য করতে পারি। গরিব মানুষ হইছি একটু লাথি ঝাঁটা খামু না সেইটা তো হতে পারে না। কিন্তু যখন তোমাদের সামনে গায়ে হাত দেওয়া তখন লজ্জা লাগে।”
সুলতানা মাথা নিচু করে তার থালার ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগল। রূপা দেখল সেখানে টপ করে তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল। একটু পর সুলতানা যখন মুখ তুলে তাকাল তখন অবশ্যি তার চোখে-মুখে মন খারাপের কোনো চিহ্ন নেই, হাসি হাসি মুখ।
রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, “তুমি এখানে কেন পড়ে আছ? তুমি চলে যাও না কেন?”
“যদি দরকার হয় চলে যাব। তুমি চিন্তা কইরো না।”
“আম্মু যদি তোমার উপর এইভাবে অত্যাচার করে তা হলে তো তোমার এখনই চলে যাওয়া উচিত।”
সুলতানা কোনো কথা বলল না, প্লেট থেকে আরেক দলা ভাত মুখে নিয়ে কাঁচা মরিচটাতে কড়াৎ করে কামড় দিল। রূপা বলল, “তোমার বাড়িতে কে আছে?”
“বুড়া মা আছে। আর কেউ নাই।”
“তা হলে তুমি কই যাবা।”
“আমার দূর সম্পর্কের একটা বইন আছে। জোবায়দা। তার কাছে।”
“জোবায়দা কোথায় থাকে?”
সুলতানা রূপার দিকে তাকাল, তার দুই চোখে কৌতুক। ”তুমি জোবায়দার কথা ভুলে গেছ?”
রূপা অবাক হয়ে বলল, “আমি চিনি জোবায়দাকে?”
“সবাই চিনে।”
“সবাই চেনে?”
“হ্যাঁ।” সুলতানা আরেক দলা ভাত মুখে দিয়ে কাঁচা মরিচটাতে কড়াৎ করে আরেকটা কামড় দিয়ে বলল, “টেলিভিশনে আসছিল, পত্রিকায় আসছিল, মনে নাই? গলায় দড়ি দিল কয়দিন আগে?”
রূপা চমকে উঠল, তার মনে পড়ল, কয়দিন আগে একটা বাসার কাজের মেয়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছিল, সেটা নিয়ে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে কয়দিন খুব হইচই হয়েছিল। রূপা চোখ বড় বড় করে সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি সুইসাইড করার কথা বলছ?”
“বলছি না। কিন্তু এই রাস্তাটা খোলা আছে চিন্তা করলে বুকে জোর পাই।”
রূপা রান্নাঘরে হাঁটু গেড়ে বসে সুলতানার হাত ধরে বলল, “প্লীজ প্লীজ সুলতানা এরকম কথা মুখে এনো না। প্লীজ!”
“ঠিক আছে মুখে আনমু না। কিন্তু মাথায় যদি চলে আসে কী করমু বল।” সুলতানা প্লেটটা নিচে রেখে তার ওড়নাটা খুলে দেখাল, “এই যে তেল-কালি লাগা ওড়না পেঁচায়া গলায় বানতে হবে, তারপর ঐ শিকের মাঝে বেঁধে একটা লাফখুবই সোজা!”
রূপা একেবারে শিউরে উঠল। বলল, “ছিঃ! এইভাবে বলে না।”
“ঠিক আছে রূফ-রূফালী বলব না।”
“রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।”
সুলতানা হাসল, রূপাও হাসল। রূপা তখন দুই হাত দিয়ে সুলতানার হাত ধরে বলল, “শোনো সুলতানা। আমি যখন বড় হব তখন তুমি আর আমি একসাথে থাকব, কেউ তখন তোমারে কিছু করতে পারবে না।
সুলতানা রূপার দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে হঠাৎ পানি টলটল করতে থাকে। সে বাম হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল, “তুমি যে এইটা বলেছ সেই জন্যেই বুকটা ভইরা গেছে। এই বাসায় তুমি আছ দেখে আমি সব সহ্য করতে পারি। বুঝছ রূফ-রূফালী?
“রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।”
“রূ-ফ-রূ-ফা-লী!” সুলতানা আবার হাসল, রূপা অবাক হয়ে দেখল সুলতানার হাসিটা কী সুন্দর। না কি সবার হাসিই সুন্দর?
.
০৩.
ক্লাশে এসে রূপা ডেস্কে তার ব্যাগটা রাখার আগেই মিম্মি ছুটে এলো। গলা নামিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, “জানিস কী হয়েছে?”
রূপা অনুমান করল, বিশেষ কিছু হয়নি। মিম্মির কথা বলার ঢঙটাই এরকম। এমনভাবে শুরু করবে যে সবারই মনে হবে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে। মিম্মি অবশ্যি রূপার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না গলা আরো নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “সোহেলের বাবা-মা” তারপর দুই হাত বিচিত্র একটা ভঙ্গি করে নাড়াল। এভাবে হাত নাড়ার অর্থ যা কিছু হতে পারে, সোহেলের বাবা-মা একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলেছেন কিংবা একজন আরেকজনের হাত ধরে নাচানাচি করছেন।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের বাবা-মায়ের!”
“কমপ্লিট ছাড়াছাড়ি।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“না জানার কী আছে?” মিম্মি ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, “আমার কাছে সব খবর আসে। তা ছাড়া দেখিসনি সোহেল ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিয়েছে?”
“বন্ধ করে দিয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
রূপা খেয়াল করেনি। ক্লাশে এত ছেলেমেয়ে কে কখন আসে, কখন যায় সে। লক্ষ করতে পারে না, মিম্মি পারে। জিজ্ঞেস করল, “কেন ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিয়েছে?”
“বুঝতে পারছিস না? কেমন করে আমাদের মুখ দেখাবে?”
“মুখ দেখাতে সমস্যা কী?”
মিম্মি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তুই কিছুই বুঝিস না! বাবা-মা ছাড়াছাড়ি হলে ছেলেমেয়েদের লজ্জা হয় না? সেই লজ্জায় সে আর মুখ দেখাতে পারে না!”
রূপা দেখল ঠিক তখন সোহেল তার ব্যাগ দুলাতে দুলাতে ক্লাশ রুমে ঢুকল। তার মুখে লজ্জার কোনো চিহ্ন নেই। মুখটা একটু শুকনো তার বেশি কিছু নয়। সোহেলকে দেখে মিম্মি কেমন যেন হকচকিয়ে যায়।
রূপা মিম্মিকে বলল, “ঐ তো সোহেল। দেখি জিজ্ঞেস করে—”
মিম্মি খপ করে রূপার হাত ধরে বলল, “সর্বনাশ! কী জিজ্ঞেস করবি?”
“ওর বাবা-মায়ের কী অবস্থা–”
”মাথা খারাপ হয়েছে তোর? কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করে? কত বড় লজ্জা–”
রূপা মিম্মির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “লজ্জার কী আছে।”
মিম্মি রূপাকে ধরে রাখার চেষ্টা করল, রূপা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোহেলের কাছে গিয়ে বলল, “সোহেল, তোর সবকিছু ঠিক আছে?”
সোহেল বলল, “হ্যা–” তারপর রূপার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আসলে ঠিক নাই।”
“কী হয়েছে?”
“অনেক লম্বা স্টোরি।”
“বলবি আমাকে?”
“কী আর বলব! আম্মু-আব্বুর অনেকদিন থেকে ঝগড়া। এখন মামারা এসে আম্মুকে নিয়ে গেছে। ছোট ভাইটাসহ।”
রূপা কিছু না বলে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল। সোহেল বলল, “কয়দিন থেকে মনটা ভালো নাই।”
“ভালো থাকার কথা না।”
“কয়দিন খালি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি।”
“এখন?”
“আজকে ক্লাশে আসলাম। কিছু ভাল্লাগে না।”
রূপা নরম গলায় বলল, “আমাদের বলিস, যদি কিছু করতে পারি।”
সোহেল হাসার চেষ্টা করল, “তুই আর কী করবি?”
“তবুও। অনেক সময় যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন কারো সাথে কথা বললে একটু মন ভালো হয়।”
সোহেল বলল, “উঁহু। হয় না। সবকিছু ভুলে থাকতে পারলে হত। ভুলে থাকার রাস্তা তো একটাই–”
“কী রাস্তা?”
সোহেল মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্। কিছু না।”
রূপা দুশ্চিন্তিত মুখে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
বিজ্ঞান ক্লাশে সোহেল একটু বিপদে পড়ল। বিজ্ঞান স্যার সবাইকে অম্ল-ক্ষার নিয়ে একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছিলেন, স্যারকে সবাই যমের মতো ভয় পায় তাই সবাই নিয়ে এসেছে। শুধু সোহেল আনেনি। স্যার, হুংকার দিয়ে বললেন, “হোমওয়ার্ক আনিসনি কেন?”
সোহেল দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। কী বলল সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। স্যার আরো জোরে হুংকার দিলেন, “কী বলছিস পরিষ্কার করে বল।”
“স্যার, বাসায় একটু ঝামেলা ছিল।”
“কী ঝামেলা?”
“এই তো মানে স্যার ইয়ে স্যার–”
”ইয়ে মানে আবার কী?”
সোহেল বলল”মানে স্যার ঝামেলা।”
“বদমাইশ পাজি হতভাগা। লেখাপড়ার নামে কোনো নিশানা নাই শুধু। ফাঁকিবাজি? একটা হোমওয়ার্ক পর্যন্ত করতে পারিস না?”
সোহেল কাচুমাচু মুখ করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার।”
“ভুল?” স্যার চিৎকার করে বললেন, “ভুল আর বদমাইশীর পার্থক্য জানিস ফাজিল কোথাকার? খুন করে ফেলব তোকে। খুন করে ফেলব।”
স্যার এগিয়ে গিয়ে খপ করে সোহেলের চুল ধরে ফেললেন, প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “পাজির পা ঝাড়া কোথাকার। একেবারে খুন করে ফেলব।”
রূপার কাছে পুরো ব্যাপারটা একেবারে অসহ্য মনে হল, কিন্তু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। স্যার সোহেলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, বললেন, “লেখাপড়া করার ইচ্ছা আছে? না কি নেই?”
সোহেল বিড়বিড় করে বলল, “জানি না স্যার।”
স্যার ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললি?”
সোহেল বলল, “না স্যার আর কিছু বলি নাই।”
স্যার আর কিছু বললেন না। সোহেলকে ছেড়ে দিয়ে ক্লাশের সামনে চলে গেলেন। যখন ক্লাশ চলছিল রূপা মাঝে মাঝেই সোহেলকে লক্ষ করছিল। কেমন যেন আনমনা হয়ে বসে আছে। মনে হয় চারপাশে কী হচ্ছে সে কিছুই লক্ষ করছে না।
পরদিন থেকে সোহেল ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিল।
.
চারদিন পরের কথা। রূপা স্কুলে গিয়ে নিজের ক্লাশে যাচ্ছে, মিম্মি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আচার খাচ্ছিল, রূপাকে দেখে লুকিয়ে ফেলল। রূপা সেটা না দেখার ভান করে বলল, “সোহেলের কোনো খবর জানিস?”
“জানি।”
“কী জানিস? ক্লাশে আসে না কেন?”
“তোর মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তুইও ক্লাশে আসতি না।”
“আরো বেশি আসতাম।”
মিম্মি গলা উঁচিয়ে বলল, “আসতি না।”
“অবশ্যই আসতাম। একশবার আসতাম।”
পাশ দিয়ে রাজু যাচ্ছিল, সে দাঁড়িয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কোথায় একশবার আসবে?”
মিম্মি চোখ পাকিয়ে বলল, “আমরা আমাদের কথা বলছি তুমি তার মাঝে নাক গলাতে চাও কেন?”
মিম্মি কথাটা বলল খুবই খারাপভাবে যে কেউ শুনলে অপমানে তার কান লাল হয়ে উঠত। রাজুর কিছু হল না, সে খিক খিক করে হেসে ফেলল, “ঠিকই বলেছ। আমার নাকটা মনে হয় বেশি লম্বা যেখানে-সেখানে গলিয়ে দিই।” বলে
সে নিজের নাকটা টানাটানি করে দেখল, আসলেই সেটা লম্বা কি না।
কথা শেষ করে রাজু চলে যাচ্ছিল, রূপা তাকে থামাল। বলল, “রাজু, তুমি কি জান সোহেল চারদিন ধরে ক্লাশে আসে না?”
“চারদিন থেকে?”
“হ্যাঁ।”
“আজ বিকেলে সোহেলের বাসায় গিয়ে খোঁজ নেব।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “ওর বাসা কোথায় জান?”
“না।”
“তা হলে কেমন করে যাবে?”
“খোঁজ করে বের করে ফেলব।” রাজু বলল, “আমার লম্বা নাকটা সোহেলের বাসাতেও গলিয়ে ফেলব।” তারপর মিম্মির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রাজু হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
মিম্মি চোখ পাকিয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে রূপাকে বলল, “দেখলি? দেখলি? আমাকে খোঁচা মেরে গেল?”
রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “ঠিকই করেছে। তোর মাঝে মাঝে খোঁচা খাওয়ার দরকার আছে।”
.
স্কুল ছুটির পর রাজু সবাইকে বলল, “সোহেল চারদিন থেকে স্কুলে আসে না, আমি খোঁজ নিতে যাচ্ছি। তোমরা আর কেউ আমার সাথে যেতে চাও!”
ক্লাশে সবাই সবাইকে তুই তুই করে বলে, রাজু একটু ব্যতিক্রম। সে কেন জানি সেটা করতে পারে না, সবাইকে তুমি করে বলে। সেই জন্যে অন্যদেরও তাকে তুমি করে বলতে হয়। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “তুমি জান সোহেলের বাসা কোথায়?”
“হ্যাঁ। কাছেই।”
“যদি দেরি না হয় তা হলে আমি যেতে পারি।”
রাজু বলল, “গুড।” তারপর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর কেউ?”
সঞ্জয় বলল, “আমো যাম্বো।”
মিম্মি ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে?”
“মানে হচ্ছে আমি যাব।” বলে সে হি হি করে হাসতে থাকে।
রূপার খুব ইচ্ছে করল বলতে যে সেও যাবে। কিন্তু সে বলতে পারল না, বাসায় না বলে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বাসায় তা হলে তাকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলবে।
সবাই স্কুল থেকে একসাথে বের হল, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয়ের সাথে সাথে রূপাও হেঁটে যেতে থাকে। তারা তিনজন সোহেলের বাসার দিকে যাবে, রূপা তখন হেঁটে নিজের বাসায় চলে যাবে। চারজন গল্প করতে করতে যাচ্ছিল, এক জায়গায় রাজু হঠাৎ থেমে গেল, এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা গলি দেখিয়ে বলল, “এখন এই দিকে।”
রূপা বলল, “তোরা যা। আমি বাসায় যাই।”
মিম্মি বলল, “আমাদের সথে চল কিছুক্ষণের জন্যে।”
“না। বাসায় বলে আসিনি।”
রাজু বলল, “কাছেই বাসা। বেশিক্ষণ লাগবে না।”
রূপা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “আমি বেশিক্ষণ থাকব না। তা হলে দেরি করে বাসায় গেলে খুব রাগ করবে।”
“ঠিক আছে। তোমাকে বেশিক্ষণ থাকতে হবে না। আমরাও থাকব না। খোঁজ নিয়েই চলে যাব।”
খানিক দূর, হেঁটে একটা বাসার সামনে রাজু দাঁড়িয়ে বলল, “এই বাসাটা।”
সামনে একটা গেট, তারা ধাক্কা দিয়ে গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে একটা ভোলা জায়গা, খোয়া দেওয়া রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে শুকনো কিছু ফুলের গাছ। তারা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজায় ধাক্কা দিল। কোনো সাড়া নেই, তাই আবার দরজা ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে একজন মেয়েলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”
রাজু বলল, “আমরা। সোহেলের বন্ধু।”
তখন একজন মহিলা দরজা খুলে দিল, রাজু জিজ্ঞেস করল, “সোহেল বাসায় আছে?”
“মনে হয় নাই।” বলে মহিলাটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজু বলল, “আমরা তার সাথে দেখা করতে এসেছি। গিয়ে একটু দেখবেন?”
মহিলাটা মনে হয় একটু বিরক্ত হল। বলল, “এই রকম সময় সোহেল স্কুলে থাকে।”
রাজু বলল, “সে স্কুলে নাই। আমরা স্কুল থেকে এসেছি।”
“তা হলে কোথায় জানি না।”
রূপা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “একটু আগে বলেছেন মনে হয় নাই। এখন বলছেন কোথায় জানি না। আমাদের জানতে হবে।”
সঞ্জয় বলল, “ইমার্জেন্সি-স্কুল থেকে আমাদেরকে পাঠিয়েছে। ভেতরে খবর দেন। রিপোর্ট করে দিলে সমস্যা হবে।
সঞ্জয়ের হুমকিতে মনে হয় কাজ হল। মহিলাটি বলল, “ঠিক আছে, আমি দেখি তার ঘরে আছে না কী।”
মহিলাটি ভেতরে চলে গেল, একটু পরে এসে বলল, “ঘরে আছে।”
রাজু বলল, “আসতে বলেন, আমরা কথা বলব।”
মিম্মি বলল, “তার চাইতে আমরা সোহেলের ঘরে চলে যাই?”
মহিলা বলল, “যান। বারান্দা দিয়ে গেলে শেষ ঘর।”
চারজন বারান্দা দিয়ে হেঁটে শেষ ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল। দরজাটা খোলা, ভেতরে বিছানায় সোহেল গুটিসুটি মেরে বসে আছে। পরনে একটা ময়লা পায়জামা আর ঢোলা টি-শার্ট। ওদেরকে দেখে সে একটু অবাক হয়ে তাকাল, “তোরা?”
রাজু বলল, “তুমি তো কয়েকদিন থেকে স্কুলে যাও না, তাই খোঁজ নিতে এসেছি। তুমি ভালো আছ তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ভালো আছি।” সোহেল হড়বড় করে বলল, “ভালো থাকব না কেন? খুব ভালো আছি।” বলে সে হাসি হাসি মুখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
রাজু একটু এগিয়ে গিয়ে সোহেলের হাতটা ধরার চেষ্টা করতেই সে ঝট করে তার হাত সরিয়ে নিয়ে একটু সরে বসল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে তুমি স্কুলে যাও না কেন?”
“যাব। যাব। যাব। স্কুলে যাব।” সোহেল বিড় বিড় করে বলল, “স্কুলে যাব।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “এই কয়দিন যাওনি কেন?”
“এই তো এমনি। দুই-তিনদিন স্কুলে না গেলে কী হয়? কিছু হয় না। আবার যাব।”
সঞ্জয় এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “এইটা তোর ঘর?”
“হ্যাঁ। আমার আর সাদিবের। সাদিব এখন নাই। সাদিব মানে বুঝেছিস তো? আমার ছোট ভাই। ক্লাশ ফোরে পড়ে। ক্লাশ ফোর।”
সঞ্জয় চারদিকে তাকিয়ে বলল, “তোর ঘরের এই অবস্থা কেন? মনে হয় এইটা কেউ কোনোদিন পরিষ্কার করে না।”
সোহেল হি হি করে হাসল, হাসিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। মনে হল জোর করে হাসির মতো শব্দ করছে, হাসতে হাসতে বলল, “পরিষ্কার করবে না কেন? পরিষ্কার করে। কয়দিন থেকে কাউকে ঘরে ঢুকতে দেই না।”
রাজু জিজ্ঞেস করল, “কেন ঢুকতে দাও না?”
“এমনি।”
রাজু একটু কাছে গিয়ে বলল, “সোহেল, তুমি আমার কাছে একটু আসবে?”
সোহেল হঠাৎ করে কেন জানি মুখ শক্ত করে ফেলল, “কেন? আমি কেন তোমার কাছে যাব?”
“এমনি। একটু কাছে আস। আমার দিকে তাকাও।”
“আমি কেন তোমার দিকে তাকাব?” সোহেল হঠাৎ রেগে উঠল, অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কী তোদের আসতে বলেছি? তোরা কেন এসেছিস?”
রূপা বলল, “তুই এতদিন স্কুলে যাবি না আর আমরা তোর খোঁজ নিতে পারব না?”
“কে বলেছে খোঁজ নিতে? যা এখন। তোরা যা।”
রাজু অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা যাও।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “তুমি যাবে না?”
“আমি একটু পরে যাব।”
“না।” সোহেল চিৎকার করে বলল, “তুমিও যাও।” সে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, “যা, তোরা যা। সবাই বের হয়ে যা।”
সবাই দেখল তার হাতটা কাঁপছে।
রাজু খুব শান্ত গলায় বলল, “রূপা, মিম্মি আর সঞ্জীব, তোমরা যাও। আমি সোহেলের সাথে একটু কথা বলে আসছি।”
সোহেল বলল, “আমি কারো সাথে কথা বলব না। না, বলব না।”
রাজু সোহেলের কথাকে গুরুত্ব দিল না, অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও। তোমরা যাও। বাসায় যাও।”
রূপা, মিম্মি আর সঞ্জয় ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাইরের ঘরের দরজা খোলা, তারা বের হয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। রাস্তায় না ওঠা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। খানিকক্ষণ চুপ করে হাঁটার পর সঞ্জয় বলল, “আজিব ব্যাপার। সোহেলের মাথা মনে হয় আউলে গেছে।”
আজিব বলে কোনো শব্দ নাই শব্দটা আজব, তারপরেও কেউ সেটা শুদ্ধ করে দিল না।
.
পরদিন ক্লাশে ঢুকে রূপা প্রথমেই রাজুকে খুঁজে বের করল। ক্লাশের পিছন দিকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় রাজু বসে বসে একটা গল্পের বই পড়ছে। রূপা কাছে গিয়ে ডাকল, “এই রাজু।”
রাজু বইটার পৃষ্ঠা ভাঁজ করে বইটা বন্ধ করল (পদ্মা নদীর মাঝি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়), রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “কী রূপা?”
“কালকে কী হল?”
রাজু এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “ভালো না।”
“কী হয়েছে?”
“খুব সিরিয়াস। এখন কাউকে বলা ঠিক হবে না। তোমাকে বলি।”
“বল।”
“সোহেল ড্রাগস ধরেছে।”
রূপা আঁতকে উঠল, “সর্বনাশ!”
“হ্যাঁ। দেখেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। আমি চোখের মণির দিকে দেখতে চাইছিলাম, ড্রাগ খেলে সেগুলো ফুলে যায় আমাকে কাছে আসতে দিচ্ছিল না মনে আছে?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“তোমরা চলে যাবার পর আমি চেপে ধরলাম, তখন স্বীকার করেছে। হাউমাউ করে কান্না।”
“কেন ড্রাগস ধরেছে?”
রাজু ভুরু কুঁচকে বলল, “ফ্যামিলিতে অশান্তি। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, ছোট ভাইটাকে নিয়ে মা চলে গেছে। মন খারাপ, স্কুলে বন্ধু-বান্ধব নাই একা একা থাকে। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় খারাপ খারাপ কিছু বন্ধু জুটেছে, তারা শিখিয়েছে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাওয়ার না কী এক নম্বর ওষুধ।”
“কী সর্বনাশ! এখন কী হবে?”
“আমি জানি না।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “ওকে বোঝাওনি?”
“বুঝিয়েছি। কিন্তু লাভ কী? এমন ড্রাগস আছে একবার খেলেই তুই আটকে যাবি আর ছুটে আসতে পারবি না। খেতেই হবে তোকে, খেতেই হবে।”
“কী ড্রাগস খায়?”
“জানি না। বুলবুলি না ভুলভুলি কী একটা নাম বলল। ছোট ছোট লাল-নীল ট্যাবলেট।”
“কোথা থেকে কিনে?”
“ওই যে তার রাস্তার বন্ধু। তারা দেয়।”
“টাকা পায় কোথায়?”
“বাসা থেকে চুরি করে।”
“ওর বাসার কেউ জানে না?”
রাজু মাথা নাড়ল, “কে জানবে? আছেই তো শুধু বাবা। বাবার কোনো কিছু নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।”
“এখন কী করা যায়?”
রাজু তখন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন মিম্মি এসে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কী নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করছিস?”
রূপা বলল, “তোকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে?”
রাজু হাসল, বলল, “না তোমাকে নিয়ে না। সোহেলকে নিয়ে।”
“কী হয়েছে সোহেলের? আমরা চলে আসার পর কথা বলেছে তোমার সাথে?”
“নাহ্!” রাজু মাথা নাড়ল, “বলেনি। আমার সাথে ঝগড়াঝাটি করল।”
মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “সোহেলটা কত বড় বেয়াদব দেখেছিস? আমরা গিয়েছি তার খোঁজ নিতে, আর আমাদেরকে বাসা থেকে বের করে দিল। তোমার সাথে ঝগড়া করল।”
“আহা বেচারা। মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেই জন্যে মন খারাপ।”
“তাই বলে এরকম ব্যবহার করবে?”
রূপা বলল, “ছেড়ে দে। মন খারাপ হলে মানুষ কত কিছু করে।”
মিম্মি এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “এদিকে কী হয়েছে জানিস?”
“কী হয়েছে?”
মিম্মি আরো গলা নামিয়ে ফেলল, প্রায় ফিসফিস করে বলল, “লিজা কী। করেছে জানিস?”
“কী করেছে?”
“তার তো ধারণা সে হচ্ছে বিশ্ব সুন্দরী। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। সেইদিন একটা দোকানে গিয়েছে থ্রী-পিস কিনতে–”
মিম্মি তখন সবিস্তারে লিজাকে নিয়ে বিচিত্র একটা ঘটনার কথা বলতে শুরু করল, রূপা শোনার ভান করল, হুঁ হুঁ করল, মাথা নাড়ল, মাঝে মাঝে চোখে-মুখে অবাক হবার ভান করতে লাগল, কিন্তু তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগল সোহেলের কথা। সোহেল হাতটা তুলে রেখেছে, হাতটা কাঁপছে কিছুতেই রূপা সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারছে না। সোহেলের চোখে-মুখে এক ধরনের অস্থির অস্থির ভাব। তার দুই চোখের মাঝে বিচিত্র একটা দৃষ্টি। কী ছিল সেই দৃষ্টিতে?
রূপা হঠাৎ করে বুঝতে পারে সোহেলের দুই চোখে ছিল আতঙ্ক। ভয়ংকর আতঙ্ক।
.
০৪.
সোহেলকে নিয়ে কী করা যায় কিংবা আসলেই কিছু করা সম্ভব কী না সেটা নিয়ে রূপা আর রাজু চিন্তা করছিল। সমস্যা হচ্ছে বিষয়টা নিয়ে নিরিবিলি যে দুইজন একটু কথা বলবে তারও কোনো সুযোগ পাচ্ছিল না। স্কুল শুরু হওয়ার পর সারাদিন ক্লাশ, ছুটির পর রূপাকে বাসায় যেতে হয়। দুইজনে পরামর্শটা করবে কীভাবে?
কিন্তু সমস্যাটা সমাধান হয়ে গেল হঠাৎ করে। ব্যাপারটা ঘটল এভাবে :
স্কুলে যে কয়জন স্যার আর ম্যাডাম আছেন তার মাঝে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছেন বিজ্ঞান স্যার। দেশে না কী আইন করা হয়েছে স্কুলে ছেলেমেয়েদের পিটানো যাবে না কিন্তু বিজ্ঞান স্যারের সেটা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, ক্লাশে এসে যখন খুশি তখন ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলেন। এই স্যারের মার খেয়েই সোহেল ক্লাশে আসা ছেড়ে দিয়েছে।
সেদিন মাত্র ইংরেজি ক্লাশ শেষ হয়েছে, বিজ্ঞান ক্লাশ শুরু হবে। স্যার পরমাণুর গঠনের উপর একটা হোমওয়ার্ক করতে দিয়েছিলেন সবাই সেটা হাতে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। এই স্যারের ক্লাশে একটা আতঙ্কের মাঝে সময় কাটে, যখন খুশি স্যার যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারেন। ভালো করে লেখাপড়া করে এলেও কেউ এই স্যারের ক্লাশে নিরাপদ না।
সবাই যখন নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে তখন দেখা গেল বিজ্ঞান স্যারের বদলে ছোটখাট হাসিখুশি একজন মহিলা ক্লাশে উঁকি দিলেন। মাথা ঢুকিয়ে বললেন, “ক্লাস এইট, সেকশান বি?”
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম!”
ম্যাডাম ক্লাশে ঢুকলেন। হাতে একটা বই ছিল সেটা টেবিলে রাখলেন তারপর ক্লাশের সবার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকালেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ এখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, বিজ্ঞান স্যার কোথায় গেলেন, তার বদলে এই ম্যাডাম কোথা থেকে এলেন?
ম্যাডাম বললেন, “আমি তোমাদের নতুন বিজ্ঞানের ম্যাডাম।”
সবাই বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা বাতাসটুকু কোনোভাবে বের করল, কিন্তু এখনো বুঝতে পারছিল না। এটা আসলেই বিশ্বাস করা ঠিক হবে কী না। মাসুক বলল, “পাকাঁপাকি?”
ম্যাডাম হেসে ফেললেন, জিজ্ঞেস করলেন, “পাকাঁপাকি মানে?”
“মানে আপনি এখন থেকে সবসময় বিজ্ঞান পড়াবেন?”
“হ্যাঁ।”
সাথে সাথে ক্লাশের সবাই আনন্দের মতো একটা চিৎকার করল। ম্যাডাম হাত তুলে থামানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, “আস্তে আস্তে! তোমাদের হয়েছে কী? এত চিৎকার করছ কেন?”
সঞ্জয় বলল, “ম্যাডাম আপনি জানেন না বিজ্ঞান স্যার আমাদের উপর কত অত্যাচার করতেন। পিটিয়ে আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিতেন। আমাদের
ম্যাডাম হাত তুলে সঞ্জয়কে থামালেন, বললেন, “দাঁড়াও দাঁড়াও! আমি প্রথম দিন এসেই অন্য স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে চাই না।”
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা বলতে লাগল, “শুনতে হবে। শুনতে হবে।”
“না, শুনব না।” ম্যাডাম মুখটা একটু শক্ত করে বললেন, “তার চাইতে আমি কী বলি তোমরা সেটা শুনো।”
শেষ পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা শান্ত হল। ম্যাডাম তখন সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমাদের স্কুলে নতুন এসেছি। আমি বিজ্ঞানের শিক্ষক, কোনো একটা ক্লাশে আমার বিজ্ঞান পড়ানোর কথা। আমাকে উঁচু ক্লাশে দিতে চেয়েছিল আমি রাজি হইনি।”
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কেন রাজি হননি ম্যাডাম?”
“তা হলে সিরিয়াসলি পড়াতে হবে। আমার সিরিয়াসলি পড়াতে ভালো লাগে।”
সবাই আবার আনন্দের শব্দ করল। ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “তোমরা এরকম চিৎকার করছ কেন?”
মাসুক বলল, “আনন্দে।
“কীসের আনন্দে?”
“আপনি পড়াবেন না, সেই আনন্দে।”
“আমি মোটেও বলিনি তোমাদের পড়াব না।”
সঞ্জয় দাঁত বের করে হেসে বলল, “বলেছেন ম্যাডাম। বলেছেন।”
“আমি বলেছি আমার সিরিয়াসলি পড়াতে ভালো লাগে না।”
“একই কথা ম্যাডাম!”
“না। মোটেও একই কথা না। আমি তোমাদের পড়াব, তবে অন্যরকমভাবে পড়াব।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে পড়াবেন?”
“একটু অন্যরকমভাবে। যখন শুরু করব তখন দেখবে। এখন একটা অন্য কাজ করা যাক।”
“কী কাজ ম্যাডাম?”
“এই যে ক্লাশ রুম, এটা খুবই বোরিং। ক্লাশ রুমটা একটু অন্যরকম করে ফেলি!”
সবাই আবার আনন্দের শব্দ করল। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “অন্য কী রকম?”
ম্যাডাম ক্লাশের চারদিকে তাকালেন, তারপর মনে মনে কী একটা হিসাব করলেন তারপর বললেন, “বেঞ্চগুলো ঠেলে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিই। তা হলে মাঝখানে ফাঁকা জায়গা হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কথা বলা যাবে!”
সঞ্জয় দাঁত বের করে হাসল, বলল, “কী মজা হবে।”
ম্যাডাম বলল, “চল তা হলে করে ফেলা যাক!”
“চলেন ম্যাডাম।” বলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বেঞ্চগুলো ঠেলে ঠেলে চারপাশে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্লাশরুমটাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগতে থাকে, ফাঁকা এবং ভোলামেলা! ম্যাডাম চারদিকে তাকালেন, খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, “ক্লাশ শেষ হবার পর আবার আগের মতো করে দিতে হবে কিন্তু!”
মাসুক বলল, “করে দেব ম্যাডাম। কোনো চিন্তা করবেন না।” মাসুক ক্লাশ ক্যাপ্টেন কাজেই তার কথাবার্তা অন্যরকম।
ক্লাশে সবাই গোল হয়ে ঘিরে বসে আছে, ম্যাডাম মাঝখানে। ঘুরে ঘুরে কথা বললেন, তাই ক্লাশটাকে মোটেও ক্লাশরুমের মতো মনে হয় না। ম্যাডাম বললেন, “সারা পৃথিবীতে খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটেছে। সেটা কী, কে বলতে পারবে?”
লিজা বলল, “এইডস ম্যাডাম।”
“হ্যাঁ। সেটা যথেষ্ট ভয়ংকর–আমি অবশ্য এইডসের কথা বলছিলাম না। আমি আরো সাধারণ বিষয়ের কথা বলছিলাম-লেখাপড়া সংক্রান্ত”
সবাই মাথা চুলকাতে থাকে তখন ম্যাডাম নিজেই বললেন, “সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞান পড়ায় ছাত্র-ছাত্রীরদের আগ্রহ কমে গেছে। আমাদের দেশেও কমেছে। বড় বড় দেশে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা। তারা গরিব দেশের মেধাবী বিজ্ঞানের ছাত্রদের টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দেশে নিয়ে আসবে। অবস্থার সামাল দিয়ে দেবে। আমরা কী করব?”
সঞ্জয় বলল, “আমাদের দেশের কাউকে বিদেশ যেতে দেব না। দড়ি দিয়ে পা বেঁধে রাখব।” কথা শেষ করে সে আনন্দে দাঁত বের করে হি হি করে হাসল।
ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “সেটা একটা সমাধান হতে পারে। সেটা করার জন্যে তোমাকে দড়ি নিয়ে স্কুলে স্কুলে, কলেজে কলেজে আর ইউনিভার্সিটিতে ইউনিভার্সিটিতে ঘুরে বেড়াতে হবে।”
সবাই হি হি করে হেসে উঠল। ম্যাডাম বললেন, “তার চেয়ে সহজ সমাধান হবে অনেক বেশি ছেলেমেয়েদেরকে বিজ্ঞান পড়ানোতে আগ্রহী করা। সেটা কীভাবে করা যাবে?”
লিজা বলল, “বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে।”
“উঁহু। জোর করে লেখাপড়া করানো যায় না।”
মিম্মি বলল, “যারা বিজ্ঞান পড়বে তাদের সবাইকে একটা করে মোবাইল ফোন দিলেই সবাই চলে আসবে!”
ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “না। লোভ দেখিয়েও লেখাপড়া করানো যায় না।”
রূপা বলল, “সবাইকে সায়েন্স ফিকশন পড়ালে-”
ম্যাডাম একটু ইতস্তত করে বললেন, “সায়েন্স ফিকশন তো আসলে ফিকশান-মানে গল্প! সেটা পড়লে কতটুকু লাভ হবে বুঝতে পারছি না। তবে সায়েন্স বা বিজ্ঞানের আগ্রহ যদি ছোট থাকতে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তা হলে বড় হলে তারা মনে হয় সায়েন্স নিয়ে পড়বে। আমি সেই মিশন নিয়ে এসেছি।”
সঞ্জয় বলল, “গুড মিশন!”
ম্যাডাম বললেন, “থ্যাংকু!”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “বিজ্ঞানের আগ্রহ তৈরি করার জন্যে কী করবেন ম্যাডাম?”
“ক্লাশের সবাইকে নিয়ে অনেকগুলো বিজ্ঞানের প্রজেক্ট করব। মজার মজার প্রজেক্ট। আমার ধারণা নিজের হাত দিয়ে যখন সবাই মজার মজার বিজ্ঞানের প্রজেক্ট তৈরি করবে তখন অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে।”
“আমাদের কী কী প্রজেক্ট হবে ম্যাডাম?
“অনেক প্রজেক্ট। মনে করো আমরা টেলিস্কোপ তৈরি করতে পারি, মাইক্রোস্কোপ তৈরি করতে পারি, সোলার কার তৈরি করতে পারি, রোবট তৈরি করতে পারি, রকেট তৈরি করতে পারি, আরো কত কী!–”
মাসুক লাফ দিয়ে উঠে বলল, “আমি রোবট বানাতে চাই ম্যাডাম!”
ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “ভেরি গুড! তবে একজন তো পারবে না, তাই কয়েকজন মিলে একটা গ্রুপ তৈরি করতে হবে। ক্লাশটাকে অনেকগুলো গ্রুপে ভাগ করে দিই।”
রূপা জানতে চাইল, “এক গ্রুপে কতজন থাকবে?”
“চার থেকে পাঁচজন।”
“কারা কারা থাকবে গ্রুপে?”
“নিজেরা ঠিক করে নাও।”
সবার আগে লিজা দাঁড়িয়ে বলল, “আমার গ্রুপে থাকব আমি, তাহিরা, মৌমিতা, টুশকি আর বীথি।”
ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “উঁহু। শুধু মেয়েরা মেয়েরা গ্রুপ তৈরি করা যাবে না। মিলেমিশে করতে হবে। গ্রুপে ছেলেমেয়ে থাকবে। হিন্দু-মুসলমান থাকবে। চিকন-মোটা থাকবে। লম্বা-খাটো থাকবে। শান্ত-রাগী থাকবে। দুষ্টু-মিষ্টি থাকবে!”
ম্যাডামের কথার ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে ফেলল। তারপর সবাই নিজেরা নিজেরা কথা বলে গ্রুপ তৈরি করল। রূপা রাজুর সাথে কথা বলে একটা গ্রুপ তৈরি করল, সেই গ্রুপের মাঝে থাকল রূপা, রাজু, সঞ্জয়, মিম্মি আর সোহেল। আজকে ক্লাশে সোহেল নাই কিন্তু তাতে ম্যাডাম আপত্তি করলেন না। প্রত্যেকটা গ্রুপের একটা নাম দিতে হবে–ম্যাডাম সবাইকে পরের দিন নিজের গ্রুপের জন্যে একটা সুন্দর নাম ঠিক করে আনতে বললেন।
দেখা গেল গ্রুপের নাম ঠিক করা এত সহজ না। নাম ঠিক করতে গিয়ে লিজাদের গ্রুপ নিজেদের মাঝে ঝগড়া করে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, মাসুকের গ্রুপের মাঝে মারামারি হয়ে গেল। রূপাদের কম সমস্যা হল না, সঞ্জয় বলল নামটা হতে হবে মজার। মজার নাম হিসেবে সে ঠিক করল টুং টিং টাং! মিম্মি বলল যেহেতু এটা বিজ্ঞান সংক্রান্ত তাই নামের মাঝে একটা বিজ্ঞান বিজ্ঞান ভাব। থাকা দরকার, সে নাম দিল মিমিট্রন।
মিমিন্টুন নাম শুনে সঞ্জয় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল,
“মিমিট্রন? নিজের নাম দিয়ে গ্রুপের নাম? তা হলে সঞ্জয়ট্রন না কেন?”
মিম্মি বলল, “আমি মোটেও নিজের নাম দিয়ে নাম দেইনি। আমার নাম মিমি না আমার নাম হচ্ছে মিম্মি! এখানে মি এসেছে মিল্কিওয়ে থেকে।”
রূপা বলল, “তা হলে নাম রেখে দিই মিল্কিওয়ে!”
মিম্মি বলল, “উঁহু। মিল্কিওয়ে শব্দের মাঝে দুধ দুধ ভাব। মনে হবে আমরা গরুর ফার্ম।”
“তা হলে বাংলায় ছায়াপথ। ছায়াপথ অনেক সুন্দর নাম।”
মিম্মি ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল, “কেন? তোদের মিমিট্রন নামে আপত্তি কী? কী সুন্দর বৈজ্ঞানিক একটা নাম, মি-মি-ট্র-ন!”
রূপা, মিম্মি আর সঞ্জয় যখন নিজেদের মাঝে ঝগড়াঝাটি করছে তখন রাজু তার খাতায় কী কী যেন লিখছিল। রূপা একসময় ঝগড়ায় একটু বিরতি দিয়ে রাজুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করছ?”
“আমাদের টিমের নাম বের করার চেষ্টা করছি।”
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী বের করেছ?”
“একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমাদের পাঁচজনের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে একটা নাম তৈরি করি।”
সঞ্জয় বলল, সঞ্জয়ের স, রাজুর রা, রূপার রূ, মিম্মির মি আর সোহলের সো, তা হলে হয় সরারমিসো–কেমন হল এটা?” জাপানি জাপানি শোনা যায়!”
রাজু বলল, “পাঁচজনের পাঁচটা অক্ষর, সব মিলিয়ে মনে হয় ফ্যাক্টরিয়াল পাঁচভাবে সাজানো যাবে। ফ্যাক্টরিয়াল পাঁচ হচ্ছে একশ বিশ। কাজেই একশ বিশটা থেকে একটা বেছে নেওয়া যায়।”
মিম্মি মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এখন বসে বসে একশ বিশটা নাম লিখতে হবে?”
রাজু বলল, “উঁহু, আমি এর মাঝে একটা বের করেছি। রূমিসোরাস।”
“রামিসোরাস?”
“হ্যাঁ। এই নামের মাঝে একটা ডাইনোসর ডাইনোসর ভাব আছে। ডাইনোসরের নামের পিছনে সোরাস থাকে দেখিসনি? টাইরানোসোরাস, স্টেগোসোরাস, ব্রন্টোসোরাস-”
মিম্মি আবার বলল, “রূ-মি-সো-রা-স? তার মানে রূপার নামটা আগে?”
“সমস্যা কী? কোনো একজনের নাম তো প্রথমে থাকতে হবে।”
“তা হলে মিরূসোরাস না কেন?”
রূপা বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে মিম্মির নামটাই আগে থাকুক। মিরূসোরাস।”
মিম্মি বলল, “আমি মোটেও আমার নামটা আগে দিতে চাচ্ছি না। মিরূসোরাস শুনতে ভালো শোনায় সেই জন্যে বলছি।”
সঞ্জয় বলল, “রামিসোরাস আর মিরূসোরাসের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। তুই নিজের নামটা আগে দেওয়ার জন্যে মিরূসোরাস করতে চাচ্ছিস।”
মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “মোটেও না।”
সঞ্জয় বলল, “অবশ্য অবশ্য অবশ্যই।”
“না, না, না!”
আরেকটু হলে দুজনে মারামারি শুরু করে দিত, রূপা তখন ধমক দিয়ে সঞ্জয়কে থামাল, “আমি যদি আপত্তি না করি তা হলে তুই ঘ্যান ঘ্যান করছিস কেন?”
“আমি মোটেও ঘ্যান ঘ্যান করছি না। আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলছি।”
“থাক, থাক। এত যুক্তির দরকার নাই।”
রাজু বলল, “ব্যস অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এখন সবাই থাম। তা হলে আমাদের টিমের নাম হচ্ছে টিম মিরূসোরাস।”
রূপা বলল, “হ্যাঁ। টিম মিরূসোরাস।”
অন্যেরা মাথা নাড়ল।
.
পরের বিজ্ঞান ক্লাশে বিজ্ঞান ম্যাডাম আবার ক্লাশে বেঞ্চগুলো দেয়ালের কাছে সরিয়ে মাঝখানে জায়গা করে নিলেন। তারপর সবগুলো গ্রুপের নাম লিখে নিলেন। শুধু একটা গ্রুপের নাম বদলাতে হল–তারা নাম রেখেছিল টিম ধুরন্ধর, বিজ্ঞান ম্যাডাম সেটাকে বদলে করে দিল টিম সহজ-সরল। ধুরন্ধর কোনো টিমের নাম হতে পারে না। রূপাদের টিমের নামটা শুনে প্রথমে সবাই অবাক হল, যখন সেটা কীভাবে তৈরি হয়েছে বুঝতে পারল তখন সবাই মাথা নাড়তে লাগল, কেন তাদের মাথায় এই আইডিয়াটা আগে আসেনি সেটা নিয়েও কেউ কেউ আফসোস করল।
বিজ্ঞান ম্যাডাম তারপর কিছুক্ষণ কথা বললেন, তারপর সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন কে কী নিয়ে কাজ করতে চায়। মাসুক তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল
সে রোবট বানাতে চায়।
ম্যাডাম বললেন, “তোমার গ্রুপের অন্যেরা কী বলে?”
মাসুক বলল, “তারাও চায় ম্যাডাম।”
“তাদের মুখ থেকেই শুনি।
তখন তাদের গ্রুপের অন্যেরা উঠে দাঁড়াল। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করল, “তোমরাও কী রোবট তৈরি করতে চাও?”
একজন মাথা চুলকে বলল, “ইয়ে মানে, আমরা তো জানি না কেমন করে তৈরি করতে হয়।”
ম্যাডাম কিছু বলার আগেই মাসুক বলল, “আমরা শিখে নেব ম্যাডাম।”
“ঠিক আছে। ঠিক আছে!” ম্যাডাম একটু হাসলেন, “আমি হলে একটা কাজ করি। অনেকগুলো প্রজেক্ট নিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলি। তারপর তোমরা নিজেরা নিজেরা ঠিক করো কে কোনটা করতে চাও!”
সবাই রাজি হল। ম্যাডাম তখন কথা বলতে শুরু করলেন। কোনটা কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করলেন, কোনটা সোজা কোনটা কঠিন, কোনটা তৈরি করতে কী লাগবে সেগুলো বোঝালেন। সঞ্জয় রূপার পাশে বসেছিল, ম্যাডাম যেই প্রজেক্টের কথা বলে সে সেটাই শুনে মাথা নেড়ে বলল, “এইটাই আমাদের তৈরি করতে হবে! এইটা হচ্ছে ফার্স্ট ক্লাশ! এইটা হচ্ছে এক নম্বরী।”
ক্লাশের শেষে ম্যাডাম বললেন, “তোমরা গ্রুপের ছেলেমেয়েরা স্কুলের পরেও নিজেরা তোমাদের প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করো। বাসা কাছাকাছি থাকলে ছুটির দিনেও তোমরা কাজ করতে পার।”
রূপা তখন তার হাতে কিল দিয়ে মনে মনে বলল, “ইয়েস!” এখন তার সুযোগ হয়েছে স্কুল ছুটির পরে কিংবা ছুটির দিনে রাজুর সাথে পরামর্শ করা। সোহেল যেহেতু তাদের গ্রুপের একজন তার বাসাতে যেতেও এখন কোনো সমস্যা নেই। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারা গেল।
.
কাজটা অবশ্যি খুব সহজ হল না। রাতেরবেলা খেতে বসে রূপা প্রথমে কথাটা বলল। শুনে আম্মু ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, “এইটা কোন ধরনের ঢং? বই পড়বে, বই মুখস্থ করবে তার বদলে প্রজেক্ট? প্রজেক্ট আবার কী?”
রূপা মুখ গম্ভীর করে বিজ্ঞান ম্যাডামের কাছে শোনা কথাগুলো বলার চেষ্টা করল, “আম্মু, আজকাল সারা পৃথিবীতেই লেখাপড়াটা অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন আর কেউ কোনো কিছু মুখস্থ করে না। আগে স্যার-ম্যাডামরা পড়াত ছাত্র ছাত্রীরা শুনত। এখন ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীরাও কথা বলে-”,
আম্মু চোখ পাকিয়ে বললেন, “ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীরা কথা বলে? কী কথা বলে?”
“যেটা পড়ানো হয় সেটা নিয়ে আলোচনা করে। প্রশ্ন করে।”
“ক্লাশে আলোচনা করে? প্রশ্ন করে? বেয়াদবের মতো?”
“বেয়াদবী কেন হবে? ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের কথা বলতে বলে।”
আম্মু টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, “হতেই পারে না। লেখাপড়া হতে হবে লেখাপড়ার মতোন। আমরা স্কুলে বেতন দেই রং-তামাশা করার জন্যে?
তখন তিয়াশা বলল, “আম্মু লেখাপড়ার স্টাইল বদলে যাচ্ছে। আগে স্কুল ছিল ভয়ের জায়গা-এখন হবে আনন্দের জায়গা–”
আম্মু রূপাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। তার ভালো কথাটিও শুনতে চান না, কিন্তু তিয়াশা হচ্ছে আম্মুর প্রিয় মানুষ। তিয়াশার কথাকে আম্মু একটু হলেও গুরুত্ব দেন, তাই আম্মু তিয়াশার কথাটা শুনলেন তারপর গজগজ করতে লাগলেন, “এইটা কী হল? স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠাই যেন তারা লেখাপড়া শিখে আসবে, আদব-কায়দা শিখে আসবে–এখন দেখছি স্কুল হয়ে যাচ্ছে রং-তামাশার জায়গা, ঢংয়ের জায়গা।”
রূপা আবার চেষ্টা করল, “আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ দিলে তারা নিজেরা শেখে–”
আম্মু মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কোনোদিন শেখে না। শেখাতে হয় পিটিয়ে। বেত দিয়ে পিটিয়ে ছাল তুলে দিতে হয়। আমরা যখন স্কুলে পড়েছি তখন আমাদের এক স্যার ছিলেন এক চড়ে আমাদের ফার্স্ট গার্লের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। স্যারের কী তেজ ছিল, সিংহের মতোন।” সিংহের তেজওয়ালা স্যারের কথা চিন্তা করে এতোদিন পরেও আম্মুর চোখ-মুখ শ্রদ্ধায়-ভক্তিতে চকচক করতে থাকে।
রূপার ইচ্ছে হল বলতে, এখন এরকম হলে সিংহের তেজওয়ালা স্যারকে পুলিশে ধরে নিয়ে হাজতে আটকে ফেলবে। কিন্তু তার বলার সাহস হল না। রূপার প্রজেক্ট নিয়ে আরো আলোচনা হল আর শেষ পর্যন্ত আম্মু মেনে নিলেন। ঠিক হল মাঝে মাঝে প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তার বন্ধু-বান্ধবরা ছুটির পর কিংবা ছুটির দিনে আসতে পারবে। সে নিজেও যেতে পারবে, কিন্তু কবে কোথায় কখন কতক্ষণের জন্যে যাবে সেটা আগে থেকে বলে যেতে হবে। আর এই ধরনের কাজ-কর্মের জন্যে যদি লেখাপড়ায় ক্ষতি হয় কিংবা অন্য কোনোরকম সমস্যা হয় তা হলে তার ফল হবে ভয়ানক।
“অন্য কোনোরকম সমস্যা” বিষয়টা কী সেটা আম্মু পরিষ্কার করলেন না কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখেই রূপা আন্দাজ করে নিল সেটা কী হতে পারে। রূপা অবশ্যি এই হুমকিতে মোটেও ভয় পেল না, প্রথমবার বাসা থেকে স্বাধীনভাবে বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যেতে পারবে সেটা চিন্তা করেই আনন্দে তার নাচানাচি করার ইচ্ছা করছিল।
কিন্তু সে তার আনন্দটা মোটেও কাউকে বুঝতে দিল না, গম্ভীর মুখে খেতে লাগল।
০৫-৮. রাজুর মুখে হাসি
দরজা খুলে রূপাকে দেখে রাজুর মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল। প্রায় চিৎকার করে বলল, “রূপা! তুমি চলে এসেছ!”
রূপা বলল, “তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন? আমাদের সবারই তো আজকে আসার কথা!”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। আমি অবাক হইনি। আমি খুশি হয়েছি। আসো, আসো।–”
রাজু দরজা বন্ধ করতে করতে চিৎকার করে বলল, “আম্মু, দেখে যাও আমাদের রূপা চলে এসেছে।”
রূপা তার বাসার সাথে পার্থক্যটা ধরতে পারল, সে কোনোদিন তার আম্মুর সাথে এই ভাষায় কথা বলতে পারবে না।
রাজুর আম্মু উঁকি দিলেন, চশমা চোখে হাসিখুশি একজন মহিলা, চুলের মাঝখানে খানিকটা অংশ সাদা! তার আম্মুরও চুলে পাক ধরেছে, আম্মু অনেকখানি খাটাখাটুনি করে রং দিয়ে সেটা কালো রাখার চেষ্টা করেন। রাজুর আম্মুর পাকা চুল নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই বলে মনে হল।
রাজুর আম্মু হাসিমুখে বললেন, “এসো মা এসো! রাজুর মুখে তোমাদের কথা শুনি, তোমাদের এখনো সামনা-সামনি দেখা হয়নি।”
রূপা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। রাজু তাদের সম্পর্কে কী বলে কে জানে।
রাজু বলল, “বুঝলে আম্মু আমাদের রূপা হচ্ছে স্যার-ম্যাডামদের ত্রাস।”
“ত্রাস?” রাজুর আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “এই সুইট মেয়েটা ত্রাস হতে যাবে কোন দুঃখে?”
“আমাদের স্যার-ম্যাডামরা যদি ভুল-ভাল পড়ায় রূপা তখন কাঁক করে ধরে ফেলে! কাউকে ছাড়ে না।”
রাজুর আম্মু বললেন, “ওমা! স্যার-ম্যাডামরা ভুল পড়াবে কেন?
“পড়ায় আম্মু পড়ায়। তুমি জানো না।”
রাজুর আম্মু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “বুঝি না বাপু তোদের কথা। স্যার ম্যাডামেরা ভুল পড়ায় জন্মেও শুনিনি।” রাজুর আম্মু সুর পাল্টে বললেন, “পড়ালে পড়াক। তারা তাদের মতো পড়াবে, তোরা তোদের মতো শিখবি। তা হলেই তো ঝামেলা মিটে যায়। তাই না রূপা?”
রূপা মাথা নাড়ল। বলল, “জি। আমরা তাই করি। তা ছাড়া–”
“তা ছাড়া কী?”
“আমাদের স্যার-ম্যাডামেরা এত বোরিং, একটুও ক্লাশ করতে ইচ্ছে করে না। তাই যখন ভুল-ভাল পড়ান তখন ক্লাশটা ইন্টারেস্টিং হয়।”
রূপার কথা শুনে রাজুর আম্মু হি হি করে হাসতে লাগলেন যেন সে খুব একটা মজার কথা বলেছে। রূপা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, সে তার নিজের আম্মুকে এরকম একটা কথা বলার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আর যদি সে বলেও ফেলে তার আম্মু শুনে কোনোদিন এভাবে হি হি করে হেসে উঠবেন না। উল্টো তাকে বকে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবেন।
রাজু বলল, “আম্মু আমরা আমার রুমে বসছি। তুমি একটা কিছু খেতে দেবে আমাদের?”
রূপা তাড়াতাড়ি বলল, “আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি, আমার কিছু লাগবে না।”
“বাসা থেকে তো খেয়েই আসবে, তাই বলে এখানে কিছু খাবে না?” রাজুর আম্মু বললেন, “তোমাদের বাড়ন্ত শরীর, এখন অনেক খেতে হবে।”
রাজুর পিছু পিছু রূপা তার ঘরে গেল, বাসাটা একটু এলোমেলো, বড়লোকদের এক ধরনের সাজানো-গোছানো বাসা থাকে যেখানে মনে হয় কিছু ধরা যাবে না, ধরলেই কিছু একটা পড়ে ভেঙে যাবে, এখানে সেরকম কিছু নেই। বাসাটার মাঝে কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব। প্রত্যেকটা ঘরে বড় বড় বইয়ের তাক, সেই তাক ভর্তি শুধু বই আর বই। দেখে মনে হয় এটা বুঝি কারো বাসা না, এটা বুঝি একটা লাইব্রেরি।
রূপা বলল, “বাবারে বাবা! তোমাদের বাসায় কত বই!”
রাজু বলল, “বেশি না কি?”
“হ্যাঁ। অনেক বেশি, কারো বাসায় এত বই থাকে না।”
“বেশিরভাগই অখাদ্য! পড়া যায় না, কঠিন কঠিন প্রবন্ধ। আব্বু-আম্মু পড়ে যে কী মজা পায় কে জানে!”
রাজুর ঘরের মেঝেতে বসে তার ছোট ভাই-বোন খেলছিল, তাদের দেখে মুখ তুলে তাকাল, একজনের ফোকলা দাঁত, সে ফোকলা দাঁত বের করে হাসল। তার ভাই-বোনের সাথে রাজুর চেহারার মিল নেই, রাজুর এত ছোট ভাই-বোন আছে সে জানত না। তার একজন আঁতেল ধরনের বড় বোন আছে সেটাই শুধু শুনেছে।
ফোকলা দাঁতের ভাইটি একটা কাগজের প্লেন তৈরি করছিল, রাজুকে দেখিয়ে বলল, “ভাই দেখো, প্লেন।”
“ভেরি গুড।”
“এটা কী উড়বে ভাই?”
“উড়িয়ে দেখো।”
রূপা লক্ষ করল সে যে শুধু ক্লাশে তাদের সাথে তুমি তুমি করে কথা বলে তা নয়, ছোট ভাই-বোনদের সাথেও তাই করে।
ছোট ভাই প্লেনটা ছুঁড়ে দিল, নাক নিচের দিকে দিয়ে সেটা ডাইভ দিয়ে পড়ে গেল। ছোট বোনটি আনন্দে হাততালি দিল, “উড়ে না! উড়ে না!”
রাজু টেবিল থেকে দুইটা কাগজ হাতে দিয়ে বলল, “আবার বানাও-বানিয়ে বারান্দায় উড়াও। যাও।”
ভাই-বোন দুজন বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো কাগজ হাতে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে যাচ্ছিল, রাজু থামাল, বলল, “কী হল? আমাদের বাসায় একজন গেস্ট আছে তাকে কিছু বললে না?”
সাথে সাথে দুইজন কপালে হাত দিয়ে বলল, “স্লামালিকুম আপু।”
“ওয়ালাইকুম সালাম। তোমাদের কী নাম?”
ফোকলা দাঁত বলল, “আমার নাম ইদরিস আর ওর নাম জাহানারা।”
“ভেরি গুড।” রূপা মাথা নাড়ল, সে ভেবেছিল রাজুর ছোট ভাই-বোনের নাম আরো আধুনিক হবে। রূপম আর মৌমিতা কিংবা অনিক আর মৌটুশী।
বাচ্চা দুইজন চলে যাবার পর রাজু এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “ভালো হয়েছে তুমি আগে এসে গেছ। মিম্মি আর সঞ্জয় আসার পর সোহেলের ব্যাপার নিয়ে কথা বলা যাবে না।”
“কী খবর সোহেলের?”
“ভালো না।”
“কেন, কী হয়েছে?”
“দেখে কেমন যেন ভয় লাগে। আমাদের ক্লাশের ছেলে কিন্তু মনে হয় চিনি না। বাসা থেকে সকালবেলা স্কুলে যাবার কথা বলে বের হয়ে যায় বই-খাতা হাতে নিয়ে। স্কুলে আসে না, কোথায় কোথায় জানি ঘুরে বেড়ায়।”
“এখন কী করব?”
“সেইটাই তো চিন্তা করে পাচ্ছি না। বড় কোনো মানুষের সাথে কথা বলব কী না বুঝতে পারছি না।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “বড় কোন মানুষ?”
“বড় আপু।”
“তোমার বড় আপু কত বড়?”
“মেডিকেলে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বড় আপু মহা আঁতেল। তাকে বললেই সে একটা আঁতেল আইডিয়া নিয়ে আসবে।”
“তা হলে আর কে আছে বড়?”
“আবু-আম্মু।”
রূপা অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি বলতে পারবে?”
“কেন পারব না? আব্বু-আম্মু ঠিক ঠিক বলতে পারবে, কিন্তু—”
”কিন্তু কী?”
”আবু-আম্মু, আপু এদেরকে বলতে চাই না।”
রূপা মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে কেন রাজু বাসায় কাউকে বলতে চায়। সোহেল তাদের ক্লাশের ছেলে তার সম্পর্কে এরকম একটা কথা বলা অনেকটা নিজেদের সম্পর্কে বলার মতো। রূপা একটু চিন্তা করে বলল, “বিজ্ঞান ম্যাডামকে বললে কেমন হয়?”
রাজু মাথা নাড়ল, “আমিও চিন্তা করছিলাম। কিন্তু ম্যাডাম তো মাত্র এসেছেন এখনই বলতে কেমন লাগে।”
“তা ঠিক।”
রাজু বলল, “আমি কী ভাবছিলাম জান?”
“কী?”
“আমরা নিজেরা ব্যাপারটা একটু ভালো করে দেখি। লুকিয়ে সোহেলের পিছু পিছু ঘুরে ঘুরে দেখি সে কোথায় যায়, কার সাথে মেশে। কী করে। তারপর না হয় বড়দের সাথে কথা বলব।”
“এখন ব্যাপারটা শুধু তুমি আর আমি জানি। আমরা কী এইটা আর কাউকে বলব না? মিম্মিকে? সঞ্জয়কে?”
রাজু হি হি করে হাসল, “মিম্মিকে বলা আর পত্রিকায় হেডলাইন দিয়ে ছাপিয়ে ফেলা তো একই ব্যাপার!”
“কিন্তু আমরা পাঁচজন এক গ্রুপে, আমাদের আগে হোক পরে হোক বলতে তো হবেই। যদি এরা পরে জানে আমরা জেনেও তাদেরকে বলিনি তা হলে খুব রাগ হবে।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।”
রূপা বলল, তুমি অবশ্যি ঠিকই বলেছ, আমাদের ব্যাপারটা আরো ভালো করে বোঝা দরকার। সোহেল কী ড্রাগ খায়, সেই ড্রাগ খেলে কী হয় এইসব।”
রাজু মাথা নাড়ল, দুইজনে বসে আরো কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করল কিন্তু কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেল না। তারা অবশ্যি খুব বেশিক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করতে পারল না, প্রথমে সঞ্জয় তারপর মিম্মি এসে হাজির হল। সঞ্জয় বাসা বোঝাই বইগুলো দেখে বলল, “এতগুলো বই! কোনটা কোথায় আছে কেউ জানে?”
রাজু হাসল, “জানবে না কেন? গল্পের বই এক জায়গায়, কবিতার বই এক জায়গায়, মুক্তিযুদ্ধের বই এক জায়গায়
“যদি একটা বই এই হাজার হাজার বইয়ের মাঝে হারিয়ে যায় তখন কী করবে?”
“হারাবে কেন?”
“মনে কর কবিতার একটা বই কেউ প্রবন্ধের বইয়ের সাথে রেখে দিল-তখন কী হবে?”
“কী আর হবে?”
সঞ্জয় চোখ বড় বড় করে বলল, “তোমাদের কখনো হয়নি যে একটা বই সকালবেলা খোঁজা শুরু করেছ, সারাদিন খুঁজেও পাওনি?”
“সবসময় হয়। আমাদের বাসার এইটা হচ্ছে খুবই সাধারণ ঘটনা। কেউ না কেউ কিছু না কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছে!”
মিম্মি সরু চোখে রাজুর ছোট ভাই-বোন দুইজনকেই খুব ভালো করে লক্ষ করল। তারপর রূপার কাছে এসে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি, রূপা–এই দুইটা বাচ্চা আসলে-”
রূপা বলল, “কী বলবি জোরে জোরে বল, সবাই শুনুক।”
মিম্মি থতমত খেয়ে বলল, “না-না-কিছু বলছি না।”
রাজু বলল, “কিছু হয়েছে মিম্মি?”
মিম্মি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, কিছু হয়নি।”
রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় বসে বসে ম্যাডামের বলে দেওয়া প্রজেক্টগুলো নিয়ে আলোচনা করল। আলোচনাগুলো হল অবশ্যি রূপা আর রাজুর মাঝে। মিম্মি সারাক্ষণই চোখের কোনা দিয়ে এদিক-সেদিক দেখতে লাগল। সঞ্জয় প্রজেক্ট নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি না–যখনই কেউ কিছু বলছিল সে মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “ফার্স্ট ক্লাশ! ফার্স্ট ক্লাশ!”
কিছুক্ষণের ভেতরেই রাজুর আম্মু ওদেরকে খাবারের জন্যে ডাকতে এলেন, বললেন, “চলে এসো! অনেক কাজ হয়েছে এখন কিছু একটা খাও।”
রূপা দ্রতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সঞ্জয় তোক করে লাফ দিয়ে উঠে আনন্দের একটা শব্দ করল। রূপা তখন আর কিছু বলতে পারল না, সবার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। খাবারঘরে একটা বড় ডাইনিং টেবিল, টেবিলে নানারকম খাবার। সঞ্জয় মহা উৎসাহে মাঝামাঝি একটা চেয়ারে বসে গেল, সেখান থেকে সবগুলো ডিশ নাগাল পাওয়া যায়। রাজুর আম্মু রূপাকে আর মিম্মিকে পাশাপাশি বসালেন। রাজু এক মাথায় বসল আর তার দুই পাশে বসল তার ছোট দুই ভাই-বোন।
রাজুর আম্মু তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলেন, গরম গরম ডালপুরি দেখেই রূপার জিবে পানি এসে গেল। রাজুর আম্মু বললেন, “তোমরা লজ্জা করো না–অনেক আছে।”
রাজুর আম্মুর কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় ভেতর থেকে কাজের মহিলাটি একটা প্লেটে আরো অনেকগুলো ডালপুরি নিয়ে এলেন। রাজু ডালপুরিতে কামড় দিয়ে বলল, “ময়না খালা, আজকে আপনার ডালপুরি স্পেশাল হয়েছে। ফ্যান্টাস্টিক।”
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, মুখে খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, “হ্যাঁ ফাটাফাটি, ফ্যান্টাস্টিক।” মুখে খাবার থাকার কারণে সঞ্জয়ের কথাটা ভালো বোঝা গেল না।
রূপা কনুই দিয়ে সঞ্জয়কে একটা গুতো দিয়ে বলল, “মুখে খাবার নিয়ে কথা বলিস না, গাধা কোথাকার।”
সঞ্জয় হি হি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে আর বলব না। কথা না বলে আগে খাই।”
রাজুর আম্মু বললেন, “হ্যাঁ। সেটাই ভালো। আগে খাও।”
রাজুর ছোট ভাই হঠাৎ করে ডালপুরিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, টেবিলের উপর রাখা চমচমের প্লেটটা দেখিয়ে বলল, “চমচম খাব।”
রাজু তার প্লেটে একটা চমচম তুলে দিয়ে বলল, “পুরোটা খেতে হবে কিন্তু।”
সে ফোকলা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হ্যাঁ পুরোটা খাব।”
এরকম সময় কাজের মহিলাটি বড় এক বাটি বোঝাই চটপটি এনে টেবিলে রাখল। সঞ্জয় আবার আনন্দের শব্দ করল। রাজু বলল, “ময়না খালার চটপটি ওয়ার্ল্ড ফেমাস। একবার খেলে ভুলবে না।”
রাজুর ছোট ভাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আম্মুর চটপটি সবচেয়ে ভালো! ময়না খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না আম্মু?”
ময়না খালা বললেন, “থাক! নিজের মায়ের এত প্রশংসা করতে হবে না!”
রূপা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, যে বাচ্চা দুটোকে এতক্ষণ রাজুর ছোট-ভাই বোন ভেবে এসেছে তারা আসলে রাজুদের বাসার কাজের মহিলার ছেলেমেয়ে! এই জন্যেই চেহারায় মিল নেই, এই জন্যে নামগুলো অন্যরকম। এই বাসায় কাজের মহিলার বাচ্চাগুলোকে একেবারে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করা হচ্ছে। কী আশ্চর্য! রূপা মুগ্ধ হয়ে একবার বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাল একবার তার মায়ের দিকে তাকাল, পুরোটা কী স্বাভাবিক। কী চমৎকার।
রূপার সাথে সাথে সঞ্জয় আর মিম্মিও হঠাৎ করে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে, রূপা একটু ভয়ে ভয়ে থাকল, তারা হঠাৎ করে এটা নিয়ে বোকার মতো কিছু একটা বলে ফেলে কী না। কপাল ভালো দুইজনের কেউ কিছু বলল না।
নাস্তা করে যখন তারা চা খাচ্ছে তখন বাইরের দরজা শব্দ করল আর সাথে সাথে ছোট দুইজন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “আপু! আপু!”
তাদের ধারণা সত্যি, দরজা খুলে একুশ-বাইশ বছরের একটা মেয়ে এসে ঢুকল, চেহারা দেখেই বোঝা গেল নিশ্চয়ই রাজুর বড় বোন। ছোট দুইজন চেয়ার থেকে নেমে ছুটে গিয়ে দুই দিক থেকে তাকে ধরে ফেলল, চিৎকার করতে লাগল, “আপু? আপু!”
রাজুর বোন বলল, “ব্যাস অনেক হয়েছে। তোদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাকে আগে দেখিসনি!” ছোট দুইজন তখন আবার চিৎকার করতে করতে তাদের চেয়ারে গিয়ে বসল।
রাজু বলল, “আপু আমার ক্লাশের বন্ধুরা এসেছে।”
“তাই তো দেখছি। সত্যি দেখছি না সব কল্পনা?”
“কেন? কল্পনা কেন হবে?”
“তোর আবার বন্ধু আছে সেটাই তো জানতাম না।”
“কেন? আমার কেন বন্ধু থাকবে না?”
“তার কারণ তুই হচ্ছিস রোবট। তুই সবাইকে আপনি আপনি করে কথা বলিস। মানুষ যখন ছোটাছুটি করে তখন তুই রবীন্দ্র রচনাবলি পড়িস। সেই জন্যে কেউ তোর কাছে আসে না। সেই জন্যে তোর কোনো বন্ধু নেই।”
“আমার অনেক বন্ধু আছে।” রাজু রূপার দিকে তাকাল ”তাই না রূপা?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক না হলেও কিছু আছে।”
রাজুর বোন একটা খালি চেয়ারে বসে তাদের তিনজনকে দেখল তারপর বলল, “আমি রাজুর বড় বোন মিথিলা। মেডিকেলে পড়ি।”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “জি! বুঝতে পেরেছি।”
“সঞ্জয় বলল, আপনাদের চেহারা একদম একরকম।”
“মোটেও না।” মিথিলা বলল, “রাজুর নাক বোঁচা। আমার নাক মোটেও বোঁচা না।”
রাজুর আম্মু বললেন, “নাক নিয়ে আর ফাইট করতে হবে না। হাত-মুখ ধুয়ে এসে কিছু খা।”
“হ্যাঁ, আম্মু খাব। খিদে লেগেছে।” টেবিলের নানারকম খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “ময়না খালা তার স্পেশাল চটপটি আর ডালপুরি বানিয়েছে মনে হয়?”
“বানিয়ে লাভ কী? বাচ্চারা তো কেউ কিছু খায়নি।”
রূপা বলল, “খালাম্মা, ওভাবে বলবেন না। আমাদের সঞ্জয় আপনার কথা বিশ্বাস করে আসলেই খেতে শুরু করবে।”
রূপার কথা শুনে সঞ্জয় হি হি করে হাসতে শুরু করে। রূপা বলল, “কী হল? তুই বোকার মতো হাসতে শুরু করেছিস কেন?”
সঞ্জয় হাসতে হাসতে একবার হেঁচকি তুলল, রাজুর বোন মিথিলা একটু ভয় পেয়ে বলল, “কী হল? কী হল তোমার?”
রূপা বলল, “কিছু হয়নি। সঞ্জয়ের মাথার ক্রু ঢিলা। যখন-তখন এইরকম বোকার মতো হাসতে থাকে।”
সঞ্জয় হি হি করে হাসতে হাসতে কোনোভাবে বলল, “আমি মোটেও বোকার মতো হাসতে থাকি না।”
রাজুর বড় বোন মিথিলা হাত-মুখ ধুয়ে তাদের পাশে এসে বসে। একটা বাটিতে খানিকটা চটপটি নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের কাজ হল?”
মিম্মি বলল, “সব এখনো শেষ হয়নি।”
“তোমাদের কী কাজ সেটা একটু শুনি।”
মিম্মি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমরা সবাই সায়েন্স প্রজেক্ট করব তো, সেই জন্যে আলাপ-আলোচনা করছি।”
মিথিলা চোখ মটকে বলল, “তোমাদের আলোচনা কী ফলপ্রসূ হয়েছে?”
মিম্মি ঠাট্টাটা ঠিক ধরতে পারল না, বলল, “জি। ফলপ্রসূ হয়েছে।”
মিথিলা হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “গুড! আমাদের রোবট ভাই রাজু দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করতে শিখেছে সেটা খারাপ কী?”
রাজু বলল, “আপু, আমাকে যদি রোবট বল, তা হলে তুমি কী? তুমি তো রোবট থেকেও কাঠখোট্টা!”
মিথিলা হঠাৎ করে মুখটা গম্ভীর করে ফেলল, বলল, “সেটা ঠিকই বলেছিস। ডাক্তারি পড়তে পড়তে কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছি। প্রথম প্রথম যখন দেখতাম কোনো একজন রোগী মারা গেছে কয়েক রাত ঘুমাতে পারতাম না। এখন দেখি সহজভাবে নেই। আজকে যেরকম–”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “আজকে কী হয়েছে?”
“একজন অ্যাকসিডেন্ট করে এসেছে, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই তার কিছু হয়েছে। রেসিডেন্ট ডাক্তার পরীক্ষা করে এসে বললেন, বাঁচবে না। আগে হলে শুনে আধাপাগল হয়ে যেতাম, আজকে দেখি মেনে নিলাম! কী আশ্চর্য!”
রাজু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “আপু তুমি আসলেই মেশিন হয়ে যাচ্ছ।”
“ছোট বাচ্চাদের কিছু দেখলে অবশ্যি এখনো সহ্য করতে পারি না। হাসপাতালে একটা পেশেন্ট এসেছে বয়স তেরো-চৌদ্দ থেকে বেশি হবে না। ড্রাগ ওভারডোজ।”
রাজু চমকে উঠল, “কী ওভারডোজ?”
“ড্রাগ। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না স্কুলের বাচ্চারাও ড্রাগস নিচ্ছে। কী সর্বনাশ!”
রূপা আর রাজু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “স্কুলের বাচ্চারা?”
“হুঁশ। তোমাদের বয়সী বাচ্চারা। অবিশ্বাস্য।”
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ খেলে কী হয়?”
“অনেক কিছু হয়। কোন ড্রাগ নিচ্ছে তার উপর নির্ভর করে কী ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে। মাসখানেক আগে একজনকে এনেছে–সে ড্রাগ খেত, জোর করে তাকে ড্রাগ খাওয়া বন্ধ করেছে তাই মানুষটা ছটফট করতে করতে মরে গেল।”
“মরে গেল? মানে সত্যি মরে গেল?”
“হ্যাঁ, সত্যি মরে গেল।”
মিমি জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ বন্ধ করলে মানুষ মরে যায়?”
“অনেক ড্রাগ আছে যেটা খেলে শরীর অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন যদি হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন শরীর বিদ্রোহ করে, এটাকে বলে ড্রাগ উইথড্রয়াল সিনড্রোম, ভয়ংকর রিঅ্যাকশন হয়, মানুষ চোখের পলকে মরে যায়।”
“কী সর্বনাশ!”
মিথিলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, কী সর্বনাশ। এই ড্রাগগুলো যে কী ভয়ংকর। কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। না বুঝে এক-দুইবার খেয়ে এডিক্ট হয়ে যায়। তখন আর কোনো মুক্তি নাই। ফ্যামিলির পর ফ্যামিলির সর্বনাশ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায়।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ খেলে কী হয়?”
“সেটা নির্ভর করে ড্রাগের উপর। এখানে যেটা বেশি খায় সেটার লোকাল নাম বুলবুলি, খেলে হার্টবিট বেড়ে যায়, ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, চোখের পিউপিল ডায়লেট করে, ঘামতে থাকে, টেম্পারেচার বেড়ে যায়, বক বক করে কথা বলতে থাকে, মনে হতে থাকে খুব আনন্দ হচ্ছে। যদি ভোজ বেশি খায় তা হলে হেলুসিনেট করে, আজব আজব জিনিস দেখে, জেগে থাকে দুঃস্বপ্ন দেখার মতো—” মিথিলা হাত নেড়ে থেমে যায়।
“তারপর কী হয়?”
“শুকিয়ে কাঠি হয়ে যায়। খিদে থাকে না, রাতে ঘুমাতে পারে না–যদিবা ঘুমায় ভয়ংকর ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। সারারাত বসে থাকে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কাউকে বিশ্বাস করে না। ড্রাগসের নেশা ভয়ংকর নেশা–তার জন্যে টাকার দরকার। নিজের টাকা না থাকলে টাকা চুরি করে। ছিনতাই করে, ডাকাতি করে। নিজের ফ্যামিলির মানুষকে মারধর করে। দেখবে পুরোপুরি সুস্থ সমর্থ ভালো একজন ছেলে বা মেয়ে শুধুমাত্র ফূর্তি করার জন্যে একবার একটু ড্রাগ খেয়ে পুরোপুরি এডিক্ট হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগে পুরোপুরি ভালো একটা ছেলে একেবারে হার্ডকোর ক্রিমিনাল হয়ে গেছে।”
রাজু জিজ্ঞেস করল, “আপু কেউ যদি ড্রাগ এডিক্ট হয়ে যায় তা হলে তাকে আর ভালো করা যায় না?”
“অনেক কষ্ট হয়। ড্রাগ রিহেবিটেলিশান সেন্টারে নিতে হয়, ডাক্তারদের চোখে চোখে রাখতে হয়–চিকিৎসা করতে হয়। ফ্যামিলি আর বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে যদি সাহায্য করে পাশে থাকে, সাপোর্ট দেয় তা হলে হয়তো বের হয়ে আসতে পারে।”
রাজু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মিথিলা সেটা দেখে বলল, “তুই এরকম হতাশ হয়ে যাচ্ছিস কেন? তোর কে ড্রাগ খাচ্ছে?”
রাজু আর রূপা একসাথে বলল”না, না, কেউ খাচ্ছে না। তারা দুইজন একসাথে এত জোরে একই কথা বলল যে সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকাল।
.
বিকেলবেলা যখন রূপা, মিম্মি আর সঞ্জয় বিদায় নিয়ে চলে আসছে ঠিক তখন রাজুর আব্বু তার কাজ থেকে ফিরে এলেন। কাঁচা-পাকা চুল, চোখে চশমা। সবাইকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন”কী ব্যাপার? আমি আসছি আর তাই তোমরা চলে যাচ্ছ?”
মিম্মি মাথা নাড়ল, “না চাচা। আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম।”
রূপা বলল, “বাসায় বলে এসেছি অন্ধকার হবার আগেই চলে আসব।”
“ঠিক আছে যাও। আবার এসো।”
“জি চাচা।”
রাজুর আব্বু রাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী হল, তুই তোর বন্ধুদের বাসায় পৌঁছে দিবি না?”
রূপা আর মিম্মি বলল, “না, না, লাগবে না। আমরা নিজেরা যেতে পারব।”
“সেটা তো পারবেই। একশবার পারবে। তাই বলে রাজুর একটা দায়িত্ব আছে না? যা, রাজু তুই বন্ধুদের বাসায় পৌঁছে দে।”
কাজেই রাজুও ওদের সাথে বের হল। রাজু তখন ওদের সাথে গেল বলে ওদের পুরো ব্যাপারটাই সেদিন থেকে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল।
.
০৬.
চারজন একসাথে বের হবার পর থেকে মিম্মি কিছু একটা বলার জন্যে উশখুশ করছিল কিন্তু রাজু সাথে রয়েছে তাই বলতে পারছিল না! বড় রাস্তার মোড়ে এসে মিম্মি আর সঞ্জয় দুইজন দুইদিকে চলে গেল। সে কী বলতে চাইছিল তাই সেটা আর কেউ শুনতে পেল না।
রূপা তখন রাজুকে বলল, “রাজু আমি এখন একা একা চলে যেতে পারব। তুমি যাও।”
রাজু বলল, “তোমাকে আরেকটু এগিয়ে দিই।”
রূপা বলল, “তোমার আপুর কাছ থেকে ড্রাগের গল্পগুলো শুনে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছিল।”
“ঠিকই বলেছ।”
“এখন সোহেলের কী হবে?”
“বুঝতে পারছি না। কী করব বুঝতে পারছি না।”
রূপা বলল, “আমার মনে হয় কী জান?”
“কী?”
“প্রথমে ওর আব্বুকে বলা দরকার। তারপর মনে হয় ওর আম্মুকে ফোন করা দরকার–”
হঠাৎ রাজু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স।”
রূপা রাজুর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায়। দূরে সোহেল, হন হন করে হেঁটে আসছে। রাজু বলল, “চল লুকিয়ে যাই, দেখি কোথায় যায়।”
দুইজন তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে একটা দোকানের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল, না দাঁড়ালেও তাদের দেখত বলে মনে হয় না। সোহেল তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে, এলোমেলো চুল, কুঁচকানো একটা টি-শার্ট। মুখটা শুকনো আর চোখের দৃষ্টি কেমন কেমন উদভ্রান্ত।
রূপা ফিসফিস করে বলল, “কোথায় যাচ্ছে?”
“জানি না।” রাজু সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি বাসায় যাও। আমি দেখি সোহেল কোথায় যায়, কী করে।”
“আমিও আসি তোমার সাথে।”
“না। দুইজন গেলে দেখে ফেলতে পারে। আমি একাই যাই।”
রূপা রাজি হল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে এখন যদি সোহেলের পিছু পিছু যায় বাসায় যেতে আরো দেরি হয়ে যেতে পারে। রূপা তার বাসার দিকে রওনা দিল, রাজু দূর থেকে সোহেলের পিছু পিছু হেঁটে যেতে লাগল।
সোহেল বড় রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে চৌরাস্তার মোড়ে এসে একটু দাঁড়াল, এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর বাজারের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। বাজারের কাছে একটা ভিডিওর দোকানের সামনে দাঁড়াল, এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর ভিতরে ঢুকে গেল।
রাজু ঠিক বুঝতে পারল না এখন সে কী করবে, বাইরে অপেক্ষা করবে না কী ভেতরে ঢুকবে। তাকে অবশ্যি বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হল না, তার কারণ সোহেল প্রায় সাথে সাথেই বের হয়ে এলো, আবার এদিক-সেদিক তাকাল, মনে হচ্ছে সে কাউকে খুঁজছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে আবার হাঁটতে থাকে। রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানের ভেতর সে উঁকি দিল। হঠাৎ করে মনে হল সে যাকে খুঁজছে তাকে পেয়ে গেছে। লম্বা লম্বা পা দিয়ে সে ভেতরে ঢুকে গেল আর একটু পরেই সে আরেকজনের সাথে বের হয়ে এলো।
যার সাথে বের হয়ে এলো তার বয়স আঠারো-উনিশ বছরের বেশি হবে না, খুবই টাইট একটা জিন্সের প্যান্ট আর কালো একটা টি-শার্ট পরে আছে। টি-শার্টে মানুষের নরমুণ্ডুর একটা ছবি। ছেলেটির মাথায় বাহারি চুল, গলায় একটা চেন।
রাজু দূর থেকে দেখল সোহেল এই ছেলেটার সাথে কথা বলছে। ছেলেটা সোহেলকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, সোহেল বুঝতে চাইছে না। খানিকক্ষণ দুইজন কথা বলল, কিংবা বলা যেতে পারে তর্কবিতর্ক করল তারপর মনে হল সোহেল হাল ছেড়ে দিল। ছেলেটা তখন হাত পাতল, সোহেল পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে গুনে গুনে কিছু টাকা ছেলেটার হাতে দিল। ছেলেটা তখন আবার টাকাগুলো গুনে গুনে পকেটে ঢোকাল। তারপর ছেলেটা চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। রাজু তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কোথাও কোনো সন্দেহজনক কিছু নেই নিশ্চিত করে ছেলেটা পকেট থেকে ছোট একটা প্যাকেট বের করে, সেখান থেকে আরেকটি ছোট প্যাকেট বের করে সোহেলের হাতে ধরিয়ে দিল।
সোহেল প্যাকেটটা খুলে ভালো করে দেখল তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। ছেলেটার সাথে আবার কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে হন হন করে হেঁটে যেতে শুরু করে।
রাজু তাড়াতাড়ি আরেকটা দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। সোহেল চলে যাবার পর রাজু বের হয়ে আসে, রাস্তার অন্য পাশে টাইট জিন্স আর কালো টি শার্ট পরা ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। রাজু একটু চিন্তা করল এখন সে কী করবে, সোহেলের পিছু পিছু যাবে না কী এই ছেলেটা কী করে সেইটা বের করবে। সোহেল নিশ্চয়ই এখন বাসাতেই যাবে কাজেই তার পিছু পিছু গিয়ে সে নতুন কিছু জানতে পারবে না। কিন্তু এই ছেলেটার পিছু পিছু গেলে সে নতুন কিছু জানতেও পারে।
ছেলেটা একটা সিগারেট ধরাল, তারপর লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়া ছাড়ল তারপর উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে।
রাজু তখন রাস্তা পার হয়ে ছেলেটার খুব কাছাকাছি চলে এলো, ছেলেটা তাকে লক্ষ করল না। রাজু বেশ কয়েক পা পিছনে থেকে তার পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে।
ছেলেটা হেঁটে হেঁটে রাস্তার পাশের খোলা একটা চায়ের দোকানে ঢোকে। যে মানুষটা চা তৈরি করছে তাকে জিজ্ঞেস করল, “বকর আইছে?”
মানুষটি চা তৈরি করতে করতে বলল, “আইছে।”
“কই?”
রাজু বকরের গলা শুনতে পেল, “এই যে! আমি এইখানে।”
রাস্তার পাশে একটা দেয়াল, বকর নামের মানুষটা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছিল। প্রস্রাব শেষ করে প্যান্টের জিপ লাগিয়ে কাছে এসে বলল, “ব্যবসাপাতি কেমন চলছে?”
“ভালো না। রেগুলার কাস্টমার ছাড়া নতুন কেউ নেই।”
“এমনি এমনি কাস্টমার হয় না আক্কাইস্যা। কাস্টমার বানাতে হয়।”
“সেইটা তো চেষ্টা করছি, কিন্তু মালদার কাস্টমারের অভাব। সখ আছে মালপানি নেই।”
মানুষ দুটি মাথা ঘুরিয়ে রাজুকে দেখল তাই রাজুকে ভান করতে হল সে এই খোলা চায়ের দোকানে কোনো একটা কারণে এসেছে। সে বকর এবং আক্কাস নামের দুইজন মানুষকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে দোকানিকে বলল, “একটা সিংগারা দিবেন।”
দোকানি এক টুকরো খবরের কাগজে মুড়ে তাকে একটা সিংগারা দিল। রাজু দাম মিটিয়ে সিংগারাটা হাতে নিয়ে হেঁটে চলে আসে। এক্ষুনি বাসা থেকে এত কিছু খেয়ে এসেছে এখন এই সিংগারা খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। রাস্তার মোড়ে উদাস মুখে একটা ছোট বাচ্চা ধুলো দিয়ে খেলছে, তার মা কোথায় কে জানে। রাজু বাচ্চাটাকে সিংগারাটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে এলো।
সোহেল তার ড্রাগস কার কাছ থেকে কিনে, কোথায় কিনে সেটা অন্তত আজকে জানতে পেরেছে। অন্তত দুইজন মানুষ আছে যার একজনের নাম বকর অন্যজন আক্কাস।
.
০৭.
রূপা বলল, “তোদের এখন খুবই জরুরি একটা কথা বলা হবে, তোরা কাউকে এই কথাগুলো বলতে পারবি না।”
দুপুরের ছুটিতে স্কুলের মাঠে রূপা আর রাজু, সঞ্জয় আর মিম্মিকে নিয়ে বসেছে। অন্য সময় হলে চারজনকে মাঠের মাঝে বসে থাকতে দেখলেই অন্যেরাও এসে বসে যেত। এখন সবাই জানে বিজ্ঞান ম্যাডাম সবাইকে বিজ্ঞানের প্রজেক্ট দিয়েছেন সবাই নিজের টিম নিয়ে বসে আলাপ-আলোচনা করছে। সবাই ধরেই নিয়েছে তারা তাদের প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে বসেছে। আসলে রূপা আর রাজু ঠিক করেছে অন্য দুইজনকে সোহেলের কথাটা বলবে।
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী কথা?”
“আগে বল কাউকে বলবি না।”
“কাউকে বলব না।”
“যদি বলিস তা হলে তোদের জিব খসে যাবে কিন্তু।”
সঞ্জয় অধৈর্য হয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবা। কী বলবি বল।”
“রূপা মুখ গম্ভীর করে বলল, আমাদের পাঁচজনের টিম হচ্ছে মিরূসোরাস কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা হচ্ছি মিরূরাস-সোহেল নেই।”
মিম্মি বলল, “আমি তখনই বলেছিলাম সোহেলকে নিয়ে কাজ নেই।”
“তুই বলিসনি।”
“ভেবেছিলাম বলব। শেষ পর্যন্ত বলা হয়নি।”
সঞ্জয় বলল, “সোহেলের মাথা তো আউলে গেছে।”
রূপা মাথা নাড়ল, “আসলে মাথা আউলে যায়নি। সেইটাই বলতে যাচ্ছি।”
“বল।”
রূপা একটু গলা খাকারি দিয়ে বলল, “সোহেল এখন ড্রাগ এডিক্ট।”
মিম্মি আর সঞ্জয় চোখ বড় বড় করে তাকাল, তাদের কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে রূপা কী বলছে। সঞ্জয় কয়েকবার চেষ্টা করল, ড্রা-গ-এ-ডি-ক্ট?”
“হ্যাঁ।”
মিম্মি বলল, “তা হলে সে আমাদের সাথে প্রজেক্ট করবে কেমন করে?”
রাজু বলল, “আসলে আমরা প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তা করছি না। আমাদের এখন চিন্তা কেমন করে সোহেলকে বাঁচানো যায়।”
মিম্মি বলল, “এক্ষুনি হেডস্যারকে বলতে হবে। হেডস্যার পুলিশকে ফোন করে দিলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে–”
রূপা বলল, “সোহেলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে?”
“নেওয়াই তো উচিত। ধরে নিয়ে শক্ত পিটুনি দেওয়া দরকার। পিটুনি হচ্ছে ড্রাগিদের সবচেয়ে ভালো ওষুধ।”
রূপা বলল, “আসলে আমরা তোদর ডেকেছি অন্য একটা কারণে।”
“কী কারণ?”
“আমরা ড্রাগ ডিলারদের ধরে পুলিশকে দিতে চাই।”
সঞ্জয় আর মিমি চোখ বড় বড় করে রূপার দিকে তাকাল।
মিম্মি বলল, “তুই ড্রাগ ডিলারদের চিনিস?”
রূপা বলল, “আমি চিনি না। রাজু চেনে।”
“তা হলে পুলিশকে বলে দিচ্ছিস না কেন?”
রাজু বলল, “আমি আসলে মাত্র দুইজনকে দেখেছি। দলে মনে হয় আরো অনেকে আছে। আমি যে দুইজনকে দেখেছি সেই দুইজন ফালতু টাইপের, যেটা লিডার সেইটাকে খুঁজে বের করে তারপর পুলিশে খবর দিতে হবে।”
সঞ্জয় ভুরু কুঁচকে বলল, “কেমন করে খুঁজে বের করবে?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “সেইটা নিয়ে তোদের সাথে কথা বলতে চাই। তোদের কোনো আইডিয়া আছে কী না।”
সঞ্জয় ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকে, কিন্তু তার চিন্তা করার খুব বেশি অভ্যাস নেই তাই একটু পরেই হাল ছেড়ে দিল। বলল, “তোদের কোনো আইডিয়া আছে?”
রূপা বলল, “সবার আগে আমাদের সোহেলের সাথে কথা বলতে হবে।”
“সোহেলের সাথে?”
“হ্যাঁ।”
“কী বলবি?”
“আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করব, দেখব সে কী বলতে চায়।”
মিম্মি সরু চোখে একবার রূপার দিকে আরেকবার রাজুর দিকে তাকাতে লাগল। রূপা বলল, “মিম্মি–”
“কী?”
“তুই কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারবি না।”
“বলব না।”
“আমার গা ছুঁয়ে বল।” রূপা তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। ”বল গা ছুঁয়ে।”
“গা ছুঁয়ে বললে কী হয়?”
“সেটা আমি জানি না, কিন্তু গা ছুঁয়ে বল।”
মিম্মি রূপার গা ছুঁয়ে বলল, “কাউকে বলব না।”
বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর চারজন সোহেলের বাসায় হাজির হল। দরজায় শব্দ করার পর আবার সেই মহিলা দরজা খুলে দিল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “সোহেল আছে?”
“আছে।”
“আমরা সোহেলের সাথে কথা বলতে এসেছি।”
“হে মনে হয় ঘুমায়।”
“ঘুমালেও সমস্যা নেই, আমরা ডেকে তুলব।”
“মনে হয়, শরীরটা বেশি ভালা না।”
“সেইটাও আমরা দেখব।”
“তয় যান। বারান্দার শেষ ঘরটা।”
রাজু বলল, “আমরা চিনি। আমরা আগে আরেকবার এসেছিলাম। মনে নেই?”
মহিলাটা মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে।”
বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে রূপা দরজাটা ধাক্কা দিল। দরজাটা বন্ধ, ভেতর থেকে তারা সোহেলের গলার স্বর শুনতে পেল, “কে?”
সঞ্জয় বলল, “আমরা। দরজা খোল।”
ভেতরে সোহেল হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। সঞ্জয় আবার বলল, “কী হল? দরজা খুলিস না কেন?”
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল, সোহেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী চাস?”
রূপা বলল, “ভেতরে ঢুকতে দে।”
“কেন?”
“তোর সাথে কথা আছে।”
“কী কথা?”
রাজু বলল, “আমাদের সায়েন্স প্রজেক্টের টিমের তুই একজন মেম্বার। প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে হবে।”
সোহেল কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সরে দাঁড়াল, বলল, “আয়।”
চারজন সোহেলের ঘরে ঢুকল। আগেরবার ঘরটা যত এলোমেলো ছিল এখন ঘরটা তার থেকে বেশি এলোমেলো, অনেক বেশি নোংরা। সঞ্জয় বলল, “তোর ঘরটা পরিষ্কার করা দরকার।”
সোহেল এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, ““।
রাজু বলল, “আমরা একটা সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। তুমি আমাদের টিমে আছ। তুমি আর আমরা চারজন।”
সোহেল বলল, “হু–”
রাজু বলল, সায়েন্স ম্যাডামের কাছে আমাদের আইডিয়াটা কালকে জমা দিতে হবে। সেই জন্যে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।”
সোহেল বলল, “হু–”
রূপা বলল, আমাদের তিনটা আইডিয়া আছে–অদৃশ্য আলো, স্মোক বম্ব আর আলোর সংমিশ্রণ। তোর কোনটা পছন্দ?”
সোহেল ভুরু কুঁচকে বলল, “হু–””কোনটা পছন্দ?”
“জানি না।”
সঞ্জয় বলল, “আমার ইচ্ছা স্মোক বম্ব। যখন ফাটাবি তখন ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে ধোয়া দিয়ে। লাল-নীল ধোয়া।”
সোহেল বলল, “হুঁ“।
রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “খালি হু হু করবি না। কথা বল।”
“কী কথা বলব?”
“আমরা কিন্তু তোর সব কথা জানি।”
সোহেল কেমন যেন চমকে উঠল, দেখতে দেখতে তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল, রূপার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কী কথা জানিস?”
মিম্মি বলল, “তুই ড্রাগ এডিক্ট।”
সোহেল ঝট করে ঘুরে মিম্মির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললি? কী বললি
রূপা বলল, “ঠিকই তো বলেছে।”
সোহেল বলল, “খুন করে ফেলব তোদের সবাইকে।”
রাজু সোহেলের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, তুমি কেন মিছামিছি খেপে উঠছ। শান্ত হয়ে একটু বসো দেখি। বসো শান্ত হয়ে।”
সোহেল ঝটকা মেরে রাজুর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “বের হয়ে যা তোরা। বের হয়ে যা এক্ষুনি।”
রাজু শান্ত গলায় বলল, “মিছামিছি রাগ করো না সোহেল। আমরা তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।”
সোহেল চিৎকার করে বলল, “আমার কারো সাহায্য দরকার নেই। তোরা বের হয়ে যা আমার রুম থেকে।”
“শোন সোহেল। খুব ইম্পরট্যান্ট। খুবই ইম্পরট্যান্ট।”দরকার নেই আমার ইম্পরট্যান্ট কথার। কোনো দরকার নেই।”
রূপা গলা উঁচিয়ে বলল, “আছে। শোন সোহেল, তুই খুব বিপদের মাঝে আছিস। ড্রাগ খুব ভয়ংকর জিনিস-এর থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। বের না হলে তুই মরে যাবি।”
“আমার বেঁচে থেকে কী হবে?” হঠাৎ সোহেল হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আম্মা গো, ও আম্মা–তুমি কোথায় গেলে আমাকে ছেড়ে কোথায়-”
সোহেলের দিকে তাকিয়ে রূপার চোখে পানি এসে গেল।
.
রাজু বলল, “এই যে ভিডিওর দোকান আছে, সোহেল প্রথমে এখানে ঢুকেছিল।”
রাজু তিনজনকে নিয়ে এসেছে ড্রাগ ডিলারদের আস্তানাটা দেখানোর জন্যে। সোহেলকে অনেক কষ্ট করে শান্ত করে এসেছে। ওকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করিয়েছে সে যেন আবার স্কুলে আসা শুরু করে। স্কুলে নতুন ম্যাডাম খুব ভালো, ক্লাসে মোটেও বকাবকি করেন না। সোহেল আসতে রাজি হয়েছে কিন্তু আসলেই আসবে কী না কে জানে।
রাজু বলল, “ভিডিওর দোকানের পাশে যে রেস্টুরেন্টটা আছে সোহেল সেইখানে ড্রাগ ডিলারটাকে খুঁজে পেয়েছিল। সোহেল তার কাছ থেকে ড্রাগ কেনার পর ড্রাগ ডিলারটা ঐ খোলা চায়ের দোকানে গিয়েছে সেইখানে তার একটা পার্টনার আছে। মনে হয় এই চায়ের দোকানের মানুষটাও একই দলের।”
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “এখন আমরা কী করব?”
“এই জায়গাটাকে চোখে চোখে রাখলে মনে হয় ড্রাগ ডিলারকে পেয়ে যাব।”
“আমরা কীভাবে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখব? আমাদের স্কুল আছে না? বাসা আছে না?”
রাজু মাথা চুলকাল, “সেইটাই তো মুশকিল।”
রূপা বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
“কী আইডিয়া?”
“এইখানে বসে না থেকেই আমরা এইখানে নজর রাখতে পারব। যদি-”
“যদি কী?”
“আমাদের কাছে দুইটা মোবাইল ফোন থাকে।”
মিম্মি মুখ বাঁকা করল, “দুইটা মোবাইল ফোন?” আমার বাসায় আমাকে মোবাইল ফোন ধরতেই দেয় না।”
রাজু বলল, “আপুকে বললে আপু আমাকে ব্যবহার করতে দিতে পারে।”
রূপা বলল, “আমার আপুরও একটা মোবাইল ফোন আছে। আমাকে কখনো ব্যবহার করতে দিবে না। কিন্তু—”
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
“সোজা পথে না দিলে বাঁকা পথে চেষ্টা করলে দোষ কী?”
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, “কোনো দোষ নেই। সোজা পথে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই, বাঁকা পথে যা।”
.
০৮.
তিয়াশা যখন বাথরুমে গেল তখন রূপা তিয়াশার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সেটা খুলে ব্যাটারি বের করল। তারপর ছোট এক টুকরো স্কচ টেপ ব্যাটারির ধাতব টারমিনালে লাগিয়ে আবার ব্যাটারিটা ভেতরে ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে তিয়াশার ব্যাগে রেখে দিল। এখন চেষ্টা করলেও মোবাইল ফোনটা আর চালু করা যাবে না।
তিয়াশা সেটা লক্ষ করল ঘণ্টা দুয়েক পর। মোবাইল ফোনটা কয়েকবার টেপাটেপি করে বলল, ‘আরে! আমার মোবাইল ফোনটা অন হয় না কেন?”
রূপা শুনেও না শোনার ভান করে চোখের কোনা দিয়ে তিয়াশাকে লক্ষ করতে লাগল। তিয়াশা ফোনটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হল! কী মুশকিল!”
এবারে রূপা বলল, “কী হয়েছে?”
“আমার মোবাইল! অন হচ্ছে না।”
“চার্জ শেষ। চার্জ কর। তা হলেই চালু হবে।”
“উঁহু। পুরা চার্জ ছিল।”
“তা হলে তোমার টাকা শেষ।”
তিয়াশা বিরক্ত হয়ে বলল, “টাকা শেষ হলে ফোন অফ হবে কেন?”
“দেখি আমার কাছে দাও দেখি!” রূপা তিয়াশার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। ব্যাটারিটা বের করল, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল তারপর আবার ভেতরে ঢুকিয়ে টেপাটেপি করে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভান করে বলল, “নাহ! কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”
“এখন কী হবে? আমার ইম্পরট্যান্ট ফোন করার ছিল।”
“একদিন ফোন না করলে কী হয়?”
“এখন কেমন করে ঠিক করব?”
“সকালে আমাকে দিও আমি ঠিক করিয়ে আনব।”
“কোথা থেকে ঠিক করবি?”
“আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে পড়ে নাম সঞ্জয়, সে হচ্ছে মোবাইলের এক্সপার্ট। যে কোনো মোবাইল ঠিক করে ফেলতে পারে। তাকে দিলে সে ঠিক করে দেবে।”
“তোদের ক্লাসের ছেলে? মোবাইল ঠিক করতে পারে?”
মিথ্যা কথা বলা বেশ কঠিন রূপা প্রথমবার টের পেতে শুরু করল।
সরল মুখ করে বলল, “হ্যা–”
”কেমন করে শিখেছে?”
একটা মিথ্যা কথা বললে সেটাকে রক্ষা করার জন্যে আরো দশটা মিথ্যা বলতে হয়। কাজেই রূপাকেও আরো মিথ্যা বলতে হল, “ওর আব্বুর মোবাইলের দোকান আছে, সেখান থেকে শিখেছে।”
তিয়াশা ভুরু কুঁচকে তাকাল তাই রূপাকে আরো মিথ্যা বলতে হল, “সঞ্জয় খুবই ব্রিলিয়ান্ট, বড় হলে নির্ঘাত ইঞ্জিনিয়ার হবে।”
“এমনি এমনি ঠিক করে দেবে?”
“দেবে না? আমাদের ক্লাসের ছেলে আমাদের মোবাইল ফোন ঠিক না করলে কার ফোন ঠিক করবে?”
তিয়াশাকে এবারে একটু চিন্তিত দেখাল, “কিন্তু কাল তো শুক্রবার। স্কুল বন্ধ।”
“আমাদের প্রজেক্টের মিটিং আছে, সঞ্জয়ের সাথে দেখা হবে, তখন ঠিক করে দিতে পারবে।” রূপা পুরো ব্যাপারটা আরো বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে বলল, “তোমার যদি সঞ্জয়কে বিশ্বাস না হয় তুমি মোবাইলের দোকানেও নিতে পার। চৌরাস্তার মোড়ে একটা দোকান আছে। কালকে শুক্রবার মনে হয় বন্ধ।”
“ঠিক আছে আমি তোকেই দেব। দেখি তোর বন্ধু ঠিক করতে পারে কী না।” তিয়াশা মনমরা হয়ে তার ফোনটাকে নানাভাবে ঝাঁকি দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে।
.
সন্ধ্যেবেলা যখন তাদের বাসার সবাই হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসেছে তখন সুলতানা চুপি চুপি রূপার ঘরে এলো। রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “কী কর, আফা?”
“আফা না, আপা।”
“একই কথা।” সুলতানা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল।
”কী হয়েছে তোমার?”
“কিছু হয়নি।” সুলতানা রূপার বিছানায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসল, “মনটা ভালো লাগে না।”
“কেন?”
“কাল রাতে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম।”
“কী স্বপ্ন?”
“মায়েরে সাপে কাটছে আর মা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।”
রূপা হাসার ভান করল, “ধুর! স্বপ্ন দেখে কেউ মন খারাপ করে? স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন তো আর সত্যি না।”
“কিন্তু স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল একেবারে সত্যি। ভোরবেলার স্বপ্ন না কি সত্যি হয়।”
“স্বপ্ন বলে দিলে সেটা আর সত্যি হয় না। তুমি আমাকে বলে দিয়েছ এখন আর সত্যি হবে না।”
“সত্যি বলছ?”
“হ্যাঁ। সত্যি বলছি।”
সুলতানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কতদিন মায়েরে দেখি না।”
রূপা বলল, “একবার বাড়ি যাও। মাকে দেখে আস।”
“যেতে তো চাই। কিন্তু খালাম্মা ছুটি দিতে চায় না।”
রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না। সুলতানা শেষবার কবে তার বাড়ি গেছে সে মনে করতে পারে না। ঠিক এরকম সময় তার নাকে একটা পোড়া গন্ধ এসে লাগল।”নাক কুঁচকে বলল, কিছু একটা পুড়ছে না কি?”
অমনি সুলতানার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “সর্বনাশ! চুলায় ডেকচিটা রেখে আসছি।”
সুলতানা রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল কিন্তু ততক্ষণে পোড়া গন্ধ রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘর পর্যন্ত চলে এসেছে। হিন্দি সিরিয়াল থেকে আম্মুর মনোযোগ রান্নাঘরের পোড়া গন্ধের দিকে চলে গেল। সিরিয়ালের মূল চরিত্র জাসিন্দর আর আনিলার একটা গভীর আবেগময় দৃশ্যের মায়া কাটিয়ে আম্মুও সুলতানার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেলেন।
রূপা তার ঘর থেকে প্রথমে আম্মুর চিৎকার তারপর প্রচণ্ড মারধোরের শব্দ শুনতে পেল। মনে হল আম্মু বুঝি সুলতানাকে খুন করে ফেলবেন। প্রথম প্রথম সুলতানার একটা-দুইটা অনুনয়-বিনয় শুনতে পেল কিন্তু আম্মুর হিংস্র চিৎকারে সব চাপা পড়ে গেল। প্রচণ্ড মারধোরের মাঝে সুলতানার কাতর চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। রূপা আর সহ্য করতে পারছিল না। যখন প্রায় ছুটে যাচ্ছিল তখন আব্বু গিয়ে আম্মুকে থামালেন। বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন ছেড়ে দাও।”
“ছেড়ে দেব? এই হারামজাদিকে ছেড়ে দেব?” আম্মু চিৎকার করে বললেন, “কি করেছে দেখেছ? সবকিছু পুড়িয়ে শেষ করেছে। আরেকটু হলে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিত।”
“যাই হোক, আগুন তো লাগেনি।”
“তুমি এদের চেনো না। এরা হচ্ছে ছোটলোকের জাত। এদের রক্তের মাঝে দোষ আছে। এদের লাই দিলে এরা মাথায় ওঠে। এদের জুতো দিয়ে পিটিয়ে সিধে রাখতে হয়।”
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেল তখন রূপা চুপি চুপি রান্নাঘরে গেল। সুলতানা মেঝেতে বসে আছে, হাত দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুকি কাটছে। রূপা ফিসফিস করে ডাকল, “সুলতানা।”
সুলতানা কোনো কথা না বলে মাথা তুলে তাকাল। রূপা বলল, “তুমি মন খারাপ করো না। আমি আমি–”
“তুমি কী?”
“আমি যখন বড় হব তখন আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তুমি আর আমি থাকব। তখন তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।”
সুলতানা হাসার চেষ্টা করল। ঠোঁটটা ফেটে গেছে তাই হাসার চেষ্টা করার সময় এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে এলো। রূপা বলল, “তুমি বিশ্বাস করছ না আমার কথা?” সুলতানা মাথা নাড়ল, বলল, “করেছি।” তোমার কথা বিশ্বাস করি দেখেই তো আমি বেঁচে আছি। তা না হলে কী আর বেঁচে থাকতাম? আমার কী খুব বেঁচে থাকার সখ?”
০৯-১২. ফোনটা লাউড স্পীকার মোডে আছে
মোবাইল ফোনটা মাঝখানে রেখে চারজন সেটার চারদিকে বসে আছে। ফোনটা লাউড স্পীকার মোডে আছে তাই যে কথাই আসুক সেটা চারজনে শুনতে পাবে। এই মোবাইল ফোনটা রাজুর বড় বোন মিথিলার। এই মুহূর্তে মিথিলার ফোনটা থেকে তিয়াশার ফোনে ডায়াল করা হয়েছে। তিয়াশার ফোনটা রয়েছে ড্রাগ ডিলারদের চায়ের দোকানে। সেখানে কোনো কথাবার্তা হলে তারা এখানে বসে শুনতে পাবে-সেটাই ছিল পরিকল্পনা।
পরিকল্পনাটা কাজে লাগবে না সেটা তারা বুঝতে শুরু করেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে টাকা-পয়সা, মিথিলার ফোনে শ খানেক টাকা ছিল সেই টাকাটা ধীরে ধীরে খরচ হয়ে যাচ্ছে। যখন পুরো টাকা খরচ হয়ে যাবে তখন লাইন কেটে যাবে–কাজেই এই সময়ের ভিতরে যদি কোনো কথাবার্তা না হয় তা হলে তারা সেটা শুনতে পাবে না। দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে ফোনটার অবস্থান। তারা অনেক বুদ্ধি করে ফোনটার উপরে শক্ত টেপ দিয়ে ফ্যাসেনার লাগিয়েছে। সেই ফ্যাসেনারের অন্য অংশ আছে চায়ের দোকানের বেঞ্চের নিচে। সেগুলো দিয়ে তিয়াশার ফোনটা বসানো হয়েছে বেঞ্চের নিচে। বেঞ্চে কেউ বসলে নাড়াচাড়া করলে তারা সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায় কিন্তু যখন কেউ কথা বলে সেটা অস্পষ্ট শোনা যায়। তারপরেও তারা যে কথাবার্তা একেবারেই শুনতে পায় না তা না। মাঝে মাঝেই একটা-দুইটা কথা শুনতে পায় কিন্তু সেই কথাগুলো খুবই সাধারণ কথা, কেউ একজন এসে চায়ের অর্ডার দিচ্ছে, সিঙ্গারা কিনছে, সিগারেট কিনছে এরকম।
সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে রূপা। যদি দোকানের লোকগুলো কোনোভাবে ফোনটা খুঁজে পেয়ে যায় তা হলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। তিয়াশার ফোনটা তা হলে তারা আর ফেরত পাবে না, তখন তিয়াশাকে কী জবাব দেবে সেটা সে চিন্তাও করতে চায় না। রূপা তাই একটু পরে পরে ঘড়ি দেখছিল, মোবাইলের টাকা শেষ হবার পর চায়ের দোকানের বেঞ্চের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা উদ্ধার না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না।
মোবাইল ফোনটায় তখন একটু কথা শোনা গেল, চারজনই তখন কান পাতল। কথাগুলো খুব আস্তে কিন্তু তারপরেও বোঝা যাচ্ছে। একজন বলল, “আজকে কিন্তু বড় ডেলিভারি।”
আরেকজন বলল, “ঠিক আছে।” গলার স্বর শুনে মনে হল চায়ের দোকানদার।”আপনারা বুঝছেন তো আমার কত বড় রিক্স।”
“কীসের রিক্স?”
“পুলিশের।”
“পুলিশের কোনো রিক্স নেই। আমরা মাসে মাসে টাকা দেই না!”
“সব পুলিশকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কিছু ত্যাড়া পুলিশ থাকে।” দোকানদার বলল, “আপনাদের এত বড় বড় ডেলিভারির জন্যে আমার এই ভাঙাচুরা দোকান ব্যবহার করেন–আমার ভয় লাগে।”
“ভয় নেই। আমরা আছি না?”
“জে আছেন।”
“শোনো তা হলে, খুব বড় ডেলিভারি। এক পার্টি তোমারে ডেলিভারি দিব। তুমি মাল তোমার কাছে রাখবা। তোমারে মাল ডেলিভারি দিবার সময় বলবে মিঠা পানি, লুনা পানি। বুঝেছ?”
“বুঝেছি। মিঠা পানি, লুনা পানি।”
“হ্যাঁ, আর তোমার কাছ থেকে আরেক পার্টি সেই মাল নিয়ে যাবে।”
“কখন?”
“আজকেই নেবে।”
“কে আসবে?”
“সেইটা কী তোমারে বলে দেব? বলব না। গোপন পার্টি। দেখে বুঝতেই পারবে না। কিন্তু তার কথা শুনে বুঝবে সে গোপন পার্টি।”
“কী কথা বলবে?”
“বলবে গিলা-কলিজার বাটি।”
“গিলা-কলিজার বাটি? হে হে হে!”
“হ্যাঁ। হাসির কিছু নেই। গোপন কথা–গোপন।”
“ঠিক আছে। কেউ এসে যদি বলে গিলা-কলিজার বাটি তারে আমি মাল দিয়ে দেব?”
“হ্যাঁ। যদি সন্দেহ হয় তা হলে বলবে পরিষ্কার করে বলেন। তখন সে বলবে, বরফের মতো গরম আগুনের মতো ঠাণ্ডা। বুঝেছ?”
“বরফের মতো গরম?”
“হ্যাঁ, আর আগুনের মতো ঠাণ্ডা। মনে থাকবে?”
“মনে থাকবে।”
“আরেকটা বিষয়। খুব জরুরি–” মানুষটা যখন খুব জরুরি কথাটা বলতে শুরু করল ঠিক তখন লাইনটা কেটে গেল। মিথিলার ফোনের টাকা শেষ।
ওরা চারজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “দেখেছ? ড্রাগ ডিলাররা কেমন করে কাজ করে?”
সঞ্জয় বলল, “হ্যাঁ। গোপন পাসওয়ার্ড!”
মিম্মি বলল, কী আজব। গিলা-কলিজার বাটি! এইটা একটা পাসওয়ার্ড হল? ভালো কিছু বলতে পারে না?”
“এইটাই তো যথেষ্ট ভালো। কেউ কী কখনো চিন্তা করতে পারবে পাসওয়ার্ড হচ্ছে গিলা-কলিজার বাটি”-সঞ্জয় হি হি করে হাসতে শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু সবাই এমনভাবে তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল যে সে সুবিধা করতে পারল না।
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন কী করব?”
সঞ্জয় বলল, “পুলিশকে খবর দেব।”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু! শুনিসনি ওরা পুলিশকে মাসে মাসে টাকা দেয়। পুলিশের কাছে যাওয়া যাবে না।”
“সব পুলিশ তো খারাপ না। শুনিসনি ত্যাড়া পুলিশ আছে”
“তুই দেখে বুঝবি কোন পুলিশ ভালো আর কোন পুলিশ ত্যাড়া?”
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, বলল, “না–”
রাজু বলল, আমাদের মনে হয় এখন বড়দের জানানোর সময় হয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।”
“কাকে জানাবি?”
“আপুকে দিয়ে শুরু করি। আপু যখন দেখবে তার মোবাইলের সব টাকা খরচ করে ফেলেছি তখন আমার কাছে জানতে চাইবে কোথায় এত লম্বা ফোন করেছি। তখন বললেই হবে।”
রূপা বলল, “তোমার আপুর ফোনের টাকা–আর আমার আপুর ফোনটা আনতে হবে। যদি ফোনটা হারায় তা হলে আমি শেষ।” কথা শেষ করে রূপা গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করল।
রাজু মাথা নাড়ল, “ঠিক বলেছ। চল আগে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসি।”
চায়ের দোকানটার কাছাকাছি গিয়ে ওরা থেমে গেল। রাজু বলল, “আমাদের সবার যাওয়ার দরকার নেই। দুইজন যাই।”
“কোন দুইজন?”
“মোবাইল ফোনটা বেঞ্চের তলায় ফিট করেছিল রূপা। কাজেই রূপাকে যেতে হবে। সাথে আরেকজন।”
রূপা বলল, “মিম্মি, তুই আয়। দুইজনই মেয়ে হলে সন্দেহ কম করবে।”
“আমি?” মিম্মি কেমন জানি ভয়ে ভয়ে তাকাল।
“হ্যাঁ। সমস্যা কী? আমরা গিয়ে বেঞ্চের উপর বসব। তুই চা-সিংগারা অর্ডার দিবি, কথা বলবি, মানুষটাকে ব্যস্ত রাখবি। আমি বেঞ্চের তলায় হাত দিয়ে মোবাইলটা খুলে নেব।”
মিম্মি বলল, “ঠিক আছে।” তারপর বিড়বিড় করে বলল, “গিলা-কলিজার বাটি।”
রূপা বলল, “কী বললি?”
“না কিছু না। মনে নেই গোপন পাসওয়ার্ড? হঠাৎ মনে পড়ল। এইখানে এই পাসওয়ার্ড বলে ড্রাগ ডেলিভারি নিবে। মনে নেই?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে আছে।”
“ডেঞ্জারাস জায়গা।”
“তোর ভয় লাগছে?”
“না, না। ভয় লাগবে কেন?” বলে মিম্মি দুর্বলভাবে হাসল। বিড়বিড় করে বলল, “গিলা-কলিজার বাটি! কী আজব।”
রূপা আর মিম্মি হেঁটে হেঁটে খোলা চায়ের দোকানটার কাছে যায়। দোকানি মানুষটা তার কেতলিতে গরম পানি ঢালছিল, তাদের দুইজনকে দেখে মুখ তুলে তাকাল।
চায়ের দোকানে আর কেউ নেই, দুইজনে তাদের বেঞ্চে গিয়ে বসে। রূপা সাবধানে হাত দিয়ে বেঞ্চের তলাটা পরীক্ষা করে। দোকানি মানুষটা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা কনুই দিয়ে মিম্মিকে একটা খোঁচা দিল, দৃষ্টিটা তার দিকে সরানোর দরকার। মিম্মি বলল, “আমাদের দেন দেখি
“কী দেব?”
মিম্মি হঠাৎ করে বলে বসল, “গিলা-কলিজার বাটি–” কথাটা শুনে রূপা পাথরের মতো জমে গেল, সিংগারা বলতে গিয়ে বলে ফেলেছে গিলা-কলিজার বাটি। কী সর্বনাশ। দোকানি মানুষটাকে দেখে মনে হল তার মাথার উপর বাজ পড়েছে। সে মুখ হাঁ করে মিম্মির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
মিম্মি নিজেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না কী ঘটে গেছে। রূপা টান দিয়ে মোবাইল ফোনটা খুলে নিয়েছে এখন আর এখানে থাকার দরকার নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। দোকানি মানুষটা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তো-তোমরা? তোমরা?”
মিম্মি বোকার মতো মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ আমরা।”
“তোমরা গিলা-কলিজার বাটি! কি আশ্চর্য!”
রূপা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল মিম্মি।”
“দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমরা এসেই চলে যেও না। তোমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছ। এইটাই সেই জায়গা। খালি বল দেখি এর পরেরটা কী?” রূপা বলল, “বরফের মতো গরম আগুনের মতো ঠাণ্ডা।”
দোকানি মানুষটা বোকার মতো মাথা নাড়তে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় তার ঘাড়ের সাথে মাথার অংশটা ঢিলে হয়ে গেছে। মানুষটা তার ময়লা দাঁত বের করে হাসল তারপর টেবিলের তলা থেকে কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিল।
রূপা বুঝতে পারল এখন আর তাদের পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। সে হাত বাড়িয়ে বাক্সটা হাতে নিল তারপর আর একটা কথা না বলে হাঁটতে শুরু করে।
রাস্তার অন্য পাশে রাজু আর সঞ্জয় দাঁড়িয়ে ছিল তারা তাদের দিকে এগিয়ে আসে, রাজু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী?”
রূপা বলল, “এখন কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি হাঁট।”
রাস্তার পাশে মোড় নিয়ে ডান দিকে চলে যাবার আগে রূপা চোখের কোনা দিয়ে দেখল চায়ের দোকানের মানুষটা এখনো মুখ হাঁ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
কিছুক্ষণ আগে যেরকম তারা চারজন মিথিলার মোবাইল ফোনটাকে মাঝখানে রেখে চারজন চারদিকে বসে ছিল এখন প্রায় ঠিক সেইভাবে মাঝখানে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা রেখে চারজন চারদিকে বসে আছে। সবাই বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে এবং তাদের দেখে মনে হয় তারা ঠিক বাক্সের দিকে নয় তারা বুঝি একটা মরা মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। সঞ্জয় বলল, “তোরা কেমন করে এটা করলি?”
মিম্মি মুখ কাচুমাচু করে বলল, “হঠাৎ করে মুখ ফসকে বের হয়ে গেল। আমি কী করব?”
“মুখ ফসকে অন্য কিছু বের হতে পারল না? ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়্যার?” সঞ্জয় চোখ লাল করে বলল, “তোকে গিলা-কলিজার বাটিই বলতে হল!”
রাজু বলল, “থাক। থাক। যা হবার হয়ে গেছে। এখন ঠিক করতে হবে আমরা কী করব?”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী করব?”
মিম্মি বলল, “এই বাক্সটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারি। বলতে পারি ভুল হয়ে গেছে, সরি।”
“মাথা খারাপ?” আমাদেরকে পেলে এখন খুন করে ফেলবে।”
“পুলিশকে দিতে পারি।” সঞ্জয় বলল, মোড়ে যে পুলিশ বক্সটা আছে সেখানে গিয়ে তাদেরকে এই বাক্সটা দিয়ে বলতে পারি এটা রাস্তায় পড়েছিল, আমরা পেয়ে ফেরত দিতে এসেছি।”
“আর যখন খুলে দেখবে ভেতরে ড্রাগস তখন আমাদের এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? রিমান্ডে নিয়ে এমন টর্চার করবে–”
সঞ্জয় বলল, “এর ভেতরে ড্রাগস আছে কেমন করে জান? হয়তো অন্য কিছু।”
রাজু ভুরু কুঁচকে বলল, “অন্য কিছু কী?”
“কোনো মানুষের কাটা মাথা–”
মিম্মি পিছনে সরে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কাটা মাথা?”
“দেখিসনি? সিনেমায় থাকে? বাক্সের ভেতরে কাটা মাথা?” রা
জু বলল, “খুলে দেখি কী আছে ভেতরে।”
মিম্মি বলল, “কাটা মাথা থাকলে আমি ফিট হয়ে যাব।”
“আগেই কারো ফিট হওয়ার দরকার নেই।”
.
বাক্সটা মোটা টেপ দিয়ে খুব ভালো করে লাগানো, হাত দিয়ে টেনে খোলা গেল না। রাজু রান্নাঘর থেকে একটা চাকু আনল, টেপ কেটে বাক্সটা সাবধানে খোলা হল। ভেতরে ভেঁড়া খবরের কাগজ দিয়ে প্যাকিং করা আছে সেগুলো সরানো হলেই দেখা গেল সারি সারি অনেকগুলো বয়াম আর প্রত্যেকটা বয়ামের ভেতর ছোট ছোট লাল রঙের ট্যাবলেট।
রূপা একটা কাঁচের জার হাতে নিতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজা খুলে রাজুর আম্মু ঢুকলেন। রূপা খুব শান্তভাবে কিছুই হয়নি এরকম ভান করে বাক্সটার ঢাকনা বন্ধ করল যেন রাজুর আম্মু ভেতরে দেখতে না পারেন।
রাজুর আম্মু তাদের মুখের দিকে তাকালেন তারপর একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? তোমাদের কী হয়েছে? এরকম মুখ কালো করে সবাই বসে আছ কেন?”
রূপা বলল, “না খালাম্মা। কিছু না।”
“বাক্সের মাঝে কী?”
রূপা এক মুহূর্তের জন্যে ভাবল সত্যি কথাটা বলে দেবে কী না। কিন্তু মনে হল এখনই বলা যাবে না–ফলটা ভালো না হয়ে খারাপ হতে পারে। কাজেই মিথ্যা কথা বলতে হল। সে যেহেতু আগেও বলেছে তাই সে নিজেই দায়িত্বটুকু নিল। বলল, “কেমিক্যালস।”
“কেমিক্যালস?”
“জি।”
“কীসের কেমিক্যালস?”
“আমাদের সায়েন্স প্রজেক্টের। আমরা ঠিক করেছি স্মোক বম্ব বানাব। সেই জন্যে কেমিক্যালস দরকার, সেগুলো জোগাড় করেছি।”
“ও আচ্ছা। কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমরা বুঝি একটা ব্যাংক ডাকাতি করতে যাচ্ছ।”
“না। না। আসলে কীভাবে করব, চিন্তা করছিলাম তো তাই।”
“ঠিক আছে!” রাজুর আম্মু হাসলেন, বললেন, “বেশি চিন্তা করলে আবার খিদে পেয়ে যায়। টেবিলে তোমাদের জন্যে নাস্তা দিচ্ছি। তোমরা খেতে এসো।”
রাজু বলল, “আসছি আম্মু।”
রাজুর আম্মু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই মিম্মি রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই বড় হয়ে নিশ্চয়ই ক্রিমিনাল হবি।”
রূপা চোখ পাকিয়ে বলল, “কেন?”
“কী রকম চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে দিলি! ঘাগু ক্রিমিনাল না হলে পারে না।”
রূপা রেগে উঠল, “এত যদি সত্যি কথা বলার ইচ্ছে তা হলে গিয়ে বলে দিচ্ছিস না কেন? আমরা ড্রাগ ডিলারদের ড্রাগ বোঝাই একটা বাক্স নিয়ে এসেছি। এখন ড্রাগ ডিলাররা আমাদের খুঁজছে মার্ডার করার জন্যে? বলিসনি কেন?”
রাজু বলল, “আহা-হা-রাগ করছ কেন?”
“তা হলে কী খুশি হব? আমাকে তোরা মিথ্যাবাদী বলবি আর আমি আনন্দে লাফাব? আমি কী ইচ্ছে করে মিথ্যা কথা বলেছি? আমি কী আমার নিজের জন্যে মিথ্যা বলেছি?”
রাজু বলল, আহা-হা-প্লীজ রূপা। শান্ত হও।”
রূপার প্রায় চোখে পানি এসে গেল। বলল, “রাজু আমি তোমার আম্মুর কাছে মিথ্যা কথা বলতে চাই না। তাই যে কয়টা কথা বলেছি তার সবগুলো করতে হবে, যেন কোনো কথাই মিথ্যা না হয়। বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
“স্মোক বম্ব বানাবার জন্যে যেই সব কেমিক্যালস লাগে আমাদের সেই কেমিক্যালস কিনতে হবে। আমাদের সায়েন্স প্রজেক্টে সেটা বানাতে হবে। বুঝেছিস সবাই?” রূপা প্রায় হিংস্র গলায় বলল, “বুঝেছিস?”
সবাই মাথা নাড়ল। মিম্মি ভয়ে ভয়ে বলল, “বুঝেছি।”
রাজু জিজ্ঞেস করল, “আর এই ড্রাগসগুলো?”
“যা ইচ্ছে তা করতে পার।”
রাজু বলল, “পরে ঠিক করব কী করা যায়, আপাতত লুকিয়ে রাখি।”
রাজু বাক্স থেকে কাঁচের বয়ামগুলো বের করে তার বইয়ের শেলফে বইয়ের পিছনে রেখে দিল।
ময়না খালার বাচ্চা দুটো এ সময় ঘরে ঢুকে বলল, ভাই তোমার বন্ধুদের নিয়ে নাস্তা খেতে এসো। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তা না হলে।
অনেক মজার মজার খাবার কিন্তু তারা এমনভাবে সেগুলো খেতে লাগল যে দেখে মনে হতে থাকে খাবার নয়, শুকনো খবরের কাগজ খাচ্ছে। ব্যাপারটা রাজুর আম্মুর চোখ এড়াল না, জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে তোমরা বেশ ডিস্টার্বড়!”
রূপা যেহেতু মিথ্যা কথা বলার দায়িত্বটি নিয়ে নিয়েছে তাই সে আবার দায়িত্ব নিল, তবে এবারে একটু অন্যভাবে বলল, “না খালাম্মা, আসলে আমার মনটা একটু খারাপ ছিল তো সেই জন্যে মনে হয় অন্যদেরও মন খারাপ হয়েছে।”
রূপা রাজুর কাছে শুনেছিল তার আম্মু কী একটা মহিলা সংগঠনে কাজ করেন। কয়দিন থেকে ভাবছিল তার সাথে সুলতানার ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে। এখন তার একটা চেষ্টা করা যায়। সে বলল, খালাম্মা, আমাদের বাসায় একটা মেয়ে কাজ করে, তার নাম সুলতানা। বেচারি সুলতানার ফ্যামিলির খুব অভাব-অনেক বড় ফ্যামিলি। কিছুতেই বেচারি টাকা জমাতে পারছে না। বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে না।
রাজুর আম্মু কিছুক্ষণ রূপার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপরে বললেন, “আমাদের দেশের কাজের মানুষের সমস্যা অনেক বড় সমস্যা। তারা চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে, তাদের কোনো ছুটি নেই। অল্প কিছু বেতন পায় অনেক ফ্যামিলিতে ‘অত্যাচার করে কিন্তু কেউ সেটা দেখে না। দেশে তাদের জন্যে কোনো আইন নেই। তুমি এত ছোট একটা মেয়ে এদের ব্যাপারটা লক্ষ করেছ, সেটা খুব চমৎকার। কংগ্রাচুলেশনস।”
“ওদের জন্যে কী করা যায় খালাম্মা?”
“সবচেয়ে সহজ হচ্ছে বাসার কাজ থেকে সরিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া। বাসার কাজে তো কোনো সম্মান নেই। সত্যিকার কাজে সম্মান আছে।”
“কী ধরনের কাজ?”
“যাদের লেখাপড়া নেই, ট্রেনিং নেই তাদের জন্যে তো সুযোগ খুব বেশি নেই! গার্মেন্টসের কাজ হতে পারে। বড় বড় শহরে বিশাল বিশাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, এখানে সেরকম নেই। কিন্তু একটা-দুইটা আছে।
“রূপা আগ্রহ নিয়ে বলল, এরকম একটা গার্মেন্টসে কী সুলতানা কাজ করতে পারবে?”
“বয়স কত?”
“আমার মতো।”
“তা হলে তো অনেক ছোট।”
“আরেকটু বড়ও হতে পারে।”
“যাই হোক শিশু শ্রমের ব্যাপার আছে। তারপরেও চেষ্টা করতে পারি। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, যদি রাজি থাকে তা হলে বল। আমার পরিচিত কিছু গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি আছে।”
“বলব। খালাম্মা, আপনাকে বলব।”
.
১০.
বিজ্ঞান ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কী খবর?”
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা বলল, “ভালো ম্যাডাম। খুব ভালো।”
“ভেরি গুড। তোমাদের বিজ্ঞান প্রজেক্ট কেমন এগোচ্ছে?”
এবারে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ভেতর থেকে নানা ধরনের উত্তর শোনা গেল। কিছু জোরে, কিছু আস্তে, কিছু উৎসাহের, কিছু হতাশার, কিছু আনন্দের এবং কিছু দুঃখের। ম্যাডাম সবকিছু বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝেছি।”
মাসুক জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝেছেন ম্যাডাম?”
“তোমাদের চাপ দিতে হবে। তা না হলে তোমরা প্রজেক্ট শেষ করবে না।”
“চাপ?”
“হ্যাঁ। একটা ডেডলাইন দিতে হবে।” ম্যাডাম মনে মনে কী একটা হিসাব করলেন তারপর বললেন, “তোমাদের এক সপ্তাহ সময় দিলাম, পরের শুক্রবার সায়েন্স ফেয়ার।”
ক্লাসের অনেকেই চমকে উঠল, “পরের শুক্রবার? এত তাড়াতাড়ি?”
“হ্যাঁ। এত তাড়াতাড়ি। তার কারণ এইটা শেষ হবার পর আরেকটা প্রজেক্ট হবে তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা এভাবে চলতেই থাকবে! বুঝেছ?”
“বুঝেছি ম্যাডাম।”
“এবারে সবার প্রগ্রেস রিপোর্ট শুনি।” ম্যাডাম ব্যাগ থেকে কাগজ বের করলেন, “প্রথমে হচ্ছে টিম দুর্বার। টিম দুর্বার তোমরা বল তোমাদের কাজ কতদূর অগ্রসর হয়েছে?”
টিম দুর্বারের সদস্যদের খুব দুর্বার মনে হল না, মুখ কাচুমাচু করে জানাল সৌর বিদ্যুৎ প্রজেক্টের জন্যে তাদের সোলার প্যানেল আর ব্যাটারি জোগাড় করার কথা, এখনো জোগাড় হয়নি তাই প্রজেক্ট থেমে আছে। ম্যাডাম তখন কীভাবে সোলার প্যানেল, ব্যাটারি এসব জোগাড় করা যায় সেটা বলে দিলেন।
এরপরের টিমের নাম টিম গ্যালিলিও, তাদের একটা টেলিস্কোপ তৈরি করার কথা। তারা জানাল টেলিস্কোপ একটা তৈরি হয়েছে কিন্তু এখনো দুটি সমস্যা। প্রথমত, সবকিছু ঝাঁপসা দেখা যায় এবং উল্টো দেখা যায়। তাদের কথা শুনে ক্লাসের অনেকে হেসে উঠলেও ম্যাডাম হাসলেন না, ঝাঁপসাকে কেমন করে পরিষ্কার করা যায় আর উল্টোকে কেমন করে সিধে করা যায় সেটা বলে দিলেন।
এর পরের টিমের নাম টিম রোবটিক্স, টিম লিডার মাসুক। তার উৎসাহের শেষ নেই কিন্তু তার টিমের অন্য মেম্বারদের কেমন যেন নেতিয়ে পড়া ভাব। মাসুক বলল, “ম্যাডাম আমরা আমাদের প্ল্যানটা একটু অন্যরকমভাবে করেছি।”
“কী রকম করেছ?”
“সত্যিকারের রোবট বানানো তো সোজা না, এক সপ্তাহের মাঝে তৈরি করা যাবে না, তাই আমরা ঠিক করেছি আমরা নিজেরাই রোবট সেজে ফেলব। কার্ডবোর্ড কেটে মাথার মাঝে লাগিয়ে রোবটের ভাষায় কথা বলব।”
বিজ্ঞান ম্যাডাম কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন, “রোবটের ভাষা? সেটা কী রকম?”
মাসুক তখন নাক দিয়ে কাটা কাটা এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করল। সেটা শুনে ক্লাশের সবাই হেসে উঠল এবং ম্যাডাম আরেকটু হকচকিয়ে গেলেন, একটু ইতস্তত করে বললেন, “রোবট বানানো আর রোবট সাজা কিন্তু এক ব্যাপার না।”
রোবট বানানোটা ধর বিজ্ঞানের কাজকর্ম হতে পারে, কিন্তু রোবট সাজাটা হবে নাটক-থিয়েটারের কাজকর্ম।”
মাসুককে এবারে একটু হতাশ দেখা গেল, বলল, “রোবট বানানো খুবই কঠিন। ইন্টারনেটে একটু দেখেছিলাম কিছুই বুঝি না।”
ম্যাডাম বললেন, “পৃথিবীর কোনো জিনিসই কঠিন নয়। একসাথে পুরোটা কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সেটাকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নাও দেখবে কোনোটাই কঠিন নয়। কাজেই পুরো রোবট একবারে তৈরি না করে রোবটের একটা অংশ তৈরি কর। হাতের মডেল কিংবা একটা আঙুল।”
মাসুককে এবারে কেমন যেন আতঙ্কিত দেখা গেল, “শুধু আঙুল?”
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মাসুকের হাহাকার শুনে হি হি করে হেসে ফেলল ম্যাডামও হাসলেন, বললেন, “ঠিক আছে তা হলে তোমরা রোবটই সেজে আস! আমরা বলব এটা হচ্ছে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার পদক্ষেপ।”
মাসুককে এবারে আবার উৎসাহী দেখা গেল, বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম আপনি দেখবেন একবারে ফাটাফাটি রোবট বানাব। আসল রোবটের বাবা।”
বিজ্ঞান ম্যাডাম এরপর টিম সহজ-সরল-এর সাথে কথা বললেন, তারপর টিম ব্ল্যাকহোল তারপর টিম মিরূসোরাস। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, টিম মিরূসোরাসের পক্ষ থেকে কে কথা বলবে?”
রূপা দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বলতে পারি।”
“বল তোমাদের কাজের কতটুকু হয়েছে?”
রূপা মাথা চুলকে বলল, “আমরা ঠিক করেছি স্মোক বম্ব বানাব–কিন্তু এখনো কিছু জিনিস নিয়ে ঝামেলার মাঝে আছি।”
“কী ঝামেলা?”
“ইন্টারনেট থেকে কী কী কেমিক্যাল লাগবে বের করেছি কিন্তু কোথা থেকে পাওয়া যায়, কত দাম এগুলো বুঝতে পারছি না।”
“কী কেমিক্যাল লাগবে বল দেখি?”
”পটাশিয়াম নাইট্রেট, চিনি, ঐন্সিয়াম সল্ট, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড”
বিজ্ঞান ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, “এর সবগুলো তোমাদের এখনই লাগবে না। কিছু কিছু লাগবে। ক্লাসের পর আমার সাথে দেখা কর আমি তোমাদের বলে দেব এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে।”
সঞ্জয় বলল, “ম্যাডাম এইটা কী আসলেই বম্ব? মানে বোমা?”
বিজ্ঞান ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “তার মানে তুমি জানতে চাইছ এটা বিশাল শব্দ করে বিস্ফোরণ হয় কি না?”
সঞ্জয়ের চোখ উৎসাহে চক চক করতে থাকে, “জি ম্যাডাম! এটা কি ফাটবে?”
“না, এটা সেরকম বোমা না। এটা স্মোক বম্ব, ধোঁয়ার বোমা। এটাতে আগুন ধরিয়ে দিলে গলগল করে ধোঁয়া বের হতে থাকে। তাই এটা তোমরা ঘরের ভিতরে করতে পারবে না। এটা করতে হবে ঘরের বাইরে। মাঠে।”
“ঘরে করলে কী হবে?”
“ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে।”
শুনে সঞ্জয়ের চোখ আবার আনন্দে চকচক করতে থাকে। বিজ্ঞান ম্যাডাম বললেন, “তোমাদের টিমের নাম মিরূসোরাস। কিন্তু ‘সো’ কে এখনও দেখিনি, সে কোথায়?”
রূপা, মিম্মি, রাজু আর সঞ্জয় তখন সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। রাজু বলল, “ম্যাডাম, সোহেল অসুস্থ। তা ছাড়া তার আবার পারিবারিক কিছু সমস্যা হয়েছে সেটার জন্যে সে স্কুলে আসতে পারছে না।”
“তোমরা খোঁজ নিয়েছ?”
“জি ম্যাডাম। আমরা ওর বাসাতেও গিয়েছি। কয়েকবার।”
“কী ধরনের অসুস্থ।”
রাজু মাথা চুলকাল, কাজেই রূপাকে আবার উত্তর দিতে হল। যেহেতু মিথ্যে কথা বলা শুরু করেছে মনে হয় মিথ্যে কথা বলার দায়িত্বটা এখন থেকে পাকাঁপাকিভাবে তার ঘাড়েই এসে পড়বে। রূপা বলল, “কারণটা ঠিক করে ধরা যাচ্ছে না। খুব দুর্বল।”
বিজ্ঞান ম্যাডামের মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল, বললেন, “এরকম কম বয়সী ছেলে সে দুর্বল কেন হবে?”
“আরও কিছু সমস্যা আছে ম্যাডাম। আপনাকে ক্লাসের পরে বলব।”
ম্যাডাম কিছু একটা বুঝে গেলেন। বললেন, “ঠিক আছে ক্লাসের পর বল।” তারপর চলে গেলেন টিম আলোকবর্তিকার কাছে।
.
ডাইনিং টেবিলে বসে রূপা টের পেল আম্মুর মেজাজটা খুব খারাপ। কারণটাও কিছুক্ষণের মাঝে বোঝা গেল। হিন্দি সিরিয়ালের জাসিন্দর আর আনিলার মাঝে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে তাদের সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যাবার অবস্থা। আব্বুর ধারণা দোষটা আনিলার, আর আম্মুর ধারণা দোষটা জাসিন্দরের। সেটা নিয়ে আব্বু আম্মুরও একটা ঝগড়া হয়ে দুজনেই এখন মেজাজ খারাপ করে আছেন। সুলতানা টেবিলে খাবার এনে রাখছে। সবজিতে লবণ একটু কম হয়েছে সেই জন্যে আম্মু সুলতানাকে যাচ্ছেতাইভাবে গালাগাল করলেন। সুলতানার হয়েছে মুশকিল আম্মুর ব্লাড প্রেসার সেই জন্যে কম করে লবণ খাবার কথা, সুলতানাকে দিনে দশবার করে বলে দেওয়া হয় যেন কম লবণ দিয়ে রাধে। সে যখন সত্যি সত্যি কম লবণ দেয় তখন তাকে গালাগাল করা হয় লবণ কম দেবার জন্যে। প্রথম প্রথম সুলতানা ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করত তাতে লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টাকে এক ধরনের বেয়াদবী হিসেবে ধরে সুলতানার উপর অত্যাচার আরও বেড়ে যেত। সুলতানা এখন আর কিছু বলে না, মুখ বুজে গালমন্দ সহ্য করে।
খানিকক্ষণ নিঃশব্দে খাবার পর মিঠুন বলল, “আমরা যদি লবণকে চিনি বলতাম আর চিনিকে লবণ বলতাম তা হলে কী হত?”
খুবই গাধা টাইপের প্রশ্ন কিন্তু প্রশ্নটা পরিবেশটাকে একটু সহজ করে দিল। তিয়াশা বলল, “তা হলে আমরা লবণ দিয়ে চা খেতাম।”
আম্মু বললেন, “সুলতানা সবজিতে চিনি বেশি দিত না হয় কম দিত!” রূপা বলল, “আমরা যখন ঘামতাম তখন শরীর থেকে চিনির সিরা বের
রূপার কথা শুনে সুলতানা থেকে শুরু করে আব্বু পর্যন্ত সবাই হি হি করে হেসে উঠল। তিয়াশা খেতে খেতে একটু বিষম খেয়ে বলল, “রূপাটা যে কী ফানি কথা বলে! ওফ!”
পরিবেশটা একটু সহজ হওয়ার পর রূপা কাজের কথায় এলো। বলল, “আমাদের স্কুলে সামনের শুক্রবার সায়েন্স ফেয়ার।”
আম্মু বললেন, “সেটা আবার কী?”
“সবাই তাদের সায়েন্স প্রজেক্ট দেখাবে।”
মিঠুন জিজ্ঞেস করল, “ছোট আপু তোমার সায়েন্স প্রজেক্ট কী?”
“স্মোক বম্ব।”
“বম্ব?” আম্মু ভুরু কুঁচকালেন, “তোরা বোমা বানাচ্ছিস?”
রূপা হাসার ভান করল, “সত্যিকারের বোমা না আম্মু। ধোঁয়ার বোমা।”
“তারপরেও তো বোমা। স্কুলে বোমা বানানো শেখায়?”
রূপা বলল, “বোমা না আম্মু। এখান থেকে গলগল করে ধোয়া বের হবে। এটা ভয়ের না, মজার।”
আম্মু অপছন্দের ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন। রূপা বলল, “সবাইকে কিছু না কিছু বানাতে হবে। সবার আব্বু-আম্মুকে দাওয়াত দেওয়া হবে।”
আম্মু বললেন, “অ–”
রূপা এবারে তার আসল কথায় এলো, কাচুমাচু করে বলল, “আমাদের এই প্রজেক্টটা বানানোর জন্যে কিছু কেমিক্যাল কিনতে হবে। সেই জন্যে কিছু টাকা লাগবে আম্মু।”
“টাকা!” আম্মু রীতিমতো চমকে উঠলেন, তার গলার স্বর শুনে মনে হল টাকা নয় রূপা যেন মানুষ খুন করার কথা বলেছে।
“হ্যাঁ আম্মু। আমার একটু টাকা লাগবে।”
কত টাকা লাগবে আম্মু সেটা জানতেও চাইলেন না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “টাকা কী গাছে ধরে? এইসব পোলাপানের খেলাধুলার জন্যে টাকা নষ্ট করত হবে?”
রূপা প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, “আম্মু এটা পোলাপানের খেলাধুলা না–এটা সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”
“তুই যখন সায়েন্স পড়বি না তা হলে সায়েন্স নিয়ে এত নাটক-ফাটক করা শুরু করেছিস কেন?”
রূপা চোখ কপালে তুলে বলল, “কে বলেছে আমি সায়েন্স পড়ব না?”
আম্মু মুখে একটু খাবার তুলে বললেন, “এর মাঝে আবার বলাবলির কী আছে? কেউ এখন সায়েন্স পড়ে না।”
“কে বলেছে সায়েন্স পড়ে না? সব ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা সায়েন্স পড়ে। আমিও পড়ব।
“শুধু যারা গাধা তারা সায়েন্স পড়ে।”
“গাধা?”
“হ্যাঁ। দশজন প্রাইভেট টিউটর লাগে। ছয়টা কোচিং সেন্টার লাগে। তাই বড়লোকেরা সায়েন্স পড়ে। এইটা হচ্ছে বিলাসিতা।”
“কী বলছ আম্মু?”
“মাথার মাঝে ঐ সব বড়লোকী চিন্তা আনবি না। অন্য দশজন যা করে তুইও তাই করবি। কমার্স পড়বি।”
“না আম্মু, আমি সায়েন্স পড়ব।”
আম্মু চোখ পাকিয়ে বললেন, “ কী বললি? সায়েন্স পড়বি?”
“হ্যাঁ আম্মু।”
“তোর শখ দেখে আমি বাঁচি না!” আম্মু বিদ্রুপের হাসির মতো একটা শব্দ করলেন, তারপর মুখ শক্ত করে বললেন, “এই বাসায় কেউ সায়েন্স পড়তে পারবে না। দেখি তুই কেমন করে সায়েন্স পড়িস। এই বাসায় যদি থাকতে চাস তা হলে আমরা যেটা বলি তোকে সেটা করতে হবে। বুঝেছিস?”
কথা বলে কোনো লাভ নেই তাই রূপা কোনো কথা বলল না। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে একটু পরে বলল, “আর আমার সায়েন্স প্রজেক্টের জন্যে টাকাটা?”
“ভুলে যা। এতো সহজে টাকা গাছে ধরে না।”
রূপার চোখে পানি চলে এলো, সে মাথা নিচু করে ফেলল যেন কেউ দেখতে না পায়।
সবাই ঘুমিয়ে যাবার পরও রূপা জেগে রইল। কাল স্কুলে গিয়ে কী বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছিল না। তার কোনো একটা কিছু আছে কী না যেটা সে বিক্রি করতে পারে সেটা চিন্তা করছিল তখন মশারির পাশে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল, মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “রফ-রূফালী? ঘুম?” সুলতানার গলার স্বর!
“না এখনও ঘুমাইনি।”
“এই যে নাও।” বলে সুলতানা মশারির ভেতর দিয়ে তার হাতটা ঢুকিয়ে তাকে কিছু একটা দেওয়ার চেষ্টা করল।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“টাকা। আমার এখন দরকার নাই। তুমি রাখ। পরে দিয়ে দিও।”
রূপা বলতে গেল, না না, লাগবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না, টাকাগুলো নিয়ে বলল, “থ্যাংকু। আমি সামনের মাসে স্কলারশিপের টাকা পেলে দিয়ে দেব।”
সুলতানা ফিসফিস করে বলল, “কোনো তাড়াহুড়া নাই।”
.
১১.
সুলতানা হি হি করে হেসে বলল, “দেখো দেখো ছ্যামড়াটারে দেখো!”
রূপা তাকিয়ে দেখল, রাস্তার পাশে গাবদা-গোবদা একটা ছোট বাচ্চা বসে আছে। খালি পা, পেট মোটা, গলায় তাবিজ, মাথা ন্যাড়া এবং মুখে দর্শনিকের মতো একটা উদাসীন ভাব। এই বাচ্চাটাকে দেখে এভাবে হাসিতে গড়িয়ে পড়ার কিছু নেই কিন্তু সুলতানা হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেল। হাসি মনে হয় সংক্রামক এবং একটু পর রূপাও হি হি করে হাসতে লাগল। সে ছোট বাচ্চাটিকে জানাতেও পারল না যে, তার শিশু মুখে নিপাট গাম্ভীর্য দেখে দুইজন হাসিতে ভেঙে পড়েছে।
সুলতানা সামনে এগিয়ে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে দেখতে বলল, “কি মায়া লাগে, তাই না রূফ-রূফালী?”
রূপা মাথা নাড়ল, ছোট বাচ্চা দেখলেই সুলতানার মায়া লাগে, তার মনটা খুব নরম।
আরেকটু এগিয়ে একটা ছাগলকে দেখে সুলতানা আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল। বলল, “দেখো দেখো-বেকুব ছাগলটারে দেখো। রাস্তার মাঝখানে খাড়ায়া কাঁঠাল পাতা খায়।”
রূপা আগে কখনো ছাগল দেখে হাসেনি, কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হল, একটা ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যদি একটা ছাগল গম্ভীরভাবে কাঁঠাল পাতা চিবুতে থাকে তা হলে তার মাঝে একটু কৌতুকের চিহ্ন থাকতে পারে। আরেকটু এগিয়ে সুলতানা যখন একটা মোটা মানুষকে দেখে একটু বিপজ্জনকভাবে হাসতে শুরু করল তখন রূপা বুঝতে পারল যে আসলে সুলতানার মনটার মাঝে ফুরফুরে আনন্দ তাই সে কারণে-অকারণে হাসছে।
সুলতানা চব্বিশ ঘণ্টা বাসার ভেতরে আটকে থাকে, তার শুক্র-শনিবার নেই, ছুটিছাটা নেই, রাতের কয়েক ঘণ্টা ঘুম ছাড়া বাকি সময়টা তাকে একটানা কাজ করতে হয়। একজন মানুষের পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার জীবনে আনন্দের কিছু নেই। হঠাৎ হঠাৎ করে সে বাসার বাইরে যাবার সুযোগ পায় যখন আম্মু খুব বিশেষ একটা কারণে তাকে বাজার করতে পাঠান। আজকে সেরকম একটা দিন, বাসায় হঠাৎ করে কিছু জিনিস শেষ হয়ে গেছে তাই আম্মু সুলতানাকে বাজারে পাঠিয়েছেন। ঠিক যখন সুলতানা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হয়েছে তখন রূপার মনে হয়েছে তারও একটু দোকানে যাওয়া দরকার পোস্টার পেপার কেনার জন্যে। আম্মু সুলতানার সাথে যেতে আপত্তি করেননি তাই দুইজন একসাথে বাইরে।
সুলতানা যখন একজন বদরাগী মহিলাকে দেখে হাসতে শুরু করতে যাচ্ছিল, রূপা তাকে থামাল, বলল, “সুলতানা, তুমি যখন একা একা বাজারে যাও তখন এইভাবে সবকিছু দেখে হাস? হাসতে হাসতে যাও?”
সুলতানা বলল, “ধুর। মানুষ কী:একা একা হাসতে পারে? একা একা হাসলে মানুষ পাগল বলবে না?”
“আজকে সাথে আমি যাচ্ছি সেই জন্যে এত হাসছ?”
সুলতানা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। সেইটা সত্যি।”
“তোমার হাসতে ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ। আমি যখন গেরামে থাকতাম দিন-রাত হাসতাম। আমার মায়ে বলত আমারে জিনে পাইছে!”
রূপা বলল, “সেইটা মনে হয় তোমার মা ঠিকই বলত। তোমারে মনে হয় আসলেই জিনে পেয়েছে।”
“বাসায় যখন থাকি তখন তো হাসতে পারি না, আজকে বাইরে এসে তাই একটু হাসি-তামাশা করছি।”
“ভালো।” রূপা বলল, “যারা বেশি হাসে তাদের অসুখ-বিসুখ হয় না, বেশিদিন বাঁচে।”
“সর্বনাশ! তা হলে আমার এক্ষুনি হাসা বন্ধ করা দরকার।”
“কেন? তুমি বেশিদিন বাঁচতে চাও না?”
“আমার মতো মানুষ বেশিদিন বেঁচে কী করবে? বেশিদিন বাঁচবে তোমাদের মতো মানুষ।” বলে সুলতানা একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
তারা দুইজন কোনো কথা না বলে পাশাপাশি কিছুক্ষণ হেঁটে যায়। একসময় সুলতানা মুখ তুলে তাকাল, রাস্তার অন্যপাশে একটা বিল্ডিং, সেখানে অনেক মানুষের ভিড় বেশিরভাগই কমবয়সী মেয়ে। দেখে বোঝা যায়, মেয়েগুলো গরিব ফ্যামিলির। সুলতানা বলল, “এতগুলা শুকনা শুকনা মেয়ে এইখানে কীসের মিটিং করে?”
“জানি না।”
“কোনো কামকাজ নাই, সকালে এসে রাস্তার মাঝে হইচই!”
রূপা তাকিয়ে দেখল বিল্ডিংয়ের উপর বড় বড় করে লেখা জানে আলম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি-এই মেয়েগুলো নিশ্চয়ই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সে মাথা নাড়ল, বলল, “গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। এরা এখানে কাজ করে।”
সুলতানা ভুরু কুঁচকে বলল, “যদি কাজ করে তা হলে ভেতরে ঢুকে না। কেন?”
“ঢুকবে। দরজা খুললেই ঢুকবে।”
“উঁহু। এরা কাজ করে না। কাজ করলে পোলাপান নিয়ে আসত না।”
রূপা তাকিয়ে দেখল সুলতানার কথা সত্যি, অনেক মেয়ে, অনেক মহিলা অনেকের কোলে বাচ্চাকাচ্চা। মেয়ে আর মহিলারা লাইনে দাঁড়ানোর জন্যে ঠেলাঠেলি করছে। হঠাৎ করে রূপার একটা কথা মনে হল, হয়তো আজকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লোক নেবে-সবাই চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। রূপা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গেল, সুলতানা বলল, “কী হল?”
“চলো দেখে আসি।”
“কী দেখবা?”
“ওখানে কী হচ্ছে।” সুলতানা কিছু বলার আগে রূপা রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেল, ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হচ্ছে?”
“গার্মেন্টসে লোক নিবে।”
“তার ইন্টারভিউ?”
মহিলাটা মাথা নাড়ল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “ইন্টারভিউ দিতে হলে কী করতে হবে?”
মহিলাটা রূপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলল, “এইখানে লাইনে দাঁড়াতে হবে।”
“আর কিছু লাগে?”
“না। গায়ে-গতরে জোর থাকা লাগে। পেটে ভুখ থাকা লাগে আর কিছু লাগে না।”
সুলতানা ততক্ষণে হেঁটে রূপার কাছে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
রূপা কিছুক্ষণ সুলতানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “সুলতানা।”
“কী?”
”ইন্টারভিউ দেবে?”
সুলতানা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কী করব?”
“গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লোক নিচ্ছে। তুমি ইন্টারভিউ দিতে চাও?”
“আমি?” সুলতানা ভাবল রূপা ঠাট্টা করছে তাই ঠাট্টার উত্তর দেবার মতো করে হি হি করে হাসল।
রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। সিরিয়াসলি বলছি।”
এবারে সুলতানা অবাক হয়ে রূপার দিকে তাকাল বলল, “তুমি সত্যি বলছ?”
“হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। বাসায় তোমাকে যত কষ্ট করতে হয় তার কোনো মানে নাই। গার্মেন্টসে কাজ করলে তুমি স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে।”
“স্বাধীনভাবে?”
“হ্যাঁ। বাসার কাজে কোনো সম্মান নাই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমাকে কাজ করতে হয়। আম্মু তোমাকে খালি বকে না, তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে। তোমার এখানে থাকা ঠিক না।”
সুলতানা খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল। রূপা বলল, “তুমি লাইনে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ দাও।”
সুলতানা এতক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে, একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “বলা খুব সোজা।”
“কেন? বলা সোজা কেন?”
লাইনে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে তুমি জান? তারপর বাসায় গেলে খালাম্মা আমারে আস্ত রাখবে?”
রূপা বলল, “তুমি বাজারের জিনিসটা আমারে দাও। আমি বাজার করে আনি। তুমি এইখানে দাঁড়াও, ইন্টারভিউ দাও।”
সুলতানা হি হি করে হাসল, বলল, “তুমি বাজার করবে?” তা হলেই হইছে।”
“কেন? আমি দুই-তিনটা জিনিস কিনতে পারব না?”
সুলতানা লম্বা লাইনটার দিকে তাকাল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ্! এই লাইন অনেক লম্বা। রাত পোহায়ে যাবে।”
রূপা প্রথম যে মহিলার সাথে কথা বলেছিল সে কাছেই দাঁড়িয়ে তাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে হঠাৎ করে সুলতানাকে বলল, “তুমি চাইলে আমার সামনে দাঁড়াতে পার। তা হলে বেশিক্ষণ লাগবে না।”
সুলতানা বলল, “আপনার সামনে দাঁড়াব?”
“হ্যাঁ।”
রূপা বলল, “যারা পিছনে আছে তারা রাগ হবে না?”
“কিছু রাগ তো হবেই। এত রাগ-গোসা দেখলে হয়?”
“কিন্তু কাজটা কী ঠিক হবে? লাইন ভেঙে সামনে–”
“বেঁচে থাকতে হলে ঠিক-বেঠিক সব কাজ করতে হয়।” মহিলা সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “খাড়াও।”
সুলতানা তখন সুরুত করে লাইনে ঢুকে গেল। পিছন থেকে একটা শশারগোল হল কিন্তু মহিলাটি কোমরে হাত দিয়ে পিছনে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, “কে আওয়াজ দেয়?”
পিছনের শোরগোলটা হঠাৎ করে থেমে গেল।
আধঘণ্টা পর সুলতানা একটা খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল তারপর কয়েক মিনিটের ভেতরেই বের হয়ে এলো, হাতে একটা কাগজ আর মুখে হাসি।
রূপা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল সুলতানা? কী হল?”
সুলতানা কাগজটা রূপার দিকে এগিয়ে দেয়, “এই যে! চাকরি হয়ে গেছে। আমি এখন জজ-ব্যারিস্টার অফিসার। আট ঘণ্টার শিফট, দুই হাজার টাকা বেতন।”
রূপা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
রূপার তখনো বিশ্বাস হয় না, “খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
রূপা তখন সুলতানাকে জড়িয়ে ধরল। সুলতানার হি হি করে হাসার কথা কিন্তু সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
.
আম্মু ঢোক গিলে বললেন, “কী বললি?”
সুলতানা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কাজ করমু না।”
আম্মু কঠিন গলায় বললেন, “কাজ করবি না? তা হলে খাবি কী? থাকবি কোথায়?”
“আমি গার্মেন্টসে কাজ করমু।”
মনে হল আম্মু কথাটা বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কীসে কাজ করবি? গার্মেন্টসে?”
“জে?”
আম্মু খলখল করে হাসলেন, বললেন, “তোর ধারণা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকেরা তোরে চাকরি দেওয়ার জন্যে বসে আছে? চাকরি করা এত সোজা? তুই যাবি আর তোরে হাজার টাকা বেতনে চাকরি দিয়ে দেবে?”
সুলতানা বলল, “আমি চাকরি পেয়ে গেছি।”
মনে হল আম্মু একটা ইলেকট্রিক শক খেলেন।
কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “চাকরি পেয়ে গেছিস?”
“জে।”
“কো-কোথায়?”
“জানে আলম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। আট ঘণ্টার শিফট। দুই হাজার টাকা বেতন।”
আম্মু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুলতানার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “দু-দুই হাজার টাকা?”
“জে।”
“কেমন করে পেলি?”
সুলতানা এবারে কোনো কথা বলল না। আম্মু তখন রেগে গেলেন, “কেমন করে পেলি? বাড়ি এসে তোকে চাকরি দিয়ে গেছে?”
সুলতানা মাথা নাড়ল।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে?”
“যেদিন বাজারে গিয়েছিলাম সেদিন ইন্টারভিউ দিছি।”
“রূপা তোর সাথে ছিল না?”
সুলতানা রূপাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, বলল, “রূফা জানে না। পোস্টার কাগজ কিনতে গেছিল আমি তখন দিছি।”
আম্মু চোখ লাল করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। আম্মু হঠাৎ তার গলায় একেবারে মধু ঢেলে বললেন, “পাগলি মেয়ে! তোর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভদ্রঘরের মেয়েরা কখনো গার্মেন্টসে কাজ করতে যায়?”
আম্মুর গলার স্বর শুনে সুলতানা একেবারে ভড়কে গেল, অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। আম্মু গলায় আরও মধু ঢেলে বললেন, “তুই গার্মেন্টসে কাজ করতে যাবি, কোথায় থাকবি, কী খাবি, কখন কোন বিপদে পড়বি, আমি কী শান্তিতে থাকতে পারব? আমার একটা দায়িত্ব আছে না?”
সুলতানা এবারেও কিছু বলল না। আম্মু মুখে আঠা-আঠা এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বললেন, “মাথা থেকে এই সব পাগলামি চিন্তা ঝেড়ে ফেল মা! এইখানে থাকতে তোর কষ্ট কীসের? নিজের বাড়ি মনে করে থাকবি। আমরা কী তোর নিজের ফ্যামিলির মতো না? আমাদের ছেড়ে তুই চলে যেতে পারবি?”
সুলতানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আম্মু তাকে বলতে দিলেন না। হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে আহ্লাদী স্বরে নেকি নেকি গলায় বললেন, “আমি তোর কোনো কথা শুনব না। তুই আমার ফ্যামিলির, তোকে আমি যেতে দিব না। তুই এখানে থাকবি।”
সুলতানা আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আম্মু আবার হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, “যা এখন। একটু চা বানিয়ে আন, আমার জন্যে এক কাপ। তোর নিজের জন্যে এক কাপ!”
রাতেরবেলা আরো ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল, আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন মিলে যখন হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তখন আম্মু মধুর গলায় ডাকলেন, “সু-ল-তা-না!”
সুলতানা ছুটে এলো, “জি খালাম্মা।”
“তুই কী করছিস?”
“তরকারি গরম করছি।”
“পরে করবি। এখন এখানে বস।”
সুলতানা ঢোক গিলে বলল, “বসব?”
“হ্যাঁ, আমাদের সাথে এই সিরিয়ালটা দেখ। অসাধারণ। নায়কের নাম জাসিন্দর, একটিং দেখলে তোর চোখে পানি এসে যাবে।”
সুলতানা শুকনো গলায় বলল, “আমার দেখতে হবে না খালাম্মা। হিন্দি কথা আমি বুঝি না।”
“বুঝবি না কেন? একেবারে বাংলার মতোন। একটু শুনলেই সব বুঝতে পারবি।”
“ভাত-তরকারি গরম করতে হবে। সালাদ কাটতে হবে–”
“পরে করবি। এখন এইখানে বস। বসে দেখ কী অসাধারণ একটিং।”
আম্মু জোর করে সুলতানাকে বসালেন, সুলতানা কাঠ হয়ে বসে রইল।
.
ভোরবেলা রূপা, তিয়াশা আর মিঠুন স্কুলে চলে যাবার পর সুলতানা আবার আম্মুর কাছে এলো। বলল, “খালাম্মা, আমারে বিদায় দেন, আমি যাই। আজকে গার্মেন্টসে আমার কাজ শুরু করার কথা।”
আম্মুর চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, “তোকে না বলেছি না যেতে।”
“আমারে যেতে হবে খালাম্মা। আমি আর বাসায় কাম করতে চাই না।”
“বাসায় কাজ করতে চাস না?”
“না খালাম্মা।”
“আমার কী হবে? বাসা কেমন করে চলবে?”
“আপনি কাউকে পেয়ে যাবেন খালাম্মা।”
আম্মু হিংস্র মুখে তাকালেন, “তুই আমার সাথে নিমকহারামি করবি?”
“এইটা নিমকহারামি না খালাম্মা। আমি একটা ভালো সুযোগ পাইছি, সেই সুযোগটা নিতে চাই। আপনি আমার জন্যে দোয়া করে দেন।”
“তোর জন্যে দোয়া করব? হারামজাদি।” আম্মু হিসহিস করে বললেন, “তোর গলা দিয়ে যেন রক্ত বের হয়। কুষ্ঠ রোগে তোর যেন নাক খসে পড়ে। তোর চৌদ্দ গুষ্টি যেন রাস্তায় ভিক্ষা করে। বের হয়ে যা বাসা থেকে বের হয়ে যা–”
“আমার জিনিসপত্র। গত তিন মাসের বেতন?”
“কী! গত তিন মাসের বেতন?” আম্মু এবারে ভয়ংকর আক্রোশে সুলতানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এর আগে আম্মু যতবার সুলতানার গায়ে হাত তুলেছেন সুলতানা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে, আজ প্রথমবার ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিল। বলল, “অনেক মাইর খাইছি খালাম্মা। আর খামু না।”
আম্মু চিৎকার করে বললেন, “বের হয়ে যা হারামজাদি। বের হয়ে যা এক্ষুনি।”
রূপা দরজা খুলে বের হতে হতে বলল, “কয়েকদিনের জন্যে রান্না করে গেছি খালাম্মা। ফ্রিজে আছে। খালি ভাতটা বেঁধে নিবেন।”
“চুপ কর হারামজাদি”
“কাপড়গুলো ধুয়ে নেড়ে দিছি, বিকালে তুলে নিতে হবে–”
“বের হয়ে যা তুই-দূর হয়ে যা।”
সুলতানা বের হলে গেল।
.
১২.
এলুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মোড়ানো কালচে জিনিসটা উপরে তুলে রূপা বলল, “এই হচ্ছে আমাদের তৈরি প্রথম স্মোক বম্ব।”
মিম্মি সন্দেহের চোখে স্মোক বম্বটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটাকে মোটেও বোমার মতো মনে হচ্ছে না, দেখে মনে হচ্ছে খাবার জিনিস। পিৎজার সুইস।”
রাজু বলল, “উঁহু, এইটা খাবার জিনিস না। এইটা স্মোক বম্ব।”
সঞ্জয় উত্তেজিত গলায় বলল, “আয় টেস্ট করি। আগুন ধরিয়ে দেই।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় টেস্ট করব?”
“কেন? এই বারান্দায়।”
তারা টিফিন ছুটিতে তাদের প্রথম স্মোক বম্ব তৈরি করেছে। সায়েন্স ফেয়ার নিয়ে সবার ভেতরে উত্তেজনা, অনেক ছেলেমেয়েই অনেক কিছু তৈরি করেছে, সেগুলো নানাভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। কাজেই এর মাঝে টিম মিরূসোরাস যদি তাদের স্মোক বম্বটা পরীক্ষা করে দেখে তা হলে কেউ কিছু বলবে বলে মনে হয় না। তারপরও রূপা সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “আমরা আমাদের স্মোক বম্ব টেস্ট করছি। কেউ কাছে আসবে না।”
আশেপাশে যারা ছিল তারা দূর থেকে এবারে কাছে চলে এলো ভালো করে দেখার জন্যে। রূপা তাদের ঠেলে সরানোর একটু চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে সঞ্জয়কে বলল, “সঞ্জয় আগুন দে।”
সঞ্জয় পকেট থেকে ম্যাচ বের করে তাদের স্মোক বম্বে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করল, আগুনটা জ্বলে উঠেই নিভে গেল। রাজু চিন্তিত মুখে বলল, কী হল? আগুন ধরছে না?”
সঞ্জয় বলল, “জানি না। আবার দেখি।” সে আবার ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে স্মোক বম্বের এক কোনায় ধরে রাখে এবারে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায় তারপর চিড়চিড় শব্দ করে সেটা পুড়তে থাকে আর স্মোক বম্ব থেকে গলগল করে ধোয়া বের হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে। যারা স্মোক বম্ব ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা আনন্দে চিৎকার করে আরো কাছে এগিয়ে আসে।
স্মোক বম্বের ধোয়া একতলার বারান্দা থেকে দোতলায় উঠে যায়, দোতলা থেকে তিনতলায়, সেখান থেকে পাশের বিল্ডিংয়ে। শুধু ধোঁয়া নয় ধোয়ার সাথে এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধে চারদিক ভরে গেল।
“আগুন আগুন” বলে চিৎকার করতে করতে দোতলা থেকে কয়েকজন মেয়ে চিৎকার করে ছুটে আসতে থাকে। অফিস ঘর থেকে স্যার-ম্যাডামরা উদ্বিগ্ন মুখে বের হয়ে আসেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে”ফায়ার ব্রিগেড ফায়ার ব্রিগেড” বলে চিৎকার করতে থাকেন।
স্কুলের দপ্তরি এক বালতি পানি নিয়ে ছুটে আসতে থাকে। সে আসতে আসতে স্মোক বম্ব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে, মেঝের মাঝে কালচে একটু অঙ্গার ছাড়া আর কিছুই নেই। বালতি হাতে সে অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়, “কোথায় আগুন? কোথায়?”
রূপা বুঝতে পারল তারা অত্যন্ত সফল একটা স্মোক বম্ব তৈরি করেছে কিন্তু সেই জন্যে একটা মহা গাড্ডার মাঝে পড়েছে। স্যার-ম্যাডামের বকাবকি কিংবা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের শাস্তি থেকে উদ্ধার পাবার কোনো উপায় ছিল না কিন্তু বিজ্ঞান ম্যাডাম তাদের রক্ষা করলেন। সবাইকে বোঝালেন এটি কোনো সত্যিকারের আগুন নয়, অত্যন্ত নিরীহ একটা স্মোক বম্ব। কিছু ধোঁয়া তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই করে না। নিচে জড়ো হওয়া স্যার, ম্যাডাম আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললেন, “এদের কোনো দোষ নেই। দোষটা আমার, ওদের বলতে ভুলে গেছি বারান্দায় টেস্ট না করে মাঠের মাঝখানে বা ভোলা জায়গায় টেস্ট করতে হবে।”
সত্যিকারের কোনো আগুন নয় একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা শুনে স্যার ম্যাডামরা তাদের অফিসে ঢুকে গেলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম গজগজ করে বললেন, “কী করছ না করছ সেটা একটু ভেবে দেখবে না?”
রূপা মাথা চুলকে বলল, “আমরা বুঝতে পারিনি। আর হবে না ম্যাডাম।”
“হ্যাঁ। আর যেন ভুল না হয়।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে যাবার পর সঞ্জয় খুশিতে হাতে কিল দিয়ে বলল, “একেবারে, ফাটাফাটি আবিষ্কার! সায়েন্স ফেয়ারের সময় একসাথে দশটা জ্বালিয়ে দিয়ে সারা স্কুল ধোয়া দিয়ে অন্ধকার করে দেব।”
মিম্মি বলল, “আমরা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব। তাই না?”
রূপা বলল, “শুধু ধোয়া হলে সেটা তো এমন কিছু না। সিগারেট ধরালেও তো ধোঁয়া বের হয়। আমাদের এখন এই ধোঁয়াকে রং করতে হবে। লাল, নীল, বেগুনি ধোয়া যদি বানানো যায় তা হলে মজা হবে।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। শুধু আরো কিছু কেমিক্যাল দরকার। জোগাড় করতে পারলে হয়।”
সবাই মাথা নাড়ল। কেমিক্যালস বেশ দামি। সব পাওয়াও যায় না। রূপা বলল, “আরেকটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“আমরা যদি আরো একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করি!”
“কী এক্সপেরিমেন্ট?”
“ফিল্মের খালি কৌটার ভেতর একটুখানি খাবার সোডার মাঝে ভিনেগার ঢেলে কৌটাটা বন্ধ করে দেব, ভেতরে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হয়ে একটু পরে ফটাশ করে ফেটে যাবে!”
মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি। বানানো খুব সোজা-খাবার সোডা আর ভিনেগার, বাসাতেই আছে। শুধু ফিল্মের প্লাস্টিকের কৌটা লাগবে।”
রাজু বলল, “আমাদের বাসার কাছে একটা ফটো স্টুডিও আছে, আমি সেখান থেকে কাল ফিল্মের কৌটা নিয়ে আসব।”
সঞ্জয় হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফাটাফাটি সায়েন্স ফেয়ার হবে তাই না? আমরা মনে হয় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব, তাই না?”
রূপা বলল, “ধুর গাধা। শুধু ধুমধাম শব্দ করলে কেউ ফার্স্ট প্রাইজ পায় না, ফার্স্ট প্রাইজ পেতে হলে সায়েন্সটা বুঝতে হয়। তুই কিছু বুঝিস? আরেকজনকে বোঝাতে পারবি?”
সঞ্জয় চিন্তিত মুখে বলল, “বোঝাতে হবে?”
“হ্যাঁ বোঝাতে হবে।” বোঝাতে না পারলে আবার সায়েন্স ফেয়ার কীসের?”
.
বিকেলবেলা বাসায় এসে রূপা খবর পেল সুলতানা চলে গেছে। তার একই সাথে খুবই মন খারাপ আর অনেক আনন্দ হল। খুবই মন খারাপ হল কারণ বাসায় সুলতানা ছিল তার এক নম্বর বন্ধু, এখন থেকে তার কোনো বন্ধু থাকল না। আনন্দ হল যে সুলতানা এই দোজখ থেকে মুক্তি পেয়েছে–যেখানেই থাকুক যত কষ্টে থাকুক তাকে আর এই দোজখে থাকতে হবে না।
বাসার অন্য সবাইকে দেখে অবশ্যি মনে হল সুলতানা চলে গিয়ে খুব বড় একটা অপরাধ করেছে। এই অপরাধের জন্যে থানায় পুলিশের কাছে জিডি করে রাখা দরকার। আম্মুর মুখ থমথম করছে। সুলতানা চলে যাবার কারণে বাসাটা যে অচল হয়ে গেছে সেটা তিনি টের পেলেন খাবার টেবিলে। সুলতানা আগামী কয়েকদিনের জন্যে রান্না করে গিয়েছে। শুধু ভাতটা রান্না করে নিতে হবে। দেখা গেল আম্মু সেই ভাতটাও ঠিক করে রান্না করতে পারলেন না।
ডিসে করে যে ভাত দেওয়া হল তার মাঝে একই সাথে গলে যাওয়া ভাত এবং অসিদ্ধ কটকটে চাউল পাওয়া গেল। আব্বুর মতো মানুষ যে আম্মুকে রীতিমতো ভয় পান, তিনি পর্যন্ত মুখে ভাত দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “এইটা কী বেঁধেছ? ভাত না চাউল ভাজা?”
আম্মু হিংস্র মুখে বললেন, “পছন্দ না হলে তুমি নিজে বেঁধে নাও।”
আব্বু বললেন, “দরকার হলে রাঁধব। কিন্তু একবেলা সিম্পল ভাত পর্যন্ত রাঁধতে পার না–এটা কী রকম কথা?”
তারপর আম্মু আর আব্বু খুব খারাপভাবে ঝগড়া করলেন। খাওয়া শেষ হবার পর এতদিন সবাই উঠে যেত, সুলতানা টেবিল পরিষ্কার করত, থালা-বাসন ধুত, খাবার তুলে রাখত। আজকে সেগুলো করার কেউ নেই–আম্মু করার চেষ্টা করলেন, রূপা আর তিয়াশা সাহায্য করার চেষ্টা করল, দেখা গেল সবকিছু শেষ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। সুলতানা একা একা এত কাজ কেমন করে করত কে জানে?
খাবার পরে আব্বু-আম্মু টেলিভিশন দেখতে দেখতে চা খেতেন–আজ আর খাওয়া হল না। চায়ের কৌটাই কেউ খুঁজে পেল না। রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ করে সবাই আবিষ্কার করল মশারিগুলো কেমন করে লাগানো হয় সেটা কেউ জানে না। রূপা অনেক কষ্ট করে মশারিটা টানানোর পর আবিষ্কার করল সেটা প্রায় তার নাকের উপর ঝুলে আছে।
ঘুমানোর আগে আম্মু ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খান, তার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তাই ওষুধ খাবার আগে আধা গ্লাস দুধ খান। প্রতিরাতে সুলতানা গাসে করে আধা গ্লাস দুধ টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখত-আজকে আম্মুর নিজের দুধ গরম করে আনতে হল। একটুখানি অসতর্ক হয়েছিলেন বলে দুধ উপচে পড়ে রান্নাঘর মাখামাখি হয়ে গেল, সারা বাসায় একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। দুধের ডেকচি নামাতে গিয়ে আম্মুর হাতে ছ্যাকা লেগে গেল এবং আম্মু সেটা নিয়ে সারাক্ষণ আহা-উঁহু করতে লাগলেন।
ঘুমাতে গিয়ে কেউ তাদের ঘুমানোর কাপড় খুঁজে পেল না। সুলতানা প্রতিদিন সেগুলো ভাঁজ করে বিছানার উপর রাখত আজকে কিছু নেই। অনেক খুঁজে পেতে কিছু একটা বের করে সেটা পরে তাদের ঘুমাতে যেতে হল। আম্মু প্রতি নিশ্বাসে সুলতানাকে গালি দিতে লাগলেন-ব্যাপারটা এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল যে শেষ পর্যন্ত আব্বু বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “অনেক হয়েছে। এখন থামো।”
তখন আবার আল্লু আর আম্মুর মাঝে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রূপা ভেবে পেল না আগামীকাল দিনটা কেমন করে শুরু হবে। সুলতানা একা এই বাসার সবকিছু করেছে এখন কে করবে? কীভাবে করবে? আম্মু যদি কোনোভাবে জানতে পারেন যে রূপাই সুলতানাকে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তা হলে মনে হয় তাকে খুনই করে ফেলবেন। শুয়ে শুয়ে রূপা মুখ টিপে হাসল, মনে মনে বলল, সুলতানা! তুমি যেখানে থাকো ভালো থাকো।
.
সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর রূপা শুনতে পেল আম্মু রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ করছেন। রূপা রান্নাঘরে গিয়ে দেখল আম্মু নাস্তা বানানোর চেষ্টা করছেন, তার চেহারা কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো। মনে হয় একদিনে বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে, চোখের নিচে কালি, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড। এদিক-সেদিক থালা-বাসন পড়ে আছে। রূপা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু তোমার কোনো সাহায্য লাগবে। আমি কিছু করব?”
আম্মু চিৎকার করে বললেন, “সাহায্য করবি? আয়। বটি দিয়ে কোপ মেরে আমার মাথাটা আলাদা করে দে।”
রূপা উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না।
খাবার টেবিলে সবাই নিঃশব্দে নাস্তা খাওয়ার চেষ্টা করল। কয়েকটা পোড়া টোস্ট এবং কয়েকটা পরোটা। পরোটাগুলো আসলেই পরোটা না কী তেলে ভেজা রুটি বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো গোল নয়, দেখে মনে হয় কোনোটা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ, কোনোটা আফগানিস্তানের ম্যাপ! কয়েকটা ডিম ভাজা হয়েছে, তার মাঝে ডিমের খোসা রয়ে গেছে। ডিমের এক অংশে লবণের তেতো অন্য অংশে লবণের চিহ্ন নেই। মুখে দিলে উগলে দিতে ইচ্ছে করে। আব্বু গম্ভীর মুখে পরোটাটা টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “বাসার কাজের জন্যে একজন বুয়া না পেলে মুশকিল।”
আম্মু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “কেন? আমাকে বুয়া হিসেবে পেয়ে তোমাদের মন ভরছে না?”
আল্লু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “না আমি সেটা বলিনি। তুমি কেন বুয়া হতে যাবে?”
“বুয়া তো হয়েই গেছি। বুয়া হইনি? এই বাসায় চব্বিশ ঘণ্টা কে বুয়ার কাজ করে? কে? আর তোমরা লাটসাহেবরা কী করো? নবাবের বাচ্চার মতো কে বসে থাকে?”
আম্মু কিছুক্ষণ চিৎকার করলেন, তারপর আব্বুও চিৎকার শুরু করলেন। তারপর আবার দুইজন ঝগড়া শুরু করে দিলেন।
১৩-১৬. জ্যামিতি ক্লাশ শেষ হয়েছে
জ্যামিতি ক্লাশ শেষ হয়েছে সমাজপাঠ এখনো শুরু হয়নি ঠিক এরকম সময় একজন দপ্তরি একটা নোটিশ নিয়ে এলো। দপ্তরিরা সাধারণত স্যার-ম্যাডাম না আসা পর্যন্ত নোটিশ পান না। কিন্তু আজকে মনে হয়ে জরুরি কিছু ঘটেছে। ক্লাশরুমে ঢুকে বলল, “তোমাদের চাইরজনকে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বোলায়।”
মাসুক জিজ্ঞেস করল, “কোন চারজন?”
দপ্তরি তখন হাতের চিরকুটটা দেখে পড়ল, “রাজু, সঞ্জয়, রূপা আর মিম্মি।”
চারজনেরই বুকটা ধড়াস করে উঠল, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মিম্মি ফিসফিস করে বলল, “স্মোক বম্ব।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “স্মোক বম্ব কী?”
“মনে নাই আমরা জ্বালালাম আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে ধোয়া গেল? আমাদের টিসি দিয়ে বিদায় করে দেবে!”
“কেন টিসি দেবে? আমরা কী করেছি?”
“সারা স্কুল ধোয়া দিয়ে অন্ধকার করে দিসনি?”
“কিন্তু সেটা তো মিটে গেল। মিটে যায়নি?”
“মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “নিশ্চয়ই মিটে যায়নি। দেখছিস না?”
দপ্তরি তখন তাগাদা দিল, “তাড়াতাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি।”
চারজন তখন শুকনো মুখে রওনা দিল। সঞ্জয় দপ্তরিকে জিজ্ঞেস করল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন ডাকছেন আমাদের? আপনি জানেন?”
দপ্তরি মাথা নাড়ল, বলল, “না জানি না। তবে—”
”তবে কী?”
“এই চৌদ্দ বছরে কখনো দেখি নাই কোনো ভালো কিছুর জন্যে ম্যাডাম কাউকে ডেকে এনেছে। তোমাদের কপালে মনে হয় দুঃখ আছে।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাজু শুকনো মুখে বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”
“আসো।”
চারজন ভেতরে ঢুকল। ম্যাডামের অফিসঘরটা অনেক বড়। চারদিকে বড় বড় আলমারি। কিছু আলমারিতে বই, কিছু আলমারিতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাওয়া মেডেল, কাপ, শিল্ড আর ক্রেস্ট। দেয়ালে স্কুলের নানা অনুষ্ঠানের বড় বড় ছবি। ঘরটা সাজানো-গোছানো এবং কেমন যেন ছমছমে ভাব।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাতের একটা কাগজ দেখে বললেন, “তোমরা ক্লাশ এইট বি?”
সবাই একসাথে মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম।”
“রাজু, সঞ্জয়, রূপা আর মিম্মি?”
আবার মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম।”
“তোমরা সবাই সোহেলের বন্ধু?”
এবার তারা লক্ষ করল ম্যাডামের অফিসে এক পাশের চেয়ারে একজন মাঝবয়সী মানুষ বসে আছে। মানুষটির পোশাক আধুনিক, গলায় টাই এবং চোখে চশমা। মিম্মি ফিসফিস করে রূপাকে বলল, “সোহেলের আব্বু।”
রূপা মাথা নাড়ল, মানুষটি নিশ্চয়ই সোহেলের আব্বু, চেহারায় হুবহু মিল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সায়েন্স ফেয়ারের জন্যে তোমরা যে টিম করেছ সেখানে সোহেল একজন মেম্বার?”
রূপা বলল, “জি ম্যাডাম।”
“তোমরা মাঝে মাঝে সোহেলের বাসায় গিয়েছ?”
“জি ম্যাডাম।”
“তার সাথে তোমাদের কথা হয়েছে? কথা হয়?”
“জি ম্যাডাম।”
“শেষবার কবে কথা হয়েছে?”
সঞ্জয় বলল, “এই তো–পাঁচ-ছয়দিন আগে।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তখন চেয়ারে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে–এরাই আপনার বাসায় গিয়েছে। এদের সাথেই যোগাযোগ আছে–কথা বলেন।”
সোহেলের আব্বু বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন, কাকে বললেন পরিষ্কার বোঝা গেল না। ম্যাডামকেও হতে পারে, এই চারজনকেও হতে পারে। রাজু বলল, “জি চাচা-”
“সোহেল-মানে সোহেল। ইয়ে সোহেল হয়েছে কী-” সোহেলের আব্বু কথা শেষ করলেন না।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের?”
“না মানে–ইয়ে নিশ্চয়ই তার আম্মুর কাছেই গিয়েছে কিন্তু মানে আমাকে বলে যায়নি।” কথাটা নিজেকে বললেন না তাদেরকে বললেন, বোঝা গেল না।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “সোহেল তার আম্মুর কাছে চলে গেছে?”
“নিশ্চয়ই গেছে। কিন্তু মানে-” সোহেলের আব্বু তার টাইটা ঠিক করলেন, “তার আম্মু বলছে যায়নি।”
রাজু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কোথায় গেছে?”
“সেটাই জানতে তোমাদের কাছে এসেছিলাম। তোমরা না কী একটা টিম তৈরি করেছ। সায়েন্স ফেয়ারের টিম, সোহেলকে নিয়ে।”
সঞ্জয় বলল, “জি। আমাদের টিমের নাম মিরূসোরাস। মি হচ্ছে মিম্মি, রূ হচ্ছে রূপা, সসা হচ্ছে সোহেল–”
রূপা সঞ্জয়কে থামাল, বলল, “হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।”
সোহেলের আব্বু বললেন, “তোমাদেরকে কী কিছু বলেছে, কোথায় গেছে বা কোথায় যেতে পারে?
রূপা মাথা নাড়ল, “না।”
“ময়নার মা বলেছে কোনো ব্যাগ, জামা-কাপড় নেয় নাই। বিকেলে বের হয়েছে আর ফিরে আসেনি।
ময়নার মা নিশ্চয়ই সোহেলদের বাসার কাজের মহিলাটি। সোহেল বিকেলে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি সেটা নিয়ে সোহেলের বাবার খুব দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হল না। স্কুলে আসার আগে সেজেগুঁজে টাই লাগিয়ে এসেছেন।
রাজু জিজ্ঞেস করল, “সোহেল কবে গিয়েছে?”
“গতকাল।”
ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “পুলিশে জিডি করেছেন?”
“না করিনি। আমি ভেবেছিলাম মায়ের কাছে গেছে।”
“সোহেলের মা, মানে আপনার স্ত্রী আপনার সাথে থাকেন না?”
“উঁহু।” সোহেলের বাবা মাথা নেড়ে হাসির ভঙ্গি করলেন, যেন ব্যাপারটা খুব মজার একটা ব্যাপার।
ম্যাডাম এবারে রূপাদের দিকে তাকালেন, “সোহেল কী ক্লাসে রেগুলার?”
রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় নিজেদের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করল, তাদের মনে হয় এখন সবকিছু খুলে বলা দরকার। রাজু একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “না ম্যাডাম। সোহেল বহুদিন থেকে ক্লাসে আসে না। আমরা মাঝে মাঝে গিয়ে তাকে ক্লাসে আসতে বলেছি, আসতে রাজি হয় না।”
“কেন ক্লাসে আসে না?” সোহেলের আব্বুকে প্রশ্নটা করেছেন বলে রাজু কোনো কথা বলল না। সোহেলের আব্বু অবশ্যি প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন না খুব মনোযোগ দিয়ে টাইটা ঠিক করতে লাগলেন।
এবারে মিম্মি মুখ খুলল, “আংকেল-আন্টি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেই জন্যে খুব মন খারাপ।”
সোহেলের আব্বু ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, “না। ছাড়াছাড়ি হবে কেন? তোমরা এসব কী হাবিজাবি কথা বল?”
মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “সোহেল বলেছে।”
“যত সব বাজে কথা।”
রূপা বলল, “সেটা যাই হোক এমনিতে সোহেলের খুব মন খারাপ ছিল। তা ছাড়া সোহেলের একটা সমস্যা হচ্ছে–”
সোহেলের আব্বু হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “ঠিক আছে তা হলে আমি যাই। একটু খোঁজ নেই। খুব দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল।”
তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অফিস ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ম্যাডাম কিছুক্ষণ টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করলেন তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ব্রোকেন ফ্যামিলি খুব বড় সমস্যা।”
রূপা একটা নিশ্বাস ফেলল, যে ফ্যামিলি ভাঙেনি তার মাঝেও খুব কম সমস্যা নেই–তার নিজেরটাই তো বড় উদাহরণ।
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিস থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে ক্লাশরুমে যাবার সময় রাজু বলল, “সোহেলের আব্বুকে বলতে পারলাম না সোহেল ড্রাগ ধরেছে। বলা উচিত ছিল।
রূপা বলল, “ম্যাডামের সামনে বলা ঠিক হবে কী না বুঝতে পারছিলাম না।”
রাজু বলল, “স্কুল ছুটির পর চল সোহেলের বাসায় গিয়ে ওর আব্বুকে সবকিছু খুলে বলি। ওর আব্বুর জানা দরকার।”
সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, “সোহেল কোথায় গিয়েছে?”
রূপা চিন্তিত মুখে বলল, “কে বলবে?”
মিম্মি বলল, “আমি জানি কোথায় গেছে।”
“কোথায় গেছে?”
“ও কোথায়ও যায়নি। ওকে ধরে নিয়ে গেছে।”
“কে ধরে নিয়ে গেছে?”
“ড্রাগ ডিলাররা।”
রূপা মুখে বলল, “ধুর! ড্রাগ ডিলাররা কেন ওকে ধরে নেবে?” কিন্তু ভয়ে হঠাৎ করে ওর ভেতরটা কেমন যেন নড়েচড়ে গেল।
.
দুপুরবেলা টিফিনের ছুটিতে চারজন মিলে তাদের স্মোক বম্বগুলো তৈরি করল। তারা অনেক তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারত কিন্তু ক্লাসের অনেকেই তাদের সাহায্য করার জন্যে হাজির ছিল বলে সময় বেশি লেগে গেল। স্মোক বম্বগুলো রোদে শুকিয়ে তারা তাদের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। আজকে বাসায় নিয়ে রাখবে সায়েন্স ফেয়ারের দিন নিয়ে আসবে। খাবার সোডা আর ভিনেগার দিয়ে তাদের আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করানোর জন্যে রাজুর ফিল্মের প্লাস্টিকের কৌটা নিয়ে আসার কথা ছিল। দেখা গেল সে ব্যাগ ভর্তি করে প্রায় পঞ্চাশটা কৌটা নিয়ে এসেছে। সঞ্জয় চোখ কপালে তুলে বলল, “এতগুলো? এতগুলো দিয়ে কী হবে?”
রাজু বলল, “স্টুডিওতে গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন ফটোগ্রাফার তার ময়লার ঝুড়ি থেকে সব আমার ব্যাগে ঢেল দিল! আমি বলতেই পারলাম না দুই তিনটা হলেই হবে!”
রূপা বলল, “থাকুক। সমস্যা নাই। সারাদিন ধরে সায়েন্স ফেয়ার হবে–একটু পর পর দেখাতে হবে। যত বেশি তত ভালো।”
রাজু বলল, “এখন আমাদের বাকি আছে শুধু পোস্টারটা লেখা।”
সঞ্জয় বলল, “কী লিখতে হবে বলে দে। আমি লিখে দেই।”
মিম্মি বলল, “তুই লিখবি? তুই তোর হাতের লেখা কোনোদিন দেখিসনি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং!”
সঞ্জয় গরম হয়ে বলল, “আর তোরটা এমন কী রসগোল্লার টুকরা?
মিম্মি আরো গরম হয়ে বলল, “আমি কী বলেছি আমার হাতের লেখা ভালো? আমি শুধু বলেছি তোরটা জঘন্য।”
সঞ্জয় চিৎকার করে বলল, “আমার ইচ্ছে হলে আমি আরো জঘন্য করে লিখব। তোর কী?”
দুইজনের মাঝে ঝগড়া লেগে যেত কিন্তু কপাল ভালো ঠিক তখন ক্লাশের ঘণ্টা পড়ে গেল, সবাইকে ক্লাশে চলে আসতে হল। ওরা সবাই নিজের কাজ করছে, ঝগড়া করছে কিন্তু বুকের ভিতর অশান্তি। সোহেল কোথায়?
.
স্কুল ছুটির পর চারজন ঠিক করল সোহেলের বাসা হয়ে যাবে। সোহেলের বাবাকে বলে যাবে সোহেলের ড্রাগ নিয়ে সমস্যা আছে, ড্রাগ ডিলারদের কাছ থেকে সে ড্রাগ কেনে। চায়ের দোকানের কথাটাও বলে আসবে–তবে তারা যে তাদের একটা চালান তুলে এনেছে সেটা হয়তো বলা যাবে না।
এই ব্যাপারটা হয়তো কখনোই কাউকে বলা যাবে না।
সোহেলের আব্বুকে বাসায় পাবে কী না সেটা নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু তাকে বাসায় পেয়ে গেল। দরজা ধাক্কা দেওয়ার পর ময়নার মা দরজা খুলে
তাদেরকে দেখে পাথরের মতো মুখ করে বলল, “সোহেল বাসায় নাই।”
“জানি।” রূপা বলল, “আমরা সোহেলের আব্বুর কাছে এসেছি। চাচা কী আছেন?”
“আছেন।” বলে সে দরজাটা খুলে দিতেই তারা সোহেলের আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে কেমন জানি জবুথবু দেখাচ্ছে। বসার ঘরে একটা সোফায় পিঠ সোজা করে বসে আছেন হাতে একটা কাগজ সেই কাগজটা দেখছেন কী না বোঝা যাচ্ছে না।
রূপা, রাজু, সঞ্জয় আর মিম্মি ঢোকার পরও তাদেরকে সোহেলের আব্বু দেখলেন বলে মনে হল না। রাজু তখন একটু গলা খাকারি দিয়ে ডাকল, “চাচা।”
সোহেলের আব্বু ঘুরে তাদের দিকে তাকালেন। বিড়বিড় করে বললেন, “আমি এখন সব বুঝতে পারছি।”
রূপা অবাক হয়ে বলল, “আপনি কী বুঝতে পরছেন?”
“চিঠিতে কী লেখা।”
“কীসের চিঠি?”
“এই যে একটা চিঠি এসেছে।” সোহেলের আব্বু হাতের কাগজটা দেখালেন।”কে লিখেছে? কী লিখেছে?”
সোহেলের আব্বু চিঠিটা তাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। রূপা চিঠিটা নিল, কম্পিউটারে কম্পোজ করা একটা চিঠি। উপরে কোনো সম্বোধন নেই-হঠাৎ করে শুরু হয়েছে। চিঠিতে লেখা :
তোর ছেলের এত বড় সাহস তার পার্টনারদের নিয়ে আমাদের মাল ডেলিভারি নেয়? দশ লাখ টাকার মাল? এখন অস্বীকার যায়? কত বড় সাহস! হয় মাল ফেরত দে না হলে দশ লাখ টাকা দে। মোবাইলে বলে দিমু রেডি থাকিস। দুই দিন সময়।
পুলিশের কাছে যাবি না। খবরদার। গেলে খবর আছে। ছেলের কল্লা পলিথিনে করে তোর বাসার দরজায় রেখে যামু। ছেলেরে জ্যান্ত ফেরত চাস তো মাল ফেরত দে না হলে দশ লাখ টাকা দে।
উনিশ-বিশ যেন না হয়। খবরদার। ফিনিস।
-তোর বাবা, আজরাইল
তারা কয়েকবার এই ভয়ংকর চিঠিটা পড়ল। প্রত্যেকবারই একটা করে নতুন জিনিস চোখে পড়ল। চিঠির শেষে লেখা ফিনিস-কী ফিনিস হবে বলা নাই কিন্তু শব্দটা পড়লেই কেমন জানি হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
রূপা চিঠিটা সোহেলের আব্বুর কাছে ফেরত দিল। সোহেলের আব্লু চিঠিটা হাতে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। ভাঙা গলায় বললেন, “আমি টের পাচ্ছিলাম ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে। তাদেরকে নিয়ে সে ড্রাগ ডিলারদের সাথে ড্রাগ ডেলিভারির কাজে জড়িয়েছে টের পাইনি। সর্বনাশ।”
রাজু বলল, “না চাচা ব্যাপারটা সেইটা না।”
“সেইটাই ব্যাপার। চিঠিতে পরিষ্কার লেখা আছে। ড্রাগ ডেলিভারি নিয়ে পেমেন্ট করেনি। এত ছোট ছেলে এই রকম কাজে কেমন করে জড়াল!”
“চাচা, আসলে ব্যাপারটা অন্যরকম।”
সোহেলের আব্বু রাজুর কথাটায় গুরুত্ব দিলেন না। মাথাটা ধরে বললেন, “দুইদিন সময় দিয়েছে। দুইদিন। এই সময়ে এত টাকা কোথায় পাব?” তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “অন্তত ছেলেটা তো জানে বেঁচে আছে।” মাথাটা তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আছে না?”
ওরা মাথা নাড়ল। বলল, “জি বেঁচে আছে।”
“তোমরা কাউকে কিছু বলবে না। আমি চিন্তা করে দেখি কী করা যায়।”
রাজু আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রূপা তাকে থামাল, গলা নামিয়ে বলল, “এখন আমরা যাই।”
মিম্মি বলল, “হ্যাঁ। যাই।”
বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় চারজন দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে। মিম্মি বলল, “আমার কথা এখন বিশ্বাস হল? বলেছিলাম না সোহেলকে ড্রাগ ডিলাররা ধরে নিয়ে গেছে?”
সঞ্জয় বলল, “এখন কী হবে?”
রূপা বলল, “কিছু একটা করতে হবে।”
“কী করতে হবে?”
কী করা যায় রূপা সেটা নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন রাস্তার পাশে একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়াল। মাইক্রোবাসের দরজা খুলে চারজন মানুষ নেমে আসে। মানুষগুলো তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। রূপা চোখের কোনা দিয়ে দেখল হঠাৎ করে চারজনই ঘুরে তাদের চারজনকে খপ করে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাইক্রোবাসে ঢুকিয়ে নেয়।
কিছু বোঝার আগে রাস্তায় কর্কশ শব্দ করে মাইক্রোবাসটা ছুটে যেতে থাকে।
রূপা একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেল-তার মাথায় একটা মানুষ একটা রিভলবার ধরে রেখেছে। রূপা ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল, তার চোখ দুটি কী ভয়ংকর-সেগুলো যেন ধক ধক করে জ্বলছে। মানুষটির চেহারা আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর, মনে হয় যেন মানুষ নয়, যেন একটা দানব। একটা প্রেতাত্মা।
রূপা শুনল কে একজন বলল, “জে বস। এই দুইটা ছেমড়িই। এরাই মাল ডেলিভারি নিছে।”
“ঠিক তো?”
“জে বস। ঠিক আমার স্পষ্ট মনে আছে।”
রূপা চোখের কোনা দিয়ে দেখল, চায়ের দোকানের সেই দোকানদারই কথা বলছে। যাকে সে বস ডাকছে সেই মানুষটিই তার মাথায় রিভলবার ধরে রেখেছে। হাতটা ট্রিগারে, মনে হয় অবলীলায় ট্রিগারটা টেনে দিতে পারে।
রূপা কুলকুল করে ঘামতে লাগল।
.
১৪.
ঘরটা ছোট। ঘরের মাঝামাঝি একটা টেবিল। টেবিল ঘিরে কয়েকটা কাঠের চেয়ার। একটা চেয়ারে বস পা তুলে বসেছে। বসের বয়স ত্রিশ-চল্লিশের মতো। গায়ের রং ফরসা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লালচে চুল। মানুষটির চেহারায় একটা বিচিত্র নিষ্ঠুরতা রয়েছে, ঠিক কোন কারণে তাকে এত নিষ্ঠুর দেখায় কেউ সেটা বুঝতে পারে না।
বসের পাশে আরো দুইজন মানুষ বসে আছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন-রাজু এই দুইজনকে চিনতে পারল। একজনের নাম আক্কাস অন্যজন বকর, চায়ের দোকানে রাজু তাদের দুইজনকেই দেখেছিল। চায়ের দোকানের দোকানি মেঝেতে পা ভাঁজ করে বসে আছে। ঘরের ভেতর বেশ কয়েকজন সিগারেট খাচ্ছে, তবে সিগারেটের সাথে নিশ্চয়ই কোনো নেশার জিনিস আছে কারণ ঘরের ভেতর এক ধরনের বোটকা গন্ধ।
এই ঘরের মাঝে রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয়কে আনা হয়েছে। তারা ঘরের একপাশে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে কেউ কোনো কথা বলছে না, মনে হচ্ছে তারা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বুঝি সবাই ভুলেই গেছে।
দিনেরবেলা ঘরের মাঝে অনেক আলো তারপরও বস তার টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বালাল। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চামচ বের করে আনে। পকেট থেকে কয়েকটা রঙিন ট্যাবলেট বের করে চামচের উপর রাখে তারপর চামচটা মোমবাতির শিখার উপরে রেখে ট্যাবলেটগুলো গরম করতে থাকে। দেখতে দেখতে ট্যাবলেটগুলো গলে সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। বস তখন চামচটার খুব কাছে নাক লাগিয়ে সেই ধোঁয়াটা নাকের মাঝে টেনে নিতে শুরু করে। সাথে সাথে তার চেহারা পরিবর্তন হতে শুরু করে, মুখটা টকটকে লাল হয়ে ওঠে, তার মুখের মাংসপেশী অনিয়ন্ত্রিতভাবে নড়তে থাকে। মুখ থেকে লালা বের হয়ে আসে, সে হাতের উল্টাপিঠ দিয়ে লালাটা মুছে নেওয়ার চেষ্টা করে। রূপা দেখল মানুষটার চোখ উল্টে যাচ্ছে, দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছে আর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।
বস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নিজের হাত কামড়ে ধরে গোঙানোর মতো শব্দ করে চাপা গলায় বলে, “একটা বোতল।”
কেউ একজন কালচে লাল রঙের পানীয় ভরা একটা বোতল তার হাতে ধরিয়ে দেয়। সে মুখে লাগিয়ে ঢক ঢক করে খানিকটা খেয়ে মুখ তুলে তাকাল, বিড়বিড় করে বলল, “তোদের কে পাঠিয়েছে?”
রূপা, রাজু কিংবা মিম্মি সঞ্জয়ের কেউই বুঝতে পারল না যে তাদেরকে প্রশ্নটা করা হয়েছে। তাই তারা কিছু বলল না। বস তখন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে দুই হাতে টেবিলে জোরে থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, “কে পাঠিয়েছে তোদের?”
রাজু ভয়ে ভয়ে বলল, “আ-আমাদের?”
“হ্যাঁ। কে পাঠিয়েছে?”
“আমাদেরকে কেউ পাঠায়নি।”
“তুই বলবি আর আমরা সেটা বিশ্বাস করব? গোপন পাসওয়ার্ড বলে আমাদের মাল নিয়ে গেলি আর সেইটা এমনি এমনি হয়েছে? কার জন্যে কাজ করিস তোরা?”
“আমরা কারো জন্যে কাজ করি না।”
বস ভয়ংকর খেপে গেল, হাতের বোতলটা হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। অল্পের জন্যে সেটা মিম্মির মাথায় না লেগে পিছনের দেয়ালে লেগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, ভেতরের তরলটা ছিটকে সারা ঘরের মাঝে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বস হিংস্র মুখে বলল, “খুন করে ফেলব আমি। এখনো বল তোরা কার জন্যে কাজ করিস? আমাদের মাল ডেলিভারি নেবার জন্যে তাদেরকে কে পাঠিয়েছে?”
মিম্মি হঠাৎ ভয়ে আতঙ্কে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার কথায় কিছুই বোঝা গেল না। বস তখন প্রচণ্ড জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, “চোপ! চোপ ছেমড়ি। কাঁদবি না।”
মিম্মি তখন আরো জোরে কেঁদে উঠল।
বসের পাশে বসে থাকা কালো মতোন মানুষটা বলল, “বস, আমার মনে হয় ইদরিসের দল। আমি শুনছি ইদরিস স্কুলের বাচ্চাদের ব্যবহার করে। প্রথমে ফ্রি বুলবুলির ব্যবস্থা করে দেয়। যখন এডিক্ট হয়ে যায় তখন এদেরকে বন্দি গোলামের মতো ব্যবহার করে।”
বস তখন ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা কী ইদরিসের দলের সাথে কাজ করিস?”
সবাই মাথা নাড়ল। বলল, “না।”
কালো মতোন মানুষটা বলল, “কাজ করলেও স্বীকার করবে না বস। ইদরিস খুবই চালু, তার দলে কে কোন দায়িত্বে থাকে কেউ জানে না।”
আক্কাস বলল, “মাইর দিলে সবকিছু বলে দেবে। আমার হাতে দেন আমি ঠিকমতো বানাই। দেখবেন সবকিছু বলে দেবে।”
বকর মাথা নাড়ল, “এইটা সত্যি কথা। মাইরের ওপরে ওষুধ নাই।”
বস বলল, “কেমন করে কথা বের করতে হয় সেইটা তোমাদের আমারে শিখাতে হবে না। আমার নাক টিপলে দুধ বের হয় না। দল কেমন করে চালাতে হয় আমি জানি।”
আক্কাস শুকনা মুখে বলল, “জে বস। অবশ্যি জানেন।”
“তোমরা জান না কেমন করে কাজ করতে হয়। গোপন পাসওয়ার্ড বলে আণ্ডা-বাচ্চারা মাল ডেলিভারি নেয়। তার অর্থ কী?”
আক্কাস ও বকর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সাহস করে চায়ের দোকানের দোকানিকে দেখিয়ে বলে, “বস, আমাদের দোষ নাই। এই মদন-”
বস ধমক দিয়ে বলল, “গোপন পাসওয়ার্ড অন্যেরা কেমন করে জানল। তোমরা মানুষরে বলছ?”
দোকানি দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করে বলল, “আল্লাহর কসম বস। কাউরে বলিনি। কেউ ছিল না আশেপাশে—”
“খবরদার আমার সামনে কিরা-কসম কাটবি না।” আমি কিরা-কসম শুনতে চাই না, আমি কোনো ওজুহাত শুনতে চাই না। আমি কাজ চাই।”
কালো মতোন মানুষটা বলল, “বস। এই চাইরটা পোলা-মাইয়া তো ভদ্রলোকের ঘর থেকে আসছে। এদের ফ্যামিলিরে চাপ দিলেও তো পাঁচ-দশ লাখ টাকা আসবে। আসবে না?”
“আসবে। কিন্তু আমাদের ব্যবসা কি কিডন্যাপিং? এই রকম উল্টা-পাল্টা ঝামেলা হাতে নিলে পরে সামলাবে কে? আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের ড্রাগ খাওয়া শিখানো। যত ছোটদের শিখাতে পার তত ভালো। একবার এডিক্ট হয়ে গেলে পারমানেন্ট কাস্টমার। সারাজীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত। আর আমাদের ব্যবসাও নিশ্চিন্ত।”
আক্কাস জিজ্ঞেস করল, “এখন এগুলোরে কী করব বস?”
“ঘরটাতে বন্ধ করে রাখ।”
আক্কাস তখন ওদের চারজনকে ঠেলে নিতে থাকে। বস থামাল, বলল, “ব্যাগের ভেতরে কী? দেখ।”
আক্কাস ওদের ব্যাগ খুলে এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো স্মোক বম্বগুলো দেখতে পেল। একটা হাতে নিয়ে গন্ধ শুকে মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী? পিজ্জা না কি?”
“না। আমাদের সায়েন্স প্রজেক্ট।”
সঞ্জয় বলতে গেল, “এগুলো–” রূপা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “গাছের সার। ফুলগাছে দিলে এত বড় বড় ফুল হয়।”
“সাথে নিয়ে ঘুরছিস কেন?”
“স্কুলে ফুলবাগানের কম্পিটিশান হচ্ছে তো সেই জন্যে।”
সঞ্জয় বলল, “এক ক্লাসের সাথে আরেক ক্লাসের।”
রূপা বলল, “যাদের বাগান সবচেয়ে সুন্দর হবে তারা ফার্স্ট প্রাইজ পাবে।”
সবগুলো ব্যাগে একই জিনিস। শুধু রাজুর ব্যাগে অনেকগুলো ফিল্মের কৌটা। খাবার সোডা আর ভিনেগার। আক্কাস জিজ্ঞেস করল, “ফিল্মের কৌটা দিয়ে কী করবি?”
“কেক বানাব।”
“কেক!”
“হ্যাঁ। ময়দা, খাবার সোডা, চিনি আর ভিনেগার মিশিয়ে এই কৌটার মাপ মতোন ছোট ছোট কেক-”
বকর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। হো হো করে হেসে বলল, “এরা দেখি চূড়ান্ত বেকুব। এরা মালের ডেলিভারি নিছে বিশ্বাস হয় না।”
বস বলল, “চূড়ান্ত বেকুব দেখেই মালের ডেলিভারি নিয়েছে। মাথায় কোনো ঘিলু থাকলে কেউ এই লাইনে আসে না।”
“সেইটা সত্যি কথা।”
আক্কাস তখন চারজনকে ঠেলে পাশে একটা ঘরের সামনে নিয়ে গেল। ঘরের দরজার ছিটকানি খুলে তাদেরকে ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আবার ছিটকানি লাগিয়ে দিল।
চারজন ভেতরে ঢুকে দেখে ঘরের এক কোনায় গুটিসুটি মেরে সোহেল বসে আছে। সোহেল মাথা তুলে তাকিয়ে তাদের চারজনকে দেখে খুব অবাক হল বলে মনে হল না। বিড়বিড় করে বলল, “তোদের কাছে বুলবুলি আছে?”
“বুলবুলি?” সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, “মানে ড্রাগ?”
“হ্যাঁ। দিবি আমাকে একটা। প্লীজ–”
“কোথা থেকে দিব?”
“তোরা না কী ওদের সব ড্রাগস নিয়ে গেছিস? সেখান থেকে আমাকে একটা দিবি? প্লীজ! মাত্র একটা। আর কোনোদিন চাইব না। প্লীজ! প্লীজ!”
রূপা অবাক হয়ে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল, এক মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেল শুধু সোহেল না, তারা সবাই একটা ভয়ংকর বিপদের মাঝে আছে।
রূপা হেঁটে সোহেলের কাছে যায়, চোখ গর্তের মাঝে ঢুকে গেছে, মাথার চুল এলোমেলো। শরীরের চামড়া খসখসে, হাত দিয়ে চুলকিয়ে জায়গায় জায়গায় রক্ত বের করে ফেলেছে। সোহেল বিড়বিড় করে বলল, “শরীরটা জানি কী রকম করছে। মনে হচ্ছে চামড়ার নিচে দিয়ে কিছু একটা কিলবিল কিলবিল করছে।”
“ড্রাগস। এগুলো হচ্ছে ড্রাগস খাওয়ার ফল।”
“দিবি না আমাকে একটা?”
“নাই আমাদের কাছে।”
সোহেল তখন হঠাৎ করে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। সে হাঁটু মুড়ে হাঁটুতে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইল। দেখে মনে হল সে বুঝি জীবন্ত মানুষ না। সে বুঝি একটা মৃত দেহ।
রূপা অন্যদের কাছে গিয়ে বলল, “সোহেলের কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?” মিম্মি বলল, “আমাদেরও এই অবস্থা হবে।”
রূপা একবার মিম্মির দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না।
মিম্মি বলল, “তোদের সাথে থাকাই আমার ভুল হয়েছে।”
সঞ্জয় রেগে বলল, “আমাদের সাথে থাকা ভুল হয়েছে? চায়ের দোকানে গিয়ে গিলা-কলিজার বাটি কে বলেছিল? তুই যদি ওই গাধামো না করতি তা হলে আমরা আজকে এখানে থাকতাম না। বুঝেছিস?”
“তোদের সাথে যদি না মিশতাম তা হলে–”
রূপা মিম্মিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অনেক হয়েছে। এখন চুপ করবি? একটা বিপদের মাঝে আছি এখন সবাই একসাথে থাকবি তা না ঝগড়াঝাটি শুরু করলি।”
রাজু বলল, “খুব বিপদে পড়ে গেলাম। এই মানুষগুলো খুব খারাপ। আমাদের মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে আমাদের মারবে বলছে—”
মিম্মি বলল, “কী কথা বের করবে? আমরা তো সত্যি কথা বলেই দিতে পারি।”
“আমাদের কোনো কথা বিশ্বাস করবে না।”
রূপা বলল, “ওদের সব ড্রাগস আমরা কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দিয়েছি।”
“যদি শুধু খবর পায় আমাদের খুন করে ফেলবে।” সঞ্জয় বলল, “দশ লাখ টাকার ড্রাগ কমোডে ফেলে দিয়েছি! চিন্তা করে
মিম্মি বলল, “কিন্তু এখন আমাদের কী হবে?”
রূপা বলল, “এখান থেকে পালাতে হবে।”
“কীভাবে পালাবি? পালানো কী এতো সোজা?”
রূপা দরজার কাছে গিয়ে সেটা একটু পরীক্ষা করে বলল, “দরজাটা পুরানো, খুব শক্ত না। আমরা পাঁচজন মিলে যদি ধাক্কা দেই দরজার ছিটকিনি ভেঙে যেতে পারে।”
মিম্মি মুখ ভেংচে বলল, “দরজা ভাঙতে দেওয়ার জন্যে ঐ লোকগুলো তো বসে আছে। তারা তোমাকে ভাঙতে দেবে?”
“আমি কী ওদের পারমিশান নিয়ে দরজা ভাঙব?”
“দরজায় যখন ধাক্কা দেবে তখনই তো শব্দ হবে। শব্দ শুনে সবগুলো ছুটে আসবে না?”
রূপা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “স্মোক বম্ব।”
সবাই রূপার দিকে তাকাল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “স্মোক বম্ব কী?”
“আমরা আমাদের স্মোক বম্ব জ্বালিয়ে দেই–সারা বাড়ি ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যাবে তখন এখানে একটা হই চই, গোলমাল শুরু হবে–সেই গোলমালের মাঝে আমরা দরজা ভেঙে বের হয়ে পালিয়ে যাব।”
মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “পারব আমরা?”
সত্যি সত্যি পারবে কী না সেটা নিয়ে রূপার মাঝে সন্দেহ ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। বলল, “কেন পারব না? একশবার পারব।”
রাজু বলল, “আমাদের কাছে ফিল্মের কৌটাগুলো আছে। তার মাঝে খাবার সোডা আর ভিনেগার ভরে সেগুলোও ছুঁড়ে দিতে পারি। ঠাস ঠাস শব্দ করে সেগুলো ফুটতে থাকবে।”
রূপা হাতে কিল দিয়ে বলল, “গুড আইডিয়া।”
ওরা তখনই কাজ শুরু করে দিল। প্রথমে ফিল্মের কৌটাগুলো খুলে সারি সারি সাজিয়ে রাখল তারপর সবগুলোর ভেতর একটু করে খাবার সোডা ঢালল। যখন সেগুলো ছোঁড়ার সময় হবে তখন ভেতরে একটু ভিনেগার ঢেলে মুখ বন্ধ করে ছুঁড়ে দেবে।
এরপর ওরা সবগুলো স্মোক বম্ব বের করে নেয়। সঞ্জয়ের পকেটে ম্যাচ ছিল, সেটা দিয়ে প্রথমে কাগজে আগুন ধরিয়ে নিল। রূপা আর মিম্মি স্মোক বম্বে আগুন লাগিয়ে দেবে, সঞ্জয় সেগুলো ছুঁড়ে দেবে। রাজু ফিল্মের কৌটায় ভিনেগার ঢেলে মুখটা বন্ধ করে ছুঁড়ে দিতে থাকবে।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “সবাই রেডি?”
“হ্যাঁ।”
সোহেল নির্জীব গলায় জিজ্ঞেস করল, “কীসের জন্যে রেডি?”
“আমরা দরজা ভেঙে পালিয়ে যাব।”
“ও!” সোহেল কোনো উৎসাহ দেখাল না, বলল, “মাথার মাঝে কী যেন হয়েছে, মনে হচ্ছে সবকিছু আউলে গেছে।”
ওরা তখন সোহেলকে নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। রূপা আর মিম্মি কাগজ জ্বালিয়ে স্মোক বম্বে আগুন দিতে শুরু করল। আগুন জ্বলতেই গলগল করে ধোঁয়া বের হতে থাকে, সাথে সাথে সঞ্জয় জানালা দিয়ে সেগুলো বাসাটার ভেতরে ছুঁড়ে দিতে থাকে।
কিছুক্ষণের মাঝেই তারা ভেতরে মানুষের হইচই, চিৎকার শুনতে পেল।”আগুন আগুন” বলে লোকজন চিৎকার করতে থাকে, এদিক-সেদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। রূপা আর মিম্মি থামল না, একটার পর একটা স্মোক বম্ব জ্বালিয়ে কখনো সঞ্জয়ের হাতে দিতে লাগল কখনো নিজেরাই ছুঁড়ে দিতে লাগল। দেখতে দেখতে পুরো বাসা ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ততক্ষণে রাজু তার ফিলের কৌটায় ভিনেগার ঢেলে কৌটার মুখ বন্ধ করে ছুঁড়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সেগুলো শব্দ করে ফাটতে শুরু করে। ভেতরের লোকজনের মাঝে সেটা আবার নতুন একটা আতঙ্কের জন্ম দিল। কেউ একজন বলে উঠল, “পুলিশ! গুলি করছে।”
ব্যস! আর যায় কোথায়-সাথে সাথে সবাই দুদ্দার করে ছুটে পালাতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝে পুরো বাসাটা নীরব হয়ে গেল, শুধু বাইরে কিছু মানুষের দৌড়াদৌড়ি এবং চিৎকার শোনা যায়।
রাজু বলল, “সবাই মনে হয় বাসা ছেড়ে চলে গেছে।”
“হ্যাঁ।” রূপা বলল, “এখন দরজা ভাঙার সময়।”
সঞ্জয় দরজায় কয়েকটা লাথি দিল কোনো লাভ হল না। রূপা বলল, “লাথি দিয়ে ভাঙতে পারবি না।”
“কেমন করে ভাঙবে?”
“দূর থেকে দৌড়ে এসে ধাক্কা দিতে হবে। গতিশক্তি হচ্ছে হাফ এম ভি স্কয়্যার। গতিবেগের বর্গ। তাই যত জোরে দৌড়াব তত বেশি গতিশক্তি। দুই গুণ বেশি জোরে দৌড়ালে চার গুণ বেশি শক্তি।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“কাজেই আমরা দূর থেকে যত জোরে সম্ভব দৌড়ে আসব একসাথে, কাঁধ দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিব।”
মিম্মি বলল, “দেখেছি আমি।”
“কী দেখেছিস?”
“সিনেমায়। সবসময় দৌড়ে এসে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দেয়।”
রূপা বলল, “হ্যাঁ। সিনেমার মতোন।”
তখন চারজন ঘরের অন্য মাথায় গিয়ে দাঁড়াল। রূপা বলল, “ওয়ান টু থ্রী-” সাথে সাথে চারজন ছুটে এসে কাঁধ দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। প্রথমবারেই দরজাটা মটমট করে উঠল, ছিটকিনিটাও একবারেই নড়বড়ে হয়ে গেল। তারা যখন দ্বিতীয়বার ছুটে এসে ধাক্কা দিল পুরো দরজাটা ধড়াস করে খুলে যায় আর তারা হুড়মুড় করে একজনের উপর আরেকজন এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
রাজু জিজ্ঞেস করল, “সবাই ঠিক আছিস?”
রূপা ব্যথায় কে কে করে বলল, “ঠিক নাই। কিন্তু সেটা নিয়ে পরে চিন্তা করব। আগে সবাই বের হ।”
“বের হবার দরজা কোথায়?”
সঞ্জয় বলল, “সামনে।”
রূপা বলল, “সামনে হয়তো ঐ লোকগুলো আছে। দেখ পিছনে কোনো দরজা আছে কি না।”
রাজু পিছনে গিয়ে একটু পরে চাপা স্বরে বলল, “হ্যাঁ পাওয়া গেছে। পিছনে একটা দরজা আছে।”
“গুড। চল পালাই।”
ওরা নিজেদের ব্যাগ নিয়ে ছুটে যেতে থাকে। সোহেল তখনো হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। রূপা চাপা স্বরে বলল, “সোহেল, আয় তাড়াতাড়ি।”
“কোথায়?”
“পালাব।”
“কেন?”
রূপা অধৈর্য হয়ে বলল, “আরে! পালাবি কেন এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? উঠে আয়।”
“উঁহু। আক্কাস ভাই রাগ করবে। আমাকে বলেছে গোলমাল না করতে।”
রূপা তখন ছুটে গিয়ে সোহেলকে টেনে তুলল। সঞ্জয়কে বলল, “তুই আরেকদিকে ধর। মনে হচ্ছে টেনে নিয়ে যেতে হবে।”
সোহেল অবাক হয়ে বলল, “কী করছিস? কী করছিস তোরা। আমি যাব। আমাকে নিস না।”
সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল, “এখানে থাকবি? তোর মাথা খারাপ হয়েছে? আয় আমাদের সাথে।”
“না।” সোহেল ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গায়ে জোর নেই, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না।
“আয় আমাদের সাথে।” রূপা ফিসফিস করে বলল, “তা হলে তোকে একটা বুলবুলি দেব।”
এই কথাটায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সোহেলের চোখ চকচক করে ওঠে, জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। সত্যি। আয় আমাদের সাথে।”
সোহেলকে টেনে বের করে এনে তারা ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর তারা ছুটে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়। একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে সেটা দিয়ে দুদ্দাড় করে হেঁটে তারা রাস্তায় চলে এলো। ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।
মিম্মি ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে গেছি আমরা।”
“হ্যাঁ। প্রাণে বেঁচে গেছি। পালা।” রূপা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
“ধোঁয়া যখন কমে যাবে তখন ঐ লোকগুলো আবার বাসাটাতে ঢুকবে। ঢুকে যখন দেখবে ভেতরে আমরা নেই তখন বের হয়ে আমাদের খুঁজবে। না হয় নিজেরাও পালাবে। তাদেরকে আর ধরা যাবে না।”
“তা হলে তুই কী করবি?”
“লোকগুলো যখন ভেতরে ঢুকবে তখন বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে লোকজনকে ডেকে আনব, পুলিশকে ফোন করব।”
“বাইরে থেকে যদি ছিটকিনি দেওয়া না যায়?”
“তা হলে অন্য ব্যবস্থা–আগে গিয়ে দেখি।”
মিম্মি মাথা নেড়ে বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? কোনোমতে পালিয়ে এসেছি এখন ভেতরে গিয়ে আবার ধরা খাব? মরে গেলেও না।”
রূপা বলল, “ঠিক আছে, তোরা তা হলে এইখানে অপেক্ষা কর। আমি বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে আসি।”
রাজু বলল, “তুমি একা যাবে কেন? আমিও আসি।”
“যাবে আমার সাথে? ঠিক আছে আসো।”
রাজু বলল, “অন্ধকার আছে, আমাদের কেউ দেখবে না।”
মিম্মি বলল, “তোরা একা একা যাবি না। চেষ্টা কর অন্য মানুষজনকে সাথে নিয়ে যেতে।”
রূপা বলল, “দেখি।”
.
রাজু আর রূপা খুব সাবধানে বাসাটার সামনে গেল। সেখানে মানুষের ভিড়, সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। রাজু আর রূপা একটু দূর থেকে দেখল ধোয়াটা কমে যাবার পর ড্রাগ ডিলারের দলটা ভেতরে ঢুকে গেল, ওরা গুনে গুনে যখন দেখল ছয়জনই ঢুকেছে তখন তারা সাবধানে এগিয়ে গেল। তখনো বাসার সামনে মানুষের জটলা-রূপা মানুষগুলোকে বলল, “প্লীজ আপনারা চলে যাবেন না!”
বয়স্ক একজন বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
“বলছি। একটু দাঁড়ান। আগে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে আসি।”
“ভেতরে মানুষ, বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগালে মানুষগুলো বের হতে পারবে না।”
“সেই জন্যেই লাগাচ্ছি যেন মানুষগুলো বের হতে না পারে।”
“কী আশ্চর্য! কেন?”
“বলছি, একটু দাঁড়ান। বলে রূপা আর রাজু বাসাটার দিকে ছুটে গেল। কপাল ভালো সত্যি সত্যি বাইরে একটা ছিটকিনি আছে। তারা সাবধানে ছিটকিনি লাগিয়ে ফিরে এলো।
বয়স্ক মানুষটি বলল, “কিন্তু ভেতরে আগুন–”
রূপা মাথা নাড়ল, “না, আগুন না। শুধু ধোয়া।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“কারণ আমরা পালানোর জন্যে তৈরি করেছিলাম। আমাদের কিডন্যাপ করে ভেতরে আটকে রেখেছিল।
এবারে আরো কিছু মানুষ এগিয়ে এলো, বলল, “কী বলছ?”
“সত্যি বলছি। প্লীজ আপনারা কেউ একজন পুলিশকে ফোন করে দেন। প্লীজ। তাড়াতাড়ি।”
কয়েকজন মোবাইল ফোন বের করল, কিন্তু দেখা গেল কারো কাছে পুলিশের নাম্বার নেই। রাজু তখন তাড়াতাড়ি তার পকেট থেকে সোহেলের আব্বুর নাম্বার বের করে বলল, “এখানে ফোন করে বলে দেন। তা হলেই হবে–”
একজন নাম্বার ডায়াল করে কথা বলে ফোনটা রূপার হাতে দিয়ে বলল, “নেও। তোমার সাথে কথা বলবেন।”
রূপা ফোনটা হাতে নিল ভেবেছিল অন্য পাশে সোহেলের আব্বুর গলার স্বর শুনবে কিন্তু একজন মহিলার গলার স্বর শুনল।”হ্যালো। আমি সোহেলের আম্মু-কী হয়েছে? সোহেল কোথায়?”
“চাচি, সোহেল আর আমরা পালিয়ে বের হয়ে এসেছি। কিডন্যাপারগুলো বাসার ভেতরে আছে। ওদেরকে ধরার জন্যে পুলিশকে খবর দিতে হবে। এক্ষুনি। ওরা খুব ডেঞ্জারাস মানুষ।”
“আমরা থানাতেই আছি, পুলিশকে দেই, কোথায় আসতে হবে বল।”
রূপা ঠিকানা জানে না বলে আবার ফোনের মালিককে কথা বলতে দিল। মানুষটি এলাকার ঠিকানা বলে দিল। রূপা শুনল ঠিকানা বুঝিয়ে দেবার পর মানুষটি বলছে, “আপনারা চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। ছেলেমেয়ের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। ড্রাগ ডিলাররাও পালাতে পারবে না।”
ড্রাগ ডিলাররা কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল কিন্তু ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বাসাটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। মানুষজনের ভিড় দেখে মিম্মি আর সঞ্জয়ও ওদের কাছে চলে এলো। সোহেলকে দেখে মনে হল এখনো সে একটা ঘোরের মাঝে আছে, চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। রূপাকে দেখে ফিসফিস করে বলল, “রূপা! তুই বলেছিলি আমাকে একটা বুলবুলি দিবি। দে না! না হলে মরে যাব।”
রূপা বলল, “মরবি না। একটু অপেক্ষা কর।”
কিছুক্ষণের মাঝে পুলিশের গাড়ি চলে এলো, পুলিশেরা হাতে রাইফেল নিয়ে বাসাটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। পুলিশ নামার পর গাড়ি থেকে সোহেলের বাবা আর তার মা নেমে এলেন। সোহেলকে দেখে সোহেলের মা ছুটে এলেন, সোহেল তখন কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল সে বিশ্বাস করতে পারছে না, ফিসফিস করে ভাঙা গলায় বলল, “মা। তুমি?”
“হ্যাঁ বাবা। তোর এ কী অবস্থা হয়েছে?”
“মা, আমি মরে যাচ্ছি মা। আমাকে একটু ধরবে?”
সোহেলের মা ছুটে এসে সোহেলকে ধরলেন আর ঠিক তখন সোহেল এলিয়ে পড়ে গেল। সোহেলের মা চিৎকার করতে লাগলেন, “সোহেল! সোহেল বাবা–”
রূপা সোহেলের মায়ের হাত ধরে বলল, “চাচি, এক্ষুনি হাসপাতালে নেন, ওর ড্রাগ উইথড্রয়াল সিনড্রোম হচ্ছে।”
সোহেলের মা কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
১৫.
রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় স্কুল মাঠের মাঝখানে বসে আছে। এখানে ওদের স্মোক বম্বটা জ্বালানোর কথা ছিল, গলগল করে নানা রঙের ধোঁয়া বের হয়ে আসত আর সেটা ঘিরে ছোট ছোট বাচ্চাদের লাফ-ঝাঁপ দেওয়ার কথা ছিল। সঞ্জয়ের ধারণা তাদের স্মোক বম্বটা নির্ঘাত ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যেত যদিও রূপা জানে তার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল না। তবে দেখানোর জন্যে সেটা চমৎকার একটা প্রজেক্ট ছিল। কিন্তু এখন তাদের দেখানোর কিছু নেই, যতগুলো স্মোক বম্ব বানিয়েছিল সবগুলো ড্রাগ ডিলারের বাসায় জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছে। নতুন করে বানানোর সময় নেই, কেমিক্যাল কেনার টাকাও নেই! ফিল্মের কৌটায় খাবার সোডা আর ভিনেগার দিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বানানোর প্রজেক্টটাও শেষ করতে পারেনি। ড্রাগ ডিলারদের ধরার পর তাদের অনেকবার থানা-পুলিশ করতে হয়েছে। ভাগ্যিস পুলিশের বড় অফিসাররা একটু পরে পরে তাদের সাহস আর বুদ্ধির প্রশংসা করেছে, বিশাল এক ড্রাগ ডিলারদের দল ধরে ফেলে এলাকার অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ফেলেছে বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে তা না হলে বাসায় বাবা-মায়েরা তাদের বারোটা বাজিয়ে ফেলতেন। ভেতরে ঠিক কী হয়েছে কেউ জানে না। সবাই ধরে নিয়েছে সোহেলকে ড্রাগ ডিলাররা ধরেছিল, সোহেলের টিম বলে তাদেরকেও ধরেছে। তারা বুদ্ধি খাঁটিয়ে পালিয়ে এসেছে আর ড্রাগ ডিলারদের ধরেও ফেলেছে। পুলিশ বলেছে এটা নিয়ে বেশি কথা না বলতে–যত কম মানুষ জানে তত ভালো, ড্রাগ ডিলাররা না কী খুব সাংঘাতিক, দল অনেক বড়। সোহেল সম্পর্কে সবাই এখন ভাসা ভাসা জানে। তার মা ঢাকায় নিয়ে কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করেছেন, সেরে উঠতে সময় নেবে। এই বছর স্কুলে যেতে পারবে না। প্রাণে বেঁচে গেছে এটাই বেশি।
রূপার অবশ্যি আলাদাভাবে মন খারাপ। তার আম্মু আজকে স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে আসবেন–সবার প্রজেক্টগুলো দেখবেন, শুধু ক্লাশ এইট বিয়ের মিরূসোরাস টিমের টেবিলে গিয়ে দেখবেন সেটা খালি। তারপর বাসায় গিয়ে সেটা নিয়ে রূপাকে বাকি জীবন খোটা দেবেন। অন্যেরা কত সুন্দর প্রজেক্ট করেছে আর সে কিছুই করতে পারেনি সেটা একটু পরে পরে মনে করিয়ে দেবেন। তাদের প্রজেক্টটা দিয়ে যে একটা ড্রাগ ডিলারের আস্তানা থেকে পালিয়ে এসেছে সেটা বুঝতেই চাইবেন না। যখন পুরস্কার দেওয়া হবে তখন যে তারা কোনো পুরস্কার পাবে না সেটা নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলবেন। পৃথিবীতে মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসে কিন্তু তার মা কেন তাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না কে জানে!
মিম্মি বলল, “ঐ যে বিজ্ঞান ম্যাডাম আসছেন।”
রূপা তাকিয়ে দেখল বিজ্ঞান ম্যাডাম লম্বা লম্বা পা ফেলে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। তারা চারজন উঠে দাঁড়াল, ম্যাডাম কাছে এসে বললেন, কী হল তোমরা মাঠের মাঝখানে বসে আছ কেন?”
রূপা বলল, “আমাদের মন খারাপ সেই জন্যে।”
“মন খারাপ কী জন্যে?”
“আমাদের কোনো প্রজেক্ট নাই সেই জন্যে।”
ম্যাডাম তাদের পুরো অ্যাডভেঞ্চারের সবকিছু জানেন, তাই তাদের সান্ত্বনা দিলেন, বললেন, “কে বলেছে প্রজেক্ট নাই! তোমাদের প্রজেক্টটাই তো সবচেয়ে
বেশি আছে। সেটা ব্যবহার করে কত কাজ করেছ।”
“কিন্তু এখানে তো নাই।”
“তাতে কী আছে? পরেরবার হবে। এখানে বসে থেকে কী করবে? ভেতরে যাও। তোমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাক।”
রাজু বলল, “এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকব?”
“কিছু একটা বল। কোনো একটা আইডিয়া–”
“আইডিয়া?”
“হ্যাঁ। সেটাই হোক তোমাদের প্রজেক্ট!”
মিম্মি বলল, “এখন চিন্তা করে আইডিয়া বের করব?”
“হ্যাঁ। কোনো আইডিয়া নাই? আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম তখন মাথার মাঝে কত আইডিয়া কিলবিল কিলবিল করত।”
সঞ্জয় চোখ বড় বড় করে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
ম্যাডাম বললেন, “গুড! সেটা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাও।”
“বলব আইডিয়াটা?”
“আমাকে বলার দরকার নেই, নিজেরা নিজেরা ঠিক করে নাও।” ঠিক তখন ম্যাডামের মোবাইল ফোন বাজল, ম্যাডাম তখন ফোনে কথা বলতে বলতে স্কুলের দিকে হেঁটে চলে গেলেন।
রাজু সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার আইডিয়াটা কী?”
“ডারউইন না কে বলেছেন যে, মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে।”
“হ্যাঁ।”
“সেটা ভুল। আমরা এইটাই বলব।”
“ডারউইন ভুল?”
“হ্যাঁ। মানুষ যদি বাদর থেকে আসত তা হলে এখন কেন বাঁদর থেকে মানুষ হচ্ছে না। কোনোদিন চিড়িয়াখানায় দেখেছিস কোনো বানরের লেজ খসে সে মানুষ হয়েছে?”
মিম্মি সঞ্জয়ের কথা শুনে হি হি করে হাসতে লাগল। রূপা বলল, “পরশু দিনের পেপার দেখেছিস?”
সঞ্জয় বলল, “কেন? কী আছে পেপারে?”
“পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীরা মিলে ঠিক করেছেন এই পৃথিবীতে বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার আছে তার মাঝে ফার্স্ট হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তন থিওরি। আর তুই বলবি সেটা ভুল? তোক হাসাবি?”
“কিন্তু আমার যুক্তিতে ভুল কোথায়? দেখেছিস বাঁদরকে মানুষ হতে? দেখেছিস?”
“তোর কথাটাই ভুল। ডারউইন মোটেও বলেননি, মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে। ডারউইন বলেছেন, মানুষ আর বাঁদর দুটোই একটা প্রাণী থেকে এসেছে। একটা ভাগ হয়েছে মানুষ আরেকটা ভাগ হয়েছে বাঁদর। আরেকটা ভাগ হয়েছে শিম্পাঞ্জী, আরেকটা গরিলা–এরকম।”
সঞ্জয় রূপার যুক্তি মানতে চাইল না, গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করতে শুরু করল। রাজু তখন বলল, “ব্যস, অনেক হয়েছে। নিজেরাই যেটা নিয়ে তর্ক করবে সেইটা তো আর ওখানে বলতে পারবে না!”
রূপা বলল, “কিন্তু আমাদের তো একটা আইডিয়া দরকার।”
রাজু বলল, “হ্যাঁ। বৈজ্ঞানিক আইডিয়া।”
মিম্মি মাথা চুলকে বলল, “আমরা যদি বলি একটা টাইম মেশিন তৈরি করে আমরা অতীতে চলে যাব। গিয়ে যত রাজাকার আছে সবগুলোকে ঝুলিয়ে দেব।”
রূপা বলল, “টাইম মেশিনটা বানাবি কেমন করে?”
“বানাতে হবে কেন? ম্যাডাম বলেছেন আইডিয়ার কথা। ম্যাডাম তো বলেননি বানাতে হবে। বলেছেন?”
“কিন্তু টাইম মেশিনের আইডিয়া তো আর আমাদের আইডিয়া হল না।”
মিম্মি মাথা নাড়ল। রাজু বলল, “তা হলে ব্ল্যাক হোল দোষ করল কী? ছোট একটা ব্ল্যাক হোল দিয়ে যত ময়লা-আবর্জনা শুষে নেবে।”
রূপা বলল, “আর তার সাথে সাথে যখন তোকে আমাকেও শুষে নেবে তখন কী হবে?”
রাজু মাথা চুলকাল, বলল, “তা ঠিক।”
তাদের পায়ের কাছে একটা পানির বোতল পড়েছিল, রূপা বোতলটা নিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, “ধুর! পানিটা গরম হয়ে গেছে।”
মিম্মি বলল, “রোদে ফেলে রেখেছিস পানি গরম হবে না?”
হঠাৎ করে রূপা চোখ বড় বড় করে বলল, “ইউরেকা! পেয়েছি!”
“কী পেয়েছিস?”
“আইডিয়া।”
“কী আইডিয়া?”
“রোেদ দিয়ে পানি গরম করা।”
রাজু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “এইটা তোমার নতুন আইডিয়া! সারা দুনিয়ার সবাই জানে যে সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম করা যায়।”
রূপা উত্তেজিত গলায় বলল, “কিন্তু আমরা বলব অন্যভাবে।”
“কীভাবে বলবে?”
“আমরা বলব আমরা যদি ঠাণ্ডা পানি দিয়ে রান্না না করে সূর্যের আলো দিয়ে পানিটাকে একটু গরম করে রান্না করি তা হলে অনেক জ্বালানি বেঁচে যাবে।”
সঞ্জয় ভুরু কুঁচকে বলল, “সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম?”
”হ্যাঁ।”
“কীভাবে করা হবে?”
“প্রত্যেকটা বাসায় একটা পানির গামলা থাকবে, সেই গামলায় পানি ভরে রোদে রেখে দেবে। একটা প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেবে, যেন তাপ বের হতে না পারে। রান্না করার সময় সেখান থেকে পানি নিয়ে রান্না করবে।”
সঞ্জয় হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর! রান্নাবান্না আবার সায়েন্স প্রজেক্ট হল না কি?”
রূপা রেগে গিয়ে বলল, “গাধা, এটা রান্নাবান্না না। এটা হচ্ছে জ্বালানি বাঁচানো। শুধু জ্বালানি বাঁচবে না গ্রিন হাউস গ্যাসও কম বের হবে। পরিবেশের জন্যে ভালো–”
“ধুর!” সঞ্জয় বলল, “এর থেকে টাইম মেশিন ভালো।”
মিম্মি বলল, “না হয় ব্ল্যাক হোল!”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “টাইম মেশিন আর ব্ল্যাক হোল তো আমরা বানাতে পারব না। রূপার আইডিয়াটা তো কাজে লাগানো যাবে।”
“কিন্তু খুবই বোরিং।” মিম্মি হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “কেউ শুনবেই না।”
রূপা বলল, “না শুনলে নাই। আমি এটাই বলব।”
.
কাজেই দেখা গেল সবাই তাদের টেবিলে নানা ধরনের মজার মজার সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মিরূসোরাস টিমের টেবিল খালি। শুধু পিছনে একটা কাগজে লেখা :
জ্বালানি সাশ্রয় এবং গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন থেকে
রক্ষার সহজ পন্থা : সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম
করে সেই পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করা।
তাদের সেই লেখাটি কেউ পড়েও দেখল না, সবাই আশেপাশের বিজ্ঞান প্রজেক্ট দেখতে লাগল। মাসুক রোবট সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা সবচেয়ে বেশি ভিড় জমিয়ে ফেলল। ইলেকট্রিক বেল, অদৃশ্য আলো, মানুষের পরিপাকতন্ত্র, রঙের মিশ্রণ–এরকম মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে কে তাদের বক্তৃতা শুনতে আসবে? কাজেই তাদের টিম থেকে প্রথমে মিম্মি তারপর সঞ্জয় খসে পড়ল। রাজু হয়তো আরো কিছুক্ষণ থাকত কিন্তু ভলান্টিয়ার কম পড়ে গেল বলে ম্যাডাম তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। কাজেই রূপা একা তার পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তার কাছে কিছু শুনতে এলো না। ছেলেমেয়েদের আব্বু আম্মুরা এসেছে তারা ঘুরে ঘুরে প্রজেক্টগুলো দেখছে কেউ তার টেবিলের সামনে দাঁড়াল না।
শুধু আম্মু তার টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন, সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এইটা তোর প্রজেক্ট?”
রূপা লজ্জায় লাল-বেগুনি হয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“একটা কাগজে দুই-তিনটা লাইন লিখে টানিয়ে রেখেছিস?”
“আসলে এইটা একটা আইডিয়া।”
“এইটা আইডিয়া?”
রূপা মাথা নাড়ল। আম্মু গলা নামিয়ে বললেন, “গাধামোর তো একটা সীমা থাকা দরকার। সবাই কত সুন্দর সুন্দর প্রজেক্ট করেছে আর তুই একটা কাগজে ফালতু একটা কথা লিখে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছিস? কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না। লজ্জা করে না তোর?”
রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না, সত্যিই তো, কেউই তার কাছে আসেনি। সত্যিই তো সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এলেন, “তুই সারাক্ষণ বলিস না যে সায়েন্স গ্রুপে পড়বি? সেই জন্যে আমি আজকে এসেছি দেখতে। কারা সায়েন্স গ্রুপে পড়বে জানিস?” আম্মু আশেপাশের সবাইকে দেখিয়ে বললেন, “ওরা! তুই না। তুই সায়েন্সের ‘স’ও জানিস না।”
বলে আম্মু গট গট হেঁটে চলে গেলেন। রূপার মনে হল তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে। পৃথিবীতে তার আম্মুর থেকে নিষ্ঠুর কোনো মানুষ কী আছে? রূপা তখনই তার পোস্টারটা টেনে ছিঁড়ে চলে যেত কিন্তু যেতে পারল না তার কারণ বিজ্ঞান ম্যাডামের সাথে তিন-চারজন মানুষ ঠিক তখন হাতে কাগজ কলম নিয়ে তার টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মানুষটা তার পোস্টারে লেখা কাগজটার লেখাগুলো পড়ে বলল, “ইন্টারেস্টিং! তোমার প্রজেক্ট হচ্ছে এই স্টেটমেন্ট?”
রূপা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, বলল, “আসলে আমাদের আরেকটা প্রজেক্ট ছিল, সেটা শেষ হয়ে গেছে তাই-”
পিছনের মানুষটা বলল, “এটাতে তো দেখার কিছু নেই। আমরা গ্রেড দিব কীসে?”
রূপা বুঝতে পারল এরা হচ্ছে বিচারক, বাইরে থেকে এসেছেন। সবার প্রজেক্টে নম্বর দিতে দিতে যাচ্ছেন। তাকে কত নম্বর দেবেন? শূন্য? না কী শূন্য থেকেও কম, নেগেটিভ নম্বর?
মানুষগুলো চলে যাবার জন্যে রূপা দাঁড়িয়ে রইল। পিছনের দুইজন চলেও যাচ্ছিল কিন্তু বয়স্ক মানুষটা দাঁড়িয়ে কী যেন চিন্তা করল তারপর রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এটা তো বিজ্ঞানের প্রজেক্ট হয় নাই।”
রূপা মাথা নিচু করে বলল, “জানি। আসলে আমাদের আসল যে প্রজেক্ট ছিল–”
বয়স্ক মানুষটা বাধা দিয়ে বলল, “না না, আমি সেটা বলছি না। তুমি যদি দাবি কর একটা আইডিয়া দিয়ে জ্বালানি কিংবা গ্রিন হাউস গ্যাস কমানো সম্ভব তা হলে তোমাকে একটা সংখ্যা বলতে হবে। বল, কতখানি জ্বালানি বাঁচাবে?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “ইয়ে-জানি না।”
“তা হলে তো হবে না। আমিও তো একটা আইডিয়া দিতে পারি, বলতে পারি মোবাইল ফোনে কথা না বললে ব্যাটারি চার্জ করতে হবে না। আর ব্যাটারি চার্জ করতে না হলে অনেক ইলেকট্রিসিটি বাঁচবে। দেশের উপকার হবে। বলতে পারি না?”
“জি। পারেন।”
“কিন্তু আমি যদি সংখ্যা দিয়ে দেখাতে না পারি তা হলে তো আমার কথার কোনো গুরুত্ব নাই। কাজেই তোমার এই আইডিয়াটা আসলেই ঠিক না ভুল যদি আমাকে জানতে হয় তা হলে তোমাকে কোনো সংখ্যা দিয়ে বলতে হবে। বলতে পারবে?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “না, পারব না।”
“ঠিক আছে আমি তোমাকে সাহায্য করি। সূর্যের আলো থেকে রাফলি প্রতি বর্গমিটারে একশ বিশ ওয়াট এনার্জি আসে। আর প্রতি সি এফ টি গ্যাস থেকে তাপ তৈরি হয় আনুমানিক এক মেগাজুল। এখন তুমি আমাকে বলো তোমার আইডিয়া দিয়ে তুমি দেশের কত সম্পদ রক্ষা করতে পারবে?”
রূপা মাথা নিচু করে বলল, “পারব না স্যার।”
“পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে। বলো।”
রূপা দাঁড়িয়ে রইল, আর তখন বয়স্ক মানুষটার একটু মায়া হল। তাই তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুমি পারলে বের কর। আমি যাবার সময় দেখব তুমি পেরেছ কী না।”
তিনজনের বিচারকের টিম তখন পাশের টেবিলে গেলেন অদৃশ্য আলো দেখার জন্যে। সায়েন্স ম্যাডাম টিমের সাথে আছেন। কিন্তু নিজ থেকে একটা কথাও বলছেন না।
বিচারকের দলটা বেশ খানিকটা দূর চলে যাবার পর রূপা হঠাৎ করে বুঝতে পারল বয়স্ক মানুষটা তার কাছে কী জানতে চেয়েছেন–আসলেই তো কঠিন কিছু জানতে চাননি, বেশ সোজা একটা জিনিস জানতে চেয়েছেন। সারাদিন যদি কেউ একটা পানির গামলায় সূর্যের আলো ফেলে পানি গরম করে তা হলে কত সি এফ টি গ্যাস বাঁচানো যাবে। রূপা তখন একটা কাগজে হিসাব করতে বসল। বাংলাদশে সোল কোটি মানুষ, যদি পাঁচজনের একটা পরিবার হয় তা হলে প্রায় তিন কোটি পরিবার। প্রত্যেকটা পরিবার যদি এক স্কয়ার মিটারের এক গামলা পানি রোদে রেখে দেয় তা হলে সারাদিনে সেই পানি কতটুকু গরম হবে। যদি গ্যাস জ্বালিয়ে সেই পরিমাণ তাপ তৈরি করতে হয় তা হলে কত গ্যাস লাগবে। ক্যালকুলেটর নেই তাই কাগজে লিখে অনেক গুণ, ভাগ করতে হল এবং তার উত্তর হল বছরে পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি! হিসাবে কোথাও নিশ্চয়ই গোলমাল করেছে তাই আরেকবার হিসাব করল তারপরও একই উত্তর। তা হলে কী আসলেই পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি গ্যাস? সেটা তো অসম্ভব একটা ব্যাপার। রূপা আরো একবার হিসাব করল একই উত্তর এলো। কী আশ্চর্য!
বিচারকের দলটা যাবার আগে সত্যি সত্যি তার কাছে আরো একবার এলো। বয়স্ক মানুষটা রূপাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বের করেছ?”
রূপা মাথা চুলকে বলল, “বের করেছি, কিন্তু মনে হয় উত্তরটা ভুল।”
“কেন?”
“আমার উত্তর এসেছে বছরে পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি গ্যাস বাঁচানো যাবে!”
ভদ্রলোক শিস দেবার মতো শব্দ করে হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, “কেমন করে বের করেছ?”
“ধরেছি পাঁচজন করে ফ্যামিলি, বাংলাদেশে মোট ফ্যামিলি প্রায় তিন কোটি। সবাই সূর্যের আলো দিয়ে দিনে বারো ঘণ্টা এক মিটার স্কয়্যারের গামলায় পানি গরম করে। সেভাবে ধরলে–”
বয়স্ক ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝেছি।” বিচারকের দলটি হেঁটে চলে যেতে যেতে থেমে গেলেন, রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, “তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার এই আইডিয়াটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কী তুমি কী বলবে?”
রূপা মাথা চুলকাল তারপর বলল, “এইটা খুবই সোজা। সত্যি সত্যি যে কোনো মানুষ এটা করতে পারবে। একটা চাড়ি কিনে পানি ভরে বাইরে ফেলে রাখবে। রান্না করার সময় এখান থেকে পানি নিয়ে রান্না করবে!”
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন তারপর হেসে ফেললেন। তারপর দল নিয়ে চলে গেলেন। রূপার আম্মু তার মাঝে যে তেতো একটা লজ্জা আর অপমানের ভাব দিয়ে গিয়েছিলেন, বয়স্ক ভদ্রলোকের হাসিটুকু দিয়ে তার অনেকটুকু দূর হয়ে গেল। পুরস্কার সে না পেতে পারে কিন্তু অপমানিত তো হতে হল না!
.
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আরো অনেক বুড়ো বুড়ো মানুষ স্টেজে বসে রইল। টেবিলে অনেকগুলো মেডেল সাজানো-কারা কারা সেটা পাবে সবাই এর মাঝে অনুমান করে ফেলেছে। পুরস্কার দেবার আগে বক্তৃতা শুরু হল এবং লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুনে সবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। রূপা ফিসফিস করে মিম্মিকে বলল, “আয় পালাই।”
মিম্মি বলল, “চল।”
দর্শকদের সাথে আম্মুও বসে আছেন, কাজেই আম্মুর চোখ এড়িয়ে রূপা হলঘর থেকে বের হয়ে এলো। রূপার পিছু পিছু মিম্মি এবং সবার শেষে সঞ্জয়। তিনজন বারান্দায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল, সঞ্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইশ! আমরা ফার্স্ট প্রাইজটা মিস করলাম।”
রূপা বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”
সঞ্জয় বলল, “আমি জানি।”
“ঠিক আছে তা হলে পরের বার।”
তিনজন হলঘরের বারান্দার এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত একবার হেঁটে আসে। ভেতরে বক্তৃতা শেষ, এখন মনে হয় পুরস্কার দেওয়া শুরু হবে। রূপা মিম্মিকে জিজ্ঞেস করল, “সোহেলের কোনো খবর জানিস?”
“মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে।”
“কতদিন লাগবে?”
“অনেকদিন। আর মজা কী হয়েছে জানিস?”
“কী?”
“এই গোলমালের কারণে সোহেলের আব্বু-আম্মুর মিলমিশ হয়ে গেছে।“
”সত্যি?”
“সত্যি!”
ঠিক এরকম সময়ে হলঘরের ভেতর থেকে একটা বিস্ময়ের মতো শব্দ শোনা গেল। মনে হল সব ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক অবাক হয়ে একটা নিশ্বাস ফেলেছে। রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মিম্মি বলল, “নিশ্চয়ই কেউ স্টেজ থেকে আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে!”
কে আছাড় খেয়ে পড়েছে সেটা দেখার জন্যে তারা তিনজন তখন হলঘরের একটা দরজা দিয়ে উঁকি দিল। মঞ্চে ডায়াসের সামনে বিচারকদের মাঝে বয়স্ক মানুষটি ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। রূপা শুনল মানুষটি বলছেন, “আমি জানি তোমাদের মনে হতে পারে একটা কাগজে দুই লাইন কথা লিখে একটা টিম কেমন করে সায়েন্স ফেয়ারে ফাস্ট প্রাইজ পেতে পারে! কিন্তু তোমরা বিশ্বাস কর এই দুটি লাইন কিন্তু অসাধারণ একটা আইডিয়া। এটা বাস্তবে করা সম্ভব এবং দেশের কোটি কোটি টাকার জ্বালানি বাঁচানো সম্ভব। ছোট মেয়েটি প্রায় নিখুঁতভাবে হিসাব করে আমাকে এটা দেখিয়েছে এবং আমি এনজিও ফোরামে গিয়ে বলব তারা যেন গ্রামে গ্রামে এই আইডিয়াটা ছড়িয়ে দেয়–
ভদ্রলোক একটু থামতেই হঠাৎ করে হাততালি শুরু হয়ে গেল। হাততালি থামার পর বয়স্ক মানুষটি বললেন, “টিম মিরূসোরাস, তোমরা মঞ্চে এসে তোমাদের প্রথম পুরস্কার নিয়ে যাও।”
সঞ্জয় তখন প্রথমবার বুঝতে পারল তারা পুরস্কার পেয়েছে। তখন সে একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল, তারপর স্টেজের দিকে ছুটতে লাগল। দর্শকদের ভেতর থেকে রাজু ছুটে এলো, বারান্দা থেকে মিম্মি এবং সবার শেষে রূপা। প্রধান অতিথি তাদের গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দিলেন এবং তখন হঠাৎ রূপা আবিষ্কার করল আম্মু তার জায়গা থেকে উঠে ছুটতে ছুটতে স্টেজের সামনে চলে এসেছেন, হাতে তার মোবাইল ফোন যেটা দিয়ে ছবি তোলা যায়। আম্মুর ছবি তুলতে অনেক সময় লাগল, যতক্ষণ ছবি তোলা শেষ না হল প্রধান অতিথি ততক্ষণ মেডেলটা রূপার গলায় ঝোলানোর ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ছবি ভোলা শেষ হবার পর আম্মু রূপার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন আর রূপা হঠাৎ করে আবিষ্কার করল, আম্মুর চেহারা খুব সুন্দর, হাসলে আম্মুকে কী সুন্দরই না দেখায়।
.
১৬.
দরজায় শব্দ শুনে রূপা গিয়ে দরজা খুলে দিল। মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে টিশটাশ একজন সুন্দরী মহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রূপা মহিলাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখন টিশটাশ সুন্দরী মহিলাটি হি হি করে হেসে ফেলল। বলল, “রূপ-রূপালী, আমাকে চিন না?”
রূপা তখন অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল, “সুলতানা! তুমি?”
“হ্যাঁ, আমি! কী হল? আমারে ঢুকতে দিবা না?”
“তোমাকে কী সুন্দর লাগছে সুলতানা! আমি চিনতেই পারিনি!”
সুলতানা তার সেই ময়লা কামিজ পরেনি। সে সুন্দর একটা সুতির শাড়ি পরেছে। মাথার চুলগুলো তেল চিটচিটে হয়ে নেতিয়ে নেই। সুন্দর হয়ে ফুলে আছে। কপালে টিপ আর ঠোঁটে খুব হালকা লিপস্টিক। কাঁধ থেকে একটা আধুনিক হ্যান্ডব্যাগ ঝুলছে। দুই হাতে কাঁচের চুড়ি, গলায় সরু একটা নেকলেস। সুলতানাকে মনে হয় কোনোদিন রূপা ভালো করে দেখেনি। সে যে এত সুন্দর সে কখনো কল্পনা করেনি। শুধু যে দেখতে সুন্দর হয়েছে তা না, কথাও বলে সুন্দর করে। এই প্রথমবার রূফ-রূফালী না বলে রূপ-রূপালী বলছে! রূপা গিয়ে সুলতানাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “তুমি আমাদেরকে ভুলেই গেছ।”
সুলতানা বলল, “না ভুলি নাই। রূপ-রূপালী আমি তোমাকে একটুও ভুলি নাই। খালাম্মা কই?”
“ভেতরে।”
“আমার উপরে অনেক রাগ?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“দেখি রাগ ভাঙানো যায় কী না” বলে সুলতানা বাসার ভেতরে ঢুকল।
রূপা যে রকম প্রথমে সুলতানাকে চিনতে পারেনি আম্মুও ঠিক সেরকম সুলতানাকে চিনতে পারলেন না। সুলতানা ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেটটা রেখে রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুর পায়ে ধরে সালাম করে যখন বলল, “খালাম্মা, আপনার শরীরটা ভালো?” তখন আম্মু সুলতানাকে চিনতে পারলেন। অবাক হয়ে বললেন, “সুলতানা? তুই!”
“জি খালাম্মা। আপনার শরীর ভালো?”
“আর আমার শরীর! আমার শরীর নিয়ে কার ঘুম নষ্ট হয়েছে?”
আম্মু হাতে চাকু নিয়ে পেঁয়াজ কাটছিলেন, রূপা আম্মুর হাত থেকে চাকুটা টেনে নিয়ে বলল, “খালাম্মা আপনি বিশ্রাম নেন। আমি রেন্ধে দেই।”
“তুই বেঁধে দিবি? এই রকম সেজেগুঁজে রাধা যায় না কি?”
“যায় খালাম্মা।” বলে সুলতানা শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। মাথার চুলগুলো মাথার উপরে ঝুঁটির মতো করে খোঁপা করে নিল। হাতের চুড়িগুলো টেনে উপরে নিয়ে আটকে দিয়ে দক্ষ হাতে পেঁয়াজ কাটতে লাগল।
আম্মু কী করবেন বুঝতে না পেরে একটা ডেকচি একটু ধুতে যাচ্ছিলেন, সুলতানা হা হা করে উঠল, বলল, “যান খালাম্মা, যান! আপনার ডেকচি ধুতে হবে না।”
আম্মু বললেন, “আমি কি বাসন ধুই না?”
“কিন্তু আমি যতক্ষণ আছি আপনাকে ধুতে হবে না। আমি ধুয়ে দেব। যান আপনি।”
আম্মু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, “তোর কাজকর্ম তা হলে ভালোই হচ্ছে?”
“এই এক রকম।”
“দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে।”
“ভালো আর কী খালাম্মা। আপনারা আমার জন্যে যেই রকম দোয়া করবেন আমি সেই রকম থাকব।”
সুলতানা পেঁয়াজ কেটে সরিয়ে রেখে আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “কী খাবেন আজকে খালাম্মা? ফ্রিজে মুরগি আছে? আলু দিয়ে রেন্ধে দেই?”
“রাধবি?”
“আপনি যদি বলেন।” সুলতানা চোখ বড় বড় করে বলল, “সাথে ভাত না রেন্ধে একটু পোলাও করে দেব? ছুটির দিনে সবাই খাবেন?”
আম্মু বললেন, “ঠিক আছে। সাথে সবজি–”
সুলতানা বলল, “যান খালাম্মা, আপনি বিশ্রাম নেন, কী রান্ধতে হবে আমার হাতে ছেড়ে দেন। আমি দেখি কী আছে।”
আম্মুকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে দিয়ে সুলতানা রান্না শুরু করে দিল। সুলতানা এসেছে শুনে তিয়াশা আর মিঠুনও রান্নাঘরে তাকে দেখতে এলো। মিঠুন বলল, “সুলতানা আপু তোমাকে দেখে এখন অন্যরকম লাগছে! মনে হচ্ছে তুমি কলেজে পড়!”
সুলতানা হি হি করে হেসে বলল, “তা হলে কী আমি এখন তোমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলব? কামিং গোয়িং ইটিশ মিটিশ?”
মিঠুন বলল, “তুমি খুবই ফানি সুলতানা আপু!”
.
যখন রান্নাঘরে কেউ নেই তখন গুটিগুটি পায়ে রূপা সেখানে হাজির হল। রূপাকে দেখে সুলতানা দাঁত বের করে হাসল, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “রূপ রূপালী, কী মনে হয় খালাম্মার রাগ কি একটু কমেছে?”
রূপা মাথা নাড়ল, “আম্মুর রাগ কমেছে। তুমি এসে যে রান্না শুরু করে দিয়েছ সেই জন্যে আম্মু খুব খুশি। আব্বুকে গিয়ে বলছেন, মেয়েটার আদব কায়দা এখনো আছে।”
সুলতানা মুরগির মাংস কাটতে কাটতে বলল, “এমনিতে বাসার কী অবস্থা?”
“খাওয়া-দাওয়ার অবস্থা খুব খারাপ। তোমার রান্না খেয়ে অভ্যাস–এখন আম্মুর রান্না মুখে দেওয়া যায় না!”
“তোমরা সাহায্য কর না কেন? একা খালাম্মা কত করবে?”
“করি তো।” রূপা সুর পাল্টে বলল, “এখন তোমার কথা বলো। তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“কাউরে বলবা না, আমার প্রমোশন হইছে।”
“প্রমোশন! এই তো মাত্র সেইদিন জয়েন করেছ। এর মাঝে প্রমোশন?”
“আসলে একটা কারণ আছে। কয়দিন আগে ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিল সবগুলো মেয়ে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ছোটাছুটি শুরু করেছে। ছোট একটা সিঁড়ি দিয়ে একসাথে সবগুলো দৌড় দিচ্ছে। আরেকটু হলে পায়ের চাপা খেয়ে কমপক্ষে দশজন মারা পড়ত। আমি তখন সবগুলোরে শান্ত করালাম, লাইন ধরে একজন একজন করে নামালাম। দেয়ালে আগুন নিভানোর একটি যন্ত্র ছিল সেইটা দিয়ে আগুন নিভায়া দিলাম।”
“সত্যি? সুলতানা, তুমি হচ্ছ সুপার গার্ল!”
“ফ্যাক্টরির ম্যানেজার সেই জন্যে খুবই খুশি। আমারে দশ হাজার টাকা বোনাস দিছে!”
“দ—শ—হা—জা–র! তুমি তো বড়লোক।”
“আমি আসলেই বড়লোক, তোমার টাকা লাগলে বলো!” সুলতানা হি হি করে হাসে।
“বলব। তারপর কী হল বলো। তোমার প্রমোশন কেমন করে হল সেটা বলো।”
সুলতানা মুরগির মাংসগুলো একটা ডেকচিতে নিয়ে ধুতে ধুতে বলল, “তারপর তারা একটা তদন্ত করার সময় সবার সাথে কথা বলেছে। আমার সাথেও কথা বলেছে। তারপর ম্যানেজার একদিন আমারে ডেকে বলে, সুলতানা, তোমার ভেতরে কী যেন কী যেন আছে-”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী যেন কী যেন মানে?”
“ইংরেজিতে বলেছে তো, তাই মনে নাই। কথাটার বাংলা হল নেতা নেতা ভাব-”
“ও আচ্ছা বুঝেছি। লিডারশীপ কোয়ালিটি”
সুলতানা বলল, “হ্যাঁ। এই কথাটাই বলেছে। বলেছে তুমি শিফটে কাজ করে কী করবে, তোমাকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দেই! শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কী পাগলে! আমি বললাম আমি লেখাপড়া জানি না মুখ সুখ মানুষ আমি এই সব পারব না। তারা বলে তুমি পারবে। তোমারে ট্রেনিং দেব!”
রূপা হাতে কিল দিয়ে বলল, “কী মজা!”
“মজা না কচু। একসাথে সবাই যোগ দিছি এখন আমারে বানাইছে লিডার–সবগুলো আমার দিকে চোখ বাঁকা করে তাকায়। অনেক কষ্ট করে তাদের সাথে মিলেমিশে আছি। আস্তে আস্তে শেষ পর্যন্ত সবগুলো মনে হয় আমারে আবার বিশ্বাস করা শুরু করছে।”
“কী সাংঘাতিক সুলতানা। তুমি আসলেই সুপার গার্ল।”
সুলতানা হঠাৎ ডেকচিটা নিচে রেখে রূপাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “সব তোমার জন্যে রূপ-রূপালী! তুমি ছিলে বলে আমি টিকে গেছি। তুমি না থাকলে আজকে আমি কোথায় থাকতাম কে জানে।”
.
খাবার টেবিলে অনেকদিন পর সবাই আগের মতো খেতে বসেছে আর সুলতানা টেবিলে খাবার এনে দিচ্ছে। একটা খুব বড় পার্থক্য অবশ্যি আছে এই সুলতানা আগের সুলতানা না। ময়লা কাপড় পরা ভীত দুর্বল কাজের মেয়ের বদলে সে এখন ফুটফুটে সুন্দর হাসিখুশি আত্মবিশ্বাসী একজন তরুণী। টেবিলে খাবার দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “রান্না কেমন হয়েছে খালাম্মা?”
আম্মু মুখে দিয়ে বললেন, “ভালো।”
মিঠুন বলল, “ফার্স্ট ক্লাশ!”
আব্বু বললেন, “তুমি খাবে না?”
“জি খাব। সব শেষ করে খাব।”
হঠাৎ করে আম্মু বললেন, “সুলতানা তুইও বসে যা আমাদের সাথে।”
সুলতানা বলল, “আমি পরে খাই খালাম্মা। আপনারা খান। আমি খাওয়াই।”
“খাওয়ানোর কী আছে। আমরা নিজেরা নিয়ে নেব। তুই বস। এই চেয়ারটা খালি আছে।”
সুলতানা বলল, “থাক খালাম্মা।”
আব্বু বললেন, “বসে যাও।”
রূপা বলল, “প্লী-ই-জ!”
সুলতানা তখন খালি চেয়ারটাতে বসল। সে খুব বেশি খেল না–একটু পরে পরে রান্নাঘরে উঠে গেল খাবার আনতে। কেউ দেখল না রান্নাঘরে গিয়ে আসলে সে তার চোখ দুটো মুছে আসছিল।
.
রাতেরবেলা আম্মু বাসন ধুচ্ছিলেন, রূপা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, “আম্মু।”
“কী হল?”
“একটা কথা বলি?”
“বল।”
“তোমাকে থ্যাংকু আম্মু।” রূপা কোনোদিন তার আম্মুর সাথে এভাবে কথা বলেনি, কোনোদিন বলবে সে চিন্তাও করেনি।
আম্মু সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, “কেন?”
“তুমি আজকে সুলতানাকে আমাদের সাথে একসাথে বসে খেতে বলেছ সে জন্যে।”
আম্মু বললেন, “লাভ কী হল, কিছুই তো খেতে পারল না। কাঠ হয়ে বসে থাকল।”
“খাওয়াটা তো বড় কথা ছিল না আম্মু। সম্মান দেওয়াটা বড় ছিল। থ্যাংকু আম্মু।”
“আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না। যা।”
রূপা চলে গেল না, এসে পিছন থেকে তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরল। জীবনের প্রথম।