রূপা বলল, “কী বলবি জোরে জোরে বল, সবাই শুনুক।”
মিম্মি থতমত খেয়ে বলল, “না-না-কিছু বলছি না।”
রাজু বলল, “কিছু হয়েছে মিম্মি?”
মিম্মি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, কিছু হয়নি।”
রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় বসে বসে ম্যাডামের বলে দেওয়া প্রজেক্টগুলো নিয়ে আলোচনা করল। আলোচনাগুলো হল অবশ্যি রূপা আর রাজুর মাঝে। মিম্মি সারাক্ষণই চোখের কোনা দিয়ে এদিক-সেদিক দেখতে লাগল। সঞ্জয় প্রজেক্ট নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি না–যখনই কেউ কিছু বলছিল সে মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “ফার্স্ট ক্লাশ! ফার্স্ট ক্লাশ!”
কিছুক্ষণের ভেতরেই রাজুর আম্মু ওদেরকে খাবারের জন্যে ডাকতে এলেন, বললেন, “চলে এসো! অনেক কাজ হয়েছে এখন কিছু একটা খাও।”
রূপা দ্রতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সঞ্জয় তোক করে লাফ দিয়ে উঠে আনন্দের একটা শব্দ করল। রূপা তখন আর কিছু বলতে পারল না, সবার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। খাবারঘরে একটা বড় ডাইনিং টেবিল, টেবিলে নানারকম খাবার। সঞ্জয় মহা উৎসাহে মাঝামাঝি একটা চেয়ারে বসে গেল, সেখান থেকে সবগুলো ডিশ নাগাল পাওয়া যায়। রাজুর আম্মু রূপাকে আর মিম্মিকে পাশাপাশি বসালেন। রাজু এক মাথায় বসল আর তার দুই পাশে বসল তার ছোট দুই ভাই-বোন।
রাজুর আম্মু তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলেন, গরম গরম ডালপুরি দেখেই রূপার জিবে পানি এসে গেল। রাজুর আম্মু বললেন, “তোমরা লজ্জা করো না–অনেক আছে।”
রাজুর আম্মুর কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় ভেতর থেকে কাজের মহিলাটি একটা প্লেটে আরো অনেকগুলো ডালপুরি নিয়ে এলেন। রাজু ডালপুরিতে কামড় দিয়ে বলল, “ময়না খালা, আজকে আপনার ডালপুরি স্পেশাল হয়েছে। ফ্যান্টাস্টিক।”
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, মুখে খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, “হ্যাঁ ফাটাফাটি, ফ্যান্টাস্টিক।” মুখে খাবার থাকার কারণে সঞ্জয়ের কথাটা ভালো বোঝা গেল না।
রূপা কনুই দিয়ে সঞ্জয়কে একটা গুতো দিয়ে বলল, “মুখে খাবার নিয়ে কথা বলিস না, গাধা কোথাকার।”
সঞ্জয় হি হি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে আর বলব না। কথা না বলে আগে খাই।”
রাজুর আম্মু বললেন, “হ্যাঁ। সেটাই ভালো। আগে খাও।”
রাজুর ছোট ভাই হঠাৎ করে ডালপুরিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, টেবিলের উপর রাখা চমচমের প্লেটটা দেখিয়ে বলল, “চমচম খাব।”
রাজু তার প্লেটে একটা চমচম তুলে দিয়ে বলল, “পুরোটা খেতে হবে কিন্তু।”
সে ফোকলা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হ্যাঁ পুরোটা খাব।”
এরকম সময় কাজের মহিলাটি বড় এক বাটি বোঝাই চটপটি এনে টেবিলে রাখল। সঞ্জয় আবার আনন্দের শব্দ করল। রাজু বলল, “ময়না খালার চটপটি ওয়ার্ল্ড ফেমাস। একবার খেলে ভুলবে না।”
রাজুর ছোট ভাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আম্মুর চটপটি সবচেয়ে ভালো! ময়না খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না আম্মু?”
ময়না খালা বললেন, “থাক! নিজের মায়ের এত প্রশংসা করতে হবে না!”
রূপা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, যে বাচ্চা দুটোকে এতক্ষণ রাজুর ছোট-ভাই বোন ভেবে এসেছে তারা আসলে রাজুদের বাসার কাজের মহিলার ছেলেমেয়ে! এই জন্যেই চেহারায় মিল নেই, এই জন্যে নামগুলো অন্যরকম। এই বাসায় কাজের মহিলার বাচ্চাগুলোকে একেবারে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করা হচ্ছে। কী আশ্চর্য! রূপা মুগ্ধ হয়ে একবার বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাল একবার তার মায়ের দিকে তাকাল, পুরোটা কী স্বাভাবিক। কী চমৎকার।
রূপার সাথে সাথে সঞ্জয় আর মিম্মিও হঠাৎ করে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে, রূপা একটু ভয়ে ভয়ে থাকল, তারা হঠাৎ করে এটা নিয়ে বোকার মতো কিছু একটা বলে ফেলে কী না। কপাল ভালো দুইজনের কেউ কিছু বলল না।
নাস্তা করে যখন তারা চা খাচ্ছে তখন বাইরের দরজা শব্দ করল আর সাথে সাথে ছোট দুইজন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “আপু! আপু!”
তাদের ধারণা সত্যি, দরজা খুলে একুশ-বাইশ বছরের একটা মেয়ে এসে ঢুকল, চেহারা দেখেই বোঝা গেল নিশ্চয়ই রাজুর বড় বোন। ছোট দুইজন চেয়ার থেকে নেমে ছুটে গিয়ে দুই দিক থেকে তাকে ধরে ফেলল, চিৎকার করতে লাগল, “আপু? আপু!”
রাজুর বোন বলল, “ব্যাস অনেক হয়েছে। তোদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাকে আগে দেখিসনি!” ছোট দুইজন তখন আবার চিৎকার করতে করতে তাদের চেয়ারে গিয়ে বসল।
রাজু বলল, “আপু আমার ক্লাশের বন্ধুরা এসেছে।”
“তাই তো দেখছি। সত্যি দেখছি না সব কল্পনা?”
“কেন? কল্পনা কেন হবে?”
“তোর আবার বন্ধু আছে সেটাই তো জানতাম না।”
“কেন? আমার কেন বন্ধু থাকবে না?”
“তার কারণ তুই হচ্ছিস রোবট। তুই সবাইকে আপনি আপনি করে কথা বলিস। মানুষ যখন ছোটাছুটি করে তখন তুই রবীন্দ্র রচনাবলি পড়িস। সেই জন্যে কেউ তোর কাছে আসে না। সেই জন্যে তোর কোনো বন্ধু নেই।”
“আমার অনেক বন্ধু আছে।” রাজু রূপার দিকে তাকাল ”তাই না রূপা?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক না হলেও কিছু আছে।”
রাজুর বোন একটা খালি চেয়ারে বসে তাদের তিনজনকে দেখল তারপর বলল, “আমি রাজুর বড় বোন মিথিলা। মেডিকেলে পড়ি।”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “জি! বুঝতে পেরেছি।”
“সঞ্জয় বলল, আপনাদের চেহারা একদম একরকম।”
“মোটেও না।” মিথিলা বলল, “রাজুর নাক বোঁচা। আমার নাক মোটেও বোঁচা না।”