না জেনে অপরিচিত একটা মেয়ের সামনে প্যান্ট খুলে ফেলে ছেলেটি লজ্জা না পেয়ে যায়, তাই রাশা একটু কাশি দেয়ার মতো শব্দ করল। কিন্তু তার ফল হলো ভয়ানক। শুকনো ছেলেটি চমকে উঠে মাথা ঘুরে তাকাল এবং রাশাকে দেখতে পেয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং কিছু বোঝার আগেই সে তাল হারিয়ে ঝপাং করে পানির মাঝে পড়ে গেল।
রাশা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, ছেলেটা ততক্ষণে সাঁতরে পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেছে, সেখান থেকে সে চিৎকার করতে থাকে। রাশা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?”
ছেলেটা সাঁতরে পুকুরের অন্য পাশে চলে যেতে যেতে বলল, “ভূত!”
“ভূত!” রাশা অবাক হয়ে বলল, “কোথায় ভূত?”
“তুমি!”
রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি? আমি ভূত?”
“হ্যা”
“না–” রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “আমি ভূত না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“তুমি তাহলে কে?”
“এইটা আমার নানি বাড়ি। আমি আমার নানির কাছে এসেছি। আমার নাম রাশা।”
“লাশা?”
“না। লাশা না। রাশা।”
ছেলেটা নিশ্চয়ই পানির পোকা, মাঝ পুকুরে ভাসতে ভাসতে বলল, “সত্যি কথা বলছ?”
“হ্যাঁ সত্যি কথা বলছি।”
ছেলেটা তখন সঁতরে সাঁতরে পুকুর ঘাটের দিকে আসে। শ্যাওলা ঢাকা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাশার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল, তার মাথা থেকে চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। রাশা একটু এগিয়ে যেতেই সে চিৎকার করে বলল, “কাছে আসবা না।”
রাশা দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে আসব না।”
ছেলেটি বলল, “এইটা তোমার নানি বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“মিছা কথা।“
“কেন? মিথ্যা কথা কেন হবে?”
“আমি তোমারে আগে কোনোদিন দেখি নাই।”
“আমি আগে কোনোদিন আসি নাই, সেই জন্যে দেখো নাই।”
“খোদার কসম?”
রাশা বলল, “খোদার কসম।”
মনে হয় এইবার ছেলেটার একটু বিশ্বাস হলো, সে ঘাটে উঠে এসে বলল, “তোমারে দেখে যা ভয় পাইছিলাম।”
“ভয় পাওয়ার কী আছে?”
“মঙ্গলবার দুপুর খারাপ সময়। ভূত-পেত্নি বের হয়।”
রাশা এইবারে একটু হেসে ফেলল, সত্যি কথা বলতে কি অনেক দিন পর সে প্রথমবার একটু হাসল। রাশাকে হাসতে দেখে ছেলেটা কেমন যেন চটে উঠে, গরম হয়ে বলল, “হাসো কেন তুমি? হাসো কেন?”
“তোমার কথা শুনে।”
“আমার কোন কথাটা হাসির?”
“ভূত-পেত্নির কথাটা।”
“তুমি বলতে চাও শনিবার আর মঙ্গলবার ভূত-পেত্নি বের হয় না?”
“ভূত-পেত্নি থাকলে শনি, মঙ্গল কেন অন্যবারেও বের হতো। ভূত পেত্নি বলে এই দুনিয়াতে কিছু নাই।”
ছেলেটা একধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, রাশার কথায় সে বুঝি রীতিমতো অপমানিত বোধ করছে। ক্রুদ্ধ মুখে বলল, “যেই জিনিসটা জানো না সেইটা নিয়ে কথা বলা ঠিক না।”
“আমি জানি। সেই জন্যেই বলছি।”
“তুমি জিন ভূত-পেত্নি বিশ্বাস করো না?”
“না।”
“যখন দেখবা তখন মজাটা টের পাবা।”
রাশা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তুমি আমাকে একটা ভূত দেখাতে পারবে?”
“সেইটা আর কঠিন কী? অমাবস্যার রাতে শুশানঘাটে গেলেই দেখবা ভূত-প্রেত আর পিশাচ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
রাশা তার মুখের হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, “তুমি আমাকে একটা ভূত ধরে এনে দিতে পারবে?”
“ভূত ধরে আনব?”
“হ্যাঁ যদি ভূত ধরে আনতে পারো তাহলে তোমাকে আমি একশ টাকা দিব। আর যদি একটা শিশিতে ভরে এনে দিতে পারো তাহলে তোমাকে দিব একশ তিরিশ টাকা।”
ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড রাশার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি আমার সাথে মশকরা করছ?”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
ছেলেটার আরো রেগে উঠার কথা ছিল কিন্তু সে রেগে না উঠে হঠাৎ করে দাঁত বের করে হেসে ফেলল, বলল, “তুমি অনেক আজিব মানুষ।”
“আজিব কোনো শব্দ নাই। শব্দটা আজব।”
ছেলেটা আরো জোরে জোরে হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, “আজিব! আজিব! একদম আজিব।”
রাশা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“জিতু। জিতু মিয়া।”
“ভেরি গুড জিতু মিয়া। তোমার সাথে আমার পরিচয় হলো।”
জিতু মিয়া আবার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে থেমে গেল, বলল, “তোমারে আমি কী ডাকব? রাশা খালা?”
“খবরদার। আমাকে খালা ডাকলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।”
“কিন্তু তুমি তো সম্পর্কে আমার খালা। তোমার মা হচ্ছে আমার নানির ফুপাতো বোন-”
“আমি এতো কিছু বুঝি না, কিন্তু আমাকে খালা ডাকতে পারবে না। আমাকে খালা ডাকলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।”
রাশার কথা শুনে জিতু মিয়ার খুব আনন্দ হলো, সে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “আজিব! আজিব! তুমি এক্কেবারে আজিব!”
“আজিব হলে আজিব।”
“তাহলে তোমাকে কী বলে ডাকব?”
“আমার নাম রাশা। রাশা বলে ডাকো।”
জিতু মিয়া জিবে কামড় দিল, বলল, “সর্বনাশ! তুমি আমার বড়, তোমারে নাম ধরে ডাকলে গুনাহ হবে।”
“তাহলে রাশা আপু বলে ডাকো। শর্টকাট করে বলতে পারো রাশাপু।”
এই নামটা জিতু মিয়ার খুব পছন্দ হলো, হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “রাশাপু! রা-শা-পু! এইটা ঠিক আছে। খালারে আপু ডাকলে লোকজন মনে হয় পাগল বলবে। বললে বলুক!”
জিতু মিয়া এবারে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল সেখানে থেকেই একটা লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তাকে দেখা গেল না, একটু পরে পুকুরের মাঝামাঝি ভুস করে সে ভেসে উঠল, চিৎকার করে কিছু একটা বলে সে আবার পানিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখে রাশার রীতিমতো হিংসা হয়, বাচ্চা ছেলেটা পানিতে কী সুন্দর দাপাদাপি করছে, দেখে মনে হয় শুকনো মাটি থেকে পানিটাই বুঝি তার জন্যে সহজ! এই বাচ্চাটার মতো সেও যদি সাঁতার জানত তাহলে সেও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত!