- বইয়ের নামঃ রাতুলের রাত রাতুলের দিন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. রাতুল ধড়মড় করে
রাতুল ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। চোখ কচলে সে ঘড়িটার দিকে তাকায়, তার চোখে-মুখে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর আতঙ্কের একটা ছায়া পড়ল। আটটার সময় তার সদরঘাট লঞ্চঘাটে পৌঁছানোর কথা-নয়টার সময় চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটির একটা জাহাজ সেখান থেকে ছেড়ে যাবে। তার সেই জাহাজে করে যাবার কথা ছিল। রাতুল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঘড়িটাতে ঠিক নয়টা বাজে, ঘণ্টার কাঁটা আর মিনিটের কাঁটা নিখুঁত নব্বই ডিগ্রি। সাতটার সময় তার ঘুম থেকে ওঠার কথা ছিল, মোবাইল ফোনে সে সাতটার অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিল, সে উঠেছে নয়টার সময়, দুই ঘণ্টা পর।
রাতুল বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে, রাতে কোনো একসময় ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাতুল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এরকম বিশ্বাসী একটা ফোন তার সঙ্গে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে সে এখনও বিশ্বাস করতে পারে না। তৃষা নিশ্চয়ই অনেকবার তাকে ফোন করেছে, ফোন বন্ধ, কোনো লাভ হয়নি।
সপ্তাহ খানেক আগে তৃষা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তাদের ফিল্ম সোসাইটি জাহাজ ভাড়া করে সুন্দরবন যাচ্ছে, ভলান্টিয়ার হয়ে সে সঙ্গে যেতে চায় কি-না। পরিচিত অনেকে মিলে জাহাজ ভাড়া করে সুন্দরবন যাওয়া খুব মজার একটা ব্যাপার কিন্তু এখানে তার জন্যে ব্যাপারটা অন্যরকম। তৃষাদের ফিল্ম সোসাইটির সবাই সবাইকে চেনে, তারা সবাই মিলে হইচই করতে করতে যাবে, শুধু সে তার মাঝে কাবাব-মে-হাড্ডি হয়ে ঘুরে বেড়াবে–ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার উৎসাহ কমে যাবার কথা ছিল। রাতুলের উৎসাহ কমেনি, তার কারণ হচ্ছে তৃষা। সারা জাহাজে তার একমাত্র পরিচিত মানুষ হবে তৃষা এবং সেই তৃষার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা সে এক জাহাজে থাকবে সেটা চিন্তা করেই সে এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। তৃষা তখন সব ব্যবস্থা করেছে–আটটার ভেতরে তার সদরঘাট পৌঁছানোর কথা, নয়টার ভেতর জাহাজ ছেড়ে দেবার কথা। অথচ সে ঘুম থেকে উঠেছেই নয়টার সময়-কাঁটায় কাঁটায় নয়টায়। কী ভয়ংকর কথা!
ফোনটা চার্জারে লাগিয়ে সে তৃষাকে ফোন করতে পারে। ফোন করে সে কী বলবে?”আমি খুবই দুঃখিত তৃষা, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই অ্যালার্ম বাজেনি। সেই জন্যে উঠতে পারিনি।” তৃষা কী বলবে রাতুল অনুমান করতে পারে, “আমি জানতাম! তুই কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারিস না। কেন করতে পারিস না সেই কৈফিয়তটা শুধু ঠিক করে দিতে পারিস।” তারপর একটুও রাগ না হয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলবে, “ভালো থাকিস রাতুল।”
রাতুল শরীর থেকে কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে প্রথমবার পুরো ব্যাপারটা একটু চিন্তা করার চেষ্টা করে। মাথার মাঝে চিন্তাগুলো কেমন জানি জট পাকিয়ে যাচ্ছিল, তারপরও সে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করল। এই দেশে কোনো কাজ কেউ সময়মতো করতে পারে না, তাই যে জাহাজটা নয়টার সময় ছেড়ে যাবার কথা সেটা নিশ্চয়ই কোনোভাবেই নয়টার সময় ছেড়ে যেতে পারবে না, সেটা নিশ্চয়ই এখনও লঞ্চঘাটে আছে। আজ শুক্রবার, তাই রাস্তাঘাটে ভিড় খুব বেশি নেই, সে যদি এই মুহূর্তে রওনা দেয় তা হলে–ভাগ্য ভালো হলে ”হয়তো”–জাহাজটা ধরে ফেলতে পারবে।
রাতুল তখন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। যে ঢিলে পায়জামা আর টি শার্ট পরে ঘুমিয়েছিল তার ওপরেই জিনসের প্যান্ট আর একটা শার্ট পরে নেয়। বোম লাগিয়ে সময় নষ্ট করল না, মোজা পরে টেনিস স্যু-টা পায়ে পরে নেয়। বাথরুম থেকে এক খাবলা দিয়ে টুথব্রাশ টুথপেস্ট রেজরগুলো তুলে ব্যাকপেকে ঢুকিয়ে নিল। চেয়ারের ওপর রাখা সোয়েটারটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে টান দিয়ে বিছানার চাদরটা ব্যাকপেকে ঢুকিয়ে ফেলে। বের হয়ে যাবার সময় শেষ মুহূর্তে তার মানিব্যাগটার কথা মনে পড়ল, ড্রয়ার খুলে সেটা বের করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সে ছুটতে থাকে। গেটের কাছে কে যেন বলল, “এই যে ভাই জুতার ফিতা খোলা।” রাতুল ছুটতে ছুটতে বলল, “জানি।”
মোড়ে সবসময় কয়েকটা সিএনজি থাকে, আজকে নেই। রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে এদিক-সেদিক তাকায়, একটা বাস আসছে, কত নম্বর বাস কোন দিকে যাচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠে গেল। বাসটা ভুল দিকে রওনা দেওয়ার সময় কন্ডাক্টরের সাথে ঝগড়া করে সে নেমে গেল। নামতেই একটা কালো রঙের ক্যাব। দরজা খুলে ঢুকে সে চিৎকার করতে থাকে, গুলিস্তানের কাছে একটা ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়তেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে সে ছুটতে থাকে। ভিড়টা পার হয়ে সে একটা সিএনজি পেয়ে গেল, খানিকদূর পর আবার জটলা, আবার নেমে সে ছুটতে থাকে। রাস্তা ফাঁকা হবার পর সে হাট্টাকাট্টা জোয়ান একটা রিকশাওয়ালা পেয়ে গেল, সে বাকি পথটা তাকে মোটামুটি উড়িয়ে নিয়ে এলো।
সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে নেমে সে ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে যায়। জেটিতে সারি সারি লঞ্চ আর জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে তার মাঝে কোনটা তাদের বোঝার উপায় নেই। টেলিফোনে চার্জ থাকলে তৃষাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারত কিন্তু এখন তারও উপায় নেই। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে সে এগিয়ে যায়, যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন রাতুল জাহাজটাকে দেখতে পেল। জাহাজের ওপর বড় একটা ব্যানার টানানো, সেখানে চিলড্রেন ফি। সোসাইটির নাম এবং লোগো। রাতুলের মনে হল জাহাজটা না দেখতে পেলেই হয়তো ভালো হত, কারণ সেটা এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং জেটি থেকে সরতে শুরু করেছে। রাতুল যখন ছুটে কাছে গিয়েছে তখন সেটা আট দশ ফুট সরে গিয়েছে, আর কয়েক সেকেন্ড আগে এলেই সে লাফিয়ে উঠে যেতে পারত।