রাশা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, এত হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভেতরে তাকে আলাদা করে কেন ডাকছে। কোনো একটা সমস্য নিশ্বয়ই। হয়েছে, কিন্তু কী সমস্যা? তবে একটা জিনিষ অনুমান করা যাচ্ছে।
অফিম্পিয়াডের অঙ্কগুলো মনে হয় ঠিক হয়েছে, তা নাহলে আলাদা করে তাকে ডাকবে কেন? রাশার একই সাথে একধরনের আনন্দ আবার অন্য ধরনের ভয় হতে থাকে।
.
কমবয়সী মেয়েটির পিছু পিছু রাশা যেতে থাকে। মেয়েটা বলল, “আমার নাম মিমি। আমি সায়েন্স অলিম্পিয়াডের কো-অর্ডিনেটর।”
রাশা জিজ্ঞেস করল, “মিমি আপু, আমাকে কেন ডেকেছেন?”
“আমি ঠিক জানি না, পরীক্ষার কন্ট্রোলার খবর পাঠিয়েছে! চলো গিয়ে দেখি।”
রাশা মিমি নামের মেয়েটার পিছনে পিছনে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা রুমে গিয়ে ঢুকল। সেই রুমে খিটখিটে ধরনের একটা মানুষ বসে আছে, রাশাকে দেখে চশমার উপর দিয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর খসখসে গলায় বলল, “তুমি সেই মেয়ে?”
রাশা যেহেতু আগে-পিছে কিছু জানে না তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষটা খসখসে গলায় বলল, “পরীক্ষা তো খুবই ভালো দিয়েছ, একেবার ফার্স্ট কিন্তু এত কেয়ারলেস হলে কেমন করে হবে?”
রাশা জিজ্ঞেস করল, “কেয়ারলেস?”।
“হ্যাঁ। খাতায় নাম লিখেহু, রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখেছ, স্কুলের নাম লেখ নাই।” মানুষটি রাশাকে তার খাতাটা দেখিয়ে বলল, “এই দেখছ না, এখানে বড় বড় করে লেখা আছে স্কুলের নাম লিখতে হবে?”
রাশা কিছু বলল না। খিটখিটে মানুষটা বলল, “পরীক্ষার নিয়মে স্পষ্ট বলা আছে ভুল কিংবা মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা সব তথ্য না দিলে খাতা ক্যান্সেল হয়ে যাবে! বুঝলে মেয়ে আমি ইচ্ছে করলে তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দিতে পারতাম। বুঝেছ?”
রাশা মাথা নেড়ে বলল যে সে বুঝেছে। খিটখিটে মানুষটা বলল, “কিন্তু তুমি এইটুকুন মেয়ে পরীক্ষায় এত ভালো করেছ খাতা ক্যান্সেল করি কেমন করে? তাই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। নাও স্কুলের নাম লেখ। ফিউচারে এরকম কেয়ারলেস হবে না।”
রাশা ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমি কেয়ারলেস হইনি। আমি আসলে ইচ্ছা করে স্কুলের নামটা লিখি নাই।”
খিটখিটে মানুষটার মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল, সরু চোখে বাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি তাহলে কেয়ারলেস না, তুমি হচ্ছ আইন অমান্যকারী! নিয়ম কানুনের প্রতি তোমার কোনো সম্মান নেই–”
“না, না, তা নয়।” রাশা একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “আসলে আমার স্কুলটার নাম একটা রাজাকারের নামে। খাতায় রাজাকারের নামটা লিখতে ইচ্ছে করে না তো–”
মানুষটার মুখটা এবারে কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল। সে রাশার খাতাটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসে রাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী বলেছ?”
“বলেছি যে স্কুলটার নাম একটা রাজাকারের নামে, সেই নামটা লিখতে ইচ্ছে করে না।”
“রাজাকার?”
“জি।”
“তোমার বয়স কত?”
“চৌদ্দ।”
“তোমার বয়স চৌদ্দ আর এই বয়সে তুমি রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের পলিটিক্সে ঢুকে গেছ?”
“ঠিক পলিটিক্স না–”
মানুষটা ধমক দিয়ে রাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি কী বলি শোনো। এই দেশে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অনেক পলিটিক্স হয়েছে, আর না। বুঝেছ? যে জিনিস দেখ নাই সেই জিনিস নিয়ে কথা বলবা না।”
“কিন্তু—”
মানুষটা ক্রুদ্ধ মুখে বলল, “বড় বড় লম্বা লম্বা কথা অনেক শুনেছি। আমার বয়স তো কম হয় নাই। লম্বা লম্বা কথা বললে সেই লম্বা কথা এক সময়ে গিলতে হয়। তুমি এখন যেভাবে গিলবে।”
মানুষটা কী বোঝাতে চাইছে রাশা অনুমান করতে পারল, তারপরও সে বলল, “আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ আমি কী বলছি। খুব বড় গলায় বলেছ, রাজাকারের নাম লিখতে ইচ্ছা করে না! এখন ফার্স্ট প্রাইজটার জন্যে তুমি এসে ঠিকই রাজাকারের নাম লিখবে। যদি না লেখো তাহলে আমি তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দেব।”
এতক্ষণ মিমি নামের মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, এবারে সে একটু অস্থির হয়ে বলল, “স্যার আমি ওর রেজিস্ট্রেশন ফর্ম খুঁজে বের করে স্কুলের নামটা নিয়ে আসি স্যার। আমি লিখে দিই—”
খিটখিটে মানুষটা চিৎকার করে বলল, “না! এই মেয়ের নিজের লিখতে হবে। তাকে শিখতে হবে থুথু ফেলা সোজা। সেই থুথু চেটে খাওয়া কঠিন।”
রাশার মনে হলো তার মাথার ভেতরে বুঝি আগুন ধরে গেছে। মনে হলো সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না তার নানি যখন দুই মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলেন, মাথাটা মনে হয় আউলে গেছে তখন তার মনে হয় ঠিক এরকম লাগে!
“লেখো।” খিটখিটে মানুষটা খাতাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “রাজাকারের নামে দেওয়া তোমার স্কুলের নাম লেখো।”
ব্লাশী বলল, “আমি লিখব না।”
মানুষটা মনে হয় চমকে উঠল, বলল, “কী বললে?”
“আমি বলেছি, আমি আমার খাতায় কোনো রাজাকারের নাম লিখব না।”
মানুষটা মনে হলো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি তোমার স্কুলের নাম লিখবে না?”
“তাহলে আমি তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দেব। সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েও তুমি কোনো পুরস্কার পাবে না।”
“জানি?”
“তারপরেও তুমি তোমার খাতায় তোমার স্কুলের নাম লিখবে না?”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি থুথু ফেলেছি, সেই গুথু আমি চেটে খাব না।”