সুরতুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মাধাই যেন বলীয়ান হয়ে উঠলো। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যেন সে হাসতেও পারে এমন ভঙ্গি করে বললো, এক জোয়ানের গল্প জানো না? সারা দেশে সব চায়ে বড়ো জোয়ান হবি বলে সে কী কী খাতে। কিন্তু কোবরেজমশা যা কইছিলোতার চেয়ে বেশি খাতে লাগলো, তার পরে তার মাংস চামড়া খসে খসে গেলো। আমিও খুব সুখ চাইছিলাম, ফতেমা, আমারও তেমন অবস্থা।
কী কও বুঝি না।
মাধাই হেসে বললো, দ্যাখো তে কি বোকা আমি! মনকে ভালো করতে চাইছিলাম। শরীল আমাক মারে খুন করছে।
ফতেমা বললো, তোমার এ সকল কথা বুঝি না। কী অসুখ তোমার, তাই কও। আর পুরো যদি যত্ন করবি সে-অসুখ সারে না কেন্ তাই কও।
বুনেক তা কওয়া যায় না। ডাক্তার উপর-উপর সারায়ে দিছে, কিন্তু জানি, সারা শরীলে সে-বিষ ছড়ায়ে আছে। রাতে ঘুম নাই। সুরোক সে বিষ দিয়ে কী হবি?
সুরতুন একাগ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাধাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। তার তখন মনে হলো মাধাইয়ের নাকটি যেন কিছু বিকৃত, তার মুখের ত্বক যেন কোথাও কোথাও সংকুচিত। কিন্তু এ তার চোখের ভুলও হতে পারে। সারা দেহে বিষ ছড়িয়ে গেছে, এ কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। আর হাসির কথা ভাবো যা একটু আগে মাধাইয়ের মুখে ফুটে উঠেছিলো। সুরতুনের মুখ একটি আকস্মিক হাসিতে ঝলমল করে উঠলো; সে বললো, কে, বায়েন, সেই ভাসান পালাগানে কার যেন গায়ের চামড়া খুলে খুলে গিছিলো, তারপর তো জোড়া লাগছিলো।
পালাগানের কোনো চরিত্রের কথা নয়। মাধাইয়ের গল্পটার পাল্টা আর একটা গল্প বলা, যার বীজ মাধাইয়ের কথা থেকেই সংগ্রহ করেছে সে। তবু সুরতুনের মুখের হাসি ও তার গলার সুরে একটা গোটা পালাগানের সবটুকু রস সঞ্চিত।
ফতেমা যেন আশ্বাসে সোজা হয়ে বসলো।
কিন্তু বিমূঢ় ভাবটা সাময়িক। মাধাই বললো, যাও, যাও। আমি কি পাথর? অমন করে লোভ দ্যাখাও কেন্? কী লাভ? কী লাভ? কিছুক্ষণের মধ্যেই মাধাই কেঁদে কেটে ফুঁপিয়ে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়লো। শুধু সুরতুন নয়, জীবনও তার আওতার বাইরে চলে গেছে।
৩৭. কী এক অশান্তির সময়
কী এক অশান্তির সময় এসে পড়লো। রেডিওর সংবাদ, কাগজের সংবাদ, সব যেন অশান্তিতে কাঁপছে। কোথাও কি আনন্দ উচ্ছ্বসিত হবে? সে আনন্দে কি কান্না জড়ানো থাকবে, কিংবা দুঃখ ঢাকার বেপরোয়া হাসি? এ কি এক নতুন দর্পিত বৈশাখ আসছে তার ঝড়ে পুরনো সব কিছুকে ধ্বংস করে? কারো কারো মনে হতে পারে–পদ্মা নতুন খাত নিতে পারে, সংবাদটা এরকমই যেন। যে প্লাবন পলি আনে তা নয়, বরং যেন কীর্তিনাশা রূপ নেবে। ভয় হতে থাকে, ভয়কে অবিশ্বাস করতে সাধ যায়।
রূপুর মনে হয়েছিলো সংবাদগুলো সকলেরই জানা দরকার। সে সদর থেকে একটা রেডিও আনিয়ে যে ঘরগুলোতে সদানন্দর স্কুল বসতো সেখানে রেখেছে। গ্রামের সকলেই যেন তাদের ইচ্ছা আর সময়মতো শুনতে পারে, এরকম ব্যবস্থা।
বৈশাখের মাঝামাঝি। সুমিতিকে নেবার জন্য তার কাকা এসেছেন চিঠি পেয়েই। মনসা তাকে দুদিন থেকে যেতে রাজি করেছে।
তিনি কলকাতার ব্যারিস্টারপাড়ার মানুষ। তার কথা শুনে মনে হয়, রেডিও ও খবরের কাগজে সেসব সংবাদে দিগমণ্ডল আচ্ছন্ন হয়ে আসছে পাকা আবহবিদের মতো তার অন্তরস্থিত গতিপ্রকৃতির খবরও তিনি রাখেন। বিভিন্ন মত থাকতে পারে, তা সবেরই নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যারিস্টাররা। কলকাতাই আসল। তাকে দখলে রাখতেই শলাপরামর্শ। শুনে রূপু সুমিতিকে বলছিলো, দেখো, বউদি, এ যেন সেই কনৌজের জন্যই যুদ্ধ আবার।
সকালে সুমিতির কাকা সদানন্দকে সঙ্গে করে গ্রামের পথে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় সান্যালমশাইয়ের লাইব্রেরিতে গ্রামের কথাই হচ্ছিলো।
গ্রামের অনেক পথ আছে যেখানে গত বিশ বৎসরে সান্যালমশাই একবারও পদার্পণ করেননি। সেসব পথের ধারে যে-মানুষগুলি এককালে বাস করতো তাদের বংশধররা এখন বাস করে কিনা এ খবরও তার জানা ছিলো না। সদানন্দর মুখে বর্ণনা শুনে তার মনে হলো এইসব পথের উপরে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ছোটোখাটো দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে এবং যুদ্ধের এই পর্যায়ে অন্তত মানুষেরই বড়ো রকমের একটা হার হয়েছে। আর সে সব যুদ্ধে তার সংযোগ ছিল না।
এরপরে গ্রামের পুরাতন সমৃদ্ধির কথা উঠলো। কোনো কোনো পথে ধুলোর আস্তরণের নিচে ঘুটিং আছে বলে অনুমান হয়। সুমিতির কাকা এ থেকে গ্রামের সেকালের সমৃদ্ধি নির্ণয় করার উদ্যোগ করছিলেন।
সদানন্দ বললো, দরিদ্রের সংখ্যা আগের তুলনায় অবশ্যই বেড়েছে। ধনীদের সংখ্যাও, অন্যদিকে, বাড়েনি তাতে। গ্রামের গড় আয় তখন বেশি ছিলো। কারণ কৃষির সঙ্গে তখন শিল্পও ছিলো, এখন যাঁরা ধনী আছেন গ্রামে তাদের মতো মানুষের সংখ্যা নিশ্চয়ই তখন বেশি ছিলো।
সেসব পথঘাট ধনীরা কি নিজেদের জন্যই করেছিলেন?
সব ধনীরা নয়। পাটের সাহেবরা করেনি। অন্তত দুটি ভালো পথ, যার কিছু কিছু অংশ এখনো মজবুত আছে, নীলকর সাহেবরা তৈরি করেছিলো। কিন্তু কৌতুকের বিষয় এই যে, পথ দুটোর একটা গেছে পদ্মার পুরনো খাতের দিকে, অন্যটা কবরখানায়। সেখানে দু-তিনটি কবর আছে। তার মধ্যে একটি এক আর্মেনি বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মুন্সেফের। মনে হয়, এ-গ্রামে এক মুন্সেফি আদালত ছিলো।