- বইয়ের নামঃ গড় শ্রীখণ্ড
- লেখকের নামঃ অমিয়ভূষণ মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বাঙাল নদী পদ্মা
গড় শ্রীখণ্ড – উপন্যাস – অমিয়ভূষণ মজুমদার
প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৭ সংস্করণ : ১৯৮৭
আমার সবচাইতে পরিচিত পুরুষ চরিত্র
বাবাকে উৎসর্গ করলাম
.
যেমন সুরতুন। সুরতুন তো প্রেমে পড়ার মুখেই ছিলো, তার অবচেতনে একটা ভয় ছিলো পুরুষের প্রতি-সেই জন্যে যাকে ভালোবাসতো সেই মাধাই বায়েনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলো না। কিন্তু ইয়াজ তাকে তাকে উইন করছে কীভাবে? চলল আমি তোমাকে তোমার প্রেমিকের কাছে নিয়ে যাবো, মাধাই বন্যায় ডুবে যেতে পারে, তুমি একলা যেতে পারবে না–এই বলে তার সঙ্গে দুঃখ ভাগ করে বন্যার জলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় সে-ও তো যুবক, সে-ও তো সুরতুনকে কামনার চোখে দেখে এসেছে–যেহেতু ঠিক জীবনের পরিপোষক নয়, সে মরবিড হয়ে গেছে, সেখানে জীবন ইয়াজের চেহারা নিয়ে সুরতুনকে ফিরিয়ে এনেছে। তারা ফিরে আসছে। যে-চরে উপস্থিত হয়েছে, সেখানে আদিগন্ত সেই চর থেকে জল সরে গেছে, শুধু কাদার পাথর, কিছু দেখা যায় না। শুধু দেখা যাচ্ছে, চরণকাশির আলেফ সেখ–তারও তো কলকাতার দাঙ্গায় ছেলে গেছে, যে-ছেলে জীবনকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে : ডাক্তার ছিলো, ফুটপাথে রোগী পড়েছিলো, তুলে আনতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। তা, সেই আলেফ সেখ এই বন্যা-ছেলের মৃত্যু-দেশভাগ রাজনীতি কিছু ভাবছে না : সে লাঠি হাতে দেখছে উপরে যে বালি পড়েছে তার কত নিচে পলিমাটি, অর্থাৎ পলিটা সরিয়ে সে চাষ করবে–এই দেখছে। এই দেখে সুরতুনকে ইয়াজ বলছে যে আমি আমার কাপড় থেকে আর-একটু ছিঁড়ে দি, তুই গায়ে জড়িয়ে নে। ওই দ্যাখ আলেফ সেখ, মনে হয় ওর কাছে গেলে কিছু খাবার পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সেখানে কী? জীবন সৃষ্টি হচ্ছে সুরতুনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করছে ইয়াজ। দেখছে, এই লাইফটা আমরা হাতে পেয়েছি, দ্যাখো ওই মসজিদটা। এবং সে সময়ে লেখকের একটা কথাই মনে হয়, সেটা হচ্ছে, উপরে মেঘ ডাকছে, পদ্মর মুখ কালো হয়ে উঠছে। পদ্মকে বলছে : হে কাল-পদ্ম যেন কাল, কালের প্রতিমা-তুমি দয়া করো। এই যে কালপ্রবাহ, পদ্মার মতো এদিক-ওদিক টার্ন নিচ্ছে, আমরা কষ্ট পাচ্ছি, বুঝতে পারছি না এর মধ্যে ক্যারাকটার তৈরী হয়ে গেছে। তাই কাল, তুমি দয়া করো, অর্থাৎ ধ্বংস কোরো না। জীবনে যারা সবচাইতে বঞ্চিত, সেই শ্রেণী জীবনে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তুমি দয়া করো। ছোটোখাটো জিনিস দিয়ে আমরা জীবনের আয়োজনকরছি–এটা কিন্তু চিরস্থায়ী, কালকে সারপাসকরে যাচ্ছে।–১৯৮৩
.
০১.
বাঙাল নদী পদ্মা এখানে বন্ধনে পড়েছে, ‘বিরিজ’ বলে লোকভাষায়। দুর্ধর্ষা গণগামিনী গঙ্গাকে সে কোন তরুণ আদর করে পদুমা–পদ্মা বলেছিলো এবং
আপন করেছিলো তা কেউ বলতে পারে না; সে ভালোবেসেছিলো কিন্তু বন্ধন। করার চেষ্টা করেনি। তার সর্বনাশা কূলনাশিনী গতিকে শ্রদ্ধাও করেছিলো। এখন ভালোবাসা বংশধরদের রক্তে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভয়ের সমন্বয়ে সব চিন্তা সব ভাবনার পিছনে ধর্মের অদৃশ্য দৃঢ় ভিত্তি হয়ে আছে।
রেলের লোহার আলকাতরা-মাখানো বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে পুরো আকাশের দিকে চেয়েছিলো। তার মাথার উপরে একটি বিরলপত্র শিশু ছাতিমের শাখা, বাকিটুকু চৈত্রমাসের আকাশ। ইতিমধ্যে রোদ কড়া হয়ে উঠেছে। দূরের দিকে বায়ুমণ্ডল ঝিলমিল করে কাঁপছে। চিলগুলো খুব উঁচু থেকে পাক খেতে-খেতে খানিকটা নেমে এসে উল্টোপাকে আবার উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। ডানদিকে আকাশের গায়ে লোহার ব্রিজ।
স্টেশনে লোকজন নেই। সুরো-সুরতুন্নেছা–প্রায় একা ট্রেনের প্রতীক্ষা করছে। প্ল্যাটফর্মের বিপরীত প্রান্তে একটা হাত-তিনেক উঁচু তাঁবু খাড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছে। তাবুর কাছে রূপালী রং করা গুটিকয়েক টেলিগ্রাফের পোস্ট, পাকানো তারের বান্ডিল। সেগুলো এত উত্তপ্ত হয়েছে, মনে হয় চোখে লাগবে সেদিকে চাইলে। পেতলের বড়ো বড়ো থালা মেজে নিয়ে কয়েকজন। মজুর আধঘণ্টা আগে শেষবারের মতো তাঁবুতে ঢুকেছে। কোন দেশীয় এরা কে জানে। পশ্চিমের নয়, তা পুরো ওদের কথায় বুঝতে পেরেছে। কুচকুচে কালো, চুলগুলি ভেড়ার লোমের মতো, চোখগুলো লাল করর্চা। পায়ে ভারি-ভারি জুতো, কালচে-সবুজ রঙের প্যান্ট পরনে।
ব্রিজটা অত্যন্ত উঁচু, তার ধরাছোঁয়া পাওয়ার জন্য গ্রামের জমি থেকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মও উঁচু। এত উঁচু যে বড়োবড়ো তালগাছগুলিও পায়ের নিচে থাকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে। সেই তালগাছগুলির পায়ের কাছে পোডোজমির মধ্য দিয়ে গ্রামে যাওয়ার পথ।
প্ল্যাটফর্ম থেকে ঢালু হয়ে জমি নেমে গেছে গ্রামের মাটির দিকে, সেই ঢালু বেয়ে পাকদণ্ডির মতো আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা উঠে এসেছে। সেই রাস্তার পাশে সোনালি-লতায়-ঢাকা আমগাছের আড়াল থেকে একটা ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আগুন নাকি? ভাবলো সুরো। নিচের দিকে ভালো করে তাকালো সে আবার। ধোঁয়ার পাকটা এগিয়ে আসছে। ধুলোর থাম–তাহলে বোধহয় পাল্কি আসছে, বেহারাদের পায়ে-পায়ে ধুলো উড়ছে, ঘূর্ণিপাকের মতো হচ্ছে এলোমেলো বাতাস লেগে–এই ভাবলো সুরো। সে ভালো করে চেয়ে দেখলো–একজন। কে আসছে ঘোড়া ছুটিয়ে।
ক্লান্ত অলস অবসর। সে সোজা হয়ে বসলো।
জল ও জঙ্গল নিয়ে জাঙ্গাল-বাঙ্গাল বাংলা দেশের এক গৈ-গাঁয়ের মেয়ে সুরো। ব্রাত্য ‘সান্দার–বংশে তার জন্ম। বাপ নেই ভাববে, মা নেই কাঁদবে। গাঁয়ের পরিসীমার সঙ্গে সম আয়ত ছিলো তার মনের বিস্তার। গ্রামের মধ্যে গাঁ, বড়ো গ্রামের অংশ ছোটো গ্রাম। পদ্মার চরে বসানো গাঁয়ের একটির নাম বুধেভাঙা, তারই মেয়ে সে। বাউলপীরের গানে-গানে ছড়ানো, কথক-পাঠকের মুখে-মুখে রঙানো ধর্ম-দর্শন ন্যায়-নীতির প্রবেশ হয়নি তার মনের সীমায়।
ধান যখন নতুন বউ-এর মতো পাত্রে-অপাত্রে অকাতরে সলজ্জ হাসি বিলোচ্ছে তখন আহার করা, এবং ধানের দিন সরে যেতে-যেতেই উপোস শুরু করার অভ্যাস ছিলো তার। কিন্তু বাঙাল নদীর দু-পাড়ে সেবার এক দুর্ভিক্ষ এলো। তারপর গ্রামের বাইরের জীবন।র্যাল, হাউইজাহাজ, সোলজর। আঘাতে-আঘাতে তার মনের পরিসীমা বিস্তৃত হতে লাগলো। বাঙালনদীর হংসপক্ষ বিধূত একটি দৃশ্যপটে সহসা যদি বনরাজির মাথা ছাড়িয়ে ধোঁয়াকলের চোং জেগে ওঠে, যদি চোং-এর ফাঁকে-ফাঁকে হাঙর রং-এর লোহার পাখি গর্জন করে উড়ে যায়, সুরোর মনের তুলনাটা দেওয়া যায় তাহলে।
ট্রেনের অপেক্ষা নয়, প্রতীক্ষা করছে সে। এ স্টেশনটায় মেল ট্রেন থামে না। কিন্তু ফুলটুসি তাকে বলেছে আজকাল বড়োবড়ো ট্রেনগুলিও আকস্মিকভাবে এ স্টেশনে থেমে যায়, সাহেব সুবো নামে কখনো কখনো, বেশিরভাগই নামে বুট-পরা, প্যান্ট-পরা মজুররা। এখানে সুবিধা এই, পুলিসের ভয় এখানে কম। দিঘার স্টেশনে চালের কারবারিদের পুঁটুলি নিয়ে পুলিসের লোকেরা বড়ো জুলুম করছে কিছুদিন ধরে। এখানে তাদের চোখের আড়ালে কিছু করা যায় কিনা এ-খোঁজ নেওয়াও তার উদ্দেশ্য। কিন্তু কোনো ট্রেন না-থামতেও পারে, কোন ট্রেনটা থামবে তারও নিশ্চয়তা কিছু নেই। সকাল থেকে দু-তিনখানা না-থেমে চলে গেছে, যে-কোন একটা থামবেই এই আশা নিয়ে পুরো প্রতীক্ষা করছে।
ধড়মড় করে উঠে বসলো সুরো এবং অনুভব করলো নিশ্চয়ই সে একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলো। চোখ মেলে যা সে দেখলো তাতে মুখে কথা সরলো না। চারহাত উঁচু নিরেট পুলিসের থাম। দিঘা থানার বড়ো দারোগা ছাড়া আর কেউ নয়। পুরো পৃথিবীতে কোনো দারোগাকেই চিনতো না, কনক হোক কিংবা হিরণ। কিন্তু এমন প্রকাণ্ড, এমন সুন্দর কনক ছাড়া আর কে হবে। সান্দারদের মুখে গত দু-তিন বছর ধরে কথা। কিন্তু স্বজাতীয়দের আলাপ থেকে যা কল্পনা করেছিলো সুরো তার চাইতেও দৃঢ় এর দাঁড়ানোর ভঙ্গি, তার চাইতেও ফর্সা। খাকি। রং-এর বুক-খোলা সার্ট; টুপির নিচে কৌশলে বসানো রুমাল দিয়ে দুটি কান, ঘাড়ের অনেকটা ও খানিকটা করে মুখ ঢাকা। সুরো চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকালো। চকচকে লাল চামড়ার হাঁটু পর্যন্ত উঁচু জুতো। জুতো নিয়েই জন্মেছিলো নাকি? নতুবা এ-জুতোয় পা যায় কী করে? কিন্তু পরক্ষণেই ধকধক করে উঠলো সুরোর বুক, আর কিছু দেখবার সাহস অবশিষ্ট রইলো না তার।
সান্দারদের জাতশত্রু পুলিস। শত্রুতা এখনকার দিনে আর সক্রিয় নয়। সরকারের কাগজপত্রে সান্দারদের নাম অপরাধপ্রবণ উপজাতি হিসাবে লেখা আছে। তারই নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সান্দারপুরুষকে সপ্তাহে একদিন গিয়ে থানায় হাজিরা দিতে হয়। এটা সয়ে গিয়েছিলো। তবু জাতশত্রুতা এমনই জিনিস, থানা থেকে ফেরার পথে কখনো কখনো কোনো এক সান্দারের মেজাজ বিগড়ে যেত, পুলিসকে উত্ত্যক্ত করার জন্যই পথ চলতে কারো পকেট কাটতো, কিংবা দোকান থেকে দুটো টাকার মাল সরাতে। হৈ-হৈ-পুলিস আর সান্দারে দ্বন্দ্ব। কিন্তু যুদ্ধের পরিবর্তে সে-সব আন্তর্জাতীয় ফুটবল খেলা। কনকদারোগা দিঘায় আসার পর থেকেই ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়েছিলো। সান্দাররা এমন ভয় কোনো দারোগাকে কোনোদিন পায়নি। দুরন্ত ছাত্র যেন হঠাৎ এক কড়া মাস্টারমশাইয়ের সম্মুখে পড়ে কী করে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কনকের দৃষ্টি সান্দারদের অন্তস্তল দেখতে পায়। অন্য কোনো দারোগা হলে পুরো ব্যাপারটাকে নিছক দুর্ঘটনা মনে করতো। ভাবতো, ভাগ্যের বিরূপতায় দারোগার পরিক্রমায় সে পড়ে গেছে। বে-আইনি চালের কৌশলগুলি প্রয়োগ করে দারোগাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতো। কিন্তু কনকদারোগা, কনকদারোগাই। এ কথা না-ভেবে বলা যায়, ভাবলো সুরো, কনক তার খোঁজেই এই দুপুর-রোদ মাথায় করে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে।
কনকদারোগা বললো, বাড়ি কোথায় তোর? উত্তর পাওয়ার আগেই ধমক দিয়ে উঠলো, চোপরাও বেটি, মিথ্যে বলবি তো–
জে, বুধেডাঙা।
স্ত্রীলোক না-হলে কনকদারোগা তার অনুশীলিত ইংরেজি গালির বাংলা তর্জমায় তাকে বিধ্বস্ত করে দিতো। নিজেকে একটু সামলে সে বললো, সান্দার?
কুণ্ঠা ও ভয়ের দলাটা গলা থেকে নামিয়ে সুরো বললো, জে, চালের কারবার করি। এখন চাল সঙ্গে নাই।
কনক হো-হো করে হেসে উঠলো। প্ল্যাটফর্মে সুরো ছাড়া দ্বিতীয় শ্রোতা নেই, হাসিটা প্রতিধ্বনিত হয়ে নিজের কানে ফিরে আসতেই হাসিটার মাঝখানে কেটে একটা কথা বসিয়ে দিলো সে–সুরো তুই?
সুরো এবার উচ্ছিত জানুতে মুখ গুঁজে বন্দুকের গুলির প্রতীক্ষা করে কাঁপতে লাগলো।
কনক বললো–আমি সব খবর রাখি। তুই, ফতেমা, এসব কে-কে চালের চোরা কারবার করছিস খবর পেয়েছি। তা কর, কর। কী করবি আর!
সুরো মুখ তুলে দেখলো কনকদারোগা প্ল্যাটফর্মের অপর প্রান্তে চলে গেছে। জুতোর চাপে গুঁড়ো পাথরগুলো সরসর করছে। কী-একটা যন্ত্র বার করে কনক একবার পরীক্ষা করলো। দারোগার কোমরে চামড়ার খাপে যখন ঝুলছে তখন বন্দুক ছাড়া আর কী! ছোটো বন্দুক, এই ভাবলো সে। এই দুপুরের নিস্তব্ধতায় কনক যদি একটা গুলি তার বুকে বসিয়ে দেয়, কেউ জানতেও আসবে না, খোঁজও করবে না। কিন্তু তবে আর দেরি কেন? সহসা তার মনে হলো :কার কাছে যেন সে শুনেছিলো কনক সান্দারদের একরকম ভালোবাসে। কনকের বোধহয় কষ্ট হচ্ছে, অপরাধের শাস্তি দিতে তার মন সরছে না। সুরোর মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে কনক আবার তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
তুই তো সান্দারদের মেয়ে, চিকন্দির সান্যালবাড়িতে গিয়েছিস কখনো?
জে, গেছি।
সান্যালমশাই-এর ছেলেপুলে কটি জানিস? তাঁর বড়োছেলেকে দেখেছিস?
জে, না।
তুই দেখবি কী করে! কনক আবার দূরে চলে গেলো।
অনেক নিচে স্টেশনবাড়ি। সেখানে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা পড়লো। গাড়িটা এখনই এসে পড়বে, তারই প্রস্তুতি। কিন্তু প্রস্তুতি বলতে যা বোঝায় তা নয়। টিকেট কাটার সোরগোল নেই, কুলিদের হাঁকাহাঁকি নেই। দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে মাত্র দুজন লোক স্টেশন থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে এলো। তাদের মধ্যে একজনের হাতে নিশান, আর-একজন সম্ভবত কৌতুকপ্রিয় দর্শক। কনক একবার ঘড়ি দেখলো। তাহলে এ-গাড়ি আজ এখানে থামবে? উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষণিক একটা তাগিদ সুরো অনুভব করলো, পরমুহূর্তে কনকের উপস্থিতি সেটাকে মিইয়ে দিলো।
গাড়ি থামলো। জানলা দিয়ে কৌতূহলী যাত্রীরা মুখ বাড়িয়ে দেখলো স্টেশনটাকে। কেউবা এই প্রথম পদ্মা দেখছে, বললো তার কথা। নিশানওয়ালা নোকটা গার্ডের সঙ্গে কী কথা বলে ছুটলো ড্রাইভারের কাছে আর-একটি কথা বলতে।কনক ক্ষিপ্র নিপুণ হাতে টান দিয়ে উর্দিটা ঠিক করে নিলো, টুপিটা মাথায় আর-একটু কষে বসিয়ে দিলো, পাশে খাপে-ঢাকা রিভলবারে হাত দিয়ে একবার অনুভব করলো, তারপর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।
গাড়ির একটি কামরা খুলে আঁকা নিয়ে দুজন গ্রাম্য চাষীনামলো৷ ধুলোমাটির তৈরি সহিষ্ণু ক্লান্তির মুখোশ আঁটা তাদের মুখে, অন্য কোনো অনুভবের লেশ নেই তাতে।কনক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে দেখলো৷ ছ’ফুটের কাছাকাছি উঁচু বলে যাকে বর্ণনা করা হয়েছে এ দুটি চাষীর একটিও সে নয়।
প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি উঁচুশ্রেণীর একটি কামরার দরজা খুলে একটি মহিলা নামলো। একটি সাধারণ মেয়ে, রুক্ষ চুলগুলো উড়ছে, পরনে সাধারণ শাড়ি। নিজের হাতে ছোটো স্যুটকেসটি নামালো, গাড়ির ভিতর থেকে একজন সুবেশ য়ুরোপীয় তার ছোটো হোল্ডঅলটি নামিয়ে দিলো। স্যুটকেস-হোল্ডঅল স্টেশনে নামিয়ে মহিলাটি য়ুরোপীয়টিকে হাত তুলে নমস্কার করলো।কনক এগিয়ে গেলো মহিলাটির দিকে, তাকে দেখতে নয়, য়ুরোপীয়টিকে লক্ষ্য করতে। তার ঋজুতা লক্ষণীয়। কিন্তু কনককে বুট ঠুকে স্যালুট করতে হলো। লোকটি পুলিসসাহেব স্বয়ং। কিন্তু একটা পা কাঠের বলে তিনি যুদ্ধে যেতে পারেননি।
গাড়ি ছেড়ে দিলে কনক প্রথমে ভাবলো ফাঁইলটা যখন ওঁর সামনে যাবে তখন উনি নিশ্চয় বুঝবেন এ-স্টেশনে কী করছিলো কনকদারোগা ধড়াচূড়া এঁটে। খুশি হলো কনক, সেই খুশি মন নিয়ে সে মহিলাটির দিকে ফিরে চাইলো। ছোটো নাক, ছোটো কপাল; দেহবর্ণের। অনুজ্জ্বলতাকে ছাপিয়ে উঠেছে ঠোঁট দুটির গড়ন। আর চোখ! কনক কৌশল করে দ্বিতীয়বার চোখ দুটি দেখে নিলো। যেন একটি মীনের ছায়া জলের তলায় স্থির হয়ে আছে, এখনই চঞ্চল হয়ে উঠবে। চোখের প্রান্ত দুটি রক্তাভ।
আপনি চিকন্দি যাবেন?
মহিলাটি একটা ক্ষীণ হাসি দিয়ে কনকের প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করলো, পুলিসদের সব খবরই রাখতে হয়। যাব চিকন্দি, কিন্তু কেউ নিতে আসেনি। একটা গাড়ি-টাড়ি–
ওসব এদিকে পাওয়া যায় না। আপনি নিশ্চয়ই এই প্রথম আসছেন। সান্যালদের কারো বাড়িতে যাবেন?
আপনার অনুমান ঠিক।
সান্যালমশাই-এর বড়োছেলেকে আপনি চেনেন?
আপনাদের বড়সাহেব, ওই যে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন, তাঁর সঙ্গেও এই আলাপই হচ্ছিলো। খোঁজটা আমিও নেবো। এতদিন ধারণা ছিলো আমার, তিনি আপনাদেরই কাছে আছেন। দিন-পনেরো আগে কলকাতার পুলিস তাকে অ্যারেস্ট করেছে।
তিনি?
তিনি আমার স্বামী।
কনক দৃশ্যত অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। রক্তবিন্দুলেশহীন কপাল ও সিঁথি থেকে চোখ নামিয়ে সে বললো, আচ্ছা, আমি একটা পাল্কি পাঠিয়ে দেবো।
মহিলাটি আবার হাসলো, এ জেলায় ঢুকবার সঙ্গে-সঙ্গে প্রথমে পুলিসসুপার, তারপর আপনি, মোটামুটি পুলিসই আমাকে সাহায্য করছে। ধন্যবাদ।
কনক মহিলাটির কাছে বিদায় নিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে টুপি খুলে ঘাম মুছলো। ক্লান্তি বোধ হচ্ছে তার। পিস্তল উচিয়ে একটা সাধারণ ডাকাত ধরতে যাওয়ার চাইতে অনেক বেশি ক্লান্ত হতে হয় এসব ব্যাপারে।
সুরো গাড়ির দিকে এক পা এগিয়েছিলো, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলাটির সঙ্গে আলাপ। করার জন্য কনক এগিয়ে এলো। সুবোর মনে হলো যথেষ্ট করুণা করেছে কনক, কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে তারই সামনে গাড়িতে উঠে বসতে গেলে সে ক্ষমা করবে না।
কিন্তু বিস্ময়ের চাইতে বিস্ময়, উঁচু কেলাসের গাড়ি থেকে নামে যে-ভদ্রলোকের মেয়েছেলে সে-ও কি চালের কারবার করে!নতুবা দারোগা অমন খবরাখবর করে কেন? ওর বোধহয় বাক্স বিছানা বোঝাই চাল। চাল, তুমি কত রঙ্গই দেখালে!কন তাহলে ওর খবর পেয়েই এসেছিলো, তার নিজের মতো পাঁচসের চালের কারবারিকে ধরতে দারোগার নিজের আসা একটু অস্বাভাবিকই বটে, এখন ভাবলো সুরো।
তবু কনকদারোগার ব্যবহার চিরকালই সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। ধরতেই যদি আসা, ধরলো না কেন?
সুরো উঠে দাঁড়ালো। আজ আর কোনো গাড়িই ধরবে না। তাহলে কোন দিকে যাবে সে? দেড় ক্রোশ পথ ভেঙে গ্রামে যাওয়া যায়, কিন্তু কাল সকালেই আবার দেড় ক্রোশ পথ বেয়ে আসতে হবে স্টেশনে।নতুবা যাওয়া যেতে পারে দু ক্রোশের পথ দিঘায়। সেখানে অনেক গাড়ি থামে উত্তরে যাওয়ার। না-ও যদি পাওয়া যায়, মাধাই বায়েনের ঘরে এক রাত বিশ্রাম নেওয়া যাবে।
সে দিঘার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
সুমিতি নিস্তব্ধ স্টেশনটির চারিদিকে চেয়ে দেখলো। পুলিসের ছোটোবড়োদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যা হয়নি এখন সেটা হলো, বিজন স্টেশনটায় বসে নির্জনতায় তার গা ছমছম করে উঠলো। ডানদিকের ব্রিজটাই বোধহয় সভ্য জগতের শেষ সীমা। এপারে গাড়ি পাওয়া যায় না এমন দেশ। গ্রাম সম্বন্ধে সমিতির ধারণা একেবারেই নেই তা নয়। রাজনৈতিক কাজে সে গ্রামে গিয়েছে। সেসব গ্রাম ম্যালেরিয়াজীর্ণ; ডোবা-জঙ্গল ও ক্ষয়িষ্ণু ভগ্নস্তূপে ভরা! কিন্তু সেসব গ্রামে গিয়েছে সে পার্টির মোটরে, সঙ্গে সমবয়সী ছাত্রছাত্রী। মোটর না চলেছে তো গোরুগাড়ির বন্দোবস্ত আগেই করা থাকতো। চড়ুইভাতির উন্নততর সংস্করণ সেসব পরিক্রমা–এই ধারণা এখন সুমিতির। এখানে এমনি বসে থাকার চাইতে পুলিসের সাহচর্যও ভালো ছিলো। দারোগাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েছে, মনে হলো সুমিতির। লোকটি ভদ্র, সঙ্গে থাকলে কিছু-একটা ব্যবস্থা না করে পারতো না। পাল্কি পাঠাবে বলে গেছে বটে, কিন্তু অনেক পুরুষের ক্ষেত্রেই সুমিতি দেখেছে, সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দিয়ে কাজ করানো যত সহজ, অলক্ষ্যে থেকে নির্দেশে ততটাকরানো যায় না। সুমিতির সেক্সপীয়রকর্ষিত মনে যে কথাটা কাঁটা দিয়ে উঠলো সেটা এই : সৌন্দর্য, সোনার চাইতেও কাউকে কাউকে বেশি প্রলুব্ধ করে।
সান্যালরা জমিদার, কিন্তু তাদের সেই দুর্গকত মাইল দূরে কে জানে। বঙ্কিমচন্দ্রের ইন্দিরার কথা মনে পড়ে গেলো সুমিতির। তার মনে হলো চূড়ান্তভাবে–এতদিন যে-সব প্রতিপক্ষের সম্মুখে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সে বিখ্যাত হয়েছে তারা ডাকাতে রাজনৈতিক মত পোষণ করে, কিন্তু ডাকাত নয়।
সে চিন্তা করতে লাগলো, ওই মেয়েটির মতো নিরাভরণ এবং মলিন মোটা শাড়ি পরে এদেশে আসা উচিত ছিলো কিনা; ঠিক এমন সময়ে হই-হুঁইশব্দ করে চার-পাঁচজন বেঁটে শুটকো লোক আলকাতরা রাঙানো একটা কাঠের বাক্স নিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাক্সটির গায়ে লম্বা দাঁড়া লাগানো, আর সেই দাঁড়ায় কাঁধ দিয়ে বাক্সটিকে লোক ক’টি বয়ে আনছে দেখে সে বুঝলো পাল্কি সেটা। সে তার সজ্ঞান জীবনে এই প্রথম একটি পুলিসকে ধন্যবাদ দিলো এবং ধন্যবাদ দিতে গিয়ে ইংলন্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়কে প্রশংসা করলো। মনে-মনে বললো, লোকটি ইংলন্ডের পুলিসদের মতো।
কিন্তু প্রথম কথা ঐ বাক্সে ঢোকা, দ্বিতীয় কথা বাক্সে ঢোকামাত্র লোক ক’টি তাকে ভুমি থেকে সংস্পর্শশূন্য করে কাঁধে তুলবে। তারপর তাদের খুশির উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
বেহারাদের আভূমি-আনত সেলাম সে দেখতে পায়নি, এবার তাদের সসম্রম আহ্বানে ফিরে দাঁড়িয়ে তাকে হাসতে হলো। হাসিই একমাত্র মনোভাব যেটা টেনে এনে অন্য মনোভাব ঢাকা যায়। সুমিতি ভয় ঢেকে ভয়ে-ভয়ে বললো, সান্যালদের বাড়ি চেনো?
জে, মাঠান, তেনারা মুনিব।
তোমরা পথ চিনে নিয়ে যেতে পারবে তো?
জে, আপনি উঠলিই গেলাম।
যদি দরকার হয় কাল তোমাদের দারোগাসাহেব খুঁজে পাবেন?
তা আর পাবেন না! তিনি তো আমাদের বাড়ির পরে ঘোড়া থামায়ে পাঠায়ে দিলেন।
সুমিতি ওদের প্রদর্শিত উপায়ে পাল্কিতে উঠে বসলো। লোকগুলি অনাহারজীর্ণ কিন্তু অভ্যস্ত হাতে মোটগুলো পাল্কির ছাদে বেঁধে নিয়ে এক নিমেষে পাল্কিটা শূন্যে তুলে ফেলো। দুহাতে পাল্কির দেয়াল আঁকড়ে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে সুমিতি চিকন্দির দিকে রওনা হলো।
০২. মাথার উপরে প্রখর সূর্য
মাথার উপরে প্রখর সূর্য, মেঠো ধুলোর পথে পা পুড়ে যাচ্ছে। কাপড়ের পাড় দিয়ে বাঁধা জট-পড়া লালচে চুলের খোঁপাবাঁধা মাথাটা ক্লান্তিতে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। রোদে উত্তপ্ত হয়ে তার কটা রং লালচে দেখাচ্ছে। হাঁটার তালে তালে ডান হাতখানি দুলছে পুরুষালি ভঙ্গিতে। সে-হাতের উপরে নীল উল্কিতে আঁকা ডানা-মেলা-এক পক্ষী।
ডানা ম্যালেছে পক্ষী! স্বগতোক্তি করলো সুবো।কথাটা অন্যের মুখে শোনা। মাধাই বায়েনই বলেছিলো একদিন তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে।
মাধাই বায়েন (কখনো মাধব বাদ্যকর) আমার-তোমার চোখে নীল, কখনোবা খাকি উর্দিপরা একটি রেলওয়ে পোটারমাত্র।বড়োবড়োচুলে পাতাকাটা সিঁথি, পায়ের মাপের চাইতে বড়ো একজোড়া চপ্পল পায়ে শিশ দিতে-দিতে যে বন্দর দিঘার স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে এর-তার সঙ্গে ইয়ার্কি মেরে বেড়ায়, সুবোর হাতে সে-ই নীলপক্ষী আঁকিয়ে দিয়েছে। সুরোর হাতে একজোড়া বাঁকা তোবড়ানোকালচে কাসার চুড়ি ছিলো এককালে। মাধাই একদিন চুড়িজোড়া খুলে ফেলে দিয়েছিলো তার অনুমতি না নিয়ে, তার বদলে কিছুই আর পরতে দেয়নি। ব্যাপার দেখে সুরো সাবধান হয়ে গিয়েছিলো। ছোটোবেলা থেকেই দস্তার যে-চিকটা তার গলায় ছিলো সেটা নিজেই একদিন খুলে ফেলেছে।
এখন সুরা মাধাই বায়েনের ঘরের দিকেই চলেছে। মাধাই তাকে চালের ব্যবসায়ের হদিশ বলে দিয়ে রওনা করে দিয়েছিলো।
সে আর কী করেছে তার জন্য, ভাবতে গিয়ে কোথায় আরম্ভ করা যায় খুঁজে পায় না সুরো। মাধাইয়ের মুখে সে শুনেছে: পশ্চিমের মজুররা ইট তৈরি করছিলো দিঘা আর চিকন্দির মধ্যে এক মাঠে। অনাহারের প্লাবনের মধ্যে আহারের দ্বীপগুলির অন্যতম সেটি। আহারের আশায় না হোক, জলের আশায় ইট তৈরির ভেজানো কাদার একটা তালের কাছে সুরোর দেহটা মুখ গুঁজে পড়ে ছিলো। মাধাই তাকে দিঘা বন্দরে তার নিজের ঘরে তুলে এনেছিলো। কী করে আনলো?মাধাই বলেছে–তুই কী এমন ছিলি, হাড় কখানাই ছিলো। তাই সম্ভব,নতুবা মাধাইয়ের এমন-কিছু মজবুত পালোয়ানি দেহ নয়।
সুরোর যখন খেয়াল করে দেখবার-শুনবার অবস্থা হলো সে দেখেছিলো, একটা স্বল্পপরিসর ইটের ঘরের মেঝেতে সে শুয়ে আছে, আর তার মুখের উপরে ঝুঁকে আছে একটি অপরিচিত পুরুষের মুখ। মাধাই তখন অপরিচিত ছিলো। অন্নের উত্তাপে দেহ আতপ্ত হয়েছে তখন, মনের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলি ফুটি-ফুটি করছে। পরিধেয়ের সন্ধান করতে গিয়ে সে দেখেছিলো, একটুকরো কোরাথান যেমন-তেমন করে তার গায়ে জড়ানো।
এবার পুরুষটি কথা বললো–তোর কাপড়টা ফেলে দিলাম। যা ময়লা, আর পিঁপড়ে কত!
একটু পরেই আর-একজন পুরুষ ঘরে এসেছিলো। তখন সুরো বুঝতে পারেনি, এখন তার মনে হয় সে ডাক্তার। কিন্তু মাধাই কী বলেছিলো মনে আছে আমার বুন, গাঁয়ে ছিলো।
সুরতুন্নেছার পক্ষী-আঁকা হাতখানি ঘন-ঘন দুলতে লাগলো। তার মন কল্পনায় বহু সময় লঙঘন করে যাচ্ছে।
একদিন তার প্রশ্নের উত্তরে মাধাই বলেছিলো–যে-কেউ চোখে পড়তো তাকেই আনতাম, তাকেই খাওয়াতাম।
পৃথিবীতে থাকার মধ্যে মাধাইয়ের এক বুড়ি মা ছিলো। যতদিন মাধাই গ্রামে ছিলো মায়ের সঙ্গে তার সদ্ভাব ছিলো না। বুড়ি যদি ক্ষুধার মুখে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে না-পারতো মাধাই তাকে মারতো ধরে ধরে। আসের বেহদ্দ ছিলো সে। কিন্তু গ্রামে অনাহার এসেছে এই খবর পেয়ে সে গিয়েছিলো রেল-কোম্পানির-দেওয়া র্যাশানের চালডাল নিয়ে মায়ের জন্য। সংবাদটা কেউ তাকে দেয়নি। মায়ের পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা থালাবাসন, ঘেঁড়াখোঁড়া কাপড়চোপড় ঘটনাটা রাষ্ট্র করে দিয়েছিলো। ধূলায় আচ্ছন্ন ক্লান্তমুখ চোখের জলে আবিল করে সে ফিরে আসছিলো। পথের ধারে পড়েছিলো সুরো। মায়ের বুভুক্ষু আত্মার তৃপ্তি হয়েছিলো কিনা কে জানে, মাধাইয়ের শূন্যীভূত আত্মা একটা অবলম্বন পেয়েছিলো।
কিন্তু এ-উত্তরটা মনে-মনে উচ্চারণ করে সুরো সুখী হতে পারে না। মাধাই তার দ্বিতীয় ১ বারের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো–একদিন তুই আমার হয়ে চোরের মার খেয়েছিলি, সেজন্যে।
সেই বিশ্বব্যাপী অনাহারের দিনের আগেও সুরোর মতো যারা তাদের অনাহারের দিন ধানের । ঋতুগুলির মধ্যেও ইতস্তত ছড়ানো থাকতো। পৃথিবীতে সে একা। তার বাবা বেলাতআলির মৃত্যুর পরও সে কী করে খুঁটে খেয়ে বারো থেকে আঠারোতে সম্পূর্ণ একা-একা পৌঁছেছিলো, ভাববার বিষয়। তার পিতৃধনের মধ্যে ছিলো একখানি কুঁড়ে, একটি গাভী।
তখন একনাগাড়ে দু-দিন ধরে তার অনাহার চলছিলো। ছোটো নিচু খড়ের চালাটার নিচে সে আর তার গর্ভবতী গাভীটি। খালি পেটে এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভোরবেলা সে উঠে বসলো। ভাবলো, উঁশ কামড়াচ্ছে বোধ হয়। গাভীটাকে কাল থেকে বাইরে বেঁধে রাখবে স্থির করলো। ওটা বিয়োলে একটা হিল্লে হয়।
ক্ষুধার ব্যাপারটা একবার যদি মনে পড়েছে ঝাড়া দু-ঘন্টা লাগবে তোমার ভুলতে–একথায় ওকথায় ফিরে-ফিরে মনে পড়ে যাবে।
সান্যালবাড়ির তেঁকিশালের কাছে বোকা-বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলে পেট ভরার মতো ভাত রোজই পাওয়া যায়। কিন্তু পথের প্রতিবন্ধক দেবীদাস আছে। বুধেভাঙা চিকন্দি যাওয়ার পথে তার বাড়ি। মাহিষ্য দাসদের দেবী সান্দার-ছেলেদের খেলার সঙ্গী ছিলো, সুরোর বাল্যপরিচিত। কিন্তু দেবীর গলা একদিন ভার হলো। মাথায় বেড়ে ওঠার চাইতেও স্বরের পরিবর্তনটাই বেশি লক্ষণীয়, সেটা যেন রাতারাতি হলো, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি। সুরোকে আগেও দেখেছে দেবী, কিন্তু এ-দেখা অন্যরকম। দেবীদাসের ভয়ে সুরোর এ-পথে চলা কঠিন।
ভয়ের মূলে আছে তার অল্পবয়সের একটি বেদনার ঘটনা। তার বাবা বেলাত আলি তখন জীবিত। তার ফিরবার পথের দিকে চেয়ে দশ-এগারো বছরের সুরতুন্নেছা ঘাটিয়ালের ঘাটের চালায় অপেক্ষা করছিলো। শুকনো খটখটে সন্ধ্যা-আবির ছড়ানো, ঝিঁঝি ডাকা, উদাসকরা সেই সন্ধ্যায় ঘাটের অনতিদূরে ধর্ষিতা হয়েছিলো সে।
গোরুটিকে দড়ি ধরে বাইরে নিয়ে এসে ঘরের সম্মুখে বাবলার চারাটায় বেঁধে দিয়ে চারিদিকে তাকালো সে। তখন সম্ভবত পৌষ মাস। হালকা একটা কুয়াশার আবরণ মাটির আধ হাত উপর পর্যন্ত নেমে এসেছে। রজব আলি সান্দারের বাড়ির দুখানা খড়ের ঘর আর খড়ের গাদাটি আসলগুলির ছায়ার মতো চোখে পড়ছে। রজবআলির বাইরের দিকের ঘরখানির সম্মুখে তার ছোটো ধানের মরাইটার পাশে বাঁশের খাঁচায় বসানো চারিতে মুখ দিয়ে তার দুটি বলদ, দু-তিনটি বকনা গাই হুস হুস করে খড়-ভেজানো জল খাচ্ছে, চপ চপ খস খস শব্দ হচ্ছে। বলদগুলোর মুখে, সট সট করে বাবলার শুকনো বিচি চিবুচ্ছে গাইগোরুগুলো।
আগে রজব আলির মতোই ঘর ছিলো সুরতুনদের। গাই-বলদ ছিলো না তেমন কিছু পাঁঠা বকরি ছিলো। এখন মাত্র একটা কাঠা জমির উপরে একখানা চালা দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের পেছন দিকের বেড়া ঘেঁষেই আজকাল রজব আলির জমি। সামনের দিকের কয়েক পা গিয়েই সুরতুনের জমির সীমানা শেষ, তার পরই রজব আলির ভূঁই। বেলাত আলি নাকি জীবিতকালে রজব আলির কাছে ধান ধার করেছিলো, সেই ধানের মূল্য রূপে রজবআলি জমিগুলি দখল করেছে।পিতামহ আলতাপজীবিত থেকেও রজব আলির কাজকে ধিকৃত করেনি, সেক্ষেত্রে এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে। সুরো কী করতে পারে?
কুয়াশা প্রায় কেটে গেছে। বাঁ-দিকের দু-তিনটি গোরুর রং স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আর দেরি করা যায় না।আল থেকে নরম মাঠে নেমে সোজাসুজি পাড়ি দিয়ে সুরতুন গিয়ে দাঁড়ালো লালচে রঙের বলদটার পাশে। সেটার আড়ালে হেঁট হয়ে পাশের ছোটো বকনাটার চারি থেকে পটু হাতে জানার জল হাতড়ে কুচোনো খড় আর বাবলার বিচি তুলে নিলো কেঁচড়ে। তারপর আল ডিঙিয়ে অন্য আর-একটি খেত পার হয়ে নিজের ঘরের পেছন দিয়ে ঘোরাপথে এসে দাঁড়ালো নিজের গোরুটার সামনে।
–খা, খা। কয় যে খাতি দিবি বাবলার দানা, দুধ হবি বটের আঠা।
গোরুটির খাওয়া হলে তার দড়ি ধরে সুরো পথে বার হলো। আলের পথের শেষে জেলাবোর্ডের পথটা সে আড়াআড়ি পার হলো। পথের ওপারে কাশজাতীয় বুনোঘাস এক কোমরের চাইতেও বেশি উঁচু হয়ে উঠেছে। কিন্তু জমিটা সেদিকে নিচু বলে ঘাসগুলোর মাথা জেলাবোর্ডের রাস্তার এপার থেকে বড়জোর আধ-হাতটাক চোখে পড়ে। ঘাসবনের ভিতর দিয়ে গোরুটাকে টানতে টানতে সুরতুন ওদিকের জমিটায় সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে সেটাকে বেঁধে দিলো।
গোরুকে সে একটু বেশি যত্ন করে দেখে লোকে তাকে ঠাট্টা করে, কিন্তু সে নিরুপায়। অন্য সময়ে গোরু ছেড়ে দেওয়া চলে। রাত-চরা-ধূর্ত গোরু সহজে ধরা পড়ে না, কিন্তু এখন বেচারার বড়ো কাহিল অবস্থা, মস্ত বড়াই বোধ হয় হবে বাছুরটা। কোথাও না বাঁধলে চলে না। গোরু বাঁধতে বাঁধতে তার মনে হলো মেয়েমানুষেরও বোধ হয় এমনি কাহিল অবস্থা হয়, নড়তে-চড়তেও অসুবিধা। কিন্তু সেদিন অসময়ে রজব আলি মাঠ থেকে হন্তদন্ত ফিরে এলো। বাড়ির সামনের জমিটুকু পার হতেও যেন তার তর সয় না, সেখান থেকেই হাঁক দিতে দিতে সে বাড়ির দিকে দৌড়ে এলো–ইয়াকুব, ইয়াকুব!
ছেলে ইয়াকুব ছিলো বাড়িতে, বাপের উত্তেজনায় হাসিমুখে সে বললে–চেঁচাও কেন্, আগুন লাগছে নাকি?
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে রজব আলি বললোব খাবের দিছিলো কেডা?
–জাব তো আমিই মাখে দিছিলাম, কেন্ হলে কী?
–হলে কী? শালা গিধর, বাড়া মরে যে, ধলিডা।
–কও কী?
মুহূর্তে পিতার উত্তেজনা ইয়াকুবে সংক্রামিত হয়ে গেলো–তাইলে অষুধ করছে বোধায়। হা রে খোদা!–বলে রজব আলি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই বসে পড়লো।
ইয়াকুব বললোবসলি কি হবি? বদ্যি খবর দিতি হবি। চিকন্দির রাম মণ্ডলে নাই পাই কেষ্টদাসে আনবো। তুমি তৎক্ষণ উয়ে তেঁতুল-জল খাওয়াও, তামুক-জল খাওয়াও। হাওয়ায় ভেসে ইয়াকুব দৌড় দিলো মাঠের উপর দিয়ে আল টপকাতে টপকাতে।
রজব আলির উত্তেজিত স্বরে আকৃষ্ট হয়ে যারা এসেছিলো তাদের মধ্যে ছিলো ইয়াকুবের স্ত্রী ফতেমা। তার পরীর ভয় ছিলো। জিন পরী মানুষের কাছে ঘোরাফেরা করে তার এই ধারণার কথা পরিবারের সকলেই শুনেছে, তা নিয়ে হাসাহাসিও করেছে।
সে ঘোমটার আড়াল থেকে শাশুড়িকে বললে–আমি যে কই, রোজ সকালে একটা পরী ঘুরঘুর করে চারিগুলার কাছে।
কথাটা রজব আলির কানে গেলল। সে বললে–তুই দেখছিস্ পরী?
–আপনেক আগুনের বোঁদা দিয়ে গোয়াল সুরবের গেলাম, আপনে গেলেন বাড়ির ভিতর। তখন দেখলাম পরী আসে জান্নার চারিতে হাত দিয়ে কী যেন করতিছে।
–ই আল্লা, কস কী! তারপরে করলে কী পরীডা?
কী যেন তুলতিছে চারি থিকে আর চাবাতিছে মটমট করে।
রজব আলি তেঁতুলগোলা জল, তামাকপাতার জল, আগুন জ্বালার কাঠ নিয়ে মাঠের দিকে তেমনি হন্তদন্ত ছুটলো। একটা বড়ো মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তার গা শিউরে উঠলো পরী ঘোরে? সর্বনাশ। চাবায়ে-চাবায়ে খায় কী পরী? জিন্দা গোরুর কলিজা নাকি?
বকনাটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা হলো। চিকন্দির রামচন্দ্র এসেছিলো। ফতেমা কালীর কাছে মানত রেখেছিলো। কিছু করা গেলো না।
রজব আলি অপ্রতিভের মতো মুখ করে বললো–পরীর কামভাই, রোজাকীকরবি? রামচন্দ্র ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী রোজা নয়, বৈদ্য। পরীর গল্পটা সে ধৈর্য ধরে শুনলো কিন্তু মাথা নেড়ে বললো–এ যদি কুকুরমারা বিষ না হয় কী কইছি। চিকন্দিতে একমাসে পাঁচটা গোরু মরেছে।
সন্ধ্যায় দুঃখিত মনে অন্য গোরুগুলি তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে রজব আলি তামাকে হাত দিয়েছে, গোরুগুলি ছাড়া পেয়ে চারির দিকে ছুটেছে, এমন সময়ে সুরতুন এসে হাঁ-হাঁ করে তাড়ালো সেগুলোকে।
–কেন্ রে, তাড়ালি কেন্?
সুরতুন বলেছিলো–আমার মনে কয় উয়েতে বিষ আছে। কোন্ চারিতে আছে কিবা করে কবা।
–ঠিকই কইছি, জল বদলাতি হবি। সরায়ে বাঁধ রে, ইয়াকুব।
সুরতুন উসখুস করে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। দুঃসংবাদটা সে ঘরে বসেই পেয়েছে। রজব আলির যেবাছুরটা আজ মারা গেছে সেটার চারি থেকেই খড় চুরি করে নিজের গোরুটাকে দিয়েছিলো কিনা, মাথা কুটলেও এ-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। বিষ এখনো ধরেনি, কিন্তু তাতেই কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে বিষ ধরার সম্ভাবনা নেই।
শুকনো মুখে পুরো প্রশ্ন করেছিলো–চাচা, এক চারি পানিতে বিষ মেশালে কয়ডা গোরু মরে।
রজব আলির মাথায় তখন অন্য গোরুগুলির নিরাপত্তার কথা ঘুরছে, রাগ হচ্ছিলো গোরুগুলোর উপরে। শালার জেতের খাওয়ার কামাই নি। দুইপর রাতে কলার পাতে মুড়ে সামনে যা কেন দ্যাও, উঁস করে খায়ে ফেলাবি। আর তার উপরে আছে এই ভয়ংকর পাপের প্রতিবিধিৎসা। শিশুর মতো অবুঝ প্রাণী, তাকে কিনা খাবার নাম করে বিষ তুলে দেয়। সুরোর কথা সে শুনতে পেলো না।
ইয়াকুবের স্ত্রী ঘড়ায় জল এনে দিয়েছে হাত-পা ধোবার। সেই কাদায় ভারি ময়লাটে জলে হাত-পা ধুতে ধুতে মনটা যখন রজব আলির একটু স্থির হয়েছে, তখন ইয়াকুবের স্ত্রী বললো–সুরো কচ্ছিলো অও নাকি পরী দ্যাখছে! ও কয় বেটা ছাওয়াল, আমি কই মিয়ে মানুষ।
রজব আলির হাত-পা ধোয়া বন্ধ হয়ে গেলো, সে সাগ্রহে প্রশ্ন করলো–সুরো বেটা-ছোওয়াল দ্যাখছে?
পুরুষই যদি হয় তবে কাল্পনিক জিন বা পরী নয়। তাদের চাইতে শতগুণে বীভৎস দুশমন, মানুষ–যে বিষ দেয় গোরুকে।
ঘরে ফিরে সুরতুন তখন দু-তিনটে পাটকাঠি একত্র করে একটা মশাল বানিয়ে নিজের গোরুটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখছে। যে-চারিটায় খাচ্ছিলো রজবআলির মৃতবৎসটি সেটা থেকেই নিজের গোরুটাকে খড় এনে দেয়নি এমন প্রমাণ নেই,বরং এনে দিয়েছিলো একথাটাই আশঙ্কিত মনে দৃঢ়মূল হয়ে বসেছে। এমন সময় রজব আলি ডাকলো তাকে।
সেই পরীর কথা আবার। ফতেমা যখন চোখ বড়ো বড়ো করে গল্প করেছিলো, সে এক। পরীকে রোজ সকালে গোরুর চারির কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে তখন সুরতুনের অন্তস্তল শুকিয়ে গিয়েছিলো। সে নিজে জিন পরীমানেনা, কাজেই তার বিশ্বাস হলো ফতেমা যদি সত্যিই কাকেও দেখে থাকে তবে সে তাকেই দেখেছে। কী সর্বনাশ! সে তখন ফতেমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বললো–আমিও দেখছি পরী, খুব কাছে দাঁড়ায়ে দেখছি। ইয়া গালপাট্টা তার, একমাথা ঝাকড়মাকড় চুল। ফতেমার তাক লেগে গিয়েছিলো।
কিন্তু রজব আলি যখন তার দরজায় এসে হাঁক দিয়ে দাঁড়ালো তখন ভয়ে হকচকিয়ে পুরুষ জিনের কথা বলতে পারলো না সে। সে নিজেই সকালে চারির কাছে যায়, বলে ফেলো।
–গেছিলি কে, তাই ক। সুরতুন নির্বাক।
–কেন তাই ক।
সহসা রজব আলির মনে হলো সত্যটার তলদেশও সে দেখতে পেয়েছে : এটা সুরতুনের অকারণ জ্ঞাতিবৈর সাধন। জ্ঞাতির মেয়ে কিনা তাই।
প্রথম চড়টা খেয়ে সুরতুন হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো, কিন্তু উপর্যুপরি চড় পড়তে লাগলো যখন, বোবা কান্নায় হাহাকার করতে লাগলো সে। পড়শির ভিড় জমে উঠলো রজব আলির উঠোনে। সুরতুনের গায়ের কাপড়টুকু দড়ির মতো পাকিয়ে তার গলা টেনে ধরেছে রজব আলি। অস্পষ্ট আলোয় সুরতুনের পিঠের ও পাঁজরার হাড়গুলো চোখে পড়ছে, তার ধূলিমলিন বুকের মেদহীন আকুঞ্চিত স্তন দুটি।
.
মাধাই বায়েন বিষ দিতো গোরুকে।
চামড়ার ব্যবসায়ী সানিকদিয়ারের কফিলুদ্দি সেখ। বাবোখানা ছাল পৌঁছে দেবার বরাত নিয়ে মাধাই আষাঢ় মাসে পঁচিশ টাকা আগাম নিয়েছিলো তার কাছ থেকে। কিন্তু বরাত রাখা সহজ কথা নয়। সে ছাড়াও ছাল তুলবার লোক এঅঞ্চলে আছে, কেউ-কেউ আবার কফিলুদ্দির মাইনে করা।
তিনখানা ছাল পৌঁছে দেবার পর বিপদে পড়লো মাধাই, আর গোরু মরছে না এ অঞ্চলে। ওদিকে কফিলুদ্দির তাগাদা। তাগাদা শুধু মুখেই নয়,হাটফেরতা পথে গালমন্দও বটে। এই পথে নামলো মাধাই। দুমাসে চারটি গোরুকে বিষ দিয়েছিলো সে; কিন্তু সব ক’টির ছালই যে তার হাতে পৌঁছেছে এমন নয়, তিনটিই অন্যের হাতে পড়েছে। যত ঝুঁকিই সে নিয়ে থাক, যত কৌশলেই সে কাজটা করে থাক, তার দাবির যুক্তিটা প্রতিপক্ষকে বলা যায় না। নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে সে? কিন্তু কফিলুদ্দির কাছে সমব্যথা আশা করার চাইতে তার আত্মহত্যা আশা করা সহজ। সে ছাল চায়, যেমন চৈতন্য সাহা চায় দাদন-দেওয়া পাট। অন্য কোনো কথা বোঝার ব্যাপারে অত্যন্ত নির্বোধ বলে মনে হয় তাদের দুজনকে।
চিকন্দিতে গোরু কম। যাদের আছে তারা হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। বুধেডাঙায় গোরুর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু সান্দারদের ঘরে যেতে সাহস হয় না। সুরতুন যে মারটা খেয়েছিলো তাতেই মাধাই গুড়ো হয়ে যেতো। সব চাইতে মুশকিল করেছে রামচন্দ্র। যে-বিষ কফিলুদ্দি নিজে নারকেলডাঙা থেকে আনিয়ে দিয়েছিলো গোবধের জন্য তার কাছে রামচন্দ্রর ওস্তাদি হার মেনেছে। কিন্তু রামচন্দ্রর মণ্ডলগিরির প্যাঁচে হার মানতে হলো কফিলুদ্দিকে। গোরু মরলে মাটিতে পুঁতে ফেলছে গ্রামবাসীরা।
কয়েকদিন ধরে নানারকম উল্টোপাল্টা ভেবে আবার প্রথম যে রাতে মাধাই কলাপাতায় মুড়ে বিষমাখানো ভাত নিয়ে বেরিয়েছিল রামচন্দ্র মণ্ডলের হাতে ধরা পড়ে গেলো।
বুধেভাঙা আর চিকন্দির সীমায় হাঁক দিলো রামচন্দ্রকে যায়? ছুটে পালাতে গিয়ে মাধাই বুধেভাঙার পথ ধরেছিলো; কিন্তু বুধেডাঙায় রজবআলি সান্দার জেগে ছিলো। মনে হলো সে গলায় খাকরি দিয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো। সেও যেন হাঁক দিলো–কে যায়?
মাধাই আর পারলো না। দৌড়তে গিয়ে তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। পিছন থেকে রামচন্দ্র তার বিষসুদ্ধ হাতখানা চেপে ধরেছিলো। বৈদ্যর চোখে দেখামাত্রই ধরা পড়েছে। অপরিসীম ঘৃণায় তার হাত ছেড়ে দিয়ে রামচন্দ্র বললো–তুই না হিঁদু!
মাধাই কাঁদতে পারলোনা।বুকের মধ্যে থেকে আইঢাইটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
–গাঁ ছাড়বি? মণ্ডলি গলায় বললো রামচন্দ্র।
–ছাড়ব, আজ্ঞা।
–যা!
সম্মুখের দিকে একটা ধাক্কা দিলো রামচন্দ্র। উল্টে পড়ে গিয়ে মাধাই সহসা উঠতে পারলো না। বুকের ভিতরে ছুরি বেঁধার মতো ব্যথা করছে। দম যেন নেওয়া যাবে না আর। খানিকটা সময় বসে থেকে কোনরকমে উঠে মাধাই বুধেভাঙা ছাড়িয়ে দিঘার পথ ধরেছিলো।
সে বলেছিলো একদিন–প্রথমে হাসি-হাসি মুখে শুরু করে শেষের দিকে বাবরিচুলসমেত মাথা দুলিয়ে কথার ফাঁকে ফাঁকে ডাইনে বাঁয়ে থুথু ফেলে। রামচন্দ্র মণ্ডল বলেই নাকি সেদিন তার প্রাণটা রক্ষা পেয়েছিলো। বিড়ালছানার মতোশূন্যের দিকে করে গ্রামের সীমার বাইরে তাকে ফেলে দিয়েছিলো রামচন্দ্র, ইচ্ছা করলে অনায়াসেই মাটিতে দু-চার বার আছড়ে সে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও করতে পারতো।
মাধাই বলে–আমার হয়ে তুই সেদিন মারটা খেয়েছিলি, আর তাতেই রজব আলির রাগ পড়ে গিয়েছিলো, নতুবা ঐ মারটা আমাকে মারলে আমি বাঁচতাম না।
এটা এক ধরনের কৃতজ্ঞতা হতে পারে, কিন্তু এরই জন্য একটি মানুষ আর-একজনকে পথ থেকে বুকে করে কুড়িয়ে আনে না। আর যদি এই সামান্যটুকুর জন্যই করে কেউ, তবে সে মহৎ মানুষটিই চামড়ার লোভে কখনো গোরুকে বিষ দিতে পারে না।
অন্তত একাহিনীতে এমন কিছু নেই যাতে বোঝা যাবে সুরাকে চিকন্দির পথ থেকে কুড়িয়ে এনে শুধু তখনকার মতো প্রাণ বাঁচানোই নয়, তার ভবিষ্যতের ব্যবস্থাও কেন সে করে দিয়েছে।
টেপির মায়ের দলে ভর্তি হয়ে এক শহরের চাল পুলিসের চোখ আড়াল করে আর-এক শহরের বাজারে নেবার কাজ করে পুরো পৃথিবী সম্বন্ধে কিছু কিছু জ্ঞান সংগ্রহ করেছে। এখন তাদের নিজেরই একটা দল আছে। যাদের মাধাই নেই তাদেরও কেউ কেউ অবশ্য এই পথ নিজেরাই আবিষ্কার করেছে। কিন্তু সুবোর মতো একটি গেঁয়ো-মেয়ের পক্ষে তা সম্ভব ছিলো না। আর শুধু কি তাই? চেকার বলল, পুলিস বলল, তাদের ভয়ে যখন প্রাণ শুকিয়ে আসে তখন দিঘার শত শত মাইল দূরে থেকেই গাড়ির কামরার জানলায় মুখ গলিয়ে দিঘা বন্দরের মাধাইয়ের জন্য সুরো চোখ মেলে রাখে। পুলিস থাক, চেকার থাক, গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে মাধাইকে কোথাও না কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে। হয় সে স্টেশনের কনেস্টবলদের সঙ্গে রসিকতার গা তুলে দিয়েছে, কিংবা কোনো রেল কর্মচারীর সঙ্গে নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে গল্প করছে।
এমন যে মাধাই, ভ্রাতা নয় শুধু রক্ষীও, ফতেমা বলে–সোনাভাই, তাকে কি সাহস করে জিজ্ঞাসা করা যায় তার কোনো কাজের কারণ? দেবতাকে কে কবে জিজ্ঞাসা করেছে খরা বা বর্ষার কারণ, বলো?
কিছু-কিছু পরিবর্তন হয়েছে মাধাইয়ের। খরখর করে কথা বলতো, তড়বড় করে চলতো, এ যেন সে মাধাই নয়। গত কয়েক খেপ চাল নিয়ে ফিরে সুরো এটা লক্ষ্য করেছে। মাধাই এমন ধীরস্থির ছিলো না চিরকাল। বরং অসম্ভব ফুর্তিবাজ ছিলো। স্ফুর্তির কথায় ঘটনাটা সুরোর মনে . পড়ে গেল।
সুরো জানতো, টেপির মা এবং অন্য দু’একজন গাঁজা খেতো। দু’একজন চালওয়ালি মদ ধরেছিলো। নেশার ঘোরে তারা অশ্লীল কথাবার্তা বলতো। এই তাদের স্মৃর্তি করা। মাধাই একদিন তাকে বলেছিলো–মাঝে মাঝে ফুর্তি করবি, নইলে কাজে জোর পাবিনা। মাধাই একথা বলার আগে টেপির মা প্রভৃতি দু’একজন সুরোকে তার গম্ভীর চালচলনের জন্য পরিহাস করেছিলো। তখন মাধাই তার স্টেশনের ডিউটিতে যাচ্ছিলো। তাদের পরিহাস শুনে একটু থেমে মাধাই বলেছিলো কতকটা যেন একটি শিশুকে প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গিতে-ওকে যে অত কও, ফুর্তি ও একদিন আমার সঙ্গে করবি।
মাধাই স্ফুর্তি করার প্রস্তাবটা যখন সোজাসুজি তার কাছে তুলো সুরো একটা বোবা ভয়ে ঘামতে লাগলো। কিন্তু অনাহারের বন্যায় তার ক্ষীণ মুঠি ধরে যে-পুরুষমানুষটা তাকে বাঁচিয়েছিলো, তার হাত হারিয়ে ফেলার ভয়ে সুরো মাধাইয়ের পিছন পিছন বাজারে গিয়েছিলো। অবাক করলো মাধাই। বাজারে ঢুকে মদ-গাঁজার দোকানের ধার-পাশ দিয়েও সে হাঁটলো না। সুরোর হাত ধরে, খুব সম্ভব সুরোই ভয়ে তার হাত চেপে ধরেছিলো, কেবল সে পাক খেয়ে বেড়াতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তারা গিয়ে বসেছিলো উল্কিওয়ালার সামনে।সুরোর ডান হাতের মণিবন্ধের কিছু উপরে একটি নীলপক্ষী ফরমায়েস করে আঁকিয়ে নিলো মাধাই, একটা লাল জমির ঠেটি শাড়ি কিনলো সুরোর জন্য। অবশেষে মাধাই বলেছিল–হলো ফুর্তি করা? অজ্ঞাত বিভীষিকায় তখনো সুরোর গলা কাঠ হয়ে আছে।
সুরো হাঁটতে-হাঁটতে তার নীলপক্ষীটার দিকে চেয়ে-চেয়ে দেখলো৷ কিন্তু এই দুপুর রৌদ্রের আকাশ, এ কি ফুর্তি করে উড়িয়ে দেয়ার বিষয়? সুরোর গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, ধুলো ও ঘামে মিশে কাদা জমে যাচ্ছে মুখের এখানে-সেখানে।
ফতেমার ব্যাপারে মাধাইকে স্ফুর্তির ব্যবস্থা করে দিতে হয়নি। মাধাই নিজেই বলেছিলোতোতে আর ফতেমাতে তফাত আছে। ভাবল সুরতুন: ফতেমার সঙ্গে তার আগেও পার্থক্য ছিলো, এখনো আছে। রজব আলি সান্দারের বেটা বউ,ইয়াকুবের স্ত্রী ফতেমা গোলগাল একটি একরোখা মুরগীর মত কুঁদুলি ছিলো। জিন পরীর ভয়ে সে বার হতো না বড়ো একটা, কিন্তু যখন বা’র হতো পাড়ার মেয়েরা তাকে মেনে নিয়ে সরে পড়তো। কিন্তু এসব ঘটতে ধানহীন দিনে। ধানের দিনের ফতেমা, সে আর-একজন। কোথায় বা জিনপরী, কোথায় কোন্দল। মাঠের ধান কেটে দিয়ে পুবদেশী মজুররা চলে যেতেই গ্রামের মেয়েরা ভোর রাতের অন্ধকারে মাঠে-পড়ে-থাকা ধান কুড়োতে যেতো। ফতেমা আসতো অন্যান্য সান্দার-মেয়েদের দলে। সেই ভোর রাতে আলো ফোঁটার আগেই ধান খোঁটার কাজ শুরু করতো তারা।কত গল্প, কত রসিকতা ফতেমার ভাঁড়ারে আছে, শুনে সান্দারদের মেয়েদের তাক লেগে যেতো। পাছে কৃষক শুনে। ফেলে তাড়া করে আসে, এই ভয়ে অন্য মেয়েরা যত তাকে হাসি চাপতে বলে তত তার আঁচল চাপা মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে হাসি বার হয়।
এখন সে ফতেমা নেই। শিশুদের গালের অতিরিক্ত মেদের মতো তার গায়ের মেদও ঝরে গেছে। তেল-চুকচুকে কাজলমাখা গৃহিণী নয়, রুক্ষ ধূলিমলিন যাযাবরের মতো দেখায় তাকে। কিন্তু সে যেন অনেক লম্বা হয়েছে আগের চাইতে, চোয়াল দুটি গালে স্পষ্ট হয়ে উঠে তাকে পুরুষ-পুরুষ দেখায়। মনে হয়, সে যেন পুরুষের মতো দৈহিক শক্তিও অর্জন করেছে। ধরা পড়ে গেলে হাতজোড় করে পুলিস বা চেকারের সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে যেমন, অপরিচিত শহরের তেলেভাজা জিলিপির দোকানের পাশে দল নিয়ে বসে হাসি-তামাশা করার বিষয়েও তেমনি সে অগ্রণী। কী করে সে দলের মাথা হয়ে উঠলো কে জানে। অথচ এই চালের ব্যবসায়ে সুরোই তাকে ডেকে এনেছিলো মাধাইয়ের অনুমতি নিয়ে।
.
বন্দর দিঘার এক গলিতে পৌঁছে সুরো পা দুখানিকে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। একটি শুকনো চেহারার বুড়ি দোকানটা চালায়। পানের দোকানের পাশ ঘেঁষে একটা নোংরা গলি পুবদিকে চলে গেছে। গলিটার দুপাশে ভাঙাচোরা ছোটো ছোটো ইটের বাড়ি। সুরোর সম্মুখে উত্তরমুখী পাথর-ছড়ানো রাস্তাটায় আধ মাইলটাক হাঁটলে মাধাই বায়েনের ঘর।
পান নিয়ে সুরো উত্তরের পথ ধরবে এমন সময়ে কে তার কাঁধে হাত দিলো। চমকানো সুরোর অভ্যাসগত। এতদিনের চালের কারবারেও সে এ-বিষয়ে নিঃশঙ্ক হতে পারেনি। তার কাঁধে যে গত দিয়েছিলো তাকে দেখে সুরো সম্ভ্রমে সরে দাঁড়াচ্ছিলো, কিন্তু সেই আগ বাড়িয়ে কথা লিলো, সুরো না?
হ্যাঁ।
তাহলে চমকালি কেন? আমি টেপি।
টেপিই বটে। কিন্তু চেনা অসম্ভব। চালওয়ালি টেপির মায়ের টেপি নয়, এ যেন কোন-এক ভাসান পালাগানের বেহুলা সুন্দরী। তেমনি রঙিন শাড়ি পরনে, তেমনি একগা গহনা। চোখে কাজল, ঠোঁট পানের রসে টুকটুকে। মাস দু’এক আগে টেপি চালের মোকামে দলছাড়া হয়ে পড়েছিলো। এক চেকার তাকে বিনা টিকিটে চলার দায়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে রাখে। সুরোর ধারণা ছিলো টেপি জেলে আছে। কিন্তু দু-মাসেই মানুষের এত পরিবর্তন হয়?
তুই এখন কনে থাকিস, কী করিস? সুরো জিজ্ঞেস করলো।
এইখানেই। ঐ গলিটার মধ্যে এক বাড়ি আছে আমার।
তোর বাড়ি? ওখানে তো পাকাবাড়ি সব, ভদ্দরলোকেরা সব থাকে।
না থাকলেও তারা আসে। কেন, চেকার কি ভদ্দরলোক না?
চেকারবাবুর বাড়িতে কাম কাজ করিস?
কাম কাজ করবো কেন লো, আমি কি চেকারবাবুর ঝি?
সহযাত্রিণীর সৌভাগ্যে খুশি হলো সুরতুন, সে প্রশ্ন করলো, বিয়ে করছে?
টেপির মুখোনি ঈষৎ ম্লান হলো। সে বললো, না করছে ক্ষেতি কী? বউ না যে বকাবকি করবি, অচ্ছেদা করবি। এখানে দাঁড়ায়ে দ্যাখ, তার আসার সময় হতিছে। কিন্তু ফতেমা বুন যা কয় তাই সত্যি। ঠারেঠোরে বোঝার বয়েস তোর কোনোকালেই হবিনে।
টেপির কথার সুরে সুরো বুঝতে পারলো তার প্রশ্নটিতে টেপি খুশি হয়নি, কিন্তু তার বিরক্তির কারণটাও সে ধরতে পারলো না।
টেপি বললো, সে কথা যাক, তুই একা যে?
সুরতুন বললো, কী করি কও, সাহস পালেম না।
এরপর সে যা বললো তার সারমর্ম এই রকম : পরশুদিন দিঘার স্টেশনে পুলিসরা গাড়ি ঘেরাও করে চালের কারবারিদের ধরার চেষ্টা করেছিলো। সেই ভয়ে সে গাড়ির কাছে আর ভিড়তে পারেনি। ফতেমা, ফুলটুসি প্রভৃতি কয়েকজন মরিয়া হয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠেছিলো। শেষ পর্যন্ত তাদের কী হয়েছে কে জানে? এখন সুরতুন ছোটো ইস্টিশন থেকে আসছে। সেখানে পুলিস চেকার থাকে না এই শুনে সে গিয়েছিলো, কিন্তু কপাল যায় সঙ্গে। পুলিস বলতে দিঘা থানার কনকদারোগাই সেখানে ছিলো উপস্থিত। আশ্চর্য হবে তুমি, টেপি, উঁচু কেলাস থেকে যেসব মহিলা নামে তারাও চালের কারবার করে। এ অবস্থায় কী করতে পারে সুরতুন?
টেপি বললো, কিন্তু কোনো এক কিছু তো করা লাগবি।
কী করবো তা কতি পারো?
টেপি কিছুকাল ভেবে বললো, আছে এক ব্যবসা।
কও।
টেপি হেসে বললো, কাল দুইপরে আসিস, কবো।
সুরো আবার হাঁটতে শুরু করলো।
আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে টেপির, শুধু বেশভূষায় নয়, কথায়, ভঙ্গিতে। সব মিলে সে এক নতুন মানুষ। বয়সে টেপি তার চাইতে ছোটো কিন্তু সে-ও যেন বুদ্ধিতে তাকে ছাড়িয়ে গেলো। এখন সে ব্যবসায়ের ফিকির বলে দেয়।
অন্য কাউকে না বললেও নতুন ব্যবসায়ে নামতে হলে মাধাইকে অবশ্যই বলতে হবে। তার অনুমতি নিয়ে, পুরো স্থির করলো, একদিন সে আসবে টেপির কাছে খোঁজ নিতে। :
আর টেপির নিজের কথা। না, সেটা মাধাইকে বলা যাবে না। তাদের দলের অন্য অনেকে এসব ধরনের কথাবার্তা রসিয়ে রসিয়ে বলে। সুবো স্তব্ধ হয়ে শোনে, শুনতে তার ভালো লাগে না। গা গুলিয়ে ওঠে, পালাতে ইচ্ছা করে তার। আর, তার যে এমন হয় একথাটাও প্রকাশ করার উপায় নেই। একদিন মন খুলে একটু বলতেই টেপির মা ও ফতেমা বলেছিলো–এ এক রকমের রোগ। শুধু ফুলটুসি নামে যে ছোটোখাটো অকালে সন্তান-ভরাক্রান্ত মেয়েটি আজকাল তাদের দলে আসছে সে একদিন বলেছিলো–বিশ্বাস করবা না ভাই পুরুষের জাতকে।
চেকারকে সে এতদিন কালোকাপড়ে-মোড়া-নৈব্যক্তিক একটা আইন বলে মনে করেছে, যার চেহারা খানিকটা পুরুষের মতো। আজ টেপি চেকার জাতটিকেই চিনিয়ে দিয়েছে।কী বোকা সে নিজে! এতদিন চেকারদের থেকে আরো কেন সাবধান হয়ে থাকেনি, ভাবলো সুরতুন।
মাধাইয়ের ঘরের নিচু বারান্দাটায় পৌঁছে কিছুকাল একেবারে ঝিমহয়ে বসে রইলো সুরতুন। দুপুর রোদে দু-ক্রোশ পথ চলে সে যেন অন্তঃসারবিহীন হয়ে গেছে। চলার সময়ে এতটা বোঝ যায়নি।
শরীরটা একটু স্বাভাবিক হলে আবার দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে এলো। কী হবে তাহলে? চালের কারবার কি বন্ধ করতে হবে? অনাহারে মৃত্যু? ফতেমার সঙ্গে তার পার্থক্য আছে, আবার মনে হলো তার। ফতেমার গ্রামে ফিরলেও চলবে। কষ্ট হবে, অনেকদিনই তাকে অনাহারে থাকতে হবে, তবু তার শ্বশুর এবং সে দুজনের সম্মিলিত চেষ্টায় অর্ধাহারে দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু তার নিজের? এব্যবসা যত কষ্টের হোক, যত বিপজ্জনক হোক, এ ব্যবসায়ে নামার আগে আহার যে এমন নিয়মিত হতে পারে এ-ও সে জানতো না। পুলিসের ভয় ছিলো, চেকারের ভয় ছিলো। কিন্তু ছোট স্টেশনটাতে কনকদারোগার উপস্থিতি পুলিসি ভয়কে সহ্যাতীত করেছে, এবং টেপির কথা শুনে এবং টেপিকে দেখার পর চেকার আজ এক নতুনতর বিভীষণ মূর্তি নিলো। হায় হায়, সে কী করবে!
কিছু পরে সে অবশ্য স্থির করলো, মাধাই আসুক। যা করার সে-ই করুক। তার নিজের বুদ্ধি আর কতটুকু।
০৩. অন্দরের আঙিনায়
অন্দরের আঙিনায় সকালের পায়চারি ও আলাপচারিতা শেষ করে সান্যালমশাই কাছারিবাড়িতে এসে বসেছেন। আমলারা আসেনি, কাছারিবাড়ির বুড়ো চাকরটি সান্যালমশাইয়ের ফুর্সির জল বদলে অন্যান্য হুঁকোগুলোর দিকে মন দিয়েছে।
সান্যালমশাই বসতেই সে নিবেদনের ভঙ্গিতে বললো, তামাক দি, কর্তা?
তামাক? না, থাক।
সান্যালমশাই তামাকটা খুব বেশি খান। অনেকের চোখে তিনি ও তার তামাক অবিচ্ছেদ্য। ভৃত্যটি হুঁকোয় জল বদলাতে বদলাতে তার মুখের ভাবটি পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অসুখ বিসুখ করলে কিংবা খুব ক্রুদ্ধ হলে তামাকে তার মন থাকে না। এটা এদের সকলেরই জানা। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করা কাছারিবাড়ির প্রথা নয়। অন্দরের কোনো ভৃত্য হলে হয়তো সাহস করে প্রশ্ন করতে পারতো।
ভৃত্য চলে গেলে সান্যালমশাই ভাবলেন, দ্যাখো অভ্যাসটা কী! তামাকের নাম শুনে তিনি প্রায় হাত বাড়িয়েছিলেন। অথচ কাল রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে তিনি চিন্তা করে স্থির করেছেন তামাক খাওয়া কমিয়ে দেবেন। স্বাস্থ্য? না। সংযম? দূর করো। এ বয়সে সংযম-অসংযমের প্রশ্ন আর ওঠে না। পঞ্চাশ পার হলো। শুধুমাত্র স্নায়ুগুলিকে আর-একটু থিতিয়ে দেওয়া, যাতে সেগুলি সহজেই উত্তেজিত না হয়ে পড়ে। আর এ কথাগুলি চিন্তা করতে গিয়ে তিনি তার আর এক সহগামীকে আবিষ্কার করেছেন এক মুহূর্তের জন্য যে কতগুলি অভ্যাসলব্ধ মুদ্রাদোষের সমুষ্টি, কতগুলি বাঁধিবুলির রেকর্ড। এবং এই সহগামীর নাম খুঁজে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পশ্চাতের আমি’ কথাটাই তার সম্বন্ধে প্রয়োগ করেছে। তখন সেই ‘পশ্চাতের আমি’র হাত থেকে আহোদ্ধার করার ইচ্ছাও তাঁর হয়েছিলো।
মামলাটা শেষ হবার আগে থেকেই এ সন্দেহটা হচ্ছিলো তাঁর, এটা না করলেও চলতো। কিন্তু সেটা যত সময় নিচ্ছিলো ততই স্নায়ু উত্তেজিত হচ্ছিলো আর ততই জেদের ফন্দি ফিকিরগুলো আসছিলো মাথায়।
যাক, হবার যা হয়ে গেছে।
কাল, রাত্রি তখন বারোটা, আইন-সেরেস্তার আমলা ব্রজকান্ত এসে খবর দিলো, মিটেছে। খবর দেওয়ার কথা ছিলো, সেজন্য সে নিজের বাড়িতে না গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে অত রাত্রিতে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো।
দোতলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে সান্যালমশাই নীরবে খবরটা উপভোগ করলেন, তারপর বললেন–তুমি তাহলে এবার বিশ্রাম নাও, দারোয়ানদের কাউকে বরং নিয়ে যাও, এগিয়ে দেবে।
সে চলে গেলে তামাক নিয়ে বসেছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন, আর নয়। মিহিরকে ডেকে একবার বলবেন ব্যাপারটাকে বরং তুমি ভবিতব্য বলে মেনে নিও। তাহলে আর জ্বালা থাকবে না।
দিনের আলোয় এখন তিনি অনুভব করছেন, রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এটা সম্ভব বলে বোধ হলেও, এ কথাগুলির দৈনন্দিন অর্থ সান্ত্বনাপ্রদ নয়। বরং মিহিরের মনে হতে পারে, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য। সময় তার কাজ করুক।
কিন্তু মোকদ্দমার সংবাদ প্রত্যুষেই ছড়িয়ে পড়েছিলো। রামচন্দ্র এলো, সঙ্গে আট-দশজন লোক।
রামচন্দ্রের হাতে একটা লাঠি, মাথায় গামছা বাঁধা। সে এসেই লাঠিসমেত সান্যালমশাইয়ের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলো। লাঠিটা রইলো তার পায়ের তলায়।
সান্যালমশাই বললেন–সকালেই খবর পেয়েছো বুঝি? কিন্তু একটা কথা তোমাদের বলে রাখি, এ নিয়ে কোনো হৈচৈ আমোদ-আহ্লাদের ব্যবস্থা কোরো না।
আজ্ঞা না কর্তা, তা হবে না।
তিনি বললেন, তোমাদের জেদ বজায় রইলো, কিন্তু আর টানাটানি কোরো না। এখন বরং মিহিরের কাছে যাও। আমি একটু কাজ করি।
রামচন্দ্র উঠবার ভঙ্গি করলো। বারান্দা থেকে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপরে সঙ্গের লোকগুলোকে বললো, রাজার কাছে কথা, তোমরাই বলো না কেন কী কথা আছে তোমাদের।
আর কেউ কথা বললো না, রামচন্দ্রকেই বলতে হলো।
আজ্ঞা, মামলার সাথে সামিল।
সান্যালমশাই একটু উত্তেজিত স্বরে বললেন–না-না। আর বোলো না।
মামলাটার সূত্রপাত করেছিলো রামচন্দ্ররাই এমনি করে সাধারণ কথাবার্তা থেকে।
মিহিরও সান্যালবংশের ছেলে। শৈশবে তার পিতার মৃত্যু হয়। তার মা অনেক কষ্টে ও গ্রামের চোখে সান্যালদের মর্যাদাবোধ ক্ষুণ্ণ হয় এমন অনেক কাজ করে তবে মানুষ করতে পেরেছিলো তাকে। এখন সে নিজের ভার নিজে নিয়েছে, কিছু কিছু সম্পত্তি বাড়িয়েছেও। উদ্যমশীল সে। কোনোনা-কোনো পরিকল্পনায় সে সবসময়েই লেগে আছে। ইতিমধ্যে সে নিজের বাড়ির চারিদিকে পড়ে যাওয়া প্রাচীরের জায়গায় নতুন প্রাচীর তুলেছে।
কিন্তু মিহির নির্দয়।
তার বাড়ির প্রাচীরের নিচে দিয়ে পশ্চিমমুখী একটা রাস্তা ছিলো। সরকারি রাস্তা নয়। তবু বহুদিন থেকে সাধারণের ব্যবহার্য বেশ চওড়া একটা পথ। চিকন্দি ও সানিকদিয়ারের সংযোগকারী সরকারি সড়কের বড়ো বৃত্তাংশটির দুই প্রান্ত যুক্ত করতে। সান্যালদের জমির উপর দিয়ে রাস্তা। মিহির একদিন বাঁশ আর কুলকাটা দিয়ে রাস্তার অনেকটা নিজের জমির সামিল করে ঘিরে নিলো।
রামচন্দ্ররা এসে এরই প্রতিবিধান চেয়ে নালিশ করেছিলো।
সান্যালমশাই একদিন মিহিরকে বলেছিলেন–পথটা বন্ধ করে দিলে? লোকের অসুবিধা হবে।
–জমিটা তো লোকের নয়, আমার।
তিনি হেসে বলেছিলেন–সব জমিই তো কারো না কারো। সব পথই তো কোনোনা-কোনো সান্যালের জমির উপর দিয়ে।
মিহির অগত্যা বলেছিলোলোক চলে কোথায় ও-পথ দিয়ে?
কিন্তু পথ সে খুলে দেবে না এটা বোঝা গিয়েছিলো তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে।
এই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই মামলা লাগলো। সান্যালমশাই থমথমে মুখ নিয়ে কাছারির দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন–নায়েবমশাই, মিহিরের বাড়ির নিচের রাস্তাটা আমার চাই। পুরনো কাগজ ঘেঁটে দ্যাখো একবার।
পুরনো কাগজ ঘাঁটা চললো। সারা গ্রামের কোথায় কতটুকু কোন সান্যালের, এর মোটামুটি হিসাব যত সহজ, সূক্ষ্ম হিসাব তত কঠিন। মোটা হিসাব নিয়ে রোজকার কাজ চলে,টাকা আদায় হয়, লাট দেওয়া চলে। সূক্ষ্ম হিসাব মামলা করে পেতে হয়, মামলা করে রাখতে হয়। সূক্ষ্ম হিসাবের মোট কথা এই সব জমির হিসাব জট পাকিয়ে সব সান্যালের বলে বোধ হয়। পরচা, দানপত্র, কটকোবলায় দুরূহ দর্শনের পাণ্ডুলিপি।
মামলা মানে টাকা নিয়ে খেলা। নিচের কোর্টেই কাগজপত্রের সীমাহীন ফর্দ নিয়ে যখন দাঁড়ালো সান্যালমশাইয়ের নায়েব, তখন মিহির হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। টাকার অভাবে ঠিক নয়, টাকা আঁকড়ে থাকার সহজ প্রবৃত্তিতেই বরং। সহজ বুদ্ধির অঙ্কে সে হিসাব করে দেখলো মামলার শেষ পরিণতি হাইকোর্ট। একতরফা ডিক্রি পেলেন সান্যালমশাই।
মামলাটা তার ভালো লাগেনি। জমিদারিবৃত্তিটাই মামলাসংকুল। মামলার ভয় না থাকলে এক পয়সা খাজনা আদায় হয় না। কিন্তু সেসব মামলার প্রবক্তা নায়েবমশাই, সেগুলিতে এমন করে রক্ত গরম হয়ে ওঠে না, এমন করে পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হয় না স্নায়ু। শুধু সম্মান রাখার এই মামলায় মিহিরকে নত করাই সার্থকতা। এ-সব আর ভালো লাগে না। যেন অন্য কেউ তাঁকে নিয়োগ করেছিলো এ ব্যাপারে।
সান্যালমশাই বললেন আবার–মিহিরের কাছেই বরং যাও একবার। সে-ই খুলে দেবে পথ।
তা নয়, আজ্ঞা। মিহিরবাবু সকাল থেকেই পথ খুলে দেওয়ার জন্য লোক লাগিয়েছেন।
তবে আর কী থাকতে পারে?
রামচন্দ্র সঙ্গীদের নির্দেশ করে বললো–কর্তা, এরা যে মরে। মরার বাড়া গাল নাই। তাই হইছে এদের। মিহিরবাবু এদের ভিটাছাড়া করবেন।
ব্যাপারটা এই : মিহিরের বাড়ির অনতিদূরে শাঁখারিদের পাড়া। একসময়ে খুব বাড়বাড়ন্ত ছিলো এ পাড়ার। এমনকী দালানকোঠা তোলার মতো সচ্ছলতাও হয়েছিলো ওদের কারো কারো। এখন যারা আছে তারা শাঁখা তৈরি করা ভুলে গেছে। যারা পেরেছে শহরে পালিয়েছে, যারা পালায়নি তাদের একাংশ উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করে ধুকছে, অবশিষ্ট চাষী হচ্ছে। পাড়াটার সবটাই মিহিরকে খাজনা দেয়। যেসব ভিটায় অধিবাসী নেই সেগুলি সে বাকি খাজনার দায়ে খাস করে নিচ্ছে। খাস করে নেওয়াটার ভালোও আছে। জঙ্গলের বদলে সেগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে মিহিরের বাগান হয়েছে। স্বাস্থ্যের পক্ষে এ-পরিবর্তনটা বোধ হয় ভালো। কিন্তু খাস করতে শুরু করে সে থামতে পারছে না, বাকি খাজনার দায়ে অনবরত এর-ওর নামে ডিক্রি আনছে। শাঁখারিদের মাতব্বরস্থানীয় হরিশচন্দ্র একদিন মিহিরের স্নেহ পেয়েছে। কিন্তু এই মামলাটায় সান্যালমশাই-এর নায়েবের চক্রান্তে মিহিরের বিপক্ষে সে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে। তাই মিহিরের লোক গেছে সদরে তার নামে মামলা করতে আজকেই রাত থাকতে উঠে।
কথাটা শুনে ভাবলেন সান্যালমশাই।
কিন্তু নীরবতায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লোক নয় রামচন্দ্র। একটু পরে সান্যালমশাই বললেন–এতে আমার আর কী করার আছে রামচন্দ্র, তোমরা যা বোঝে করো গে।
রামচন্দ্র তার গোঁফটিকে সূক্ষ্ম দু-ভাগে ভাগ করে নিলো। তারপরে বললো–রাজা যদি প্রজাকে রক্ষা না করেন, সে তো অরাজক, আজ্ঞা!
জুতসই কথা বলার সুখে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে লাগলো। সান্যালমশাই-এর বলতে ইচ্ছা হলো–আদালতে যাও তবে, রাজ্য চালানোর ভার আমার উপরে নেই। কিন্তু থামলেন তিনি। রামচন্দ্রর অবক্তব্য কিছু নেই। আদালতের কথায় হয়তো সে বলে বসবে–এই আদালত, ফিস দিব, আজ্ঞা করেন। লোকটি হামেশা আসে না কাছারিতে। খাজনা বাকি ফেলার দলে নয় সে যে তলব তাগাদায় হাজিরা দেবে।বরং তার উল্টো। খাজনা দেওয়ার সময় এমন ভাব দেখায়, যেন আরো বেশি খাজনা দিতে পারলেই সুখী হবে। তার কথাবার্তায় চালচলনে একটা নাটকীয়তা আছে। তার সরলতাকে কৃত্রিম বলে বোধ হয়।
রামচন্দ্র বললো, কর্তা, এ গাঁ গড়-চিকন্দি। রায়রা জমিদারি করেছে, সান্যালরাও। কিন্তুক কোনোদিন কোনো সান্যালকর্তা অত্যাচার করে নাই প্রজার উপর। লোকে কয়, কাছারি তো সান্যাল-কাছারি, যাও, বিচার পাবাই। দোষ করো, পায়ের কাছে লাঠি রাখে দণ্ডবৎ হও, সাতখুন মাপ। কর্তা, সেই সান্যালের দুয়ারে আসছি আমরা।
মামলাটার বিষয় নিয়ে যখন রামচন্দ্র এসেছিলো, সে দীর্ঘতর প্রশস্তি দিয়ে তার আবেদন শুরু করেছিলো। সেদিন সান্যালমশাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, এমনকী উভয় বংশের পুরনো কথা ভাবতে একসময়ে তার মনে পড়েছিলো সেকালের অত্যাচারী পুরুষদের কথা। তখন তার মনে হয়েছিলো, সেকালের সেই মহাবাহু বীর্যবান পুরুষদের যেন অত্যাচার-প্রবৃত্তি মানাতো, যেমন কোনো মহৎ শিল্পীর সুরাপান। তখনি তার মনে হয়েছিলো, মিহির তো সে সব পুরুষের মতো নয়, ডান হাতে তরোয়াল ধরে রাজার অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন সামন্ত নয় সে। সান্যালমশাই স্থির করেছিলেন পারুষ্য মিহিরকে মানায় না।
কিন্তু তখন ছিলো মনের অভিমান মত্ত অবস্থা। বাস্তবের আলোয় বিষয়টিকে হাস্যকর বোধ হয়। হাসিমুখে সান্যালমশাই ভাবলেন, কাকে মানায় না বা মানায়–এ প্রশ্নই নয়।কলকাতা থেকে দূরে থাকার ফলে কিছুদিন আগেও মধ্যযুগীয় সে সব প্রথার কিছু কিছু এ অঞ্চলে বেঁচে ছিলো, ক্রমশ সে সবও গত হচ্ছে। এখন অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভগবানের কাছে নালিশ হয় না, হয় আদালতে।
আর তাছাড়া এ ব্যাপারে অত্যাচারটা কোথায়? সান্যালমশাই ভাবলেন, সেকালে জমিদাররা অত্যাচার করতো, ভালোবাসতো। এখন দুটির কোনোটিই নয়। বাইরের শাসনের চাপে দুই-ই এক হয়ে গেছে প্রজা ও জমিদার। উপরে যে সরকার সে কি ভালোবেসে লাটটা কম করে নেয় কেউ অশক্ত হলে? আগাগোড়া হক বুঝে নেওয়ার ব্যাপার। যদি খাসমহলের প্রজা। হতো হরিশচন্দ্র, আদালতি পরোয়ানা ফিরতো যুক্তহস্তের মিনতিতে? কালেক্টর দয়া করতে না।
সান্যালমশাই বললেন–শোনো রামচন্দ্র, আজকাল তো প্রজারা আকচার নালিশ করছে জমিদারের নামে আদালতে। প্রয়োজন হলে তোমরাও তাই করো। খাজনা আদায় করা আমার কাছে অন্যায় নয়।
এদিকে রামচন্দ্রও দমবার নয়, সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, আজ্ঞা ন্যায়ের উপরেও ন্যায় আছে। আমরা অন্যায় করে স্বীকার কবুল করতেছি। আদালতে তাতে মাপ নাই, কিন্তুক বাপ। আর ভগোমান মাপ করে, আজ্ঞা।
রামচন্দ্রের বসার ভঙ্গিতে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে উঠলো কিছু একটা প্রতিকারের আশ্বাস–নিয়ে সে উঠবে না। কথায় কথাই বেড়ে যাবে। সান্যালমশাই বললেন–আচ্ছা তোমরা এখন যাও। আমি মিহিরের কাছে সব ব্যাপারটা আগে জেনে নিই।
রামচন্দ্ররা চলে গেলেনায়েব এলো সুমার বই নিয়ে। এটা প্রাত্যহিক কর্ম। গতদিনের সুমারের অঙ্কগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে তলায় একটা সই করে দেন সান্যালমশাই।
নায়েবের কাছ থেকে সুমার বই নিয়ে সান্যালমশাই বললেন–আবার কী গোলমাল লাগালো এরা, একবার দেখো তো। খাজনা দেবে না অথচ মিহিরকে অনুরোধ করতে হবে যাতে উচ্ছেদ না করে। মিহিরই বা শুনবে কেন?
আজ্ঞে, ধানটা উঠলে ওরা খাজনা শোধ করে দেবে হয়তো।
বলেছিলো নাকি? ধান উঠবার কত দেরি?
আর দু’একটা মাস যো-সো করে চালাতে পারলে আউস
তবে তোমার মহালগুলোতেও এখন বাকি খাজনার চাপ পড়বে না বলো?
আজ্ঞে। মাথা চুলকালো নায়েব।
তবে?
লোকের বসতবাটি কিনা। চাষের জমিগুলো গেলে তবু সহ্য হয়, বাসের কুঁড়ে গেলে বুকে বড়ো লাগে।
সুমার বই সই হয়ে গিয়েছিলো, নায়েব আর দাঁড়ালো না। নায়েবমশাই তার মামার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে চাকরিটা পেয়েছিলো, তেমনি পেয়েছিলো দুটি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। তার প্রথমটা হচ্ছে : এ বংশের নায়েবি করে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, মনিবের পরিবারের প্রায় একজন হয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বাজে টাকার লোভ রাখতে নেই। একদিন হয়তো সুমার বইয়ের অঙ্কের নিচে কলম বাধিয়ে তাকান এঁরা, ভয়ংকর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে : জিজ্ঞাসিত না-হলে কোনো প্রস্তাব করতে নেই।
কিন্তু আজ সান্যালমশাই নিজেই ডাকলেন নায়েবকে।
তামাক দিতে বলবো, হুজুর।
আচ্ছা, তা দিতে বলল।
তামাক এলো। আজ সকালে এই প্রথম তামাক। খানিকটা সময় সেটা নিয়ে ব্যস্ত রইলেন সান্যালমশাই, তারপরে বললেন–ধান ওরা বুনেছে, কিন্তু চৈতন্য সাহার হাত এড়িয়ে তা ঘরে তুলতে পারবে?
কিছু হয়তো পারবে।
সে-কিছুটা কতটুকু? তাতে খাজনা শোধ হয়?
আজ্ঞে! নায়েব থতমত খায়।
বাসের কুঁড়ের কথা বলছিলে। বুধেডাঙায় তুমি কী করছো? সেখানেও তো সান্দারদের বাসের কুঁড়ে।
এমন জেরায় পড়তে হবে জানলে নায়েব ওদের হয়ে কথা বলতো না। সে বিব্রতমুখে উত্তরের জন্য কাছারির দরজা আঙিনা ইত্যাদি অন্বেষণ করতে লাগলো।
আজ্ঞে, তাহলে কিন্তু আমরা সান্দাররা ফিরলে জমি ফিরিয়ে দেবো। আমরা না ধরলে চৈতন্য সা সব বেদখল করে নিতো।
ধোঁয়া ছেড়ে সান্যালমশাই হেসে বললেন–মামলাটার ঝোঁক তোমার এখনো কাটেনি। মিহিরের সঙ্গে আমার মামলা মিটে গেছে তুমি ভুলে গিয়েছিলে। আসলে মিহিরকে কিছু বলার কোনো যুক্তিই আমার নেই।
নায়েবের বলতে ইচ্ছা হলো-হরিশচন্দ্র মিহিরবাবুর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়াতেই এই বিপদ তার।
সান্যালমশাই বললেন–মিহিরের কাছে একবার যেও, অনুরোধ কোরো, যদি একমাস সে মাপ করতে পারে।
নায়েব চলে গেলো।
সান্যালমশাই-এর মনে হলো, মিহির তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনা দেখেই কি তিনি তাকে বিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন? তার সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে যে-স্বাতন্ত্র ছিলো সেটা কি তার মনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়াপাত করেছিলো? নিজের মনের স্বরূপ দেখে যেন তিনি বিস্মিত ও লজ্জিত হলেন। এরকম কেন হয়? পরে যা খারাপ বলে বুঝতে পারেন আগেই কেন তা অনুমান করতে পারেন না। এই অনুশোচনা হলো তার।
কাছারির সম্মুখে বিদেশী লাইম গাছটার পুরনো ডালে কালকের ঘুঘু জোড়া এসে বসেছে। বোধ হয় বাসা বাঁধবে। একটু পরেই দ্বিপ্রহরে স্তব্ধ বিশ্রামের নিকেতন হবে। তখন চঞ্চুচুম্বনের অবসরে ওরা দীর্ঘ টানা সুরে এক-এক বার ডেকে উঠবে।
ওদের কি মন আছে? চিন্তা করার মতো, স্মৃতি থেকে বিচারে পৌঁছবার মতো মন ওদের হয়তো নেই। সামান্যতম মস্তিষ্কও যখন আছে তখন স্মৃতি না-থাকার কী যুক্তি আছে বলো।
লাইম গাছটার পাতা নড়ে উঠতেই গাছটার গোড়ার কাছে রোদের সীমা এসে পৌঁছলো। বেলা তাহলে অনেকই হলো।
কাছারির সদর দরজার বাঁ-দিকে দুটি কাঠের খুঁটিতে একটি কাঠ আড় করে শোয়ানো, সেই শোয়ানো কাঠ থেকে ঝুলেছে পেতলের ঘড়ি। কিছুদিন আগেকার ব্যাপার, সান্যালমশাই দিনের বেলায় ঘড়ি পেটা বারণ করে দিয়েছেন। নতুবা সান্যালগিন্নি অনসূয়ার কাজের হাত থামতে চায় না। দুপুরের বিশ্রাম কুঁড়ে তিনি বলে বসেন–যাই, সময় হলো। আজ আবার ছানাটাও ওরা ভালো করে কাটতে পারেনি। পেটা ঘড়ি বন্ধ হওয়াতে প্রথম যেদিন সান্যালগিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সেই দুপুরের কথাটা মনে হওয়াতে কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সান্যালের দৃষ্টি। মামলার কয়েকটি দিন এসব তেমন নজরে পড়েনি। কী অন্যায়!
স্নানের সময় হয়েছে। এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে চাকরকে দেখতে না পেয়ে সান্যালমশাই ডাকে-আসা খবরের কাগজ আর চশমার খাপটি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চাকরও এলো।
দুপুরের ঘুম শেষ হয়েছে। শোবার ঘরের সবচাইতে ছায়া-গাঢ় কোণে গভীর একটা সোফায় ডুবে বসে আছেন সান্যালমশাই, চোখের সামনে বিলেতি পত্রিকা। তামাকের মৃদু-মৃদু শব্দ হচ্ছে।
রূপনারায়ণ মায়ের পাশে বসে ছবি আঁকছে। সান্যালগিন্নি অনসূয়া কী একটা সেলাই করছেন।
রূপনারায়ণ বললো, আজ সকালে রামচন্দ্ররা এসেছিলো কেন, বাবা?
পত্রিকার পৃষ্ঠা উলটিয়ে সান্যালমশাই বললেন–তুমি রামচন্দ্রকেও চেনো?
হ্যাঁ, লোকটি একটা কীর্তনের দল খুলেছে। ওরা বলে নাম কীর্তন করে বেড়ালে দেশের আধিব্যাধি দূর হবে। আমাদের বাড়িতে করতে চায় একদিন।
এতসব খবর তুমি কোথায় পেলে? সান্যালমশাই মৃদু-মৃদু হাসলেন।
একদিন ব্ৰজকান্তবাবুর কাছে বলছিলো ওদের একজন, শুনলাম। তোমার কাছে বলতে সাহস পায়নি।
সান্যালমশাই বই মুড়ে রেখে বললেন–ছোটোবাবু, তুমি চাঁদ কাজির গল্প শুনেছো? চার পাঁচশো বছর আগে একদল বাঙালি কীর্তন দিয়ে দেশের আধিব্যাধি দূর করতে চেষ্টা করেছিলো। তখন এ দেশের রাজা ছিলো কীর্তন শুনতে যাদের ঘোরতর আপত্তি। সেসব কীর্তনিয়া কিন্তু ভয় পায়নি।
তাহলে ওদের আসতে নিষেধ নেই তো?
ওরা তো কীর্তনের কথা আমাকে কিছু বললে না।
তাহলে তোমার আপত্তি নেই। আমি বলে আসি।
রূপনারায়ণ নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেলো।
সান্যালমশাই ছেলের উৎসাহের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসতে লাগলেন।
অনসূয়া বললেন–হাসছো যে?
সান্যালমশাই বললেন, ওদের কথায় একদিন রূপু বলেছিলো, ভালুকে চাষী। সেটা ঘৃণা করে বলেনি, ওদের শক্তির যে রূপটা চোখে পড়েছিলো তারই বর্ণনা করেছিলো ভালুকের সঙ্গে উপমা দিয়ে। তারা মৃদঙ্গ নিয়ে বৈষ্ণব হয়ে গেলে কেমন হয়, তাই কল্পনা করছিলাম।
ওদের মধ্যেও ধর্মভাব আছে। ওরা তো মাঝে মাঝে বারোয়ারি কালীপুজো করে। অসুখ বিসুখ খুব লেগে উঠলেই ওরা একটা না একটা পুজো করে।
সেসব পুজো ওদের মানায়।
কীর্তন ওদের মানায় না এ তুমি কী করে বলো? সেটা তো এখানকারই জিনিস।
গড়গড়ার নলটা দোলাতে দোলাতে সান্যালমশাই বললেন, এমন এক দুর্ভিক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের মহেন্দ্ররা কামান তৈরি করেছিলো, সত্যানন্দরা কীর্তনের বাড়বাগি জ্বেলেছিলো; এবার তোমার স্বামী পালিয়েছিলো শহরে। রাজপুরুষ শ্যালক ছিলো বলেই, নতুবা কী হতো বলা যায় না।
তোমার সব তাতেই হাসিঠাট্টা, ধর্ম নিয়েও তাই।
কে বলছে, কে বলছে? তোমার সঙ্গে হাসিমস্করা? সান্যালমশাই মৃদুমন্দ হাসতে লাগলেন, আমি ওদের আজই খবর দেবো। কীর্তন শুনতে আমিও ভালোবাসি। ব্রজকান্ত এবার যেদিন শহরে যাবে রামগোঁসাই-এর দলকে নিয়ে ফিরবে।
আসলে তুমি বিশ্বাস করো না ওদের কোনোকালে ধর্মে মতি হতে পারে।
সান্যালমশাই গম্ভীরমুখে বললেন–ধর্মে মতি হওয়া খুবই বাঞ্ছনীয় বোধ হয়।
অনসূয়া স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে গাম্ভীর্যটার কতটুকু কপট ঠাহর করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিন্তু ধর্ম ও কীর্তন নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। কাছারিতে ঢুকবার আগেই রূপনারায়ণকে যেমন, দোতলার এ ঘরখানাতে সান্যালমশাইদেরও তেমনি বিস্মিত হতে হলো। বিষয়টা কৌতুকেরও বটে। পাল্কিতে চড়ে এমন হুম-হাম শব্দের মধ্যে অনেকদিন কেউ কাছারিবাড়ির সীমানা পার হয়ে অন্দরবাড়ির দরজায় এসে থামেনি।
পুলিসের লোকেরা আসে। শহরের রাজপুরুষরা বছরে এক-আধবার আসে; আত্মীয়স্বজনরাও আসে। পুলিসের ঘোড়া ও সাইকেল। রাজপুরুষরা আসে সান্যালমশাই-এর ফিটনে। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আজকাল যারা আসে তারা প্রায়ই গোরুগাড়ি করে আসে। অন্যসব যানবাহন থাকে কাছারির ফটকের বাইরে। কদাচিৎ অনসূয়া যাওয়া-আসা করেন। তার পাল্কি অবশ্য অন্দরেই চলে আসে আট বেয়ারার কাঁধে। আর একজন আসে, সে মনসা। অপরিচিতি হালকা পাল্কির এমন সোরগোল!
হু হুম না, হু হুম না।
অনসূয়া কৌতূহলভরে সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে এলেন। সান্যালমশাই জানলার কাছে উঠে দাঁড়ালেন। রূপনারায়ণ কাছারি আর অন্দরের দরজার পাশে পাকিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো।
পাল্কি থেকে নিজের ছোটো হাতব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে সুমিতি নামলো।রূপনারায়ণের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলো। তুমি বড়োবাবুর ছোটোভাই, ছোটোবাবু রূপু?
মহিলার সম্মুখে দাঁড়ানোর অভ্যাস রূপনারায়ণের একেবারেই নেই, তার উপরে যে এমন সপ্রতিভ তাকে কী উত্তর দেবে লাজুক রূপনারায়ণ।
সুমিতি রূপনারায়ণের হাত ধরে বললো–চলো ভাই, বাবা-মায়ের কাছে।
০৪. কনকদারোগা দিঘা থানার
কনকদারোগা দিঘা থানার প্রবল প্রতাপান্বিত বড়ো দারোগা। তার অধীনে আরো দুজন সইস্পেক্টর আছে, জন-চারেক অ্যাসিসট্যান্ট সইস্পেক্টর আছে।
কিন্তু এহেন কনকদারোগা থানায় বসে নিজের উপরে কখনো কখনো । বিরক্ত হয়ে ওঠে।
সসম্মানে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে তার নাহলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, নাহলো কোনো ব্যবহারিক-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চাকরি। টাকার তাগিদে আসতে হলো দাবোগাগিরির বাঁধা সড়কে। বাঁধানো হলেও দুপাশে ফুটপাতের সীমাসরহদ্দ নেই। সামনের দিকে টাইম-স্কেলে মাইনে এগিয়ে যাচ্ছে, এপাশে-ওপাশে কুড়িয়ে-বাড়িয়েও চলা যায়।
লেখাপড়া হলো না বলে যে-খেদটা হয়, সবদিক দিয়ে ভেবে দেখতে গেলে সেটা থাকে । একসময়ে তার বিবেক পীড়া দিত। এখন কর্তব্যকর্মের সঙ্গে তারও একটা সামঞ্জস্য হয়ে গেছে। তার চাকরির গোড়াতেই সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ বাংলাদেশে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আর এই থানায় গান্ধীপন্থীরাও নেই যে তাদের উপরে মাঝেমাঝে হুমকি চালাতে হবে। ৪২-এর অত বড়ো সর্বভারতীয় ঘটনাটায় এ অঞ্চল উৎসুক ছিলো না। দু’একদিনমাত্র। থানার চারদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো, এক-আধবার কস্টেবলদের ফল ইন করানো মাত্র–তা-ও উপরওয়ালার মতে, প্রয়োজনে নয়। আর একটিবারমাত্র যেতে হয়েছিলো সান্যালমশাই-এর বড়ছেলে গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছে না কি খোঁজ করতে। ভাগ্য তাকে দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা থেকে রক্ষা করেছিলো। অন্তত ভারতবর্ষ যদি স্বাধীন হয় সে বলতে পারবে সরকারের শাসনযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সে কোনো দেশপ্রেমিকের নির্যাতনের নিমিত্তমাত্রও নয়।
কাজেই বেশ দিন যাচ্ছিলো তার। ছোটোখাটো সাধারণ চুরিচামারির ব্যাপারে তদন্ত করা ছাড়া তার একটিমাত্র কাজ ছিলো মাসে দু-দিন করে সান্দারদের হাজিরা নেওয়া। শেষের কাজটাতে সেরীতিমতো আনন্দ পেত। মাঝে মাঝে অপরাধ-বিজ্ঞান চর্চা করার যেসখটা তার হয় তাতে যেন সান্দারদের অস্তিত্ব সাহায্য করে। স্বভাবদুবৃত্ত এরা সরকার থেকে এমনি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। পুরুষানুক্রমে এরা দুবৃত্তই থেকে যাবে। কৃষিকর্মে এরা যতই মগ্ন হয়ে থাকুক, ছোরা-গুপ্তি এদের লাঙলের আড়ালে লুকোনো না-ই থাক, এদের মনের মধ্যে নাকি সভ্যতাবিরোধী হিংস্রতা ধিকিধিকি জ্বলছে।
কনকদারোগার দৃষ্টিও কাজে কাজেই সান্দারদের প্রতি সজাগ ছিলো। পাক্ষিক হাজিরার দিন আসবার আগেই সে তোড়জোড় করতে এই নৈমিত্তিক কাজটার জন্য। কে এলো, কে এলো না এদিকে তার কড়া নজর। কেউ না এলে লোক পাঠিয়ে খবর নিতে কোনোদিনই তার আলস্য ছিলো না।
কিন্তু আজকাল হাজিরাটা হয় না। সরকার তার নিয়ম শ্লথ করেছে তানয়। গহরজান সান্দার এখনো মাঝে মাঝে আসে। একবুক শাদা দাড়ি নিয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সান্দার সংখ্যা হাজিরায় কমতে কমতে এখন দু-চারজনে দাঁড়িয়েছে।
এক হাজিরায় এসে ওরা বলেছিলো, বুড়ো আলতাপ খসে গেছে। আর কোনোদিনই সে থানায় আসবে না।
কনক ধমকে উঠে বলেছিলো রসিকতা রাখ; কোথায় গেলো তাই বল।
–জে, মরেছে সে।
–কী করে মরলো? মারপিট দাঙ্গার কথাটা নিজেই প্রায় বলে ফেলেছিলো কনক।
ওরা চলে গেলে খটকা লেগেছিলো কনকের। মৃত ও অসুস্থ ছাড়া কোনো সান্দার তার থানার এলাকায় বাস করে থানায় হাজিরা দেবেনা, এ তার কল্পনারও বাইরে। একসময়ে এই অনুপস্থিতি অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিলো। সে ভেবেছিলো অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে অনাহারজনিত দুর্বলতা লিখে রাখবে। কিন্তু সেটা লিখতে গিয়েও কলম সরলো না। খবরের কাগজওয়ালারা দুর্ভিক্ষ বলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে আর সরকার এখনো দুর্ভিক্ষকে মেনে নেয়নি, এ সময়ে যদি সে কাগজে-কলমে এতগুলি অনাহারের কথা লিপিবদ্ধ করে রাখে তবে তো সরকারকেই বিপদে ফেলার সামিল হলো।
সে সময় কনকদারোগা একটা ভুল করে ফেলেছিলো, সে সত্যি তদন্তে বার হয়েছিলো। বুধেডাঙা অবধি ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে সে যদি থামত তাহলৈও হতো। বুধেডাঙা ছাড়িয়ে চিকন্দির সীমানায় পৌঁছে সে ব্যাপারটার মুখোমুখি হয়েছিলো।
–ও বাবা, বাবা, সোনা আমার—
ঘোড়া থামিয়েছিলো কনক, তার কানে গেলো–ঐ সোনার মুখে ভাত দিতে পারলাম না রে, বাবা।
থিয়েটারে দেখা সংহত শোক নয়, সিনেমায় শোনা মার্জিত বেদনার হেঁচকি নয়, অসংস্কৃত বেদনার বিকৃত উচ্চারণ।
কনকদারোগার বুকের গোড়াটা উল্টে উল্টে যেতে লাগলো, অগ্রন্থিগুলো ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। চোখের জল পুরোপুরি চাপতে পারলো না সে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে কনক পালিয়ে এসেছিলো। । আজ তার মন ভালো ছিলো। অনেক কারণ তার। দুপুর রোদে স্টেশনে ঘোরাফেরা করা
অনেক দিক দিয়ে সার্থক হয়েছে।কর্তব্যরত অবস্থায় উপরওয়ালার চোখে পড়া তার মধ্যে প্রথম। দ্বিতীয়টি তার চাইতেও বড়ো: সান্যালমশাই-এর ছেলে সত্যি আসেনি তার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলতে। তৃতীয় একটিও আছে, তাকে কারণ বলা যায় না, কিন্তু তাহলেও উল্লেখযোগ্য: শিক্ষিত মার্জিত ভদ্রমহিলার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করার সৌভাগ্য সব পুরুষের ভাগ্যে রোজ ঘটে না। আর পরম কৌতুকের বিষয়-তার উপরে নির্দেশ এসেছিলো সান্যালমশাই-এর ছেলে নৃপনারায়ণকে চোখে চোখে রাখার, যখন সে লোকটি পুলিসের হেপাজতে, হয়তোবা সেন্ট্রাল জেলেই।
থানার সামনে বড়ো অশ্বত্থ গাছটার পাতাগুলিকে আলোড়িত করে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে। বারান্দার টেবিলটার সম্মুখে বসে অস্ফুট শব্দে শিস দিতে দিতে আঙুলের ডগা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলটা ঠুকে কনক উঠে দাঁড়ালো। মুন্সিকে ডেকে বললো, আমি চলোম বিপিন, বাসাতে থাকবো। আজ আর ডাকাডাকি কোরো না।
বাসায় ফিরে স্ত্রী শিপ্রার হাতের খানিকটা সেবা নিয়ে কনক শোবার ঘরের টেবিলের সামনে বসলো। কালো রঙের মাঝারি চেহারার পুরনো ডায়েরিখানা খুলে পাতা উল্টে সেতার গবেষণার প্রচেষ্টা-স্বরূপ লেখাটা বার করে ফেলো। তার মনে হলো স্টেশনে দেখার পর পুরো তার মনের অনেকখানি জুড়ে আছে।
সান্দারদের নিয়ে সে আলোচনা শুরু করেছিলো। উচ্চাভিলাষী কিছু নয়। নিজের জানা কথাগুলির পাশে পাশে নিজের চিন্তাগুলিকে গুছিয়ে রাখা।
সান্দারদের উৎপত্তির ইতিহাসটা কনকের কল্পনাজাত। সেখানে সে লিখে রেখেছে নিজের গন্তব্য। এরা নাকি কোনোকালে বাঙালির নৌ-সৈন্য ছিলো। বাঙালির যেদিন নৌসৈন্য রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো এদের একদল হয়েছিলো জলের ডাকাত আর একদল হলো যাযাবর। কিংবা যখন বাঙালির শানিত ইস্পাতের প্রয়োজন ছিলো তখন এরাই শান্দার ছিলো।
আর যাই হোক, এরা যে যাযাবর সে-বিষয়ে কনক নিঃসন্দেহহয়েছে। নিঃসন্দেহ হতে পারার কারণ বুড়ো আলতাপের সঙ্গে পরিচয়। বুধেডাঙার চরে সান্দারদের সেই নিয়ে আসে। এদিকের সান্দাররা তারই জ্ঞাতিগোত্র।
তারও আগে সান্দাররা দু-তিনটে জেলার ব্যবধানে জাত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলো। জাত-ব্যবসায়টি যে ঠিক কী তা আন্দাজ করতে হবে। আলতাপের কথা ধরতে গেলে সেটা চুরি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। থানায় দাঁড়িয়ে দারোগার মুখের সামনেও বুড়ো আলতাপ বলতো, ট্রেনে উঠলেই পয়সা। একখান সুটকেস সরাতি পারো পনেরোদিন অ-ভাবনা। বুধেডাঙায় আসবার আগে হয়তো সে-ও ট্রেনে উঠে চুরি করতে যাত্রীদের মালপত্র। অন্তত তাদের ওস্তাদ মেরজান সর্দার করতো। মেরজানের মৃত্যুর ব্যাপারটাই তার প্রমাণ।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ির পিছন দিকের জানলা গলিয়ে একটা সুটকেস নিয়ে পালালো মেরজান পুড়াদ’ স্টেশনে। হৈ-হৈ রব উঠলো যাত্রীদের মধ্যে। ইতস্তত করার সময় ছিলো না। পাশে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, মেরজান চুপ করে একটা মালগাড়ির নিচে গিয়ে বসলো। বসে হয়তো মনে মনে হেসেছিলো সে, কিন্তু হঠাৎ মালগাড়িটাই চলতে আরম্ভ করলো। তখন সেই চলন্ত চাকার ফাঁকে বেরিয়ে আসার জন্যে কত ফিকিরই না সে করেছিলো। প্রাণ নিয়ে যখন টানাটানি তখন মানুষ তার সেরা ওস্তাদি কাজে লাগায়, নাকি সব গুলিয়ে যায় তখন, মাথায় সাধারণ বুদ্ধিও আসে না।
মেরজানের বিবির কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো আলতাপ।
–চাচী, আজ তুই ঘরে দুয়ার দে।
–কেন্ রে, সর্দার আসবি নে?
–না, সর্দার, মনে কয়, আজ আসবিনে।
দু-তিন দিনেও যখন মেরজান এলোনা আলতাপ আর গোপন রাখতে পারলোনা। মেরজান বিবি হাহাকার করে উঠেছিলো।
তখন মাথাঘোরা রোগ ছিলো ফুরকুনির, শুধু অনাহারে নয়, সন্তান সম্ভাবনাতেও। একদিন আলতাপকে পথে চলতে দেখে তাকে থামিয়ে ফুরকুনি বললো–আমার কী হবি, কও?
আলতাপ চোখ মেলে দেখলো ফুরকুনিকে।
আলতাপের যাতায়াত এরপরে বেড়ে গিয়েছিলো। আহা, এ সময়ে সাহায্য না পেলে কোনো মেয়েমানুষই বাঁচে না। আর যাই হোক সে মেরজানের বংশধর বহন করছে। একথাও উল্লেখযোগ্য, মেরজান, যার কাছে সান্দারদের যে-কোনো কন্যা সহজলভ্যা ছিলো, তাকে যে বেঁধে রাখে সেই ফুরকুনিবিবি এই।
কিন্তু আলতাপের যে বয়স তাতে তার পক্ষে বিপন্নকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা যত সহজ সেকাজে লেগে থাকা তত নয়। মাঝে-মাঝে ট্রেনে চেপে সে উধাও হয়ে যেতো দীর্ঘদিনের জন্য।
একদিন স্টেশনে বসে জুয়া খেলতে খেলতে রোখ চাপলো মাথায়। রাত যখন মাঝামাঝি তখন আর সকলে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিলো ঘর থেকে। পরাজয়ের বেদনার উপর অপমানের জ্বালা। নিজের গ্রামের পথে ফিরতে ফিরতে তার মনে হলো কার কাছে কত টাকা পায় সে, পায় কিনা কারো কাছে। এরকম গোলমাল মাথায় নিয়ে পথ চলতে চলতে আলতাপের মনে হলো ফুরকুনি তাকে অনেক ঠকিয়েছে। কান্নার সুরে কথা বলে অনেক চাল, অনেক টুকিটাক খরচ আদায় করে নিয়েছে সে। এ কী অন্যায়! তার অভিজ্ঞতা কম বলেই তাকে এরকম ঠকাতে পেরেছে সকলে। চুড়ান্ত আক্রোশের একটা গালিতে চরাচরকে অভিহিত করে সে পণ করলো আজ সে হিংস্রতম প্রতিশোধ নেবে।
কানাকড়ি থাকার দিন ছিলো না ফুরকুনির, তা দিন বারোটাই হোক কিংবা রাত বারোটা কিন্তু নেশার মাথায় আলতাপ স্থির করলো–সব মেয়েরাই, বিশেষ করে সান্দারনীরা চোরাই মালের এটা-ওটা সরিয়ে রাখে। ফুরকুনি মেরজানের সময়ের কিছু কিছু কি আর রাখেনি?
ধাক্কা দিতে ঝাঁপ খুলে গেলো। আলতাপ দেখলো ঘরের একপাশে চটের বিছানায় দু-তিন মাসের শিশুকে পাশে নিয়ে ফুরকুনি ঘুমিয়ে আছে। কুপিটা বোধ হয় নেবাতে ভুলে গেছে, তারইআলো আর ধোঁয়ায় ঘরের ভিতরটা নজরের সামনে নাচছে।
হাত ধরে একটানে ঘুমন্ত লোকটাকে খাড়া করে দিলো আলতাপ। ভালো করে সে চোখ মেলবার আগেই, ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই আলতাপ চড় মারলো ফুরকুনির গালের উপরে। চড় খেয়ে ফুরকুনি পড়ে গেলো। ঘুমন্ত গালে পুরুষালি চড়!
–কই দে, কী আছে তোর ট্যাকা পয়সা।
–কনে পাবো? সোনা আমার, মারিস নে আর, তুই খাবের দিছিলি তাই বোঁচে আছি।
মাথায় খুন চাপলে কোনো কথাই কানে ওঠে না মানুষের। ফুরকুনি আরো মার খেলো কিন্তু কিছুতেই যেন আক্রোশ যাবার নয়, গায়ের চামড়া খুলে নিলেও রাগ যেন যায় না। পরিধেয় তার সামান্য পরিবর্ত।
মুশকিল হলো হঠাৎ। রাগের মাথায় সান্দারনীকে সে বিবস্ত্র করে ফেলেছে। রাত্রির ম্লান আলোয় নিরাবরণ নারীদেহ আলতাপের চোখের সম্মুখে। সহসা আলতাপের মন সীমাহীন করুণায় ভরে গেলো। জানু পেতে সে দেহটার পাশে বসে পড়লো।
রাত যখন ভোর হয় আলতাপ ঘুমের মধ্যে শীত শীত বোধ করে সরে এলো; ফুরকুনি জেগে ছিলো; নিজের আঁচলের খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে আলতাপকে ঢাকতে পারলো না যখন নিজেই একটু এগিয়ে গিয়েছিলো আলতাপের দিকে।
আলতাপই তার সমাজের ঐতিহাসিক। ইতিহাস তার কণ্ঠস্থ নয় শুধু, তার প্রকাশভঙ্গিও অনন্য। সন-তারিখে কিছু গোলমাল হয়ে যায় বটে, কিন্তু তাতে যেন ইতিহাসের প্রাচীনত্ব গভীর হয় ওঠে।
বেলাতের যখন বছর পনেরো বয়স, রজব আলি উড়ুউড়ু করছে, তখন ফুরকুনির মৃত্যু হলো। সে এক হাঙ্গামা। পুলিস আলতাপকে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলোগোমুখখু পুলিস! কনক দারোগার সম্মুখেই থুথু ফেলে মুখ বিকৃত করে বলেছিলো আলতাপ। অথচ কত না ভালোবাসা ছিলো দুজনের, এক-আধ দিনের চোখ-ঠারার ব্যাপার নয়, দুটি সন্তানের দুপাশে বসে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে তাদের মানুষ করে তোলার সাহচর্য। অথচ পুলিসের দারোগা-উকিল বলেছিলো: ফুরকুনির বয়স হয়েছিলো, চুলে পাক ধরেছিলো, আর এদিকে আলতাপের জোয়ান বয়স। আরো লক্ষণীয়, এতদিন পরেও ধর্মের গ্রন্থি পড়েনি এদের জীবনে, এরা এখনো বিবাহিত নয়।
কনক নিজেই প্রশ্নটা করেছিলো–তোমাদের বিয়েসাদিটা কবে হলো।
আলতাপ প্রত্যুত্তরে যা বলেছিলো তার সারমর্ম এই : অসুখ করলে নিজের সন্তানের মতো বুক করে রাখতে পারে আর কোন সান্দারনী ফুরকুনি ছাড়া? আর এটা এত সত্য যে আলতাপ পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন বোধ করেনি। ফুরকুনির মৃত্যুর পর এই দীর্ঘ সময় পৃথিবীর অন্য সব সান্দারনী থেকে সে মুখ ফিরিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। মেরজান-গরবিনী ফুরকুনিকে যে পায় সে কি তাকায় তোমার ফেলানি আর কুড়ানির দিকে।
এই ফুরকুনির তাগিদেই সান্দাররা বুধেডাঙায় এসেছিলো। বোধ করি মেরজানকে হারিয়ে সান্দারদের দুঃসাহসিকতার বৃত্তিকে তার ভয় হয়েছিলো। আলতাপকে পেয়ে তার হারানোর ইচ্ছা ছিলো না। পদ্মার চর তখনো খানিকটা সিকস্তি। বুধবারের দিন গোরুভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে আলতাপের যাযাবর দল এসে দাঁড়িয়েছিলো চরটার উপরে। দুপুরে আহারের পর আলতাপ-ঘরনী ফুরকুনি নিজের বিড়ি থেকে আলতাপের বিড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলছিলো–আলতাপ!
-ফরমাইয়ে।
–এখানে থাকলি কেমন হয়?
–যেখানে থাকি তোমার কাছেই থাকবো।
–তা লয়, এখানে চাষবাস করে ঘর-দরজা করে ছাওয়াল দু’ডে নিয়ে বসলি হয় না?
–চাষবাসের কাম আমি কী জানি?
সত্যি আলতাপ লাঙল ধরা কোনোদিনই শিখতে পারেনি। শুধু তাই নয়, লাঙল ধরা কাজটাকে সে ঘৃণা করে। সান্দারদের মধ্যে গহরজান কৃষিতে অত্যন্ত সাফল্য লাভ করেছে। মাটির কাজে হাত দিয়ে সান্দাররা মাটি হলো, আলতাপের এ প্রকল্প সে মানতে চায় না। আগেকার দিন হলে আলতাপ সর্দার কী করতে বলা যায় না, এখন সে তার চিরাচরিত প্রথায় থুথু করে ওঠে।
ফুরকুনি তাকে দুটি সন্তান দিয়েছিলো : মেরজানের ছেলে রজব আলি আর তার নিজের ছেলে বেলাত হোসেন। ভাবতে গিয়ে তার অবাক লেগে যায়।রজব আলিকে সে খানিকটা শ্রদ্ধার চোখে দেখে–সে মেরজান সর্দারের ছেলে। লোককে সে বলে–হবি নে কে, সদ্দারের ছাওয়াল, দিল-দেমাক উঁচুই হবি। বেলাত হোসেনের কথায় ফুরকুনি বলেছিলো–এটা তোমার নিজের, তা-ও আদর যত্ন করো না।
কিন্তু পিতার স্নেহ কম পেলেও পিতার প্রবৃত্তিগুলো পেয়েছিলো বেলাত হোসেন। তার নাকি আলতাপের মতো গায়ের রং ছিলো, তেমনি নাকচোখ।শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছাতি সারানোর ব্যবসা করে বেড়াতো সে কিন্তু কখনো কখনো এমন সব জিনিস নিয়ে ফিরে আসতো যা নাকি ছাতি-সারানোর মজুরি দিয়ে কেনা যায় না।
অন্য অনেকের জীবনের মতো আলতাপের জীবনে এটাই দুঃখবীজ যে তার আদর্শ ও অন্তরে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়েছিলো। রজব আলিকে সে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। অথচ রজব আলি জমিজমা নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। বেলাত হোসেন তার যাযাবরত্বের আদর্শ মেনে নিয়েছে, কিন্তু সর্দার হবার মতো উদারতা তার নেই। পুলিসের সঙ্গে তার সদ্ভাব।
অনেক জেরার উত্তরে আলতাপ একদিন বলেছিলো–কোনো সান্দার কোনোদিন নিজের সদ্দার ছাড়া আর কাকে সেলাম দিছে? কন দারোগাসাহেব। আর এ কী হলো? জমিদার, তা আমলা, তার পাইক, তার সমনজারি!
কনক বুঝতে পেরেছিলো কৃষক-জীবনে আলতাপের আপত্তিটা কোথায়।
দুর্ভিক্ষের আগে রজবআলির বাড়ির সমুখে একটা মাচায় বসে থাকতো আলতাপ আর বিড়বিড় করতো। ঠাহর করে শুনলে বোঝা যেতো সে বলছে : এতটুকু নতুনত্ব নেই জমিতে যেনতুন কিছু আশা করবে। ঐ তো গহরজান বিশ পটি ধান তুলেছে গোলায়। দুই দু-খান গোরুর গাড়ি তার, পাঁচজোড়া লাঙল বিধে। কালো কোট পরে থানায় হাজিরা দেয় সে, লাল মোল্লাকি টুপি, তফনের চেকনাই চমকে ওঠে বোদ-ভরা মাঠ পার হতে গেলে। সাদি করেছে এ-সনেও একটা। আহাম্মুখ বোঝে না ষাট বছরে ওসব ঘরে আনা শুধু নিজের খাঁচায় পরের জন্য পাখি পোষা। কিন্তু তা যতই করো, দাঁড়াতে হয় না তোমাকে সান্যালদের পেয়াদার সামনে ভেড়া-ভেড়া মুখ করে?
থুথু ফেলে চারপাশ অগম্য করে তুলতে আলতাপ। এর কিছুদিন পরে সে বলতে আরম্ভ করেছিলো–অন্য কোথাও চলো, অন্য কোথাও চলো। এমন ধানও হয়নি কোনো সালে, এমন না-খেয়ে থাকাও আর কোনোদিন হবি নে।
লোকে ভাবতো ওটা বুড়োদের ধরতাই বুলি। প্রতিবারেই তারা বলে এবারের মতো কোনো ঋতু এত প্রবল হয়ে কখনো আসেনি।
কিন্তু আলতাপের শেষ কথা চূড়ান্ত হয়ে সত্য হলো।
কনকদারোগা কলম খুলে নিয়ে কিছু-একটা লিখবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। সে লিখলো : সারা গায়ে মাটি মেখে ধূলিধুকড়ি হয়ে অকরুণ আকাশের দিকে ধানের বৃষ্টির জন্য চেয়ে থাকবে, সে-জাত এদের নয়। কোনো-একটা মেয়ের প্ররোচনায় এরা মাটিতে হাত দিয়েছিলো, এদের শ্রমে বুধেডাঙা শস্যময়ী হয়ে উঠেছিলো। আজ সুরোকে দেখে এলাম। আলতাপ সান্দারের পৌত্রী, বেলাত হোসেনের কন্যা। চোরাই ব্যবসায়ে লিপ্ত আছে। যাযাবর হয়ে গেলো। মাটির বন্ধনে পড়ে সামাজিক প্রাণী হবার যে-সুযোগ এসেছিলো সেটা চলে গেছে।
কনকের স্ত্রী শিপ্রা ঘরে ঢুকলো। সদ্যস্নাতা একটি সামাজিক প্রাণী।
শিপ্রা বললে–গবেষণা?
সময় কাটাচ্ছি।
শিপ্রা ঝিলিক তুলে বললো–কেউ যদি বলে তোমাদের সকলেরই ঐটি আসল ব্যাপার, ঐ সময় কাটানো? ওদের বাঁচা-মরা তোমাদের নির্লিপ্ত সময় ক্ষেপণের সুযোগ দিয়েছে। এই তোমাদের পলিটিক্স।
তা যদি বলো। কনক খাতা মুড়ে রাখলো–বললে, আলতাপ ফুরকুনির হাসি পাবার লোভে বুধেডাঙায় ঘর বেঁধেছিলো শিপ্রা। আমায় কী করতে হবে বলো।
০৫. মাধাই সন্ধ্যার পরে ফিরলো
মাধাই সন্ধ্যার পরে ফিরলো স্টেশন থেকে। অন্ধকারে ঠাহর করে সুরোকে দেখে সে একটু অবাক হলো–সুরো না?
–হয়।
কী মনে করে আলি, শহরে গেলি না চাল আনবের?
চাল আনবো? পুলিসের তাড়া খেয়ে পলাইছি।
পুলিস তাড়া করছে? কস কী, কনে?
ছোট ইস্টেশনে। মন কয়, দিঘার বড়ো দারোগা।
তাইলে? মাধাই বারান্দার উপরে তার সবুট একখানা পা তুলে দিয়ে দাঁড়ালো। সে জানে না তার এই দাঁড়ানোর কায়দাটা স্টেশনমাস্টার কোলম্যানসাহেবের। সে ভাবলো : রেল পুলিস ধড়পাকড় করার তোড়জোড় করে মাঝে-মাঝে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়, বোঝানোর চেষ্টা করা যায়। দিঘা থানার দাবোগাকে কী বলবে সে।
কিছু ক’লা?
কবনে। এখন খাওয়া-দাওয়া কর। রাত্তিরে তো টেরেন নাই।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে মাধাই ঘরে ঢুকলো।
রেলের সবচাইতে ছোট পরিমাপের কোয়ার্টারগুলির একটি। সাত-আট হাত দৈর্ঘ্য ও প্রায়। সমপরিমাণ প্রস্থের একখানা ঘর। ঘরের দুটিমাত্র জানলার একটার নিচে মাধাইয়ের খাঁটিয়া। দেয়ালের গায়ে পেরেক থেকে তার জামাকাপড়গুলো ঝুলছে। ঘরে ঢুকে একটা মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে খেয়ে বিছানায় বসে একটা বিড়ি ধরালো মাধাই।
সুরো দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলো।
মাধাই লঘুস্বরে বললো, এখনো ভাবতেছিস চালের কথা?
কথাটা মিথ্যা নয়। অপ্রতিভ হয়ে সুরতুন বললো, পুলিস ধরলি কবো–মাধাই বায়েনের লোক আমরা? র্যালের লোক ধরলি তা কই।
কইছিস একখান কথা। তোর মাধাই যে র্যালের বড়োসাহেব।–মাধাই হো-হো করে হেসে উঠলো।
হাসি থামলে মাধাই বললো, এখন খাওয়া-দাওয়া কর। কাল সকালে ফতেমারা আসবি বোধায়। তাদের সঙ্গে বুদ্ধি করিস। একটা কিছু ব্যবস্থা হবি।
মাধাই যখন বলেছে কিছু নিশ্চিন্ত হওয়া যায় বৈকি। ছোটো স্টেশনের কনকদারোগা কিংবা দুপুর রোদের দু-ক্রোশ পথ স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু মাধাইয়ের হাসিও মিথ্যা নয়।
এখন ঘুমাবা?
হয়, ডিব্টি দেওয়া লাগবে সারা রাত। স্পেশাল আসবি। বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাধাই পোশাকপরা অবস্থাতেই খাঁটিয়ার উপরে শুয়ে পড়লো।
সুরো কিছুকাল বারান্দায় বসে থেকে আহার্য সংগ্রহের জন্য বাজারের দিকে গেলো।
বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে মাধাই খানিকটা ভাবলো। তার ভাবনাচিন্তা একখানি স্পেশ্যাল ট্রেনকে কেন্দ্র করে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া দরকার। এখন যে খুব পেয়েছে তা নয়। বরং ঘুমোবার সময়ই এটা নয়। কয়েকদিন আগে শুনেছে সে কথাটা, আজ সেই স্পেশ্যাল আসছে। তাকে সাদর অভ্যর্থনা করার জন্য দেহ ও মন দুটিই সজাগ থাকা চাই। চোখে এতটুকু ঘুম থাকলে হবে না। আগে থেকে ঘুমিয়ে রাতজাগার জন্য প্রস্তুত হতে সে ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘুম প্রয়োজনের সময়ে আসে না। মাধাই শুয়ে-শুয়ে বুটসুদ্ধ পা-জোড়া দোলাতে লাগলো।
বোধ হয় একটু তন্দ্রা এসেছিলো। মাধাই ধড়মড় করে উঠে বসলো।
সুরো আসছিস?
বারান্দা থেকে পুরো সাড়া দিলো।
তুই ঘরে আসেও শুতে পারিস। আমি ডিব্টিতে চলোম।
ঘুমালে না?
না রে, ঘুম আসতেছে না।
ঠিক এই মুহূর্তে কেউ যদি মাধাইকে তার এই চাঞ্চল্যের কারণ জিজ্ঞাসা করতো, সে উত্তর দিতে–এ কি তোমার মেলোয়ারি ভোগা আর খায়ে না-খায়ে থাকা। এর নাম চাকরি। রেলের কামই লোক পায় না,হলো তোহলো,শালা মেলেটারি।নীল প্যান্টকোটকজন পায়, তার উপরে পাওয়া গেলো খাকি প্যান্ট, কোট, টুপি। পুলিসের দারোগারাও তাকায়ে তাকায়ে দেখে।
খাকি, খাকিই হচ্ছে এই দুনিয়ার সেরা রঙ।
মাধাই যখন গ্রাম ছেড়েছিলো তখন তার বয়স কুড়ি ছাড়িয়েছে। মাধাই এক গণস্কারকে দিয়ে হাত দেখিয়েছে। পাঞ্জাবি গণৎকার পুরোপুরি একটা সিকি পেয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই মাধাই বায়েনকে রাজা করে দিয়েছিলো প্রায়, পুরোপুরি পারেনি মঙ্গলের স্থানে কী একটা দুর্যোগ ছিলো বলে। মাধাই এখন নিজের হাতের রেখা দেখিয়ে বলে–তা দেখ, ঠিক কুড়িতে যদি গাঁ ছাড়া না হতাম, জুটতো এই চাকরি?
গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঠিক তিন মাসের মধ্যে মাধাইয়ের চাকরি জুটে গেলো স্টেশনে। তেরো টাকা মাসিক বেতনের চাকরিটা মাস্টারসাহেব তাকে ডেকে দিয়েছিলো। অবশ্য কফিলুদ্দি শেখের চামড়ার ব্যবসায়ে কোথায় মাস্টারসাহেবের সঙ্গে খাতির হওয়ার যোগাযোগ ছিলো।
স্টেশনের কনস্টেবল দোবেজি একদিন এক রাজপুরীর গল্প বলেছিলো। ত্রিশ হাত উঁচু তার প্রাচীর। ভেতরে বাগান। সারি সারি ফুলফলের গাছের মধ্যে লাল আলোকোজ্জ্বল রাস্তা।
বাইরে কাঁটাভরা রাক্ষুসে লতায় ঢাকা জলা। এক-একটা কাঁটা যেন এক-একটা বিষমুখো সাপ। কিছুদিন পরে মাধাই অনুভব করেছিলো তার চাকরিটাও একটা প্রাচীর।
কিন্তু সবটাই যেন এক পূর্বপরিকল্পিত কাহিনী। কোথায় কোন দুই দেশের রাজায় লেগে গেলো যুদ্ধ। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রচণ্ড প্রচণ্ড ইঞ্জিনগুলো খাকি-পরা লোক নিয়ে ছুটতে লাগলো। ইয়া ইয়া ইঞ্জিন আর হাজার হাজার গাড়ি। হুস হুস ঝম ঝম। যেখানে পাঁচখানা চলতে এখন চলছে পঁচিশখানা। এক সকালে তেমনি কোথা থেকে রাশি রাশি খাকির জামাকাপড় এলো। মাস্টারসাহেব থেকে শুরু করে মাধাই পর্যন্ত সবাই পরলো। প্রথম যেদিন পোশাক বিতরণ শুরু হয়েছিলো হাসাহাসির চূড়ান্ত হলো! কারো ভুঁড়ির বোতাম লাগতে আপত্তি করলো, কারো বা পোশাক আলখিল্লার মতো ঝুলঝুলে হলো গায়ে। কিন্তু এক রাত পার না-হতেই হাসির জায়গায় এলো গাম্ভীর্য। আর মাইনা বেড়ে যে কত হলো লেখাজোখা নেই। তেরো বেড়ে তেষট্টি। ছ মাসের কামাই একমাসে।
অফিসঘরগুলিতে কাজ হচ্ছে যেন ঝড়ের মতো। ফিরিওয়ালা যে এত কোথায় ছিলো কে জানতো! স্টেশনের উপরেই প্রতি প্ল্যাটফর্মে একটি করে বিলিতি খানাঘর তৈরি হয়েছে। আর কোথায় ছিলো এরা, যারা যে-কোনো দামে যে-কোনো জিনিস কিনবার জন্য গাড়ি স্টেশনে আসবার আগে থেকেই জানলায় দাপাদাপি করতে থাকে। গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে মাথা ঘুরে যায়, পায়ের ঠোক্করে মানুষ ঠিকরে পড়ে, মানুষ চটকে যায় পায়ের নিচে। দৃশ্যটা এ বলেও বোঝানো যাবে না। যে না-দেখেছে সে বুঝবে না, ভাবে মাধাই, এ এক নৃত্য। কিছুদিন আগে এক বাজিকর পুতুলনাচ দেখিয়েছিলো। লাল একটা গোল শতরঞ্জির টুকরোর উপরে একটা পুতুলের চারদিকে অন্য কয়েকটি পুতুল নাচতে লাগলো। তাদের নাচের তালে তালে শতরঞ্চিটাও দুলে দুলে উঠতে লাগলো। তারপর নাচ যখন উদ্দাম হয়ে উঠলোতখন শতরঞ্জিটাও বনবন করে ঘুরতে শুরু করলো। সেই শতরঞ্জিই এই স্টেশন।
অন্ধকার পথটা দিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে মাধাই অন্ধকারের শূন্যতাকে বুট ঠুকে একটা স্যালুট করে দিলো। ট্রেনটা এসে দাঁড়ালে শুধু সে নয়, স্টেশনে যে যেখানে আছে সবাই এমন করবে। সাধারণ ট্রেন এলেই কত করতে হয়, তার উপরে আসছে স্পেশ্যাল,ইপেশিয়াল যার নাম। পাঁচ-ছয় দিন আগেই তারে-তারে খবর পেয়েছে সারা দেশ। দক্ষিণের রাজা নাকি উত্তরের রাজাকে খুব হারিয়ে দিয়েছে। ফুল-পাতায় রঙিন কাগজে স্টেশন সাজানো হয়েছে। বড়ো বড়ো গেট। স্টেশনমাস্টারের ঘরে নাকি কয়েকজন বড়ো বড়ো যোদ্ধা চা খাবেন। তার আয়োজন করতে গিয়ে স্টেশনমাস্টার কোলম্যানসাহেবের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সেই স্পেশ্যাল!
স্টেশনের চৌহুদ্দিতে পা দিতে না-দিতে মাধাই খবরটা পেলো। জয়হরি তারই মত পোর্টার। সে-ই বললে–একখানা নামে, আসলে দুখানা। সেই উত্তর থেকেই চারখানা ইঞ্জিনের পেছনে দুখানা স্পেশ্যাল আধ মাইল তফাতে থেকে চলছে। দ্যাখো মজা, এক লাইন ক্লেয়ারে দুখান গাড়ি চলে।
মাধাই এমনটা কখনো শোনেনি। সে বললো, পেছনের ড্রাইভার কত ওস্তাদ দ্যাখো। একটু। বে-মাপ চালাবা তো সামনের গাড়িতে ঠোক্কর।
সামনের ড্রাইভার বা কম কী? ইঞ্জিন একটু কমালে চলবি নে?
সব ইষ্টিশনে থুরু পাস?
না, এখানে থামবি।
থামবে সেটা মাধাইও জানে। প্রশ্নটা উত্থাপন করে বন্দর দিঘার স্টেশন সম্বন্ধে গর্ববোধটি নতুন করে অনুভব করার চেষ্টা করলো সে।
বাব্বা, দিঘায় না থামে কারো উপায় নাই।
সামনের ভেন্ডারের ডালা থেকে একটা পান ছিনিয়ে নিয়ে চিবোতে চিবোতে মাধাই মালবাবুর ঘরের দিকে গেলো।
মালবাবু তার ঘরেই ছিলো। মাধাই তার অত্যন্ত ভুল কায়দায় একটা স্যালুট দিয়ে বললো, দুই গাড়িতে নাকি এক ইসপেশিয়াল?
গাড়ি দেখতে এলে বুঝি?
দেখতে আসি নাই। পাস্ করাবো আমি। আমি ঝাণ্ডাদার। বেশ করেছে।
মাধাই মালবাবুর চোখেমুখে একটু উত্তেজনা প্রত্যাশা করেছিলো। মালবাবু যেন কীরকম! অন্য বাবুদের থেকে আলাদা।
প্ল্যাটফর্মে ডাউন গাড়ির প্রবেশপথের কাছে কর্মচারীদের ভিড় বাড়ছে। মাধাই তাড়াতাড়ি সেদিকেই পা চালাতে লাগলো। সেখানে পৌঁছুতে না-পৌঁছুতে দিগন্তে স্পেশ্যালের ধোঁয়া দেখা দিলো। স্টেশনমাস্টার নিজেই ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে তিন-চারজন বাবু, জন দু-এক পোর্টার, পয়েন্টম্যান। এইনা হলে জীবন? কেবিন আর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় মাধাই দাঁড়িয়ে পড়লো ঝাণ্ডা নিয়ে। দাঁতে দাঁত লেগে চোয়াল কঠিন হয়ে উঠলো তার। দিগন্তবিস্তৃত রেল দুখানা যেন একটু একটু কাঁপছে। স্পেশ্যাল সে-দুটিকে অবলম্বন করে এগিয়ে আসছে। লাইন দুখানার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মাধাইয়ের অনুভব হলে সে-দুটি তার দেহে প্রবেশ করে শিরা-উপশিরার প্রঋনতম দুটি হয়েছে, গাড়িখানা তার হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করবে সন্দেহ কি।
.
কিন্তু স্পেশ্যাল এসেছিলো, চলেও গেলো। মাধাই মালবাবুর ঘরের দরজায় একটি প্যাকিং বক্সের উপরে বসে পড়লো। একটু উসখুস করে মাধাই বললো, দেখলেন?
না, আমার যে অনেক কাজ।
সিগারেটের ছাই ঝেড়ে সেটাকে আবার মুখে গুঁজে মালবাবু স্টেটমেন্টে মন দিলো। মাধাই মনিরুদ্দির খোঁজে গেলো।
যে ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করেছে সেটা আর কারো নজরে পড়লো কিনা এটা জানা দরকার। স্পেশ্যাল যখন ইন করলো তখন মাধাই লক্ষ্য করেছিলো গাড়ি দুখানি ফুলপাতা-পতাকায়। সজ্জিত। ছোটোখাটো অনেক স্পেশ্যাল ট্রেন এর আগে উত্তরে গিয়েছে, অনেক ফিরেছে। দক্ষিণে। কিন্তু এমনটা কখনো হয়নি। মাধাই ভেবেছিলো এবার সব সেরা কিছু দেখতে পাবে। আলোয় ঝলমল করতে করতে প্রথম গাড়িটা থামলো। গাড়ির আলোয় স্টেশনের আলোয় রাত দিন হয়ে গেলো। একসঙ্গে সবগুলো ভেন্ডার তাদের ডালা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। সে চিৎকারে মাটির ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সেই আলোক-উদ্ভাসিত গাড়ি যেন ঘুমিয়েই রইলো। জানলায় যে-মুখগুলি দেখা গেলো তারাও এতটুকু উৎসুক হলো না। একটি দুটি প্রথম শ্রেণীর গাড়ির দরজা খুলে গম্ভীর মুখে দু-একজন খুব বড়ো বড়ো অফিসার নামলো। তারপর তাদের নামা দেখে সাহস পেয়ে আরো দু-একজন করে সৈন্য নামলো। কিন্তু এরা যেন কোনো নতুন পৃথিবীতে পদার্পণ করছে। যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা স্টেশনটার চারিদিক দেখতে লাগলো। ভেন্ডাররা তাদের গাম্ভীর্য দেখে এগোতে সাহস করলো না। কিছুমাত্র সাড়া শব্দ নেই, একটা পয়সা বিক্রি করতে পারলো না ভেন্ডাররা। অবশ্য এটা হয়তো অত্যুক্তি। বিক্রি কি আর হলো না, কিন্তু তাকে বিক্রি বলে না। আগে দু’পয়সার জিনিস কিনতে যে হুংকার ঝনৎকার ছিলো, এখন হাজার টাকার লেনদেনেও তার সিকিটা হলো না। কেউ ডালা থেকে থাবড়া দিয়ে সবগুলি সিগারেট তুলে নিয়ে দশটাকার নোট ছুঁড়ে ফেলে দিলো না। ভেন্ডারের টিকি ধরে টান দিয়ে কেউ হো-হো করে হেসে উঠলো না। এর আগে গাড়ি থামতে-না-থামতে যারা দুদ্দাড় করে ছুটতে ইঞ্জিনের জল নেওয়ার কলামের নিচে, এক-স্টেশন লোকের সামনে উলঙ্গ শিশুর মতো স্নান করতে পারতো, সেই লোকগুলিইবা গেলো কোথায়! দ্বিতীয় গাড়ি প্রথম গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। একই কথা।
মাধাই মনিরুদ্দির সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, মুর্দা গাড়ি নাকি রে? মাস্টারসাহেব তো বলে খুব যুদ্ধ জিতছে ওরা।
এ কী রকম জয়লাভ মাধাই বুঝে উঠতে পারে না। জয়লাভ করা মানে চোরের মতো মুখ করে ঘরে ফেরা নাকি?
একটা চায়ের দোকানে বসে পড়লো মাধাই। দোকানিকে চা দিতে বলে সে পাশের যাত্রীটিকে প্রশ্ন করলো’দেখলেন?
দেখলাম।
যুদ্ধে জিতছে তবে আনন্দ করলো না কেন?
এখানে করবে কেন? ওদের দেশে ওদের ছেলে মেয়ে বউ আছে, তাদের কাছে গিয়ে করবে।
মাধাই শ্রদ্ধায় লোকটার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বসলো। এতক্ষণে একটা কথা একজন বলেছে বটে। ঠিক তো। যুদ্ধজয়ের পর এখন বাড়ি ফেরার তাড়া। এখন কি আর হৈ হৈ ভালো লাগে!
লোকটির ট্রেন ধরার তাড়া ছিলো। সে উঠে গেলো। মাধাই চুষে চুষে চা খেতে লাগলো। দোকানিকে সে কথাটা বললো, যুদ্ধে জিতলে কী হবি, নিজের ঘরে না ফিরলে কি আর আনন্দ হয়!
অথচ মজা দ্যাখো, এই এত বড় ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করলো না–না জয়হরি, না মনিরুদ্দি।
এটা যে আজই প্রথম হলো নয়। আজ চূড়ান্তভাবে বিষয়টি চোখে পড়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগে থেকেই মাধাইয়ের একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হচ্ছে? জয়হরি কথাটা শুনে ঠিক হেসে উড়িয়ে দেয়নি, বরং মাধাইয়ের পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখে বিস্মিত হয়েছিলো। পর্যবেক্ষণটির মূল্য সম্বন্ধে সে কিছু বলেনি, মোটামুটি গভীরে চিন্তা করে সে এটাই তাদের বিস্মিত করেছিলো। তার কথাগুলো যেন কতকটা ভদ্রলোকের আলাপের মতো শোনায়।
জয়হরি বলেছিলো, মানুষ কি চিরকালই লাফায় নাকি? তুই চাকরির প্রথম দিকে ওভারব্রিজে দড়ি বেঁধে দোল খাতি, এখন তা করিস? বয়স বাড়লি ধীরথির হয়। এ-ও তেমনি। যুদ্ধের বয়েস হলো না?
কৌশল করে একটা উপমা দিতে পেরেও সুখী হলো না জয়হরি। অপ্রতিভের মতো মুখ করে সে হাসলো। উপমাটার প্রয়োগের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তার সন্দেহ ছিলো।
এসব ধরনের কথাবার্তা শুনে মনিরুদ্দি আর-একদিন তাকে বলেছিলো–এত মনমরা কেন?
মাধাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলো, আমি কি একা? জেল্লা যেন সকলেরই কমে।
কমে, না বাড়ে?
মাধাই একটু চিন্তা করে বললো–ভাত-ভাত লাগে।
ভাত, সে কি খারাপ? কয় হা অন্ন, যো অন্ন।
এই কথাটা থেকে একটা তুলনা এসেছিলো মাধাইয়ের চিন্তায়। রেলের গ্রেইন-সপ থেকে একবার একরকম চাল দিয়েছিলো। সুন্দর ধবধবে ভাত হতো। কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে থু-থু করে। ফেলে দিতে হতো। তেতো হলেও তবু স্বাদ থাকে। সে ভাত ছিলো সবরকমে স্বাদহীন। ঘটনাটা মনিরুদ্দিকে মনে করিয়ে দিয়ে মাধাই বলেছিলো–সংসারটা সেই ভাতের মতো। মনিরুদ্দি হো। হো করে হেসে উঠে বলেছিলো–তুমি ভদ্রলোক হলা, বাবুমানুষ হলা, কেন?
এসব ধরনের আলাপ-আলোচনা সম্বন্ধে জয়হরি এবং মনিরুদ্দি দুজনেরই মনোভাব প্রায় এক। অন্তত একটি বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ একমত, দৈনন্দিন সুখদুঃখও প্রয়োজনের বাইরে আলাপ আলোচনা করাটা ভদ্রলোকদের ব্যাপার।
মনিরুদ্দি বললো, মনমরা কেন্? ফুর্তি করো, হৈ হৈ করো। মদ খাবা?
ধুর। এক্কেবারে বাজে। গা গুঁটায়।
কও কী, খাইছো?
খাইছিলাম একটু একদিন।
জয়হরির কাছে শুনো, সে কেমন জিনিস। ও তো রোজ খায়। সাহেবরাও খায়।
ওদিক থেকে মনিরুদ্দিকে বাবুরা ডাকলো। সে চলে যেতে যেতে বলেছিলো–তুই ভাবিস? কাম আর কাম। বাড়ি যায়েও তাই। এটা কাঁদে, ওটা চেঁচায়।
আর একটু চা খাবে নাকি ভাবলো মাধাই। চা না খেয়ে সে একটা বিড়ি ধরালো। তার মনে পড়লো মনিরুদ্দির প্রস্তাবটা। সে বলেছিলো সাহেবরাও খায়। ও খেলে কী হয়? স্পেশ্যালে যে সাহেবরা গেলে তারা তো খানাগাড়ির মধ্যে বসে মদ খেতে খেতেই গেলো। তবে অমন মুখের চেহারা কেন তাদের?
এতদিন তার যে অনুভবটা হয়েছে সেটা অত্যন্ত অনির্দিষ্ট ছিলো। সেটা এত লঘুস্পর্শ যে কথা দিয়ে সেটাকে প্রকাশ করতে গেলে অত্যুক্তি হয়ে গেছে। মাধাইয়ের নিজের কাছেই পরে মনে হয়েছে যা সে বললো সেটা সত্য নয়। স্টেশনের এতগুলি লোকের আর কেউ যা নিয়ে আলোচনা করে না সেটা তার নিজের অনুভবের ভ্রান্তিও তো হতে পারে। আজকের স্পেশ্যাল ট্রেনটাকে সে তার ভ্রান্তির বড়ো একটা প্রমাণ হিসাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিলো। এত আলো, এত আয়োজন, তাহলে সংসার স্বাদহীন হবে কেন? কিন্তু স্পেশ্যাল ট্রেনটাই যেন তার অনুভবকে সত্য বলে প্রমাণ করে গেলো।
চায়ের দোকান থেকে উঠে মাধাই নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। অনেক লোক আছে ডিউটি করার এখন। একজন অনুপস্থিত থাকলেও কারো চোখে পড়বে না।
ডাক শুনে সুরতুন উঠে বসলো, তারপর মাধাইয়ের গলা চিনতে পেরে দরজা খুলে দিলো।
সুরতুন বললো–ফিরে আলে এখনই? গাড়ি চলে গিছে?
হয়।
তাইলে আপনে ঘরে আসে শোও। আমি বারেন্দায় শুই।
মাধাই ততক্ষণে বারান্দায় বসে পড়েছে। সে বললো, তুই এখানে আয়। গল্প করি।
পরিস্থিতিটা অভিনব। মাধাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় অনেকদিনের হলো। এর আগেও মাধাইয়ের ঘরে সে অনেক রাত্রিযাপন করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফতেমা তার সঙ্গে ছিলো। অনেকক্ষেত্রে এমন হয়েছে সুরো একা বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়েছে। তখন ভরসা ছিলো মাধাই ঘরের মধ্যে আছে, ডাকলেই সাড়া পাওয়া যাবে। অন্য দু’এক ক্ষেত্রে মাধাই স্টেশনের কাজে ব্যস্ত থেকেছে, দেখা হলে সুরোকে ঘরের চাবি দিয়েছে কিন্তু কখনো ঘুমের মাঝখানে রাত্রির অন্ধকারে এমন করে ফিরে এসে সে ডাকেনি। পুরো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
মাধাই বললো, বোস না, গল্প করি, তোর কি ঘুম পাতেছে, সুরো?
ঘড়ির মাপে রাত্রির বয়স পরিমাপ করতে না পারলেও আকাশের যেটুকু চোখে পড়লো তাতে সুরো বুঝতে পারলো তখনো এক প্রহর রাত বাকি আছে। সে যন্ত্রচালিতের মতো মাধাইয়ের অদূরে বসে পড়লো।
কথা কস না যে? মাধাই প্রশ্ন করলো।
কী কবো?
রাত্রিতে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে কেউ যদি এমন সব কথা বলতে থাকে তবে সাধারণত তার মনের উদ্ভিন্ন অবস্থাটাই ধরা পড়ে যায়। ফতেমা যদি এখানে থাকতে হয়তো তার কাছেও মাধাইয়ের ভাবভঙ্গি অস্বাভাবিক বলে বোধ হতো। কিন্তু সে হয়তোবা মাধাইয়ের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করতো। তার থেকে আলাপের সূত্রপাত হতো। সুরোর মনে পড়ে না আর কবে মাধাই আহার্য এবং তার সংগ্রহের বিষয় ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলেছে, সেই এক পক্ষী আঁকার দিনটির কথা ছেড়ে দিলে। হাসিঠাট্টা মাধাই যে একেবারেই করে না তা নয়, কিন্তু সে-সবই ফতেমার সঙ্গে, সুরো শ্রোতামাত্র। প্রশ্নের উত্তর দিতে তবু সম্ভবত সুরো পারতো, কিন্তু নিজে থেকে প্রশ্ন করে আলাপের সূচনা করবে এমন শক্তি নিজের মধ্যে সে খুঁজে পেলো না।
তোর ব্যবসার কথা ক। কতদিন তো ব্যবসা করলি, কত টাকা জমাইছিস। সেব্যবসা নাকি বন্ধ হয়-হয়? মাধাই বললো।
পুলিস আর ব্যবসা করবের দিবিনে, মনে কয়। আর তাছাড়াও–
কী তাছাড়াও?
একদিন মোকামেও যদি চাল অ-পাওয়া হয়?
তা হতে পারে। তোরা কি ঠিক করছিস আর কোনো কালে গাঁয়ে ফিরবি না!
গাঁয়ে ফিরে আমার কী লাভ? সেখানে কেউ খাবের দেয় না। আর তাছাড়াও–
কী?
এখানে তবু আপনে ডাকে কথা কও। সেখানে না-খায়ে মরলেও কেউ কথা কয় না।
হুম। তোর এত ছুটাছুটি ভালো লাগে! আমার আর কাজ কাম ভালো লাগে না। মনে কয় চাকরি ছাড়ে দেই। তা যদি করি, আমাক তুই খাওয়াবের পারবি না? কলি না?
কী কবো? আপনে যদি কও, যাকও তাই করবো। সুরতুন এত বিস্মিত হলো যে মাধাইয়ের বক্তব্যটাকে পরিহাস মনে করতেও পারলো না।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাধাই প্রশ্ন করলো, সুরো, এ দুনিয়ার আমার কেউ নাই। তোর কে কে আছে?
সুরতন মাধাইয়ের কথাটা অনুভব করলো। সে বুঝে উঠতে পারলো না এ প্রশ্নের জবাব কী দিতে পারা যায়। আত্মীয়তার হিসাবে ফতেমা তার ভাই বউ, রজব আলি তাই জ্যাঠামশাই। গ্রামের বাইরে অনাত্মীয়ময় পৃথিবীতে তাদের নিকট বলে মনে হয়, গ্রামের ভিতরে তারা প্রতিবেশীর মতো। আর চালের কারবারে নেমে ফতেমার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসবের চাইতে বড়ো মাধাই, নির্ভরযোগ্য কোনো সম্বন্ধই যার সঙ্গে নেই, অকারণে যে প্রাণ বাঁচায়, প্রয়োজনের সময়ে যে পরামর্শ দেয়। তাকে আজকাল সুরোর সব আত্মীয়ের সেরা আত্মীয় বলে বিশ্বাস হয়। তা যদি না হতো তবে তার অনুমতি না নিয়ে কী করে কনকদারোগার তাড়া খেয়ে তার বারান্দায় এসে বসতে পারতো সে। কিন্তু এ সব কথা তো বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে সুরতুনের কেউ-ই নেই এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।
সুরো সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো।
মাধাই একটা বিড়ি ধরালো। লোহার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে সে বললো, ঘুম পালে। ঘুমাতাম, এখন কী করি বুঝি না। আমার আর কিছুই করার নাই। তুই কথা কয়ে যা, আমি শুনে? যাই।
আচ্ছা বায়েন, চাল যখন বেচা যাবিনে নুন বেচলি কি হয়? সে-ও তো দুর্মূল।নুনের মোকাম কনে?
তুই যাবি?
পথ দেখায়ে দেও।
সুমুদুর চিনিস?
হয়, শুনছি পদ্মার চায়েও বড়ো নদী।
সেখানে তালগাছ পেরমান ঢেউ। মনে কর এক-এক ঢেউ উঠতিছে পদ্মার ব্রিজের গায়ে জল লাগতিছে। সেই জল থিকে নুন হয়।
নুন কি ফেনায় ভাসে আসে?
জল শুকায়ে নুন।
জল কি পয়সা দিয়ে কেনা লাগে?
তা লাগে না।
তবে?
সুরতুন নিজেই চিন্তা করে প্রশ্নের উত্তর বার করলো। তার মতো হতভাগ্য আরো আছে। সকলেই তারা তাহলে নুনের মোকামে ছুটতো। সেখানেও নিশ্চয় পুলিস আছে। নতুন একটা হতাশায় তার মন ভরে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরে সুরতুন আবার বললো, মনে কয় আবার না-খায়ে থাকার দিন আসতিছে।
মাধাইয়ের মনে হলো, তার নিজের যদি আহারের উপরে এমন রুচি থাকতো! অন্তত এই মুহূর্তে আহারের কথা চিন্তা করতেও তার ইচ্ছা করছে না।
সুরতুন ভাবলো, পুলিস তাহলে এ কী করছে, বেড়াজাল দিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে? সহসা তার মধ্যে সান্দারনী ফুঁসে উঠলো। সম্ভবত মাধাইয়ের মতো নির্ভর করার উপযুক্ত পুরুষ কাছে ছিলো বলেই সে ক্রোধকে ভাষা দিতে সাহস পেলো।
সে বললো, জাত-সাপ পুলিস। আমাদের শত্রুর জন্ম-জন্মের। কেন্ শোনো নাই বায়েন, আমার নানা কী কতো? আমার নানা ছিলো আলতাপ, কতো–কোনোদিনই আর মিটবি না। আমার আম্মার আগের পক্ষের সোয়ামি ছিলো এক পুলিসের কনিস্টবল! সেকালে আমার বাপ ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ এ কথা জানতো না। বুধেডাঙার কাছে এক জাহাজ ডুবি হয় গাঙে। সান্দাররা ডুবে ডুবে সেই ডুবি-জাহাজ থিকে চালের বস্তা, লোহার পাত, কাপড়ের বান্ডিল বার করে আনলো। পুলিস ঘোরাফেরা করবের লাগলো। আম্মার সাথে আগে জানাশোনা ছিলো তার আগের সোয়ামির আমলে, এমন একজন কনিস্টবল কী করে না জানি মালের লুকোনো জায়গার খবর পায়; পুলিস বাঁধে নিয়ে গেলো সান্দারদের সব বেটাছাওয়ালকে। কও এই তো পুলিস। আগের সোয়ামির কাছে থাকে পুলিসি শিখছিলো। কী ঘেন্না তাই কও।
গল্পটা বলে সুরো বেপরোয়াভাবে সোজা হয়ে বসলো। জাতিগত ঘৃণার আতিশয্য প্রকাশ করতে গিয়ে সে যে নিজের মাকেই হীন প্রতিপন্ন করলো তা যেন সে বুঝতে পারলো না। কিংবা ক্ষয়িতাবশিষ্ট সান্দারত্বের এইটুকুই বোধ হয় বৈশিষ্ট্য।
মাধাই বললো–তাই বলে তুমিও পুলিসের শত্রুর হবা নাকি?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো সুরতুনের।
মাধাই আবার একটা বিড়ি ধরালো। খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে সে বললো, তার চায়ে ভালো এক সান্দার খুঁজে বার করে বিয়েসাদি কর। সে-ই খাওয়াবি পরাবি।
কথাটা একেবারেই নতুন নয়। চালের কারবারের সঙ্গীদের মধ্যে বসে এ ধরনের কথা এর আগেও সুরতুন শুনেছে। প্রথম প্রথম উৎকণ্ঠার মতো অনুভব হলেও এখন সয়ে গেছে, কারণ সে সব রং তামাশার কথা। কিন্তু মাধাইয়ের কথাকে হাসিঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে। বিবাহ ব্যাপারটাকেও পুলিসের বেড়াজালের মতো দিগন্তবিস্তৃত বলে মনে হলো। তার মনের মধ্যে যে আকুলতা অস্ফুট আবেগে ছটফট করতে লাগলো সেটার কোনো অংশে যেন এমন কথাও ছিলো–মাধাই, আপনে আমাক পুলিস আর বিয়েসাদি থেকে বাঁচাও।
রাত অনেক হয়েছে। অন্ধকার ঝিমঝিম করছে। বাঁদিকে রেল কলোনির শেষ। সেখানে কিটি ছোটো জঙ্গল-ঢাকা ডোবা আছে। এখন কিছু বোঝার উপায় নেই। চাপা গলায় কোনো নিশাচর ক্ষুদ্র প্রাণী সেখানে তার ক্ষীণ হিংস্রতা প্রকাশ করলো।
মাধাই বললো–রাত পেরায় শেষ হয়ে আলো। ঘুম পায় না তোর?
পায়। আপনে ঘুমাবে না, বায়েন?
হয়। ভাবনা দিনের বেলায় হবি। মাধাই বিড়ি ফেলে আঙুল মটকে সোজা হয়ে বসলো।
উঠে দাঁড়িয়ে সে বললো, তুই বারান্দায় শুবি, আলো জ্বালায়ে দেবো? ভয় করবি না?
না। মাঝেসাজে শুই একা। ঘরে আপনে থাকবা।
তা শো। দুয়ার খোলাই থাকবি।
মাধাই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
আঁচল বিছিয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়ার আগে সুরতুন ভাবলো–আমি আর ভেবে কী করি। না খেয়ে যখন মরতে বসেছিলাম তখন ভেবে কী করেছি।
কিন্তু নিজে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে সুরতুনের ইচ্ছা হলো, সে উঠে গিয়ে দেখে মাধাই ঘুমিয়ে পড়লো কিনা। এতক্ষণে সহসা একটা অনুভব হলো তার :কী যেন একটা হয়েছে, মাধাইয়ের অসুখ করেনি তো?
একটা তুলনা দিয়ে মাধাইয়ের এই ব্যাপারটার কাছাকাছি যাওয়া যায়। বোধ হয় এই রকম মানসিক অবস্থাতেই পুরুষরা স্ত্রীকে খুঁজে বার করে নিছক কথা বলার জন্যে। কথা বলা প্রয়োজন হয়ে থাকে।
০৬. শুধু পাল্কি করে আসা
শুধু পাল্কি করে আসার ব্যাপার নয়, দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সান্যালগিন্নি, সুমিতি যখন তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন সে অনেকদিনের পরিচিতের মতো রূপনারায়ণের একখানা হাত নিজের হাতে ধরে রেখেছে, হাসছে। একটু বিব্রত হলেও সে-হাসিটা সুন্দর। প্রার্থীর মতো লজ্জার হাসি নয় যে কুণ্ঠিত হতে হবে।
সুমিতি প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালে অনসূয়া বললেন–ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না।
আমিও পারছিলাম না। তবু আমার পড়ার টেবিলে আপনার একখানা ফটো আছে, আপনি আমাকে কোনদিন দেখেননি।
কিন্তু চেনা-চেনা লাগছেও বটে।
তা লাগবে। আমি আপনাদের ছোটোবউ সুকৃতির বোন।
সুকৃতি! সুকৃতির বোন? সান্যালগিন্নি অনসূয়া হাত বাড়িয়ে ব্যানিস্টার চেপে ধরলেন।
এক মুহূর্ত পরে সুমিতির কাঁধে হাত রেখে বললেন–এসো, ঘরে এসো। তোমাদের বংশ খুব উদার। তোমাদের পক্ষেই এমন করে আসা সম্ভব। সান্যালগিন্নি দৃশ্যতই বিচলিত হয়েছেন।
সুমিতিকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনসূয়া বললেন–খবর না দিয়ে এসে আমাকে খুশি করেছে কিন্তু নিজে কত কষ্ট পেলে।
না, কষ্ট হয়নি। একজন দারোগা আমাকে পাল্কি ঠিক করে দিয়েছিলো।
ওঁকে বললো খবর নিতে। লোকটি তাহলে ভদ্র।
ঘরে এসে অনসূয়া সুমিতিকে প্রশ্নের মাধুর্যে ডুবিয়ে দিলেন। কিন্তু কুশল প্রশ্নের মধ্যেই হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–তুমি এখন বিশ্রাম করো। ট্রেনের ক্লান্তিটা আগে যাক, আলাপ করবো।
অনসূয়া হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন কিন্তু কান্না তার বুকের ভিতরে উদ্বেল হয়ে উঠেছিলো। সুমিতিকে নিজের শোবার ঘরে বসিয়ে এসে নিজে কোথায় যাবেন খুঁজতে লাগলেন।
পনেরো-যোলো বছর আগেকার ঘটনা। দেবরকে বিবাহ দিলেন অনসূয়া, কলকাতার ব্যারিস্টার-পাড়ায় আত্মীয়তা করলেন। অনসূয়ার বহুদিনের ব্যবধানে থেকেও সে সব কালের ছোটো-ছোটো ঘটনা, ভুলে-যাওয়া কথাবার্তা মনে পড়তে লাগলো।
সম্বন্ধগুলির মধ্যে অনসূয়া যখন এটাকেই বেছে নিলেন, মাথায় উপরে শাশুড়ি ছিলো না, সান্যাল কপট বিরক্তিতে ভু কুঞ্চিত করে বলেছিলেন–ঐ সাহেবিপাড়ায়? আমাকে কি এখন। তামাক ছেড়ে চুরুট ধরতে হবে?
সান্যালগিন্নি অনসূয়া সুকণ্ঠে ঝংকার দিয়ে বলেছিলেন–আলো আসুক, একটা জানলা কাটো। প্রাগৈতিহাসিক মিনারে বাইরের আলো প্রবেশ করুক একটু।
শুধু বিলেত-ফেরত-পিতামাতার সন্তান বলেই নয়, সুকৃতি নানা দিক দিয়েই প্রশংসনীয়া ছিলো। গায়ের রঙটা বোধ হয় এই সুমিতি মেয়েটির চাইতে আর-একটু প্রকাশিত ছিলো। তার জ্ব দুটির কোনোটিতে যেন একটা কাটা দাগ ছিলো, ছোটোবেলার দুরন্তপনার চিহ্ন। আর সে বোধ হয় কথা বলার সময়ে ঠোঁট দুটিকে কেমন একটু উল্টে দিত। অনভ্যস্ত চোখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিলো না, মেয়েটি কোনো ব্যাপারকেই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না।
সমগ্র দেশের ছোঁয়াছুঁয়ির বাইরে রাজনৈতিক চাঞ্চল্যহীন গড় শ্রীখণ্ডের গড়-অধিবাসীদের জীবনে একবারইমাত্র রাজনীতি প্রবেশ করলো। খবরের কাগজে পড়া রাজনীতির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলো গ্রামটা। অনসূয়ার প্রার্থনার চাইতেও বেশি আলোক ফুটে উঠলো। কিন্তু সেটা বিদ্যুৎ-জ্বালা। মিনারের খিলানে-খিলানে আলোর উদ্ভাস এলো। মিনারটিও শতধা দীর্ণ হয়ে গেলো।
সান্যালমশাই কাছারিতে এসে বসেছেন। সম্মুখে প্রজাদের একটি ছোটোখাটো জনতা। তারা এসেছিলো পাটের দাদনের টাকা নিতে। লিভোয়ালকুঠির সাহেবরা যে-দাদন প্রতি বৎসর দেয় এবার তারা তা নেবে না, অথচ না-খেয়ে মরতে হবে কোনো দাদন না-পেলে। সান্যালের পক্ষে ব্যাপারটা ছিলো অন্যরকম। পাটের সাহেবের দালালরা এবং তাদের টাকার জোয়ারভাটা যথাক্রমে সান্যালের প্রতিপত্তির ভাগ নিচ্ছিলো এবং খাজনার একমুখী সহজ স্রোতের বাধা হয়েছিলো।
এমন সময়ে পুলিস এলো। ঘোড়া ও সাইকেল চেপেবড়ো ছোটো পুলিস অফিসারের একটি বাহিনী। অভূতপূর্ব দৃশ্য। কাহিনীতে শোনা, খবরের কাগজে পড়া একটা ব্যাপার তার নিজের বাড়িতে ঘটছে।
লিন্ডোয়াল কুঠির সাহেবের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিস সাহেবের সদ্ভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক, তবু পুলিসের নির্বোধ অভিযানে সান্যাল হাসতে পারলেন না, অপমানিত বোধ করে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। সারা বাড়িটা থমথম করছে।
কিন্তু যা ঘটে গেলো তার আশঙ্কা পুলিসরাও করেনি।
ছোটোবউয়ের বাক্স থেকে বেরুলো একখানা দুখানা নয়, পাঁচ-ছখানা চিঠি, যে-চিঠির হস্তাক্ষর পুলিসের নাকি পরিচিত। এতদিনে বোধ হয় সত্যিকারের নামটা ধরা পড়লো লোকটির।
চিঠিগুলো হাতে নিয়ে পুলিসের বড়োকর্তা সদরে এসে বসলেন। গম্ভীর মুখ করে বললেন আপনাদের ছোটোবউরানীকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার। সান্যাল পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হয়ে গেলেন।
–এই চিঠিগুলো পাওয়া গেছে ছোটো বউরানীর বাক্সে। এগুলোর লেখক আপনার ভাই নয়। ছোটোবউরানীর কোনো আত্মীয়ও নয় বোধ হয়।
চিঠিগুলো সত্যি কোথায় ছিলো, চিঠিতে কী লেখা আছে, আর জানার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা তাতে আছে কিনা, যতটুকু আছে তাতে ছোটোবউরানী রাষ্ট্রদ্রোহীদের একজন বলে প্রমাণিত হয় কিনা এসব জানারও প্রয়োজন নেই। ছোটোবউরানীর বাক্স থেকে অপরিচিত একজন পুরুষের চিঠি বেরিয়েছে এ-ই যথেষ্ট। চারিদিকে আমলা-কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে, তারা কেউ কি খোঁজ করবে চিঠিতে কী লেখা আছে–অপরিচিত পুরুষের চিঠি এই কথাটা শোনার পর? সান্যালমশাই হাতের ইশারায় পুলিসের কর্তাকে নিরস্ত করলেন। তার চোখের কানায় কানায় অশ্রুও দেখা গেলো।
কিন্তু সব উল্টোপাল্টে গেলো। কথাটা অন্দরেও রটেছিলো ইতিমধ্যে। নাকি ভাগ্যের দান হিসাবে এই আবিষ্কার করে রটিয়ে দেওয়াই ছিলো পুলিসের উদ্দেশ্য? পুলিস প্রশ্ন করবে এ বোধ হয় সুকৃতির ভয় হয়েছিলো। বোধ হয় তার মনেও কথাটা বার বার গুটিয়ে গুটিয়ে উঠছিলোপরপুরুষের চিঠি।
খিড়কির পুকুরটার চারিদিকে এখন গভীর জঙ্গল। তারপর থেকেই ওটা অযত্নে পড়েছে। খিড়কির দরজায় যে-পুলিসটি পাহারায় ছিলো সে ছুটে এসে খবর দিলো।
–কী হয়েছে?
পুলিসের কর্তারা এবং সান্যাল নিজেও উঠে দাঁড়ালেন।
কে একজন জলে লাফিয়ে পড়লো। উঠলো না।
ঠিক দেখেছিলো সে। দামী শাড়ি ও অলঙ্কারের একটা ঝিলিক লেগেছিলো তার চোখে। সম্ভ্রমে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপরে ঠাহর করেছিলো বিষয়টি।
তারপরের দৃশ্যগুলি ভাবতে পারেন না সান্যালগিন্নি। অনুকম্পা ও বেদনার সঙ্গে ঘৃণাও মিশে যায় চিন্তায়। মন থেকে ভাবটাকে দূর করার জন্যই তিনি চেষ্টা করেন। মৃত্যুতে মৃত্যুতে বাড়িটা সেদিন ছেয়ে যেতে পারতো। রিভলবারসুদ্ধ সান্যালের হাত দুখানা তিনি প্রাণপণ বলে চেপে ধরেছিলেন। পুলিসদের সঙ্গে আর দেখা করতে দেননি।
রাজনীতি নয়, মিথ্যা একটা কলঙ্ক। তারই জন্য একটা প্রাণের অবসান হলো। সান্যাল লড়েছিলেন। কোর্টে নয়। তখনকার দিনে যতদূর হওয়া সম্ভব ছিলো, মিথ্যা কলঙ্ক রটানোর অভিযোগে পুলিসের বড়োকর্তা তিরস্কৃত হয়েছিলেন তার ওপরওয়ালাদের কাছে। কিন্তু শারি কথা দূরে থাকুক, সান্যালের ক্রোধের উপশমও হয়নি তাতে। সেই ক্রোধ হয়তোবা তাকে রাজনীতিগত প্রতিহিংসার পথে টেনে আনতে, ব্যাক্তিগত ক্রোধ জাতিগত বৈরে মিশে যেতে পারতো, কিন্তু সান্যালের ডান হাতখানাই ভেঙে দিলো তার ছোটোভাই। সান্যালবংশের ছেলে কিনা বৈষ্ণব সন্ন্যাসী হলো!
কিছুক্ষণ সান্যালগিন্নি অস্থিরচিত্তে এঘর-ওঘর করতে লাগলেন। এটা গোছান, ওটা ঝাড়েন নিজের হাতে। অবশেষে সান্যালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে রূপু এসে খবর দিয়ে গেছে। খবরটা সারা বাড়িতে রাষ্ট্র করার ভার নিজের মাথায় নিয়ে রূপু ততক্ষণ এ-দরজায় ও দরজায় খবর বিলোচ্ছে।
সান্যাল বললেন–এসো।
অনসূয়া বললেন–ও সুমিতি, আমাদের সুকৃতির বোন।
-–শুনলাম তাই।
হোক একটা ছোটোমেয়ে, তবু মহামানী আত্মীয়। তাকে অভ্যর্থনা করা, তার আতিথ্যের যথোচিত ব্যবস্থা করা গুরুতর বিষয়। বেদনাটাও মনে পড়লো সান্যালমশাইয়েরও।
কিন্তু তিনি যা এইমাত্র বললেন তারপরে আর কী বলার থাকতে পারে? বিচলিত হয়ে সান্যালমশাই বললেন–কাউকে একটু তামাক দিতে বলল।
এদিকে অনসূয়া চলে যাওয়ার পরে বিপদ হলো সুমিতির। স্টেশনে নেমে কনকদারোগাকে যা সে বলে এসেছিলো সেকথাটা মনে পড়লো। এখানে নেমে সে নিজের যে-পরিচয় দিয়েছে– তার সঙ্গে কনকদারোগার কাছে দেওয়া আত্মপরিচয়ে পরস্পর বিরোধ না-থাকলেও পরিচয় দুটির পার্থক্য আছে। এ বাড়ির একটি স্ত্রী, আর এবাড়ির একটি স্ত্রীর আত্মীয় হওয়া এক ব্যাপার নয়। আজকের দিনটা এক পরিচয়ে সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর কাল সকালে দ্বিতীয় পরিচয়টা সকলকে জানানো কী করে সম্ভব হবে? সুমিতির মনে হলো ইতিমধ্যে দেরি হয়ে, গেছে। এরপরে তার অন্য পরিচয়টি বলতে গেলে শ্রোতাদের চোখে যে বিস্ময় দেখা দেবে তার সঙ্গে অবিশ্বাসও থাকবেনা কি? অবিশ্বাস যদিনা-ও থাকেনানারকম সন্দেহ থাকবে তাদের গলায়।
কিন্তু একটা বাড়িতে ঢুকে কীকরে বলা যায় আমি আপনাদের বউ। সঙ্গে এবাড়ির ছেলেটি নেই তবুবলতে হবে আমি বেটা বউ আপনাদের। প্রথম পরিচয়ে এই কথা বলা যেন উপন্যাসে পঠিত স্বামী-পরিত্যক্ত স্ত্রীদের আত্ম-অধিকারের দাবির মতো শোনাবে।
সুমিতির আবার মনে হলো এমন সমস্যাসঙ্কুল দেশে আসা ভালো হয়নি। সংসারে চলা রাজনীতির চাইতেও কঠিন এই মনে হলো তার। আসার উদ্যোগ করতে করতে নিজে সে এখানকার সকলকে কী করে গ্রহণ করবে এটাই ভেবেছিলো। তাকে এরা কীভাবে গ্রহণ করবে । সেকথাটা মনে হতেই স্বতঃসিদ্ধের মতো সে ধরে নিয়েছিলো একজন ভদ্রমহিলাকে একটি ভদ্র পরিবার যেভাবে গ্রহণ করে তাই হবে। কিন্তু ঠিক এখন তাকে চিন্তা করতে হলো–এরা তাকে কি গ্রহণ করবে?
দাসী এলো স্নানের ঘরে যাওয়ার তাগিদ দিতে।
স্নানের ঘর সুমিতিকে খানিকটা অন্যমনস্ক করে দিলো। রাজনীতির একটি পুরনো পাঠ মনে পড়ে গেলো তার।কলকাতা শহরনয় যে পাঁচতলায় জল উঠবে বৈদ্যতিক শক্তিতে। এই গ্রামের অধিবাসীদের যদি শয়নকক্ষের কাছাকাছি স্নানের ঘর দরকার হয় কী করে এরা তার ব্যবস্থা? উপায়টা জানা না-থাকলে সেই অত্যন্ত সহজ উপায়টাও চোখে পড়তে চায় না।
কালোপাথরের স্নানের ঘর। পাথরের চৌবাচ্চায় জল টলটল করছে। ঘরটা এমন ঠাণ্ডা, স্নানের ঘর না বলে ঠাণ্ডীগারদ বলা যায়। দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলা আছে বোধ হয় এই মনে করে সুমিতি চারদিকে ফিরে দেখলো। কালো পাথরের উপর শাদা দেওয়াল উঠেছে ছাদ পর্যন্ত, দেয়ালগুলি শাদা পাথরের নয় কিন্তু পাথরের মতোই চিক্কণ। দাসদাসীর মাথায় এই জল উঠেছে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে।
সুমিতি গায়ে জল ঢালতে ঢালতে বললো নিজেকে সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আর একটা নিদর্শন।
স্নান শেষ করে বেরিয়ে সুমিতি দেখলো শোবার ঘরের একপ্রান্ত ইতিমধ্যে বিলেতি হোটেলের এক টুকরো হয়ে উঠেছে।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অনসূয়া ঘরে ঢুকলেন।
এসো। সেই সকালে বেরিয়েছে।
কিন্তু আমি তো থাকতে এসেছি।
সান্যালগিন্নি চিরাচরিত ভাষায় বললেন, সে তো খুব আনন্দেরই হবে। কিন্তু তিনি ভাবলেন: এ তো কখনো সম্ভব নয় সুমিতি তার সঙ্গে পরিহাস করবে, তবে এ কথাটা বলছে কেন? কী জানিঃ আজকালকার মেয়ে, হয়তো বা সম্বন্ধের সুবাদে পরিহাসই করছে।
এসো। মুখে দাও কিছু।
নতুন বউদের ব্রীড়ার কথা শুনেছে সুমিতি। হঠাৎ যেন তেমনি একটা জড়তা এলো তার। অনসূয়া অতিথিকে সহজ করার জন্য বললেন, তুমি বোসো, সুমিতি, খেতে খেতে গল্প করো, শুনি।
সুমিতি টেবিলে বসে বললো, আমার এমন সম্বন্ধ আপনার সঙ্গে,আমাকে এমন করে বসিয়ে খাওয়ালে নিন্দা হবে।
নিন্দা হয় না। পৃথিবীতে সবচাইতে আপন লোকগুলিকেই সামনে বসে খাওয়াতে হয়। সেও নাকি এক স্বার্থের ব্যাপার।
কিন্তু আমি তো আপনার বড়োছেলের স্ত্রী।
স্ত্রী? খোকার? খোকার বউ তুমি?
চশমার আড়ালে অনসূয়ার চোখ দুটির কীকী পরিবর্তন হলো, তার মুখের পেশীগুলো কী করে সংকুচিত হলো এসব দেখতে পেলো না সুমিতি। সে টেবিলের অপ্রয়োজনীয় কাটা চামচগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো মুখ নিচু করে।
অনসূয়া বললেন, তোমার অসুবিধা হচ্ছে সুমিতি, আমি রূপুকে পাঠিয়ে দিই। তিনি স্থান ত্যাগ করলেন। দাসী এলো।
সে বললে–বামুনদিদি জানেন না আপনি চা কিংবা কফি খাবেন। তাই দুই-ই পাঠিয়ে
দিয়েছেন।– সুমিতি চেষ্টা করে দাসীকে একটা হাসি উপহার দিলো। দাসী চলে গেলে সুমিতি এক কাপ কফি ঢেলে নিলো। ঢেলে নেবার আগে সে চিন্তা করেছিলো : কিছুই যদি সে স্পর্শ না করে সেটা লক্ষণীয় হয়ে উঠবে দাসদাসীদের চোখেও। দ্বিতীয় পর্যায়ে সে ভেবেছিলো স্নায়ুগুলিকে সতেজ করা দরকার, সামনে যে-সময়টা তাতে একটু শক্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে।
সুমিতি ভেবেছিলো, এরপরে বাড়ির ছেলেরা অন্তত দু’একজন আসবে, খবরটা রাষ্ট্র হবার পর মেয়েরাও আসবে।
সন্ধ্যার সময়ে দাসী এসে আলো দিয়ে গেলো। রূপনারায়ণ এলো একবার। হাতের বইগুলি সমিতির সম্মুখে টেবিলে রেখে বললোমা পাঠিয়ে দিলেন আপনার জনে।
দু-একটা সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রূপনারায়ণ চলে গেলো। রাত্রি বাড়তে লাগলো। সুমিতি লক্ষ্য করলো দরজার বাইরে একজন দাসী ছোটোখাটো কীকাজ নিয়ে বসে আছে। দেখে বোঝা যায় কাজটা উদ্দেশ্য নয়, বসে থাকাই উদ্দেশ্য। সে যে সুমিতির আদেশেরই অপেক্ষা করছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
সুমিতি উঠে দাঁড়িয়ে শয্যার দিকে অগ্রসর হলো। আলোটাকে টেনে নিয়ে বিছানায় গা ঢেলে দিয়ে একখানা বই তুলে নিলো। সে যে বধূ হিসাবে সমাদৃত হলো না এতে সন্দেহ করার কিছু নেই।
আশ্চর্য হওয়ার কী আছে, বইয়ের মলাটে চোখ রেখে ভাবলো সুমিতি, কপালে তার সিঁদুর পর্যন্ত নেই। সামন্ততান্ত্রিক কথাটা আবার তার মনে হলো। সে-পরিবেশে তার আকস্মিক প্রবেশটা একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার হয়েছে। বিবাহ বলতে বহু অর্থব্যয়ের বহু কোলাহলের শেষেব্রীড়াবনতা একজনকে বরণ করার যে চিরাচরিত পদ্ধতির সঙ্গে এরা পরিচিত তার সঙ্গে আজকের বাহুল্যবিহীনতার বৈপরীত্য অত্যন্ত প্রখরভাবে স্পষ্ট। আভিজাত্যের আত্মাভিমান না-থাকলে হয়তো বা তার আশ্রয় পাওয়াই দুরূহ হতো, এরা অভিজাত বলেই নীরব উপেক্ষায় তাদের মতামতটা পরিস্ফুট করে দিয়েছে।
০৭. ফুলটুসি শহরের মেয়ে
ফুলটুসি শহরের মেয়ে আর সুরতুন গাঁয়ের।
যে গলিটায় টেপির জন্য চেকারবাবুবাসা করে দিয়েছে তারই অপর প্রান্তে ইসমাইল কসাইয়ের বাড়িতে ফুলটুসি থাকে। ইসমাইলের অনেক নাম ছিলো একসময়ে। এখন প্রধান হয়ে আছে ইসমাইল। তার কাছাকাছি খ্যাতিযুক্ত অন্য নাম বোঁচা।
এখন আর তার সেদিন নেই, বয়স হয়েছে। এখন সে বাজারে গিয়ে দোকান করে না। তার বাসার সামনের দিকের ঘরখানায় বসে দিনের বেলায় মাংস বিক্রি করে। সে-সময়ে তার দোকানের বিক্রিটায় ভিড় হয় না। গতরাত্রির রঙের দাগ মুখে আছে এমন সব শীর্ণদেহ জীর্ণরূপ মেয়েরাই বেশি আসে তার দোকানে। আর আসে দু-চারজন পুরুষমানুষ। এদের কী জীবিকা। এ যেন পৃথিবীর কেউ জানে না। দিনের বেলায় এদের প্রায় সকলের পরনেই মলিন লুঙ্গি, পায়ে ছেঁড়া জুতো।ঠিক সন্ধ্যার সময়ে এদের দেখা যাবে গলিটার মোড়ে মোড়ে ঘুরে বেড়াতে, পরনে মলমলের পাঞ্জাবি, পায়জামা; কারো কারো গলায় ফুলের মালা। রাত্রি গম্ভীর হলে গলিটার বন্ধ দরজাগুলির বাইরে বাইরে এরা ঘুরে বেড়ায়। শেষরাত্রির কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যাবে কোনো একটি বারান্দায় মোমবাতির আলোয় গোল হয়ে বসে গুটি খেলছে।
সন্ধ্যার পর ইসমাইলের বাসার কাছে ভিড় জমে যায়। তখন রান্না করা মাংস বিক্রি হয় তার দোকানের সামনের দিকে। কিন্তু তার চাইতেও ভিড় বেশি হয় তার বাড়ির ভিতরে। দেশীদারু তাড়ি তো পাওয়া যায়ই, প্রয়োজন হলে বিলেতি মদের ছোটোখাটো বেঁটে বোতলও দু’একটা সে ঘরের মেঝে খুঁড়ে বার করে দিতে পারে।
কিন্তু তার দোকানে মাঝেমাঝে পুলিস বড়ো জুলুম করে। গত বৎসর শ্রাবণ মাসে পুলিস এসে তাকে বললো–ইসমাইল মিঞা, এবার কিছুদিন ঘুরে আসতে হয়।
–জি?
–বড়ো বেশি গরম করে তুলেছে।
–জি।
–কাউকে বাকি দিতে আপত্তি করেছিলেন কি না, পাওনা টাকার জন্য গালমন্দ করেছে?
–জি, না। সেই নতুনকনেস্টবলবাবু বাসা ভুল করেছিলো। আমার বউকে মনে করেছিলো–
–বলো কী? তোমার নতুন বউ ফুলটুসি?
–জি। তবে নেশার মাথায় ওরকম গোলমাল হয়। আমি কিন্তুক ধরে নিয়ে গিয়ে যমুনার ঘরে দিয়ে আসছি। সেই যমুনা গো, ঐ যে কলেজের মিয়ে সাজে বেড়ায়, নাকি সুরে গান করে।
–বেশ করেছে। এখন চলল। মাস চার-পাঁচ হবে।
–না হলে হয় না?
–না বোধ হয়। কনেস্টবলবাবু কড়া রিপোর্ট করেছে। বি. এ. কেস। অনেক সাক্ষী।
বি. এ কেস? ইসমাইল হাসলো।তাও ভালো, পকেট কাটার দায় নয়।
ইসমাইল তার ব্যবসায়ের টেক্স দিতে গেলে পুলিসের সঙ্গে গল্প করতে করতে, ফুলটুসি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো।
এরপর চালের কারবারে নামতে হলো ফুলটুসিকে।
ইসমাইল চলে গেছে বলে দুঃখিত নয় সে, ইসমাইল ফিরে এসেছে বলেও সুখী নয়। ইসমাইল ফিরে এসে তার চালের কারবারের কথা জানতে পেরে বলেছিলো–এদিকে ভালো সরু চাল পাওয়া যায় না, মোকাম থেকে ভালো চাল আনবি। ফুলটুসি এখনো চালের ব্যবসা করে যাচ্ছে। চাল যত ভালো ইসমাইলের কৌশলে পচানি নাকি তত মালদার হয়ে ওঠে।
নিজের জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করার সময় নেই ফুলটুসির। আসন্ন বিপদ থেকে নিজেকে এবং সন্তান দুটিকে রক্ষা করার কৌশল খুঁজতেই তার দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। তার মধ্যেও যেটুকু তার মনে পড়ে সেটা নিছক বর্তমান। অতীতের দিনগুলি খুব অস্পষ্টনয়, কিন্তু বর্তমানের দিনগুলি এত গভীর রঙে রাঙানো যে তার পাশে নিকট অতীতকেও সুপ্রাচীন স্বপ্নের মতো মনে হয়। সে আশৈশব ইসমাইলের পরিচিত। তার যখন তিন-চার বছর বয়েস তখন ইসমাইল তাকে কবে যেন একটা রঙিন ফরক’ এনে দিয়েছিল। তারপর কিছুকাল ইসমাইল মাঝেমাঝেই জেলে গিয়ে দীর্ঘসময় কাটিয়ে আসতো। ইসমাইলের ছেলে ইয়াজ তার সমবয়সী প্রায়। তারা দুজনে পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে। ইসমাইলের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি তখনো তাদের কাছে মূল্যবান কিছু ছিলো না। এ সময়ে ইসমাইলের বাড়িতে একটি প্রৌঢ়া থাকতো। একই খোঁয়াড়ে আবদ্ধ তিনটি প্রাণীর পারস্পরিক সম্বন্ধ কিছু থাকানা-থাকা যতটা মূল্যবান,ইসমাইলের সংসারে আবদ্ধ সেই প্রৌঢ়া, ইয়াজ ও ফুলটুসির সম্বন্ধও ততটা। এখন সে সব সম্বন্ধ ফুলটুসির কাছে শৈশবের বোকামি বলে মনে হয়।
ইসমাইলের কাছে ফুলটুসি কৃতজ্ঞ। আবাল্য সে এ বাড়িতে বাস করতে পেয়েছে। অন্নের অভাব হয়নি। তারপর এখন থেকে পাঁচ-সাত বৎসর আগে সেইসমাইলের স্ত্রীহলো। দুটি সন্তান, হাঁড়িকুঁড়ি, উনুন, ইসমাইলের শয্যা-দিবারাত্রি। প্রতিবেশী নেই, সঙ্গী নেই। শুধু ইয়াজ ধূমকেতুর মতো এসে উদিত হয় কখনো কখনো।কী আক্রোশ তার কে জানে! পাঁচ-সাত বৎসর ধরে এ আক্রোশ সে পুষে রেখেছে। অতীতের একটি দিনের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে ফুলটুসির। তার প্রথম সন্তান তখন হামা টানতে শিখেছে। সে রান্নাঘরের মেঝেতে জল ঢেলে কাদা করে সারা গায়ে কাদা মেখে হামা টেনে বেড়াচ্ছে। ইয়াজের ভাত গুছিয়ে দিতে দিতে সেদিকে নজর পড়লো ফুলটুসির। কাকে আর বলার আছে মায়ের এই প্রথম গর্বের কথা, প্রথম সন্তানের এই অপূর্ব বীরত্বের কথা! প্রৌঢ় ইসমাইলের কাছে এমন কথা তুলতে সাহস হয় না। প্রতিবেশী কেউ নেই যে তাকে বলা যাবে। চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি মায়ের পক্ষে সন্তান তথাপি গর্বের বিষয় তো বটে। ফুলটুসি বলেছিলো ইয়াজকে–কেন, ভাই, ছাওয়াল আমার। ইস্টিশনের বড়োমাস্টার হবি?
ইয়াজ গোঁজ হয়ে বসেছিলো। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে থু থু করে ফুলটুসির মুখের উপরে থুথু ফেলে বাড়া ভাত না-খেয়ে বেরিয়ে গেলো।
রাগে অভিমানে ফুলটুসি খানিকটা কাঁদলো। একবার সে ভাবলোইসমাইলকে বলেও দেবে, কিন্তু ভাবতে গিয়ে খটকা লাগলো তার। ইয়াজ যে তাকে ঘৃণা করে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সহসা তার মনে হলো ঘৃণাই যুক্তিসংগত।
কিন্তু ইয়াজের যুক্তিসংগত ঘৃণার চাইতে বড়ো ভয় ইসমাইলের ছুরিকে, যে-ছুরি অনায়াসে পাঁঠাবরি-দুম্বার গলায় বসছে দিনে বহুবার। ইসমাইল যদি তার প্রতি কোনো অন্যায় করেই থাকে তার প্রতিকার কোথায় পাওয়া যাবে? তার অন্নে সে বেড়ে উঠেছে, তার অন্ন এখনো তার জীবিকা। সে যদি রাত্রির অন্ধকারে তাকে কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত করে নদীর জলে ফেলে দিয়েও আসে কেউ খোঁজ নিতে আসবে না। আপন-পর সবকিছুই ইসমাইল। সে যদি বলে একদিন ফুলটুসিকে হাট থেকে কিনে এনেছিলো আর একদিন হাটে বিক্রি করে আসবে, কিংবা একদিন পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছিলো তেমনি একদিন পথে ফেলে দিয়ে আসবে, ফুলটুসির কিছু বলার থাকবে না। ইসমাইলের বাড়ির মধ্যে খোঁয়াড়ে প্রতিপালিত অনেক ভেড়া-বরি থাকে। তাদের মধ্যে একটা ছাগীমৃত্যুর অনেক তিথি পার হয়েছিলো। এটা ফুলটুসি লক্ষ্য করেছে ইসমাইলের গায়ের গন্ধ পেলে খোঁয়াড়ের মধ্যে প্রাণীগুলি ছটফট করে। ছাগীটা কিন্তু ইসমাইলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আহার্যের লোভে। তার সন্তান-সম্ভাবনা উপস্থিত হয়েছিলো। একদিন কী মনে করে ইসমাইল সেটাকে দুহাতে চেপে ধরে তার গলাটা কেটে দিলো। ফুলটুসির প্রাণীহনন-অভ্যস্ত প্রাণও আহা-আহা করে উঠেছিলো। ফুলটুসির মনে হয় ছাগীটাও ইসমাইলের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলো। নাকি ওভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হলে চোখের দৃষ্টিটা ওরকম হয়ে যায়?
সুরতুন ভীরু, ফুলটুসিও। শহরে থেকেও ফুলটুসি সাহসী হয়নি। এদের মধ্যে পার্থক্য এই: সুরতুন ভয় থেকে পালানোর জন্য সর্বদা চেষ্টা করছে, ফুলটুসি কোনো কোনো ভয়ের কারণকে মেনে নিয়েছে।
সন্তান দুটিকে সঙ্গে নিয়ে ফুলটুসি স্টেশনে এসে দেখলো টেপির মা শেষের দিকে একটি কামরার কাছে যাত্রীদের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ভিক্ষা করছে। এটা তার একটা কৌশল। গাড়ির দরজার কাছাকাছি ঘোরাই উদ্দেশ্য।তারপর গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে কোনো একটিতে উঠে পড়া। ফুলটুসি সেই কামরার কাছে গিয়ে দেখলো ভিড়ের মধ্যে ফতেমাও আছে। ফুলটুসি ছেলেদের নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ছেলে দুটি কথা বলছিলো, ফতেমা আঙুল তুলে ইশারা করতেই থেমে গেলো। যাত্রা শুরু হলো।
কিন্তু ভয়ই মৃত্যুর কারণ হলো ফুলটুসির।
গাড়ি ছাড়তে ছাড়তেই একটি বুড়ো যাত্রী বললো, তোমরা বোধ হয় চালের কারবার করো, না?
এরা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তাহলে তাদের চেহারা দেখলেই কি লোকে আজকাল চিনতে পারে?
তা বেশ করো। কিন্তু আজকের এ গাড়িতে চেপে ভালো করোনি। সাহেব চেকার আছে। তাছাড়া আজ সকাল থেকে প্রতি জেলার সীমায় গাড়ি থামিয়ে পুলিসরাও গাড়িতে তোমাদের মতো কেউ আছে কিনা খুঁজে দেখছে।
টেপির মা বললো, আমরা ভিক্ষে করে খাই বাবা, আমাদের পুলিস কী করবি, বাবা।
ফতেমা বললো, আমাদের যা চাল তা-ও ভিক্ষে করা।
ফুলটুসি সুরতুনকে ফিসফিস করে বললো, পুলিস কি সত্যি আসবি?
তাই হবি, হয়তো।
কী হবে কে জানে। ফুলটুসি হাত বাড়িয়ে ছেলে দুটিকে কোলের কাছে টেনে নিলো। একটির বয়স সাত, অন্যটির পাঁচ। ধূলি মলিন নোগারোগা দুটি অযত্নলালিত শিশু, কিন্তু স্বভাবতাই ফুলটুসির দৃষ্টিতে তারা অনন্য। গতবার চালের মোকাম থেকে ফিরে সে একটা বড়ো রঙচঙে গামছা কিনে দুটুকরো করে লুঙ্গির ঢঙে পরিয়ে দিয়েছে তাদের। ইসমাইল যে ইসমাইল সে ও দেখে হাসি হাসি মুখেই বলেছিলো–বেশ হইছে, মোগ্লাজিদের মতোই। ফুলটুসির মনে হলো এমন চকচকে লুঙ্গি পরিয়ে আনা ভালো হয়নি। এত লোকের মধ্যেও এদের উপরেই যেমন তার চোখ দুটি বারে বারে গিয়ে পড়ছে চেকারদেরও তেমনি পড়বে। সুরতুন কতকটা বেপরোয়ার মতো এবার গাড়িতে উঠেছিলো। অবশ্য সঙ্গে ফতেমা এবং টেপির মা দু-পাশে আছে বলেই তার সাহস। তবু ফুলটুসির কথা শুনে তার গলা শুকিয়ে গেলো। সে ফতেমার হাত ছুঁয়ে বসে রইলো।
হঠাৎদুটি স্টেশনের মধ্যে চিৎকার করতে করতে গাড়িটা থেমে গেলো। যাত্রীরা তখন ঘুমের নেশায় ঢুলছে। বুড়ো যাত্রীটি নিদ্রাহীন। সে বললো, এবার বোধ হয় চেক হবে।
ফতেমারা সরে সরে বসলো। ফতেমা বললো, ভয় কী? সঙ্গে চাল নি। ট্যাকা কিন্তুক কেউ বার করবা না, বলবা ট্যাকা নাই।
ফুলটুসি কিন্তু এদের কথায় যোগ দিলো না। এরা কিছু বলার আগেই পিছন দিকের দরজাটা খুলে বাইরের অন্ধকারে সে নেমে পড়লো। শুধু নেমে পড়া নয়, পাশের লাইনটা পার হয়ে, লাইনের ওপারের গাছগুলোর ছায়ায় গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
কিন্তু তেমনি একটা শব্দ করেই গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো। ছুটন্ত গাড়ি ধরবার জন্য ফুলটুসি ছুটে এলো। হাতল হাতের নাগালের বাইরে, উপরের দিকের একটা পাদানি হাত দিয়ে ধরে উঠতে গেলো ফুলটুসি, পায়ের তলায় কোনো অবলম্বন পেলো না। একটা আতঙ্কময় শূন্যের মধ্যে দিয়ে ক্ষণস্থায়ী একটা আঘাতের অনুভব পার হতে-না-হতে ফুলটুসির সব অনুভব মিলিয়ে গেলো।
খবরটা এরা তখন তখনই পেলোনা। প্রথমে ভাবলো পেছন দিকের কোনো কামরায় উঠেছে সে। পর পর কয়েকটা স্টেশনে গাড়ি ধরলেও যখন সে এলো না তখন এরা স্থির করেছিলো সে উঠতে পারেনি গাড়িতে। ফিরবার পথে খবরটা এলো। সবাই পাথর হয়ে বসে রইলো। কান্নাকাটি করে ক্লান্ত হয়ে ছেলে দুটি ফতেমার পাশেই বসেছিলো। ফতেমা এতক্ষণ তাদের প্রবোধ দিয়েছে আর-একটু দূরে গেলেই পাওয়া যাবে মাকে। এবারও যখন স্টেশনটা থেকে গাড়ি ছেড়ে দিলো আর ফুলটুসির বড়োছেলে জয়নুল প্রশ্ন করলো তার মা এলো না কেনে, ফতেমা উত্তর দিতে পারলো না। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কাঁদতে লাগলো।
বেদনাতুর হৃদয় নিয়ে এদের দলটি দিঘার স্টেশনে নামলো। স্টেশনে নেমে সুরতুনের মনে হলো: অনেক বিপদের কথা তারা কল্পনা করেছে এই ব্যবসা সম্বন্ধে, এমন চূড়ান্ত বিপদের কথা মনে আসেনি কারো। প্রায় মাস চার-পাঁচ আগে টেপির মা যে-ঘটনাটা ঘটিয়েছিলো বিরামগঞ্জের স্টেশনে তারই সত্যিকারের রূপটা যে এত নির্মম তা সেদিন বোঝা যায়নি। স্টেশনের কর্তৃপক্ষ টেপির মায়ের চালের পুঁটুলিটা আটকে ফেলেছিলো। গাড়ি ছাড়তে বেশি দেরি নেই। টেপির মা আত্মহত্যাই যেন করবে এমনভাবে প্ল্যাটফর্ম থেকে রেল লাইনের উপর নেমে পড়লো দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দুখানা কামরার ফাঁক দিয়ে। রেলের কর্মচারীরা ভীত হয়ে তাকে তখনকার মতো চালের পুঁটুলি ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
সুরতুন বললো ফতেমাকে–ছাওয়াল দুডে?
–আর কোথায় যাবি, ওরে বাপ কনে থাকে তাও জানি নে।
নিজের চালের পুঁটুলিটা সুরতুনের হাতে দিয়ে ফতেমা ছেলে দুটির হাত ধরলো।
০৮. চিকন্দির শ্রীকৃষ্টদাস অধিকারী
চিকন্দির শ্রীকৃষ্টদাস অধিকারীর বাড়িতেই গ্রামের সংকীর্তনের আখড়া।
গ্রামের এ দিকটায় একসময়ে কারো সখের বাগিচা ছিলো, কতগুলি বড়ো
বড়ো গাছের সুবিন্যস্ত ভিড় দেখে বোঝা যায়। বাগিচার অবশ্য আর কিছু অবশিষ্ট নেই। জায়গাটা প্রয়োজনের চাইতে বেশি ছায়া-সুশীতল।
বহুদিন পূর্বে, শোনা যায় সান্যালরাও নাকি তখন চিকন্দিতে আসেনি, বাগানটির একটা আম গাছের নিচে এক সর্বত্যাগী বৈষ্ণব সন্ন্যাসী আসন করে বসেছিলো। স্থানটি পছন্দ করার কারণ নাকি আম গাছটাকে জড়িয়ে জড়িয়ে একটা মাধবীলতার বোপ ছিলোতখন। এই রকমই প্ৰবাদ।
রায়বাবুরা তখন গ্রামের একচ্ছত্র জমিদার। সেই রায়বাবুদের একটি ছোটো ছেলে বিপথে গিয়েছে এই অভিযোগে রায়কর্তা তাকে গ্রাম ছাড়বার হুকুম দিলেন। সন্ন্যাসী টললো না, ‘রাধারানীর ইচ্ছা–এই বলে সে রায়বাবুদের এক্তিয়ারের মধ্যেই স্থির হয়ে বসে রইলো। রায়কর্তার মৃত্যুর পরে রায়দের বিপথে যাওয়া ছেলেটিই নাকি বাগানখানি বৈষ্ণবদের দান করেছিলো। একটা আখড়া হয়েছিলো সেখানে।
কিন্তু আখড়ার কোনো চিহ্ন আর এখন চোখে পড়ে না। সেই সন্ন্যাসীর পর স-বৈষ্ণবী যে সব সংসারী গোঁসাই এসেছিলো তাদেরও চিহ্ন নেই। পরে একসময়ে আখড়ার জমিতে দাস উপাধিধারী একদল লোক এসে বাসা নেয়।কপালে গঙ্গামাটির বদলে পদ্মার মাটি দিয়েই একটা চিহ্ন আঁকতো তারা, আর গলায় পরতো কাঠের মালা। বাগানের এখানে যে যেটুকু পারলো দখল করে বাইরের একটু-আধটু জমি নিয়ে এটা-সেটা লাগিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করতে করতে কৃষকদের স্তরেই তারা নেমে এসেছিলো।
একটিমাত্র বিষয়ে এরা এদের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে, সেটা এদের বিবাহের ব্যাপার। বৈষ্ণবী আনে এরা কন্ঠি বদল করে। একশোয় একজন বৈষ্ণবী হয়তো তরুণ বয়সী হয়, বাকি আর সব কটুভাষিণী, বিগতযৌবনা মুণ্ডিতশির। তারা যেন ধর্মপালনের জন্যই বেঁচে আছে।
এদের সম্বন্ধে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই, এরা কখনো আত্মবিস্তার করতে পারেনি। লোকগুলি নিজেরা হ্রস্বজীবী, শিশুমৃত্যুর সংখ্যাও বোধ হয় অন্যান্য পাড়ার চাইতে তুলনায় বেশি এদের মধ্যে। গ্রামে একটা বিদ্রুপাত্মক কথা চালু আছে–আম গাছে মাধবীলতা দেখলে পরগাছাটা কেটে ফেলাই বিধেয়, পরগাছা যারা ভালোবাসে তারা ফল পাবে কোথায়? ডাক্তাররা যদি এ বিষয়ে কথা বলতো, তারা ম্যালেরিয়া প্রভৃতি ছাড়াও যে কারণ দেখাতো সেটা যৌনব্যাধি।
রায় এবং সান্যাল বংশে সব বিষয়ে শত মতভেদ থাকলেও এদের ধর্মমতটাকে কিছুটা অবহেলা, কিছুটা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার বিষয়ে তারা একমত ছিলেন। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেননি বটে, নামকীর্তনের জন্য দোল-দুর্গোৎসবে হয়তো ডাকতেন, কিন্তু সেটা এঁদের চোখে হীনজাতীয় চামার-ঢাকিদের ঢাক বাজানোর জন্য ডাকার মতো।
কিন্তু কোনো কোনো চামার যেমন জাতব্যবসা ছেড়ে জমিজমা নিয়ে চাষী হয়ে যায় তেমনি হয়েছিলো শ্রীকৃষ্টদাসের বাবা। তিন-চার বিঘা ধানীজমিও করেছিলো সে সানিকদিয়ারের মাঠে।
শ্রীকৃষ্টদাস পিতার ধানীজমিগুলো পেয়েছিলো, উপরন্তু তার দূরসম্পর্কের দুই পিসির দরুন দুখানা ভিটাও পেয়েছিলো। তা ভিটা দুখানা যযাগ করলে এক বিঘারও ওপর হবে। লোকটি সম্পন্ন চাষী হয়ে উঠতে পারত, হঠাৎ হলো ধর্মে মতি। হাতে কিছু নগদ টাকাও পড়েছিলো তার; তীর্থ করতে বেরুলো সে অল্পবয়সে।
নবদ্বীপমুখো মন হলে খেতখামার থাকার কথা নয়। শ্রীকৃষ্টদাস একদিন অধিকারী পদবী নিয়ে গ্রামে ফিরে এলো। তার সঙ্গে এলো এক বৈষ্ণবী, ঝাকড়ঝকড়া একমাথা চুল, লাল চোখ, গাঁজার কল্কে, আর খুসখুসে কাশি। বৈষ্ণবীর সম্বল ছিলো পেতলের একটি ঘাটি, আর একটি কঝুলি। শ্রীকৃষ্ট তার কাছে দুটি পদ গানও শিখেছিলো।
বৈষ্ণব মতে বিরহটা মিলনের চাইতেও মূল্যবান। সেই মূল্যবানের আস্বাদও শ্রীকৃষ্ট পেলো। অত বড়ো চেহারা যে বৈষ্ণবীর, যে নাকি শ্রীকৃষ্টর পক্ষ হয়ে একপাড়া লোককে কায়দা করতে পারতো সে হঠাৎ বিদায় নিলো। একটিমাত্র রোগা বিবর্ণ সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হলো তার। প্রায় বিশ বৎসর আগেকার ঘটনা।
বিরহ কিন্তু শ্রীকৃষ্টকে প্রেমিক করে তুলেছিলো, পর্যায়ক্রমে সে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৈষ্ণবী . ঘরে এনেছিলো।
শোনা যায় তৃতীয় বৈষ্ণবী যখন দিঘা স্টেশনের দিকে রাত করে পায়ে হেঁটে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ট এসে বলেছিলো–রাধারানী, তুমি নাকি যাবা?
শ্রীকৃষ্ট অনেকদিন থেকে জ্বরে ভুগছিলো, হলদে মুখচোখ, চুলগুলো তামাটে। যে-বৈষ্ণবী পালানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে, সে অবাক হয়ে গেলো কৃষ্টদাসের কথার ভঙ্গিতে। রাধারানী তার নামও নয়।
শ্রীকৃষ্টদাস বললো–রোসো, গাড়ি আনি।
শ্রীকৃষ্ট নিজে গাড়ি চালিয়ে তৃতীয় বৈষ্ণবীকে স্টেশনে তুলে দিয়ে এসেছিলো।
এই ঘটনার প্রায় বছর দশেক পরে শ্রীকৃষ্টর ঘরে চতুর্থ একজন এলো। সে নিজেই এসেছিলো। প্রথমা বৈষ্ণবীর সংসার-আশ্রমের কীরকম এক দূরসম্পর্কের বোন সে। তার মাহিষ্য চাষীপিতা অল্পবয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এগারোতে পা দিয়েই সে স্বামীকে খেয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলো। পিতা তখনও বেঁচে, সংসারে আদরযত্নের অভাব হয়নি, কিন্তু ভাগ্য মানুষকে টানে। পাড়ার একপ্রান্তে কপালিদের বাসা ছিলো, তাদের এক ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেলো সে। সমাজে বাধলেও সংসার পেতেছিলো তারা; কিন্তু সংসার দুবছর চলেই থেমে গেলো, আঠারোতে দ্বিতীয় স্বামীকে খেলো সে। ততদিনে পিতার মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিক দিয়েও সংসারে ফেরা তার পক্ষে আর সম্ভব ছিলো না। নবদ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে সে সংবাদ পেলো তার সেই দিদির, যে নাকি শ্রীকৃষ্টদাসের প্রথম বৈষ্ণবী। কিন্তু বিশ বছরের পুরনো খবর। প্রায় তার জন্মের আগেকার ঘটনা।
দিদির খোঁজে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চিকন্দি এসে সে দেখতে পেলো দিদি গত হয়েছে, আরো দুটি বৈষ্ণবী তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে এসেছে, গিয়েছে।
খবর পেয়ে বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্টর মুখের দিকে চেয়ে মেয়েটি বললোকী করব তাই বলল, জামাইবাবু।
–থাকো যতদিন উপায় না হয়। পায়ের ঘা সারুক।
কিছুদিন পরে একদিন শ্রীকৃষ্ট বলেছিলো–ছোটো-বউ, এখন কী করবো?
–বউ কয়েন না। আমাকে যে বউ কয় সে বাঁচে না। পদ্ম মুখ নিচু করে বলেছিলো। শ্রীকৃষ্ট প্রত্যাহত হলো।
খুব যখন দুঃখকষ্ট চলছে গ্রামে শ্রীকৃষ্টর দিকে লক্ষ্য করার মতো অবস্থা তখন কারো ছিলো না। তাদের শতছিদ্র নৌকার মতো সংসার কী করে অত বড় দুর্যোগের সময়টা কাটালো এ খোঁজও কেউ নেয়নি। দুর্যোগ কাটলেও দেখা গেলো শ্রীকৃষ্টরা আছে।
কিছুদিন থেকে রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্টর বাড়িতে আসছে পড়তবেলায়। শ্রীকৃষ্ট তার দাওয়ায় জীর্ণ মাদুর বিছিয়ে মলাটছেঁড়া ময়লা কাগজের মহাভারতখানি নিয়ে বসে থাকে। রামচন্দ্রকে আসতে দেখে সসম্ভ্রমে বলে–আসেন মোণ্ডল।
শ্রীকৃষ্টর চৈতন্যমঙ্গল ছেড়ে মহাভারত ধরার একটু ইতিহাস আছে। বার বার বৈষ্ণবীদের কাছে আঘাত পেয়ে সে বুঝতে পেরেছে ‘জয় রাধারানী’ বলার যোগ্যতা তার নেই। নিজের নাম শ্রীকৃষ্ট না বলে একসময়ে কেষ্টদাস বলতে সে শুরু করেছিলো, আর ‘রাধারানী’র বদলে ‘গুরুগোঁসাই’। তখন একদিন তার মনে হয়েছিলো-বিরহ-প্রেমের টানাপোড়েন আর নয়, বুকে যত জোর থাকলে বিরহের ঝড়-ঝাঁপটাতেও নিশ্বাস টানা যায় ততটা কেন, তার তুলনায় কিছুই নেই তার। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ না-পড়লেও তো নয়, তারই ফলে আসে মহাভারত।
সারাদিনে তার একমাত্র কাজ সন্ধ্যায় ঘন্টাখানেক ধরে মহাভারত পড়া। আহারাদির ব্যবস্থা কী করে হয় এ খবরটাও সে নেয় না। অনাহারে মৃত্যুর খবরগুলি যখন প্রথম কানে আসতে লাগলো সে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালো, তারপর তার নিজের ভাষায়, তার দৃষ্টি এদিক থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভগবান পাঠালেন ব্যাধি। বুকভরা ব্যাধি নিয়ে বিনা চিকিৎসায় ঘরের মেঝেতে সে পড়ে থাকতো, কোথায় দিন, কোথায় রাত। ব্যাধি সারলো, একসময়ে সে উঠেও বসলো, কাশি তাকে ছাড়েনি, হাঁপানির রূপ নিয়েছে। কিন্তু সে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে, এ ব্যাধি ভগবানের আশীর্বাদ। যে নৌকা চালানোর ক্ষমতা তার ছিলো না, সেই নৌকার যাত্রী হিসাবে সে যদি ভয় পেয়ে ছটফট করতো, তবে তার ছটফটানিতে নৌকা ডোবা অসম্ভব ছিলো না। ‘চোখ বেঁধে বৈতরণী পার করালে গুরুগোঁসাই’।
মহাভারতখানায় টোকা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ফেলে শ্রীকৃষ্টদাস মনে মনে বলে : আর না বাবা, এই কাশিতেই কাশী পাবো। ও ঝঞ্ঝাট যখন আপসে আপ খসে পড়লো, ব্যস আর নয়।
সম্মুখে রামচন্দ্রকে পেলে শ্রীকৃষ্ট বলে–বুঝলেন ভাই, আমি পলাইছি এবার, সহজে আর ধরা দিতেছি না।
সবসময়ে রামচন্দ্র উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু প্রায়ই বলে–কিছুই যে ভালোনা, গোঁসাই, আমি কী করি বুঝি না।
শ্রীকৃষ্ট মুহূর্তকাল সান্ত্বনা বাক্যের জন্য মনে হাতড়ায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে–দ্দোর্ণোপর্ব পড়ি আজ, কি কন মোণ্ডল?
শ্রীকৃষ্ট দ্রোণপর্ব খুলে বসে। রামচন্দ্র একখান রৌদ্রদগ্ধ মেঘের মতো বসে থাকে, বর্ষণের তেমনি নিষ্ফল আগ্রহে বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে তার।
মহাভারত থেকে একসময়ে কীর্তনের দিকে মন গেলো রামচন্দ্রদের। আকাশবাতাসভরা অপমৃত্যুর ক্লিন্নতা, দুর্ভিক্ষের প্লাবন নেমে গেছে কিন্তু সে প্লাবনে উৎক্ষিপ্ত আবর্জনার পূতিগন্ধ এখনো আছে। যেন শব্দ দিয়ে, ধ্বনি দিয়ে সে বাতাসকে খানিকটা নিশ্বাস নেওয়ার মতো করা যাবে। ভক্ত কামার নিজে থেকেই খোল নিয়ে উপস্থিত হলো। তারপর থেকে শুরু হলো এদের কীর্তন।
কীর্তন বলতে সচরাচর বুঝি নয়। কতগুল প্রৌঢ় বয়সের চাষী, মিস্ত্রী,কুমোর প্রভৃতির বেসুরো গলায় প্রাণপণ চিৎকার আর তার সঙ্গে বেসুরো মৃদঙ্গের শব্দ। দাঁড়িয়ে শুনলে হাসি পায়। এই পুরুষগুলির কারো পক্ষেই সংগীত স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এদের কীর্তনের ব্যাপার নিয়ে শুধু সান্যালমশাই ঠাট্টা করেননি, সংগীত সম্বন্ধে যার কিছুমাত্র জ্ঞান আছে সে-ই করবে।
রামচন্দ্রের কথা ধরা যাক। পৃথিবীতে চাষ ও মাটি ছাড়া আর কিছু সে বোঝে বা জানে, তার প্রিয়জনরাও এতখানি গুণপনা তাকে কোনোদিন বর্ষণ করেনি। মাটির রঙ দেখে, হাতের চেটোয় মাটির ডেলা গুঁড়ো করে, জিহ্বায় স্বাদ নিয়ে জমির প্রকৃত মূল্য সে বলে দিতে পারে; কিংবা জমির উত্তাপ হাতের তেলোয় অনুভব করে সে অক্লেশে ঘোষণা করতে পারে বিনা বর্ষণে ধানের জমি তৈরি করার দুঃসাহস করা যায় কিনা। কিন্তু অন্য অনেকের পক্ষে অসম্ভব এই কথাগুলি বলতে পারলেও ধান, জমি, চাষ, এর বাইরে কথা বলতে তাকে কচিৎ শোনা গেছে।
বাল্যকাল থেকে এই মাটির সঙ্গে কতরকম সম্বন্ধই স্থাপন করেছে সে। সুখের দিনে মনে, মনে পূজা করেছে, দুঃখের দিনে অব্যক্ত আবেগ নিয়ে বসে থেকেছে মাটির পাশে। জমিদারকে সে সম্মান করে, খাজনা দিতে আপত্তি করা দূরের কথা, বরং তাগাদা আসবার আগেই মিটিয়ে। দিতে গিয়েও কত বিনয়, কত ভঙ্গি। বাহুল্য দেখে একবার তার স্ত্রী বলেছিলো–পাওনাদাররা যেন্ কুটুম, কত আদর, কত ছেদ্দা’। রামচন্দ্র বলে ফেলো, কও কী? কুটুমের উপরে কুটুম। যার কাছে বউ পালাম, আর জমি, দুজনেই ধর যে একই সমান।
রামচন্দ্রের স্ত্রী একদিন অনুভব করেছিলো, এ কথাটা সে বাড়িয়ে বলেনি। দুপুরের খাড়া রোদে সব কৃষক যখন গাছতলায় কিংবা ঘরে তখনো রামচন্দ্র মাঠে। বলদজোড়া খেতের একপাশে দাঁড়িয়ে অতি পরিশ্রমে ধুকছে আর তাদের মালিক খেতের মাঝখানে মই দিয়ে সমতল করা জমির লক্ষণীয় নয় এমন খাজগুলি পাঁচন দিয়ে টেনে টেনে মিলিয়ে দিচ্ছে।
পাগল হলা নাকি? মাথায় রক্ত উঠবি।
রামচন্দ্র স্ত্রীর সাড়া পেয়ে গাছতলাটায় পৌঁছে খেতে বসে বলেছিলো–একটুকু গায়ে হাত বুলায়ে দিলাম।
উয়েরই তো দিবা।
স্ত্রীর মুখের দিকে খানিকটা চেয়ে থেকে পুলকবিহ্বল গলায় ডাক ছেড়ে হেসে উঠে রামচন্দ্র বলেছিলো–কও কী? কিন্তু বাড়িতে মিয়ে জামাই যে।
সেই রামচন্দ্র যখন কীর্তনিয়া হয়ে ওঠে, তখন চিন্তা না করে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না।
কিছুদিন আগে একজন প্রতিবেশী নির্লজ্জের মতো, কিংবা হয়তো অভ্যাসবশেই, চাষবাসের কথাটা তুলেছিলো, জোর দিয়ে নয়, মুদ্রাদোষের মতো মুখে এসে গিয়েছিলো, কিন্তু পরক্ষণেই অন্য সকলের উদাস দৃষ্টির সম্মুখে নিজেকে মূঢ় মনে হয়েছিলো তার।
রামচন্দ্রই কি বলতে পারে চাষবাস করে কী হবে। অতি বিশ্বাসীর বিশ্বাস নড়ে গেলে যা হয়, তার চাইতেও তার বেশি হয়েছে। যেখানে ছিলো বিশ্বাসের দৃঢ়তা, এখন এসেছে ভয়ের অন্ধকার। নিজের ঘরের জীর্ণ দাওয়ায় বসে থাকা আর আকাশের দিকে তাকানো ছাড়া কিছু করার নেই। তার চোখের সম্মুখে মাঠান জমি হলুদে আগাছায় ভরে আছে। ফাল্গুন গেছে, চৈত্র যায় যায়। সূর্যের কাছে তেজ পাচ্ছে না মাটি, রোদে পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে। ভোর রাতের কুয়াশা গলা-স্নিগ্ধতায় মাটি আর কোনোদিন উর্বরা হবে না।
বলার কি মুখ আছে আমার? এই ভাবে রামচন্দ্র। জমির জন্য, জমির লোভই তার মেয়েটির মৃত্যুর কারণ, এই তার বদ্ধমূল ধারণা।
দুর্ভিক্ষের প্রথম পদচারণে যখন জমির দাম নেমে যেতে লাগলো আর পাল্লার বিপরীত দিকের মতো চড়তে লাগলো ধানের দাম তখন চৈতন্য সাহার কাছে সে ধান বিক্রি করে জমি কেনার টাকা সংগ্রহ করেছিলো। তখন কাজটা অস্বাভাবিক বোধ হয়নি। এদিকের সুগন্ধি আমন ধান যায় শহরে, আর শহর থেকে আসে কৃষকদের খাবার মতো কম-দামী মোটা চাল। অনেক কৃষকই ধান বিক্রি করে দেয় সামান্য কিছু বীজধান রেখে। রামচন্দ্র বুদ্ধি করেছিলো খাবার ধান পরেও পাওয়া যাবে নগদ টাকা যদি থাকে, কিন্তু জমির দাম পড়েছে সেটা বাড়তে কতক্ষণ। তখন কেউ বুঝতে পারেনি ধানের দাম এমন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সে-সময়ে যেটা সুযুক্তি ছিলো এখন সেটা চূড়ান্ত বুদ্ধিভ্রংশতা বলে বোধ হচ্ছে।
তার মেয়েটা বোধ হয় মেয়েদের মধ্যেও নরম জাতের ছিলো। এতটুকু অনাদর তার সইলো না। অনাহারে নয়, কু-আহারে মুখ ফিরিয়ে সে চলে গেলো।
জমি! জমিকে কুলটা বলেছে অনেকে অনেক বেদনার সময়ে। রামচন্দ্রর অনুভবটি ঐ কথাটার সাহায্যে সোচ্চার হয় না, কিন্তু ব্যর্থপাপ-প্রেমের অনুরূপ একটা অনুশোচনা ও আক্রোশ তার বুকে জমে ওঠে।
রোদ পড়ার আগেই রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্টদাসের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। শ্রীকৃষ্ট থেমে থেমে বটতলার ছাপা জীর্ণ মহাভারত পড়ে। রামচন্দ্র ভাবে রাজা হরিশচন্দ্র, রাজা শ্রীবৎস এদের কী হলো দেখো। রাজ্যে বিশ্বাস নেই, তার জমি!
কীর্তন করে রামচন্দ্র। প্রাণের উদ্বেলতা উৎক্রোশ কণ্ঠে ছড়িয়ে দিতে থাকে। কীর্তনের কথাগুলিতে এক চিরসুন্দরের স্নিগ্ধ রূপ আঁকার প্রয়াস আছে, কিন্তু উচ্চারণটা অভিযোগের মত, ক্ষুব্ধ অভিমানে ফেটে পড়ে বিরাগ জানানোর মতো।
চৈত্র যায়-যায়।
এই এক দেশ, শাল-মহুয়ার নয়, ধানের এবং পাটের। ফাল্গুনে এখানে উদাসকরা লাল রঙ নেই, এখানে গৈরিক অবান্তর। নিতান্ত মাটির দেশ। গাছ-গাছড়ার সবুজ রঙেও মাটির গাঢ়তা। বর্ষায় গাছপালাগুলি বাঁচবোবাঁচবো বলে দেখ-দেখ করে বেড়ে ওঠে। তারপর আসে বর্ষণহীন অকরুণ দিন। ধু ধু নিষ্ফল মাঠের দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ে ফাট-ধরা কালচে মাটি, ইতস্তৃত দু-একটা বাবলাগাছ। গাছগুলোর পাতা নেই, আছে শুধু শুকনো কাটা। প্রাণ-শুকানো রৌদ্রে দাঁড়িয়ে আরো দৃঢ় আরো কর্কশ হবার তপস্যা করছে কাঁটাগুলি। বাঁচবো, বাঁচবো–এই রুদ্ধশ্বাস আকুতি সেগুলির। উদাসীনতা নয়, অত্যন্ত গভীর মোহ।
চৈত্র যায় যায়, এমন সময়ে রামচন্দ্র কীর্তনে মন বসাতে পারছে না। তার জামাই মুঙ্লা গত বৎসর চাষের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে যেন দেহাতিদের কোদাল দিয়ে জমি চষার মতো হাস্যকর একটা কিছু। কী করে পারবে বলে মুঙ্লা। বাইশ তেইশ বছরের একটি ছেলে অকরুণ পৃথিবীকে পুরুষ সোহাগে করুণাবতী করে তুলবে, এ সম্ভব নয়। তাকে সাহায্য করবে এমন চাষীও কাউকে চোখে পড়লো না।
কীর্তনের সুর বাড়তে বাড়তে, লয়ে দ্রুততর হতে হতে একটা নীর শব্দদুর্গের সৃষ্টি করে, আর পরাজিত চাষীরা যেন তার আড়ালে মুখ লুকোনোর জন্য প্রাণপণ করতে তাকে।
কার ধান আছে, কে ছিটাবে ধান! ধান ছিটানোর চিত্রটিতে যে পুলকের আভাস আছে, সেটা যেন মনের এই ধূসরপটে মানায় না। বাঁ হাতে ধামাভরা বীজধান চেপে ধরে হাঁটার তালে তালে ডান হাতের মুঠি মুঠি ধান ধামার গায়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়ে ক্ষেতময় ধান ছিটানো!
কিন্তু এখানেই অশান্তির শেষ নয়। গ্রামের অশান্তির কিছু কিছু অংশও রামচন্দ্রের গায়ে এসে পড়ে।
সে গ্রামের চাষীদের মধ্যে খানিকটা বিশিষ্ট। এ বৈশিষ্ট্যের কতখানি তার চরিত্রগত আর কতটুকু আকৃতিগত এটার বিচার করা কঠিন। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও যাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে তাদের চালচলনে স্বভাবতই খানিকটা গাম্ভীর্য এসে যায়। এ গাম্ভীর্য রামচন্দ্রের ছিলো; একটু অধিকন্তু ছিলো তার। বোধহয় তার দু পায়ের পেছনদিকের শিরা দুটি কোনো কারণে ছোটো হয়ে গিয়েছিলো, তার ফলে চলার সময়ে তার পায়ের গোড়ালি দুটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত উঠে উঠে যায়। হাট থেকে যখন সে তেলের দুর্মূল্যতার কথা ভাবতে ভাবতে ফিরছে, হঠাৎ অচেনা লোকের তখন মনে হতে পারে–যেন একজন মগ্ন। আখড়ার ধুলো উড়িয়ে পাঁয়তারা কষার অভ্যাস সাধারণ পদক্ষেপেও সংক্রামিত হয়েছে।
এমন হতে পারে, লোকে তার পায়ের খুঁতটির দিকে লক্ষ্য করে করে তার মনে এ ধারণাটা এনে দিয়েছে, সে দর্শনীয় কিছু। এরই ফলে সম্ভবত তার কথাবার্তাও নাটকীয় হয়ে পড়েছে।
তার ঠোঁটজোড়া মস্ত গোঁফনাকের নিচে সূক্ষ্মরেখায় দ্বি-বিভক্ত। গোঁফ চারিয়ে দেওয়া তার মুদ্রাদোষ। সময় নেই, অসময় নেই, পরম যত্নে সে গোঁফ চারিয়ে দেয়। যেহেতু গোঁফ চারা দেওয়ার সঙ্গে আমরা খানিকটা বলস্পর্ধা মিশিয়ে ফেলি, সেজন্য তাকে কখনোকখনো অপদস্থও হতে হয়েছে।
অনাহারে গ্রাম যখন উৎসন্নে যাচ্ছে, সদর থেকে সরকারি আমলারা এসেছিলো চালের পরিবর্ত হিসাবে মাথাপিছু পোয়াভর ছোলা বিলোতে। খবর পেয়ে রামচন্দ্রও গিয়েছিলো। কিন্তু তার অত বড় দেহের কাঠামোটা নিয়ে আঁচল পেতে দাঁড়াতে তার লজ্জা করছিলো। সে সব চাইতে পেছনে ছিলো। অবশেষে সে যখন আমলাদের মুখোমুখি হলো, তারা বলেছিলোতোমার তো লাগবে না বোধ হয়, কি বলল? রামচন্দ্র ছোলা না নিয়ে গোঁফ চোমরাতে চোমরাতে ফিরে এসেছিলো।
সে যাই হোক, রামচন্দ্রকে ওরা টেনে নিয়ে যায়। হরিশ শাঁখারির জন্য তদ্বির করতে তাকে যেতে হয় সান্যালমশাই-এর বাড়িতে। তার কীর্তনের আসরেও চাষবাসের কথা,জমিজমার কথা এসে পৌঁছয়।
হরিশচন্দ্রের ব্যাপার নিয়ে যেদিন সে সান্যালমশাইয়ের কাছে গিয়েছিলো সেই সন্ধ্যায় কীর্তনের মুখে ভক্ত কামার যখন তার খোল নিয়ে ঠুকবুক করছে, হরিশ শাঁখারি ধুয়ো ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, এমন সময়ে আর-এক উপদ্রবের সূত্রপাত হলো।
রামচন্দ্ররা শুনতে পেলো আর একটি কীর্তনের দল যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এরকম হয়, ছোটোবেলায় এরকম সে দেখেছে:গ্রামের বিভিন্ন পাড়া থেকে, ছোটোখাটো গানের দল এসে গ্রামের মাঝখানে প্রায়ই রায়বাড়ির দোলমঞ্চের সম্মুখে, একত্র হতো। তারপর শুরু হতে অষ্টাহব্যাপীকীর্তনের উৎসব। বোঝো আর না-বোঝো, শোনো আর না-শোনন, খোলর বিরামহীন শব্দের সঙ্গে বহুকণ্ঠের কলশব্দ নেশায় আবিষ্ট করে দেবেই একসময়ে; মাথা ঝিমঝিম করবে; তারপর একসময়ে সেই দলে মিশে নাচতে শুরু করতে গ্রামবাসীরা।
রামচন্দ্র হেসে বললোবোধায় তোমার পাড়ার হবি, হরিশ। বোধায় সান্যালমশাই কিছু হিল্লে করেছে।
শ্রীকৃষ্ট বললো–আপনে যখন গিছলেন তখনই আমি মনে বল পাইছি।
কিন্তু এ কী অদ্ভুত গান!
গাইতে গাইতে যখন ছোটো দলটির কাছে এসে দাঁড়ালো তখন রামচন্দ্র হো হ করে হেসে উঠলো। রামচন্দ্র চিনতে পারলো তার জামাই মুঙ্লা আর শ্রীকৃষ্টদাসের ছেলে ছিদামকে। গানটার একটি কলি গাইছে মুঙ্লা, ছিদাম তার ধুয়া ধরছে, পালটে নিচ্ছে মুখে থেকে সুর ছিদাম, আখর? দিচ্ছে মুঙ্লা। ঢোলকের তালে তালে মুঙ্লা গাইলো
চিতিসা চিত্তিরসাপ আমন খেতের বিষ
বিষের বায়ে সোনার দ্যাশে শুকায় ধানের শিষ।
ছিদাম আখর দিলো ঢোলকে চাটি দিয়ে-হায় রে আমন ধানের শিষ!মুঙ্লা তাল দিলো তার ঢোলকে, ছিদাম সুরে ধরলো–
চিতিসা খুললো মরি জাহাজী কারবার
বেলাতে চালান দিলো দ্যাশের ষণ্ড হাড়।
মুঙ্লা প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ে আখড় দিলো–হায় হায় শিশুমান্ষের হাড়।
গানের দোলায় দোলায় শ্রীকৃষ্ট বলতে লাগলো–ঠিক ঠিক।
রামচন্দ্র বললে–কও কী, আঁ, কও কী?
মুঙ্লা ও ছিদাম তখন বলে চলেছে-আকাশে ওড়ে হাউই জাহাজ, মহাজনী নৌকা লাগে ঘাটে। কোথা থেকে কী হয়ে গেলো, কোথায় গেলো ধান, কী হলো প্রাণীর! আর দেখো ঐ চিতিসাকে,কপালে তিলক এঁকে একটামাত্র দাঁত দিয়ে কী করে নরনারীর মৃতদেহগুলো খেলে, কী করে পৃথিবীর মাটি যা আগুনে পোড়ে না, বন্যাও ফিরিয়ে দেয়, তাই সে গ্রাস করলো!
রামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ট স্তব্ধ হয়ে গেলো শুনতে শুনতে। ছিদাম বা মুঙ্লার এই প্রথম গান গাইবার প্রয়াস।সবসময়ে সুর লাগছেনা। কিন্তু এই অদ্ভুত গান কোথায় শিখলোতারা? রামচন্দ্রের বুকের মধ্যে বাতাস পাওয়া আগুন হাঁ হাঁ করছে, শ্রীকৃষ্ট কাঁদো কাঁদো মুখ করে, বোকা-বোকা মুখ করে কেমন যেন ছটফট করছে।
চৈতন্য সাহা এ গ্রামের মহাজন। চিকন্দি ও সানিকদিয়ারের যুক্ত সীমান্তের কাছে তার দোকান। প্রতি বছর ধান ওঠার কিছুদিন পরেই হাজারমনী নৌকাগুলো এসে লাগে পদ্মার ঘাটে। নৌকার মাঝিরা চৈতন্য সাহার পুরনো খরিদ্দার। লোহার কড়াই থেকে আলকাতরার টিন, তেল থেকে আমসি এসবই তার দোকানে পাওয়া যায়, মাঝিরা কেনে। কিন্তু আকাশে অদৃষ্টপূর্ব হাওয়াই জাহাজের আনাগোনার সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্য সাহার কার্যকলাপ অভূতপূর্ব হয়ে উঠলো। অন্যান্য বার সে মাঝিদের হয়ে ধান কেনে, এবার সে নিজে থেকেই ধান কিনতে লাগলো। সানিকদিয়ার থেকে বুধেডাঙা থেকে চিকন্দি আড়াআড়ি পাড়ি দিতে লাগলো সে। পদ্মার ঘাটে নৌকার ভিড় বাড়তে লাগলো। মাঝিদের ও চৈতন্য সাহার একটা খেলা শুরু হলো। মাঝিরা বলে–ছটাকায় উঠলো ধান। চৈতন্য সাহা বলে, সাড়ে ছয়ে আমাকে দাও। দশে উঠলো দাম, দেড় টাকার ধান দশ ছাড়িয়ে বারো ধরলো, চৈতন্য সাহা তবু কিনছে।
একসময়ে ধান গেলো ফুরিয়ে, বীজধানও ধরে রাখলো না কোনো চাষী। হাতে নগদ টাকা নিয়ে চৈতন্য সাহার নির্বুদ্ধিতার কথা উল্লেখ করে হাসাহাসি করেছিলো তারা। কিন্তু শহর থেকে খাবার চাল আনতে গিয়ে তাদের হাসি শুকিয়ে গেলো। দু দিনেই যেন শহরের সব দোকানদার খবর পেয়ে গেছে, তাদের ঘরে খাবার নেই। দু’একজন দোকানদার তো মুখের সামনেই বলে দিলো–বিক্রি করবো কি? কিনবো।
এরপরই চাষীদের ছুটোছুটি শুরু হলো, হায়, হায়, চাল কোথায়! জমি ঘর যার যা সম্বল ছিলো দুর্ভিক্ষের মুখে গুঁজে দিতে লাগলো। আল ভেঙে গেলে চাষীরা যেমন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ফাটলের মুখে নিজের বস্ত্রখণ্ড পুরে দিও জল বাঁধবার চেষ্টা করে, তেমনি করে তারা চেষ্টা করলো। জমির দাম অকিঞ্চিৎহয়ে গেলো। প্রথমে বড়োচাষীরা ছোটোচাষীদের জমি ধরার চেষ্টা করলো, তারপর তারাও প্লাবনে ভেসে গেলো। চৈতন্য সাহা এসে দাঁড়ালো ক্রেতা হয়ে; এবার যেন সে সব কিনবে, পৃথিবী পায় তো তা-ও কিনবে। কোথায় ছিলো এত টাকা তার কে জানে! কিন্তু সে যেন পাগলও হয়েছে। এক বিঘা ধানের জমির দাম দশ টাকা বলে সে, শুনে প্রথম প্রথম চাষীরা না-হেসে পারেনি। দেড় টাকার ধান বারোতে কিনেছে, একশোর জমি দশে চায়। কিন্তু এদিক-ওদিক ঘুরে তার ঘরেই ফিরে এলো চাষীরা, পনরো টাকা হয় না? এক বিঘা দো ফলা জমি?
তা তুমি যখন বলছে, দশের উপরে আর আট আনা দিতে পারি।
তাই দাও, তাই দাও। ছাওয়াল মিয়ে খায় নাই।
নিজের পাঁজরার একখানা হাড় খুলে রেখে দশ টাকা আর কতগুলি খুচরো নিয়ে চলে গেছে চাষীরা। বুড়ো সিন্ধুসিংহের মতো চাষীদের নাক বেয়ে চোখের জল নেমেছিলো; অনাহারে কষ্টে কিংবা জমির শোকে তখন তারা তা বুঝতে পারেনি।
নগদ দামে, রেহানে, খাইখালাসি বন্দোবস্তে চৈতন্য সাহারা চাষীদের দশ আনা জমি গ্রাস করেছে। চৈতন্যর সঙ্গে সহযোগিতা করলো গ্রামের কয়েকজন জোতদার।
গান থামলে রামচন্দ্র বললো–এ তোরা শিখলি কোথায়?
গুরুর নিষেধ, কবের পিরবো না।
এ গান শুনলি লোকে কী কবি?
ছিদাম কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু লোকে কী বলবে, তার মীমাংসা করে দিলো আর একজন লোক। এদের গানের সময়ে পথচলতি দু’চারজন লোক জড়ো হয়েছিলো, তাদের মধ্যে একজন বললো, কেন ভাই, গায়েন, আমাদের গাঁয়ে একদিন গান শুনাবা না?
কোন গাঁ তোমাদের?
চরনকাশির পর মাধবপুর।
তা যাবো একদিন।
যায়ো ভাই, যায়ো, আমার বাড়িতে যায়ো; সেখানে জলসা হবি। আমার নাম যাদো ঘোষ।
তোমরাও কি চিতি সা-কে চেনো?
হয়। সে গোরুও কিনেছে আমাদের ঘোষেদের কাছে।
যাবো ভাই, যাবো।
লোকটি চলে গেলে রামচন্দ্র আবার প্রশ্ন করলোতোরা কি এখন গাঁয়ে গাঁয়ে এমন সব গান গায়ে বেড়াবি?
হয়। নীলের গাজন ইস্তক এই করব আমরা। আপনেরাও ভগোমানের নাম করেন, আমরাও করি।
এ কি তোদের ভগোমানের নাম, চিতি সা কি তোদের ভগোমান?
একটু থেমে কথাটা গুছিয়ে নিয়ে ছিদাম বললো, ও আমাদের সব খালো, আর আমরা বললিও দোষ।
কয়ে কী হয়? রাস্তার লোকেক মুখ ভ্যাংচায়ে কী হয়, নিজের মুখে ব্যথা।
ছিদাম মাথা চুলকাতে লাগলো।
মুঙ্লা বললো–এখানো গান বাঁধা শেষ হয় নাই, মিহির সান্যালের নামেও গান বাঁধা হবি।
রামচন্দ্র বললো, সাবোধান। দ্যাশের মালিক, রাজা।
কীসের রাজা, আমরা তার জমি রাখি না।
কস কী! হাজার হলিও সান্যালবংশ, রাজবংশ। এর জমি না রাখো, তার রাখো। কোনা না কোনো সান্যালের জমি রাখো। তুমি কি মনে করছে মিহিরবাবুর নামে গান বাঁধলি, নোসল্লা করলি সান্যালমশাই খুশি হলো। কি কও, শ্রীকৃষ্টভাই?
ঠিক কইছেন মণ্ডল,বললো শ্রীকৃষ্ট, মিহিরবাবু কী ক্ষতি করছে তোমাদের?
আমাদের গ্রাম ছাড়া করতিছে। সে সময়ে যারা আমাদের ঠকায়ে জমি নিছে সকলেই চিতি সাপ।
তোমাদের গাঁ ছাড়া করিতেছে তোমাদের বাপরা জানলো না?
আমাদের না হউক, শাঁখারিদের–বললো মুঙ্লা।
শাঁখারি আর তোমরা এক হইছে?
এক হওয়া লাগবি। মরার সময়ে আগে তারা, পরে আমরা মরছি। মরে এক হইছি–বললো ছিদাম।
রামচন্দ্র বললো–আচ্ছা, এক যদি হওয়া লাগে, বাপরা এক হোক। তোমরা ছাওয়ালরা এসব করবা না।
ছিদাম ও মুঙ্লা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাঁইগুঁই করতে লাগলো। রামচন্দ্র মণ্ডল নিষেধ করলে ভাবতে হয়।
সে সন্ধ্যায় কীর্তন জমলো না। যারা এলো তারা এই গানের কথাই বলাবলি করলো। কেউ বললো, ঠিকই করেছে ছাওয়ালরা, বেশির ভাগই বিষয়টির আকস্মিকতায় মুগ্ধ হলো। যারা ল্গানের পদগুলি শোনেনি তারা পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করে জানতে লাগলো।
অন্ধকার পথে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে গানের পদগুলি রামচন্দ্রর মনে পড়লো। ছেলেদের ছেলেমানুষির সম্মুখে আসা উচিত নয়, হাসিকে দমন করার জন্য গোঁফ চারিয়ে দিয়েছিলো সে। কিন্তু হাসি নয় সবটুকু। আবার তার সেই অনুভব হলো। বুকের ভিতর চাপা আগুন হাঁ-হাঁ করে জ্বলে উঠলো। সেখানে আগুনলাগা বাড়ির মতো কী যেন একটা ভেঙে পড়বে। তার মেয়ের মৃত্যুর সঙ্গেও কি গৌণভাবে চৈতন্য সাহাদের অদ্ভুত ব্যবসার যোগ নেই? লার কাছে আটকে যাওয়া কান্নায় রামচন্দ্রর বুকপাট ফোঁপানোর মতো দুলে দুলে উঠলো।
এর আগেও চৈত্রসংক্রান্তির জন্য গ্রামে গান বাঁধা হতো। এই গ্রামে ছিলো নবীন, সে নিজের পরিচয় দিতো—নব্নে বুড়ো গাঁয়ের খুঁড়ো। সে-ই বাঁধতে গান। দুর্ভিক্ষের প্রায় প্রথম গ্রাসে সে গিয়েছে। আর কেউ গান বাঁধেনি গত বছর। নবীন বুড়োর গানের বৈশিষ্ট্যও ছিলো, জমিতে স্ত্রীজাতির দোষগুণ, দুর্বলতা, সোহাগ-প্রিয়তা আরোপিত করার রীতি সে-ই প্রথম এই অঞ্চলে চালু করেছিলো।
কিন্তু এ কী গান! বাড়ির কাছাকাছি এসে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়লো। কানের ভুল নয়। দাসপাড়ায় ছিদাম-মুঙ্লার গান শোনা যাচ্ছে। দূর থেকে আখরগুলি কান্নার মতো শোনাচ্ছে। একটা রামশিঙাও জোগাড় হয়েছে। তার শব্দটা তীব্র হাহাকারের মতো ফেটে ফেটে পড়ছে। রামচন্দ্র ভাবলো, এমন গান বাঁধলো কেন্? কী করলো এরা, এ কীসের সূচনা করলো!
রবিশস্যের সময় এটা। ধানের সময় নয় যে প্রকৃতি নিজে থেকে ধান দেবার জন্য সাধাসাধি করবে। গত আমন-চাষ হয়নি এ অঞ্চলে। একেবারে কি হয়নি? যা হয়েছে তাকে চাষ বলে না। আর আউস? কে বোনে আউস? পথ চলতে কোনো চাষীর যদিবা ঘাসভরা আগাছা ঢাকা আউসের খেত চোখে পড়ে তবু তার দৃষ্টি চকচক করে না, মনে হয় না সে আউসের কথা ভাবছে। কানে আসছে চিকন্দির সীমায় সীমায় সান্যালদের খাসজমিতে, সানিকদিয়ারের খামারগুলিতে, চরনকাশির আলেফ সেখের জমিতে আউস চাষের জোগাড় হচ্ছে। রবিশস্যও উঠছে। এমন কথাও কানে আসে, সরষে এবার এ অঞ্চলে ভালো হয়েছে।
চিকন্দির গ্রামের ভিতরে আর বুধেডাঙার মাঠে দু’একটি নির্লজ্জ কৃষক মাঠে নেমেছে, কিন্তু সেসব চাষ নয়, খেলা–যেমন খেলতে পারে রামচন্দ্রর জামাই মুঙ্লা কিংবা শ্রীকৃষ্টদাসের ছেলে ছিদাম। আর রামচন্দ্ৰই একা একথা বলে না। চৈতন্য সাহাও বলে বেড়াচ্ছে। সে নাকি চাষীদের বাড়িতে ডাকিয়ে নিয়ে বলেছে–খেলা খেললে হয় না, কাজ করে খেতে হয়। গত সন টাকা দিছি কাজ করো নাই, খেতে নামে খেলা করলা; যে খেতে দশ মন হবি, হলো চার। এবার টাকা পাবা না।
এই বিস্ময়কর অথচ সত্য কথাগুলিই এই পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য। দু বছর আগে জমির মালিক ছিলো যে আজ সে মজুর সেই জমিতেই। সকলের মনে হয় কিনা কে জানে, রামচন্দ্রর মনে পড়ে যাত্রায় শোনা সেই হীরার কাহিনী। হীরাকে যখন চাষীর ঘর থেকে বাবু বের করে নিয়ে মোটরে চড়ালো, হীরার স্বামীকে নাকি সেই বাবু দয়া করে একটা চাকরি দিতে চেয়েছিলো, মোটরগাড়ির ধুলো ঝাড়ার কাজ। খাইখালাসিতে জমি আটকে চৈতন্য সাহাও নাকি তাই করছে। গত বছর খেতে না-পেয়ে কৃষকরা যখন তার কাছে ধারে ধান কিনতে গিয়েছিলো। তখন সে নতুন করে কাগজ লিখিয়ে নিয়েছে: ধান দিয়েছে চাকরান শর্তে; এক বছর জমিতে খেটে দেবার শর্তের নিচে টিপসই দিয়ে ধান এনেছিলো চাষীরা। কিন্তু কেউ কি পারে হীরার স্বামীর মতে মোটরগাড়ি সাফ করতে? গত বছর চৈতন্য সাহার খেতগুলিতে যে চাষ পড়েছিলো তাকে সেই জন্যই চাষ বলা যায় না। অবশ্য চৈতন্য সাহার ধার ধারেনা এমন চাষীও আছে। আছে গহরজান সান্দার, আছে আলেফ সেখ, আছে ঘোষপাড়ার বাপবেটা দুজন। কিন্তু দশ আনা জমিতে চৈতন্য সাহা বলে বেড়াচ্ছে–গত বছর ঠকায়েছো। এবার আগাম টাকা পাবা না। দরকার হয় বাঙাল আনাবো, চাষ দিবো।
ছিদাম মুঙ্লার গান যেদিন প্রথম শোনা গিয়েছিলো তার কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায় শ্রীকৃষ্টদাসের আসরে ধানের কথা উঠে পড়লো কথায় কথায়। স্বর্ণবর্ণ সেই সব ধানের কথা যা সেকালে ছিলো বলে মনে হয়, সেই আমন ধানের শতেক নাম আওড়ানো।
সেদিন ছিদাম মুঙ্লা গান করতে পথে বার হয়নি। ছিদাম বললো–কে, জেঠা, বোরো ধান কি সোনার মতন হয় না?
রামচন্দ্র বললো–হয়, সব ধানই সোনা।
মুঙ্লা বললো–ছিদামভাই, তোমার ধানের কথা কও নাই বাবাকে?
কথাটা বলে ফেলেই মুঙ্লা লজ্জিত হয়েছিলো, নতুন বউ-এর কথা হঠাৎ গুরুজনের সামনে উচ্চারণ করে গ্রাম্য যুবারা যেমন হয়।
ধান কস কি? হা হা।
হা-হা শব্দ দুটিতে রামচন্দ্র কী ইঙ্গিত করলো বোঝা গেলো না। চিকন্দি অঞ্চলে কেউ যদি কোনোকালে বোরো ধান লাগায় তবে সেটা সখ করে। দিঘা থেকে আসতে আসতে সড়কটা যেখানে পদ্মার পার ধরে চলতে শুরু করে সেই লবচরের সেরা বোরো ধানের চাষ করে নিয়মিতভাবে। চিকন্দি অঞ্চলে জমি উঁচু, পদ্মার পলি প্রায়ই পড়ে না। এদিকে বোলোর আবাদ নেই।
ব্যাপারটা ছিদাম বললো। নতুন বিষয়ে অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নেওয়া ভালো। শ্রীকৃষ্টদাসে বাড়ির পিছন দিকে আখড়ার পুকুরটার এখন স্নান করার মতো জল নেই। সেটাকে এখন পুকুর না-বলে পচা গাড়ো বলে, পুকুর পাড়ায় অর্থাৎ খানায় পরিণত হয়েছে। শ্রীকৃষ্টর কাশির অসুখটা হবার আগে সে পুকুরের ঢালু পাড়ে কচু, ওল প্রভৃতি লাগাতো। সেই পচা পুকুরের জলের ধারে ধারে, জলের মধ্যে নেমে গিয়েও চাষ দিয়েছে ছিদাম। প্রথম যখন সে চাষ দিতে শুরু করে তখন যে চেহারা ছিলো এখন তা নেই। লবচরের সেখদের কাছে চেয়ে-চিনতে বোরো ধানের কিছু বীজ সংগ্রহ করেছিলো সে। এখন পুকুরটা একটা নিচু জমির রূপ নিয়েছে।
মুঙ্লার চাষ-আবাদের চেষ্টাও এমনই হাস্যকর বৈকি। সে হয়তো ধানহীন দিনে ছিদামের মতো ধান-পাগলা হয়নি, কিন্তু সে তার শ্বশুরের পড়ে-থাকা খেতে মটর-মসুর লাগিয়েছে। সংসার চালাচ্ছে। কিন্তু চাষ কি শুধু কায়ক্লেশে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা? তাহলে তো রামচন্দ্রও চাষ করেছে। গত বৎসর সে-ও তো দু’একদিন মাঠে গিয়েছে, লাঙলের মুঠিটা কিছুকালের জন্য ধরে মুঙ্লাকে খেতে যাবার সুযোগ দিয়েছে।
রাবণের মৃত্যুর পর সদ্য-প্রসূত মহীরাবণও নাকি যুদ্ধে নেমেছিলো। রামচন্দ্র বোকা-বোকা মুখ করে বসে গোঁফ চোমরাতে লাগলো।
০৯. অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের
অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের পুঁথিঘরের দিকে যেতে যেতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
বিস্মৃতপ্রায় অতীতে সুকৃতি একবার এক সমস্যা সৃষ্টি করেছিলো, আর এতদিন পরে আর-একটির সৃষ্টি করেছে সুমিতি। অন্যের সমস্যা হলে আলোচনা করে বুদ্ধি বাৎলে দেওয়া যায়, কিন্তু যে কথাটা মনে করতে গিয়ে বুকটা মুচড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কী করে তা আলোচনা করা যাবে।
তিনি মা, সহ্যকরাই তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিন্তু ঐ লোকটির কেমন লাগবে? পুরাতনপন্থী লোক, হয়তোবা খোকার বিয়ের ব্যাপারে কত উচ্চাশা পোষণ করেছেন, চাপা লোক তাই প্রকাশ করেন না। খোকা বিয়ে করলো, একটা সংবাদ দেওয়া পর্যন্ত দরকার বোধ করলো না! তবু যা হোক, অশ্রু রোধ করে ভাবলেন সান্যালগিন্নি অনসূয়া, ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিয়ে করে এত বড়ো বংশটার মাথা হেঁট করে দেয়নি। কিন্তু এতে প্রবোধ হয় না, অভিমান অত সহজে ভুলবার নয়।
পুঁথিঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনসূয়া দেখতে পেলেন রূপু আলমারিতে বই খুঁজছে আর টেবিলের সামনে বসে সান্যালমশাই সদানন্দ মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছেন।
সান্যালমশাই বললেন–হরিশচন্দ্র ও লঙ দুজনেরই অভাব হলো, খানিকটা ছন্নছাড়া হয়ে গেলো আন্দোলনটা। তা হলেও এটা কিন্তু জাতীয়তার আন্দোলন ছিলো না। ইংরেজদের কাছে। সুবিচার পাওয়ার চেষ্টাই ছিলো।
সদানন্দ বললো–তার চাইতেও বড়ো কথা এমন একটি স্বতঃপ্রবৃত্ত উঠে বসার চেষ্টা চাষীদের মধ্যে সব সময়ে দেখা যায় না, যেমন হয়েছিলো নীল-আন্দোলনের সময়ে কিংবা তার চাইতে ছোটো সিরাজগঞ্জের প্রজাবিদ্রোহে।
রূপু লাল খেরোয় বাঁধানো বড়ো একটা বই এনে টেবিলের উপরে রাখলো। পাতা উল্টোতে উল্টোতে সান্যালমশাই বললেন–সে সময়ের খবরের কাগজের কতগুলি বাবার পুরনো কাগজপত্রের বাক্সে পেয়ে বাঁধিয়ে রেখেছি। কতগুলি হাতে-লেখা কাগজও আছে। এই গ্রামে ও আশেপাশে যে-গান তৈরি হয়েছিলো, তার কিছু কিছু পাবে। পড়ে দেখো সদানন্দ।
রূপু বললে–বাবা, ওদের গান একদিন শুনলে হয় না?
সান্যালমশাই বললেন–ওদের গানে যদি তোমার বাবার নিন্দা থাকে?
রূপু বললে–থাকলেই হলো! আপনি কি কখনো কোনো অন্যায় কাজ করেছেন?
সান্যালমশাই মৃদু মৃদু হাসলেন। কিন্তু বললেন–ওসব পথের গান, বাড়িতে ডেকে আনতে নেই।
সদানন্দ বললো, এখন এসো, একটু ভূগোল পড়ে নিই।
হ্যাঁ, এবার পড়ো তোমরা। সান্যালমশাই উঠে দাঁড়ালেন।
অনসূয়া দরজার কাছ থেকে সরে প্যাসেজে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে পড়লো তাঁর বড়োছেলের লেখাপড়ার কথা। সবই যেন অতীত, কত সুদূরের অতীত। কিন্তু অতীত ভাবতে গিয়েই মায়ের মন ছটফট করে উঠলো–আহা, আহা, তা কেন, খোকা মারাত্মক একটা ভুলও যদি করে থাকে তা বলেই তার সব কিছু অতীত হবে কেন?
সান্যালমশাই তাকে দেখতে পেয়ে বললেন–ছেলের লেখাপড়ার খোঁজ করতে এসেছিলে? কিন্তু তোমার বাড়িতে তো আজ অতিথি আছে।
অনসূয়া পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললেন–বড়োছেলের খবর অনেকদিন পাওয়া যায় না।
যেমহীরাবণ সেটা হয়েছে, ভূমিষ্ঠ হয়েই যুদ্ধ করতে চায়। খবর দেবার সময় কোথায় তার। তাহলেও নিজের বাপ মাকে—
ওর ধর্ম-মায়ের কথা বুঝি শোনোনি?
অনসূয়া নিজের বক্তব্য উপস্থিত করার জন্য যে-সূত্রটা পেয়েছিলেন, সেটা হাতছাড়া হলো। অন্য আর-একটি সূত্র প্রশ্নের আকারে উত্থাপন করলেন তিনি। ধর্ম-মা? বিয়ে করেছে, শাশুড়িদের কারো কথা বলছো? তোমাকে লিখেছে বুঝি?
না, খাঁটি ধর্ম-মা। তার চেহারার বর্ণনাও একদিন পড়লাম ওর চিঠিতে। বোধ হয় জেলের মেয়ে, জলে-জলেই দিন কাটে। দাঁতের বর্ণনা নেই, কিন্তু কপালের বর্ণনা আছে, আকাশছোঁয়া কপাল!
অনসূয়ার সূত্রগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো, তিনি বললেন–বলো কী, সেই জেলের মেয়ে হলো আমার ছেলের মা? আর তার রূপ বর্ণনা করেছে ছেলে তোমার কাছে! চিঠিটা দিও তো।
তাছাড়া মেয়েটির রুচিও বোধ হয় ভালো নয়, ছেলেপুলে আছে, তবু নাকি সবুজে রঙের শাড়ি পরে আঁচল উড়িয়ে বেড়ায়।
‘ধিক্ ধিক্!
সান্যালমশাই হেসে বললেন–এতদিন পরে আমার রুচি তোমার অজানা নেই। বড়ো কপাল আমার কোনোদিনই পছন্দ নয়।
অনসূয়া রাগ করে বললেন–তোমার প্রশ্রয়েই ছেলে এমন বেড়ে উঠেছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, তুমি শাসন করো না। ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করো। তোমার এই সেকেলে পরিহাসও আমার ভালো লাগে না।
সেটা আমার দোষ নয়, অনসূয়া। বিলেতি কায়দায় ছেলে মানুষ করার ঝোঁক ছিলো তোমার। ছেলেদের স্কুল-কলেজে যেতে দিলেন। পাস দিলো না যে চাকরি পাবে।মধ্যের থেকে সদানন্দ বেচারার ভবিষ্যৎটা গেলো। কোনো কলেজে মাস্টারি করবে সে ক্ষমতাও ওর নেই। ভাবছি ওর মাসোহারাটা কিছু বাড়িয়ে দেবো। আর কিছু না করুক ছেলেকে অন্তত বিলেত ফেরতদের মতো জেল খাটা শিখিয়েছে।
জেল খাটার কথায় অনসূয়ার মনে পড়লো কবিদের মধ্যে একজন দেশকে ‘অম্বরচুম্বিতা ভাল-হিমাচল’ বলে বর্ণনা করেছেন বটে। জেলের মেয়ের পরিচয় বুঝতে পেরে তিনি হেসে ফেললেন, বলেন, খুব জেলেবউ-এর গল্প বলেছে।
এবং তখন-তখনই তার বক্তব্যের সূত্র আবার স্থাপন করলেন, কিন্তু এখন তুমি হাসছে তার দেশের কাজের কথায়, যদি সে সবদিক দিয়েই বিপ্লব সৃষ্টি করতে থাকে, সহ্য হবে তোমার? সমাজের বিধানগুলো, গৃহস্থজীবনের রীতিনীতিগুলোও যদি সে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে–তা কখনো তোমার ভালো লাগবে না।
তার সেই গৃহ-বিপ্লবের কথা বলছো? সেই দুই হাত দিয়ে পৃথিবীকে সম্মুখে এগিয়ে দেওয়া? মন্দ কী। ওটা এক ইংরেজ কবির ভাষা।
তোমার প্রশ্রয় যে ছেলেগুলিকে আর কতভাবেনষ্ট করবে আমি ভেবে পাইনে। জমিদারের ছেলে হয়েও সে যখন জমিদারী প্রথা ধ্বংস করতে চায় তখনো তুমি চুপ করে থাকো। তুমি কি বোঝো না ওদের হাতে পড়লে আমার এই শ্বশুরের ভিটের কী দুর্দশা হবে?
আমি তো দোষের কিছু দেখি না। অন্দরের বসবার ঘরে নিজের আসনে বসে সান্যালমশাই বললেন, এ বংশের অনেক ছেলেই বহুদিন ধরে মিনমিন করে জীবন কাটিয়ে দিলো। বহুদিন পরে যদি দু-একটি ছেলে দুর্মদ হয়ে ওঠে ভালোই হবে বোধ হয়।
কিন্তু জমিদারদের উচ্ছেদ করতে গেলে তোমার সঙ্গেই যে প্রথম বিবাদটা বাধবে না তার প্রমাণ কী?
কোনো প্রমাণই নেই। বরং বাধবেই, ধরে নিতে পারো। তবে তোমার বিপন্ন মুখ করার কোনো কারণ নেই। জমিদাররাও আটাশে ছেলে নয় যে হট বললেই হটে যাবে। আমার সঙ্গে তার বিবাদ হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। লোকে বলবে অমুক সান্যালের ছেলে জমিদারী প্রথার ধ্বংস কামনা করে অথচ নিজের পৈতৃক ব্যাপারে অতি ভালো ছেলে। ছেলের এ অপবাদ আমি কখনো সহ্য করতে পারি না, বড়োবউ। বাপ-বেটার বিবাদ, সেটা ঠিক ধর্মযুদ্ধ হবে না। এ যুগের কেউই কূটকৌশলের চেষ্টা না করে ছাড়বে না। শুধু আইন বদলানোর আন্দোলন নয়, রক্তপাতও হতে পারে। বড়ো কাজের জন্য রক্তের মতো দামী জিনিসের প্রয়োজন হয় কখনো কখনো। তোমার ঐ চরনকাশির চরের জন্যে নীলকরদের সঙ্গে মারপিট হয়েছিলো সান্যালদের।
অনসূয়া শঙ্কিত হলেন। এটা রহস্যের সুরে বলা একটা কথামাত্র! তথাপি তার আড়ালে কিছু কিছু দৃঢ়তা লুকিয়ে রইলো। পর পর কয়েকটি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এ বাড়ির মা হয়েছিলো বলে বর্তমানে সান্যালমশাইয়ের চেহারায় বলবার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য সেখে পড়ে না, কিন্তু কয়েকটি পুরুষ ডিঙিয়ে সাধারণ একটি মায়ের কোলে খনাসা একটি শিশু যদি আসতে পারে, এই শান্তিপ্রিয় প্রৌঢ়টির আটপৌরে স্বভাবের ভিতর থেকে সান্যালদের আক্রোশ বা রোষ প্রকাশ পাবে না, এ জোর করে বলা যায় না। বুদ্ধিমান সে-রোষকে আত্মঘাতী বলবে হয়তো, কিন্তু তার প্রতিহিংসা পৃথিবীর যে কোনো প্রতিহিংসার চাইতে কম নয়। হেস্টিংসের লাটগিরিকেও রেয়াত করে না সে-ক্রোধ।
যদি সত্যিই মতবাদ নিয়ে পিতাপুত্রে বিবাদ বেধে ওঠে তাহলে তিনি কী করবেন, এই দুশ্চিন্তা হলো অনসূয়ার। তার যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তা থেকে কীকরে তিনি পরিত্রাণ পাবেন? আর তেমনি একটি মত-পার্থক্যের সূচনা ইতিমধ্যে হয়েছে।
সান্যালমশাই হাসছেন, তিনি হেসে বললেন, কিন্তু আপাতত দুশ্চিন্তার কোনো কারণ তোমার দেখছি না, প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত। বরং সদানন্দকে একটু সমঝে দিও, চাষীদের কয়েকটা ছেলে কী গান করলো, সেটার সাথে নীল বিদ্রোহের তুলনা রূপুর মাথায় যেন ঢুকিয়ে না দেয়। এরকম চেষ্টা হচ্ছে।
সবতাতেই তোমার ঠাট্টা।
না, পরিহাস নয়। তোমার বড়োছেলের লেখাপড়ার জন্যে আমাকে দায়ী করতে পারো না। তার যুক্তিগুলির গোড়ার কথা যে সদানন্দর, এমন সন্দেহ আজকাল আমার হচ্ছে।
অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের হাসি-মাখানো মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। এই মানুষটির সঙ্গে ত্রিশ বছর কাটিয়েও যেন এঁর সবটুকু পরিচয় পাওয়া গেলো না। কোনটি লঘু পরিহাস, কোনটি কঠোর সত্য, এটা এখনো তিনি বুঝতে পারেন না। অকস্মাৎ এঁর একটি মনোভঙ্গি এত নতুন, এত অপরিচিত বলে বোধ হয় যে, অনসূয়া বিবাহিত জীবনের প্রাথমিক সেই দিনগুলির মতো কিছু অনুভব করেন।
সান্যালমশাই যখন ভৃত্যর হাত থেকে নিয়মমাফিক তামাক নিয়ে তাতে মন দিলেন, সেই অবসরে অনসূয়া ভাবলেন–আর যা-ই হোক, যে অপ্রত্যাশিত ও অপ্রিয় বিবাহ ব্যাপারটির কথা তিনি একই কালে স্বামীকে বলতেও চাচ্ছেন, গোপন করারও চেষ্টা করছেন, সেটা বলার সময় এখন নয়। সান্যালমশাইয়ের সম্ভাব্য সুপ্ত রোষ কিংবা তার কথা বলার এই হাসিমাখা মিগ্ধ ভঙ্গি কোনোটিকে আঘাত করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো না।
কিন্তু রাত্রির অনেকটা সময় বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে চিন্তা করতে হলো অনসূয়াকে। তিনি ভাবলেন–তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় সান্যালমশাই নিজে মেনে নিলেন এই বিবাহ; আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধব এরাও কি মানবে? তার চাইতে বড়ো কথা, গ্রামের লোকেরা কী বলবে। সাধারণ প্রজাদের মনে যদি প্রশ্ন জাগতে থাকে, যদি কুৎসা রটে। সহসা তার চোখে এই প্রজারাই বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো। প্রজারা ও দাসদাসীরা এবং আশ্রিতরা যারা মুখ তুলে চেয়ে আছে, এসব পরিবারের বিবাহের ব্যাপার যাদের কাছে বহুদিন ধরে আলাপ করার, আনন্দ করার বিষয়; অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য, যাদের মতামতের খোঁজও কেউ করেনি, তাদের গ্রহণ করার ভঙ্গিটির উপরেই যেন বিষয়টি নির্ভর করছে।
তার মনে হলো : ছেলেমেয়েরা একটা কথা বুঝতে চায় না। মানুষ যত বৃদ্ধ হয়, মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকে, তার বাঁচার প্রবৃত্তি, মৃত্যুকে অস্বীকার করার প্রবৃত্তি হয় তত তীব্র। সে সন্তানের মধ্যে নিজের আকৃতির প্রতিফলন নয় শুধু, মতামতের অনুসরণও খুঁজে পেতে চায়; সে অন্য আধারে মৃত্যুকে অস্বীকার করে থেকে গেলো এই যেন বলে যেতে চায়।
তারপর তিনি ভাবলেন : বিবাহটা কি শুধু দুটি প্রাণীর? একটা কাহিনী মনে হলো তার। এবংশের একটি স্ত্রী বিবাহের দুবছর পরে স্বামীকে হারিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যু হয়নি, তিনি ইতর স্ত্রীদের নিয়ে ছন্নছাড়া হয়ে যেতে লাগলেন ক্রমশ। প্রথমে স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিলেন বউটি, তারপর করলেন অস্বীকার। তার মহলে স্বামীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো। এতটা হলো যে জমিদারির মালিক হয়েও সে লোকটি স্ত্রীর মহলের দাসীদের মুখে যেতে পারবেন না আপনি এই হুকুম শুনে ফিরে গেলেন। সে যেন এক মাতৃতন্ত্রের পুনঃস্থাপন। স্ত্রীর অধিকার শ্বশুরের প্রতিষ্ঠাতেও, শুধু স্বামীতে নয় এই যেন প্রমাণ করেছিলেন বউটি। শ্বশুরবাড়ি স্বামীর চাইতে অনেক বড়ো। বিবাহটা শুধু দুজনের সম্বন্ধনয়। দুজনের হৃদয়ের গভীরতায় সীমা পাওয়া যায় না এমন বহু হুদয়ের সঙ্গে জড়িত। নতুন বিবাহ আর বাঈজী-প্রণয়ে কি প্রভেদ?
প্রকাশ্যে বিয়ের মন্ত্র পড়ুক ওরা এখানে। সেটা যদি অভিনয় হয়, হোক না। প্রায়শ্চিত্তর মতো লাগছে শুনতে, তাহলে তাই। তোমাদের কাছে হয়তো প্রস্তাবটা হাস্যকর শোনাবে, কিন্তু পিতামাতা যদি আঘাত সহ্য করতে পারে, পরিবর্তে তাদের মুখ রাখার জন্য একটা মিথ্যা অভিনয় করা কি খুব কঠিন হবে, সুমিতি?
মনে মনে এই কথাটি হুকুমের মতো করে বলে অনসূয়া একটু শান্ত হলেন।
.
সকালে স্নান সেরে ঘরে ঢুকে সুমিতি দেখলো আয়নার সামনে টেবিলটার উপরে একটি সিঁদুরের কৌটো। সেটা সেকেলেসোনার, ভারি এবং অত্যন্ত বড়ো। এটা অতিথির জন্য সংরক্ষিত বস্তুগুলির একটি নয়, উপহার দেওয়ার জন্য কিনে আনাও নয়। হয়তো-বা সান্যালগিন্নির নিজের ব্যবহার্য, কিংবা হয়তো এই সেকেল পরিবারের প্রথার সঙ্গে যুক্ত একটি উত্তরাধিকারচালিত সামগ্রী।
আয়নার সম্মুখে বসে সুমিতির মনে হলো, সান্যালবাড়ির প্রথম শাসন কৌটো মারফত তার কাছে এসে পৌঁছেছে। সিঁদুরহীন কপালে এ বাড়ির বউ হওয়া সম্ভব নয়, একটিমাত্র কথা ব্যয় না করেও সে কথাটি অনসূয়া তার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
বিবাহের চিরাচরিত প্রথা যদি না মেনে থাকে তারা, সেটার পিছনে পুরাতনকে অস্বীকার করার ইচ্ছাও যদি থেকে থাকে, তাকে সবসময়ে ঘোষণা করে বেড়াতে হবে এমন কথা নেই। প্রতিবাদ মানে পাহাড়ীদের মতো সর্বদা কোমরে কুকরি বেঁধে বেড়ানো নয়।
গোল করে কপালে টিপ আঁকতে আঁকতে সুমিতি ভাবলো সিঁথিতেও দিতে হবে নাকি? সামান্য একটু চেষ্টাতেই চুলগুলো চিরে সোজা সিঁথি করে সিঁদুর পরতে পারলো সে।
সিঁদুর পরে আয়নার দিকে চেয়ে সে লজ্জিত হলো। তার সে লজ্জাটি অন্য যে কোনো নববিবাহিতা অনুভব করে। এটা বুঝতে না পারলেও তার মনে হলো কেউ বা তাকে দেখে ফেলেছে।
চায়ের অভাব বোধ করছিলো সুমিতি, চায়ের সম্ভার নিয়ে ঝি এলো না, এলেন সান্যালগিন্নি খালি হাতে।
এসো তো।
সুমিতিকে পিছনে নিয়ে ঘর থেকে বার হলেন অনসূয়া। ঠাকুরঘরে প্রণাম করে বেরিয়ে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী সুমিতি দেখলো একটা ছোটোখাটো জনতা তার জন্য অপেক্ষা করছ। অনসূয়ার সঙ্গে সুমিতিকে দেখতে পেয়ে হুলু দিয়ে উঠলো তারা। কে একজন শাঁখও বাজালো। সভা করে অনেক সাবাস বাহবা পেয়েছে সে কিন্তু সহসা এই স্ত্রীমণ্ডলের সমবেত কণ্ঠে ‘বেশ বউ, বেশ বউ’ শুনে সুমিতিকে মাথা নত করতে হলো।
শুধু একজন এদের কথায় সায় দিলেন না। অনেক বয়স হয়েছে তার। কথা বলতে গেলে গলা কোথাও কোথাও কেঁপে যায়, কিন্তু এখনো তার দেহবর্ণ বয়সের নিষ্প্রভতাকে কাটিয়ে দর্শনীয়। তিনি বললেন, আমি ভাবি মেমসাহেব বুঝি। অনসূয়া বলে আমারই মতো, তা তোরাই বিচার কর। এ যে আফ্রিকার বুয়ার।
একটা চাপা হাসি কানে এলো সুমিতির।
প্রসন্ন হাসিতে অনসূয়া বললেন, উনি তোমার ঠানদিদি সুমিতি, প্রথমে ওঁকেই প্রণাম করতে হয়।
প্রণাম পর্ব শেষ করে সুমিতি ঘরে এসে দাঁড়ালো। স্নানের ঘর দেখে সুমিতির যেমন সামন্ততান্ত্রিকতা লক্ষ্য করে সচেতন হয়ে উঠেছিলো সেই মন কাজ করতে লাগলো। বিবাহযজ্ঞের ধোঁয়া শুধু নিশ্বাস ও দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে না, মনকেও করে। সেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় অকাব্যকে কাব্য বলে ভ্রম হয়, নিছক কতগুলি বস্তুতান্ত্রিক প্রতিজ্ঞা এবং কতগুলি কষ্টবোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ রম্য হয়ে ওঠে। তেমনি একটি মোহই যেন এরা বিকিরণ করছে। কিছুক্ষণ আগে প্রভাত হয়েছে। এরই মধ্যে আয়োজনের এতখানি যারা করেছে, রাত্রিতে পৌঁছবার আগে দিনটাকে তারা কীভাবে অনুপ্রাণিত করবে বলা কঠিন।
কাল রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত একটা সন্দেহ হয়েছিলো সুমিতির–এরা আদৌ তাকে বধূ হিসাবে গ্রহণ করবে।কনা, এখন আর সে সন্দেহ নেই; গ্রহণ নয় শুধু, বিপুল আয়োজন করে চিরাচরিত কোলাহলের মধ্যে গ্রহণ করছে।
পদশব্দে চোখ তুলে দেখলো সুমিতি, ঘরের ঠিক মাঝখানে অনসূয়া এবং একজন প্রৌঢ় এসে দাঁড়িয়েছেন। সুমিতির মনে হলো হাত তুলে নমস্কার জানানো উচিত, কিন্তু এগিয়ে গিয়ে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে সে নতজানু হয়ে প্রণাম করলো।
তোমার শ্বশুর, সুমিতি। অনসূয়া বললেন।
কী বলা উচিত–এই ভাবতে ভাবতে চোখ তুলে সুমিতি সান্যালমশাইয়ের মুখ দেখতে পেলো। অতি সাধারণ একজন মানুষ, অথচ এ-অঞ্চলে এত বড়োমানুষ নাকি কেউ নেই।
সান্যালমশাই বললেন, কল্যাণ হোক। তারপর একটু যেন দ্রুতপদে তিনি চলে গেলেন। সুমিতির মনে হলো, সান্যালমশাইয়ের চোখ দুটি টলটল করছিলো।
দ্বিপ্রহরের আহারের ব্যাপারটা সেদিন সহজ হলোনা। ডালিমফুলি বেনারসি শাড়ি, ফিরোজা ওড়না, সদ্য-কেনা ঝকঝকে অলংকারে সজ্জিত হয়ে বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত আত্মীয় ও জ্ঞাতিদের আহারের সম্মুখে দাঁড়াতে হলো তাকে একবার।
খেতে-খেতে কে একজন বললো, দাদা, আপনি যে এত চাপা তা আমি জানতাম না। বড়োছেলের বিয়ে, দশ গাঁয়ের লোক জানবে; জানাজানি হবার আগেও কানাকানি চলবে; তা নয়
সদানন্দ সান্যালমশাইয়ের হয়ে উত্তর দিলো, চারদিকে অশান্তি, প্রজাদের ঘরে হা অন্ন, এখন কি হৈ-হুঁল্লোড়ের বিয়ে ভালো দেখায়।
প্রথম লোকটি হাসতে-হাসতে বললো, মাস্টারমশাই নিজে যেমন, ঠিক তেমনি মানানসই কথাই বলেছেন। তিনি যে গ্রামে আছেন, এটা খোঁজ নিয়ে জানা যায় না বটে।
কয়েকজন মোসাহেবির ভঙ্গিতে হেসে উঠলো।
সান্যালমশাই বললেন, মিহির, তুমি সদানন্দের ব্যাপারে হাসছো, কিন্তু আসল ব্যাপারটা সে গোপন করে যাচ্ছে, তা ধরতে পারেনি।
না-না, গোপন করবো কেন?
জেল খাটা যাদের উপজীব্য, লোকালয়ে আত্মপ্রকাশ করা যাদের চলে না, তাদের প্রকাশ্যে বিবাহ করারও মুখ নেই, এ কথাটাই সদানন্দ গোপন করছে।
দু’একজন হাসলো।
মিহির বললো, মাস্টার যে আমাদেরসুদ্ধ জেলে পাঠাননি, এটাই আশ্চর্য!
.
ঘরে ফিরে সুমিতি শাড়ি, ওড়না, অলংকার খুলে ফেলতে ফেলতে চিন্তা করলো। শাড়ির রং ও অলংকারের গঠনের কথা গণনীয় নয়। অন্যের রুচিমতো সাজসজ্জা করা জ্ঞান হওয়ার পরে তার এই প্রথম। তা হোক, একটা অভিনয় বলে সেটাকে মেনে নেওয়া যায়। এদের হাসি ও লঘু আলাপের পিছনে একটি প্রয়াস ছিলো, সেটা অতি সহজেই ধরা পড়ে। একজনকে মাঝে মাঝে নিজের মতামত প্রকাশ করার জন্য জেলে যেতে হয়, সেজন্যই যে তাকে বিবাহ ব্যাপারটা গোপনে সমাধা করতে হবে, এটা নিশ্চয়ই এরা বিশ্বাস করে না।
কিন্তু চিন্তার অবসর আজ এরা দেবে না। প্রায় তার সমবয়সী কয়েকটি স্ত্রীলোক এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। বেশভূষা ও আকৃতিতে লক্ষণীয় আর্থিক আভিজাত্য নেই তাদের, কিন্তু সুমিতি বিস্ময়ের সঙ্গে অনুভব করলো, তাদের এই কোলাহলে কিছুমাত্র অভিনয় নেই। বিশেষ করে একটি মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার মনে ছাপ রাখলো। তার বেশভূষা সবচাইতে কম সোচ্চার, কিন্তু তার বড়ো বড়ো চোখ দুটির ক্ষমতা সম্বন্ধে যে সে সম্পূর্ণ সজ্ঞান তার পরিচয় তার চোখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজলের রেখায়। সুমিতি কিছুক্ষণের মধ্যে পরিচয় পেলো মেয়েটি সম্বন্ধে তার ননদ।
মেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলো, সুমিতির এই ননদ বললো, এদিকে জ্যাঠামশাইয়ের ঘর, জোরে হাসাহাসি করলে ওঁর কানে যাবে। বউকে গিরিতার করে নিয়ে চলো। সুমিতির ননদ পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো, আর অন্যান্যদের মাঝখানে সুমিতিকে যেতে হলো অন্দরমহলের দক্ষিণ সীমায় দক্ষিণী একটা ঘরে।
সুমিতির ননদের নামটা একটু অদ্ভুত-মনসা। অবশ্য তাতে মাধুর্যের হানি হয়নি। তার স্বামী তাকে মণি, মণিমালা ইত্যাদি বলে থাকে। এসব একমুহূর্তে জানতে পারলো সুমিতি। কথাগুলো বলেই মনসা বললে, হা বউ, তোমাকে দাদা কী বলেন?
সুমিতি সুন্দর একটা উত্তর ভেবে নেওয়ার আগেই মনসা হেসে বললো, হ্যাঁ গো, দাদার সঙ্গে তোমার কোনোদিন সত্যি দেখা হয়েছিলো তো? তুমি তার বউ তো, নাকি ঠকাতে এসেছো?
সুমিতির মুখে একটা ছায়া পড়ছিলো, সে হেসে-হোক একটু চেষ্টা করে বললো, মণিদিদি, তোমার জিভে বিষ আছে। কিন্তু তা হোক, তোমাকে আমি শিগগির শ্বশুরবাড়িতে ফিরতে দিচ্ছি। না।
মনসা তার চোখ দুটি ব্যবহার করলো।
সুমিতির মনে হলো কথাটা সে শুনতে ভালো শোনাবে বলেই বলেনি, সমস্ত মন দিয়েই বলেছে। মণি ভালোবাসার মতো। ।
.
দুপুর গড়িয়ে গেছে। সুমিতির ঘরে শোফাটায় শুয়ে গল্প করতে করতে মনসা রৌদ্রের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুমিতি মনসার নিঃসংকোচ শোবার ভঙ্গিটি লক্ষ্য করলো। তারপর সে লক্ষ্য করলো অনসূয়া ক্লান্ত শ্লথ পায়ে ছাদটা পার হয়ে নিজের বসবার ঘরের দিকে যাচ্ছেন। সুমিতি শুনতে পেলো মাটি-উঠোনের বাঁধানো চত্বর থেকে যে থামগুলো দোতলার ছাদ পর্যন্ত উঠেছে, তারই একটা কার্নিশে বসে একজোড়া ঘুঘু ডাকছে। অনসূয়া কার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন। মাঝে মাঝে রান্নামহলের চত্বর থেকে ক্ষীণ একটা কোলাহল কানে আসছে।
মনসার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করতে পেরেছে সুমিতি। মনসা সরাসরি প্রশ্ন করেছিলো, বিয়েটা কি গন্ধর্ব মতে হয়েছে, ভাই বউদি? সুমিতি একটু চিন্তা করে, একটু সময় নিয়ে বলেছিলো, না, ইংরেজি মতে। মনসা উত্তরটায় হাসির কী পেলো কে জানে। হাসতে হাসতে সহসা গম্ভীর হয়ে সে বিষ ঢাললো, বললো, ভাই বউদি, যে ইংরেজের সঙ্গে আমার দাদার আকৈশোর বিবাদ, নিজের জীবনে সেই ইংরেজের আদর্শ ছায়া ফেলো! তার এ হার স্বীকারের জন্য কি তুমি দায়ী, না তোমার চোখজোড়া?
সুমিতি নিজের দৃষ্টি আনত করে দেখলো মনসার চোখ দুটিতে টলটল করছে আশ্বাস। সে বললে, গন্ধর্ব মতে হলে কি আমাকে গ্রহণ করতে?
‘আমাদের গ্রহণ করার মূল্য কী তা আমি নিজে জানি না; নিশ্চয় আছে, নতুবা জ্যাঠাইমা তার জন্যে এত আয়োজন করতেন না। তবু তোমাদের কাছে যতটা সাহস আমরা আশা করি, এ ব্যাপারে তার পরিচয় নেই। অবশ্য এও নব গন্ধর্বমত, শুধু বয়স্য কিংবা বনস্পতিকে সাক্ষী রেখে সরকারের দু’একজন কর্মচারীকে রেখেছে কিন্তু সাক্ষীর কী প্রয়োজন হলো?
সুমিতি আবার চিন্তা করলো। এখানে আসবার প্রস্তাবটা তার নিজের। কারো সঙ্গে সে আলোচনা করেনি, কিন্তু অন্তরঙ্গ যারা তাদের সকলেই যে এই প্রস্তাবে সমস্বরেনা না করে উঠতো তাতে সন্দেহ নেই। এমনকী এই বাড়ির বড়োছেলেকে একদিন প্রস্তাব করায় সে বলেছিলো, সম্মানের যদি হানি হয়?
সুমিতি বললো, মণি, সাক্ষ্য থাকা না-থাকায় আমার নিজের কিছু এসে যায় না। তোমার দাদার হাতে কেউ আমাকে সম্প্রদান করলো কিনা তারও খুব বড়ো দাম নেই, কিন্তু গন্ধর্ব মতকে আমরা গ্রহণ করিনি, কারণ–
সুমিতির গাল দুটি লাল হলো। মনসা তার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, কারণ বিয়ে শুধুদুজনে শেষ হবে মনে করোনি।
মনসা উঠে এসে সুমিতির পাশে বসে তার একখানা হাত নিজের হাতে নিলো কিন্তু এই ভঙ্গির বিপরীত সুরে কথা বললো, তুমি তো তাহলে আমাদের মতোই সাবধান। প্রেমের জন্য সবকিছু দিতে বসেও হিসেবের নাড়িতে টান লাগছে তোমার। খিলখিল করে হেসে বললো মনসা, দেন মোহর ব্যবস্থা করোনি তো?
কিন্তু, মনসা পরক্ষণেই গভীর সুরে বললো, আমার আর একটা ধারণা পরিচ্ছন্ন হলো আজ। বহুদিন ধারণা ছিলো তোমরা যারা ভালোবাসো তারা বিদ্রোহী, এখন মনে হচ্ছে প্রেমের সে বিদ্রোহ রংদার রাংতা।
কিন্তু তাহলেও সুমিতি নিজের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে স্বেচ্ছায় এসেছে, একথা কেউ কি বিশ্বাস করবে?নিজের বাড়িতে সুমিতি প্রমীলার মতো স্বাধীনা। তার এই যেচে আসা এবং এদের এই গ্রহণ করবার পদ্ধতি সুমিতির চরিত্রে খড় ও বাঁশ ছাড়া আর কিছু কি অবশিষ্ট রাখলো? তার সঙ্গে বিপন্ন আর একটি আশ্রয়কামীর কী পার্থক্য রইলো? সুমিতি অন্তর্বত্নী একথা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কি লোকে বলবে না বেকায়দায় পড়ে এসেছে সে? এদের চোখে মন্ত্রপড়া বিবাহ ছাড়া আর সববিবাহই কি অসংযমের গ্লানিমাত্র নয়? বিবাহের যে কোনো প্রথাই একটি সমাজিক স্বীকৃতিমাত্র। সেই স্বীকৃতি যদি না থাকে কী মূল্য রইলো প্রথার,কী প্রভেদ রইলো এই বিবাহের প্রথাহীন মিলনের সঙ্গে।
তখন কেউ সুমিতিকে দেখলে ভাবতে রৌদ্রের ভয়ংকর উত্তাপে মেয়েটির অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে।
মনসা ঘুমিয়ে পড়েছে। সুমিতি ভাবলো–আর যা-ই হোক, নিজের চরিত্র কী সেটা প্রকাশ । করার জন্য সে এখানে আসেনি, যেমন আসেনি এদের প্রথাগুলিকে আঘাত করে নিজের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে। যদি কেউ বলে–সে আশ্রয় চায়? উত্তরে সুমিতি হাসলো মনে মনে।
.
অনসূয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে ঘরে এলেন। প্রায় বিশ বছর বাদে তিনি আজ কোমরে কাপড় বেঁধে রান্নার মহলে নেমেছিলেন। বিবাহের পরে এমনি আর একটা ঘটনা ঘটেছিলো, সেটা তার দিদিশাশুড়ির শ্রাদ্ধের সময়ে।বু সেদিন ছিলো একটি সুপরিকল্পিত কার্যক্রম।ব্যাপারটির মর্যাদা রক্ষা করাই ছিলো তার দায়িত্ব। কিন্তু আজ সকালে যখন আলাদীনের মতো ইচ্ছা কিন্তু তার প্রদীপনা নিয়েই মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়ালেন তখন হুকুম নির্দেশ দেবার অবসর ছিলোনা।মুখরক্ষা করতে হবে এই দৃঢ় সংকল্প ছিলো।
এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ ছিলো সান্যালমশাইকে খবরটা দেওয়া। কাল বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত্রিতে যা একান্ত অসম্ভব বলে বোধ হয়েছে, এখন সকালের দু’পাঁচ মিনিটে সেই খবরটা দিতে হবে; এবং খবর দেওয়াই শেষ নয়, তাকে অভিমান করার অবসর দেওয়া যাবে না, বরং সহায়তার জন্য ডাকতে হবে।
সান্যালমশাই তখন শয্যা ত্যাগ করেননি। অনসূয়া তার ঘরে এসে বিছানার একপাশে বসে বলেছিলেন, একটা বউভাতের ব্যবস্থা করে দিতে হয়।
বউভাত! কার? এখনো রাজ্যে বউভাত হচ্ছে নাকি?
খোকার।
খোকার? মানে তোমার বড়োছেলের?
অনসূয়ার ঠোঁট দুটি এই জায়গাটায় কাঁপছিলো। সান্যালমশাই লক্ষ্য করলেন সেটা।
তিনি বলেছিলেন, তোমার বড়োছেলে বিয়ে করেছে? সুমিতি কি সেই বউ? তবে তো বউভাত করতেই হবে।
সর্বাঙ্গসুন্দর না হলেও একটি হাসি আনতে পারলেন সান্যালমশাই, বললেন হাসতে হাসতে, ছেলেটা এতেও বিপ্লব আনলো।
অনসূয়া উঠে দাঁড়ালেন, দ্বিতীয়বার কথা বলার আগে পিছন ফিরে হাতের তেলোয় চোখ দুটি মুছে নিলেন, বললেন, বস্ত্র, আভরণ
নিশ্চয়, সদানন্দ এখনো ঘোড়ায় চড়তে পারে কিনা খোঁজ করি।
সান্যালমশাইয়ের মুখাবয়ব রক্তহীন, যেন একটা মুখোশের আড়ালে ঢাকা রইলো সবসময়ে।
কাজকর্ম মিটিয়ে অনসূয়া ঘরে এসে মনে মনে অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন, বড়োছেলের একটিও নতুন ভোলা ফটো নেই ঘরে। প্রায় তিন বৎসর পূর্বে শেষবার তাকে তিনি দেখেছেন। মাঝে মাঝে ভাইদের চিঠিতে তার খবর পান। কিন্তু আজ যেমন করে তার ফটোর অভাব বোধ করলেন এমন অনেকদিন হয়নি।
পদশব্দে চোখ তুলে তার নিজস্ব দাসীকে দেখতে পেলেন অনসূয়া।
এই শরবতটুকু পাঠিয়ে দিলেন বুড়িদিদি।
আহা, তার খাওয়া হয়েছে তো? সব উল্টোপাল্টা ব্যাপার হলো আজ। তোমরা খেয়েছো?
আমরা এবার বসবো, কিন্তু আপনি এটুকু নিন।
বড্ড খাটলে আজ তোমরা।
বুড়িদিদি বলছিলেন–বাড়িতে অনেক আশ্চর্য আশ্চর্য ব্যাপার হয়েছে, কিন্তু পাঁচ ঘণ্টায় এমন বউভাত সাজাতে আর কেউ সাহস করেনি।
দাসী চলে গেলো। দাসপাড়া, সেনপাড়ার লোকেরা জোকার দিয়ে অন্দরের উঠোনে প্রবেশ করছে, খবর পাওয়া গেলো। এবং এ জোকারের স্বীকৃতিটুকু এ-উদ্যমের সার্থকতা।
১০. আলেফ সেখের বাড়িতে
একদিন রামচন্দ্র আলেফ সেখের বাড়িতে যাচ্ছিলো। আলেফ সেখের বাড়ি চরনকাশিতে। আলেফ সেখের তিনজোড়া বলদই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নতুন একজোড়া সে কিনেছে গত সপ্তাহে অরনকোলার হাট থেকে, তাদের থেকেই রোগটা ছড়াচ্ছে। বুধেডাঙার প্রান্ত পর্যন্ত এসে রামচন্দ্র মাঠের পথ ধরলো। মাঠ পেরিয়ে সে সোজা পাড়ি দেবে চরনকাশির জোলা পর্যন্ত, জোলা পার হলেই আলেফ সেখের বাড়ি।
হঠাৎরামচন্দ্র থেমে দাঁড়ালো। দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য। ভরুই পাখি! ধানের সঙ্গে তাদের যাওয়া আসা, ঝাঁক বেঁধে তারা আসে, ধোঁয়ার মতো ধানের শিষগুলির উপরে ভেসে বেড়ায়। তেমনি আসে এদেশে দক্ষিণের চাষীরা। মাথায় টোকা, হাতে ছোট ছোট লাঠি, কাঁধে একটি করে ঝোলা, তাতেই তাদের সর্বস্ব। ধানের দিনে তারা আসতো, তখন তাদের আসাটাই ছিল স্বাভাবিক। তাদের আসা সূচনা করতো ধান, তাদের হাসিতামাশা, কথাবার্তা গ্রামের পথে গ্রামের চাষীদের আত্মতৃপ্তির নিশানা দিয়ে বেড়াতো।
রামচন্দ্র অবাক হয়ে দেখলো ঠিক তাদের মতো চেহারার কয়েকজন তোক দল বেঁধে আসছে। ছিদামের ধান কাটতে এলো নাকি এরা? কথাটা মনে হতেই রামচন্দ্র শূন্য মাঠের মধ্যে একা একা হেসে ফেলো।
কাছাকাছি এসে ওরা বললো চৈতন্য সা-র বাড়ি কোন দিকে যামু?
যাও এই পথেই।
ওরা চলে গেলে রামচন্দ্র পথ চলতে লাগলো আবার। তাহলে এরা চৈতন্য সাহার খোঁজে এসেছে, তার সেই কুখ্যাত হাড়-চালান-দেওয়ার ধানীনৌকার দাঁড়িমাল্লা হবে বোধ হয়। চৈতন্য সাহার জমি হয়েছে, কিন্তু ধান কোথায় যে কাটবে এরা? রামচন্দ্র ঠিক করলো ফিরবার সময়ে বাড়ি যাবার পথে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্টকে কৌতুকের খবরটা দিয়ে যাবে।
.
কিন্তু চৈতন্য সাহা নাবালক নয় যে ছিদামের ধান কাটার খবর পাঠিয়ে দাঁড়িমাল্লা ডেকে আনবে। বাঙালরা–এ অঞ্চলে ধান কাটার জন্য যারা দক্ষিণ থেকে আসে তাদের প্রচলিত নাম-কেন এসেছে বোঝা গেলো। রটলোএ বছর চৈতন্য সাহা এ গ্রামের চাষীদের আগাম টাকা দিয়ে চাষ করতে ডাকবে না। যারা প্রাণের দায়ে তার কাছে গিয়েছিলো কথাবার্তা বলতে তারা ফিরে এসেছে। সে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে–এবার সে অন্য দেশ থেকে চাষী এনে তার খাইখালাসি জমি চাষ করাবে। চাষীরা ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেলো। তারা গত ফসলের সময়ে যে অপমান বোধ করেছিলো ভয়ে তাদের সে-অপমান বোধও আর রইলো না।
কথাটা তার কাছে দু’একজন উত্থাপিত করলে রামচন্দ্র একদিন ভক্ত কামারের কাছে বললো, এমন তো হয়ই, খাইখালাসিতে জমি বাঁধা পড়লে চাষীর তো এই হালই হবি।
কিন্তুক ধরো যে নিজের জমিতে মজুর খাটে গত সনে প্রাণ বাঁচছে, এবার কী হবি? এবার যে মজুর খাটেও দিন চলার উপায় নি। এ সনও না, তার পর সনও না, তারপর জমি ফিরে পাবা। ততদিন কোন ধানে বাঁচবা?
ব্যাপারটা দেখতে দেখতে অন্যতর পরিণতি নিলো।
শ্রীকৃষ্ট সেদিন অসুস্থ, মহাভারত পড়ার শক্তি নেই। রামচন্দ্র তার দাওয়ায় বসে বললো, শুনছেন না, গোসাই?
শ্রীকৃষ্ট সবই শুনেছে, খানিকটা সময় চুপ করে থেকে সে ধীরে ধীরে বললো, আপনাকে নিয়ে আমি একবার সান্যালমশাইয়ের কাছে যাবো। কবো, এখন আমরা মরে গেলে যদি দেশে শান্তি হয়, হউক।
রামচন্দ্র বললো, দেশে আর শাস্তি হবি নে।
গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো তার।
ঘরের মধ্যে থেকে আর একজনের দীর্ঘনিশ্বাস শোনা গেলো। সে শ্রীকৃষ্টর শেষ বৈষ্ণবী পদ্ম।
শ্রীকৃষ্ট বললো, কেন, পদ্মা, তুমি কী কও?
পদ্ম বললো, আমাদের দেশে লাঙলের পূজা হয়, তাতে শান্তি আসে।
সে কী পূজা?
পদ্ম বললো, দেখছি–নতুন কাঠ দিয়ে এক লাঙল তৈরি করে পাটবাণের পূজার দিনে পূজা হয় তার, তারপর সেই লাঙলে খানিক মাটি ভোলা হয়, গাঙের জল তুলে কাদা করা হয়, সেই কাদায় গড়ায়ে, সারা গায়ে কাদা মাখে আমার দাদারা খেতে নামতো চাষ দিতে।
খেত? না, কন্যে। এদেশে আর খেত নাই। রামচন্দ্র বললো।
আলোচনাটা আর এগোলো না। প্রায় অন্ধকার পথ বেয়ে দশ-পনেরো জন লোক এসে দাঁড়ালো শ্রীকৃষ্টর ঘরের সম্মুখে।
তুমি এখানে আছেন মোণ্ডল, আমরা খুঁজতেছিলাম। ওদের মধ্যে একজন বললো।
কেন্ ভাই, আমাক কেন্?
তারা বললো ভক্ত কামারের দুই ছেলে অনেকদিন থেকে ওপারের মিলে কাজ করে। বড়োছেলে আজ ভক্তকে নিতে এসেছে। তার কাছে শোনা গেছে ওপারের ধানের কলে এখন অনেক মজুর নেবে। ভক্তর কাছে গিয়েছিলো গ্রামের অনেকে, সে বলেছে, রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করো, সে বললেই–যাওয়া।
রামচন্দ্র কথা বলার ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসলো, কিন্তু কথা খুঁজে না পেয়ে গোঁফে হাত। রাখলো।
তার বক্তব্য ছিলো–আমি কী বলবো, এমন করে তো আগে তোমরা আমাক কও নাই, আমি কী পরামর্শ দেবো? আমি কি কোনোকালে পরামর্শ দিবের শিখছি?
এদের মধ্যে একটি বোকা বোকা লোক ছিলো, কথা বলতে তার ‘র’ও ন’ দুটিই ‘ল’ হয়ে যেত; সে বললো, মল্ডল্ বুঝি গাঁ ছাল্বা লা? যখন আমলা লা খায়ে মলাম তখন জমিদালও গাঁ ছালে পলাইছিলো।
রামচন্দ্র বললে, কোথায় যাবো?
তার বক্তব্য ছিলো : কোথায় যাবো, সর্বত্রই তো একই পৃথিবী।
প্রশ্নটা সকলেই করতে পারে, উত্তর দেবে এমন কে আছে?
রামচন্দ্র বললো, এবার তার গলাটা আবেগে কেঁপে গেলো, কোথায় যাবো কও, তোমরাই কও। ভক্ত আসে নাই কেন্?
তাদের মধ্যে ভক্তর ছেলেও ছিলো, সে বললো, বাবা কলোমুখ দেখাতে লজ্জা করে। আমি কই, না খায়ে মরার চায়েও কি লজ্জা বড়ো?
এখন হয় কি, পুনঃপুনঃ এই নাটক অভিনীত হচ্ছে। যারা মঞ্চে থাকে তারা ঠিক ঠাহর করতে পারে না, কী রকমটা তারা চলবে। তারপর এ ওকে কথা যুগিয়ে দেয়, এর কাজের থেকে ওর কাজের সৃষ্টি হয়। একটা সামান্য কথা, এতটুকু ইঙ্গিতবিভঙ্গ থেকে জনসমুদ্র উদ্বেল হওয়ার গতিবীজ পায়। মেয়েরা যতই উহ্য থাক পুরুষদের আলাপ আলোচনায়, মাঝে মাঝে তাদেরও দু’একটি কথা ছিটকে বাইরে এসে পৌঁছায়। তার গুরুত্ব কম নয়, বরং দেখা যায় পুরুষদের সম্মিলিত যুক্তির আধখানা সৃষ্টি করেছে সেই স্বল্পোচ্চারিত কথা কয়টি।
এতগুলো লোক শ্বশুরকে খুঁজছে কেন এ জানবার আগ্রহে আগন্তুকদের সঙ্গে মুঙ্লাও এসেছিলো। ঘরের ভিতর থেকে তাকে ডেকে পদ্ম বললো, বাবাক একটা কথা কবা, আপনেরা যেন যাবেন, মিয়েছেলের কী হবি? তাদের সেখানে আবু থাকে না।
মুঙ্লা ফিরে এসে কথাগুলি বললো, সেগুলি অবশ্য ইতিপূর্বেই এদের অনেকে শুনতে পেয়েছে।
তুই কী কস? ওদের একজন প্রশ্ন করলো।
মনে কয়, আমার মাকে নিয়ে আমরা যাবো না।
কয়েকজন প্রায় সমস্বরে বললো, তোমরা শ্বশুর জামাই রোজগার করে সেখানে খাওয়াবের পারবা না? তোমরা থাকতে আব্রুর কী ভয়?
মুঙ্লা বললে, অচেনা জায়গায় কী কাম যায়ে, পারি তো এখানেও খাওয়াতে পারবো। কি কও ছিদামসখা?
নেচ্চায়!
যারা চলে যেতে কৃতসংকল্প হয়েছিলো তারা বললো, কিন্তুক চৈতন্য জমির খাজনা দেয় নাই, জমিদার জমি জব্দ করবি। চৈতন্য খাজনা দিবি নে; খাইখালাসি সব খাস হবি, কোনোদিনই আর আমাদের হাতে ফিরবি নে।
মুঙ্লা বললে, তা হউক, জমিদার জমি বাক্সে পুরবি নে; খাস করে, বরগা চায়ে নেবা।
বাকি খাজনা না দিলে কোনো জমিদার বরগা দেয় না।
অবিশ্বাসের হাসি হাসলো অনেকে।
একজন বয়স্ক চাষী হাসিটা কথায় প্রকাশ করলো, যেমন ছিদামের বোরো ধান লাগান! বরগা চষা কি গানের পালা বাঁধা নাকি?
অতি দুঃখে কয়েকজন হো হো করে হেসে উঠলো। রামচন্দ্রদাদার সব জমি যে খাইখালাসি হয় নাই তাই এমন কয়- সে হাসির মধ্যে এমন কথাও শোনা গেলো।
হাসি থামলে হরিশ শাঁখারি কথা বললো, রাম রে, আমি কী করি তাই কও।
কেন্ ভাই, হরিশ?
আমার খাইখালাসি যে জমিদারের কাছেই। মিহির সান্যালকে চাপ দিবি কে? মুঙ্লা, আমি যে বরগাতেও জমি ফিরে পাবো না।
রামচন্দ্রর মনে হলো এবার সে কেঁদে ফেলবে। বললো, তোমরা যদি থাকো, আমি তোমাদের ছাড়ে যাবো না।
আগন্তুকরা ধীরে ধীরে চলে গেলো। কিন্তু তাদের চলবার কায়দায় মনে হলো রামচন্দ্রর কথায় তারা কিছুমাত্র আশ্বাস পায়নি।
কী করা উচিত রামচন্দ্র কিছুতেই ঠাহর করতে পারছে না। ভাবতে না ভাবতে একদিন সে একটা অনুচিত কাজই করে ফেলো।
ছিদামের বোরো ধান আগুই হয়েছে, এই কৌতুকের খবরটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। এক সকালে বন্ধু মুঙ্লার সাহায্যে ধান কাটার জন্য ছিদাম প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময়ে তারা দেখতে পেলো পুকুরটার অন্যদিকে চৈতন্য সাহার পেয়াদারা এসে দাঁড়িয়েছে।
মুঙ্লা বললে, কেন্ ভাই, তোমরা আসছো কেন্?
ওদের একজন বললে, এ পুকুর কার?
কেন, সান্যালবাবুর প্রজা শ্রীকৃষ্টদাসের।
খাজনা দেও না কয় বছর?
খাজনা দিবার কী আছে কও? মাছ হয় না–জলকর দিবো, ফসল হয় না-খাজনা শোধবো মুঙ্লা বললে যুক্তি দিয়ে।
তাইলে খাইখালাসি বন্দোবস্ত করছিলা কেন্ চৈতন সার সাথে?
তা করছি, কিন্তু খাইখালাসির মধ্যে কি এই ধানের কথা ছিলো? এ মুল্লুকে এই ধান কো কালে হয়? যে ফসল এ জমিতে সচরাচর হয় তার উপরই মহাজনের দখল। কিন্তুক যে ফসলে কথা কেউ ভাবে নাই, তার উপর তার দখল হয় কী করে? জমি তো তাক চিরকালের জনি বেচি নাই। সে খাউক না যে ফসল মনে মনে জানা ছিলো কাগজ করার সময়। এ ফসলে। কথা কাগজের সময় তারও মনে ছিলো না, আমারও না। এর পর তার হক্ কী, কও। ছিদা যুক্তি দিলো।
জমি তো তার, তোমার দখল নাই; সে খালাস না দিলে তুমি ইয়েত লাঙল ছোঁয়াবা কে ধান কাটবের আমরা দিমু না। জমিদারের খাজনা দেও, আর চৈতন সার টাকা, তারপর কার ধান।
মুঙ্লার মনে হলো এদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করা বৃথা। এরা যুক্তির কথা শুনতে আসেনি গায়ের জোর দেখিয়ে এ ধানটুকুও নিয়ে যেতে চায়। সে বললে, ছিদামসখা, ধান তুমি কাটো
কিয়ের ধান কাটবা! ওরা পাঁচ-ছজন একসঙ্গে গর্জে উঠলো।
ছিদাম বললো, ধান কাটাই লাগবি, মেঞাভাইরা, এ ধান আমার সখের ধান। ধান কা বেচবো। বেচে যে টাকা হয় দিব চৈতন্য সা-কে। এক বিশ ধান আর তিন টাকা নিয়ে বন্দোবৎ করছিলাম পুকুরের ডাঙা। এক বিশ ধান আর তিন টাকা আমি তা ফিরায়ে দিব। পুকুরের জ তা দিই নাই, জলের ধান আমার।
লোকগুলির পিছন দিকে একটা ছোটো ঝোঁপের আড়াল থেকে চৈতন্য সাহার মুখ দেখা দিলো, আর সুদ, সুদ দিবি কে?
ছিদাম বললে, সুদ? সুদের কথা তখন কও নাই, মহাজন, মিছা কয়ো না। খাইখালাসির সুদের কথা নাই।
চৈতন্য সাহা ঝোঁপের পিছনে ডুব দিলো।
মুঙ্লা বললে, আমাদের যা বলার তা শুনছো, এই ধান আমরা কাটে নিবো। তারপর ও জমি খাক।
মুঙ্লা নিচু হয়ে বসে একগোছা ধানের গোড়ায় কাস্তে দিলো। চৈতন্য সাহার পেয়াদাদে একজন এগিয়ে এসে মুঙ্লার একখানা হাত চেপে ধরলো।
হাত ছাড়ো, অন্যাই কোরো না। বললো ছিদাম।
মুঙ্লা নিজেই হাত ছাড়িয়ে নিলো, কিন্তু ধানের গোছা ছাড়লোনা। পেয়াদাদের আর একজন এগিয়ে এসে মুঙ্লার হাতের উপরে তার লাঠিটা দিয়ে একটা গুতো মারলো।
মুঙ্লা ধান ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সে এ গ্রামের জামাই। সমবয়সীদের সতে খেলাধুলোর সময়ে চড়চাপড় দেওয়া নেওয়া সে করেছে, কিন্তু, এমন তিরস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এত বড়ো অপমান তাকে কেউ করেনি। কী একটা তীব্র কথা সে বলতে গেলো, কি তার আগে তার দু চোখ থেকে অশ্রু নেমে এলো।
ছিদাম বললো, সখা,চলো, ধান আমরা কাটবো না, আমার জন্যি তোমার অপমান সয় না।
মুঙ্লা বললো, না তুমি থাকো; খেতে দাঁড়ায়ে মরে যাও সখা, ক্ষেত ছাড়বা না। আমি সান্যালমশাইয়ের কাছে যাবো, গাঁয়ের লোকের কাছে যাবো, খাইখালাসি মানে কী তা বোঝাবো। তারপর আমিও মরবো।
ছিদামকে খেতের পাহারায় রেখে মুঙ্লাকে বেশিদূর যেতে হলো না। সে তেমাথার মোড়টায় পৌঁছে দেখলো সেখানে একটা জটলা হচ্ছে। রামচন্দ্র বোঝাচ্ছে আর তার চারপাশে দাঁড়িয়ে দশ-পনেরোজন চাষী একসঙ্গে তীব্র কণ্ঠে তর্ক করছে। এমনকী বুধেডাঙার রজবআলি সান্দারও এসে জুটেছে। সে কথা বলছেনা, পাগলের মতো দলটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তর্কের সমর্থনে।
প্রত্যহ এমন ব্যাপার ঘটে না। ভক্ত কামারের ছেলেরা আজ ভক্তকে নিয়ে গেলো। নদীর ঘাটে তাকে নৌকোয় তুলে দিতে যে দু-একজন গিয়েছিলো তারা লক্ষ্য করেছিলো, শুধু তারা দু’একজন নয়, আরো অনেকে এসেছে ভক্ত কামারের চলে যাওয়া দেখতে। রেল এঞ্জিনের মতো শব্দ করে নয়, ভিজেমাটিতে লগির বাঁশের কিছুমাত্র শব্দ হলো না যখন ভক্ত কামারের নৌকো চিরদিনের জন্য এ গ্রামের মাটি ছেড়ে নদীতে ভেসে গেলো।
স্তব্ধ হয়ে খানিকটা পথ চলার পর কথাটা উঠে পড়েছিলো এর-তার মুখে।
চাষীদের মধ্যে একজন শেষ কথা বলার ভঙ্গিতে বললো, গত সন যা হইছে তা হইছে, এ সন আর নয়। খাইখালাসি দিছি তার দলিল কই?
তোমরা তার কাগজে টিপ দেও নাই? রামচন্দ্র প্রশ্ন করলো।
সই টিপ দিছি, কিন্তুক রেজিস্টারি হয় নাই, সব ভুয়া। লাগে লাগুক মামলা।
রামচন্দ্র বললো, বুকের ভেতর হাতড়ায়ে দেখ তার কাছে টাকা খাইছো কি না খাইছো।
তখন যে না খায়ে মরি, তা দেখে কে? আর-একজন চাষী বললো।
সেই তো বড়ো কথা, তার টাকায় প্রাণ বাঁচছে তখন।
অন্য একজন অল্পবয়সী চাষী তেড়ে উঠে বললো, মানিনা ওসবদলিল। টাকায় নিছিটাকায় দিবো। চিতি সাপ! দলিল সাপের খোলস।
দলিলের দোষ কী ভাই? সব জমিরই কোনো না কোনো দলিল আছে। চৈতন্যর দোষ কী কও, সে খাইখালাসি না করলি আর একজন করতো। নিয়ম আছে তাই সে করছে, না থাকলি সে করতো না। নিয়মেক যদি তাড়াতে পারো তাড়াও!
এমন সময়ে জনতার মধ্যে থেকে রামচন্দ্রর দৃষ্টি পড়লো মুঙ্লার মুখের উপরে। তখন মুঙ্লা আবেগ ও অবমাননায় আকুঞ্চিত হচ্ছে।
কী হইছে রে?
ও পাড়ার থিকে মার খায়ে আলাম।
মার খায়ে?
রামচন্দ্রর ডান হাতখানা বারবার গোঁফের কাছে উঠে পড়তে লাগলো। ক্রোধে, ক্ষোভে,লজ্জায় সে বিচলিত হয়ে পড়েছে, বুদ্ধিতে কিছু ঠাওর হচ্ছে না; কিন্তু দর্শকদের মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় সে প্রতিবিধিৎসায় মনস্থির করে ফেলেছে।
কার হাতে মার খালে, মুঙ্লা?
মুঙ্লা ছিদামের ধান কাটার কথা ব্যক্ত করলো।
রামচন্দ্রর চারপাশে যারা দাঁড়িয়েছিলো তাদের একজনের হাতে একটা বড়ো লাঠি ছিলো। হঠাৎ সেটা হাতে নিয়ে রামচন্দ্র হাঁটতে লাগলো; মাঝে মাঝে তার হাত উঠে যেতে লাগলো। গোঁফে। ভারি দেহে দ্রুত হাঁটার ফলে তাকে দেখে মনে হতে লাগলো যেন একটা রাস্তা সমান করার এঞ্জিন ধ্বস্ ধ্বস্ শব্দ করে ছুটছে, যত তাড়াতাড়ি যন্ত্র চলছে ততটা পথ অতিক্রম করছে না। গ্রামবাসীদের ছোটো দলটি রামচন্দ্রর পিছনে পিছনে চলছে।
ছিদামের ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রামচন্দ্র দেখলো দুজন বাঙাল ছিদামের দু-পাশে পাহারায় দাঁড়িয়েছে আর জন তিন-চার বাঙাল বিপরীত দিক থেকে ধান কাটছে। রামচন্দ্রর মনে হলো সে হো হো করে হেসে ফেলবে–এই ধানের এত হাঁকডাক।
কিন্তু হাসিটা ফুটবার আগেই তার মনে পড়লো মুঙ্লাকে অপমান করেছে এরা।
রামচন্দ্র বললো, মুঙ্লাক মারছে কেন্? অন্যাই করে সে, আমাকে ক’লেও হতো।
ছিদাম বললো, অন্যাই কেন্? অন্যাই আমার। আমি ধান দিছি খেতে, চিতি সাপের থুথু লাগা খেতে; সেই মহাপাতক।
রামচন্দ্রর রাগটা অকস্মাৎ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, লাঠির উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে প্রচণ্ড স্বরে বললো, তফাৎ।
ওপাশের জঙ্গলটা নড়ে উঠলো, বোধহয় চৈতন্য সাহা স্থান পরিবর্তন করলো। খেতের বাঙালচাষীরা ধানের গোড়া ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
‘ধান কাটো কোন সম্মুন্দি, কোন চিতিসার বাপের ক্ষেত এটা?
একজন বাঙালচাষী বললো, গালমন্দ করেন না, ভাই।
ভাই! শালা আমার চোদ্দপুরুষের।
ক্রুদ্ধ বাঙালরা একসারি হয়ে দাঁড়ালো, কাস্তে মাটিতে ফেলে রেখে তারাও হাতে লাঠি নিলো। ছিদাম আর মুঙ্লা রামচন্দ্রকে বাধা দেওয়ার জন্য কী বলতে গেলো; কিন্তু তার আগে রামচন্দ্র খেতের মাঝখানে গিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়েছে, হিংস্রতায় তার দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, ক্রোধে তার পিঠ, বুক ও পাশের পেশীগুলি ছিঁড়ে যাবার মতো টানটান।
পিছন থেকে রজব আলি ফিসফিস করে বলে দিলো, রাগ কমান মোল, গা ঢিল দেন; লাঠি চলবি নে না হয়।
ওপাশের জঙ্গলের পিছন থেকে চৈতন্য সাহা কী যেন বললো। একজন বাঙাল কান পেতে শুনলো, তারপর সব বাঙাল পুকুরের পারে উঠে দাঁড়িয়ে সমম্বরে হুলহুলি করে বললো, আমরা ধান কাটার নাইগা আসছি, মারপিট আমরাও জানি, আজ তা কয়ে গেলাম।
বাঙালরা চলে গেলে রামচন্দ্রর দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সে জলকাদায় মেশানো প্রানের মধ্যে বসে পড়লো। তার বুকপাট তখনো সাপের ফণার মতো বারংবার আকুঞ্চিত ও বিস্ফারিত হচ্ছে।
গ্রামবাসীরা ঘিরে দাঁড়ালো রামচন্দ্রকে, ছিদাম আর মুঙ্লা রামচন্দ্রর সম্মুখে কাদার উপরে। বসে পড়লো। একজন স্ত্রীলোকও এসে দাঁড়িয়েছিলো ভিড়ের মধ্যে। খাটো হলদে শাড়ি পরা, আঁটসাট দেহ, চুলগুলো খুব টেনে বাঁধা, বড়ো বড়ো চোখ। চাষীদের যদি ভাষাজ্ঞান থাকতো, বলতো, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি উপাসনার মতো কতকটা। সে শ্রীকৃষ্টর বৈষ্ণবী পদ্ম।
রজব আলি এতক্ষণ একবার খেতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, একবার পিছিয়ে যাচ্ছিলো, এবার সে রামচন্দ্রর পাশে বসে দুই হাঁটুর উপর দিয়ে হাত দুটি ধানের দিকে অগ্রসর করে দিয়ে খুঁতখুঁত করে হাসতে লাগলো।
ছিদাম বললো, কেন্ জেঠা, ধান কাটি?
রামচন্দ্রর হয়ে মুঙ্লা বললো, এবেলা না হয়, ওবেলা কাটাবো। ভাইসব, তোমরা সকলে আসবা। আমার সখার এই ধানে ভোজ হবি, আকাশে ছিটায়ে ছড়ায়ে দেবো।
কিন্তু রামচন্দ্র মাথা দোলালো। গোঁফে একবার চাড়া দিয়ে মনটাকে স্ববশে এনে সে কথা বললো, ধানে হাত দিবা না, ও ধান তোমার না।
‘তবে?
আগে বিচার করো, রাজার কাছে যাও, তার কথা শোনো। যদি রাজা বলে, ধান তুলবা।
রাজা তো এখন শহরে। উকিল দিয়ে মামলা করে তার কথা শুনতে চারমাস; ততদিনে ধান মাটিতে পড়ে নতুন করে গাছ হবি।-হরিশ বললো কথাটা।
গাঁয়ের রাজা সান্যাল আছে, তাদের কাছে যাও।
তোমার সে রাজা মহাজনের পক্ষ, মিহির সান্যাল খাইখালাসি কারবার করে।
রামচন্দ্র একটু থামলো, তারপর কথাটা বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বললো, যে খাজনা খায় তাকে রাজার কাজও করতে হবি। রাজা মহাজন এদের তো কওয়া হয় নাই আমরা দেনা খাজনার দায়িক হব না। না কয়ে বলে দেনা খাজনা বন্ধ করবের পিরবো না ভাই। যা করবো জানায়ে শুনায়ে।
রামচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। মুঙ্লা ছিদাম ও অন্যান্য সকলকে বিস্মিত করে সে বললো, আমি এই কাদা গায়ে সান্যালমোশাইয়ের কাছে যাতেছি, তিনি মহাজনের বিপক্ষে আয় দেয় কিনা দেখবো।
রামচন্দ্র খেত পার হয়ে সান্যালবাড়ির পথ ধরলো।
পদ্মর মনে হলো, কী ভীরু, কী ভীরু।
কিন্তু সেটা শেষ কথা নয়। আদর্শটা কী করে তৈরি হয় বলা শক্ত। মেয়েদের বেলায় বোধ হয় নিজের বাবাই আদর্শবীজ। বাবার মতো এমন শক্তিশালী কেউ নেই, বাল্যের এই বোধ পুরুষদের আদর্শের মূলে চিরকালের জন্য থেকে যায়। নিজের ভাইরা, নিকট পুরুষ-আত্মীয়রা এই আদর্শের পুষ্টি করে, এবং পরবর্তী জীবনে অপরিচিত যে পুরুষকে মেয়েটি গ্রহণ করে প্রথম ভাবালুতা কেটে যাওয়ার পর সেই পুরুষ তত বেশি নিকটে আসে যতখানি মেয়েটির পূর্ব পরিচিত আত্মীয়পুরুষগুলির সঙ্গে তার চরিত্রগত ঐক্য আছে। পদ্মর কল্পনায় এমন একটি পুরুষ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এটা সে এর আগে কোনোদিন অনুভব করেনি, এখনো তার চিন্তায় এ কথাগুলি ভেসে উঠলো না। এমন কালো তেল-চুঁইয়ে-পড়া রঙ, এমন পেশীবহুলতা, এমন ভারভারিক্কি গোঁফ, এমন পাকাকঁচায় মেশানো একরাশ চুল মাথায়–পদ্মর অনুভবেঅপূর্ব একটি একাত্মবোধ ফুটে উঠলো। নিজের মনের সঙ্গে সে সওয়াল জবাবে নামলোনা, ভীরু নয়, ভীরু নয়। পাঁচ-ছ’জন বাঙাল চাষীর সম্মুখে–তারাও নিরস্ত্র নয়, লাঠি হেঁসো ছিলো–যে হাঁক দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সে ভীরু নয়।
.
সংবাদটা গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেলো। খাইখালাসি আর বন্ধকী, বরগাদারী, কিংবা পত্তনি হঠাৎ যেন তার প্রতি দুর্ভিক্ষের আগেকার দিনগুলির মতো মমত্ব বোধ করলো চাষীরা।
সন্ধ্যার পরে চাষীরা শুনলো রামশিঙা বাজছে, খোলে ঘা পড়ছে, ঢোলকে আখর ফুটছে–
চিতিসাপ চাঁদ শাহে লাগলো বিসম্বাদ
শোনো শোনো দেশবাসী তাহার সম্বাদ
–চাঁদ হেন্তাল হাতে নিলো।
১১. তখন দুপুরবেলা
তখন দুপুরবেলা, মানুষের জ্ঞান আহারের সময়; কাদা মাখা, অজ্ঞাত, অভুক্ত একটি লোক আঙিনায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখা করতে, এই সংবাদ পেয়েছিলেন সান্যালমশাই। শহরে যাদের দরোয়ান থাকে তাদের তুলনায় দরোয়ান। বরকন্দাজের সংখ্যা তার বাড়িতে বেশি, কিন্তু দরোয়ানের মুখে কথা দিয়ে লোককে ফিরিয়ে দেওয়ার অভ্যাস তার নেই; কেন নেই, সেটা অন্য কথা। সরাসরি অন্দরের আঙিনায় আসবার জন্য রামচন্দ্রর উপর সান্যালমশাই যৎপরোনাক্তি বিরক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তবু তাকে সামনে গিয়ে দাঁড়তে হয়েছিলো।
সান্যালমশাই সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই রামচন্দ্র নিচু হয়ে বসে সেকালের কায়দায় তার হাতের লাঠিটা তার পায়ের কাছে রাখলো।
আছ্রয় চাই, আজ্ঞা।
কী করেছে?
অন্যাই করছি, আছ্রয় দেন, কবুল আপনার কাছে।
কী আশ্চর্য, রামচন্দ্র! তুমি অন্যায় করবে, আর তার প্রশ্রয় আমি দেবো, এমন আশা তুমি কোরো না; মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা করে থাকো তার ব্যবস্থা আদালতে হবে। তুমি কি আমাকে ফৌজদারিতেও জড়াতে চাও! সান্যালমশাই বিরক্ত হলেন।
না, আজ্ঞা। গড় ছিরিখণ্ড এটা, তার জমিতে দাঁড়ায়ে আপনার কাছে কথা কতেছি।নীলকর সাহেব আমাদের জেরবার করছিলো, আজ্ঞা; আমাদের বাপ সান্যাল গুলি করে মারলো নীলকর সাহেবেক। ফৌজদারিতে কি হয়? পুলিস ক’লে ডাকাতি। আমরা জানি, হুজুর, দু-বিঘে জমির জন্যে অমন রাগ হয় না সান্যালদের। অনেক অপমান ছিরিখণ্ডের লোকরা সহ্য করছিলো, সেই সকলের রাগ ফাটে পড়লো ঐ দু বিঘে জমির ছুতা করে। লিন্ডোলসাহেব পাটের মহাজন ছিলো, তাক উচ্ছেদ করছিলেন স্বয়ং, আজ্ঞা।
রামচন্দ্র যাই বলুক, কথা বলার সময়ে তার চোখ দুটির যে পরিবর্তন হতে থাকে সেটা চোখে পড়লে তার আন্তরিকতায় সন্দেহ করার কিছু থাকে না।
রামচন্দ্র ব্যাপারটা বর্ণনা করলো। চৈতন্য সাহার খাইখালাসি বন্দোবস্ত, চাষীদের বিপদ, ছিদামের ছেলেমানুষি ইত্যাদি বর্ণনা করে অবশেষে সে বললে, ও জমিও আমার না, ও ধান বোনার একপয়সা দামও আমি দিইনা, আজ্ঞা। কিন্তুক ছাওয়ালদের কৌশলে জড়ায়ে পড়লাম।
রামচন্দ্র বিস্মিত হলো, সান্যালমশাইও আশ্চর্য হয়ে পাশের দিকে চাইলেন। রূপনারায়ণ কখন এসে দাঁড়িয়েছে এরা কেউ লক্ষ্য করেনি, শুধু রূপু নয়, রূপুর পাশে সুমিতি।
রূপু বললে, তুমি কিছু অন্যায় করোনি রামচন্দ্র, লোকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যারা তাদের আরো বিপদে জড়াতে চায় তারা সভ্য সমাজে বাস করার উপযুক্ত নয়। তুমি কিছুমাত্র অন্যায় করোনি, এটাই বুঝবার চেষ্টা করো।
রূপু থেমে গেলো। বোধ হয় আর কথা খুঁজে পেলো না। সে আর দাঁড়ালো না। একটা মৃদু সুঘ্রাণ ও সুমিতির অলংকারের মৃদু শিঞ্জন রইলো।
রামচন্দ্রকে যা বলবেন ভেবেছিলেন সেটা ঠিক হবে না রূপুর কথার পরে, রূপুকে যেন তাতে হীনমান করা হবে–এই মনে হলো সান্যালমশাইয়ের। তিনি বললেন, আচ্ছা রামচন্দ্র, তুমি যাও, খবর নিচ্ছি।
দ্বিপ্রহরের নিদ্রার পরে সান্যালমশাইয়ের মনে পড়লো এই কথাগুলি। রামচন্দ্র কথা বলার সময়ে ছিরিখণ্ড কথাটা বলেছিলো। কথাটা শ্রীখণ্ড, এখন ভাষার বিবর্তনে চিকন্দি, জমিদারির কাগজপত্রে চিকনডিহি। আশপাশের আর দশখানি গ্রামের সঙ্গে চিকন্দির কী পার্থক্য আছে এটা এখন খুঁজে খুঁজে বার করতে হয়। রায়দের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের উপরে যে-জঙ্গল সেদিকে অতিপ্রয়োজনেও কেউ যায় না; আর আছে সান্যালদের এই বাড়ি; কিন্তু এ বাড়ির ঐতিহাসিকতা বড়ো জোর দেড়শ বছরের এবং সে-ইতিহাসের সঙ্গে কোনো গড়েরই কোনো সম্বন্ধ নেই।
তবু কারো কারো মনে চিকন্দি এখনো গড় শ্রীখণ্ড। রামচন্দ্র যেন সেটাই এইমাত্র প্রমাণ করে গেলো।
আর লক্ষ্য করো কী কৌতুকের বিষয় এটা হতে পারে। রামচন্দ্র তাকেও যেন অতীতে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে। এরকম লোকের সাক্ষাৎ মাঝে-মাঝে পাওয়া যায় যারা বর্তমান পৃথিবীতে বাস করে কিন্তু অতীতের অদৃশ্য এক আবরণও যেন থাকে তাদের। কথাটা চিন্তা করতে গিয়ে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। সদানন্দ বলেছিলো তাদের কলেজের এক অধ্যাপক সারাজীবন ছেহলেদের ক্রিকেট খেলতে অনুপ্রাণিত করে পেন্সান নিয়ে কাশীতে যান। সহসা একদিন তিনি পেন্সান নেওয়া বন্ধ করে দিলেন, কাশীতে এখন তিনি দণ্ডী সন্ন্যাসী হয়ে আছেন। ভিক্ষালব্ধ খুদই তার আহার্য। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নৈমিষারণ্যের আবহাওয়া সর্বাঙ্গে এমন দৃঢ়তার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন যে ব্যাপারটাকে লঘু করে ভাবতেও সংকোচ হয়। এমনি অতীতপয়াসী মন রামচন্দ্রর, এবং তার প্রয়াসেও যেন একটুকু ছলনা নেই।
সে যাই হোক, মূল ব্যাপারটার সঙ্গে ছেলেমানুষির যোগ আছে, এবং সেটা রামচন্দ্রও বলে গেছে। চৈতন্য সাহাকে বিষয়টির এদিকটাতেই নজর দিতে বলবেন, এবং ছেলেমানুষি ব্যাপারটাকে মামলা-মোকদ্দমার পর্যায়ে নেবার চেষ্টা করার জন্য রামচন্দ্র চৈতন্য উভয়কেই তিরস্কার করবেন, এই স্থির করলেন তিনি।
এমন সময়ে নায়েব এলো।
কী সমাচার? প্রফুল্লমুখে আলাপের সূত্রপাত করলেন সান্যালমশাই।
আজ্ঞে, আপনাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। চৈতন্য সাহার খাজনার হিসাব নিচ্ছি।
তার খাজনা কি খুব বেশি বাকি? তেমন তো মনে হয় না।
আজ্ঞে না, সে নাকি এ অঞ্চলের বহু প্রজার জমি খাইখালাসি বন্দোবস্ত নিয়েছে, যার খবর আমরা পাইনি। খবর নিতে হচ্ছে সেটা গত অষ্টমের আগেও বহাল ছিলো কিনা।
এমন গর-ঠিকানা ব্যাপার তো তোমার কাছারিতে হয় না।
ঠিক তা তো নয়। দুর্ভিক্ষের জন্য নিজ গ্রামের প্রজাদের খাজনা আদায়ে একটু ঢিলে দেওয়া হয়েছিলো। এখন যেন মনে হচ্ছে চৈতন্য ঠকিয়েছে। সে যদি খাইখালাসি বন্দোবস্ত করে থাকে তবে খাজনাটাও তারই দিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। ছোটোবাবু এই কথাই বলেছেন। সে তো দুর্ভিক্ষের ফৌত প্রজা নয়।
ছোটোবাবু আজকাল দপ্তরে আসছেন নাকি?
নায়েব পুলকিত হয়ে বললো, কোনোদিনই আসেন না। আজ দুপুরে প্রথম এসেই দপ্তরের এই গাফিলতি ধরে ফেলেছেন।
রূপনারায়ণ কাছাকাছি ছিলো। হুকুমটা এই প্রথম দিয়েছে সে। সান্যালমশাই ডাকলেন, এসো ছোটোবাবু, এসো। নায়েবমশাইয়ের সঙ্গে তোমার কথাই হচ্ছিলো।
নায়েবমশাইকে আমি একটা কাজের কথা বলেছি, শুনেছেন?
শুনলাম, কিন্তু হঠাৎ এমন কড়া হলে কেন?
দুষ্ট প্রজাকে শাসন করা দরকার।
সান্যালমশাই কপট গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, তা ভালো, হঠাৎ কিনা।
হঠাই হলো। রামচন্দ্র চলে যাওয়ার পরে গ্রামের পথে ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে শুনলাম সব। চৈতন্য সাহাকে শাসন করা দরকার। সে যে ব্যবস্থা করেছে তাতে খাইখালাসি বলুন কিংবা বন্ধকী বলুন, চাষীরা কোনোদিনই আর তাদের জমি ফিরে পাবে না।
সান্যালমশাইয়ের হতে গড়গড়ার নলটা দুলতে লাগলো। রূপু বললো, এর আর-একটা দিক আছে। বেশির ভাগ চাষী চৈতন্য সাহার কাছে বন্ধক দেওয়া জমিতে চাষ দিতে অনিচ্ছুক। চৈতন্য সাহার এমন ক্ষমতা নেই নিজে সে জমি চাষ করে, তার ফলে সারা গ্রামের আধখানা খেতে ফসল উঠবে না। আহার্য দুর্মূল্য হবে, চাষী সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বউদি বলছিলেন।
কিন্তু তাহলেও চৈতন্য সাহাকে খাজনার তাগিদ দিয়ে কী হবে?
ফলটা ঠিক কী হতে পারে তা ভেবে দেখেনি রূপনারায়ণ, ফ্রেজার সাহেবের কাহিনী শুনে তার স্থলভূত চৈতন্য সাহাকে তাগিদ দেওয়ার কথা মনে হয়েছিলো। সে কথাটাই বললো সে।
ফ্রেজারকে একবার তাগিদ দেওয়া হয়েছিলো, মাস্টারমশাই বলছিলেন কয়েকদিন আগে।
কাকে, ফ্রেজারকে? তার কথা তুমি কী জানো?
সান্যালমশাই বিস্মিত হলেন, যত না ফ্রেজারের নাম শুনে তার চাইতে বেশি ফ্রেজারের সঙ্গে চৈতন্য সাহার তুলনায়। ছেলের মনে বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে; শুধু বইয়ের পাতায় লেখা ঘটনা নয়, শুধুমাত্র আলাপ-আলোচনার ব্যাপার নয়, ব্যক্তিগত জীবনে সেই বিদ্বেষ দৃঢ়মূল হবে এমন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে যার মূলে থাকে বিদ্বেষ। তেমনি একটি ঘটনা ফ্রেজার নীলকরের। রামচন্দ্রও বলেছিলো বটে। কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে নীলকর ফ্রেজার সান্যালদের প্রজাদের অনেক জমি দখল করেছিলো, তারপর লাগে ছোটোখাটো বিবাদ। ফ্রেজারকে অবশেষে একদিন তার বাংলোয় মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো, তখনো নাকি তার হাতে বন্দুক ধরা ছিলো। কিন্তু এই বিদ্বেষ প্রকাশের বয়স নয় রূপুর। অন্তত ছেলে মানুষ করার যে বিশিষ্ট পরিকল্পনা তার আছে, তার সঙ্গে রূপুর এই বিদ্বেষপরায়ণতা মেলে। না। কথাটা সদানন্দকেও বলা দরকার। তিনি ঠিক করলেন, বলবেন : লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে এমন সব কাজে যেন হাত না-দেয় রূপু।
কিন্তু আর-একটি দিকও আছে। রূপুর এই ব্যাপারটায় খুশি হওয়ার মতো কিছু কিছু যেন পেলেন তিনি। এই তো সেদিনও রূপু সবগুলো যুক্তবর্ণের পরিচ্ছন্ন উচ্চারণ করতে পারতো না। তার আজকের কথাগুলো শুধু পরিচ্ছন্নভাবে উচ্চারিত হয়েছে তা নয়, চিন্তা করে ধীরে ধীরে বিশিষ্ট একটা অর্থ প্রকাশ করার জন্য বলেছে সে কথাগুলি। তার গলার স্বরে তার মায়ের কণ্ঠের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এখনো তত নিটোল এবং পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি, একটু যেন খনখন করে ওঠে, কিন্তু স্বরটি যে মায়ের তা বোঝা যাচ্ছে। এ ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে আজই অনুভব করলেন সান্যালমশাই এবং উপভোগও করলেন। গভীরতার দিক দিয়ে এ উপলব্ধিটা যেন দৈনন্দিন লিপিকায় আন্ডারলাইন করা কিছু।
সন্ধ্যার পর অনসূয়া বললেন, শরীর বা মনের কিছু একটা তোমার খারাপ হয়েছে।
অশান্তি বোধ করছি। গ্রামের চাষীদের মধ্যে অসন্তোষ, সেটাকে তোমার ছেলে টেনে আনছে। বাড়িতে। ছোটোছেলে রূপুও।
সান্যালমশাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে অনসূয়া বিব্রত বোধ করলেন। নিজেকেই অশান্তির মূলস্বরূপ বলে মনে হলো। সান্যালমশাই বড়োছেলের দেওয়া আঘাতটা সহ্য করেছেন বলেই আরো বেশি তাকে সহ্য করতে বলা যায় না।
সমস্যার সমাধান হিসাবে অনসূয়ার মনে হলো রূপুকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও যাওয়া যায়, কিন্তু তিনি তার কোনো কাজকেই সমস্যার সমাধান হিসাবে চিহ্নিত করতে কুণ্ঠা বোধ করলেন। রূপুকে যদি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাইরে রাখতে হয়, তাহলে তাকে বুঝতে দেওয়া চলবে না সে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে বলেই তাকে অন্যত্র যেতে হলো। এই কুণ্ঠা থেকে তিনি সমাধানটা চিন্তা করে রাখলেন কিন্তু স্বামীর সম্মুখেও প্রকাশ করলেন না। বরং বললেন, রূপুকে বোলো ব্যাপারটা তুমিই হাতে নিয়েছে, তাহলে ও নিশ্চয়ই নিরস্ত হবে।
কিন্তু সান্যালমশাইয়ের চোখের প্রান্তে-প্রান্তে ত্বক কুঞ্চিত হলোকঠিনতম ব্যাপারগুলি নিয়ে আলোচনা করতে করতেও এমন হয়। তখন তার দিকে চেয়ে তার মুখের কথার অর্থ বোঝ কঠিন হয়; রহস্যের সুর লাগে কথায়, রহস্য হিসাবে গ্রহণ করাও যায় না।
সান্যালমশাই বললেন, এমনি ভাগ্য বটে আমার। ছেলের কাঁচাহাতে জমিদারির যে প্যাঁচগুলো খেলছে না, সেগুলো আমার হাতে দেখতে চাও?
অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের মুখের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন, কাজেই তার কানে এই কথাগুলি খানিকটা রহস্যের আভাস দিলো। সহসা উত্তর দিলেন না তিনি। এই অবসরে খাসভৃত্য এসে তামাক দিয়ে গেলো; একগোছা বিলেতি কাগজের সাপ্তাহিক সঞ্চয় সে সঙ্গে এনেছিলো। এগুলি সদানন্দ মাস্টারের হাত ঘুরে এসেছে। পড়ার মতো খবর ও আলোচনাগুলি সে চিহ্নিত করে দিয়েছে। তার একান্ত-সচিবত্বের এইটুকুই বর্তমানে কর্তব্য বলে নির্ণীত আছে।
ভৃত্য চলে গেলে অনসূয়া বললেন, অনেকদিন পরে একটা কথা মনে পড়ে গেলো।
একসময় ছিলো যখন অনসূয়া তাঁর এবং সান্যালের মধ্যে একটা ব্যবধান লক্ষ্য করতেন এবং কল্পনায় সেটাকে দুর্লঙঘ্য মনে হতো। সে-সব দিন এখন নেই, এই সাপ্তাহিক খবর ও আলোচনার ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই এখন পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মতো মূল্যবান নয়। সেজন্য এই সাপ্তাহিক কাগজের গোছা দেখলে অনেকসময়ে অনসূয়ার পুরনো কথা মনে পড়ে।
অনসূয়া বললেন, এককালে তোমার যবন গুরুদেব ছিলো, তখন আমারই হয়েছিল সবচাইতে বেশি বিপদ।
কালু খাঁ সরোদিয়ার কথা বলছো?
বোধ হয়, ঐরকমই নাম ছিলো।
কেন বলো তো তিনি কি আবার চিঠি দিয়েছেন? তাঁর মাসোহারাটা কি ঠিকমতো যাচ্ছে। না?
না, আমার কষ্টটাই বৃথা গেলো।
তা বটে, তা বটে। একদিন আবার দেখতে হয়।
সংগীতকলা সম্বন্ধে কিছুকাল স্মৃতি আলোচনা করে অনসূয়া সংসারের তদারক করতে বার হলেন। সান্যালমশাই কালু খাঁর কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
একটা সমস্যার চারিদিকে সমাধানের আবরণ দিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাই যদি হয় এটা অনসূয়ার, তবে তিনি খানিকটা সফল হলেন বলতে হবে।
১২. চৈতন্য সাহা বিপদ দেখতে পেলো
চৈতন্য সাহা বিপদ দেখতে পেলো। তার পথেঘাটে চলা কঠিন হয়ে উঠেছে। শুধু নিজের গ্রামেনয়, আশেপাশের দু’পাঁচখানা গ্রামেও তাকে দেখলে ছেলেরা। হো-হো করে করে হাসে, বড়োরাও সে-হাসিতে পরোক্ষে যোগ দেয়, দু’এক জায়গায় অভিযোগ করতে গিয়ে ফল উল্টো হয়েছে।
সকালে উঠে রামচন্দ্রর সঙ্গে জড়িত বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটে গেলো। তার প্রথম ইচ্ছা হয়েছিলো দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে যে-ঘরে দলিল আছে, আর দুষ্প্রাপ্য পণ্যগুলি। ভয় কমলে নিজের পাড়ার দু’একজনের সঙ্গে কথাও হয়েছিলো, তাদের একজন পুলিসকে খবর দিতে বলেছিলো। এ প্রস্তারে সহসা সে রাজী হতে পারেনি। তার বাবার সময়ে জমি-জিরাতের ব্যাপার নিয়ে এমন লাঠি ধরেছে কেউ-কেউ, তাদের দরুন পুলিসে খবর দেয়নি মহাজনপক্ষ। আছে, অস্ত্র আছে, যাকে মহাজনি চাল বলে।
চৈতন্য সাহার একজন কর্মচারীদা দিয়ে কুচনোতামাকে চিটেগুড় মিশিয়ে বিষ্ণুপুর বালাখানা লেখা একটি টিনে তুলেছিলো, তার উপর লক্ষ্য রাখতে রাখতে চৈতন্য সাহা চিন্তা করছিলো এমন সময়ে সে তহসিলদারের মুখ দেখতে পেলো। বয়স্ক কোনো তহসিলদার নয়, কাল পর্যন্ত মুঙ্লাদের দলে খেলেছে এমন এক ছোকরা। তবু সঙ্গে তার তক্মা-আঁটা পাইক দেখে সসম্ভ্রমে তাকে বসতে দিয়ে সে বললো, দ্যাখেন ভাই, সবই আমার লোকসান। খাজনা দিবো কি, এক পয়সা লাভ হয় নাই। যখন ওরা না-খায়ে মরে তখন খাবার জন্যি টাকা দিলাম, তার শোধ নিলো ভগোবান। এমন নিমকহারাম ভগোবান, জমি চষলো না ওরা।
খাইখালাসি জমি চবি এমন বাধ্যবাধকতা নাই।
তাও গত সন আগাম মজুরি নিয়ে চাষ করলিও করছিলো, এ সন জমি ছুঁলো না।
গত সনে ওরা ঠক্ছিলো।
চৈতন্য সাহা মাথা নেড়ে বললো, ইছ্-ইছ্। আমাক ঠকালো। যে-জমিতে দশ মণ আমন উঠতো, উঠলো করা। বেলা ডোবার দিকে চায়ে-চায়ে দিন কাটাইছে।
কিন্তুক, লাভ হোক, লোকসান হোক, খাজনা দেওয়ার দায় আপনার। আপনার খাইখালাসির লিস্টি আনেন, আমার জমার বই রেডি। টাকা এখন না-দেন, হিসাব হোক; বৈকালে আসে টাকা নেবোনে। আর না-হয় দলিল দেখান, চাষীরা খাজনার দায়িক কিনা দেখি।
অস্-অস্, দু’এক মাস সবুর করলি হয় না। চৈতন্য সাহার মুখের সম্মুখভাগে একটামাত্র হলুদ রঙের দাঁত অবশিষ্ট ছিলো। সেটাকে সে ঘন ঘন চুষতে লাগলো।
তহসিলদারের সম্ভবত ব্যক্তিগত কিছু অপ্রীতি ছিলো, সে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়েই বললো, লিস্টি ধরেন, লিস্টি। কত বিঘে জমি রাখছেন খাইখালাসিতে?
একশ কি পাঁচশ। সে যৎসামাইন্ন।
তাহলি বছরে আড়াই হাজার নিরিখে কম করেও পাঁচ হাজার। কী ভয়ঙ্কর, আমার চাকরিটাই যাবি। আর নজর, নজরের কী ব্যবস্থা? আমাদের তহুরির?
আজ্ঞে, খাইখালাসিতে নজর তহুরি কীসের?
সাজিমশাই, মরা জিনিসের কারবার করেন, তাজা জিনিসের মর্ম কী বুঝবেন! জমি হতেছে তরতাজা। তহুরির ব্যবস্থা না করলি আমরা শোনবো কেন? এ মরা জিনিসের কারবার না।
বার বার মরা জিনিস কি কন? আপনি কি চাষীদের মতন মনে করেন আমি হাড় চালান দেই?
তহসিলদারের হাসি পেলো। মুঙ্লার গান সেও শুনেছে, কিন্তু আদায় তহসিল করতে এসে হাসাহাসি করা যায় না। সে বললো, তা ধরেন যে, আলকাতরাও তো মরা জিনিস। আর দেরি করেন না।
একটুক চিন্তা করার সময় দেন।
সময় সময় করে আর সময় কাটায়েন না। ছোটোবাবুর কড়া হুকুম : তিনদিনের মাথায় সব খাজনা শোধ, না হলি কোট কাছারি হবি।
ছোটোরাবু? ঐটুক গ্যাদা ছাওয়াল?
তোমার আমার ছাওয়াল না, সাজিমশাই। খোদ নায়েবেক হুকুম করছে-প্রজা হয়ে দেখা করে না, কত বড়ো সে মহাজন, আমি দেখবো। অবশ্য খাজনা না দেন লোকসান নাই, লাভ আছে।
তহসিলদার চলে গেলে চৈতন্য সাহা শূন্য দেখলো পৃথিবী। তহসিলদার নতুন কিছু বলেনি ভাবা যেতো, যদি সে খাজনা আদায়ের উপরেই জোর দিতো। কিন্তু সে বলে গেছে, খাজনা না দিলেই সুবিধা, আসলে ওরা মামলা করতেই চায়।
চিন্তা করতে গিয়ে সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। তার সবটুকু রাগ গিয়ে পড়লো রামচন্দ্র, তার জামাই মুঙ্লা আর তার সঙ্গীদের উপরে। না-খাওয়ার দিনে ধান দিলাম, টাকা দিলাম, তার এই শোধ, না? অন্য দেশ থেকে কৃষক এনেছি তাদের উপরেও জুলুমবাজি। বেআইনি কাজ করে তার উপরে লাঠিবাজি। ঐ রামচন্দ্র বেটাকে পুলিসে দেবো। একটা গারদে গেলে আর সব কটা শায়েস্তা হয়।
রাগের মাথায় উঠে দাঁড়িয়ে সে কনক দারোগার থানার দিকে ছুটলো।
থানায় এজাহার দিয়ে সে গ্রামের দিকে ফিরছিলো। সকাল থেকে, এখন প্রায় সন্ধ্যা পার হলো, একই ব্যাপার নিয়ে নানা রকম ভেবেছে সে। এখন রাগটা পড়ে আসছে, থানায় এজাহার দেওয়ার পরিণতিও যে একটা মামলা তা সে বুঝতে পারছে। সাক্ষীসাবুদের প্রয়োজন। তাদের কথা ভাবতে গিয়ে মনে হলো ভালো মজবুত সাক্ষী দিতে হবে। নিজ গ্রামের লোকদের দিয়ে ভরসা নেই। গ্রামের বাইরে তার টাকা লেনদেনের ব্যাপারে যাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে, তারা হচ্ছে চরনকাশির আলেফ সেখ ও সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের ছেলে। এদের বলে রাখা দরকার। ধানের কারবারে সে বছর এরা সহায়তা করেছিলো।
কখন চরনকাশিতে এসে পড়েছে তা সে খেয়াল করেনি। একসময়ে সে দেখলে সে মাঠের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর পরই আলো হয়েছে। সেই আলোতে শুকনো খটখটে বন্ধ্যা মাঠ চারিদিকে ছড়ানো। তার মনে হলো এগুলিও তার কাছে বন্ধক রাখা জমি, নতুবা চাষের জমি কেন এমন পড়ে থাকবে। আর এরই জন্য কিনা জমিদার খাজনা চায়! লোকসান, লোকসান, কী আহাম্মুখি হয়েছে এই জমি রেখে! নিজেকে বিদ্রূপ করে সে বললো, দিগরের সব ধান ঘরে উঠবি, ধানের রাজা হবা? হবা না?
সম্মুখে কে যেন ছাতি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, সন্ধ্যার পর তার ছাতি মাথায় দেওয়ার মতো বিশিষ্ট ব্যাপারটাও লক্ষ্যে আনতে পারলো না। চৈতন্য। সে বললো, এও বুঝি, এ সবই বুঝি চৈতন্য সার খাইখালাসি?
ছাতিমাথায়, সজে রঙের আচকান জাতীয় পোশাক পরা লোকটির মুখ দেখা গেলো না; এক বুক শাদা দাড়ি দেখা গেলো,কী কন! চৈতন্য সার খাইখালাসি?
লোকটি চৈতন্য সাহার চারিপাশে একটি অদৃশ্য বৃত্ত রচনা করে ঘুরে এলো ধীরে ধীরে।
কী কলেন? এর নাম চরনকাশি। কে জাগে?–না, আলেফ সেখ। আপনে? তা বেশ গান বাঁধেছে ওরা। চিতিসা–চিত্তিসাপ, আমন ধানের বিষ।
লোকটি সুর করে গান ধরলো। যেন ঘুরে ঘুরে নাচবেও।
চৈতন্য সাহা আর দাঁড়ালো না। এই তার সাক্ষী, এই তার সম্ভাব্য সহায়! রাগ করতে গিয়ে কান্না পেলো তার। ছুটো পালানোর ভঙ্গিতে সে চরনকাশির আলেফ সেখকে ছাড়িয়ে এলো।
আলেফ সেখ গদগদ করে হেসে উঠলো।
দু দিন গুম মেরে থেকে আর এক সন্ধ্যার পর সে বেরুলো তখন সে অন্য মানুষ। রামচন্দ্রর পাড়ায় যেতে তার সাহস হলো না। নিজের বাড়ির কাছাকাছি যেসব চাষী ছিলো, তাদের দু’একজনের কাছে গেলো।
শুনছ না? তোমরাও গেলে, আমিও গেলাম। জমিদার বাকি খাজনার নালিশ করবি। জমি তো সবই খাস হবি।
কন কী?
তাই হলো। তোমরা চাষ করলা না। কত কলাম, বাবা সোনা, মজুরি নেও, জমিতে চাষ দেও। যদি বা দিলা চাষ, সে ঠুগযুগ। ফসল উঠলো উনা। কিন্তু এখন, এখন আমি খাজনা শোধবো কেন?
আমরা খাজনা দিবো আর আপনি জমি খাতে থাকবেন, এমন কাগজ করা হয় নাই।
আমি খাজনা দিবার পারি কনে? খেতের ফসল উঠবের চায় না ঘরে, রামচন্দ্র লাঠি নিয়ে ধাওয়া করে। টাকা আমার অমনি গেছে মিছামিছা আর জমিদারের খাজনা শুধি কেন। দুই সনে জমিদারের পাওনা–পাঁচ হাজার।
কথাটা কানাঘুষো চলছিলোই, এবার সত্যের রূপ নিয়ে রাষ্ট্র হলো। জমিদার লোক পাঠাচ্ছে সদরে চৈতন্যের নামে বাকি খাজনার মামলা দায়ের করতে। কিছু লোক চৈতন্য সাহার কাছে। গেলো, কিছু গেলো রামচন্দ্রর কাছে। যারা ব্যাপারটির গুরুত্ব বোঝে তারা দিশেহারা হয়ে গেলো। কিন্তু বিশেষ করে ছেলেছোকরার দল তাদের পুরনো যুক্তি আবার তুলো, চৈতন্য সা জমি খাবি? তা খাক না, কত খাবি ঐ একটা দাঁত দিয়ে। জমি খাস হয়, বরগা চায়ে চষবো।
কিন্তু রামচন্দ্র জানে খাজনা বন্দোবস্ত জমি ও বরগার জমি এক নয়। অনেকক্ষেত্রেরই পিতৃপুরুষের সঞ্চিত পরিশ্রমের ফলে খাজনায় বন্দোবস্ত হয়েছিলো, সে জমি চলে গেলে ভূমিহীন হয়ে বরগা বন্দোবস্তের জমি নেওয়া এই মাঝবয়সে শৈশবে ফিরে যাওয়া নয় শুধু, পিতৃপিতামহের পরিশ্রমকেও মূল্যহীন করে দেওয়া।
একদিন সকালে রামচন্দ্র ক্লিষ্টমুখে দাওয়ায় উবু হয়ে বসে তামাক খাচ্ছে। গত সন্ধ্যার কথাগুলি মনে অনেকটা থিতিয়ে গেলেও সমস্যার মতো হয়ে আছে। প্রভাতটা আজ তাকে স্নিগ্ধ করেনি। এখনই হয়তো লোকজন কেউ এসে পড়বে আর সঙ্গে করে আনবে তাদের সমস্যা। কাল সন্ধ্যায় কথাটা জানা গেছে, হালদারপাড়ার আরও ছ’ঘর লোক চলে যাবে। তা প্রায় পঞ্চাশটি প্রাণী হবে, ছেলে-বুড়ো ধরে। এদের সঙ্গে রামচন্দ্রর প্রত্যক্ষ জানাশোনা ছিলো না। তাহলেও গ্রামের লোক, চিকন্দিরই নোক তো বটে। ভক্ত কামার কী পথই দেখালো! রামচন্দ্র জানে হালদার অর্থাৎ জেলেরা একরকমের যাযাবর। পদ্মার মাছের সঙ্গে তাদের চলাফেরা। পদ্মা যখন চিকন্দির দিকে মাটি ফেলে ফেলে সরে যেতে লাগলো, তখন–এখন থেকে প্রায় দু পুরুষ আগে–জমিতে মন দেয় এরা। কিন্তু জাত-চাষী হয়ে উঠতে পারেনি। খেতে-খামারে এমন কিছু বাড়বাড়ন্ত হয়নি। আমসি আর ভাত খেয়ে ঝোড়ো বাদলায় দিনরাত জলে স্যাঁতসেঁতে হাতপা নিয়ে মাছ ধরে টাকা উপায় করে ঘরে ফিরে এসে দু’দিনে সে টাকা ফুরিয়ে হা অন্ন হা অন্ন করতে করতে জলের দিকে ছোটা এদের রক্তে। খেত-খামার করার সময়েও তাই করেছে। কিন্তু শত হলেও গ্রামের লোক, তাদের চলে যাবার কথায় বেদনা বোধ হয়।
কিন্তু যে লোকটি তখনই এলো তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য রামচন্দ্র প্রস্তুত ছিলো না। পরিচ্ছন্ন কাপড়জামা পরা একজন প্রৌঢ়।
আপনে রামচন্দ্র?
জে। আপনে?
আমি চরনকাশির আলেফ সেখের ভাই এরফান সেখ।
রামচন্দ্রর বুকটা ধকধক করছিলো, হয়তো-বা থানার লোক ভদ্রবেশে এসেছে। ভয়টা কেটে যেতে সে আগন্তুককে উপলক্ষ্য করে অজস্র হেসে ফেলো। কথা বলার আগে সুচারুরূপে গোঁফের কোণদুটি পাকিয়ে সে বললো, আসেন মিঞাসাহেব, এমন সৌভাগ্যি কেন্!
এরফান বললো, বড়োভাই কলে যে, যা এরফান একবার চিকন্দি, সেখানে চাষীরা নাকি জমি-জিরাত ছিটায়ে-ছড়ায়ে দিতেছে।
কে, তা দেয় কেন্?
তারা বলে চলে যাতেছে?
আপনেরাও তাই শুনেছেন?
হয়, ভাবলাম, খানটুক জমি যদি ধরা যায়।
রামচন্দ্রর মনে হলো সে বিদ্রূপ করে বলবে–জমি কি পদ্মার ভাসা কাঠ, ধরলিই তোমার হলো। কিন্তু আগন্তুকের প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হয় বলে সে সংযত হলো, বললো, শুনছি ওরা কে-কে যাবি। তা খোঁজ নেন, কিন্তু সেসব জমি খাইখালাসি বাঁধা, জব্দ-সামিল।
এরফান ঘনিষ্ঠ হওয়ার ভঙ্গিতে হেসে বললে, খাইখালাসি ছাড়াও তো কিছু কিছু আছে, তাইলে আর আপনার কাছে আসছি কেন?
ইঙ্গিতটা ধরি-ধরি করেও ধরতে পারলো না রামচন্দ্র, কিন্তু কথাটি যে ইঙ্গিত-প্রাণ তা বুঝতে পেরে মণ্ডলী কায়দায় বললে, আচ্ছা সেরকম যদি খোঁজ পাই কব আপনেক।
এরফান সেখ কুমোরপাড়ার দিকে চলে গেলো। তখন ইঙ্গিতটার অর্থ ধরা দিলো রামচন্দ্রর কাছে। সে স্বগতোক্তি করলো, কেন রে, আমার জমি বুঝি ধরতে আসছিলো? একটা অপমান বোধ হলো তার।
কোনো কোনো দিন মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব বেদনা নিয়ে আসে। সারাদিন ধরে রামচন্দ্র যে ক্লেশটা অনুভব করলো সেটা কোনোভাবেই নির্দিষ্ট করা গেলো না।
দুপুরের ঠিক পরেই হালদারপাড়ার লোকরা চিরকালের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে গেলোমলিন শীর্ণ কতকগুলি নরনারী শিশু। তাদের যাবতীয় পার্থিব সম্পদ ছোটো ছোটো মলিন কথা ও কাপড়ের পুঁটুলিতে বাঁধা। তাদের যাওয়ার পথ রামচন্দ্রর বাড়ির পাশ দিয়ে। একটা কান্নার মতো শব্দ হচ্ছিলো। খবর পেয়ে রামচন্দ্র দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যারা চলে যাচ্ছিলো তারা সকলেই মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নিলো, যেন সম্মুখের পথ অত্যন্ত পিচ্ছিল।
রামচন্দ্র ছটফট করে ঘর বার করতে লাগলো। কারণে-অকারণে অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্যগুলিতে তার চোখ গিয়ে পড়লো। আকাশের সর্বদাই পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু তার বাড়ির সম্মুখে গাছগুলির মাথা দিয়ে ঘেরা আকাশটুকুকে সীমা-সরহদ্দযুক্ত জমির মতোই আপনার বলে বোধ হতে লাগলো।
সন্ধ্যায় আর একজন লোক এলো তার কাছে। এ লোকটি তার পরিচিত। সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের ছেলে ছমির মুন্সি। লোকটির সঙ্গে রামচন্দ্রর আবাল্য একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব আছে–পাঠশালা থেকে চাষীজীবন পর্যন্ত। দিনকাল যখন এ দেশের ভালো ছিলো, রামচন্দ্র তাই সানিকদিয়ারের কোল ঘেঁষে জমি নেবার চেষ্টা করতে আর ছমির চেষ্টা করতে চিকন্দি অনুপ্রবেশের। এ ব্যাপারটা নিজেদের অজ্ঞাতেই হতো মাঝে মাঝে।
ছমির হাঁক দিয়ে বললো, কে, রামচন্দ্র আছে?
কে, ছমিরভাই না?
হয়। বারাও দেখি।
কী মনে করে?
রামচন্দ্র বারান্দায় এসে ছমিরকে বসতে দিলো।
ছমির রামচন্দ্রর দেওয়া তামাকের কলকেটি নিঃশেষ করে বললো, ওপারে কবে যাবা?
যাবো একদিন, সেদিন খবর পাবা; হরিধ্বনি দিবে।
আরে, সে পার না; মিলে কবে যাবা?
মিলে? তুমি বুঝি জমির খোঁজে আসছো?
তা দেখ, তোমাক কওয়া থাকলে ভাই, যে যা-ই দিক, তার উপর বিঘায় পাঁচ টাকা দাম ধাই থাকলো আমার। তোমার জমিগুলে সোনা। আর কেউ না জানুক আমি জানি।
জমির প্রশংসায় রামচন্দ্রর মন নরম হলো। ছমিরের জমি কেনার কথায় যে জ্বালা শুরু হয়েছিলো তার কিছুটা প্রশমিত হলো।
রামচন্দ্র বললো, তামুক দি?
ছমির চলে গেলে জমির প্রশংসাসূচক কথা কয়টি খানিকটা সময় রামচন্দ্রর মন জুড়ে রইলো। অনেকদিন জমির দিকে এমন অনুভবটা হয়নি, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুর্দম্য ক্ষোভ এলো তার মনে। মুঙ্লা পাটের সুতলি পাকাচ্ছিলো, তাকে লক্ষ্য করে রামচন্দ্র বললো, কেন্ রে, এ কি ভাগাড়, শকুন উড়ে?
কথাটা বুঝতে না পেরে মুঙ্লা মুখ তুলো, ততক্ষণ রামচন্দ্র সরে গেছে।
রাত্রিতে রামচন্দ্রর স্ত্রী বললো, কথা কই তোমাক।
কও।
তুমি কি যাবাই?
কী করি কও, বুঝি না। থাকে কী করি, যায়ে কী করি?
বৈষ্ণবী আসছিলো কাল, কয় যে তুমি চলে গেলে কার ভরসায় গাঁয়ে থাকবো।
হুম।
আর কয়, সেখানে মিয়েছেলের লজ্জা-হায়া থাকে না। পচ্ছিমাদের তাড়ি খাওয়া আছে। সেখানে নাকি তুলসী বোনার জায়গা নি। জলে কাদায় থিকথিকে।
রাত্রিতে ঘুম হলো না রামচন্দ্রর। ওরা যখন প্রস্তাব করেছিলো তখন সে বলিষ্ঠভাবে কিছু বলতে পারেনি–নিজের এই দুর্বলতাকে এখন অতলস্পর্শী বলে মনে হলো তার, আর এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবার জন্যে তার মন অধজাগ্রত অবস্থায় আঁকুপাঁকু করতে লাগলো।
এরফান সেখ এবং ছমির মুন্সির কথা মনে হলো। জমি, জমি। বুকের হাড় ভেঙে নিতে চায় ওরা। হায় ভগোমান, হায় ভগোমান! এখন হয়েছে কি, চাষবাস রামচন্দ্রর কাছে শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের হেতুমাত্র নয়। জীবনের উদ্দেশ্যও বটে। রোজ তার মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, আজ হলো।
ধান উঠেছে, নতুন গোলা একটা বাঁধা হয়েছে। তার মেয়ের আবদার রাখার জন্যে সে গোলাটাকে বেতের কারুকার্য দিয়ে সাজিয়েছে। একদিন হাট থেকে ফিরে দেখলো জামাই মুঙ্লা রং গুলে রাঙাচ্ছে গোলার গায়ের বেতের বাঁধনগুলো। হুকুমটা দিয়েছে এ বাড়ির মেয়ে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
সে কাছেই ছিলো, ছুটে এসে বলেছিলো–কে বাবা, লক্ষ্মীর ঝাপির মতন হয় নাই?
–হইছে।
একদিন এই গোলার পাশে বসেই কথা হচ্ছিলো।
মেয়ে বললো–এত ধান দিয়ে কী হবি, বাবা?
–বেচবো। রামচন্দ্র বললো।
–বেচলা যেন, তারপর?
–জমি কিনবো।
–তারপর কী হবি?
–আরো ধান।
–আরো ধান? তাও যেন বেচবা, তারপর কী করবা?
–আরও জমি নিবো।
মেয়ে হেসে বললো–সব জমি নেওয়া হলি, তারপর?
এবার রামচন্দ্র ভাবলো। একটু ভেবে বললোমনে কয় চরে খানটুক জমি নিবো। মুঙ্লা দড়ি পাকাচ্ছিলো লাটাইয়ে, সে বললো হাসিহাসি মুখে–তারপর আবার ধান।রামচন্দ্র কলকেতে তামাক ভরতে ভরতে বলেছিলো–সে ধান তুমি তুলবা, বাপ। আমি তখন কাশী যাবো।
চাষের কথায় এমন দৃশ্য মনে পড়ে যায়। মেয়েটা মনের অন্ধকারে একলা কেঁদে কেঁদে বেড়ায়। যেন সেই নিঃসঙ্গতায় ভয় পেয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চাপা গলায় বাবা বাবা’ৰ্বলে ডাকে। রামচন্দ্রর মনের আধখানা সব সময়েই তাকে সঙ্গ দিতে উন্মুখ হয়ে আছে। প্রাত্যহিক দিনের চাষবাস করতে নামলে যেন তাকে অশ্রদ্ধা করা হবে।
রামচন্দ্রর দু চোখে উষ্ণ জল লবণাক্ত হয়ে উঠলো।
অহহ, কী করবো। কী করি।
পরদিন সকালে দেখা গেলো রামচন্দ্র লাঙল কাঁধে নিয়ে বার হয়েছে; একটা বলদ ও একটা বুড়ি গাইকে মুঙ্লা বাঁচিয়ে রেখেছিলো, সে-দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে সে খেতের দিকে যাচ্ছে।
কিছুদূর যাবার পর লজ্জায় যেন তার মাথাটা নুয়ে আসতে লাগলো। কী বলবে লোকে? গ্রামের সব মাঠ যখন আগাছায় ঢেকে আছে, তখন ভাঙা নড়বড়ে লাঙল নিয়ে সে বেরিয়েছে। বেহালের গোরু বলদে ভুই চাষ করতে! এত বড়ো শোকটাও কি তবে তার লাগেনি? ম্লান প্রাণে আকাশের দিকে মুখ তুলে সে অনুচ্চারিত সুতীব্র কণ্ঠে বলতে লাগলো, কী উপায় আছে কও, যাবের পারবো না যে।
কিন্তু জমির উপরে লাঙলনামিয়ে গোরু বলদকে জোয়ালে জুড়তে জুড়তে হঠাৎ তার শিরা উপশিরাগুলো বিস্ফারিত হয়ে গেলো আরো গভীর রক্তপ্রবাহের পথ করে দিতে। মুঠি দিয়ে দৃঢ়ভাবে লাঙলটা চেপে ধরা নয় শুধু, আরও কঠিন করে ভূমিকে পীড়িত করতে লাঙলের পিছন দিকের বাঁকা অংশটিতে পায়ের চাপ দিতে লাগলো রামচন্দ্র। তার মনোভাবটাকে রুদ্ধ আক্রোশের কাছাকাছি বলা যায়, কিন্তু যত না আক্রোশ তার চাইতে বেশি অভিমান। এই মাটি তার মা না হয়ে জারমুখী হয়েছে।
একটু বেলা হতেই রামচন্দ্রর পাড়ার লোকরা দেখলো, রামচন্দ্রর একটা জমির আধাআধি লতাঘাসের জঙ্গল উপড়ে গিয়ে কালো কালচে জমি বেরিয়ে পড়েছে।’হোক নাবলা, মণ্ডল চাষ দিছে–বৈশাখের বাতাসের মতো খবরটা হাল্কা হয়ে উড়তে লাগলো।
মুঙ্লা সকালেই বেরিয়েছিলো, আজকাল প্রায়ই তার সঙ্গে একটি ছোটো সমবয়সী মানুষের দল থাকে। সেই দলটি নিয়ে সে এসে দাঁড়ালো ক্ষেতের ধারে। দৃশ্যটার বিস্ময় কাটলে মুঙ্লা বললো, শুনছনা বাবা, চৈতন সা পুলিসে খবর দিছিলো, পুলিস আসেনা। জমিদার সদরে লোক পাঠাইছে নালিশের জন্যি। জমি খাস, ট্যাকা জব্দ।
তারপর?
কয় চৈতন সা–বাপ-সকল এই এক বছর তোমরা খাইখালাসিগুলা নিজের জমি মনে করে চষে দাও; এক বছরের ফসল শুধু আমি নিবো, তোমাদের সব দেনা ওয়াসিল; জমিদারের খাজনা শোধ করবো।
আমরা যে খাটবো তার দাম? হেদি। তারপর?
কলাম, লেখো নতুন দলিল। তিরিশ টাকায় তিন বছর খাইখালাসি, বিশ টাকা ওয়াসিল পাইছো লেখো। নতুন দলিলে শুধু দশ টাকার কথা থাকবি।
সে তো অমনি ফিরবি। ডানি ডানি। এক বছর পর তো জমি আপনি ফিরবি। তারপর কী হলোকও।
কলাম। ছিদামও কলে; এক সন তোমার জমিতে খাটবো-খাটবো, খাবার ধান দিবা।
কস কী? হেদি ভোর।
কলে–রাজী, রাজী। কলে বাপ-সকল, আর এক কথা–গান করবা না।
রামচন্দ্র গাঁক গাঁক করে হেসে উঠলো।
মুঙ্লা যথাসাধ্য গম্ভীর মুখে তার বিজয়কাহিনী বর্ণনা করলো, কলাম, কিন্তুক সাজিমশাই, ঢোল তোলা থাকবি ঘরে, রামশিঙা গোঁজা থাকবি বাতায়।কয় যেহবি, সব হবি। বাপ-সকল, গান থামাও। আলেফমিঞাও দাড়ি ভাসায়ে নাচেনাচে গান শুনায়।কয়, আমাক হাড় চুষে খাতে দেখেছে।
রামচন্দ্র বজ্রের মতো ফেটে পড়লো হাসিতে, যেমনভাবে আকাশ ফেটে বৈশাখী ধারাবর্ষণ শুরু হয়।
কিন্তু। দুপুরে বাড়িতে ফিরে খেতে বসেছিলো রামচন্দ্র। মুঙ্লা পাশে বসেছে। আর দুদিন পরে নীলের গাজন। মুঙ্লা সেই উৎসবের কথা বলছিলো।বর্ষশেষের এই উৎসবে দুঃখদুর্দশা শেষ করতে সে বদ্ধপরিকর। সে নিজে বুঝতে পারছে না কেন, কিন্তু অনুভব করছে চৈতন্য সাহা অতঃপর কৃষকদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলবে। সে কথাও আলোচনায় আসছিলো। সহসা ভাতের দলাটা মুখে তুলতে গিয়ে রামচন্দ্রর হাত অসাড় হয়ে গেলো। হাউহাউ করে কেঁদে উঠে পরমুহূর্তে কান্না থামানোর চেষ্টায় সে আহার্য ফেলে উঠে গেলো।
রাত্রিতে স্ত্রীকে কথায় কথায় সে বললো, অমন কান্নাকাটি করে লাভ নাই। কিন্তু আমার মনে হলো আমার মিয়ে কনে। সে খায় নাই।
১৩. সাপ্তাহিক খোঁজখবর
সাপ্তাহিক খোঁজখবর নেবার দিনে চৈতন্য সাহার এজাহারটা আবার কনকদারোগার নজরে পড়লো। এর আগে পড়ে সে ছোটো দারোগা ছলিমুল্লার সঙ্গে একমত হয়েছিলো। এজাহারটাই উল্টোপাল্টা কথায় তৈরি। যে মারবে বলে লাঠি নিয়ে যায়, সে আবার ধর্মকথা শুনিয়ে বলে–খবরদার ধান কাটবে না। আর এই মূল আসামীর সঙ্গে আর একদল যোগ রাখছে গানের সূত্রে। ছলিমুল্লা বলেছিলো, গানের বিরুদ্ধে এজাহার থানার দারোগা কী করবে? এ কি জাতীয় সংগীত? জমিদারও নাকি রামচন্দ্রর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। প্রমাণ কী? জমিদার বাকি খাজনার জন্য মামলা করবে বলেছে। জমিদারের খাজনা আদায় যে ধারার অপরাধ সে ধারা পিনালকোডে নেই। কনক হেসে কিছু মন্তব্য করে ডায়েরি রেখে দিয়েছিলো।
আজ দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে কনক চুরুট ধরালো। এজাহারে অন্তত একটি বিষয় আছে-মহাজনের বিরুদ্ধে চাষীদের সঙঘবদ্ধ প্রতিকূলতা। আপাতদৃষ্টিতে খাজনার জন্য। মহাজনের উপরে চাপ দেওয়া জমিদারের পক্ষে স্বাভাবিক, সেটির সঙ্গে চাষীদের প্রতিকূলতার কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু এক্ষেত্রে কনক যোগাযোগের সূত্রটি কল্পনা করে নিলোসান্যালমশাইয়ের সে ছেলেটি তবে গ্রামে ফিরেছে। অন্তরীণ অবস্থা থেকে ইচ্ছামতো বেরিয়ে আসা তার রীতি। এজন্য সে দুবার জেলও খেটেছে।
দশ মিনিটের মধ্যে কনক ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো চিকন্দির দিকে। চিকন্দির গাছগাছড়া ঢাকা পথে তখনো রোদ কড়া হয়ে ওঠেনি, কিন্তু এতখানি পথ জোরে ছুটে এসেদুপুরের রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত একজন দারোগার মতো দেখাচ্ছে তাকে। এরকম চেহারা নিয়ে সান্যালবাড়ি যাওয়া চলে না। ঘোড়া থামিয়ে কনক তার প্রকাণ্ড রুমালখানি বার করে ঘাম মুছলো, সিগারেট ধরালো, খানিকটা সময় স্থির হয়ে রইলো; তার ও তার ঘোড়ার নিশ্বাসে সমতা এলে আবার সে চলতে আরম্ভ করলো।
আর খানিকটা যাবার পর কনক, দেখতে পেলো, একজন স্ত্রীলোক ও একটি পুরুষ আসছে। স্ত্রীলোকটির পরনের শাড়িটি দামী নয়, কিন্তু পরিচ্ছন্ন এবং উজ্জ্বল রঙের। উভয়ে পরস্পরের কোমরে হাত রেখে চলেছে। এ বয়সে এরকম চলা প্রথম প্রণয়ী সাঁওতালদের পক্ষে হয়তো সম্ভব। এই ভাবলো কনক এবং জিজ্ঞাসা করলো, দ্যাখো, তোমরা এই গ্রামে থাকো?
হ্যাঁ। পুরুষটির চাইতে স্ত্রীলোকটি সপ্রতিভ; সে-ই এগিয়ে দাঁড়ালো।
তোমরা বলতে পারো, এ গ্রামের লোকদের সঙ্গে চৈতন্য সাহার বিবাদ লাগলো কেন?
বিবাদ লাগেনি, লাগলে ভালো ছিলো। স্ত্রীলোকটি বললো।
তুমি তো এ দেশের লোক নও বাপু, তোমার কথাগুলো তার প্রমাণ।
গোলমাল একটু আছে আমার কথায়।
তুমি বলতে পারো, রামচন্দ্র কেন চৈতন্য সাহাকে মারলো?
কখন মারলো? এই শুনলাম সব মিটে গেছে। কখন মারলো রে মুঙ্লা?
তা তো জানিনে। মুঙ্লা বললো।
যখন দরকার তখন পলায়ে থাকলো, আর এখন মারলো?
তোমার যেন খুব ভালো লাগলো সংবাদটা,কনক বললো, রামচন্দ্র চৈতন্য সাহাকে মারপিট করলে তুমি খুশি হও, কেমন?
এখন আর তার দরকার নেই। নীলের গাজন গেছে, আউসের চাষ হয় নাই; বৈশাখ যায়, কছু একটা করতে হবে। এখন তো সকলকেই খাটতে হবে। পদ্ম হাসলো।
তাহলে মারপিট হলে তুমি খুশি হতে?
শুধু আমি কে, ভগোমানও হতো।
কনক স্থির করলো এ গ্রামে যদি কোনদিন কোনো গোলমাল হয়, এই মেয়েটিকে আগে খুঁজে বার করতে হবে। কনক ঘোড়া ছেড়ে দিলো, কিন্তু আবার তাকে থামতে হলো। শহরের
কানো মেয়ে নয় তো, পুলিসের চোখের আড়ালে বেড়াচ্ছে।
অ্যাই, শোন!
আজ্ঞে।
পদ্ম কাছে এলে কনক এবার পুলিসি দৃষ্টিতে তার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো। শহরের পলাতক যে কয়টি মেয়ের ছবি তার কাগজপত্রে আছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মনে মনে তুলনা করলো। বৈষ্ণবী ঈষৎ সংকুচিত হয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আচ্ছা যাও। কনক চিন্তা করতে করতে লাগাম আলগা করে দিলো।
কনক চলে গেলে মুঙ্লা বললো, শ্বশুরকে ধরতে আইছে, কেন পদ্মমণি?
পদ্ম বললো, তুই বাড়ি যা।
কী করবো?
সাহস দেবা, আমি একটু সান্যালবাড়ি যাবো। ছোটোবাবুকে খুঁজে বার করবো।
নোদিন সে বাড়ি গিছ? সারাদিন ধরে খুঁজলিও তাক খুঁজে পাবা না। আর পালেও কী কবা?
তোক যা কলাম, কর।
মুঙ্লা চলে গেলো। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো সেটা সান্যালদের বাগিচার সীমা। সেখান থেকে ঘোড়ার পথে সদর দরজায় যেতে অন্তত দশ-বারো মিনিট, কিন্তু বাগিচার আড়াআড়ি আম গাছগুলোর তলা দিয়ে ছুটতে পারলে খিড়কির পুকুরের জঙ্গলকে অগ্রাহ্য করতে পারলে পাঁচ-সাত মিনিটে অন্দরে পৌঁছানো যাবে। নিচু হয়ে কাঁটাতারের বেড়া গলে পদ্ম সান্যালবাড়ির দিকে ছুটলো।
কনক সান্যালদের কাছারি-ঘরে ঢুকে দেখলো, দশ বারোজন চাষী বসেছে মেঝেতে গোল হয়ে। একজন জরাজীর্ণ প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। ফরাশের উপরে বৃদ্ধ নায়েব, তার চারিপাশে গুটিকয়েক আমলা। তারা খাতাপত্র, কাগজ কলম নিয়ে ব্যস্ত।
নমস্কার, নায়েবমশাই।
নমস্কার। আসুন, বসুন।
পঞ্চায়েত নাকি? কনক হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো।
তা একরকম। চৈতন্য কৃষকদের সঙ্গে একটা আপোষ করে ফেলছে। ইনি চৈতন্য সাহা, চেনেন বোধ হয়?
ইনি-ই?
কনকের পুলিসি দৃষ্টি ও নায়েবমশাইয়ের পদোপযুক্ত হাসির সম্মুখে চৈতন্য সাহা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
এখানে রামচন্দ্রও আছে নাকি? কনক জিজ্ঞাসা করলো।
কৃষকদের মধ্যে স্থূলকায় একজন নড়েচড়ে বসে গোঁফে হাত দিলো।
বেশ। কিন্তু, ব্যাপার কী? রামচন্দ্র চৈতন্য সাহাকে হত্যার চেষ্টা করলো কেন?
রামচন্দ্র ও চৈতন্য সাহার মুখের অবস্থা দেখে মনে হলো কনকমাস্টার তাদের দুজনের মাথা ঠুকে দিয়েছে লেখাপড়ায় অবহেলার জন্য।
নায়েবমশাইয়ের অনুসন্ধানী দৃষ্টি পর্যায়ক্রমে রামচন্দ্র ও চৈতন্য সাহার মুখের উপরে পড়তে লাগলো।
না, না। তা করবি কেন। রামচন্দ্র আমার বন্ধু। ছোটকালে আমরা খেলছি একসাথে। কেন রামচন্দ্র, খেলি নাই? চৈতন্য প্রাণপণ করে বললো।
কিন্তু থানায় মিথ্যা এজাহার দিলে কী হয়, তা বুঝি আপনি জানেন না? কনক চোখ পাকালো।
রামচন্দ্রভাই, তুমি গাঁয়ের সকলের হয়ে কথা কতিছ, আমার হয়ে দারোগা হুজুরেক কও। চৈত্য সাহা করুণ হলো।
কথাটার আকস্মিকতায়, সম্ভাব্য হত্যাকারীর কাছে চৈতন্য সাহার এই আয়ভিক্ষার ভঙ্গিটিতে প্রথমে কনক ও নায়েবমশাই, এবং পরে সকলে হেসে উঠলো।
পদ্ম বৈষ্ণবী কনকের আগে সান্যালবাড়িতে পৌঁছেছিলো, এবং ছোটোবাবুকে খুঁজেও বার করেছিল। খাজনার জন্য চাপ দিয়েছেন তিনি এ-গুজব শুনে বিপদের সময়ে তার কথা মনে পড়লেও, ছটোবাবুর সামনাসামনি কোনো কথা বলা তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়েছিলো। এমন সময়ে সেখানে সুমিতি এলো। সেতার ঘরের জানলা দিয়ে দারোগাকে দেখে চিনতে পেরেছিলো এবং স্থির করেছিলো, দারোগাকে তার ভদ্র ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।রূপুর হাতে কাজ ছিলো না। দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির নকল তোলার চাইতে বউদির সঙ্গে একথা সেবলে সময় কাটানো ভালো। তাই করছিলো সে। পদ্ম অনুভব করলো, ছোটোবাবুকে বলা না গেলেও এ বউটিকে বলা যায়। কিছু কিছু আলাপ হলেও তখন সব কথা আলাপ করার সময় ছিলো না। এইরকম যোগাযোগ হওয়ায় কনক যখন রামচন্দ্রর লাঠালাঠির ব্যাপার শেষ করে হাসিমুখে কিন্তু সুকৌশলে বাকি খাজনা আদায়ের জন্য জমিদার ঠিক এই সময়েই কেন চাপ দিলেন এই তথ্যটি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেনায়েবমশাইকে জেরা করে, একজন ভৃত্য এসে বললো, আপনাকে বাবুমশাইরা ডাকতেছেন।
নায়েব বললো, যান, পরে আলাপ হবে; অবশ্য আলাপ করার আগে আপনাকে বলে রাখা যায় বাকি খাজনা আদায়ের পূর্ণ অধিকার জমিদারের আছে। ১৮২০র কাগজপত্র আছে আমাদের।
কনক ভৃত্যটির পিছনে কিছুদূর চলে কাছারির একটি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।দরজায় দামী পর্দা দুলছে। কাছারির ঘরে ঢুকতে গিয়ে যে কলগুঞ্জনের শব্দ কানে এসেছিলো, এদিকে তেমন নেই। কী একটা অজ্ঞাত ফুলের গন্ধ আসছে যেন। সদরের পুলিস-অফিসের গুঞ্জনের পাশে অথচ একেবারে নিস্তব্ধ পুলিস-সাহেবের খাস কামরার কথা মনে হলো কনকের।
ঘরে ঢুকে কনক দেখলো, একটা গোলটেবিলের পাশে তিনজন বসে আছে, একজন প্রৌঢ়, একজন মহিলা এবং একটি কিশোর। কনক সান্যালমশাইকে চেনে, প্রৌঢ়টি সান্যালমশাই নন। কিশোরটিকে চেনা চেনা মনে হলো মুখের আদরায়, কিন্তু আসলে সেও অপরিচিত। মহিলাটির দিকে চোরা চোখে চেয়ে কনক চিনতে পারলো, দিঘার স্টেশনে এঁকে সে দেখেছিলো।
মহিলাটি সুমিতি। সে বলল, আমাদের একটু দরকার আছে, কিন্তু তার চাইতেও বড়ো দরকার আপনাকে ধন্যবাদ জানান। সেদিন আপনি সাহায্য না করলে এতটা পথ আমাকে পায়ে হেঁটে আসতে হতো।
না, না। সে আর কী।
প্রৌঢ়টি সদানন্দ। সে বললো, অনেক সেটা, আপনি যা করেছিলেন, ইংরেজরা যদি অধিকাংশ পুলিস কর্মচারীকে তেমনটি করার সাহস দিতো, তাদের রাজত্ব তাহলে এত শীঘ্র টলটলায়মান হতো না।
তা নয়, সে কিছু নয়। কনক বললো, এখনই টলটলায়মান বলাটা কষ্টকল্পনা।
অতি অবশ্য। কারণ রাজত্ব তো আর চোখের জল নয়। তবে ভাষায় ওটা চলে যাচ্ছে।
আমি সে অর্থে বলিনি।
তা-ও বুঝি, তা-ও বুঝি।
সুমিতি বললো, মাস্টারমশাই, আপনার আর যে কত ছাত্র চাই তা বুঝে উঠতে পারছি না।
সুমিতির কথায় কনকের কানের পাশ লাল হয়ে উঠলো। কিন্তু সুমিতির ঝরঝরে হাসির মধ্যে রাগ করাও কঠিন।
সুমিতি তখন-তখনই বললো, আপনার সঙ্গে একটি মেয়ে কথা বলতে চায়।
আমার সঙ্গে?
তাকে ডাকি?
ডাকুন।
ভিতরদিকের পর্দার কাছে গিয়ে সুমিতি ডাকলো, পদ্ম, এদিকে এসো।
বৈষ্ণবী ঘরে ঢুকে মুখ নিচু করে দাঁড়ালো।
কী বলবে, বলল।
পদ্মমণি বৈষ্ণবী বললো, আপনি রামচন্দ্রকে কয়েদ করতে চান, তা ভালো নয়।
ভালো নয় কেন, বলো তো।
অন্যায় সে করে নাই, চৈতন্য সার পিছনে লাগছিলাম আমরা। গান বাঁধার জন্যে আমি ছিদাম-মুঙ্লাকে খোঁচাতাম। গান বাঁধে দিছি আমি। তারপর ওরাও বাঁধছে।
গান বাঁধা অন্যায় নয়।
তাছাড়া আমরা আর কিছু করি নাই।
রামচন্দ্র চৈতন্য সাকে মারতে গিয়েছিলো।
চৈতন্য সা রামচন্দ্রর দুশো হাতের মধ্যেও ছিলো না।
‘কিন্তু, রামচন্দ্র তোমার কে, সেটা আমার জানা দরকার; এবং তার উপরেই নির্ভর করছে রামচন্দ্র সম্বন্ধে তোমার মতামতের মূল্য।
পদ্ম মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।তার মুখে ব্রীড়ার চিহ্ন ফুটি-ফুটি করছিলো, কিন্তু চোখের জল নেমে মুখের আর সব ভাবচিহ্নকে ঢেকে দিলো। সে আমার কেউ নয়–এ কথাটা বলতে তার কেন বা আটকালো!
সান্যালবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে কনক দারোগা থানার পথ ধরলো। পদ্ম কথা বলতে-না পেরে চলে গিয়েছিলো, তারপরে খানিকটা সময় একথা-ওকথা নিয়ে আলাপ হয়েছিলো এদের সঙ্গে কনকের। সোপকরণ চা এসেছিলো, এবং প্রাথমিক সংকোচের পর কনককে আহার্যে চামচ দিতে হয়েছিলো। সুমিতি একসময়ে হেসে বলেছিলো, দাবোগাবাবু, এর সঙ্গে যখন আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো যোগই নেই, আশা করি রামচন্দ্রকে অ্যারেস্ট করা দরকার হবে না।
না, তা নেই।
ধন্যবাদ।
কনকদারোগা মুখোশও এঁটেছিলো মুখে, সে বক্রোক্তির সাহায্যে এ ব্যাপারে সান্যালমশাইয়ের বড় ছেলের যোগাযোগের ইঙ্গিত করেছিলো। সুমিতি রিনরিন করে হেসে বলেছিলো, এব্যাপারে সান্যালদের যোগ হচ্ছে খাজনা আদায় করার চেষ্টা আদালতের মারফত। কিন্তু সে প্ল্যানও আমার এই ছোটোভাইটির, তা যদি এর দাদার বলে চালাতে চেষ্টা করেন তবে এর প্রতি অন্যায় করা হবে।
কিন্তু সদানন্দমাস্টার বলেছিলো, এটাকে বিপ্লব বললে অন্যায় বলা হয় না। চাষীদের শক্তি আছে কিন্তু সব সময়ে চোখে পড়ে না। এটা সমস্যা বটে। আপনি পদ্মার তীর দিয়ে এলেন? ওকে দেখে কি মনে হয়েছে, ইচ্ছামাত্র আপনার থানা, আমাদের এই পাথরের বাড়ি, লোহার ব্রিজ–এ সবই মুছে দিতে পারে? মনে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু ও তা পারে। শুধু প্লাবন দিয়ে, নয়, অসহযোগ করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েও যেমন অনেক জনপদকে করছে। যা কোনো কোনো সময়ে করে এবং সব সময়েই পারে, প্রয়োজন হলেই করে না কেন–এটা সমস্যা বটে। অবশ্য বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে, কিন্তু এখন তা আমার মাথায় আসছে না।
থানামুখো কনকের চোখের সম্মুখে এদের ছবিই ভাসতে লাগলো। মাথাভরা টাক, লাল মুখ, পরনে গরদের আগুন জামা, সদানন্দ মাস্টার; সুখলালিত রূপ; আর সুসজ্জিতা সুমিতি। সুমিতির হাতের বলয় দুটির আনুমানিক মূল্য তার পক্ষে আন্দাজ করাও কঠিন। অথচ রূপ? এ কথা কনক চিৎকার করে বলতে পারে তার স্ত্রী শিপ্রার যা ছিলো এবং যা থাকতে পারতো, তার কিছু নেই সুমিতির। সুমিতির হীরক বলয় আছে, এই বাড়ি আছে। কথা বললো যেন অনুগ্রহ করে। যদি নিজেরা দয়া করে ডেকে না পাঠাতে কথা বলাও সম্ভব হতোনা, কারণ ওয়ারেন্ট ছিলো না। কিন্তু ওয়ারেন্ট থাক বা না-থাক অনুরূপ অবস্থায় যে কোনো দারোগা এসে শিপ্রাকে জেরা করতে পারতো।
আর কী অপচয় অর্থের এবং মানুষের শ্রমের। সদানন্দ মাস্টারের অমন মহামূল্য জামা সব সময়ে পরে থাকার কী যুক্তি? সুমিতির পরনে যে শাড়ি ছিলো সেটা তার আটপৌরে, কিন্তু শিপ্রার পোশাকী একমাত্রটির চাইতেও দামী। কে দেখছে বলল, এই গ্রামে।
আর ওই ঘরখানি। আসবাবে গালিচায় সদরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের খাসকামরাও এমন নয়। কিন্তু গালিচার ধূলা না-ই থাক, ঘরের কোণে কোণে মাকড়সার জাল ছিলো। দু বছরেও এ ঘরখানি একবার ব্যবহৃত হয় কিনা কে জানে। তবু এতগুলো টাকার কী অনর্থক ব্যবহার। এমন কত সুসজ্জিত অব্যবহৃত ঘর এ বাড়িতে আছে কে বলবে!
পথের পরিসরটা এত কম যে পাশের একটা কুঁড়ের নিচু চালা কনকের গায়ে লাগলো। পচা খড়ের কয়েকটা কুচি তার ঝকঝকে খাকির হাতায় লেগে গেলো। বাড়িটার উঠোনে একটা আট দশ বছরের উলঙ্গ মেয়ে গোবর মেখে ঘুঁটে দিচ্ছে। এদের চোখে লাগে না, কিন্তু কনকের চোখে বিবস্ত্রা বলে মনে হলো। কী অশিক্ষা, তার চাইতে কত বেশি এই দারিদ্র্য!
বড়ো রাস্তা পেয়ে কনকের ঘোড়া দুলকি চালে চলতে লাগলো।
নিশ্চয়, নিশ্চয়; এর প্রতিকার চাষীরাই করতে পারে। কেন সহ্য করবে তারা, তাদেরই হাতের তৈরি ওই রাজপ্রাসাদ। সদানন্দমাস্টারের পদ্মার উপমাটি মনে পড়লো কনকের। আভিজাত্য? ছাই ছাই!
চিন্তাগুলি একটু থিতুলে কনক ভাবলো–বাহা রে! বিপ্লবী ধরতে এসে নিজেই বিপ্লবী হলাম!
লোকের মুখে কনক অসন্তোষের কথা এর আগেও শুনেছে, তার সেই সব বন্দী বাবুরা তাকে এরকম ব্যাপারটাই বুঝিয়েছে, কিন্তু কনক সবটুকু বিশ্বাস করেনি। বন্দুকের কুঁদোর কাঠে যে ঘুণ ধরেছে এটা যেন নিজেকে দিয়েই সে অকস্মাৎ বুঝতে পারলো। সে ভাবলো, হয়তো একদিন পুলিস কনস্টেবলরা ধর্মঘট করে বসবে।
কিন্তু একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। তার মতো একজন পুলিসকর্মচারীকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এদের না এলেও চলতো।নায়েবকর্মচারী মারফত জানালেও খুব হতো। এটায় যেন এই বধূটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে।
একটা বাতাস উঠেছে। কনক ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিলো। আর বেশি বাতাস উঠলে বুধেডাঙার বেলেমাটির পথে চলতে কষ্ট হবে। সান্দারদের পাড়ায় ধুলোর ঝড় উঠবে।
কিন্তু হঠাৎ তার ঘোড়াটা থেমে গেলো, কান দুটো খাড়া করে দিলো।
চল্।
ঘোড়াটা ধীরে ধীরে চলতে লাগলো।
শুয়োর-টুয়োর নাকি! যেরকম জঙ্গল পথের ধারে, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রিভলবারটা হাতে নিলো কনক। ডানদিকের ঝোঁপটা দুলে উঠলো। প্রাণীটা ওর ভিতরেই আছে।কী সর্বনাশ, মানুষ! কিন্তু এত বড়ো সাহস কার এই গ্রামে যে পুলিসের সশস্ত্র দারোগাকে আক্রমণ করার জন্য গুঁড়ি মেরে বসে থাকবে। সান্যালমশাইয়ের ছেলে? না–তাই বা কী করে হবে। বিপ্লবীরা দারোগা খুন করে বটে, কিন্তু শুধুমাত্র খোঁজখবর নেওয়া ছাড়া সে তো বিপ্লবপন্থী সান্যাল-ছেলের কিছুই ক্ষতি করেনি। কনকের বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেলো। রিভলবার উদ্যত রেখে ঘোড়াকে ধীরে ধীরে চালিয়ে কনক অগ্রসর হলো।
মাথার উপরে হাত তুলে যে উঠে দাঁড়ালো সে চৈতন্য সাহা। ঘোড়র পায়ের শব্দে পিছন ফিরে দূর থেকে কনকদারোগাকে দেখে তার চোখের আড়ালে থাকবার জন্য সে পথের পাশের এই ঝোঁপটাকে আশ্রয় করেছিলো। কিন্তু তার এমন পরিণতি হবে বুঝতে পারেনি।
কনক হো হো করে হেসে উঠলো। থানার ডায়েরিতে লেখা গানের কথা মনে পড়লো তার।
ভাগ্ চিতিসাপ!
চৈতন্য সাহা ঝোঁপঝাড় ভেঙেচুরে, খানাখন্দ ডিঙিয়ে টপকে ছুট দিলো। কনক অমন হাসি অনেকদিন আসেনি। তার হাসির অস্বাভাবিক শব্দে ঘোড়াটা ভয় পেয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।
কিন্তু দেরি করার সময় ছিলো না। দু-একবার গাছপালা নড়ে উঠলো, কয়েকটা বড়ো বড়ো ফেঁটায় জলও পড়লো। আকাশে যুধ্যমান হাওয়াই জাহাজের মতো দ্রুতগতিতে মেঘ চলেছে। কনক ঘোড়ার গতি দ্রুততর করে দিলো। যদি ভালো করে বর্ষা নামে বুধেভাঙার কাদায় ঘোড়া অচল হয়ে পড়বে।
কনকের পিছন দিকে তখন বর্ষা নামলো চিকন্দিতে। চৈতন্য সাহা ভিজলো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রামচন্দ্ররাও। বৈশাখের এত সব বাতাস কোথায় আকাশের কোন দ–এ আটকে ছিলো, রামচন্দ্রর হাসির মতো শব্দ করে বজ্র, বাজ, ঠাটা পড়ে সে-দ–এর বাঁধে চিড় খেয়ে খেয়ে গেলো, বাতাস হু-হুঁ করে বেরিয়ে এলো। সান্যালবাড়ির কাছারির জানলা দিয়ে, লাইমশাখার গন্ধ ধুয়ে নিয়ে তাদের বসবার ঘরে জলের ছাঁট ঢুকলো।
ঝোঁপঝাড়, খানাখন্দ, উঁচুনিচু, তে-ফলন আর হাজা শুখা জমি একসঙ্গে ভিজতে লাগলো।
১৪. মাধাই অবশেষে মালবাবুকে
মাধাই অবশেষে মালবাবুকে আশ্রয় করেছিলো। মালবাবুর নাম গোবিন্দ, তার বয়স মাধাইয়ের চাইতেও কম। পৈতৃক সুবাদে রেল কোম্পানিতে চাকরি। পিতা রেল কোম্পানিতে বড়ো রকমের একটি হেডক্লার্ক ছিলেন। তারও আগে তারও পিতা এই রকমই ছিলেন।কলেজ ছাড়ার পর গোবিন্দ বলেছিলো, সেকলেজের অধ্যাপক হবে। পিতা বললেন, অহহা কী দুর্মতি। তিনি চাকরি থেকে বিদায় নেবার পর নবদ্বীপ এবং পরে বৃন্দাবনে দীক্ষা নিয়েছেন। চেহারাই নয়, ভাষা পর্যন্ত বদলে গেছে তার। আমিষ ত্যাগ করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত দুগ্ধ ও দুগ্ধজাতদের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। ঘৃত মানেই আমিষ এই প্রমাণ করে অধুনা উদ্ভিজ্জ ঘৃতের কারখানা খুলেছেন। তিনি চাকরি করে দিলেন ছেলের, এই স্টেশনটি মনঃপূত হওয়ায় এখানেই বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করলেন। রেল কোম্পানির চাকরি, গোবিন্দর পরিবারে লক্ষ্মীর ঝাঁপির টাকা, প্রয়োজনের নয় শ্রদ্ধার।
কিন্তু গোবিন্দ মালবাবু হয়ে মালবাবুর পক্ষে অনুচিত কাজকর্ম করতে শুরু করলো। এখন হয়েছে কি, রেল কোম্পানির একখানি আইনের পুঁথি আছে মাল চলাচল সম্বন্ধে। গোবিন্দ যখন খোঁজখবর নিয়ে এক সপ্তাহের চেষ্টায় সেটাকে আবিষ্কার করলো তখন কেউ জানতোনা একটি পুঁথির এমন বিরাট শক্তি থাকতে পারে। মাটিতে পাতা দুখানা লোহার উপর দিয়ে প্রকাণ্ড প্রচণ্ড স্পেশ্যালগুলি যেমন গড়িয়ে যায়, তেমনি চললো গোবিন্দর অফিস-পুঁথির লাইনে লাইনে।
সরষের তেলের ম্যানেজার এসেছিলো, আজ চাই গাড়ি।
চাইলেই কি পাওয়া যায়।
ম্যানেজার হেসে বললো, আপনি আমাকে চেনেননা, আমার নাম রামরিঝ দুকানিয়া। আমি–
বাধা দিয়ে গোবিন্দ বললো, দুটি কানই আপনার এখনো আছে, শুনতে পাচ্ছেন না এই আশ্চর্য। গাড়ি পাবেন না। যে ক’খানা আছে আজ আম চালান যাবে।
আম! ছোটোলোকেরা যা চালান দেয়?
আজ্ঞে হ্যাঁ, খেতে যা তিসি-মেশানো সরষের তেলের চাইতে ভালো।
এদিকে-ওদিকের লোকগুলি হেসে উঠলো। দুকানিয়া বাংলা বলতে পারে বটে, কিন্তু তার মারপ্যাঁচ বোঝে না। সে অপমানিত বোধ করে স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। স্টেশনমাস্টারের ঘরে ডাক পড়লো গোবিন্দর।
গোবিন্দবাবু, দুকানিয়া আমাদের বন্ধুলোক।
গোবিন্দ হো-হো করে হেসে উঠলো।
স্টেশনমাস্টার তার ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হলো, কিন্তু গোবিন্দপতার সম্বন্ধে তার একটা ধারণা ছিলো।
গোবিন্দ বললো, দুকানিয়া আমার বন্ধু নয়। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, ওর বংশগৌরবের চূড়ান্ত হচ্ছে দুই-একখানা দোকান। আপনি বুঝবেন না, কারণ আপনি নিজেই কোলম্যান। এরা সাহেব বললেও আমি জানি আপনার পিতাঠাকুর কয়লা কাটতেন কিংবা ও-বস্তুটি ফিরি করতেন।
সাহেব গর্জে উঠলেন, কী বলতে চাও, ছোকরা!তুমি আমাকে ফিরিওয়ালার ছেলে বলছো? তোমাকে আমি নরক দেবো।
সাহেব, আমার পিতাঠাকুর মৃত নন। তাছাড়া এস্টাব্লিশমেন্ট, স্টাফ ও অ্যাপিল তিনটি হেডক্লার্কই আমার পিতাঠাকুরের বন্ধু কিংবা আইনতুতো ভাই। তুমি যে বংশগৌরবে কিছুনার চাইতেও কম তার প্রমাণ এ পর্যন্ত ইলিয়টসাহেব তোমার ছোঁয়া চা স্পর্শ করেনি।
এটা কোলম্যানসাহেবের কোমল প্রাণের একটি দুর্বলতা। গোবিন্দ তার পায়ের কড়ার উপরে দাঁড়িয়েছে এমন মুখভঙ্গি করে কোলম্যান অশ্রাব্য শপথ গ্রহণ করে বললো, তোমার ইলিয়ট নরকে যাক।
তা যাবে, গোবিন্দ উঠে দাঁড়ালো, আপনি তার সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা করলেন তাও তাকে জানিয়ে দেবো।
.
দুকানিয়া অবাক হলেও তার বুদ্ধি লোপ পায়নি, সে বললো, বাবুসাহেব, আমরা কিছু ব্যবস্থা করে থাকি।
গোবিন্দ আবার হাসলো, যা শিখিয়েছে সেটা শিখতে বাঙালি দেরি করবে না। তুমি শুনলে অবাক হবে ইতিমধ্যে আমার পিতাঠাকুর সিনথেটিক ঘিয়ের কারবার খুলে দিয়েছেন, আট-দশ লাখ রুপেয়া খাটছে। আর সেই ঘি-ও যাচ্ছে স্রেফ জয়পুর আর বিকানীরে চালান। তুমি আমাকে
কী দেবে? আমার নিজের যা আছে তার ইনকাম ট্যাক্সই ওঠে না আমার মাইনেয়।
দুকানিয়া এবার হতবাক।
কিন্তু আমের ব্যবসায়ীরা করলো মুশকিল। তারা এসে বললো, বাবুসাহেব, কাল থেকে আমাদের গাড়ি লাগবে না।
কেন, আমার বাপের ঠাকুররা?
দুকানিয়া আমাদের সব আম কিনে নিচ্ছে।
উত্তম কথা।
সন্ধ্যার পর কোলম্যান সাহেব স্টেশন পরিক্রমার অজুহাতে এসে বললেন, দ্যাখো গোবিন্দ, তুমি বড়ো ছেলেমানুষ।
আদৌ নয়। লেখাপড়া তোমার চাইতে কম জানি না, আইনগতভাবেও আমি সাবালক। তুমি কি সেকেলে টেনিসন ব্রাউনিংয়ের নামও শুনেছো? তুমি বোধ হয় জানোই না, ইংরেজি সাহিত্য শুধু সেকস্টন ব্লেক নয়। সাহেব, তোমাকে আর কী বলবো, তোমাকে শুধু ইংরেজ পণ্ডিতদের। নামের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে পারি। তুমি কি ইটন কিংবা হ্যাঁরো কাকে বলে জানো? আ-মরি, অমন মুখ হলো কেন? এখন আর তোমার পক্ষে ইটনে যাওয়া সম্ভব নয়, বাড়িতেই একটু ইংরেজি গ্রামারটা উল্টেপাল্টে দেখো, ইলিয়ট সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে।
বলা বাহুল্য এই কথাগুলি বলছিলো গোবিন্দ তরতাজা ইংরেজিতে এখানে-ওখানে স্মিতহাসি বসিয়ে।
কোলম্যান সরে পড়লো, গোবিন্দ তার পিঠের উপর একরাশ উচ্চ হাসি ছুঁড়ে দিলো। মাধাই সেই ঘরের এক দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সে ইংরেজি না বুঝলেও কোলম্যানের মুখ ও গোবিন্দর হাসি দেখে বুঝতে পেরেছিলো ব্যাপারটা কোলম্যানের পক্ষে খুব সুবিধার হচ্ছে না। পরে আর এক মালবাবুর মুখে শুনে তার শ্রদ্ধা হলো গোবিন্দর উপরে।
.
একদিন গোবিন্দ নিজে থেকেই প্রশ্ন করলো, হ্যাঁ রে মাধাই, তুই অমন মুখ করে থাকিস কেন রে? তোর কি কোনো অসুখ আছে?
না। মাধাই ইতিউতি করে সরে পড়ার চেষ্টা করলো।
তাহলে তোর মনে কষ্ট আছে, আমি তোকে কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি।
মাধাই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। যে কথা শুনে জয়হরিরাও হাসি-তামাশা করে এমন শিক্ষিত লোকের সামনে কী করে সে কথা বাল যাবে।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার পর গোবিন্দ যখন তার বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, মাধাই ভয়ে ভয়ে কথাটা উত্থাপন করলো।
আচ্ছা বাবু, স্টেশনের সব লোকে খাকি পরে এক আপনি ছাড়া।
হ্যাঁ, তা পরে। খাকি আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি।
কেন, বাবু?
গোবিন্দ হাসতে হাসতে বললো, যে রঙের কদর ময়লা ধরা যায় না বলে সে রঙ ভদ্রলোকের পরা উচিত নয়।
না, বাবু। ঝকঝকে কাঁচা খাকিই তো সাহেববাবুরা পরে।
গোবিন্দ একটুকাল চুপ করে থেকে বললো, যুদ্ধটাকে আমি মানুষের কাজ বলে মনে করি না।
যুদ্ধ যদি খারাপই হবে, তবে বাবু, স্টেশনের সব লোক এমন মনমরা কে, তাদের সকলের মুখ ফ্যাকাসে দেখায় কেন্ যুদ্ধের জেল্লা কমায়।
মাধাই কথাটা বলে ফেলেই মনে মনে জিভ কাটলো। এতক্ষণে তার বিদ্যাবুদ্ধির হাঁড়ি ভেঙে গেলো। কিন্তু অবাক করলো গোবিন্দবাবু, উৎসাহ তার চোখ দুটি ঝকঝক করে উঠলো।
তুই লক্ষ্য করেছিস মাধাই, এত অনুভব করেছিস?
মাধাই মাটির দিকে চোখ রেখে রেখে কথা কুড়িয়ে কুড়িয়ে বললো, সব যেন জল জল লাগে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এ যে কেমন, এ যে বাঁচা না। যুদ্ধ থামে সব যেন আড়ায়ে গেলো।
গোবিন্দ বললো, তোর দেখায় খুব ভুল নেই; এখন বাসায় যাচ্ছি, পরে তোর সঙ্গে কথা বলবো।
একদিন গোবিন্দ মাধাইকে ডেকে স্টেশনের বাইরের আর একটি বাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। সে লোকটি স্থানীয় রেলস্কুলের হেডমাস্টার।
গোবিন্দ বললো, মাস্টারমশাই, আমার কথায় তুমি বিশ্বাস করতে পারোনি, কিন্তু মাধাইকে জিজ্ঞাসা করো, সেও দেখতে পাচ্ছে, নেশা ছুটে যাওয়া মাতালের মতো হয়েছে স্টেশনের
লোকগুলোর অবস্থা, সমস্ত দেশটাতেই এমন অনেক দেখতে পাবে।
মাস্টারমশাই বললো, মাধাই কোনটা চাচ্ছে-নেশা ছাড়া অবস্থাটা, না, আবার নেশা করে ঝুঁদ হতে?
কোনটা চাচ্ছে তা নিজেই একসময়ে ঠিক করবে, আপাতত যুদ্ধটাকেই ওর ভালো লাগছে নেশার জন্য। ও বুঝতে পারছে ঘোরটা কাটার মতো হয়েছে,নীলচে দেখাচ্ছে সবার মুখ। সময়টা অস্বস্তিকর।
সে নিজেই এতসব কথা বলতে পেরেছে নাকি কোনো সময়ে, এই ভেবে বিস্মিত হলো মাধাই। কথাগুলি তার মনের কথা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
মাধাই একটা কাজ পেলো। যুদ্ধের নেশা ছুটছে, তখন আর এক নেশা ধরিয়ে দিলো গোবিন্দ এবং মাস্টারমশাই। দেখালো, যেন সে নিজের অনুভূতির কথা প্রকাশ করে এই নতুনতর নেশার জন্যে দরখাস্ত করেছিলো। তারা হয়তো তার অনুভূতির কথা শুনে তাকে এই কাজের পক্ষে উপযুক্ত মনে করেছিলো, হয়তোবা হাতের কাছে তাকে না পেলে অন্য কোনো অসন্তুষ্ট আত্মাকে তারা খুঁজে বার করতো, কিংবা কোনো ঘুমন্ত আত্মাকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টাও করতো। আর মাধাই নিজের ঐকান্তিক আগ্রহ দিয়ে এটাকে নেশায় পরিণত করলো।
মাধাই প্রথমে নিজের সমশ্রেণীর মধ্যে কথাটা বলে বেড়াতে লাগলো, শেষে সাহস পেয়ে বাবুদের মধ্যে। সময় পাখা মেলে উড়ে যায়। এমন নেশা লাগলো মাধাইয়ের, রান্না করে খাওয়ার সময়টুকুকেও অপব্যয় বলে মনে হয়, কোনো কোনো দিন সে হোটেলেই খেয়ে নেয়। প্রথম প্রথম সে মাস্টারমশাই আর গোবিন্দর কাছে কথা বলা শিখেছিলো, একসময়ে তারও আর দরকার হলো না।
মাধাই বলে, টাকার নেশায় তোমাদের পাগল করে দিছিলো, এবার টাকা গুটায়ে নিবে, নেশাও টুটবি।
জিনিসপত্তর তো আগুন, টাকা না থাকলি তো খাওয়া-পরা বন্ধ।
তোমরা ঠিক পাও নাই, কিন্তু এদেশের বারো আনা লোক এ কয় বছর সেসব বন্ধ করে আছে। কোষ্কার কোন্ দুই রাজা করলো যুদ্ধ আর আমরা হলাম বোকা।
জয়হরি যদি বলে, তুই কী বলিস, যদি তাড়ায়ে দেয়?
দিবি? তা দিউক। রাতারাতি লোক আসেকাজ চালাবের পারবি? পারুক। সারা ভারতের সকলেই যদি কয়, থাকলো কাজ কাম। তাইলে?
তাইলে হয়, কিন্তু সকলেই কি শুনবি? মনিরুদ্দিন পোর্টার হাসতে হাসতে যোগ দেয়।
মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো দুলিয়ে মাধাই বলে, প্রথমে এই স্টেশনে কয়জন রাজী হইছিলো? এখন কয়জন হইছে?
তা হইছে।
কিছুদিন যেতে না যেতে স্টেশনের কর্মচারীরা মিলে রীতিমত সংঘ স্থাপন করলো। সদর থেকে কয়েকজন বক্তা এলো, সংঘমন্ত্রী, সভাপতি ইত্যাদি নির্বাচন হলো। গোবিন্দ বা মাস্টারমশাইয়ের নামও কেউ করলো না। শেষ সারিতে সকলের পেছনে যেখানে তারা তিনজন দাঁড়িয়ে ছিলো মাধাই সেখান থেকে অগ্রসর হতে যাচ্ছিলো, গোবিন্দ ইশারা করে তাকে নিষেধ করলো।
সেই মালবাবু চলে গেছে। বদলি নয়, চাকরি ছেড়ে দিয়ে। মাধাই আরো জানতে পেরেছে যাবার আগে কিছু নগদ টাকা তাদের সংঘকে দিয়ে গেছে গোবিন্দ, আর বলে গেছে মাস্টারমশাইকে, যদি সংঘের কাজ করতে গিয়ে মাধাই কখনো চাকরি খোয়ায়, সে যেন তার কাছে চলে যায়। ঠিকানা রেখে গেছে।
বস্তুত গোবিন্দকে মাধাই চিনতে পারেনি। স্টেশনের আর কেউ পেরেছে কিনা সে খবর মাধাই রাখে না। কিন্তু লোকটির ব্যক্তিত্ব যতই দুরধিগম্য হোক, মিথ্যা নয়। একটি রাত্রির কথা মাধাইয়ের মনে পড়ে-গোবিন্দর বাসায় নিমন্ত্রণ ছিলো মাধাই ও মাস্টারমশাইয়ের। এ সম্বন্ধে প্রথমেই মাধাইয়ের যে প্রশ্ন সেটা হচ্ছে–আচ্ছা, বলল, কী দরকার ছিলো এমন করে মাধাইয়ের সঙ্গে একত্র বসে খাওয়ার, তার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করার? সেই আহারের আসরে সংঘের কথাও উঠেছিলো।
গোবিন্দর একটা কথায় মাস্টারমশাই হেসে বললো, গোবিন্দ, তুমি কোলম্যানকে যা বলবে তারই কি মহলা দিচ্ছো? দ্বিধাহীন প্রচেষ্টা ছাড়া এমন হয় না তুমি যা করলে।
তোমাকে তো বলেছিসংঘ গঠন করা কত সহজ তাই দেখলাম।সব মানুষের প্রাণের ভিতরে সুখী হওয়ার ইচ্ছা আছে, তার সব চেষ্টায় থাকে নিজের সুখ আহরণের উদ্দেশ্য; এর আর একটা রূপ অন্যকে সুখী হতে দেখলে অসূয়া, ক্রোধ ইত্যাদি। উপর স্তরের বলো, বিদগ্ধ স্তরের বলল, তারা সুখের প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করে না। শ্রমিকরা বিদগ্ধ নয়, তাদের অসূয়া ও ক্রোধকে অতি সহজে খুঁচিয়ে তোলা যায়।
আচ্ছা গোবিন্দ, তোমাকে কি এতদিনের পরে আমাকে নতুন করে চিনতে হবে? এসব বলে তুমি কেন মাধাইয়ের মন ভেঙে দিচ্ছো?
মাধাই শ্রমিকের জাত নয়। তুমি কি লক্ষ্য করেছে, অন্য কোনো শ্রমিক তার জীবনটাকে শূন্য বোধ করছে? সেই কথা বলে বেড়াচ্ছে?
তুমি কী বলতে চাও, বলো তো? মাস্টারমশাই একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন গোবিন্দর মুখের সামনে বসিয়ে দিলো।
দ্যাখো মাস্টারমশাই, তোমার বহু অভ্যাসে অর্জিত তর্কশক্তি আমার নেই। কথাটা ঠিক গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। একটা ঘটনা শোনো। একদিন এক টেলিফোন অফিসে রাত কাটিয়েছিলাম আমি; সারারাত চিন্তাকুল হয়ে থাকলাম-ঘুমের মতো বিষয়কে বিদায় দিতে হলো কার অভিশাপে। নানা যুক্তিতর্ক এলো মনে। অবশেষে স্থির করলাম, ব্যবসাদারের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। সারারাত পাট, তোষাপাট, বেল ঝাঁঝ করতে লাগলো। তোমার কথামতো তখনো বাইরে থেকে দল গড়ার চেষ্টা করেছিলাম। পরে দেখলাম তারা কেউ রাতজাগা বন্ধ করার পক্ষে নয়, আরো রাত জাগতে চায় আরো টাকা পেলে। তা গুহায় যখন মিসেস পিল্টডাউনকে নিয়ে ঘুমুতাম, তখনো খঙ্গদাত বাঘের উৎপাতে ঘুম হত না, এখন দেখছি তেমনি আছে।
এই তোমার স্বরূপ? তোমাকে আমি চিনি গোবিন্দ।
এটা তোমার গর্ব, আমি নিজেকেই চিনি না। কখন ইউলিসিস, কখন রামচন্দ্র, কখন অশোকের কোন সেনাপতি হয়ে দাঁড়াচ্ছি এ আমি নিজেই বুঝতে পারি না। আমার মন তোমার কোনো ইকুয়েশনে ধরা পড়ে না। আমি সাবালক মানুষ। ঈশ্বরেচ্ছা কিংবা ইতিহাস আমাকে নিয়ন্ত্রিত করে না।
আহার হয়ে গিয়েছিলো। গোবিন্দ তোয়ালেতে হাত মুছে একগোছ চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার ভৃত্যটি আহার্যের পাত্রগুলি তুলে নিয়ে গেলো। তারপর সে টেবিলে নতুন কাপড় বিছিয়ে কতগুলি ঝকঝকে গ্লাস রেখে গেলো। এরকম ছোটো ছোটো অদ্ভুত চেহারার গ্লাস দিয়ে কী হয় মাধাইয়ের জানা ছিলো না।
গোবিন্দ একটা মদের বোতল নিয়ে ফিরে এলো। সেই ঠাণ্ডা মধুর মদ মাস্টারমশাই ও গোবিন্দ অবিমিশ্র চালাতে লাগলো।
মাস্টারমশাই বললো, অতঃপর তুমি কী করছে, গোবিন্দ?
চাকরি থেকে বিদায় নিচ্ছি।
যদি শুনতে পাই মানস সরোবরের পথে হাঁটতে শুরু করেছে, তাহলে বোধ হয় আমার আশ্চর্য হওয়া উচিত হবে না।
তা হয় না, গোবিন্দ হাসলো, আপাতত একটা সখ চেপেছে মাথায়। ছোটো একটা স্টিমার চাই; পিতাজীর কোম্পানি রাজী হয়েছেন। বলেছি ডাঙার কোল ঘেঁষে ঘেঁষে হংকংটা ঘুরে আসি। তাকে তার উদ্ভিজ্জ ঘিয়ের ব্যবসায়ের কথা বলেছি, খুব প্রচার করে আসবো-যুদ্ধের পর শান্তির অভিযান। অবশ্য পিতাজী এতদিনে বুঝতে পেরেছেন তার ব্যবসায়ে জেলের ভয় আর নেই, সুতরাং আমাকে ম্যানেজার করা যায়।
সঙ্গে কেউ যাচ্ছেন?
শুনতেই চাও? সুধন্যাকে মনে আছে?গোবিন্দ নির্লজ্জের মতো হাসলো।
তার কি এখনো পঞ্চাশ পার হয়নি?
ওটা তোমার বাড়িয়ে বলা। ত্রিশ পেরিয়েছে বটে। গোবিন্দ উদ্দীপ্ত হলো, তোমার মনে আছে মাস্টারমশাই, আমার কিশোর দৃষ্টির সম্মুখে সুধন্যার যৌবনধন্য রূপের পদচারণ? হাঁ করে চেয়ে থাকার জন্যে কতইনা তিরস্কৃত হয়েছি। সেই অগ্নিময়ী এখন আর সে নয়–আর সে জন্যেই মনটা কেমন করে তার জন্যে। আচ্ছা, মাস্টারমশাই, রমণীর অনন্য রূপ আর অসাধারণ কণ্ঠ কি একটিমাত্র পরিবারের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা উচিত, না তার জন্যে ট্রয়ের যুদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয়? আমার তো মনে হয় মহাকবিরা কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি হেলেনের মতো মানসকন্যা একটিমাত্র রাজার রানী হয়ে ধীরে ধীরে জরা ও মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হবে।
নারী জাতিকে অবশ্য তুমি সম্পত্তি বলে চিন্তা করছো, গোবিন্দ; তাদের মধ্যে কোহিনুর যারা তাদের জন্যে নাদিরের লোভকেই তুমি তাদের মূল্যের স্বীকৃতি বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছো?
না, ঠিক তা নয়। ওই রূপ এবং ওই রুচির মূল্য কী করে দেওয়া যায় তাই ভাবছি। একটি পুরুষ কতটুকু মূল্য দিতে পারে?
মাস্টারমশাই কথা বললো না, তার মুখখানা থমথম করছে।
উত্তর দিলে না? গোবিন্দ বললো।
তাহলে সুধন্যা যাচ্ছেন? বিয়ে করবে তো?
আদৌ না, গোবিন্দ হেসে উঠলো, আমি শুধু জানতে চাই তিনি কেমন অনুভব করলেন জীবনটাকে। দশ বছরে অধ্যাপিকার জীবনে কী কী অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তাই শুধু বুঝবার চেষ্টা করবো : ঘটনা নয়, রটনা নয়, শুধুমাত্র তাঁর মন কোথায় কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিঘাত করেছে। দীর্ঘ দিন এবং দীর্ঘ সন্ধ্যাগুলি পাশাপাশি ডেকচেয়ারে বসে এমন কিছু নাটক নভেল পড়া যায় না নিঃশব্দে। তখন কথা হবে। তোমাকে অবাক করার জন্যে বলছি না, সুধন্যাকেও এসব বলেছি।
.
গোবিন্দ চলে যাওয়ার পরে একদিন ওভারব্রিজের সিঁড়ির মুখে দেখা হলো মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে, মাধাই বাজার করা ভুলে কথা বলতে বলতে তার বাড়ি পর্যন্ত এসেছে।
ও তো তোমার মতো খেটে খাওয়ার লোক নয়, ওর কথা আলাদা। ধরো পদ্মায় ঝড় উঠেছে, নৌকো টলছে, তখন অন্য সকলে মাটির দিকে ছুটবে; আর দু’একজন হয়তো ছুটে যাবে জলের দিকে, ঝড়ের আঘাতে বড়ো বড়ো ঢেউগুলো যেখানে শাদা ফেনা হয়ে যাচ্ছে সে জায়গাটাই তাদের লক্ষ্য। এমনি এক জাত গোবিন্দর।
আচ্ছা বাবু, আমাকে তিনি খুব ভালোবাসেন, না? কিন্তু আমার কী গুণ আছে?
ভালোবাসার কারণ বলা যায় না। তুমি খুব বেশি করে বাঁচতে চাও, গভীর করে বাঁচতে চাও সেইজন্যে বোধ হয়। তোমাদের স্বভাবে খানিকটা মিল রয়েছে এই একটা জায়গায় অন্তত।
গভীর করে বাঁচা’কথাটা শিখলো মাধাই। তার মনের অব্যক্ত আবেশটি ভাষায় রূপ পেলো।
মানুষের চরিত্র কী করে সৃষ্টি হয় তা বলার চেষ্টা করাও বিড়ম্বনা। মাধাইয়ের জীবনের ঠিক এই জায়গাটায় কিছুদিন ধরে গোবিন্দর সঙ্গে তার আলাপ তার চরিত্রের আত্মপ্রকাশের সহায়তা করেছে। এ পরিচয় তার জীবনের একটি ঘটনা যার কার্যকারণ সম্বন্ধ হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এরকমটা প্রায়ই হয় : চারিদিকের চাপে চরিত্রগুলি পরিবর্তিত হচ্ছে, অস্ফুট কথাগুলি মনের গভীরে গিয়ে হয়তোবা চিন্তার ভিত্তিভূমি রচনা করছে। গোবিন্দও ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র গোবিন্দ হয়নি। বহু জীবনের ছাপ রয়েছে তার চরিত্রে, যেহেতু সে শিক্ষিত হয়তোবা বহু পুস্তকের ছাপও আছে। পরে একদিন সুধন্যার অধ্যাপিকা-জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিও তার চরিত্রকে অন্তত আংশিকভাবে পরিবর্তিত করবে। অথবা ঈশ্বর কিংবা অর্থনীতির ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব তার জীবনকে বিধৃত করে না বলে সে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে যতদূর পারে অগ্রসর হবে।
সংঘের কাজকর্মের সঙ্গে যাতে মাধাইয়ের প্রত্যক্ষ যোগ না-থাকে সে ব্যবস্থাই করে গেছে গোবিন্দ। আবার সময় কাটানো কঠিন হলো মাধাইয়ের। একথা ঠিক নয় তার যথেষ্ট সময়, চাকরি ছাড়াও নিজের আহার প্রস্তুতের কাজ রয়েছে, নিজের বেশভূষার ব্যবস্থা করতেও তার খানিকটা সময় যায়। আসলে সে অনুভব করে একটা নেশা ধরেছিলো আর একটা যখন ছাড়ছে, সে নেশাটাও ফিকে হয়ে আসছে। কোনো একটি বিষয়ে মেতে উঠতে না-পারলে যেন শান্তি নেই।
মাস্টারমশাই একদিন তার ঘরে এসে উপস্থিত। মাস্টারমশাই গোবিন্দ নয়। মাধাই আছো?
আজ্ঞে? মাধাই ধন্যর চাইতেও ধন্য হলো। একজন অত বড়ো বিদ্বান প্রধানশিক্ষক তার দরজায় দাঁড়িয়ে।
তুমি তো আজকাল সংঘটার দিকে লক্ষ্য রাখছে না, বাপু।
বাবু–মাধাই লজ্জিত হলো।
নিজের হাতে তৈরি জিনিস তোমার। তুমি একা যা করেছে ওরা পাঁচজনে মিলে তা পারছে না। তেমন বুক দিয়ে পড়ে কাজটা তুলে দিতে কারুকে দেখছিনে। এটা ভালো লাগছেনা বাপু।
আচ্ছা বাবু, আমি যাবো। যদি সংঘের বাবুরা রাগ না করেন, আমি কথাও বলবো।
কিন্তু মাস্টারমশাই চলে যেতেই মাধাই ভাবলো–দূর করো! এ আর ভালো লাগেনা। নিজের কী হলো দেখার সময় নেই, কথা বলতে বলতে গা গরম হয়ে ওঠে, গলা শুকিয়ে যায়।
স্টেশনে গিয়ে শুনলো সংঘের গোলমাল আর কিছু নয়, কলকাতা শহর থেকে কয়েকজন ভদ্রলোক এসে গোপনে গোপনে কাজ করছে, তার ফলে লোকোশেডের শ্রমিকরা একটা আলাদা সংঘ তৈরি করেছে, দলাদলি শুরু হয়েছে। তাদের কেউ পুরনো সংঘের বাবুদের দোষ দিচ্ছে, বাবুদের কেউ কেউ তাদের দোষ দিচ্ছে। মাধাইয়ের অজ্ঞাত অনেক রাজনৈতিক গালি এ-দল ও-দলকে বর্ষণ করছে। মাধাই স্টেশনের চায়ের দোকানের একটা টিনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললো, কী হিংসে, কী হিংসে!
তবু মাস্টারমশাইয়ের সম্মান রাখার জন্য সন্ধ্যার পর মাধাই জয়হরিকে সঙ্গে নিয়ে বার হলো।
কোথায় যাবা?
চলল, লোকোশেডের পাড়ায়।
স্টেশনের পশ্চিমে লোকোশেড, আর লোকোশেডের পশ্চিমে ক্লিনার-ফিটার-সান্টার প্রভৃতি কর্মচারীর বাস।
জয়হরি বললো, এমন হাই হুই করে বেড়াতি তোমার কী ভালো লাগে তা বুঝি না, মাধা।
তুমি বুঝবা কেন, স্টেশনের গাড়ি থেকে মাছ চুরি করবা, ধনে লঙ্কা সরাবা। কিন্তুক চুপ করে বসে থাকে কী লাভ? জীবন ফুরায়ে যায়।
ছুটাছুটি করলেও ফুরাবি।
জংধরা এঞ্জিন হয়ে লাভ কী?
শরাব পিয়ো, বেরাদার। জয়হরি বললো।
ওরে আমার হিন্দুস্থানী রে! মাধাই হাসলো। একটু পরে বললো, আজ লোকোশেডের লোকদের কয়ে আসতে হবি, তারা বাঁচে আছে না মরে আছে।
বাঁচে সকলেই, তোমার মতো কেউ জীয়ন্তে মরা না। সুখ আছে, আহ্লাদ আছে, মদ আছে, মিয়েমানুষ আছে। হৈ-হৈ করো, সোডাপানির মতো ছিটেফিটে ওঠো, তা না। কেবল দুঃখকষ্ট ঘোলায়ে তোলে।
আমি কি দুঃখকষ্ট ঘোলায়ে তুলি?
হয়, কষ্ট ভুলে থাকবের দেও না, চিল্লাচিল্লি করো। একদিন কেউ তোমাকে ঐজন্যি মার দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিবি।
কথাটা আর এগুলো না। লোকোশেডের খালাসিদের মধ্যে মাতব্বরস্থানীয় আবদুল গনি ফরাজি আসছিলো সেই পথ দিয়ে। সেলাম বিনিময়ের পর আবদুল গনি জিজ্ঞাসা করলো, রাত করে কনে?
আপননদের পাড়ায়।
কী কারণ?
মাধাই বললো, এই একটুক সুখ দুঃখের কথাবাত্তা।
আবদুল গনি এত বয়সেও এমন অদ্ভুত কথা শোনেনি, দোলদুর্গোৎসব, ইদ-মহরম নয় তবু লোকে চলেছে এক পাড়া থেকে আর-এক পাড়ায় সুখদুঃখের কথা বলতে। বৃদ্ধ আনন্দে অধীর হয়ে উঠলো, মাধাইয়ের হাত ধরে বললো, চলো ভাই, চলো।
নিজে সে কোন কাজের ধান্দায় কোথায় যাচ্ছিলো তা-ও ভুলে গেলো।
অল্পকিছু দূরে গিয়ে একটা চায়ের দোকানের সম্মুখে থামলো আবদুল গনি। ভিতরে যারা কোলাহল করছিলো, তাদের কয়েকজনকে আহবান করে আবদুল গনি বললো, ইউনুস, মেহের, ফটিক, দেখ দেখ কারা আসেছে। ইস্টিশনের নোক।
দোকানটায় দেশী মদও বিক্রি হয়। মুড়ি-মুড়কি থেকে চপ কাটলেট নামক একপ্রকার পদার্থ পর্যন্ত।
লম্বা ময়লা দু-চারখানি বেঞ্চ ইতস্তত ছড়ানো। কেরোসিনের লাল আলোয় ইউনুস প্রভৃতি খাওয়াদাওয়া করছিলো, আবদুল গনির ডাক শুনে দোকানের দরজার কাছে উঠে এসে এদের অভ্যর্থনা করলো।
সকলে আসন গ্রহণ করলে আবদুল গনি বললো, এমন খুশির দিন আর হয় না, একটুকু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করো, অ রজনি!
দোকানের মালিক রজনী বললো, কী ব্যবস্থা, চা, না বড়ো-চা?
স্কুলের হাইবেঞ্চের অনুরূপ একটা লম্বা টেবিলের দু’পাশে এরা মুখোমুখি বসেছিলো। রজনী দু-তিনটে দেশী মদের বোতল ও প্রয়োজন মতো মাটির খুরি রেখে গেলো। কিছু ভোজ্যও এলো।
.
জয়হরি বললো, আনন্দ দিলেন খুব।
পাতেছিও অনেক। এ পক্ষের থেকে ইউনুস বললো।
মাধাই বললো, আপনাদের কাছে আমি আসেছিলাম এসসিওসনের কথা বলতে।
বেশ, ভালো, কন।
আপনাদের মধ্যে এখনো অনেকে মেম্বর হন নাই।
তাইলে তো লজ্জার কথা। তা এদিকেও সেই কোলকেতা শহরের বাবুরা কী বলে, কী কয়। হলে আপনের কাছে মেম্বর হবো। মায়নার দিন আপনে একবার আসবেন। তা দেখেন, দোষও দেওয়া যায় না। সারাদিন খাটনির পর বাসায় আসে খাওয়া শোওয়া ছাড়া আর কিছু মনে থাকে না।
মাধাই সংঘের গুণপনা বর্ণনা করে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো, কারো মুখের দিকে চেয়েই সে উৎসাহ পেলো না।
মাধাই বুঝলো সংঘের সভ্য এরা হবে, একদলে থেকে দলে ভারি হওয়ার সুবিধা সম্বন্ধে এরা হুঁশিয়ার কিন্তু সংঘ সম্বন্ধে দীর্ঘকাল আলাপ করতে ভালো লাগবে এমন লোক এরা নয়। ততক্ষণে জয়হরি ও ইউনুস কী একটা কথা নিয়ে চাপা হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছে।
আবদুল গনি বললো, হাসতিছো কেন্ তোমরা?
না, তেমন হাসি কই! আমাদের মিস্ত্রিসাহেব ফটিকের কথা একটু কতিছি।
কী কথা ভাই, কী কথা? দুতিনজনে প্রায় সমস্বরে বললো।
ফটিক মিস্ত্রি এবং ইউনুস সান্টারের কোয়ার্টার্স পাশাপাশি। ইউনুস মাঝে মাঝে ফটিকের ঘরের কথা বাইরে টেনে আনে; হাসাহাসি হয়। ফটিক নিঃসন্তান এবং স্ত্রীর উপরে তার মমতা সাধারণের চাইতে বেশি।
ইউনুস বললো, না, তেমন কী। ফটিকের কপালে কালি লাগে আছে। তা জয়হরি কয়, কাজল কীসের।
ফটিক বললো, কী কও তোমরা, কাজল কই? এঞ্জিনের কালি।
আমু তো তাই বলি। জয়হরি কয়, পাশের বাসায় থাকি বলে দোষ ঢাকতিছি। কে দোষ ঢাকার কী আছে? বউ যদি কারুকে কাজল পরায়, দোষ কী?
ফটিক তাড়াতাড়ি কাপড়ের খোঁট তুলে কপাল ঘষতে ঘষতে বললো, আরে এঞ্জিনের কালিও চেনো না; দাঁড়াও তোমাদের দেখাই, মবিলের গন্ধও পাবা।
কপাল ঘষে লাল করে কাপড়ের খোঁটটা চোখের সম্মুখে মেলে দেখলো ফটিক, এতটুকু কালির দাগ কাপড়ে ওঠেনি। এরা কিন্তু ফটিকের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো। ফটিক ভাবলো কালিটা বোধ হয় গালে লেগে আছে। আবার কাপড়ের খোঁট তুলে সে দুটি গালই ঘষতে লাগলো। এবার সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো।
আবদুল গনি বললো, কে ভাই, তোমার মন এমন দুব্বল কেন্? ওরা ঠাট্টা করলো আর তুমি অমন করে মুখ ঘষলা!
ফটিক হাসতে হাসতে বললো, কওয়া যায় না, শালীর অমন সব আছে তুকতাক। কালি লাগায়ে দিলিও অবাক নাই। দেয় মাঝে মাঝে।
হাসি থামলে মাধাই আর একবার চেষ্টা করলো তার বক্তব্যটা উত্থাপন করতে, কিন্তু ততক্ষণে স্ত্রীদের নিয়ে কথা অত্যন্ত জমে উঠেছে।
জয়হরি পরম জ্ঞানীর মতো বললো, তা যা-ই বলল ভাই, ছেলেপুলে না-থাকলে শুধু। কাজলে সোয়ামীকে বউরা আটকাবের পারে না সবসময়।
মেহের বললো, ঠিক, ঠিক।
আবদুল গনি বললো, বিলকুল ঠিক।
মেহের বললো, চাচামিঞা, তোমার সেই কেচ্ছাটা কও।
আবদুল গনি বললো, কেচ্ছা আর কী, সামান্যই এক কথা।
না, না, কও।
আবদুল গনি বললো, তখন আমার যৈবনকাল। পনরো-ষোল বছরে বিয়েসাদি দিয়ে বাপ মনে করছিলো উড়ু উড়ু ছাওয়াল চাষবাসে মন দিবে। দুর! বলে চলে আসলাম। আট বছরের বউ, কালো কিটকিটা, জ্বরে ভোগা, ভাতের জন্যি দিনরাত কাঁদে এমন বউ। আসে এই লোকোশেডে কাম নিলাম। একটু একটু করে কাম শিখলাম। তখনকার দিনে আমি নাম সই করবের পারতাম না, তা চিঠি লেখা। আর চিঠি লেখবো কাকে? বাপ মা বউ কেউই অক্ষর চেনে না। আর বউ! বউ কয় নাকি আট বছরের সেই কালো কিটুকিটা মেয়েকে! দশ বছর বাড়ি যাই নাই, চিঠি দিই নাই। ততদিনে আমি সান্টার হইছি। মন কলো বাড়ি যাওয়া লাগে, বাপ-মা আছে না গেছে কে জানে! হঠাৎ বাপের জন্যি বড়ো কষ্ট হবের লাগলো। বাপ খুশি হবি জানলি–ছাওয়াল সাহেবের এঞ্জিন চালায়। অনেক পথ হাঁটে-হাঁটে যখন গাঁয়ে ঢুকলাম, তখন দেখি, ও মা, এ কী? গাঁয়ে ঢোকার পথে, বুঝছ না, নতুন এক খ্যাডের বাড়ি, ঝকঝকে বালিমাটিতে ভোলা নতুন বাড়ি, এক বর্ষাও পড়ে নাই তার গায়ে এমন, মনে কয় খ্যাড় পোয়াল থিকে ধানের বাসনা উঠবি। দেখি কি, সে বাড়ির দরজায় দাঁড়ায়ে এক কন্যে। কী যে রূপ! বুঝলা না, কটা-ফরসা না, কালো-কোলো, কিন্তুক রূপের বান; মনে কলো, নাকানিচোবানি খাওয়া লাগে তো এমন বানে। কিন্তু কার বাড়ি চিনবের পারলাম না। এ বাড়ি আগে ছিলো না এ পাড়ায়।
তোমার নিজের বউয়ের কী হলো, তার কথা কলে না?
আরে দুর, সেও নাকি এক বউ! আট বছরের মিয়ে বউ হওয়ার কী জানে। কিন্তুক বড়ো কষ্ট পালাম রে। বাড়ির কাছে যায়ে দেখি, বাড়ি নাই, ঘর নাই, চষা ক্ষেত সেখানে। হায় হায় করবের লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাস করলাম-বাপ কনে, মা কনে? তুমি কেডা?-না, আবদুল গনি সান্টার, এইখানে আমার বাড়ি ছিলো। কেউ কলে, বাড়ি যে ছাড়ে আলে, তোমাক চিনি না, এইখানে যার বাড়ি ছিলো সে উঠে গেছে বড় সড়কের ধারে। ফিরে যায়ে দেখি সেই নতুন খ্যাড়ের বাড়ির দরজায় আমার বুড়া বাপ বসে। বাপ আর ছাওয়াল কাদাকাটা করলাম, মা আর ছাওয়াল কাদাকাটা করলাম, আর দেখি, ভাদুই পদ্মা, থমথম-যৈবন একমিয়ে।-আম্মা!–কী? না, ওই মিয়ে কার? তোমার সেই বেটাবউ কনে গেছে যাক, আমি কৈল ওই মিয়েক ছাড়বো না। কও, সম্মন্দে আটকাবি? আম্মা কয়–আটকাবি নে। সাঁঝকালে দেখি মিয়ে জল আনবের যায়। বুঝলা না, চুল বাঁধেছে, সুর্মা কনে পায়, সুর্মাও দিছে চোখে। সামনে আগায়ে কলাম–মিয়ে, পেরান আমার যায়।নাকী হলো, পোকায় কাটছে? না। তো কী? মিয়ে, তোমার ওই পরীমুখ দেখছি, ওই হাঁটন দেখছি, আর আমি বাঁচবো না। নজ্জা পায়ে সে কলোআমি যে নিকা করছি, ছোটোকালে একজনের সাথে নিকা হইছে। কই-যদি বাঁচে থাকে সে, তালাক দেও। সোভানাল্লা, কয় কী!না–তার কী অন্যাই। আমি দেখবের ভালোনা, সেজন্যি সে চলে গেছে, তাক আমি তালাক দিবের পারবো না। কাঁদেকাটে একছা হলাম, মিয়ের মন গলে না। ভাবলাম রাত্তিরে লুকায়ে পারি তো আরও দু’এক কথা কাটাকাটা করবো। আবদুল গনি হাসতে লাগলো, তার শাদা দাড়িগুলি সুন্দর দেখাতে থাকলো।
সেই মিয়ে?
না বুঝে থাকো, বুঝে কাম নাই।
জয়হরি বললো, আপনার সেই কালো কিটকিটা বউ?
সে-ই।
ইউনুস বললো, আরে কই হ্যাঁয়, লাগাও দুই বোতল আর।
আবার? মেহের প্রশ্ন করলা।
আড্ডা জমেছে আজ।
দোকানীর লোক যথোচিত ব্যবস্থা করলো।
মেহের বললো, আমার বউয়ের কথা আর কয়োনা।বিটি যে এমন ভালোবাসা কনে শিখলো কে জানে। কিন্তুক বড়ো রোগা হয়ে যাতিছে, কী করি বুঝি না।
জয়হরি বললো, ভাত, ভাত, পেট ভরে ভাত খাবের দিয়ো।
পাত্রে পাত্রে মদ পরিবেশন করে ইউনুস বললো, দুনিয়ার সার এই মদ, দুনিয়ার বার ওই মিয়েমানুষ। যদি কামে কাজে থাকবের চাও, যদি ওভারটাইম করবের চাও, একটু একটুক শরাব খাবা, তন্ দুরস্ত। আর যদি মন খারাপ হয়, ভাইসব, মনের মতো মিয়েমানুষ খুঁজে বার। করবা। মনের কথা তাক কয়ে হাল্কা হবা। দুনিয়া-ছাড়া হবা তা নিয়ে।
সেদিনের আড্ডায় সংঘের কথা হলো না। সে বারের মদের পাত্রগুলি নিঃশেষিত হলে আর কিছুকাল হাসাহাসি গালগল্প করে যে যার বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করলো।
আবদুল গনি প্রথম কথা বলেছিলো, সে-ই শেষ কথা বললো, ভাই, বউ না-থাকতো যদি মক্কায় যাতাম; বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। শালা, এই এঞ্জিন ঠেলে বেড়াতাম না। বাড়ি মানেই তো বউয়ের বাড়ি, কও? মাধাই, আবার আসেন একদিন। কী আনন্দই পালাম, কী আনন্দই দিলেন। যাতেছিলাম ডাল আলু কিনবের। বউ বকে তো চুপ করে থাকে পরে সেই পদ্মায় জল আনার কথা মনে করায়ে দেবো।
আবদুল গনির মাথার চারিদিকে না-হোর্ক, তার মুখে চোখে শাদা দাড়িতে শান্তির কিরণ চকচক করে উঠলো।
আবদুল গনি দলবল নিয়ে লোকোশেডের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। একটা ছোটোখাটো চাঁদ উঠে পড়েছিলো, তার বাঁদর রঙের আলো পাথরের টুকরোর অমসৃণ পথে পড়ছে। ইঞ্জিনখানার কালিমাখা এই পুরুষ কয়েকটি তখনো সম্ভবত স্ত্রীদের নিয়েই আলোচনা করছে, তার ফলে তাদের হাসাহাসির শব্দ দূর থেকে কানে আসছে। এরা সুখী কিনা তা নির্ণয় করা কঠিন। সুখের কোনো জাত্যগুণ সহসা চোখে পড়ে না যে তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যাবে। আত্মা যদি একটি কল্পনামাত্র হয়, সুখ ও দুঃখ তবে একই বিষয় : স্নায়ুর কুঞ্চন-প্রসারণমাত্র। এদের মধ্যে যে স্নায়ু-উৎক্ষেপগুলি আত্মবিস্তার ও আত্মরক্ষণের পক্ষে সহায়ক সেগুলিকে সুখ বলা যেতে পারে। বেঁচে আছি, বেঁচে আছি–এ অনুভবের চাইতে গভীর আর কোন অনুভূতি? মনের এ অবস্থায় রুগ্ন দেহকেও সবল বোধ হয়, প্রাচীন বটের পাশে দাঁড়িয়ে তার মতোই জীর্ণ ত্বকের গভীরে প্রাণস্পন্দিত মনে হয় নিজেকে। তখন সমুদ্র উদধি, সূর্য, বৃক্ষারণ্য, হিমাচল ও প্রাণ সখা হয়। আনন্দ ও হাস্য, পরে করুণার জন্ম। এগুলিকে জীর্ণ বা সংকীর্ণ করতে কোনো অসার্থকতাই যথেষ্ট বিদ্বেষপরায়ণ নয়।
চিন্তা-ভাবনা নির্জন না হলে আসে না। ফিরবার পথে জয়হরি বকতে বকতে চললো। তখন। চিন্তা না করে তার কথায় কান পেতে রাখতেই ভালো লাগলো মাধাইয়ের।
.
কিন্তু মাস্টারমশাই লোকটির ছাত্রদের উপরে অবশ্যই প্রখর দৃষ্টি ছিলো। পরদিন সকালেই সে উপস্থিত হলো।
ও পাড়ায় গিয়েছিলে মাধাই? কথাবার্তা হলো?
কথাবার্তা তেমন না, গল্পসল্প আর কি।
কীসের গল্প, মাধাই?
বলা কি উচিত হবে, ভাবলো মাধাই। মদ আর মেয়েদের কথা কী করে বলা যায় মাস্টারমশাইয়ের মতো লোককে।
বলো মাধাই, মেহনতি মজুরের লজ্জার কী আছে?
বউদের কথা হলো।
মাস্টারমশাই হেসে বললো, পৃথিবীর আধখানা বউরা, তাদের কথা বলতে লজ্জা নেই কিন্তু তার চাইতে বড় কথা, প্রথম দিনেই যারা তোমার সামনেবউদের নিয়ে আলোচনা করেছে তারা তো তোমার বন্ধু। রবিবারে খোঁজ রেখে আবার যেও।
মাধাই কাজে যাবার আগে পোশাক পরছিলো, তখন কথাটা মনে হলো তার। মাস্টারমশাই দু’কথায় আবদুলের সব কথা সমর্থন করেছে, জীবনের সঙ্গে স্ত্রীদের যে যোগটার কথা আবদুল গনি বলেছিলো সেটা তবে মূল্যহীন নয়।
গোবিন্দর কথা মনে হলো, আর সেই সুকন্যা না কী নাম যার সেই মেয়েটির কথা গোবিন্দবাবু কি তাকে সুখী করার জন্যেই চলে গেলো!
স্টেশনের পথে চলতে চলতে মাধাই চিন্তা করলো : তাই হয় বোধ হয়, বেঁচে থাকা তখনই ভালো লাগে যখন আপন একজন থাকে। সংঘের কাজে বিদ্বেষের নেশাটা আর তেমন ধরছে না। বাকিটুকু কর্তব্যের মতো, চাকরির মতো ভারি বোধ হচ্ছে। গোবিন্দবাবু বোধ হয় এ কথা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলো। মাস্টারমশাইয়ের অবশ্য এসবে দৃকপাত নেই, সব সময় অন্যের চিন্তায় ব্যস্ত, যেন সকলকেই পরীক্ষায় পাস করাবে।
কিন্তু মদ? কাজের ছোটোখাটো অনেক অবসরে কথাটা মনে পড়লো। মদ যদি খারাপ জিনিস হয় না, ভদ্রলোক ছি ছি করে ওঠে কেন? মন হাতড়াতে গিয়ে যে দৃশ্যটা সে খুঁজে পেলো সেটা ছি ছি করার মতোই। ধাঙ্গড়পাড়ায় রোজই দেখা যায়, রাস্তার পাশে মরার মতো স্ত্রী-রুষরা পড়ে আছে, মুখের উপর ভনভন করে নীল মাছি উড়ছে। কী কুৎসিত, কী ময়লা!
তবে মদ যে পথে পথে খেতে হবে এমন কথা নয়। সাহেবরা খায়, তারা খানায় পড়ে থাকে না। গোবিন্দবাবুও খান। তাহলেও–
মাধাই ‘তাইলেও’ কথাটা উচ্চারণ করে ফেলো চিন্তা করতে করতে। তাহলেও মদে কী হবে। মাধাই স্বচক্ষে দেখেছে স্পেশ্যাল ট্রেনের কাঁচের জানলা দিয়ে কাঁটা-চামচ, ভোয়ালের ফুল, কাঁচের আলোর সেই স্বর্গরাজ্যে বসে সাহেব-যোদ্ধারা মদ খেতে খেতে চলেছে। তখনো কিন্তু তাদের বসবার ভঙ্গিটিও নির্জীব। মুখের কথা বোলো না, যেন জোর করে কেউ তাদের পাঁচন খাওয়াচ্ছে।
মাস দু-তিন পরে আবার একদিন মাস্টারমশাই এসে বললো, ঘরে আছে মাধাই?
আসেন, প্রণাম হই।
কী হলো, মাধাই?
কই, তেমন কিছু আর কী!
খানিকটা সময় আলোচনা করে মাধাইকে কথার মাঝখানে পরিখা খুঁড়ে শক্ত হয়ে থাকতে দেখে একটু থেমে হাসি হাসি মুখে মাস্টারমশাই বললো, তুমি কি বাঁচতে চাও মাধাই?
আজ মাধাই অত্যন্ত দুঃসাহস প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর। সে বললো, তাই চাই।
বাঁচতে হলে ঘরদোর লাগে, অন্নবস্ত্র লাগে।
তা লাগে।
এখন যা পাচ্ছো তা যথেষ্ট নয়।
তা নয়।
যথেষ্ট পাওয়ার কী উপায়?
ঠিক জানি না, মাস্টারমশাই।
দল বেঁধে দাবি করতে হবে, দর কষাকষি করতে হবে। একসময়ে তুমি টাকার জন্য গোরুকে বিষ দিতে।
মাস্টারমশাই তার সম্বন্ধে কতদূর খবর রাখে জেনে মাধাই বিস্মিত হলো। কিন্তু ধীরভাবে বললল, আর কোনোদিনই কাউকে বিষ দেবো না।
এখনই বলা যায় না।
তা না যাক, টাকাতে সুখ হয় না। আপনার টাকা আমার চেয়ে বেশি।
আমি তোমার চাইতে সুখী কিনা এই তো তোমার প্রশ্ন?
বাবু, তা করা আমার অন্যাই। আমি পারিনে, ভালো লাগে না।
‘পরে একদিন আসবো’ বলে মাস্টারমশাই সেদিনের মতো চলে গেলো। কিন্তু মাধাই মাস্টারমশাইয়ের জন্য অপেক্ষা করলো না। ইতিমধ্যে একদিন লোকোশেড মহল্লায় গিয়ে এমন পরিশ্রম সে করলো যে সে খবর যখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পৌঁছলো তখন সে স্তম্ভিত হলো, কলকাতা শহর থেকে যে শ্রমিকনেতারা এসে পারস্পরিক নেতৃত্বের মহার্ঘতার প্রচার করছিলো তারাও বিপন্ন বোধ করলো সাময়িকভাবে।
কিন্তু ফিরতি পথে মাধাই একটা কাজ করে বসলো, সে খবর কারো কাছে পৌঁছলো না। রজনীর দোকান থেকে এক বোতল মদ কিনে কিছু খেয়ে কিছু সঙ্গে নিয়ে সে বাসার পথ ধরলো। গলা সুড়সুড় করছিলো। প্ল্যাটফর্মে উঠে অন্ধকার জায়গা দেখে আরও খানিকটা গলায় ঢেলে দিলো সে। বাসার কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো তার। কিন্তু তার মধ্যেও মন যেন বল পাচ্ছে অনেকদিন পরে। সে সম্মুখের অন্ধকার শূন্যকে লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠলো, এই ওপ।
নিজের ঘরের বারান্দায় বসে সে একটা সিগারেট ধরালো। কয়েক টান ধোঁয়া গিলে তার শরীর অস্থির হয়ে উঠলো। শরীরকে সুস্থ করার জন্য বোতলের বাকি মদটুকু সে চুষে চুষে খেলো। তার বোধ হলো সে আর বাঁচবেনা। চোখে জল এলো। অন্ধকারে শায়িত নিজের একটি বিপন্ন প্রাণকে যেন সে দেখতেও পেলো। তার মনে হলো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার। ঘরে ঢুকে মাটিতে বসে বিছানায় মাথা রাখলো সে। দেহ ও মস্তিষ্ক একটি আচ্ছন্নতায় ডুবে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন অবস্থায় মাধাই বিছানা থেকে ফসকে মাটিতে শুয়ে পড়লো। মূৰ্ছা ও ঘুমের মাঝামাঝি অবস্থায় সে কখনো কখনো ফোপাতে লাগলো, যেন তার একটি অন্তরাত্মা আছে, এবং সেটা অত্যন্ত ব্যথিত এবং তার চাইতে বেশি ভীত হয়ে কাঁদছে।
১৫. এগোলেও মৃত্যু
এগোলেও মৃত্যু, পিছলেও তাই। সুরতুন একদিন একদিন ভয়ে ভয়ে বলেছিলো ফতেমাকে, আগুনের বেড়াপাক। মোকামে পুলিস চালের পুটুলি কেড়ে নেবার ভয় দেখালে টেপির মা তাদের পাল্টা ভয় দেখাতে স্টেশনে দাঁড়িয়ে-থাকা ট্রেনের তলায় গিয়ে বসতো আত্মহত্যার ভঙ্গিতে। সেই অভিনয় যে কত মর্মান্তিক তার পরিচয় দিয়েছে ফুলটুসির মৃত্যু। বাঁচার জন্যই চালের কারবার। চাল প্রাণ দেয় বলেই এত করা, যদি
সেই বাঁচার আশ্বাস আর না থাকে, চাল যদি বিষের দানা হয়? সমস্যা বাড়িয়েছে ফতেমা। ফতেমা গ্রামমুখো হয়ে পড়ছে ক্রমশ। দু-তিন মাস সুরতুন চালের কারবার থেকে দূরে দূরে কাটালো। অথচ অন্য কোনো জীবিকা অবলম্বন করতেও পারেনি। অবশ্য বছরের এ সময়টায় চালের কারবারে মন্দা পড়ার কথা, কিন্তু সুরতুনের বিপন্ন বোধ হয় চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে। একা একা চালের মোকামে যেতেও সে সাহস পায় না। ঠারে ঠারে কথা বলার পর একদিন সে খোলাখুলি বললো ফতেমাকে। তখন তারা দুজনে খেতে বসেছিলো। ফতেমা মুখ নিচু করে ভাতের পাত্রে হাত দিয়ে বসে রইলো। তার মুখটা বিষণ্ণ। কী একটা কথা বলতে গেলো সে, কিন্তু নিরুদ্ধ আবেগে যেন দুলতে লাগলো। এঁটো হাত দিয়ে কপাল চাপড়াতে লাগলো সে, যেন তার চোখের জল আসছে না, যা এসেছে তা প্রচুর নয়।
সুরতুন ভয়ে ভয়ে বলেছিলো, ভাবি, ভাবি, তুমি কি মরে যাবা?
সুরতুন ভেবেছিলো–যা এতদিনের মধ্যে একদিনও ঘটেনি সেটা এমন আকস্মিকভাবে আজ ঘটলো কেন? ইয়াকুবের জন্য ফতেমার অন্তরটা এত কাতর এ বুঝবার কোনো উপায়ই ছিলো না।
পরে ফতেমা বলেছিলো, যাবো মোকামে, কিন্তু এখন সেখানে ধানের দাম চড়া। কয়দিন যাক।
কিন্তুক বসে বসে কয়দিন খাবো? লাভের ট্যাকা শেষ হবি, চাল কেনাবেচার ট্যাকা থাকবি নে।
তা ঠিক।
তবুও ফতেমার এই নিষ্ক্রিয়তার যুক্তি খুঁজে পায় না সুরতুন। মানসিক ক্লান্তির সঙ্গে তার পরিচয় নেই যে সেটা ফতেমাতে আরোপ করবে। ফতেমাই বরং উৎসাহের আকর। ফুলটুসির ছেলে দুটিকে সে যেভাবে আদর করে দিঘায় গেলে, তাতে মনে হয় না পৃথিবীতে তার কিছুমাত্র দুঃখ আছে। ভাবো দেখি,শুধু আম্মা বলে ডাকা নয়, ফুলটুসির ছোটোছেলে ফতেমার বুকের কাপড় সরিয়ে তার বন্ধ্যা স্তনে মুখ ঘষতে থাকে। এর আর-একটি দিকও আছে। প্রতিবারই যাওয়া-আসার পথে ফুলটুসির ছেলে দুটিকে রান্না করে খাওয়ায় ফতেমা। অর্থব্যয় হয়। সুরতুন একদিন এ কথা উত্থাপন করায় ফতেমা বরং বলেছিলো, যতদিন ব্যবসা চলে ভাবনা কী।
সাহস সংগ্রহে বাধ্য হয়ে সুরতুন একদিন দিঘায় এলো একা একা। সে আশা করেছিলো টেপির মায়ের খোঁজ পাওয়া যাবে। তা গেলো না, কিন্তু বন্দরের পূর্বপরিচিত এক মহাজনের আড়তে একটা কাজ জোগাড় হলো। সকাল থেকে কাজ আরম্ভ-মহাজনের গুদামঘরে নিভৃততম অংশে বসে কেরোসিন কুপির স্বল্প আলোয় বস্তাপচা চাল থেকে পোকা ঝেড়ে ফেলার কাজ। দু’বেলা খাবার জন্য ওই চাল থেকেই কিছু কিছু পায় সে। যদি সে এক মাস কাজ করে, আর এক মাস কাজ থাকে, তবে নগদ তিনটে টাকাও পাবে।
দিনের বেলায় বাজারের বটতলায় সে রান্না করে। সে এ বিষয়ে একা নয়। বটগাছটার আর এক দিকে একটি সংসার আছে। একটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত কৃষক, তার স্ত্রী, একটি শিশু ও একটি বুড়ি। এত দুঃখেও এরা একসঙ্গে আছে।
কিন্তু রাত্রির আশ্রয় নিয়েই হচ্ছে মুশকিল। বটতলায় একা একা রাত কাটাতে তার সাহস হয় না। মাধাইয়ের ঘরের বারান্দা আছে, কিন্তু সে ঘর থেকে মহাজনের আড়ত প্রায় এক ক্রোশ পথ, সন্ধ্যার পরে আড়ত থেকে বেরিয়ে পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। যে পথটায় অনেক রাত পর্যন্ত আলো থাকে ছোটো ছোটো দোকানগুলিতে, স্বভাবতই সুরতুন সেটাকে বেছে নিয়েছিলো। কিন্তু দিনেক দু’দিনে সে ভুল বুঝতে পারলো। প্রথম দিনেই সে যে বিপন্ন হয়নি, এ তার ভাগ্য বলে মনে হলো। পথটা শহরের কুৎসিত পল্লীর প্রান্ত দিয়ে গেছে। একটা সুফল হয়েছে–জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানাখন্দ বেয়ে চলা জনমানব পরিত্যক্ত একটা পথ সে খুঁজে পেয়েছে। রাত্রিতে আন্দাজে হাতড়ে একলা একলা পথ চলতে গায়ে কাঁটা দেয়। উপায় কী, এই ভাবে সুরতুন–এ পথে মানুষ অন্তত নেই।
মাধাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় না। দৈবাৎ দেখা হলে মাধাই অভ্যাসমতো বলে, কী খবর, কবে আসলে? কিন্তু উত্তর শোনার জন্য দাঁড়ায় না। একদা সুরতুনকে পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাধাই গল্প করেছিলো ভোর রাত্রির অস্পষ্ট অন্ধকারে, সেটা যে ব্যতিক্রম তা সুরতুনও জানে। বিনা প্রয়োজনে এর আগে সে অনেক কথা সুরতুনদের সঙ্গে বলেনি, তারা নিজে থেকে প্রশ্ন করলে উত্তর দিয়েছে। তবু এরই মধ্যে কিছু একটা সুরতুন অনুভবও করলো। বন্দরে গিয়ে কাজ শুরু করার আগে একবার, দুপুরের পরে রান্না করতে এসে আর একবার সে গ্রামের লোকদের খোঁজ নিলো একদিন। চেনা চেনা লাগলো একজনকে। তাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো–সে চিকন্দির লোক, ঘাস বিক্রি করতে এসেছে। সুরতুন তাকে বলে দিলো সে যেন চিকন্দি যাওয়ার পথে বুধেডাঙায় দাঁড়িয়ে রজব আলি সান্দারের বেটাবউ ফতেমাকে বলে যায়, মাধাই রাগ করেছে, সে যেন আসে। এ খবর পেয়েও ফতেমা আসেনি, এবংনা আসায় একরকম ভালোই হয়েছে, হয়তো মাধাই রাগ করেনি, ফতেমার কাছে আর একবার সে নির্বোধ প্রতিপন্ন হতো। এই ভেবেছে সুরতুন।
মহাজনের গুদামে চালের কাজ তিন সপ্তাহে শেষ হয়ে গেছে। সে আবার একেবারে বেকার বসে। সমস্তদিন সে মোকামের অন্য কোনো যাত্রী আছে কিনা তার খোঁজখবর নিয়ে কাটিয়েছে। এদের মধ্যে দু’একজন বলেছে, তারাও আবার মোকামে যাবো যাবো করছে। অন্যান্য দিনের চাইতে কিছু আগে সুরতুন মাধাইয়ের বারান্দায় এসে বসেছিলো। মাধাইয়ের অনুমতি নেওয়া দরকার।
সন্ধ্যার পরই মাধাই এলো কিন্তু তাকে লক্ষ্য করলো না। বারান্দার অন্যপাশে বসে সে আপন মনে একটা বোতল থেকে কী খেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে উঠে মাধাই ঘরের মধ্যে চলে গেলো। ঘরের দরজা খোলা রইলো। আরও কিছুক্ষণ পরে শিশি বোতল পড়ার মতো কীসের একটা শব্দ হলো, তারপর একটা ভারীনরম জিনিস পড়ার শব্দ হলো। সুরতুন সন্তর্পণে উঠে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো মাধাই মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার প্রাণের মূল দেশটা শূন্য হয়ে গেলো। সে ঘরে ঢুকে আবার তেমনি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। হায়, হায়, কী করতে পারে সে। নিজের সমস্ত চিন্তাশক্তি একাগ্র করেও সে প্রতিকারের কোনো পথ খুঁজে পেলো না। অথচ মাধাইকে সাহায্য করার জন্য তার সমস্ত প্রাণ ব্যথিত হয়ে উঠেছে। সে এগিয়ে গিয়ে মাধাইয়ের শিয়রের কাছে বসে মৃদুস্বরে ডাকতে লাগলো, ভাই, বায়েন। কিন্তু মাধাইকে স্পর্শ করার সাহস সে কিছুতেই সংগ্রহ করতে পারলো না, উঠে এসে তার পায়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এমনি করে প্রায় সারাটা রাত কাটলো। একবার মাত্র দুলুনি এসেছিলো তার, সঙ্গে সঙ্গে নিজের তিরস্কারে সে খাড়া হয়ে বসলো। শেষ রাতের দিকে মাধাই পাশ ফিরে শুলো। সুরতুনের মুখে একটা ক্ষীণ আনন্দ ফুটে উঠলো।
ভোর হচ্ছে তখন, মাধাই বললো, একটু জল দে, খাই।
সুরতুন জল এনে দিলো।
আরো জল দে।
দ্বিতীয়বার জল এনে দিয়ে সুরতুন বললো, কেন বায়েন, জ্বর আসছে?
মাধাই কথা বললো না, ক্লিষ্টমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, একটা কিছু দে, পরি।
সুরতুন দড়ি থেকে মাধাইয়ের একটা কাপড় এনে দিলো। মাধাই বিছানায় বসে জামা খুললো, জুতো খুললো, কাপড় পাটে বিছানায় শুয়ে পড়ে চোখ বুজলো।কিন্তু অস্বস্তি গেলো না, এপাশ ওপাশ করতে লাগলো সে, তার কপালে বিনবিন করে ঘাম ফুটে উঠলো। সুরতুনের মনে হলো ঘামের জন্য মাধাইয়ের কষ্ট হচ্ছে কিন্তু দড়ির আলনা থেকে গামছা নিয়ে এসেও ঘাম মুছিয়ে দিতে সাহস পেলো না। মাধাই একবার তার লাল টকটকে চোখ মেলে সুরতুনকে খানিকটা সময় দেখলো। সে দৃষ্টিতে অনুভূতির কোনো চিহ্ন ছিলো না। কিন্তু হাত বাড়িয়ে সুরতুনের একখানা হাত টেনে নিয়ে নিজের কপালের উপরে রেখে আবার সে চোখ বুজলো।
দুপুর গড়িয়ে গেলে মাধাই উঠে বসে ডাকলো, সুরো রে।
কী কও, বায়েন?
বেলা পড়ছে?
তা পড়লো।
কেউ আসছিলো?
না। আপনে কিছু খালে না বায়েন?
না। মনে কয় জ্বর আসছে। তুই কি খাওয়া দাওয়া করছিস? তাই কর গা। সাঁঝের আগে ডাকে দিস। মাধাই আবার শুয়ে পড়লো।
সুরতুন বারান্দায় এসে চুপ করে বসলো। দুপুরের রোদে পুড়ে আসছে বটে বাতাসটা, তবু মিষ্টি লাগলো। সে এই প্রথম অনুভব করলো তার চোখ দুটি জ্বলে যাচ্ছে।
মাধাই তাকে আহারাদি করতে বলে দিয়েছে। আহারের প্রয়োজন নিজেও সে অনুভব করছিলো, কিন্তু মাধাইকে একা রেখে যেতেও মন সরলো না। তার কী প্রয়োজন তা কিছুই সে বুঝতে পারছে না। হয়তো তার শিয়রে বসে তার কপালে হাতটা রাখা উচিত ছিলো। এখন কি সে যাবে? না, এখন আর যাওয়া যায় না।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে সুরতুনের মনে হলো ঘরের মধ্যে মাধাই চলে বেড়াচ্ছে। মাধাইও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, জাগছিস?
শরীর ভালো বায়েন?
হয়।
ডিটিতে যান?
হয়। সি দেবো। ছুটি নিবো। মনে কয় কাল থিকে তুইও খাস নাই।
কুণ্ঠিত বোধ করে সুরতুন মুখ নামিয়ে নিলো।
মাধাই ছুটি নিয়ে ফিরে এলে কী ব্যবস্থা হবে, কী করা সম্ভব হবে তার পক্ষে এ সব ভাবতে লাগলো সে। ঘটনাটা কোনদিকে গড়াতে পারতো এ অবস্থায় তার আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না। কারণ মাধই চলে যেতে যেতে ফতেমা এলো।
কী হইছে রে বায়েনের?
তবে তুমি খবর পাইছিলা?
হয়। বায়েন কেমন?
এখন মনে কয় ভালোই আছে। পরশু রাত, কাল সারাদিন রাত কী যে তার হলে বুঝবের পারি নাই।
অনেকক্ষণ ধরে ফতেমা সুরতুনকে মাধাই সম্বন্ধে প্রশ্ন করলো।
মাধাই ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে দেখলো ফতেমা বসে আছে, সুরতুন নেই। মৃদু হেসে সে বললো, কাল যাক দেখছিলাম সে ফতেমা, না, সুরো?
ফতেমা বললো, সুরোক বাজারে পাঠাইছি। খাতে হবি তো। একটু থেমে সে প্রশ্ন করলো, অসুখ করেছে ভাই?
মাধাই মাথা নাড়লো। কিন্তু সুরো ধরতে না পারলেও ফতেমার চোখে ধরা পড়ে গেলো–মাধাইয়ের চোখ দুটি তখনো লাল, মাথার চুলগুলো বিশৃঙ্খল, চোখ-মুখ বসে গেছে। ফতেমা তার কথায় নিবৃত্ত হলো না; মাধাই ঘরে ঢুকে বিছানায় বসেছিলো, সে এগিয়ে গিয়ে তার চুলে হাত রাখলো, না ভাই, অসুখ তোমার করেছে।
কিন্তু শুধু অসুখই নয়তো, ফতেমা এবার আরও লক্ষ্য করলো মাধাইয়ের পায়ের একটা আঙুলে ন্যাকড়া জড়িয়ে বাঁধা, কপালের বাঁ পাশটা তামাটে রঙের হয়ে ফুলে আছে। সে আকুল হয়ে উঠলো, কান্নাকাতর স্বরে বললো, কিও সোনাভাই, কী হয়েছে তোমার?
তার সোহাগের স্বরে মাধাইয়ের অপূর্ব অনুভূতি হলো। রেল হাসপাতাল থেকে সদ্য ব্যান্ডেজ বাঁধা নিজের পায়ের দিকে একবার, আর একবার ফতেমার মুখের দিকে চেয়ে ছেলেমানুষি স্বরে বললো সে, অন্যাই করছি। নেশা করছিলাম।
নেশা তো বেটাছাওয়াল করেই, অন্যাই কু করছে। প্রবোধ দিলো ফতেমা, কিন্তুক এমন করে নেশা করবের নাই। দ্যাখো তো পায়ের কী দুর্গতি করছো!
মাধাইয়ের মুখ অত্যন্ত বোকা বোকা দেখালো।
ফতেমা আবার হাসলো, বললো, তা হঠাৎ নেশা করলা কেন্?
মাধাইয়ের মন খালি করে কথা বলতে ইচ্ছা হলো। একটু ইতস্তত করে সে বললো, ভালো ঠেকে না। কেমন যেন একা একা লাগে।
ফতেমা খানিকটা সময় ভাবলো কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পেলো না। একটু থেমে সে বললো, আমি রান্নার জোগাড় করি, তুমি ছান করে আসো। শরীর সুস্থ হবি। চা না কী খাও, তা খাইছো?
ফতেমা নিজে থেকে মাধাইয়ের র্যাশানের ঝোলা খুঁজে চাল বার করলো। কুলোয় করে চাল নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বাছতে বসলো।
ঘরের মধ্যে কিছুকাল খুটখাট করে, জামা খুলে মাধাইও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফতেমা তাকে আসতে দেখে চোখের দৃষ্টিতে স্বাগত করলো, মুখেও বললো, আসো।
তোমার সাথে কথা কওয়ার জন্যি আলাম।
আসবাই তো। বোসো। জিরাও।
ফতেমা মুখ নিচু করে পটু হাতে চালের ধান কাঁকর বেছে ফেলতে লাগলো, মাধাই খুঁটিতে হেলান দিয়ে অন্যমনস্কভাবে কাজ দেখতে লাগলো তার।
ফতেমা বললো, বিড়ি খালে না, সোনাভাই?
মাধাই বিড়ি ধরালো। বিড়ি ধরানোর পর বিস্ময় বোধ হলো তার। বাড়িতে অভ্যাগত এলে পুরুষের পক্ষে এরকম অনুরোধ করা স্বাভাবিক, কিন্তু ফতেমা কোথায় শিখলো এমন করে বলতে? টেপির মা নিজে বিড়ি খায় বলে তার মুখে এটা কতক মানাতো। কিন্তু ফতেমা তো বিড়ি খায় না।
মাধাই বললো, ছান করতে কও, কিন্তুক মাথা এখনো দপদপ করতিছে।
ফতেমা কথা না বলে সরে এলো তার কাছে, তার পিঠে গলায় হাত রেখে পরখ করে বললো, জ্বর না বোধায়। রাত জাগছে, উপাস পাড়ছে। যাও ওঠো, অল্প করে ছান করে আসো।
মাধাই স্নান করে এসে দেখলো উনুনে আঁচ দেওয়া হয়েছে, বঁটি নিয়ে আনাজ কুটতে বসেছে সুরতুন। ফতেমা হাঁড়িকুড়ি মেজে ঘষে পরিচ্ছন্ন করে নিচ্ছে। মাধাইকে দেখে ফতেমা তাড়াতাড়ি সুরতুনকে বললো, তুই যে কী মেঠাই আনছিস, তাই আগে ভাইকে খাবের দে।
কথাটা ভেবে দেখার মতো। মাধাইয়ের আহারাদির ইদানীং কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিলো না। কাজের ভিড় থাকলে, তা স্টেশনের হোক কিংবা ইউনিয়নের, রানিংরুমে গিয়ে সে খেয়ে আসে। র্যাশানের চাল দিলে যে কোনো হোটেলের চাইতে কম পয়সায় সেখানে আহার্য মেলে। ছুটিছাটার দিনে সখ করে কিংবা মেজাজ হলে সে তার ঘরেও রান্না করে। কিন্তু সেটা অনির্দিষ্ট ব্যাপার। রান্নার কাজে সময় ব্যয় না করে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে নিয়ে কাটাতেই তার ভালো লাগতো। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেশীগুলোকে অনুভব করা, আয়না কোলে করে বসে সিঁথি বাগানো, জামার বোতামগুলো নিপুণ হাতে সেলাই করা, এসব নিয়ে তার সময়, যতটুকু তার অবসর, কেটে যেতো। ইদানীং রান্নার ব্যাপারে তার আরও বিমুখতা এসেছে। নিজেকে নিয়ে সে চিন্তা করে।
কিন্তু তার ঘরে রান্নার ব্যবস্থা হিসাবে অ্যালুমনিয়মের পাত্র, উনুন, বঁটি, লকড়ি, এসবই ছিলো। ফতেমাদের সে ব্যবহার করতে দিতো এসব। ফুলটুসির ছেলেদের জন্য রান্নার প্রয়োজন হয়েছিলো ফতেমার।
মাধাই বিস্মিত হলো। ফতেমা তার জন্য রান্না করতে বসেছে, যেন সেটাই অভ্যস্ত স্বাভাবিকতা। কোনো সংশয়ই যেন নেই। মাধাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করাও দরকার বোধ করেনি ফতেমা। তার মনে এমন কোনো দ্বিধা নেই-মাধাই তার রান্না খাবে কিনা।
কিন্তু সুরতুনের দেওয়া মিঠাই ও জল খেয়ে মাধাইয়ের মনে হলো এমন স্নিগ্ধতা সে দীর্ঘদিন অনুভব করেনি।
স্নান-আহার করে খানিকটা গড়িয়ে নিয়ে তার মনে হলো শরীরে কোনো কষ্ট নেই আর। ঘরের মধ্যে কিংবা বারান্দায় ফতেমারা ছিলো না। কোথায়-বা গিয়েছে কোনো চালের ধান্দায়, ভাবলো হাসি হাসি মুখে সে। বহুদিন পরে আবার সে এদের কথা ক্ষণেকের জন্যও চিন্তা করলো।
বাইরের দিকে চাইতে গিয়ে বহু পরিচিত কাঁঠাল গাছটার প্রথম ডালটায় তার চোখ পড়লো। কিছুদিন সে লক্ষ্য করেনি। মনে হলো যেন ডালটা বেড়েছে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় পাতা কাঁপছে। সেখান থেকে সরতে সরতে তার দৃষ্টি পড়লো আরো দূরের দৃশ্যপটে। দিগরের আবর্জনা বয়ে পাকা নালাটা কিছু দূরে গিয়ে খানিকটা নিচু জমি প্লাবিত করে একটা জলা সৃষ্টি করেছে। বর্ষায় জল বেড়ে ছোটো একটা বিলের মতো দেখায়। প্রথম চাকরি পাবার পর একদিন সে ছিপ নিয়ে গিয়েছিলো মাছ ধরতে, খুব পাকা একটা শোল পেয়েছিলো। এখন জল অনেক কমে গেছে। জলের ধারে ধারে বুনোঘাসের সবুজ ঝোঁপগুলোও ঠাহর হচ্ছে চোখে।
মনের গতি চিন্তার গণ্ডিবদ্ধ না হলে যেমনটা হয়, তেমনি হলো মাধাইয়ের। বহুদিন-ভুলে যাওয়া গ্রামের কথা মনে পড়লো তার। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার তিক্ত কোনো ছবিনয়, একটি বিশেষ দিনের স্মৃতি। রটন্তীকালীর পূজা হয়েছিলো সান্যালবাড়িতে। আর সেইবারই প্রথম ঢাক বাজানোর সাহস হয়েছিলো তার। দুখানা ঢাক নিয়ে সে আর তার বাবা গিয়েছিলো সান্যালবাড়িতে। ধানখেতের আলের উপর দিয়ে পথ। ধানের পরিপূর্ণ গোছাগুলো ঢাকের গায়ে লেগে একরকম মৃদু বাজনার শব্দ উঠছিলো। অদ্ভুত, অদ্ভুত। এতদিনকার পুরনো কথা কী করে এত স্পষ্ট হয়ে মনে পড়লো, ভাবলো সে। পূজামণ্ডপে নতুন ধুতি গামছা বিদায় পেয়ে সে যখন ভাবছে যথেষ্ট পাওয়া হয়েছে, ঠিক তখনই তাদের কঁশি বাজানোর ছোকরাটা তার বাবার ঢোল বাঁশি নিয়ে এলো। তার বাবা ছিনাথ ঢোল কাঁধে উঠে দাঁড়ালো, তার হাতে সানাই বাঁশি দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ঠিক করে বাজাস সারগাম। কষে রাখিস তাল। সান্যালমশাই স্বয়ং বসে ছিলেন অন্দরের দরদালানে। সানবাঁধানো আঙিনায় অন্যান্য বাজনদারদের মধ্যে। গলায় ঢোল ঝুলিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো ছিনাথ বায়েন। রোগে ভুগে তার শরীর তখন জীর্ণ। তবু সে বাজনদারদের সেরা। সে আবার বললো, বাজাস কৈল ঠিক করে, কর্তাক কইছি ছাওয়ালেক আনছি। তারপর বাজনা শুরু হলো। বসে, দাঁড়িয়ে, নাচতে নাচতে, পিছিয়ে গিয়ে, প্রমত্ত তাণ্ডবে সম্মুখে হেলে পড়ে ছিনাথের সে কী বাজনা! মাধাই প্রাণপণে মুখস্থ সারগম দিয়ে বাবার সঙ্গে জুড়ি রেখে যাচ্ছিলো, কিন্তু ওস্তাদি ভর করলো ছিনাথের মাথায়।নতুন বোল তৈরি হতে লাগলো তার মনে মনে, সেগুলি ঝংকার দিয়ে বাজতে লাগলো তার ঢোলে। মাধাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো, দম পাচ্ছিলো না, কিন্তু থামবারও উপায় ছিলো না। ছিনাথ কথা বললো না, কিন্তু তার ঢোলের বাজনা তেড়ে তেড়ে উঠে মাধাইয়ের সমস্ত নির্জীবতার উপর তর্জন করতে লাগলো। মাধাইয়ের স্পষ্ট মনে পড়ে, হিংসা ভুলে সাবাস করে উঠেছিলো অন্য সব টুলিরা। আর তাদের দিকে ফিরে হাসি হাসি মুখে কাত হয়ে ঘুরতে-না-ঘুরতে তেহাইয়ের মাথায় আবার চাটি দিলো ছিনাথ।
মানুষের কৃতকর্মের শেষ বিচারে বলা যায় এই কাজটি না করে তার উপায় ছিলো না। কিন্তু তার জীবনধারা অনুসরণ করতে করতে সবসময়ে বলে ওঠা যায় না তার ভবিষ্যতের ঘটনা আগেরগুলির পরিণাম হবে কিনা। হিসাবের চাইতে বড়া যেন কিছু এসে পড়ে।
আগের ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই তাদের পরিবারে এলো বিঘোর দুর্দিন। ছিনাথের স্বাস্থ্য কিছুদিন থেকে ভেঙে পড়েছিলো। সেবৎসর শীতের গোড়াতে যখন তার জ্বর হতে শুরু করলো। তখন সে নিজেও হাল ছেড়ে দিলো। তার জ্বর সাধারণ নয়, বিপথ থেকে কুড়িয়ে-আনা বিষাক্ত ক্ষতগুলো সহস্ৰমুখে আত্মপ্রকাশ করলো। মৃত্যুটা হলো বীভৎস। তারপর এলো না খেয়ে-থাকার দিন, গোরুকে বিষ দেওয়ার দিন। বাঁশির বদলে বিষ উঠলো হাতে।
উঠে দাঁড়িয়ে মাধাই বিড়ি ধরালো। গ্রামের জীবন সে চিরকালের জন্য ত্যাগ করে এসেছে। এত দূরে থেকেও যখন তার বাবা-মা বর্তমান ছিলো, তাদের গৃহ ছিলো, সে-সময়ের কথা মনে হলো। কেন হলো এ কথা বলা শক্ত। হাতের কাছে অবশ্য ফতেমা আছে; তার স্নেহ অন্য অনেক স্নেহশীল দিনের কথা মনে আনতে পারে।
ফতেমার কথা মনে হলো। সে লাজুক নয়, প্রয়োজন হলে সে অগ্রসর হতে পারে, তার সঙ্গীদের মুখে ছোটোখাটো ঘটনা শুনে মাধাই বুঝতে পেরেছিলো, কিন্তু এমন সোহাগ-ঝরানো কথা শুনবার অবকাশ মাধাইয়ের আগে হয়নি। স্ত্রীলোক এমনভাবে কথা বলে বলেই বোধ হয়। শ্রান্ত পুরুষরা বাড়ির দিকে ছুটে যায়। কিন্তু সাধারণের চাইতেও বুঝি-বা বেশি কিছু ফতেমা, ভেঙেপড়া পুরুষের পদস্খলন যারা স্নেহ দিয়ে ক্ষমা করতে পারে তাদের মতো বোধ হয় সে। বোধ করি এমন স্ত্রীদের কাছেই পুরুষ বার বার ফিরে আসে।
পরদিনও ফতেমাকে মাধাই যেতে দিলো না। ঘুম ভেঙে উঠে সে বললো, আজ না গেলি হয় না?
থাকবের কও, ভাই?
হয়, থাকো।
চার-পাঁচ দিন ফতেমা বেঁধে খাওয়ালো মাধাইকে। মাধাই যখন স্টেশনে ঘুরে বেড়ায় তখন তাকে দেখে তার সঙ্গীরা অবশ্যই বুঝতে পারে না তার অন্তরকে গত কয়েকটি দিন কত কিছু এনে দিয়েছে। ইতিমধ্যে একদিন সে বলে ফেলো জয়হরিকে, হাত পোড়ায়ে খায়ে বেটা ছাওয়ালের চলে না। ফতেমা রাঁধে খাওয়ায়, বেশ আছি?
ফতেমা থাকে নাকি আজকাল তোমার কাছে?
আছে কয়দিন।
কিন্তু সেদিনই অন্য একসময়ে জয়হরি রসিকতা করে বললো, দুটাই রাখবা?
মাধাই বুঝতে না পেরে বললো, কী কও?
কই যে, দুজনকেই পুষবা? শেষ দুজনে চুলাচুলি হবি।
না, ওরা ঝগড়া করে না।
পুরুষের ভাগ নিয়ে করবি।
রসিকতার তলদেশ দেখতে পেয়ে মাধাই প্রায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো, বিরস মুখে বললো, ওরা আমাকে ভাই কয়।
সন্ধ্যায় ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরে সে দেখলো ফতেমা কুপি জ্বালিয়ে ঘরের কাজ করছে।
সুরো কই?
গাঁয়ে পাঠাইছি। শ্বশুরের অসুখের খবর নিয়ে আইছিলো একজন।
রাত্তিরেও রাঁধা লাগবি নাকি?
হয়।
রাত্রিতে নতুন করে রাঁধার প্রয়োজন হয়েছে কেন সেটা ফতেমা ঠিক সাহস করে বলতে পারলো না। ফুলটুসির ছেলে জয়নুল ও সোভান এসে খেয়ে গেছে।
মাধাই ঘরের ভিতরে বসে বিড়ি টানছে, আর ফতেমা বাইরে রান্না করছে। ফতেমা বললো, আনাজ নামানের সময় কঁচা তেল লঙ্কা দিয়ে নামালি খাও?
মাধাই বললো, হুঁ।
কৌতুকের মনে হলেও সত্য যে একয়েকটি দিনেমাধাই একপক্ষে সুরতুন-ফতেমা অন্যপক্ষে এদের পারস্পরিক অবস্থানের যেন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এরা যেন খানিকটা আশ্রিতের মতো, খানিকটা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলো মাধাইয়ের চোখে। এখন যেন তার সমকক্ষ বলে বোধ হচ্ছে।
কিছু সময় ঘরে কাটিয়ে মাধাইয়ের মনে হলো ফতেমার সান্নিধ্যে বারান্দায় গিয়ে সে বসবে। এরকম আকাঙ্ক্ষা এর আগে কোনো সময়েই তার হয়নি। কিন্তু জয়হরির রসিকতাটাও তার মনে পড়ে গিয়ে মনে অস্বাচ্ছন্দ্য এনে দিলো।
ফতেমা বাইরে থেকে ডেকে বললো, লাকড়ি কৈল নাই। দু-এক দিনের মধ্যে আনতে হবি।
কাল মনে করায়ে দিও কী কী লাগবি!
মনের অস্বাচ্ছন্দ্যের চাইতে সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষাই অবশেষে প্রবল হলো। মাধাই বাইরে গিয়ে বললো, আবার আসলাম তোমার কাছে বসতে।
কেন্, ভয় করলো সোনাভাই? ফতেমা যেন শিশু-ভ্রাতার ভয় দূর করছে।
মাধাই অপ্রতিভের মতো হাসলো। উঠে যাচ্ছিলো সে, ফতেমা হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে বসালো।
বোসো না কেন, ভাই।
মাধাই লক্ষ্য করলো ইতিমধ্যে ফতেমারও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিনের তুলনায় কিছু পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে তাকে। পরিধেয় ও মাথায় চুলেই পরিচ্ছন্নতার ভাবটা বেশি লক্ষণীয়। মাধাইয়ের মনে হলো, ফতেমা পথে বেরিয়ে পড়ার আগে হয়তো এরকমই ছিলো কিংবা এর চাইতেও বেশি ছিলো তার লক্ষ্মীশ্রী।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাধাই বললো অবশেষে, রান্না করো তুমি, আমি একটু ঘুরে-ফিরে আসি।
পরদিন দুপুরবেলায়। মাধাই ডিউটি সেরে ফিরেছে। আহার্যের আয়োজন দেখে বিস্মিত হয়ে সে প্রশ্ন করলো, বিয়েসাদির ব্যাপার নাকি?
ফতেমা বললো, সে হারামজাদারা আবার আইছে।
কে?
কাল যারা খায়ে গিছলো।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ফুলটুসির ছেলে জয়নুল আর সোভান উপস্থিত হলো। কোথায় কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে হয়তো কেউ দরজায় কলাগাছ লাগিয়েছিলো তারই একটা তারা সংগ্রহ করে এনেছে। দেহে এমন বল হয়নি তাদের যে কাঁধে করে আনবে, সমস্তটা পথ মাটি দিয়ে হেঁচড়ে টেনে এনেছে, পথের আবর্জনায় কলাগাছটি ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছে।
ফতেমা ধমকের সুরে বললো, ইল্লত! কোথে কুড়ায়ে আনলি, কী হবি?
ছেলে দুটি সম্ভবত মাধাইকে দেখেই ভয় পেয়েছিলো, বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়ালো। নতুবা ফতেমার তিরস্কারে তারা বিমর্ষ হয়নি, তার প্রমাণ মাধাই শুনতে পেলো। ছোটোছেলেটা উঠে এসে ফতেমার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, আম্মা, রান্না সারে উঠেকলাগাছটা কাটে দিবা। উয়েতে থোড় আছে। ঠিক দুই পয়সার হবি।
ফতেমা মিষ্টি হেসে বললো, সোনার চাঁদ ছাওয়াল। অমন করে পয়সা আনতে হবিনে তোর। কিন্তুক এখন তোরা যা, রাঁধে রাখবো। পরে আসিস।
এবার বড়োছেলেটা বললো, কনে যে যাই বুঝিনে। বাড়িতে চাল না নিয়ে ঢুকলি আব্বা পাঁঠার কোলজের মতো কোলজে কাটে নিবে বলেছে।
কিস কী? তোরা চাল পাবি কনে?
সে কয়, তা জানিনে। তোগরে ফতেমা আম্মার কাছে থিকে চাল আনিস।
এবার ফতেমার রাগ হলো। সে বললো, তোগরে আব্বাক কয়ে দিস, ফতেমা তার বউ না।
উরে বাস! এ কথা কলি তার পাঁঠাকাটার ছুরি বসায়ে দিবি গলায়।
একটু থেমে ছোটোছেলেটি আবার বললো, কেন্ আম্মা, আমি এখন খালে তোমার বায়েন রাগ করে?
ফতেমা উত্তর দিলো না।
তুমি যে কও আমি ছোটো ছাওয়াল। ছোটো ছাওয়ালের পরেও বায়েন রাগ করে?
বড়োছেলেটি বললো, চুপ কর, চুপ কর, বায়েন ঘরে আছে।
হঠাৎ মাধাইয়ের কী হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে ওদের কাছে দাঁড়ালো। ওরা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালানোর উদ্যোগ করলো। সে এক মুখ হেসে ফেলে বললো, আয় আয়, খায়ে যা। তোরা আগে খায়ে নে।
মাধাই এত উত্তেজিত বোধ করলো যে তার মনে হলো সে নিজেই ওদের আসন করে খেতে বসাবে। তার অনুরোধে ফতেমা ওদের তখনই খেতে দিলো। সেদাওয়ায় উবু হয়ে বসে বিড়ি টানতে টানতে ওদের খাওয়ার তদ্বির করলো। সে সময়ে এবং তারপরও কিছুকাল তার অনুভব হতে লাগলো যেন সে ফতেমার দলভুক্ত তার নেত্রিত্ব-আশ্রিত কেউ। সে-অনুভবে সে শান্তিও পেলো।
কিন্তু ফতেমার ভঙ্গিতে যতই গতিহীনতার প্রতিশ্রুতি থাক, তাকে চঞ্চল হয়ে উঠতে হলো। সুরতুন গ্রাম থেকে দুঃসংবাদই বয়ে এনেছে। ফতেমার শশুর রজব আলি অত্যন্ত পীড়িত।
সব শুনে মাধাই বললো, তোমার যাওয়াই লাগে।
ফতেমা প্রায় তখন-তখনই চলে গেছে। যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ বসে সুরতুনকে কী কী যুক্তি দিয়ে গেলো, মাধাই শুনতে না পেলেও আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝতে পারলো তার অনেকখানি তার নিজের সুখ-সুবিধা সম্বন্ধে। মাধাই শুয়ে শুয়ে ফতেমার কথা চিন্তা করতে লাগলো। অনেকদিনের পরিচিত ফতেমাকে এখন যেন সে অনেক বেশি করে চিনতে পেরেছে। ফতেমা যখন ফুলটুসির ছেলেদের মা হয়ে বসেছিলো সেই দৃশ্যটা তার মনে পড়লো। জয়হরি বা আবদুল গনিদের সংসার কী রকম কে জানে। তাদের স্ত্রীরাও কী রকম কে জানে। তাদের স্ত্রীরাও কি ফতেমার মতো এমন পটু, এমন স্নিগ্ধ!
এমনি তাদের যাওয়া-আসা। যাবো’ এ কথাটাও প্রত্যেকবার মাধাইকে বলে না, এবার তবু একবার অনুমতি নেবার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারটা ঘটেছে কিন্তু এই প্রথম তার অনুভব হলো তার বাড়ি থেকে কেউ যেন চলে গেছে।
সব চিন্তাকে ভাষায় পৌঁছে দেবার মত অনুশীলিত মননয় তার। সে যা ভাবলোতা কতকটা এইরকম :পরের জন্য করা নয়, না করে পারে না বলেই ফতেমা এমন করে পরের জন্য উদ্বিগ্ন। কথাটা শ্বশুর বটে কিন্তু কী করেছে শ্বশুর তার জন্য? আহার-আশ্রয় কিছু সে দিতে পারে না, শোকে সান্ত্বনা তো দূরের কথা। ফুলটুসির ছেলেদের জন্য এমন আকুল হয়ে ওঠে ফতেমা। যদি মাধাই বলতে তোমাকে ছাড়া আমার চলেনা ফতেমা, হয়তো সে বাকি জীবনটা মাধাইয়ের সুখ-সুবিধার ব্যবস্থায় কাটিয়ে দিতে পারে।
সুরতুন এসে যখন ডাকলো তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। সুরতুন বললো, ভাবী কলে–লকড়ি নাই।
আজই যাওয়া লাগবি–বলে মাধাই উঠে বসলো। তুই তাইলে আছিস? ফতেমা কবে আসবি কইছে।
তা কিছু কয় নাই। যে কয়দিন না আসবি আমাকে রাঁধাবাড়া করবের কইছে।
কিছুক্ষণ বাদে মাধাই দা, লাঠি, দড়িদড়া নিয়ে লকড়ি আনবার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।
তাইলে তুই থাকবি আজ? বাজারে যাবি? রান্নার কী আছে তা আমি জানিনে। তুই কি রান্না জানিস?
ভাবি কলে কিছু লাগবি নে আজ। একটা কথা কব? লাকড়ি আনবের বাঁধে যাও?
হয়।
ছান করিনে অনেকদিন। কও তো আপনার সঙ্গে যাতাম।
তা চল।না হয় লাকড়ির বোঝা তোর মাথায় চাপায়ে দেবো। কিন্তুক অবেলায় ছান করবি?
সুরতুন কিছু না বলে দরজায় কুলুপ এঁটে চাবিটা মাধাইয়ের হাতে দিয়ে তার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো।
পদ্মার তীরে বাঁধ একটি নয়, তিনটি। প্রথমটি জল ঘেঁষে চাই চাই পাথর মোটা মোটাতারের জালে বাঁধা। তার পিছনে প্রায় চার-পাঁচ হাত উঁচু বাঁধ, তারও পিছনে তৃতীয়টি পায়ের কাছে একটি অধিত্যকা। এই অধিত্যকাটুকু শুধু ঘাসে ঢাকা নয়, বাবলা, খেজুর, ঝাউ, বানে ভেসে আসা কলাগাছ, কাশে মিলে ছোটোখাটো একটা জঙ্গল সৃষ্টি করেছে। সে জঙ্গলে খ্যাকশিয়াল থাকে, খরগোস,বুনোকাছিমদু-এক জাতেরবকের খোঁজও পাওয়া যায়। জঙ্গলের মধ্যে ছোটো ছোটো খাদ চোখে পড়ে। বর্ষায় প্রথম বাঁধ ছাপিয়ে দ্বিতীয় বাঁধের মাথার উপর দিয়ে তৃতীয়টির গোড়ায় গিয়ে লাগে জল। বর্ষার পর পদ্মা অনেক দূরে সরে গেলে এই খাদগুলি জলাশয়ের মতো দেখতে হয়। শরতের কাছাকাছি এসে খাদগুলির বেশির ভাগ শুকিয়ে যায়, দু’একটায় জল থাকে, এবং ময়লা থিতিয়ে গিয়ে সে জল টলটল করে।
বাবলা খেজুর প্রভৃতি গাছগুলি বড়ো হলে রেল কোম্পানির সম্পত্তির সামিল হয়, কিন্তু সেগুলির ডালপালা কিংবা ছোটো বাবলা ঝাউ প্রভৃতির খবরদারি করে না কর্তৃপক্ষ। যেসব স্বল্পবেতনের কর্মচারী লকড়ি সংগ্রহের প্রয়োজন বোধ করে, কিংবা ঝাউয়ের বঁটা বিক্রি করে যেসব উটকো লোক তাদের চলাফেরায় জঙ্গলে সরু সরু পথ আছে। অবশ্য এমন নয় যে এ জঙ্গলে কেউ হারিয়ে যেতে পারে, যদিও দু’একদিন লুকিয়ে থাকা যায়।
পথে বেরিয়ে কথাটা মনে হলো মাধাইয়ের কিন্তু সমাধান করতে পারলোনা সে। সুরতুনদের মতো যারা, তারা স্নান করে কোথায়? বুধেডাঙায় থাকবার সময় চৈত্র-বৈশাখ দূরের কথা আশ্বিন-কার্তিকে গ্রামের ডোবাগুলো শুকিয়ে গেলে পানীয় জল সংগ্রহ করার জন্যই দুর্ভাবনা হয়। সেক্ষেত্রে পদ্মায় গিয়ে দৈনিক স্নান দূরে থাক, সাপ্তাহিক স্নানও হয় না। গ্রামের বাইরে কী হয়? আহার্যের ব্যাপারে, নিদ্রার বিষয়ে মাধাইয়ের এই ভূয়োদর্শন যে, ওসবগুলি সকলের জন্য সমান নয়। নানা উপকরণের আকণ্ঠ আহার একদিকে, আর-একদিকে অনাহার;এই দুইয়ের মাঝখানে বহু শ্রেণী, বহু ধাপ, বহু স্তর। কিন্তু মাটির তলায় গঙ্গা, সেই জলও যে সকলের সমান আয়ত্তাধীন নয় এই চিন্তাটা তাকে পেয়ে বসলো।
সে বললো, তোরা ছান করিস কনে?
সুরোও ভাবলো উত্তর দেওয়ার আগে। গ্রামের বাইরে এবং গ্রামের ভিতরে বর্ষার সময় যখন আকাশ স্নান করায় তাছাড়া প্রত্যেকটি স্নানের ব্যাপারই একটা ছোটোখাটো অভিযান। সে বলতে পারতো রাত্রির অন্ধকারে চিকন্দিতে সান্যালদের পুকুরে, কখনো গভীরতর রাত্রিতে স্টেশনে ইঞ্জিনের জল নেওয়ার লোহার থামে, সন্ধ্যার অন্ধকারে এবং ভোররাতে চরনকাশির কোনো জলায়–সে ফতেমা কিংবা অন্য সঙ্গীর সঙ্গে স্নানের অভিযানে যোগ দিয়েছে। একদা টেপির মা সন্ধান দেয় এই বাঁধের জলার। তারপর থেকে সপ্তাহে একবার সে স্নান করে আসছে, কখনো ফতেমার সঙ্গে গিয়ে, কখনো দুপুর রোদের নির্জনতায় একা একা। এত কথা গুছিয়ে বলা যায় না বলে সুরো বললো, করি। আপনের অসুখ বলে এই কয়দিনে একবারও করি নাই।
মাধাই বললো বিজ্ঞের সুরে, ছান না করে থাকিস, খোস-পাঁচড়া হবি।
তা হয় না। গায়ের মরামাসের সঙ্গে ধুলো মিশে এমন একটা আবরণ তৈরি হয়েছে যাকে দ্বিতীয় ত্বক বলা যায়।
সুরতুনের পরিচিত খাদটা পথের ধারেই। কিন্তু সেখানে জল শুকিয়ে গেছে।
তাইলে, বলে সুরতুন মাধাইয়ের দিকে তাকালো।
মাধাই বললো, আরো দূরে একটা না, কয়টাই আছে। বাঁয়ের দিকে চলে যা।
জ্যামিতিক পাহাড়ের মতো সর্বোচ্চ বাঁধটির গায়ে গড়ানে রাস্তা বেয়ে নামতে নামতে মাধাই বললো, বুজ জল দেখলে নামবিনে, তলায় বাবলার কাঁটা থাকতি পারে, জলও ময়লা। ওরই মধ্যে একটায় রেল কোম্পানি কোনো কাজে বালি ঢালছিলো, জল চুমুক দিয়ে তোলা যায়।
আরো কিছুদূর একসঙ্গে গিয়ে পুরো জলাশয়ের খোঁজে চললল, মাধাই শুকনো ডালপালা সংগ্রহের চেষ্টায় গেলো।
সমস্ত অধিত্যকায় দুটিমাত্র মানুষ। মাধাইয়ের দায়ের খটখট শব্দ সুরার কানে আসছে, সুরোর জল ছিটিয়ে স্নানের শব্দও একেকবার মাধাইয়ের কানে যাচ্ছে।
একসময়ে মাধাই ডাকলো, আর ভিজিস না, দিনকাল ভালো না, বর্ষার জমা জলে জ্বরও হয়।
আরো কিছুক্ষণ কাজ চললল। সুরতুন লক্ষ্য করে দেখলো জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে মাধাইকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে,কখনো তার দাসমেত হাত,কখনো পিঠের খানিকটা,কখনোবা মাথার চুলগুলো।
সুরতুন ভিজে কাপড় চিপতে চিপতে বললো, সারা জঙ্গলে লাকড়ি কাটলা, নিবা কেমন করে?
আজ কি আর সব নেওয়া যাবি। পারিস তো তুই কয়খান শুকনা ডাল নে, আমি কিছু নিই। কাঁচা লাকড়িই বেশি, সেগুলো শুকাক, আর একদিন আসবো।
মাধাই সঙ্গে দড়ি এনেছিলো, শুকনো ডালপালার একটা বোঝা বেঁধে সেটাকে কাঁধে তুলে সে চলতে লাগলো, পথে কয়েক বোঝা এমন জমায়ে রাখছি, নিতে হবে।
খানিকটা দূর হেঁটে বোঝা নামিয়ে গুছিয়ে রাখা ডালপালা বোঝায় বেঁধে আবার হাঁটে মাধাই। সুরতুন কখনো দড়ির মাথা ফিরিয়ে দিয়ে, কখনো লাকড়ি তুলে তুলে দেয়।
মাধাই প্রশ্ন করলো, তোকে এক বোঝা বেঁধে দিবো?
দেও।
সামনে মাধাই, পিছনে সুরতুন, দুজনে বোঝা নিয়ে ধীরে ধীরে চলেছে।
একসময়ে সুরতুন বললো, আপনের পায়ের বিষ সারছে?
হয়।
লজ্জিত সুরে সুরতুন বললো, ফতেমা সঙ্গে সঙ্গে দেখবের পায়, আমি সারারাত বসে থাকেও দেখবের পারলেম না।
তুই সারারাত বসে ছিলি?
বোঝার আড়াল থেকে সুরতুনের মুখ দেখা গেলো না।
.
বাসায় ফিরে লাকড়ির বোঝা নামিয়ে সুরতুন তখন তখনই বললো বাজারে যাই, কে, বায়েন?
কী হবি?
তরকারি আনাজ আনা লাগবি, আপনের কষ্ট হবি খাতে।
তুই যেন আজ ফতেমা হলি।
ফতেমাকে সুরতুন ঈর্ষা করে না। সে জানে ফতেমা হওয়া তার পক্ষে সহজসাধ্য নয়। অবশ্য সে যে সব বিষয়েই তার অনুকরণীয় এমনও তার বোধ হয় না। ফুলটুসির ছেলেদের জন্য দেখা হওয়ামাত্র খরচপত্র করা তার কাছে অনেক সময়েই বাড়াবাড়ি বোধহয়। একদিন সেই ছেলেদের প্রয়োজনে ফতেমা কিছু পয়সা চেয়েছিলো তার কাছে, সে দেয়নি; কিন্তু মাধাইয়ের প্রয়োজনে ফতেমা যা করলো তার জন্য সে খুশিই হয়েছে। তবু এখন যেন মাধাইয়ের কথায় একটা বেদনা বোধ হলো তার। সে ভাবলো, অন্যের সম্বন্ধে না হোক সে কি মাধাইয়ের সম্বন্ধেও স্নেহশীলা হয়ে উঠতে পারে না?
সুরতুন বললো, কে বায়েন, কী কষ্ট তা কি কওয়া যায় না?
মাধাই কথাটা শুনে যারপরনাই বিস্মিত হলো। কিন্তু হাসি হাসি মুখে বললো, কষ্ট কই? চল যাই বাজার করে আসি। বাজার করে তোর হাতে দিয়ে ডিউটিতে যাবো, রাঁধে রাখিস।
বাজারের পথে কথা হলো। সুরতুনের মনে পড়লো মাধাইয়ের সঙ্গে আর একদিন সে বাজারে গিয়েছিলো। হাতে পক্ষী আঁকার দিন ছিলো সেটা। ঘটনাটা মনে পড়তে সুরতুন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।
মাধাই বললো, বাজনা শুনছিস? সুরতুন ঠাহর করে শুনলো দূর থেকে একটা বাজনার শব্দ আসছে।
ও কী?
সার্কাস। যাবি একদিন দেখতে?
নিয়ে যাও যাবো।
সুরতুন একা একা তার সামান্য প্রয়োজনের বাজার সওদা করে কিন্তু মাধাইয়ের সঙ্গে বাজারে আসা আর একা বাজারে আসা এক নয়।
একটা ছোটো চায়ের দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাধাই বললো, র’স, একটু চা খায়েনি। তুইও আয়।
মাধাই দোকানটায় ঢুকে গেলো, সুরতুন পথে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের যাওয়া-আসা দেখতে লাগলো। সহসা সে বিস্মিত হলো। চেহারার পরিবর্তন সাধনের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও টেপিকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। বিস্ময়ের কারণটা বেশভূষার বিবর্তন। পুরুষদের মতো পায়জামা আর পাঞ্জাবি, শাড়ির আঁচলের মতো খানিকটা ওড়না জড়ানো টেপিকে দেখে সে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ততক্ষণে কানের কানবালা দুলিয়ে সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে উঁচু গলায় কথা বলতে বলতে টেপি চলে গেছে। তার সঙ্গীর দিকে চাইতে সুরতুনের সাহস হয়নি। গালে গালপাট্টা, মাথায় পাগড়ি, কিন্তু সাহেবের মতো পোশাক।
চাল ডাল তেল কিনে মাধাই বললো, আলাম যখন মাছের বাজারেও ঘুরে যাই, সস্তা হয় নেবোনে।
মাছের বাজারে যাবার পথে কয়েকটা বড়ো বড়ো আধুনিক কায়দার করে সাজানো ঝকঝকে দোকান আছে। সন্ধ্যা হতে তখনো দেরি আছে, তবু কাঁচের শো-কেসে দু’একটি আলো জ্বলতে আরম্ভ করেছে।
সুরতুন মাধাইয়ের পাশে চলতে চলতে বললো, টেপি না?
মাধাই হো হো করে হেসে বললো, মাটির পুতুল। আরো আছে।
কাপড়ের দোকানদার পাঞ্জাবী, বাঙালি ও হিন্দুস্থানী এই তিন পদ্ধতিতে পুতুল সাজিয়ে কাপড়ের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রথাটা এ অঞ্চলে খুব পুরাতন নয়, এসব পথ দিয়ে মুরতুন একা হাঁটতে সাহস পায় না বলেও বটে, এগুলি সুরতুনের দেখা ছিলো না। ব্যাপারটির আকস্মিকতায় ও সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বললো সে, ঠিক যেন দুগ্গা ঠাকুর। মনে মনে সে টেপির সঙ্গেও পুতুলগুলোর রূপের তুলনা করতে লাগলো।
মাছ কিনে মাধাই বললো, তুই এবার বাসায় যা। যা পারিসরাঁধ।আমার যাতে যাতে রাত হবি।
সুরতন ফিরে চললো। কাপড়ের দোকানের সামনে দিয়েই তার পথ। ঠিক সেখানেই একটি বিস্ময়কর ঘটনা আবার ঘটলো। এবার সুরতুন টেপির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো। সুরতুনকে। দেখতে পেয়ে টেপি থামলো না বটে, বললো, ভালো আছিস?
টেপি স্বচ্ছন্দ গতিতে আগে আগে চলছে, পিছনে সুরতুন।
রেশমি পায়জামা, সাটিনের পাঞ্জাবি, নকল বেনারসির ওড়নায় শ্যামা টেপি। পিঠের উপরে দোলানো লম্বা বেণী চকচক করছে ওড়নার তালে।
ধামা-ভরা চাল-ডাল,সুতোয় বাঁধা বোতলে তেল, হাতে মাছের একটা টুকরো; ধামা কাঁকালে বাঁকা হয়ে চলছে সুরতুন। তার পরিধেয় মলিন মোটা সরু লালপাড় ধুতি। চুলগুলিতে আজ ময়লা নেই, কিন্তু তেলের অভাবে লাল হয়ে উড়ছে। তার চৌকো ধরনের মুখে টিকোলো নাক, টানা টানা জ্বর নিচে বড়ো বড়ো চোখ ভয়ে সংকুচিত। কিন্তু তার বাবার নাম ছিলো বেলাত আলি। তার রঙের জেল্লা বিলাতওয়ালাদের মতো ছিলো, এই প্রবাদ। আজ সুরতুনের সদ্যস্নাত ত্বক পথের জনতার মধ্যে অনন্য বোধ হচ্ছে। ধবধবে শাদা নয়, বরং রোদে পুড়ে পুড়ে পাকা খড়ের মতে রঙ।
সুরতুন ভাবলো আশ্চর্য সুখী হয়েছে টেপি। স্বর্গরাজ্যে বিচরণ করে সে। সে স্থির করলো মাধাইকে সে জিজ্ঞাসা করবে কেন দোকানের সম্মুখে অমন পুতুল সাজানো থাকে, আর কেন। টেপি সেই দোকানে যায়।
মাধাই যখন খেতে এলো তখন রেল কলোনীর এই নগণ্য অংশটিতে নিশুতি রাত। তার আগে রান্নার কাজ শেষ করে সুরতুন টেপির কথা ভাবলো, ফতেমার কথা ভাবলো, অবশেষে নিজের কথা। নিজের কথা চিন্তা করতে বসে সুরতুন স্থির করলো সকালে উঠেই সে মহাজনের কাছে যাবে কাজের খোঁজে। বাজারে যে-অঞ্চলে চাল বিক্রি হয় সেখানেও খোঁজ নিয়ে দেখবে চাল কারবারের পরিচিত কাউকে পাওয়া যায় কিনা।বসে খেলে আর কয়দিন। মহাজনের কাছে। কিছু, মাধাইয়ের কাছে আর কিছু জমা আছে; সব জড়ালে, সুরতুন আঙুলে গুনে গুনে দেখলো, তিন কুড়ির কাছাকাছি হলেও হতে পারে; কিন্তু তাতে কদিন যায়। ফতেমার যা-ই হোক, তার নিজের তত অন্যগতি নেই চালের কারবার ছাড়া।
খেতে বসে মাধাই বললো, বেশ তো রান্না শিখছিস।
ফতেমার রান্না দেখলাম যে।
তা ভালোই করেছিস।
আর কোনো কথা নেই।
মাধাই খেয়ে উঠে গেলে, এঁটো পরিষ্কার করে এসে সুরতুন কথা বলার ভঙ্গিতে দাঁড়ালো।
কিছু কবি? গাঁয়ে যাওয়ার কাজ আছে?
না। গাঁয়ে যায়ে কীকরবো।কই যে,বায়েন, এবার কীকরবোকও। ফতেমা চালের মোকামে যাবের চায় না; পুলিস আছে, চেকার আছে, মরণ আছে; কী করি বোঝা যায় না। চাল হলে এদিকেও সস্তা হবি ই সন। খাবো কী?
কেন, তুই গাঁয়ে কী করতি দুভূভিক্ষের আগে। এবার শুনতিছি গাঁয়ে চাষবাস হবি।
সুরতুন বললো, জমি-জিরাত নাই, ধান কুড়ায়ে, বাড়াবানে কয়দিন চলবি। সে সময়ে দিন চলতো না।
হুম। মাধাই বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়ার মতো কথাটা উড়িয়ে দিলো বলতে বলতে, এই তো বেশ আছিস। রাঁধ, বাড়, খা।
বসে বসে খাওয়াবা?
আপত্তি কী? যেকয়দিন চাকরি করি খানা কেন্দুজনের খাওয়া-পরা আমার টাকায় চলে। টাকা দিয়ে আমার আর কোন কাম।
আহারপর্ব মিটলে সুরতুন বারান্দায় তার শয্যা বিছিয়ে নিচ্ছিলো। মাধাই বললো, আজ ফতেমা নাই, একা বাইরে শুবি কেন্।
কথাটায় সুরতুন বিস্মিত হলো। বহুদিন তারা বারান্দার আশ্রয়ে কাটিয়েছে। সব সময়েই ফতেমা থাকেনি। সে একা এই বারান্দায় অনেক শীত বর্ষার অন্ধকার রাত্রি কাটিয়েছে।
সুরতুন বললো, আমার কাঁথা পাটি ময়লা, কালো।
মাধাই হাসিমুখে বললো, তা ঠিক বলছিস, আমার ঘর সাহেবদের মতো মার্বেলের তৈরি। অবশ্য পরে নিজেই সে ভেবে পেলো না এতখানি আগ্রহ কেন সে দেখালো। নিজের মনের একটি অংশে এদের একান্ত আপনার বলে ভ্রম হচ্ছে। যেমন আকস্মিকভাবে হয়েছিলো একটা করুণার বোধ ফুলটুসির ছেলেদের দেখে।
পরদিন সকালে মাধাই বললো, আজ গাঁয়ে পলাবি নাকি?
না।
না যাস ভালোই হবি। রাত্তিরে সার্কাসে যাবোনে। সে যে কী জিনিস!
আচ্ছা।
তাইলে পলাসনে কৈল।
দুপুরের আহারাদির জন্য মাধাই ফিরবে। এখন সে ডিউটিতে গেছে। সুরতুন বসে চাল ঝাড়ছিলো। নিজের রান্নার সময়েও ফতেমা চাল ঝেড়ে পরিষ্কার করে নেয়। সুরতুন নিজের বেলায় অত হাঙ্গামা করে না। কিন্তু মাধাইয়ের জন্যও রান্না করতে হবে, সুতরাং একটু সতর্ক হতে হয়।
পায়ের শব্দে চোখ তুলে চেয়ে সুরতুন অবাক হয়ে গেলোসামনে দাঁড়িয়ে টেপি।শাদামাটা রঙিন একটা শাড়িতে তাকে গত সন্ধ্যার মোঝকঝকে দেখাচ্ছে না। চোখের কোলে অস্বাস্থ্যের কালো চিহ্ন। কিন্তু তবু তাকে বড়োঘরের ঝি বউয়ের মতো দেখাচ্ছে। হাতে সোনার চুড়ি, গলায় সোনার হার, এসব তো আছেই, পায়ে জুতোও আছে। বলা বাহুল্য, সোনা গিলটির তফাত জানতো না সুরো।
টেপি ভূমিকা না করেই বললো, তোর কাছে এক কাজের জন্যে আলাম। আমাকে একটু ওষুধ আনে দিতে হবি।
আমি? কও কী? আমি কি চিনি, কনে যাবো?
আমি তোকে দোকান দেখায়ে দিবো, টাকা দিবো।
তুমি নিজে যাও না কেন্? তুমি তো বাজারে ঘুরে বেড়াও। লোকের সঙ্গে কথা কও। কিন্তু ওষুধ কেন, কার অসুখ?
অসুখ না, ওষুধ আমারই লাগে।
সুরতুন ঘরের দরজায় চাবি দিয়ে টেপির সঙ্গে বার হলো।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে টেপি বললো, কাল তোকে মাধাইয়ের সঙ্গে বাজারে দেখে মনে হলো তোর কাছে আসার কথা।
টেপির কথায় সুরতুনের মনে একটু সাহস হলো প্রশ্নটা করার। প্রশ্নটা তার মনে কিছুক্ষণ। থেকে উঁকি দিচ্ছিলো। সে বললো, অমন মেমসাহেবের মতো সাজে কাল কনে যাওয়া হইছিলো?
টেপি সুরতুনের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কী ভেবে নিয়ে বললো, তোকে কওয়া যায়। আমি আর চেকারের কাছে থাকি না। কাল যাক দেখছিস সে চেকার না।
টেপির প্রাণের ভিতরে কথাগুলি পুঞ্জীভূত হয়ে বহিঃপ্রকাশের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। বলার লোক প্রতিবেশীদের মধ্যে নেই। সুরতুনের প্রশ্নে প্রকাশের বাধাটা দূর হতেই টেপি বলতে লাগলো, চেকার বদলি হয়ে গেছে তিনদিন হয়। যাবার সময় আমাকে বেচে দিয়ে গেছে। এক দোকান থিকে আমার জন্যে কাপড় জামা গয়না কিনতো। সাতশো টাকা ধার হইছিলো। তার যাওয়ার দিন দোকানের লোক আসে উপস্থিত। অনেক কথাবার্তাকয়ে শেষ পর্যন্ত দোকানদারের কাছে টাকার বদলে আমাকে জমা রাখে গিছে। ফিরায়ে নিবি মনে হয় না। কী করি কও, সুরে। দোকানদার পাঞ্জাবী। কেন যে কান্না পায়, ঘিন্না ঘিন্না করে।কাল পাঞ্জাবী সাজে বার হইছিলাম। চেকার গিছে আপদ গিছে, কিন্তুক, কও সুরো, কওয়ামাত্র অন্য আর একজনেক ঘরে আসবের দেওয়া যায়?
টেপির অজ্ঞাতসারে তার কথাগুলি বাষ্প গাঢ় হয়ে যাচ্ছিলো। সুরতুনের কাছে স্পষ্ট হলো না সবটুকু, তবু সে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইলো–দেখো দেখি মানুষ নাকি বেচা যায়!
টেপি বললো, আমি সময়ে যা পারবো, আজই তা পারবো কেন্। আমার এক বুড়ি পড়শি কইছে এই ওষুধ আনে মসুরদানার সমান হালুয়ায় মিশায়ে খাওয়ালে পুরুষ ঘুমায়ে পড়ে।
দুজনে নীরবে পথ অতিবাহিত করতে লাগলো। টেপির সমস্যা ফতেমা বুঝতে পারতো হয়তো, হয়তোবা সে আন্দাজ করতে পারতো টেপি আফিম কিনতে যাচ্ছে এবং এ পদ্ধতি যে কতদূর বিপজ্জনক তাও বলতে পারতো। সুরতুন টেপির জন্য একটা অনির্দিষ্ট সমবেদনা অনুভব করলো শুধু।
দূরে দাঁড়িয়ে আফিমের দোকান থেকে সুরতুনের হাত দিয়ে রতি-ভর আফিম কিনলো টেপি।
ফিরবার পথে টেপি বললো, সুরো, তুই আজকাল মাধাইয়ের কাছে থাকিস?
হয়, আছি কয়দিন।
টেপি একটু ইতস্তত করে বললো, সাহস হয়, একটা দুটো ছাওয়াল মিয়ে চায়ে নিস। মনে। কয় এমন করে তাইলে মিয়েছেলেক বেচে দেওয়া যায় না।
.
রাত্রিতে সার্কাস দেখার কথা ছিলো, সুরতুন তা ভুলে গিয়েছিলো। টেপির চালচলন কথাবার্তা কতবার যে সে ভাবলো তার ঠিক-ঠিকানা নেই। মাধাই সকাল সকাল ডিউটি থেকে ফিরে বললো, কি রে, রান্না হয়েছে?
সুরতুন তখনো উনুন ধরায়নি, সে বিব্রত মুখে বললো, ভাত নামাতে আর কত বেলা। আপনে ঘরে বোসো, এখুনি হবি।
কেন, সার্কাসে যাবি না?
যাবো। সে কী?
বাঘ সিংহ মানুষের কত খেলা।
কৌতূহলের চাইতে সুরতুনের বিস্ময়ই বেশি। সে বললো, আচ্ছা আমি উনুন ধরাই। মাধাই ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে সুরতুনের কাজকর্ম লক্ষ্য করতে লাগলো। একসময়ে সে বললো, তুই রান্না শেষ কর, আমি আসি।
মাধাই যখন ফিরে এলো ততক্ষণে সুরতুনের ভাত নেমেছে।
মাধাই খেয়ে উঠে বললো, আমার সিগারেট শেষ হতে হতে তোর খাওয়া হওয়া চাই।
সুরতুন হাঁড়িকুড়ি তুলে রেখে সামনে এসে দাঁড়াতেই মাধাই তাকে একটা কাগজে-মোড়া পুটলি দিয়ে বললো, কাপড় জামা আছে, পর।
সুরতুনের পরিহিতখানা পুরনো হলেও জীর্ণ নয়, কাপড়ের কথায় সে বিস্মিত হলো। জামা সে জীবনে কখনো গায়ে দিয়েছে বলে তার জানা নেই। টেপি গায়ে দেয়। ফতেমার যখন সুদিন ছিলো তখন তার গায়ে সে দেখেছে বটে। কিন্তু দুর্দান্ত শীতের দিনেও সুরো বড়োজোর গায়ে কাপড়ের উপর কাপড় জড়িয়েছে, জামা পরার দুঃসাহস তার হয়নি।
তাকে ইতস্তত করতে দেখে মাধাই বললো, যা, যা, দেরি করিস নে। খেলা আরম্ভ হয়ে যাবি।
কাপড় জামা নিয়ে সুরতুন বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। কাপড় পাল্টে জামা হাতে করে সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে।
কী রে, দেরি কী? চুল আচড়াবি নে?
সুরতুন অন্ধকার বারান্দা থেকে ভয়সংকীর্ণ গলায় বললো, জামা না পরলে হয় না? পরবের জানি নে।
আ-হা! মাধাই বিরক্ত হলো, এদিকে আয়। দুই হাতায় হাত ঢুকা, ধুর, ওরকম না।
অবশেষে মাধাই উঠে গিয়ে জামা পরিয়ে দিলো, পয়লা নম্বর বোকা তুই! নে এবার চুল আঁচড়া।
চুল আঁচড়ানোর সমস্যা কী করে সমাধান হবে সুরতুন ভেবে পেলো না। সে মুখ নিচু করে ভীতস্বরে বললো, কাকই নাই।
কী আছে!
দেয়ালের গায়ে বসানো একটা ছোটো তক্তা থেকে মাধাই তার চিরুনি নামিয়ে দিলো।
নে তাড়াতাড়ি সারে নে। বলে মাধাই নিজের পোশাক পালটাতে লাগলো।
জট পাকনো ময়লা চুলে চিরুনি বসাতেই সংকোচ হলো সুরতুনের, আঁচড়াতে চুল ছিঁড়ে ব্যথা লাগতে লাগলো, তাও সহ্য হচ্ছিলো কিন্তু পটপট করে দু-তিনটে চিরুনির দাঁত ভেঙে যেতেই সুরতুন ভয়ে মুখ কালো করে বললো, থাক বায়েন, আর আঁচড়াবো না।
চল তাইলে। ম্লান আলোকে মাধাই সুরতুনের চোখের জল দেখতে পেলো না।
দরজায় তালা ঝুলিয়ে মাধাই বললো, যদি তোর চুল কোনোদিন আর ময়লা দেখি নাপিত ডাকে কাটে দেবো। বাঁধে যায়ে চুল ঘষে আসবি কাল।
তখনো সার্কাসের দ্বিতীয় প্রদর্শন শুরু হতে দেরি আছে। অন্ধকারে গলিপথ দিয়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি হেঁটে সার্কাসের আলোকোজ্জ্বল তাবুর কাছাকাছি এসে মাধাই বললো, ওই দ্যাখ।
আলোর চাকচিক্য, তাঁবুর আয়তন ও পরিধি, লোকজনের চলাচল দেখে সুরতুন হকচকিয়ে গেলো।
মাধাই বললো, টিকিট কাটে ওই তাঁবুর মধ্যে ঢুকবো। খেলা শেষ হলে যে-দরজায় তুই এখন ঢুকবি সেখানে দাঁড়ায়ে থাকবি, আমি আসে নিয়ে যাবে।
টিকিটঘরে টিকিট কেটে মাধাই বললো, দাঁড়া, পান খায়ে নিই।
সার্কাসের সামনে যেমন বসে, সস্তা কাঁচের দুতিনখানা বড়ো বড়ো আরসি দিয়ে সাজানো ডেলাইট-জ্বালা লালসালুতে উজ্জ্বল তেমনি একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালো মাধাই।
পান খাবি তুই? মাধাইয়ের প্রশ্নে আশেপাশের লোক ও দোকানদার সুরতুনের দিকে চাইলো। সুরতুন লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে অস্ফুট স্বরে বললো, না।
‘না’ বলার সময়ে মুখ নামিয়ে নিলেও সুরতুনকে বার বার চোখ তুলে চাইতে হলো। পানের দোকানে কোনাকুনি করে বসানো আরসিগুলোতে সুরতুনের একাধিক প্রতিচ্ছবি পড়েছে। অন্ধকারে কাপড়-জামা পরার সময়ে এ যে কল্পনা করাও যায়নি। নীল জমিতে সবুজ ডুরের জোলার শাড়িতে, নীল চকচকে ব্লাউজে একটি সুন্দরী মেয়েকে বারংবার দেখে সুরতুন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলো যেন।
সার্কাসের তাবুতে ঢুকে খেলা আরম্ভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজের রূপের প্রাবল্য তার নিজের রক্তেই যেন জোয়ার এনে দিলো। আয়নায় দেখা তার প্রতিচ্ছবির অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সে যেন মনের মধ্যে খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলো। লজ্জাও হলো। মাধাই কি দেখেছে তাকে? টেপির মতোই তাকে দেখাচ্ছে না?
সার্কাসের কোনো খেলাই সুরতুন দ্যাখেনি। তার বিস্ময় ও ভয়মিশ্রিত সমবোধ একসময়ে তাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল। খেলার অবসরে এদিকে-ওদিকে চেয়ে সে পুরুষদের গ্যালারির মধ্যে মাধাইকে আবিষ্কার করলো। আর যেখানে লালসালুর ঘেরের মধ্যে পুরুষ ও মেয়েরা চেয়ারে বসেছে তার মধ্যে টেপিকে দেখতে পেলো গালপাট্টাওয়ালা এক সাহেবের পাশে। টেপি তাহলে সাহেবকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারেনি। ঠিক এমন সময়ে দুটি সিংহের হাঁকডাকে সে আবার সার্কাসের দিকে মন দিলো।
খেলা শেষ হলে মাধাই এসে সুরতুনকে ডেকে নিলো। সুরতুনের হুঁস হলো তখন। দুর্দান্ত পশুগুলির হাঁকডাক দাপাদাপি, পুরুষ খেলোয়াড়দের সুগঠিত দেহ, নারী খেলোয়াড়দের প্রকাশীকৃত দৈহিক আবেদন, গভীর রাত্রির তীব্র আলো–এসব মিলে তার মনে অভূতপূর্ব এক উন্মাদনা এনে দিয়েছিলো। তার স্নায়ুগুলি আতপ্ত হয়ে উঠেছিলো।
এবার অন্ধকার পথ ধরে তাড়াতাড়ি চলার দরকার ছিলো না। মাধাইয়ের পিছনে বড়োরাস্তা দিয়ে চলতে চলতে সুরতুনের আবার মনে পড়লো নিজের প্রতিচ্ছবির কথা। সেই প্রতিচ্ছবির পাশে সার্কাসের মেয়েদের ছবি ভেসে উঠলো। ট্যারা চোখে সুরতুন নিজের শাড়ির আঁচলটা আর একবার দেখে নিলো। মাধাইয়ের কাজের অর্থ সে বোঝে না, বুঝবার চেষ্টায় মাধাইকে কোনদিন প্রশ্নও সে করেনি। মাধাই যে তাকে অত্যন্ত স্নেহ করে এটার চুড়ান্ত প্রমাণই যেন। আজ সে পেলো।
তারপর তার টেপির কথা মনে হলো। টেপি তার সঙ্গীটিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলো, কিন্তু পরে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়েছে। টেপির আজকের সজ্জা অন্যান্য দিনের চাইতে অধিকতর উজ্জ্বল। এ কি কখনো হতে পারে টেপিকেও নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে ওই সাহেবটি। সাহেবের মেজাজ তো! সে কি আর টেপির মতো একটি মেয়েকে সাজিয়ে দেয়। যখন মাধাই তাকে জামা পরিয়ে দিয়েছিলো তখন মাধাইয়ের উপস্থিতির ভয়ে সুরতুন ত্রস্ত। এখন মাধাইকে তেমন ভয়ংকর বোধ হলো না। ফলে, সেই জামা পরার ঘটনাটা মনে পড়ে সুরতুনের শরীর থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। মাটিতে যেন পা সোজা হয়ে পড়বে না। সার্কাসের সময়ের অনুভবগুলি জড়িয়ে গেলো এই কাঁপুনির সঙ্গে। টেপির জীবনের কথাও মনে পড়তে লাগলো।
ঘরের কাছে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সুরতুন কী হবেকীহবে এই ভয়ে অস্থির হয়ে ইতিউতি করতে লাগলো। তার সহসা মনে হলো টেপি যেমন ওষুধ কিনেছিলো তেমন কিছু আরও সংগ্রহ করা দরকার। টেপিকে যেমন ওরা সাজায় তেমনি তো সাজিয়েছে মাধাই তাকেও।
মাধাই দরজা খুলে তার চৌকিতে বসে জুতো জামা খুলে বললো, জামা রাখ, একটু জল দে, খাই।
সুরতুন জল গড়িয়ে দিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
মাধাই বিছানায় শুয়ে বললো, এখন আর কী, ঘুমা গা যা। কাল মনে করিস মাথায় দেওয়ার তেল আনে দেবো। তোরা আমার কেউ না, কিন্তুক তোরা ছাড়াই বা কে আছে আমার।
বাইরের অন্ধকারে জামাকাপড় পাল্টে সুরতুন কোথায় রাখবে বুঝতে না পেরে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক করছে। সে ভেবেছিলো মাধাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাধাই বললো, রাখ, আমার জামার পাশেই রাখ। কাল তোর জন্যি দড়ির আলনা করে দেবো। কিন্তুক ময়লা হলে চলবি নে।
বিব্রত সুরতুন কিছু না বলে বাইরে চলে গেলো।
পরদিন সকালে সুরতুন ঘর ঝাট দিচ্ছে, মাধাই কলে জল সংগ্রহ করতে গেছে, এমন সময়ে টেপি এলো৷ এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে টেপিবললো, মাধাই কনে?নাই তো? তোমাক একটা কথা বলবের আসলাম।
কও না।
কাল যে-ওষুধ কিনছিলাম তা কৈল কাউকে কবা না, মাধাইকেও না।
কে, কী হলে?
ও বিষ। কাউকে খাওয়ালি সি ঘুমাতেও পারে, মরবেরও পারে।
সব্বোনাশ!
একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো টেপির। সে বললো, তা ভাই, তুমি সাক্ষী থাকলা। এই দ্যাখো যতটুক্ কিনছিলা ধরাই আছে। তুমি নিজে হাতে নিয়ে ফেলায়ে দেও।
তুমি ফেলায়ে দেও, তাইলেই হয়। তুমি তো তাক বিষ দিবের চাও নাই।
সুরতুনের ইচ্ছা হলো সে টেপিকে প্রশ্ন করে তার নতুন সঙ্গীটির সম্বন্ধে; কিন্তু কথা সংগ্রহ করতে পারলো না।
এমন সময়ে দু-হাতে দুবালতি জল নিয়ে মাধাই এলো। ঘরে জল রেখে ফিরে এসে বললো, টেপি যে? অনেকদিন পরে আলি।
খুব মিষ্টি হেসে টেপি বললো, আলাম। তুমি ভালো আছো?
তোর মা কনে? বাঁচে আছে?
আছে, চালের কারবার করে না। কাছেই এক গাঁয়ে বসছে।
গাঁয়ে বসে কী করে?
একজন শুনালো। ভাবে মনে হলো মালা বদল করছে কারো সাথে। একটু হেসে টেপি বললো আবার, আমরা বোষ্টম।
নতুন সংসার দেখবের যাবা, কেমন?
না। মনে কয়, দূরে থাকে সেই ভালো। মাকে দেখবের চালেও গাঁজা-খাওয়া বোষ্টমদের সঙ্গে থাকবের পারি নে।
কথাটা কৌতুকের বলে মনে হতে পারে, কিন্তু টেপির বেশভূষা ভঙ্গির দিকে লক্ষ্য করে মাধাইয়ের অনুভব হলো, টেপির যে মা মাথায় গামছা বেঁধে পুরুষদের দলে বসে গাঁজা খেতে খেতে অশ্লীল রসিকতা করতে পারে, টেপির বর্তমান অবস্থা তার থেকে অনেক পৃথক। এমনকী তার এই রেল কোম্পানীর ঘর, হীন অবস্থার কোনো গ্রাম্য চাষীর কুড়ের তুলনায় যত পরিচ্ছন্নই হোক তার পটভূমিকাতেও টেপিকে যেন অসংগতভাবে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। যেন সে অন্য কোনো লোকের অধিবাসী।
মাধাই প্রস্তুত হয়ে এসে বললো, ডিউটিতে যাবো।
টেপি বললো, চলো একসাথে যাই।
খানিকটা দূর চলে মাধাই বললো, তাইলে তুই ভালোই আছিস আজকাল।
তা আছি। তুমি কেমন আছো, দাদা?
মাধাই প্রশ্নের সুরটিতে এবং তার চাইতেও বেশি সম্বোধনটিতে বিস্ময় বোধ করলো। টেপির কথাবার্তায় পরিবর্তন হয়েছে। এর আগে কোনোদিন কারো কাছে এমন সম্বোধন সে শোনেনি।
পথ চলতে চলতে ধীরে ধীরে বললো মাধাই, আমার আর ভালো মন্দ কি আছে? আছি–আছি।
কিন্তু টেপি তো সুরতুন নয়, সে বললো, বিয়ে করা, সংসার করো।
মাধাই রসিকতার সুরে বললো, তুই তাইলে কন্যে খোঁজ।
তা পারি, তুমি কও যদি আমি ভালো লোক দিয়ে কন্যের খোঁজ আনতে পারি।
খানিকটা নীরবে চলে আবার বললো টেপি, স্বজাত বিয়ে করাই ভালো, তা যদি না মানো এক কন্যের খোঁজ আমার আছে। এমন রূপ দেখলে চোখ ফেরা যায় না, কিন্তু বি-যত্নে ছাই ঢাকা।
মাধাই হাসি হাসি মুখে বললো, কেন্ রে, দিগনগরের মিয়ে? যারা চিকন চিকন চুল ঝাড়ে।
মস্করা করি নাই, দাদা। ঘরেই চোখ চায়গা, আজ কয়ে গেলাম।
আহত এবং ক্লিষ্টের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে সমবেদনার আশ্রয় খোঁজা। মাধাই একসময়ে অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করে সংঘের কাজের আড়ালে আত্মগোপনের চেষ্টা করেছিলো। তার নিজের জীবনটাকে অর্থহীন বোধ হতো, তাই সংঘের কাজ করে, কাজের লোক হয়ে জীবনের ফাঁকিটাকে সে ভরে তুলতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেছিলো, ওটা বিদ্বেষের পথ, জীবন আরও ফঁকা হয়ে যায় ওপথে। নেশার মতো। যতক্ষণ বেহুস ততক্ষণ ভালো, হুঁস এলেই ঘৃণা। হঠাৎ এলো ফতেমা। পুরনো সুরতুন আর ফতেমার সান্নিধ্যে সে সমবেদনার একটু ছোঁয়াচ পেলো। পৃথিবীর অন্য সব লোকের চাইতে এরা তার বেশি পরিচিত। এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সময় কাটানোর সময়ে অন্য কোনো কথা মনে থাকে না। আর এদের অভাব পূরণ করা, যা সে আগেও করতো, এমন একটা কাজ যাতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা যায়, অথচ যা ক্লান্তি আনে না। মাধাই স্থির করলো নিজের উপার্জনের কিছুটা সে ফতেমা-সুরতুনের জন্য ব্যয় করবে এবং সেটা তার ভালো লাগবে।
টেপির পাশাপাশি চলতে, চলতে একটি সুঘ্রাণ পাচ্ছিলো মাধাই, যে সুঘ্রাণ আকর্ষণ করে। মাধাইয়ের দয়াস্নিগ্ধ মনে এই কথাটা উঠলো, যখন টেপি আর সুরতুন চালের ব্যবসা করতো সুরতুনকে টেপির তুলনায় হীন বলে বোধ হতো না, এখন যেমন হয়। পুরুষের আদরে টেপির এই পরিবর্তন। মাধাই ভাবলো, সাবান এসেন্স কাপড়চোপড়ের পরিচ্ছন্নতা এমন কিছু কিছু ব্যাপারে সে লক্ষ্য রাখবে। সেদিন ডিউটি সেরে ফিরবার সময়ে মাথায় দেওয়ার তেল ও একটা সাবান কিনলো মাধাই। মধ্যবিত্তের চোখে সেগুলো নিচের স্তরের হলেও মাধাইয়ের চোখে তেমনটা নয়।
দিবানিদ্রা সেরে উঠে মাধাই বললো, মনে কয় যে লাকড়ি কাঁচা কাটে রাখে আসছিলাম তা শুকাইছে।
আনবের যাবা?
তা যাওয়া যায়। তুইও চল না কেন ছান করে আসবি।
সুরতুন খুব একটা প্রয়োজন বোধ করছিলো না স্নানের। মাধাই ঘুমুলে ঘরে তোলা জলে হাঁড়িকুড়ি ধোয়ার সময়ে হাত পা ধুয়ে নিয়েছিলো, আঁজলা করে করে জল তুলে মাথায় চাপড়ে চুল ভিজিয়ে নিয়ে, ভিজে আঁচলে চোখমুখ মুছে নিয়েছিল। কিন্তু সে সময়েই সে স্থির করেছিলো এখানেই যদি থাকতে হয়, ভোরে রাত থাকতে বাঁধের জলে মাঝে মাঝে স্নান করতে যাওয়া যায় কিনা মাধাইকে তা জিজ্ঞাসা করে নেবে–কিংবা রাত দশটায় যখন শেষবারের মতো রাস্তার কলে জল আসে তখন সেটা ব্যবহার করা যায় কিনা।
চলো, তা যাই।
এক কাজ কর, ঘরে তেলের শিশি আর সাবান আছে, তা আন। নতুন কাপড়জামা আন।
সুরতুনকে প্রায় জলের ধারে পৌঁছে দিয়ে মাধাই তার আগের বারের কাটা লকড়ির খোঁজে গেলো। সুরতুনের হলো মুশকিল।না পারে তেলের শিশি খুলতে, না পারে সাবান মাখতে সাহস করে। খানিকটা বাদে মাধাই নিজেই এলে।
কি রে, বসে আছিস?
সুরতুন তেলের শিশিটা দেখিয়ে মুখ নিচু করে হাসলো।
খুলবের পারিস নাই?
খুলতে মাধাইয়েরও জোর লাগলো, পকেট থেকে ছুরি বের করে তার সাহায্য নিতে হলো।
এক কাজ কর, চুলে অনেক ধুলা আছে। সাবান দিয়ে মাথা ঘষে নে।
কী কাম?
কলাম ঘষে নে। ময়লা থাকে লাভ কী?
সুরতুন নিজের মাথা ঘষার কাজটা জীবনে করেনি। গ্রামে থাকার সময়ে কোনোদিনই তার এসব কথা খেয়াল হতোনা। চালের কারবারে বেরিয়ে বরং একবার সে মাথা ঘষেছিলো, যেদিন মোকামের ছোটো নদীটিতে সন্ধ্যাবেলায় তারা দল বেঁধে স্নান করতে নেমেছিলো ট্রেন ফেল করে অন্য কিছু করার ছিলো না বলে। ফতেমা সেদিন অনেকটা সময় ধরে তার মাথা ঘষে দিয়েছিলো।
কী হলো? মাধাই প্রশ্ন করলো।
আমি জানি নে।
তখন সুরতুনকে শিউরে দিয়ে, ভয়ে দিশেহারা করে দিয়ে মাধাই তার ঝাকড়মাকড় চুলগুলো আর সাবান নিয়ে দু’হাতে মাজতে বসলো। একটি অনভ্যস্ত পুরুষ যেমন পারে তেমনি করে চুল ঘষে ঘষে পরিচ্ছন্ন করে মাধাই বললো, এবার গায়ে সাবান মাখে ডুব দিয়ে নিয়ে চুল ঝাড়ে মাথায় তেল দিস। আমি লাকড়ি বাঁধে আনি।
মাধাই ফিরে এসে দেখলো সুরতুনের স্নান হয়ে গেছে। পরিচ্ছন্ন জামাকাপড়ে একুপিঠ ফাপানো চুলে সুরতুনকে যেন চেনাই কঠিন।
মাধাই বললো, তোর ছাড়া-শাড়ি কী করলি, ধুয়ে নিয়া কাম নি। যে ময়লা, ও আর পরেও কাম নি।
কী করবো?
পা দিয়ে ঠেলে জলে ফেলে দে।
সামনে সুরতুন, পিছনে মাধাই। লকড়ির ভারে মাধাই হেঁট হয়ে চলছে কিন্তু ইতিমধ্যে মাধাই সুরতুনকে লক্ষ্য করেছে কয়েকবার।
সে বললো, কাপিস কেন?
জার লাগে।
তা জার একটু লাগবের পারে। অবেলায় সাবান ঘষা তো।
একটু চুপ করে থেকে সুরতুন বললো, কাপড় ফেলায়ে দিলাম ‘আবার কিনলি হবি। টেপির মতো গয়না দিবের পিরবো না, সিল্কের শাড়িও না। জোলাকি এক-আধখান ধারে হলিও কিনে দিবো। ক’ আমার যে টাকা তার কিছু হলে তোর চলে কিনা।
ঘরে ফিরে মাধাইয়ের কথামতো চুল আঁচড়ে সিঁথি কেটে সুরতুন যখন ঘরময় কাজ করে বেড়াতে লাগলো মাধাইয়ের বিস্ময় বোধ হলো এই ভেবে, এমন রূপ এমন গঠন কোথায় লুকানো ছিলো। লক্ষ্য করার মতো মনের অবস্থা তার ছিলো না,নতুবা অন্তত একটা আভাসের মতো মাধাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো সুরতুনের দৈহিক দিকটা। অনাহারে যে কাঠি কাঠি কাঠ কাঠ হয়েছিলো, চালের ব্যবসায়ের শত কষ্ট সত্ত্বেও নিয়মিত আহার পেয়ে সে তেমনটা আর ছিলো না। একটা মালিকানা বোধও হলো তার। এই দেহটির কী দুরবস্থা হয়েছিলো অনাহারে। পিঁপড়ে ঢাকা মৃতদেহের মতো সুরতুনকে কুড়িয়ে এনেছিলো সে। সে ছাড়া আর কেউ সুরতুনকে এমন করে সাজাতে এগিয়ে আসেনি অন্তত এ কথাটা তো ঠিক। কাজের এক অবসরে সে সুরতুনকে ডাকলো।
কী কও?
লাইন-দেখা রেল কোম্পানির আলোটা তুলে সুরতুনকে মাধাই যেন পরীক্ষা করলো। নিজের ঘরে তেমন বড় আরসি ছিলো না যে তার সম্মুখে সুরতুনকে দাঁড় করাবে। মাধাই ভাবলো, ও কি বুঝতে পারে ওকে কেমন দেখায়। স্বাস্থ্য ও দেহবর্ণ কথা দুটির প্রয়োগ করতে না পারলেও মাধাই অনুভব করলো টেপির চাইতেও সুরতুন গরীয়সী। এমন পরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে সুরতুন কি মালবাবুর সেই সুকন্যে না কী তার নাম, তার মতোই হবে না?
মাধাইয়ের উপলব্ধি হলো জীবনের শূন্যতা পূর্ণ হয়ে উঠবে। সুরতুনকে নিয়ে এই খেলা তার মুখে যেন স্বাদ এনে দিলো।
কিন্তু যারা মনের গোপন তথ্য নিয়ে বহু আলোচনা করতে অভ্যস্ত তারাও কি মনের গতি নির্ধারণ করতে পারে?মনের কোনো হদিসই যার জানা নেই সেই মাধাই পোর্টার কীকরে জানবে তার মনে কোন রূপটি তার ব্যবহারে কখন আত্মপ্রকাশ করে বসবে। আমি কর্তা, আমি অভিভাবক, আমার প্রাচুর্য থেকে দান করে ওকে ধাপে ধাপে একটি স্বছন্দ জীবনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি, এই ছিলো তার অনুভব। এবং এরই ফলে তার হৃদয় আতপ্ত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু আর একটি বিষয়ের দিকে তার নজর ছিলো না। মলিন সুরতুনকে দেখে যা কোনোদিন হয়নি তেমনি একটা কামনা সংগোপনে তার চেতনার অজ্ঞাতে বেড়ে উঠেছিলো তার সন্ধান সে কখনন রাখেনি। প্রকাশের মুহূর্তেও তা তার চেতনায় পরিস্ফুট হলো না। ইতিমধ্যে সুরতুনের জন্যে সে একজোড়া রোল্ড গোল্ডের বালা এনে দিয়েছে, চোখে দেবার সুর্মাও।
সুরতুন প্রসাধনের আর কিছু জানতো না, কিন্তু সুমা দেওয়া জানতোবোধ করি তাদের সমাজে পুরুষরাও পালে-পার্বণে সুমা ব্যবহার করে বলে। সে রাত্রিতে আবার সার্কাসে যাবার কথা ছিলো, পৃথক আসনে না বসে আজ কাছাকাছি বসার কথা। সুরতুন নিজেই আজ সেজেছে। রান্না শেষ করে মাধাই ডিউটি থেকে ফেরার আগে চুল বেঁধে, চোখে সুর্মা দিয়ে সুরতুন প্রস্তুত হয়েছিলো। সার্কাসে যাবার জন্য পোশাক পরে ফিরে দাঁড়িয়ে সুর্মা-আঁকা চোখজোড়া দেখে মাধাই যেন তারই আকর্ষণে এগিয়ে গেলো সুরতুনের দিকে। আকস্মিক দুর্দম্য কামনায় মাধাই সুরতুনের সুগঠিত অবয়ব ছাড়া অন্য সবই বিস্মৃত হয়ে গেলো।
উদ্বেল অবস্থাটা কেটে গেলে মাধাই লক্ষ্য করলে সে তখনো ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, যে কুপিটা দরজার কাছে ছিলো সেটা ছিটকে পড়ে খুলে গিয়ে দপদপ করে জ্বলছে। সুরতুন নেই। মাধাই ধোঁয়ায় ও কেরোসিনের গন্ধে বিরক্ত হয়ে জুতোসুদু পায়ের চাপ দিয়ে কুপিটি চটকে লেপটে আগুনটা নিবিয়ে দিলো।
মাধাইয়ের ঘর থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে অন্ধকার পথে দিশেহারা হয়ে ছুটে সুরতুন কলোনির প্রান্তসীমায় এসে পড়েছিলো। কিন্তু এ জায়গাও যেন যথেষ্ট গভীর আশ্রয় নয়।সুরতুন উঁচু বাঁধের মাথার উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। একবার তার মনে হলো বাঁধের নিচের জঙ্গল লুকানোর পক্ষে ভালো, কিন্তু তার মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন একটা শিয়াল খ্যাক খ্যাক করে তাকে ভয় দেখালো। গতি দ্রুততর করে চলতে চলতে সুরতুনের মনে হলো, এই বাঁধ যেখানে গিয়ে ব্রিজের নিচে লেগেছে তার কাছে কতকগুলি কুটির আছে। প্রায় একবছর হলো সেগুলি খালি পড়ে আছে, বাঁশের গায়ে বিলেতিমাটি বসানো দেয়ালগুলি ভেঙে পড়েছে, সেগুলির প্রতি এত অযত্ন। সুরতুনের বোধ হলো, ঐরকম একটা ঘরে গিয়ে যদি দরজা বন্ধ করে দিতে পারে তবে সেই নিচ্ছিদ্র আবরণে সে নিশ্চিন্ত হবে।
ঘরগুলির কাছে এসে একটু ভয় ভয় করলো তার। সে শুনেছিলো এগুলি এক সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিলো। তারা চলে গেছে বটে, কিন্তু তাদের উত্তরাধিকারী কি কেউ নেই? যতদূর সম্ভব নিশব্দে এবং একটি মানুষের পক্ষে নখ ও দাঁতকে যতখানি প্রস্তুত রেখে এখোনো সম্ভব তেমনি করে চলে একটি ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় সে লক্ষ্য করলো সেই গভীর অন্ধকারে কোনো মানুষের সাড়া পাওয়া যায় কিনা। ক্রমশ সাহস সঞ্চয় করে সে ঘরটিতে প্রবেশ করে হাতড়ে হাতড়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
সকালে পাখপাখালির ডাকে ঘুম ভাঙলে সে ধড়মড় করে উঠে বসলো। তার বাঁদিকে ঘরের ছাদ আর দেয়ালের মাঝখানে অনেকটা জায়গা ভাঙা, সেদিক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে তার। গায়ের উপরে। আরও খানিকটা সময় চুপ করে বসে থেকে সে ইতিকর্তব্যতা নির্ধারণের চেষ্টা করলো।
একসময়ে সে ঘরটির বারান্দায় গিয়ে বসলো। মাধাইয়ের কাছে ফিরবার মুখ আর তার নেই। মাধাইকে সে শুধু যে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে তাই নয়, ঠিক সে-সময়ে একটি অভূতপূর্ব বন্য। আগ্রহও সে অনুভব করেছিলো মাধাইয়ের প্রতি। আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিও ছিলো।
সম্মুখে বাঁধটা অনেকটা চওড়া। বাঁধের নিচের দুটি ধাপ ক্রমশ উঁচু হয়ে সর্বোচ্চটির সঙ্গে মিশেছে ব্রিজের তলায়। এ অঞ্চলে তোক চলাচল কম। বাঁধের উপরে যতদূর চোখ যায় সবুজ ধানগাছের মতো উঁচু উঁচু ঘাসের মাঠ। উপরে ছাই রঙের আকাশ। এ দুয়ের মাঝখানে শাদা ঢেউ ভোলা কাঁচের মতো ব্যবধান। ঘাসের সবুজ তলটির উপরে দু’একটি সরু সরু গাছ চোখে পড়ে। সেগুলি ঘাসের জঙ্গলের উচ্চতার সমতা বুঝতে সাহায্য করছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সুরতুন বারান্দাটিতে বসে রইলো। খাড়া রোদ গায়ে না পড়লেও দুপুরের উত্তাপে কষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু সে যেন ক্ষুৎপিপাসাতেও কাতর হবে না এমনি তার বসার ভঙ্গি। পিপাসার কষ্ট একসময়ে দুঃসহ হয়েছিলো, কিন্তু বাঁধ ও বাঁধের জঙ্গল ডিঙিয়ে জল খেতে যাবার চেষ্টা করাও তার কাছে সমান অসম্ভব বোধ হলো। একটা পুরো দিন সুস্থ দেহে উপবাস করা তার জীবনে এই নতুন নয়। এর আগে একবার রজব আলির কাছে মার খেয়ে সে নিজের ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে ছিলো, নিরম্বু উপবাস ভিন্ন গত্যন্তর ছিলো না। মনোভাবের দিক দিয়েও ঘটনা দুটি তুলনীয়। কিন্তু একটু পার্থক্য আছে, তখন না-খাওয়া আধপেটা খাওয়াই ছিলো দিনের সহজ নিয়ম। এরই ফলে সৈন্যবাহিনীর পরিত্যক্ত এই ঘরের কোণে টিনের কৌটো ইত্যাদির জঞ্জাল পড়ে থাকতে দেখে থেকে থেকে তার লোভ হচ্ছিলো আহার্যের সন্ধান করতে।
দ্বিতীয় দিনের সকালে জনসমাগম হলো। তিন হাত লম্বা একটি লোক। মাথাটা দেহের তুলনায় অনেক বড়ো। মাথার পাতলা চুলে কানের দু-পাশে পাক ধরেছে। চিবুকে দশ-পনেরোটি দাড়ি, তিন-চার আঙুল লম্বা। একমুখ হলুদে দাঁত মেলে সে হেসে বললো, তোমার বাড়ি কোন দ্যাশে, মিয়ে? কালও দেখছিলাম, আজও দেখছি। মনে করছিলাম মাটির পুতুল, মনে করছিলাম পরী, এখন দেখি মিয়ে।
মানুষের সাড়ায় সুরতুন ভীত হয়েছিলো, কিন্তু লোকটির মুখের দিকে চেয়ে তার সাহস ফিরে এলো। দিঘার বাজারে দুধের দোকানের পাশে এ লোকটিকে ঘাস বিক্রি করতে সে ইতিপূর্বে দেখেছে।
কে, মিয়ে, কোন দ্যাশের লোক তুমি?
সুরতুন বললো, বুধেডাঙায় ছিলো, এখন কোনোখানেই নাই।
বুধেডাঙায় যাবা? আমার সাথে গেলি যাতে পারো। আমার বাড়ি চরনকাশি।
কোথাও তো নিশ্চয়ই যেতে হবে।
সুরতুন অন্যমনস্কের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চলেন, আমিও গাঁয়েই যাই।
পথে যেতে যেতে লোকটি সুরতুনকে গ্রামের অনেক সংবাদ দিলো। তার মধ্যে চৈতন্য সাহা ও রামচন্দ্রর খবরও ছিলো। চৈতন্য সাহার বেলায় সেগুলি মুঙ্লাদের গানে প্রচারিত, রামচন্দ্রর ক্ষেত্রে রূপকথার শক্তিকল্পনা। সুরতুনের মন এতটা ভারমুক্ত হয়নি যে সে প্রশ্ন করবে। নীরবে সে শুনে যাচ্ছিলো।
লোকটি প্রস্তাব করেছিলো উঁচু সড়ক ছেড়ে আলের পথে চলার, তাতে নাকি তাড়াতাড়ি গ্রামে পৌঁছনো যাবে। উঁচু সড়কে প্রকাশ্যে চলার চাইতে অপেক্ষাকৃত অবিশিষ্ট হয়ে চলা যায় আলপথে। সুরতুন রাজী হয়েছিলো। আলের দু-ধারের জমিতে আউসের চাষ হয়েছে। কখনন কখনো পরিপুষ্ট ধানের ছড়া গায়ে এসে লাগছে।
কৌতূহল নিয়ে না শুনলেও, লোকটির গল্প আগ্রহভরে গ্রহণ না করলেও ধানের স্পর্শ সুরতুনে মনের উপরে শান্তির মতো কিছু লেপে দিচ্ছিলো, যেমন জ্বরতপ্ত দেহে সকালের বাতাসটুকু দিতে পারে।
কিছুদূর গিয়ে লোকটি এক অদ্ভুত প্রস্তাব করে বসলো, কেন্ মিয়ে, তুমি আমাক বিয়ে করবা?
বিয়ে? প্রস্তাবটার আকস্মিকতা ও প্রস্তাবকারীর স্বরের দ্বিধাহীনতা লক্ষণীয়। অন্য কোন পুরুষ যদি এমন দৃঢ়স্বরে বলতে সুরতুন নিঃসন্দেহে ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠতো। কিন্তু নির্জীব এই লোকটির মুখের দিকে এই প্রস্তাবের পরও সে চাইলো। লোকটিই বরং লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলো।
কেন, আপনে আমাক বিয়ে করবের চান কেন্?
এমন লজ্জত আর দেখি নাই।
কেমন লাগে দেখতে?
লোকটি অকবি নয়। সে বললো, মিয়ে নতুন ধানের মতন। আমার এক পাখি ধানের জমি, চাষ দিছি, বুঝলা। আমার নাম ইস্কান্দার। আউস উঠলি সেই শ্যাড়ে ঘরে ছাউনি দিবো।
ইস্কান্দারের গলা আবেগে ধরে এসেছিলো।হয়তো একথা সত্যি তার এই প্রৌঢ় চাষীজীবনে সুরতুনের মতো সুবেশী কোনো রূপবতীর ছাপ এর আগে পড়েনি। চোখে পড়ছে সুরতুনের পরনে মাধাইয়ের দেওয়া নতুন জামাকাপড়। ধানের জমির আল দিয়ে চলতে চলতে ধানের অজস্রতা তার প্রৌঢ় শিরায় বিবাহের প্রস্তাব করার যে সাহস এনে দিয়েছিলো, ঘরের কথা উঠতেই কিন্তু তার সবটুকু নিমেষে স্তিমিত হয়ে গেলো। কিছুকাল চিন্তা করে সে বললো, ঘরে আমার ছাওয়ালের মা আছে, মিয়ে, তোমাক বিয়ে করা হবি নে। ছাওয়ালের মা অরাজী।
কিছুকাল ইস্কান্দার তার ছেলের মায়ের গুণ বর্ণনা করলো। তার ধানের ভালোবাসার মুর্তিরূপা সেই বিগতযৌবনা স্ত্রীলোকটির গৃহকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলো সে। তারপর তার ভালোবাসাবৃত্তি ধান-স্ত্রীলোকবর্ষার আকাশকে আশ্রয় করে ঘরের দিকে একমুখী হয়ে রইলো।
বুধেডাঙার সীমান্তে, যেখানে পথের ধারে একটা খেজুর গাছের গায়ে পরগাছার মতো। অশ্বখগাছ উঠেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ইস্কান্দার বললো, পথ চিনবা? যাও।মিয়ে, আবার বাজারে যাবা কবে?
বলতে পারি নে, কেন্?
তোমার পাশে পাশে হাঁটতাম। ইস্কান্দার ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
বলতে পারি নে কবে আবার যাবো বাজারে। বলে সুরতুন পথ ধরলো।
ইস্কান্দার তার চিবুকে হাত রেখে অবাক হয়ে সুরতুনের দিকে চেয়ে রইলো। এ মেয়ে কি গল্পে শোনা জিন পরীদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, এই যেন তার সমস্যা।
খানিকটা দূরে গিয়ে সুরতুনও একবার পিছন ফিরে দেখতে পেয়েছিলোইস্কান্দার গালে হাত রেখে তাজ্জবের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
ইস্কান্দারের কথাগুলি ভাবতে ভাবতে সুরতুন ফতেমার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। মাধাইয়ের কথা মনে হলো। অনেকটা সময় মনে হয়নি বলেই যেন চতুগুণ প্রবল হয়ে মনে পড়ে গেলো। যে বোবা-আশঙ্কায় সে রাত্রির অন্ধকারে বাঁধের পথে ছুটে পালিয়েছিলো এত দূরে এসে সে ভয়টা তত নেই; কিন্তু খানিকটা গ্লানি, খানিকটা নিজের আচরণের জন্য অনুতাপ, দুয়ে মিলে একটি পাথরের মতো ভার তার মনের মধ্যে চেপে রইলো।
আহার্য সংস্থানেরইবা কী উপায় অবশিষ্ট রইলো?
আর এই রূপ! মাধাই যা আবিষ্কার করলো, বোকা ইস্কান্দারের চোখেও যা ধরা পড়ে, কোথায় লুকাবে তা?
১৬. চরনকাশির জোলানয়
চরনকাশির জোলানয় শুধু সমস্ত গ্রামটাই একদিন পদ্মার গর্ভে ছিলো। কোনো সময়ে হয়তো চিকন্দির মাটি গ্রাস করেছিলো পদ্ম, একসময়ে সে মাটি ধীরে ধীরে চর হয়ে মাথা তুলো। কিন্তু তখনো পদ্মার মনোভাব বুঝবার উপায় ছিলো না। চরের তিন দিকে তো বটেই, চরকে দ্বিখণ্ডিত করেও স্রোত চলতো। কালক্রমে সেই মধ্যস্রোতই জোলা হয়েছে। সমস্ত অঞ্চলটাই চিকন্দির তুলনায় এদিকে ভাষায় দোলা অর্থাৎ নিচু জমি। জোলাটার প্রবাহ একটানানয়। আকাবাঁকা গতিপথের কোথাও কোথাও সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কোথাও দু-পাশের জমির চাইতে দু’তিন হাত নিচু; মাত্র একটি জায়গায় বারো মাস জল থাকে। প্রগাঢ়তম বর্ষাতেও এখন জোলা পদ্মর স্বপ্ন দেখে না। ভরা বর্ষার একটা দুটো মাস দু-একটি তালের ডোঙা চলে,দুএকটা জালও হয়তোছপছপ করে পড়ে, কিন্তু তখনো বদ্ধজলায় আগাছার মতো জোলার বুকে আমনধানের মাথাগুলি জেগে থাকে জলের উপরে এক-আধহাত করে। আর চৈত্র-বৈশাখে পিচ্ছিল শ্যাওলা-ঢাকা তলদেশ বেরিয়ে পড়ে; তারপর লাঙলের মুখে মাটি উটে শ্যাওলাগুলি ঢাকা পড়ে যায়, কখনো কখনো গত ফসলের বিচুলির অংশও চোখে পড়ে।
তবু প্রবাদ এই : পদ্মার সঙ্গে এর গোপন সংযোগ আছে। তার প্রমাণ নাকি এই যে, এদিকে বর্ষা নামতে একদিন দুদিন করে যখন দেরি হচ্ছে কিন্তু উত্তরের পাটকিলে জল এসে এক সুত দু সুত করে ফুলতে থাকে পদ্মা, তখন জোলার তলদেশও ভিজে ভিজে ওঠে। আসলে জলটা আসে সানিকদিয়ারের কাটা খাল বেয়ে পদ্মার পুরনো প্রবাহ-পথ থেকে।
তা যতইনা দুর্বল হোক, জন্ম যার মহাবংশে–এরকম একটা মনোভাব হয় আলেফ সেখের।
জোলাটার অনেকাংশ হাজিসাহেব গয়রহের দখলে। সানিকদিয়ারে তার বাড়ি থেকে সোজা পুবে হেঁটে এসে যে বাঁশঝাড় তার নিচে থেকে প্রায় সিকি মাইল জোলা ধরে এগিয়ে গেলে একটা বুড়ো পাকুড় গাছ, তার গোড়া পর্যন্ত জোলাটা হাজিসাহেব এবং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর। এদিকের চৌহুদ্দিটা আরও পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট করা আছে। পাকুড়ের গোড়া থেকে এপার ওপার বিস্তৃত একটা বাঁধ। এপার থেকে বাঁধ ডিঙিয়ে নামা সহজ নয়। এদিক থেকে বাঁধের উচ্চতা প্রায় চার-পাঁচ হাত, ওদিক থেকে হাত দু-তিন। জোলা যখন টইটুম্বুর তখনোবাধটা আধ হাতটাক জলের উপরে জেগে থাকে।
আলেফ সেখ জোলার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে বাঁধটার নিচে হাজিসাহেবদের চৌহুদ্দির এপারে থামলো। হাতের লাঠিটা দিয়ে বাঁধটার গা ঠুকতে ঠুকতে সে স্বগতোক্তি করলোবোধায় ওপারের জমি আরও ভালো।
আলেফ সেখ একটা প্রবাদ শুনেছিলো, সেটা এই পদ্মার প্লাবন হলেই কেউ না কেউ বড়লোক হয়। পুরনো প্রাসাদ যখন ভেঙে পড়ে তখন পদ্মার জলে ঝনঝন করে লোহার শেকল বাঁধা ঘড়া পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। যে ভাগ্যবান দুঃসাহসী সেই আবর্তের কাছাকাছি যেতে পারে, তার আর হা-অন্ন করতে হয় না। বালে যেমন এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার বলে মনে হতো, এ বয়সে তেমন হবার কথা নয়। তাহলেও পদ্মার ভাঙাগড়ায় ব্যাপারের সঙ্গে হঠাৎ কারো ভদ্রলোক হওয়ার সম্ভাবনা তার মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি। যুক্তির সাহায্যে বরং তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পদ্মার গতি পরিবর্তন মানেই জমি ভাঙা আর চর জেগে ওঠা। যার জমি ভাঙে সে নিজের কপাল চাপড়ে চাপড়ে ফাটায়, আর যার ভাগ্যে চর পড়ে তার কপাল আপনি ফাটে-বরাতের বরকত, এক আবাদে বিশ ধান, ধানের মাপের বিশ নয়, বিশগুণের বিশ। সে বারের ব্যাপারটাও পদ্মার কূল ভাঙার মতো হয়েছিলো। হেঁউতি ধানের ফলন দেখলেই মাথা ঘুরে যায় ফসল ঘরে ওঠার আগেই। ঘরে যখন উঠলো ধান তখন মতি স্থির রাখা যায় না।
ঠিক সেই বছরেই আলেফ সেখ আর তার ভাই এরফান সেখ শহর থেকে পেন্সান নিয়ে গ্রামে এসেছিলো। বিদায়ের সময়ে তারা কিছু নগদ টাকা পেয়েছিলো, তারই সাহায্যে বহুদিন। পরিত্যক্ত নিজেদের বাড়িঘর মেরামত করে, লাঙল-বিধে বলদ কিনে, দুই ভাই স্থির করেছিলো জীবনের বাকি কয়েকটি দিন শান্তির দিকে মুখ করে একটানা নমাজে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
গ্রামে আসার পর তাদের নিজ গ্রামের কয়েকজন লোক আলেফ সেখ ও এরফান সেখের কাছে এসে কথায় কথায় বলেছিলো, গ্রামে একটা পাঠশালা ছিলো সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যদি দু’ভাই এদিকে নজর দেয় ভালো হয়। পাঠশালায় ধর্মকথা শেখানো হবে, এবং তার নাম মক্তব হবে এই শর্তে আলেফ সেখ নজর দিয়েছিলো। অবশ্য গ্রামে বিদ্যোৎসাহী জনতা ছিলো এমন নয়। আমজাদ, যাকে গ্রামের চাষীরা আড়ালে খোঁড়া মৌলবী বলে, তারই উদ্যোগে ব্যাপারটা হয়েছিলো। সে সরকার থেকে পাঠশালায় শিক্ষকতা করার দরুন বৎসরে তিন কুড়ি টাকা পায়। পাঠশালাটাকে একটু ভালো করতে পারলে সেটা বেড়ে বৎসরে তিন কুড়ির উপরে বারো টাকায় দাঁড়াতে পারে। আলেফ সেখ এর পরে মক্তবের সেক্রেটারি হলো এবং তদারক করে পদ্মার তীর থেকে স্বচ্ছন্দজাত কাশ ও নলখাগড়া কাটিয়ে এনে ঘরটিও মেরামত করে দিয়েছিলো।
এরপরেই এলো ধানের বন্যা। সে এরফানের সঙ্গে পরামর্শ করে ধান কেনাবেচার কাজ করেছিলো। চিরকালের অস্থিরমতি ধানের সে এক অবুঝ পাগলামি। এ-হাটে ধান কিনে ও-হাটে যাও, দু’টাকা ব্যাজ মনে। সাতদিনের দিন ধানের দাম বাড়ে পাঁচ টাকা। কিন্তু ভাটার টান লাগলো ধানের বন্যায়। সে-টান এমন যে চড়চড় করে জমি ফেটে যেতে লাগলো। ধান যেন পদ্মা। সে ভাটার টানে মাথা ঠিক রেখে নৌকো চালানো যার-তার কাজ নয় তো! চৈতন্য সাহা আর তার বাঙাল মাল্লারা ছাড়া আর সকলেই সরে দাঁড়ালো।
আলেফ সেখ এরফানকে ডেকে বলেছিলো, কেন্ রে আর ধান কিনবো?
এরফান জানতো আলেফ ধানের হাত-ফেরতার কাজ করছে। সে বললো, কে, হলে কি? কতকে?
গহরজান তিনপটি দিবের চায়,চৌদ্দ মনের দরে।
সব্বোনাশ! চৌদ্দয় উঠেছে। আর কেনা নাই।
কেন্?
এবার নামবি।
নামবি তার কি মানি?
নাইলে মানুষ জেরবার হবি। বাঁচবি কে? খোদাই আর দাম উঠবের দিবে নে, নামাবি।
যুক্তিটা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ না করলেও আলেফ ধান কিনতে সাহস পায়নি। কিন্তু পরদিন সকালেই আবার এসেছিলো।
এরফান রে–
কী কও বড়োভাই?
জমি ধরবো?
জমি?
হয়। বিশ টাকায় বিঘা, এক বছরের খাইখালাসি।
ভাবে দেখি।
আলেফ তখনকার মতো চলে গেলো। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে সে জমি কিনবে না। এরফানের সঙ্গে পরামর্শ করার আগেই বুধেডাঙার এক সান্দারের পাঁচ বিঘা জমি সে খাইখালাসিতে রেখে টাকা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু খটকা লেগেছে তারও, জমির এই স্বল্পমূল্য কি প্রকৃত কোনো ব্যাপার, না জিন-পরীর খেলা। সে অপেক্ষা করতে লাগলো, ঘুরঘুর করে বেড়াতে লাগলো সুযোগের অপচয় করে উদাস ভঙ্গিতে এ-মাঠে ও-মাঠে।
এরকম সময়ে একদিন মাঠের পথে রিয়াছৎ মৌলবীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো। রিয়াছৎ তখন রাস্তার পাশ থেকে খানিকটা দড়ি কুড়িয়ে নিয়ে তার লজ্রঝড় সাইকেলটার একটা অংশ মজবুত করছে। আলেফকে দেখে সে প্রীতি সম্ভাষণের ভঙ্গিতে বললো, আদাব সেখসাহেব।
আসলাম্।
ইস্কুলডা কেমন চলতেছে?
কোন্ ইস্কুল?
আপনার সেই মক্তবডা।
আলেফ উত্তর দিতে গিয়ে থামলো। মক্তবটার দিকে সে কয়েক মাস নজর দিতে পারেনি। ধান উঠবার আগে সে স্থির করেছিলো মক্তবের নামে একটা ফান্ড খুলে দেবে। কিন্তু ধান ও জমির ভাবনায় সেদিকে আর কিছু করা হয়নি। রিয়াছতের কথায় আলেফের গা চিড়বিড় করে উঠলো। সে যেন আলেফের পায়ের কড়া মাড়িয়ে দিয়েছে। রিয়াছৎ কিছুদিন আগে সানিকদিয়ারের মসজিদের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য চাইতে এসেছিলো, আলেফ বলেছিলো মক্তবের জন্যই তার অন্য কোনো সৎকাজে অর্থব্যয় করার সামর্থ্য নেই। সে কথাটা রিয়াছৎ কেচ্ছার মতো আজগুবি করে ছড়িয়ে দিয়েছে।
আলেফ বললো, চলবে না, কেন্, বেশ চলতেছে, জোরের সঙ্গে চলতেছে।
আজ যে বন্ধ দেখলাম।
তা মাঝে-মধ্যে বন্ধ দেয়াও লাগে।
রিয়াছৎ ফিক্ করে হেসে সাইকেলে চড়লো। তার হাসিটা বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিক প্রফুল্লতার লক্ষণ নয়।
আলেফ ক্রুদ্ধ হলো। যে কটুক্তিটা মুখে এসেছিলো সেটা চেপে সে রিয়াছকে ডাকলো, শোনা শোনন, রিয়াছৎ।
জে। রিয়াছৎ সাইকেল থেকে নামলো।
তুমি শুনছো নাকি মক্তবটার জন্য দুইশ টাকার ফন্ড করে দিছি?
তা তো দিবেনই, আপনার মক্তব। রিয়াছৎ উদাসীন সুরে বললো।
আলেফ আশা করেছিলো খবরটা শুনে রিয়াছৎ বিস্মিত হবে। আশানুরূপ ফল না পেয়ে সে আবার বললো, ধরো যে দুইশ তো নগদ, এছাড়াও মেরামতরে, বেঞ্চিরে, টুলরে, এ সকলেও খরচ-খরচা আছে।
রিয়াছৎ এবার বিস্মিত হয়ে বললো, দেওয়াই তো লাগে, পাঠানের বংশ আপনার।
বলা বাহুল্য, ফান্ড, বেঞ্চ, টুল এসবই কাল্পনিক বদান্যতা; আলেফ আর কথা বাড়ালো না। পায়ে পায়ে বাড়িতে ফিরে সে ভাবতে বসেছিলো। স্ত্রী এসেছিলো খরচের পয়সা চাইতে, আলেফ বললো, নাই, নাই।
কও কী, এত ধান তুললা?
হয়, ধানই তো।
দুপুরের পরে এরফানের বাড়িতে গিয়ে সে বললো, কও দেখি কী অত্যাচার!
অত্যাচার করলো কে?
আলেফ রিয়াছ মৌলবীর ব্যাপারটা বর্ণনা করলো।
এরফান হেসে বললো, দিলা নাকি এসব?
তুই কি কস?
ভালো কাজ। কিন্তু এখন মানুষ না খায়ে মরে। এখন এ কী কথা?
বাড়িতে ফিরে খানিকটা সময় আলেফ ভাবলো। হয়তো তার সঙ্গে আলাপ করার আগে খোঁড়া মৌলবীর সঙ্গে মক্তব সম্বন্ধে রিয়াছৎ আলাপ করে এসেছিলো এবং ফাণ্ড ইত্যাদি যে সবই কাল্পনিক এ কথাটা এতক্ষণে প্রচার করতে লেগে গেছে। এবং প্রচার করার সময়ে আলেফের পাঠানবংশ সম্বন্ধেও ইঙ্গিত করছে। এরপরে দু-এক দিনের মধ্যে ফাণ্ড খোলা, মক্তবের বেঞ্চ ইত্যাদি তৈরির ব্যাপারে আলেফের টাকার একটা মোটা অঙ্ক খরচ হয়ে গিয়েছিলো; যদিও ছাত্র বা মাস্টারদের তখন আসবার কথা নয়, আসেওনি তারা।
জমি কেনার পথে প্রথম বাধা হিসাবে এ ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য ছিলো এই মনেহলো এখন আলেফের। জোলার খানিকটা জমি হস্তান্তর হবে এ সংবাদ শুনেই আজ সে পরিদর্শনে এসেছে। কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষের বছরের তুলনায় এ বৎসর দাম প্রায় পাঁচগুণ! এখন দাঁড়িয়ে বাঁধের গায়ে লাঠি ঠুকে জমির পরখ করতে করতে আলেফের মনে হলো এছাড়া আরও বাধা ছিলো। রিয়াছৎ মৌলবীর ব্যাপার মিটবার পর কিনি-না-কিনি করতে করতে কাউকে কিছুনা বলে পাঁচ-দশ বিঘা জমি বুভুক্ষুদের কাছে কিনে, গ্রামে যতদূর লেখাপড়া করে নেওয়া সম্ভব তা সব শেষ করে আবার একদিন এরফানের বাড়িতে গিয়েছিলো সে।
এরফান ফুর্সিটা আলেফের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললো, বড়োভাই, এদিকে আর আসোনা। কাল গিছলাম তোমার বাড়ি, পাই নাই। জমি কেনার কথা বলছিলা, কিনলা?
অল্প-সল্প কিছু।
দাম কমে যাতেছে। আল্লা, কী হলো দুনিয়ায়!
এরফানের কথা বলার ধরনটা আলেফের ভালো লাগলোনা। জমির দাম কমা যেন খুব একটু খারাপ ব্যাপার এরকমই তার কথায় মনে হলো। সে কথার পিঠে কথা বললো না।
এরফান বললো, ধান কিন্তুক ছাড়ো না।
তুই সবই উল্টা কস। জমির দাম কম তাও খারাপ, ধানের দাম বেশি তাও ধান ছাড়বো না।
ছয় মাসের খাবার রাখে যা হয় করবা। দুর্ভিক্ষ কতদিন চলবি কে বলবি।
আলেফ এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো, তুই জমি কিনলি না?
ভাবছিলাম কিনবো, তা কিনলাম না।
কেন, এমন সুবিধা কি আর কখনো পাবি?
এরফান খানিকটা সময় ভাবলো বড়োভাইয়ের মুখের সম্মুখে কথাটা বলা উচিত হবে কিনা, তারপর ধীরে ধীরে বললো, কে বড়োভাই, ওরা খাতে না পায়ে জমি বেচতিছে, সে জমি কেনা কি অধর্ম না?
আলেফ খুঁতখুঁত করে হাসলো।
অভাবে না পড়লে কেউ কোনদিন বেচে সম্পত্তি, সে সান্দারই হোক আর সান্যালই হোক!
এরফান এ কথাটার যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারলো না। পৃথিবীর সব ক্রয়-বিক্রয়ের মূলকথা এটা। তবু তার দ্বিধা কাটলো না। সে বললো, আমার আর খানেয়ালা কোথায়, কী হবি জমিতে?
এর ফলেও জমি কেনার প্রবৃত্তি কিছুসংহত হয়েছিলো আলেফের কিন্তু আসল বাধাটা এলো অন্যভাবে।
ঠিক এরকম সময়েই শোনা যাচ্ছিলো খানিকটা জোলার জমি বিক্রি করবে রহমৎ খন্দকার। হাজিসাহেবেরই বংশের লোক রহমৎ। শহরে গিয়ে ভিক্ষা করতে পারবে না, ঘরেও ধান নেই যে তারই জোরে ঘরে থাকা যাবে; ঘরে থাকতে হবে ঘরেরই একাংশ বিক্রি করে।
খবরটা শুনে আলেফ সানিকদিয়ারে গেলো হাজিসাহেবের বাড়িতে। হাজিসাহেব নমাজ শেষে উঠে বসতেই কথাটা সে উত্থাপন করলো। গত কয়েক মাসে হাজিসাহেব আর একটু বৃদ্ধ হয়েছেন, চোখে কম দেখছেন। আলেফের কথা শুনে বললেন, ওরা কি গাঁয়ে থাকা নে?
তা থাকবি।
তবে বাপ বড়ো বাপের জমি বেচে কেন্? তা কি বেচা লাগে?
মনে কয় জমি বেচে খোরাকির ধান কিনবি।
হাজিসাহেব দুর্ভিক্ষের খবরটা ভালোরকম জানতেন না। নমাজ, ফুর্সি ও বিশ্রামের গণ্ডিবদ্ধ। জীবনে আজকাল পৃথিবীর সংবাদ কমই পৌঁছায়। তিনি জিভ-টাকরায় চুকচুক শব্দ করে প্রশ্ন করলেন, খোরাকির ধান জমি বেচে, কও কি আলেফ?
হয়, তাই শুনি। আপনে জমিটুক্ রাখবেন?
রহমৎ খন্দকারের বাপ-জ্যাঠার সঙ্গে তারা যতদিন বেঁচে ছিলো হাজিসাহেবের মামলা চলেছে। এ জোলা নিয়েও শরিকানী হুজ্জত কম হয়নি তখন। হাজিসাহেবের কপালের পাশে দু’একটা শিরা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বড়োছেলে ছমিরুদ্দিকে ডাকলেন তখন, তখুনি যেন জমি সম্বন্ধেই কোনো নির্দেশ দেবেন।
শেষ পর্যন্ত হাজিসাহেব কিন্তু জমি কিনলেন না। এখন বাঁধের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছুকভাবেই আলেফ মাথাটা নত করে মনে করলো ঘটনাটাকে। একটু পরে হাজিসাহেব বলেছিলেন–না আলেফ, লোভ সামলান লাগে;কামটা ভালোনা। লোকে কবি বিপদে পড়ছিলো আপ্তজন; তাক না দেখে, হাজি তার মাথায় বাড়ি মারলো। তোবা। ছমির, দুই বিশ ধান দেও না কেন্ রহমতেক।
আলেফকে তখন-তখনি বাড়ি ফিরতে দেননি হাজিসাহেব। গোসল, খানাপিনা শেষ করে রোদ পড়লে হাজিসাহেব আলেফকে ফিরবার অনুমতি দিলেন। ধানের কথা, জমির কথা তলিয়ে গেলো। হাজিসাহেব বললেন, কে আলেফ, তোমার বাপের সেই মজিদের কী হলো?
আছে সেই রকমই।
কও কী, কলে যে দুই ভাই পিন্সান পাও।
তা পাই।
এবার তাইলে মজিদের ভিত পাকা, রং করে দেও।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভদ্রতা করে আলেফ বলেছিলো, বেআদপ যদি করছি মাপ করবেন, হাজিসাহেব।
কও কী, আলেফ, তুমি সৈয়দ বংশের। আসছিলা তারই জন্য সুক্রিয়া করতেছি।
কিন্তু জমি জমিই। বিশেষ করে জোলার জমি। একসঙ্গে তিন চাষ। আউস, আমন, কলাই। আউস তোলো, নামুক ঢল। জল বাড়বি, আমন বাড়বি। এক হাত বাড়ে জল, সোয়া হাত আমন। কাটো সোনার আমন।জল কমবি, জল শুকায়ে যাবি। একেবারে শুকানের আগে ছলছলায় কাদায় ছিটাও কলাই। ধরো যে চাষই নাই।
কথাগুলি প্রায় সোচ্চার করে আবৃত্তি করতে করতে বাঁধ থেকে নামলো আলেফ। খুবঠকেছে সে এরকম অনুভব হলো তার। এখন কি আর জোলার জমি টাকায় বেড় পাওয়া যায়। লাঠির আগায় খানিকটা এঁটেল মাটি লেগেছিলো। লাঠিটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মাটিটুকু আঙুলে করে তুলে ডলে ডলে সে স্পর্শটুকু অনুভব করলো; নাকের কাছে এনে সোঁদা সোঁদা গন্ধটা অনুভব করলো। স্বগতোক্তি করলো সে–এতদিন চাকরি না করে জমির চেষ্টা করলে জোলার অনেকখানি আমার হলেও হতে পারতো।
জোলার উপর দিয়ে সে হাঁটতে লাগলো। কচিৎ কোথাও জলের চিহ্ন আছে; তাছাড়া সর্বত্রই শুকনো পলিমাটি। যখন কাদা কাদা ছিলো জমিটা, তখন গোরুর খুরের গর্ত হয়েছে। দেখে মনে হয় শক্ত। পা দিলে ভেঙে সমান হয়ে যায়।
হায়, হায়, এমন সব জমি পড়ে আছে! তার হলে কি এই দশা হয় জমির। জোলার বাঁধের ওপারে যেমন হাজি গোষ্ঠী, এপারে তেমনি সান্যালরা। এদিকের অধিকাংশ জমি পড়েছে মিহির সান্যালের জমিদারীতে, কিছু খাস, অধিকাংশ পত্তনিতে প্রজা বসানো ছিলো। খাসে তবু কিছু চাষ পড়েছে, প্রজাপত্তনি ভূঁইয়েতে চাষ না হওয়ার সামিল। যারা নেই তারা নেই। দু’সন পরে যারা ফিরেছে তাদেরও অধিকাংশ বাকি খাজনার মামলা-হামলায় কোটকাছারি নিয়েই ব্যস্ত, চাষ হয় কী করে? নানা দিক থেকে বাধা পেয়ে ইচ্ছানুরূপ জমি কেনা তার হয়নি। একটা ক্ষোভের মত হয়ে ব্যাপারটা তার মনে ঘুরতে থাকলো।
জোলা ধরে হেঁটে আসতে আসতে মুখ তুলে দেখতে পেলো আলেফ তার সম্মুখে কিছুদূরে জোলার একটি অংশে চাষ হচ্ছে। দুজন কৃষাণ, দুটি লাঙল। জোলার ধারে একজন ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি যে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে। জমির অবস্থান লক্ষ্য করেই সে বুঝতে পারলো ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে এরফান চাষের তদারক করছে।
জোলার এই অংশটার প্রায় দশ-পনেরো বিঘা জমি আলেফ-এরফানদের পৈতৃক সম্পত্তি। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে অন্যত্র যা আছে পেন্সান নিয়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আপোষে ভাগ করে নিয়েছিলো তারা, কিন্তু এটা এজমালি থেকে গেছে। ব্যবস্থা করা ছিলো চাষ ইত্যাদির সব দায়িত্ব এরফানের, ফসল উঠলে সে ভাগ করে দেবে। কথা ছিলো চাষের খরচেরও একটা হিসাব হবে। সেটা এ পর্যন্ত হয়নি, খরচটা এরফানই করে। আর, সব জমি ভাগ করার পর এটা এজমালি রাখার মূলে একটা মেয়েলি সখ ছিলো। আউস উঠবার পর আমন যখন একবুক জলে দাঁড়িয়ে শিরশির করে তখন জোলায় মাছ আসে, ট্যাংরা পাক্কা তত বটেই, সংখ্যায় নগণ্য হলেও পাঁচ দশ সের ওজনের বোয়ালও কখনো কখনো পাওয়া যায়। জোলাটার অন্যতম গভীর অংশে এই জমি, পলাদ’র পরেই এর গভীরতা। জমিটা ভাগ করে নিলে মাছ ধরার কী উপায় হবে সেখবন্ধুরা তা নিয়ে খুব বিচলিত হয়ে পড়ায় এরফান এজমালি রাখার প্রস্তাবটা তুলেছিলো।
এখন এখানে জল নেই বললেই চলে, যেটুকু ছিলো লাঙলের টানে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। বাঁ পাড় থেকে শুরু করে চষতে চুষতে লাঙলজোড়া তলদেশে পৌঁছে গেছে, এবার ডান পাড়ের দিকে লাঙলের মুখ ফিরবে।
সকালে উঠে যখন আলেফ এই পথ দিয়ে বাঁধের দিকে গিয়েছিলো তখন এখানে লাঙল ছিলো না। এরফানের সঙ্গেও তার দু তিনদিন দেখা হয়নি, কাজেই কবে চাষ হতে পারে এটা জানা ছিলো না তার। কথা বলার মতো দূরত্বে পৌঁছে আলেফ বললো, আজই দিলা চাষ?
এরফান ফিরে দাঁড়িয়ে আলেফকে দেখতে পেয়ে বললো, হয়। দেরি করে কাম কি?
দেরি করার কথাও নয়। জল দাঁড়ানোর আগেই আউস কেটে তুলতে হবে; আষাঢ়ে পনেরো দিন থাকতে থাকতে সামাল করতে হয়। কাজেই চৈত্রের গোড়াতেই জোলায় চাষ দিতে হয়। ধান না হলে আর রক্ষা নেই।
আলেফ বললো, আমি যে জানবেরই পারি নাই।
এরফান বললো, আমিও জানতাম না। আজ পেরভাতে ঠিক হলো। চাষের লোক পায়ে গেলাম দুজন, নামায়ে দিলাম।
আজ লোক পালা, আজই নামায়ে দিলা? খুব যেন আগ্রহ করতিছ?
এরফান বললো, রোজ পাবো এমন কী ভরসা।
কথাটা শুনবার জন্য আলেফ অপেক্ষা করলো না। সে ততক্ষণে চাষ দেওয়া জমিতে নেমে গিয়ে লাঙলের কাছাকাছি ঘুরছে। লাঠিটা একবার শুন্যে উঠছে, একবার মাটিতে বিধছে। খুব ঠাহর করে দেখতে দেখতে মনে হয় তার লাঠিচালনা আর চলায় মিলে একটা ছন্দ তৈরি হচ্ছে। বিচালি থেকে ধান আলাদা করার পর ধান থেকে ধুলো আর চিটে উড়ানোর জন্য কুলোর হাওয়া দিতে দিতে চাষীরা যখন একবার এগোয় একবার পিছোয় সে সময়েও কতকটা এমনি হয়। অভ্যস্ত চোখে স্বাভাবিক বলে বোধ হয়, যারা নতুন দেখছে তারা অনুভব করে ছন্দটুকু।
কখনো লাঙলের পেছনে, কখনো আগে খানিকটা সময় ঘুরে ঘুরে আলেফ অবশেষে এরফানের কাছে ফিরে এলো। তখন তার জুতোজোড়া এঁটেল মাটির প্রলেপ লেগে লেগে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; পায়জামার পায়ের কাছে কাদা লেগেছে, কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে।
এরফান রহস্য করে বললো, লাঙলের মুঠাও ধরছিলে নাকি?
আলেফ বলল, তা ভালো করছিস আজ চাষ নামায়ে। মিঠে মিঠে রোদ্দুর আছে।
আজকের রৌদ্র গতকালের মতোই। এরফান হেসে বললো, হয়, চিনি চিনি।
আলেফ আবার হাসলো, বললো, মস্করা না, মাঠে নামে দ্যাখ।
তুমি কি আর না দেখে কইছো।
ব্যাপারটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। দুজনে দাঁড়িয়ে লঘুস্বরে কথা বলাই এর একমাত্র সার্থকতা।
কিন্তু কোনো কোনো মনে সুখ নিখাদ অবস্থায় থাকতে পারেনা। পেন্সান নিয়ে বাড়ি আসবার পর থেকে আলেফের মনের গতিটা এরকমই হয়েছে। আহারাদির পর যখন ভালো থাকা উচিত তখনই তার মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। নিষেধের পর নিষেধ এসে তাকে যেন কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করেছে। সামান্য ওইটুকু জোলাজমির চাষে যদি এত আনন্দ, রহম খন্দকারের জোলাটুকু পেলে কত না গভীর আনন্দ সে পেতে পারতো। ওই সামান্য জমি, তবু সবটুকু তার একার নয়।
এমন অবশ্য শোনা গেছেদু ভাইয়ের এজমালি জমি অবশেষে একজনের অধিকারে এসেছে। এক ভাই খাজনা চালাতে পারেনি, অন্যজন সেই সুযোগে খাজনার ব্যবস্থা করে ক্রমে জমিটার দখল নিয়েছে।
চিন্তাটা পাক খেতে খেতে একটা কল্পনা গড়ে উঠছিলো,কাঁচামাটি থেকে মৃৎপাত্র গড়ে ওঠার মতো। সেটা সম্পূর্ণ গড়ে ওঠামাত্র আলেফের চিন্তা বাধা পেলো। চুরি করে ধরা পড়লে যেরকম মুখ হয় তেমনি মুখ করে সে বললো, তোবা, তোবা। এরফানেক ঠকানের কথা ভাবা যায় না।
কিন্তু এত সহজে ঝেড়ে ফেলার নয়, চিন্তাটা আবার অন্যরূপে ফিরে এলো। জমিটা বিক্রি করে না এরফান? ভাবলো সে। অভাবে পড়া চাষীদের মতো নয়, ন্যায্য দাম নিয়ে হাত বদল করে না?
করে হয়তো, কিন্তু কী করে প্রস্তাব তোলা যায়। এরফান যদি হেসে উঠে বলে–কে, বডোভাই, ট্যাকা যে খুবই হলো? কিংবা ধরো যদি সে রাগ করে? কিংবা পাল্টা প্রস্তাব করে-বড়োভাই, নতুন যা কিনছো আমারও তাতে ভাগ দেও না ট্যাকা নিয়ে।
কাজ নাই লোভ করে–এই ভেবে আলেফ কল্পনাকে সংহত করলো। মনের মধ্যে তবু অসন্তোষ প্রশ্ন তুলো–একবার যাচাই করে দেখলে কী হয়? এতই যদি নির্লোভ এরফান, দেখাই যাক না কী বলে সে।
সন্ধ্যার আগে আগে আলেফ এরফানের বাড়িতে গেলো। এরফানের উঠোনে তখন ধান ঝাড়া চলছে। একদিকে আমন অন্যদিকে আউস ঢেলে দুজন কৃষাণ কুলোর বাতাসে ধুলো চিটে উড়িয়ে বেছন বাছাই করছে। ধুলো আর চিটে আবর্তের মতো উড়ছে। সে সব অগ্রাহ্য করে আলেফ প্রথমে বাঁ দিকের স্তূপটার কাছে গিয়ে একমুঠো ধান তুলে নিয়ে নাকেমুখে খানিকটা ধুলো খেয়ে বললো, আউস, কেন্? তারপর ডাইনের পটার কাছে গিয়ে অনুরূপভাবে বললো, আমন, কেন?
এরফান বারান্দায় বসে তামাক টানছিলো, সে হাঁ হাঁ করে উঠলো। কো কি, ধুলো খাও কেন্? আঃ হাঃ!
আলেফ হাসিমুখে বারান্দায় গিয়ে বসলো, এত ঝাড়ো যে ধান?
এরফান কৌতুকোজ্জ্বল মুখে বললো, ধান দেখলেই ঘুরানি লাগে বুঝি? লোক পালেম, ঝাড়ে রাখি।
আলেফ বললো, তোর অত অভরসা কেন্? এবারও কি লোকে খাটে খাবি নে?
এরফান ফুর্সিতে মুখ দিয়ে দম মেরে রইলো, তারপর বললো, বড়োভাই, দুনিয়ার হাল কে কবি কও? আদমজাদ পয়মাল হয় না খায়ে। শুনছো না খবর? লোক দেশ ছেড়ে যাতেছে।
দেশ ছাড়ে কনে যায়?
কে, শোনন নাই? ওপারের কলে নাকি মেলাই লোক নিতেছে।
গাঁয়ের সব লোক খাবি এত বড়ো পেট কোনো কলেরই নাই, তা তোক কয়ে দিলাম।
তা নয় নাই। সময়মতো হাতের নাগালে তোক না পালে সময়মতো তোমার চাষও হয় না, ধান ছিটানোও হয় না। কে খোঁজ করে দেখলেই পারো বুধেডাঙায় কয়ডা লোক আছে। কয়জন খেত আর লাঙল এক করলো, কও।
কথাটা মিথ্যা নয়, ভাবলো আলেফ। শুধু বুধেভাঙা কেন, চিকন্দি, চরনকাশি আর সানিকদিয়ার কোথাও যেন চাষের তাগাদা নেই এবার।
নিস্পৃহ উদাসীন ভাব যেন কৃষকদের। এরফানের একক প্রচেষ্টার কথা ছেড়ে দিলে জোলাতেও আজ পর্যন্ত চাষ পড়লো না।
আলেফ বললো, হয়, শুনছি। চৈতন সার জমিগুলোতে এবার কেউ চাষ দিবের চায় নাই। মিহির সান্যালও জমি সব খাস করতেছে। লোক পাওয়া কঠিন হলেও হবের পারে। তাইলে আমার জমিতেও চাষ ফেলা লাগে। এজমালিডার ধান ছিটানে কবে করবি?
কাল লাঙল, পরশু মই, তরশুদিন ধান বই।
রঙ্গ রাখেক। বেছন ঝাড়তিছিস?
ঝাড়া লাগে না?
লাগে না কে। আমার নতুন কেনা জমিগুলোতেও কালই চাষ দিবো, কি কস? রাখাল পাঠায়ে আজই লোক ডাকাবো। তা শোনেক এরফান যত ধান ঝাড়ছিস সব তো তোর জোলায় লাগবি নে।
না, তা লাগবি নে।
তাইলে আমার জমিটুকের জন্যে খানটুক রাখিস।
এরফানের হাসি পেলো। তার বড়োভাই যতদিন চাকরি করেছে ততদিন তার এ পরিচয়টা ঢাকা ছিলো। এখনো খরচের জাঁক তারই বেশি। মক্তব করা, মসজিদ তোলা, এসব পরিকল্পনা এরফানের মাথায় আসে না। অথচ এই সামান্য সামান্য ব্যাপারে আলেফের ব্যয় সংকোচের চেষ্টাও হাস্যকর।
তা রাখবো। বললো এরফান হাসিমুখে।
ফুর্সিতে আর দু’একটি টান দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আলেফ, বললো, তাইলে আর বসি না। চাষ কালই দি। বুঝিস না গত সন সান্দারদের জমিতে এক ফসল পাইছি। এবার দু ফসল তোলা চাই।
বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে সে বললো, মনে রাখিস বেচনের কথা।
বাড়িতে পৌঁছে সে দেখলো, তার স্ত্রী কুপি ধরে পথ দেখাচ্ছে আর রাখাল ছেলেটি গোরুবাছুরগুলো গোয়ালে তুলছে।
দরজার কোণে লাঠিটা রেখে সে গোয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মনটা তার খুশি খুশি হয়ে উঠেছে। চাষ, চাষ। একটা প্রত্যাশায় অন্য সব অভাববোধ সাময়িকভাবে মন থেকে স্থানচ্যুত হয়েছে। স্ত্রীকে হকচকিয়ে দিয়ে সে হাঁই হাঁই করে বললো, কে, জমি কিনবা, চাষ দিবা না?
বুঝতে না পেরে স্ত্রী বললো, আমি কি মানা করছি?
তা করো নাই, বুদ্ধিও দেও নাই।
স্ত্রী তার মনোভাব বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।
স্ত্রীকে ছেড়ে আলেফ রাখালকে আক্রমণ করলো, শালা গিধর, শোনেক!
জে।
জের কাম না। তোর বাপ দাদাক কাল আনবি।
জে, যদি না আসে?
তুমি এ মুখ হবা না, হাড় ভাঙে দেবো তোমার।
রাখাল ছেলেটি মনিবের আকস্মিক রূঢ়তায় ফ্যালফাল করে চেয়ে রইলো।
বোঝ নাই আমার কথা? কাল তোর বাপ-দাদাক আনাই চাই।
ছেলেটি পলায়নের ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলো। সে চলে যেতেই আলেফের স্ত্রী বললো, নেশা করছো নাকি বুড়াকালে, আচমকা ছাওয়ালোক তাড়লা।
তাড়লাম কই। রঅস্য করলাম। বুঝলা না, কাল ধরে যে তোমার জমিতে চাষ দিবো। ওর বাপ-দাদা না হলি চাষ করে কেডা।
চাষ দিবার জন্যে বউয়েক আর রাখালকে মারপিট করতি হয়? ও, মনে কয়, কাল আসবি নে, বাবা-দাদাক আনা দূরস্তান।
কও কি!
আলেফ বাইরে এসে দাঁড়ালো। চৈত্রের চাঁদের আলোয় ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে রাখাল ছেলেটি হেঁটে যাচ্ছে। আলেফ ডাকলো, ছোবান! উত্তর না পেয়ে মুখের দু পাশে হাত রেখে আলেফ হাঁক দিলো, ছু-বা-না!
জে-এ-এ।
বাপ আমার–শো-নে-ক।
ছেলেটি কাছে এলে আলেফ বললো, তোর আজি ডাকতিছে রে, জলপান দিবি। রাখাল ছেলেটির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে এনে স্ত্রীকে বললো আলেফ, দুডে জলপান দেও না।
এখনই তো গরম ভাত রাঁধে দিছি।
তা হোক, তা হোক। কাল কত খাটবি-খোটবি। দেও, দুড়ে দেও।
রাখাল ছেলেটির কেঁচড়ে জলপান এসে পৌঁছুলে আলেফ বললো, ছুবান আমার সোনার ছাওয়াল। কাল তোমার বাপ আর দাদাক আনবা, কেমন? কবা যে, কী যেন কও তুমি, কবা যে সেখের বেটা ডাকছে তোমাদেক। তার বুধেডাঙার জমিতে চাষ দিবি।
ছেলেটির মুখে এবার হাসি দেখা দিলো।
আহারাদির পর আলেফ স্ত্রীকে বললো, তুমি শোও, আমি আসতেছি।
রাত করে জমি দেখবের যাও নাকি?
শোও না, শোও। আমি আসতিছি।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেখানে লাঙল-বিঁধে থাকে খানিকটা সময় সেখানে অকারণে ঘোরাঘুরি করে আলেফ মসজিদটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বা চওড়ায় বারো-তেরো হাত, টিনের ছাদ, বাঁশের চার উপরে মাটিলেপা বেড়ার ঘর, পাশে একটা পাতকুয়া। এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছিলো আলেফের বাবা। প্রধানত এটা পারিবারিক উপাসনার জন্যই ব্যবহৃত হবার কথা। কখনো কখনো গ্রামের লোকরাও আসে। প্রবাদ এই যে, চরনকাশি ও বুধেডাঙার নতুন মাটিতে লাঙল দেবার নেশায় যখন আদমজাদরা রহমান খোদাকে বিস্মৃত হয়ে গেলো তখন আলেফের বাবা এ দুটি গ্রামের প্রতিষ্ঠাকে শয়তানের দৃষ্টি থেকে দূরে রাখার জন্য প্রায় একক চেষ্টায় এই মসজিদ স্থাপন করে তৎসংলগ্ন পাঁচ-ছ কাঠা জমি পৃথক করে রাখে। আলেফ চাকরি থেকে ফিরে কিছু অর্থব্যয় করে এটাকে আবার ব্যবহারযোগ্য করেছিলো কিন্তু জমির দিকে নজর দিয়ে মসজিদকে বাঁধিয়ে পাকা করার পরিকল্পনা কাজে আসেনি। ফকির বোধ হয় চেরাগের তেল পায়নি আজ। বার্ধক্যের দরুন ঘুমও হয় না, মসজিদের বারান্দার একটেরে চুপ করে বসে আছে।
দুর্ভিক্ষের বৎসরে বোধ করি আহারের আশায় ফকির এই দেশে এসেছিলো। কিন্তু কেউই তাকে আশ্রয় দেয়নি। অবশেষে সে এই মসজিদের কাছে এসে বসে পড়েছিলো। ময়লা ঝুলঝুলে আলখিল্লা আর ছেঁড়া ছেঁড়া কথাগুলো বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতাও তার আর অবশিষ্ট নেই তখন। অন্ধকারে লোকটিকে বসে থাকতে দেখে আলেফ রাগ করে বলেছিলো–কে ওখানে?
ফকির ভীতও হলো না, আগ্রহও দেখালো না।
আলেফ উঠে গিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো–এখানে কী হতিছে?
–বাবা—
–ভিক্ষা-শিক্ষা এখানে নাই।
–ভালো, বাবা, ভালো।
–নিজেই খাতে পাই না।
–ভালো, বাবা।
–গ্রামের বড়ো বড়ো লোক আছে, উঠে দেখেন।
–তা বেশ, বাবা। আজ রাত থাকি। গ্রামের লোক কলে সৈয়দবাড়ি এটা।
–হুঁ। কী ক’লে?
–সৈয়দবাড়ি।
–হুঁ, সৈয়দবাড়ি। ওয়াজীব।
আলেফ দম্-দম্ করে পা ফেলে অন্দরে গিয়ে বললোলোক না খায়ে মরে দরজায়। স্ত্রী বললো–আমি কী করি কও। আমি মরতে কই নাই।
-–ও কি যাবের আসছে মনে করো? নড়বি নে, থাকবি। খাবের তো দেওয়া লাগবি। ওর জন্যি পাক, মনে কয়, করা লাগে।
সেই থেকে ফকির মসজিদে আছে। প্রথম দু’চার দিনের পর আলেফ নিজের অকারণ অর্থব্যয়ে বিরক্ত ও শঙ্কিত হয়ে ফকিরকে প্রকারান্তরে স্থানত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলো, এমনকী একবেলা আহারও বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। নির্বিরোধ ফকির। যা বলল তাতেই ‘তা বেশ, বাবা’ ছাড়া অন্য কথা মুখে নেই। একটা দিকে অবশ্য সুবিধা হয়েছে, ফকির মসজিদের যত্ন করে। দাওয়া ও ঘরের ভিতরে নিকিয়ে ঝকঝকে করে রাখে। ঘঁাচার বেড়া থেকে মাটির প্রলেপ খসে গেলে নিজেই কাদামাটি ছেনে আস্তর লাগায়। মোটকথা মসজিদ সম্বন্ধে আলেফ নিশ্চিন্ত।
আলেকোম সেলাম।
আশ্লাম আলাইকুম। আলোয় ঘুরতেছেন? ফকির প্রশ্ন করলো মৃদুস্বরে।
আপনের কাছে আসছিলাম। কাল জমিতে চাষ দিবো কিনা।
তা বেশ, বাবা, বেশ।
ধরেন যে আমি তো চৈতন সার মতো মানুষকে জেরবার করি নাই। নগদ দামে জমির স্বত্বও কিনছি, জমিদারের হালতক খাজনাও শোধ করছি।
চাষবাসের কথা আমি বুঝি না বাবা, সেই কোন বয়সে ঘরবাড়ি ছাড়া।
তা না। ধরেন যে বছরের প্রথম খন্দের চাষ। তা ধরেন মৌৎ, হায়াৎ, দৌলৎ, এ তো ধরেন যে মানুষের কাছে থাকে না।
খোদার ফরমায়েস, বাবা।
ধরেন যে মজিদের কাছে আসে একবার তো অনুমতি নেওয়া লাগে।
বেশ, বাবা, বেশ।
.
স্বামী বিছানায় এলে আলেফের স্ত্রী প্রশ্ন করলো, সাঁজে কতি গিছলা?
এরফানের বাড়ি।
কেন?
কথাটা আবার মনে হলো। আলেফ বললো, এজমালিডার সবটুক যদি আমার হতো!
না হলিই বা ক্ষতি কী?
ক্ষতি কী, হলে বৃদ্ধি ছিলো।
ও পক্ষ থেকে কোনো উৎসাহের সঞ্চার হলো না। আর তাছাড়া তখনকার মন আর সকালের মনে পার্থক্য আছে। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাষের টুকিটাকি বিষয়গুলি শোভাযাত্রা করে তার মনের উপর দিয়ে চলতে লাগলো। লাঙল ঠিক আছে কিনা, মইয়ের দুখানা কাঠ ভেঙে গেছে, কাল সকালে ছোবানের বাপ-দাদা দুজন এলে তাদের জলপান দেওয়া উচিত হবে কিনা।বলদ দু জোড়াকে এতদিন দেখা হয়নি, কাল তারা লাঙল কীরকম টানবে কে জানে। ছোবানের বাপ-দাদা আসবে তো? শেষের এই প্রশ্নটা অনেক সময় ধরে মনের মধ্যে পাক খেয়ে ঘুরলো। এরফানের কথায় ভয় হয় কাজের মানুষ পাওয়া যাবে না।
এ চিন্তাগুলি শেষ করে আলেফ সদ্য চাষ-দেওয়া জমিগুলির চেহারা কল্পনা করতে লাগলো। বুধেভাঙার যে জমিগুলিতে কাল চাষ দেওয়ার কথা সেগুলিকে ভুলে গিয়ে আবার জোলার কথাই চিন্তা করতে লাগলো সে। মানুষের দুখানা হাত একত্র করে যাচ্ঞার ভঙ্গি করলে যেমন দেখায় অঞ্জলিটা, তেমনি যেন জোলার চেহারা। কালো রঙের একজন চাষী অঞ্জলি পেতে আছে। সেই অঞ্জলি ভরে উঠবে ধানে, জলে, কলায়ে।
আলেফ খুশি খুশি মুখে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
সব জমিতে আউসের চাষ হয় না। নতুন পুরনো মিলে আউসের সব জমিতে চাষ দেওয়া শেষ করে, ধান ছিটানো শেষ করে এদিকে-ওদিকে চাইবার অবকাশ পেলো আলেফ। চৈতন্য সাহার নামে গান বেঁধেছে ছেলেরা, সেটা কানে এলো তার। প্রথমে শুনে ছেলেদের উপরে রাগ হয়েছিলো। পরে একসময়ে সে কৌতুক বোধ করলো। এরকম সময়ে একদিন চৈতন্য সাহার সঙ্গে মাঠের মধ্যে তার দেখা হয়ে গেলো। সেদিন সন্ধ্যার পর এরফান এসেছিলো। প্রাথমিক আলাপের পরই আলেফ বললো, শুনছ না গান?
কিসের?
চৈতন সার নামে বাঁধেছে। রাখাল কতেছিলো।
হয়, শুনছি। তোমার ছোবানই আমার উঠানে নাচে নাচে শুয়ে আলো।
কাণ্ড! বলে আলেফ খুঁতখুঁত করে হাসলো।
এরফান বললো, এবার যদি তোমার নামে বাঁধে।
সোবানাল্লা, কস কী?
তুমিও তো কিনছে কিছু কিছু জমি, কিছু খাইখালাসিতে রাখছো।
কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, খানিকটা সময় ভাবলো আলেফ।
কস কী, সে তো মুশকিল। তাইলে তো কোনো ব্যবস্থা করা লাগে।
ব্যবস্থা আর কী করবা? এত যদি ডর হাই-হুঁই করে বেড়াও কেন, বয়স তোমার বাড়তিছে না কমে?
কেন রে, কী বাঁধবি গান আমার নামে?
কেন, তুমি নিজেক সৈয়দ কও, তাই নিয়ে যদি চ্যাংড়ামো করে।
তাই করবি নাকি?
করবি তা কই নাই, করবের পারে তো।
আলেফ বিরক্ত হয়ে বললো, মানুষ কি মজিদের ফকির-তার নড়াচড়া নাই?
এরফান এবার হাসলো। ফুসিঁটায় সুখটান দিয়ে দাদার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ছোটোকালে বাজান যখন এক হাতে লাঙল ধরছে তার থিকে এখন অনেক বাড়ছে। আর কেন, এবার সাজায়ে গুছায়ে আরাম করো। ছাওয়াল বড়ো হতিছে। সে কি চিরকালই মামার বাড়ি থাকবি?
মামার বাড়ি থাকবি কে। গরমের বন্ধেই তো আসবি।
তা আসবি। কী লেখছে জানো?
কই, চিঠি তো পাই নাই আজকালের মধ্যে।
তার চাচীক লেখছে কোলকাতায় নাকি পড়বের যাবি। এট্রেন্স পাস করে সে থামবি নে।
হয়, হয়, পাস করুক! তার পাস করার ব্যাপারটা আলেফ বিশ্বাস করে না।
পাস সে দিবি, নইলে অমন কথা লেখে না। লেখছে কলারসিপ না পালেও সে পড়বি। চাচী যেন চাচাক কয়ে রাখে।
ছেলের কথায় কিছুকাল আলেফ অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। সেদিন এরফান উঠে দাঁড়ালে আলেফ বললো, চৈতন সার মত গান যদি বাঁধে, চুপ করে থাকাই ভালো হবি, তাই না?
এরফান বললো, সে তখন দেখা যাবি।
এরফান চলে গেলেও খানিকটা সময় আলেফ বসে বসে চিন্তা করলো–কী সর্বনাশ! কয় কী! ছাওয়াল যদি সে গান শোনে, কী কবি?
রাত্রিতে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আলেফের অভিমান হলো। ছেলে মামার বাড়ি থেকে পড়ে, তারও আগে নিঃসন্তান চাচার কাছেই মানুষ হয়েছে। আলেফকে বহুদিন পর্যন্ত ভয় করে এড়িয়ে এড়িয়ে বেড়াতো। সেসব অল্পবয়সের ব্যাপার। এখন ছেলে বড়ো হয়েছে, তার বাপ মা চেনা উচিত।
আলেফ বললো, কে, ছাওয়ালের মা? তোমার ছাওয়াল নাকি পাস দিবি?
হয়। ওর চাচা কলে মেট্টিক না কী পাস দিবি।
হুম।
কী কও?
বলি ছাওয়ালডা আমার তো?
তার মানি?
মানি আর কি? দুনিয়ার লোক জানে ছাওয়াল পাস দিতেছে, আর আমি জানবের পারলাম না।
তোমাক তো লেখছে। তুমি তো চিঠি হাতে পায়েও চালের বাতায় গুঁজে রাখছিলে, গোঁজাই আছে। সে পেরায় একমাস।
কাল সকালে দিবা। পড়বো। সে নাকি কোলকাতায় পড়বের যাবি।
হয়। ওর ছোটো চাচী কলে, ডাক্তারি পড়বের চায়।
ডাক্তারি! আল্লা, আল্লা, কয় কী? লোক মারে শেষ করবি তাইলে। কিছুকাল চিন্তা করে আলেফ বললো, কে, ঘুমালে?
না, কী কবা?
কেন, আমি কি কিছু কবের জানি না।
কোনোদিন কও নাই।
আলেফ রসিকতার চেষ্টা করে বললো, তোমাক হেঁদুদের আয়োস্ত্রীর মতো দেখায়, কই নাই?
কইছো। স্বামী যখন বাঁচে আমি তখন আয়োস্ত্রী না তো বিধবা হবো নাকি?
চাকরির একসময়ে আলেফকে দীর্ঘকাল হিন্দুপল্লীতে বাস করতে হয়েছিলো। আলেফের স্ত্রীর মিশুক স্বভাবের জন্য হিন্দুমেয়েরা আলেফের বাড়িতে যাতায়াত করতো। কেন তা বলা যায় না, আলেফের স্ত্রী তাদের কাছে লেস বোনা জামা সেলাই করা যেমন শিখেছিলো তেমনি পায়ে আলতা দিতে প্রথমে, পরে কপালে সিঁদুরের টিপ দিতে। এখন অবশ্য সে আলতা বা সিঁদুর ব্যবহার করে না কিন্তু এঁটোকাঁটার বাছবিচার করে। এবং অত্যন্ত কৌতুকের ব্যাপার, কোনো মাংসই খায় না। একসময় ছিলো যখন আলেফ এসব নিয়ে বিদ্রূপ করেছে স্ত্রীকে কিন্তু স্ত্রীর নির্বিরোধ দৃঢ়তাই জয়লাভ করেছে শেষ পর্যন্ত। এসবের গোপন কারণ অবশ্য এরফান জানে। আলেফের স্ত্রী তার ছেলের মঙ্গল কামনা থেকে মাংস খায় না। এটাকে এরফান প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও মনে মনে প্রশংসা করে।
আলেফ বললো, কাল সকালে চিঠি দিয়ো, দেখবো ছাওয়াল তোমার কত লায়েক হইছে।
ওরকম করে কথা কও কেন, ছাওয়াল এখন বড়ো হইছে।
আট-দশদিন পরে আলেফের মনে হলো ছেলেকে একটা চিঠি লেখা দরকার। সহসা এ কর্তব্যবোধটা জাগ্রত হওয়ার কারণ আগের দিন সন্ধ্যায় এরফানের সঙ্গে আলাপ করে সে বুঝতে পেরেছিলো ছেলেকে কলকাতায় রেখে পড়ানোর অর্থ মাসে সত্তর-আশি টাকা খরচ।
আলেফ আঁতকে উঠে বলেছিলোকস কি? সে যে আমার পিন্সানের সব টাকা দিলেও হয় না।
–তা কি করবা। ছাওয়ালেক ডাক্তার করতি গেলে তা লাগে।
আলেফ নিজের অর্থকৃচ্ছতার কাল্পনিক ও অর্ধসত্য কাহিনী দু-একটি উত্থাপন করেছিলো কিন্তু এরফান এতটুকু সহানুভূতি দেখায়নি। বরং ভয় দেখিয়েছিলো বেশি জোরজার করলে ছেলেই হাতছাড়া হবে। এরকম ভালো ছেলে এরকম ঘরে সব সময়ে হয় না। তার মামাবাড়ির দেশের যে কোনো সচ্ছল গৃহস্থ জামাই করে ছেলেকে ধরে রাখতে পারবে, পড়াতেও পারবে।
রাত্রিতে অনেকটা সময় সে চিন্তা করে স্থির করলো ছেলেকে বাড়িতে এনে নিজের খপ্পরে পুরতে হবে, তারপর অন্য কথা।
খুব সকালেই গ্রামের ডাকঘরে চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলো আলেফ, এরফানও বেরিয়েছিলো লোহারের দোকানে নিড়ানি তৈরি করানোর জন্যে।
ফিরতি-পথে এরফান হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো। তার সম্মুখের ঘাসবনটা দুলছে, ভিতর থেকে। একটা ঘোঁত ঘোঁত শব্দও উঠছে। শুয়োর না হয়ে যায় না। এরফান নিঃশব্দে সরে যাবার চেষ্টা করছিলো, এমন সময় সে জঙ্গলের মধ্যে সবুজে রঙের আলখিল্লা ও শাদা দাড়ির কিছু কিছু দেখতে পেলো।
সোভানাল্লা, বড়োভাই! কী করো?
কথাটা শুনতে পেয়ে আলেফ থেমেছিলো, রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে এরফানকে দেখতে পেয়ে হাসি হাসি মুখে বললো সে, বুঝলি না, লটা ঘাস! কুশেরের মতো লাগে। ছোটোকালে খাইছিস মনে নাই।
তা খাইছি, কিন্তু এখন কি তুমি আবার ছোটোকালের মতো কায়েফলা আর লটা খায়ে বেড়াবা নাকি?
না, না, আমি খাবো কেন্? গোরু ভালো খায়।
তোবা। গোরুর ঘাসও কাটবা?
আলেফের মতি স্থির করা কঠিন হলো। ঘাস তুলে তুলে ইতিমধ্যে সে ছোটো একটা আঁটি করে ফেলেছে। করুণ চোখে একবার ঘাসের আঁটির দিকে, একবার এরফানের মুখের দিকে চাইতে লাগলো সে।
থাক থাক, মায়া ছাড়তে না পারো-বাড়ি যায়ে রাখালেক পাঠায়ো।ও আর তোমাক মানায় না।
বিপর্যস্ত আলেফ এরফানে পিছন পিছন চলতে চলতে বললো, ঠিকই কইছিস।
এরফান সে কথায় ফিরে না গিয়ে বললো, ছাওয়ালেক চিঠি লিখলা?
লেখলাম!
গালমন্দ করে নাই তো?
তা করবো কেন।
বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে আলেফ বললো, ডাকঘরে যায়ে এক কথা শুনে আসলাম।
কী কও?
জমি কিনবি?
জমি-জমি, আবার বুঝি ঘুরানি লাগছে। গান তাইলে ওরা এখনো বাঁধে নাই।
না, না, তাই কই নাই। শুনলাম রামচন্দর মণ্ডল জমি বেচে। বুঝলি এক লপ্তে আট-দশ বিঘা কি তারও বেশি হবের পারে। এ-তো না-খাওয়ার সুঁই না। ন্যায্য দামে কিনব, তার কী কথা কে কবি। আর জমি বুঝলি না, সে যেন কথা শুনে ফসল দেয়। রামচন্দরের জমি!
জোত্দার হবের চাও?
জোত্দারি আর কনে, একটুক বাড়ায়ে বাড়ায়ে খাতে হয়।
জমি কিনবা, লটা ঘাসও বাঁধবা, এ কেমন বুঝি না।
আলেফ আবার চুপ করে গেলো।
একই বাপ-মায়ের সন্তান আলেফ এবং এরফান সেখ। আলেফ বড়ো, এরফান ছোটো। দু ভাই একই সঙ্গে প্রায় একই অফিসে চাকরি করেছে, একইসঙ্গে পেন্সান নিয়ে ফিরেছে গ্রামে। কথাটার চারিদিকে এক পাক ঘোরা দরকার। ইস্কুলের মাঝামাঝি এসে সে পথে দুজনের কেউই আর চললোনা। আলেফ প্রায় তখন তখনই সরকারি কাজে লেগে গেলো, আর এরফান লাগলো পৈতৃক চাষবাসের কাজে। সকালে গোরু তাড়িয়ে নিয়ে মাঠে যেতো, আর সন্ধ্যায় ফিরতে গোরুগুলিতে তাড়াতে তাড়াতে। তখন তার মুখে না ছিলো সুখের চিহ্ন, না ছিলো বিমর্ষতা। তারপর তার সরকারি চাকরি হলো আলেফের চেষ্টায়। উন্নতিও হয়েছিলো, পিওন থেকে বাবু, এগারো থেকে একশ দশ।উন্নতিটা জোগাড়ের বেলাতেও ছিলো আলেফ।কাকে কোথায় তদ্বির করতে হবে, কাকে এনে দিতে হবে শিলিগুড়ির কমলা, গোয়ালন্দের ইলিশ, এবলে দিতে যেমন আলেফ, সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে দিতেও তেমনি সে। লোকে বলে, সেজন্যই নাকি দাদা চাকরির বাইরে যেতে ভাইও স্বেচ্ছায় বিদায় নিলো।
আলেফ এরফানের পাশে হাঁটছে। আলেফের মাথায় ছাতা,হাতে লাঠি। একবুক সাদা দাড়ি। পায়ের জুতোজোড়া বোধ হয় একটু বড়ো। মাটির পথে যত শব্দ হওয়া উচিত তার চাইতে জোরে একটা ফাপা শব্দ হচ্ছে আলেফের পায়ে পায়ে।
ছাতিটা পিঠের উপরে রেখে দুই বাহুতে আটকে সামনের দিকে টেনে ধরলে খানিকটা দেহভারও বোধ হয় তার উপরে হেলিয়ে দেওয়া যায়। তেমনি করে চলছে এরফান। তার গড়ন বলিষ্ঠ, যদিও তার মাথার চুলগুলো ধবধবে শাদা।
এরফানের ঘরে ছেলে নেই, মেয়ে নেই, দুই বউ আছে।
আলেফের সংসারও ছোটো, বহুদিন শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর সংসারই ছিলো। ছেলে হওয়ার আশা যখন সে প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন তার একটি ছেলে হলো। বউ যায় যায়। এরফানের স্ত্রী পলতেয় করে দুধ খাইয়ে মানুষ করেছে। বড় হয়েও ছেলে অধিকাংশ সময় চাচীর কণ্ঠলগ্ন হয়েই থেকেছে মামার বাড়িতে পড়তে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। আলেফের কুটুম্ব মোক্তার। তার বাড়িতে কিছু লেখাপড়ার চর্চা আছে।
এরফানের দ্বিতীয় স্ত্রী দিঘা বন্দরের শালকর ইস্কান্দার বন্দীপুরের মেয়ে। এরফানের প্রথমপক্ষের শ্বশুর সম্পন্ন গৃহস্থ। ধান ও পাটের চাষে তাদের অবস্থা ভালোই বলতে হবে, কিন্তু সে পরিবারে কারো অক্ষরজ্ঞান নেই। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সম্পর্কিত যে যেখানে আছে সবাই কিছুদিন লেখাপড়া করেছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী নিজেও লিখবার মতো জ্ঞান রাখে। তার তিন ভাইয়ের মধ্যে দুজন রেল কোম্পানিতে চাকরি করে, সর্বকনিষ্ঠ যুদ্ধে গেছে। ছোটোবউ সুর্মা চোখে দেয়, জামা গায়ে দেয়, জড়িয়ে জড়িয়ে শাড়ি পরে, মেহেদি পাতার নির্যাস দিয়ে পা রাঙিয়ে রুপোর মল ও চটি পরে, বোরখা ছাড়া পথ চলেনা। কোনো কাজই করেনা সারাদিন। মুটিয়ে গেছে, ছেলেপিলে এরও হবে না।
সম্বন্ধটাও স্থির করেছিলো আলেফ। দুই ভাই যখন চাকরি করে, এবং গ্রামের বাড়িতে খড়ের চালের পরিবর্তে টিনের চাল উঠেছে, আলেফের সখ হলো অভিজাত ঘর থেকে একটি কন্যা আনার। শালকর ইস্কান্দার বন্দীপুরের সঙ্গে তার আলাপ ছিলো। ইস্কান্দারের পূর্বপুরুষরা নাকি অযযাধ্যার নবাব পরিবারের কাজ করতো। এখনও তাদের পরিবারে উর্দু লৰ্জ চালু আছে। আলেফের কথায় ইস্কান্দার অন্য কোথাও খোঁজ না করে নিজের মেয়ের সঙ্গেই বিবাহের প্রস্তাব তুলে বসলো। কিন্তু এবার আলেফ মত বদলালো। দেনমোহর বাবদ দু হাজার টাকার কথা উঠতেই পিছিয়ে গেলো সে, এবং এরফানকে এগিয়ে দিলো। তবু বিবাহের ব্যাপারে কিন্তু আলেফের উৎসাহই বেশি প্রকাশ পেলো। খানাপিনার ধুমধামে, সামাজিকতার উচ্ছ্বাসে সে সর্বত্র এই কথা প্রচার করে দিলো–যেনতেন ঘরের মেয়ে আনেনি সে ভ্রাতৃবধূ হিসাবে। রইরইস না । হতে পারে, কিন্তু অযোধ্যার খানদানি ঘর। বিবাহের সভায় ও ভোজের আসরে আলেফ বেশ সুক্রিয়া, খায়ের প্রভৃতি উচ্চারণ করে বাল্যের উর্দু শিক্ষা কাজে লাগিয়েছিলো।
কথাগুলো মনে পড়ায় এরফানের মুখে এখন একটা হাসি ফুটলো।
মাঝে মাঝে এরফানের দ্বিতীয়পক্ষের শালা-সম্বন্ধীরা আসে। বাড়িতে আনন্দের হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। তিন-চার বছর আগে তার বড়ো সম্বন্ধী ঈদের সময়ে বউকে সঙ্গে করে এসেছিলো। শাদা প্যান্ট শাদা কোট, চকচকে নতুন জুতোয় রেলের চেকারবাবু। কিন্তু একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিলো।কুরবানির মাংস হিসাবে এক-আধ সের গোমাংস এর আগেও বাড়িতে আসেনি এমন নয়। ভাই এসেছে এজন্য একটু ভালোরকমের উৎসব করার সাধ হয়েছিলো ছোটোবউয়ের। বাড়ির একটা দামড়া বাছুর কুরবানির জন্য সে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। অন্যান্য দিন রান্নাঘরের ভার থাকে বড়োবউয়ের; সেদিন ছোটোবউ রান্না করবে বলেবড়োবউ কাদামাটি গুলে নিয়ে বাইরের ঘরের দাওয়া পৈঠা নিকোতে গিয়েছিলো। চাকর যখন গোমাংস নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছে তখন লাগলো বিবাদ। অবশ্য সেটাও একই পক্ষের। বড়োবউ মিনমিন করে ভয়ে ভয়ে বলেছিলো–কে, ছোটু, ও মাংস তো রান্নাঘরে রাঁধা হয় না। আর যায় কোথায়! ছোটোবউ ফেটে পড়লো। কুফরির ঘরের মেয়ে, এর থেকে আরম্ভ করে, নমশূদ্র, চাড়াল প্রভৃতি বলে বড়োবউকে নানাভাবে হীন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে অবশেষে এরফান আসতেই সে বলে বসলো, ও যদি এ বাড়িতে থাকে তবে সে নিজে আজই ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাবে। বড়োবউ তরস্কৃত হয়ে কাদামাটি হাতে নীরবে কাঁদতে লাগলো। ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে না যদি, ছোটোবউ নিজের বাড়ির দামড়াটা কুরবানিতে না দিতো, কিংবা বড়োবউ তার বক্তব্যটা কুটম্ব-স্ত্রীর সম্মুখে উল্লেখ না করতো।
উৎসব অবসান হলে এরফানের শ্যালক যেন লজ্জিত হয়েই চলে গেলো। এরফান অন্যান্য দিনের তুলনায় গভীর রাত পর্যন্ত বাইরের দাওয়ায় বসে তামাক খেয়ে অন্দরে শুতে এসেছিলো। অন্দরের উঠোনের দুপাশে দুখানা ঘর, ছোটো এবং বড়োবউয়ের। দীর্ঘ আট-দশ বছরে যা মনে হয়নি সেদিন এরফানের তাই হলো। কোন ঘরে শুতে যাবে দ্বিধা করলো সে। ছোটোবউয়ের ঘরে দরজার পাশে ছোটোবউ দাঁড়িয়েছিলো, তবু নীরবে বড়োবউয়ের ঘরে ঢুকলো সে।
মলিন থান পরা বড়োবউ স্নান চেরাগের আলোয় বসে শীতকালের জন্য কাঁথা সেলাই করছিলো। এরফান বিছানায় বসে কেশে গলা সাফ করে বললো, শোবা না?
–তুমি শোও গা, আমি শোবো নে।
–উঠে দুয়ার দেও।
বড়োবউ বুঝতে না পেরে দুয়োরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। দশ বছর বাদে এ-ঘরে শোবো একথাটা বলতে এরফানের লজ্জা করছিলো, সে আর কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। দরজা বন্ধ করে চেরাগ উস্কে দিয়ে বড়োবউ আবার সেলাই নিয়ে বসলো। এরফানের শোয়া হলো না। সে উঠে এসে বড়োবউয়ের পাশে বসলো, কিছুকাল নিচু স্বরে আলাপ করে বড়োবউয়ের মনের গ্লানি দূর করার চেষ্টা করলো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যা করলো সেটাই উল্লেখযোগ্য। ঈদের দরুন নতুন কাপড় জামা এসেছিলো। ছোটোবউ, কুটুম্বদের, এরফানের নিজের জন্য, এমনকী বাড়ির চাকরটির জন্যও। এরফানের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখার ভার বড়োবউয়ের উপরে। এরফান দেখতে পেলো ঘরের এক কোণে কাঠের বাক্সের উপরে তার নিজের জন্য আনা ধোলাই ধুতিজোড়া রয়েছে। সে নিজের হাতে করে নতুন ধবধবে ধুতিখানা এনে বড়োবউকে পরতে দিলো। বিস্মিত বড়োবউ কিছু বলার আগে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তারশনের নুড়ির মতো পাকা চুলে, জরাজীর্ণ গালে সেশত শত চুমু দিতে লাগলে। বিছানায় শুয়েও এরফান বড়োবউয়ের মাথা নিজের বাহুর উপরে তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে তার শাদা চুলগুলোতে সিঁথি কেটে দিলো।
অনেক আদরে মুখ খুলে বড়োবউ বলেছিলো–কে, আমার বাপ ভাই যেন মুরুখু, আমি কি ভালোবাসি নাই আপনেক?
-সোনা, সোনা।
কিন্তু গভীর রাত্রিতে এরফান ঘুমন্ত বড়োবউয়ের ঘরের দরজা সন্তর্পণে ভেজিয়ে দিয়ে ছোটোবউয়ের ঘরে ফিরে গিয়েছিলো।
পুরনো ঘটনা, তবুও এরফানের এখন মনে হলো, লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা যার অভ্যাস সেদিন তাকে অমন করে আঘাত না দিলেও চলতো। সে কারো পাকা ধানে মই দেবার মতো লোক নয়। পাকা ধান, ধানের হিসাব সবই তো তোমার দখলে, বাপু। এই তো আবার চাদির চন্দ্রহারে গিল্টি করার সখ হয়েছে তোমার, আর সেই কত বৎসর আগে ধান পাকার সময়ে সে শেষবারের মতো হয়তো কিছু চেয়েছিলো। কিছুই চায় না সে।
এসব মনে হওয়ার কারণ এই ছিলো, কাল রাত্রিতে ঘুমটা ভালো হয়নি এরফানের। ছোটোবউ গাল ফুলিয়ে রাগ করতে বসলো। নিদ্রাবঞ্চিত চোখ দুটি করকর করছে। এরফান স্থির করলো আজ থেকে সে বড়োবউয়ের ঘরে ঘুমুবে। ঘুমুলে মুখ দিয়ে ফৎ করে শব্দ হয় বটে, কিন্তু শীতল-স্নিগ্ধ সে। বহুদিন পরে দেখা হলেও চোখ মুখ দেখেই সে বুঝবে।-চেরাগ নিবায়ে দি, ঘুমাও। চুলে হাত বুলায়ে দেবো? হয়তো এসবই বলবে সে।
ছোটোবউয়ের রাগের উপলক্ষ্যগুলি আলোচনা করে সেগুলিকে অকিঞ্চিৎকর বিষয় বলে মনে হলো। তার প্রথম ফরমায়েস হলো–একটা সামাই-এর কল লাগবি।
–কী হবি? বছরে তোমার কয় মন সামাই লাগে? দোকানে কেনা সামাইয়ে হয় না কেন?
মেয়েছেলেদের সখ হয় বটে এমন তুচ্ছ জিনিসে, এরফান ভেবেছিলো এরপর সদরে লোকজন যখন যাবে বলে দেবে আনতে। কিন্তু এ ব্যাপারে মনস্থির করেও গল্পচ্ছলে এরফান বলেছিলো–যাই কও, সামাই যে লোকে খায় কে, বুঝি না। পায়েস যদি খাতে হয় নতুন আমনের আতপ আর খেজুরের গুড় আর দেও ক্ষীর।
এ আলাপের তবু নিষ্পত্তি হয়েছিলো কিন্তু দ্বিতীয় বায়নার বেলায় অন্যরকম হলো। ছোটোবউ বললো, পোশাক-আসাক ভালো করার লাগে।
–কেন, এখন পোশাক-আসাক ভালো করলে কি তাজা হবে?
–তা কই না। তাজা পুরুষ দিয়ে কী করবো? আমার ভাই আসবি, তার সামনে জোলা সাজে বেড়াতে পারবা না।
–জোলা হবো কেন, আমি কি কাপড় বুনবের পারি?
–তানা। তুমি ধুতি পরে থাকো, বেমামান লাগে। ময়লা মোটাধুতি মানায় না যেন তোমাকে।
–কী করা লাগবি?
–কেন, সকলে পায়জামা পরে, তুমিও পরবের পারো।
–তা পরবো কেন, আমি সায়েব না পশ্চিমা যে দু-চুঙ্গি পরবো?
–তাই বলে আমার ভাইয়ের সামনে তুমি ময়লা ধুতি পরে বেড়াবা, তা হবি নে।
–বেশ তো, তোমার ভাই যা চোখে দেখে নাই তাই করবো। সান্যালমশাই চাপড়ির কাপড়-চাদর পরে, তাই পরবো। একটু কড়া মুখেই বলেছিলো এরফান।
এরপরই রাগ হয়েছিলো ছোটোবউয়ের। ভাই চোখে দ্যাখেনি, এই কথাটাই রাগের পক্ষে যথেষ্ট ছিলো, তার উপরেও ছিলো সান্যালমশাইয়ের অনুকরণে কাপড় পরার কথা।
এরফান স্ত্রীকে ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য বলেছিলো : চাপড়ি একটা জায়গার নাম। সেখানকার জোলা-তাঁতীরা সূক্ষ্ম চাদর আর কাপড় বুনতে পারে। এবং সেই কাপড় ও চাদর এখন কয়েকটি বিখ্যাত পরিবারেই ব্যবহৃত হয়, বাজারে বিক্রি হয় না।
দ্বিতীয় দফায় এরফান স্ত্রীর যুক্তির উত্তরে বলেছিলো–আমি যদি চাপড়ি পরলে দোষ হয়, তুমিও পাবনার শাড়ি পরবের পারবা না, পাঞ্জাবি আর ঘাগরা কিংবা পায়জামা পরবা। পারবা? কেন, লজ্জা করে? আমারও করবের পারে তো!
এখন এরফানের মনে হলো ব্যাপারটা অত হাল্কা নয় যতটা সে ভেবেছিলো। তার অনুভব হলো কোনো কোনো বিষয়ে ছোটোবউয়ের সঙ্গে আলেফের চরিত্রগত মিল আছে। পেন্সান পওয়ার আগে থেকেই আলেফের পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। মাথায় ফেজটুপি পরা, হাঁটু ছাড়িয়ে জামার ঝুল দেওয়া, ধুতির বদলে পায়জামা। গ্রামে এসেও সে যেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে
নিজের পার্থক্য ফুটিয়ে তুলতে চায়। একদিন আলেফ এরফানকে দাড়ি রাখতেও অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু এরফান নিজের পোশাক বদলায়নি, দাড়িও রাখেনি। এক মৌলবী সাহেব বলেছিলোধুতি পরে নমাজ পড়া গুনাহ্। তারই ফলে ঈদের নমাজ পড়ার সময়ে এরফান একজোড়া পায়জামা ব্যবহার করে। অন্য সময়ে সেটা বাক্সে তোলা থাকে।
চরিত্রগত মিলটা সব সময় চোখে না পড়লেও, সে এ বিষয়ে কৃতনিশ্চয় হলো। বাল্যে যাদের সঙ্গে খেলাধুলো করেছে সেই সব প্রতিবেশী ও সে যে এক নয় তার প্রমাণ দেওয়ার জন্যই সুযোগ পেলেই আলেফ বলে–তারা সৈয়দ বংশীয় পাঠান। এরফান বুঝতে পারে না পাঠানত্ব কোথায় অবশিষ্ট আছে। ইতিহাস পড়া থাকলে সে হয়তো সৈয়দ এবং পাঠান একইকালে কী করে হওয়া যায় এ নিয়েও চিন্তা করতো। তেমনি ছোটোবউ প্রচার করে–সে অযযাধ্যার অধিবাসিনী। একটা কথা বলে দেওয়া যায়–দুজনেরই প্রাধান্য পাবার আকাঙ্ক্ষা খুব বেশি।
কিন্তু শান্তি পায় কি? আলেফকে মাঠে মাঠে হুটহাট করে বেড়াতে হয়, মক্তবের জন্য টাকা খরচ করতে হয়। বড়োবউ তাকে শাস্তির হদিশ দিতে পারে এই অনুভব হলো এরফানের।
বাড়ির কাছাকাছি এসে আলেফ বারকয়েক ছোটোভাইয়ের মুখের দিকে চোরা চোখে চেয়ে দেখলো। তারপর বললো, কী কস, রামচন্দ্রর জমিগুলোর একবার খোঁজ নিবি?
এরফান আলেফের মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলো।
প্রস্তাবের সময় খুব মনোযোগ না দিলেও, বলছে যখন বড়োভাই এরকম মন নিয়ে এরফান গিয়েছিলো রামচন্দ্রর কাছে জমির সংবাদ নিতে। ফেরার পথে সে শুনে এলো চৈতন্য সাহা বিপাকে পড়েছে, চাষীরা জমিতে চাষ দিচ্ছে না, উপর থেকে জমিদার খাজনার জন্য চাপ দিচ্ছে। চৈতন্য সাহার জন্য কিছুমাত্র সমবেদনা অনুভব করলোনা সে,বরং তার মনে হলো অতিলোভের এরকম ফলই হয়ে থাকে।
সন্ধ্যার পরে আলেফের সঙ্গে দেখা করার জন্য এরফান নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলেফের বাইরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। আলেফের রাখাল ছেলেটা খবর এনে দিলো আলেফ তখনো বাড়িতে আসেনি, জোলার জমি দেখতে গেছে। দাদার প্রতীক্ষায় এরফান এদিক ওদিক ঘুরে অবশেষে নামিয়ে রাখা গোরুর গাড়িটার জোয়ালের উপরে গিয়ে বসলো। যেখানে সে বসেছিলো সেখান থেকে মসজিদের বারান্দাটা খুব দূরে নয়। সে লক্ষ্য করলো ফকির মসজিদের বারান্দায় বসে একমনে কুলোয় করে চাল বেছে যাচ্ছে। তাকে দেখলে একটা নিবু নিবু চেরাগের কথা মনে হয়। আগেও যেমন, এখনো তেমনি, থরথর করে কাঁপছে কিন্তু হঠাৎ কিছু হবে বলে মনে হয় না। একবেলার আহার্যমাত্র তাকে দেয় আলেফ। যেদিন প্রথম প্রস্তাবটা শুনেছিলো ফকির সে বলেছিলোতা বেশ, বাবা, বেশ। একবেলাই ঢের। আলেফের কাছে ফকির একটা জামা চেয়েছিলো, না পেয়ে নির্বিকার মুখে বলেছিলোতা বেশ, বাবা। বোধ হয় ‘বেশ, বাবা, বেশ’বলাটা ফকিরের মুদ্রাদোষ, কিন্তু শুনে সহসা মনে হয়, সবই ভালো তার কাছে, বেশ চলছে দুনিয়াটা।
এরফান পায়ে পায়ে মসজিদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, দরবেশজী, কী করেন, সেলাম।
সেলাম, বাবা, সেলাম।
কী করেন?
চাল কুড়ায়ে আনছি, বাছি।
কেন, একবেলা কি রাঁধে খাওয়া লাগে?
কেন, এবেলা তো আপনার বাড়ি থিকে খাবার দিয়ে যায় আপনার চাকর।বড়োবিবিসাহেবা পাঠায়।
দেয় নাকি? তা কি জানি। চাল দিয়ে কী হয় তবে?
বাবা, একটা জামা লাগবি। জার আসবি, তার আগে একটা যইসই বানায়ে নেওয়া লাগে। পয়সার জন্যি চাল বাঁচাই’
এরফান ফিরে এসে তার আগের আসনে আবার বসলো। সে মনে মনে বললো–বেশ, বাবা, বেশ নয়। এ, বাবা, সংসার। এর নামই তাই। কারো রেহাই নেই না ভেবে। তুমি ফকির, তোমাকেও ফিকির করতে হয়। আমরাই শুধু ধান-পান জমি-জমা হুই-হাই করে বেড়াই না। এই তো আমি ভেবেছিলাম, শান্ত হবো, পারলাম? তার চাইতে ভালো জমির সন্ধান পেয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম রামচন্দ্রর কাছে খোঁজ করতে। তখন ভাবিনি, রামচন্দ্র যদি গাঁ ছাড়ে তবে সে কত কষ্টে দগ্ধ হয়ে। বড়োভাইকে কী দোষ দেব?
কিন্তু ফকিরের স্থৈর্যও অস্বীকার করা গেলো না। ওই যে চাল বেছে যাচ্ছে সে মাথা নিচু করে, সেও যেন ঘুমের মতো ব্যাপার। হ্যাঁ, এটাই ঠিক চেহারা ফকিরের। ঠিকটা যে কী তা ভাষায় এলো না, অনুভবটা হলো :এই যেমন নড়াচড়া নেই। বাঁচার অনিচ্ছা নয়, বরং বাঁচতেই যেন চাওয়া। ফকির নিজেও বলে, যতদিন বাঁচা যায় আল্লার খিদম করা যায়। তার খিদমদ বলতে এক আজান দেওয়া। বাঁচতেই সে চায় কিন্তু সে যেন গাছের বাঁচা, কিংবা মনে করো, চিৎসাঁতার দিয়ে নদী পার হওয়া।
সাঁতারের তুলনাটা আলেফই দিয়েছিলো। একদিন চারিদিকের অবস্থার কথা উত্থাপন করে এরফান বলেছিলো–দুনিয়ার গজব, বড়োভাই। কী যে দাড়ি ভাসায়ে হুটপাট করে বেড়াও?
প্রত্যুত্তরে আলেফ বলেছিলোকস কী! জলে যেন ডুবতিছি, তাই বলে কি প্রাণী হাত-পাও ছুঁড়বি নে? তখন এরফান লাগসই কথাটা খুঁজে পায়নি। এরপর যদি কখনো আলেফ এই ধরনের কথা বলে, এরফান হাত-পা না-ছুঁড়ে চিৎসাঁতারের কথা বলবে।
এরফান বাল্যে পদ্মায় সাঁতার দিতো। চিৎসাঁতারের আনন্দটা তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। যদি পরপারের কোনো একটা জায়গায় পাড়ি জমানোর গরজ না থাকে তবে চিৎসাঁতার না দিয়ে বুকে যে জল ঠেলে তাকে বেয়াকুফ ছাড়া আর কী বলা যায়।
বড়োভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো না। আর একটু বসে থেকে এরফান ফিরে গেলো। তার নে হলো বড়োবউ এবং ফকিরের দলেই সে থাকবে।
.
দু’এক মাস পরে আলেফ আবার অস্থির হয়ে উঠলো। চিকন্দির চাষীদের জমি সম্বন্ধীয় অবস্থায় অপ্রত্যাশিত একটা পরিবর্তন হয়েছে। চৈতন্য সাহার দুদিক বাঁচানোর চেষ্টায় এই সাব্যস্ত হয়েছে, জমিদার তাকে খাজনা পরিশোধের জন্য ছ মাস সময় দেবে, আর সে নিজে চাষীদের খাইখালাসি জমিগুলি মাত্র আর-এক সন দখলে রেখে ছেড়ে দেবে; এ সনে চাষীরা যদি তার খাইখালাসি বদ্ধ জমিতে চাষ দিয়ে আউস আমন তুলে দেয়, তবে খোরাকির ধানও সে দেবে। কিন্তু রেহানবদ্ধ জমির বেলায় কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ওদিকে মিহির সান্যাল বলেছে, সে এমন কোনো প্রস্তাব মানতে রাজী নয়। রেহান বদ্ধ জমি মায় সুদ আসল পেলে খালাস দেবে সে, কিন্তু খাইখালাসিবদ্ধ জমির বেলায় সুদ আসলের কোনো প্রশ্নই নেই, দু বৎসরের ফসলের আনুমানিক মূল্য ও জমির খাজনা পরিশোধ করে দিতে হবে। সে একাধারে মহাজন এবং জমিদার, কাজেই তার প্রজাদের অবস্থা সর্বাপেক্ষা বিপন্ন। চিকন্দির চাষীরা চৈতন্য সাহার শর্ত মেনে নিয়েছে। মিহির সান্যালের প্রজারা জমি বিক্রি করে দেবে এরকম কথা শোনা যাচ্ছে। এরকমই এক প্রজার নাম ইসমাইল আকন্দ। আলেফদের জোলার জমির পাশে প্রায় পাঁচ-সাত বিঘা জমি আকন্দর। বিপাকে পড়ে সে খাইখালাসি বন্ধক রেখেছিলো মিহির সান্যালের কাছে। আলেফ খুঁটে খুঁটে খবর নিতে গিয়ে ইসমাইলের ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছে। কিছুক্ষণ আলাপের পর ইসমাইল বলেছিলোবড়োমি, মনে কয় জমি বেচে দিয়ে অন্য কোথাও খানটুক জমি নিই। এমন মহাজন জমিদারের জমি রাখা যায় না।
তা নেও না কেন, সান্যালমশাইয়ের কোনো জমি পত্তনি নেও।
পারি কই, ট্যাকা নাই যে।
কেন, কলে যে এ জমি বেচবা?
কে কেনে কন্? জমির দাম যা হোক তা হোক, মিহিরবাবুর ফসলের দাম কে দেয়।
সে কতকে?
দুই সনের ফসলের দাম ফেলাইছে ছয়শ বিশ।
ই আল্লা! অমন দাম হয়?
তা বাজার দরে দুই সনের ধানে কলাইয়ে হবি। কন্, জমির দাম দিয়ে কলাইয়ের দাম দিয়ে কেডা অত টাকা একসাথে বার করে দেয়?
সোভানাল্লা, জমির দাম কতকে!
তা সাত বিঘা সাতশ হবি।
আলেফ ইসমাইলের সম্মুখে উবু হয়ে বসে পড়ে বললো, সাতশ আর হয় না, কেন্?
পুরাপুরি হয় না। ছয় বিঘা কয়েক কাঠা জমি। এদিনে হিসাব করে নিলে সাড়ে ছয়শ হবি। দু’তিন দিন আলেফ ছুটোছুটি করে বেড়ালো। পায়চারি করে মনস্থির করার মতো অনুদ্দিষ্ট ঘোরাফেরা। ইতিমধ্যে একদিন গহরজান সান্দারের বাড়িতেও সে গেলো। জোলার জমিতে দুই সনের ফসলের আনুমানিক মূল্যটা স্থির করাই তার উদ্দেশ্য ছিলো। আলেফ মনে মনে হিসাব করে দেখলো জমি কিনে এবারই নিজের দখলে আনতে হলে পনেরোশ টাকা নিয়ে নামতে হয়। নতুবা শুধু জমি হস্তান্তরে কী লাভ? মিহিরবাবুর কাছে খবর নিয়ে সে জানলো ইসমাইল তাকে ঠিক খবরই দিয়েছে।
কিন্তু শেষ পরামর্শটা করা দরকার এরফানের সঙ্গে। পরামর্শ করার আগে জমিটার চৌহুদ্দিগুলি আর একবার পরখ করার জন্য আলেফ প্রত্যুষে বেরিয়ে পড়েছিলো। অনেকটা বেলা পর্যন্ত জমিটার চারিদিকে চষে বেড়ানোর মতো ঘোরাফেরা করে দুপুরের আগে সে এরফানের বাড়ির দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলো। এরফানের বাড়িতে যাবার পথ তার নিজের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে। তন্ময় হয়ে চলতে চলতে সে লক্ষ্য করেও করলো না, তার বাড়ির দরজায় একটা টোপর দেওয়া গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আল থেকে মাঠ, মাঠ থেকে আবার আল ধরে সে এরফানের দরজায় গিয়ে ডাক দিলো, এরফান রে!
এরফান তেল মেখে স্নানের আগের তামাক টানছিলো, সাড়া দিলো।
পাঁচশ টাকা দিবা?
এরফানের হাসি পেলো–দুপুর রোদে টাকার কথা, পাঁচশ টাকার কথা, তাও না বসে, না জিরিয়ে, বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় পথ থেকেই।
এরফান বললো, কেন্, ছাওয়াল চালে বুঝি?
ছাওয়াল? সে আবার কী চায়? সে তো কোলকেতায়।
তাই কও, নেশা করছে। ছাওয়াল আসছে দ্যাখো নাই?
আলেফের এবার মনে হলো বাড়ির সম্মুখ দিয়ে আসার সময়ে অস্পষ্টভাবে একটা আসা যাওয়ার ব্যাপারের মতো কিছু যেন অনুভব হয়েছিলো তার।
আসছে নাকি? কিন্তু তোর কাছে আলাম অন্য কামে।
কী কাম? পাঁচশ টাকার?
হয়। তুই আদ্দেক দে, আমি আদ্দেক। জোলা—
কিসের জোলা? ফসলের আদ্দেক তো পাবাই।
আলেফের দৃষ্টিটা যদি ভাষা হতো তবে এখন সেটা কুণ্ঠা ও গোপন প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে তোতলা হয়ে উঠতো। এরফান তার দৃষ্টির পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পেলো না। সে বললো, তোমার অংশ বেচবের চাও পাঁচশ টাকা নিয়ে? তা করবা কেন্? ওটা পৈতৃক জমি,দুই ভাইয়েই ভোগ করবো। ও জমি আমাকেও না, কাকেও না, বিক্রি করবা না।
কথাগুলি বললো এরফান আলেফের নীরবতার অবকাশে থেমে থেমে তার স্তব্ধতার কারণ কল্পনা করতে করতে। সে আবার বললো, তুমি তো আজকাল কারো কথাই মানোনা, তা একটা কথা কই তোমাক, ছমন করে না বেড়ায়ে ছাওয়ালের দিকে মন দেও, ও ছাওয়াল বংশের গৈরব বাড়াবি।
ফেরার পথে ভাবলো আলেফ, ঝোঁকের মাথায় সামনে পিছনে না তাকিয়ে কী কাজটাই সেকরতে গিয়েছিলো।নগদ এরফানের যত আছে, তার অর্ধেকও তার নিজের নেই। পরে টাকাটা ফিরিয়ে দিলে ইসমাইলের দরুন জমির মালিকানাও এরফান হয়তো ফিরিয়ে দিতে রাজী হতো, শত হলেও ভাই তো, এই ভেবেছিলো সে; কিন্তু–
কিন্তু এরফানের এ পক্ষের সম্বন্ধীরা আবার প্যাচালো লোক। তারাও তো একটা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বসতে পারে। যদি ফিরিয়ে দিতে না চায়? এমন কী, লাঠি দিয়ে মাটি ঠুকলো আলেফ, উল্টে আলেফের অর্ধাংশও চেয়ে বসতে পারে, কিংবা জমির খবর পেলে সে নিজেই ইসমাইলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বন্দোবস্ত করে নিতে পারে।
আলেফনিজেকে শোনালো গদগদ করে–হয়, কওয়া যায় না জমির কথা। জমি যার নাম। এতক্ষণে যে রোদটা লক্ষ্যের বাইরে থেকেও পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিলো,হঠাৎ বেশ ভালো লাগলো সেটা আলেফের, যেন সেও একখণ্ড কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এসেছে। খুশির কারণটা নিজের উপস্থিত বুদ্ধি। প্রয়োজনের মুখে সে যে এমন দম মেরে থাকতে পারে এ সে নিজেও জানতোনা। অন্য কেউ হলে হয়তো জমি কেনার কথা প্রকাশ করেই ফেলত। আলেফ মিটমিট করে হাসলো–ও ভাবছে পৈতিক জোলার আদ্দেক আমি বেচবের চাই। তা ভাবুক, ক্ষেতি কি।
বাড়ির দরজায় পৌঁছে খুশি হওয়ার আর একটা কারণ পেলো সে। ছিলোই কারণটা, এতক্ষণে অনুভূত হলো। এরফান বলেছে–সেবংশের গৈরব। পুত্রগর্বে বুক ভরে উঠলো। সদর দরজার কপাটটায় দোষ ছিলো, ছেড়ে দিলে আচমকা অনেক সময়ে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। অন্যমনস্ক বা পুত্রমনস্ক হয়ে ঢুকতে গিয়ে আলেফ ফিরে আসা পাল্লায় তো খেলো।
অন্দরের উঠোনে নেমে কথা না বলে সে চোখ মেলে খুঁজলো ছেলেকে, কিন্তু কথা বলেও খুঁজতে হলো, কৈ, গেল কনে?
এই তো। আলেফের স্ত্রী হাসিমুখে বেরিয়ে এলো দরজার কাছে।
হয়। তোমাক খুঁজে চোখ কানা হইছে। গদগদ করে বললো আলেফ।
তা খুঁজবা কে, বুড়া হইছি যে।
ক্ষোভের অভিনয় করে আলেফ জামা খুলতে ঘরে গেলো।
একটু বাদে ফিরে এসে একটা জলচৌকি টেনে নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় বসে আলেফ বললো, কী কী রাঁধলা?
ডাল, ভাত, মাছ।
এরফান কী কলে জানো? কয়, ছাওয়াল বংশের গৈরব।
তা হবি।
আমিও কই ছাওয়াল পড়ুক। ডাক্তার হবি, না, উকিল হবি, তা হোক। থাক না কেন কোলকাতায়, যত টাকা লাগে তা দিবো। দেখবো ট্যাকার বাড়ি কনে।
রাখাল ছেলেটি কি একটা কাজে অন্দরে ঢুকছিলো, আলেফ হুংকার দিয়ে উঠলো, তামাক খাবের পলাইছিলি কাম ফেলে?
থমকে দাঁড়ালো ছেলেটি।
আলেফ তো আর রাগ করে বলেনি যে তার কথায় হুংকারের জের থাকবে; একেবারে সাধারণ সুরে সে বললো, তামাক সাজ।
তারা থেকে উদারায় নেমে আলেফ বললো, দুধ দোয়াইছিলি, কেন্? এক কাম করো না কেন্, সামাই দিয়ে–
রাখাল ছেলেটি ভয়ে ভয়ে বললো বিমূঢ়ের মতো, জে, সামাই দিয়ে—
আলেফ আবার বললো, সামাই দিয়ে, বুঝলা?
দুশ্চিন্তায় মাথা চুলকে রাখাল বললো, জে, সামাই দিয়ে।
আলেফ রাগ করে বললো, থাম ফাজিল, বদ্বখ্ত।
স্ত্রী বেরিয়ে এসে বললো, আমাক কতিছ বুঝি সামাই দিয়ে পায়েস করবের?
করো না কেন্। মনে করো কোলকেতায় কত হরকিসিম খাবার। সে শহর দেখি নাই, কী সে শহর!
স্ত্রী হেসে বললো, এ কি দামাদ আসছে? ছাওয়াল কয়ে গেলো বড্ড খিদে পাইছে, আম্মা।