মেয়ে দুটা কে?
তারই মেয়ে। বাবার সঙ্গে থাকে। একজনের নাম কেয়া আরেকজনের নাম
আরেকটা মেয়ে হলে তো বিপদে পড়ত, নাম রাখতে হতে গেয়া।
ভদ্ৰলোক রিকশা ভাড়া মিটালেন এবং কিছু বোঝার আগেই গলির ভেতর ঢুকে গেলেন। এতক্ষণ পাঞ্জাবি ধরে থাকা বৃথা গেল। পুরনো দিনের গদ্যের ভাষায়–চক্ষের নিমিষে পক্ষি উড়িয়া গেল।
আফতাব দুই মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাতে। ফুটপাত রাস্তা থেকে উঁচু। তিনজনই পা বুলিয়ে বসেছে। হিসাবমতো মেয়ে দুটির বসার কথা বাবাকে মাঝখানে রেখে বাবার দুপাশে। তারা সে রকম করে নি। দুইবোন হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে বসা। বড় মেয়েটির বয়স ৬/৭ হবে। ছোটটি ৪/৫। দুটা মেয়েই ফুটফুটে। আমি এগিয়ে গেলাম। অতি পরিচিত কেউ এমন ভঙ্গিতে বললাম, কেয়া-খেয়া, এত রাতে রাস্তায় বসে আছ কেন? সমস্যা কী?
তিনজনই চমকে তাকাল। আমি মেয়ে দুটির পাশে বসতে বসতে বললাম, বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে নাকি?
কেয়া বলল, হ্যাঁ বের করে দিয়েছে।
আমি বললাম, ঘটনা কী বলো? অল্প কথায় বলবে, ডিজিটাল যুগে অল্প কথা বলতে হয়।
কেয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে তার বাবা বলল, আপনাকে চিনলাম না। আপনার পরিচয়?
আমার নাম হিমু। আমি এই মেয়ে দুটার মামা হই। আপনার নাম আফতাব?
হ্যাঁ। কিন্তু এখনো আমি আপনাকে চিনলাম না।
আমি বললাম, চেনাচিনি পরে। আগে আপনাদের ঘটনা শুনি। এত রাতে আমার দুই ভাগ্নি রাস্তায় বসা-এর মানে কী? এরা কি রাতে খাওয়াদাওয়া করেছে?
মেয়ে দুজন একসঙ্গে বলল, না। ছোট মেয়েটা বলল, মামা! বাবার কাছে টাকা নাই।
আমি বললাম, টাকা না থাকলেও খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কেয়া মা এবং খেয়া মা, বলো কী খেতে চাও? পোলাও, মুরগির রোস্ট, সঙ্গে ডিম ভুনা—চলবে?
দুজন আবারও একসঙ্গে বলল, চলবে।
খাবারের সঙ্গে কোক বাঁ পেপসি এইসব কিছু লাগবে? কেয়া বলল, আমি খাব সেভেন আপ। খেয়া বলল, আমি ফান্টা।
আমি বললাম, খাওয়ার প্রবলেম সেটেল হয়ে গেল। এখন আফতাব ভাই, আপনার প্রবলেম শুনি। বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন নাই বলে বহিষ্কার?
আফতাব বলল, মেয়ে দুটিার সামনে বলতে চাচ্ছি না।
আমি বললাম, এদের সামনেই বলতে হবে। বাচ্চাদের সমস্যা থেকে দূরে রাখা যাবে না। এরা বড় হবে সমস্যার মধ্যেই।
আফতাব আমাকে হাত ধরে চায়ের দোকানের কাছে নিয়ে গলা নিচু করে সমস্যা বললেন।
সমস্যা জটিল না, সাধারণ সমস্যা। আফতাব একজনের সঙ্গে সাবলেট থাকতেন। ছমাসের ভাড়া বাকি পড়ায় এই অবস্থা। ছমাস ধরে আফতাবের চাকরিও নাই। এক কনষ্ট্রাকশান কোম্পানিতে কাজ করত। রড চুরির দায়ে চাকরি চলে গেছে।
রড চুরি করেছেন?
হুঁ।
এই প্রথম চুরি করেছেন না। আগেও করেছেন?
আগেও করেছি; ফর্মেসিতে যখন চাকরি করতাম তখন করেছি। বড় চুরি না, ছোটখাটো চুরি।
রড চুরিটাই বড়? নাকি এরচেয়ে বড় কিছু আছে? ঝেড়ে কাশেন, ঝেড়ে না। কাশলে হবে না।
আফতাব বিড়বিড় করে বললেন, একবার একটা NGO-তে চাকরি করতাম। তখন নতুন মোটরসাইকেল চুরি করে বেচে দিয়েছি।
আপনি তো কামেল আদমি। রড দুজনে মিলে চুরি করেছিলাম। হাফ টন রড। অন্যজনের চাকরি আছে। তার প্রমোশনও হয়েছে। বাদ দেন তার কথা, বাচ্চা দুটাকে আপনি এক রাতের জন্যে রাখতে পারবেন? আমার উপকার হয়। নারায়ণগঞ্জে একজনের কাছে কিছু টাকা পাই, টাকাটা উদ্ধার করতে পারি।
এত রাতে নারায়ণগঞ্জ যাবেন?
গভীর রাত ছাড়া তাকে পাওয়া যাবে না। সে বাড়িতে ঢেকে রাত একটার পর।
তাহলে যান। এরা থাকুক আমার সঙ্গে।
ধার হিসেবে একশ টাকা দিতে পারবেন?
পারব। একশ টাকার একটা নোটিই আমার কাছে আছে। নিয়ে যান।
আফতাব চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, অচেনা অজানা একজনের কাছে মেয়ে দুটা রেখে যাচ্ছেন। আপনি কী রকম বাবা?
আফতাব আবার বসে পড়ল। ছোট মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, আমরা কখন পোলাও খাব?
আমি বললাম, তোমার বাবা নারায়ণগঞ্জে যখন রওনা হবে। আমরাও তখন পোলাও খেতে রওনা হব।
ছোট মেয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা তুমি যাও না কেন?
আমি বললাম, আফতাব, আমি পাকেচক্রে এখানে উপস্থিত হয়েছি। বাচ্চা দুটাকে সাহায্য করার জন্যে। প্রায়ই দেখা গেছে মহাবিপদে যারা পড়ে তাদের মাঝে মাঝে উদ্ধারের ব্যবস্থা প্রকৃতি করে। বাচ্চা দুটাকে নিয়ে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নাই। তাদের কোথায় নিয়ে যাব তা এখনো জানি না, কাজেই আপনাকে ঠিকানা দিতে পারছি না। ধানমণ্ডি থানায় আমি বাচ্চা দুটা কোথায় আছে জানিয়ে রাখব। সেখানে গেলেই খোঁজ পাবেন।
ছোট মেয়েটা বলল, মামা! আমরা খেতে যাব না?
যাব। এখনই যাব।
এখনো জানি না কোথায় যাব। আশেপাশেই কোথাও যেতে হবে, দূরে যাওয়া যাবে না। তোমরা হাঁটতে পারবে না। আর আমার সঙ্গে টাকাও নেই যে রিকশা করে নিয়ে যাব।
বাবা যাবে না?
না।
আমরা একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ির নাম কমলকুটির। গেটে ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে লুঙ্গি পরা গেঞ্জি গায়ে এক বৃদ্ধ বের হলেন, বৃদ্ধ অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
আমি বললাম, স্যার বাই এনি চান্স, আজ কি আপনার বাসায় পোলাও এবং মুরগির রোস্ট রান্না হয়েছে? সঙ্গে ভুনা ডিম। বাচ্চা দুটা এই খাবার ছাড়া অন্য কিছু খাবে না।
হু আর ইউ?
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম হিমু। বড় মেয়েটার নাম কেয়া, ছোটটার নাম খেয়া।