- বইয়ের নামঃ অন্তমিত কালের গৌরব
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্তরাল
মানুষের ভিড়ে মানুষ লুকিয়ে থাকে
গাছের আড়ালে গাছ,
আকাশ লুকায় ছোট্ট নদীর বাঁকে
জলের গভীরে মাছ;
পাতার আড়ালে লুকায় বনের ফুল
ফুলের আড়ালে কাঁটা,
মেঘের আড়ালে চাঁদের হুলস্তুল
সাগরে জোয়ার ভাটা।
চোখের আড়ালে স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে
তোমার আড়ালে আমি,
দিনের বক্ষে রাত্রিকে ধরে রাখে
এভাবে দিবসযামী।
অস্তমিত কালের গৌরব
বিশ শতকের এই গোধূলিবেলায় হঠাৎ কেমন এলোমেলো ধূলিঝড়
কেমন উদ্ভট উল্টোপাল্টা হাওয়া,
যেন ঝরে যায় সব মানবিক মূল্যবোধ, ইতিহাসের
স্বর্ণাক্ষরে লেখা একেকটি পাতা।
এ কী দৈত্যপুরী থেকে যুদ্ধ জয় করে ফিরে-আসা
লালকমল ও নীলকমলের মুখ
অকষ্মাৎ ভীষণ পান্ডুর বর্ণ হয়ে ওঠে
হঠাৎ গোলাপচারাগুলো এ কী ঢলে পড়ে,
জুই আর চন্দ্রমল্লিকার বন
এ কেমন ছেয়ে যায় ফণিমনসার ঝাড়ে;
কবিতার প্রিয় পান্ডুলিপি জুড়ে
হঠাৎ কেমন ধূসর কুয়াশা নেমে আসে,
প্রেমিকার উষ্ণ হাত মনে হয় যেন নিরুত্তাপ, অনুভূতিহীন
এ কী শীমপ্রাসাদে আবার জমে বরফের স্তপ;
আর তাতে ঢাকা পড়ে যায় মানুষের
আশা ও স্বপ্নের মুখ, ধসে পড়ে
তার সব মহিমা ও কীর্তির মিনার।
বিশ শতকের এই গোধূলিবেলায় এ কেমন এলোমেলো ধূলিঝড়
এ কেমন সমস্ত আকাশ ছেয়ে কালো মেঘের আঁধার
কিছুই পড়ে না চোখে, কোনো আলো,
কোনে উজ্জ্বলতা-
মনে হয় বুখি এই গোধূলিতে অস্তমিত কালের গৌরব।
» এই জীবন
এই একরত্তি জীবনে বলো না কীভাবে সম্ভব ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো দীর্ঘ অনন্ত জীবন,
ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব, অতিশয় ছোটো এ জীবন
একবার প্রিয় সম্বোধন করার আগেই
শেষ হয় এই স্বল্প আয়ু-
হয়তো একটি পরিপূর্ণ চুম্বনেরও সময় মেলে না
করস্পর্শ করার আগেই নামে বিচ্ছেদের কালো যবনিকা;
এতো ছোটো সামান্য জীবনের কীভাবে হবেই ভালোবাসা
ভালোবাসি কথাটি বলতেই হয়তোবা কেটে যাবে সমস্ত জীবন,
হয়তোবা তেমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই
লেগে যাবে অনেক বছর
হয়তো তোমার কাছে একটি প্রেমের চিঠি লিখতেই
শেষহয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ নিদ্রাহীন রাত;
তোমার সম্মুখে বসে প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই
শেষ হয়ে যাবে কতো কৈশোর-যৌবন,
ঘনাবে বার্ধক্য, কেশরাজি উড়াবে মাথায়
সেই ধূসর পতাকা;
এইটুকু ছোট্ট জীবন, এখানে সম্ভব নয় ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো অনেক জীবন, অনন্ত সময়
তোমাকে ভালোবাসার জন্য জানি তাও খুবই স্বল্প ও সংক্ষিপ্ত মনে হবে।
চিরকুট
হঠাৎ সেদিন হাতে পেয়ে চিরকুট
নিমিষে সময় হয়ে গেলো যেন লুট;
পার হয়ে বহু বছরের ব্যবধান
কানে ভেসে এলো হারানো দিনের গান।
মনে পড়ে গেলো তোমার প্রতম খাম
আদ্যক্ষরে লেখা ছিলো শুধু নাম,
একটি গোলাপ আঁকা ছিলো এককোণে
র-ফলাবিহীন প্রিয় লেখা পড়ে মনে;
খুব সাধারণ খাতার কাগজে লেখা
লুকিয়ে পড়েছি, হয়নি সেভাবে দেখা
তবু মনে আছে কোথায় কী ছিলো তাতে,
এতোদিন পর চিরকুট পেয়ে হাতে
আবার হঠাৎ কেঁপে ওঠে যেন বুক
নিজেই তখন লুকাই নিজের মুখ;
এই বয়সেও একখানি চিরকুট
তোলে শিহরন, কম্পিত করপুট।
টিভিতে লেনিনের মূর্তি অপসারনের দৃশ্য দেখে
এই মূঢ় মানুষেরা জানে না কিছুই, জানে না কখন তারা
কাকে ভালোবাসে, কাকে করে প্রত্যাখ্যান,
না বুঝেই কাকে বা পরায় মালা,
কাকে ছুঁড়ে ফেলে।
এই মূঢ় মানুষেরা বোঝেনা কিছুই,
মূর্তি ভাঙে, উন্মত্ত উল্লাসে মাতে
এমনকি ফেলে না চোখের জল
যার জন্য প্রকৃতই হাজার বছর কাঁদবার কথা;
বিশ শতক শেষের এই পৃথিবীকে আজ
বড়ো অবিম্বাসী বলে বোধ হয়,
মানুসের কোনো মহৎ কীর্তি আর ত্যাগের স্বাক্ষর
ধারণ করে না এই কুটিল সময়-
আজ সে কেবল শূন্যতাকে গাঢ় আলিঙ্গন করে,
পৃথিবীর এই আদিম আঁধারে বুঝি যায়, সবই অস্ত যায়।
তাহলে কি ঢেকে যাবে পৃথিবীর মুখ
ভীষণ তুষার-ঝড় বয়ে যায় পৃথিবীর মানচিত্রে আজ
এই শতকের শেষে নামে শৈত্য, হিমপ্রবাহ এখানে
এশিয়অ ও ইওরোপ কাঁপে শীতে, বৃক্ষপত্র ঝরে যায়
ইতিহাস থেকে টুপটাপ খরেস পড়ে পাতা;
এই ভয়ানক দুঃসময়ে কার দিকে বাড়াই বা হাত
বন্ধুরাই শত্রু এখন, হৃদয়েও জমেছে বরফ।
পরফে পড়েছে ঢাকা বার্চবন, তৃনভূমি, বার্লিনের ব্যতিত আকাশ,
মানুষের কীর্তিস্তম্ভ, মানবিক প্রীতি-ভালোবাসা-
অনেক আগেই ঢাকা পড়ে গেছে মূল্যবোধ নামক অধ্যায়,
অবশেষে বিম্বাস ও সাহসের জাহাজটি বরফে আটকে গেছে দূরে।
তাহলে কি পৃথিবীর মানচিত্রই ক্রমশ ঢেকে যাবে উত্তাল বরফে,
ঢেকে যাবে পৃথিবীর চোখ, মুখ, মাথা?
দয়ার্দ্র আঁচল
তুমি তো জানো না তোমার আঁচলখানি কতো বেশি নিরাপদ তাঁবু
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় এখানে বাঁচাতে পারি মাথা
লজ্জা ভয়ে এখানে লুকাতে পারি মুখ,
এই নিবিড় আশ্রয় আর কোনখানে পাবো।
সবখানে যকন আমার নামে রটে কুৎসার কালি
সবাই নিন্দায় ওঠে মেতে, ছিছি করে, টিটকারি দেয়
যকন আমাকে এই অশ্লীল বিদ্রূপ আর শীতল উপেক্ষা
করে মর্মাহত, তখনো দাঁড়াই এসে এই আঁচলের
স্নিগ্ধ ছায়ায়।
যকন দেখতে পাই কোথাও যাবার মতো কোনো স্থান নেই
কেউ ফিরে তাকায় না আর, খোলে না দরোজা
যখন দুচোখে কেবল আমি অন্ধকার দেখি
তখনো কেবল তোমারই আঁচলখানি হয়ে ওঠে দয়ার্দ্র, কোমল।
তোমারই আঁচলখানি তখন মুছিয়ে দেয় মুখ
সকলের উপেক্ষার ধুলোবালি খুব যত্নে ঝেড়ে মুখে দেয়,
আমার রক্তাক্ত বুকে বেঁধে দেয় নরম ব্যাণ্ডেজ
তোমার আঁচলখানি সেই গ্রীষ্মে হয়ে ওঠে ছাতা।
যখন দেখেছি আমি সবখানে ভয়ানক কাঁটা, কারো কাছে
মেলে নাই ঠাঁই,
কারো চোখে দেখি নাই সামান্যও করুণার ধারা
একবারো কেউ বাড়ায়নি স্নেহমাখা একখানি হাত,
তখন আবার আমি রোদে পুড়ে ফিরে আসি তোমারই ছায়ায়।
তোমারই আঁচলখানি মুছে দেয় সেই ব্যর্থতায় গ্লানি
আর ক্লান্তির ঘাম,
হয়ে ওঠে এই রুক্ষ মরুভূমি ঢেকে এক রম্য তৃণাঞ্চল।