জি আচ্ছা।
বসন্তু দাগওয়ালা বললেন, কাজটা আপনি ঠিক করছেন না স্যার। পরে বিপদে পড়তে পারেন। র্যাবের হাতে দিয়ে দিন ক্রসফায়ারে ঝামেলা শেষ করে দিবে। ওদের কাজকর্ম আমার পছন্দ। ধর তক্তা মার গ্যাজাল।
ওসি সাহেব অন্যমনস্ক গলায় বললেন, তাও করা যায়।
ছামাদ বলল, চা লাগবে না স্যার। যদি অনুমতি দেন। আমরা আপনাকে কদমবুসি করে এখনই চলে যাই।
নাজমুল হুদ বললেন, কদমবুসি করতে হবে না। চলে যা। আর শোন, তুই তুই করে বলেছি বলে কিছু মনে নিবি না। পুলিশে চাকরি করার কারণে ভদ্রতা গেছে। অথচ এই আমি একসময় এমফিল করেছি। রবার্ট ফ্রাস্টের উপর।
Woods are lovely dark and deep
And I have promised to keep
And miles to go before sleep.
আমরা তিনজন একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। থানার গেট থেকে বের হয়ে তিনজন তিনদিকে হাঁটা। রবীন্দ্রনাথ প্ৰথমে কিছুক্ষণ গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলেন। বাঙালির স্বভাব হলো কাউকে দৌড়াতে দেখলে তার পেছনে পেছনে দৌড়াবে। দুইজন টোকাই এবং একজন মধ্যবয়স্ক লুঙ্গিপরা মানুষকে তার পেছনে পেছনে দৌড়াতে দেখলাম।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মজিদও দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে কেউ নেই। সে দৌড়াতে দৌড়াতে এক চলন্ত বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়ল। বেচারা ভালো ভয় পেয়েছে।
কোথায় যাওয়া যায় বুঝতে পারছি না। হাজতবাসের জন্যে প্ৰস্তৃত ছিলাম। হাজতবাস হচ্ছে না বলে সিস্টেমে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। হাজাতের কাছাকাছি কোথাও রাত কাটাতে ইচ্ছা করছে। এই সমস্যা সবারই হয়। ফাঁসির এক আসামিকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গলায় দড়ি পরাবার আগে আগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণায় খবর চলে এল। জেলার তার পাছায় লাথি দিয়ে বললেন, যা বাড়ি চলে যা। সে বাড়ি গিয়ে ফ্যানের সঙ্গে লাইলনের দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়ল। খেল খতম ফাঁসি হজম।
কটা বাজে জানা দরকার। ঘড়ি দেখে ঠিক করতে হবে রাতটা কোথায় কাটাব। মেসে যেতে ইচ্ছা করছে না। রাত যদি এগারোটার কম হয় তাহলে বাদলের কাছে চলে যাব। এগারোটার বেশি হলে ধানমণ্ডি থানায় ফিরে গিয়ে ওসি সাহেবকে বলব, স্যার সাতটা হাজতে থাকতে দিন। আপনার পায়ে ধরি। I touch your foot.
আজকাল হাতঘড়ির চল উঠে গেছে। সময় জিজ্ঞেস করলে লোকজন বিরক্ত হয়। কারণ সময় জানতে তাকে মোবাইল ফোন বের করে টেপা টিপি করতে হয়। সময় ঘড়ির কাছ থেকে চলে গেছে মোবাইল ফোন সেটের কাছে।
লাইটপোস্টের কাছে মোটামুটি উদাস দৃষ্টির এক ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলাম। বিনীত গলায় বললাম, ভাই, কয়টা বাজে?
ভদ্রলোক বললেন, সঙ্গে ঘড়ি নাই।
মোবাইল সেটটা দেখে বলুন কয়টা বাজে।
মোবাইল ফোন সেট নাই। চুরি গেছে।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত বোধ করলেন না। উঁচুগলায় কথাবার্তা চালাতে লাগলেন।
আফতাব? ভালো আছ? আমি ঢাকায় না তো। ঢাকায় থাকলে অবশ্যই তোমার সঙ্গে দেখা করতাম। আমি এখন রাজশাহীতে। সপ্তাহখানিক থাকব। হ্যাঁ, তোমার বিপদের কথা শুনেছি। সো স্যাড।
আমি ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইল ফোনের কারণে তিনি ঢাকায় থেকেও রাজশাহীতে অবস্থান করতে পারছেন। এটাকে বিজ্ঞানের পশ্চাৎযাত্ৰা বলা যেতে পারে।
টেলিফোনে ভদ্ৰলোকের কথাবার্তা থেকে আন্দাজ করছি, তিনি আফতাব সাহেবের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন। টাকা আজই ফেরত দেওয়ার কথা। তিনি টাকার ব্যবস্থাও করেছেন, রাজশাহীতে থাকার কারণে দিতে পারছেন না।
ভদ্রলোক টেলিফোন শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কী চান?
সময় জানতে চাই।
অন্য কারও কাছ থেকে জানেন। ফালতু ঝামেলা।
আফতাব ভাই আপনার কাছে কত পায়?
হোয়াট?
উনি বিপদে আছেন, টাকাটা ফেরত দেওয়া উচিত না? আপনি যখন বিপদে পড়েছিলেন তখন আফতাব ভাই ঠিকই আপনাকে সাহায্য করেছে।
আপনি তাকে চিনেন?
অবশ্যই চিনি। আমি আপনাকেও চিনি।
ভদ্ৰলোক হকচকিয়ে গেলেন। তার মধ্যে আমতা আমতা ভাব চলে এল। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। আমি রিকশা থামিয়ে ভদ্রলোককে বললাম, আসুন যাই।
কোথায় যাব?
আফতাব ভাইয়ের কাছে যাই। উনাকে টাকাটা দিয়ে আসি।
পুরা টাকা তো আমার সঙ্গে নাই। অল্প আছে।
যা আছে তা-ই দিন। বাকিটা দুই দিন পরে দিবেন। দেরি করবেন না। রিকশায় ওঠেন। রিকশা কোথায় যাবে বলে দিন।
ভদ্রলোক বিরসমুখে রিকশায় উঠে এলেন।
রিকশায় করে আমরা চলে এলাম। কলাবাগানে। সারা পথই ভদ্রলোক উসখুস করতে লাগলেন। একবার মনে হলো। উনি চলন্ত রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়বেন। আমি শক্ত করে তার পাঞ্জাবি চেপে ধরলাম। নেমে গেলে পাঞ্জাবির অর্ধেকটা আমার হাতে রেখে নামতে হবে। ভদ্রলোক এই রিস্ক নিবেন বলে মনে হয় না। পাঞ্জাবিটা দামি।
পাঞ্জাবি ধরে আছেন কেন?
রিকশায় চড়লে আমার কিছু একটা ধরে থাকতে হয়। কিছু ধরে না থাকলে ভয় লাগে। মনে হয় পড়ে যাব।
হুড ধরে রাখুন।
হুড ধরে একবার ক্যাঁচা খেয়েছি, এইজন্যে হুড় ধরি না। আফতাব ভাইয়ের কাছ থেকে কত টাকা ধার করেছিলেন?
আপনার তা দিয়ে দরকার কী? পাঞ্জাবিটা ছাড়েন তো।
পাঞ্জাবি ছাড়ব না।
কলাবাগানে ঢোকার কয়েকটা গলি। একটার সামনে এসে ভদ্ৰলোক রিকশা থামালেন। আমি বললাম, গলিতে ঢুকব না? ভদ্রলোক ইশারায় দেখালেন এবং গলা নামিয়ে বললেন, আফতাব বসে আছে। চায়ের দোকানের সামনে।