ওসি সাহেব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আমি একজনের সঙ্গে কথা বলছি দেখস না বদমাইশ? থাপ্পড় খেতে চাস? পুলিশের থাপ্পড় কখনো খেয়েছিস?
জি-না স্যার।
বিড়বিড় করছিস কী জন্যে?
দোয়া পড়তেছি স্যার। দোয়ায়ে ইউনুস। ইউনুস নবী মাছের পেটে এই দেয়া পড়ে খালাস পেয়েছিলেন।
মনে মনে পড়, ঠোঁট নাড়বি না। ঠোঁট নড়লে সুই দিয়ে ঠোঁট সিলাই করে দেব।
ঠোঁট আর নড়বে না স্যার। I Promise.
ওসি সাহেব ওয়াকিটকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার গলা দিয়ে বুলন্দ আওয়াজ বের হচ্ছে। তিনি মাঝে মাঝে চেয়ারটা পুরোপুরি ঘোরাচ্ছেন। ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেল পূর্ণ করছেন। তিনি যে মজা পাচ্ছেন তা বোঝা যাচ্ছে। উনার নাম নাজমুল হুদ। প্লাষ্টিকের লেখা নাম। পকেটের উপর লাগানো। হুদ কারও নাম হতে পারে না। আরবের এক পাখির নাম হুদ। মনে হয় হুদা নাম। আকার পড়ে গেছে।
নাজমুল হুদ ওয়াকিটকি মুখের কাছে নিয়ে বললেন, স্যার এখন আপনি ডিসিশান দিন—এই তিনটাকে নিয়ে আমি কী করি। মন্ত্রী মহোদয়ের টেলিফোন পেয়ে ছুটে গেছি। তিনটাকে ধরে নিয়ে এসেছি। এখন কী? চ্যানেল আঁখির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা কোনো মামলা করবে না বলে জানিয়েছে।
মন্ত্রী মহোদয়ের পিএস-এর সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, স্যার কিছুই বলবেন না। উনি কোনো দায়িত্বও নিবেন না। প্রথমবার মন্ত্রী হয়েছেন তো, কোনো ঝামেলা চান না। তিনি মিডিয়ার ভয়ে অস্থির। তাঁর সংবর্ধনার জন্যে অঞ্চলে ১৮৩টি তোরণ করা হয়েছিল। মিডিয়ায় সেই খবর চলে আসার পর থেকে তিনি মিডিয়া ভয় পান। এখন স্যার আপনি একটা ডিসিশান দিন। জি স্যার, আপনার কথা বুঝতে পারছি। Over.
বসন্তের দাগওয়ালা বিরক্ত মুখে বললেন, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন বুঝলাম না। হাজতে থাকুক, সকালে কোর্টে চালান করে দিব। এখন পর্যন্ত তো ডলাও খায় নাই। পুলিশের হাতে ধরা খেয়েও ডিলা ছাড়া পার হবে এটা ঠিক না। পুলিশের উপর থেকে পাবলিকের ভয় চলে যাবে। রাতে আমার হাতে ছেড়ে দেন, পাকিস্তানি ডলা দিয়ে সকালবেলা কেটে চালান করে দেব।
কোটে যে চালান করবেন চার্জ কী?
একটা কিছু দিলেই হয়। উলফা কানেকশন, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা। উলফায় যেতে না চান, উদীচী বোমা হামলা আছে। আমাদের হাতে জিনিসের তো অভাব নাই।
নাজমুল হুদ বললেন, এদের সামনে এই আলোচনাটা না করলে ভালো হয়।
বসন্তওয়ালা বিরস মুখে বললেন, ডলা ঠিকমতো পড়লে আলোচনা কিছুই মনে থাকবে না।
পাকিস্তানি ডলা, পাকিস্তানি ডলা বলছেন। জিনিসটা কী?
সেভেনটিওয়ানে অনেকে এই ডলা খেয়েছে। উপরের চামড়া টাইট থাকে, ভিতরের হাড্ডি ছাতু হয়ে যায়।
না না, আমার থানায় এইসব চলবে না।
বসন্ত দাগওয়ালা হতাশ হয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন। কিছু মানুষ অল্পতেই হতাশাগ্রস্ত হয়।
নাজমুল হুদ ছামাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তুই রবি ঠাকুর সেজেছিস কী জন্যে?
ছামাদ বলল, ঘাউ!
ওসি সাহেব কিছুক্ষণের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সম্ভবত রবিঠাকুরের কাছ থেকে তিনি ঘাউ আশা করেন নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুই কী বললি?
ছামাদ বলল, ঘাউ। এবারের ঘাউ আগের চেয়েও জোরালো। বসন্তের দাগওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তিনি মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। তার চোখে মুখের ভঙ্গি বলছে—খাইছি তোরে। পাকিস্তানি ডলা কামিং।
ওসি সাহেব বললেন, তুই যদি আরেকবার ঘাউ বলিস, তাহলে আমার হাতের ব্যাটনটা তোর মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। মুখ ছাড়া অন্য কোনো জায়গা দিয়ে চুকাতে বলতাম। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেছি বলে বলতে পারছি না। মুখে বাঁধছে।
আমি গলাভর্তি আনন্দ নিয়ে বললাম, স্যার আপনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ?
নাজমুল হুদ বললেন, তাতে তোর কোনো সমস্যা?
জি-না স্যার।
এমএ-তে শেষ না; কবি রবার্ট ফ্রাস্টের উপর এমফিল করেছি। বিশ্বাস হয়?
আমি বললাম, বিশ্বাস হয় না স্যার।
নাজমুল হুদ হতাশ গলায় বললেন, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না।
মজিদ বলল, আমার বিশ্বাস হয় স্যার। আপনারে দেখলেই বুঝা যায় আপনি বিরাট জ্ঞানী। আপনার চোখেমুখে জ্ঞান।
তোরে না বললাম ঠোঁট নাড়াবি না। ঠোঁট নাড়ালি কোন সাহসে?
স্যার ভুল করেছি। মাফ করে দেন। আর একটা কথা যদি বলি তাহলে মাটি খাই।
নাজমুল হুদ তাকালেন ছামাদের দিকে। কঠিন গলায় বললেন, যা জিজ্ঞেস করব জবাব দিবি। ঘাউ করবি না!
ছামাদ বলল, ঘাউ করব না স্যার। ঘাউ করলে আমিও মাটি খাই।
তুই থাকিস কোথায়?
আগে গোরানে থাকতাম। তিন কাঠা জমির উপরে বাপ একটা দোতলা বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ি ছাত্রলীগের কংকন ভাই দখল করেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু জ্ঞান বিকাশ কেন্দ্র খুলেছেন।
জ্ঞান বিকাশ কেন্দ্রে কী হয়?
উনারা ক্যারাম খেলেন, তাশ খেলেন। গল্পগুজব করেন। সন্ধ্যার পর লাল পানি খান বলে শুনেছি। নিজের চোখে দেখি নাই। শোনা কথায় বিশ্বাস করা ঠিক না।
ছামাদের কথায় ওসি সাহেবের মনে হলো মন সামান্য নরম হয়েছে। তার গলা উঁচু পর্দা থেকে মধ্যমপর্দায় নেমে এল। তিনি বললেন, বাড়ির দখল নেওয়ার চেষ্টা করিস নাই?
একটা মামলা করেছিলাম। পরের দিন মামলা তুলে নিয়ে কংকন ভাইয়ের পায়ে ধরে মাফ চেয়েছি। উনার হাতে চুমু খেয়েছি।
হাতে চুমু খেয়েছিস কেন?
পুরুষ মানুষ, এইজন্যে হাতে চুমু খেয়েছি স্যার।
চা খাবি?
খাব স্যার। আপনায় অসীম দয়া।
ওসি সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, রবীন্দ্রনাথ সেজে আর খবরদার ঝামেলা করবি না। চা খেয়ে বিদায় হয়ে যা।