দর্শক : নূরে আলম।
উপস্থাপিকা : আপনি কোত্থেকে টেলিফোন করেছেন?
দর্শক : মগবাজার।
উপস্থাপিকা : মগবাজার থেকে জনাব নূরে আলম টেলিফোন করেছেন। আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চান?
দর্শক : গুরুদেবের সঙ্গে।
রবিদা, ভালো আছেন?
ছামাদ : ভালো আছি।
দর্শক : আপনি রিয়েল না ফলস?
ছামাদ : (বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করছেন বলে জবাব দিতে পারছেন না।)
মন্ত্রী মহোদয় : প্রচার বন্ধ হচ্ছে না কেন?
দর্শক : রবিদা, আপনার পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল কেন?
ছামাদ : ভাই, চটিজুতা খরিদ করতে পারি নাই। এখান থেকে বের হয়ে খরিদ করব ইনশাল্লাহ।
মন্ত্রী মহোদয় : অনুষ্ঠান এক্ষুনি বন্ধ করা প্রয়োজন। সমুদ্র কোথায়? সমুদ্র।
ছামাদ : স্যার সমুদ্র কক্সবাজারে। এখানে সমুদ্র কই পাবেন!
উপস্থাপিকা : (মুখের হাসি আরো বিস্তৃত) কারিগরি ত্রুটির কারণে আলাপচারিতা অনুষ্ঠানটি এখন প্রচার করা যাচ্ছে না বলে আমরা দুঃখিত। দর্শকদের জানাচ্ছি শুভেচ্ছা।
অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানের ফিলার। কাকতালীয়ভাবে সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচ হচ্ছে। বর্ষার গান—আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে। নাচছেন অভিনেত্রী তানিয়া। ছবির নাম নয় নম্বর বিপদ সংকেত।
আমি মুগ্ধ হয়ে নাচ দেখছি। ঘরে পাঞ্জাবি পরা এক লোক ঢুকেছেন। তিনি ক্ষুব্ধ গলায় বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে কে নিয়ে এসেছে খুঁজে বের করো। স্যাবোটাজ হয়েছে। বিরাট স্যাবোটাজ। পুলিশে কি খবর দেওয়া হয়েছে?
চারদিকে ছোটাছুটি হচ্ছে। এখন আর চ্যানেলের অফিসে থাকা সমীচীন নয় বলে কেটে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। য পলায়তি স জিবতী।
কেটে পড়া সম্ভব হলো না। রিসিপশনের মেয়েটি বলল, আপনি রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের পিএ না?
জি।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ম্যাডাম চলে যাচ্ছি। গুরুদেবকে রেখে গেলাম। টকশোতে সামান্য ঝামেলা হয়েছে। তাতে সমস্যা নেই, অন্য যে-কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। আপনাদের একটা অনুষ্ঠান আছে না— জাপানি রান্না? শুরুদেব জাপানি রান্নায় আগ্ৰহী। তাঁর একটা বই আছে জাপান যাত্রীর পত্র, সেখানে…
কথা বলবেন না। এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আসছে। আপনারা দুজনই থানায় যাবেন।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ম্যাডাম কাজটা কি ভালো হবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রেফতার—শুনতেও খারাপ। আপনাদের চ্যানেলে গ্রেফতার হয়েছেন এটা আপনাদের জন্যে ব্যাড় পাবলিসিটি।
কথা শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ চলে এল। আমাদের তিনজনের স্থান হলো ধানমণ্ডি থানার হাজতে। আমি, ছামাদ এবং খালু সাহেবের ড্রাইভার মজিদ। মজিদ হতভম্ব। এটাই নাকি তার প্রথম হাজত খাটা।
মজিদ বারবার বলছে, আমারে কেন পুলিশ ধরল! আমি করেছি। কী? আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবা ভুরুঙ্গামারীতে যুদ্ধ করেছেন।
ছামাদ বলল, ভুরুঙ্গামারী জায়গাটা কোথায়?
মজিদ বিরক্ত গলায় বলল, আমি জানব কীভাবে? যুদ্ধ তো আমি করি নাই। আমার বাবা করেছেন।
আপনার বাবা যেখানে যুদ্ধ করেছেন সেখানে আপনি যাবেন না? দেখে আসবেন না? আপনার তো কার্বুরেটর ঠিক নাই।
আমার আবার কার্বুরেটর কী? আমি গাড়ি নাকি? আপনি রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন বলে যা মন চায় বলবেন?
আমি যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। এই গুণটি আমি ছামাদের মধ্যেও দেখলাম। দেয়ালে হেলান দিয়ে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি টানছে। মজিদ অস্থির। সে হাঁটাহাঁটি করছে। একটু পরপর বলছে, কী করি কন তো?
পুলিশ কনস্টেবলদের একজন পুরোপুরি বিভ্রান্ত। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চলে যায় আবার আসে। এক পর্যায়ে সে নিজের কৌতূহল সামলাতে না পেরে আমাকে বলল, দাড়িওয়ালা উনার পরিচয় কী?
আমি বললাম, উনার নাম রবীন্দ্ৰনাথ।
বিশ্বকবি?
হুঁ।
উনার মতো মানুষ হাজতে। কী অবস্থা! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার দেখলাম সব বিশিষ্টজন গ্রেফতার। হাসিনা আপা, খালেদা ম্যাডাম। এখন বিশ্বকবি হাজতে। উনি করেছেন কী?
অভিযোগ এখনো তৈরি হয় নাই। টিভি চ্যানেলে হামলা জাতীয় কিছু হবে।
উনি বিড়ি টানতেছেন দেখে মনটা দেওয়ানা হয়েছে। সাধারণ কেউ তো না। বিশ্বকবি। জিজ্ঞেস করেন তো উনি চা খাবেন কি না।
আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করুন।
পুলিশ কনস্টেবল বিনীত গলায় বলল, কবি সাব, চা খাবেন? চা এনে দেই?
ছামাদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘাউ।
পুলিশ কনস্টেবল লাফ দিয়ে সরে গেল।
শুরু হলে আমাদের হাজত বাস।
ওসি সাহেবের খাস কামরায়
আমরা তিনজন ওসি সাহেবের খাস কামরায়, তার মুখোমুখি বসেছি। ওসি সাহেবের চেয়ারটা মনে হয় নতুন কেনা হয়েছে। গদির সঙ্গে লাগানো পলিথিনের ঢাকনা এখনো খোলা হয় নি। চেয়ারটা রিভলভিং। ওসি সাহেব অস্থির প্রকৃতির। সারাক্ষণই চেয়ার ঘোরাচ্ছেন। একবার এদিকে তাকাচ্ছেন, পরমুহূর্তেই সাঁই শব্দে চেয়ার ঘুরে যাচ্ছে।
ওসি সাহেবের বাঁ পাশে সিভিল ড্রেসে একজন বসে আছেন। তার হাতে ওয়াকিটকি। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনিও পুলিশের একজন। তার মুখভর্তি বসন্তের দাগ। এই ধরনের খাবলা খাবলা মুখ আজকাল আর দেখা যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে অনেক ইস্টারেস্টিং বিষয় থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
ওসি সাহেবের হাতেও ওয়াকিটকি। তিনি বিরক্তমুখে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। এর মধ্যে মজিদ বলল, স্যার আমি একজন জেনুইন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার পিতা ভুরুঙ্গামারিতে ফাইট করেছেন। উনার সাখীরা সবাই মারা পড়েছেন। আমার পিতাও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন।