আমি জায়গা বদল করলাম। খালু সাহেব শান্ত গলায় বললেন, তুমি নানাবিধ যন্ত্রণা তৈরি করেছি। বর্তমান যন্ত্রণাটির নাম কী?
আমি বললাম, কোন যন্ত্রণার কথা বলছেন?
সোফাতে শুয়ে সকালবেলা যে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে সে কে?
তার ভালো নাম রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুর। ডাকনাম ছামাদ। ছামাদ মিয়া!
আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না। speak out.
ছামাদ মিয়া রবীন্দ্ৰনাথ সেজেছে। সে আগে একটা চায়ের দোকানের ক্যাশিয়ার ছিল। টাকা চুরির অপরাধে চাকরি গেছে। তবে সে রবীন্দ্রনাথের কসম খেয়ে বলেছে যে, টাকা চুরি করে নি। ছামাদ বাবার উপদেশ মতো তার কাৰ্বরেটর ঠিক রেখেছে। যাদের কার্বুরেটর ঠিক তারা চুরি চামারি করে না। ছামাদের বাবা মোটর মেকানিক। তাঁর মটো হলো—কার্বুরেটর ঠিক থাকলেই সব ঠিক। হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা কার্বুরেটর ঠিক রাখে।
অকারণ কথা বলবে না। বদটা রবীন্দ্ৰনাথ সেজেছে কেন?
অল্পকথায় বলব, না ব্যাখ্যা করে বলব?
অল্পকথায় বলো।
সারা পৃথিবীতেই বিখ্যাত ব্যক্তির মতো সাজার প্রবণতা আছে। চার্লি চ্যাপলিনের জীবদ্দশাতেই চার্লি চ্যাপলিন সেজে পাঁচজন ঘুরে বেড়াত। এদের আলাদা করা মুশকিল হতো। আইনস্টাইনের সময়ে তিনজন আইষ্টাইনের ভেক ধরেছিল। এক নকল আইনস্টাইন বিজ্ঞানী নীলস বোরের সঙ্গে দেখা করে বলেছিল—থিওরি অব রিলেটিভিটি বোগাস!। আইনস্টাইনের কথা শুনে নীলস বোরের মাইল্ড স্ট্রোকের মতো হয়েছিল। তিনি বুঝতেই পারেন নি যে নকল আইনষ্টাইনের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমাদের ছামাদও একই পথের পথিক।
খালু সাহেব ইংরেজি খবরের কাগজ চোখের সামনে ধরতে ধরতে বললেন, তোমাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। এই তিন মিনিটের মধ্যে তুমি ঐ বস্তু নিয়ে বিদায় হবে। আর কোনোদিন যেন তোমাকে এবং ঐ বস্তুকে আমার ফ্ল্যাটে না দেখি।
আমি বললাম, তিন মিনিটের মধ্যে তো খালু সাহেব বিদায় হতে পারব না। শুরুদেব নাশতা করবেন। দুকাপ চা খাবেন। চা খাবার পর তার পাইখানা ক্লিয়ার হবে। তারপর তিনি যাবেন। উনি আপনার ফ্ল্যাটে এসেছেন পাইখানা ক্লিয়ার করার জন্যে।
খালু সাহেবের হাত থেকে পত্রিকা পড়ে গেল। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তার চোখে আগুন দাউদাউ করছে। খালু সাহেব সাধু-সন্ন্যাসী পর্যায়ের কেউ হলে তার চোখের আগুনে আমি ভষ্ম হয়ে যেতাম। ভাগ্যিস তিনি সাধু সন্নাসী না। ইংরেজি খবর পড়া বাঙালি সন্তান, যার মাসে দুবার সিরিয়াস ডায়েরিয়া হয়।
You get lost.
আমি মধুর ভঙ্গিতে হেসে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
টেবিলে নাশতা দেওয়া হয়েছে। মাজেদা খালা এবং তাঁর নতুন কাজের মেয়ে হামিদ পাশেই দাঁড়িয়ে। মাজেদা খালার চোখে কৌতূহল। হামিদার চোখে ভয়। কাজের মেয়েরা কী কারণে জানি ভয় পেতে পছন্দ করে।
গুরুদেব টেবিলে বসে খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। মাজেদা খালা বললেন, চায়ের কাপে করলার রস। আগে করলার রস খান। গুরুদেব বললেন, করলার রুসের আমি কেঁথা পুড়ি।
মাজেদা খালা এবং হামিদা মুখ চাওয়া-চাওয়ি পর্কের ভেতর দিয়ে গেল। কেঁথা পুড়ি রাবীন্দ্রিক ভাষার মধ্যে পড়ে না।
ছামাদ কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বুয়া?
বুয়া এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, জে স্যার।
চুরি করুবা না খবরদার। কার্বুরেটর ঠিক রাখবা।
বুয়া চিন্তিত গলায় বলল, জে আচ্ছা রাখুম নে।
ঘরে পান আছে না?
জে আছে।
জর্দা দিয়ে পান রেডি রাখো।
মাজেদা খালা ফিসফিস করে বললেন, উনি কি দুপুরে খাবেন? দুপুরে খেলে উনার পছন্দোর খাবার তৈরি করতাম।
আমি বললাম, অন্য কোনো দুপুরে এসে খেয়ে যাব। আজ উনি অনেক জায়গায় যাবেন। খালু সাহেবের গাড়িটা পাওয়া গেলে ভালো হতো। উনার মতো মানুষকে নিয়ে তো রিকশায় করে যাওয়া যায় না। দেখি কী করা যায়।
খালু সাহেব নতুন গাড়ি কিনেছেন—টয়োটা আলাফার্ডে না কী যেন নাম। নিশ্চয়ই দামি গাড়ি। কারণ এই গাড়ি বের করা হয় না। গ্যারেজে জামা গায়ে দিয়ে রাখা হয়। ড্রাইভার মজিদ সপ্তাহে দুইদিন গাড়ির গায়ে কী সব ক্রিম ঘষাঘষি করে।
গুরুদেবকে নিয়ে আমি নিচে নামতেই খালু সাহেবের ড্রাইভার মজিদের সঙ্গে দেখা। আমি বললাম, মজিদ! উনাকে চিনেছ? মজিদ বলল, উনারে চিনব না!! কী বলেন হিমু ভাই। উনার গানের সিডিতে আমার গাড়ি ভর্তি।
মজিদ এগিয়ে এসে পা ছুয়ে কদমবুসি করল। আমি বললাম, নতুন গাড়িটা বের করো। আজ উনাকে নিয়ে ঘুরব। পত্রিকার অফিসে যেতে হবে। ইন্টারভিউএর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখা দরকার। টিভি চ্যানেলগুলির সঙ্গে কথা বলতে হবে। একটা টকশোর ব্যবস্থা যদি হয়ে যায়। চ্যানেলগুলিতে রান্নারও নানান অনুষ্ঠান হয়; সেখানে উনাকে সেলিব্রেটি হিসাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। রান্নার একটা অনুষ্ঠান বাংলার ভর্তা। সেখানে উনি একটা রেসিপি দিতে পারেন—কাঁচকলার খোসার ভর্তা } রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথা বললেন।
খালু সাহেবের দামি গাড়ি চলছে! আমি বসেছি। ড্রাইভারের পাশে। ছামাদ পেছনের সিটে আয়েসি ভঙ্গিতে বসা। গাড়িতে গান বাজছে। গুরুদেবের গান—
আহা আজি এ বসন্তে
ছামাদ বলল, ভাইজান, বিমানি গান না। হিন্দি ছাড়েন। শামসাদ বেগমের সিডি আছে? উনার একটা গান সঁইয়া দিলমে আনা রে নোবেল প্ৰাইজের যোগ্য। আজেবাজে জিনিস নোবেল পায়। ভালোটা পায় না; আফসোস।