আলখাল্লা পেয়েছ কোথায়?
আমার এক চাচাতো ভাই আছে, নাম সামছু। এফডিসিতে কাজ করে। ডাইরেক্টর এমদাদ সাহেবের থার্ড এসিসটেন্ট। সে বানায়ে দিয়েছে। এফডিসির দরজি বিরাট এক্সপার্ট। যা বলবেন বানায়ে দেবে। রবি ঠাকুরের ড্রেস ঠিক আছে না।
আমি বললাম, সবই ঠিক আছে। পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেল ঠিক নাই। চটিজুতা! দরকার। উনি চটজুতা পরতেন।
জানি। টাকার অভাবে কিনতে পারি না। দুইবেলা খাওয়া জুটে না, আর চটিজুতা। শুনেছি। রবি ঠাকুর ছিলেন জমিদারের ছেলে, আর আমার বাবা ছিলেন মোটর মেকানিক। কাৰ্বরেটরের কাজ উনার মতো কেউ জানত না। মারা গেলেন। ক্যানসারে। মৃত্যুর আগে আমারে বললেন, বাবা ছামাদ, যা করতে মন চায় করবি। একটাই উপদেশ, কার্বুরেটর ঠিক রাখবি। গাড়ির যেমন কাৰ্বরেটর ঠিক থাকলে সব ঠিক, মানুষেরও একই ঘটনা।
তোমার কার্বুরেটর কীভাবে ঠিক রাখছ?
দুষ্ট কাজ কখনো করি না। খাওয়া জুটলে খাই, না জুটলে নাই। রবি ঠাকুর সাইজ মানুষরে আনন্দ দেই। মানুষরে আনন্দ দেওয়া বিরাট সোয়াবের কাজ।
টেবিলে পাউরুটির কিছু গুড়া পড়ে ছিল। ছামাদ আঙুলে করে পাউরুটির গুড়া মুখে দিয়ে দিল। আমি বললাম, চলো তোমাকে চটিজুতা কিনে দেই। রবি ঠাকুর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঘুরছেন এই দৃশ্য সহ্য হচ্ছে না।
আগে চা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সকালে চা না খেলে অস্থির লাগে। একটা বিষয় বুঝলাম না, রবি ঠাকুর সাজলে অল্পতেই অস্থির লাগে। ভাইজান, উনি কি अश्न्नि छिब्लन?
মনে হয় না। তিনি অস্থির প্রকৃতির হলে বাংলা সাহিত্যে অস্থিরতা চলে আসত। তুমি উনার লেখা কিছু পড়েছ? ইস্কুলে তালগাছের লেখাটা পড়েছিলাম। তালগাছ একপায় দাঁড়িয়ে—ঐটা। লেখাটায় ভুল আছে।
কী ভুল?
উনি লিখেছেন উঁকি মারে আকাশে। গাছের কি চউখ আছে? আসমানের দিকে ক্যামনে উঁকি মারবে। বিরাট ভুল না?
আমি চুপ করে রইলাম। ছামাদ উৎসাহের সঙ্গে বলল, বড় মানুষ ভুল করেছে এইজন্যে পাবলিক কিছু বলে না। আপনে আমি ভুল করলে খবর ছিল। বিড়ি একটা খাবেন? খালিপেটে বিড়ির আলাদা মজা। ধোয়া ব্রেইনের মধ্যে গিয়া লাগবে।
আমি খালিপেটে বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ব্ৰেইনে লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। ব্রেইনের চেয়ে ফুসফুসে বেশি লাগছে। কাশতে কাশতে জীবন বের হওয়ার উপক্রম।
ছামাদ বলল, কেমন বুঝতেছেন?
আমি কাশতে কাশতে বললাম, ভালো বুঝতেছি।
ঠ্যাং উপরে মাথা নিচে—এই অবস্থায় বিড়ি কখনো খেয়েছেন?
বিরাট মজা। প্রথমে মাথার মধ্যে একটা চক্কর দেয়। তারপরে.
তারপরে কী?
এখন বলব না। প্র্যাকটিক্যালে দেখবেন। যদি অনুমতি দেন। আজ সারা দিন আছি আপনার সাথে।
সারা দিন তোমাকে নিয়ে আমি করব কী?
ছামাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, আত্মীয়-বান্ধবের বাড়িতে নিয়া যাবেন। বলবেন, রবি ঠাকুর নিয়া আসছি। অটোগ্রাফ নিতে চাইলে নাও। ছবি তুলতে চাইলে তোলো। দশজনের মধ্যে আটজন বিশ্বাস করবে না। কিন্তু দুইজন বিশ্বাস করবে। তখনই মজা। ভাইজান, চায়ের ব্যবস্থা কিন্তু এখনো করেন নাই।
আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম, চলো মাজেদা খালার ফ্ল্যাটে যাই। চা-নাশতা সেখানেই হবে।
মাজেদা খালা চোখ কপালে তুলে বললেন, বসার ঘরে কে বসে আছে?
আমি বললাম, অনুমান করো কে?
রবি ঠাকুর নাকি?
হুঁ।
বলিস কী? উনি মারা গেছেন না?
তার ক্লোন। বিজ্ঞানের আবিষ্কার।
বলিস কী? উনার ক্লোন হয়েছে? জানতাম না তো; একটা ভেড়ার ক্লোন হয়েছে জানি, নাম ডলি।
নিজের চোখেই তো দেখলে। পত্রিকা পড়ো না, জানবে কীভাবে? আজকের পত্রিকা পড়েছ? শুরুদেব সম্পর্কে নিউজ থাকার কথা।
খালা বললেন, আমার তো মনে হয় ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক। কেউ রবি ঠাকুর সেজেছে।
আমি বললাম, তুমি জীবনে কখনো ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইকে কাউকে রবি ঠাকুর সাজতে দেখেছি? মূর্তি সাজে, মুক্তিযোদ্ধা সাজে। চুড়িওয়ালা, বাদামওয়ালা সাজে। রবীন্দ্ৰনাথ সাজে না।
খালা ফাঁপরে পড়ে গেলেন। আমি বললাম, চা-নাশতার ব্যবস্থা করো খালা। বিখ্যাত মানুষ। চিরতার পানি আছে?
চিরতার পানি দিয়ে কী হবে?
রবি ঠাকুর সকালে নাশতার আগে এক গ্লাস চিরতার পানি খেতেন। ইনিও খান। তবে এক গ্রাস খান না। এক চামচ।
চিরতার পানি এখন কোথায় পাব?
তিতা করলা চিপে রস বের করে এক চামচ দাও। এতেই হবে।
নাশতা কী দেব?
গোশত-পরোটা, ডিমের ওমলেট।
উনি কি গরুর মাংস খান?
অবশ্যই। গরুই এখন উনার প্রধান খাদ্য।
তুই কি কাউকে রবি ঠাকুর সাজিয়ে নিয়ে এসেছিস?
এই কাজটা আমি কেন করব? আমার স্বাৰ্থ কী?
সেটাও একটা কথা।
খালা চিন্তিত মুখে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খালু সাহেবের ঘরে আমার ডাক পড়ল। খালু সাহেব খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখমুখ কঠিন। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। এটা নতুন কিছু না। সবসময় এরকমই থাকে। শুধু যখন কঠিন ডায়েরিয়া হয় তখনই তাঁর চোখমুখ স্বাভাবিক দেখায়। মনে হচ্ছে আজ তিনি ডায়েরিয়ামুক্ত। খালু সাহেবের সামনে একটা ইংরেজি খবরের কাগজ। যেসব বঙ্গভাষী ইংরেজি খবরের কাগজ পড়েন তাদের জাত আলাদা। আমি খালু সাহেবের বাঁ-পাশে রাখা সাইড টেবিলে বসতে বসতে বললাম, কেমন আছেন। খালু সাহেব? ওরস্যালাইন চলছে নাকি চলছে না?
তিনি আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, চেয়ারে বসো। সাইড টেবিল বসার জন্যে না। আর শোনো, ডোন্ট ট্রাই টু বি ফানি। তুমি চার্লি চ্যাপলিন না।