হিমু বলল, কিসলু। চা দুকাপ বানাবে! বাইরে আঙুলকাটা জগলু আছে। উনাকে এক কাপ চা দিবে।
আঙুলকাটা জগলুর কাছে। এ না জেলে আছে?
হিমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জেলে নকল জগলু। আসলটা বাইরে। তুমি চা নিয়ে যাও। দেখলেই চিনবে। আমি দোতলায় যাচ্ছি। কংকন ভাইকে দোতলায় পাঠাও। তার সঙ্গে আমার প্রাইভেট কিছু কথা আছে।
হিমু এবং কংকন ভাই মুখোমুখি বসা। হিমুর হাতে চায়ের কাপ। কংকন ভাইয়ের হাতে পানির গ্লাস। গ্লাসে কয়েক টুকরা বরফ। পানিতে ভদকা নামক ওষুধ খানিকটা দেওয়া হয়েছে। এই ওষুধ ভয় কমাতে সাহায্য করে। ওষুধের দুটা বোতল কংকন ভাইয়ের প্রাইভেট আলমারিতে সবসময় থাকে।
হিমু বলল, ভয় পেয়েছেন?
কংকন জবাব দিল না। হিমু বলল, আমাকে শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। আমি নির্বিষ। তের লাখ টাকা চাঁদার কথা যা বলেছি সেটাও ভুয়া। আপনাকে চাঁদা জোগাড় করতে হবে না।
কংকন ভাইয়ের ফ্যাকশে মুখে কিছু রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে। ফ্যাকাশেভাব কিছুটা দূর হয়েছে। তিনি ঘনঘন গ্লাসে কয়েকটা চুমুক দিলেন। হিমু বলল, চাঁদা না দিলেও তের তারিখ এই বাড়িটা ছেড়ে দেবেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা অন্য কোথাও করবেন। ভালো কথা, আপনি ছাত্রলীগ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হলেন তখন কিন্তু আপনার ছাত্রলীগ টু শব্দ করে নাই। মিটিং মিছিল দূরের কথা।
সেই সময়ের ছাত্রলীগ কী করছে তার দায়িত্ব তো আমাদের না।
হিমু বলল, আচ্ছা এই সময়ের ছাত্রলীগের কথাই হোক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে অ্যারেক্ট করে জেলে ঢোকানো হলো। তখনো কিন্তু আপনারী টু শব্দ করেন নি। মিটিং না, মিছিল না। আজ অন্যের বাড়ি দখল করে গবেষণা কেন্দ্র খুলে বসেছেন।
ওষুধে কাজ দিয়েছে। হারানো সাহস ফিরে আসছে। কংকন খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, আপনি কি ভেবেছেন এত সহজে পার পেয়ে যাবেন? না। আমি এর শোধ যদি না নেই। আমার নাম কংকন না। আমার স্ত্রীর নাম সুমনা না।
হিমু নামের মানুষটা হাসছে। এই লোকটা হাসছে কেন? তার হাসির কী আছে? হাসির শব্দ শুনে কংকনের আবার ভয় লাগতে শুরু করেছে। কংকন বড় করে গ্লাসে চুমুক দিল। সে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে।
হিমু বলল, যে অন্যকে ভয় দেখায় সে নিজে সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকে। ভয়ে আপনার কলিজা শুকিয়ে গেছে। ভয়ের প্রধান কারণ হলো, আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না। মানুষ ভূতপ্রেত বুঝে না বলে ভূতপ্রেত ভয় পায়। মৃত্যুকে বুঝতে পারে না বলে মৃত্যু ভয় পায়। আপনি আমাকে এই কারণেই ভয় পাচ্ছেন। আমি এখন চলে যাব। ভাই, ভয়টা দূর করেন। কাউকে ভয় দেখাতে আমার ভালো লাগে না । এরপরেও কেন যে মাঝে মাঝে ভয় দেখাই!
এই বাড়ি বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের জন্যে ছামাদ দান করেছে। আমার কাছে দলিল আছে। আমার নামে দলিল ।
আপনি আবার ছামাদের নামে দলিল করে দিবেন। ছামাদ বেচারার নিজের বাড়ি থাকতে ফুটপাতে ঘুমায়।
সেটা আমার দেখার বিষয় না। বাড়ি লিখে দেওয়ার সময় মনে ছিল না?
হিমু উঠে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, ভাই আমি যাচ্ছি। সুমনা ভাবিকে আমার সালাম দিবেন।
হিমুকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল কিসলু। কিসলু গলা নামিয়ে বলল, আপনি বললেন আঙুলকাটা জগলুর কথা। আমি চা নিয়ে দেখি কেউ নাই। তখনই বুঝলাম ঘটনা আছে। হিমু ভাই, ঘটনা কী? আঙুলকাটা জগলুকি ছিল?
না।
তার কথা কী জন্যে বলেছেন?
কংকনকে ভয় দেখানোর জন্যে বলেছি।
কংকন ভাই ভয় খাওয়ার জিনিস না, তয় আপনারে বিরাট ভয় পাইছে। অবশ্য আপনারে তো ভয় পাইতেই হবে।
হিমু বলল, কিসলু যাই?
কিসলু বলল, চলেন একটা চায়ের দোকানে বসি। আপনার সঙ্গে এক কাপ চা খাই। আপনার মুখ থেকে দুটা ভালো কথা শুনি। চারদিকে মন্দ কথা শুনি, দুষ্ট কথা শুনি। দুটা ভালো কথা শুনতে মন চায়।
রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চি পাতা। হিমু এবং কিসলু বসেছে। হিমু হাসিতে হাসতে বলল, ভালো কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত?
কিসলু বলল, জি হিমু ভাই।
হিমু বলল, একজন সাধুর গল্প শোনো। সাধুর নাম ঋষি কাশ্যপ। তার কাছে ভয়ঙ্কর এক খুনি এসেছে। সে সাধুর কাছে দীক্ষা নিতে চায়।
সাধু বললেন, তুমি অতি ভয়ঙ্কর মানুষ। তারপরেও তোমাকে আমি দীক্ষা দিব। একটা শর্ত আছে। আজ সন্ধ্যার মধ্যে তোমাকে যে-কোনো একটা ভালো কাজ করতে হবে।
কী রকম ভালো কাজ সাধুজি?
যে-কোনো ভালো কাজ। যত তুচ্ছই হোক ভালো কাজ হলেই হবে। একটা ভালো কাজ করে আমার কাছে আসবে, আমি তোমাকে দীক্ষা দিব।
ভয়ঙ্কর মানুষ ভালো কাজের সন্ধানে বের হলো। একটা কুকুরের সঙ্গে তার দেখা। কুকুরটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যাচ্ছে, কারণ তাঁর একটা ঠ্যাং নেই। পিঠে ঘা। ভয়ঙ্কর মানুষটার মনে হলো কুকুরটা কষ্ট পাচ্ছে। তার কষ্ট লাঘব হওয়া দরকার। সে থান ইট দিয়ে কুকুরের মাথায় বাড়ি দিয়ে তাকে মেরে ফেলে সাধুর কাছে উপস্থিত হয়ে ভালো কাজটা কী করেছে তা বলল। বিস্তারিত বলল। সে ভালো কাজ করতে পারায় আনন্দিত।
সাধুজি বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। স্নান করে আসো, তোমাকে দীক্ষা দেব।
কিসলু বলল, এটা কী করে সম্ভব? ঐ লোক তো ভয়ঙ্কর মন্দ কাজ করেছে। ভালো কাজ তো করে নাই।
হিমু বলল, যে ভালো কাজ করতে পারে তার দীক্ষার প্রয়োজন নাই। যে ভালো কাজ করতে পারে না তারই দীক্ষার প্রয়োজন।