মিস রিনকি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, পানি খাব। আশেপাশে কেউ নেই। ওসি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কত বদমাইশকে নিজের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছেন, আর ইনি সম্মানী মহিলা। অপূর্ব অভিনয়।
মিস রিনকি পানির গ্লাস হাতে নিলেন। ছোট্ট চুমুক দিলেন। জিভ ভেজানোর মতো কয়েক ফোঁটা পানি মুখে নিলেন। অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। নায়িকারা নায়ক ছাড়া অন্য কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। ওসি সাহেব বললেন, আপনার চুড়ি কেনার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
ও আচ্ছা।
কেন মুগ্ধ হয়েছি বলব? যদি বিরক্ত না হন, অল্পকথায় বলি।
মিস রিনকি হ্যাঁ না কিছু বলল না। পানির গ্লাসে আরেকবার ছোট্ট চুমুক দিল। ওসি সাহেব বললেন, আপনি চুড়িওয়ালির সামনে বসলেন। হাত ভর্তি করে চুড়ি পরলেন। অনেক দরাদরি করলেন। দরে বনল না। মন খারাপ করে সব চুড়ি ফেরত দিলেন। হাত থেকে চুড়ি বের করার সময় দুটা চুড়ি ভেঙে গেল। আপনি ভাঙা চুড়ির দাম দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে এসে ভাঙা চুড়ি দুটা নিয়ে চলে গেলেন। অসাধারণ, অসাধারণ! আমার হাতে অস্কার পুরস্কার থাকলে আজই একটা পেয়ে যেতেন।
বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ওসি সাহেব বসলেন। রিনকি বলল, এখানে যা করেছি সব নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে করেছি। ডিরেক্টর শুধু বলেছে আপনি হাতে চুড়ি পরবেন। দাম না বনায় হাত থেকে চুড়ি খুলে দিয়ে চলে যাবেন। বাড়তি কাজ অর্থাৎ চুড়ি ভেঙে যাওয়া, ভাঙা চুড়ির টাকা দেওয়া এবং ভাঙা চুড়ি নিতে আবার আসা-সব আমি আমার চিন্তা থেকে করেছি।
আবারও বলছি, অসাধারণ।
আপনাকে ধন্যবাদ। আমার কপাল খারাপ, সব অগা মগা বগা ডাইরেক্টরের হাতে পড়ি।
এই ডাইরেক্টর কেমন? হিরন্ময় কারিগর। অগা মগা বগার মধ্যে কোন ক্লাসে পড়ে?
সে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বগা শ্রেণীর। বগার চেয়েও খারাপ, ছাগা বলতে পারেন।
ঠিকই বলেছেন, আসলেই ছগা। দুবারে এসএসসি পাশ করেছে। ইন্টারমিডিয়েটে আটকে গেছে। সেদিন এক পত্রিকায় ছাগার ইন্টারভ্যু ছাপা হয়েছে। ছাগা বলেছে সে অষ্ট্রেলিয়া থেকে সিনেমাটোগ্রাফির উপর ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। ডিগ্রি তো দূরের কথা, অস্ট্রেলিয়া কোথায় তা-ই ছগাটা জানে না।
তাকে চিনেন? আমার ছোট শ্যালক।
সরি, না জেনে অনেক কিছু বলেছি।
না জেনে কেন বলবেন! জেনেশুনেই বলেছেন। হাতি চেনে মাহুতকে, সাপ চেনে ওকপ্লাকে, নায়িকা চেনে ডিরেক্টরকে।
আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। আপনি কি অভিনয় করেন?
না, তবে আপনাকে দেখে অভিনয় করার ইচ্ছা হয়েছে। জানি পারব না। চা খবেন? চা দিতে বলব?
বলুন।
এখন কোন শট হবে?
বলতে পারছি না, ডিরেক্টর বলতে পারবেন।
নাজমুল হুদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দৃশ্য নেওয়াকে যে শট বলে তা-ই জানতাম না। পুলিশের লোক তো। আমার কাছে শট মানে গুলি করা।
আপনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে?
জি। ধানমণ্ডির থানার ওসি ছিলাম, এখন আমাকে ক্লোজ করা হয়েছে।
আপনার ছেলেমেয়ে কী?
বিয়ের দ্বিতীয় দিনে আমার স্ত্রী মারা যান, তারপর আর বিয়ে করি নাই। একদিকে ভালোই হয়েছে। পুলিশের চাকরিতে ঘরে ফিরতে ফিরতে কোনোদিন রাত দুটা বাজে, কোনোদিন তিনটা বাজে। রেহনুমা দ্বিতীয় দিনে মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
আপনার স্ত্রী বিয়ের দ্বিতীয় দিনে মারা গেছেন শুনে খুব খারাপ লাগল। আমার আসলেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
ওসি সাহেব বললেন, দ্বিতীয় দিনে মারা গেছে এটা মন খারাপ করার মতো কোনো ঘটনা না। সে ফাঁস নিয়ে মারা গেছে। অন্য জায়গায় প্রণয় ছিল। জোর করে বিয়ে দিয়েছে। কাজেই বিয়ের শাড়ি ফ্যানের সঙ্গে লাগিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েছে।
Oh God! আপনার এই স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তারপরেও আপনার যোগাযোগ আছে?
কেন থাকবে না? রেহনুমা মারা গেছে। তার বাবা-মা, ভাইবোন এরা তো বেঁচে আছে। রেহনুমারি ছোটভাই ছোটবোন দুজনই দুলাভাই বলতে পাগল।
মিস রিনকি ইতস্তত করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি ঘুষ খান?
খাওয়ার খুবই ইচ্ছা হয়। কিন্তু খাই না। সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম, ঘুষ না খাওয়ার পেছনে এটা একটা কারণ। সাহিত্যের সঙ্গে অভাব যায়, ঘুষ যায় না।
এই মাসের ১৩ তারিখ রাতে কি আপনার কাজ আছে?
চাকরি থাকলে কাজ থাকবে। না থাকলে ফ্রি। কেন বলুন তো?
১৩ তারিখ আমার জন্মদিন। আমি সবসময় চেষ্টা করি জন্মদিনের রাতে ১৩জন ভালো মানুষ আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আপনাকে আমি সিলেক্ট করলাম। আমার জন্মদিনে আপনার নিমন্ত্রণ।
আমি ভালো মানুষ?
প্রাথমিকভাবে সে রকমই মনে হচ্ছে।
জীবনে প্রথম কেউ আমাকে ভালো মানুষ বলল। যাই হোক, এখন বলুন আপনাকে নিয়ে ১৩, নাকি বাদ দিয়ে ১৩?
আমাকে নিয়ে ১৩।
যিশুখ্রিস্টের লাষ্ট সাপারের মতো?
হ্যাঁ।
১৩ জনের মধ্যে কতজন জোগাড় হয়েছে?
আমি তো আছিই। আমাকে ছাড়া আর মাত্র দুজন জোগাড় হয়েছে। একজন আপনি। অন্যজনকে আপনি চিনবেন না। তার প্রধান কাজ রাতে ঢাকা শহরের পথে পথে হাঁটা। তার ভালো নাম হিমালয়। ডাকনাম হিমু। অনেক দিন হয়ে গেল তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। আপনি পুলিশের লোক, আপনি কি তাকে ১৩ তারিখের আগে খুঁজে বের করতে পারবেন?
কী নাম বললেন?
হিমু।
নাজমুল হুদের কাছে নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। হিমু যে চোর-ডাকাত কেউ না এটা বোঝা যাচ্ছে। চোর-ডাকাতের নাম তার মনে থাকে। ভালো মানুষের নাম মনে থাকে না। তিনি নিশ্চিত মিস রিনকির নাম তার মনে থাকবে না। তবে মিস রিনকিকে নিয়ে দুলাইনের ছড়া বানালে নামটা মনে থাকবে। ভালো মানুষের নাম তিনি এইভাবে মনে রাখেন।