ভূষণ কাকার বয়স হয়েছে। প্রচুর টাকার মালিক। তবু কলকাতায় যায়নি কখনও। যাবার প্রয়োজনও হয়নি। কাকা বললে—মাথায় ঘোমটা-টোমটা কিছু নেই।
তারাপদ বললে–ঘোমটা দেবে কেন শুনি—কোন্ দুঃখে ভালো করে কি ছাই দেখতে পাচ্ছে কেউ তাদের—আমি রাস্তা থেকে দেখছি ঠিক যেন এই একটা য়্যাট্টুক কড়ে আঙুলের মতো–
ভূষণ কাকা বললো রে শুনেছি নাকি কলকাতায় আজকাল বিয়ে-অলা মেয়েরা সিঁদুর পরে না—ঘোমটা খুলে সোয়ামীর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে হাওয়া খেতে যায়, শ্বশুর-ভাসুরের সামনে সোয়ামীর সঙ্গে কথা বলে—
মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা কাকা-তারাপদ মাথা নাড়তে লাগলো।—তা হতে পারে না—আমি যে নিজের চোখে সমস্ত দেখে এলাম কাকা—ধরে না কেন সকালবেলা নামলাম তো ট্রেন থেকে—আর সন্ধ্যেবেলা আবার ট্রেন ধরলামকলকাতার কিছু দেখতে তো আর বাকি রাখিনি কাকা-রানাঘাট থেকে পাউরুটি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম—আর মাজদের রসগোল্লা-পেটটি পুরে তাই খেয়ে নিয়ে সব খুটে খুটে দেখলাম ঘোড়ার ট্রাম গাড়ি দেখলাম—কী জোরে যায় যে কাকা–সামনে আসতে দেখলে বুকটা দুর দুর করে ওঠে।
—কেন, বুক দুর দুর করে কেন?—জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ। জবাব দিয়েছিল ভূষণ কাকা। বলেছিল—তুই থাম তত ভূতে—বোকার মতো কথা বলিস নে–লোকে হাসবে।
ভূতনাথ সত্যি সত্যি আর কথা বলেনি। চুপ-চাপ শুনে গিয়েছিল।
তারাপদ বলেছিল-আমার একবার ইচ্ছে করে কাকা ভূতোকে দিই ছেড়ে গিয়ে কলকাতার রাস্তায়ও ঠিক হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলবে—দেখো–
ভূষণ কাকাও যেন বিজ্ঞের মতো জবাব দিয়েছিল—তা তো বটেই—এ কি আর ছিন্নাথপুরের গাজনের মেলা যে, রাত হয়ে গেলে ভাবনা নেই—কেষ্ট ময়রার দোকানের মাচায় দুটো চিড়ে মুড়কি চিবিয়ে শুয়ে পড়লাম।
মল্লিকদের বাড়ির তারাপদর কথায় সেই ছোটবেলা থেকেই কলকাতার নাম শুনলে যেন রোমাঞ্চ হতো ভূতনাথের। একদিন মিত্তিরদের ঢিপ-চালতে গাছটার মগডালে গিয়েও উঠেছিল ভূতনাথ। এর হাজার-ডবল উঁচু। সে যে কতখানি—তা অনুমান করা শক্ত। তবু অনেক অনেক দূরে চেয়ে চেয়ে দেখেছে সে। সোজা পশ্চিমদিকে চাইলে শুধু দেখা যায় কেবল গাছ আর গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাঠ। তারপর আকাশ। শুধু আকাশ আর আকাশ। আকাশময় চারিদিক। সন্ধ্যেবেলা বাদুড়গুলো ওদিক থেকে ফল-পাকড় খেতে একটার পর একটা উড়ে আসে। ওই শইরের দিক থেকে। মাজদে’ স্টেশনের চেয়েও অনেক দূরে—কত শহর—ফতেপুরের মতো কত গ্রাম পেরিয়ে তবে কলকাতা। সেখানে ঘোড়ার ট্রামগাড়ি চলে খুব জোরে-সামনে আসতে দেখলে বুক দুর দুর করে। (কেন করে তা বলা যায় না) মিত্তিরদের টিপু-চালতে গাছের হাজার-ডবল উচু সব বাড়ি। তার মাথায় লোক গুলো দেখায় এতটুকু কড়ে আঙুলের মতো।
এমতি ভাবতে ভাবতে গাছ থেকে একসময় নেমে পড়ে ভূতনাথ।
এর পর আর একদিনের ঘটনা। তখন অনেক বড় হয়েছে ভূতনাথ। ইস্কুলে এসে ভর্তি হলো গঞ্জের হাসপাতালের বড় ডাক্তারের ছেলে ননী। ভারি ফুটফুটে ছেলেটা। যেমন ফরসা, তেমনি কালো কালো চোখ, বড় বড় চুল। পরে অনেকবার ভূতনাথ ভেবেছে ননী যেন ছেলে নয়। অনেক ভাব হবার পরেও ননীর হাতে আচমকা হাত ঠেকে গেলে কেমন যেন শিউরে উঠতে ভূতনাথ। ইস্কুল থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসার পথে ননীর কথাই সারা রাস্তাটা ভাবতো। এক-এক সময় মনে হতো, ননী তার বোন হলে বেশ হতো। তাহলে দুজনে এক বাড়িতে থাকতো, শুতে এক বিছানায়। অনেক ছুটির দিন ভূতনাথ হেঁটে হেঁটে একা চলে গিয়েছে ইস্কুলের কাছে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে হাসপাতালের আশে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। ননীকে যদি একবার এক ফাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। আবার লজ্জাও হতে। যদি ননী তাকে সত্যি সত্যিই দেখে ফেলে। যদি ননী জিজ্ঞেস করে-কী রে ভূতনাথ, তুই এখানে কেন—তখন কী জবাব দেবে সে।
ননীকে তো বলা যায় না যে তাকে দেখতেই তার আসা। ভুল করে নিজের একটা বই কতদিন নীর বই-এর মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছে। তবু যদি সেই অছিলায় স্কুলের পরেও তারে সঙ্গে আবার কথা বলার সুযোগ হয়। সেই ননী কতোদিনই বা ছিল তাদের স্কুলে। তবু কত গল্প হতো। কত জায়গায় তার বাবা বদলি হয়েছে। কত স্কুলের গল্প—কত ছেলের গল্প।
সেই ননী একদিন চলে গেল। চলে গেল চিরকালের স্বপ্নের দেশ–কলকাতায়। যাবার আগের দিন কেমন যেন মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথর। ননীর বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় যাবে–
ননীর তাই আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু ভূতনাথ অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করেছিল-তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না ননী।
—কেন? কষ্ট হবে কেন?
কলকাতায় যাওয়াতে কষ্ট হওয়ার যে কী আছে তা ননীর মাথায় আসেনি। কিন্তু ভূতনাথের মনে হয়েছিল তার নিজের যেমন কষ্ট হচ্ছে—ননীর তেমন হলেই যেন ভালো হতো। কেন যে ননীর মনে কষ্ট হওয়া উচিত—তা ভূতনাথ লজ্জায় ব্যাখ্যা করে আর বলতে পারেনি। ভূতনাথের সে-দুঃখ সেদিন বুঝতে পারেনি ননী। না পারবারই কথা। কত দেশ সে দেখেছে। কত বড় লোক তারা। কতো ভূতনাথ তার জীবনে আসবে যাবে। মনে আছে ননীরা কলকাতায় চলে যাবার দিন খাটরোর বিলের ধারে শাড়া গাছটার তলায় বসে হাউহাউ করে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল সে।
কিন্তু একদিন ননীর চিঠি এল। খাস কলকাতা থেকে। জীবনে সেই তার প্রথম চিঠি পাওয়া। সেদিন সে-চিঠি পড়ে যে-আনন্দ ভূতনাথ পেয়েছিল—তা আর কোনদিন কোনও চিঠি পড়ে পায়নি। চিঠিখানা সে কতবার পড়েছে। বালিশের তলায় রেখে ঘুমিয়েছে দিনের পর দিন। চিঠিখানা জামার তলায় বুকের ওপর রেখেছে। যেন ননীর হাতটার স্পর্শ আছে ওই একটুকরো কাগজে। অথচ কী-ই বা লিখেছে ননী। বলতে গেলে কিছুই নয়। ননী লিখেছিল—