যদুর মা’র কানে যায় সব। কিন্তু সে কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। কিন্তু হঠাৎ গিরির কানে যেতেই বলে-কার সঙ্গে বক্ বক্ করছিস লা সদু—এবার হঠাৎ চুপ হয়ে যায় সৌদামিনী।
ভূতনাথ রেলিং ধরে ধরে এগুতে লাগলো। ভাঙা রেলিং-এর ফাঁকগুলো যেন উপপাসী জন্তুর মতো হাঁ করে আছে। এর পর ডাইনে বেঁকে, বাঁদিকে ঘুরে-এ-গলি সে-গলি পার হয়ে উত্তরদিকে। তিনচারটে ধাপ উঠে পড়বে বউদের মহল। আকাশ-সমান উচু কাঠের ঝিলিমিলি দিয়ে ঢাকা। আর তার সামনে দক্ষিণমুখখা সার-সার বউদের ঘর। ছোটবৌঠানের ঘর একেবারে শেষে। ডানদিকে প্রথমেই বড় বউ-এর ঘর। তিনি বিধবা। কোথা থেকে যে এ-বাড়ির সব বউরা এসেছিল! মেম-সায়েবদের মতো গায়ের রং। ফরসা দুধে-আলতার ছোপ। বড় বউ-এর বয়েস হয়েছে, তবু চেহারায় বয়েস ধরবার উপায় নেই। পরনে সাদা ধবধবে থান।
ভূতনাথকে দেখে সিন্ধু সরে দাঁড়ালো। বড় বউ-এর ঝি সিন্ধু।
ভেতর থেকে গলার আওয়াজ এল—ওখানে কে রে সিন্ধু।
ভূতনাথ শুনতে পেলে সিন্ধু বলছে—মাস্টারবাবুর শালা।
তারপরেই মেজগিন্নীর ঘর। পর্দাটা ভোলা। ভূতনাথের নজরে পড়লো এক পলক। মেজগিন্নী মেঝের ওপর বসে তাকিয়া হেলান দিয়ে গিরির সঙ্গে বাঘ-বন্দী খেলছেন। চোখ সরিয়ে নিয়ে ভূতনাথ একেবারে শেষ ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
পায়ের আওয়াজ পেতেই কে দরজা খুলে দিলে যেন। কত বছর আগের ঘটনা। তবু অতীতের মায়াঞ্জন যেন আজো চোখে লেগে আছে স্পষ্ট। ভূতনাথ যেন আজ স্মৃতির পাখীর পিঠে চড়ে বর্তমানের লোকালয় ছেড়ে অতীতের অরণ্যে ফিরে গিয়েছে।
ছোটবৌঠান দরজা খুলে ডাকলে—কে ভূতনাথ-আয়।
হঠাৎ দুটো হাত ধরে ফেলেছে পটেশ্বরী বৌঠান।একটা কাজ তোকে করতে হবে ভাই—বলে ছোটবৌঠান তার কালো কালো চোখ দুটো তুলে সোজা তাকালো ভূতনাথের মুখের ওপর।—সেইজন্যেই তোকে ডাকা।
–কী কাজ-বলো না–
—এই নে টাকা—বলে ভূতনাথের হাতের মুঠোর মধ্যে গুজে দিলো টাকাটা।
—কী আনবে এতে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—মদ—গলাটা নিচু করে ছোটবৌঠান বললে।
সত্যি চমকে উঠেছে ভূতনাথ। মদ? কানে ঠিক শুনেছে তো সে।
-হ্যাঁ মদ—
—এতো রাত্তিরে—
–হ্যাঁ যেখান থেকে পারিস যেমন করে পারিস—খুব ভালো মদ, খুব দামী। কিন্তু এততেও যেন স্বস্তি পেলে না ছোটবৌঠান। হঠাৎ কান থেকে হীরের কানফুলটা খুলে ভূতনাথের মুঠোর মধ্যে পুরে দিলে ছোটবৌঠান জোর করে। বললেও টাকাতে যদি না কুলোয় তো এটাও রেখে দে ভাই—
–এ কী করলে, এ কী করলে তুমি বৌঠান—চিৎকার করে উঠলে ভূতনাথ। চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছে গিরি, মেজগিন্নী, সিন্ধু আর বড় বউ। কী হলো? কী হলো রে ছোট বউ?
হঠাৎ যেন নিজের চিৎকারে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। ছোটবৌঠান নয়, ভূতনাথই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো যেন। বুড়ো বয়েসে এ কি করলে সে। কেউ তো কোথাও। নেই। সে তো আজ একলাই দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা বাড়িটার মাথায়। সে তো ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওভারসিয়ার ভূতনাথ : ভূতনাথ চক্রবর্তী। নিবাস—নদীয়া, গ্রাম—ফতেপুর, পোস্টাপিস—গাজনা। কোনও ভুল নেই। হীরের কানফুল আর টাকাটা আর একবার দেখবার জন্যে হাতের মুঠো খুলতেই ভূতনাথের নজরে পড়লোকই কিছু তো নেই, শুধু সাইকেলের চাবিটা রয়েছে মুঠোর মধ্যে। হঠাৎ কেমন যেন ভয় হতে লাগলো ভূতনাথের। এ অভিশপ্ত বাড়ি। ভালোই হয়েছে এর ধ্বংস হচ্ছে। এই এত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো তার। কেউ কোথাও নেই। বিষাক্ত বাড়ির আবহাওয়া ছেড়ে সে যতো শিল্পীর বেরিয়ে যেতে পারে ততই মঙ্গল। কালই চরিত্র মণ্ডল এখানে এসে গাঁইতি বসাবে। বনমালী সরকার লেন-এর স্মৃতির সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের ইতিহাসও বিলুপ্ত হয়ে যাবে একেবারে। তাই যাক। তাই যাক। তাই ভালো।
অন্দরমহল, রান্নাবাড়ি, বারবাড়ি, বৈঠকখানা, দপ্তরখানা, দেউড়ি সব পেরিয়ে ভূতনাথ একেবারে সাইকেলটা নিয়ে উঠতে যাবে—এমন সময় কাপড় ধরে কে যেন টানলে—ভয়ার্ত একটা চিৎকার করতে যাচ্ছিলো ভূতনাথ। কিন্তু ভালো করে চেয়ে দেখতেই একটা লাথি ছুড়লো—দূর–দূর হবেরো—সেই কুকুরটা! অনেকদিন আগে আর এক দিন এমনি করে এ-বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় যে বাধা দিয়েছিল সে ছোটবৌঠান। আর আজ বাধা দিলে এই কুকুরটা।
সাইকেল চড়ে অন্ধকার বনমালী সরকার লেন দিয়ে চলতে চলতে ভূতনাথের মনে হলো অর সমস্ত অতীতটা যেন ওই কুকুরের মতো তাকে আজ কেবল পেছু টান দিতে চেষ্টা। করছে। ওই কুকুরটার মতোই তার অতীত কালো, বিকলাঙ্গ, মৃতপ্রায় আর অস্পষ্ট।
ভূতনাথের সাইকেলের চাকার ঘূর্ণায়িত তরঙ্গে ক্রমে ক্রমে উদ্বেলিত হতে লাগলো তার বিস্মৃত প্রায় কাহিনী-মুখর অতীত।
০১. কাহিনী
ফতেপুর গ্রাম থেকে তিন ক্রোশ পথ হেঁটে তবে মাজদিয়া ইস্টিশান। সেই ইস্টিশানে ট্রেন ধরে একদিন এসেছিল ভূতনাথ এই কলকাতায়।
শেয়ালদা ইস্টিশানের চেহারা, লোকজন, চিৎকার আর বাইরের দৃশ্য দেখে হা হয়ে গেল ভূতনাথ। কোথায় এসে পড়েছে সে। কুলিদের টানাটানি বাঁচিয়ে কোনওরকমে বাইরে এসে দাঁড়ালো। দুটো টাকা ছিল পকেটে–সে দুটো পুরে নিলো ট্যাঁকে। ব্ৰজরাখাল বলেছিল—খুব সাবধান, পকেটে টাকাকড়ি থাকলে সে আর দেখতে হবে না-কলকাতা শহর তোমার ফতেপুর নয় যে…
কলকাতা শহর যে ফতেপুর নয় তা ভূতনাথ জানতো। মল্লিকদের তারাপদ সেবার বারোয়ারি পার্টির যাত্রার নাটকের বই কিনতে এসেছিল কলকাতায়। ‘হরিশ্চন্দ্র’ পালার বই। তার কাছেই শোনা। বললে—ওই যে দেখছে মিত্তিরদের ঢিপ-চালতে গাছ—ওই টিপ-চালতে গাছের হাজার-ডবল উঁচু সব বাড়ি, বুঝলে কাকা—সেই উঁচু বাড়ির মাথায় দেখি না মেয়েমানুষরা দিব্যি আরামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে—